Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প

রক্তরাঙা ছাপাখানা

Spread the love

অর্ঘ্যদীপ রায়


পর্ব ১

কলকাতা, ১৮৫৭। শহরের বুকে তখনও রাত নেমে আসেনি, কিন্তু সূর্যের আলো যেন লুকোচুরি খেলছে কুয়াশা আর ধোঁয়ার আড়ালে। গঙ্গার ধারে, শোভাবাজারের পেছনের এক অচেনা গলির ভিতরে, একটি পুরনো ছাপাখানা নিঃশব্দে নিঃশব্দে জেগে ওঠে প্রতিরাতে। বাইরে থেকে দেখলে কেউ ভাববে—এটি কোনো দেউলিয়া ব্যবসায়ীর বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা। ভাঙা জানালা, ঝুলে থাকা দরজা, আর ধুলো জমে থাকা সাইনবোর্ড—“চরণ প্রেস।” কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, এখানে প্রতিরাতে গোপনে লেখা হয় এক নতুন ইতিহাস।

চরণ দত্ত, বয়স পঁচিশ, এই প্রেসের চালক, অথচ তার পরিচয় কেবল মুদ্রাকর নয়—সে এক অগ্নিমূর্তি, শব্দের যোদ্ধা। দিনের বেলায় সে ছদ্মবেশে অন্য ছাপাখানায় কেরানি, কিন্তু রাত নামলেই সে হয়ে ওঠে “স্বদেশী বার্তা” পত্রিকার প্রধান মুদ্রাকর—এক গোপন পত্রিকা যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের জাগাতে শুরু করেছে।

আজকের সংখ্যায় ছাপা হবে মাধবী সেনের নতুন কবিতা। মাধবী, যিনি ছদ্মনামে লেখেন—‘দূর্বা’। ব্রাহ্মসমাজের এক বিধবা, যিনি চরণদের বিপ্লবী আখড়ার বুদ্ধিদাত্রী। কবিতাটি কেবল শব্দের খেলা নয়, তার মধ্যে রয়েছে এক গুপ্ত সংকেত, যা দিল্লির বিদ্রোহী দের কাছে পৌঁছাবে সুরাট হয়ে। আজকের রাত্রি, তাই শুধুমাত্র আরেকটি পত্র প্রকাশ নয়—এটি একটি বিপ্লবী যোগাযোগের পর্ব।

চরণ হাতে লাল কালির দোয়াত রেখে টাইপ গঠনের কাজে ব্যস্ত। পেছনের ঘরে বসে অদ্বৈত ঘোষ, প্রেসের প্রবীণ সম্পাদক, যিনি এক সময় নিজেই ছিলেন এক সিপাহী বিদ্রোহের সমর্থক। তাঁর চোখে জ্বলে ওঠে পুরনো অভিজ্ঞতার দীপ্তি। তিনি হাতে একটি ছোট কাঁচের বোতলে কিছু শুকনো কাগজের কুচি রাখছেন—এগুলি নাকি নীলের চাষে নিপীড়িত এক কৃষকের চিঠি।

ঠিক তখনই, দরজায় টোকা পড়ে—তিনটি টোকা, বিরতি দিয়ে আরেকটি। চরণ দ্রুত গিয়ে খোলে দরজা। এক যুবক ঢোকে, মাথায় মাটি রঙের পাগড়ি, কাঁধে বস্তা।

“নাম কী?” চরণ শান্ত গলায় প্রশ্ন করে।

“সদানন্দ মুখার্জি। টাইপসেটার। কর্ণওয়ালে কাজ করতাম, এখন খিদিরপুরে নতুন আসি। শঙ্করদা বলেছিলেন… আপনি লোক খুঁজছেন।”

চরণের চোখ সরু হয়। শঙ্কর? সে নিজেই তো যাচাই না করে কাউকে পাঠাবে না। কিন্তু সদানন্দের চোখে একটা ভদ্রতা, মুখে স্বাভাবিক কৌতূহল। চরণ ভেতরে ডাকল।

“আমরা যেটা ছাপি, সেটা বাজারে পাওয়া যায় না,” চরণ বলে উঠল।

“জানি,” সদানন্দ মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, “সেইজন্যই এসেছি। এই কাজ শুধু টাইপ নয়, সাহসও লাগে, তাই তো?”

অদ্বৈত দৃষ্টি দেয় চরণকে। “তাকে একটা প্যারা টাইপ করতে দাও। ‘প্লো’ আর ‘প্লট’ শব্দে ভুল হলে বিদায়।”

চরণ এগিয়ে দিল একটি হস্তলিখিত কবিতা। সদানন্দ দ্রুত হাতে কাজ শুরু করল। তার টাইপ চাপানোর দক্ষতায় চরণের কপালে ভাঁজ পড়ে না, কিন্তু মন কিন্তু পুরোপুরি ভরসা করে না।

অদ্বৈত মুখে বললেন, “আচ্ছা, সদানন্দ, তোমার চোখে ব্রিটিশরা কেমন?”

এক মুহূর্ত থেমে সদানন্দ বলল, “সাহেবরা সুশৃঙ্খল, তবে ভদ্রতার মুখোশ পরে অত্যাচার চালায়। আমাদের হাড় দিয়ে বানানো সেই মুখোশ একদিন আমি নিজে ছিঁড়ে ফেলতে চাই।”

অদ্বৈতের চোখে হালকা প্রশ্রয় দেখা গেল, কিন্তু মাধবী, যিনি অন্য ঘর থেকে পুরো কথোপকথন শুনছিলেন, আস্তে করে জানালার পাল্লা ফাঁক করে মুখ দেখালেন।

“চরণ, আমার কবিতার শেষ লাইনটা পাল্টে দিও,” তিনি বললেন। “যেখানে লিখেছিলাম ‘রক্তে রঙিন পতাকা’, তার বদলে দাও—‘রক্তে জাগে অক্ষরের ধ্বনি’। এর মধ্যে দিয়ে আমার সংকেত যাবে দিল্লিতে। বুঝলে তো?”

চরণ মাথা নেড়ে আবার কাজে মন দিল। রাত গভীর হতে লাগল। প্রেসের শব্দ যেন হৃদস্পন্দনের মতো চলতে থাকল—চটচট… ট্যাঁক… চাপ… চাপ… চটচট।

কিন্তু ঠিক তখনই, ছাদের উপর হালকা একটা শব্দ হল—কেউ যেন পা টিপে হাঁটছে। অদ্বৈত চরণকে চোখের ইশারায় কিছু বললেন। চরণ কাজ থামিয়ে মাটির নিচের গোপন খুপরিতে লেখা সংখ্যা লুকিয়ে ফেলল। সদানন্দ কিছুটা ভড়কে গেল।

“কী হল?” সে জিজ্ঞেস করল।

“ইঁদুর,” চরণ হেসে বলল, “তবে আমাদের প্রেসে মানুষরূপী ইঁদুরও মাঝে মাঝে ঢোকে। সাবধান!”

রাত প্রায় শেষের দিকে। কাগজ ছাপা শেষ, মাধবী কবিতা পড়ে দেখলেন—প্রতি শব্দে বারুদের গন্ধ। সদানন্দকে কিছু কাগজ গুছিয়ে আনতে বলা হল পেছনের ঘর থেকে। সে চলে যেতেই চরণ চুপিচুপি বলল, “ওর মুখে ঠিক কথা আছে, কিন্তু চোখে ভয় নেই। একজন নতুন টাইপসেটার এত দ্রুত জেনেছে সংকেতের ভাষা? আমি নিশ্চিত না…”

অদ্বৈত গম্ভীর স্বরে বললেন, “তাকে সময় দাও। ভয় যেখানে নেই, সেখানে হয় বিপ্লব—নয়তো বিশ্বাসঘাতকতা।”

চরণ চেয়ে রইল সদানন্দের ফেরা পথের দিকে।

ছাপাখানা শান্ত। কিন্তু সেই শান্তির নিচে ছাপা হয়ে চলেছে—একটি নতুন বিপ্লব, এক গুপ্ত সন্ধির শুরু।

পর্ব ২

কলকাতার আকাশ তখনো পুরোপুরি আলোয় ভরে ওঠেনি। গঙ্গা থেকে ভেসে আসা হালকা কুয়াশার মধ্যে চাপা পড়ে আছে শহরের নিঃশব্দ শ্বাস। কিন্তু “চরণ প্রেস”-এর ভেতরে সকালের আলো ঢোকার আগেই শেষ হল এক বিপ্লবী সংখ্যার ছাপা কাজ। কাগজগুলো গুছিয়ে রাখা হলো তিনটি গুঞ্জনির বাক্সে—যার প্রত্যেকটি পৌঁছাবে আলাদা তিনটি গন্তব্যে—সোনাগাছি, সুরাট এবং বর্ধমান।

চরণ শেষ কাগজের প্রুফ চেক করে অদ্বৈতের দিকে তাকাল। “সব ঠিকঠাক। মাধবীদির সংকেতও সঠিক জায়গায় বসানো হয়েছে—তৃতীয় স্তবকে, ‘রক্ত’ শব্দের আগে লঘু মুদ্রাক্ষর। দিল্লির লোকেরা জানবে এটা সংকেত।”

অদ্বৈত চোখ মেলে বললেন, “আজকে কাগজে শুধু কথা নয়, আগুন ছাপা হয়েছে, চরণ। শব্দের ভেতরে বারুদ আছে। তুমি জানো এর পরিণতি কী হতে পারে?”

চরণ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আমরা প্রতিদিনই মৃত্যু ছাপি দাদা। কিন্তু ওই কাগজটাই কাল আমাদের বাঁচাবে।”

সেদিন সকালের আলো ঢোকার আগেই সদানন্দ প্রেস থেকে বেরিয়ে গেল, কাঁধে একগুচ্ছ কাগজ নিয়ে, যেগুলোর মধ্যে কিছু ছিল সাদামাটা ছাপা আর কিছু কাগজের ভাঁজে ছিল বিপ্লবের নকশা। সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালো হাতিবাগানের একটা নির্জন গলির চায়ের দোকানে। সেখানে বসে চা খেতে খেতে কাগজের গুঁটি গুলোকে একটা পুরনো খবরের কাগজে মুড়িয়ে রাখল।

ঠিক সেই সময়ই, পেছনে এক ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল।

“সব খবর ঠিকঠাক পৌঁছেছে সাহেবের কাছে?” লোকটির গলা কর্কশ।

সদানন্দ মাথা ঘোরাল। “এখনও না। আজ সন্ধ্যায় কর্নওয়ালিস স্কোয়ারে গিয়ে জমা দেব।”

লোকটি আরও কাছে এগিয়ে এসে বলল, “তুমি ছাপাখানায় ঢুকে পড়েছ, কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। কিন্তু খবরদার, একটা ভুলও যেন না হয়। চরণ দত্ত সন্দেহ করছে।”

সদানন্দ ঠোঁট চেপে বলল, “চরণ খুব বুদ্ধিমান। মাধবী সেন আমাকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। কিন্তু ওরা জানে না, আমার চোখে ছাপা কাগজ নয়, আমি পড়ি লোকের চোখ। এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা। প্রেসের মধ্যে কে কী লিখছে, কে কী লুকোচ্ছে—সব আমার কাছে পরিষ্কার হবে।”

লোকটি মাথা নেড়ে চলে গেল। সদানন্দ আবার চায়ের কাপটা হাতে নিল, কিন্তু এবার তার মুখের ভেতর এক তীব্র গন্ধ—আগুনের গন্ধ, বেইমানির গন্ধ।

প্রেসের অন্যদিকে, দুপুরে মাধবী এসে পৌঁছালেন। হালকা ধুতি, সাদা আঁচল, কপালে কালি নেই—তিনি যেন শহরের মাঝে এক নিঃশব্দ আগ্নেয়গিরি। চরণ তাঁকে কাগজের নমুনা তুলে দিল।

মাধবী শব্দ গুলো পড়লেন—“‘রক্তে জাগে অক্ষরের ধ্বনি’—সুন্দর হয়েছে। তবে আমি দেখছি, যেই সংখ্যাগুলো কবিতা ছাপছে, সেগুলো বেশি আগ্রহ পাচ্ছে পাঠকের। এটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

চরণ বলল, “আমাদের কবিতা ওদের বারুদের চেয়েও ভয়ংকর। কুড়ি লাইনের কবিতা, অথচ তার মধ্যে যদি তিনটি সংকেত থাকে, তাহলে দিল্লিতে রক্ত, কানপুরে আগুন। সাহেবরা এসব বুঝতে পারে না।”

মাধবী নিচু গলায় বললেন, “সাহেবরা না বুঝলেও, কেউ যদি আমাদের মধ্যেই থাকে…”

চরণ থমকে গেল। “তুমি সদানন্দের কথা বলছ?”

“আমি নিশ্চিত না,” মাধবী ধীরে বললেন। “তবে গত পরশু যেই পাতার সংকেত ছিল ‘গোধূলি’ শব্দে, সেটা ঠিকই ছিল, অথচ মিরাট থেকে উত্তর এল ‘সূর্যাস্ত’। এটা কীভাবে সম্ভব? কেউ যেন কিছুটা বদলে দিচ্ছে।”

চরণ তখন বুঝতে পারল, ওদের গাছের ভেতরে শিকড় নয়, ঢুকে পড়েছে এক সাপ।

রাতের দিকে প্রেসে ফিরে এলো সদানন্দ। চরণ তখন একা, টাইপের কাঠিতে নতুন সংখ্যা সাজাচ্ছে।

“আজ তোমার টাইপ ভালো হয়েছে,” চরণ বলল।

“ধন্যবাদ। আপনি তো বলেছিলেন, অক্ষর ঠিক হলে বিপ্লব ঠিক হয়,” সদানন্দ হাসল।

চরণ একটা টাইপ কাঠি রেখে বলল, “তোমার টাইপ ঠিক, কিন্তু তোমার হাতের লেখা? সেদিন যে পরিত্যক্ত পত্রিকার পাতায় তুমি ‘প্লট’ বানিয়েছিলে, সেটা দেখে বুঝলাম তুমি শুধু টাইপসেটার না। তুমি লেখাও জানো।”

সদানন্দের চোখে হালকা দুশ্চিন্তার ছায়া এল, কিন্তু মুহূর্তেই গায়েব।

“আমি স্কুলে লেখাপড়া করতাম। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর বন্ধ হয়ে যায়। লেখার অভ্যাসটা চলে যায়নি।”

চরণ চুপ করে থাকে। কিন্তু তার মন তখন অন্য কিছুর ইঙ্গিত পাচ্ছে।

“আচ্ছা সদানন্দ,” চরণ হঠাৎ বলল, “তুমি কী কখনো সাহেবদের অফিসে কাজ করেছ? মানে টাইপ রাইটিং বা কিছু?”

সদানন্দ ঘাড় নাড়ল, “না। শুধু একবার সেক্রেটারিয়েটের গেটের বাইরে গিয়ে দেখে এসেছিলাম। ভেতরে যাওয়ার সাহস হয়নি।”

চরণ হাসল। কিন্তু তার চোখে তখন সন্দেহ জমে উঠছে।

সেদিন রাত ২টা। প্রেসে সবাই চলে গেছে। চরণ একা। সে গিয়ে পেছনের ঘরের প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল দোতলায়। ওখানে আছে এক পুরনো কাঠের আলমারি—যার ভেতরে লুকানো থাকে পূর্ববর্তী ছাপা হওয়া সমস্ত সংখ্যা ও সংকেতের রেকর্ড।

চরণ ধীরে ধীরে আলমারির কপাট খুলল। কিন্তু খুলেই হঠাৎ থমকে গেল।

একটা সংখ্যা নেই।

সেই সংখ্যাটাই, যেখানে ছিল কবি ‘দূর্বা’র সেই লুকানো সংকেত—‘আলো পেরিয়ে ছায়ার ধ্বনি শুনবে রাত্রির বর্ণ’। এই কবিতার তৃতীয় স্তবক ছিল সংকেতপূর্ণ। কিন্তু তার মূল কপি নেই!

চরণ বুঝে গেল—যে কেউ এই সংখ্যাটা নিয়েছে, সে এই আন্দোলনের হৃদপিণ্ড ধরে টান দিয়েছে।

সে নিচে নেমে এসে অদ্বৈতকে খবর পাঠাল। মাধবীকেও জানানো হলো।

অদ্বৈত এসে বললেন, “এর মানে কেউ আমাদের মধ্যে থেকেই ছাপাখানার আলমারি খুলেছে। কেবল কর্মচারী নয়—এতটা জানে শুধু ভিতরের কেউ। কিন্তু কে?”

চরণ ধীরে বলল, “আমি কাল থেকে সদানন্দকে অনুসরণ করব। যদি সে সত্যিই আমাদের লোক হয়, তাহলে বুঝব। আর যদি না হয়… তাহলে ওকেও ছাপার অক্ষর নয়, রক্ত দিয়ে লিখতে হবে।”

প্রেস নিস্তব্ধ। বাইরে গঙ্গার জল থমকে আছে যেন। কিন্তু ছাপাখানার ভেতর, শব্দ আর সন্দেহ মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এক ভয়ংকর সত্যের ছাঁচ।

পর্ব ৩

কলকাতা শহরের গা ঘেঁষে ছুটে চলা গঙ্গার জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল চাঁদের ম্লান আলো। রাত গভীর, কিন্তু চরণ দত্তের চোখে ঘুম নেই। আজ সে বাইরে বেরিয়েছে, সাধারণ কেরানির বেশে নয়—বরং একজন নিঃশব্দ অনুসন্ধানকারী হিসেবে। তাঁর মাথায় এখন একটাই চিন্তা—সদানন্দ মুখার্জি কে? চরণ বিশ্বাস করে, বিপ্লবী আন্দোলনে অক্ষরের থেকে বড় অস্ত্র আর নেই। কিন্তু সেই অস্ত্রের পাহারাদার যদি বিশ্বাসঘাতক হয়, তাহলে গোটা সংগ্রামটাই হয়তো ব্যর্থ হয়ে যাবে।

বিকেলবেলা সদানন্দ প্রেস থেকে বেরিয়ে সোজা রওনা দেয় দক্ষিণ দিকের খালপাড়ের দিকে। তার কাঁধে ময়লা বস্তা, যেন সে কাগজ-কুড়োনো মজুর। চরণ পেছন পেছন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে। শহরের আলো-আঁধারির মধ্যে দুজন দুজনকে দেখছে না, কিন্তু তাদের ছায়াগুলো যেন একে অন্যকে অনুসরণ করছে।

সদানন্দ গিয়ে থামে কর্নওয়ালিস স্কোয়ারের কাছাকাছি একটা পুরনো ভাঙা ফটকের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে বস্তা থেকে কাগজের কিছু গুঁটি বের করে দেয় এক মাঝবয়সী লোকের হাতে। লোকটি একটা ছোটো খাম এগিয়ে দেয়, সদানন্দ সেটি নিয়ে দ্রুত পকেটে ভরে নেয়।

চরণ দূর থেকে দেখে ফেলে এই বিনিময়। কিন্তু শব্দে কিছু বোঝা যায় না। তখন হঠাৎ সে দেখে, সদানন্দ পেছনের সরু গলি দিয়ে সরে যাচ্ছে। চরণ সিদ্ধান্ত নেয়, সে এবার গলিটা ধরে সামনে এগিয়ে যাবে। হাতে তার নেই কোনো অস্ত্র, কেবল বুকের মধ্যে আছে উত্তেজনা আর সন্দেহের খাঁজ।

গলি শেষ হতে না হতেই এক কোণ থেকে ভেসে আসে চাপা আওয়াজ, “তুমি আমাদের অনুসরণ করছো কেন?”

চরণ থমকে যায়। এক পাথরের থামের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে সদানন্দ, হাতে ধরা একটা ছোটো কাঠের চাবুকের মতো কিছু।

“তুমি আমাকে ভুল বুঝছো চরণদা,” সে বলল, ঠাণ্ডা গলায়। “আমি আজ সন্ধ্যায় শুধু পুরনো কিছু টাইপ ব্লক সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম।”

“টাইপ ব্লক নিয়ে কর্নওয়ালিস স্কোয়ারে?” চরণ প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

সদানন্দ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মা খুব অসুস্থ। আমি প্রেসে কাজ করছি ঠিকই, কিন্তু খরচ চালাতে গিয়ে টান পড়েছে। পুরনো প্রেসের লোকজন কিছু ধাতব টাইপ কিনতে চায় কালোবাজারে, তাই বিক্রি করছিলাম। ভুল করেছি জানি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।”

চরণের মুখ কড়া, কিন্তু চোখে দ্বিধা। সে একবার ভাবল, হয়তো ভুল করছে। কিন্তু তখনই সদানন্দের পকেট থেকে পড়ে যায় সেই খামটা—যেটা সে কিছুক্ষণ আগে নিয়েছিল। চরণ তৎক্ষণাৎ সেটা কুড়িয়ে নেয়। খুলতেই দেখা যায় ভিতরে কিছু ইংরেজিতে লেখা কাগজ—‘Translated Cipher — From Subaltern Bengali Source’।

চরণ আর কিছু না বলে এক ধাক্কায় সদানন্দকে দেয়ালে ঠেলে ধরে। “তুমি গুপ্তচর। কাগজের ভাঁজে যেসব সংকেত ছিল, সব তুমি ইংরেজদের কাছে পাঠাও।”

সদানন্দ এবারও চুপ থাকে না। বরং মাথা উঁচু করে বলে, “আমি যা করছি, দেশের ভালো ভেবেই করছি। এই ছাপাখানা, এই কবিতা, এই বিপ্লব—সব লোক দেখানো। সাহেবরা যতক্ষণ আছে, দেশ অন্তত একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আছে। স্বাধীনতা মানেই কি বিশৃঙ্খলা নয়?”

চরণ কিছু না বলে তার কলার চেপে ধরে বলে, “স্বাধীনতা মানে সাহেবের বুটের নিচে নতজানু হয়ে বাঁচা নয়। তুমি আজ রাতেই প্রেসে ফিরে চুপচাপ থাকবে। আমি কাউকে কিছু বলছি না… কিন্তু যদি আর কিছু ফাঁস করো, তাহলে পরের সংখ্যায় ছাপা হবে তোমার মৃত্যুসংবাদ। অক্ষরে নয়, রক্তে।”

চরণ সদানন্দকে টেনে প্রেসের দিকে ঠেলে দিল। কিন্তু জানে, এটা কেবল শুরু। বিশ্বাসঘাতকরা একবার মুখ খুললে থামে না, আবার কামড় দেয়।

পরদিন সকাল। মাধবী প্রেসে এসে পৌঁছালেন। তাঁর চোখে আজ অন্যরকম উগ্রতা।

“গতরাতে দিল্লি থেকে সংবাদ এসেছে,” তিনি বললেন। “আমাদের সংকেত পৌঁছেছে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তিত হয়ে। যার মানে স্পষ্ট—আমাদের ভিতরে ফাঁস হচ্ছে তথ্য। তুমি কিছু জানতে পেরেছো?”

চরণ চুপ করে থেকে শুধু খামের কাগজগুলো তাঁর দিকে এগিয়ে দিল। মাধবী তা দেখে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “এই কাগজগুলোই প্রমাণ, আমাদের ভিতরে সাপ ঢুকেছে। এখন প্রশ্ন—তাকে বিষে মারব, না অক্ষরে?”

চরণ বলল, “আমি ভাবছি, তাকে ব্যবহার করা যায় কিনা। তাকে দিয়ে ভুল তথ্য ছড়াতে পারলে ইংরেজরা বিপথে যাবে।”

মাধবী বললেন, “সঠিক। এবার আমরা আমাদের অক্ষরে আগুনের বদলে ছায়া ছাপাব। যাতে তারা ছায়ার পেছনে ছুটে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।”

অদ্বৈত তখন এসে ঢুকলেন। “তোমরা ঠিক ভাবছো। আমাদের এবার বিপ্লব নয়—চতুরতা লাগবে। সত্য আর মিথ্যার মাঝখানে যে ধোঁয়া, তার মধ্য দিয়েই লড়াই হবে।”

চরণ জানে—এখন থেকে ছাপাখানার প্রতিটি অক্ষর শুধু বিপ্লব নয়, বিভ্রান্তিও ছড়াবে।

প্রেসের ঘরে ঢুকল সদানন্দ। তার মুখে হালকা ব্যথা আর ক্লান্তির ছাপ, হয়তো ভিতরটা খানিকটা দগ্ধ হয়েছে। চরণ তাকিয়ে বলল, “আজ তোমার জন্য একটা বিশেষ কাজ আছে। এই সংখ্যায় একটা নতুন কবিতা ছাপা হবে, যার শব্দে শব্দে ছড়ানো থাকবে ভুল সংকেত। ইংরেজরা যদি পড়ে, তারা ভুল রাস্তায় যাবে।”

সদানন্দ এক মুহূর্ত থেমে থাকল। তারপর মাথা নত করে বলল, “যা বলবেন, তাই করব।”

চরণ জানে, সে এক ডামির যুদ্ধ শুরু করেছে। যেখানে শত্রুকে সত্য মনে করিয়ে দিতে হবে মিথ্যা—আর মিথ্যাকে বানিয়ে তুলতে হবে তাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক।

প্রেসের ভেতরে ছাপা হতে লাগল সেই নতুন কবিতা—“ছায়া যখন জাগে, আলো তার পথ ভুলে।” শব্দের ভেতরে ছড়ানো এক অদ্ভুত খেলা। বাইরের দুনিয়া জানে না, চরণ এখন কেবল মুদ্রাকর নয়, সে এখন ছায়ার কারিগর।

পর্ব ৪

কলকাতার আকাশে আজ অস্বাভাবিক রকমের ঘন মেঘ। জোড়াসাঁকোর গলিতে হেঁটে চলেছে সদানন্দ মুখার্জি, মাথায় সাদা গামছা, গায়ে চিটচিটে পাঞ্জাবি। কিন্তু এই ছেঁড়া পোশাকের নিচে রয়েছে এক অতল রহস্য। সে এখন কেবল একজন টাইপসেটার নয়—বরং এখন সে ‘দুই জগতের চর’। একদিকে ছাপাখানার বিশ্বাস, অন্যদিকে ব্রিটিশ অফিসার ক্যাপ্টেন রেনল্ডস-এর কাছ থেকে আসা দিকনির্দেশ।

কিন্তু আজকের কাজটা আলাদা। আজ তাকে ছাপতে হবে একটি ছায়া-সংকেত—একটি কবিতা যার প্রতিটি স্তবকে লুকানো আছে ভুল তথ্য, বিভ্রান্তিকর সংকেত, এবং এক উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রতারণা। চরণ দত্ত নিজেই এই কবিতা লিখেছে, মাধবীর নির্দেশে। এমন শব্দ চয়ন করা হয়েছে যাতে ব্রিটিশরা তা পড়ে ভুল বোঝে, ভুল পথে হাঁটে।

সদানন্দ প্রেসে এসে ঢোকে হালকা হাঁপিয়ে। চরণ সেদিকে না তাকিয়ে বলে,
“আজকের ছাপা সাবধানে করো। টাইপে যদি একটি মাত্র হরফ এদিক-সেদিক হয়, ইংরেজরা হয়তো ঠিকমতো ফাঁদ বুঝে ফেলবে।”

সদানন্দ চুপচাপ মাথা নোয়ায়।

মাধবী সেন সামনে এসে দাঁড়ান, তাঁর হাতে কাঁচাপত্র।
“এই পংক্তিগুলো এমনভাবে ভাঙবে যাতে তারা ভাবে আমরা দিল্লি নয়, কানপুরে পরিকল্পনা করছি। এবং সেই ভুল তথ্য দিয়েই তারা সেখানে যাবে।”

সদানন্দ কবিতার দিকে তাকায়।
“আলো চলে পশ্চিমে, ছায়া নামে গোপনে।
নদীর ঢেউ বলে দেয়, পথ ভুল করেছে কপোতে।”

সে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি রাখে। এই কবিতা ইংরেজদের পেটানো কায়দার বাইরে কিছু নয়। কিন্তু চরণ জানে, এই হাসি হয়তো আত্মবিশ্বাসের নয়—বরং কুৎসিত জালবোনা।

রাত নামার আগেই চরণ গোপনে বেরিয়ে পড়ে সদানন্দের গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে। গত তিন দিন ধরে সে লক্ষ্য করছে, সদানন্দ প্রতিদিন সন্ধে বেলা প্রেস থেকে কিছু ছাপা পৃষ্ঠা নিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যায়, কার কাছে দেয়—তা এখনও পরিষ্কার নয়।

চরণ আজ ছদ্মবেশে বেরিয়েছে, পাটকাঠির মতো শরীর, পরনে ধুতি, মুখে একরাশ গোঁফ। মাথায় উঁচু করে বেঁধেছে গামছা, যেন রাস্তার মাঝারি দোকানদার। সদানন্দ হাঁটতে থাকে গোপীবল্লভ লেনের দিক দিয়ে, তারপর ঢুকে পড়ে এক অচেনা দালানে। চরণ দূর থেকে দেখে, দালানের পেছনে একটি দরজা খুলে অপেক্ষা করছিল এক লোক, মাথায় হ্যাট, গায়ে লাল কোট—নিশ্চয়ই সাহেব অফিসের কেউ।

সদানন্দ কিছু কাগজ এগিয়ে দেয়, আর লোকটা তাকে একটা খামে ভরে কিছু দেয়। চরণ দেখে—খামটা এবার ভারি, মনে হয় মুদ্রা।

চরণ আর দেরি করে না। সে নীরবে ফিরে যায় প্রেসে। সেখানে পৌঁছে পায় অদ্বৈত ঘোষ বসে আছেন, হাতে মোমের আলো, সামনে পুরনো সংখ্যা বিশ্লেষণ করছেন।

“আপনি নিশ্চয়ই ওর পেছনে ছিলেন,” অদ্বৈত বললেন, না তাকিয়েই।

চরণ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। এবার আর সন্দেহ নেই। ও শুধু গুপ্তচর নয়, নিয়মিত ঘুষ নিচ্ছে আর তথ্য পাচার করছে। আজকে আমি ওকে ফাঁসাতে চাই।”

“কীভাবে?”

“আগামী সংখ্যায় আমি একটা ভুয়া সংকেত দেব, এমন কিছু যা দিয়ে ওর সাহেব প্রভুরা ছুটে যাবে রংপুরের দিকে। আর ঠিক সেই সময়ই আমরা প্রকৃত কাগজ পাঠাব রাজশাহীতে।”

অদ্বৈত বললেন, “তুমি জানো তো, যদি তোমার ফাঁদ ধরা পড়ে, ওরা শুধু ছাপাখানাই পুড়িয়ে দেবে না—তোমার শরীর দিয়েও অক্ষর বানাবে।”

চরণ ধীরে বলল, “আমি মরে গেলেও চাই না এই প্রেসের মাটি সাহেবদের বুটের নিচে চলে যাক।

পরদিন সন্ধ্যা। প্রেসে আজ এক অদ্ভুত উত্তেজনা। সদানন্দ আজ একটু বেশিই কথা বলছে, সহকর্মীদের সঙ্গে কৌতুক করছে, কাগজ ছাপার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। যেন আজ সে নিশ্চিত, আজকের কাজটাই তার সবচেয়ে বড় সাফল্য।

কিন্তু সে জানে না, চরণ আর মাধবী মিলে তার জন্য তৈরি করেছে এক ঘাতক-সংকেত—একটি ‘ডেকয়’ কবিতা।

এই সংখ্যার কবিতার নাম—“রক্তের মেঘে আলো ঢাকা”। চরণ নিজেই টাইপ সাজিয়েছে এমনভাবে যাতে শব্দের মাঝের হরফগুলো দিয়ে গড়ে ওঠে একটি ভুয়া মানচিত্র—রংপুরের লোকেশন, তারিখ এবং সময়।

সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে সদানন্দ আবার গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়। চরণ এবার আর অনুসরণ করে না। সে অপেক্ষা করে ফাঁদে পড়ার।

রাত ১১টা। চরণ নিজের ঘরে বসে আছে। হাতে মোমবাতি, চোখে চিন্তা। মাধবী এসে দরজায় দাঁড়ান।

“সব ঠিকঠাক হয়েছে?”

“হ্যাঁ,” চরণ বলল। “আমরা আজকে ওকে শুধু ঠকাইনি, সাহেবদেরও রক্তের মিছিলে পাঠিয়ে দিয়েছি। কাল খবর আসবে।”

“আর সদানন্দ?”

চরণ উঠে দাঁড়ায়। “ওর জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। কাল সকালে আমরা ওর সামনে সত্যটা খুলে ধরব। তারপর ওকে ছাড়ব, তবে শুধু একবার। যেন সে বুঝে যায়—কোনটা ছায়া আর কোনটা ছেদন।”

মাধবী চুপ করে থাকেন। তাঁর চোখে এক অদ্ভুত আলো।

পরদিন সকাল। সদানন্দ প্রেসে এসে দেখে চরণ, অদ্বৈত ও মাধবী বসে আছে একসঙ্গে। সামনে রাখা একটি চিঠি—সাহেবদের দপ্তর থেকে পাঠানো, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে রাজশাহীতে সেনা পাঠানোর নির্দেশ বাতিল হয়েছে।

চরণ সদানন্দের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমরা জানি সব কিছু। তুমি আমাদের ঠকিয়েছিলে। কিন্তু এবার আমরা তোমাকে ঠকালাম। আমরা চাই তুমি আজ প্রেস ছাড়ো—তবে বেঁচে। আর যদি সাহেবদের বলে দাও, তাহলে তারা জানবে—তুমি ভুল খবর পাঠিয়েছ।”

সদানন্দ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, ঠোঁটের কোণে বিদ্বেষ আর লজ্জার ছায়া।

চরণ ধীরে বলে,
“তুমি অক্ষরকে মাটি ভেবে পা রেখেছিলে। কিন্তু আমরা জানি, অক্ষরের ভেতর থাকে আগুন। সেই আগুন আজ তোমার বিশ্বাস পোড়াল।”

সদানন্দ কিছু না বলে ঘর ছাড়ে।

চরণ তাকিয়ে থাকে সেই দরজার দিকে, আর প্রেসের দেয়ালের ছায়ায় পড়ে থাকে তার নিজের মুখ।

পর্ব ৫

সদানন্দ মুখার্জি চলে গিয়েছে তিন দিন হয়ে গেছে। চরণ দত্ত প্রত্যেকটা সকাল শুরু করে সেই ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে, যেটা প্রেসের ভেতরের কাঠের দেয়ালে ঝুলে আছে ১৮৪৯ সাল থেকে। সেই ঘড়ি দেখতে যতই শান্ত মনে হোক, তার প্রতিটি টিকটিক শব্দ যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে—সময় এখন থমকে থাকলেও বিপ্লব থেমে নেই।

এই তিন দিনে প্রেসে আবার একটা নতুন গতি এসেছে। যেন সদানন্দের উপস্থিতি চাপ সৃষ্টি করেছিল সকলের উপর, আর আজ হঠাৎ নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা পাওয়া গেছে।

অদ্বৈত ঘোষ ধীরে ধীরে পুরনো চেহারায় ফিরছেন। চরণ প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসে ছাপার নমুনা দেখে, মাধবী কবিতা পাঠাচ্ছেন নতুন ছদ্মনামে—এইবার ‘কৌশিকী’। সব ঠিকঠাক চলে যাচ্ছে বলেই মনে হয়…

…তবে সেটা ঠিক যতক্ষণ না একরাতে ঘটল সেই অদ্ভুত মৃত্যুর ঘটনা।

প্রেসে কাজ চলছিল রাত আটটা পর্যন্ত। নতুন কর্মচারী রঘুনাথ—এক যুবক, লাজুক, কিন্তু কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান—আজ বেশি সময় ধরে থেকেছিল টাইপ পরিষ্কার করতে। তার কাজ ছিল কালির দোয়াতগুলো গুছিয়ে রাখা, ব্যবহৃত ব্লক ধুয়ে শুকনো কাঠিতে সাজিয়ে রাখা।

চরণ বাড়ি চলে গিয়েছিল সাড়ে আটটার মধ্যে। অদ্বৈত তখনো নিচের ঘরে পুরনো সংখ্যা খুঁজছিলেন, রঘু একা ওপর ঘরে কাজ করছিল।

তখনই এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ে পুরনো লোহার আলমারি। অদ্বৈত ছুটে এসে দেখে, রঘুর মাথা থেঁতলে গেছে—সেই আলমারির নিচে। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ব্লক, কিছু ছাপা কাগজ, আর রঘুর হাতের মুঠোয় ধরা একটা কাগজ।

কাগজটা অদ্বৈত তুলে নেন। তাতে লেখা আছে একটা কবিতার পংক্তি, যা মাধবী পাঠাননি। শব্দগুলো খাপছাড়া, ধাঁধার মতো—

“নোনা কালি গায়ে মাখে,
যে বর্ণে মৃত্যু নাম লিখে…”

অদ্বৈতের গলা শুকিয়ে যায়। তিনি জানেন, এই ছাপাখানায় মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু এত হঠাৎ? এত নির্ভুল?

তিনি চরণকে খবর দেন।

পরদিন সকালে, চরণ এসে প্রেসে ঢোকে, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কালি শুকনো ছেঁড়া কাগজের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

রঘু মারা গেছে। পুলিশের মতে, এটা নিছক দুর্ঘটনা—আলমারি ভারসাম্য হারিয়ে পড়েছে। কিন্তু চরণ জানে, ছাপাখানার প্রতিটি স্ক্রু, প্রতিটি হিঞ্জ সে নিজে হাতে কষে রেখেছে।

“এটা দুর্ঘটনা নয়,” চরণ গম্ভীরভাবে বলল। “রঘু কিছু দেখে ফেলেছিল। আর কেউ চেয়েছিল, সেটা আর কারো চোখে না পড়ে।”

মাধবী তখন এসে পড়েছেন, তাঁর মুখেও একই রকম অস্থিরতা।

“রঘু নীরব ছিল, কিন্তু তার চোখ কাঁচের মতো স্বচ্ছ। সে দেখেছে নিশ্চয়ই… কাকে? সদানন্দ তো চলে গিয়েছে। তাহলে কে?”

চরণ বলল, “আমি এখন সন্দেহ করছি, সদানন্দ একা ছিল না। কেউ হয়তো তাকে ঢুকতে সাহায্য করেছিল, তথ্য সরবরাহ করতেও। আমরা ভুলে গেছি, একজন বিশ্বাসঘাতক গেলে আরেকজন তার ছায়া হয়ে ফিরে আসে।”

অদ্বৈত তখন একটা ময়লা কাগজ সামনে রাখলেন।

“দেখো,” তিনি বললেন, “এই ছাপা নমুনা রঘুর মুঠোয় পাওয়া গেছে। কিন্তু এটা আমাদের এই সপ্তাহের কাজ নয়। টাইপ গঠন অদ্ভুত, আর শব্দগুলো কুৎসিতভাবে বদলে গেছে। কেউ প্রেসে রাতে গোপনে কিছু ছাপাচ্ছে।”

চরণ বুঝতে পারে, প্রেস এখন আর শুধু বিপ্লবের অক্ষর ছাপে না—এটা এখন ছলনার ছাঁচও বানাচ্ছে।

সেদিন সন্ধ্যায়, চরণ সিদ্ধান্ত নেয় সে একা রাতভর প্রেসে পাহারা দেবে।

“আমি জানি, কেউ হয়তো ফিরে আসবে,” সে মাধবীকে বলল। “রঘুর মৃত্যুর পরেও যদি কেউ সাহস করে আসে, তবে সে আমাদের বিপ্লবের চেয়েও ভয়ংকর।”

রাত দশটা। প্রেস নিস্তব্ধ। চরণ এক কোণে বসে আছে, হাতে কাঠের লাঠি। ঘড়ির কাঁটা নড়ে, পেছনের জানালার কাঁচে মাঝে মাঝে বাতাসের ছায়া পড়ে।

ঠিক তখনই, সে একটা চাপা শব্দ শুনতে পেল—উপর ঘরে। খুব হালকা, যেন টেবিলের ওপর কিছু সরানো হচ্ছে।

সে নিঃশব্দে উঠে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেল। সিঁড়ির শেষে গিয়ে দেয়ালে কান পাতল। কারও নিঃশ্বাসের আওয়াজ।

সে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল।

ঘরের মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি, মুখ ঢেকে টাইপ ব্লকের পেছনে দাঁড়িয়ে দ্রুত কিছু সাজাচ্ছে। কিন্তু সেটি সদানন্দ নয়—এই মুখ সে চিনে।

নাম বিভূতিভূষণ, প্রেসের পুরনো কর্মচারী, শান্ত প্রকৃতির, দশ বছর ধরে টাইপসেটার। কেউ কখনও ভাবেনি সে এমন কিছু করতে পারে।

চরণ ধীরে ভেতরে ঢুকে পেছন থেকে বলল, “তুমি কি আবার একজন ‘সদানন্দ’ হতে চাও?”

বিভূতি চমকে পিছিয়ে পড়ে।

“না! আমি… আমি শুধু…”

“তুমি শুধু নিজের বিশ্বাস বিক্রি করছো। রঘু কী দেখেছিল, বলো।”

বিভূতির মুখে আতঙ্ক। “রঘু দেখে ফেলেছিল আমি কিছু ছাপছি রাতে। সে প্রশ্ন করলে আমি ভয় পেয়ে বলি, এটা অদ্বৈতবাবুর পুরনো অক্ষর চর্চা। কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি। আমি ওকে থামাতে চেয়েছিলাম… ধাক্কা দিয়েছিলাম। ও পড়ে গিয়েছিল।”

চরণ শান্ত গলায় বলল, “তাহলে রঘুর মৃত্যু দুর্ঘটনা ছিল না। তুমি তার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলে, আমরাও তোমার মুখ চিরতরে বন্ধ করবো না—কিন্তু তুমি আজ প্রেস থেকে বিদায় নেবে। কারণ আমরা শব্দ দিয়ে বিপ্লব করি, খুন দিয়ে নয়।”

পরদিন সকালে, প্রেসের সামনে ছড়িয়ে পড়ল একটি ছোট ছাপা পত্রিকা—“রক্তরাঙা অক্ষর”—যেখানে লেখা আছে রঘুর নামে এক কবিতা, আর নিচে ছোট অক্ষরে লেখা:

“মুদ্রাক্ষরের মৃত্যু হলেও, কালি কখনো শুকায় না।”

চরণ জানে, প্রেস এখনও বেঁচে আছে। আর যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন শব্দ দিয়ে রক্ত লেখা হবে।

পর্ব ৬

শহরটা যেন দিনকে দিনের মতো করে জাগে না এখন। কলকাতার বাতাসে একটা থমথমে উত্তেজনা জমে আছে—যেন চারদিকেই বিস্ফোরণ অপেক্ষা করছে, শুধু কেউ টোকা দেয়নি। এই অবস্থার মধ্যে “চরণ প্রেস” যেন একটা ছায়ার দুর্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে জন্ম নেয় শব্দের বিদ্রোহ, আর ছড়িয়ে পড়ে গুপ্ত সংকেত।

রঘুর মৃত্যুর পর প্রেসে অদ্ভুত এক স্তব্ধতা। বিভূতিভূষণ চাকরি থেকে সরে গিয়েছে—প্রেসের ইতিহাসে প্রথমবার, কাউকে তাড়ানো হয়নি, তবু তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়নি। আর এখন যারা আছে, তারা একেকটা ছায়ার মতো নীরব, মুখে কিছু না বলেও চোখে লেখা—“আমরা জানি, মৃত্যু আমাদের এক নিঃশ্বাস দূরেই হাঁটে।”

চরণ দত্ত আজ প্রেসে নেই। সে গিয়েছিল গুপ্তিপাড়া, সেখানে এক নতুন বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে উঠছে যারা পূর্ব বাংলা থেকে পালিয়ে এসেছে। তাঁদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে নতুন সংখ্যা—যেখানে থাকবে এক ছায়া-কবিতা, যার প্রতিটি স্তবকে ছড়িয়ে আছে পরবর্তী বিদ্রোহের বার্তা।

কিন্তু আজকের সংখ্যা বিশেষ। কারণ এই সংখ্যা ছাপা হবে এক নতুন কালি দিয়ে—সাত দিনের পুরনো রক্তমেশানো কালি, যা মাধবী নিজে বানিয়েছেন। কালির এই রঙ শুধু প্রতীক নয়, এটা প্রমাণ—রঘুর রক্ত শুধু মাটিতে পড়েনি, অক্ষরের ভেতরেও ঢুকে গেছে।

সন্ধ্যাবেলা চরণ ফিরে আসে। প্রেস তখন খালি। অদ্বৈতবাবু কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন, বাকি কর্মচারীরা ছুটি নিয়েছে। শুধু মাধবী বসে আছেন এক কোণে, তার সামনে ছোট একটা টিনের বাটিতে রাখা লালচে কালি।

“এই কালি দিয়ে আজ ছাপা হবে সেই কবিতা,” তিনি বললেন। “তুমি বলেছিলে, রঘু যেন শুধু একটা মৃত্যুর সংখ্যা না হয়ে থাকে। এই কালি সেই শপথ।”

চরণ নিচু গলায় বলল, “এই কালি যদি ছাপার অক্ষর ভিজিয়ে তোলে, তাহলে সাহেবরা যখন তা পড়বে, তাদের চোখ জ্বলে উঠবে। কিন্তু জানো তো, আজ আমি শুধু বিদ্রোহ ছাপতে চাই না, আমি ভয় ছাপতে চাই। এমন ভয়, যা তাদের বুটের নিচে কাঁপন ধরাবে।”

মাধবী তার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বলেন, “আমাদের শব্দ আজ আর কেবল প্রতিবাদ নয়, এই শব্দ এখন খুনের সমান। তুমি তৈরি তো?”

চরণ মাথা নাড়ে। সে জানে, আজ রাতটা হয়ত একটা চিরস্থায়ী স্মৃতি হয়ে থাকবে প্রেসের ইতিহাসে।

টাইপ সাজাতে বসে চরণ খেয়াল করে, অদ্ভুতভাবে তার টাইপ কাঠিগুলো একটু হালকা লাগছে। কিছু ব্লক যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে হিসেব করে—সাতটা স্বরবর্ণ, তিনটে ব্যঞ্জনবর্ণের ব্লক নেই। তার মানে কেউ প্রেসে এসেছিল গতকাল রাতে। কেউ যাকে কেউ চেনে না, কেউ যাকে এখনো চরণ ধরতে পারেনি।

সে দ্রুত মাধবীকে ডাকে।

“আমরা ভেবেছিলাম বিভূতিকে সরিয়ে দিলেই কাজ শেষ। কিন্তু কেউ এখনো আমাদের কাজ নষ্ট করতে চায়। এটা শুধু বিশ্বাসঘাতকতা নয়—এটা সরাসরি প্রতিশোধ।”

মাধবী চিন্তিত গলায় বলেন, “তা হলে কি সদানন্দ ফিরে এসেছে?”

চরণ মাথা নাড়ে, “না। সদানন্দ যতোই চতুর হোক, এত নিঃশব্দে ফিরে এসে আবার কিছু সরিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা কারও খুব কাছের কাজ।”

তারা সিদ্ধান্ত নেয়, আজ রাতেই ছাপা হবে কবিতা—নতুন টাইপ ব্লক কেটে। চরণ পুরনো কাঠ দিয়ে নিজের হাতে বানায় ‘র’, ‘ব’, আর ‘অ’-র ব্লক। প্রতি আঘাতে তার হাতের পেশি জ্বলে যায়, কিন্তু সে থামে না।

মধ্যরাতের একটু আগে, তারা সেই কবিতা ছাপা শুরু করে—

“যে শব্দ রক্তে ভেজে, সে মৃত্যু বাঁচে না।
কালির নিচে থাকে আগুন—ধোঁয়ায় ভুল করো না।”

চরণ প্রতিটি শব্দ ছাপে ধীরে, এমন যত্নে, যেন কেউ তার হৃদস্পন্দন মেপে শব্দ গড়ছে।

কিন্তু হঠাৎই, পেছন ঘর থেকে এক ঝনঝনে শব্দ। মাধবী চমকে ওঠেন। চরণ লাঠি নিয়ে দৌড়ে যান পিছনের ঘরের দিকে। সেখানে ঢুকে দেখে—একজন ছায়ামূর্তি জানালার গ্রীলে পা রেখেছে, বেরিয়ে যেতে চায়।

“থামো!” চরণ চিৎকার করে।

ছায়ামূর্তি থামে না। সে লাফিয়ে বাইরে পড়ে পালাতে চায়। কিন্তু জানালার ফাঁকে সে আটকে যায়।

চরণ এগিয়ে যায়, ধরতে চায়। কিন্তু ছায়ামূর্তির হাতে ধরা একটি কাগজ হঠাৎ চরণ ছিনিয়ে নেয়। তারপর সে দেখে—এটা সেই নতুন কবিতার প্রথম প্রুফ!

“তুমি এইটা নিতে এসেছিলে?” চরণ ফিসফিস করে।

ছায়ামূর্তি এবার মুখ খুলে বলে, “তোমরা যেটা করছো সেটা খেলা। আর এই খেলার পরিণতি জানো না। সাহেবরা যতটা নিষ্ঠুর, তার চেয়ে বেশি কৌশলী।”

চরণ চিনতে পারে না মুখ। নতুন কেউ? নাকি পুরনো মুখের নতুন ছদ্মবেশ?

ততক্ষণে ছায়ামূর্তি সরে গেছে, অন্ধকার গিলে ফেলেছে তাকে।

রাত তিনটা। চরণ আর মাধবী বসে আছে প্রেসে। সামনে রাখা সেই কাগজ, যা ছিনিয়ে আনা হয়েছে ছায়ামূর্তির হাত থেকে।

“ওদের লক্ষ্য কবিতা নয়, সংকেত,” মাধবী বললেন। “তারা চায় আমরা ভুল বার্তা দিই, যাতে তাদের হাতে থাকে অস্ত্র। এবার আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আরও গভীর ছায়া বানাবো, নাকি আলোয় তুলে আনবো সবাইকে।”

চরণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “আগামী সংখ্যায় আমরা ঘোষণা করবো—একটা চিঠি, যেটা সাহেবদের উদ্দেশ্যে। ‘স্বদেশী বার্তা’ এবার সরাসরি মুখোমুখি হবে।”

মাধবী তাকিয়ে থাকেন।

“তুমি জানো তো, তার মানে হচ্ছে—কালির নিচে এবার রক্ত ছড়াতে চলেছে।”

চরণ উঠে দাঁড়ায়।

“তবে এবার সেই রক্ত আমাদের নয়—ওদের।”

পর্ব ৭

কালো রাতের বুক চিরে ঢুকে পড়েছে ভোরের হালকা আলোকছায়া, কিন্তু শোভাবাজারের সেই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো ছাপাখানার জানালায় কোনো আলো নেই। আজকের সকাল এক অদ্ভুত স্তব্ধতায় ডুবে আছে। চরণ দত্ত সারারাত ঘুমাননি। জানালার পাল্লা খুলে তিনি তাকিয়ে ছিলেন গলির শেষ মাথার দিকে—যেখান থেকে ছায়ামূর্তিটা পালিয়ে গিয়েছিল আগের রাতে।

প্রেসের টেবিলে রাখা সেই ছিনিয়ে আনা কবিতা—যার প্রতিটি অক্ষরে মিশে ছিল নতুন বিপ্লবের সংকেত—এখন একটি নষ্ট পৃষ্ঠায় পরিণত হয়েছে। কালির দাগ ছড়িয়ে পড়েছে এমনভাবে, যেন কেউ ইচ্ছে করেই শব্দগুলো ঝাপসা করে দিয়েছে।

চরণ জানেন, সময় এসেছে প্রকাশ্যে আসার। এতদিন ধরে তারা ছায়া হয়ে কাজ করছিলেন, এবার আলোয় এসে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করার পালা।

তবে তার আগে প্রয়োজন আরও কিছু নিশ্চিত হওয়া—কে সেই ছায়ামূর্তি? কে আজও প্রেসের ভেতরে ঢুকে সাহস করে কবিতা চুরি করতে আসে? সদানন্দের বিদায়, বিভূতির বিদ্বেষ, রঘুর মৃত্যু—সব কিছু এক জটিল ছকের অংশ।

এমন সময় অদ্বৈত ঘোষ প্রবেশ করেন, হাতে কাগজের প্যাকেট। তাঁর চোখে উদ্বেগ।

“এই খবরটা আজ সকালে এসেছে,” তিনি বলেন, “দেখো। দিল্লির কাছাকাছি এক জায়গায়, এক অজ্ঞাত তরুণ বিপ্লবীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। কেউ চেনেনি, শুধু হাতে লেখা একটা শব্দ খোঁজে পাওয়া গেছে তার জামার ভেতরে—‘চরণ প্রেস’।”

চরণ স্তব্ধ হয়ে যায়।

“কে হতে পারে?” মাধবী জিজ্ঞেস করেন, যিনি এসে দাঁড়িয়েছেন পেছনে।

চরণ কাঁপা গলায় বলেন, “গত মাসে আমরা একটি বিশেষ সংখ্যা পাঠিয়েছিলাম দিল্লি, যেটা নিয়ে গিয়েছিল হরিনাথ নামের এক তরুণ, যিনি আমাদের নতুন কবিতাগুলো বিতরণ করতেন। সেই শব্দও তিনিই লিখতেন। হয়তো ধরা পড়েছেন।”

অদ্বৈত বলেন, “হ্যাঁ। এই মৃত্যুর পেছনে সাহেবদের বোঝা যাচ্ছে না, বরং বোঝা যাচ্ছে তাদের ভয়। তারা এখন প্রতিটি অক্ষরের পেছনে সন্দেহ খুঁজছে।”

চরণ বলেন, “তাহলে আমাদের পরবর্তী সংখ্যা ওদের সামনে প্রকাশ্যে যাবে—একটি ঘোষণাপত্র। যেখানে ‘স্বদেশী বার্তা’ সরাসরি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখবে।”

মাধবী বলে ওঠেন, “তুমি জানো না, এর মানে কী? ওরা প্রেস চিহ্নিত করবে, আসবে, গুলিবর্ষণ করবে। আর আমরা সবাই…”

চরণ মাঝপথে থামিয়ে বলেন, “…বিপ্লবীর শব হবো। কিন্তু তার আগে আমরা একটি শেষ বার্তা ছড়িয়ে দেব, যা কেবল সাহেবদের নয়, সমস্ত শহরকে কাঁপাবে।”

তিনদিন পরে। প্রেসের ভেতর প্রস্তুত হচ্ছে এক বিশেষ সংখ্যা—‘শেষ কবিতা’ নামে একটি সংস্করণ, যেটি আর কারও নাম লেখা নয়, বরং তিনটি অক্ষর—স্বাধীন শব্দে স্বাক্ষরিত।

চরণ নিজে হাতে কবিতাটি লিখেছেন। এইবার না কোনও সংকেত, না কোন ছায়া—এইবার কেবল সত্য।

“শব্দ যখন শেষ হয়, তখন জন্ম নেয় অগ্নি,
কালি নয়, এবার রক্তই হবে ছাপা—
গলা টিপে ধরা এই দেশ, আজ ফেরাবে প্রতিধ্বনি—
‘আমরা বেঁচে আছি’, বলবে আকাশ, গাছ, মাটি।”

মাধবী কবিতাটি পড়ে বলেন, “এই অক্ষরগুলো মাটির মতো। যেমন করে রক্তে মিশে যায় ধুলো, তেমন।”

অদ্বৈত বলেন, “এইবার আমরা ছাপবো না শুধু পত্রিকা, এইবার আমরা ছাপবো নিজেদের অস্তিত্ব।”

চরণ প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছাপা হওয়ার সময় একটানা দাঁড়িয়ে থাকেন। যেন প্রতিটি শব্দ তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে।

তারা ৫০০ কপি ছাপেন। কিন্তু এই সংখ্যা তারা প্রেস থেকে ছড়াবে না। তারা পৌঁছে দেবে শহরের প্রধান জায়গায়—টাউন হল, গভর্নর হাউসের গেট, প্রেসিডেন্সি কলেজের সদর দরজা, এবং ধর্মতলার ট্রাম ডিপো।

তিনজন তিনপথে বেরিয়ে পড়েন—চরণ, অদ্বৈত, ও মাধবী।

চরণ পৌঁছান প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে। গেটের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সিপাহি তাকে থামায়।

“কি ব্যাপার?”

চরণ মাথা নিচু করে বলেন, “কাগজ ছড়িয়ে দিচ্ছি। ছাত্রদের জন্য।”

“কোন কাগজ?”

চরণ ছড়িয়ে দেন হাতে থাকা ৫০টি কপি। ছাত্ররা এগিয়ে আসে, কেউ পড়ে, কেউ নেয়, কেউ চোখে চোখ রাখে চরণের। কেউ কিছু বলে না, কিন্তু সেই নীরবতা বুঝিয়ে দেয়—এই শব্দ পৌঁছেছে হৃদয়ে।

অন্যদিকে, অদ্বৈত পৌঁছান টাউন হলের গেটে। তিনি নীরবে সিঁড়ির ধাপে কাগজ রাখেন। পাহারাদার কিছু বোঝার আগেই তিনি উধাও।

আর মাধবী—তিনি যান গর্ভনর হাউসের গেটের কাছে। সাহসিকতা এমনভাবে বিস্ফারিত হয়, যে এক নারী, একা হাতে সাহেবদের প্রাসাদের সামনে বিপ্লবী পত্রিকা রাখে।

পরদিন সকাল। শহর জেগে ওঠে এক অজানা চাঞ্চল্যে। কিছু জায়গায় সাহেবরা জোর করে কাগজ ছিনিয়ে নেয়, কিছু জায়গায় ছাত্ররা তা দেয়ালে সাঁটিয়ে দেয়।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার—ফোর্ট উইলিয়ামের গেটে এক সিপাহী, যিনি নিজে ব্রিটিশ বাহিনীতে, এক কপি পকেটে রেখে দেন।

চরণ ফিরে এসে বসেন প্রেসে। জানালার বাইরে শহর কাঁপছে, সাহেবদের জিপ ঘুরছে, বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চলছে।

অদ্বৈত বলেন, “আমরা হয়তো আজ রাতেই ধরা পড়ব।”

মাধবী বলে ওঠেন, “হোক। তবু এই রাত শহর মনে রাখবে। কারণ আজ আমরা ভোরের আগে বলেছি—‘আমরা আছি’।”

চরণ ধীরে বলেন, “আর যদি প্রেস ভেঙে পড়ে, তবে তার নিচে থাকবে সেই অক্ষর, যা শব্দের চেয়েও বেশি শত্রু।”

তারা জানে, রঘুর মতো আরও কেউ মরবে। হয়তো তারা নিজেরাও। কিন্তু আজ যে সংখ্যাটা ছাপা হয়েছে, সেটা শুধু কাগজ নয়—এক বিপ্লবীর শবদেহ, যা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের পথে শুয়ে আছে।

পর্ব ৮

কলকাতার আকাশ যেন সেদিন একটু বেশি লাল হয়ে উঠেছিল, যদিও সূর্য তখনও উঠেনি। পুব দিগন্তে একরকম কুয়াশার মতো আলো ফুটছিল, অথচ শহরের প্রাণকেন্দ্রের চারপাশে জমে উঠছিল ভয়ে ভেজা নিস্তব্ধতা। শহরের রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে কাগজের টুকরো, কেউ পড়ে দেখছে, কেউ ভয় পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু সবাই জানে—এই কাগজ সাধারণ নয়। এর কালি শুধু ছাপার নয়, এর শব্দে আছে বিদ্রোহের আঁচ।

“স্বদেশী বার্তা”র সেই বিশেষ সংখ্যা ছড়িয়ে গেছে শহরের নানা প্রান্তে। সাহেবদের চোখের সামনে গিয়েও কেউ তা আটকাতে পারেনি। সেই কাগজের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি পঙক্তি যেন একটি অনুরণিত চিৎকার, যা ধাতব পাথরের শহরকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে।

প্রেসে এখন একধরনের প্রস্তুতির সময়। চরণ, অদ্বৈত আর মাধবী কেউ জানেন না, কখন পুলিশ চলে আসবে। হয়তো আজই, হয়তো কাল। কিন্তু তবুও তারা থেমে নেই। চরণ নতুন একটি সংখ্যা ছাপার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—যেটা হবে এক প্রতিক্রিয়া, এক জবাব। যাকে বলে ‘ধ্বনির উত্তর’।

প্রেসে ঢোকার আগে চরণ গলির মুখে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছিলেন। দূর থেকে দেখে বোঝা গেল, গলির ওপাশে দুটো সাহেবি পোশাক পরা লোক ঘোরাফেরা করছে। কেউ কথা বলছে না, কিন্তু দূরত্বে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন কিছু মেপে নিচ্ছে।

চরণ জানে, সময় গুনছে।

প্রেসের ভেতর মাধবী আজ প্রথমবার নিজের হাতে টাইপ সাজাচ্ছেন। তিনি বলেন,
“আজ যদি মরতেই হয়, তাহলে আমার অক্ষর যেন আমারই হাতে সাজানো থাকে।”

চরণ হালকা হাসলেন। “আপনি কেবল কবিতা লেখেন না, আপনি কবিতা বাঁচিয়ে রাখেন। আজকের এই সংখ্যার নাম দেব—‘লাল ছাপা কাগজ’। কারণ এই শব্দগুলো রক্তের চেয়েও বেশি ঘনীভূত।”

অদ্বৈত ঘরে ঢুকলেন একটি পুরনো ব্যাগ হাতে।
“এই ব্যাগে আছে সেই সংখ্যা, যেগুলো আমরা কখনো ছাপিনি। ‘সত্তর পত্র’ নামে এক পাণ্ডুলিপি। যদি আজ আমরা ধরা পড়ি, এই ব্যাগ যেন পৌঁছায় চক্রবাক গোষ্ঠীর কাছে।”

চরণ ব্যাগের দিকে চেয়ে থাকল।
“এই পাণ্ডুলিপি আসলে ইতিহাস। যদি আমরা না থাকি, তাহলে ভবিষ্যতের কেউ বুঝবে, আমরা কী বলতে চেয়েছিলাম।”

মাধবী বললেন, “তাহলে আজকের সংখ্যাটার কাঠামো বলো। আমি টাইপ করব।”

চরণ টেবিল থেকে একটি কাগজ তুলে দিলেন।
সেখানে লেখা:

> “তোমরা যাকে কাগজ বলো, আমরা তাকে বলি মাটি।
এই মাটিতে লিখে রেখেছি, কে কখন কাঁদল।
এখন যদি আগুন ধরাও, কেবল ছাই পাবে না—
পাবে অক্ষরের ভেতরে একটা জাতির আত্মা।”

 

মাধবী পড়তে পড়তেই বলেন, “এই লেখা কেউ পোড়াতে পারবে না।”

চরণ আরেকটি পাতায় কিছু সংকেত লেখেন। এবার আর ছায়া নয়, এবার প্রকাশ্য ভাষায় নাম লেখা—কে কোথা থেকে পত্রিকা ছড়িয়ে দিচ্ছে, কার হাতে পৌঁছবে কোন জেলার মানুষের কাছে।

তখনই দরজার বাইরে এক চাপা শব্দ।

চরণ চোখ তুলে চেয়ে দেখেন—বাইরের ছোট জানালার কাচে ছায়া। কেউ দাঁড়িয়ে।

তিনজন থেমে যায়। মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর একটানা টোকা—দুইবার, বিরতি, তারপর একবার।

“সঙ্কেত!” অদ্বৈতের মুখে বিস্ময়।

চরণ ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। এক তরুণ, শীর্ণ চেহারা, হাতে রক্তমাখা চাদর জড়িয়ে।

“আমি হরিপদ,” সে ফিসফিস করে বলল। “কাকদ্বীপ থেকে এসেছি। রাস্তায় ধরা পড়েছিলাম। দুইজন সিপাহী কাগজ খুঁজছিল। কিন্তু আমি কিছু না বলে পালিয়ে এসেছি।”

চরণ তাঁকে ভেতরে ডাকলেন।

“তুমি কাগজ পেলেই তো সাহেবরা ধরবে। তবু এসেছো?”

হরিপদ বলল, “কারণ আমি জানি, এই কাগজ কেবল ছাপা নয়—এটা এক বিস্ফোরণ।”

মাধবী তার হাতে তুলে দিলেন দশ কপি। “এইবার শেষ যাত্রা। সাহেবরা বুঝুক, ‘স্বদেশী বার্তা’ শুধুই পত্রিকা নয়, এ দেশ নিজের গলা দিয়ে যা বলে, সেটা।”

চরণ ধীরে বললেন, “আর আমরা? যদি আজ রাতে চলে আসে তারা?”

অদ্বৈত বুকে হাত রাখলেন। “তাহলে আমরা লুকোব না। দাঁড়িয়ে থাকব, কালি মাখা হাত নিয়ে। আর বলব—এই হাতেই ছিল তোমাদের ভয়।”

সন্ধ্যা। আকাশে ধোঁয়াশা। গলির মুখে এবার আর কেবল ছায়া নয়—আলোও এসেছে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে দুইটি ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে রাইফেলধারী তিনজন সেনা।

চরণ জানালা দিয়ে দেখেন।

“সময় হয়ে গেছে।”

তারা তিনজন একে একে প্রেসের ঘরের মধ্যে সেই শেষ সংখ্যাটা সাজান। টেবিলের ওপর দশ কপি। এক পাশে অক্ষর সাজানোর কাঠি, অন্য পাশে রক্তমাখা কালি।

মাধবী হাতে ধরেন সেই ব্যাগটা—‘সত্তর পত্র’।

“যদি আমাদের কেউ না বাঁচে, এই ব্যাগ যেন যায় সুধীর চক্রবর্তীর হাতে। ওদের গোষ্ঠী সব কিছু জানে।”

চরণ তাঁর কাঁধে হাত রাখে।

“আপনার কবিতা মরবে না। আপনার শব্দই তো আমাদের অস্তিত্ব।”

ঘণ্টাখানেক পর দরজায় কড়া নাড়ে সিপাহী।

চরণ দরজা খোলে।

“চরণ দত্ত?” সিপাহী জিজ্ঞেস করে।

“আমি,” চরণ বলেন, মাথা তুলে।

সিপাহী ঘরে ঢুকে কাগজ দেখে। কিছু নেয়, কিছু ছুঁয়ে দেখে। তারপর একটি কপি নিয়ে পেছনে দাঁড়ানো সাহেব অফিসারের হাতে দেয়।

অফিসার পড়ে। চোখ সরু হয়। তারপর বলে,
“তুমি কি জানো, এই কাগজ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বিদ্রোহ?”

চরণ বলে, “এই কাগজে আমরা কিছু বলিনি, শুধু লিখেছি। কিন্তু যদি লেখাই এত ভয়ংকর হয়, তাহলে বুঝতে পারছি, শাসন খুব দুর্বল হয়ে গেছে।”

অফিসার কিছু না বলে চরণকে দিকে তাকিয়ে থাকে।

“তোমাদের প্রেস এখন থেকে বন্ধ। আর তুমি, অদ্বৈত ঘোষ, এবং ওই মহিলা—সবাইকে সঙ্গে যেতে হবে। তদন্ত চলবে।”

মাধবী উঠে দাঁড়ান।

“আমরা আসব। কিন্তু মনে রেখো, আমরা যাচ্ছি, অক্ষর যাচ্ছে না। এই ছাপাখানা একদিন নিশ্চিহ্ন হবে, কিন্তু শব্দ যারা পাঠিয়েছে, তাদের থামাতে পারবে না।”

চরণ ধীরে ধীরে দরজা দিয়ে বের হন। পেছনে থাকে টেবিলে রাখা সেই লাল ছাপা কাগজ। বাতাসে ওড়া শুরু করে একটি কপি।

গলির বাতাসে ভেসে ওঠে সেই অক্ষরের চিৎকার:

“আমরা ছাপা বন্ধ করিনি, তোমরা শুধু আমাদের পৃষ্ঠা ছিঁড়েছ।”

পর্ব ৯

ফোর্ট উইলিয়াম-এর একটি অন্ধকার কক্ষে বসে আছে চরণ দত্ত, তার পাশে অদ্বৈত ঘোষ, এবং সামনের চেয়ারে নিঃশব্দে বসে রয়েছেন মাধবী সেন। কক্ষটি বদ্ধ, বাতাস ভারী, দেয়ালের এক পাশে ঝুলছে একটি ছোট খ্রিস্টীয় ক্রস, আর অন্য পাশে ব্রিটিশ রাজপ্রতীক—সিংহ ও ইউনিয়ন জ্যাক। তার মাঝখানে বসে রয়েছে একজন কঠোর মুখাবয়বের সাহেব—লেফটেন্যান্ট চার্লস উইলকিন্স, খাঁটি বাঙালি উচ্চারণে প্রতিটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন বিষের মতো।

“তোমরা কি জানো, এই ‘স্বদেশী বার্তা’ কী করছে শহরে?”

চরণ নিশ্চুপ। মাধবী চোখে চোখ রাখেন, তীক্ষ্ণ, নিঃশব্দ। অদ্বৈত ফিসফিস করে বলেন, “হ্যাঁ, জানি। আমরা জানি, আমাদের শব্দগুলো এখন বোমার মতো। কিন্তু আপনারা যে ভয় পান, সেটা দেখেও তো বোঝা যায়, শব্দ বেশি শক্তিশালী।”

উইলকিন্স হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা একটি ছাপা কাগজ তুলে ধরেন।
“এই কবিতা—‘কালির নিচে থাকে আগুন’—এটা কে লিখেছে?”

চরণ উত্তর দেন না। তিনি জানেন, কিছু কথা বলা মানে নিজেদের ভেতরের অবস্থান ফাঁস করা।

“তাহলে বলুন, এই ‘সত্তর পত্র’ কোথায় আছে?” সাহেবের গলা চড়ছে।

মাধবী এবার শান্ত গলায় বলেন, “আপনি যেটা খুঁজছেন সেটা একটা ব্যাগ না। সেটা ইতিহাস। এবং ইতিহাস কখনো কাউকে ধরা দেয় না। তার প্রকাশ ঘটে নিজস্ব গতিতে, নিজের সময় নিয়ে।”

উইলকিন্স চুপ করে যান। বুঝতে পারেন, এই তিনজন যেন জেলখানার ভেতর থেকেও ভয়হীন। তাদের মধ্যে কেউ নিজেকে বাঁচাতে কিছু বলছে না। বরং, মনে হচ্ছে তারা অপেক্ষা করছে… যেন প্রস্তুত—আরও বড় কিছু করার জন্য।

প্রেস এখন তালাবদ্ধ। বাইরে লাল সিল লাগানো। কিন্তু ভেতরে একটা কাগজ ওড়া ওড়া করছে—একটি অসমাপ্ত পৃষ্ঠা, যার উপরে লেখা—

“যদি প্রেস ভাঙে, তবে শব্দ উঠবে গর্জনে—
যদি কালি শুকায়, তবে রক্তে হবে লেখা।”

গলির ছেলেরা যাদের দেখে প্রতিদিন টাইপ টেনে আনত, তারা আজও জানে, এই প্রেসের প্রতিটি ইট এখন একটা স্মৃতিচিহ্ন। তারা জানে, সাহেবেরা প্রেস বন্ধ করেছে, কিন্তু শব্দ তো রাস্তায় ছড়িয়ে গেছে আগেই।

আর ঠিক তখনই ঘটল প্রথম বিস্ফোরণ।

ধর্মতলার মোড়ে, এক ব্রিটিশ অফিসারের ঘোড়ার গাড়ির নিচে কেউ ছুঁড়ে দেয় এক কাগজের মোড়ানো প্যাকেট। মুহূর্তে বিকট শব্দ—ধোঁয়ায় ভরে যায় রাস্তাঘাট। অফিসার আহত, সিপাহী পালিয়ে যায়। বিস্ময়ের চেয়েও বড় যে বিষয়—প্যাকেটটা মোড়ানো ছিল ‘স্বদেশী বার্তা’-র সেই শেষ সংখ্যায়।

সারাদেশে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। সাহেবেরা বোঝে—তারা চরণ দত্তদের ধরে ফেললেও, বার্তার বীজ ছড়িয়ে গেছে।

ফোর্ট উইলিয়ামের কক্ষে আবার ডেকে আনা হয় চরণকে। উইলকিন্স এবার বললেন, “তোমরা কী প্রমাণ করতে চাও? যে কাগজ দিয়ে বোমা বাঁধা যায়, সেটা তোমরা বানিয়েছ?”

চরণ বলেন, “আমরা শুধু শব্দ লিখি। শব্দ যদি বোমা হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা তোমাদের ভয়, আমাদের নয়।”

উইলকিন্স উঠে দাঁড়ালেন। “আজকের মধ্যেই যদি ‘সত্তর পত্র’ আমাদের হাতে না আসে, তাহলে প্রেস চিরতরে ধ্বংস করা হবে। আর তোমাদের বিচারের অপেক্ষাও থাকবে না।”

চরণ তখন মৃদু গলায় বললেন, “আপনারা যত ভাবেন তার চেয়েও আগেই আমরা ‘সত্তর পত্র’ পাঠিয়ে দিয়েছি। চক্রবাক গোষ্ঠীর সদস্যদের হাতে, গোপনে।”

“তুমি স্বীকার করছো?”

“না। আমি ঘোষণা করছি।”

সিপাহিরা চরণকে আবার কক্ষে নিয়ে যায়। উইলকিন্স বুঝে যান, ভয় দেখিয়ে এই লোকদের কাছে কিছু পাওয়া যাবে না।

এদিকে অন্যদিকে, ব্যাগটি পৌঁছে গিয়েছে দক্ষিণ শহরতলিতে এক পুরনো বটগাছের নিচে—চক্রবাক গোষ্ঠীর পুরনো আখড়ায়। সদস্য সুধীর চক্রবর্তী, ভীমলাল, ও কিশোর বালক কুমারেশ ব্যাগ খুলে দেখে বিস্ময়ে হতবাক। প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন জীবন্ত ইতিহাস—কলমের আঁচড়ে লেখা ছায়া-কবিতা, সংকেত, চিঠি, সাহেবদের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা, গ্রামেগঞ্জের ছড়িয়ে থাকা খবরের তথ্য, এমনকি কিছু অসমাপ্ত উপন্যাস যেগুলো মাধবী লিখেছেন—সাহেব দালালদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলে।

সুধীর বলেন, “এই ব্যাগ কোনো নথি নয়, এটা বেঁচে থাকার প্রমাণ। এবার আমাদের ছাপাখানা তৈরি করতে হবে।”

তারা স্থির করেন, ব্যাগের লেখা দিয়ে নতুন প্রেস গড়ে তোলা হবে—নতুন নামে, নতুন সংকেত পদ্ধতিতে। সেই প্রেসের নাম হবে—স্বদেশের কালি।

ফোর্ট উইলিয়ামে চরণ, অদ্বৈত ও মাধবীকে আলাদা আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের মধ্যে এখন এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

অদ্বৈত মনে মনে ভাবেন—প্রেসে কাটানো প্রথম রাত, প্রথম কবিতা, প্রথম শব্দ—যেটা সাহেবদের বিরুদ্ধে লেখা হয়েছিল।

মাধবী তাঁর মাথায় হাত রেখে আবৃত্তি করেন—

“আমি লিখিনি কিছু, আমি কেবল শুনেছি মাটির মুখে—
তোমরা যে শাসন করো, সেটা শাসন নয়—
সেটা শুধু টান, আর তার নিচে চাপা শব্দ।”

চরণ জানে, যদি এই কক্ষে তার মৃত্যু হয়, তবে কেউ একজন আবার শব্দ তুলে নেবে। কারণ কালি কখনো মুছে যায় না—সে শুধু মালিক বদলায়।

পরদিন শহরের দেয়ালে ওঠে এক নতুন কাগজ, নতুন ফন্টে, নতুন কালি দিয়ে ছাপা:

“স্বদেশের কালি—প্রথম সংখ্যা।
আমরা ফিরছি, অক্ষরে নয়, আগুনে।”

পর্ব ১০

ভোরের আলোর মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন শব্দ। “স্বদেশের কালি” নামক এক নতুন পত্রিকা এখন শহরের গায়ে আঁচড় কেটে চলেছে। কেউ জানে না কে ছাপে, কোথা থেকে ছাপা হয়, কিন্তু জানে—এই কাগজে লেখা প্রতিটি শব্দ সাহেবদের ভয় পাইয়ে দেয়।

ফোর্ট উইলিয়ামে বন্দি চরণ দত্ত জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে সকালবেলা সূর্য ওঠা দেখেন। তিনি জানেন না কদিন ধরে রয়েছেন এখানে, দিনরাত্রি গুলিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে একটাই বিশ্বাস—যতক্ষণ শব্দ বেঁচে আছে, ততক্ষণ বিপ্লব থেমে যাবে না।

হঠাৎ সেই দিন সকালবেলা তাকে একজন সিপাহী এসে বলল,
“তোমাদের জন্য হুকুম এসেছে—তিনজনকেই ছেড়ে দেওয়া হবে।”

চরণ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মুক্তি? এত সহজে?

অদ্বৈত ঘোষকে যখন খবর দেওয়া হল, তিনি নীরবভাবে হাতজোড় করে বললেন, “বেঁচে থাকাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অপমান। কারণ আমাদের প্রেস নেই, কালি নেই, শব্দ নেই।”

মাধবী মৃদু গলায় বললেন, “আছে, অদ্বৈতবাবু। এখন যেটা নেই, সেটাই আমাদের পুনরায় তৈরি করতে হবে। আমরা যদি বেঁচে থাকি, তাহলে শব্দ আবার জন্ম নেবে।”

তিনজন মুক্তি পেলেন। কিন্তু সাহেবদের নির্দেশ ছিল স্পষ্ট—চরণ দত্ত, অদ্বৈত ঘোষ ও মাধবী সেন এই তিনজন যেন আর কখনও কোনো প্রেস না চালাতে পারেন, আর যদি তাদের হাতে আবার কোনো কাগজ পাওয়া যায়, তবে চিরতরে নির্বাসন।

তারা ফিরে এলেন শোভাবাজার গলিতে। “চরণ প্রেস”-এর সিঁদুরে দরজায় এখনো সিল মারা তালা। কাঁচ ভাঙা, রঙ উঠে যাওয়া সাইনবোর্ডটি ঝুলে আছে একদম কাত হয়ে, যেন সে নিজেই জানে তার ভিতরকার ইতিহাস শেষ হয়ে এসেছে।

চরণ দাঁড়িয়ে রইলেন প্রেসের সামনে।

“তুমি কী ভাবছো?” মাধবী জিজ্ঞেস করলেন।

“আমি ভাবছি, যদি অক্ষররা আমাদের কথা শুনতে পেত, তারা আজ কাঁদত।”

অদ্বৈত বললেন, “আমরা এখন কারা? প্রেস ছাড়া ছাপাখানার লোক আর কী করে?”

চরণ ধীরে এগিয়ে গেলেন সাইনবোর্ডের দিকে। সেটিকে মুছে, কালি মাখানো আঙুল দিয়ে তিনটি অক্ষর লেখেন—“আছি”।

“এইটুকুই তো যথেষ্ট,” তিনি বলেন, “আমরা আছি। আমাদের শব্দও।”

পরদিন সন্ধ্যায়, কুমারেশ এসে হাজির হল চক্রবাক গোষ্ঠী থেকে। হাতে লাল কাপড়ে মোড়া একটি ব্যাগ।

“এই ব্যাগে আছে ‘সত্তর পত্র’-এর ছাপা নমুনা। প্রথম সংখ্যা ইতিমধ্যে চারটি জেলাতে ছড়িয়ে গেছে। ‘স্বদেশের কালি’ এখন নতুন প্রতীক।”

তিনি চরণদের জানালেন, ব্যারাকপুরে এক নতুন প্রেস গড়ে তোলা হয়েছে একটি পুরনো তেলের গুদামে, যেখানে গোপনে ছাপা হচ্ছে প্রতিটি সংখ্যা।

চরণ, অদ্বৈত, মাধবী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।

“তবে?” অদ্বৈত বলেন, “আমাদের কাজ তো শেষ হয়নি। আমাদের শব্দ আবার জন্ম নিচ্ছে।”

মাধবী বলেন, “এইবার আমরা সামনে থাকব না। আমরা হব কালি। অক্ষরের নিচে থাকা ছায়া।”

চরণ মাথা নেড়ে বলেন, “এইবার আমরা লড়ব ‘আমি’ হয়ে নয়, ‘আমরা’ হয়ে।”

নতুন প্রেসে শুরু হয় নতুন ছাপা। চরণদের তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় ছয়টি নতুন সংকেত-ভিত্তিক কবিতা। এই কবিতার বিশেষত্ব—পাঠ করলে শুধু কবিতা, কিন্তু উল্টো থেকে পড়লে নির্দেশ: কোথায় জড়ো হবে বিপ্লবীরা, কোথা থেকে নামবে পাথরভরা ট্রাক, কোনদিনে ট্রেন আটকে দেওয়া হবে।

“স্বদেশের কালি” এখন কেবল পত্রিকা নয়, এটি আন্দোলনের নকশা।

১৮৫৮ সালের মার্চ মাস। সাহেবদের নতুন নির্দেশ—কলকাতার সমস্ত পত্রিকার উপর নজরদারি বাড়ানো হোক। ইংরেজ গোয়েন্দারা এখন ভিড় করছে প্রেসে, পাঠাগারে, কলেজে, এমনকি চায়ের দোকানেও।

একদিন একটি সাহেব অফিসার একটি দোকানে চা খেতে খেতে পেয়ে যান “স্বদেশের কালি”-র একটি সংখ্যা। তাতে লেখা—

“আমরা যেখান থেকে লিখি, সেখানেই জন্ম নেয় শব্দের বিপ্লব।
আর যেখানে শব্দ থেমে যায়, সেখানেই রক্তের উৎসার।”

তিনি অল্প একটু হাসলেন, বললেন, “শুধু শব্দ? ওদের বুদ্ধি তো শেষ হয়ে গেছে।”

তবে পরদিনই ওঁর গাড়ির নিচে পাওয়া গেল একটি কবিতার চিঠি, ছাপা অক্ষরে লেখা—“এবার আমরা শব্দ দিয়ে নয়, নীরবতা দিয়ে আঘাত করব।”

শেষে, চরণরা সিদ্ধান্ত নেন, একটি বিশেষ সংখ্যা ছাপা হবে—নাম হবে “অক্ষরের বিপ্লব”।

এই সংখ্যায় থাকবে শুধু একটি কবিতা, মাধবীর লেখা—

“তোমরা থামাও প্রেস, আমরা থামি না।
তোমরা পোড়াও কাগজ, আমরা জ্বলি না।
তোমরা মুছে দাও নাম, আমরা লিখি গায়ে মাটি,
তোমরা শাসন করো, আমরা করি শব্দে স্বাধীনতা।”

এই সংখ্যার প্রতিটি কপি ছাপা হবে গোপনে, ঢাকা হবে বাটিক কাপড়ে, তার ভেতর থাকবে একটি কাঠের পেন্সিল।

কারণ এই সংখ্যা শুধুই পড়ার নয়—এটি হলো পরবর্তী বিপ্লব লেখার আহ্বান।

চরণ, মাধবী ও অদ্বৈত এখন আর সামনে নেই। তারা কেউ কাজ করেন না কোনো প্রেসে, কেউ লেখেন না প্রকাশ্যে।

তারা এখন ছড়িয়ে দিয়েছেন শব্দের বীজ। প্রেস তো ভেঙে দেওয়া যায়, কিন্তু শব্দকে?

যখনই কেউ কোনো অজানা গলিতে পড়ে যায় ‘স্বদেশের কালি’-র একটি পাতা, যখনই কেউ দেয়ালে দেখতে পায় এক অসমাপ্ত কবিতা—তখন মনে পড়ে যায় চরণদের কথা।

অক্ষরের বিপ্লব শেষ হয়নি।

আর কখনো হবে না।

সমাপ্ত

1000025044.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *