প্রিয়ম সরকার
কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তের নামকরা এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল—সাউথ সিটি মডার্ন হাই—সেই শুক্রবার দুপুরে যেন কিছুক্ষণ নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় পিরিয়ডের গণিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর হঠাৎই হইচই শুরু হয়, যখন ছাত্রী রুদ্রানী ঘোষের দেহ পাওয়া যায় পুরনো লাইব্রেরির সিঁড়ির পাশে পড়ে থাকতে। তার চোখদুটি খোলা, ঠোঁট রক্তাক্ত, আর পাশে ছড়িয়ে আছে তার জ্যামিতি বক্স—যেন কোনও শেষ মুহূর্তের আঁচড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সব। হেডমাস্টার বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন—“আত্মহত্যা, ক্লাসের চাপ নিতে পারেনি,” এবং পুলিশকে ফোন করলেও মৃদু স্বরে অনুরোধ করেন বিষয়টি মিডিয়াতে না পৌঁছাতে। ছাত্রছাত্রীরা কাঁদছে, শিক্ষিকারা অস্বস্তিতে—কিন্তু একজন শিক্ষক, অভিজিৎ সেন, ওই সময় কিছু না বলেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যান রুদ্রানীর পরীক্ষার খাতা হাতে নিতে। তাঁর চোখ সোজা চলে যায় শেষ পাতায়, যেখানে এক অদ্ভুত জ্যামিতিক চিত্র আঁকা ছিল—একটা অসম্পূর্ণ ত্রিভুজ, একটি ঘূর্ণায়মান রেখা আর কিছু কৌণিক নির্দেশনা, যেগুলো পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে মোটেও মেলে না। তিনি সেটা লক্ষ করে থেমে যান। বাকিরা যখন কান্না, উৎকণ্ঠা আর ফিসফাসে ব্যস্ত, তখন অভিজিৎ বুঝতে পারেন—এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, এবং সম্ভবত রুদ্রানী কিছু বলতে চেয়েছিল… একমাত্র ভাষায় যা সে জানত—গণিতের ভাষায়।
পরদিন শনিবার স্কুল বন্ধ। অভিজিৎ রাতভর ঘুমাতে পারেন না। চায়ের কাপ নিয়ে তিনি নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাটের ডেস্কে বসে রুদ্রানীর শেষ খাতার পাতাটি আলোকের নিচে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। অঙ্কের সেই জ্যামিতিক চিত্র দেখতে সরল মনে হলেও, তার প্রতিটি রেখা ছিল সূক্ষ্মভাবে সাজানো, যেন একটি সংকেত। একটি অসম্পূর্ণ ত্রিভুজ, একটির বাহু ৯০ ডিগ্রির কোণে, আর এক কোণে লেখা ছিল “XII B”, সাথে কিছু ইংরেজি অক্ষর—D, 17—আরেকটা জায়গায় ছিল একটি রাশিমালা: 3, 7, 15, 31… যা একটি দ্বিগুণ-১ সিরিজের ইঙ্গিত দেয়। এমন অদ্ভুত সাজানো সংখ্যা ও চিহ্নের পেছনে ছাত্রী কেন এমনভাবে সময় ব্যয় করবে? কেনই বা মৃত্যু ঘটার আগে ঠিক এই রকম কিছু আঁকবে? একজন সাধারণ ছাত্রীর পক্ষে এটা হতো না—কিন্তু রুদ্রানী ছিল ভিন্ন। অভিজিৎ মনে করতে পারেন, সে তার ক্লাসের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ অথচ অদ্ভুত রকম প্রতিভাবান ছাত্রী ছিল—অঙ্কের প্রতিটি ক্লাসে তার চোখ থাকত গভীর, প্রশ্ন করত যেখানে কেউ সাহস করত না। তিনি একটা সময় তার অঙ্কের খাতা থেকে বুঝেছিলেন, মেয়েটি নিছক পড়ুয়া নয়—সে গণিতকে অনুভব করতে জানত। কিন্তু এখন, সেই খাতাই যেন হয়ে উঠেছে তার শেষ আর্তি। অভিজিৎ মনস্থির করেন—এটা ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি স্কুলে ফিরে যাবেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখার চেষ্টা করবেন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জানার চেষ্টা করবেন কে বা কারা এই অঙ্কের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সত্যকে ভয় পেয়েছিল।
সোমবার সকাল। স্কুল আবার খুলেছে, কিন্তু চারপাশে থমথমে পরিবেশ। ক্লাসরুমে রুদ্রানীর বেঞ্চটা খালি, আর টিচার্স রুমে চাপা গুঞ্জন চলছে। হেডমাস্টার বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় সবার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, “আমরা আমাদের একজন ছাত্রীকে হারিয়েছি, এবং পুলিশ জানিয়েছে এটি একটি আত্মহত্যা। অতএব, দয়া করে সবাই শান্ত থাকুন এবং স্বাভাবিক পঠনপাঠনে ফিরে যান।” কিন্তু অভিজিৎ তখনই লক্ষ্য করেন, কিছু শিক্ষক চোখ নামিয়ে রেখেছেন, কেউ কেউ মুখ লুকিয়ে চলে যাচ্ছেন—যেন কিছু গোপন আছে যেটা তারা প্রকাশ করতে পারছেন না। সেই সময় ইংরেজি শিক্ষিকা ইরিনা সরকার অভিজিৎকে একপাশে ডেকে বলেন, “আপনি রুদ্রানীর খাতা দেখেছেন? সে আমার কাছেও একদিন কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু ভয় পাচ্ছিল।” অভিজিৎ শুধু মাথা নেড়ে বলেন, “আমি ওর খাতায় একটা সংকেত পেয়েছি। সেটা খুনের ভাষা হতে পারে।” ইরিনা চমকে যান, কিন্তু কিছু বলেন না। ঠিক তখনই অভিজিৎ তার কণ্ঠে শপথ করেন—এই মৃত্যুকে অঙ্কের চাপে ঘটানো এক ‘দুর্ভাগ্য’ বলে মেনে নেবেন না। এই মৃত্যুর পেছনে লুকিয়ে আছে একটা ধাঁধা, এক নির্মম প্যাটার্ন—যার নাম, হয়তো, রক্তের জ্যামিতি।
–
সোমবার দুপুর। গরমে ভরা কলকাতার বাতাস যেন স্কুলের দেওয়ালের ভেতরেও এসে ঘামিয়ে তুলেছে সবাইকে। টীচার’স লাউঞ্জে গুনগুন শব্দ পর্যন্ত নেই। চায়ের কাপে শব্দ হয়, কিন্তু কথাবার্তা নেই বললেই চলে। অভিজিৎ সেন চুপ করে বসে, চারপাশের মুখগুলোর অভিব্যক্তি পড়ার চেষ্টা করছিলেন। ইংরেজি শিক্ষিকা ইরিনা সরকার একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলেন। হেডমাস্টার বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় বারবার ঘড়ি দেখছেন, যেন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন—কিন্তু তারপর চুপচাপ উঠে চলে যান। এই পরিবেশটা অস্বাভাবিক, এবং একান্তভাবে চাপা দেওয়া হচ্ছে কিছু একটা। অভিজিৎ বুঝে যান, সবাই জানে রুদ্রানীর মৃত্যু “আত্মহত্যা” নয়, কিন্তু কেউ কথা বলছে না। তিনি আচমকা বলে ওঠেন, “রুদ্রানীর খাতার শেষ পাতায় একটা অঙ্ক ছিল—যেটা পরীক্ষার প্রশ্নের অংশ ছিল না। তাতে ত্রিভুজ ছিল, কোণ ছিল, কিন্তু সবকিছু যেন ইচ্ছাকৃতভাবে অগোছালো। কেউ এটা লক্ষ্য করেছেন?” কেউ জবাব দেয় না। শুধু ইতিহাসের শিক্ষক অসিত সান্যাল নিচু গলায় বলেন, “ও তো এমনিতেই খুব চাপ নিয়ে চলত… হয়তো অঙ্কেই বারবার ফেল হচ্ছিল।” অভিজিৎ মুখ ঘুরিয়ে বলেন, “ওর প্র্যাকটিস খাতায় তো দেখেছি, ইন্টিগ্রেশন করত গানের ছন্দে… যে মেয়ে অঙ্ককে ভালোবাসত, সে পরীক্ষা খারাপ করে আত্মহত্যা করবে না।” কথাটি বলা মাত্রই ইরিনা লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে যান—অভিজিৎ লক্ষ করেন, তার চোখে পানি ঝলমল করছে। কিছু একটা আছে, এবং সেটা ভয় থেকে আসা, দোষের থেকে নয়।
টিফিনের সময় ইরিনা অভিজিৎকে লাইব্রেরির পুরনো অংশে ডেকে নিয়ে বলেন, “রুদ্রানী একটা ডায়েরি লিখত। ও মাঝে মাঝে আমাকে দেখাত, কিন্তু সবটা নয়। একদিন বলেছিল, ‘ম্যাম, আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে কেউ যেন আমার খাতা পড়ে।’ আমি ভেবেছিলাম ও একটু বেশি নাটক করছে, কিন্তু এখন… আমি বুঝতে পারছি, সে কিছু জানত। কাউকে ভয় পেত।” তিনি ব্যাগ থেকে একটা নীল মলাটের পুরনো খাতা বের করে দেন। অভিজিৎ সেটি খুলে দেখেন, প্রথম কয়েকটি পাতায় ব্যক্তিগত লেখা, কিছু কবিতা, তারপর কিছু অদ্ভুত মন্তব্য: “ও বলে, আমি অঙ্কে ভালো বলেই আমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে… ও বলে, কিছু বুঝলে কাউকে বললে, আমার বাবা-মাকেও…”—সেই জায়গাটা কেটে দেওয়া। ঠিক তারপরের পাতাটি ছেঁড়া। অভিজিৎ পাতা উল্টে দেখে খাতা পেছনের দিকে কিছু চিত্র আঁকা আছে, ঠিক সেই রকম জ্যামিতিক প্যাটার্ন, যা রুদ্রানীর খাতায় ছিল। তিনি উপলব্ধি করেন, খাতার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে—প্রতিটি আঁকায় কিছু শব্দ লেখা আছে মাঝখানে বা কোণের দিকে, যেমন “XII B”, “17”, “D”। তিনি ভাবেন, এগুলো কি কোনো ক্লাসরুম, রোল নম্বর, নাকি স্কুলের কোনো অভ্যন্তরীণ সংকেত? তিনি খাতাটা ব্যাগে ভরে বলেন, “এই খাতা কাউকে বলবেন না। আমি কয়েকটা ছবি তুলে রাখছি। আপনি যদি আর কিছু জানেন… কিছুই, দয়া করে বলুন।” ইরিনা মাথা নিচু করে বলেন, “আমি শুধু এটুকু জানি—রুদ্রানী কাউকে ভয় পেত। হয়তো স্কুলেই ছিল সেই ছায়া।”
সন্ধেবেলা, অভিজিৎ একা নিজের ঘরে বসে খাতার প্রতিটি চিত্র নিয়ে কাজ করতে থাকেন। তিনি খেয়াল করেন, প্রতিটি প্যাটার্নে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে—১৭, ৩১, ৬৩—সবই দ্বিগুণ সংখ্যা মাইনাস এক। গণিতে যাকে বলে “2ⁿ – 1” প্যাটার্ন। এই প্যাটার্ন ইঙ্গিত দেয় পরিকল্পনার সূক্ষ্মতা। এভাবে কেউ শুধু অঙ্কের খাতায় ছবি আঁকে না। তখনই তিনি কাগজে অঙ্ক কষে বোঝেন, সংখ্যাগুলো দিয়ে স্কুলের ছাত্রদের রোল নম্বর মিলতে পারে। তার ধারণা হয়, “D” মানে হতে পারে Division D, “XII B” হলো ক্লাস, আর “17” একজন ছাত্র। সেই ছাত্র কি রুদ্রানীর ক্লাসমেট ছিল? না কি সিনিয়র কেউ? তার মাথায় ঘুরতে থাকে সেই প্রশ্ন—যদি এই অঙ্ক ছিল খুনের সংকেত, তাহলে খুনি কি চিহ্ন রেখে গেছে? নাকি এটা রুদ্রানীর শেষ চেষ্টা ছিল নিজের মৃত্যুর দায়ীর দিক নির্দেশ করার? তিনি নিজের হাত দিয়ে আঁকা এক ত্রিভুজের কোণে তিনটি নাম লেখেন: “XII-B”, “D-17”, “Counsellor?”. এরপর এক টান দিয়ে ত্রিভুজটি ঘিরে দেন লাল কালি দিয়ে। নিজেই বলেন, “এই জ্যামিতি শুধু অঙ্ক নয়, এই হল রক্তের জ্যামিতি।” আর ঠিক সেই সময়, ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে আসে একটা ছোট্ট মেসেজ: “অঙ্ক বুঝে ফেলেছেন তো, স্যার?”
–
অভিজিৎ সেন মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে থাকা সেই বার্তাটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন—“অঙ্ক বুঝে ফেলেছেন তো, স্যার?”—অজানা নম্বর, কোনও নাম নেই, শুধু এক ধরণের ঠান্ডা বিদ্রুপের সুর যেন লুকিয়ে আছে বাক্যটার ভিতরে। তিনি নম্বরটি ট্রেস করতে পারেন না, এবং রিপ্লাই দিলে তা “অ্যাক্টিভ ইউজার নয়” বলে ফিরে আসে। এই চুপচাপ হুমকি তাকে কাঁপিয়ে না দিলেও মাথার ভিতর বুলেটের মতো ঢুকে পড়ে। কে জানে সে রুদ্রানীর খাতার রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করছে? কেউ তো দেখেই ফেলেছে। এবং এও বোঝা যাচ্ছে, সে ব্যক্তি এখনই সরাসরি বাধা দিতে চায় না, কিন্তু তার উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে। অভিজিৎ ডায়েরির আঁকা আর পরীক্ষা খাতার প্যাটার্ন একসঙ্গে বসিয়ে একটা অদ্ভুত জ্যামিতিক কাঠামো তৈরি করেন—ত্রিভুজ, বৃত্ত, কোণ আর কিছু অলিখিত সংখ্যা দিয়ে যেন এক ‘ছক’ তৈরি হয়। এবং তিনি খেয়াল করেন, এই আঁকার ভিতর এমনভাবে সাজানো কিছু রেখা রয়েছে, যা সোজা গিয়ে মিলছে স্কুলের পুরনো লাইব্রেরি ও পরীক্ষার হলে বসানো আসন বিন্যাসের সঙ্গে। লাইব্রেরির ভিতর এক কোণে, ঠিক যেখান থেকে রুদ্রানীর দেহ উদ্ধার হয়েছিল, সেই অংশই আঁকার মধ্যে নির্দেশিত। তাহলে রুদ্রানী কি নিজের মৃত্যুর জায়গাটিই অঙ্কে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল? নাকি তাকে বাধ্য করা হয়েছিল সেখানে পৌঁছতে? তিনি খাতার কোণায় লেখা একটি বাক্য খুঁজে পান—“সব রেখা এক জায়গায় কেটে যায়”—যা সাধারণ জ্যামিতির কথা হলেও এখন তার কাছে মৃত্যুর পূর্বাভাস মনে হয়।
পরদিন সকালে, অভিজিৎ স্কুলে পৌঁছে সরাসরি যান স্কুল কাউন্সেলর অর্ণব বসুর ঘরে। অর্ণব সম্প্রতি নিযুক্ত হয়েছেন, বয়স কম, স্মার্ট, আর ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয়। প্রথম দিকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলেন, কিন্তু অভিজিৎ প্রশ্ন করেন, “রুদ্রানী আপনাকে শেষ সময় দেখা করেছিল?” অর্ণব কিছুটা থমকে গিয়ে বলেন, “হ্যাঁ… বলেছিল, কারও থেকে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু বলেনি।” অভিজিৎ জিজ্ঞেস করেন, “সে কি কাউকে ভয় পেত?” অর্ণব চুপ করে বলেন, “সে শুধু বলেছিল—ওর খাতার শেষ পাতায় সব লেখা আছে। আমি ভেবেছিলাম কবিতা জাতীয় কিছু। বুঝিনি এত গভীর কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে।” অভিজিৎ ফোন থেকে সেই প্যাটার্নের একটা ছবি দেখান এবং বলেন, “এই অঙ্কের মাঝে বারবার ‘XII-B’, ‘D’, ‘17’, ‘Counsellor’—এই শব্দগুলো এসেছে। আপনি কি জানেন এই রোল নম্বর কার?” অর্ণব একটু দ্বিধা করে বলেন, “রোল নম্বর ১৭… ক্লাস টুয়েলভ, সেকশন বি… ওই ছেলেটার নাম অর্ণব চৌধুরী। মেধাবী, তবে খুব প্রাইভেট টাইপ। ওর সঙ্গে রুদ্রানীর কথাবার্তার কিছু খবর শুনেছিলাম, তবে ঠিক কী জানি না।” অভিজিৎ তাঁর খাতায় সেই নামটা লেখেন। একই নাম—অর্ণব—কিন্তু দুই ব্যক্তি। এটা কি কাকতালীয়? না কি এর পেছনেও লুকিয়ে আছে আরেকটি সমান্তরাল রেখা?
স্কুল ছুটির পর অভিজিৎ যান লাইব্রেরির পুরনো অংশে, যেখানে রুদ্রানীর দেহ পাওয়া গিয়েছিল। তিনি সেই জায়গা ঘিরে কয়েকটি কাগজে আঁকা রেখা বসান, মিলিয়ে দেখেন রুদ্রানীর আঁকা চিত্রের সঙ্গে। অবিকল মিলে যায়! ঠিক সেই কোণেই দাঁড়িয়ে গেলে, বাইরে বড় জানালা দিয়ে স্কুলের বাইরের গেট দেখা যায়—যেটা সাধারণত বন্ধ থাকে। তিনি অনুভব করেন, রুদ্রানী হয়তো সেখানে অপেক্ষা করছিল কোনও সংকেতের জন্য, কিংবা কাউকে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তিনি একসাথে সব মিলিয়ে ভাবতে থাকেন—এক মেধাবী মেয়ে, যাকে কেউ বুঝতে চায়নি, যার খাতায় লেখা শেষ অঙ্ক হয়ে উঠেছে মৃত্যুর ভাষা। তিনি জানেন, সময় বেশি নেই। খুনি হয়তো ভাবছে, একজন গণিত শিক্ষক এসব অঙ্ক বুঝবে না। কিন্তু অভিজিৎ বলেই ওঠেন নিঃস্বরে, “তুমি ভুল করেছ, আমি অঙ্কে শুধু নম্বর খুঁজি না—আমি ভাষা পড়ি।” সেই রাতে আবার আসে একটি নতুন বার্তা—“রেখাগুলোর শেষ আছে। প্রশ্ন হল, আপনি সেখানেই থামবেন তো?” অভিজিৎ বুঝতে পারেন, এই খেলা এখন শুরু হয়েছে—এবং তার প্রতিপক্ষ অঙ্ক জানে, কিন্তু নীতি জানে না।
–
স্কুলের করিডোর যেন আজ আরও নিরব। বেলা পড়ে আসছে, তবু হেডমাস্টারের ঘরের বাইরে কেউ নেই, খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে পড়ন্ত রোদের ক্লান্ত আলো। অভিজিৎ ধীরে পা ফেলে হেডমাস্টার শঙ্কর মিত্রর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজা অর্ধেক খোলা। নক করার আগেই ভেতর থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল, “হ্যাঁ, আসুন।” ভেতরে প্রবেশ করতেই শঙ্করবাবুর কড়া মুখ, একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে আজ। “আপনি আবার কী একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়েছেন? পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের জন্য?” অভিজিৎ সামান্য থেমে বললেন, “না, আমি শুধু বলেছি যে মেয়েটার লেখায় কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল, সেটি বিশ্লেষণ করা দরকার।” শঙ্করবাবু টেবিলের ওপর হাত ঠুকে বললেন, “দেখুন, এটা স্কুল, গোয়েন্দা অফিস না। আপনি যদি এই সব তত্ত্ব ঘাঁটাতে থাকেন, স্কুলের নাম খারাপ হবে। মিডিয়া খোঁজ পাবে, গার্ডিয়ানরা প্রশ্ন তুলবে। আপনার দায়িত্ব ছাত্রদের পড়ানো, না কি থ্রিলার লেখা?” অভিজিৎ চুপ করলেন। কিন্তু চোখের কোনে যে অদ্ভুত অগ্নি ছিল, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। হেডমাস্টার তাকে কাগজের একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন, “এই মর্মে একটা লেখা দিন যে আপনি ওই বিষয় আর তদন্ত করবেন না। না হলে বোর্ডের কাছে রিপোর্ট পাঠাতে হবে।” অভিজিৎ সেই ফাইল হাতে নিয়ে বললেন, “আমি মেনে নিচ্ছি না, শুধু কিছু প্রশ্নের উত্তর চাইছি—এটা কি ভুল?” উত্তরে শঙ্কর মিত্র মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকালেন, “কখনও কখনও প্রশ্ন না করাটাই শান্তি এনে দেয়, মিস্টার সেন।”
সেদিন সন্ধ্যায় অভিজিৎ তার কোয়ার্টারে ফিরে এলেন উদভ্রান্ত মন নিয়ে। ছাদে উঠে ধূপ জ্বালালেন, মাথা ঠান্ডা করতে। তারপর রুদ্রানীর সেই অঙ্কের খাতা আবার খুললেন। কিছু তো লুকানো ছিল এই রেখা, কোণ, ত্রিভুজ আর বৃত্তের মধ্যে। হঠাৎ একটি আঁকা চিহ্ন তার চোখে পড়ল—একটি অসমাপ্ত ষড়ভুজ, কিন্তু তার একদিকের রেখাটি হঠাৎ ভেঙে গেছে। যেন ইচ্ছাকৃতভাবে অসম্পূর্ণ রাখা। সেই চিহ্নটা তাকে কোথাও দেখার কথা মনে পড়ল। তিনি স্কুলের পুরনো প্রোজেক্ট ফাইল ঘেঁটে বের করলেন ‘ক্রিয়েটিভ ম্যাথ ক্লাব’ নামে ছাত্রদের একটি পুরনো ম্যাগাজিন—তাতে ২০১৯ সালের সংখ্যায় একটি শিক্ষার্থী একটি আর্টিকল লিখেছিল: “জ্যামিতি দিয়ে কিভাবে বার্তা পাঠানো যায়।” লেখকের নাম—রুদ্রানী ঘোষ। অভিজিৎ স্তব্ধ। ওই একই চিহ্ন সেখানে আঁকা ছিল, তাতে নিচে লেখা ছিল: “একটি অসম্পূর্ণ রূপ মানে সতর্কবার্তা। যে দেখবে, সে বুঝবে।” এই চিহ্নটা কী কাউকে কিছু জানানোর মাধ্যম ছিল? যদি এটা সত্যি হয়, তবে সে নিজের মৃত্যুর আগে জানিয়ে গেছে কোনো বিপদের কথা—কার বিপদ, কে ছিল তার আশেপাশে? অভিজিৎ জানতেন, পরের প্রশ্নের জবাব স্কুলের মধ্যে আছে।
পরদিন সকালেই তিনি কাউন্সেলর সুহাসিনী রায়ের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন। শিক্ষক লাউঞ্জে সুহাসিনী একা চা খাচ্ছিলেন। অভিজিৎ সরাসরি বললেন, “রুদ্রানী আপনার কাছে কাউন্সেলিং করতে এসেছিল কিছুদিন আগে?” সুহাসিনী কিছুটা বিরক্তির ভঙ্গিতে বললেন, “হ্যাঁ, এসেছিল। কিন্তু খুব বেশি কিছু বলেনি। শুধু এটুকু বলেছিল—ওর চারপাশে কেউ আছে যাকে সে ভয় পায়। তবে নাম বলেনি। আমি ভেবেছিলাম পারিবারিক সমস্যা হবে।” অভিজিৎ চাপা স্বরে বললেন, “সে ভয় কার প্রতি ছিল, সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। হয়তো সে কাউকে বার্তা দিয়ে গিয়েছে, জ্যামিতির ভাষায়।” সুহাসিনী ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, “আপনি কী বলছেন, বুঝতে পারছি না। এগুলো কি কিছু সিনেমার কল্পনা নয়?” অভিজিৎ মৃদু হেসে বললেন, “কল্পনার মধ্যেই বাস্তব থাকে, শুধু দেখতে জানতে হয়।” ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের কোণে রাখা লকার থেকে একটি শব্দ এল—ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার মতো। তারা দুইজনই একসাথে তাকালেন—কেউ যেন কিছু রেখে গেছে ওখানে। তারা এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলেন একটি ছোট্ট নোট: তাতে শুধু আঁকা একটি চিহ্ন—ওই একই অসমাপ্ত ষড়ভুজ। নিচে লেখা: “তোমার ওপর নজর আছে। সাবধানে থাকো।”
–
স্কুলে শোকের ছায়া এখন খানিকটা হালকা হলেও, শিক্ষক অভিজিৎ সেনের মনে অস্বস্তি দিন দিন বাড়ছে। তিনি জানেন, গণিতের পেছনে যে কোড লুকিয়ে থাকে, তা অনেক সময় শব্দের থেকেও বেশি স্পষ্ট হয়। রুদ্রানীর শেষ পরীক্ষার খাতায় খুঁজে পাওয়া ত্রিভুজাকার চিত্র আর তাতে খোদাই করা অদ্ভুত কোণ ও সংখ্যা—তাঁর মনে জাগিয়েছে সন্দেহ। তিনি গতরাতেও সেই খাতাটি খুলে আবার লক্ষ করেছিলেন। ত্রিভুজটির এক কোণে লেখা ছিল “37°”—যা সাধারণ জ্যামিতির চিত্রে সচরাচর দেখা যায় না। এছাড়া একটি কোণে লেখা “B–III”—যা হয়তো স্কুল বিল্ডিংয়ের ব্লক ও তলায় কিছু নির্দেশ করছে। পরের দিন সকালে স্কুলে পৌঁছে তিনি সরাসরি গেলেন B ব্লকের তৃতীয় তলায়, যেখানে মূলত ল্যাবরেটরি এবং পুরনো স্টোর রুম। স্টোররুমটি সচরাচর বন্ধ থাকে, কিন্তু আজ দরজাটা সামান্য খোলা ছিল। ভিতরে ঢুকে অভিজিৎ সেন দেখতে পেলেন এক পুরনো ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকা একটা অসমাপ্ত জ্যামিতিক চিত্র—এক ত্রিভুজ, যার এক পাশে লেখা: “Solve Me.”
সেই চিত্রে স্পষ্ট ছিল এক অসম ত্রিভুজ, যার তিনটি বাহু ছিল ভিন্ন দৈর্ঘ্যের। অভিজিৎ বোর্ডে রাখা একটি চক নিয়ে মাপ করতে গিয়ে বুঝলেন, এটি একটি স্কেলড এনিগ্রাম, যেখানে প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য নির্দেশ করে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীকক্ষ। তার পাশে লেখা কিছু সংখ্যার গুচ্ছ—“216, 314, 118”—গণিত শিক্ষক হিসেবে তাঁর চোখে পড়ে যে এগুলি পিরিয়ডিক টেবলের উপাদানের নম্বর। 216–Livermorium, 314–অস্তিত্বহীন, 118–Oganesson। রসায়ন শিক্ষক অচিন্ত্য বসুকে মনে পড়ে যায়, যিনি আগে সিআইডি-তে কাজ করতেন এবং কোড নিয়ে কাজ করতেন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। অভিজিৎ সেই মুহূর্তে বুঝলেন, এ শুধু খুনের ক্লু নয়, এটা কোনও ‘খেলা’—একজন অত্যন্ত কৌতূহলী, মেধাবী এবং বিপজ্জনক খেলোয়াড়ের ফেলে যাওয়া সংকেত। তিনি তড়িঘড়ি ছুটে গেলেন স্কুলের ডিজিটাল রেকর্ড কক্ষের দিকে, যেখানে ছাত্রছাত্রীদের পুরনো প্রজেক্ট জমা থাকে। সেখানে তিনি খুঁজে পান রুদ্রানীর একটি বিজ্ঞান প্রজেক্ট, যেখানে Livermorium ও Oganesson-এর মাঝে সংযোগ নিয়ে লেখা ছিল—“When stability is forced, decay begins.” পৃষ্ঠার নিচে ছোট্ট করে লেখা একটি বাক্য যেন তাঁকে চমকে দেয়—“Math doesn’t lie. People do.”
এই বাক্য যেন অভিজিৎ সেনের রক্তে ঢুকে যায়। কে এই খেলোয়াড়? কেন সে গণিত দিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে একটি খুনের রহস্যে? রুদ্রানীর প্রজেক্টের শেষে একটা QR কোড সাঁটানো ছিল, যেটা মোবাইলে স্ক্যান করতেই খুলে যায় একটি এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার, যেখানে রুদ্রানী নিজের ভয় এবং সন্দেহের কথা রেকর্ড করেছিল। ভয়েস ক্লিপে সে বলছে, “তুমি যাকে শিক্ষক ভাবছ, সে আসলে একটা হিসেবি খুনি। যদি আমি কিছু হয়ে যাই, B–III–Solve Me তে খুঁজো।” অভিজিৎ বুঝলেন, এই মৃত্যু কেবল আবেগপ্রবণ কিশোরীর আত্মহনন নয়—এটা ছিল একটি সুপরিকল্পিত হত্যা, আর রুদ্রানী হয়তো আগেই আঁচ করতে পেরেছিল সেটা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—সে কার কথা বলছিল? হেডমাস্টার? কাউন্সেলর? না কি অন্য কেউ? অভিজিৎ ঠিক করেন, এবার তিনি এই ধাঁধার সমাধানে এগোবেন স্কুলের গণ্ডির বাইরে, কারণ এখন এই খেলায় তাঁর নিজের জীবনও জড়িয়ে পড়তে চলেছে।
–
ভোরবেলা স্কুল চত্বরে ফের একবার আলোড়ন ওঠে—রক্ষী রঘুবাবু প্রথম দেখে যে অঙ্কন স্যারের টেবিলে একটি খাম পড়ে আছে, যার ভিতরে একটি গোল ধাঁধা কাটা কাগজ আর একটা হাতের লেখা চিঠি। চিঠিতে লেখা, “যে অঙ্ক তুমি শিখিয়েছিলে, সে-ই তোমার শাস্তি বেছে নিয়েছে।” এই লাইনটি শোনামাত্র অঙ্কন স্যারের মুখ শুকিয়ে যায়। ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন এই ধাঁধা কোনো সাধারণ খেলা নয়—এ এক শৃঙ্খল যা হত্যার সূত্রে বাঁধা। কাগজে যে গোল ছাঁদের অঙ্ক দেওয়া ছিল, তা ছিল ক্যালিওনিয়ন সিকোয়েন্সের একটি অংশ, যেখানে প্রত্যেক সংখ্যার অর্থ ছিল ঘরের নম্বর, ক্লাসরুমের কোড, এবং ছাত্রছাত্রীদের রোল নম্বর। এই সূত্র অনুযায়ী যাকে পাওয়া যায়, সে হল—শ্রেয়সী, সায়ন্তিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অঙ্কন স্যার শ্রেয়সীকে আলাদাভাবে ডেকে পাঠান। মেয়েটি অসহায় চোখে বলে, “স্যার, আমি জানতাম কিছু একটা ঘটবে… কিন্তু ভাবিনি এতটা মারাত্মক…” স্যার চমকে যান, বলেন, “তুমি কি আগে থেকেই জানতে যে সায়ন্তিকা বিপদে আছে?” শ্রেয়সী চোখ নামিয়ে ফেলে, “সায়ন্তিকা কোনো এক ভয়ানক খেলায় জড়িয়ে গিয়েছিল, স্যার। সেটা শুরু হয়েছিল আমাদের গাণিতিক অলিম্পিয়াড প্রজেক্ট থেকে।” স্যার চমকে উঠে বলেন, “মানে?” মেয়েটি বলে, “ও বলত আমাদের মধ্যে কেউ একজন প্রতিভা নয়, বরং আতঙ্ক। ও ক’দিন আগে একটা ‘রক্তের ত্রিভুজ’ নিয়ে বলছিল—যেটা নাকি শুধু তিনজনেই জানে। আমি, সায়ন্তিকা আর…” সে থেমে যায়।
শ্রেয়সীর চোখের ভাষা দেখে অঙ্কন স্যার বুঝতে পারেন, মেয়েটি ভয় পেয়ে গেছে এবং আরও কিছু লুকোচ্ছে। তিনি শ্রেয়সীকে বলেন, “তুমি যদি সত্যিটা না বলো, তাহলে আর অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুমি কি বলতে চাও এই হত্যার পেছনে তোমরা তিনজন জড়িত ছিলে?” মেয়েটি এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, “তৃতীয় জন তোমার চেনা, স্যার। অভ্রজিৎ—যে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডে রেগুলার অংশ নিত, সে-ই মূল সূত্রপাত করেছিল। ও বলত গণিত হল শুধু অঙ্ক নয়—ওটা নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র। একরকম ‘জ্যামিতিক প্রোগ্রামিং’ বানিয়ে ও আমাদের বোঝাত, কাকে কোথায় ফেললে কী ফল হবে। সায়ন্তিকা শুরুতে মজা পেত, কিন্তু পরে ভয় পেতে শুরু করে।” অঙ্কন স্যার আঁতকে ওঠেন। এই কথাগুলো যেন ধীরে ধীরে তাঁর সামনে এক ছায়াময় ছক একে চলেছে। তিনি তখনই অভ্রজিতের ফাইল বের করেন, এবং দেখেন গত বছর এক অভ্যন্তরীণ অভিযোগ উঠেছিল যে ছেলেটি ব্ল্যাকবোর্ডের অঙ্কের মাঝে উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়, এমনকি শিক্ষকের বিরুদ্ধে কথাও বলে। কিন্তু তারপর হেডমাস্টার মিটমাট করে দিয়েছিলেন। এবার স্পষ্ট হয়ে যায়, সায়ন্তিকার মৃত্যু হয়তো নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং এক কল্পনাপ্রসূত ‘অঙ্ক-খেলার’ ফল।
সন্ধ্যা হয়ে এলে অঙ্কন স্যার সিদ্ধান্ত নেন, এ রহস্য তাঁকে ভেদ করতেই হবে। তিনি স্কুলের পুরনো ভিডিও রেকর্ডিং ঘেঁটে খুঁজতে থাকেন সেই দিনকার ফুটেজ—যেদিন সায়ন্তিকা মারা যায়। হঠাৎ এক দৃশ্যে তিনি দেখেন, একটি ছায়াময় মূর্তি—যে আচমকা ক্লাসরুমে ঢুকে বোর্ডে কিছু লেখে, তারপর দ্রুত বেরিয়ে যায়। ক্লাসের কেউই তখন তাকিয়ে ছিল না, কারণ তারা তখন পরীক্ষার পেপারে মগ্ন। তিনি ছবিটি স্থির করে বুঝতে পারেন, সেই মূর্তি অভ্রজিৎ ছাড়া আর কেউই নয়। পরদিন সকালে পুলিশকে তিনি জানানোর সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তার আগেই অভ্রজিৎ স্কুলে আসে না। বরং তার জায়গায় আসে এক অদ্ভুত চিঠি, লেখা: “অঙ্ক সব জানে, কিন্তু সব অঙ্ক বোঝে না। খুঁজে দেখো, সমান্তরাল রেখার মধ্যে একটা এমন বিন্দু আছে, যা শুধুই রক্তে লেখা যায়।” অঙ্কন স্যার বুঝতে পারেন, শেষ লড়াই এখন শুরু হবে।
–
শহরের বুকে যখন রাত নামে, তখন কলকাতার পুরনো স্কুলবাড়িটার ছায়াগুলোর যেন এক অদ্ভুত ভাষা হয়। অনির্বাণ সেই স্কুলেই আবার ফিরে এল—এইবার এক ক্লাসঘরে একা বসে, আয়নার সামনে নিজের চোখে চোখ রেখে। গণিতের সেই ধাঁধাগুলো যেন এবার তাকে তাড়া করছে। পত্রলেখা রায় নামে এক পুরনো ছাত্রী যিনি প্রায় দশ বছর আগে এই স্কুলেই আত্মহত্যা করেছিল—তার নাম উঠে এসেছে অঙ্কের প্যাটার্নে। অনির্বাণ জানত না এই নাম কোথা থেকে এসেছে, কিন্তু স্কুলের পুরনো রেজিস্ট্রার থেকে খোঁজ পেয়ে সে নিশ্চিত হয় যে সায়নীর লেখা সূত্রে উঠে আসা “PR-RA-0714” আসলে পত্রলেখা রায়ের আইডি নম্বর ছিল। রাত বাড়তে থাকায় স্কুলের নিস্তব্ধতা গা ছমছমে হয়ে উঠল, হঠাৎ একটা বেঞ্চ শব্দ করে নড়ে উঠল ক্লাসের পেছনে। অনির্বাণ জোরে ফিরে তাকাল, কিন্তু কেউ নেই। সে ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দেখে সেখানে সায়নীর পুরনো খাতা রাখা, যা সে আগেই স্টাফরুমে জমা দিয়েছিল। কে আনল এটা এখানে?
পরদিন সকালে সে সরাসরি যায় অঞ্জন সেনের কাছে। হেডমাস্টার চুপচাপ বসে ছিল। অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে, “পত্রলেখা রায়ের আত্মহত্যার দিন আপনি স্কুলে ছিলেন?” অঞ্জনের মুখে অদ্ভুত স্নায়বিক টান তৈরি হয়। “আমি… আমি তখন নতুন জয়েন করেছিলাম। সে মেয়ে মানসিক সমস্যায় ভুগছিল, তদন্ত হয়েছিল, কিন্তু প্রমাণ হয়নি কিছু। স্কুলে আর অশান্তি চাইনি, তাই চেপে রাখা হয়েছিল।” অনির্বাণ এবার বুঝল যে একসময়কার ঘটনার ছায়া এখনও বর্তমানকে ঘিরে রেখেছে। পত্রলেখা রায়ের মৃত্যুর তদন্তের ফাইল সে নিজের জোরে খোঁজে, এবং জানতে পারে যে সেই মৃত্যুর দিন, একটা অঙ্কের সূত্র তার ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা ছিল, আর সে সূত্রটি হুবহু মিলে যায় সায়নীর মৃত্যুর আগের রাতের লেখার সঙ্গে। দুটো সূত্রই একটাই সংকেত বহন করছে—“∠A + ∠B + ∠C = 180°, but the triangle is broken.”
তদন্তের এই ধাপে এসে অনির্বাণ বুঝতে পারে যে এখানে গণিত আসলে একটি ভাষা, যার মাধ্যমে কোনও অপরাধী তার চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। প্রতিটি হত্যার পর কোনও না কোনওভাবে একটা জ্যামিতিক সংকেত রয়ে যাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবে, যদি এই ধাঁধার ভিতরে আর কোনও সূত্র লুকিয়ে থাকে, সেটা হয়তো অতীতের ছায়ার মধ্যেই—যেখান থেকে সব শুরু হয়েছিল। পত্রলেখা, সায়নী—দুজনেই যেন সেই অদৃশ্য জ্যামিতির রেখায় আবদ্ধ। অনির্বাণ ঠিক করে, তাকে এবার পত্রলেখার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই হবে, হয়তো তাদের কাছেই রয়েছে সেই মূল সূত্র যা আজকের মৃত্যু রহস্যকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। আঁধার ঘন হচ্ছে, আর সেই আঁধারে প্রতিটি কোণ তৈরি করছে এক জ্যামিতিক ছায়ার রেখা—যা তাকে নিয়ে যাচ্ছে এক ভয়ংকর সত্যের দিকে।
–
স্কুল ভবনের পুরনো লাইব্রেরির দেওয়ালে লেগে থাকা ছত্রাকের গন্ধ, ধুলোর স্তরে ঢাকা বইয়ের তাক আর টিকটিকির ফিসফাসে সন্ধ্যা যেন একটু বেশিই গা ছমছমে হয়ে উঠেছিল সেদিন। অনির্বাণ, অনিন্দিতা ও গৌতম মিলে এক অদ্ভুত সূত্রে এসে পৌঁছেছিল—প্রত্যেকটা ধাঁধার পেছনে লুকিয়ে আছে নির্ভার চিহ্ন, অঙ্কের রেখা, এবং একটা নির্দিষ্ট স্থানের ইঙ্গিত। সপ্তম ধাঁধাটি ছিল সরলরেখা সংক্রান্ত—“তিন বিন্দু এক রেখায় বসে না, তবে ছায়ার রেখা তবুও নির্দেশ করে মিথ্যার কবর।” এই ধাঁধার বিশ্লেষণে অনির্বাণ বুঝল, এটা লাইব্রেরির এক কোণে রাখা সেই পুরনো পৃথিবীর গ্লোবের কথা বলছে, যার ছায়া পড়ে সরু জানালার ভেতর দিয়ে। ছায়ার রেখা যেদিকে পড়ে, সেদিকে একটা কাঠের তাকের পেছনে একটা সিক্রেট ক্যাবিনেট পাওয়া গেল—যার ভেতরে ছিল কিছু পুরনো ডায়েরির পাতা, আর একহাত লেখা চিঠি। সেই চিঠিতে লেখা ছিল—“আমি দেখেছি। কিন্তু আমি কিছু বলিনি। সে বলেছিল, এটা পরীক্ষারই অংশ। কেউ বিশ্বাস করবে না।” হ্যান্ডরাইটিং চেক করে অনির্বাণ নিশ্চিত হল এটা মৃত ছাত্রীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নন্দিনীর লেখা। কিন্তু সে তো বলেছিল, সে কিছুই জানে না! চিঠিটা অনিন্দিতার হাতে তুলে দিয়ে সে বলল, “এখন আমাদের ওর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। ও হয়ত সত্যিই ভয় পেয়েছিল, কিন্তু এখন আর চুপ থাকা চলবে না।”
নন্দিনীকে স্কুলের অডিটোরিয়ামে একা বসে থাকতে দেখে অনির্বাণ ও অনিন্দিতা তার সামনে গিয়ে বসল। প্রথমে মেয়েটা কিছুতেই মুখ খুলছিল না, বারবার বলছিল সে কিছু জানে না। কিন্তু চিঠির কপি ওর হাতে দিতেই ওর চোখ কেঁপে উঠল। কান্না ধরে রাখতে না পেরে সে বলে ফেলল, “আমি চেয়েছিলাম ভুলে যেতে। ওই দিন গণিত পরীক্ষার আগে শ্রেয়া খুব নার্ভাস ছিল। সে বারবার বলছিল, প্রশ্নপত্র নিয়ে কেউ কিছু করেছে। আর স্যারের কথায় ও যেন কিছু একটা বুঝে ফেলেছিল। কিন্তু তারপর ওর আচরণ পাল্টে যায়, চুপচাপ হয়ে যায়, আর পরীক্ষার পরের দিনই সব শেষ…” অনির্বাণ প্রশ্ন করল, “তুমি কি জানো শ্রেয়া কী দেখে ফেলেছিল?” নন্দিনী বলল, “হয়ত কিছু উত্তর আগেই কাউকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হয়ত কারও হুমকি ছিল। তবে শ্রেয়া বলেছিল, কেউ একজন প্রশ্নপত্রের পেছনে একটা অঙ্ক লিখে দিয়েছিল—সেটাই ছিল তার কাছে বার্তা। ও বলেছিল, কেউ ওকে ফাঁসাতে চাইছে।” গৌতম তখনই বলে উঠল, “তাহলে প্রশ্নপত্রের কোনও কপি কি এখনো কোথাও আছে?” নন্দিনী কিছুটা চিন্তা করে বলল, “আমাদের শ্রেণীর তপনদা—সে পরীক্ষার পর অনেক কাগজ কুড়িয়েছিল। হয়ত তার কাছে কিছু আছে।” সিদ্ধান্ত হল, পরদিন সকালে তপনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কিন্তু নন্দিনী জানে না, তার এই সাক্ষাৎকার কার চোখে পড়ে গিয়েছে, আর এখন ছায়ার রেখা তার দিকেই এগোচ্ছে।
রাতের অন্ধকারে স্কুল ভবনের ছাদে কেউ একজন মোবাইলে ছবি তুলছিল। লাইব্রেরির জানালা থেকে নীচে ছায়া দেখা যাচ্ছিল তিনটে মানুষের—তারা তল্লাশি চালাচ্ছে গোপন আলমারিতে। অন্ধকারে সেই ছায়ার ছবি তুলে একজন কাউকে পাঠাল, আর লেখল—“ওরা খুব কাছে চলে এসেছে। পরবর্তী ধাঁধা এখন ওদের চেনা মুখের কাছেই আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল—কে কার ছায়া?” সেই অজানা পাঠানো ছবির প্রাপক একটা মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে হাসল—একটা ঠান্ডা, হিসেবি হাসি। কোলকাতার পুরনো একটা সত্যি আবার জেগে উঠছে, আর তার উত্তর লুকিয়ে আছে গণিতের বাইরে, মানসিক জ্যামিতিতে—যেখানে সম্পর্ক, বিশ্বাস আর ছায়া মিলে তৈরি করে এক অজানা সমীকরণ।
–
কলকাতার হিমশীতল জানুয়ারির সকালের আলো তখনো পুরোপুরি ঢুকতে পারেনি সাউথ ইস্ট স্কুলের পুরনো রেড ব্রিক ভবনের জানালাগুলোর ফাঁক গলে, কিন্তু তদন্তে দীপ্তেনের দৃষ্টি তখন ঠিক যেন সূর্যালোকের চেয়েও তীক্ষ্ণ। গণিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের শেষ পাতায় পাওয়া গিয়েছিল সেই রহস্যজনক জ্যামিতিক ধাঁধা, যেখানে একটি ত্রিভুজ, একটি রক্তচিহ্ন এবং লুকানো একটি নামের সংকেত ছিল—‘Riya’। দীপ্তেন এবার সেই প্রশ্নপত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল আর ভাবছিল, কেন রিয়া তার মৃত্যুর ঠিক আগে এই রহস্যময় সংকেত রেখে গেল? শুধু নিজের মৃত্যুর জন্য নাকি আরও কিছু জানিয়ে যেতে চেয়েছিল সে? দীপ্তেন লক্ষ্য করল, ত্রিভুজটির কোনাগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিল তিনটি সংখ্যা—১৩, ১৭, ১৯। প্রথমে এগুলো নিছক প্রাইম নাম্বার মনে হলেও, ধীরে ধীরে দীপ্তেন বুঝল এগুলো হলো স্কুলের রোল নম্বর অনুযায়ী তিনজন ছাত্রীর সংখ্যা, যারা সবসময় রিয়ার সঙ্গে দেখা করত—মিষ্টি, পায়েল আর রিমি। আরও খুঁজে দেখতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন, স্কুলের পুরনো লাইব্রেরির রেকর্ডে তিনটি বইয়ের লোন ইতিহাসে এই তিনজনের নাম একই তারিখে লেখা ছিল—তিন মাস আগে, যেদিন স্কুলে একটি দুঃসহ ঘটনা ঘটেছিল, যা পরে চাপা পড়ে যায়। দীপ্তেন সিদ্ধান্ত নেন, এবার তাকে ওই তিনজন ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করতেই হবে—না হলে এই অঙ্ক কখনো সমাধান হবে না।
প্রথমে দেখা হল মিষ্টির সঙ্গে—সে একেবারে আতঙ্কগ্রস্ত, ঠোঁট শুকনো, চোখে ঘুম নেই। সে কিছুই বলছিল না, শুধু চুপ করে বসে ছিল দীপ্তেনের সামনে। কিন্তু দীপ্তেন জানতেন, ভয়ভীতি দিয়ে নয়, বরং মানুষের মধ্যে যত্ন আর বিশ্বাস স্থাপন করেই সত্য বের করা যায়। দীপ্তেন এক কাপ গরম চায়ের পাত্র এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমরা চারজন খুব ভালো বন্ধু ছিলে, তাই না?” মিষ্টির চোখ ভিজে উঠল, সে আস্তে আস্তে বলল, “হ্যাঁ, আমরা সব কিছু একসঙ্গে করতাম। কিন্তু তিন মাস আগে রিয়া একটা ভিডিও পায়—স্কুলেরই এক শিক্ষকের মোবাইল থেকে, যেটা সে ভুল করে তার হোস্টেল রুমে রেখে গেছিল।” দীপ্তেন বুঝতে পারলেন, এখন গল্পের বাঁক পাল্টাবে। মিষ্টি বলল, “সেই ভিডিওতে রিয়া দেখেছিল… পায়েল, মানে আমাদেরই বন্ধু… আর…” সে থেমে গেল, কিন্তু দীপ্তেন বুঝে গেলেন, সেখানে কোনো শারীরিক শোষণের ভিডিও ছিল—যার জন্যই রিয়া ভীষণ রকম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। সে ভিডিওটা স্কুল অথরিটির কাছে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু হেডমাস্টার, মিস্টার চট্টোপাধ্যায় তখন তা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। রিয়া তখন হুমকি দেয় সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দেবে সবকিছু। এরপর থেকেই তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে টার্গেট করা হতে থাকে। পরীক্ষার দিন, প্রশ্নপত্রে সেই অঙ্কের ছায়ায় সে একটি সংকেত রেখে যায়, যেটা শুধুই একজন গণিতবিদ বুঝতে পারবে।
দীপ্তেন এবার সরাসরি হেডমাস্টারের কক্ষে গিয়ে হাজির হন। কক্ষে ঢুকতেই একটি গন্ধ তার নাকে এল—জ্বলন্ত এলাচি চায়ের সঙ্গে যেন মিশে আছে ঘামে ভেজা ভয়ের গন্ধ। চট্টোপাধ্যায় সাহেব তার চেয়ারে বসে ছিলেন, মুখে ফ্যাকাশে হাসি। দীপ্তেন তার সামনে প্রশ্নপত্র খুলে ধরলেন, বললেন, “এই প্রশ্নটা আপনি করেছিলেন?” তিনি একটু চমকে উঠলেন। বললেন, “না, এটা তো রিয়া নিজে লিখে গেছে।” দীপ্তেন তখন শান্ত গলায় বললেন, “রিয়া কিছু বলে যেতে পারেনি, কিন্তু সে এই অঙ্কটা রেখে গেছে, কারণ জানত, আপনি চুপ করিয়ে দেবেন সবাইকে। কিন্তু অঙ্ক তো থামে না, সেটা একটা সূত্রে পৌঁছায়ই।” চট্টোপাধ্যায় সাহেব এবার আর ধরে রাখতে পারলেন না, কেঁদে ফেললেন—তিনি স্বীকার করলেন, ভিডিওটা তিনি নিজে দেখেছিলেন, কিন্তু নাম প্রকাশ হলে তার চাকরি যাবে—তাই তিনি পায়েলকে চাপে রাখেন, এবং রিয়াকে চুপ করাতে বলেন। কিন্তু রিয়া রাজি হয়নি। এরপর… এরপর একদিন প্রশ্নপত্র ছাপানোর নামে রিয়ার রুমে গিয়ে সে তার ড্রিঙ্কে কিছু মেশান। আর সকালে সবাই জেনে যায়, রিয়া আর বেঁচে নেই। দীপ্তেন ফোন তুলে কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে ফোন করলেন। রক্তের অঙ্ক শেষ, কিন্তু রিয়াদের মতো বহু ছাত্রী যাতে আর না হারিয়ে যায়, সেই আশাতেই তিনি এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলেন—”গণিত কখনও মিথ্যে বলে না।”
–
মধ্যরাত। স্কুলের গেটের বাইরে দমদম থানার একটি জিপ দাঁড়িয়ে। অভিজিৎ ও ইনস্পেক্টর রায় একসাথে প্রবেশ করেন ভবনের ভিতর। রক্তিমার মৃত্যুর মূল সূত্রটি বেরিয়ে এসেছে আগেই—সে মারা গিয়েছিল বিষক্রিয়ায়, যা পরীক্ষার দিন তার জলের বোতলে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কার হাতে, কীভাবে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর ছিল সেই অঙ্কের ধাঁধায়, যেটা পাওয়া গিয়েছিল তার পরীক্ষার খাতায়। “πR² + 13x – 7 = 0″ এই সূত্রকে অভিজিৎ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বুঝেছিল এটি শুধু অঙ্ক নয়, একটি কোড, যেখানে πR² নির্দেশ করে একটি বৃত্ত—স্কুলের ম্যাথ ক্লাবে আঁকা এক গোলঘরের প্রতীক, আর ‘13x – 7’ ইঙ্গিত করছিল ১৩ নম্বর ছাত্রকে—অরুণাভ। সেই সন্ধ্যাবেলা ইনস্পেক্টর রায় যখন অরুণাভকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তখন সে কিছু না বলে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে—”আমি চেয়েছিলাম ওর নামটা শেষ হোক, কারণ ও আমার প্রতিভা ছিনিয়ে নিচ্ছিল। আমি ছিলাম ক্লাসের সেরা, কিন্তু ও আসার পর থেকেই আমি অদৃশ্য হয়ে যাই।”
রক্তিমার খুনের পিছনে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, ছিল হীনমন্যতা ও মানসিক বিকার। গণিত প্রতিযোগিতায় পরপর দুবার হেরে গিয়ে অরুণাভ ভেঙে পড়েছিল। একদিন ক্লাসে রক্তিমা বলেছিল, “তুই না পারিস না, তোর মাথা এমনিতেই অনেক চাপা।” এই এক বাক্য তার ভিতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সে জানত রক্তিমা শুধুই প্রতিভাবান নয়, অন্যদের সাহায্য করতেও ভালবাসে। খুনের দিন সকালে সে পরীক্ষার আগে রক্তিমাকে জলের বোতল দেয়, বলে—”তোর টেবিলের নিচে পড়ে গিয়েছিল, আমি তুলে দিচ্ছি।” এরপরই পরীক্ষার সময় রক্তিমা অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর সবাই ধরে নেয় ওর অ্যাসিডিটির সমস্যা। কিন্তু অভিজিৎ জানত, এত সহজে কেউ এভাবে অজ্ঞান হয় না। সেই সন্দেহ থেকেই খাতা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে সে পায় অঙ্কের সেই রহস্যচিহ্ন।
অভিজিৎ শেষবারের মতো রক্তিমার খাতাটি হাতে নিয়ে বোর্ডরুমের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। কলকাতার আকাশে ধোঁয়াশা। ইনস্পেক্টর রায় তাকে বলে—”আপনার কারণেই এই কেসে আলো পড়ল, না হলে এটাও হয়তো আত্মহত্যার কেস হিসেবেই বন্ধ হয়ে যেত।” অভিজিৎ মৃদু হাসে। তার চোখে ঝলমল করে ওঠে রক্তিমার সেই চেহারা—মনে পড়ে যায়, কিভাবে সে প্রশ্ন করেছিল, “স্যার, এই অঙ্কের পিছনের গল্পটা কী?” আজ উত্তরটা দেওয়া গেল, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। স্কুলে আবার সকাল হবে, নতুন ছাত্রছাত্রী আসবে, কিন্তু অভিজিৎ জানে, রক্তিমার প্রশ্ন আর ফিরে আসবে না। সে শেষবারের মতো খাতাটা বন্ধ করে রাখে টেবিলের ড্রয়ারে। এক ফাঁকা ঘরে কেবল চকের গুঁড়ো আর অঙ্কের রেখাগুলো রেখে যায় এক মেয়ের না বলা গল্প—রক্তের জ্যামিতি।
_____




