অনির্বাণ সেনগুপ্ত
১
রাত দশটা পঁচিশ। হাওড়া স্টেশনের শেষ লোকাল ট্রেনটা বাঁশদ্রোণীর দিকে ছেড়ে গেল। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হতে হতে হঠাৎ দেখা গেল এক মাঝবয়সী লোক দৌড়ে এসে থামল, যেন কিছু ফেলেছে বা কাউকে খুঁজছে। হাতে একটা লাল খাম। চোখে আতঙ্ক, মুখে ঘাম, পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে—একটা ছোট্ট ফটো, দুটো গুচ্ছ চাবি আর একটা মলিন নোট।
গার্ড আর পুলিশ এগিয়ে এলো। “কি হয়েছে?”
লোকটা বলল, “উনি… আমার স্ত্রী… ওই ট্রেনেই উঠেছিলেন। কিন্তু কিছু একটা ঠিক ছিল না। আমি ভুল করিনি। কেউ ওঁর পিছু নিয়েছিল। আমি… আমি এখনই রিপোর্ট করতে চাই।”
পুলিশ অফিসার সন্দেহের চোখে তাকাল, “আপনার নাম?”
“সঞ্জয় রায়। আমি ব্যারাকপুরে থাকি। ওনার নাম দোলা রায়। উনি আজ সন্ধে সাতটায় নিউমার্কেট থেকে বেরিয়ে হাওড়ায় আসেন। তারপর ট্রেনে ওঠেন… আমি ফোন করেছিলাম, ও বলেছিল কেউ তাকে ফলো করছে।”
পুলিশ একটু উদাসীনভাবে বলল, “হ্যাঁ, সবসময় কেউ না কেউ কাউকে ফলো করে। কিন্তু আপনি কীভাবে নিশ্চিত?”
সঞ্জয় উত্তরে শুধু একটা জিনিস বলল—”ও বলেছিল, ‘যদি আমি হারিয়ে যাই, ও ফাইলটা খুঁজে নিও।’ ফাইলটা ওর ব্যাগে ছিল। কিন্তু ব্যাগ ওর সঙ্গেই নেই।”
এই বাক্যেই যেন কিছু একটা নড়ে উঠল ট্রাফিক কন্ট্রোল অফিসার রমেন ঘোষের মাথায়। “ফাইল? কেমন ফাইল?”
“সরকারি। ও এক NGO-তে কাজ করত। শিশু পাচার সংক্রান্ত কিছু রিপোর্ট ছিল ওর কাছে। ও বলেছিল নাম আছে অনেক প্রভাবশালী লোকের।”
এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই রমেনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে একটা টেলিফোন কল করল—“গোয়েন্দা বিভাগে পাঠাও এটা। আর সিসিটিভি ফুটেজ দেখাও এই প্ল্যাটফর্মের।”
পরদিন সকালে গোয়েন্দা অফিসার অর্ণব বসু এসে পৌঁছাল হাওড়ায়। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, চাপা গলার মধ্যে একরকম আত্মবিশ্বাস। শহরের এই অস্পষ্ট ঘটনায় আগ্রহ নেওয়ার কারণ একটাই—পাচার। সে জানত, এই শহরের নিচে লুকিয়ে আছে বহু অপরাধ, যা ছায়ার মতো চলে যায় সরকারের চোখের আড়ালে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেল, দোলা ট্রেনে উঠছে, কিন্তু একজন লাল কুর্তা পরা লোক ছায়ার মতো তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে, ট্রেনের শেষ কামরায় উঠে গেল সে।
অর্ণব জিজ্ঞেস করল, “এই লোকটা কে?”
পুলিশ বলল, “চেনা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করুন—লোকটার কাঁধে একটা কালো ব্যাগ আছে, যাতে একটা হলুদ স্টিকার লাগানো।”
অর্ণব চুপ করে গেল। হলুদ স্টিকার? সে আগেও এমন কিছু দেখেছে। পাচারকারীদের মধ্যে ‘প্যাকেট’ চিহ্নিত করার এটা একটা পদ্ধতি।
“আমাকে ব্যারাকপুর যেতে হবে,” বলল অর্ণব। “ওর স্বামী হয়তো আরও কিছু জানে।”
ব্যারাকপুরের সেই ছোট ফ্ল্যাটে বসে সঞ্জয় যেন আধভাঙা মূর্তি। দেয়ালে দোলার ছবির নিচে একটা প্রদীপ জ্বলছে। তার পাশেই পড়ে রয়েছে সেই লাল খামটা।
অর্ণব খামটা খুলে দেখল—একটা চিঠি। তাতে লেখা—
“অর্ণব, যদি এটা তুই পড়িস, তাহলে বুঝে নিস, আমি নিখোঁজ। ফাইলটা খুঁজিস, এতে একটা মেয়ের জীবন আছে। আর নামগুলোও। সময় নেই—ওরা আমাকে ফলো করছে। তুই পারলে, সত্যিটা তুলে ধরিস।”
— দোলা
অর্ণব চমকে উঠল। “তুই”? এই চিঠিটা তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা? তার মানে…?
“আপনি কি দোলাকে আগে চিনতেন?” সঞ্জয়ের প্রশ্নে সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
“হ্যাঁ। আমরা একসঙ্গে সাংবাদিকতা করতাম অনেকদিন আগে। তারপর আমি CID-তে চলে আসি, ও NGO-তে। কিন্তু যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। শুধু এই শেষ কয়েক বছর ছিল না।”
সঞ্জয়ের চোখ ছলছল করে উঠল। “তাহলে আপনি জানেন—ও সহজে ভয় পায় না।”
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, “জানি। তাই ও যদি বলেছে, তাহলে কিছু একটা খুব গম্ভীর আছে এর পেছনে। আর আমি সেটা বের করবই।”
বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি নামছে। দক্ষিণবঙ্গের ছায়াঘেরা আকাশ যেন আরও অন্ধকার হয়ে এল। অর্ণব জানত—এই অন্ধকারের মধ্যেই রয়েছে সেই সত্য, যাকে খুঁজে বের করতে হলে তাকে নামতে হবে কলকাতা থেকে পূর্ব মেদিনীপুর পর্যন্ত—যেখানে হারিয়ে গেছে দোলার ট্রেনের শেষ ছায়া।
আর এই ছায়ার পেছনে যিনি আছেন, তিনি কেবল একজন অপরাধী নন—তিনি ‘ব্যবস্থা’রই এক অংশ।
২
গন্ধহীন কিছু ফুল টেবিলের উপর পড়ে ছিল। সাদা গাঁদা, নিস্প্রাণ, শুকিয়ে গেছে। অর্ণব বসুর চোখ আটকে ছিল সেগুলোতেই—সঞ্জয়ের দেওয়ালে টাঙানো ছবির নিচে রাখা সেই ফুলের তোড়াটি যেন অনেক কিছু বলছিল। একটা বিষণ্ণ বিদায়, একটা অসমাপ্ত কথা। ঘড়িতে তখন সকাল আটটা। ব্যারাকপুর থেকে সোজা নিউমার্কেটের দিকে রওনা হলো সে। দোলার মোবাইল লোকেশনের শেষ সংকেত এই এলাকার কাছাকাছি ধরা পড়েছিল।
নিউমার্কেটের ভিড় তখনও জমে ওঠেনি। দোকানিরা ঝাঁপ তুলছে, রিকশাওয়ালারা গলা চড়িয়ে ডাকছে, আর পেছনের অলি-গলিতে চলেছে কড়িকাঠে ঠোকার শব্দ। অর্ণব ঠিক করল, আগে দোলার অফিসে যাবে—ছোট একটা NGO, নাম “মানচিত্র”। দক্ষিণ কলকাতার এই ছোট অফিসটাতে বসে দোলা শিশু পাচার বিরোধী রিপোর্ট তৈরি করত। বলা যায়, বহু অজানা গ্রামের গল্প এখানে এসে শেষ হতো এক টেবিলের ওপর।
অফিসে ঢুকতেই একটা মাঝবয়সী মহিলা উঠে দাঁড়ালেন—“আপনি কি অর্ণব বসু? দোলা’র পরিচিত?”
“হ্যাঁ, আমি CID থেকে এসেছি। আপনি?”
“আমি সীমা। আমরা একসাথে কাজ করি। উনি শেষ এসেছিলেন দুদিন আগে, খুব অস্থির ছিলেন। বারবার বলছিলেন, ‘ওরা জানে আমি কী লিখেছি। আমার নজরদারিতে আছে কেউ।’ আমি বলেছিলাম—ছুটি নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে যেতে। কিন্তু তিনি শুধু একটা পেনড্রাইভ আমার হাতে দিয়ে বলেন, ‘আমি না ফিরলে এটা পুলিশের হাতে দিও।’”
অর্ণব পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে গভীরভাবে তাকাল। সাদা পেনড্রাইভ, ওপরের দিকে কালো পেন দিয়ে লেখা “V-JUNCTION”. নামটা দেখে সে একটু চমকে উঠল। এই কোডনেম সে আগে শুনেছে।
“আপনি জানেন এটা কী?” জিজ্ঞাসা করল সে।
সীমা বলল, “নাহ, উনি কিছু বলেননি। শুধু এটুকু বলেছিলেন—ভয় পেয়ো না, আমি থাকব না ঠিকই, কিন্তু সত্যি থাকবে।”
অর্ণব ধন্যবাদ জানিয়ে পেনড্রাইভটা পকেটে রেখে বেরিয়ে পড়ল। এখন দরকার একটা ল্যাপটপ, আর একটা নিরাপদ জায়গা। সে ফোন করল বন্ধুকে—আসিফ, একজন সাংবাদিক, যে এখন একটা ওয়েব চ্যানেলে কাজ করে।
আসিফের ফ্ল্যাট পার্ক সার্কাসের কাছে। চা আর বেগুনি দিয়ে শুরু হলো তাদের পুরনো দিনের মত আলোচনায় ফেরা।
“দেখ, অর্ণব,” আসিফ বলল, “তুই যখন শেষ সাংবাদিকতা করতিস, তখনো আমি তোর স্টোরিগুলোর পাঠক ছিলাম। এখন তুই পুলিশ, আর আমি মিডিয়া। কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে, তোর ভিতরের সেই রিপোর্টারটা আবার জেগে উঠেছে।”
অর্ণব হেসে বলল, “রিপোর্টারের হৃদয়টাকেই তো বাঁচিয়ে রেখেছি, বাকিটা নিয়ম মেনে কাজ করি।”
পেনড্রাইভ খুলতেই একটা পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড ফোল্ডার। নাম—“Project D-6”।
“পাসওয়ার্ড তো জানা নেই,” আসিফ বলল।
“না, কিন্তু আমি দোলাকে চিনি। ওর ছেলের জন্মদিন ৫ জুন। আমি চেষ্টা করি—Dola0506।”
ফোল্ডার খুলে গেল।
ভেতরে একের পর এক স্ক্যান করা রিপোর্ট, কয়েকটা নাম—সুশীল মৈত্র, এক ব্যবসায়ী; দেবাশিস রায়, একজন প্রশাসনিক আধিকারিক; আর তৃতীয় নামটা দেখে অর্ণব যেন কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল।
“ডঃ বিভাস সেন”—কলকাতার বিখ্যাত শিশু মনোবিদ, যিনি বহু স্কুল ও রিহ্যাব সেন্টারে কাজ করেন। শহরের চোখে তিনি একজন মানবতাবাদী, অথচ এই ফাইলের পাতায় তাঁর নাম আছে পাচার র্যাকেটের কেন্দ্রীয় ফিগার হিসেবে।
আসিফ মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, “এটা ছাপানো দরকার। এক মুহূর্তও দেরি করা উচিত না।”
“না,” অর্ণব থামাল। “এটা ছাপালে এখনই ওরা টের পাবে আমরা কী জানি। আমাদের আগে খুঁজতে হবে দোলাকে। হতে পারে সে এখনো বেঁচে আছে। আর যদি না-ও থাকে, তাহলে এই অন্যায়কারীরা অন্তত ছাড়া না পায়।”
আসিফ জিজ্ঞাসা করল, “তুই এখন কী করবি?”
“আমি যাব পূর্ব মেদিনীপুর। দোলার মোবাইল লোকেশন শেষ যেটা ছিল, তা আসলে ভুল ছিল। আমি ধরে নিচ্ছি ওরা ফেক লোকেশন দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। কিন্তু ওই ট্রেনটা, যেটা বাঁশদ্রোণী হয়ে দক্ষিণে যায়, সেটা মাঝরাতে একটা পুরোনো স্টেশনে দাঁড়ায়—চিলকিগড়। সেই রুটটা বহু বছর ধরেই পাচারকারীদের পছন্দের পথ। আমি যাচ্ছি সেখানে।”
রাত তখন বারোটা। ট্রেনের জানালা দিয়ে কুয়াশার মতো রাত ঢুকছিল। অর্ণব জানত, এই রাত নিঃশব্দ। কিন্তু রাত যত গভীর, অপরাধ ততই সাহসী হয়ে ওঠে।
চিলকিগড় নামলেই সে অনুভব করল, যেন সময় পেছনে চলে গেছে। স্টেশনের বাইরে কুয়াশা, একটা চায়ের দোকান শুধু খোলা। সে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল—“গত পরশু রাতে এখানে কেউ নামেনি? একজন মহিলা?”
দোকানদার চোখ গোল করে বলল, “একটা অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল। কেউ নামেনি, বরং একটা মেয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল মনে হচ্ছিল।”
“কে নিয়ে গেল?”
“তেমন দেখিনি। কিন্তু গাড়িতে লেখা ছিল—‘Srishti Seva Kendra’।”
অর্ণব থমকে দাঁড়াল।
এটা একটি রিহ্যাব সেন্টারের নাম। আর সেটার পরিচালনাকারী কে জানো?
ডঃ বিভাস সেন।
৩
বিকেল চারটে। চিলকিগড় স্টেশনের পাশের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে অর্ণব পৌঁছল একটা বড় লোহার গেটের সামনে। ওপরেই বড় হরফে লেখা—“শ্রুতি সেবা কেন্দ্র – পুনর্বাসনের একমাত্র ঠিকানা।” চারপাশে পলাশ ফুল ফুটে আছে, গেটের পাশে বকুল গাছের নিচে বসে এক বৃদ্ধ ফটকে পাহারা দিচ্ছে। তার চোখে ঘোলাটে চশমা, মুখে ধুলো জমা দাড়ি।
“আমি একটা কেসে এসেছি,” অর্ণব তার আইডি কার্ড দেখাল। “এখানে পরশু রাতে একটা মেয়ে আনা হয়েছিল কি?”
বৃদ্ধ কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাল। “আমি তো বাইরে ছিলাম সেদিন। আপনি ভেতরে অফিসে যান। ডাঃ সেন এখনই আসবেন না, কিন্তু মীনা ম্যাডাম আছেন। উনিই সব দেখেন।”
অর্ণব গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা বিষন্ন বাতাস যেন তাকে ঘিরে ধরল। তিনতলা পুরনো বিল্ডিং, চারদিকে শিশির ধরা ঘাস, ভেতরে কোলাহল নেই, অথচ কিছু একটার অদৃশ্য গুঞ্জন যেন গাছেদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে।
ভেতরের রিসেপশনে বসে থাকা মহিলা—মীনা দত্ত—চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন, “আপনি সরকারি লোক?”
“না, CID,” পরিচয় দিতেই তার মুখে এক গম্ভীরতা ফিরে এল।
“আপনি বুঝতেই পারছেন, এটা একটা পুনর্বাসন কেন্দ্র। এখানে অনেকে আসে, অনেকে যায়। কারো ব্যক্তিগত তথ্য আমরা দিতে পারি না।”
“আমার কাছে অর্ডার আছে,” অর্ণব নকল কোর্ট ওয়ারেন্ট দেখাল, যা সে ইচ্ছে করেই বানিয়েছিল পরিস্থিতি বুঝতে।
মীনা ম্যাডাম একটু দ্বিধায় পড়লেন। “ঠিক আছে, আপনি যদি উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে রেজিস্টারে নাম দেখে নিতে পারেন।”
অর্ণব খাতাটা হাতে নিয়ে পাতাগুলো উল্টাতে লাগল। তার খোঁজ ছিল পরশু রাতে, অর্থাৎ তিনদিন আগের এন্ট্রিগুলোর দিকে। তারপর একটা নাম দেখে তার চোখ থেমে গেল—“জয়া মিত্র (আনুমানিক বয়স ৩৫), স্টেশন থেকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার, আনা হয় রাত ১২:৪৫-এ।”
“এই জয়া মিত্র কে?”
মীনা বললেন, “স্টেশনে পড়ে ছিল। স্থানীয় পুলিশ খবর দেয়, আমরা নিয়ে আসি। এখনও ঘুমন্ত অবস্থায় আছে।”
“আমি দেখতে চাই তাকে। এখনই।”
মীনা একটু ইতস্তত করলেন, “দেখুন, উনি মানসিকভাবে অস্থিতিশীল, ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আপনি চাইলে বাইরে থেকে একবার দেখতে পারেন।”
অর্ণবকে নিয়ে যাওয়া হল নিচতলার একটি ঘরের সামনে। সাদা পর্দা টানা, জানালায় ধুলো জমে আছে। বিছানায় একজন নারী শুয়ে আছেন, মুখ ঢাকা, গায়ের উপর পাতলা চাদর।
অর্ণব ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা সরাল।
হ্যাঁ—চোখদুটো জানে, মুখটা যেন বহু বছর আগে কোথাও দেখা।
সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। তীব্র এক অনুভব বুক চিরে উঠল—দোলা।
সে কি বেঁচে আছে?
“জয়া বলছেন আপনি?”
“আমরা তো তার আসল নাম জানি না,” মীনা বললেন। “সে তো এখনও জ্ঞান ফেরায়নি।”
“আমি নিজেই নিশ্চিত করতে চাই,” অর্ণব বলল।
সে মোবাইল থেকে দোলার একটা ছবি বের করে দেখাল। “এটা উনি। আমি নিশ্চিত।”
মীনা চুপ করে গেলেন।
“আপনারা পুলিশে রিপোর্ট করেননি?”
“করেছি। কিন্তু লোকেশন হাওড়া বলার পর থানা ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এখানে আমরা শুধু যত্ন নিই, অনুসন্ধান নয়।”
অর্ণব দোলার পাশে একটু সময় কাটাল। চুলের পাশে লেগে থাকা ধুলো সরিয়ে তার কানে ফিসফিস করে বলল, “আমি এসেছি। উঠে দাঁড়াও, দোলা। তোমার সত্যের লড়াই শেষ হয়নি।”
সে বুঝতে পারছিল, দোলা সংজ্ঞাহীন ঠিকই, কিন্তু তার মুখের পেশিতে একটা কাঁপন হচ্ছে।
সে জানে, এই ঘুম কোনও প্রাকৃতিক নয়। ওষুধের ঘুম।
অর্ণব এবার বেরিয়ে এসে সরাসরি বলল, “আমি উনাকে নিয়ে যেতে চাই।”
“তা সম্ভব নয়,” মীনা কঠিন গলায় বললেন। “আপনার কাছে যদি মেডিক্যাল ক্লিয়ারেন্স, কোর্ট ওয়ারেন্ট সব থাকে, তবেই।”
অর্ণব শান্তভাবে বলল, “তবে আমি এখান থেকে বেরিয়ে প্রথমে যাব এসডিও অফিসে, তারপর ডঃ বিভাস সেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করব, কারণ তিনি একজন পরিচিত নাগরিককে সংজ্ঞাহীন করে আটকে রেখেছেন। আপনারা জানেন না উনি কে?”
মীনা এবার মুখ নামিয়ে ফেললেন।
“আমি শুধু কাজ করি। কী হয়, কী আসে, সব দেখিনা।”
অর্ণব বুঝল, একা কিছু হবে না। তাকে এবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে বড় পরিকল্পনা করতে হবে।
রাত দশটার লোকালে সে ফিরল কলকাতায়। হাওড়ায় পৌঁছে ফোন করল আসিফকে।
“রাত বারোটায় তোর অফিসে দেখা কর। মিডিয়া লাগাতে হবে। আমি এবার মুখোশ খুলব। কাল সকালে শহর জানবে ডঃ বিভাস সেন কে।”
ট্রেনের জানালা দিয়ে চেয়ে অর্ণব বুঝতে পারল—সে এখন শুধু একজন পুলিশ অফিসার নয়, একজন বন্ধুর সাথী, একজন সত্যসন্ধানী।
আর দোলার চোখের পাতা কাঁপছিল—সম্ভবত জেগে উঠতে চাইছিল।
৪
রাত তখন বারোটা কুড়ি। কলকাতার ধূপছায়ার মতো অলিগলি তখনও পুরোপুরি ঘুমোয়নি। পার্ক সার্কাসের কাছের ছোট্ট অফিসঘরে বসে আসিফ আর অর্ণব শেষবারের মতো একটা ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করছিল। টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপের পর্দায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—ডঃ বিভাস সেন একটি শিশুকে কোলে তুলে ধরছেন, মুখে অমায়িক হাসি, পেছনে দাঁড়িয়ে সাদা অ্যাম্বুলেন্স। এই ছবির ক্যাপশন—“Shree Foundation supports Srishti Seva Kendra.”
“এইটা নিউজে গেলে সরাসরি কামড়াবে ওকে,” বলল আসিফ। “কিন্তু তুই নিশ্চিত তো, আমরা যা করছি তা আইনত নিরাপদ?”
“আমরা যদি চুপ থাকি, তাহলে আর কেউ মুখ খুলবে না,” অর্ণব বলল। “এই শহরে কেউ জানে না যে একজন মনোবিদের নামে খোলা আছে শিশু পাচার ও মানসিক নির্যাতনের আখড়া। আমি চাই, সকাল হতেই প্রতিটা মোড়ের খবরের কাগজে এই নামটা ছাপা হোক—ডঃ বিভাস সেন।”
আসিফ মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল। তারা ভিডিও এডিট করে একটা ছোট্ট রিপোর্ট তৈরি করল, যেখানে ছিল দোলার পাওয়া পেনড্রাইভের কাগজ, ডঃ সেন-এর ছবিসহ প্রমাণ, শ্রুতি সেবা কেন্দ্রের সন্দেহজনক রেজিস্ট্রেশন এন্ট্রি, আর একটি ভয়েস রেকর্ডিং—যেটা ছিল আসল বিস্ফোরণ।
ভয়েসটা ছিল দোলার—“আমি জানি, আমার পেছনে ওরা আছে। কিন্তু আমি চুপ থাকব না। বিভাস সেন এই শহরের ‘শিশু উদ্ধারকর্তা’ নয়, সে শিশুদের মেরুদণ্ড ভাঙা এক কারিগর।”
সকাল আটটার মধ্যে ভিডিওটি আপলোড হয়ে গেল আসিফের নিউজ পোর্টালে। “Child Savior or Criminal? The Truth Behind Dr. Bibhash Sen”—এই শিরোনাম নিয়ে।
তিন ঘণ্টার মধ্যে ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেল। সোশ্যাল মিডিয়ায় #JusticeForDola ট্রেন্ড করতে শুরু করল। পুরনো ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে স্কুলের অভিভাবকেরা পোস্ট করতে থাকলেন বিভাস সেনের চরিত্র নিয়ে। কেউ বললেন, “উনি ঠিকমতো কাউন্সেলিং করতেন না,” কেউ বললেন, “ওনার কেন্দ্র থেকে একবার আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, অকারণে।”
সকালে, ঠিক ১১টা ২০ নাগাদ, অর্ণবের মোবাইলে ফোন এল—“আপনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হচ্ছে। ডঃ বিভাস সেন খুবই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। আপনি এইভাবে জনসমক্ষে তাঁর নাম টেনে এনেছেন।”—একটি হঠাৎই আগ্রাসী কণ্ঠস্বর।
“আপনি কে?” অর্ণব জানতে চাইল।
“আমি অ্যাডভোকেট চক্রবর্তী। সেন সাহেবের হয়ে কথা বলছি।”
“খুব ভালো। তাহলে আপনিই জানাবেন উনি কোথায়? পুলিশ তাঁকে এখনই ডেকে পাঠাতে চায়।”
ওপাশে চুপচাপ কিছুক্ষণ, তারপর কেটে গেল।
অর্ণব জানত, ওরা চাপে আছে। কারণ সত্যি এবার লোকের সামনে এসেছে।
তবে এই চাপে ওরা অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
দুপুর দুটো নাগাদ অর্ণব ও আসিফ যখন লাঞ্চ করার কথা ভাবছে, ঠিক তখনই একটা ফোন এল সীমা দত্তর কাছ থেকে—দোলার সহকর্মী।
“অর্ণবদা, আপনি কি আমার গলায় ভয় পাচ্ছেন না শুনে কথা বলবেন? আমি ভয় পাচ্ছি। আজ সকাল থেকে অদ্ভুত কিছু ফোন আসছে। একটা কণ্ঠ বলল—‘তুমি যদি মুখ খোলো, তাহলে তোদের অফিসেই আগুন লাগবে।’”
অর্ণব বুঝতে পারল, ব্যাপারটা এখন আরও গভীর।
সে অফিসে গিয়ে সীমাকে বলল, “আজ রাতেই তোমাকে সেফ হাউজে রাখতে হবে। দোলাও বিপদে আছে, আর তুমি ওর সঙ্গে কাজ করেছো বলে ওরা জানে।”
“কিন্তু আপনি কি পারবেন ওদের থামাতে?” সীমার কণ্ঠ কাঁপছিল।
“না,” অর্ণব বলল, “আমি পারব না। কিন্তু ‘আমরা’ পারব। এখন আমরা একা নই। হাজার জন এই লড়াইয়ে আছেন।”
বিকেল পাঁচটায় অর্ণব গেল শ্রুতি সেবা কেন্দ্রে—পুলিশি সাহায্যসহ।
এইবার সত্যি ওয়ারেন্ট ছিল। সঙ্গে ছিল শিশু কল্যাণ দপ্তরের এক অফিসারও।
কিন্তু গেট খুলতেই দেখা গেল, কেন্দ্রটা প্রায় ফাঁকা।
রেজিস্ট্রার, ওয়ার্ডেন, নার্স—সব পালিয়েছে।
শুধু তিনজন রোগী রয়ে গেছে। আর একটা ঘরে শুয়ে ছিল দোলা।
এইবার জেগে ছিল সে। চোখ খুলে তাকাল, ক্লান্ত কিন্তু সজাগ।
“তুই এলি…” সে ফিসফিস করে বলল।
“তুই থেকেছিস বলেই আমি আসতে পেরেছি,” অর্ণব বলল।
দোলার মুখে ছায়া হাসি।
“ওরা পালিয়েছে। ডঃ বিভাস সেন গায়েব। আমায় রেখেছিল স্যালাইনের অজুহাতে কোমায় পাঠানোর জন্য,” দোলা বলল।
“তাহলে এবার খেলাটা শুরু হলো,” অর্ণব বলল। “ওরা দৌড়েছে। এখন পালানোর পালা আমার নয়।”
৫
কলকাতার বুকে সন্ধ্যার আলো নামছে, আর অর্ণব বসু ঠিক তখনই নামছে দক্ষিণ কলকাতার একটি পুরনো বহুতলের সামনে। নাম—বেলভিউ রেসিডেন্সি। এখানেই শেষ দেখা গেছে ডঃ বিভাস সেন-কে, একটি সাদা SUV-তে উঠতে, গতকাল রাত একটার পরে। তার মোবাইল সিগন্যাল শেষ পাওয়া গেছে এই বাড়ির ৯ তলার কাছ থেকে।
সঙ্গে ছিল সাব-ইন্সপেক্টর সুপ্রিয়, আর দুই কনস্টেবল। দোলা এখন সেফ হাউজে, হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষা চলছে তার। কিন্তু অর্ণব জানে—যে অপরাধটা এতদিন চুপচাপ চলেছে, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি মিশে আছে। হয়ত এই বিল্ডিংয়ের একটি ফ্ল্যাটেই বসে আছে সেই মুখোশধারী ডাক্তার, তার পরিচিত ভদ্রলোকের মুখে, আর ভিতরে লুকিয়ে থাকা রাক্ষসের নখর।
“ইনফর্মার বলেছে, সেন সাহেব এখানেই এক আত্মীয়র ফ্ল্যাটে লুকিয়েছে। ফ্ল্যাট নম্বর 9B,” সুপ্রিয় বলল।
“চলো,” অর্ণব শুধু এটুকু বলল।
লিফটে না উঠে তারা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা শুরু করল—কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। নয়ত দেরি হয়ে যাবে। একবার যদি কেউ ফোন করে সাবধান করে দেয়, তাহলে এই লোকটা ফের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে।
৯ তলায় পৌঁছে তারা দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজা বন্ধ, আলো জ্বলছে ভেতরে। অর্ণব কড়া নাড়ল—একবার, দুবার।
একটা নরম গলা উত্তর দিল, “কে?”
“CID,” অর্ণব বলল।
এক মুহূর্ত থেমে গেল সব। তারপর হঠাৎ ‘চটাস!’ করে আলো নিভে গেল।
“ভেতরে আছে!” চিৎকার করে অর্ণব দরজা ঠেলে ঢুকল।
ভেতরের ঘরে ছড়ানো জামাকাপড়, ফাইল, ভাঙা চায়ের কাপ, আর এক কোণায় একটা ছোট্ট ব্যাগ—তাতে মোড়ানো ছিল কিছু ক্যাশ, একখানা বিদেশি পাসপোর্ট আর… একটি সোনালি পেনড্রাইভ।
“তুই এবার পালাতে পারবি না,” অর্ণব ফিসফিস করল।
তারা ফ্ল্যাটের প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখল। বাথরুম বন্ধ। ভেতর থেকে শব্দ। “তালাটা ভাঙো!” অর্ণব নির্দেশ দিল।
দুজন কনস্টেবল ধাক্কা দিতে শুরু করল।
দরজা খুলতেই দেখা গেল—একজন মানুষ জানালার গ্রিল টেনে কিছু একটা নামানোর চেষ্টা করছে, নিচে রাখা একটা রশির মতো বেঁধে কিছু নামিয়ে দিচ্ছে।
“স্টপ! হ্যান্ডস আপ!” অর্ণব গর্জে উঠল।
লোকটা ঘুরে তাকাল—চোখে আতঙ্ক, কিন্তু ভেতরে এক বিষাক্ত শীতলতা।
“আপনার মতো মানুষেরা বুঝবে না,” বিভাস সেন বলল। “আমি একটা সমাজ গড়ছি। যেখানে দুর্বলদের কোনো স্থান নেই, আর যাদের কারও প্রয়োজন নেই, তারা কেউ না। আমি ওদের কাজে লাগাচ্ছি—অর্থে, বৈজ্ঞানিকে, সমাজে। তোমরা ভাবছ এই কাজ অন্যায়?”
“আপনার মতো শিক্ষিত হিংস্ররা সমাজের সবচেয়ে বিপজ্জনক,” অর্ণব বলল।
তখনই সে একটা কিছু ছুড়ে মারল জানালার বাইরে। নিচে ধ্বংসাবশেষে পড়ে গেল সেই সোনালি পেনড্রাইভ।
“ওইটায় আছে প্রমাণ। আমি এখনই শেষ করব সব,” সেন ফুঁসে উঠল।
অর্ণব পেছন থেকে লাফ দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। সুপ্রিয় হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে বলল, “আপনার হাতেই পড়বে এখন আইন, ডাক্তর।”
বাইরে পুলিশের গাড়ি এল, বাড়ির লোক জড়ো হল, মিডিয়াও পৌঁছল।
সেন যখন গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে, তখন হঠাৎ এক টিভি রিপোর্টার চিৎকার করে বলল—“ডঃ সেন, আপনি কি শিশু পাচার র্যাকেটের মাথা?”
সেন মুখ ফিরিয়ে বলল—“তোমরা কখনো জানতেও পারবে না, আমি কার হয়ে কাজ করতাম।”
এই কথাটাই যেন নতুন আরেকটা দরজা খুলে দিল অর্ণবের মনে।
“কার হয়ে?”
সে চিন্তায় পড়ে গেল। যদি সেন একজন সামনের মুখ, তাহলে পেছনে কেউ আছে—আরও বড়, আরও ধূর্ত।
রাত তখন প্রায় ১২টা। ফিরে গিয়ে সে দোলার পাশে বসল। হাসপাতালের কেবিনে দোলা হালকা ঘুমে। কিন্তু মুখে শান্তির ছায়া।
“তোর সংগ্রাম শেষ হল না দোলা,” অর্ণব ফিসফিস করে বলল। “শুধু প্রথম পরতটাই আমরা তুলে এনেছি। কিন্তু এর নিচে যে কাঠামো আছে, তা এখনও অন্ধকারেই আছে।”
দোলার চোখ খুলল। ক্লান্ত চোখেও একটা দীপ্তি।
“আমি লিখে যাব অর্ণব। তুমি লড়াই চালিয়ে যেও।”
অর্ণব জানত, এই শহরে কেবল অপরাধীরাই নয়, তাদের ছায়ারাও অনেক। আর এই ছায়াগুলো ভেঙে ফেলতে হলে, তাকে ঢুকতে হবে আরও গভীর অন্ধকারে।
৬
হাসপাতালের কেবিনের জানালা দিয়ে সকালের আলো ঢুকছে। পাখিরা ডাকছে দূরে, হাসপাতালের করিডরে নার্সের কড়া জুতোয় টিপটিপ শব্দ। কিন্তু দোলার মুখে একটুও প্রশান্তি নেই। সে বিছানায় আধশোয়া হয়ে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। যেন তার চোখে আটকে আছে সেই সময়, সেই কুয়াশা, সেই ভয়।
অর্ণব জানত, সেন ধরা পড়লেও যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। সে ঠাণ্ডা মাথায় হাসপাতালের ক্যান্টিনে বসে কফি খাচ্ছিল, হঠাৎ এক পরিচিত নাম কানে এল—
“ডঃ রাকেশ মালহোত্রা আজ এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানাবেন তিনি শিশু সুরক্ষা নীতিতে নতুন সংযোজন আনতে চলেছেন…”
রেডিওতে ঘোষণাটি শুনেই অর্ণব চমকে উঠল। মালহোত্রা—পশ্চিমবঙ্গ শিশু কল্যাণ দপ্তরের উচ্চপদস্থ আমলা, বহু সমাজকর্মীর কাছে প্রিয়, বহু মিডিয়ার মুখ। কিন্তু অর্ণব জানে, সে একবার দোলার রিপোর্টে এই নামটা পড়েছিল। এবং তখন সেটা খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছিল।
কিন্তু এখন সেনের শেষ কথাগুলো, সেই “আমি কার হয়ে কাজ করতাম”—এই কথাগুলো ঘুরেফিরে মালহোত্রার নামের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
অর্ণব তৎক্ষণাৎ ফোন করল আসিফকে—“মালহোত্রার উপর একটা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক কর। কে ওর সঙ্গে কাজ করে, কোন এনজিওতে ও প্রভাব খাটায়, আর সেনের সঙ্গে কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে কিনা।”
আসিফ বলল, “পাচ্ছি কিছু তথ্য। কিন্তু এগুলো পাবলিক ডোমেইনে নেই। এক কাজ কর, আজ সন্ধ্যায় এস আমার অফিসে। আমি ভেতরের একজনের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। ওর কাছে অফ-দ্য-রেকর্ড কিছু আছে। কিন্তু সাবধানে যাস।”
অর্ণব বুঝতে পারল, এটাই সেই সময়, যখন দোলার যুদ্ধ, সেনের মুখোশ খোলার পর, আরেকটা বড় লড়াই শুরু হবে।
সন্ধ্যা ৭টা। আসিফের অফিস।
সামনে বসে আছে একজন মহিলা—স্মিতা। বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ, চুলে সিঁদুর নেই, চোখে ক্লান্তি। ও নিজেকে পরিচয় দিল—“আমি ছিলাম রাকেশ মালহোত্রার দপ্তরে একটা অ্যাসিস্ট্যান্ট। চার বছর ধরে। তারপর আমার বদলি হয়ে যায় বিহারে। কিন্তু যাওয়ার আগেই আমি অনেক কিছু দেখেছি, শুনেছি। এমনকি একটা নোটও তুলে রেখেছিলাম নিজের জন্য।”
স্মিতা ব্যাগ থেকে বের করল একটা প্যাডের পাতায় লেখা চিঠির কপি।
“এইটা একটা ইন্টার-ডিপার্টমেন্টাল মেমো, যা ‘সেন ফাউন্ডেশন’ নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ‘মনস্তাত্ত্বিক পুনর্বাসন’ নামে ট্রান্সফার করার কথা বলছে। এতে স্বাক্ষর আছে মালহোত্রার। অথচ এই প্রতিষ্ঠান রেজিস্টার্ডই নয়, কোনো সরকারি অনুমোদন নেই।”
অর্ণব বুঝল—খেলা এখন প্রশাসনের ভেতরে। এই মালহোত্রা সেনকে শুধু রক্ষা করেননি, তাঁকে ক্ষমতার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
“তুমি কি স্বীকার করবে এটা আদালতে?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল।
“করব,” স্মিতা বলল। “তবে আমার নিরাপত্তা চাই। আমি জানি এরা কী করতে পারে।”
“তোমাকে এখনই সেফ হাউজে পাঠানো হবে। দোলাও সেখানে আছে,” অর্ণব বলল। “তুমি ওর লড়াইয়ের সঙ্গী হবে।”
স্মিতার চোখে জল এসে গেল।
রাত ১০টা। কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলনে বসেছেন রাকেশ মালহোত্রা। চারদিকে ফ্ল্যাশ, মাইক্রোফোন, রিপোর্টারদের কোলাহল। মালহোত্রা এক হাতে মাইক ধরলেন—
“আজ আমরা শিশু সুরক্ষার এক নতুন যুগে প্রবেশ করছি। আমাদের দপ্তর…”
ঠিক তখনই সম্মেলন হলের পেছনের দিকে ঢুকলেন অর্ণব বসু, সঙ্গে দুই সাদা পোশাকের অফিসার।
“রাকেশ মালহোত্রা, আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে IPC Section 370 ও POCSO Act-এর আওতায় শিশু পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে,” অর্ণব গম্ভীর গলায় বললেন।
হল নিস্তব্ধ।
মালহোত্রা মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করলেন, “আপনারা ভুল করছেন। আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই।”
অর্ণব সামনে এগিয়ে একটা ফোল্ডার দিল—স্মিতার স্বাক্ষ্য, দোলার রিপোর্ট, সেনের বয়ান, আর সেই চিঠি।
“এইসবের পরও যদি আপনি বলেন প্রমাণ নেই, তাহলে হয় আপনি অন্ধ, নয়তো বেপরোয়া।”
মালহোত্রা তখন বুঝলেন, ছায়া থেকে উঠে এসেছে সত্য।
সেদিন রাতেই কলকাতার সমস্ত চ্যানেলে শিরোনাম—“শিশু পাচার চক্রে সরকারি আমলার জড়িত থাকার প্রমাণ, ধৃত রাকেশ মালহোত্রা।”
দোলার কেবিনে যখন খবরটা পৌঁছাল, সে তখন জানালার ধারে বসে ছিল।
সে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “এখন বুঝলাম, কতটা কালো হতে পারে একটা সাদা জামা।”
অর্ণব পাশে বসে বলল, “তুই জয়ী হলি। তোর লেখার ভাষা থেমে যায়নি।”
“আর তোর লড়াইও নয়,” দোলা বলল।
তারা জানত, এই শহরের পাথরের ফাঁকে এখনও ফুটতে পারে সত্যর একটা ছোট্ট ফুল।
৭
হাসপাতালের কেবিনে সেই রাতে দোলার চোখে ঘুম ছিল না। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল টিপটিপ করে। বিছানায় শুয়ে সে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ছিল দূর আকাশের দিকে—যেখানে কোনো তারা নেই, শুধু ঢেকে থাকা মেঘ। সেই মেঘেই হয়তো লুকিয়ে ছিল প্রশ্নগুলোর উত্তর—কেন তার সঙ্গে এমন হলো, কেন এতদিন ধরে কেউ কিছু টের পায়নি, আর কেনই বা সমাজ মুখ ফিরিয়ে থাকে যখন তার সামনে চলে আসে নগ্ন সত্য?
অর্ণব তখনও ছিল তার পাশেই। টেবিলে কফির কাপ ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার মুখে ছিল গম্ভীরতা, কিন্তু চোখে জ্বলছিল নতুন এক দৃঢ়তা। সে জানত, সেন এবং মালহোত্রা পড়ে গেলেও এই জাল এখনও সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যায়নি। কিছু প্রশ্ন বাকি, কিছু মুখোশ এখনও পড়েই আছে।
“দোলা,” অর্ণব বলল নিচু গলায়, “আমি ভেবেছিলাম শেষ হয়েছে। কিন্তু আরও কিছু প্রমাণ আমার দরকার।”
দোলা তার দিকে তাকাল। “কি প্রমাণ?”
“সেই পেনড্রাইভটা মনে আছে? সেন যেটা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিল?”
“হ্যাঁ…”
“ওটা খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু ড্যামেজড। আইটি টিম বলেছে, তার মধ্যেকার একটা এনক্রিপটেড ফাইল খোলা যাচ্ছে না। আর ফাইলটার নাম ছিল… ‘The Guest List’।”
দোলার চোখে বিস্ময় ফুটল। “ওটা আমি শেষদিকে তৈরি করছিলাম। সেই সব লোকজনের নাম, যারা সেনের সঙ্গে দেখা করত নিয়মিত, কিন্তু তাদের কোনো সরকারি রেকর্ড নেই। অনেকে আসত রাতের বেলা, অনেকে ছদ্মনামে। কেউ কেউ ছিল বেশ পরিচিত নাম…”
“তোমার কাছে সেই নামগুলো কোথাও আলাদা করে লেখা আছে?”
দোলা একটু চিন্তা করে বলল, “হ্যাঁ, একটা কোডেড খাতায়। আমি ওটা রেখে দিয়েছিলাম আমার বাড়ির পুরনো বইয়ের ভেতর। শুধু আমিই জানতাম কোন বই।”
“কোন বই?”
“আলবেয়ার কামুর The Outsider—প্রচ্ছদের পেছনে একটা গর্ত কেটে ওখানে রেখেছিলাম।”
অর্ণব দাঁড়িয়ে গেল। “চল, চলেই যাই এখন।”
“না,” দোলা বলল। “তুমি যাও। আমি আসবো পরে। এখন আমার ঠিকঠাক ভাবে হাঁটতে পারার মতো শক্তি নেই। কিন্তু আমার খাতা যেন ভুলেও কারও হাতে না পড়ে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, অর্ণব।”
রাত তখন প্রায় দুটো। ব্যারাকপুরের সেই পুরনো ফ্ল্যাটে অর্ণব ঢুকল চুপচাপ। সঞ্জয় তখন হাসপাতালে দোলার কাছে। ঘর অন্ধকার, বইয়ের তাকে আলোর টর্চ ফেলে একে একে খুঁজে বের করল সেই বই—The Outsider।
প্রচ্ছদের পেছনে সত্যিই গর্ত কাটা, আর তার মধ্যে রাখা একটা ছোট্ট লাল খাতা। পাতাগুলো তর্জনীতে নাড়াতে নাড়াতে সে একেকটা নাম পড়তে থাকল:
— নীতীন গার্গ
— অঞ্জলি মিত্র
— সুধাংশু রায়
— সঞ্জয় ধানুক
— ‘K’ – Guest Code Only
— ‘B-Lux 9’ – Friday Nights Only
অর্ণব অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, কিছু নামের পাশে বিশেষ কোড আছে, কিছু নামের পাশে হোটেল বা নির্দিষ্ট দিন লেখা। এর মানে পরিষ্কার—এই পাচারচক্র কেবল স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা দপ্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর শিকড় ঢুকে আছে বিনোদন ও রাজনীতির অভিজাত জগতে।
“B-Lux 9”—এটা কি কোনো হোটেল? না, ক্লাব?
সে সার্চ করল—B-Lux নামে একটি এক্সক্লুসিভ মেম্বারস ক্লাব আছে EM বাইপাসের কাছে, যেখানে অভিজাত গেস্টরা নিয়মিত আসেন, সদস্য না হলে প্রবেশ নিষেধ।
ঠিক সেই মুহূর্তে অর্ণবের ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর।
“তুমি হয়তো ভাবছো তুমি জিতে গেছো, মি. বসু। কিন্তু মনে রেখো, কেউই পুরোটা জানে না। তুমি শুধু একটা অংশ দেখেছো। বাকিটা এখনও অন্ধকারেই আছে।”
অর্ণব কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল।
পরদিন সকালে সে ক্লাবে ঢোকার ব্যবস্থা করল এক ভুয়া পরিচয় দিয়ে। ক্লাবের ভেতরে গাঢ় আলো, মদ আর মিউজিকের গুঞ্জন। কেউ পরিচিত নয়, অথচ অদ্ভুতভাবে সবাই যেন কিছু একটা জানে। দেওয়ালে ঝোলানো ছিল বড় বড় শিল্পীর ছবি, আর তার নিচে বসে থাকা কোট-টাই পরা কিছু লোক যেন দেখেও না-দেখার ভান করে।
ঠিক তখনই ক্লাবের এক কোণায় চোখে পড়ল সেই মানুষটিকে—নীতীন গার্গ, একজন বড় টেলিকম সংস্থার CEO। দোলার খাতায় ওর নামের পাশে লেখা ছিল—“Escort Services – Screening Partner”
অর্ণব ভেতরে ঢুকে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। “মিস্টার গার্গ, আপনি জানেন না, আমি কে। কিন্তু আপনি জানেন, আপনি কী করেছেন। আমি এখনই বের করব আপনার মুখোশ।”
গার্গ হেসে বলল, “তুমি হয়তো ভাবছো, আমরা ভয় পাবো। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা তোমার থেকেও বেশি জানি।”
“তাহলে প্রমাণ করে দাও,” অর্ণব চ্যালেঞ্জ করল।
গার্গ গ্লাসটা তুলে বলল, “তুমি বুঝতে পারছো না, মি. বসু। তুমি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছো না। তুমি যুদ্ধ করছো একটি সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যেটা আমাদের রক্ষা করে।”
এই কথার সাথেই, অর্ণব বুঝে গেল—লড়াই শুরু হয়েছে। কিন্তু এবার প্রতিপক্ষ নিছক একজন মানুষ নয়। এটা এক গোটা ছায়া-সভ্যতা, যাদের রক্ত মিশে আছে ক্ষমতার মদে।
৮
রাত তখন ন’টা। EM বাইপাসের পাশে ধূলোমাখা রাস্তার এক কোণায় দাঁড়িয়ে অর্ণব তাকিয়ে ছিল দূরে, যেখানে আলো ঝলমলে বিলাসবহুল ক্লাব ‘B-Lux’ অদ্ভুত নিরবতায় ঢাকা। শহরের ভেতরে আরেক শহর যেন, যেখানে অপরাধ নেই—কারণ সবকিছু এতটাই শুদ্ধভাবে সাজানো, যেখানে অপরাধ নিজেই অলংকার হয়ে ওঠে।
নীতীন গার্গের শেষ কথাগুলো যেন তার কানে গুঁজন করছিল—“তুমি যুদ্ধ করছো সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।”
অর্ণব জানত, এই সমাজব্যবস্থাই দোলা’র ভয়কে সত্যি করেছে, স্মিতার আতঙ্ককে জন্ম দিয়েছে, আর হাজার ‘নিখোঁজ’ শিশুকে চিরতরে কাগজহীন করে তুলেছে। এখন আর শুধু সেন বা মালহোত্রা নয়, এই লড়াই একরকম বিপজ্জনক খেলার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর ফাঁদ থাকতে পারে।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা কন্ঠ—“মিস্টার বসু?”
অর্ণব ঘুরে তাকাল। বছর পঁচিশের মতো এক যুবক, পাতলা চশমা, মুখে অস্থিরতা।
“আমি সোম। আমি আগে ‘সেন ফাউন্ডেশন’-এ কাজ করতাম। এখন আর করিনা। কিন্তু আমার কাছে কিছু আছে… যা আপনাকে জানতে হবে।”
“কোথায় কথা বলা যাবে?”
“একটা জায়গা আছে। গড়িয়াহাটের কাছে। কিন্তু আপনাকে একা আসতে হবে।”
অর্ণব একটু থেমে বলল, “আসছি। তবে তুমি ঠিকঠাক কথা বললে, শুধু আমাকে নয়—অনেককে বাঁচাতে পারো।”
গড়িয়াহাটের এক পুরনো গলি। গলির ভিতরে ছোট্ট এক ছাপাখানার পেছনে একটা ঘর—অন্ধকার, শুধুই একটা টেবিল, দুটো চেয়ার, আর এক দেয়ালে বহু পুরনো পত্রিকার কাটিং সাঁটানো।
সোম বসে পড়ল। হাতে একটা খাম।
“এই ফাইলটা আমি বহুদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমি জানতাম একদিন কেউ না কেউ আসবেই খুঁজতে। আপনি যদি সত্যিই সত্যি খুঁজতে চান, তাহলে এটা নিন।”
অর্ণব ধীরে ধীরে খামটা খুলল।
ভেতরে পঁচিশটা ছোট ছোট ছবি—সব শিশু, বয়স ৫ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। প্রতিটি ছবির নিচে নাম, বয়স, ‘প্রাপ্তি স্থান’ লেখা।
— রেশমি, ৭, জয়নগর স্টেশন থেকে উদ্ধার, ২০১৯
— সুমন, ৮, পাণ্ডুয়া রাস্তা, অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া, ২০২০
— নুসরাত, ৬, শেওড়াফুলি, সরকারি হোম থেকে উধাও, ২০১৮
অর্ণব দেখে প্রতিটি শিশুর ফাইল বন্ধ, তাদের খোঁজ কেউ রাখেনি। আর খাতায় লেখা একটি বিশেষ মন্তব্য তার হৃদয় কাঁপিয়ে দিল—“All marked as ‘transferred to NGO care’. No follow-up done.”
“এই ‘Transferred’ মানে কী?” অর্ণব প্রশ্ন করল।
“এটাই তো ওদের কোড। শিশুকে পাচার করার আগে কাগজে দেখানো হয় সে সরকারি হোম বা NGO-তে পাঠানো হয়েছে। পরে নাম কাটা যায়, বা বলা হয় ‘রান অ্যাওয়ে’। কেউ খোঁজ করে না। কারণ কাগজে ওদের অস্তিত্ব আর থাকে না।”
অর্ণব তখন একের পর এক ছবি দেখতে লাগল। আর একটা ছবিতে তার চোখ আটকে গেল—একটা ছোট্ট মেয়ে, খুব চেনা চেহারা।
“এইটা তো… দোলার রিপোর্টে যে মেয়ে ছিল, নাম শ্রেয়া।”
সোম মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। ওর খোঁজ নিতে গিয়ে দোলা আপা ওদের নজরে পড়ে। তারপর থেকেই ওর ওপর নজরদারি শুরু হয়।”
“ও কোথায় এখন?”
“নেই। তিন বছর আগে ‘বন্দনা ট্রাস্ট’-এ পাঠানো হয় ওকে। তারপর আর কোনো খোঁজ নেই। কিন্তু একটা নাম আমি আপনাকে দিতে পারি—‘B-11’। এটা শুধু একটা রুম নম্বর নয়, এটা একটা জায়গার নাম।”
“কোথায়?”
“নদিয়ার ভেতরে, কৃষ্ণগঞ্জে। ওরা এক পরিত্যক্ত স্কুল বিল্ডিং ব্যবহার করে। সেখানে ট্রেনিং হয়। শিশুদের বদলানো হয়। তাদের পরিচয়, কথা বলার ধরন, এমনকি মুখও—সবকিছু। আমি একবার গিয়েছিলাম, ভয় পেয়েছিলাম।”
“তুমি আমার সঙ্গে যাবে?”
সোম চুপ করে গেল। তারপর বলল, “আমি চলব। এবার পালানোর পালা আমার না।”
পরদিন সকালে অর্ণব, সোম ও একদল নিরাপত্তাকর্মী রওনা দিল নদিয়ার দিকে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের পুকুর, ধানক্ষেত, আর মাঝে মাঝে পথের ধারে বসে থাকা মানুষগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল—এই দেশ এত নিরীহ কেন? এর মানুষগুলো এত সহজে ভুলে যায় কেন? কারও নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কেবল একদিনের শিরোনাম হয়ে পড়ে থাকে, তারপরে স্রেফ নিঃসঙ্গতা।
তারা যখন পৌঁছল সেই পরিত্যক্ত স্কুলে, তখন সন্ধে নামছে। বিল্ডিংটা বাইরে থেকে যেন কিছুই নয়—একদম পুরনো কাঠামো, ধ্বংসাবশেষের মতো। কিন্তু সোম বলল, “ভেতরে লিফটের মতন একটা চেম্বার আছে। সেটা নিচে নামে।”
তারা ভেতরে ঢুকল। আঁধারে টর্চ জ্বলল। হঠাৎই দেখা গেল—একটা খোলা দরজা, নিচে সিঁড়ি, আর দেয়ালে ‘B-11’ লেখা।
অর্ণব নামতে শুরু করল।
ধাপে ধাপে নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। নিচে একটা গন্ধ—ভেজা কাপড়, ব্লিচিং পাউডার, আর প্লাস্টিকের গন্ধ।
তখনই পিছনে সোম ফিসফিস করে বলল—“সাবধানে, এখানেই শেষবার আমি শ্রেয়ার কণ্ঠ শুনেছিলাম… ‘ভাইয়া, আমাকে নিয়ে চল।’”
৯
B-11—এই নামটা ছিল এতদিন রহস্যের মতো, যেন কোনো ভৌতিক ঠিকানা, যা কেবল কানাঘুষোয় শোনা যায়। কিন্তু আজ অর্ণব নিজের চোখে দেখছে সেই নামের পেছনের বাস্তবকে। একঘরের নিচের গুহার মতো অংশ, ছায়ায় ঢাকা, স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল আর তার পাশে মলিন হয়ে যাওয়া হাতের ছাপ। যেন এখানে কেউ কিছু আঁকতে চেয়েছিল, কিছু বলতে চেয়েছিল… কিন্তু কণ্ঠ চুপ হয়ে গিয়েছিল।
সোম মৃদু গলায় বলল, “এই ঘরে শিশুগুলোকে কয়েকদিন রাখত ওরা। এরপর ট্রেইনিং শুরু হতো। নাম বদলানো, মুখ বদলানো, আচরণ পাল্টে দেওয়া। কেউ হয়ে উঠত গৃহপরিচারিকা, কেউ ‘দত্তক’ মেয়ে, আবার কেউ যেত বিদেশে—শরীরের দাম নিয়ে।”
অর্ণব চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল, জায়গাটা পরিত্যক্ত ঠিকই, কিন্তু সাম্প্রতিক। দেওয়ালের ধুলোতে এখনও পায়ের ছাপ আছে। ঘরের একপাশে একটা পুরোনো টেবিল, আর তার নিচে একটা বস্তা। বস্তা খুলতেই উঠে এল শিশুর জামাকাপড়, নোটবুক, কিছু ছোট ছোট জুতো।
তার গায়ে লেখা নাম—“শ্রেয়া, ক্লাস ১, নীলগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়”
অর্ণব কেঁপে উঠল।
“ও কি এখানেই ছিল?” তার কণ্ঠ রুক্ষ হয়ে এল।
“হ্যাঁ,” সোম বলল। “আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে জেনেছিলাম, শ্রেয়াকে শেষ দেখা গেছে এখানেই। ও খুব স্মার্ট মেয়ে ছিল। সব কিছু মনে রাখত। আমি ওকে বারবার বলতাম—তুই বাঁচতে পারবি না। কিন্তু ও বলত, ‘আমি পালাব, আমি মায়ের কাছে যাব।’”
অর্ণব হঠাৎ নিচু হয়ে একটা কাঠের বাক্সের মতো কিছুর দিকে হাত বাড়াল। ভিতর থেকে একটা ক্যামেরার পুরোনো মেমোরি কার্ড বেরোল। তার ওপর লেখা—“ভি-রুম ফিড, 04-08-2021”
“ভি-রুম মানে?” অর্ণব জিজ্ঞেস করল।
“ওরা একটা রুমে ভিডিও করত শিশুগুলোর কথোপকথন, মানসিক অবস্থা, প্রতিবাদ ক্ষমতা। যেন ভবিষ্যতে ‘কাস্টমাইজ’ করে বিক্রি করা যায়।”
অর্ণব বুঝে গেল—এই চিপে হয়তো রয়েছে সেই মুহূর্তগুলো, যা আদালতে সত্যের শেষ শ্বাসপ্রশ্বাস হয়ে উঠতে পারে।
ঠিক তখনই বাইরে গাড়ির শব্দ।
“কেউ আসছে!” সোম চিৎকার করল।
অর্ণব টর্চ নিভিয়ে দেয়। দেওয়ালের পেছনে গা লুকিয়ে দেখে, দু’জন লোক—গম্ভীর মুখ, হাতে বড় ব্যাগ।
“তারা ফিরেছে। চলো!” অর্ণব ফিসফিস করে সোমকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পাশের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
পেছনে, সেই পুরোনো স্কুলবাড়ি যেন আবার নিস্তব্ধ। কিন্তু তারা জানে—আজ এই নীরবতা কোনো নিরাপত্তা নয়, এটা চিহ্ন—আরেকটা নরক একসময় এখানে ছিল।
দুপুর। কলকাতা।
সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে মেমোরি চিপটা প্লে করা হচ্ছে। পর্দায় দেখা যাচ্ছে ধূসর রঙের ছোট্ট ঘর। একটা চেয়ারে বসে আছে এক ছোট্ট মেয়ে—চোখে ভয়, মুখে প্রশ্ন।
“তোমার নাম কী?”
— “শ্রেয়া।”
“তুমি এখানে এসেছো কেন?”
— “এক লোক বলেছিল, আম্মু আসবে। কিন্তু এখন তো কেউ আসে না।”
“তুমি পালাতে চাও?”
— “হ্যাঁ। আমি জানি মায়ের বাড়ি কোথায়। আমি একা যাব।”
এই কথার পর, ক্যামেরা থেমে যায়। আওয়াজ শোনা যায়—একজন পুরুষের গলা—
“এই মেয়ে খুব বেশি কথা বলে। পাঠিয়ে দাও লাইন চেঞ্জে। এদের সঙ্গে রাখা যাবে না।”
অর্ণব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
“এই কণ্ঠটা কার?” সে জিজ্ঞেস করল ফরেন্সিক কর্মকর্তাকে।
“ভয়েস ম্যাচ করে দেখেছি। এটা কারোর পরিচিত নয়। কিন্তু আপনার দেওয়া গেস্ট লিস্ট অনুযায়ী, এক নাম আছে যাকে তদন্তের বাইরে রাখা হয়েছিল—‘K’. যেহেতু কোনো ছবি বা পরিচয় ছিল না, আমরা ওকে ধরিনি।”
“এবার ধরতে হবে,” অর্ণব বলল। “এই ‘K’ এখনই আমাদের পরবর্তী টার্গেট।”
“আর শ্রেয়া?” ফরেন্সিক অফিসার কাঁপা গলায় বলল।
“আমরা জানি না, ও বেঁচে আছে কিনা। কিন্তু আজ থেকে এই কণ্ঠ আমাদের অস্ত্র। কোর্টে এই ভিডিও চলবে—একটা শিশুর নিখোঁজ হওয়ার আগে তার শেষ কথোপকথন।”
হাসপাতালে দোলা সেই ভিডিও দেখে চুপ করে ছিল। শেষবার যখন শ্রেয়া বলেছিল—“আমি একা যাব,” তখন তার চোখ বেয়ে নেমে গিয়েছিল নিঃশব্দ জল।
“এই ভিডিও একদিন ইতিহাস হবে,” সে বলল।
“আর তুমি সেই ইতিহাসের গর্ভধারিণী,” অর্ণব বলল।
তারা জানত, সামনে আরও বিপদ, আরও ছায়া। কিন্তু এই যুদ্ধে এখন পিছনে ফিরতে নেই। সামনে শুধু একটাই লক্ষ্য—‘K’। সেই অন্ধকারের মূল মুখ, যে এখনও নিজেকে অদৃশ্য রাখে।
১০
কলকাতা, রাত ১১টা। শহর ঘুমোতে শুরু করেছে, কিন্তু অর্ণব বসুর ঘুম নেই। ল্যাপটপে বারবার চলছে সেই ভয়েস ক্লিপ, যেখানে শ্রেয়া তার জীবনের শেষ কথাগুলো বলেছিল। ‘আমি মায়ের কাছে যাব’—এই নিরীহ বাক্যেই লুকিয়ে আছে গোটা চক্রের মুখোশ খোলার চাবিকাঠি। অর্ণব জানে, এবার তাকে শেষ পরতটা ছিঁড়তেই হবে।
গেস্ট লিস্টে “K” নামে যে কোড আছে, তার চারপাশ ঘিরেই এখন তদন্তের কেন্দ্রবিন্দু। এই লোকটি কখনও ধরা দেয়নি, ছবি নেই, ঠিকানা নেই, শুধু একটা ‘বিরল উপস্থিতি’ রয়ে গেছে সমস্ত শিকারের চারপাশে। এমনকি মালহোত্রা বা সেনের মতো মানুষরাও কথা বলার সময় এড়িয়ে গিয়েছিল এই নাম।
তবে একটিমাত্র সূত্র ছিল—B-Lux Club-এর অ্যাক্সেস কার্ডের রেকর্ডে, “K” নামে এক VIP অতিথি প্রবেশ করেছিল প্রতি শুক্রবার রাত ১০টায়, ব্লক B-9 নম্বর রুমে। সিসিটিভি ফুটেজ অন্ধকার, মুখ ঢেকে রাখা। কিন্তু ফরেন্সিক ফুটেজে তার হাতে একটা উল্কি দেখা যায়—একটি ধনুক ও তীর।
এই চিহ্ন দেখে হঠাৎই অর্ণব মনে পড়ে—এই প্রতীকটা একবার দোলার রিপোর্টে এসেছিল। একটি প্রভাবশালী মিডিয়া হাউসের লোগোর বিকল্প সংস্করণ। নাম—‘প্রবাহ মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’।
এর সিইও—কৌস্তভ বসু।
চমকে উঠেছিল অর্ণব। একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক, সমাজসেবক, এনজিওর নিয়মিত দাতা হিসেবে পরিচিত এই মানুষটিই কি সেই মুখোশের নিচে ‘K’?
পরদিন সকালে বিশেষ অনুমতি নিয়ে অর্ণব পৌঁছাল প্রবাহ মিডিয়ার সদর দফতরে। মিডিয়ার ভেতর তখন ফিসফাস—“CID এসেছে”, “কৌস্তভদা আবার কি করেছেন?” কেউ কিছু জানে না, কেউ কিছু বলতেও চায় না।
রিসেপশন পেরিয়ে সে যখন দোতলায় পৌঁছল, কৌস্তভ বসু নিজেই বেরিয়ে এল তার কাচঘেরা কেবিন থেকে। বয়স চল্লিশের আশেপাশে, গম্ভীর চেহারা, মুখে হালকা হাসি।
“মিস্টার বসু, কিছু প্রশ্ন আছে আপনার কাছে,” অর্ণব বলল।
“নিশ্চয়ই, আমার ঘরে আসুন,” কৌস্তভ বলল।
ঘরের দরজা বন্ধ হতেই কৌস্তভ বলল, “আপনি যা খুঁজছেন, তাতে হয়তো আপনার চাকরি চলে যাবে।”
অর্ণব থেমে গেল।
“আপনি জানেন, আমরা ‘K’ কে খুঁজছি?”
“জানি। আর জানি যে তুমি অনেকটা এগিয়েও গেছো,” কৌস্তভ চোখে চোখ রেখে বলল। “কিন্তু একটা কথা ভেবেছো কখনও? যে ব্যবস্থা পুরোটা জানে না, সে ব্যবস্থা কাকে সাজা দেবে?”
“আপনি শিশু পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আপনি সেনকে অর্থ দিতেন। আপনি মালহোত্রার চ্যানেল ব্যবহার করে নাম মুছে দিতেন। এই ভিডিও প্রমাণও আছে,” অর্ণব বলল।
“তা হলে গ্রেফতার করো,” কৌস্তভ এগিয়ে এসে বলল।
“করব। কিন্তু আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। শ্রেয়া কোথায়?”
একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তারপর কৌস্তভ হেসে বলল, “ও বেঁচে আছে। কারণ আমি চেয়েছিলাম ও বাঁচুক। ও ভেতরে শক্ত ছিল, বুদ্ধিমান ছিল। আমি শুধু ওকে ‘পরীক্ষা’ করছিলাম। কিন্তু তুমি যদি ওকে চাও, নাও।”
সে ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা চাবি দিল।
“EM বাইপাসের কাছে ‘অরণ্য হোম’ বলে একটা পুরনো রিহ্যাব সেন্টার আছে। সেখানেই আছে শ্রেয়া। আজ রাত পর্যন্ত।”
অর্ণব বুঝে গেল, সময় একেবারেই কম। সে ফোন করল সুপ্রিয়কে, পুলিশ ফোর্স সহ সে রওনা দিল ‘অরণ্য হোম’-এর দিকে।
রাত ১০টা। অন্ধকার অরণ্যর মতো নির্জন বাড়ি। বাইরে থেকে বোঝা যায় না যে ভিতরে একটা মানুষ বাঁচার জন্য লড়ছে। দরজা খুলে পুলিশ ঢুকল, কক্ষের পর কক্ষ খোঁজা হতে লাগল।
অবশেষে একটা ঘরে, ধুলো জমে যাওয়া পর্দার পাশে, ছোট্ট একটা মেয়ে শুয়ে ছিল—চোখ বন্ধ, গায়ের কাপড়ে দাগ।
“শ্রেয়া!” অর্ণব চিৎকার করে তার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “আমি এসেছি। তোমার মা তোমার কথা ভাবছে। চলো, ঘরে চল।”
মেয়েটি চোখ খুলল। দুর্বল, ফ্যাকাসে, কিন্তু তাতে একটুখানি দীপ্তি।
“তুমি কি সত্যি এসেছো?” সে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, আমি এসেছি। আর এবার তোমাকে কেউ আর ছুঁতে পারবে না।”
অর্ণব তাকে কোলে তুলে নিল। বাইরের আলোয় সেই ছোট্ট মুখটা যেন ঘুমন্ত শহরের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠল—সহ্য করা, হারানো, কিন্তু শেষপর্যন্ত টিকে থাকা।
কোর্টে কৌস্তভ বসুর বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা হল—মানবপাচার, শিশু নির্যাতন, জালিয়াতি, তথ্য গোপন। সেন ও মালহোত্রা ইতিমধ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
প্রেস কনফারেন্সে দোলা বসে জানাল—“এই শহর অনেক কিছু চেপে রাখে। কিন্তু কিছু মানুষ, কিছু কণ্ঠ সবকিছুকে ছিঁড়ে সামনে আসে। শ্রেয়া সেই কণ্ঠ।”
অর্ণব তাকে দেখে হালকা হাসল। “লড়াই শেষ নয়, কিন্তু আজ একটা নামহীন শিশুর নাম ফিরে পেলাম।”
প্রতিদিনের ভিড়ের শহর জানে না, কিভাবে ‘রাত’ একেকবার জয়ী হয় ‘আলো’র উপর। কিন্তু এই একদিন, এই এক মুহূর্ত জানিয়ে দেয়—আলো ফিরবেই।
শেষ