Bangla - তন্ত্র

রক্তমন্ত্র

Spread the love

অগ্নিভ চক্রবর্তী


কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের পুরনো ভবনটার করিডোর সবসময়ই যেন একটু অন্ধকার আর আর্দ্র গন্ধে ভরা থাকে, বিশেষ করে বর্ষার রাতে। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসছে ঠান্ডা বাতাস, আর কোথাও দূরে হাসপাতালের করিডোরে ভিজে স্লিপারের শব্দ ভেসে আসছে। অয়ন মুখার্জী, তৃতীয় বর্ষের মেডিকেল ছাত্র, নিজের ঘরে বসে নোটস লিখছিল, কিন্তু মনটা অস্থির। সেদিন বিকেল থেকে বন্ধুর ফোনে কোনো উত্তর নেই—ঋত্বিক সেন, যে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, সবসময় সময়মতো খবর দেয়, তার এই নীরবতা অয়নকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ হঠাৎ পাশের ঘর থেকে আসা একটা ধাক্কার শব্দ অয়নকে চমকে দিল। শব্দটা এত হঠাৎ আর তীব্র যে সে মুহূর্তের মধ্যে কলম ফেলে উঠে পড়ল। ছুটে গেল ঋত্বিকের ঘরের দরজার সামনে, কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া নেই।

দরজায় হাতুড়ির মতো আঘাত করতে করতে অয়ন নিজের বুকের ধড়ফড় বাড়তে টের পেল। হোস্টেলের করিডোরে তখন ক’জন ছাত্র এসে দাঁড়িয়েছে, কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে। অয়ন তাড়াতাড়ি হোস্টেলের ওয়ার্ডেনকে খবর দেয়, আর তিন মিনিটের মধ্যে দরজা ভেঙে ফেলা হয়। দরজা খুলতেই গন্ধের এক অদ্ভুত মিশ্রণ নাকে এসে লাগে—ক্লিনিকাল অ্যালকোহল, পুরনো কাঠ, আর তাজা রক্তের ধাতব গন্ধ। বিছানার পাশে মেঝেতে পড়ে আছে ঋত্বিক, সাদা টি-শার্টে লালচে ভেজা দাগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখ আধখোলা, ঠোঁট কাঁপছে যেন কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। অয়ন হঠাৎ নিজের বুকের ভেতরে একটা বরফ-ঠান্ডা শূন্যতা অনুভব করল। সে তাড়াতাড়ি তার গলার স্পন্দন পরীক্ষা করল—দুর্বল, প্রায় অদৃশ্য। “অ্যাম্বুলেন্স ডাকো!” সে চিৎকার করে উঠল, আর এক ছাত্র দৌড়ে নিচে ফোন করতে গেল।

হাসপাতালে পৌঁছতে সময় লাগেনি, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইমার্জেন্সি ইউনিটের উজ্জ্বল আলোয় ঋত্বিকের শরীর নিথর হয়ে পড়ে আছে, আর একজন সিনিয়র ডাক্তার ফাইলের ওপর গম্ভীর ভঙ্গিতে লিখে চলেছেন। অয়ন প্রায় ভেঙে পড়া গলায় জানতে চাইলো, “কি হয়েছে ওর?” ডাক্তার ঠান্ডা স্বরে বললেন, “হঠাৎ ইন্টারনাল হেমোরেজ। শরীরের ভেতরে একাধিক জায়গায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। রিপোর্ট দেখে বোঝা যাচ্ছে, কোনো আঘাত বা দুর্ঘটনার চিহ্ন নেই।” কথাটা শোনামাত্র অয়ন যেন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। মেডিকেল সায়েন্স পড়তে পড়তে সে জানে, এমন ঘটনা বিরল হলেও সম্ভব—কিন্তু তার অন্তর বলছিল, এখানে কিছু একটা অস্বাভাবিক আছে। বন্ধুর হাতে ছোট্ট একটা কাটা দাগ চোখে পড়তেই তার মন আরও প্রশ্নে ভরে গেল—ওটা কি কাকতালীয়, নাকি অন্য কিছু?

রাত তখন অনেক গভীর, তবু হাসপাতালের করিডোরের আলো নিভে যায়নি। অয়ন একা বসে আছে করিডোরের বেঞ্চে, চারপাশে সাদা কোট পরা ডাক্তারদের ব্যস্ত চলাফেরা, মাঝে মাঝে স্ট্রেচারে করে আনা রোগীদের হাহাকার ভেসে আসছে। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু মনে হচ্ছে শহরের সব শব্দ যেন দূরে সরে গেছে। অয়নের চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে ঋত্বিকের ফ্যাকাশে মুখ, আর মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা রক্তের দাগ। তার মন জানে, এটা নিছক মেডিকেল কেস নয়, এর পেছনে কিছু আছে—কিছু যা বিজ্ঞান দিয়ে বোঝানো যাবে না এত সহজে। কিন্তু সে মুহূর্তে কোনো প্রমাণ নেই, শুধু একটা তীব্র অনুভূতি আর বন্ধুর মৃত্যুর অসহায় রাগ। সেদিন রাতে হোস্টেলে ফেরার সময় সে মনে মনে শপথ করল—যেভাবেই হোক, এই রহস্যের শেষ খুঁজে বের করব, আর যার হাতেই থাকুক, ঋত্বিকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব।

ঋত্বিকের শেষকৃত্যটা যেন এক অদ্ভুত শূন্যতার মধ্যে মিলিয়ে গেল। শ্মশানের চুল্লি থেকে ধোঁয়া উঠছিল ধীরে ধীরে, আর গঙ্গার হাওয়ায় সেই ধোঁয়ার গন্ধে মিশে ছিল পোড়া কাঠ আর মানবদেহের ভারী, অজানা গন্ধ। সবাই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেল, কিন্তু অয়ন দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ, চোখের সামনে ধূসর ছাই উড়ে যাচ্ছে, যেন তার বন্ধুর অস্তিত্বও এভাবেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল, ঋত্বিক যদি এখন তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত, তবে কিছু একটা বলত—কিছু জরুরি কথা। কিন্তু ছাই আর ধোঁয়ার ওপারে কোনো শব্দ নেই, শুধু দূরের শঙ্খধ্বনি আর গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ। ফিরতি পথে হোস্টেলের করিডোরগুলো ফাঁকা, দরজাগুলো বন্ধ, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়া জায়গায় অন্ধকার জমে আছে। নিজের ঘরে ঢুকে অয়ন এক মুহূর্তের জন্য দরজা ঠেসে ধরে দাঁড়িয়ে রইল, যেন বাইরের শূন্যতাকে ভেতরে ঢুকতে না দিতে চায়।

রাত তখন প্রায় আড়াইটা। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে, জানলার কাঁচে ফোঁটা ফোঁটা শব্দ হচ্ছে। অয়ন বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু ঘুম আসছে না। মাথার ভেতরে দিনের সব দৃশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে—ঋত্বিকের হাসি, ল্যাবে একসঙ্গে কাটানো সময়, আর সেই শেষ মুহূর্ত, যখন তার শ্বাস ভেঙে ভেঙে আসছিল। হঠাৎ কোথা থেকে যেন খুব হালকা, প্রায় ফিসফিসের মতো এক শব্দ কানে এলো। অয়ন চমকে উঠে বসল, কিন্তু চারপাশে কেউ নেই। সে আবার শুতে গেল, মনে মনে নিজেকে বোঝাল—এটা হয়তো মাথার ভ্রম, দুঃখ আর ক্লান্তির মিশ্রণ। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই সেই শব্দটা আবার শোনা গেল, এবার একটু স্পষ্ট—“প্রতিশোধ নাও…”। অয়নের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। কণ্ঠস্বরটা অদ্ভুতভাবে পরিচিত, যেন কোনো দূরের কুয়াশা ভেদ করে ঋত্বিকই কথা বলছে।

অয়ন বিছানা থেকে উঠে জানলার কাছে গেল, বাইরে তাকাল, কিন্তু অন্ধকারে ভেজা গাছের পাতায় শুধু বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। হঠাৎ শব্দটা আবার এল, এবার আরও কাছে—“রক্তের পথ ধরো…”। কণ্ঠস্বরটা এতটাই স্পষ্ট যে মনে হল কেউ তার ঘরের ভেতরেই দাঁড়িয়ে বলছে। অয়ন তাড়াতাড়ি লাইট জ্বালাল, কিন্তু ঘর ফাঁকা। খাটের পাশে ছায়ার মতো কিছু নড়ে উঠেছিল কি? চোখের কোণে অল্পক্ষণের জন্য একটা সাদা-ধূসর আকার ভেসে উঠল, যেন ঋত্বিকের মুখ, কিন্তু চোখে ছিল গভীর অন্ধকার। অয়ন কাঁপতে থাকা হাতে মুখ মুছে আবার তাকাল—কিছুই নেই, শুধু বিছানার চাদরে একটা ভেজা দাগ, যা বৃষ্টির নয়, বরং হালকা লালচে। ঠান্ডা ঘাম গায়ে বেয়ে নেমে আসতে লাগল। সে টের পেল, তার ভেতরে অজানা একটা শক্তি নড়ে উঠছে—একটা তীব্র আহ্বান, যা তাকে ঠেলে দিচ্ছে এমন এক পথে, যেখান থেকে হয়তো আর ফেরা যাবে না।

ঘড়িতে তখন চারটা বাজে। বাইরের অন্ধকার একটু হালকা হয়েছে, কিন্তু অয়নের ঘরের ভেতরে যেন এক অদ্ভুত ভারি পরিবেশ জমে আছে। তার মাথায় বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই দুই বাক্য—“প্রতিশোধ নাও… রক্তের পথ ধরো…”। একদিকে যুক্তিবাদী মন বলছে, এটা শুধু দুঃখ আর অবসাদের কারণে সৃষ্ট মানসিক বিভ্রম। কিন্তু অন্যদিকে হৃদয়ের গভীরে এক অদ্ভুত টান, যা তাকে বিশ্বাস করাচ্ছে—ঋত্বিক সত্যিই কথা বলেছে, তার মৃত্যুর পেছনে অন্ধকার কোনো শক্তি বা মানুষ লুকিয়ে আছে। সূর্যের প্রথম আলো জানলা দিয়ে ঢোকার সময় অয়ন ঠিক করে ফেলল, সে এই ডাক উপেক্ষা করবে না। বিজ্ঞান তাকে যতই বোঝাক, সে সত্যের খোঁজে যাবে—হয় মানুষের জগতে, নয়তো মানুষের বাইরে। আর যদি প্রতিশোধের পথ রক্তে লেখা হয়, তবু সে সেই পথে পা বাড়াবে।

পরের দিন থেকেই অয়ন নিজেকে পড়াশোনার বাইরে টেনে নিয়ে গেল এক নতুন জগতে—তদন্তের জগতে। মেডিকেল কলেজের ব্যস্ত করিডোরে, ল্যাবের গন্ধে ভরা ঘরে, আর ক্যানটিনের ভিড়ের মধ্যে সে চুপচাপ মানুষের কথাবার্তা শুনতে লাগল। প্রথমে কিছুই ধরা পড়ল না, কিন্তু ধীরে ধীরে কিছু ফিসফিসানো গুজব তার কানে আসতে লাগল—ড. অমরেশ গুহ সম্পর্কে। গুহ, যিনি ছিলেন প্যাথোলজি বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক, কলেজে একদম কঠোর স্বভাবের জন্য পরিচিত। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে বলা হচ্ছিল, তিনি গোপনে একাধিক অবৈধ মেডিকেল ট্রায়াল চালাচ্ছেন, বিশেষত বিরল রক্তের রোগ নিয়ে। অয়ন মনে করতে লাগল, ঋত্বিক প্রায়ই ল্যাবের কাজ শেষ করে একা একা দেরি পর্যন্ত বসে থাকত, আর কোনো অজানা নোটবুকে কিছু লিখে রাখত। এখন মনে হচ্ছে, সেই নোটবুকের পাতায় হয়তো গুহ সম্পর্কে কিছু লেখা ছিল। কিন্তু ঋত্বিকের মৃত্যুর পর তার ঘরের জিনিসপত্র পরিবারের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে—আর সেই নোটবুকও কোথাও নেই।

অয়ন প্রমাণ খুঁজে বের করার জন্য ল্যাবের পুরনো রেকর্ডে ঢুকতে চেষ্টা করল। এক রাতে সে আর্কাইভ রুমে চুপিসারে ঢুকে ফাইলের আলমারি খোলার চেষ্টা করল। আলমারির ভেতরে ছিল নানা ধরণের মেডিকেল রিপোর্ট, রোগীর ফাইল, আর কিছু সিল করা খাম। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে রোগীর নাম গোপন রেখে শুধু কোড লেখা—অদ্ভুত বিষয় হল, সব কোডের সাথেই রক্ত পরীক্ষার এক ধরনের বিরল রেজাল্টের উল্লেখ আছে, যা সাধারণ রোগীর ক্ষেত্রে খুবই বিরল। ফাইলগুলো দেখে তার মনে হল, এসব পরীক্ষা হয়তো আইনসঙ্গত নয়, কিন্তু প্রমাণ হিসেবে এগুলো এখনও অপ্রতুল—কোনো স্বাক্ষর বা সরকারি অনুমোদনের কাগজ নেই, যা আদালতে ব্যবহার করা যাবে। তার মনে পড়ল, ঋত্বিক একবার বলেছিল, “কিছু মানুষের লোভ রক্তকেও পণ্যে পরিণত করে দেয়।” তখন সে বুঝতে পারেনি, কথাটার ভেতরে কতটা গভীরতা ছিল।

তদন্তের সময় অয়ন বুঝতে পারল, শুধু ফাইল বা কাগজ নয়—কিছু মানুষের নীরব মুখোশও সত্য লুকিয়ে রাখে। সে লক্ষ্য করল, ড. গুহকে নিয়ে কিছু সিনিয়র ডাক্তার অদ্ভুতভাবে চুপচাপ থাকে, যেন বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। এমনকি কয়েকজন ছাত্রও তাকে এড়িয়ে চলে, যেন জানে অয়ন এমন কিছুর খোঁজ করছে যা না জানলেই ভালো। একদিন ক্যানটিনে বসে চা খাওয়ার সময় এক জুনিয়র এসে ফিসফিস করে বলল, “দাদা, ঋত্বিক যা খুঁজছিল, সেটা খুব বিপজ্জনক। গুহ স্যার শুধু ট্রায়াল চালাননি… কিছু ট্রায়ালে মানুষ মরেছে।” অয়ন জানতে চাইলে ছেলেটা মাথা নিচু করে চলে গেল, আর কথা বলল না। সেই মুহূর্তে অয়নের মনে হল, সত্যিটা যতই সে কাছে পৌঁছচ্ছে, ততই অদৃশ্য একটা ছায়া তাকে ঘিরে ফেলছে—যেন কেউ তাকে দেখে রাখছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ গুনে রাখছে।

প্রমাণ আইনগতভাবে যথেষ্ট নয়—এই বাস্তবতা অয়নকে হতাশ করল, কিন্তু ভয় পাইয়ে দিতে পারল না। সে জানে, ঋত্বিকের মৃত্যুর পেছনে ড. গুহের হাত আছে, কিন্তু আদালত বা পুলিশ এই মুহূর্তে তার পক্ষে দাঁড়াবে না। সেই রাতে হোস্টেলের ঘরে একা বসে, জানলার বাইরের আলো-অন্ধকারের খেলা দেখতে দেখতে, অয়ন মনে করল ঋত্বিকের সেই ফিসফিসানি—“প্রতিশোধ নাও… রক্তের পথ ধরো…”। হয়তো বিজ্ঞান এই লড়াইয়ে তার হাত বাঁধবে, কিন্তু রক্তের পথ—যা আইন নয়, যুক্তি নয়, শুধু প্রতিশোধের তীব্র আকাঙ্ক্ষা—সেই পথ হয়তো তার জন্য খোলা। তার মনে প্রশ্ন জাগল, যদি সত্যিই এমন কোনো শক্তি থাকে, যা তাকে এই অসম যুদ্ধ জিততে সাহায্য করতে পারে? আর যদি সেই শক্তি রক্ত চায়, তবে কি সে প্রস্তুত? জানলার ওপারে ছায়ার মতো নড়ে ওঠা রাতের অন্ধকার যেন নীরবে তাকে হ্যাঁ বলে উত্তর দিল।

কলেজের করিডোরে একদিন ক্লাস শেষে অয়নকে ডাকল রণজিৎ, তার এক সিনিয়র, যিনি সাধারণত মজা-ঠাট্টার বাইরে গম্ভীর কোনো কথা বলেন না। রণজিতের চোখে সেইদিন এক অদ্ভুত চাপা ভাব ছিল, যেন বহুদিন ধরে ভিতরে লুকিয়ে রাখা কোনো গোপন কথা এবার মুখে আনতে বাধ্য হচ্ছে। “তুই যদি সত্যিই প্রতিশোধ নিতে চাস,” সে ধীরে ধীরে বলল, “তাহলে তোকে বীরভূমে যেতে হবে। ত্রিলোচন নাথ নামে একজন আছে সেখানে… তান্ত্রিক। ওর কাছে আছে এমন এক মন্ত্র—রক্তের মন্ত্র। রক্ত দিয়ে অভিশাপ দেওয়া যায়।” অয়ন প্রথমে ঠোঁটে হালকা হাসি টানল। একজন মেডিকেল ছাত্র হিসেবে এসব শোনার পর তার মন বিজ্ঞান আর যুক্তির দিকে চলে গেল—রক্ত মানে হিমোগ্লোবিন, প্লাজমা, সেল; কোনো অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার মাধ্যম নয়। কিন্তু রণজিতের চোখের ভেতরের দৃঢ়তা তাকে থামিয়ে দিল। “আমি নিজের চোখে দেখেছি,” রণজিৎ বলল, “একজন মানুষ যেভাবে দিনের পর দিন অসুস্থ হয়ে গেল, আর শেষে এমনভাবে মরল, যেটা কোনো ডাক্তার ব্যাখ্যা করতে পারেনি। ত্রিলোচন নাথের নাম কেউ মুখে আনে না, কিন্তু সবাই জানে।”

প্রথমে অয়ন এই গল্পকে কুসংস্কারের আরেকটা রূপ ভেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই রাতেই, যখন সে একা হোস্টেলের ঘরে বসে ছিল, তখন তার কানে আবার ভেসে এল সেই ফিসফিসানি—ঋত্বিকের কণ্ঠস্বর: “রক্তের পথ ধরো…”। এবার সেই ডাকের তীব্রতা যেন আরও গভীর, আরও দৃঢ়। বিজ্ঞান তার কাছে উত্তর দিচ্ছে না, আইনও নয়। তাহলে কি সত্যিই অন্য কোনো পথ আছে? অয়নের ভেতরে যুক্তিবাদী সত্তা আর প্রতিশোধপ্রবণ সত্তার দ্বন্দ্ব চলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত প্রতিশোধের আগুন তার মধ্যে এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে যুক্তি আর অবিশ্বাস তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল। পরের দিন সে রণজিতের কাছ থেকে সেই গ্রামের নাম, ত্রিলোচনের আস্তানার অবস্থান আর কিছু সাবধানতার কথা জেনে নিল। রণজিৎ শুধু বলল, “ওর কাছে গেলে স্পষ্ট কথা বলিস না। তুই কী চাস, সেটা ও নিজেই বুঝে যাবে।”

বীরভূমে যাওয়ার পথে শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, রাস্তা সরু হয়ে এল, চারপাশে গাছগাছালির ভিড়, মাঝে মাঝে খোলা মাঠে হলুদ ধানের ঢেউ। ট্রেনের জানলা দিয়ে অয়ন দেখছিল কুয়াশায় ঢাকা গ্রামীণ সকাল, যেখানে সময় যেন থমকে আছে। রেলস্টেশন থেকে নেমে বাসে, তারপর সাইকেলভ্যানে, আর শেষে হেঁটে যেতে হল। গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে দেখা গেল লালমাটির সরু রাস্তা, দুইপাশে পুরনো বটগাছ, যার শিকড় মাটির ওপর সাপের মতো ছড়িয়ে আছে। সেই পথ পেরিয়ে অয়ন পৌঁছল একটা ছোট্ট টালির ঘরের সামনে। ঘরটা অদ্ভুতভাবে নির্জন, চারপাশে মানুষের কোনো চিহ্ন নেই, শুধু শুকনো পাতা উড়ে বেড়াচ্ছে। দরজায় কোনো কড়া নেই, কিন্তু দরজা আধখোলা। ভেতরে ঢোকার আগে অয়ন এক মুহূর্ত থামল—মনে হল, দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, অথচ চোখ দেখা যাচ্ছে না।

ভেতরে পা দিতেই এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে এল—ধূপ, পুড়তে থাকা কোনো ভেষজ, আর রক্তের ধাতব গন্ধের মিশ্রণ। ঘরের ভেতর অন্ধকার, শুধু কোণায় তেলের প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের আলোয় অয়নের চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ মানুষ, গেরুয়া কাপড়ে মোড়া, চুল ও দাড়ি সাদা, চোখদুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, যেন সেই চোখ দিয়ে মানুষের ভেতরের গোপনতম ভয়কে দেখে ফেলতে পারে। তিনি কিছু না বলে অয়নের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আর অয়ন হঠাৎ অনুভব করল তার শরীরের ভেতরের সব শব্দ, সব নাড়াচাড়া থেমে গেছে। তারপর বৃদ্ধ ঠোঁটে হালকা হাসি এনে বললেন, “তুই অনেক পথ পেরিয়ে এসেছিস, অয়ন। আমি জানি তুই কী খুঁজছিস।” অয়ন কোনো কথা বলল না—শুধু মনে মনে বুঝল, যুক্তির সীমা পেরিয়ে সে এমন এক দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, যার ওপারে অন্ধকার, আর সেই অন্ধকারে হয়তো তার প্রতিশোধের উত্তর লুকিয়ে আছে।

ত্রিলোচন নাথের কুটিরের ভেতর অয়নের চোখ প্রথমে অভ্যস্ত হতে সময় নিল। প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় দেখা গেল দেয়ালে ঝোলানো অদ্ভুত সব জিনিস—কোথাও শুকনো প্রাণীর খুলি, কোথাও শুকিয়ে যাওয়া পাতা-মূল, আবার কোথাও লালচে দাগে ভরা কাপড়। কিন্তু তার দৃষ্টি আটকে গেল এক জায়গায়—দেয়ালের ওপর ছড়িয়ে থাকা অগণিত কালো-লাল দাগ, যেন পুরনো রক্তের স্তর জমে আছে। বাতাসে একধরনের ভারী গন্ধ, ধূপের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা ধাতব শীতলতা, যা তাকে এক মুহূর্তের জন্য কাঁপিয়ে দিল। ত্রিলোচন নাথ তখন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। গলায় হাড়ের মালা, যার প্রতিটি হাড় ছোট, কিন্তু কোনোটা পশুর, কোনোটা হয়তো মানুষের—অয়ন নিশ্চিত হতে পারল না। তাঁর চোখদুটি স্থির, তীক্ষ্ণ, এমন যেন মানুষের অন্তরের গভীরতম ভয় চিরে দেখতে পারে। অয়নের মনে হল, এই বৃদ্ধ শুধু একজন মানুষ নয়—অদ্ভুত, অজানা শক্তির এক বাহক, যার উপস্থিতি অন্ধকারকে আরও ঘন করে তোলে।

“রক্তে যে প্রতিশোধ লেখা হয়, তার শেষ তুমি জানো না,” ত্রিলোচনের কণ্ঠ ভেতরে কাঁপন তুলল। প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে, অথচ এমনভাবে উচ্চারিত হচ্ছিল যেন শব্দের ভেতরেই একটা শীতল সতর্কতা লুকিয়ে আছে। তিনি জানালেন, রক্তমন্ত্র একবার উচ্চারণ করলে তা থামানো যায় না—এটি ধীরে ধীরে শিকারকে গ্রাস করে, কিন্তু একই সঙ্গে মন্ত্রদাতাকেও ক্ষয় করে। “তুমি যা চাইছ, তা শুধু মৃত্যু নয়… তুমি চাইছ অভিশাপ,” তিনি বললেন, চোখ সরাসরি অয়নের দিকে স্থির রেখে। অয়ন চুপচাপ শুনছিল, কিন্তু তার ভিতরে দ্বিধা ছিল না। প্রতিশোধের জন্য সে ইতিমধ্যেই অনেক দূর চলে এসেছে, আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। যখন ত্রিলোচন নাথ থামলেন, অয়ন দৃঢ়ভাবে বলল, “আমি শিখতে চাই।” সেই মুহূর্তে বৃদ্ধের ঠোঁটে এক অস্পষ্ট হাসি ফুটল—যেন তিনি আগেই জানতেন এই উত্তর আসবে।

মন্ত্র শেখা শুরু হল সেই রাতেই। ত্রিলোচন নাথ একটি লোহার থালা বের করলেন, যার তলায় লালচে রঙে পুরনো দাগ লেগে আছে। তিনি বললেন, রক্তমন্ত্রের জন্য নিজের রক্ত দরকার—এতে প্রতিশোধের শক্তি বাঁধা পড়ে রক্তের সঙ্গে। প্রথম ধাপে অয়নের হাতের তালুতে তীক্ষ্ণ ব্লেড দিয়ে হালকা কেটে রক্তের ফোঁটা থালায় পড়ানো হল। রক্ত মাটিতে পড়ার মুহূর্তে প্রদীপের আলো যেন কেঁপে উঠল, আর ঘরের বাতাসে হঠাৎ ঠান্ডা শীতলতা ছড়িয়ে গেল। তারপর বৃদ্ধ এক অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন—শব্দগুলো অয়ন আগে কখনো শোনেনি, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন তার মনের গভীরে ঢুকে যাচ্ছিল। তিনি বুঝতে পারল, এই মন্ত্র শুধু শোনার নয়, অনুভব করার। রক্তের গন্ধ, আগুনের ঝলকানি, আর অন্ধকারের চাপ মিলেমিশে এক অজানা শক্তি তার শরীরে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে।

শেষে ত্রিলোচন নাথ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মন্ত্র শিখে গেলে তুমি শুধু শত্রুকে আঘাত করবে না—তুমি তাকে ধীরে ধীরে রক্তের মধ্যে পচিয়ে দেবে। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে তোমার নিজের রক্তও দুর্বল হবে। সময়মতো থামতে না পারলে এই মন্ত্র তোমাকেই খেয়ে ফেলবে।” অয়ন জানত, এই সতর্কতা তাকে ভয় দেখানোর জন্য নয়—এ সত্যি। কিন্তু সে ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ঋত্বিকের মৃত্যু যেভাবে তাকে ভেঙে দিয়েছে, সেভাবে সে আর কিছুতেই ভাঙবে না। যখন সে থালা থেকে রক্ত মুছতে মুছতে বাইরে বেরোল, তখন রাতের আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। দূরে বজ্রপাতের আলোয় তার চোখে প্রতিশোধের দীপ্তি ঝলসে উঠল—এবার সে জানে, তার হাতে এমন এক অস্ত্র এসেছে, যা বিজ্ঞান বা আইন কোনোদিন দিতে পারত না।

ত্রিলোচন নাথের কুটিরে তৃতীয় দিন। অয়ন তখন মন্ত্রের শব্দ আর তাল মিলিয়ে অনুশীলন করছে—এক হাতে কাঁচি, অন্য হাতে পুরনো লোহার থালা। মৃদু প্রদীপের আলোয় রক্তের ফোঁটা থালার তলায় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, আর অয়ন সেই দিকে তাকিয়ে মন্ত্র আওড়াচ্ছে, যেন শব্দ আর রক্ত একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ঠিক তখনই পেছন থেকে আস্তে পায়ে এগিয়ে এল অনিমা—ত্রিলোচনের নাতনি। কালো চুল এলোমেলোভাবে কাঁধে ছড়িয়ে আছে, চোখে গভীর উদ্বেগ। অয়ন প্রথমে খেয়ালই করল না, যতক্ষণ না অনিমা থালার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি জানো না তুমি কী নিয়ে খেলছো।” অয়ন কপাল কুঁচকে তাকাল, আর অনিমা গম্ভীর গলায় বলল, “রক্তমন্ত্র একবার উচ্চারণ করলে তা থামানো যায় না। শত্রুকে তুমি মরতে দেখবে ঠিকই, কিন্তু প্রতিশোধের প্রতিটি ধাপে তোমার নিজের ভেতর থেকেও কিছু একটা মরে যাবে।”

অনিমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, যেন অয়নকে সময় দিচ্ছে তার কথার গুরুত্ব বোঝার জন্য। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি দেখেছি… ছোটবেলায়। আমার বাবা—ত্রিলোচনের ছেলে—একবার এই মন্ত্র ব্যবহার করেছিল। সে শত্রুকে মেরে ফেলেছিল ঠিকই, কিন্তু তার নিজের রক্ত এত দ্রুত শুকিয়ে গিয়েছিল যে এক বছরের মধ্যেই সে মরে যায়। তুমি প্রতিশোধ পাবে, কিন্তু হয়তো সেই সঙ্গে নিজের জীবনও দেবে।” তার চোখে জল টলমল করছিল, কিন্তু সে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিল যেন দুর্বলতা প্রকাশ করতে না চায়। অয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে তার মুখের দিকে তাকাল—অনিমার কথায় একটা অদ্ভুত সততা আছে, কিন্তু সেই সততা তার প্রতিশোধের জ্বলন্ত ইচ্ছাকে নিভিয়ে দিতে পারল না। সে ধীরে ধীরে বলল, “আমি যদি থামি, ঋত্বিকের মৃত্যু বৃথা যাবে। আমি পিছিয়ে যেতে পারি না।”

অনিমা ঠোঁট কামড়ে নিল, যেন আর কিছু বলতে চাইছে কিন্তু জানে, তাতে কোনো লাভ হবে না। সে শুধু বলল, “তাহলে অন্তত এইটা মনে রেখো—মন্ত্র যখন শুরু করবে, তা শেষ হওয়ার আগেই তুমি পালাতে পারবে না। তোমার রক্তই হবে এর পথ, আর সেই পথ যত দীর্ঘ হবে, ততই তোমার ক্ষয় বাড়বে।” তারপর সে চলে গেল, পেছনে রেখে গেল ধূপের গন্ধে ভরা ভারী নীরবতা। অয়ন আবার থালার দিকে তাকাল। রক্তের ফোঁটা তাতে ছড়িয়ে আছে, আর প্রদীপের কাঁপা আলোয় মনে হচ্ছে যেন লাল তরলটি নড়ে উঠছে। তার মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা—যত দ্রুত সম্ভব মন্ত্র আয়ত্ত করতে হবে, যাতে ড. অমরেশ গুহর পতন নিশ্চিত হয়।

সেই রাতেই অয়ন ত্রিলোচনের নির্দেশ ছাড়াই গোপনে মন্ত্রের অনুশীলন শুরু করল। থালার ভেতরে নিজের রক্ত ফেলে প্রতিবার উচ্চারণ করল সেই অদ্ভুত শব্দমালা—শব্দগুলো যেন ধীরে ধীরে তার শ্বাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ঘরের বাতাস ঠান্ডা হয়ে এল, প্রদীপের আলো অনিয়মিতভাবে কাঁপতে লাগল, আর বাইরে হাওয়ার শব্দের সঙ্গে মিশে গেল এক অদ্ভুত, দূরের গুঞ্জন, যা মানুষের কণ্ঠস্বরের মতো হলেও স্পষ্ট বোঝা যায় না। তার মনে হল, ঋত্বিক কোথাও কাছে আছে—হয়তো মন্ত্রের ধ্বনির মধ্যে, হয়তো রক্তের গন্ধে। সতর্কবার্তা, ভয়, মৃত্যুর সম্ভাবনা—সব কিছু সে এই মুহূর্তে উপেক্ষা করল। তার কাছে একটাই সত্য—প্রতিশোধ। আর সে জানে, এখন থেকে আর ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই।

রাতটা ছিল নিস্তব্ধ, আকাশে চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ছিল, আর চারপাশে শুধু দূরের শেয়ালের ডাক আর হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ। ত্রিলোচন নাথের কুটিরের ভেতরে প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় অয়ন বসে আছে, সামনে রাখা লোহার থালা। ত্রিলোচনের কণ্ঠ গম্ভীর ও ধীর, “আজ প্রথম রক্ত দেবে তুমি। মনে রেখো, এই মন্ত্র শুরু হলেই তোমার জীবন আর আগের মতো থাকবে না।” অয়ন কোনো কথা বলল না; তার মনে প্রতিটি শব্দ যেন ঢুকে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে ঋত্বিকের রক্তাক্ত মুখও ভেসে উঠছিল—যা তাকে কোনো দ্বিধা রাখল না। বৃদ্ধ একটি ধারালো ছুরি এগিয়ে দিলেন, আর অয়ন ডান হাতের তর্জনীতে একটি গভীর কাটা দিল। ব্যথা তীব্র, কিন্তু সে মুখ বুজে সহ্য করল। লাল রক্তের ফোঁটা থালার ওপর পড়তেই যেন বাতাস ভারী হয়ে এল, আর প্রদীপের আলো হঠাৎ ঝাঁপসা হয়ে উঠল।

ত্রিলোচন মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, এক অদ্ভুত প্রাচীন ভাষা, যার প্রতিটি শব্দে যেন ধাতব শীতলতা লুকিয়ে আছে। অয়নও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উচ্চারণ করতে লাগল। প্রথমে শব্দগুলো জিভে অচেনা লাগছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে যেন সেগুলো নিজের হয়ে গেল। তখনই অয়নের চোখের সামনে এক অদ্ভুত দৃশ্য—থালার মধ্যে তার রক্ত ধোঁয়ার মতো উঠতে লাগল, কিন্তু সেই ধোঁয়া সাধারণ কুয়াশা নয়; তাতে গাঢ় লাল আভা মিশে আছে, আর সেটা ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে—মনে হচ্ছে এক ভয়াল হাত, যা বাতাসে ভেসে দূরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অয়ন চমকে দেখল, সেই কুয়াশা থালা ছেড়ে কুটিরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ত্রিলোচন থামলেন না; বরং তার কণ্ঠ আরও তীব্র হয়ে উঠল, যেন রক্তের কুয়াশাকে দূরের কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঠাচ্ছেন।

রাতের সেই সময়ে, অনেক দূরে কলকাতার শহরের এক অভিজাত ফ্ল্যাটে ড. অমরেশ গুহ ঘুমোচ্ছিলেন। প্রথমে হালকা অস্বস্তি, তারপর বুকের ভেতর অদ্ভুত ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। চোখ খুলতেই দেখলেন, সাদা বিছানার চাদরে ছোট ছোট লাল দাগ—মুখের কোণে রক্ত, নাকে হালকা রক্তক্ষরণ। কিন্তু এর কোনো যুক্তি নেই, কারণ তিনি তো একেবারে সুস্থ ছিলেন। কিছুক্ষণ পর শরীরের ভেতর ব্যথা বাড়তে লাগল, যেন অজানা কোনো রোগ ধীরে ধীরে রক্তনালী কেটে দিচ্ছে। তিনি পানি খেতে উঠলেন, কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন চোখের সাদা অংশে হালকা লাল রঙের ছোপ—যেন ভেতর থেকে ফেটে গেছে কোনো সূক্ষ্ম শিরা। আতঙ্কে ডাক্তারকে ফোন করার কথা ভাবলেন, কিন্তু শরীরে অদ্ভুত অবসাদ নেমে এল, আর তিনি ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে পড়ে রইলেন। বাইরে বৃষ্টি শুরু হল, জানালার কাচে টুপটাপ শব্দ যেন কোনো অজানা বিপদের সঙ্কেত দিচ্ছে।

ত্রিলোচনের কুটিরে তখন মন্ত্র শেষ হয়েছে। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ স্থির রইলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “মন্ত্র পৌঁছে গেছে।” অয়ন কপালে ঠান্ডা ঘাম টের পেল, বুকের ভেতর ধুকপুকানি অস্বাভাবিক রকম দ্রুত। সে জানত না, রক্ত কুয়াশায় রূপান্তরিত হয়ে কীভাবে অমরেশের কাছে পৌঁছল, কিন্তু সে অনুভব করছিল—কিছু একটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বাইরে বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল, ধূপের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকা লোহার মতো ধাতব গন্ধ। অয়ন ধীরে ধীরে নিজের আঙুলের ক্ষত চেপে ধরল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, সেই কাটা শুধু তার ত্বকে নয়, তার আত্মাতেও লেগেছে। প্রতিশোধের প্রথম ধাপ সফল হয়েছে, কিন্তু তার ভেতরে এক অজানা শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছিল—যেন অন্ধকার থেকে কেউ তাকিয়ে আছে, তার পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায়।

কলকাতার অভিজাত হাসপাতালের আইসিইউতে ড. অমরেশ গুহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সাদা চাদরে মোড়া তাঁর শরীর, চারপাশে নানা ধরনের মনিটরের তীক্ষ্ণ শব্দ, অক্সিজেন মাস্কে ঢেকে আছে মুখ। চোখ আধখোলা, কিন্তু তাতে কোনো সজাগতা নেই—মনে হচ্ছে জীবন ধীরে ধীরে তাঁর ভেতর থেকে সরে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা অবাক; রক্তক্ষরণ শরীরের ভেতর নানা জায়গায় ঘটছে, অথচ কোথা থেকে শুরু হচ্ছে বা কীভাবে থামানো যায়, তারা বুঝতে পারছে না। অয়ন দূর থেকে সংবাদ পেয়ে মনে মনে হাসল—প্রতিশোধ প্রায় সম্পূর্ণ। সে জানে, মন্ত্রের তীব্রতা যত বাড়বে, মৃত্যুর পথ তত কাছে আসবে। কিন্তু সেই আনন্দের মাঝেই একটা অদ্ভুত ক্লান্তি তার শরীর জুড়ে নেমে আসছে। সকালে আয়নায় তাকিয়ে সে লক্ষ্য করল ঠোঁট ফ্যাকাসে, চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট, আর হাত কাঁপছে হালকা। সে ভেবেছিল এটা হয়তো রাত জাগা বা মানসিক চাপের ফল, কিন্তু দুপুরে হঠাৎই নাকে রক্ত পড়া শুরু হল—যা থামাতে বেশ সময় লাগল।

সে আতঙ্কে বীরভূমে ফিরে এল, ত্রিলোচনের কুটিরে। বৃদ্ধ তখন দরজার সামনে বসে ধূমপান করছিলেন, চোখে সেই চেনা রহস্যময় হাসি। অয়ন নিজের অবস্থা বোঝানোর আগেই ত্রিলোচন বললেন, “প্রতিশোধের রক্ত, তোমার রক্তও চায়।” তাঁর কণ্ঠে কোনো সহানুভূতি নেই, শুধু অনিবার্যতার ঠান্ডা ঘোষণা। “তুমি ভেবেছিলে, রক্তমন্ত্র শুধু শত্রুর রক্ত নেবে? না… প্রতিটি ফোঁটা প্রতিশোধের জন্য, তোমার থেকেও সমান দাবি রাখে। প্রতিবার তুমি মন্ত্র ব্যবহার করলে, তোমার শরীর থেকেও রক্ত ঝরবে, ধীরে ধীরে… যতক্ষণ না তুমিও শুকিয়ে যাবে।” অয়ন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিশোধের আগুন এতদিন তার চোখ ঢেকে রেখেছিল, কিন্তু এখন সে প্রথমবার অনুভব করল—এই খেলায় সে নিজেকেও হারাতে বসেছে।

তবুও, অয়ন নিজের মনকে বোঝাল—এখন থামা অসম্ভব। অমরেশ প্রায় শেষ, কিন্তু পুরোপুরি নয়। তার প্রতিশোধ তখনই সম্পূর্ণ হবে যখন শত্রু শেষ নিঃশ্বাস ফেলবে। সেই রাতে অয়ন হোস্টেলে ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ঘুম এল না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, কোথাও থেকে মৃদু ফিসফিস শোনা যাচ্ছে—ঋত্বিকের কণ্ঠ, যেন বলছে, “শেষ করো… থামো না…”। একসময় বুকের ভেতর চাপ অনুভব করল, যেন কেউ ভেতর থেকে তার রক্ত টেনে নিচ্ছে। চমকে উঠে দেখল—তার নাক থেকে আবার রক্ত পড়ছে, আর বালিশে লাল দাগ ছড়িয়ে পড়েছে। সে দ্রুত নাক চেপে ধরল, কিন্তু মনের মধ্যে আতঙ্ক জমে গেল—ত্রিলোচনের সতর্কতা এবার সত্যি মনে হচ্ছে।

ভোরের আলো ফুটতেই সে আবার কুটিরে গিয়ে দাঁড়াল। ত্রিলোচন তখন চোখ বন্ধ করে ধ্যান করছিলেন। অয়ন কাঁপা গলায় বলল, “আমি কি এই মন্ত্র থামাতে পারি?” বৃদ্ধ ধীরে ধীরে চোখ খুলে বললেন, “থামাতে পারো না। মন্ত্রের পথ একবার খোল, আর সেটি বন্ধ হয় না যতক্ষণ না রক্তের হিসাব মিটে যায়। তোমার শত্রু মরবে, কিন্তু ততদিনে তোমার শরীরও তার প্রাপ্য দিয়ে দেবে। তুমি যা করেছ, তার থেকে পালানো যায় না।” তাঁর ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল—যেন অয়নকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সে নিজেই এই পথ বেছে নিয়েছিল। অয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, মনের মধ্যে ভয় ও জেদ একসঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিশোধ এখনও তার লক্ষ্য, কিন্তু এখন সে জানে—এর দাম হবে তার নিজের জীবন।

আকাশের ওপর কালো মেঘ জমে আছে, বাতাসে অদ্ভুত ভার। বীরভূমের সেই জঙ্গলের ভেতর ত্রিলোচনের কুটিরের সামনে বসে অয়ন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছে। শরীর প্রায় কঙ্কালসার, ঠোঁট ফেটে শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে গভীর গর্ত। তবু তার ভেতরের আগুন নিভে যায়নি—ড. অমরেশ এখনও পুরোপুরি মারা যায়নি। ত্রিলোচন নাথ প্রদীপ জ্বালিয়ে বসেছেন, তাঁর চোখে ঠান্ডা উজ্জ্বলতা, যেন তিনি অয়নের জীবন শেষ হওয়ার মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছেন। চারপাশের বাতাস এতটা নিস্তব্ধ যে দূরের শিয়ালের ডাকও কানে তীক্ষ্ণ লাগে। এই রাতেই মন্ত্রের শেষ ধাপ, যা অভিশাপ সম্পূর্ণ করবে, কিন্তু ত্রিলোচনের কণ্ঠে আগে থেকেই সতর্কতা—শেষ ধাপে নিজের রক্তই শত্রুর প্রাণের বিনিময় হয়ে যাবে।

অনিমা ছুটে এল কুটিরে, চুল এলোমেলো, চোখ লাল। সে অয়নের সামনে দাঁড়িয়ে, কাঁপা গলায় বলল, “থামো অয়ন… তোমার আর কিছু বাকি নেই। প্রতিশোধ পেয়েও যদি তুমি বাঁচো না, তবে এর মানে কী? এই শেষ ধাপে গেলে তুমি ফিরবে না।” তার চোখে জল, কণ্ঠে মরিয়া আবেদন। “তুমি জানো না, দাদু তোমাকে বাঁচতে দেবে না। রক্তমন্ত্র একবার পূর্ণ হলে তা প্রতিশোধের সঙ্গে সঙ্গেই ধারককেও গ্রাস করে।” অয়ন অনিমার দিকে তাকাল, ঠোঁটে ম্লান হাসি। “ঋত্বিকের জন্য আমি বেঁচে থাকি না, অনিমা। তার মৃত্যু আমার জীবন নিয়ে গেছে সেদিনই। আজ শুধু শেষ কাজটা বাকি।” তার কণ্ঠে ক্লান্তি থাকলেও দৃঢ়তা ভাঙেনি। অনিমা আর কিছু বলতে পারল না; শুধু ধীরে ধীরে পিছিয়ে দাঁড়াল, চোখের জল মুছে নিল, কারণ সে জানত—এই মানুষটিকে আর থামানো যাবে না।

ত্রিলোচন নাথ রক্তমাখা ছুরি এগিয়ে দিলেন। “তুমি প্রস্তুত?” অয়ন মাথা নাড়ল। এবার কাটা আগের থেকে গভীর—বাম হাতের কব্জিতে। রক্ত থালা ভরিয়ে দিল দ্রুত, আর ত্রিলোচনের মন্ত্রপাঠ শুরু হল। শব্দগুলো আগের থেকে অনেক বেশি তীব্র, বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠছে, কুটিরের দেয়ালে ঝোলানো শুকনো হাড়গুলো কেঁপে উঠছে হালকা শব্দে। অয়ন কাঁপতে কাঁপতে মন্ত্রের প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করছে, তার শ্বাসপ্রশ্বাস অনিয়মিত হয়ে উঠেছে। রক্ত ধোঁয়ার মতো উঠছে, এবার আকার নিচ্ছে একটি বিশাল ছায়ামূর্তির—যেন কোনো অদৃশ্য দানব দূরে এগিয়ে যাচ্ছে। অয়ন চোখ বন্ধ করতেই তার মনে অমরেশের মুখ ভেসে উঠল, তারপর সেই মুখ ধীরে ধীরে রক্তে ডুবে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাইরে বজ্রপাত হল, আর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল হঠাৎ, যেন আকাশও এই মন্ত্রের ভার সইতে পারছে না।

শেষ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অয়নের শরীর ঢলে পড়ল মাটিতে। তার শ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল, চোখের আলো ম্লান হয়ে গেল। দূরে, কলকাতার হাসপাতালে, ড. অমরেশ শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন—মনিটরের সমান সুরে একটি দীর্ঘ স্থির শব্দ। ত্রিলোচন নাথের ঠোঁটে সন্তুষ্টির হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু অনিমা ছুটে এসে অয়নের মাথা কোলে তুলে নিল। “অয়ন… জেগে ওঠো… তুমি পেরেছ… এখন ফিরো…” কিন্তু সে জানত, আর ফেরার পথ নেই। রক্তমন্ত্র তার প্রতিশোধ পূর্ণ করেছে, আর বিনিময়ে তার জীবন নিয়েছে। বাইরে বৃষ্টির শব্দে রাত ভিজে যাচ্ছিল, আর কুটিরের ভেতর এক অদৃশ্য শূন্যতা ভর করে ছিল—যেন কারও রক্ত দিয়ে লেখা কাহিনির শেষ অধ্যায় নীরবে শেষ হয়ে গেল।

১০

হাসপাতালের মনিটরের সুর হঠাৎ দীর্ঘ ও স্থির হয়ে গেল—একটানা “বীইইইপ…”। ড. অমরেশের চোখ আধখোলা অবস্থায় স্থির হয়ে গেল, বুকের ওঠানামা থেমে গেল একেবারে। ডাক্তাররা হন্তদন্ত হয়ে চারপাশে ছুটে বেড়ালেও তারা জানত, আর কিছু করার নেই। মৃত্যুর সেই মুহূর্ত যেন সমগ্র পরিবেশকে স্থবির করে দিল। ঠিক সেই সময়, বীরভূমের ত্রিলোচনের কুটিরে অয়নের শরীর মাটিতে পড়ে আছে, সাদা ধুতি রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে তার শিরা-উপশিরা থেকে শেষ বিন্দু রক্তও ঝরে পড়ছে মাটিতে। আশ্চর্যের বিষয়, যন্ত্রণার বদলে তার মুখে ফুটে আছে শান্তির এক ম্লান হাসি—যেন সমস্ত বোঝা শেষে মুছে গেছে, প্রতিশোধের আগুন শীতল হয়ে এসেছে। চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এলো, আর শরীর নিথর হয়ে গেল চিরতরে। বাইরে হঠাৎ থেমে গেল বৃষ্টি, বাতাসে এক ধরনের ঠান্ডা শূন্যতা নেমে এলো, যেন প্রকৃতি নিজেও এই বিনিময়টিকে নীরবে মেনে নিচ্ছে।

ত্রিলোচন কুটিরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে ধূপের ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে, চোখে সেই পুরনো শীতল উজ্জ্বলতা। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি খেলে গেল। খুব আস্তে, যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন, তিনি ফিসফিস করে বললেন—“রক্তমন্ত্রের শক্তি আরেকবার প্রমাণিত হল…”। তাঁর কণ্ঠে গর্ব আর অনিবার্যতার সুর মিশে আছে। অয়ন ছিল শুধু একটি মাধ্যম—এই মন্ত্রের প্রাচীন তৃষ্ণা মেটানোর জন্য। প্রতিটি প্রতিশোধই এক নতুন বলি দাবি করে, আর প্রতিবারই সেই দাবি পূরণ হয়েছে। ত্রিলোচনের চোখ আকাশের দিকে উঠল, যেন তিনি জানেন এই খেলা এখানেই শেষ নয়। কুটিরের ভেতরে রক্তের গন্ধ এখনও তীব্র, আর সেই গন্ধ যেন গোপনে আহ্বান জানাচ্ছে পরবর্তী ধারককে।

অনিমা মাটিতে বসে অয়নের নিথর দেহের পাশে, চোখ ভিজে গেছে অশ্রুতে। তবু তার দৃষ্টি শূন্য নয়—বরং ভেতরে কোথাও এক নতুন সংকল্প জেগে উঠছে। ধীরে ধীরে সে গিয়ে কুটিরের কোণের ছোট কাঠের তাক খুলল। সেখানে রাখা ছিল লাল কাপড়ে মোড়া একটি ছোট কৌটো। কাপড় খুলতেই দেখা গেল ভেতরে জমাট বাঁধা গাঢ় লাল রক্ত—অয়ন জীবিত থাকাকালীন প্রথম মন্ত্রের পর যে রক্ত উৎসর্গ করেছিল, সেটি ত্রিলোচন সংরক্ষণ করে রেখেছিল। অনিমা জানে এই রক্ত শুধু এক মৃত মানুষের নয়; এর মধ্যে রয়েছে সেই অদৃশ্য শক্তি, যা মন্ত্রকে জীবন্ত রাখে। তার হাত কেঁপে উঠল, কিন্তু কৌটোটি শক্ত করে ধরে রাখল বুকের কাছে। সে বুঝতে পারছে, এই মুহূর্তে সে নিজের ভাগ্যের পথ বেছে নিচ্ছে—হয় এই শক্তিকে চিরতরে মাটি চাপা দেবে, নয়তো কোনোদিন এর সাহায্যে নিজের কোনো প্রতিশোধ নেবে।

শেষ দৃশ্যে, রাতের আঁধারে অনিমা কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে। দূরে অন্ধকারে ত্রিলোচনের ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে, আর বাতাসে ধূপের গন্ধ মিশে রয়েছে রক্তের ধাতব গন্ধের সঙ্গে। অনিমা ধীরে ধীরে কৌটোটি লাল কাপড়ে জড়িয়ে নিজের ঝোলায় রাখল। তার মুখে দ্বিধা, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক—যেন কোনো গভীর সিদ্ধান্তের প্রথম ইঙ্গিত। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করল, আর দূরে বজ্রের আলো এক মুহূর্তের জন্য তার মুখ উজ্জ্বল করে তুলল। দর্শকের মনে প্রশ্ন রেখে শেষ হয় দৃশ্য—এটা কি কোনো অভিশাপের শেষ, নাকি নতুন কোনো রক্তমন্ত্রের সূচনা?

-সমাপ্ত-

1000052839.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *