প্রীতম দে
পর্ব ১
দিল্লির এক গোপন ল্যাবরেটরির অন্ধকার ঘরে বসে ছিল একজন মধ্যবয়সী বিজ্ঞানী। নাম তার ডঃ সমরনাথ দে। কাঁধে হালকা ঝুঁকে থাকা শরীর, চোখে পুরু পাওয়ার চশমা, আর মুখে চিরন্তন ক্লান্তির রেখা। কিন্তু এই রাতে তার চোখ জ্বলছে। কারণ, তার সামনে রাখা কাঁচের একটি ছোট্ট ফ্লাস্কের ভেতরে রয়েছে এমন কিছু, যার খোঁজে বহু দেশের গোয়েন্দা সংস্থারা রাতের ঘুম হারাম করেছে।
একটি লালচে তরল—একে বলা হয় রেড মারকারি।
এই বস্তু নিয়ে বহু গুজব ছড়িয়েছে। কেউ বলে এটি নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির গোপন উপাদান। কেউ আবার দাবি করে, এর এক ফোঁটায় সম্পূর্ণ শহর নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ডঃ দে জানেন, এটি শুধুমাত্র বিধ্বংসী নয়, বরং পরিবর্তন আনতে পারে মানব সভ্যতার ইতিহাসে। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন—এই তরল সময়কে বাঁকাতে পারে।
ডঃ দে তাঁর রেকর্ডারে বলছিলেন,
“ফর্মুলা এখন স্থির। আমি প্রস্তুত। কিন্তু জানি, আমাকে বাঁচতে হলে এই খবর কাউকে দেওয়া চলবে না। এই রেড মারকারি যদি ভুল হাতে পড়ে, তাহলে পৃথিবী নামক গ্রহটা আর সেই থাকবে না…”
কিন্তু ঠিক তখনই ল্যাবের বাইরের আলো নিভে গেল। সব কিছু অন্ধকার।
হঠাৎ করে দরজার নিচ দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল। সামান্য সময়ের মধ্যে তিনজন মুখ ঢাকা মানুষ ঘরে ঢুকে পড়ল। ডঃ দে চিৎকার করার আগেই একটা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের ঠাণ্ডা নল তার কপালে ঠেকে গেল।
“ফ্লাস্কটা আমাদের দাও, ডক্টর। কথা বাড়ালে মাথার পেছনের অংশ থাকবে না,” বলল তাদের একজন।
ডঃ দে চুপচাপ ফ্লাস্কটা এগিয়ে দিলেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখ চলে গেল ঘড়ির দিকে—৯:৩৩।
“ভবিষ্যত তোমাদের দখলে থাকবে না,” ফিসফিস করে বললেন তিনি।
একটি নিঃশব্দ গুলির শব্দে কেবল তার নিঃশ্বাস থেমে গেল।
কলকাতা, তিন দিন পরে।
সেন্ট্রাল এভিনিউর পাশে ছোট্ট একটা কাঠের ডেস্কে বসে থাকা সাংবাদিক অনির্বাণ সেন সকালে যখন খবরের কাগজ খুললেন, তখন এক লাইনের একটি খবর তার চোখ আটকে দিল—
“Eminent nuclear chemist found dead in Delhi lab under mysterious circumstances. Suspected espionage angle.”
সে জানত না, কেন তার বুকটা ধক করে উঠল। কিন্তু নামটা দেখেই চমকে উঠল—ডঃ সমরনাথ দে। এক সময় তার বাবার পুরোনো বন্ধু। ৮০র দশকে একসাথে মস্কোতে পড়াশোনা করতেন। তারপর হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান।
অনির্বাণ ফোন ঘোরালেন এক পরিচিত পুলিশ অফিসারকে—অর্চিষ্মান পাল।
“এই রেড মারকারি ব্যাপারটা কি রে?”
ওপাশ থেকে চাপা গলায় উত্তর এল, “এই লাইনে পা দিস না অনির্বাণ। যেটা তুই ধরতে পারবি না, সেটা নিয়ে লেখালেখি করিস না।”
“আমার বাবার বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
“তাহলে সাবধানে থাকিস। ওর মৃত্যুর সঙ্গে শুধু ভারত নয়, রাশিয়া, ইজরায়েল, আর চীনও জড়িয়ে আছে।”
অনির্বাণ ফোন রেখে চুপচাপ বসে থাকল। বাইরের শহরটা কোলাহল করছিল, কিন্তু তার ভেতরে যেন কোনও অদৃশ্য ছায়া নেমে এসেছিল।
সে জানত, এই রহস্যের মধ্যে ঢুকলে আর পেছনে ফিরে আসা যাবে না।
আর ঠিক তখনই এক অচেনা নম্বর থেকে একটা মেসেজ এল—
“He trusted you. Come to the Botanical Garden at 11. Come alone. No police.”
পর্ব ২
বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রবেশপথে পৌঁছে ঘড়ির দিকে তাকাল অনির্বাণ—ঠিক ১১টা বাজে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ছায়া যেন আরও গাঢ়, আরও নিঃশব্দ। দুপুরবেলা হলেও আজকের আকাশ অদ্ভুত ধূসর। কুয়াশা নেই, তবুও আলো ফিকে।
সে একা এসেছে, যেমন মেসেজে বলা হয়েছিল। পকেটে শুধু একটা ছোট্ট ভয়েস রেকর্ডার, আর শার্টের ভিতরে গোপনে রাখা পেপার স্প্রে। সাহস আছে, কিন্তু অতিরিক্ত বোকামি নয়।
ভেতরে ঢুকেই তার চোখ গেল বাঁদিকের পাথরের বেঞ্চটার দিকে। সেখানেই বসে আছে একজন—বয়সে মধ্যচল্লিশ, গায়ে সাধারণ শার্ট, চোখে কালো চশমা, মুখটা পড়ে থাকা এক বইয়ের আড়ালে আড়াল করা।
অনির্বাণ এগিয়ে যেতে সে বলল, “বসে পড়ুন। দ্রুত কথা বলব।”
“আপনি কে?”
“আমি ডঃ দে-র পূর্বতন সহকারী। নামটা জানলে বিপদ বাড়বে। তাই এখন শুধু ‘রায়’ বলেই চিনুন।”
“আপনি কেন আমাকে এই জায়গায় ডাকলেন?”
রায় তার পকেট থেকে এক ছেঁড়া ডায়েরির পৃষ্ঠা বের করে বলল, “ডঃ দে-র মৃত্যু আত্মহত্যা নয়। আর ওঁর হাতে ছিল এমন কিছু, যা এই পৃথিবীর ধারণার সীমানা বদলে দিতে পারে।”
অনির্বাণ তাকিয়ে রইল কাগজটার দিকে। সেটায় আঁকা ছিল একটি গোল চিহ্ন, যার ভেতরে একটি ট্রায়াঙ্গেল, আর তার কেন্দ্রে লেখা: Hg-Red।
“এই চিহ্নটা কী বোঝায়?”
“এটা রেড মারকারির গোপন চিহ্ন। Hg মানে মার্কারি, কিন্তু Red দিয়ে শুধু রং নয়—বুঝো, এটা হলো শক্তির এক রূপ, এক ধ্বংসাত্মক তাপ, যেটা তৈরি হয় অতি অস্বাভাবিক নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায়।”
রায় চুপ করে গেল। চারপাশে পাখির ডাক থেমে গেছে যেন। হাওয়ার ফিসফিস—মনে হচ্ছিল যেন গাছের পাতার আড়াল থেকে কেউ নজর রাখছে।
“ডঃ দে আপনাকে শেষবার ফোন করেছিলেন, জানেন কেন?”
“আমি জানি না,” অনির্বাণ চাপা গলায় বলল।
রায় একটা ইউএসবি ড্রাইভ বাড়িয়ে দিল।
“এতে কিছু ডেটা আছে—ডঃ দে-র শেষ গবেষণা। আপনি সাংবাদিক, তাই ওঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, আপনি এটা অনুসন্ধান করুন। কিন্তু সাবধান, আপনাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। ওঁর মৃত্যুর একঘণ্টার মধ্যেই সেই ফ্লাস্কটা উধাও হয়ে যায়। এখন সেটা কোথায় আছে, কেউ জানে না। তবে অনেক দেশ এই জিনিসের খোঁজে মরিয়া।”
“আপনি কি জানেন কে নিয়েছে সেটা?”
“না, তবে আন্দাজ আছে। একটা আন্তর্জাতিক চক্র এই রেড মারকারির পেছনে। এদের লিডার ভারতীয়, কিন্তু এখন ইউরোপে। কোডনেম—Raktachakra।”
“রক্তচক্র? সিনেমার মতো শোনাচ্ছে।”
“এটা কোনো সিনেমা না, মিস্টার সেন। এটা বাস্তব, এবং আপনি এখন এর কেন্দ্রে এসে পড়েছেন।”
এতক্ষণ শান্তভাবে বসে থাকা অনির্বাণ বুঝল—এই মুহূর্তে সে এমন এক জালে আটকে পড়েছে যার প্রতিটি সুতো আগ্নেয়গিরির মতো উষ্ণ।
ঠিক তখনই পেছন দিক থেকে একটা কুৎসিত শব্দ। বাঁশবাগানের ভিতর থেকে এক ছায়ামূর্তি ছুটে এল। রায় চিৎকার করে উঠল, “দৌড়ান!”
অনির্বাণ আর কিছু না ভেবে ছোটে। পিছন থেকে পা দেবে দেবে শব্দ, হাওয়ায় ছুটে আসা নিঃশব্দ গুলি। একবার গাছের গায়ে লেগে ছিটকে পড়ল। রায় বলছিল, “এইদিকে! বামে!”
বোটানিক্যাল গার্ডেনের পুরনো কাচঘরের কাছে এসে দুজনে লুকাল। রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দেখুন, এখন এখান থেকে বেরোতে হবে। আপনাকে একটা ঠিকানা দিচ্ছি—উত্তর কলকাতার বাগবাজারে, ৩৭ নম্বর বকুলতলা লেন। সেখানে যাবেন কাল সন্ধ্যায়। একটা পুরনো ছাপাখানার নিচে আছে ল্যাবরেটরি। সেখানেই আছে ডঃ দে-র সহচর, তমাল বসু। তিনিই জানেন, পরবর্তী ধাপ কী।”
“আর আপনি?”
“আমি আজ রাতের পর হয়তো আর থাকব না। কিন্তু আপনি থামবেন না। কারণ এই পৃথিবীর ভবিষ্যত এখন আপনার হাতে।”
এরপর সে ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল পাশের বনগুচ্ছের মধ্যে।
অনির্বাণ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার হাতের মুঠোয় এখন ধরা সেই ইউএসবি ড্রাইভ—ডঃ দে-র মৃত্যুর শেষ চিহ্ন।
তার মনে হচ্ছিল, যেন এই ছোট্ট যন্ত্রটার মধ্যে লুকিয়ে আছে ইতিহাস বদলে ফেলার রহস্য।
আর হয়তো, কোনো প্রাচীন অভিশাপও।
পর্ব ৩
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছিল। বাগবাজারের গলিগুলো একেকটা যেন পুরোনো কলকাতার কঙ্কাল—ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাপাখানা, ধুলোয় ভরা জানালা, আর সাদাকালো বিজ্ঞাপন লেখা দেয়াল। অনির্বাণ ৩৭ নম্বর বকুলতলা লেন খুঁজে পেতে খানিকটা সময় লাগল। ঠিকানাটা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে—একতলা ফিকে রঙের বাড়ি, কাঠের দরজায় মরচে ধরা তালা, আর ওপরে অদ্ভুত একটা প্ল্যাকার্ডে লেখা—“প্রাচীন ছাপাখানা ও বই বিক্রয় কেন্দ্র”।
অনির্বাণ দরজায় তিনবার কড়া নাড়তেই এক বৃদ্ধ দরজা খুললেন। মাথায় টাক, চোখে পুরু চশমা, কিন্তু চোখদুটি বিদ্ধ করার মতো তীক্ষ্ণ।
“আপনি কি তমাল বসু?”
“আপনি অনির্বাণ সেন?”
“হ্যাঁ।”
তিনি চুপচাপ দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভিতরের ঘরটা যেন অন্য জগৎ—একদিকে পুরোনো ছাপার যন্ত্র, অন্যদিকে বিশাল এক দেয়ালজোড়া বুকশেলফ, আর এক কোণে আধুনিক কম্পিউটার আর ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম।
“এই জায়গাটা দেখে তো ভাবা যায় না আপনি একজন বিজ্ঞানী।”
“ভাবা যায় না বলেই এখনও বেঁচে আছি,” তমাল হেসে বললেন।
অনির্বাণ টেবিলে ইউএসবি ড্রাইভটা রাখল।
“ডঃ দে এটা রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনি জানেন এর অর্থ।”
“অর্থ জানি। কিন্তু আপনি জানেন কি, আপনি এখন একটা যুদ্ধের মধ্যে এসে পড়েছেন? এ যুদ্ধ শুধু তথ্য বা বিজ্ঞানের নয়—এ যুদ্ধ সময়, সত্য আর ধ্বংসের মধ্যে।”
তমাল ডেস্কে বসে ইউএসবি ড্রাইভটা খুললেন। কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠল কয়েকটি এনক্রিপ্টেড ফাইল। তমাল মাথা নাড়িয়ে বললেন, “তুমি জানো ‘Hg-Red’ প্রকল্পটা আদতে কী ছিল?”
“শুধু এটুকু জানি, এটা রেড মারকারির একটা কেমিক্যাল প্রজেক্ট।”
“তা ঠিক, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন—সময়ের ভিতর দিয়ে তথ্য পাঠানো। ডঃ দে-র ধারণা ছিল, নির্দিষ্ট কম্পাউন্ড ব্যবহার করে এমন এক তরল তৈরি করা সম্ভব যা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডে প্রবেশ করলেই সময়চক্রের গঠন পরিবর্তন করতে পারে।”
“অর্থাৎ… সময় ভ্রমণ?”
“পুরোটা নয়, তবে তথ্য ভ্রমণ। যেমন—ভবিষ্যতের একদিনে লেখা মেসেজ আজ পাঠানো সম্ভব হবে, এই ফর্মুলা যদি সফল হয়।”
অনির্বাণের গলা শুকিয়ে এল। “এটা তো ভয়ঙ্কর! যদি এই ক্ষমতা কোনও সন্ত্রাসবাদীর হাতে পড়ে?”
“তাই তো এখন সবাই এই ফর্মুলার পিছনে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, রাশিয়ান মাফিয়া, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের চোরাকারবারি দলও। আর এই ফ্লাস্ক, যেখানে শেষ রেড মারকারি ছিল, সেটার অবস্থান কেউ জানে না।”
“আপনি কি জানেন কোথায় এটা?”
তমাল একটু থেমে বললেন, “জানি না, তবে অনুমান আছে। ডঃ দে মৃত্যুর ঠিক আগের রাতে আমাকে একটা ম্যাপ পাঠিয়েছিলেন। তার একটা অংশ কোড করে রেখেছেন এই ফাইলের ভেতর।”
তিনি ফাইল খোলার চেষ্টা করলেন। হঠাৎ করেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটি সতর্কবার্তা:
“ACCESS DENIED. UNAUTHORIZED DEVICE. SELF-DESTRUCT SEQUENCE INITIATED.”
তমাল চিৎকার করে উঠলেন, “পিছিয়ে যান!”
একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ, ধোঁয়া আর আগুন ছিটকে পড়ল কম্পিউটার থেকে। অল্পের জন্য দু’জনেই বেঁচে গেল, কিন্তু ডেস্কে রাখা কাগজপত্র পুড়ে ছাই। তমাল ফুঁপিয়ে উঠলেন, “সব শেষ! ফাইলটা আত্মধ্বংস প্রোগ্রামড ছিল। কেউ চায়নি আমরা এটা দেখতে পারি।”
অনির্বাণের হাত কাঁপছে। “কিন্তু ম্যাপের অংশটুকু?”
“ওটা আমার মাথায় আছে। আমি চেষ্টা করব মনে করতে। তবে এখন আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে। কারণ যারা এই সিস্টেমটা হ্যাক করল, তারা জানে আমরা কোথায়।”
তারপর তমাল একটা দেওয়ালের পেছনে ছোট দরজা খুললেন। পুরোনো ছাপাখানার নিচে একটা টানেল লুকানো ছিল।
“এটা আগে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল পলিটিক্যাল লিটারেচার পাচার করার জন্য। এখন কাজে লাগবে আমাদের বাঁচতে।”
ওরা নেমে পড়ল অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে সেই টানেলে। শুধু জ্বলছিল একটা পুরোনো টর্চ, আর তার আলোয় একে অপরের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—উদ্বিগ্ন, ক্লান্ত, তবু আগ্রহে জ্বলজ্বল।
হঠাৎ দূর থেকে এক নারীকণ্ঠ শোনা গেল—
“তমালদা? আপনি আছেন?”
তমাল থমকে গেলেন। “ও আমার এক পুরোনো ছাত্রী, নাম কৃশা। ওকেই আমি বলেছিলাম, আজ যদি দেরি করি তাহলে এই টানেলে এসে খোঁজ নিতে।”
সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল বছর তেইশেকের এক তরুণী—লম্বা চুলে বিনুনি, চোখে হালকা আতঙ্ক, হাতে মোবাইল টর্চ।
“তোমরা এখান থেকে বেরিয়ে চল, আমি পিছনে এসে দরজা বন্ধ করি,” বললেন তমাল।
কিন্তু ঠিক তখনই, উপর থেকে শোনা গেল পায়ের শব্দ। ভারি বুটের আঘাতে জানানো হল—শত্রুরা এসে গেছে।
“চলুন!” অনির্বাণ বলল।
ওরা তিনজনে দৌঁড়ে বেরিয়ে এল টানেলের অন্য প্রান্ত দিয়ে, আর পেছনে বিস্ফোরণের আওয়াজে পুরো ছাপাখানাটা কেঁপে উঠল।
পর্ব ৪
রাত প্রায় ২টা। দক্ষিণ কলকাতার একটা পুরোনো ভাড়া বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে আর কৃশা এখন তমাল বসুর পরিচিত এক পুরোনো অধ্যাপকের ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছে। তমাল দা টানেল ধ্বংস হবার আগেই কোনোভাবে বেরিয়ে বাঁচলেও কোথায় আছেন সেটা এখনও জানে না কেউ। মোবাইল অফ, যোগাযোগ বন্ধ।
কিন্তু অনির্বাণ বুঝে গিয়েছে—এখন সে একা নয়। কৃশা তার পাশে দাঁড়িয়ে।
“আপনি ঠিক আছেন?”
কৃশা মাথা নাড়ল। “ঠিক বলতে গেলে… না। কিন্তু ভয় পাচ্ছি না। আপনি তো জানেন না, তমাল দা আমার কাছে কে ছিলেন।”
“আপনার শিক্ষক?”
“শুধু তাই নয়, আমার বাবার বন্ধু। আর আমার জীবনের প্রথম অনুপ্রেরণা। উনি না থাকলে আমি আজ ফিজিক্স পড়তাম না। রেড মারকারির কথা উনি আমায় আগেই বলেছিলেন, গোপনে। তখন বিশ্বাস করিনি, আজ বুঝলাম কত বড় কিছু ছিল ওটা।”
“তাহলে আপনি জানেন রেড মারকারি কীভাবে কাজ করে?”
“ন théoretically. আমি জানতাম এটা একটা স্পেশাল আইসোটোপিক ফর্মুলা, যার একটা মাত্র ফোঁটা পরিবেশে নিঃশেষিত হলে একধরনের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ তৈরি করে। সেই তরঙ্গ ব্যবহার করে সময় ও তথ্যের মধ্যে সম্পর্ক নতুনভাবে গঠিত হতে পারে।”
“মানে ইতিহাস বদলে দেওয়া যায়?”
“না, সময় বদল নয়। বরং ইতিহাসের নির্দিষ্ট মুহূর্তে তথ্য প্রক্ষেপণ করা যায়। ধরুন, ১৯৪৫ সালের আগেই কেউ জানিয়ে দিল হিরোশিমা ধ্বংস হবে—তাহলে ইতিহাসের ধারাই বদলে যেতে পারত।”
অনির্বাণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর বলল, “কিন্তু তাহলে রক্তচক্র কী চায় এই ফর্মুলা দিয়ে?”
কৃশা উত্তর দেওয়ার আগেই একটা ফোন বেজে উঠল। ঘরের ভেতরে রাখা সেই পুরোনো ল্যান্ডলাইন ফোন, যেটা ছাড়া কেউ এই বাড়ির অস্তিত্ব জানে না।
অনির্বাণ ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে কেউ বলল,
“একটু মনোযোগ দাও, মিস্টার সেন। সময় আমাদের হাতে কম।”
“আপনি কে?”
“আমার নাম বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের সংগঠনকে তুমি ইতিমধ্যে চিনেছ—রক্তচক্র। আমরা জানি তুমি কোথায় আছ, তুমি কাদের সঙ্গে আছ, এবং ইউএসবি ড্রাইভে কী ছিল।”
“তোমরা তমালদাকে হত্যা করেছ?”
একটা ছোট হাসি শুনতে পেল অনির্বাণ।
“না, হত্যা করিনি। সে এখনো বেঁচে আছে, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। কারণ আমরা যা চাই, তা সে দিচ্ছে না।”
“তোমরা কী চাও?”
“তুমি জানো সেটা, অনির্বাণ। রেড মারকারির সূত্র। ওটা দিয়ে আমরা এই পৃথিবীর ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারি, নিজের মতো করে। ইতিহাসকে ব্যালেন্স করার সময় শেষ। এবার আমাদের ইতিহাস লিখতে হবে। রক্ত দিয়ে।”
“আমি সেটা তোমাদের হাতে তুলে দেব না।”
“আমরা জানি তুমি দেবে না। তাই তোমার বন্ধুরা মরবে। তোমার প্রিয় মানুষরা হারিয়ে যাবে। আর তুমি নিজে—তুমি সময়ের খাঁচায় আটকে পড়বে।”
এরপর একটানা বীপ শব্দ। ফোন কেটে গেছে।
অনির্বাণ স্থির দাঁড়িয়ে। পিছনে কৃশা এসে বলল, “কে ছিল?”
“ওরা। রক্তচক্র। তমাল দাকে ধরে ফেলেছে। আমাদের খোঁজ জানে।”
“তবে আমাদের এবার পালাতে হবে।”
“না কৃশা। এখন আর পালানোর সময় নয়। এখন সময় রুখে দাঁড়ানোর।”
“কিন্তু আমরা কীভাবে?”
“আমাদের দরকার তথ্য। ডঃ দে-র গবেষণাপত্র। সেটা কেউ না কেউ সুরক্ষিতভাবে রেখেছে। আর তার ধারা ধরলেই আমরা পৌঁছাতে পারব রেড মারকারির শেষ অবস্থানে।”
“কিন্তু কে?”
অনির্বাণ চুপ করে গেল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“আমার বাবার পুরোনো এক বন্ধু ছিলেন—ডঃ অশোক ভট্টাচার্য। কলকাতা থেকে বহু বছর আগে চলে গেছেন। এখন থাকেন শান্তিনিকেতনে। আর শোনা যায়, ডঃ দে-এর গবেষণার দ্বিতীয় ভাগ তিনিই হাতে পেয়েছিলেন।”
“তাহলে?”
“ভোর হতেই শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে রওনা দেব।”
হাওয়ার ঝাপটা ছাদের জানালায় ধাক্কা মারল। ঘর অন্ধকার, কিন্তু ভেতরে দুই মানুষ জানে—যা শুরু হয়েছে তা থামানো এখন আর তাদের হাতে নেই।
তবে তারা লড়বে। কারণ সত্য যত বিপজ্জনকই হোক, তা মিথ্যার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
পর্ব ৫
ভোরের আলো ছুঁয়ে যেতে না যেতেই হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিল অনির্বাণ আর কৃশা। দুজনেই চুপচাপ বসে ছিল জানালার ধারে। বাইরের সবুজ ধানক্ষেত, ইঁদুর দৌড়হীন গ্রামের দৃশ্য তাদের চোখে পড়লেও মন ছিল অন্য জায়গায়। ছুটে চলেছে তারা শান্তিনিকেতনের দিকে—কেবল প্রকৃতি বা শান্তির জন্য নয়, বরং ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক সত্যকে উন্মোচন করার জন্য।
“তুমি কি নিশ্চিত, ডঃ অশোক ভট্টাচার্য এখনও সেখানে আছেন?”
অনির্বাণ মাথা নাড়ল, “খুব বেশি মানুষ জানে না, কিন্তু আমার বাবা যখন মারা যান তখন অশোক কাকু চিঠি লিখেছিলেন—’যদি কোনদিন সত্য খুঁজতে চাও, চলে এসো শান্তিনিকেতনের হাড়ি-পট্টিতে, আমায় এখনো রক্তমারকারি তাড়ায়।’ এই ‘রক্তমারকারি তাড়ায়’—এই বাক্যটা বুঝেছিলাম না তখন। এখন বুঝতে পারছি।”
ট্রেন পৌঁছোল বোলপুর স্টেশনে। সেখান থেকে রিকশায় চড়ে পৌঁছোল হাড়ি-পট্টির গা-ছোঁয়া এক পুরোনো পাকা বাড়ির সামনে। পাঁচিল বেয়ে ছত্রাক জমেছে, জানালার কপাট কাঠ দিয়ে আটকানো। ছোট একটা কাঠের ফলকে লেখা: “ডঃ অশোক ভট্টাচার্য, প্রাক্তন নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট”।
কৃশা দরজায় ধাক্কা দিল। বেশ কয়েকবার। তারপরই ফিসফিস একটা আওয়াজ এল, “কে?”
“আমি অনির্বাণ সেন। ডঃ সমরনাথ দে-র ছেলে-সম বন্ধু। আপনাকে খুঁজতেই এসেছি।”
দরজা খুলে গেল ধীরে। চোখেমুখে বলিরেখা ছড়ানো একজন বৃদ্ধ মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। শরীর কাঁপছে, কিন্তু চোখে বিদ্যুতের মতো তীক্ষ্ণতা।
“তুমি এসেছো? এতো বছর পরে?”
“আপনি জানতেন আমি আসব?”
“জানতাম। কারণ সমর বলেছিল—সব শেষ হয়ে গেলে কেউ একজন সত্য জানতে চাইবে। সে হবে তার মনের কাছের কাউকে বিশ্বাস করা একজন।”
তিনজন ঢুকল ভেতরে। ঘরজোড়া বই, মেঝেতে পুরনো মানচিত্র ছড়ানো, আর একটি টেবিলে রাখা ধুলোপড়া একটি রেকর্ডার।
“বসো,” বললেন অশোক। “তোমরা এখন এমন একটা খেলায় ঢুকেছ, যেটা অনেক আগেই শুরু হয়েছে। আমি আর সমর ১৯৮৪ সালে রাশিয়ার ওবনিনস্ক শহরে ছিলাম। তখনই প্রথম শুনি রেড মারকারির কথা।”
“তাহলে এটা রাশিয়ার আবিষ্কার?”
“না, বরং বলা যায়, রাশিয়ার পরীক্ষার ফল। তারা পারমাণবিক অস্ত্রের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে এমন একটি পদার্থ খুঁজে পায়, যেটি শুধু ধ্বংস নয়, সময়ের গঠনও বিকৃত করতে পারে। তখন আমরা বুঝতে পারি, এই জিনিস পৃথিবীর পক্ষে বিপজ্জনক।”
“আপনারা এটা বন্ধ করেননি কেন?”
“চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু গোপনে একদল বিজ্ঞানী আলাদা হয়ে এই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের মধ্যেই একজন ছিল—‘রক্তচক্র’-এর প্রতিষ্ঠাতা। আমরা চিনি তাকে—তার নাম… অভিজিৎ নন্দী।”
“অভিজিৎ নন্দী?” কৃশা চমকে উঠল।
“হ্যাঁ। ভারতীয়। তখন মস্কোর ল্যাবে আমাদের সঙ্গেই ছিল। অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু সে বিশ্বাস করত—ইতিহাস কেবলই কিছু বিজেতাদের লেখা মিথ্যা। আর একমাত্র সত্য ইতিহাস গড়া সম্ভব রেড মারকারি দিয়ে।”
অনির্বাণ চাপা গলায় বলল, “তাহলে সে এখন এই ‘রক্তচক্র’-এর প্রধান?”
“ঠিক তাই। আর সে জানে আমি বেঁচে আছি। সে জানে, আমার কাছে আছে একটি জিনিস—রেড মারকারির শেষ মূল সূত্রের প্রতিলিপি। যেটা এখন দরকার ওদের, কারণ ডঃ দে মৃত্যুর আগেই সূত্রের একটি অংশ পরিবর্তন করে দিয়েছিল।”
“আপনার কাছে সেটা আছে?”
অশোক ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে গেলেন পাশের ঘরে। তারপর একটা ছোট্ট লোহার বাক্স নিয়ে ফিরে এলেন।
“এটা খুললে তুমি পাবে রেড মারকারির মূল ফর্মুলার শেষ স্লাইড।”
ঠিক তখনই দরজার বাইরে গাড়ির আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে কাঁচ ভাঙার শব্দ, আর পাঁচিল টপকে ছয়জন মুখোশধারী লোক ঢুকে পড়ল।
“তোমরা ফর্মুলা দাও, আর শান্তিতে মরো,” একজন বলল।
অশোক ধীরে গলায় বললেন, “অনির্বাণ, বাক্সটা নাও। পিছনের জানালা দিয়ে কৃশাকে নিয়ে পালাও। আমি এখানে ওদের সময় ধরে রাখি।”
“না! আপনি—”
“এটাই শেষ দায়িত্ব। দৌড়ো!”
অনির্বাণ ও কৃশা বাক্স হাতে পেছনের দরজা দিয়ে ছুটে পালাল। সামনে খোলা ধানক্ষেত, নিচে কাদা, পেছনে আওয়াজ—গুলি, চিৎকার।
কিন্তু তারা দৌড়োচ্ছে।
দূরে, সেই অশোক ভট্টাচার্যের বাড়ি থেকে উঠছে ধোঁয়া। একটা বিস্ফোরণ। আকাশে ছিটকে পড়ছে কিছু ছাই, কিছু ছিন্নভিন্ন স্মৃতি।
কিন্তু অনির্বাণের হাতে এখন আছে সেই ফর্মুলা, যেটা বদলে দিতে পারে সময়, ইতিহাস, অথবা তাকে নিজেকেই।
পর্ব ৬
জয়পুরের রেলস্টেশন যখন ট্রেন ঢুকল, তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। প্ল্যাটফর্মে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, বাতাসে ধুলোর গন্ধ। গাড়ি বুক করার সুযোগ নেই, মোবাইল অন করা নিরাপদ নয়। কৃশা বলল, “হাঁটতে হবে। নইলে ট্র্যাক করে ফেলবে।”
অনির্বাণ মাথা নাড়ল। তার কাঁধে একটি ব্যাগ, তাতে রয়েছে লোহার সেই বাক্স—যার ভিতরে রেড মারকারির মূল সূত্রের একটি অনুলিপি, কিন্তু সেটা খুলতে গেলে দরকার একটা কোড, একটা চাবি, যা ডঃ অশোক ভট্টাচার্য রেখে গিয়েছিলেন অনেক আগেই এই শহরে।
চলতে চলতে কৃশা জিজ্ঞেস করল, “আপনি কীভাবে নিশ্চিত যে চাবিটা জয়পুরে?”
“ডঃ অশোক তার বাড়ির ভিতরে ম্যাপের এক কোনে ‘J-RED: 18°N, 75°E’ লিখেছিলেন। সেটাই ট্রেস করে দেখলাম—এটা জয়পুর শহরের পুরাতন কেন্দ্রস্থলের একটা গলির দিকে ইঙ্গিত করে। আর একটা ছোট্ট পেন্সিলে লেখা বাক্য ছিল: ‘মৃত মূর্তি সত্যের চাবি রাখে।’”
“মৃত মূর্তি?”
“মনে হয় পুরোনো কোনো মন্দির বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা, যেখানে এখন পুজো হয় না। সেইখানে হয়তো লুকানো কিছু আছে।”
ওরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাল ‘চাঁদপোল’ নামের এক পুরোনো অংশে। রাস্তা সরু, একতলা বাড়িগুলো পাথরের, জানালায় গ্রিল আর কাঠের পাল্লা। মাঝে মাঝে কিছু দোকান খোলা, কিন্তু চারপাশে একটা থমথমে ভাব।
হঠাৎ এক বৃদ্ধ চা-ওয়ালা ডেকে বলল, “বাবু, নতুন দেখাচ্ছে। কাকে খুঁজছেন?”
অনির্বাণ একটু থেমে বলল, “পুরোনো বিষ্ণুমূর্তি মন্দির কোথায় জানেন?”
বৃদ্ধের চোখ কুঁচকে গেল। “ও জায়গা তো কেউ যায় না, বাবু। লোকেরা বলে সেখানে অভিশাপ আছে। রাত হলে কেউ ঢোকে না।”
“ঠিক সেই জায়গাটাই দরকার আমাদের,” কৃশা ফিসফিস করে বলল।
চা-ওয়ালার ইশারায় ওরা হাঁটল শহরের শেষ প্রান্তে। একটা শেওলাধরা দেওয়াল ঘেরা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল সেই মন্দির। ছাদের অর্ধেক ভেঙে পড়েছে, প্রবেশপথে জঙ্গল জমে উঠেছে, আর সামনে পাথরের সিংহমূর্তি—মাথার অর্ধেক ভেঙে পড়া।
অনির্বাণ বলল, “এইটাই ‘মৃত মূর্তি’। এখন শুধু চাবি খুঁজে বের করতে হবে।”
ওরা টর্চ জ্বালিয়ে ঢুকল মন্দিরের ভেতরে। পুরোনো খোদাই, মাটির নিচে পচা পাতার স্তর, আর মাঝখানে একটা বিরাট পাথরের পিঁড়ি—যার গায়ে ঘষামাজা করা এমনভাবে যে একটা খোপ লুকিয়ে আছে বোঝা যায়।
কৃশা নিচু হয়ে খোপটা খুঁজতে লাগল। আচমকা তার আঙুল কিছুর মধ্যে আটকে গেল। সে চাপ দিতেই একটা শব্দ হল—ঘরের এক কোণে একটা ইট সরে গেল, আর বেরিয়ে এল ছোট্ট একটি লোহার বাক্স।
অনির্বাণ বলল, “এটাই হতে পারে সেই কোডচাবি। দেখো, পাশেই কিছু খোদাই করা আছে।”
লিখা ছিল—“XII-∆-VI”।
“এইটা কী হতে পারে?”
কৃশা বলল, “রোমান সংখ্যা বারো, একটি ত্রিভুজ চিহ্ন, আর ছয়। হয়তো পাসওয়ার্ড বা সিকোয়েন্স। আমরা চেষ্টা করতে পারি।”
ঠিক তখনই পেছনে পাথরে গোঁ গোঁ শব্দ। আলো ঘুরতেই দেখা গেল—তিনজন লোক মন্দিরের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসছে। মুখ ঢাকা, হাতে পিস্তল।
“অভিজিৎ নন্দীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন, মিস্টার সেন। তুমি পরীক্ষা পেরিয়ে গেছো। এবার ফর্মুলা আমাদের দাও।”
অনির্বাণ আর কৃশা পেছনে পেছনে হাঁটছে, কিন্তু মন্দিরের এক প্রান্তে গিয়ে আর রাস্তা নেই। পেছনে বন্দুক, সামনে শূন্যতা।
তখন কৃশা নিজের ব্যাগ থেকে পেপার স্প্রে বের করল। হঠাৎ আলোর দিকে ছুঁড়ে দিল সেটা। সঙ্গে সঙ্গে চোখে গিয়ে ছিটে পড়ল, একজন আততায়ী চিৎকার করে উঠল।
এই সুযোগে অনির্বাণ তার ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে ছুঁড়ে মারল পাশের দেয়ালে। ব্যাগে থাকা ধাতব বাক্স ধাক্কা খেয়ে খুলে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের অন্ধকারে একটি মৃদু লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল।
“তোমরা জানো না কী নিয়ে খেলছো,” অনির্বাণ বলল, “এটা শুধু অস্ত্র না, এটা সময়ের কাঁটা। ভুল হাতে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে।”
“আমরাই ঠিক লোক,” একজন আততায়ী ফিসফিস করে বলল, “আমরাই নতুন ইতিহাস লিখব।”
ঠিক তখনই বাইরে থেকে পুলিশের সাইরেন। কৃশা আগেই এক স্থানীয় দোকানদারকে সাবধানে বলেছিল—যদি কিছু অস্বাভাবিক দেখেন, পুলিশে ফোন করতে।
আততায়ীরা পালাতে শুরু করল। তার আগেই একজন পুলিশ অফিসার ঢুকে পড়ে চিৎকার করলেন, “হাত তুলে দাও!”
দুইজন ধরা পড়ল, একজন পালিয়ে গেল অন্ধকারে।
অনির্বাণ আর কৃশা হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এল মন্দির থেকে। পুলিশের এক অফিসার বলল, “আপনারা ভাগ্যবান। আরও পাঁচ মিনিট দেরি হলে হয়তো এইরকম দাঁড়িয়ে থাকতেন না।”
কিন্তু অনির্বাণের হাতে এখন কোডচাবি। আর সে জানে, পরবর্তী যাত্রা কোথায়—জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুর্টে, যেখানে অভিজিৎ নন্দীর সদর দফতর, আর যেখানে রেড মারকারির আসল উদ্দেশ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে ইতিহাসের ভয়াবহতম চক্রান্ত।
পর্ব ৭
ফ্র্যাঙ্কফুর্ট শহরের বাতাসে ছিল ধাতব এক ঠান্ডা। বিমানবন্দর থেকে মেট্রো ধরে শহরের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছাল অনির্বাণ আর কৃশা। ব্যাগে এখন সেই চাবি—‘XII-∆-VI’—যার কোডে খোলা যাবে রেড মারকারির সূত্র লুকানো বাক্স। কিন্তু সেটা খুললেই বিপদ আরও কাছাকাছি চলে আসবে, জানে দুজনেই।
কৃশা চোখ মুছল হালকা ক্লান্তিতে। “তুমি নিশ্চিত, অভিজিৎ নন্দী এখানেই?”
“হ্যাঁ,” অনির্বাণ গম্ভীর গলায় বলল, “তিন বছর আগে ডঃ দে-র এক সাবেক ছাত্র গোপনে এখানে একটি ল্যাব খোলে, নাম Neoteric BioPhase Labs। আর সেই ল্যাবের বিনিয়োগ আসে ইউরোপীয় এক ছায়া-ফান্ড থেকে, যার পরিচালক—অভিজিৎ নন্দী।”
“সোজা সেখানে গেলে ধরা পড়ে যাব।”
“ঠিক তাই। তাই আমি পরিচয় বদলেছি। সাংবাদিক নই, আমি এখন এক ‘ডেটা অ্যাক্সেস অডিটর’। ভেতরে ঢুকে দেখব, কী চলছে। তুমি বাইরে থাকবে, ট্র্যাক করবে আমার লোকেশন। আর যদি কিছু হয়…”
“তাহলে?” কৃশা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে।
“তাহলে বাক্সটা নিয়ে পালিয়ে যেও। কখনও খোলার চেষ্টা কোরো না। কারণ সেটার ভেতরে শুধু সূত্র নয়, সময়ের প্রতিশোধ লুকিয়ে আছে।”
দু’জনের চোখে মিলল এক গভীর চাহনি—ভয়, আত্মবিশ্বাস, আর কিছুটা অব্যক্ত আবেগ।
Neoteric BioPhase Labs-এর সামনে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ যেন নিজেকেই চিনতে পারছিল না। কাঁচে ঘেরা বহুতল, সুইপিং স্ক্যানার গেট, আর ভেতরে স্যুট পরা নিরাপত্তারক্ষী। অথচ বাইরে লেখা আছে—“For a Better Tomorrow Through Molecular Miracles”।
রিসেপশনে গিয়ে পরিচয় দিল অনির্বাণ—“Mr. Roy, from QSecure Audit Systems. I have an appointment with Mr. Aaron Kessler.”
রিসেপশনিস্ট চোখ তুলে দেখল, হাসল, আর একটা কার্ড দিলে বলল, “Please go to Level 4, left corridor. Mr. Kessler is expecting you.”
লিফটে উঠে চতুর্থ তলায় পৌঁছেই বুঝল, এই জায়গাটা শুধু অফিস নয়—একটা শীতল কসাইখানা। দেয়ালে ফ্রেমে ঘেরা সনদ, ফ্লোরে নিঃশব্দ কার্পেট, আর বাতাসে ক্লোরিনের গন্ধ।
Mr. Kessler ছিল এক জার্মান বিজ্ঞানী, বয়স পঁইত্রিশের আশেপাশে, নিখুঁত ইংরেজি বলে।
“Welcome, Mr. Roy. We usually don’t allow audits this sudden, but your name had a high clearance tag. Unusual. Come, let me show you the data core.”
ওরা যখন নিচের ল্যাবে নামছিল, তখন কৃশা শহরের আরেক প্রান্তে একটি ইন্টারনেট ক্যাফে থেকে অনির্বাণের ট্র্যাকিং চালাচ্ছিল। হঠাৎ স্ক্রিনে দেখা গেল—লোকেশন এক জায়গায় পৌঁছেই বন্ধ।
“Underground lab,” কৃশা ফিসফিস করে বলে।
ল্যাবের ভেতরটা যেন সিনেমার দৃশ্য—সাদা আলোর নিচে সারি সারি ফ্রিজার ইউনিট, প্রিজম-আকৃতির কাচের টেস্টিং চেম্বার, আর এক পাশে একটা হোলোগ্রাফিক টেবিল যার ওপর ভেসে আছে—“Hg-Red — Phase: ∆”।
Kessler বলল, “This is where we test advanced isotopes. Some of them can alter reality perception in neural subjects. You know what that means?”
“Not exactly,” অনির্বাণ শান্ত গলায় উত্তর দিল।
“It means—if I want you to believe that you’re drowning, I can make your neurons feel it. Without water.”
ঠিক তখনই দরজার সামনে ছায়া পড়ল। একজন ঢুকল ঘরে। সাদা চুল, ঘোলা চোখ, কিন্তু গলার স্বর এখনো হিম শীতল—
“Mr. Sen, you’re quite persistent.”
অনির্বাণ তাকিয়ে দেখল অভিজিৎ নন্দী।
এক সময়ের ভারতীয় প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, এখন সারা বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থার ওয়ান্টেড তালিকায় নাম।
“তুমি জানো আমি কে?”
“হ্যাঁ,” অনির্বাণ বলল, “আপনি সেই মানুষ, যিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবী শুধুমাত্র ক্ষমতার হাতে থাকা উচিৎ। আপনি সময় বদলে দিতে চান নিজের সুবিধেমতো।”
“তুমি ভুল বুঝেছো। আমি ইতিহাসকে সংশোধন করতে চাই। এই পৃথিবী গত ২০০ বছরে যে ভুল করেছে—যুদ্ধ, ঔপনিবেশিকতা, দারিদ্র্য—সব মুছে দিতে চাই। Hg-Red দিয়ে সেই বিকল্প সময় তৈরি করব।”
“তাহলে আপনি ঈশ্বর হতে চান?”
“না,” অভিজিৎ মুচকি হেসে বলল, “আমি শুধু চেয়েছি, সত্য জানুক সবাই। কিন্তু এখন তুমি আমার পথে বাধা। বাক্সটা দাও।”
“আপনারা তো জানেন না আমি এনেছি কিনা।”
“তাই তো তোমার বন্ধুটি আজ সন্ধ্যায় ধরা পড়েছে।”
অনির্বাণের গলা শুকিয়ে গেল।
“কৃশা… কোথায়?”
“ভয় পেয়ো না। এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু তোমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে ওর ভবিষ্যত।”
অভিজিৎ হাত বাড়াল। “বাক্সটা দাও। একবার খোলা হলে, আমি তোমায় ছেড়ে দেব।”
অনির্বাণ ধীরে নিজের ব্যাগ খুলে বের করল বাক্সটা।
সবাই তাকিয়ে আছে।
তখনই অনির্বাণ বলল, “কোডটা তো আপনাদের জানা নেই।”
“তাই আমরা চাই তুমি নিজেই খুলে দাও।”
অনির্বাণ বাক্সটা স্ক্যানার টেবিলে রাখল। তারপর আস্তে করে বলল, “XII… Delta… VI”
বাক্সের কপাট খুলতেই এক প্রজেকশন উঠল—ডঃ দে-র নিজের কণ্ঠস্বর—
“যদি তুমি এই মুহূর্তে পৌঁছাও, জানবে—এই সূত্র শুধু তৈরি নয়, ধ্বংস করার ক্ষমতাও রাখে। এবং একমাত্র সত্য পথ—ধ্বংস নয়, প্রতিরোধ।”
অভিজিৎ চমকে উঠল।
“Stop him!” সে চিৎকার করল।
অনির্বাণ তখনই একটা স্পার্ক ডিভাইস চালু করল—ডঃ দে-র তৈরি অ্যান্টি-ফর্মুলা অ্যাক্টিভেশন। সঙ্গে সঙ্গে প্রজেকশনে দেখা গেল, সূত্রের বিকল্প ভার্সন সব ফাইলে ছড়িয়ে দিচ্ছে অজস্র বাইনারি কোড—এনক্রিপশন, রিকোডিং, ভ্যানিশিং সিকুয়েন্স।
Hg-Red-এর শেষ সঠিক সূত্র… নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পর্ব ৮
ঘড়িতে তখন রাত ১:১৭। ফ্র্যাঙ্কফুর্টের Neoteric BioPhase Labs-এর ল্যাব জুড়ে অ্যালার্ম বেজে চলেছে। লাল আলো জ্বলছে—বিপদের সংকেত। অনির্বাণ টেবিলের উপর থেকে বাক্সটা তুলে নিয়ে দৌড় দিচ্ছে করিডোরের দিকে। পিছনে গুলি চলেছে, চিৎকার করছে কেউ, কিন্তু তার কানে যেন আর কিছু ঢুকছে না।
সূত্র শেষ—ডঃ দে-র কণ্ঠস্বরের শেষ মেসেজ একটা সিস্টেম ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে দিয়ে গেছে সব ফাইলে। Hg-Red প্রকল্প এখন আর ব্যবহারযোগ্য নয়। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে কৃশা—সে কোথায়?
দৌড়াতে দৌড়াতে অনির্বাণ নিজের ছোট ট্রান্সমিটার চালু করে বলল, “কৃশা, শুনতে পারছো? আমি বাক্স নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। তুমি কোথায় আছো?”
কোনো উত্তর নেই।
ঠিক তখনই বাঁ দিকে একটা কাচঘেরা কন্ট্রোল রুমে চোখ পড়ল তার। ভিতরে দেখা গেল—একটা কেদারায় হাত বাঁধা অবস্থায় বসে আছে কৃশা। মুখে কাপড় গোঁজা, চোখ ফোলা। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন—অভিজিৎ নন্দী।
অনির্বাণ বুঝল, এটাই চূড়ান্ত মুহূর্ত।
সে জানালার পাশের আগুন নিভানোর অ্যালার্ম টানল। সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিংকলার চালু হয়ে ঘরে ঝরতে লাগল পানি, আলো নিভে গেল, একটা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ল।
এই সুযোগে দরজার পাশে থাকা নিরাপত্তারক্ষীকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে কাচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল অনির্বাণ। অভিজিৎ পেছন ফিরে তাকানোর আগেই অনির্বাণ কৃশার মুখ থেকে কাপড় খুলে দিল।
“তুমি ঠিক আছো?”
“তুমি…?” কৃশার চোখ ছলছল করছিল।
“তোমাকে ছাড়া কিছুই সম্ভব না,” অনির্বাণ ফিসফিস করে বলল।
তখনই পেছন থেকে ঠান্ডা গলা—
“এত নাটক দেখার মতো সময় নেই, মিস্টার সেন। ফর্মুলা হয় তুমি আমাকে দাও, না হলে তুমি ও তোমার বান্ধবী দুজনেই শেষ হয়ে যাবে। আমি চাইনি হিংসা। আমি শুধু চাই—একটা নতুন সময় শুরু হোক। আমাদের মতো মানুষের হাত ধরে। পুরনো সব ধ্বংস হোক।”
“আপনি জানেন না, আপনি কি ধ্বংস করতে চলেছেন,” অনির্বাণ বলল।
“জানি,” অভিজিৎ ঠান্ডা হেসে বলল, “আর এটাও জানি, পৃথিবী এখন নতুন ঈশ্বর খুঁজছে। তেমন একজন যিনি সাহস করে সময়কে বাঁকাতে পারেন।”
তখনই পেছনে সাইরেনের শব্দ। পুলিশ, ইন্টারপোল, সম্ভবত ভারতীয় RAW, জার্মান GSG-9—সবাই একসঙ্গে ছুটে আসছে। কারণ ডেটা ট্রান্সমিশনের সময় অনির্বাণই এক গোপন সংকেত পাঠিয়েছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্র্যাঙ্কফুর্টের সেই মহাক্লিন ল্যাব পরিণত হল এক যুদ্ধক্ষেত্রে। গুলি চলছে, কাঁচ ভাঙছে, অন্ধকারের মধ্যে ছায়ারা ছুটছে।
অনির্বাণ কৃশার হাত ধরে দৌড়াতে লাগল—পিছনে আগুন, সামনে দরজা।
কিন্তু ঠিক গেটের কাছেই অভিজিৎ আবার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার তার হাতে অস্ত্র।
“বাক্সটা দাও!”
অনির্বাণ চুপ করে রইল।
“তুমি কি জানো, তুমি যা করেছ, তা যদি এই মুহূর্তে পাল্টে না দাও, তবে কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যত বদলে যাবে? তুমি জানো না, আমি কার সঙ্গে কাজ করি। আমার পিছনে আছে এমন শক্তি, যাদের থামানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়।”
“তা হোক,” অনির্বাণ ধীরে বলল, “তবু আমি তোমার হাতে সময় দিই না। আমি বরং জীবন বেছে নিই।”
এবং সে বাক্সটা ছুঁড়ে দিল পাশের অ্যাসিড বাথ ট্যাংকের মধ্যে।
সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া, গন্ধ, এবং এক দীর্ঘ বিস্ফোরণ। বাক্স, সূত্র, আর অভিজিৎ নন্দীর স্বপ্ন—সব মিলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
অভিজিৎ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
“তুমি বুঝলে না, কী করেছ… তুমি পৃথিবীর ভবিষ্যত শেষ করেছ…”
“না,” অনির্বাণ ধীরে বলল, “আমি শুধু পৃথিবীর প্রতিহিংসা থামিয়েছি।”
এরপর পিছনে ইন্টারপোলের অফিসাররা এসে অভিজিৎকে গ্রেপ্তার করল। ওর চোখে এখনো এক ধরণের অন্ধ বিশ্বাস। হেরে যাওয়ার বেদনা নয়, বরং অসম্পূর্ণ ইতিহাস লেখার দুঃখ।
এক মাস পর
কলকাতা
বাগবাজারের সেই পুরনো ছাপাখানার ঘরে বসে কৃশা চা বানাচ্ছিল। অনির্বাণ জানালার ধারে বসে লিখছিল—এই গোটা ঘটনাকে নিয়ে তার নতুন বই: “ChronoCode: The Red Mercury Deception”
“তুমি কি ভাবো, এটা শেষ হয়ে গেল?” কৃশা জিজ্ঞেস করল।
“না,” অনির্বাণ বলল, “রেড মারকারির মতো ধারণা কখনো মরে না। কোনো না কোনো ঘরে, কোনো না কোনো ল্যাবে, কারও মাথায় আবার সেই ভাবনা জাগবে।”
“তবে কি আমরা সফল?”
“আমরা সময়কে থামাইনি। আমরা কেবল বলেছিলাম—মানুষ আগে, ক্ষমতা পরে।”
পর্ব ৯
সকালের রোদ জানালার ফাঁক গলে এসে পড়েছে অনির্বাণের ডায়েরির পাতায়। একমাস হতে চলল ফ্র্যাঙ্কফুর্টের ঘটনার পর। অভিজিৎ নন্দী এখন জার্মানির হাই-সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি। বিশ্বের বড় বড় গোয়েন্দা সংস্থা রেড মারকারির রহস্য নিয়ে আলাদা করে তদন্ত চালাচ্ছে। কিন্তু বাইরের দুনিয়ার ব্যস্ততার মধ্যে অনির্বাণ নিজের জীবনে একটু শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
আজও তাই সে খোলস ছেড়ে আসেনি। ছাপাখানার ঘরে বসেই চা আর কাগজে ডুবে ছিল। হঠাৎই কৃশা এসে বলল,
“তোমার নামে একটা চিঠি এসেছে। খামের গায়ে ঠিকানা লেখা নেই, শুধু লেখা: ‘To the one who didn’t choose God.’”
অনির্বাণ ভুরু কুঁচকে খামটা খুলল। ভেতরে একটা ছোট্ট কার্ড, যেন পোস্টকার্ড। কার্ডে হাতের লেখা খুবই সুস্পষ্ট, তবু অদ্ভুতভাবে যান্ত্রিক:
“অভিজিৎ হেরেছে, তাতে প্রকল্প থামে না। রেড মারকারি কখনও ব্যক্তির সম্পত্তি ছিল না। তার শেষ পর্ব এখন তুন্দ্রার নীল শূন্যতায় লুকিয়ে—করাচা নামক এক গ্রামে। মনে রেখো, যদি সত্যিই ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে দেখতে চাও, তাহলে পৌঁছে যাও বরফের নিচে চাপা সেই শেষ বাক্সের কাছে। সময় তোমার হাতে, আবারও।”
নীচে সই নেই। শুধু একটা প্রতীক—একটা বৃত্তের মধ্যে ত্রিভুজ, তার কেন্দ্রে একটি বিন্দু। ঠিক সেই চিহ্ন, যা অনির্বাণ আগে ডঃ দে-র নোটবুকে দেখেছিল।
কৃশা বলল, “এটা কি ফাঁদ হতে পারে?”
“অবশ্যই পারে,” অনির্বাণ গম্ভীর গলায় বলল, “কিন্তু এটা এমন কারও লেখা, যে আমাদের চলার পথের প্রতি ধাপে নজর রাখছিল।”
“তাহলে যাবার কথা ভাবছো?”
অনির্বাণ চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় পর বলল, “আমরা যা করি, তা যদি সত্যের জন্য হয়, তবে পিছিয়ে গেলে সবই বৃথা।”
দুই সপ্তাহ পর
উত্তর রাশিয়া, করাচা গ্রাম
রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক ছোট্ট, তুষারে ঢাকা গ্রামে পৌঁছনো সহজ নয়। প্রথমে মস্কো, তারপর পিটার্সবার্গ হয়ে আরও দু’টি ছোট বিমান পরিবর্তন করে অবশেষে পৌঁছতে হয়েছিল করাচা-য়। পুরো গ্রামে ইন্টারনেট নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন।
কিন্তু অনির্বাণ ও কৃশা যখন সেখানে পৌঁছল, তখনই তাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না—এখানে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের এক বিরাট সিন্দুকের মতো ঘর, যার গায়ে লেখা কিছু প্রাচীন স্লাভিক ভাষায়, যার মধ্যে কয়েকটি চিহ্ন ছিল হুবহু সেই রেড মারকারির প্রতীক।
এক বৃদ্ধ মহিলা, যার নাম ছিল নিনা, ইশারায় ডেকে বলল, “তোমরা এসেছে ওর খোঁজে, তাই না? সমরের নাম আমার মনে আছে। ও এসেছিল আজ থেকে বিশ বছর আগে। এখানেই সে রেখেছিল কিছু। বলেছিল—‘যদি পৃথিবী একদিন নিজের ভুল বোঝে, তবে কেউ আসবে এক নতুন সকাল নিয়ে।’”
অনির্বাণ ও কৃশা হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকল। ভেতরে একটিই বস্তু—একটা লোহার বাক্স। আগেরটার মতো নয়, অনেক ভারী, আর তার গায়ে খোদাই করা অদ্ভুত সব চিহ্ন।
বাক্সটা স্পর্শ করতেই এক অদ্ভুত কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল—একটা অটো-রেকর্ডিং:
“যদি তুমি এটা শুনছো, তাহলে আমি নিশ্চিত তুমি ভুল পথে হাঁটোনি। রেড মারকারি তার সম্পূর্ণ রূপে আজও তৈরি হয়নি। কিন্তু এই বাক্সে তার শেষ উপাদান আছে—যা তাকে স্থায়ী করে তুলবে। আমি এ উপাদান আলাদা করে রেখেছি, কারণ আমি জানি, বিজ্ঞান যত শক্তিশালী হোক, নীতির কাছে তাকে নতজানু হতেই হয়।”
“তুমি যদি সত্যিই এটাকে সক্রিয় করতে চাও, তাহলে শুধু বিজ্ঞান নয়, তোমার হৃদয়কেও জিজ্ঞেস করো—পৃথিবী কি প্রস্তুত নতুন সময়ের জন্য?”
অনির্বাণ বাক্সটা হাতে তুলে নিল।
কৃশা আস্তে বলল, “তাহলে এখন কী হবে?”
“এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে,” অনির্বাণ বলল, “এই বাক্সটা চালু করব, না ধ্বংস করব।”
“আমরা কি ঈশ্বর?”
“না, তবে আমরা তো মানুষ। এবং মানুষই ঠিক করে ভবিষ্যতের পথ।”
পর্ব ১০
দিল্লি, এক মাস পর।
নয়াদিল্লির ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজের একটি গোপন পরীক্ষাগারে বসে আছে অনির্বাণ আর কৃশা। তাদের সামনে রাখা সেই অদ্ভুত বাক্স—রাশিয়ার করাচা গ্রামের বরফের নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া, যেটার ভেতরে আছে রেড মারকারির শেষ উপাদান।
ডঃ তনময় সরকার, ভারত সরকারের অন্যতম সেরা পারমাণবিক পদার্থবিদ, মাথা নাড়লেন।
“আপনারা জানেন তো, এটা চালু হলে পৃথিবীর ভারসাম্য কেঁপে উঠবে? এই ফর্মুলা যদি রিকনস্ট্রাক্ট করি, তাহলে ইতিহাসে যা কখনও হয়নি, সেটা ঘটবে। পূর্বে প্রেরিত তথ্য বাস্তবে পরিণত হতে পারে, যেটা হয়তো যুদ্ধ থামাতে পারবে… আবার নতুন যুদ্ধও ডেকে আনবে।”
অনির্বাণ ধীরে বলল, “তাই তো আমরা দ্বিধায়। এটা চালু করা কি দায়িত্ববোধ? না সেটা ঈশ্বরসুলভ অহংকার?”
কৃশা চুপ করে ছিল, তারপর বলল, “আমরা এটা নিজেরা ব্যবহার করব না। আমরা চাই বিজ্ঞানীদের একটি নিরপেক্ষ বোর্ড গঠন হোক, যারা এই প্রযুক্তি সংরক্ষণ করবে, প্রয়োজনে ধ্বংস করবে। রেড মারকারি হবে না কারও একার সম্পত্তি।”
ডঃ তনময় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তা হলে সেটা লিখে দিন। স্বাক্ষর করে দিন—আপনারা এই জিনিসের উপর কোনও অধিকার দাবি করবেন না।”
সন্ধ্যেবেলা
অনির্বাণ ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথায় হালকা হাওয়া। হাতে এক কাপ চা। পেছনে এসে দাঁড়াল কৃশা।
“তুমি ঠিক করেছ?”
“না… এখনো করি নি। এই বাক্সটা আমরা কার হাতে দিচ্ছি জানি না। আজ যদি কোনো এক বিজ্ঞানী বা রাজনীতিবিদ এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে ভবিষ্যত আমাদের ক্ষমা করবে না।”
“তবে?”
“তবে আমাদের একটিই কাজ—সত্যের রক্ষক হওয়া, ব্যবহারকারী নয়।”
তখনই ফোনটা বেজে উঠল। অন্য প্রান্তে একজন চাপা গলায় বলল,
“মিস্টার সেন, আপনাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। আপনারা যদি বাক্সটা সরকারের কাছে দিয়ে দেন, সেটা আর কোনোদিন মানুষের হাতে ফিরে আসবে না। আমরা চাই না এ জিনিস হারিয়ে যাক।”
“আপনারা কারা?”
“আমরা সেই গোষ্ঠী, যারা বিশ্বাস করি—বিজ্ঞান কখনো বন্ধ ঘরে আটকে থাকে না। রেড মারকারিকে ধ্বংস করলে ভবিষ্যতের মানুষ আপনাদের অভিশাপ দেবে।”
“তাহলে আপনারা চাইছেন আমরা এটাকে উন্মুক্ত করে দিই?”
“ঠিক তাই। বিকেন্দ্রীকরণই একমাত্র সমাধান। ফর্মুলা সকলের হাতে থাকলে কেউ একা ঈশ্বর হতে পারবে না। আপনি ভাবুন। আমরা অপেক্ষা করছি।”
ফোন কেটে গেল।
কৃশা বলল, “তবে কি এটা আবার একটা চক্রের শুরু?”
অনির্বাণ ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ। এখন থেকে প্রশ্ন শুধু একটাই—আমরা কি রক্ষা করব ভবিষ্যৎ, না বানাব নিজেদের মতো এক নতুন অতীত?”
তিন দিন পর
পত্রপত্রিকায় ছোট্ট একটা খবর ছাপা হল:
“দিল্লির এক অজানা গবেষণাগারে বিস্ফোরণ। বিশেষ কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে বলে সূত্রের খবর। কর্তৃপক্ষ জানায়, কোনো রাষ্ট্রীয় গোপন প্রকল্প এই বিস্ফোরণের শিকার হয়নি।”
কিন্তু কেউ জানে না, সেই দিন সন্ধ্যায় অনির্বাণ আর কৃশা নিজের হাতে একটি বাক্স খুলেছিল। ভেতরের ধাতব ক্যাপসুল তারা রেখে দেয়নি। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—মানবতার নিরাপত্তার জন্য সেটা ধ্বংস করতে হবে।
তারা নিজেরা ট্রিগার টিপেছিল। আর ঠিক তার পর মুহূর্তেই ওই গবেষণাগারের গভীরতায় ঘটে গিয়েছিল এক শান্ত বিস্ফোরণ, যা মুছে দিয়েছিল রেড মারকারির শেষ চিহ্ন।
রাতের আকাশে তারা জ্বলছে।
অনির্বাণ আর কৃশা এখন শান্ত।
তারা জানে, সত্যকে ধরে রাখতে গেলে নিজেকে ছেড়ে দিতে হয়।
তারা জানে, রেড মারকারি আর ফিরবে না।
তবে…
এক পুরনো খামে, দূরের কোনো পর্বতের চূড়ায়…
একটি চিঠি উড়ে বেড়াচ্ছে, যার গায়ে লেখা—
“ChronoCode survives. Always.”
পর্ব ১১
তিন মাস কেটে গেছে। অনির্বাণ সেন ও কৃশা ঘোষ আর আলোচনায় নেই। না কোনো খবরের কাগজে, না সরকারি নথিতে। যেন তারা হারিয়ে গেছে—অদৃশ্যভাবে, স্বেচ্ছায়।
কিন্তু সত্য এত সহজে নিঃশেষ হয় না।
কিরঘিজস্তানের পর্বতের গা ঘেঁষে এক ছোট্ট গবেষণাগারে বসে আছে এক তরুণ বিজ্ঞানী, নাম আনজুম রাহমান। হাতে ধরা সেই পুরোনো খাম—যেটা পাওয়া গিয়েছিল রাশিয়ার বরফের নিচে। আর তার ভেতরে থাকা চিঠিতে লেখা ছিল:
“ChronoCode survives. Always. If you’re reading this, you are now its guardian.”
আনজুম জানত না অনির্বাণ সেন কে ছিলেন, বা কৃশা ঘোষ কী করেছেন। সে জানে না রেড মারকারি কতটা ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। কিন্তু তার চোখে এখন শুধু এক প্রশ্ন—যদি সময়ের সীমা ভাঙা যায়, তবে সত্যকে ফেরত আনা যায় কি?
কলকাতা, বর্তমান
বাগবাজারের ছাপাখানার সেই ঘরটি এখন খালি। শুধুমাত্র পুরোনো ডেস্কের উপরে রাখা একটা খোলা ডায়েরি। তাতে লেখা শেষ পাতাটি:
“তাদের কেউ জানবে না আমরা কোথায় গেলাম। কেউ জানবে না, রেড মারকারির সত্য আমরা ধ্বংস করেছিলাম না। বরং আমরা একে ঠেলে দিয়েছিলাম ভবিষ্যতের হাতে—একদিন কেউ যদি সত্যের জন্য প্রস্তুত হয়, তবে যেন সে একে খুঁজে পায়। আমরা শুধু সময়কে পেছনে রেখে সামনে হাঁটলাম।”
— অনির্বাণ সেন, ২২ জুন, ২০২৫
সময়: ২০৫০ সাল
স্থান: নিউ ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট, চিলি
বিশ্ব এখন জলবায়ু দুর্যোগে ভুগছে। সভ্যতার অনেক নিয়ম বদলে গেছে। এই নতুন সময়ে ইতিহাস লিখছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্য সংরক্ষণের নতুন ধারায়।
একটি সম্মেলনে, এক তরুণ গবেষক উপস্থাপন করল একটি ফাইল, নাম: Project ChronoCode
বহুজন হতভম্ব। একজন প্রশ্ন করল, “এটা কোথা থেকে পেলেন?”
গবেষক মুচকি হেসে বলল, “এক পুরনো মেইনফ্রেম থেকে। কেউ বহু বছর আগে এনক্রিপ্ট করে রেখে গিয়েছিলেন। এতে সময়ভিত্তিক তথ্য ট্রান্সমিশনের সূত্র আছে।”
শব্দটা আবার উচ্চারিত হলো—Hg-Red।
ইতিহাস ঘুরেফিরে ফিরে আসে।
মানুষের হাত থেকে কিছু যায় না—তা সে সত্যই হোক, বা ভুল।
রেড মারকারির যাত্রা শেষ হয়নি।
এটা শুধু বিরতি নিয়েছিল।
আর যারা একদিন একে প্রতিহত করেছিল—অনির্বাণ ও কৃশা—তারা হয়তো আজ নেই, হয়তো এই সময়ে নেই। কিন্তু কোথাও না কোথাও, কোনো এক পাতার নিচে, কোনো এক স্নো-সিগনালের মধ্যে, তাদের কণ্ঠস্বর এখনো বেঁচে আছে।
তারা বলছে—
“তুমি যদি সময়কে প্রশ্ন করতে চাও, তবে সাহস নিয়ে এগিয়ে চলো। কিন্তু মনে রেখো—সবচেয়ে বিপজ্জনক সত্য সেই, যেটা এখনও নিজের নাম খুঁজে পায়নি।”
শেষ