Bangla - রহস্য গল্প

রক্তের গন্ধ

Spread the love

অধ্যায় ১

পুরুলিয়ার ঘন অরণ্য পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে নির্জর বসু যখন সেই পুরনো কটেজটির সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সূর্য সবে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রোদ আর পাতার ফাঁক দিয়ে আলো-ছায়ার খেলা কেমন একটা বিমুগ্ধ নীরবতা তৈরি করেছিল। শহরের শব্দদূষণ, অফিসের ইমেল, অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন—সব ছাড়িয়ে, এই নির্জনতার মাঝে এসে যেন কিছুটা হালকা অনুভব করছিল সে। কটেজটা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে কী অপেক্ষা করে আছে—চুন-ঝরানো দেওয়াল, কাঁচভাঙা জানালার পাশে গাছের লতানো ডাল, আর এক পাশে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ লেগে থাকা আগুন নিভে যাওয়া উনুন। দুলাল কাকা, কটেজের কেয়ারটেকার, চুপচাপ একটা চাবি এগিয়ে দিলেন—চোখেমুখে কোনো উৎসাহ নেই, যেন এক পুরনো অভিশাপের ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন। “রাতের বেলা একা থাকবেন সাব, লোকে ভয় পায় এই জায়গায়,” বলেই আবার চুপ। নির্জর হেসে বলল, “ভয়টা আমার গল্পে থাক, বাস্তবে নয়।” চাবিটা হাতে নিয়েই তার মনে হল—দরজাটা যেন একটুও সহজে খুলতে চায় না।

বিকেলের রোদ ফিকে হয়ে রাত নামতে না নামতেই কটেজটা যেন নিজের রঙ বদলে ফেলল। দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে শীতল বাতাস ঢুকছিল, আর তার সঙ্গে অদ্ভুত একটা গন্ধ—না, সাধারণ জংলার নয়। কাঁচা রক্তের মতো, লৌহমিশ্রিত একধরনের ধাতব গন্ধ, যা নাকে লেগে থাকে, ফুসফুসে ঢুকে যায়। প্রথমে নির্জর ভেবেছিল এটা তার কল্পনা—হয়তো পুরনো জায়গা, স্যাঁতসেঁতে ঘর, এসবের কারণে। কিন্তু যখন সেই গন্ধ ঘনিয়ে এসে লেখার টেবিলের চারপাশ ঘিরে ধরল, সে টের পেল কিছু একটা ঠিক নেই। কটেজে কোনও অদৃশ্য চোখ যেন তাকে নিরীক্ষণ করছে। ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা ছুঁয়েছে, চারপাশ নিঃসন্দেহে স্তব্ধ—শুধু দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক আর বাতাসে পাতার মর্মর। হঠাৎ জানালার ফাঁক দিয়ে যেন লাল রঙের ছায়া এক ঝলক চোখে পড়ল, নির্জর চমকে উঠে তাকাল—কিছুই নেই, শুধু গাছে ঝুলে থাকা এক শালপাতা, অন্ধকারে তার ছায়া। কিন্তু গন্ধটা? সে তো থাকছেই।

রাত গভীর হলে নির্জর একবার ঘুমোবার চেষ্টা করল, কিন্তু ঘুম এল না। তার মাথায় ঘুরছিল কটেজটার ইতিহাস—কেউ কি আগে এখানে থেকেছে? কেন দুলাল কাকা কিছু বলতে চায় না? ঘরের কোণে একটানা তাকিয়ে থাকা একটি অদ্ভুত রঙের দাগ, খাটের তলায় কাঠের চাঙড়ে খোদাই করা নাম—ম। সে লেখার খাতা খুলল, কলম চালাতে চাইল—কিন্তু হাত কাঁপছিল। হঠাৎই কানের পাশে একটা চাপা ফিসফিসানি, যেন এক নারীকণ্ঠ বলছে—“আমার গল্পটা কে লিখবে?” নির্জর চমকে উঠে চারপাশ দেখল, কেউ নেই। বাতি নিভে গেল হঠাৎ, জানালা বন্ধ, দরজা লক করা—তবুও বাতাসে সেই গন্ধ, সেই কণ্ঠস্বর। লেখক জানে, হয়তো তার ভিতরের ভয়গুলোই এখন গল্প হয়ে উঠছে, কিন্তু এই অনুভূতি—এই নিঃসঙ্গ কটেজে রক্তের গন্ধ আর এক অদৃশ্য নারীকণ্ঠ—সব কিছু মিলিয়ে যেন তার বাস্তবতা আর কল্পনার সীমা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

অধ্যায় ২

পরের দিন ভোরে নির্জর দরজা খুলে বাইরে বেরোল। জঙ্গলের ভেজা মাটি, দূরের পাখির ডাক, আর গাছে গাছে জড়ানো কুয়াশার ধোঁয়াশা—সব মিলিয়ে যেন একটা অচেনা স্বপ্নের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল সে। রাতের অভিজ্ঞতা তাকে অস্থির করে তুলেছিল, কিন্তু লিখতে বসে সে কিছুতেই কলম চালাতে পারছিল না। মাথার মধ্যে ঘুরছিল সেই গন্ধ, সেই ফিসফিসে আওয়াজ—”আমার গল্পটা কে লিখবে?” নির্জর ভাবল, হয়তো কারও দুঃখজনক মৃত্যু হয়েছে এখানে, যার স্মৃতি বাতাসে লেগে আছে। সে দুলাল কাকার সঙ্গে কথা বলতে গেল, যিনি তখন কটেজের পেছনে কাঠ কাটছিলেন। “এই কটেজে কি কেউ মারা গেছে আগে?” প্রশ্নটা শুনে দুলাল কাকা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, “আপনি এসেছেন লিখতে। লেখা লিখুন। অত পুরনো খোঁচাখুঁচি ভালো না। জায়গাটা শান্ত রাখুন।” তার গলায় কোনও উত্তেজনা ছিল না, বরং একটা অব্যক্ত ভয়—যেন কিছু একটা লুকিয়ে রাখছেন, অথবা কোনো অতীত যা তিনি মুছে ফেলতে চাইলেও পারছেন না।

নির্জর বুঝতে পারল, কটেজটা শুধু একটা বাড়ি নয়—এখানে অতীত আটকে আছে, এবং কেউ বা কিছু যেন চায় সে সেটাকে উন্মোচন করুক। সেদিন বিকেলে, লেখার জন্য মন বসাতে গিয়ে সে একসময় উঠে ঘরের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। দেওয়ালের একটা কোণে শ্যাওলা জমেছে, কিন্তু তার মাঝে একটা অদ্ভুত দাগ—লালচে রঙের, যেন রক্তের ছিটে শুকিয়ে গিয়ে এমন রঙ ধারণ করেছে। সে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাইল, কিন্তু সাহস হল না। মেঝের একটা অংশ ঢিলা, কাঠটা তুলতেই দেখা গেল নিচে একটা গহ্বর, আর সেখানে একটা পুরনো টিনের বাক্স। সে বাক্স খুলতেই পেল কিছু পুরনো চিঠি, কিছু হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ আর একটা কালচে চামড়ার বাঁধাই খাতা—মনে হচ্ছিল ডায়েরি। খাতার ওপর নাম লেখা নেই, কিন্তু ভিতরে লেখা শুরু হয়েছে এভাবে—“তারা ভাবে আমি চলে গেছি, কিন্তু আমি এখনও এখানে, ঠিক এই কটেজেই…”

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধটা আবার ফিরে এল, এবার আরও তীব্র। নির্জর ঘরের একপাশে ডায়েরি খুলে বসে পড়ল, প্রতিটি পাতায় সেই নারীর অসহায় কণ্ঠস্বর—তার বর্ণনা, তার একাকিত্ব, আর তার ভয়। “আমি জানি ও ফিরে আসবে না। কিন্তু আমার দেহটা এখানেই পড়ে আছে—মেঝের নীচে, ঘরের ঠিক মাঝখানে।” পড়তে পড়তে নির্জর ঘামে ভিজে যায়, চারপাশে তার চোখ ছুটে বেড়ায়—জানালার বাইরে একটা লাল আলোর ছায়া, খাটের পাশে হালকা চরণের শব্দ, আর গন্ধটা, এতটাই তীব্র যে মনে হয় খোলা আঙুল দিয়ে বাতাস ছুঁলে রক্তে রাঙা হয়ে যাবে। দুলাল কাকা তখন আর নেই, জানালার ছায়া ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে, আর নির্জর বুঝতে পারছে—সে একা নেই, কেউ আছে এই কটেজে, কারও উপস্থিতি গভীর হয়ে তার লেখাকে গ্রাস করে নিচ্ছে।

অধ্যায় ৩

ডায়েরির পাতাগুলো যেন একটা অস্পষ্ট কাহিনির দরজা খুলে দিয়েছিল—একটা নারীস্বর, যার যন্ত্রণার ছাপ শব্দে শব্দে ফুটে উঠেছে। নির্জর গভীর মনোযোগে পড়তে লাগল: “সে বলেছিল আমার চোখে গল্প আছে, আমি যেন তার শব্দ হয়ে উঠি… কিন্তু আমি শুধু শব্দ হয়ে থাকলাম, গল্পটা কোনোদিন লেখা হল না। এখন এই ঘরটাই আমার কবর।” প্রতিটি বাক্যে মিশে ছিল অভিমান, আকুতি, আর এক ধরণের অব্যক্ত ক্রোধ—যা মনে হচ্ছিল বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ছে। ডায়েরির নিচে গুঁজে রাখা ছিল আরও কিছু ছেঁড়া কাগজ, একধরণের পাণ্ডুলিপি, অসম্পূর্ণ। নির্জর হাত বুলিয়ে বুঝতে পারল, এই লেখাগুলো যে কেবলই কল্পনা নয়—এখানে কোথাও লুকিয়ে আছে সত্য, একটা অসমাপ্ত সম্পর্কের, কিংবা এক অব্যক্ত হত্যার।

সন্ধ্যাবেলায় বৃষ্টি নামল হঠাৎ, জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ, আর সেই গন্ধ—রক্তের মতো, ধাতব, কাঁচা ও জঘন্যভাবে জীবন্ত—আবার ফিরে এলো। নির্জর পাণ্ডুলিপির একটা অংশ জোরে পড়ে ফেলল: “ঘরের মেঝেটা কাঁপে রাতের বেলায়। আমি সেই কাঁপন টের পাই। ওর লেখা শব্দগুলো আজও কানে বাজে—‘তোমার গল্প একদিন ছাপা হবে’। কিন্তু গল্পটা কি শুধু শব্দের ছিল?” হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে কাগজগুলো ওড়াতে লাগল। বাতি নিভে গেল। অন্ধকার ঘরে সেই পাতাগুলোর শব্দ যেন শোঁ শোঁ করে শোনা যাচ্ছিল, আর এক মুহূর্তে, নির্জর স্পষ্ট শুনতে পেল—ঘরের মাঝখান থেকে এক চাপা কাশির শব্দ, যেন কেউ দীর্ঘদিন কথা না বলে ফেলে রেখেছে গলা।

ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলেও নির্জর নিজেকে সামলে নিল। সে জানত, এটা হয়তো তার কল্পনা—অথবা অতীতের গহ্বর থেকে উঠে আসা এক স্মৃতি, যা এখনও ঘরের দেয়ালে লেগে আছে। পরদিন সকালে দুলাল কাকার মুখে কিছুই জোগাড় করতে পারল না সে—“আপনার ঘরে আপনি যা দেখেন, সেটা আপনার চোখের দোষ,” বলেই উনি হেঁটে চলে গেলেন। কিন্তু নির্জর ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপির লেখাগুলোর সঙ্গে নিজের লেখার অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করল—সাজানো বাক্য, অনুভূতির ভঙ্গি, এমনকি শব্দচয়নও অবিকল তার মতন। সে ভাবল, এটা কি নিছকই তার প্রভাব? নাকি এই কটেজ কোনওভাবে তার ভিতরের শব্দ চুরি করছে? নিজের লেখার খাতা খুলে লিখতে বসে তার আঙুল থেমে গেল—প্রথম লাইনটা লিখতেই মনে হল যেন কোনো নারী হালকা করে ফিসফিসিয়ে বলছে, “সেই লাইনটা ঠিক আছে, এবার আমাকে লিখো…”

অধ্যায় ৪

চতুর্থ রাত যেন অপেক্ষা করছিল নির্জরের সমস্ত যুক্তিবোধকে চূর্ণ করে দেওয়ার জন্য। সারাদিন লেখার চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে, অথচ এক লাইনও এগোতে পারেনি—প্রতিটি বাক্য যেন কারও অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকছিল। সন্ধের দিকে সে আবার সেই ডায়েরির পাতাগুলো খুলে বসে। পড়তে পড়তে বুঝতে পারল—এই লেখাগুলো কোনো কাল্পনিক চরিত্রের নয়, বরং এক মৃত নারীর অস্তিত্বের শেষ নথি। পাতার পর পাতা লিখে গেছে মাধবী নামের এক নারী, যে তার প্রণয়, বিশ্বাসঘাতকতা আর একান্ত নির্জন মৃত্যু সব কিছু ফেলে গেছে এই কটেজের দেওয়ালে, মেঝেতে, বাতাসে। মাধবী বারবার লিখেছে—”আমি কোথাও যাইনি, আমি এখানেই আছি।” যেন এই লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে সে কাউকে ডাকছে, অথবা আদেশ করছে তার গল্প সম্পূর্ণ করতে। রাতে শুতে গিয়ে নির্জর শপথ করল, সে নিজের মতো করে শেষ করবে মাধবীর গল্প। কিন্তু ঠিক তখনই বাতাসে আবার সেই গন্ধ, diesmal আরও ঘন, আরও ভারী—মনে হচ্ছিল কারও শরীর থেকে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তার পাশে।

জানালার কাঁচে একটা আলগা শব্দ, যেন কেউ টোকা মারছে বাইরে থেকে। নির্জর উঠে দাঁড়াতেই দেখল—একটা লাল রঙা ছায়ামূর্তি গাছে ঝুলে থাকা শালপাতার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে ছুটে জানালা খুলে বাইরে তাকাল, কিন্তু কিছুই নেই। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু একটা কুকুরের কান্নার আওয়াজ দূরে কোথাও। হঠাৎ ঘরের আলো নিভে যায়। ছায়ার মধ্যেই নির্জর টের পায় কারও নিশ্বাস তার ঘাড়ের কাছে। সে চমকে তাকায়, কেউ নেই, কিন্তু ডায়েরির খোলা পাতায় নতুন করে কিছু লেখা—তার নিজের হাতে নয়, কিন্তু কালিতেই লেখা—“তোমার হাত আমার হয়ে গেছে, এবার আমাকে লিখতে দাও।” নির্জর আতঙ্কে পিছিয়ে আসে, খাতা ছুঁয়ে দেখে সত্যিই সেই লাইনটা সেখানে লেখা।

রাত বাড়তে থাকে, আর প্রতিটি মিনিট যেন একটি শতাব্দীর মতো দীর্ঘ মনে হয়। নির্জর বিছানায় গিয়ে শুতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার চোখ বারবার চলে যায় ঘরের কোণে পড়ে থাকা সেই পাণ্ডুলিপির বাক্সের দিকে। বাতাস ভারী হয়ে যায়, গন্ধটা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে মনে হয় শ্বাস নিলেই রক্ত ঢুকে যাবে নাকে। ঠিক তখনই, ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে একজোড়া পদচিহ্ন দেখা যায়—ভেজা, রক্তমাখা, যেন কেউ স্নান সেরে এসেছে লাল জলে। সেই পদচিহ্ন আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে নির্জরের খাটের দিকে। এক অদৃশ্য চাপ যেন তার বুকের ওপর পড়ে, সে নড়তে পারে না, চিৎকার করতে পারে না। সেই ফিসফিসে কণ্ঠস্বর আবার বলে, “তুমি শুরু করেছ, এবার শেষ করো… আমি তোমাকে ছাড়ব না যতক্ষণ না আমার গল্প পূর্ণ হয়।” অন্ধকারে, নির্জর বুঝে যায়—সে কেবল এক লেখক নয়, এখন সে এক মাধ্যম, এক কণ্ঠস্বরের বাহক—যে এক মৃত নারীর অসমাপ্ত আত্মার কাছে বন্দী।

অধ্যায় ৫

পঞ্চম দিন সকালে নির্জর কটেজের দাওয়ায় বসে চুপ করে চা খাচ্ছিল। চোখের নিচে কালো ছায়া, গতরাতের আতঙ্ক এখনও শরীর জুড়ে। হঠাৎ কাঁচা রাস্তায় একটি বাইক থামে—একজন মেয়ে নেমে আসে, হাতে একটি নোটবুক আর ছোট্ট রেকর্ডার। তার চোখে কৌতূহল, কপালে ঘাম। “আপনি কি নির্জর বসু?”—মেয়েটি প্রশ্ন করে। সে নিজেকে পরিচয় দেয়—রিয়া ঘোষ, স্থানীয় সাংবাদিক, ছোট শহরের এক পত্রিকায় কাজ করে। সে বলে এই কটেজ ঘিরে তার বহুদিনের আগ্রহ, বহু বছর ধরে স্থানীয় মানুষের মুখে শোনা এক নারীর হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি, এক অদ্ভুত গন্ধের গল্প, আর এক মৃত লেখিকার আত্মার গুঞ্জন। নির্জর প্রথমে দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু তারপর ডায়েরির কথা শুনে রিয়াকে ভিতরে ডাকে। রিয়া ডায়েরি দেখে বিস্মিত, পাতার পর পাতা ঘেঁটে সে বলে, “এই লেখাগুলো কারও কল্পনা নয়, এই মাধবীর অস্তিত্ব একসময় ছিল। এই কটেজের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।”

রিয়া জানায়, কটেজটা একসময় এক নামকরা লেখকের মালিকানায় ছিল—অনিরুদ্ধ বসু, যিনি ১৯৭০-এর দশকে রহস্য গল্প লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। নির্জরের গায়ে কাঁটা দেয়, অনিরুদ্ধ বসু তার দাদু, যার লেখার প্রতি তার প্রেরণা আজও। কিন্তু এই কটেজ? সে তো কখনও জানত না পরিবারের এমন কোনো গোপন ঠিকানা ছিল। রিয়া আরও জানায়, স্থানীয় কিছু পুলিশ রিপোর্ট আছে যেখানে বলা হয়েছে, সেই সময়ে এক মহিলা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়—মাধবী নামের। ফাইলটি পরে “লোকেশন অসম্পূর্ণ” বলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। “আমি নিশ্চিত,” রিয়া বলে, “মাধবী এই কটেজেই ছিল, অনিরুদ্ধ বসুর সঙ্গে, এবং তার মৃত্যু হয়েছিল রহস্যজনকভাবে।” নির্জরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে—এক অদ্ভুত বোঝা যেন তার উত্তরাধিকার হয়ে এসেছে, যে বোঝা কাগজে লেখা ছিল না, গল্পে বলা হয়নি।

রিয়া তাকে প্রশ্ন করে, “আপনি কি গত কয়েক রাতে কিছু অদ্ভুত অনুভব করেছেন?” নির্জর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সব খুলে বলে—গন্ধ, পদচিহ্ন, কণ্ঠস্বর, এমনকি খাতার পাতায় নিজের অজান্তে লেখা সেই লাইনগুলো। রিয়া সব শুনে বলে, “তুমি শুধু এই কাহিনির লেখক নও, তুমি তার উত্তরসূরি। সে তোমাকেই বেছে নিয়েছে।” দুজনে সেই বিকেলে কটেজ ঘুরে দেখে—ঘরের দেয়ালে আঁচড়ের দাগ, মেঝের নিচে একটি দাগ যা ধুয়েও ওঠে না, আর বাতাসে সেই গন্ধ—যা ধীরে ধীরে ফের জেগে উঠছে। রাত নামার আগেই রিয়া বলে, “এই গল্পটা শেষ না হলে শুধু সে নয়, তুমিও মুক্তি পাবে না।” নির্জর বুঝে যায়—এই কটেজে আসা কেবল লেখা নয়, এটি তার নিজের অতীতের মুখোমুখি হওয়া, একটি চরম সত্যের সামনে দাঁড়ানো। আর সেই সত্য ক্রমে এগিয়ে আসছে… গন্ধে ভিজে, ছায়ায় ঢাকা।

অধ্যায় ৬

রাত গভীর হতেই রিয়া ও নির্জর বসে ছিল কটেজের ঘরের এক কোণে, যেখানে মেঝের নিচে পাওয়া গিয়েছিল সেই ডায়েরি ও পুরনো পাণ্ডুলিপি। মোমের আলোয় রিয়ার চোখ জ্বলছিল উত্তেজনায়। সে পুরুলিয়ার পুরনো থানার রেকর্ড ঘেঁটে এক অনুলিপি এনেছে—একটি নিখোঁজ ডায়েরি, বছর ১৯৭৮-এ লিখিত। তাতে নাম ছিল—মাধবী সেনগুপ্ত, ২৭ বছর বয়সী এক লেখিকা, শেষবার দেখা গিয়েছিল এই এলাকায়। তিনি নাকি কলকাতা থেকে এখানে এসেছিলেন “একজন প্রখ্যাত লেখকের আমন্ত্রণে”। আর তারপরই হঠাৎ নিখোঁজ। রিয়া বলল, “খেয়াল করো, তার পরিবারের কেউ কখনো অভিযোগও করেনি। পুরো ব্যাপারটা যেন চুপিসারে মুছে ফেলা হয়েছিল।” নির্জরের বুকটা ধক করে উঠল। তার দাদু অনিরুদ্ধ বসু, যাঁর কথা সে গল্প পড়ে জেনেছে, সেই সময় ঠিক এই কটেজেই আসতেন মাঝে মাঝেই লেখার জন্য। এবং আশ্চর্যজনকভাবে—১৯৭৮ সালেই হঠাৎ অনিরুদ্ধ বসুও লেখালিখি বন্ধ করে দেন, জনসম্মুখ থেকে অন্তর্ধান ঘটান।

রিয়া বলল, “তোমার দাদু আর মাধবীর মধ্যে কিছু একটা ছিল—হয়তো প্রেম, অথবা কোনও অসুস্থ নির্ভরতা। কিন্তু কেন সে নিখোঁজ হলো, কেন দাদু আর লিখলেন না, তার উত্তর হয়তো এই কটেজেই আছে।” নির্জর পাণ্ডুলিপির ভাঁজে লুকিয়ে থাকা কয়েকটি পুরনো ফোটোগ্রাফ খুঁজে পেল—একটি ছেঁড়া ছবি, যাতে দেখা যাচ্ছে এক নারী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, চোখে গভীরতা, হাতে খাতা। তার চোখ যেন কিছু বলছে, কিছু চেয়েছিল… ঠিক যেভাবে নির্জর রাতে অনুভব করে সেই শব্দগুলো। পেছনে পেন্সিলে লেখা নাম—“মাধবী, ৭৭”। এই সব কিছু ধীরে ধীরে মিলে যাচ্ছিল, যেমন ধাঁধার টুকরোগুলো একে একে জোড়া লাগে। রিয়া খাতা নিয়ে বসে বলল, “তুমি জানো এই কাহিনি শেষ না হলে, তার আত্মা এখানেই থাকবে। কেউ একজন চাইছে, তার কণ্ঠ পৌঁছাক পৃথিবীর কাছে।”

সেই রাতেই নির্জর লেখার টেবিলে বসে। তার মনে হচ্ছিল, কলমটা শুধু তার নয়, আর কারও হাতও যেন চালাচ্ছে তাকে। সে লিখতে লাগল—মাধবীর কণ্ঠে, মাধবীর ভাষায়। “আমি ভালোবেসেছিলাম এক লেখাকে, কিন্তু লেখকটি আমায় কখনো সম্পূর্ণ করেনি… তাই আমি অমর হয়ে রইলাম এক অসমাপ্ত গল্পের মতো।” বাতাসে হঠাৎ শীতলতা, জানালার ফাঁকে দেখা গেল সেই লাল শাড়ি পরা ছায়ামূর্তি, এবার আর ভয় জাগল না নির্জরের মনে—বরং করুণ এক অনুভূতি, যেন সে কারও জন্য দায়বদ্ধ। সেই রাতের শেষে, ঘুমের আগে রিয়া বলল, “তুমি জানো, তুমি শুধু উত্তরাধিকার নয়, তুমি হলো সেই শেষ পাঠক, যে এই গল্পটিকে ছাপা দিতে পারবে।” নির্জর বুঝল—মাধবী হারিয়ে যাননি, তিনি অপেক্ষা করছেন… তাঁর নামটা, তাঁর গল্পটা, যেন কেউ কাগজে ফিরিয়ে আনে। এখন সেই দায়িত্ব তার।

অধ্যায় ৭

কটেজের চারপাশ ঘিরে রাতের নীরবতা আরও ঘনীভূত হতে লাগল। নির্জর যখন ডায়েরির পাতাগুলো থেকে মাধবীর স্মৃতিচারণ পড়ছিল, মনে হচ্ছিল যেন অতীত থেকে এক অদৃশ্য কণ্ঠ তার কানে গুঞ্জরিত হচ্ছে—একটি মৃদু কাঁদার ফিসফিসানি। বৃষ্টির টিপটিপ শব্দের সঙ্গে মিশে ওই ফিসফিসানি যেন ঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নির্জরের ঘুম ভেঙে গেল বারবার; তার চোখের সামনে ঘোরাফেরা করছিল এক লাল শাড়ি পরা নারীর ছায়া, যার চোখে মিশে ছিল একটি দীর্ঘশ্বাস আর অবুঝ বেদনা। বারবার সে স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছিল—মাধবী বসে আছে, কাগজের পৃষ্ঠায় অক্ষরগুলো আঁকছে, কিন্তু তার হাত একবারও শেষ পাতায় পৌঁছায় না।

এক রাতে নির্জর গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠলেন—মেঝের ওপর পড়ে থাকা একটি আলপনার মতো দাগ যেন রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল, আর সেখানে অনুভব করল এক অদ্ভুত স্পর্শ, যা বাতাসের সঙ্গে মিশে মাধবীর অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছিল। সে দেখল, আলপনার মাঝখানে একটি ছোট্ট চিঠি, যেখানে লেখা ছিল—“আমার শেষ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় তুমি আছো।” নির্জর বুঝল, এটা শুধুই একটা গল্প নয়, এটি মাধবীর জীবনের প্রতিচ্ছবি, তার বেদনার চিহ্ন। সে আবারও তার কলম হাতে নিল, যেন নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটছে।

রিয়া তাকে বলল, “তুমি যে শুধু গল্পকার নও, তুমি মাধবীর শেষ ইচ্ছার ধারক।” নির্জর জানতে পারল মাধবীর মৃত্যু রহস্যময় ছিল—অথচ কিভাবে আর কেন সেটা কোনও সময়কার কাগজে লেখেনি কেউ। স্থানীয় লোকেরা আজও তার স্মৃতিতে কটেজের চারপাশে হাঁটে, কখনো কাঁদে, কখনো চুপ থাকে। নির্জর ও রিয়া একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন, মাধবীর কাহিনি যেন সবার সামনে আসে। কিন্তু তারা জানত, এই পথে তাদেরকে পুরনো ছায়া, অজানা ভয়ের মুখোমুখি হতে হবে—যে ছায়াগুলো রক্তের গন্ধের মতো কটেজে এখনও বাস করে।

অধ্যায় ৮

কটেজের দেয়াল থেকে শুরু করে মেঝে পর্যন্ত যেন অতীতের অন্ধকার ছায়া ঘন হয়ে উঠছিল। নির্জর আর রিয়া যখন মাধবীর গল্প খুঁটিয়ে দেখছিলেন, তাদের সামনে ক্রমশ জড়িয়ে আসছিল একটি বড় গোপনীয়তার আভাস। স্থানীয় এক বৃদ্ধ মিস্ত্রী থেকে তারা জানতে পারলেন, কটেজের আসল মালিক ছিলেন নির্জরের দাদু—অনিরুদ্ধ বসু। তিনি একজন বিখ্যাত লেখক, যার নামের আলোয় মাধবী এসেছিল এই জঙ্গলের গভীরে, তবে তার হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে অনিরুদ্ধ গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে।

তাদের সামনে আসা পুরানো কিছু কাগজপত্রে দেখা গেল, অনিরুদ্ধ বসু নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগে এক অদ্ভুত হুমকির মুখে পড়েছিলেন। একটি পত্রে লেখা ছিল, “যে সত্য আমি লিখতে যাচ্ছি, তা প্রকাশ পেলে অনেকের জীবন বিপন্ন হবে।” সেই সত্যের পেছনে লুকিয়ে ছিল মাধবীর রহস্যময় মৃত্যু এবং অনিরুদ্ধের গোপন জীবনের অন্ধকার দিক। নির্জর বুঝতে পারলেন, তার পরিবার এই সত্য ঢাকতে গিয়ে অনেক কিছু লুকিয়েছে, আর সেই চাপের ভার এই কটেজেই অদৃশ্য ছায়ার মতো ছড়িয়ে আছে।

রিয়া এবং নির্জর সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা এই গোপন রহস্য উদঘাটন করবেন। কিন্তু যত তারা গভীরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, ততই কটেজের বাতাস ভারী হতে লাগল রক্তের গন্ধে—যে গন্ধ এতদিন ধরে তাদের প্রতি নিশ্বাসে ভেতরে ঢুকে তাদের বাস্তব আর অতীতের মধ্যকার ফাঁক লম্বা করে দিয়েছে। অনিরুদ্ধ বসুর লেখা শেষ খাতাগুলো, মাধবীর ডায়েরি, আর কটেজের আঙিনা—সব মিলিয়ে যেন এক রহস্যময় সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। নির্জর জানতেন, এই সত্য উদঘাটনের পথে সে তার নিজের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চলেছে।

অধ্যায় ৯

নির্জর আর রিয়া যখন কটেজের নিচে থাকা সেই গহ্বরের দিকটা গভীরভাবে খুঁজতে লাগল, তখন রাতের নিস্তব্ধতা যেন আরও বিষাক্ত হয়ে উঠল। মাটির নিচ থেকে উঠে আসা গন্ধটা এতটাই প্রবল ছিল, যেন রক্তের অতীত একেবারে জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা খুঁজে পেল এক পুরনো সিন্দুক, যার পৃষ্ঠায় মাটি আর ধুলো জমে থাকলেও রক্তের দাগ এখনো ফিকে হয়ে দেখা যাচ্ছিল। সিন্দুকের ভিতরে ছিল একখানা লাল রঙের শাড়ি—যা মাধবীর ছিল বলে সন্দেহ করা হয়—সঙ্গে এক টুকরো ঝুরির মতো ছেঁড়া নথিপত্র আর একটা হাতের লেখা চিঠি।

চিঠিটাতে লেখা ছিল, “আমার গল্প শেষ না হলে, আমার আত্মা এই কটেজে বন্দী থাকবে। তোমার হাতে আমার কথা লেখো, শেষ করো আমার যন্ত্রণা।” নির্জরের চোখে জল এসে গেল। দীর্ঘদিন ধরে এক অসম্পূর্ণ জীবনের আক্ষেপ আর যন্ত্রণার কথা যেন এই কাগজে জমে আছে। গন্ধটা শুধু রক্তের নয়, বরং বঞ্চনা, বেদনা আর অপূর্ণতার মিশেল। সেই রাতে নির্জর ভাবতে লাগল, যে কাহিনী তিনি লিখছেন, তা শুধুই কথার খেলা নয়—এটা একটি আত্মার মুক্তির যাত্রা।

রিয়া বলল, “তুমি যখন এই গল্পটা শেষ করবে, তখনই তার আত্মা শান্তি পাবে, আর হয়তো আমরা সবাই।” নির্জর গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে কলম ধরল আবার—এবার আর ভয় পেল না, কারণ সে জানে, এই লেখাই মুক্তির পথ। সেই রাত কটেজের বাতাস থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই কাঁচা রক্তের গন্ধ, আর পরিবর্তে ছড়িয়ে পড়ল এক নতুন সূর্যের আশার কিঞ্চিৎ সুর। কাহিনী যা শুরু হয়েছিল রক্তের গন্ধ নিয়ে, শেষ হচ্ছে আলো আর মুক্তির গান নিয়ে—মাধবীর জন্য, নিজের জন্য, আর ভবিষ্যতের জন্য।

অধ্যায় ১০

কত রাত কেটেছে এই কটেজের ফাঁকা ঘরে, নির্জর বসু একটানা কলম চালিয়ে চলেছে, মাধবীর কাহিনি শেষ করার চেষ্টা করে। এখন আর কেবল একটি গল্প নয়, বরং এক জীবনের অধরা আত্মার মুক্তির সন্ধান। ডায়েরির শেষ পাতাগুলোতে তিনি লিখেছিলেন মাধবীর একান্ত আকুতি, তার ভালোবাসার গল্প, আর সেই বিষাদের কথা যা তাকে এখানেই আটকে রেখেছিল। নির্জর বুঝতে পারছিল, যে এই লেখালেখির মধ্যে দিয়ে মাধবীর আত্মা যেমন মুক্তি পাচ্ছে, তেমনি নিজেও মুক্তির পথ খুঁজছে—এক কঠিন অতীতের বোঝা ছেড়ে। বাতাসে আর নেই সেই তীব্র রক্তের গন্ধ; এখন সে শুধু মাধবীর কণ্ঠস্বরের সুর শুনতে পাচ্ছিল, শান্তির বার্তা নিয়ে।

এক সন্ধ্যায়, নির্জর যখন ডায়েরি খুঁটিয়ে দেখছিল, তখন জানালার বাইরে এক অদ্ভুত আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। হঠাৎ বাতাসে মাধবীর ফিসফিসানির মতন কণ্ঠ আবার শুনতে পেল, “ধন্যবাদ, তুমি আমার কথা লিখেছো।” নির্জর চোখ বন্ধ করে সেই কণ্ঠের গানের মতো সুরে নিজেকে হারিয়ে দিল। জানালার বাইরে গোধূলির আলো ভেসে আসছিল—একটা নিস্তব্ধ শান্তি কটেজের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারল, মাধবীর গল্প শেষ হয়েছে, তার আত্মা শান্তি পেয়েছে, আর এই স্থান আর অতীতের বোঝায় আবদ্ধ নেই। নির্জরের কলম থেকে অবশেষে নামল সেই শেষ বাক্য, যা শুধু একটি গল্প নয়, বরং এক জীবনের সত্যের সম্মান।

পরের সকালে রিয়া এসে কটেজে পৌঁছল, নির্জরের হাতে নিয়ে আসা সেই সম্পূর্ণ গল্পটি দেখে বলল, “এখন এই গল্পটাই সত্যিকারের মুক্তির চাবিকাঠি। এই কাগজে লেখা ক্ষমা মাধবীর জন্য, তোমার জন্য, আর এই কটেজের জন্য।” নির্জর আর রিয়া জানত, এই গল্প এখন আর শুধুই মাধবীর নয়—এটি এমন একটি ইতিহাস যা বাধাগ্রস্ত আত্মাগুলোকে মুক্ত করে, যারা হারিয়েছে তাদের কণ্ঠ। নির্জর শেষে বুঝতে পারল, কখনও কখনও অতীতের ছায়াগুলো আমাদের ছুঁয়ে যায়, কিন্তু সঠিক গল্পের মাধ্যমে আমরা তাদের আলোর পথ দেখাতে পারি। কটেজ থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ভর করে, জানিয়ে দেয় নতুন সূচনা, যেখানে রক্তের গন্ধের বদলে থাকবে মুক্তির সুবাস।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *