Bangla - ভূতের গল্প

রক্তবর্ণ শাড়ি

Spread the love

কলকাতার উত্তর শহরের ভেতর একসময়ের জমজমাট থিয়েটার আজ ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকের দেওয়ালে স্যাঁতস্যাঁতে দাগ, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়েছে, অডিটোরিয়ামের আসনগুলোতে ধুলো জমে পাহাড়ের মতো স্তূপ তৈরি হয়েছে, অথচ সব্যসাচী সেনের চোখে যেন অন্য এক স্বপ্ন ভেসে উঠেছিল। সে অনেকদিন ধরে ভেবেছিল তার নতুন নাটক কোথায় মঞ্চস্থ করবে—এমন জায়গা চাই যেখানে কেবল আলো-শব্দের খেলা নয়, জায়গাটাই যেন নাটককে জীবন্ত করে তুলতে পারে। যখন প্রথম এই ভাঙাচোরা থিয়েটারের ভেতর পা রাখল, তখনই অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতল স্রোত তার শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে, অথচ সেই শীতলতার ভেতরেই যেন জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের কৌতূহল। কুহু মুখার্জী, নাটকের নায়িকা, প্রথম দিনেই বলেছিল—“সব্যসাচীদা, এখানে কি সত্যিই আমরা নাটক করব? এই জায়গাটা তো একেবারে ভুতুড়ে!” কিন্তু তার কণ্ঠের মধ্যে যত ভয়ই থাকুক, চোখে ছিল অনাবিল উচ্ছ্বাস, কারণ নতুন নাটক মানেই নতুন চরিত্র, নতুন চ্যালেঞ্জ। রতন দত্ত, থিয়েটারের পুরনো আলো-শব্দ প্রযুক্তিবিদ, মেঝে মুছে, আলো জ্বালিয়ে, সাউন্ড চেক করে তৈরি করছিল মঞ্চ। বয়স বাড়লেও তার অভিজ্ঞ হাত এখনো নিখুঁতভাবে বোতাম ঘোরায়। আর একপাশে বসে ছিলেন শিবাজী চক্রবর্তী—প্রবীণ অভিনেতা, যিনি আজও নাটকের প্রতি একইরকম অনুরাগী। তার কণ্ঠে বয়সের ভার এলেও দৃষ্টি ছিল আগের মতোই তীক্ষ্ণ। চারজন মিলে প্রথম দিনের রিহার্সালের জন্য প্রস্তুত হলো। মঞ্চে আলো পড়তেই অডিটোরিয়ামের ফাঁকা আসনগুলো যেন অদৃশ্য দর্শকের ভিড়ে ভরে উঠল, আর তাদের নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকার চাপাটাই সবার বুকের ভেতর অজানা স্রোত জাগিয়ে তুলল।

রিহার্সাল শুরু হতেই কুহু তার সংলাপগুলো বলে উঠল, কিন্তু তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল মঞ্চের বাঁদিকের কোণায়। সেখানকার আলো অন্যরকম লাগছিল—ম্লান, ধোঁয়াটে, যেন কোনো পর্দার ফাঁক দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। সব্যসাচী প্রথমে বিষয়টিকে আমল দিল না, ভাবল হয়তো নতুন জায়গার আবহে সবাই একটু নার্ভাস। সে বলল—“কুহু, মন দাও সংলাপে, ভয় পেলে তো চলবে না। নাটক মানে সাহস।” কিন্তু রতনের মুখ তখন অস্বাভাবিক গম্ভীর। আলো-শব্দের দায়িত্বে থাকা মানুষটি এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে থিয়েটারের নানা খুঁটিনাটি, তবুও সেই মুহূর্তে তার মনে হলো যেন পরিচিত জায়গাটাই অচেনা হয়ে গেছে। হঠাৎ শিবাজী বললেন—“তোমরা লক্ষ্য করেছ? আলোটা যেমন হওয়া উচিত, তেমন হচ্ছে না। স্পটলাইট বারবার সরে যাচ্ছে।” রতন যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করল, কিন্তু কোনো গলদ পেল না। কুহু আবার সংলাপ বলার সময় থমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল—“ওখানে কে?!” সবাই একসঙ্গে তাকাল মঞ্চের বাঁদিকের দিকে, কিন্তু সেখানে কেবল ধুলোমাখা পর্দা আর অন্ধকার। কুহু কাঁপা গলায় বলল—“আমি স্পষ্ট দেখেছি, লাল শাড়ি পরা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টে তাকাচ্ছিল।” চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে এল, যেন অডিটোরিয়ামের ভেতর হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেছে। সেই নীরবতা শুধু ভাঙছিল ছাদের ফাঁক দিয়ে পড়তে থাকা পানির টুপটাপ শব্দ। সব্যসাচী ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও জোর করে হাসল—“হয়তো আলো-ছায়ার খেলা, ভয়ের কিছু নেই। নাটক চালিয়ে যাই।” কিন্তু তারও মনে হচ্ছিল ঠান্ডা একটা বাতাস মঞ্চজুড়ে বইছে, যা এই থিয়েটারের ভাঙাচোরা গায়ে অদ্ভুত শিহরণ তুলছে।

রিহার্সাল শেষ হওয়ার পর সবাই যখন মঞ্চ ছাড়ছিল, তখন কুহুর মন থেকে সেই দৃশ্য কিছুতেই মুছছিল না। সে দৃঢ়ভাবে বলল—“না, আমি কসম খেয়ে বলছি, আমি ওকে দেখেছি। লাল বেনারসি শাড়ি, খোঁপায় ফুল গোঁজা, চোখ যেন অদ্ভুত শূন্যতায় ভরা।” শিবাজী চুপ করে ছিলেন, কিন্তু তার মুখের ভাঁজে চিন্তার রেখা গভীর হচ্ছিল। বহু বছর আগে এই থিয়েটারের ইতিহাস তার অল্প অল্প মনে আছে, সেই সময়কার কিছু নাম, কিছু মুখ এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রতন নীরব থেকে যন্ত্রপাতি গুটিয়ে নিলেও ভেতরে ভেতরে তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছিল। সব্যসাচী দৃঢ় কণ্ঠে বলল—“আমরা যদি ভয় পেয়ে যাই, তাহলে এ নাটক জন্ম নেবে না। এই মঞ্চে আমরাই নতুন ইতিহাস গড়ব।” যদিও কথায় দৃঢ়তা ছিল, তবু তার চোখ একবার আবার মঞ্চের বাঁদিকের অন্ধকারে চলে গেল। পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো-ছায়ার খেলা যেন এক অচেনা শরীরের আভাস দিচ্ছিল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে এলে মনে হচ্ছিল মঞ্চের কোণায় দাঁড়িয়ে কেউ এখনো তাকিয়ে আছে, আর সেই দৃষ্টি এত গভীর যে তাকে অজান্তেই কাঁপিয়ে তুলছে। বাইরে তখন কলকাতার রাস্তায় অটো, ট্রামের শব্দ ভেসে আসছিল, অথচ থিয়েটারের ভেতরটা যেন অন্য এক জগৎ—অতীত আর বর্তমানের মাঝামাঝি ঝুলে থাকা এক রহস্যময় আবহ, যেখানে প্রথমবারের মতো রক্তবর্ণ শাড়ির ছায়া নেমে এলো।

সন্ধ্যার আভা মিলিয়ে আসছিল, আর পুরোনো নাট্যমঞ্চের ভেতর এক ধরনের গা ছমছমে অন্ধকার নেমে আসছিল, যেটা আসলে অভিনয়ের জন্য ব্যবহার করা আলোর যন্ত্রগুলোকেই আরও রহস্যময় করে তুলছিল। রিহার্সাল চলছিল জোরকদমে—মঞ্চের মাঝখানে কুহু সংলাপ দিচ্ছিল, তার চোখে মুখে চরিত্রের আবেগ ফুটে উঠছিল। কিন্তু হঠাৎই সংলাপের মাঝখানে তার দৃষ্টি জমে গেল মঞ্চের এক কোণে। সবাই ভেবেছিল হয়তো সংলাপ ভুলে গেছে, কিন্তু কুহুর মুখে যে আতঙ্ক ফুটে উঠল, তা কারও অজানা রইল না। কুহু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল, তারপর ফিসফিস করে বলল—“ওই দেখো… লাল শাড়ি পরা একজন দাঁড়িয়ে আছে।” বাকিদের মনে হলো হয়তো নাটকের প্রপস বা আলো-ছায়ার খেলা, কিন্তু কুহুর কণ্ঠে এতটা সত্যতা ছিল যে শীতল স্রোত বয়ে গেল সবার শরীর দিয়ে। রতন, যে পরিচালক হিসেবে সবসময় দৃঢ় ও যুক্তিনির্ভর থাকতে চাইত, প্রথমে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল—“এগুলো আলোর খেলা, কুহু, মনোযোগ ভেঙে যেও না।” কিন্তু তার চোখেমুখে টের পাওয়া যাচ্ছিল যে সেও ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠেছে। কুহুর দৃষ্টি যেদিকে স্থির হয়ে ছিল, সেদিকটায় তাকালে সত্যিই মনে হচ্ছিল আলো-অন্ধকারের মধ্যে একটা লাল রঙের ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, তার ভঙ্গিমা যেন এক অদ্ভুত অস্বস্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো হলঘরে। এই সময়ে সব্যসাচী, যে সবসময় যুক্তির মাধ্যমে রহস্যের সমাধান খুঁজতে চায়, একটু এগিয়ে গিয়ে আলো বাড়িয়ে দিল। আলো পড়তেই মূর্তিটা মিলিয়ে গেল, কিন্তু মঞ্চের পেছনের দেয়ালে এক ধরনের ভেজা দাগ আর ধুলোতে মাখামাখি লালচে ছাপ রয়ে গেল, যেন কেউ সত্যিই ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল।

পুরো হলঘরটা তখন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু উপরের পুরোনো ফ্যানের ঘুরে চলার শব্দ কানে আসছিল। কুহু এখনও স্থির দাঁড়িয়ে কাঁপছিল, তার ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল আর চোখে ছিল আতঙ্কের ছায়া। রতন এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল—“আমাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, এগুলো সব কাকতালীয় ঘটনা। এই হল অনেক পুরোনো, ভেজা দেয়ালে আলো পড়লে এরকম অদ্ভুত ছায়া দেখা যেতেই পারে।” কিন্তু তার গলার দৃঢ়তায় খানিকটা কাঁপন ছিল, যা তার নিজের ভয়ের প্রমাণ দিচ্ছিল। দলের বাকিরা চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন কারও সাহস হচ্ছিল না মুখ খোলার। ঠিক তখনই মঞ্চের ডানদিক থেকে একটা তীব্র ঠক করে শব্দ হলো, যেন কোনো ভারী জিনিস হঠাৎ মেঝেতে পড়ে গেল। সবাই চমকে উঠল, রতন দ্রুত ছুটে গিয়ে দেখল সেখানে কেবল একটা পুরোনো চেয়ার উলটে আছে। তবুও, ওর চোখেমুখে চাপা ভয়ের ছাপ আর গোপন অস্বস্তি লুকানো গেল না। সব্যসাচী এবার একটু ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করল। সে বলল—“দেখো, আলোর খেলা হতেই পারে, কিন্তু আজকে যেটা দেখলাম সেটা সাধারণ ছায়ার মতো লাগেনি। আমার মনে হয় আমাদের খোঁজ নিতে হবে, এই নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে হয়তো কিছু আছে যা আমরা জানি না।” বাকিরা তার কথায় সম্মতি দিলেও ভয় আর সন্দেহ মনের ভেতরে জায়গা করে নিল। কুহু আর একবারও ওই জায়গার দিকে তাকাতে চাইছিল না, তার মনে হচ্ছিল সেই লাল শাড়ি পরা নারী এখনও কোথাও অন্ধকারে লুকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

রিহার্সাল অনেকটা থমথমে পরিবেশে চলল, কেউ স্বাভাবিকভাবে সংলাপ দিচ্ছিল না, বারবার মনে হচ্ছিল চারপাশে কারও উপস্থিতি আছে। কুহু চেষ্টা করছিল অভিনয়ে মনোযোগ দিতে, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল তার পেছনেই সেই নারী দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে রহস্যময় শীতলতা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রতন ভেতরে ভেতরে ভয়ের সঙ্গে লড়াই করছিল, সে জানত যদি দল ভয় পেয়ে যায় তবে নাটক আর এগোবে না, অথচ নিজেই বুঝতে পারছিল অজানা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করছে। সব্যসাচী একা একা হলঘরের কোণাগুলো লক্ষ্য করছিল, সে খেয়াল করল বাতাস অকারণে ভারী হয়ে উঠছে, আর মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যেন দূর থেকে করুণ সুরে কেউ গান গাইছে। কিন্তু সবাইকে আশ্বস্ত করতে সে কিছু বলেনি। রাত গভীর হলে রিহার্সাল বন্ধ করে সবাই বেরিয়ে গেল, কিন্তু প্রত্যেকের মনে একটাই প্রশ্ন রয়ে গেল—কে সেই লাল শাড়ির নারী? আলো-ছায়ার খেলা, নাকি এই পুরোনো নাট্যমঞ্চের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোনো অজানা ইতিহাসের ভয়ঙ্কর আবির্ভাব? বিশেষ করে কুহুর মনে সেই দৃশ্যটা স্থায়ী হয়ে গেল, তার অভিনয়ের চরিত্রের আবেগের সঙ্গে যেন মিশে গেল আতঙ্কের ছাপ। আর রতন নিজেকে যতই শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন, তার মনে বারবার একটা অনুভূতি হচ্ছিল—এই নাটক হয়তো কেবল নাটক নয়, এর মধ্যে কিছু ভৌতিক, কিছু অমোঘ উপস্থিতি ঢুকে পড়েছে, যা তাদের রিহার্সাল আর জীবনের মাঝখানে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠবে।

ঐন্দ্রিলা বসু যখন থেকে থিয়েটার হলের ভেতরে সেই অদ্ভুত অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই তাঁর ভেতরে এক অদম্য কৌতূহল জন্মেছে। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি অনুভব করছিলেন—এই স্থাপত্যের প্রতিটি ইটের মধ্যে যেন জমে আছে কোনো অপ্রকাশিত কাহিনি, কোনো অমীমাংসিত বেদনা। তাই এক দুপুরে তিনি কলকাতার পুরনো গ্রন্থাগারে গিয়ে বসলেন, টেবিলে ছড়িয়ে দিলেন ধুলো জমা ফাইল আর হলদেটে হয়ে যাওয়া কাগজের স্তূপ। সেসব কাগজের গন্ধে ছিল একরাশ ইতিহাস, সঙ্গে অজানা রহস্যের চাপা ফিসফিসানি। বহু খোঁজাখুঁজির পর তাঁর চোখ পড়ল একটি সংবাদপত্রের পাতায়—যার শিরোনাম পড়তে গিয়েই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। লেখা ছিল—“মঞ্চেই হত্যা প্রতিভাবান অভিনেত্রী নন্দিতা রায়।” তিনি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, কিন্তু যত পড়ছিলেন, ততই কাহিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরছিল। সেখানে লেখা ছিল কিভাবে পঞ্চাশ বছর আগে, এক আলো ঝলমলে প্রযোজনার রাতে, দর্শকের সামনে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করতে করতে নন্দিতা হঠাৎই মঞ্চে লুটিয়ে পড়েন, আর পরে জানা যায় তাঁর শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছিল বিষ। সংবাদপত্রের ছবি দেখিয়ে দিচ্ছিল—নন্দিতা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, লালপাড় সাদা শাড়ি বা রক্তবর্ণ শাড়ি ছিল তাঁর প্রিয় পোশাক। ঐন্দ্রিলার মনে তখনই প্রশ্ন জাগল—যে রক্তবর্ণ শাড়ি-পরা আত্মাকে তিনি বারবার দেখতে পাচ্ছেন, সেই কি নন্দিতা? নাকি অন্য কেউ?

ঐন্দ্রিলা সংবাদপত্রের পাতায় মুখ গুঁজে বসে রইলেন, পড়তে লাগলেন সাক্ষাৎকার, পর্যালোচনা আর নন্দিতার শেষ শো নিয়ে লেখালিখি। চোখে পড়ল কিভাবে দর্শকরা ভেবেছিল এটি হয়তো নাটকের অংশ, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই হল জুড়ে চিৎকার পড়ে যায়। কিছুজনের সাক্ষ্যে পাওয়া গেল নন্দিতা নাকি মৃত্যুর আগে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে কারও নাম উচ্চারণ করেছিলেন—যেটা আজও স্পষ্ট নয়। আরও বিস্ময়কর লাগল যখন তিনি জানলেন যে নন্দিতার মৃত্যু রহস্য আজও অমীমাংসিত, পুলিশ কেস ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক চাপের কারণে। পত্রিকার এক কোণে লেখা ছিল, নন্দিতা রায়ের মৃত্যুর পর থেকে সেই থিয়েটার আর আগের মতো চলেনি, ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে, আর একসময় বন্ধ হয়ে যায়। ঐন্দ্রিলার মনে হল যেন অদৃশ্য সুতোর টানে সবকিছু মিলে যাচ্ছে—যে অশরীরীর ছায়া থিয়েটারের অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়, তার সঙ্গে এই মৃত্যুর যোগ নেই কি? তিনি জানেন, হয়তো সবাই এই কাহিনি ভুলে গিয়েছে, কিন্তু এই থিয়েটারের ভেতরে মৃত্যুটা এখনও বেঁচে আছে। সংবাদপত্রের পাতাগুলি বন্ধ করার পর ঐন্দ্রিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তাঁর বুকের ভেতর গড়গড় শব্দে ঘুরে বেড়াতে লাগল শত প্রশ্ন। কে নন্দিতাকে হত্যা করেছিল? কেন এত বছর পরও তাঁর আত্মা শান্তি পায়নি? আর কেনই বা তিনি ঐন্দ্রিলাকে বেছে নিলেন?

ঐন্দ্রিলা জানতেন, তিনি যেটা আবিষ্কার করলেন, সেটা শুধু এক ঐতিহাসিক তথ্য নয়, বরং এক অমোঘ সূত্র। এই সূত্র তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে অন্ধকার এক জটিল রহস্যের গভীরে। গ্রন্থাগার ছেড়ে বেরোবার সময় তাঁর মনে হচ্ছিল, শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটছেন বটে, কিন্তু চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছে পঞ্চাশ বছর আগেকার সেই মঞ্চ, আলোয় আলোকিত এক মুখ, আর মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর ছায়ায় গ্রাস হওয়া এক জীবন। তাঁর মনে হল, হয়তো নন্দিতা তাঁকে ডাকছে—“আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে, আমার কাহিনি থেমে গেছে, তুমি কি আমাকে মুক্তি দিতে পারবে?” ঐন্দ্রিলার শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল, কিন্তু কৌতূহল আর দায়িত্ববোধ তাঁকে ভয় জয় করতে বাধ্য করল। তিনি জানলেন, এখান থেকেই তাঁর অনুসন্ধান শুরু। সামনে আসছে বিপদ, সামনে আসছে অব্যক্ত আতঙ্ক, কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। তিনি ঠিক করলেন—আগামী দিনগুলোতে তিনি নন্দিতার পুরনো সহকর্মী, পরিবার বা প্রতিবেশীদের খুঁজে বের করবেন, যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করবেন। এই মুহূর্তে তিনি শুধু অনুভব করলেন, ইতিহাসের চাপা অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে তিনি এক ভয়ংকর দরজা খোলার পথে পা বাড়িয়েছেন, আর সেই দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিতা রায়ের রক্তবর্ণ শাড়ি-পরা আত্মা, যে এখনও প্রতীক্ষায়।

রিহার্সালের দিনগুলি যেন এক অদৃশ্য আতঙ্কের মধ্যে কাটতে শুরু করল। প্রথমে ছোট ছোট ঘটনাগুলো সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, যেমন হঠাৎ করে আলো নিভে যাওয়া বা মঞ্চের কোণে রাখা চেয়ারটা শব্দ করে কেঁপে ওঠা। সব্যসাচী বারবার বলত, এগুলো বিদ্যুতের ত্রুটি কিংবা কারিগরি সমস্যা, ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু কুহু ক্রমশ দেখছিল, ঘটনাগুলো একটার পর একটা ঘটছে এবং প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে। একদিন, যখন সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সংলাপ প্র্যাকটিস করছিল, তখন স্পষ্ট দেখতে পেল আয়নায় আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে, যে দেখতে অনেকটা তার মতো হলেও চোখদুটো শূন্য আর ঠোঁটে অস্বস্তিকর হাসি। কুহু হঠাৎ চমকে উঠতেই প্রতিচ্ছবিটা মিলিয়ে গেল, যেন কিছুই ঘটেনি। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, হাত কাঁপছিল, কিন্তু বাকিদের বললে তারা এটাকে কুহুর ভয় বা কল্পনা বলে এড়িয়ে গেল। তবুও কুহুর মনে হচ্ছিল, নাটকের সঙ্গে সঙ্গে কোনো অদৃশ্য শক্তিও তাদের সঙ্গে খেলছে, আর সেই খেলা মোটেই নিরীহ নয়।

এদিকে প্রতিদিনের রিহার্সাল যত এগোচ্ছিল, ভয়ও যেন তত বেড়ে চলেছিল। আলো হঠাৎ নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠত, আর ঠিক সেই মুহূর্তে মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা অভিনেতারা অকারণ ঝড়ো হাওয়ার মতো কিছু অনুভব করত। মঞ্চের পেছন থেকে শোনা যেত ফিসফিসানি, কখনও অচেনা কান্নার শব্দ, আবার কখনও পায়ের শব্দ—যেন কেউ দৌড়ে পালাচ্ছে। সব্যসাচী অবশ্য এসবকে গুরুত্ব দিত না, সে বারবার সবাইকে বলত যে বড় নাটক করতে গেলে নানা রকম সমস্যাই হয়, ভয়কে প্রশ্রয় দিলে মঞ্চের শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। তার দৃঢ় কণ্ঠস্বর অন্যদের সাহস দিত, কিন্তু কুহুর ভেতরে অস্বস্তি বাড়তেই থাকল। একদিন রিহার্সালের মাঝেই কুহু হঠাৎ লক্ষ্য করল, তার সংলাপের কাগজের ওপরে অজানা কারও হাতের লেখা ভেসে উঠেছে—“শেষ পরিণতি রক্তে লেখা।” সে কাঁপা হাতে কাগজটা লুকিয়ে ফেলল, কারণ সে জানত, এটা দেখলে অন্যরা তাকে পাগল বলবে। সেই রাতেই কুহু স্বপ্ন দেখল, পুরো মঞ্চ আগুনে জ্বলছে আর মুখোশ পরা কেউ একজন তাকে ডেকে বলছে—“তুমি থামো, নইলে সব শেষ।” স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে তার গায়ে ঠান্ডা ঘাম, আর ভোরে যখন সে মঞ্চে এল, তখনও বুক কাঁপছিল।

সবচেয়ে ভয়ের মুহূর্ত এল তখন, যখন তারা নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য প্র্যাকটিস করছিল—একটি মৃত্যু দৃশ্য। কুহু মঞ্চে পড়ে থাকার কথা, আর সব্যসাচী তার সংলাপ দেবে। কিন্তু হঠাৎই আলো নিভে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল, আর সেই অন্ধকারে সবাই শুনল এক অচেনা করুণ চিৎকার, যা কারও কণ্ঠ নয়, যেন মঞ্চ নিজেই চিৎকার করছে। আলো ফিরে এলে দেখা গেল, কুহু সত্যিই মাটিতে পড়ে আছে, তার মুখ ফ্যাকাশে আর চোখে আতঙ্ক। অন্যরা তাকে তুলে বসালে সে কেঁপে কেঁপে বলল, কেউ তার গলায় হাত রেখেছিল, সে শ্বাস নিতে পারছিল না। কিন্তু চারপাশে কেউ ছিল না। এই ঘটনার পর সবাই অস্থির হয়ে গেলেও, সব্যসাচী আবারও দৃঢ়ভাবে বলল, “নাটক বন্ধ হবে না। ভয়ের কাছে আমরা হার মানতে পারি না।” কুহু অসহায় চোখে তার দিকে তাকাল, কারণ তার অন্তরে যে আতঙ্কটা বেঁধে বসেছে, তা আর শুধুই কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সে অনুভব করছিল, নাটকের রিহার্সাল ধীরে ধীরে আর শুধু অভিনয় নয়—এ যেন মৃত্যুর সঙ্গে এক অদৃশ্য রিহার্সাল, যেখানে শেষ দৃশ্য কারও হাতে লেখা হয়ে গেছে আগেই।

শিবাজী বসেছিলেন মঞ্চের পুরোনো কাঠের চেয়ারটিতে, তার চোখে যেন হাজারো বছর জমে থাকা স্মৃতির ধুলো, কণ্ঠস্বরেও অদ্ভুত এক ভার। সবাই যখন নন্দিতার হঠাৎ মৃত্যু নিয়ে জল্পনা করছে, তখন এই প্রবীণ অভিনেতা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন, “তোমরা যারা এখনকার প্রজন্ম, হয়তো বুঝবে না, কিন্তু নন্দিতা শুধু একজন অভিনেত্রী ছিল না, সে ছিল নাট্যমঞ্চের এক বিস্ময়, এক আবেশ।” তার কথাগুলো যেন বাতাসে ধীরে ধীরে ভেসে বেড়াতে লাগল, এবং প্রতিটি শব্দে অডিটোরিয়ামের নিস্তব্ধতা আরও ঘনীভূত হলো। তিনি জানালেন, নন্দিতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল প্রায় তিন দশক আগে, যখন তারা একই নাট্যদলে অভিনয় করতেন। তখন দলটির ভেতর ছিল প্রবল প্রতিযোগিতা, প্রত্যেক অভিনেতা চাইত নিজের স্থান, নিজের নাম, আর তার মধ্যেই নন্দিতার আবির্ভাব হয়েছিল ঝলমলে এক তারকার মতো। শিবাজীর চোখে এক মুহূর্তের জন্য আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠল, কিন্তু সাথে সাথেই সেটি মিলিয়ে গিয়ে জায়গা নিল গভীর হতাশা। তিনি বললেন, “নন্দিতা ছিল দারুণ প্রতিভাবান, কিন্তু সেই প্রতিভা যতই আলো ছড়াত, ততই অন্ধকার হয়ে উঠত আশেপাশের অনেকের মন। সে সময়ে প্রেম, ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র—সবকিছু মিশে গিয়েছিল আমাদের দলে। আমি নিজে দেখেছি কিভাবে কয়েকজন অভিনেতা ও পরিচালক একসাথে তার পিছনে লাগত, কখনও তার অভিনয়ের কৃতিত্ব খাটো করার চেষ্টা করত, কখনও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তাকে হেয় করার চেষ্টা করত। তবু নন্দিতা ছিল অদম্য, তার হাসির আড়ালে হয়তো যন্ত্রণার ঝড় বইত, কিন্তু মঞ্চে উঠলেই সে হয়ে উঠত অপ্রতিরোধ্য।”

তিনি থামলেন কিছুক্ষণ, যেন ভেতরে জমে থাকা কথাগুলো ঠিকঠাকভাবে সাজাতে চাইছেন। বাইরের হাওয়া জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে অডিটোরিয়ামের বাতাস নড়াচড়া করছিল, আর শিবাজীর কণ্ঠস্বর আরও ভারী হয়ে উঠছিল। তিনি বললেন, “তোমরা ভাবছ, নন্দিতার মৃত্যুটা হঠাৎ, নিছক একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এটা শুধুই দুর্ঘটনা নয়। কারণ নন্দিতাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র বহুদিন ধরেই চলছিল। আমি এখনো মনে করতে পারি, একবার ‘রাজপথের আলো’ নাটক চলাকালীন হঠাৎ আলো নিভে গিয়েছিল, আর নন্দিতা মঞ্চে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিল। সবাই তখন বলেছিল টেকনিক্যাল সমস্যা, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল কেউ ইচ্ছে করেই করেছিল। কারণ তার আগের দিনই দলের এক অভিনেত্রী নন্দিতাকে বলেছিল, “তুমি যদি সবসময় আলো কাড়ো, তবে একদিন সেই আলো তোমাকে পুড়িয়ে দেবে।” তখন আমরা এটাকে হালকাভাবে নিয়েছিলাম, কিন্তু আজ পিছনে তাকিয়ে বুঝি, সে কথার আড়ালে ছিল হিংসা আর ঈর্ষার ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত।” শিবাজী ধীরে ধীরে স্মৃতির গভীরে ডুবে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, “নন্দিতাকে সবাই ভালোবাসত না, অন্তত ভেতরে ভেতরে নয়। দলের মধ্যে কারও সঙ্গে তার প্রেম হয়েছিল—আমি নাম বলব না, কারণ সেই মানুষটি আজও বেঁচে আছে। কিন্তু সেই প্রেম ভেঙে গেলে শুধু মন ভাঙেনি, সৃষ্টি হয়েছিল তিক্ততা, প্রতিশোধের বীজ। আর সেই বীজ বহু বছর ধরে জল পেয়ে বড় হতে হতে শেষমেশ একদিন বিষাক্ত গাছে পরিণত হলো। নন্দিতার মৃত্যুর খবর শুনে আমার মনে হলো, এই মৃত্যু তার সেই পুরোনো ষড়যন্ত্র আর ঈর্ষারই পরিণতি।”

শিবাজীর গলা কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ছিল দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি বললেন, “তোমরা জানো না, আমি নন্দিতাকে শেষ যেদিন দেখেছিলাম, সেদিন তার চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক ছিল। সে বলেছিল, ‘আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে, কেউ আমার জীবনটাকে ধ্বংস করতে চাইছে।’ আমি তখন ভেবেছিলাম হয়তো অতিরিক্ত চাপ আর ক্লান্তি থেকে এমন অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু আজ বুঝি, নন্দিতা ভুল বলেনি। তার মৃত্যু যে মঞ্চে হলো, সেটা কাকতালীয় নয়। মঞ্চই তার জীবনের আলো, আর সেই আলোই তার মৃত্যুর আঁধার ডেকে এনেছে। তাই আমি বলছি, খুনটি দুর্ঘটনা ছিল না। এটি একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। হয়তো যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, তারা নিজেদের আড়ালে রাখবে, প্রমাণ মুছে দেবে, কিন্তু ইতিহাস জানে, এবং আমি আমার চোখে দেখা সত্য ভুলতে পারব না। নন্দিতা আমাদের থেকে চলে গেছে, কিন্তু তার মৃত্যু যেন এক নিঃশব্দ নাটক, যার শেষ দৃশ্য এখনো অসম্পূর্ণ।” শিবাজীর এই বক্তব্যে সবাই নিঃশব্দ হয়ে গেল, কারও মুখে কোনো কথা নেই, শুধু বাতাসে ভাসতে থাকল তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি। যেন তিনি যা বললেন, তা শুধু একটি অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, বরং আসন্ন এক অন্ধকার সত্যের দ্বার উন্মোচন। তার বিশ্বাস, নন্দিতার মৃত্যু ছিল কারও বহুদিনের প্রতিশোধপরায়ণতার ফল, আর সেই ষড়যন্ত্রের ছায়া আজও মঞ্চের গায়ে লেগে আছে।

রতনের ভিতরের দ্বন্দ্ব দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছিল। অমরেশ সেনের আত্মার উপস্থিতি যেন তার চারপাশে আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল, প্রতিটি রাতেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল অদ্ভুত শব্দে, থিয়েটারের ফাঁকা হলঘরে ভেসে আসা অর্ধেক সংলাপে, কিংবা মঞ্চের পিছনে রাখা ভাঙা চেয়ার টেবিলের ঠকঠক শব্দে। কিন্তু এ সবের থেকেও ভয়ঙ্কর ছিল তার মনে জন্ম নেওয়া অপরাধবোধ। সে যেন নিজেকে দায়ী মনে করতে শুরু করল এই দীর্ঘস্থায়ী অশান্তির জন্য। কারণ যতবারই সে নিজের বাবার কথা ভাবে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই কঠোর মুখ, যিনি তখন থিয়েটারের ম্যানেজার ছিলেন। ছোটবেলায় বহুবার শুনেছিল—থিয়েটারে কোনো নাটক শেষ হয়নি, অমরেশ সেন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান, আর এর পর থেকে থিয়েটার ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাবার ঠোঁটে এই বিষয়ে অস্বাভাবিক নীরবতা তাকে তখনও ভাবিয়ে তুলেছিল। এখন, যখন এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত আত্মা বারবার তাদের সামনে আসছে, রতন বুঝতে পারছে তার বাবার নীরবতা হয়তো শুধুই এড়িয়ে যাওয়া ছিল না, বরং এক ধরনের চাপা দেওয়া সত্য। সেই রাতেই যখন সে থিয়েটারের অন্ধকার ঘরে একা বসে থাকল, তার মনের ভেতর লুকোনো ভয় গলে গিয়ে অপরাধবোধের আকার নিল। সে নিজেকে প্রশ্ন করতে শুরু করল—যদি বাবাই কিছু জানতেন, যদি সেই অজানা সত্য লুকিয়ে রাখতে গিয়ে এক নিরপরাধ আত্মাকে বন্দি করে রাখেন, তবে কি তার নিজের পরিবারও এই অভিশাপের ভার বহন করে চলেছে? রতন উপলব্ধি করল, আত্মা কোনোদিন শান্তি পাবে না যতক্ষণ না সে বাবার মুখে শোনা সত্য বের করতে পারে।

এই উপলব্ধি তাকে অস্থির করে তুলল। পরদিন ভোরে সে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াল, যেখানে একসময় আলো ঝলমলে নাটক হতো। বাতাসে ধুলোর গন্ধ, পুরনো পোস্টারগুলো দেয়ালে আধভাঙা হয়ে ঝুলছে, এবং পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি করছিল। সে হাত দিয়ে মঞ্চের কাঠ স্পর্শ করল—এখানেই অমরেশ সেন একদিন অভিনয় করতেন, এটাই ছিল তার গৌরবের আসন, অথচ এখানেই যেন তার কবর বাঁধা পড়েছে। রতনের মনে হলো, থিয়েটারের কাঠামোর ভেতর একটা লুকোনো হাহাকার আটকে আছে, যা মুক্তি চাইছে। সেই মুহূর্তে সে প্রতিজ্ঞা করল—বাবা জীবিত থাকতেই তাকে মুখোমুখি হয়ে সত্যটা বের করে আনতে হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক বরাবর দূরত্বে ভরা। ছোট থেকে তিনি কখনোই স্নেহময় বাবা ছিলেন না, বরং শাসন আর কঠোরতায় তৈরি করেছিলেন এক দেয়াল। রতন জানত, এই প্রশ্ন তোলার মানে হবে সেই দেয়াল ভেঙে দেওয়া, আর হয়তো এমন কিছু শুনতে হবে যা তার জীবনটাই পাল্টে দিতে পারে। তবুও ভেতরের অপরাধবোধ তাকে তাড়া করছিল—যদি সে কিছু না করে, তবে এই অভিশাপ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে চলবে। এই দ্বন্দ্বই তাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দিচ্ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে শক্তিও দিচ্ছিল সত্য উদ্ঘাটনের পথে হাঁটার।

সেই রাতে ঘরে ফেরার পর রতনের বাবার সঙ্গে কথোপকথন শুরু হলো। প্রথমে সে দ্বিধা করছিল, কিন্তু পরে সাহস জুগিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল—“বাবা, অমরেশ সেনের শেষ নাটকের কথা আপনি কিছু জানেন?” প্রশ্নটা যেন বজ্রাঘাতের মতো নেমে এল। বৃদ্ধ মানুষটি প্রথমে চুপ করে রইলেন, চোখের পলক ফেললেন না। রতন লক্ষ্য করল, তার হাত সামান্য কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ নীরবতার পর তিনি গলা পরিষ্কার করে বললেন—“সব কথা জানলে তোমার ঘুম আর হবে না।” এই উত্তরেই রতন বুঝল, সত্যিই কোনো অন্ধকার রহস্য লুকিয়ে আছে। অনেক অনুরোধ, কান্না, এবং তর্কের পর অবশেষে বাবা মুখ খুললেন। তিনি বললেন, শেষ রাতে থিয়েটারে অনেক চাপ ছিল, নাটক অসম্পূর্ণ অবস্থায় এগোচ্ছিল, আর অমরেশ সেন দৃঢ়ভাবে চাইছিলেন নাটকটা শেষ করতে। কিন্তু প্রযোজক এবং ম্যানেজমেন্টের মধ্যে লোভ, প্রতিযোগিতা আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছিল। শেষ মুহূর্তে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে—কেউ হয়তো আলো নিভিয়ে দেয়, কেউ সংলাপ গুলিয়ে দেয়, আর তারপর হঠাৎ অমরেশ অদৃশ্য হয়ে যান। সেই সময় ম্যানেজার হিসেবে তিনি নিজে নাকি অনেক কিছু দেখেছিলেন—কিন্তু ভয়, লোভ এবং বাইরে থেকে চাপ আসায় তিনি সবটা চেপে যান। তাঁর মনে হতো হয়তো অমরেশের মৃত্যু বা অন্তর্ধান দুর্ঘটনা নয়, বরং ষড়যন্ত্র। এই স্বীকারোক্তি শুনে রতনের শরীর শীতল হয়ে গেল। বাবার চোখে জল ভেসে উঠেছিল, তিনি ফিসফিস করে বললেন—“সত্য চাপা দিয়ে আমি শুধু নিজের নয়, গোটা পরিবারের অভিশাপ ডেকে এনেছি।” রতন তখন বুঝতে পারল, আত্মার মুক্তির একমাত্র পথ হলো সত্যটাকে আলোয় আনা। সে প্রতিজ্ঞা করল, যতই কঠিন হোক না কেন, লুকোনো সত্যের আভাসকে পূর্ণ করে আনতে হবে, নইলে এই থিয়েটারের ছায়া কখনো মিলিয়ে যাবে না।

সন্ধ্যার পর থিয়েটারঘর ফাঁকা হয়ে এলে কুহু একা বসে ছিল মঞ্চে। অডিটোরিয়ামের চেয়ারের সারি তখন অন্ধকারে ডুবে গেছে, শুধু মঞ্চের উপরে ঝুলে থাকা লাইটের ফ্যাকাশে আলো তাকে ঘিরে রেখেছিল। আগামী সপ্তাহেই নাটকের প্রথম শো, তাই রিহার্সালের চাপ তার উপর চেপে বসেছে। সহঅভিনেতাদের সঙ্গে বারবার মহড়া করেও সে ঠিক মনে শান্তি পাচ্ছিল না। বিশেষ করে নন্দিতার জায়গায় দাঁড়িয়ে তার সংলাপ বলা যেন গলায় আটকে যাচ্ছিল। কুহু বারবার চেষ্টা করছিল—“আমার রক্তই আমার শক্তি…”—কিন্তু কথা বেরোবার আগেই কণ্ঠে কেঁপে ওঠা ভয়ের ছাপ পড়ছিল। সে নিজের মনকে বুঝিয়ে বলল, সবই মনের ভ্রম, যা শোনে এসেছে, যা লোকেরা ফিসফিস করে বলে—‘নন্দিতার আত্মা এই মঞ্চে ঘুরে বেড়ায়, তার অসমাপ্ত নাটকের প্রতিটি সংলাপ এখনও বাতাসে লুকিয়ে আছে।’ কুহু এইসব কথাকে অস্বীকার করতে চেয়েছিল, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা শূন্যতা তাকে গ্রাস করছিল। তাই সে একা থেকে, রাতের নিস্তব্ধতায় নিজের ভয় ভাঙতে চাইল। ধীরে ধীরে সে সংলাপ বলতে শুরু করল, মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাঁটতে হাঁটতে চরিত্রে ঢোকার চেষ্টা করছিল। হঠাৎই মঞ্চের পর্দার ফাঁক দিয়ে একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে তার চুল এলোমেলো করে দিল। কুহু থমকে দাঁড়াল—অডিটোরিয়ামে সব দরজা বন্ধ, তবু এই বাতাস এলো কোথা থেকে? সে বুক ধড়ফড় করতে করতে সংলাপ শেষ করার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল।

ঠিক তখনই হঠাৎ করে আলো নিভে গেল। মঞ্চ ঢেকে গেল ঘন অন্ধকারে। কুহু ঘাবড়ে গিয়েছিল, তবু বুঝল—এমনটা আগেও ঘটেছে, বিদ্যুতের ওঠানামা হয়তো। কিন্তু এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে যেন অনুভব করল, কেউ একেবারে তার পেছনে নিঃশ্বাস ফেলছে। ধীরে ধীরে সে ঘুরল। আর সেখানে, কেবল কয়েক হাত দূরে, অন্ধকার থেকে ভেসে উঠল লাল রঙের এক ছায়া। প্রথমে মনে হলো, কেউ হয়তো লাল শাড়ি পরে আছে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল, ওই লাল কোনো কাপড় নয়—এটা রক্তবর্ণের ঝলক। আলো ফিরে আসতেই দেখা গেল, নন্দিতা—যার মৃত্যুর খবর সবাই জানে, যার দেহ একসময় এই মঞ্চেই শেষ হয়ে গিয়েছিল—সে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তার গায়ে রক্তমাখা শাড়ি, চোখ দুটো লাল হয়ে আছে যেন ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। ঠোঁটে এক অদ্ভুত বাঁক, যেন সে সংলাপ বলতে চাইছে কিন্তু শব্দগুলো বেরোচ্ছে না। কুহুর মনে হলো—এটা কেবল মুখ নয়, অসমাপ্ত সংলাপের যন্ত্রণা, যা বছর ধরে জমে আছে। আত্মা হালকা করে ঠোঁট নড়াল—“আমার রক্তই আমার শক্তি…”—কিন্তু কণ্ঠস্বর যেন অর্ধেক ভাঙা, গলায় যেন অসংখ্য ছুরি আটকে আছে। সেই শব্দ এত ঠান্ডা, এত কর্কশ যে কুহুর হাড় কেঁপে উঠল। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে শব্দ বেরোল না। শুধু হাত দুটো কাঁপতে লাগল, চোখের সামনে মঞ্চ যেন দুলে উঠছে। নন্দিতার আত্মা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে মঞ্চের কাঠের তক্তাগুলো কেঁপে উঠছিল যেন। আর কুহু পিছিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পা নড়ছিল না। হঠাৎই আত্মা একেবারে তার সামনে এসে দাঁড়াল, আর চোখদুটি কুহুর চোখে আটকে গেল। সেই চোখে ভয়ের বদলে ছিল প্রচণ্ড রাগ, অভিমান, আর অসমাপ্তির আক্ষেপ।

কুহু ততক্ষণে ঘামে ভিজে গেছে, ঠান্ডায় শরীর জমে আসছে। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন আর মানুষ নেই, বরং ওই মঞ্চের এক চরিত্র, যে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আত্মার ঠোঁট আবার নড়ল, এবার শব্দ আরও স্পষ্ট—“আমার রক্তই আমার শক্তি… তুমি কে, যে আমার জায়গা নিতে এসেছে?” কথাটা কানে পৌঁছতেই কুহুর মাথা ঘুরে গেল। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল, শরীর ঢলে পড়ল মঞ্চের কাঠে। তার নিস্তব্ধ, অজ্ঞান শরীর পড়ে রইল, আর মঞ্চের উপর আবার আলো নিভে গেল। যখন সবার নজরে এলো, তখন সে নিস্তব্ধ পড়ে আছে। এই ঘটনার কথা শুনে সব্যসাচীও আর সন্দেহ করতে পারল না। এতদিন সে কুহুর ভয়ের কথা উড়িয়ে দিত, বলত সবই মানসিক চাপের ফল, কিন্তু এই রাতে, যখন মঞ্চে কুহু সরাসরি আত্মার মুখোমুখি হয়ে পড়ল, তখন তাকে স্বীকার করতে হল—এটা কেবল বিভ্রম নয়। কিছু অদ্ভুত, অশরীরী উপস্থিতি সত্যিই রয়ে গেছে এখানে। আর সেই উপস্থিতি তার অসমাপ্ত সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মঞ্চ ছাড়বে না। কুহুর নিস্তব্ধ মুখ আর মঞ্চের ভেতরে ভাসমান রক্তবর্ণ শাড়ির দৃশ্য সবার মনে এক চিরস্থায়ী আতঙ্ক রেখে গেল, আর নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে গেল আরও অমোঘ এক রহস্যের পরত।

ঐন্দ্রিলার মন সেই রাতে একটুও শান্ত হয়নি, কারণ তার মনে হচ্ছিল নন্দিতার মৃত্যুর রহস্য তিনি যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে অনেক গভীরে প্রোথিত। তাই ভোরবেলা উঠে তিনি আবার পুরনো কলেজ আর্কাইভের দিকে পা বাড়ান। আর্কাইভের ধুলো জমা তাকগুলোতে শুয়ে আছে কত শত পত্রিকা, ফাইল, পুরনো ম্যাগাজিন আর সাক্ষাৎকারের কপি—যেন মৃত মানুষের ফেলে যাওয়া কিছু ছাপচিত্র। ঐন্দ্রিলা এক এক করে পাতা উল্টাতে থাকেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ে কলেজ বার্ষিকীর একটি বিশেষ সংখ্যায় নন্দিতার একটি সাক্ষাৎকার, যেখানে নন্দিতা ইঙ্গিত করেছিলেন—“মঞ্চের আলোয় সবাই হাসে, কিন্তু পিছনের অন্ধকারে দমবন্ধ প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাস আর ঈর্ষার আগুন জ্বলে।” ঐন্দ্রিলা এই লাইনগুলো পড়ে চমকে ওঠেন। স্পষ্ট বোঝা যায়, নন্দিতা শুধু প্রতিভাবানই ছিলেন না, বরং অনেকের চোখে তিনি হুমকিও হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আরও কিছু পুরনো সংবাদপত্র ঘেঁটে দেখেন যে নন্দিতার মৃত্যু নিয়ে তেমন কোনো স্পষ্ট রিপোর্ট বেরোয়নি, সবকিছু চাপা দেওয়া হয়েছিল “দুর্ঘটনা” নামের সিলমোহর দিয়ে। কিন্তু খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়—সেদিন নাটকের দলের ভেতরে এক ধরনের দ্বন্দ্ব, এক অদৃশ্য বিদ্বেষ ছিল, যা কেউ প্রকাশ্যে বলতে সাহস পায়নি। ঐন্দ্রিলা এবার আশেপাশের পুরনো চিঠি, ফাইল আর সাক্ষাৎকারগুলো জড়ো করে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র কষতে শুরু করলেন।

কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্যটি তিনি পান এক অপ্রকাশিত চিঠিতে, যা কলেজ ম্যাগাজিনের পুরনো ফোল্ডারে গুঁজে রাখা ছিল। চিঠিটি লিখেছিলেন দলের একজন সদস্য, নাম অস্পষ্ট হলেও হাতে লেখা অক্ষরে বোঝা যাচ্ছিল এটি মৃত্যুর কিছুদিন আগেই লেখা হয়েছিল। চিঠিতে লেখা ছিল—“নন্দিতা তোমার উজ্জ্বলতা কারও কারও পক্ষে সহ্য করা কঠিন। মঞ্চে তুমি একাই রাজত্ব করছো, অথচ অন্যরা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। তাদের ঈর্ষা, তাদের ক্ষোভ—তুমি বুঝতে পারছো না। সাবধান থেকো, কারণ প্রতিযোগিতা এখন আর শুধু অভিনয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কিছু লোক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমাকে সরিয়ে দেওয়ার।” ঐন্দ্রিলা চিঠির প্রতিটি লাইন বারবার পড়তে থাকলেন। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছিল, নন্দিতার মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, বরং সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ঐন্দ্রিলা ভাবলেন, প্রেম আর ক্ষমতার লড়াই—এই দুইটি কারণ মিলেমিশেই হয়তো নন্দিতার জীবন কেড়ে নিয়েছিল। নাট্যদলের ভেতরে প্রেমঘটিত প্রতিযোগিতা ছিল প্রবল, কেউ হয়তো নন্দিতার প্রতি প্রেমে পড়েছিল, আবার কেউ তার সাফল্যে হীনমন্যতায় ভুগছিল। আর দলের নেতৃত্ব কে পাবে, কে আলোয় দাঁড়াবে আর কে অন্ধকারে চাপা পড়বে—এই দ্বন্দ্বই নন্দিতাকে নিঃশব্দে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

প্রমাণগুলো ধীরে ধীরে জোড়া লাগাতে লাগাতে ঐন্দ্রিলার সামনে একটি ভয়ঙ্কর ছবি ফুটে উঠলো—যেখানে নন্দিতা একা লড়াই করছিলেন ঈর্ষা, লালসা আর বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে। পুরনো সাক্ষাৎকারে তার মুখের সেই অস্পষ্ট আক্ষেপ, ফাইলে লুকিয়ে থাকা চাপা দেওয়া রিপোর্ট আর অপ্রকাশিত চিঠির সরাসরি সতর্কবার্তা—সবকিছু মিলিয়ে যেন একটাই সত্য গর্জন করে উঠলো: নন্দিতাকে হত্যা করা হয়েছিল। তবে কে ছিল মূল ষড়যন্ত্রকারী? কে তার প্রতিভাকে হুমকি মনে করে তাকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিল? ঐন্দ্রিলা বুঝলেন তদন্ত এখানেই শেষ নয়, বরং এখনো বাকি আছে সত্যের শেষ পর্দা উন্মোচন। তবে এও বুঝলেন, সত্যকে প্রকাশ্যে আনা মানে হলো বহু বছর ধরে চাপা দেওয়া নাম, মুখ আর সম্পর্ককে আলোয় টেনে আনা—যা হয়তো আজও অনেকের জন্য অস্বস্তিকর। কিন্তু ঐন্দ্রিলা আর থামলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, নন্দিতার গল্পকে এইভাবে চাপা থাকতে দেবেন না। মৃত্যু যদি ষড়যন্ত্রের ফল হয়, তবে সেটি ফাঁস করতেই হবে। আর এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞার মধ্য দিয়ে তার তদন্ত নতুন দিক পেল—এক ভয়ঙ্কর অথচ মুক্তিকামী যাত্রার পথে।

থিয়েটারের মঞ্চে বহুদিন ধরে জমে থাকা রহস্যের পর্দা সরে যেতে শুরু করে যখন শিবাজী ও রতন নিজেদের গোপন বোঝা নামিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘদিনের নীরবতা আর আত্মগোপনের চাপ তাদের ভেতরকে ক্ষয় করছিল, সেই যন্ত্রণা আর তারা সহ্য করতে পারছিল না। নন্দিতার মৃত্যুর ঘটনা যতটা ভৌতিক বলে প্রচার হয়েছিল, আসলে তার পেছনে ছিল নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের ছক। শিবাজীর কণ্ঠ কেঁপে ওঠে যখন সে স্বীকার করে—তাদের নাট্যদলের সেই সময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিনেতা এবং প্রযোজক, যাদের সামনে কেউ কথা বলার সাহস করত না, তারাই নন্দিতাকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষেছিল। কারণ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, হিংসা আর নন্দিতার অদম্য প্রতিভা। সে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, আর দর্শক ও সমালোচকের প্রশংসায় প্রথিতযশা অভিনেতার গুরুত্ব কমতে শুরু করেছিল। প্রযোজকও ভয় পাচ্ছিলেন যে নন্দিতা একদিন তার প্রভাবশালী জায়গা দখল করবে। রতনের চোখ ভিজে ওঠে যখন সে বলে কেমন করে নন্দিতার অকাল মৃত্যু তাদের নাটকের চরিত্রকে অভিশপ্ত করে দিয়েছিল—যা দর্শক দেখেছিল রক্তাক্ত মঞ্চে, তা আসলে এক পরিকল্পিত খুন। থিয়েটারের আড়ালে খুনের মুখোশ পরে বসেছিল দুই ক্ষমতালোভী মানুষ, আর নির্দোষ এক তরুণী তার প্রতিভার জন্য জীবন দিল।

রতনের কণ্ঠে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল সেই রাতের প্রতিটি ক্ষণ—কীভাবে নন্দিতাকে ভয়ে-ভয়ে আলাদা করে ডেকে নেওয়া হয়েছিল, কীভাবে তার পানীয়তে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিষাক্ত রাসায়নিক, আর তারপর কীভাবে তার দেহকে মঞ্চের পেছনে গোপনে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। দর্শক ও সহঅভিনেতারা ভেবেছিল নাটকের শিহরণ বাড়াতে কোনো অভিনব কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু পর্দার আড়ালে তখন সত্যিকারের মৃত্যুর হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছিল। নাটকের ক্লাইম্যাক্সে যখন আলো নিভে গিয়েছিল, অন্ধকারের আড়ালে নন্দিতার নিথর দেহটিকে সাজানো হয়েছিল “দুর্ঘটনা” বলে চালানোর জন্য। শিবাজী কাঁপা গলায় জানায়, তারা দুজন এই সত্য জানলেও প্রতিবাদের সাহস পায়নি, কারণ প্রভাবশালী ওই অভিনেতা ও প্রযোজকের হাত ছিল সমাজ, সংবাদমাধ্যম আর প্রশাসনের ওপরেও। রতন যোগ করে—তাদের নিজেরাও এই সত্য চাপা দেওয়ার জন্য হুমকি পেয়েছিল, ভয় পেয়েছিল যদি কিছু বলে তবে নিজেরাই শেষ হয়ে যাবে। তাই বহু বছর ধরে তারা নীরব থেকেছে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাদের পাপবোধ তাড়া করে ফিরেছে, আর প্রতিদিন তারা ভেবেছে নন্দিতার আত্মা হয়তো তাদের অভিশাপ দিচ্ছে।

অবশেষে শিবাজী ও রতনের স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে “রক্তাক্ত নাটক”-এর আসল কাহিনি উঠে আসে—এটি ছিল না কোনো অলৌকিক অভিশাপ, বরং মানুষের লোভ, হিংসা আর ক্ষমতার খেলা। খুনের মুখোশ খুলে যায়, প্রকাশ পায় যে নন্দিতার মৃত্যু এক ভয়ঙ্কর মানবিক বিশ্বাসঘাতকতার ফল। নাটকের মঞ্চে যে রক্তাক্ত ইতিহাস তৈরি হয়েছিল, তার পেছনে ছিল অমানবিক ষড়যন্ত্র। উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে শোনে, যেন বাতাস ভারী হয়ে যায় সেই অপরাধের ইতিহাসে। মঞ্চ আর দর্শকসারিতে ছড়িয়ে পড়ে শিহরণ—প্রতিভার জন্য লড়তে গিয়ে এক তরুণীকে মরতে হয়েছিল, আর তার মৃত্যু বছরের পর বছর ধরে ভূতের গল্প হয়ে ঘুরে বেড়ালেও আসল অপরাধীরা রয়ে গেল মুখোশের আড়ালে। এখন সেই মুখোশ ছিঁড়ে ফেলার পর প্রশ্ন থেকে যায়—ন্যায়বিচার কি আর সম্ভব? নন্দিতার আত্মা কি শান্তি পাবে? শিবাজী ও রতনের স্বীকারোক্তি কেবল এক নাটকের গোপন কাহিনি উন্মোচন করল না, উন্মোচন করল এক যুগের শিল্পীসমাজের কালো দিক, যেখানে খ্যাতি আর লোভ মানুষকে হত্যা পর্যন্ত ঠেলে দিতে পারে।

১০

– শেষ অঙ্কে থিয়েটারের মঞ্চে যে নাটকটি শেষ দৃশ্যের দিকে এগোচ্ছিল, সেটি আসলে কেবল নাটক নয়, বরং বাস্তব জীবনের অসম্পূর্ণ এক অধ্যায় পূর্ণ করার জন্য এক প্রতীক্ষিত মুহূর্ত ছিল। সব্যসাচী দিনরাত অনুশীলন করেছিলেন, নন্দিতার অসমাপ্ত সংলাপগুলোকে এমনভাবে গেঁথেছিলেন যে সেগুলো নাটকেরই অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই রাতের থিয়েটার ভরপুর দর্শকে পূর্ণ ছিল, সবাই জানত আজকের রাত এক বিশেষ রাত, যদিও কেউ জানত না ঠিক কী ঘটতে চলেছে। আলো কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। অভিনেতারা নিখুঁতভাবে তাঁদের সংলাপগুলো বলছিলেন, কিন্তু সব্যসাচীর চোখে এক ধরনের আতঙ্ক ও প্রত্যাশার ঝিলিক ছিল। নাটকের চূড়ান্ত মুহূর্ত এসে পড়লে, তিনি থামলেন, আর মঞ্চের আলো নরম লালচে হয়ে উঠল। দর্শকরা নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল, ঠিক তখনই মঞ্চে হালকা কুয়াশার মতো কিছু ছড়িয়ে পড়ল, যেন বাতাসে অদৃশ্য হাত দিয়ে কেউ পর্দা সরিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে নন্দিতা যেন হঠাৎ উপস্থিত হলেন। তাঁর পরনে সেই রক্তবর্ণ শাড়ি, কিন্তু আগের মতো অস্থিরতা বা রাগ আর নেই, তাঁর মুখ শান্ত, চোখের দৃষ্টিতে এক ধরনের মুক্তির স্নিগ্ধতা। দর্শকরা প্রথমে ভেবেছিল এটি হয়তো বিশেষ ইফেক্টের অংশ, কিন্তু তারপর যখন নন্দিতার কণ্ঠ ভেসে এল—ঠিক সেই অসমাপ্ত সংলাপের মাধ্যমে, যা তিনি মৃত্যুর আগে লিখে গিয়েছিলেন—সবার শরীর শিউরে উঠল। কণ্ঠে আর কোনো কম্পন নেই, বরং দৃঢ়তা, যেন জীবনের বাইরে থেকেও তিনি তাঁর শিল্পকে পূর্ণ করতে ফিরে এসেছেন।

সব্যসাচী প্রথমে কেঁপে উঠেছিলেন, তাঁর হাতের আঙুলে ঘাম জমে গিয়েছিল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তিনি বুঝলেন, এটাই সেই সুযোগ যার জন্য তিনি এতদিন অপেক্ষা করেছিলেন। নন্দিতার সাথে একসময়ে তাঁর সম্পর্ক, প্রেম, দ্বন্দ্ব—সবকিছু যেন নতুন করে ফিরে এল এই মঞ্চের সামনে। তিনি নন্দিতার চোখের দিকে তাকালেন, আর মঞ্চে সেই সংলাপগুলোর স্রোত বইতে লাগল। দর্শকরা বুঝতে পারছিল না তারা ঠিক কোন জগতে আছে—নাটকের ভেতরে, নাকি কোনো আত্মার আবাহনে। তবুও তারা এক মুহূর্তের জন্যও চোখ ফেরাতে পারছিল না। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ভঙ্গি দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিল। একসময় নন্দিতার শেষ সংলাপটি যখন শেষ হলো, তখন পুরো থিয়েটার নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটা চলার শব্দ পর্যন্ত যেন শোনা যাচ্ছিল। তারপর ধীরে ধীরে, সেই রক্তবর্ণ শাড়ি যেন মিলিয়ে যেতে শুরু করল, যেন লাল রঙের কুয়াশা আলোয় গলে যাচ্ছে। তাঁর উপস্থিতি কমতে লাগল, কিন্তু সেই শান্ত মুখাবয়ব, সেই প্রশান্ত চোখগুলো দর্শকের মনে গেঁথে রইল। সব্যসাচী দাঁড়িয়ে ছিলেন অচল হয়ে, তাঁর ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছিল না। তিনি বুঝলেন, আজকের এই মুহূর্তে নন্দিতা কেবল মঞ্চের অসমাপ্ত কাজ নয়, নিজের অসমাপ্ত জীবনেরও পূর্ণতা পেলেন।

যখন আলো আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল, মঞ্চে আর কিছুই রইল না—কেবল সব্যসাচী দাঁড়িয়ে আছেন, আর পেছনে খালি পর্দা। দর্শকরা প্রথমে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত হাততালি বেজে উঠল, যা কোনো নাটক শেষ হওয়ার পর সাধারণত শোনা যায় না। এটি ছিল না শুধু অভিনয়ের প্রশংসা, বরং এক অলৌকিক সাক্ষাতের প্রতিক্রিয়া। দর্শকরা জানত তারা এমন কিছু প্রত্যক্ষ করেছে, যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। অনেকেই চোখ মুছছিলেন, অনেকেই কাঁপছিলেন অদ্ভুত এক অনুভূতিতে। সব্যসাচী মঞ্চে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর চোখে জল, ঠোঁটে ফিসফিস করে বলা একটিমাত্র শব্দ—“ধন্যবাদ, নন্দিতা।” সেই রাতেই শহরের থিয়েটার মহলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল—কে ছিল সে? নন্দিতা সত্যিই ফিরেছিল, নাকি এটি ছিল এক অদ্ভুত অভিনব পরিকল্পনা? কিন্তু যারা সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল, তারা জানত, এ ঘটনা ছিল শুধু নাটকের অংশ নয়, বরং এক আত্মার মুক্তির যাত্রা। সেই রাতের পর থেকে মঞ্চে নন্দিতার রক্তবর্ণ শাড়ি আর দেখা যায়নি, কেবল আলো ও স্তব্ধতার ভেতর দিয়ে থেকে গেছে তাঁর উপস্থিতির স্মৃতি। আর সব্যসাচী নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পেলেন, কারণ অসমাপ্ত প্রেম ও অসমাপ্ত শিল্প—দুটোই অবশেষে সমাপ্তি পেয়েছিল সেই শেষ অঙ্কে।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *