Bangla - ভূতের গল্প

রক্তাক্ত আলপনা

Spread the love

স্নিগ্ধা ঘোষাল


(১)

শালডাঙা—বাঁকুড়ার ভিতরের এক মাটির গ্রাম, যেখানে সন্ধ্যা নামে বেলাগাভরে, আর কুয়াশা নামে বাতাসে যেন জমাট বিষের মতো। গ্রামটা খুব বড় নয়, কুঁড়েঘর, পুকুর আর শিমুল গাছে ভরা এই জনপদে আধুনিকতার স্পর্শ এখনো খুব বেশি পড়েনি। গাঁয়ের মানুষজন এখনো চাঁদের গতিপথ দেখে দিন গোনে, আর নতুন চাঁদের রাতে হাত জোড় করে মাথায় দেয় পাতাবিহীন বেলপাতা। এই গ্রামে পূর্ণিমার রাত মানে এক অদ্ভুত গুমোট অনুভব—শব্দ নেই, কুকুর ডাকে না, শিশুরাও কান্না থামায়। ঠিক এমন এক পূর্ণিমা রাতেই মেঘ ফুঁড়ে আলো নেমেছিল গ্রামের এক কোণার পুরনো বাড়ির উঠোনে। কেউ ঠিক জানে না কখন শুরু হয়েছিল ওটা—তবে সকালের আলসে আলোয় দেখা গিয়েছিল এক বিশাল রক্তের আলপনা, যেটা মাঝখানে থেমে আছে, যেন আঁকিয়ে ফিরে আসবে পরে বাকি শেষ করতে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রথমে মজার গল্প ভেবে তাকিয়েছিল, কেউ কেউ পায়ে পায়ে গিয়ে উঠোনের ধারে দাঁড়িয়ে শিস দিয়েছিল—কিন্তু ধীরে ধীরে তারাও বুঝে গেল, কিছু একটা ঠিক নেই।

আলপনাটা ছিল অদ্ভুত—মাটির ওপর এক ঘূর্ণি আঁকা, চারদিকে শঙ্খের রেখা, মাঝে এক ফাঁকা বৃত্ত—যার মধ্যে মাটির রং লালচে, গাঢ় রক্তের মতন। আশপাশের মাটি শুকিয়ে গেছিল, কিন্তু ওই অংশটা ছিল ভেজা, যেন মাত্র কিছুক্ষণ আগেই কেউ রক্ত দিয়ে টেনে গেছে। তেজারাম, গ্রামের মোড়ল, প্রথম বলল, “এটা মেয়েদের হাতের কাজ। এই আলপনা, এই নিখুঁত টানা—এ শুধু চন্দ্রাবতীরই হাত হতে পারে।” তখনই সবাই থমকে যায়। কারণ চন্দ্রাবতী নামটা বহুদিন পরে কেউ উচ্চারণ করল। সে তো ছিল সেই পুরনো বাড়ির গৃহবধূ, যে হঠাৎ এক পূর্ণিমা রাতে নিখোঁজ হয়ে যায়—তার স্বামী ধনঞ্জয় জানায়, সে পালিয়ে গেছে। পরে শোনা যায় ধনঞ্জয়কেই পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে খুনের অভিযোগে। কিন্তু তখনো চন্দ্রাবতীর দেহ মেলেনি। উঠোন খোঁড়া হয়েছিল, কিছুই পাওয়া যায়নি—শুধু একটা পুরনো গয়নার বাক্স আর একজোড়া ছেঁড়া পায়ের নূপুর। তারপর থেকেই বাড়িটা বন্ধ। তার পর থেকে বছরের পর বছর কেটে গেছে, কিন্তু সেই বাড়িতে আর কেউ বসবাস করেনি। তবে গ্রামের বয়স্ক লোকেরা মাঝে মাঝে বলে—পূৰ্ণিমার রাতে সেই বাড়ির উঠোনে কে যেন হেঁটে বেড়ায়। কেউ দুচোখে দেখে না, কিন্তু কুকুরগুলো চিৎকার করে, পাখিরা গাছ ছেড়ে উড়ে যায়, আর বাতাসে এক গন্ধ ছড়ায়—কাঁচা রক্ত আর জ্বালা ধূপের মিশ্র এক সুরভি।

সে রাতে, যখন আবার পূর্ণিমা উঠেছিল, তখন গ্রামের শেষপ্রান্তের খেলার মাঠে কিছু ছেলে আড্ডা মারছিল। তাদের মধ্যে ছিল রণ, বারো বছরের কিশোর, যার চোখে কৌতূহল আর বুকজুড়ে সাহস। সে বন্ধুরা ফিরলে একা পেছনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পুরনো বাড়িটার পাশে আসে। সে দেখতে পায় বাড়িটার দরজা বন্ধ, জানলার ফাঁক গলে আলো পড়ছে উঠোনে। সে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দেখল—একজন নারী, ধবধবে ধূসর শাড়ি পরা, মাথায় খোলা চুল, পিঠ ঘুরিয়ে বসে রয়েছে, আর হাতের আঙুল দিয়ে রক্ত টেনে টেনে কিছু একটায় নিপুণভাবে আঁকছে। আশ্চর্যজনকভাবে, নারীটি রক্ত নিচ্ছে একটি ছোট পাত্র থেকে, কিন্তু পাত্রের উৎস বা কোথা থেকে এসেছে, বোঝা যাচ্ছে না। তার পায়ে চেন বাঁধা, কিন্তু হাঁটার শব্দ নেই। রণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু একটা শুকনো পাতার ওপর পা পড়তেই পেছন ফিরে তাকায় সেই নারী। তার চোখদুটি ঠিক যেন আগুন—উজ্জ্বল কিন্তু শীতল। রণ আর কিছু না ভেবে ছুটে পালায়, আর পরদিন সকালে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে যায় সেই কথা। কেউ বিশ্বাস করে না প্রথমে, ভাবে হয়তো কিশোরের কল্পনা। কিন্তু সকালবেলায় যখন বাড়ির উঠোনে সেই অর্ধেক আঁকা রক্তাক্ত আলপনা আবারও দেখা যায়—তখন কেউই আর মুখ খুলে হাসে না। গ্রামের পুরোহিতও বলেন, “যে চলে যায়, সে যদি অসম্পূর্ণ কিছু ফেলে যায়—সে ফিরে আসে। চন্দ্রাবতী এখনো তার কাজ শেষ করেনি।” পূর্ণিমার আলো যেন আর উজ্জ্বল নয়, বরং একটা অস্পষ্ট কুয়াশায় ঢাকা, আর চন্দ্রাবতীর নাম আবার ফিরে আসে লোকের মুখে, ফিসফাসে, থেমে থেমে। ঘর থেকে বেরোনো মায়েরা এখন পূর্ণিমার রাতে সন্তানদের জোর করে আগেই ঘরে ডেকে নেয়। আর বাড়িটার পাশে কেউ থামে না। শুধুমাত্র একটি বিষয় সবাই খেয়াল করে—প্রতি পূর্ণিমার পরদিন সেই আলপনাটা একটু একটু করে সম্পূর্ণ হচ্ছে। আর তার মাঝে, সেই ফাঁকা বৃত্তটা—দিনকে দিন বড় হচ্ছে।

(২)

চন্দ্রাবতীর বাড়িটার সামনে দিয়ে দিনের আলোয় হেঁটে যাওয়াটা একরকম সাহসিকতার পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়িটা দেখতে যতটা ভাঙাচোরা, ভেতরের নিস্তব্ধতা যেন ততটাই কানে বাজে। দিনের বেলায় বাড়ির চারপাশে শুধু শিমুলগাছের ছায়া পড়ে—ঝরা পাতায় চাপা পড়ে থাকে ধুলো আর গন্ধ। কিন্তু সন্ধ্যার পর সেই বাড়ি যেন নিজের ছায়া নিজেই গিলে নেয়। গ্রামের বৃদ্ধারা বলে, “ও ঘরের ভিতর দিন-রাত্রি একরকম। যত আলো ঢুকুক বাইরে থেকে, ভেতরটা কালোই থাকে।” চন্দ্রাবতীর ঘর যেন কেবল মৃত স্মৃতির ঠাঁই নয়, বরং জীবিত কোনো ছায়ার খাঁচা। এমনকি গরু-ছাগলরা পর্যন্ত ঘরের পাশে এসে দাঁড়ায় না। একবার এক প্রতিবেশী, হারাধন চাচা, একরাতে সাহস করে উঠোনে ধূপ দিতে গেছিলেন—বলেছিলেন, “যা আছে থাকুক, আমি পবিত্র করে দেব।” পরদিন তাকে পাওয়া গিয়েছিল নিজের ঘরের কোণে, মুখে কালীচরণ মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে, চোখ স্থির, মুখ ফ্যাকাশে। তার পর থেকে কেউ আর এ নিয়ে কথা বলেনি।

রণ প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে নিজের দাওয়ায় বসে থাকত, চুপচাপ দেখত বাড়িটার দিকে। তার ভিতরে ভয় যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিস্ময়। সে বুঝতে পারত, কিছু একটা বাড়ির ভেতর আছে—কিন্তু সেটা মানুষ নয়, আর স্রেফ ভূতও নয়। সে একদিন সাহস করে বাড়ির পেছনের গলিপথে ঢুকে যায়। ধূলায় ঢাকা জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে সে দেখে এক পুরনো কাঠের টেবিল, যার ওপর আছে ছোট একটি আয়না, আর তার পাশে রাখা এক পোড়া প্রদীপ। ঘরের মেঝেতে এক কোণায় জমে থাকা কালি আর রক্তের দাগ মিলেমিশে এক অদ্ভুত ছোপ তৈরি করেছে। জানালার ফ্রেমে গাছের শিকড় উঠে গেছে, কিন্তু এক জায়গায় সেই শিকড় থেমে গেছে—ঠিক যেখানে চন্দ্রাবতীর বিছানা ছিল একসময়। রণ শুনতে পায়, যেন কেউ ধীরে ধীরে গান গাইছে—একটা পুরনো শ্যামাসঙ্গীত, “কালী আমার মায়ের নাম…”। কোনো শব্দ নেই আশেপাশে, কেবল সেই গান। হঠাৎ জানালার কাচে রণ দেখতে পায়—আয়নার সামনে এক মেয়ে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। তার শাড়ি ধূসর, আর পিঠের নিচ অবধি লম্বা চুল ঝুলে পড়ে আছে। সে রণকে দেখতে পায় না, কেবল নিজের কাজ করে যাচ্ছে নিঃশব্দে, যেন কেউ তার চুল টেনে নিচ্ছে অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে।

গ্রামে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে, সেই বাড়িতে কেউ আবার থাকছে। কেউ বলে, চন্দ্রাবতী নাকি মরেনি—সে নিজের মৃত্যুকে ঢেকে রেখেছে কালো রাতের পেছনে। কেউ বলে, সে আসলে এখন অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ছায়া। কিছু গ্রামবাসী পূর্ণিমার আগের দিন গিয়ে দেখেছে, বাড়ির দাওয়ায় পায়ের ছাপ—ছোট ছোট, একজোড়া, আর একজোড়া বড়, যেন কেউ এসেছে, আর কেউ তাকে অনুসরণ করেছে। কেউ আবার বলে, সেই বড় ছাপটি ধনঞ্জয়ের—যে জেলে থাকার নাম করে আসলে পালিয়ে ছিল অন্য জেলায়। আর চন্দ্রাবতী? সে কি ফিরেছে প্রতিশোধ নিতে? নাকি নিজেই তার ছায়া হয়ে গেছে? রণ তখনো জানত না, তার কৌতূহল তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। তবে সেইদিন সন্ধ্যেয়, ঘরে ফেরার পথে সে আবার তাকায় সেই জানালার দিকে। সে দেখতে পায় জানালার ফ্রেমে হঠাৎ যেন লেখা হয়ে গেছে রক্তে—“আমার গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।”

(৩)

পূৰ্ণিমার পরদিন সকালে গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে কান্নাকাটি শুরু হয়েছিল গব্বর শেখের গিন্নির। তার দুধেল গাই, যেটাকে সে সন্তানের মতো দেখাশোনা করত, রাতের বেলা খোঁয়াড় থেকে উধাও হয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজি, ঝগড়া-বিবাদ, শেষে মোড়ল ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু কিছুই বেরোয় না। পায়ের ছাপ গিয়ে থেমে যায় চন্দ্রাবতীর বাড়ির উঠোনের আশেপাশে। এরকম নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা সেই প্রথম নয়। এর আগেও দুই ছাগল, এক হাঁসের ঝাঁক, আর একবার তো গোটা বাচ্চা ছানার দল—সব যেন মাটি খেয়ে ফেলেছে কেউ। লোকেরা বলেছিল শেয়াল, কেউ বলেছিল চোর। কিন্তু এবার গরু! আর গরুর পায়ের ছাপ গিয়ে থেমেছে যেখানে, সেখানে মাটি রক্তিম। পুরনো কালি আর শুকনো রক্তে জমে আছে আলপনার ধারে এক ফাটল, যেখানে যেন তাজা কিছুর গন্ধ লেগে আছে।

তবে শুধু পশু নয়, প্রকৃতিও যেন ধীরে ধীরে চঞ্চল হয়ে উঠছিল। চন্দ্রাবতীর বাড়ির উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল শিমুলগাছটা একরাতে হঠাৎ করে শুকিয়ে গেল। পাতা সব ঝরে গেল, ডালগুলো কুঁকড়ে মরা কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে রইল। গাছটা ছিল শতবর্ষ পুরনো, যার ছায়ায় কখনও পূজো হত, কখনও বিয়ের অনুষ্ঠান। এখন সেখানে বসে কাক আর শকুন। গ্রামের পন্ডিত বললেন, “গাছ প্রাণ পায় আশীর্বাদে। অভিশাপে গাছও মরে যায়।” কেউ বলল, “এই গাছের শিকড়ে পুঁতে রাখা হয়েছিল ধনঞ্জয়ের দোষ ঢাকতে—চন্দ্রাবতীর শেষ চিহ্ন হয়তো!” রণ একদিন সাহস করে শিমুলগাছের নিচে গিয়ে দেখে, গাছের গুঁড়িতে কেউ খোদাই করে রেখেছে কিছু চিহ্ন—ঠিক সেই অর্ধেক আলপনার মতো, যেটা চন্দ্রাবতীর উঠোনে আঁকা হচ্ছে। কিন্তু গাছের ছায়া যখন পড়ে বিকেলে, সেটা গিয়ে পড়ে রক্তাক্ত আলপনার মাঝখানে—যেন গাছ আর উঠোন এক সুতায় বাঁধা।

এই ঘটনার পর থেকে গ্রামের মধ্যে একটা নিঃশব্দ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ছোট বাচ্চারা আর একা মাঠে খেলে না। মায়েরা সন্ধ্যা হতে না হতেই দরজা বন্ধ করে দেয়। আর পূর্ণিমা যত এগিয়ে আসে, বাড়ির আশপাশে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে—একটা পচা ফুল, ধূপ, আর কাঁচা মাটির গন্ধ। রণ লক্ষ করে, চন্দ্রাবতীর ঘরের দরজাটা যেন একটু বেশি খোলা থাকে এসব দিন। জানালার পর্দা না থাকলেও বাতাসে কখনও তা নড়ে না। আর প্রতিটি পূর্ণিমার পরদিন সকালে আলপনার কেন্দ্রের ফাঁকা বৃত্তটা একটু করে বড় হয়ে যায়। কেমন যেন খিদে আছে ওই বৃত্তের—যেটা প্রতিটি প্রাণ খেয়ে নিজেকে পূর্ণ করছে। রণ তখনো জানত না, সেই ফাঁকা বৃত্ত একদিন তাকে নিজের মধ্যেই টেনে নেবে।

(৪)

কলকাতার ‘চোখে দেখো’ নামের এক ডকুমেন্টারি চ্যানেলের অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোহিণী পাল প্রথমবার চন্দ্রাবতীর গল্প শুনেছিল এক বন্ধুর মুখে, সিম্পোজিয়ামে, কফি খেতে খেতে। বন্ধুটি বলেছিল—“তোর ভূতের গল্পের শখ থাকলে বাঁকুড়ার শালডাঙা গিয়ে আয়, সেখানে নাকি এক মৃত গৃহবধূ রক্ত দিয়ে আলপনা আঁকে!” তখনো রোহিণী হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল ব্যাপারটা, কিন্তু কয়েকদিন পর গুগলে সার্চ করতে গিয়ে যখন সে খুঁজে পেল শালডাঙা গ্রামের খবর, ধনঞ্জয় মণ্ডলের বিচার সংক্রান্ত পুরনো আদালতের নথি, আর স্থানীয় একটি পোর্টালে ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীর সাক্ষাৎকার—তখন তার মধ্যে কাজ করল সেই পুরনো চেতনা, যে চেতনা তাকে একদিন সাংবাদিকতা পড়তে বাধ্য করেছিল। সে ব্যাগ গুছিয়ে, ক্যামেরা-ড্রোন-মাইক্রোফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাঁকুড়ার দিকে, সঙ্গে তার সহকারী মধু। বাস থেকে নামার পর প্রথমেই সে চোখে পড়ে সেই পাথুরে মাটি, বিশাল গাছের ছায়া, আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা—যেটা গ্রামের আয়ু মেপে দিতে পারে যেন।

রোহিণী শহরের মেয়ে—যুক্তিবাদী, চৌকস, সাহসী। সে স্থানীয় হোমস্টেতে উঠেই পরদিন সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করল গ্রামের লোকদের। কিন্তু সবাই কেমন যেন মুখ লুকিয়ে রাখে, ফিসফিস করে, চোখে ভয়। কেউ ঠিক করে কথা বলে না। কেবল এক বৃদ্ধা বলেছিলেন, “ও মরা নয় মা, ও ফিরে এসেছে অসমাপ্ত নিয়ে। তুমি যদি ওর গল্প খুঁজতে চাও, আগে নিজে খুঁজে নিও—তুমি কতটা বাঁচতে চাও।” রোহিণী প্রথমে ভেবেছিল, এসব কুসংস্কার। সে সন্ধেবেলা সাহস করে চন্দ্রাবতীর বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায়, ক্যামেরা চালু করে ড্রোন ছেড়ে দেয় বাড়ির ওপরে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই তার ক্যামেরা হঠাৎ ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়—স্ক্রিন কাঁপতে থাকে, একটা বিকট শব্দ ওঠে ইয়ারফোনে—ঠিক যেন কারো ফিসফিস করা: “তুমি কেন আমার উঠোনে এসেছো?” মধু ভয়ে ক্যামেরা ফেলে দেয়, রোহিণী নিজেও খানিকটা থমকে যায়, কিন্তু তখনো দমে না। পরদিন সকালে তারা বাড়ির চারপাশে চিহ্ন খোঁজে, কিছু অদ্ভুত ছাপ দেখে—যেন পায়ের নয়, বরং কারো হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি।

রোহিণীর আগমন গ্রামের নিঃশব্দ ভয়ে এক কাঁপুনি ধরায়। গ্রামের মোড়ল তেজারাম তাকে সরাসরি বলেন, “আপনি বাইরে থেকে এসেছেন, কিন্তু সবকিছু যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় না। চন্দ্রাবতীর উঠোনে যা আঁকা হচ্ছে, তা রক্ত নয়—অভিশাপ। সে আঁকছে, যতক্ষণ না শেষ হয়, সে থামবে না। আপনি ক্যামেরা নিয়ে যা ইচ্ছা করুন, কিন্তু যখন ফ্রেমে নিজেকে দেখবেন না—তখন বুঝবেন, আপনি গল্প লিখতে আসেননি, আপনি গল্পে ঢুকে পড়েছেন।” রোহিণী প্রথমবার একটু থমকে যায়। রাতে হোমস্টের ঘরে বসে রেকর্ডিং চেক করতে গিয়ে সে দেখতে পায়, ড্রোনের ক্যামেরা থেমে যাওয়ার আগে এক পলকের জন্য ফুটে উঠেছিল একটি মুখ—চুলে ধুলো, চোখে আগুন, ঠোঁটে অর্ধেক হাসি। কিন্তু সেই ফ্রেমে তার পাশে মধু ছিল না, কেউ ছিল না—তবু ক্যামেরা রেজিস্টার করেছে দুটি ছায়া।

(৫)

রোহিণী বেশ কয়েকদিন ধরে গ্রামে থেকে বিভিন্ন সূত্র জোগাড় করছিল, প্রতিটি পূর্ণিমার আগে ও পরে উঠোনে হওয়া আলপনার ছবি তুলছিল, এবং তার মধ্যে একটি প্যাটার্ন খুঁজে পেয়েছিল—যে ফাঁকা বৃত্তটি প্রথমে ছোট ছিল, সেটি ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে, কিন্তু শুধু আকারে নয়, বরং ঘনত্বে ও গভীরতায়। যেন মাটি ফুঁড়ে কিছু একটার শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা চলছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার সরাসরি সেই উঠোন খুঁড়ে দেখতে হবে—যেখানে একসময় চন্দ্রাবতীর দেহ গুম করার সন্দেহ ছিল। স্থানীয় এক কুমোর, বিটু, যার হাত মাটি চিনতে পারে, তাকে সঙ্গে নিয়ে আসে রোহিণী। প্রথমে কেউ সাহস করে না, কিন্তু মোড়ল নিজেই বলেন, “জেনে নাও, আর লিখে যাও—নইলে এই অভিশাপ ছড়িয়ে পড়বে।” রোহিণী ও বিটু রাতে, পূর্ণিমার ঠিক আগের দিন, যখন চন্দ্রাবতীর উপস্থিতি কম অনুভূত হয়, তখন শুরু করে খোঁড়া।

প্রথমে উঠে আসে পাতলা মাটি, তারপর কিছু পুরোনো পোড়া কাঠের টুকরো, ধূপের ছাই, ও একটি ভাঙা সিঁদুরের ডিব্বা। বিটু বলে ওঠে, “এই সব হোমযজ্ঞের জিনিস। কেউ হয়তো পাপ ঢাকতে ব্যবহার করেছিল।” তার পরেই একদম মাটি শক্ত হয়ে যায়—এক অদ্ভুত ধাতব স্তর। বিটু ও রোহিণী মিলেই সেটা সরিয়ে ফেলতেই উঠে আসে চন্দ্রাবতীর গয়নার বাক্স—যেটা বহু আগে খোঁজে পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু তখন বন্ধ অবস্থায় ছিল। এবার সেটা খুলে যায় একাই—ভেতরে রক্তমাখা চুড়ি, এক টুকরো শাড়ির আঁচল, আর একটি ছেঁড়া চিঠি। রোহিণী হাতে তুলে নেয় চিঠিটা—অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা ছিল: “আমার দোষ কি? আমি তো শুধু একটা সন্তান চেয়েছিলাম। আমি তাকে ডাকিনি। সে নিজেই এসেছিল আমার কোলে, কালী মা সাক্ষী। তবু ধনঞ্জয় বলল, আমি অপবিত্র… ও বলল, এই সন্তান নাকি আমার নয়।”

চিঠির নিচে দাগ আছে—লাল কালির মতো, কিন্তু শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তেই বাতাস থেমে যায়, যেন চারদিক চুপ। হঠাৎ উঠোনের চারদিকে ঘূর্ণি শুরু হয়—পাতা উড়ে যেতে থাকে, ধুলো ঢুকে পড়ে চোখে। রোহিণী অনুভব করে, মাটি যেন কাঁপছে তার পায়ের নিচে। ঠিক তখনই একটা গর্ত তৈরি হয় সেই বৃত্তের মধ্যে—যেখান থেকে উঠে আসে এক ঠান্ডা বাতাস, আর সেই বাতাসে ভেসে আসে গান—“আমার মায়ের দুয়ারে আমি, ফিরে এসেছি গান গাইতে।” বিটু ভয়ে পালিয়ে যায়, কিন্তু রোহিণী দাঁড়িয়ে থাকে। সে স্পষ্ট দেখে, সেই গর্তের ভেতর থেকে কেউ তাকিয়ে আছে তার দিকে—না পুরুষ, না নারী—একটি রক্তাক্ত মুখ, চোখের বদলে ফাঁকা গহ্বর, আর ঠোঁট নড়ে না, তবু কথা হয়: “তুমি কি আমার কাহিনি শেষ করতে এসেছ?” রোহিণী শিউরে ওঠে, কিন্তু ক্যামেরা চালিয়ে দেয়—কিন্তু স্ক্রিনে কিছুই নেই, কেবল নিজের প্রতিচ্ছবি, তার ঠিক পেছনে এক ছায়া।

(৬)

সেই রাতে, কাঁপা হাতে টর্চ হাতে রোহিণী পৌঁছেছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে, যেখানে বাঁশঝাড় পেরিয়ে ছোট একটা কুঁড়েঘরে থাকেন বিমলা পিসিমা—গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ নারী, যিনি নিজে চোখে দেখেছিলেন চন্দ্রাবতীর বিয়ের দিন, স্বামীর অত্যাচার, এবং সেই শেষ রাতের ধোঁয়াশা। পিসিমা প্রথমে কথা বলতে চাইলেন না। তার চোখে ছিল ভয়, ঠোঁটে কান্না চেপে রাখা অভিমান। কিন্তু রোহিণী চুপচাপ তার হাতে ধরিয়ে দিল সেই ছেঁড়া চিঠিটা—যেটা উঠোনের নিচে পাওয়া গিয়েছিল। পিসিমা চিঠির লেখাটা একঝলকে চিনে ফেললেন। তাঁর গলা কেঁপে উঠল—“ওর হাতের লেখা… চন্দ্রার… ও চিঠিটা আমাকে দিয়েছিল, কিন্তু আমি রাখতে পারিনি। ভয় পেয়েছিলাম।” তিনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, আর রোহিণী রেকর্ডিং চালিয়ে সেই কাঁপা গলায় এক জীবন্ত ইতিহাস রেকর্ড করতে থাকল।

পিসিমা বললেন, “চন্দ্রাবতী বউ হয়ে এসেছিল যেমন মাটি হয়, তেমন—চুপচাপ, শান্ত, মাথা নিচু করে। ধনঞ্জয় ছিল উগ্র, সন্দেহপ্রবণ, আর সর্বক্ষণ ‘গরু যেমন বাধা থাকে খুঁটিতে, বউও তেমন বাধা থাক’—এই ভাবনায় বিশ্বাসী। চন্দ্রা ঘরে থেকেও জানলা দিয়ে আকাশ দেখত। সন্তান না হওয়ায় ধনঞ্জয় ওকে অপবাদ দিতে লাগল। তারপর… একদিন, এক পূর্ণিমা রাতে, চন্দ্রা কালী মায়ের পূজা করছিল উঠোনে। কে জানত, সেই রাত্রেই তার জীবনের শেষ আর অন্যরকম শুরু হবে? সে রাতেই, আমি কুয়োর ধারে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম ওদের চিৎকার—ধনঞ্জয় বলছিল, ‘তুই ডাইনি! তুই শ্মশান থেকে ডেকে এনেছিস এই পাপ!’” পিসিমার চোখ ছলছল করছিল তখন। তিনি বললেন, “আমি ছুটে এসেছিলাম, কিন্তু তখন দরজা বন্ধ। আমি কেবল শুনেছিলাম, ‘আমি নিজেকে দেব কালী মাকে, তিনি বিচার করবেন!’ তারপর আর কিছুই না। পরদিন ধনঞ্জয় বলে—চন্দ্রা চলে গেছে। সে পালিয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম, মেয়েটা নিজের পায়ের আওয়াজ রেখে যায়। সেই আওয়াজ এখনো আমি শুনি—পূর্ণিমার রাতে… ও জানলা দিয়ে চুল আঁচড়ে।”

রোহিণী বুঝতে পারে, এই পিসিমা ছিলেন একমাত্র সাক্ষী, যিনি সত্য জানতেন, কিন্তু মুখ বন্ধ রেখেছিলেন ভয়ে। পিসিমা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে রোহিণীর হাত চেপে ধরেন—“ও শান্ত থাকবে না, মা। যতদিন না কেউ ওর অসমাপ্ত গল্প শেষ করে, ও আঁকতেই থাকবে—রক্ত দিয়ে, প্রতিশোধ দিয়ে। তুমি ওর সত্য লেখো। তবেই ও থামবে।” সেই মুহূর্তে বাতাস একদম নিস্তব্ধ হয়ে আসে, যেন আত্মা ঝুঁকে পড়েছে কথা শুনতে। রোহিণী বাইরে বেরিয়ে আসে, বুকের ভেতর এক অদৃশ্য পাথর চাপা দিয়ে। পূর্ণিমার আগমন আরেকবার এগিয়ে আসছে, আর এবার চন্দ্রাবতীর রক্তাক্ত আলপনা যেন অপেক্ষা করছে—কারো শেষ বিচার সম্পূর্ণ করতে।

(৭)

পূর্ণিমার আগের রাত। চাঁদ তখন অর্ধেক মুখ খুলেছে আকাশে, আর রোহিণীর ভেতরে যেন সমস্ত যুক্তির কণ্ঠ থেমে গেছে। পিসিমার কথা মাথায় বাজছে বারবার—”তুমি ওর সত্য লেখো। তবেই ও থামবে।” সে ঠিক করল, আর দেরি নয়। এবার সরাসরি ঢুকতে হবে সেই ঘরের ভেতরে, যেখানে চন্দ্রাবতী শেষ রাতটা কাটিয়েছিল, যার দরজা আজও কেউ খুলতে পারেনি। সেই দরজার পেছনে কি লুকিয়ে আছে শুধুই এক মৃতার স্মৃতি? নাকি এমন কিছু যা জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে আটকে আছে, অপেক্ষা করছে নতুন কোনো চোখের, নতুন কোনো কণ্ঠের?
রাত দশটা নাগাদ রোহিণী ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, আর একটি পোর্টেবল টর্চ নিয়ে পৌঁছল বাড়ির সামনে। বাতাস যেন থেমে গেছে। গাছগুলো স্থির, কুকুরগুলো চুপ। সে ধীরে ধীরে হাত রাখে সেই কাঠের দরজার ওপর—যেটার গায়ে আজো রয়েছে শঙ্খের আঁচড়, আর কুনো ধুপের পোড়া দাগ। দরজা ঠেলতেই এক খট করে আওয়াজ হয়, কিন্তু তা খুলে যায় সহজেই—যেন দরজাটা অপেক্ষায় ছিল।

ভেতরে পা রাখতেই প্রথম যেটা অনুভব হয়, তা হচ্ছে ঘরের গন্ধ—একসঙ্গে ধূপ, পঁচা রক্ত, পুরোনো শাড়ির গন্ধ, আর একটা অব্যক্ত বিষাদ। ঘরটা অন্ধকার, শুধু জানলার বাইরে পূর্ণিমার আলো এসে মেঝের এক কোণায় পড়েছে, যেখানে একটা আয়না রাখা, আর আয়নার নিচে পুঁতে রাখা এক গজ লাল কাপড়। দেয়ালে একদম মাঝখানে টাঙানো এক ছবি—কালী মায়ের ছবি, চোখের দৃষ্টি যেন সোজা তাকিয়ে আছে রোহিণীর দিকে। সে ধীরে ধীরে ঘর ঘুরে দেখতে থাকে—পুরোনো কাঠের খাট, একটা আলমারি যেটা খোলা, তাতে মলিন গয়নার বাক্স। হঠাৎ পায়ের নিচে খটাস শব্দ হয়—সে নিচে তাকায়, দেখে একজোড়া পায়েল। সেই পায়েল… যেটার ছবি সে দেখেছিল আদালতের ফাইল স্ক্যানে, যখন বলা হয়েছিল চন্দ্রাবতীর দেহ না পেলেও পায়েল পাওয়া গিয়েছিল।
ঠিক তখনই আয়নার সামনে রাখা কাপড়টি ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করে। টর্চের আলো ফেলতেই দেখা যায়—সেখানে বসে আছে এক নারী, চুলে ধুলো, মুখে ছায়া, চোখে শূন্যতা। সে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আয়নায় তার মুখ দেখা যাচ্ছে না—বরং সেখানে ফুটে উঠছে রোহিণীর মুখ, কিন্তু এক জোড়া অন্য চোখ নিয়ে! রোহিণী স্তব্ধ, কিন্তু হঠাৎ সেই মুখ বলে ওঠে—”তুমি এসেছো… শেষটা লিখতে। আমার কাহিনি আজ পূর্ণ হবে।”
আয়নার কাঁচে রক্ত দিয়ে লেখা হয়—“শেষ পূর্ণিমা।” রোহিণী আর স্থির থাকতে পারে না। বাইরে বেরিয়ে আসে, কিন্তু পেছনে দরজাটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়, আর তার মোবাইলে একটা ভিডিও চালু হয়ে যায়—তাতে দেখা যাচ্ছে সেই আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার পেছনে কেউ ধীরে ধীরে আলপনা আঁকছে রক্ত দিয়ে। এবং সেই আলপনার কেন্দ্রে এবার আর ফাঁকা বৃত্ত নয়—একটা নাম: রোহিণী পাল।

(৮)

যেন সবকিছুর পেছনে নিখুঁত এক ছায়া কাজ করছিল, ঠিক পূর্ণিমার আগের দিন ভোরবেলা শালডাঙা গ্রামে প্রবেশ করল এক বিবর্ণ মুখ, ধুলোয় ছেঁটে যাওয়া চোখ আর থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা শরীর নিয়ে—ধনঞ্জয় মণ্ডল, চন্দ্রাবতীর স্বামী, বহুদিন আগে যার নাম গ্রাম থেকে মুছে গিয়েছিল, ঠিক যেভাবে রক্ত মুছে যায় ধুয়ে দিলে, কিন্তু তার গন্ধ থেকেই যায়। তার আগমনে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল বিস্ময় ও আতঙ্ক। কারো মুখে উচ্চারণ ছিল না, কেবল চোখে ছিল প্রশ্ন—সে কেন ফিরে এল? কাকে খুঁজতে? আর এখন, এত বছর পরে কেন?

ধনঞ্জয়ের গায়ে জেলখানার পুরনো কম্বল, হাতে কিছু কাগজ, আর মুখে এক ধরণের ক্লান্তি—যা দেখলে বোঝা যায়, এই মানুষটা শুধু বাইরে থেকে ফিরেনি, সে ভিতর থেকেও ফাঁকা হয়ে গেছে। মোড়ল তাকে ডেকে পাঠালেন, রোহিণী গেল সাক্ষাৎকার নিতে। ধনঞ্জয় প্রথমে নীরব ছিল, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আমি খুন করিনি। আমি শুধু ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী… সে বদলে যাচ্ছিল। সে রাতে, সে কালী ঠাকুরের পূজারত ছিল, আর বলল—সে সন্তান পেয়েছে। কিন্তু আমি তো জানতাম… আমি তো… আমার তো কিছু হয়নি…” রোহিণী থমকে যায়—ধনঞ্জয় কী বলতে চাইছে? সে আসলে চন্দ্রাবতীর গর্ভধারণকে বিশ্বাস করেনি? নাকি সে সত্যিই ভেবেছিল এটা কোনও অপদেবতার কাজ? ধনঞ্জয় একদম নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল, “সে নিজেই বলেছিল—সে সন্তান স্বপ্নে পেয়েছে, কালী মা দিয়েছেন। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম… আমি কিছু করিনি মা… আমি শুধু… ওর মুখ বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম।”
রোহিণী জিজ্ঞেস করল, “আপনি পালিয়ে গিয়েছিলেন?” ধনঞ্জয় চোখ নামিয়ে বলল, “আমি পালাইনি। ও তখনও উঠোনে ছিল। আমি শুধু দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছিলাম। ওর চোখ… ওর চোখ দুটো তখনও জ্বলছিল। আমি জানতাম ও মরেনি, ও থামেনি।”

এই স্বীকারোক্তির পর গ্রামে হাহাকার শুরু হয়। কেউ বলে, “ও খুনি।” কেউ বলে, “ওর পাপের ফলই এখন আমরা পাচ্ছি।” কিন্তু ধনঞ্জয় অদ্ভুতভাবে শান্ত। সে পূর্ণিমার রাত আসার অপেক্ষায়, আর রোহিণী বুঝতে পারে, এই মানুষটার সঙ্গে চন্দ্রাবতীর শেষ আলপনার যোগ আছে। সেই রাত্রে, যখন চাঁদ সম্পূর্ণ পূর্ণ, আর বাতাস থেমে যায়, ধনঞ্জয় নিজেই চন্দ্রাবতীর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে পড়ে। রোহিণী, ক্যামেরা নিয়ে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে—আকাশ থেকে নেমে আসে এক পাতলা কুয়াশা, আর সেই কুয়াশার মধ্যে আলপনা আপনাআপনি আঁকা হতে থাকে। রক্ত ছিটকে পড়ছে কোথা থেকে, কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু উঠোনে সেই পুরনো চিহ্ন আবার গঠিত হচ্ছে। ধনঞ্জয় ফিসফিস করে, “আমি এসেছি, চন্দ্রা… এবার আমাকে নিয়ে যাও যদি তোর শান্তি হয়।”
আর ঠিক তখনই আলপনার কেন্দ্রে ফাঁকা বৃত্তটা ফেটে যায়—মাটি দুলে ওঠে, এক প্রাচীন ছায়া উপরে উঠে আসে, ধনঞ্জয়ের গায়ে ছায়া পড়ে, সে কাঁপে, কিন্তু পালায় না। রোহিণী ক্যামেরায় দেখে, আলপনার কেন্দ্রে এখন ধনঞ্জয়ের নাম লেখা। তারপর? আলো নিভে যায়। সকালের আলোয় দেখা যায়—উঠোনে আর কিছু নেই, শুধু শুকিয়ে যাওয়া এক সম্পূর্ণ আলপনা, আর তার মাঝখানে—একটা পায়েল, একটা পোড়া চিঠি, আর কোনো মানুষ নেই।

(৯)

ধনঞ্জয়ের অন্তর্ধান যেন কোনো বিস্ময় বা আতঙ্ক সৃষ্টি করল না শালডাঙার বুকে—বরং এক নিঃশব্দ স্বস্তির মতো নেমে এল সকাল। উঠোনে আঁকা আলপনা এবার সম্পূর্ণ। চন্দ্রাবতীর সেই বছর শুরু করা প্রতিটি বৃত্ত, প্রতিটি শঙ্খচিহ্ন, প্রতিটি রক্তধারা জুড়ে দিয়ে শেষবারের মতো সে নিজের কাহিনির পরিসমাপ্তি টানল। রোহিণী একা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল সেই অলৌকিক রচনার দিকে—যেখানে কেন্দ্রের গাঢ় বৃত্তে এখন আর কোনো নাম নেই, বরং এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি—মাঝে ফাঁকা জায়গাটা এক উন্মুক্ত চোখের মতো, যেন সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, বিচার চাইছে না, বরং ঘোষণা করছে নিজের ক্ষমতা। সেই আলপনা আর থেমে নেই, আর কাঁপছে না, বরং স্থির এক শেষ নিঃশ্বাসের মতো।

রোহিণী বুঝতে পারে, এই আলপনা আসলে একটা ভাষা—একটি মৃত্যুবৃত্ত। যেখানে চন্দ্রাবতী রক্ত দিয়ে লিখেছে সেই সমস্ত যন্ত্রণার কথা, যা মুখে বলা যায় না, ন্যায় দ্বারা বোঝানো যায় না। এ ছিল তার একান্ত প্রতিশোধ, যা চোখের বদলে চোখ নয়, বরং ন্যায়ের দাবিতে এক শিল্প। আলপনা ছিল শুধু তার হাত নয়, তার আত্মার ছাপ, তার গর্ভবতী নারীত্বের অভিশাপ আর আত্মবিশ্বাসের সম্মিলন। ধনঞ্জয়ের পতন ছিল অনিবার্য, কারণ তার পাপ শুধুই হত্যায় নয়, বিশ্বাসঘাতকতায়। রোহিণী ক্যামেরা চালু করে, সেই সম্পূর্ণ আলপনাকে দৃঢ় হাতে রেকর্ড করতে থাকে—নতুন প্রজন্মের জন্য, যারা শুধু ভয়ের গল্প খোঁজে, কিন্তু বোঝে না, অনেক ভূত আসলে বিচারপ্রার্থী আত্মা।

সন্ধ্যাবেলা শালডাঙার আকাশে হালকা বৃষ্টি নামে। রোহিণী সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে, কপালে হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ এক বাতাস বয়ে যায়, সেই ধূপ আর শিমুল ফুলের গন্ধ নিয়ে, আর উঠোনের এক কোণায় রাখা আয়নার সামনে একটা ঝলক দেখা যায়—সাদা শাড়ি পরা এক নারী, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, তার পেছনে সূর্যের শেষ আলো। কিন্তু এবার চুল খোলা নয়—গাঁথা। চোখে আগুন নয়—শান্তি। চন্দ্রাবতী এবার শেষ বার তাকায়, আর আয়নার কাঁচে অদৃশ্য অক্ষরে ফিসফিস করে ওঠে—“ধন্যবাদ।” ঠিক তখনই পুরো উঠোনে নেমে আসে এক অদ্ভুত আলো—না চাঁদের, না বাতির—যেন এক শিল্পকর্ম তার পূর্ণতা পেয়ে নিজেই ঝলমলিয়ে ওঠে।

(১০)

দুই সপ্তাহ পর, কলকাতায় ফিরে রোহিণী “চোখে দেখো” চ্যানেলের অফিসে একা বসে ছিল সম্পাদনার ঘরে। স্ক্রিনের সামনে বসে তার চোখে তখন আর কোনও ভয় নেই, নেই অবিশ্বাসও। তার ল্যাপটপে ফুটে উঠছে একের পর এক দৃশ্য—শালডাঙার মাটি, রক্তাক্ত আলপনা, কাঁপতে থাকা বাতাস, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা শাড়ির সেই নারী, আর ধনঞ্জয়ের অনুপস্থিতি। এই ছিল তার শেষ প্রজেক্ট—“রক্তাক্ত আলপনা: এক গৃহবধূর অপমান ও প্রতিশোধের কাহিনি।” সে জানে, এই ডকুমেন্টারি চলবে না বহু ভিউয়ের জন্য, কিন্তু যারা দেখবে, তাদের বুকের গভীরে কিছু নড়ে উঠবে—সেই গল্প, যেটা রক্তের নিচে চাপা পড়ে ছিল এতদিন।

রোহিণীর ভয় ছিল—যদি ভিডিওগুলোতে কিছু না থাকে? যদি ক্যামেরা ধোঁকা দেয়? কিন্তু না—সব ছিল। প্রতিটি আলপনার আঁকিবুঁকি, পায়েলের ঝঙ্কার, চন্দ্রাবতীর ছায়া, ধনঞ্জয়ের স্বীকারোক্তি, এমনকি সেই শেষ আয়নায় লেখা “ধন্যবাদ” পর্যন্ত। সব যেন কেউ নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ করে রেখে দিয়েছিল তার জন্য। অফিসের সিনিয়ররা যখন ভিডিওটি দেখল, প্রথমে মনে করেছিল—এ তো ভূতের গল্প! পরে বুঝল, এটি এক নারীর গল্প—যাকে সমাজের বুকে কালী বলে ডাকা হয়েছিল, ডাইনি বলে পুড়ানো হয়েছিল, অথচ সে ছিল কেবল এক মা, যার সন্তান চাওয়া ছিল তার সবচেয়ে বড় অপরাধ।

ডকুমেন্টারির শেষ দৃশ্যে রোহিণীর কণ্ঠস্বর শোনা যায়—
“চন্দ্রাবতী শুধু একজন ভূত ছিল না। সে ছিল ইতিহাসের এক প্রতিচ্ছবি, যাকে সময়ের বাঁকে ভুলে যাওয়া হয়েছিল। তার রক্ত দিয়ে আঁকা আলপনা কেবল প্রতিশোধ নয়, ছিল ন্যায়বিচারের আবেদন। যে সমাজ তাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল, আজ সেই সমাজের চিত্র তার রক্তে আঁকা বৃত্তের মাঝে থেকে যাবে চিরকাল।”

চ্যানেল কর্তৃপক্ষ সেই পর্বের নাম দিল, “রক্তের নিচে যে গল্প থাকে”। আর চন্দ্রাবতীর আলপনা?
সেই উঠোনে আজ আর কোনও রক্ত নেই।
কেবল একটা ফিকে ছাপ—যেটা মাঝে মাঝে রাতে হালকা ভিজে ওঠে পূর্ণিমার আলোয়।
যেন কেউ এখনো আঁকছে—মাটি, দুঃখ আর সাহস দিয়ে।

সমাপ্ত

 

 

1000039049.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *