সিদ্ধাৰ্থ ঘোষাল
এক
দূর রাজস্থানের মরুপথ পেরিয়ে ড. সায়ন মিত্র সেই পরিত্যক্ত দুর্গে পৌঁছেছিলেন এক গ্রীষ্মসন্ধ্যায়, যখন সূর্যাস্তের আগুনে মিশে যাচ্ছিল বালি ও ইটের স্তম্ভ। চারপাশে ধ্বংসস্তূপের নীরবতা, কেবল মাঝে মাঝে বালুর ঝোড়ো বাতাসের শব্দ, আর পুরনো দরজার কঁকিয়ে ওঠা। এই দুর্গটি, লোকমুখে “রক্তবিন্দু মহল” নামে পরিচিত, মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পরিত্যক্ত হয়। স্থানীয় কাহিনি অনুসারে, এখানে রাজা বিক্রমসিংহের পুত্রবধূ প্রতিভাদেবী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে—তাঁর রক্তে ভেজা একটি নেকলেস আজও কোথাও লুকিয়ে আছে, এমনটাই দাবি করে লোককথা। কিন্তু সায়নের আগ্রহ রূপকথায় নয়—তিনি খুঁজছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ, ইতিহাসের দলিল। সঙ্গে ছিল তার পুরোনো খাতাগুলি, ক্যামেরা, এক বোতল জল আর অসাধারণ ধৈর্য। দুর্গের ভিতরের ঘরে পা রাখতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হল তার—ঘরের শীতলতা যেন অপ্রাকৃতিক। সব চেয়ে আশ্চর্যজনক, পাথরের মেঝের এক কোণে ধুলোর স্তরে হঠাৎই জ্বলজ্বল করে উঠল লালচে একটি ঝলক—একটি ভারী নেকলেস, রক্তমণি বসানো, যেন কারও শরীর থেকে খুলে রাখা হয়েছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে।
ড. সায়ন মিত্র ঝুঁকে পড়ে হাতে তুলে নিলেন নেকলেসটি। ঠান্ডা ধাতব স্পর্শে এক নিমেষে কেঁপে উঠল তার হাত, কিন্তু সে নিজের যুক্তিবাদে ভরসা রেখে নেকলেসটিকে পলিথিনে মুড়ে ব্যাগে রাখলেন। ঠিক তখনই দরজার বাইরের বাতাস থেমে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ—পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁর আওয়াজ, এমনকি বালির ছোঁয়াও গায়েব। কেমন যেন একটা ঘন অন্ধকার তাঁর মনের মধ্যে নেমে এলো। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হল—কেউ যেন তাঁকে লক্ষ করছে, দূর অতীত থেকে। সেই রাতে, গ্রামের অতিথিশালায় ফেরার পর সায়ন লক্ষ্য করলেন—নেকলেসের গায়ে সামান্য রক্তের দাগ, যা আগে চোখে পড়েনি। তিনি সেটিকে পরিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু যতই ধোয়ার চেষ্টা করেন, দাগ ততই গভীর হয়ে ওঠে। ঘুমানোর চেষ্টা করলেও নিদ্রা কিছুতেই আসে না। চোখ বন্ধ করলেই, এক নারীকণ্ঠ—গভীর, বিষাদময়—ফিসফিস করে বলে, “আমার রক্ত ফিরিয়ে দাও… আমার প্রতিশোধ এখনো শেষ হয়নি…”। ভোররাতে সায়ন আচমকা জেগে উঠে দেখলেন, ঘরের দরজা খোলা, আর পায়ের কাছে পড়ে আছে সেই নেকলেস—যা তিনি ব্যাগে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন।
পরদিন সকালেই তিনি ফিরলেন কলকাতায়, কিন্তু কিছুর যেন শেষ ছিল না। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর হাতে সেই নেকলেস দেখাতে গিয়েই অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটল। অদিতির চোখ স্থির হয়ে গেল অলংকারটার ওপর। “এটা আমি আগে দেখেছি…”—বলেই সে চুপ করে গেল। সায়ন ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তুমি তো কখনো রাজস্থানে যাওনি অদিতি, দেখেছ কী করে?” অদিতি কিছু না বলে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়ল, আর রাতের বেলা আচমকা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, “ও আবার ফিরে এসেছে… রানী প্রতিভা… আমি… আমি তো ও-ই!” সায়নের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। প্রফেশনাল জীবনের যাবতীয় যুক্তি, গবেষণা, প্রত্নতত্ত্ব যেন এই একটি অলংকারের মুখোমুখি হয়ে ধসে পড়ল। কলকাতার মধ্যবিত্ত অ্যাপার্টমেন্ট যেন রূপ নিচ্ছে এক অভিশপ্ত রাজপ্রাসাদে—যেখানে প্রতিটি দরজার ওপারে অতীতের আত্মা অপেক্ষা করে, আর প্রতিটি আয়নার মাঝে প্রতিফলিত হয় এক রক্তাক্ত ইতিহাস।
দুই
রাত তিনটেয় সায়নের ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ দরজার খোলা আওয়াজে। বিছানার পাশেই অদিতির জায়গাটা ফাঁকা, আর জানলার কাঁচে একবারে ঝুঁকে সে তাকিয়ে আছে বাইরে, মুখটা চাঁদের আলোয় ধরা পড়ছে—সাদা, নির্জীব, চোখ দুটি যেন জ্বলছে কোনো ভেতরের আগুনে। সায়ন ঘুমকাতুরে গলায় ডাকল, “অদিতি? তুমি জানলার ধারে কেন?” কিন্তু কোনো জবাব নেই। সে উঠে গিয়ে স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখতেই ঝটকা দিয়ে ফিরে তাকাল অদিতি—চোখে এমন এক দৃষ্টি, যেন সে ওকে চিনতে পারছে না। অদিতি ধীরে ধীরে বলল, “আমার অলংকারটা কোথায়? আমার রক্তের অলংকার…” সেই মুহূর্তে সায়নের শরীর বরফ হয়ে গেল। এ তার স্ত্রী নয়, এমন কারো গলা, যিনি শতাব্দী পেরিয়ে এসেছেন। পরক্ষণেই অদিতি কেঁপে কেঁপে পড়ে গেল মেঝেতে। সায়ন তাকে বিছানায় নিয়ে এলো, শরীরটা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ঠান্ডা। সকালে উঠে অদিতি কিছুই মনে করতে পারল না। শুধু বলল, “গতকাল রাতে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম—আমি একটা গহনার দোকানে ছিলাম, কিন্তু আমার গলা দিয়ে রক্ত ঝরছিল…”
ড. সায়ন মিত্র আর দেরি করলেন না। অলংকারটি সেই পুরনো কাঠের বাক্সে ভরে রাখলেন, এবং ফোন করলেন তার রাজস্থানি বন্ধু দিগ্বিজয় সিংহকে, যিনি একসময় দুর্গের লোকগাথা তাকে বলেছিলেন। ফোনের ওপাশে গলা শুনেই দিগ্বিজয় থেমে গেল, “তুমি সেটা নিয়ে এসেছ? বলেছিলাম না সায়নবাবু, ওটা একটা রক্তের শৃঙ্খল—যার এক প্রান্ত অতীতে, আর এক প্রান্ত ভবিষ্যতের মৃত্যুতে বাঁধা!” সায়ন যুক্তিবাদী হলেও এবার দ্বিধায় ভুগছিলেন। অলংকারটা রাখার পর থেকে অদিতির বদল, ঘরে হঠাৎ অদ্ভুত গন্ধ, রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান পাতলে শোনা যায় কারা যেন কাঁদছে, আর মাঝেমধ্যে ভেসে আসে রাজস্থানি সেতারের সুর—যা কোনো প্রযুক্তি দিয়ে বাজছে না, বাজছে বাতাসে, বাতাসের মনোলোকে।
পরদিন সন্ধ্যায় যখন সায়ন নিজের গবেষণার কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন, তখন অদিতি ধীরে ধীরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পড়ে। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে সে গলায় সেই অভিশপ্ত অলংকারটি পরে নিল—যেটি সায়ন চাবি দিয়ে তালা বন্ধ করেছিলেন কাঠের বাক্সে। সায়ন হঠাৎ সেই দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত—বাক্সটি ছিল তার ঘরের কাঁচঘেরা শোকেসে, আর চাবি ছিল পকেটে! তাহলে? “তুমি এটা খুললে কীভাবে?” অদিতি ধীরে ঘুরে তাকাল, এবার তার মুখে এক আলাদা মেজাজ—ভঙ্গিমায় আত্মবিশ্বাস, ঠোঁটে কিঞ্চিত বিদ্রূপ, আর চোখে এক রাজরানীর কঠোর দৃষ্টি। সে বলল, “এই অলংকার আমার রক্তে বাঁধা, তালায় কী হবে? তুমি কি জানো, আমি কতদিন ধরে ঘুমিয়ে ছিলাম?” এবং সেই মুহূর্তে ঘরের আলো হঠাৎ নিভে গেল। কাচের আয়নায় আর দেখা গেল না অদিতির প্রতিবিম্ব, শুধু ঝাপসা এক নারীমূর্তি—রাজসিক পোশাকে, গলায় রক্তবিন্দুর নেকলেস, আর ঠোঁটে ধ্বংসের এক গম্ভীর আহ্বান।
তিন
ড. সায়ন মিত্র বুঝে গিয়েছিলেন—এটা শুধুই ইতিহাস নয়, এটা এখন তার নিজের জীবনের অংশ, এবং হয়তো শেষ অধ্যায়। অদিতির চোখে প্রতিদিনই বদল আসছে। সে দিনে স্বাভাবিক থাকে, অদ্ভুত রকমের শান্ত ও সৌম্য; কিন্তু রাত গভীর হলেই তার ভঙ্গিমা পাল্টে যায়, এবং সে এমন সব কথা বলে যেগুলো শুধু রাজস্থানের রাজপরিবারের অন্তর্গত কারও জানা থাকতে পারে। এক রাতে, সায়ন তার স্টাডি রুমে অলংকারটি নিয়ে বসে ছিল, তখন অদিতি চুপিচুপি এসে দাঁড়াল দরজার ওপারে। বলল, “জানো, বিক্রমসিংহ আমাকে ভালোবাসত না। সে আমাকে উপহার দিয়েছিল এই অলংকার, কিন্তু তার ভেতর ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। আমি তাকে হত্যা করতে পারিনি, তাই নিজের রক্ত দিয়ে এই অলংকারে বন্দি করেছিলাম আমার কান্না। এখন আমি মুক্তি চাই… অথবা তোমার রক্ত।” এই কথার পর সায়নের হাত থেকে বই পড়ে গেল। তিনি ভাবলেন—এই অতীতের কাহিনি যদি সত্যি হয়, তবে তাঁকে ফিরে যেতে হবে সেই ইতিহাসে, যেখানে প্রতিভাদেবীর মৃত্যু হয়েছিল।
পরদিন তিনি ফোন করেন দিগ্বিজয় সিংহকে। দিগ্বিজয় সাফ জানায়, “প্রতিভাদেবী আত্মহত্যা করেননি, তাঁকে কৌশলে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছিল। অলংকারটি তিনি শেষ রাত্রে নিজের রক্তে রঞ্জিত করে দেবী চামুন্ডার প্রতিমূর্তিতে উৎসর্গ করেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—যতদিন না সত্য প্রকাশ পাবে, তার আত্মা এই অলংকারে বাস করবে, এবং যেই এটি ধারণ করবে, সে তার শরীর ধার দেবে আত্মাকে।” দিগ্বিজয় আরও বলে, “কেবলমাত্র পূর্ণিমার রাতে, চামুন্ডার পুরনো মন্দিরে এই অলংকার শুদ্ধিকরণ সম্ভব, কিন্তু তার আগে তোমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণভাবে অধিকার করে নেবে সে। সময় খুব কম, সায়নবাবু।”
সেই রাতে, সায়ন চুপচাপ লক্ষ্য করছিলেন অদিতিকে। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাজকীয় ঢঙে নিজের চুল বেঁধে নিচ্ছে, যেন সে এক রাজপ্রাসাদে প্রস্তুতি নিচ্ছে কোনো রাজসম্মেলনের। তার ঠোঁটে তখন এক রহস্যময় হাসি। হঠাৎ সে বলল, “তুমি জানো সায়ন, মৃত্যুরও একটা গন্ধ আছে। আমি যখন মরেছিলাম, আমার চারপাশে কেবল করুণা ছিল না, ছিল অবিশ্বাস, ঘৃণা… আর রক্ত। এবার আমি ফিরেছি, সত্য প্রকাশ করতে, আর কেউ বাঁচবে না।” কথাগুলো শেষ না হতেই ঘরের মধ্যে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। জানালার বাইরে বজ্রপাত, আর অদিতির চোখ দুটি জ্বলতে লাগল ঠিক আগুনের মতো—কোনো মানুষী নয়, যেন ভেতরে কেউ আরেকজন। সায়ন কাঁপা কণ্ঠে বলল, “তুমি প্রতিভা নও। তুমি অদিতিকে আঘাত করছো।” কিন্তু উত্তর এল না। শুধু আয়নায় প্রতিফলিত হল দু’টি সত্তা—একটি তার স্ত্রীর, আরেকটি ইতিহাসের এক অসমাপ্ত প্রতিশোধপরায়ণা আত্মার।
চার
কলকাতার ঘন শহুরে বাতাসের নিচে যেন এক অদৃশ্য মরুভূমির ধুলো ছড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে। সায়ন মিত্র জানতেন, আর সময় নেই। প্রতিভাদেবীর আত্মা প্রতিদিন অদিতির উপর আধিপত্য বিস্তার করছে, আর সেই প্রক্রিয়ায় তাঁর স্ত্রী যেন এক হিমশীতল আত্মহীন পুতুল হয়ে উঠছে। সেই বিকেলে তিনি শেষবারের মতো দিগ্বিজয়ের সঙ্গে কথা বলেন। দিগ্বিজয় জানায়, পূর্ণিমার রাত আর মাত্র তিন দিন পর, এবং রাজস্থানের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত প্রাচীন চামুন্ডা মন্দির—যেখানে কোনো গাড়ি পৌঁছয় না, সেখানেই রক্তের অলংকারকে শুদ্ধ করা সম্ভব। “তুমি যদি সময়মতো না পৌঁছাও, তবে সে শুধু অদিতিকেই নয়, তোমাকেও শেষ করে দেবে,”—ফোনের ওপাশ থেকে দিগ্বিজয়ের গলা কেঁপে উঠেছিল। সায়ন সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন। কিন্তু ঠিক সেই রাতেই কিছু একটার শুরু হল। মাঝরাতে আচমকা সে এক ভয়ানক দুঃস্বপ্নে আটকে গেল—নিজেকে দেখতে পেল এক রাজপ্রাসাদের প্রাচীন সভাকক্ষে, যেখানে এক নারী চিত্কার করছে, “ওরা মিথ্যা বলেছে! আমার গর্ভে ছিল উত্তরাধিকার, কিন্তু রাজা বিশ্বাস করেনি! ওরা সবাই মিথ্যাবাদী… সবাই মরুক!” পরক্ষণেই সেই নারীর গলায় অলংকার বাঁধা, আর রক্তের ছোপ ছড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। সেই নারী তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলছে, “তুমি কি জানো, সায়ন, আমি কতদিন ধরে তোমার ভেতরে ছিলাম?”
ঘুম ভাঙতেই দেখলেন—তার বুকের ওপর বসে আছে অদিতি, চোখ দুটি রক্তবর্ণ, ঠোঁট থরথর করছে, আর তার হাতে সেই অলংকার। সায়ন গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠতেই অদিতি অচেতন হয়ে পড়ে। ঘরজুড়ে কুয়াশার মতো কিছুর গন্ধ, যেন ধূপ, রক্ত আর পচা ফুলের মিশ্র গন্ধ। সায়ন তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন—এখনই রওনা দিতে হবে। তিনদিন নয়, যত দ্রুত সম্ভব।
দু’দিনের মধ্যে তিনি ও অদিতি পৌঁছালেন রাজস্থানে। দিগ্বিজয় তাদের তুলে নিল এক জিপে। কিন্তু মন্দিরের পথে ওঠার আগে দিগ্বিজয় সায়নকে সাবধান করল, “এই পথে একবার ঢুকলে, কোনো মোড় নেই। শুধু সামনে যেতে হবে। আর একটা কথা, প্রতিভা এখন পুরোপুরি জেগে আছে। অদিতি আর পুরোপুরি অদিতি নেই।” রাস্তা যতই এগোতে থাকল, গাছগুলো বদলে যেতে লাগল—সবুজ পাতার বদলে মরা ডালপালা, বাতাসে মৃত ফুলের গন্ধ, আর সেই সুর—বিষণ্ণ রাজসঙ্গীত, যেন আত্মার যন্ত্রণা সুরে বাঁধা।
চামুন্ডার প্রাচীন মন্দিরটি এক পাহাড়চূড়ায়, বহু শতাব্দী পুরোনো। সেখানে পৌঁছে তারা দেখতে পেল, মন্দির চত্বরে কোনো পুণ্যার্থী নেই, শুধু ভাঙা মূর্তি, আর রক্তের ছাপ পাথরের ফাঁকে ফাঁকে। সায়ন মন্ত্রোচ্চারণের ব্যবস্থা করছিলেন পুরনো পুঁথি থেকে, তখন হঠাৎ অদিতি ধীরে ধীরে এগিয়ে এল পাথরের চূড়ায়। তার চোখে এখন আর ভয় নেই—ছিল বিজয়ের দীপ্তি। সে উচ্চারণ করল, “এই মন্দিরেই আমার রক্ত ঢেলেছিলাম। এইখানেই আমি শপথ নিয়েছিলাম, যতদিন না আমার সত্যি প্রকাশ পাবে, আমি ফিরব বারবার, প্রতিটি শরীরের ভিতর দিয়ে।”
সে এগিয়ে গেল অলংকার হাতে নিয়ে চামুন্ডার ভাঙা প্রতিমার সামনে দাঁড়াল। আর তারপর…
প্রতিমার মুখ থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। বাতাসে শোনা গেল এক নারীর দীর্ঘশ্বাস, আর সায়নের পেছনে দাঁড়িয়ে দিগ্বিজয় ফিসফিস করে বলল, “শুরু হয়ে গেছে…”
পাঁচ
আকাশে পূর্ণিমার আলো ঠিকরে পড়ছে পাহাড়চূড়ার উপরে প্রাচীন চামুন্ডা মন্দিরে। বাতাস থমকে গেছে, যেন প্রকৃতিও থম ধরে অপেক্ষা করছে। সায়ন মন্ত্রপাঠ শুরু করেছেন, পুরনো পালি ও সংস্কৃত মিশ্র এক জটিল শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া, যা দিগ্বিজয়ের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে সংগৃহীত। পাথরের ভাঙা প্রাচীরের মাঝে প্রতিভার অলংকার রাখা, লাল কাপড়ে মোড়া। অদিতি—না, প্রতিভা—দাঁড়িয়ে আছে দেবীমূর্তির ঠিক সামনে, চোখে আগুনের লেলিহান ছায়া। তাঁর ঠোঁট নড়ে না, তবু বাতাসে শোনা যায় তাঁর কণ্ঠ: “এই মন্দিরই তো সাক্ষী ছিল আমার মৃত্যুর। তারা আমাকে বিশ্বাস করেনি। রাজা নিজেই গোপনে বিষ খাইয়ে দিয়েছিল, আর আমার রক্ত দিয়ে সাজানো এই অলংকার বানিয়েছিল এক নিষ্ঠুর প্রতীক। আমি এখন ফিরে এসেছি, এই অলংকারের সঙ্গে আমার আত্মাও বাঁধা। আমাকে থামাতে পারবে না, সায়ন!”
দিগ্বিজয় অল্টার ঘিরে গঙ্গাজল ও চন্দনের রেখা টেনে সুরক্ষা তৈরি করলেও প্রতিভার উপস্থিতি ধীরে ধীরে ছায়ার মতো এগিয়ে আসে। অদিতির দেহে দাঁতাল এক ছায়ারূপ—রাজসভার পোশাক, সোনার মাথার মুকুট, আর সেই অলংকার, যেটা এবার তার গলায় উঠে এসেছে নিজের থেকেই। হঠাৎ মন্দিরের প্রাচীন প্রাচীরে ফাটল ধরে, আর মেঝের নিচে গর্জে ওঠে কোনো গোপন গহ্বর। প্রতিমার পেছনের দেওয়ালে এক দরজা খুলে যায়, যেটি এতদিন ছিল ঢাকা ধুলোর স্তরে। সায়ন চমকে উঠে বলে, “এটা ইতিহাসে লেখা নেই… এখানে তো কিছু ছিল না!” দিগ্বিজয় থেমে যায়, জবাব দিতে পারে না—সে নিজেও কোনোদিন এমন কিছু জানত না।
অদিতি সেই খোলা দরজার দিকে তাকায়। তার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। সে বলে, “সেই ঘরেই আমার গোপন কক্ষ ছিল। সেখানে আমার সন্তান থাকার কথা ছিল। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি—বলেছিলাম, গর্ভস্থ সন্তান রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ। তারা আমাকে পাগল বলেছিল। আমি তার জন্যই ফিরেছি, সেই উত্তরাধিকার এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছে।” এই বলে সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। সায়ন এগিয়ে এসে বাধা দিতে গেলে প্রতিভার ছায়ারূপ ঠেলে দেয় তাকে, সে ছিটকে পড়ে যায় অল্টারের বাইরে, রক্ষারেখা ভেঙে যায়।
মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশে বাতাস ঘুরতে থাকে ঘূর্ণিঝড়ের মতো, দেবীমূর্তির চোখ দিয়ে অশ্রুর মতো রক্ত ঝরছে, আর সেই অলংকারে থাকা রক্তমণিগুলি তীব্র আলো ছড়াতে থাকে। সায়ন উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, “অদিতি, তুমি আমার স্ত্রী! তুমি প্রতিভা নও! তুমি লড়াই করো, তোমার ভেতরে এই অভিশপ্ত আত্মার বিরুদ্ধে।” এবং ঠিক তখনই, প্রতিভার চোখ কাঁপে। তার দেহ কেঁপে ওঠে। অদিতি যেন নিজের ভেতরে ফিরে আসার চেষ্টা করছে।
মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে এক প্রবল গর্জন ওঠে, আর খুলে যায় সেই গোপন কক্ষ—ভেতরে দেখা যায় একটি ছোট ছাইয়ের পালংক, আর তার পাশে একটি রুপার নেকলেস। প্রতিভার গলা থেকে অলংকার খুলে নিজে থেকে মেঝেতে পড়ে যায়। সে চিৎকার করে ওঠে—কান্না, ক্রোধ আর যন্ত্রণার এক মহাকাব্যিক সুরে: “আমার সন্তান… আমার প্রতিশোধ… এখন শেষ হোক!” তারপর সে ছুটে গিয়ে সেই রুপার নেকলেস হাতে নেয় এবং চিৎকার করে বলে, “এই হোক আমার মুক্তি!”
এক ভয়ঙ্কর আলোর বিস্ফোরণের মধ্যে প্রতিভার ছায়ারূপ মিলিয়ে যায়, অদিতি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মেঝেতে, আর অলংকার দুটি—রক্তের ও রুপার—গলে গিয়ে একধরনের ছাইয়ে পরিণত হয়। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কেবল শোনা যায় পূর্ণিমার রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, আর দূরের পাহাড়ে শকুনের ডাক।
ছয়
দিগ্বিজয় ও সায়ন যখন অদিতিকে ধীরে ধীরে মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বাইরে নিয়ে আসছিলেন, তখন পূর্ণিমার আলো তার মুখে পড়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল সে। চোখ খোলার মুহূর্তটা যেন শতাব্দীর ভার বহন করা ক্লান্তির মতো; তার চোখে বিস্ময়, ধোঁয়াশা, আর একটু যেন ভয়। সায়ন নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন আছো অদিতি?” অদিতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি… আমি স্বপ্ন দেখছিলাম… আমি এক রাজমহলে হাঁটছিলাম… কেউ যেন আমাকে বিশ্বাস করেনি… আমার গর্ভে সন্তান ছিল, কিন্তু সবাই বলছিল আমি পাগল।” তার চোখে জল এসে যায়। সায়ন বুঝে যায়, অভিশাপ হয়তো মুছে গেছে, কিন্তু প্রতিভার স্মৃতির ছায়া এখনো রয়ে গেছে অদিতির গভীরে।
ফেরার পথে দিগ্বিজয় বলল, “এই অভিশাপটা শুধু অলংকারে ছিল না সায়নবাবু, ছিল ইতিহাসে—বিকৃত, চাপা দেওয়া, ভুলে যাওয়া ইতিহাসে। প্রতিভাদেবীর সন্তানের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, আর সেই সন্তানের অস্তিত্ব নিয়েই আজও আছে কিছু ছায়া।” এই বক্তব্য সায়নের মনে এক নতুন প্রশ্ন উসকে দেয়: যদি সত্যিই সেই উত্তরাধিকার থেকে যায়, তবে তার রক্তসন্তান কোথায়? কি হয়েছিল তাকে নিয়ে? ইতিহাস কি এক নতুন অভিশাপের জন্ম দিয়েছে?
কলকাতায় ফিরে আসার পর অদিতি শরীরত ঠিক হলেও, মাঝেমধ্যে অজানা ভাষায় কথা বলে ওঠে। সে আয়নায় তাকিয়ে চুপ করে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যেন কারও অপেক্ষায়। একদিন সায়ন লক্ষ্য করল, সে পুরনো রাজবংশের কিছু বই পড়ছে—প্রতিভা দেবীর কালের খতিয়ান। “আমি এটা ভুলে যেতে চাই না,” অদিতি বলল, “তার কষ্ট শুধু অভিশাপ হয়ে থাকুক, আমি চাই ইতিহাসে তার কথা লেখা থাক।” তখনই সায়নের মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত জন্মাল—এই সত্যকে কেবল পারিবারিক অভিজ্ঞতা হিসেবে রেখে দেওয়া যাবে না। এটা ইতিহাসের অন্যায়। তিনি নিজের গবেষণাপত্র নতুনভাবে লিখতে শুরু করলেন: “The Blood Ornament: A Lost Royal Tragedy”। কিন্তু লেখা শুরুর অল্পদিনের মধ্যেই ঘটতে থাকে কিছু অদ্ভুত ঘটনা—একদিন অফিস থেকে ফিরে সায়ন দেখে তার ল্যাপটপে অজানা কেউ প্রবেশ করেছে, গবেষণার নথি মুছে গেছে, পিডিএফ ফাইলের জায়গায় শুধু একটা বাক্য দেখা যাচ্ছে: “বন্ধ করে দাও। অতীতকে জাগিও না।”
দিগ্বিজয়ের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করলে সে জানায়, “বিক্রমসিংহের বর্তমান বংশধর আজও বেঁচে আছে—বিজয় সিংহ নামের এক প্রাক্তন প্রতিরক্ষা অফিসার। সে এই কাহিনির সত্যি প্রকাশে বাধা দিয়েছিল বহুবার। কারণ প্রতিভার যদি সত্যিই সন্তান থাকত, তবে রাজবংশের উত্তরাধিকার দাবিতে তার সম্পত্তির মালিকানা বদলে যেত।” সায়নের গবেষণা হুমকির মুখে পড়ল। কে বা কারা চাইছে না এই কাহিনি ইতিহাসে জায়গা পাক? সেই রাতে সায়ন যখন বিছানায় বসে নোটস গুছাচ্ছিল, অদিতি এসে বলল, “আজ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম… কেউ একজন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বলছিল, ‘তুমি যদি চুপ করো, তবে ওর মৃত্যু হবে না…’ আমি জানি না কাকে বলছিল।”
সায়নের হৃদপিন্ড থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য। কাকে বলছিল? তাকে? অদিতিকে? নাকি ভবিষ্যতের সেই শিশুকে, যার রক্তে হয়তো আবার ফিরে আসবে এই অভিশপ্ত অলংকারের প্রতিশোধ?
সাত
রাজস্থান ফেরার সময় গাড়ির জানালা দিয়ে মরুভূমির দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল যেন সময় আবার উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে। সায়ন ও অদিতি এবার এসেছেন সরাসরি বিক্রমসিংহের উত্তরাধিকারী বিজয় সিংহের খোঁজে—যিনি এখন থাকেন রাজবাড়ির এক বিচ্ছিন্ন প্রান্তে, গার্ডদের দিয়ে ঘেরা প্রাসাদসম স্থানে, বহিরাগত প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখ উঁকি দিল সদর দরজার ওপর থেকে। একজন প্রবীণ দারোয়ান বলল, “মহারাজ কারও সঙ্গে দেখা করেন না। আপনারা ফিরে যান।” কিন্তু সায়নের হাতে ছিল সরকারি অনুমতিপত্র, এবং ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর জোরাল অবস্থান। অবশেষে রাজপ্রাসাদের দরজা খুলল—তবে অভ্যর্থনায় রাজকীয়তার চেয়ে বেশি ছিল গোপনীয়তা ও আতঙ্ক।
বিজয় সিংহ—৭০-এর কোঠায়, তীক্ষ্ণ চোখ, কড়া গলা, এবং গালজুড়ে গাঢ় সাদা দাড়ি। সে সায়নকে সামান্য উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখে বলল, “আপনি যা খুঁজছেন তা ইতিহাস নয়, কল্পনা। রাজপরিবারের ইতিহাস শুদ্ধ, কোনো প্রমাণ নেই প্রতিভাদেবীর সন্তান ছিল।” কিন্তু তার চোখের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল এক অস্বস্তি। সায়ন দৃঢ়ভাবে বললেন, “আপনার পূর্বপুরুষদের গোপন দলিল যদি সত্যিই ইতিহাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে, তাহলে তার খোঁজ আমরাও করব। কারণ ইতিহাস চাপা পড়লেও স্মৃতি মুছে যায় না।”
প্রাসাদের পুরনো পশ্চিম দিকটা ছিল পরিত্যক্ত—ছাদের ফাটল, ভাঙা মার্বেল, আর ধুলোপড়া চিত্রশালা। সেখানেই একদিন রাতে, গোপনে প্রবেশ করে সায়ন ও অদিতি দেখতে পেলেন প্রাচীন পেইন্টিংয়ের ভাঁজের মধ্যে একটি চিত্র—প্রতিভা দেবীকে আঁকা হয়েছে এক শিশুকে কোলে নিয়ে, এবং নিচে লেখা “অরক্ষিত উত্তরাধিকার”। সঙ্গে থাকা চামড়ার খামে একটি চিঠি—রাজার প্রধান পুরোহিতের হাতে লেখা, যেখানে পরিষ্কার বলা রয়েছে: “সোমবার ভোরে দেবীর গর্ভস্থ বংশধরকে সরিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছেন রাজা। শিশুটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হবে, কারণ তার অস্তিত্ব রাজ্যের স্থিতি নষ্ট করতে পারে।” এই তথ্য ইতিহাস পাল্টে দিতে পারে—প্রতিভার সন্তান সত্যিই ছিল!
পরদিন সকালে বিজয় সিংহের অফিস ঘরে আগুন লাগে। সে রাতে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে—পুরনো লাইব্রেরির কক্ষে থাকা সকল রাজকীয় নথিপত্র পুড়ে যায়। পুলিশ এসে দেখে, আগুনে শুধু একটি দেহ পুড়েছে—প্রবীণ রাজভৃত্য বিষ্ণু দাস, যিনি একমাত্র জানতেন গোপন দলিলের অবস্থান।
এবার অদিতি বলতে শুরু করে—“আমার মনে পড়ছে… বিষ্ণু দাস… ওই লোকটাই আমাকে তুলেছিল মন্দিরের পেছনের কক্ষ থেকে… আমি কান্না করছিলাম… আমার কোল খালি ছিল… ও বলেছিল, মা, আমি তোমায় ভুলতে দেব না…” সায়নের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা শীতলতা নেমে এলো। তাহলে অদিতির মনে ফিরে আসছে প্রতিভার স্মৃতি?
এবার তারা জানে—কে বা কারা চায় না এই সত্য সামনে আসুক। আগুন কেবল দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল সতর্কবার্তা। কিন্তু ইতিহাসকে আর থামানো যাবে না। প্রতিভার সন্তানের অস্তিত্বের প্রমাণ আছে, এবং সেই উত্তরাধিকার আজও বেঁচে থাকতে পারে—বাংলা বা রাজস্থানের কোনো গোপন কোণে।
তবে কে সেই উত্তরাধিকার? সে কি জানে নিজের অতীত? আর কে এই খুনের পেছনে? আগুনের ছায়া কি শুধুই প্রতীকি, নাকি এবার খুন শুরু হয়েছে…?
আট
কলকাতায় ফিরে আসার কয়েকদিন পর, এক অদ্ভুত ছেলেকে নিয়ে গল্প ছড়াতে শুরু করে তাদের পাড়ায়। ছেলেটি রাস্তার এক কোণে বসে থাকে, কারও সঙ্গে কথা বলে না, কখনও খালি কাগজে অদ্ভুত ঘূর্ণির মতো চিহ্ন আঁকে—যেটা আশ্চর্যভাবে মেলে সেই অলংকারের প্রাচীন নকশার সঙ্গে। অদিতি প্রথম তাকে দেখতে পায় ভোরবেলা, দোতলার বারান্দা থেকে। তার চোখ আটকে যায় ছেলেটির চাহনিতে—যেন সেই চোখ দু’টি সে কোথাও দেখেছে, বহু আগে, হয়তো কোনো আয়নায়, অথবা… কোনো স্বপ্নে। ছেলেটির নাম বলা হয় অনীক, বয়স আনুমানিক তেরো, এবং আশেপাশের লোকেরা জানায় সে “ঘরছাড়া” — মা নেই, বাবার পরিচয় অজানা, আর মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে রাজপাটের নাম জপে উঠে বসে পড়ে।
সায়ন প্রথমে গুরুত্ব দেননি। ভাবলেন এটাও হয়তো প্রতিভার স্মৃতির আতঙ্ক থেকে তৈরি কল্পনা। কিন্তু অদিতি দিন দিন ছেলেটির দিকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। একদিন নিজেই তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী আঁকো এসব?” অনীক মাথা না তুলেই বলল, “মা বলতেন এগুলো আমার রক্তের গল্প… আমি ভুলে গেছি, কিন্তু হাতে চলে আসে।” এই উত্তর সায়নের মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা স্রোত নামিয়ে দেয়। সে বাড়ি ফিরে এসে রাজকীয় বংশের দেহরেখা ও মুখাবয়বের মিল খুঁজে পায় অনীকের সঙ্গে। একটি পুরনো রাজপরিবারের ছবি, প্রতিভা দেবীর ছোট ভাইয়ের—অদ্ভুতভাবে অনীক তার মুখের অবিকল ছায়া।
এখন প্রশ্ন উঠল—অনীক কি সেই হারিয়ে যাওয়া রক্তরেখা? তার মা কে ছিলেন? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: যদি অনীকই সেই উত্তরাধিকার হয়, তাহলে কি অলংকারের অভিশাপ সত্যিই শেষ হয়েছে, না নতুন করে বাঁধা পড়তে চলেছে এই ছেলেটির রক্তে?
তখনই ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। একরাতে অনীক হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। তার জুতা ও আঁকার খাতা পড়ে থাকে রাস্তার ধারে। পেছনে দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা এক লাইন: “আমার রক্ত এখনো দাবি পূরণ করেনি।” সায়ন ও অদিতি ছুটে যায় পুলিশে, কিন্তু কোনো হদিস নেই। ঠিক পরদিন সকালে, মন্দিরে ফুল দিতে গিয়ে পুরোহিত এক শিশুকে দেখতে পায় চামুন্ডার মূর্তির পায়ে অচেতন হয়ে পড়ে আছে—সে অনীক, কপালে চন্দনের জায়গায় অলংকারের প্রতীক আঁকা, হাতে রক্ত। কে নিয়ে গেল তাকে সেখানে? কীভাবে সে পৌঁছাল সেই দুর্গম মন্দিরে?
সায়ন আর অদিতি বুঝতে পারে—প্রতিভার আত্মা নয়, এবার কাজ করছে রক্তের স্মৃতি। অভিশাপ হয়তো শেষ হয়েছে, কিন্তু তার রক্তরেখা আজও খুঁজে ফেরে বিচার, উত্তরাধিকার, ইতিহাস। সেই রাতেই অদিতি স্বপ্নে দেখতে পায়—এক গোপন রাজসভা, যেখানে একজন শিশু সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, বলছে, “আমার নাম রেখো না… আমি আর রাজা হতে চাই না… আমি শুধু মা চাই।”
অদিতি ঘুম ভেঙে ফিসফিস করে বলে উঠল, “সায়ন, এটা শেষ নয়। অনীক শুধু উত্তরাধিকার নয়… সে এক জীবন্ত স্মারক, যার মধ্যে ইতিহাস এখনো ধ্বনিত হয়। আমাদের কিছু করতে হবে।”
নয়
কলকাতার ঝিমঝিমে বর্ষার ভেতরেও যেন সায়ন মিত্র ও অদিতির আশপাশে ছড়িয়ে ছিল মরুভূমির শূন্যতা। অনীক এখন এক হাসপাতালের পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে, তার দেহে কোনো ক্ষত নেই, কিন্তু তার কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই। সে সারাক্ষণ জানালার বাইরে চেয়ে থাকে—যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে। সায়ন সমস্ত কাগজপত্র ঘেঁটে খুঁজে পেল যে অনীকের জন্ম একটি মিশনারি হাসপাতালে—বিক্রমপুর চ্যারিটি ক্লিনিক, রাজস্থানের এক প্রান্তে। মায়ের নাম অজ্ঞাত। ফর্মে মাত্র দুটো অক্ষর লেখা: “P.D.” অদিতি মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরল—P.D. মানে কি প্রতিভা দেবী?
সায়ন এবার নিশ্চিত হন, অনীক কারও সন্তান নয়, সে ইতিহাসের জ্যান্ত বহনকারী। তিনি তথ্য নিয়ে যখন প্রশাসনের কাছে যান, তখনই শুরু হয় আরেক স্তরের চক্রান্ত। কেস ফাইল “সিল করা হয়েছে” বলে জানানো হয়। কিছু অজানা মানুষ ফোন করে হুমকি দেয়, “আপনি ইতিহাস খুলছেন, কিন্তু কিছু দরজা বন্ধ থাকাই ভালো।” দিগ্বিজয়, যিনি এতদিন সাহায্য করছিলেন, এবার ফোন রিসিভ করাও বন্ধ করে দেন। এবং ঠিক সেই সময়ে ঘটে এক মৃত্যু—হাসপাতালের নার্স অঞ্জলি, যিনি অনীককে প্রথম ভর্তি করেন, তার মৃতদেহ পাওয়া যায় হাসপাতালের ছাদে। সাদা পোশাকে, কিন্তু গলায় বাঁধা রক্তরঙা সুতোয় ঝোলানো একটা ছোট্ট পেনডেন্ট—রক্তের অলংকারের প্রতিচ্ছবি।
এই মৃত্যু স্পষ্ট করে দেয়—কেউ অলংকারের শক্তিকে আবার জাগাতে চাইছে। অনীকের রক্ত চাই তাদের। রাতের অন্ধকারে সায়ন হাসপাতাল থেকে অনীককে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, গাড়ি চালিয়ে ছুটে যান রাজস্থানের সেই পুরনো চামুন্ডা মন্দিরের দিকে, যেখানে শেষবার অলংকার গলেছিল। এবারে শুদ্ধিকরণ নয়, এবারে সত্যের বিসর্জন—কারণ রক্তকে আর ধরে রাখা যাবে না।
মন্দিরে পৌঁছে দেখতে পান, কেউ একজন আগে থেকেই সেখানে। বিজয় সিংহ—রাজপরিবারের শেষ জীবিত উত্তরাধিকারী—তার হাতে পিস্তল। সে চিৎকার করে বলে, “আমি তোমাদের থামাব। আমার রাজ্য ইতিহাসে কলঙ্কিত হবে না। সেই মেয়েটি—প্রতিভা—এক লজ্জা ছিল। আমি তাকে মুছে ফেলেছি। তার ছেলেকেও মুছে ফেলব!”
সায়ন এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় অনীকের সামনে। বলে, “তুমি যাকে মুছে ফেলেছ, সে ইতিহাস নয়—সে রক্ত। আর রক্তকে চুপ করানো যায় না।” বিজয় গুলি চালাতে গিয়েও থমকে যায়। ঠিক তখন, হাওয়ার ঘূর্ণি উঠল মন্দিরের ভেতর। প্রতিমার চোখ দিয়ে রক্তবিন্দু পড়ে আবার। আর মাটির নিচে থেকে উঠে এল সেই গলে যাওয়া অলংকারের ছায়া, যেটি এইবার কারো গলায় উঠল না—এইবার সেটা গলে পড়ে গেল বিজয় সিংহের পায়ের কাছে, এবং সে চিৎকার করে ধসে পড়ে।
আলো নিভে যায় মন্দিরে। আর যখন আলো আসে, অনীক সামনে দাঁড়িয়ে। তার চোখে জল, সে বলে, “আমি রাজা নই। আমি বিচার চাই। শুধু মা চাই।” অদিতি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে, এবং বলে, “তুই যে রাজার রক্ত বইস, তার মানে এই নয় তোর জীবনও অভিশপ্ত হবে। আমি তোর মা হতে চাই।”
সে রাতে অলংকারের ছায়া চিরতরে গলে যায়, এবং প্রতিভা দেবীর আত্মা শেষবারের মতো বাতাসে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মিশে যায় নিস্তব্ধতার গভীরে।
দশ
এক বছর কেটে গেছে। দক্ষিণ কলকাতার শান্ত এক গলিতে, তিনতলার ছিমছাম এক ফ্ল্যাটে বসবাস করে এক অদ্ভুত পরিবার—ড. সায়ন মিত্র, তার স্ত্রী অদিতি, আর তাদের দত্তকসন্তান অনীক। স্কুলে অনীক এখন ইতিহাস ভালোবাসে, ছায়ার বদলে আলো আঁকতে শিখেছে, আর প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে মাকে বলে—“আজ স্বপ্নে রাজপ্রাসাদ দেখিনি।”
কিন্তু ইতিহাস কেবল অতীত নয়, সে প্রেত নয়—সে উত্তরাধিকার। একদিন ডাকবাক্সে আসে একটি সাদা খাম। কোনো প্রেরকের নাম নেই। ভেতরে এক পুরোনো চিঠি—রাজকীয় প্রিন্টে লেখা, মোমে মোড়া। অনীকের হাতে পড়ে সে চুপ করে যায় কিছুক্ষণ। তারপর সায়নের দিকে ফিরে বলে, “ওরা আমাকে ফিরিয়ে নিতে চায়। তারা বলছে, রাজবংশকে উত্তরাধিকার দরকার। আমিই নাকি শেষ উত্তরসূরি।” চিঠিতে লেখা:
“বিজয় সিংহের মৃত্যুর পর, রাজপরিবারের শূন্য গদিতে তোমার অধিকার স্বীকৃত। আমরা চাই তুমি ফিরে এসে ঐতিহ্য রক্ষা করো।”
অদিতি কাঁধে হাত রাখে অনীকের। বলে, “তুই কি যেতে চাস?”
অনীক মাথা নেড়ে না বলে। তারপর মৃদু হাসে। “আমি অলংকার নয়, আমি মানুষ হতে চাই। ইতিহাসের মালিক নয়, নিজের গল্পের লেখক হতে চাই।”
কিন্তু সেই রাতে, সায়ন নিজের ডেস্কে বসে দেখেন—চিঠির খামের ভেতরে কিছু একটা গড়িয়ে পড়েছে। তিনি তুলে নেন—একটি ছোট রক্তরঙা পাথর, যা দেখতে অবিকল সেই অভিশপ্ত অলংকারের মাঝের রক্তমণির মতো। তার গায়ের নিচে একটা লাইন খোদাই করা:
“রক্ত কখনো বিশ্রাম নেয়, হারায় না।”
সায়ন আলো নিভিয়ে দেয়। বারান্দা দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে অনীকের ঘরের ভেতর। জানালায় সে দাঁড়িয়ে, তার হাতে এখন সাদা কাগজ, আর সে আঁকছে—না, এবার রাজমহল নয়, আগুন নয়, অলংকার নয়। সে আঁকছে একটা গাছ… যার শিকড় গভীরে, আর ডাল ছুঁয়েছে আকাশ।
এবং গল্প শেষ হয় না—কারণ রক্তের অলংকার হারিয়ে গেলেও, ইতিহাসের অলংকার আজও কারও গলায় ঝুলে আছে… হয়তো আমার, হয়তো আপনার।
সমাপ্ত




