সৌভিক নন্দী
১
কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের সেই রাতটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা ছিল, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। শহরের ব্যস্ততা একটু শান্ত হলেও, গলিগুলোয় যেন ছায়া আরও ঘন হয়ে উঠছিল। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ এক রিকশাওয়ালা প্রথম মৃতদেহটি দেখতে পান—লাল রঙের কাঁথায় মোড়া একটি দেহ, যার কপালে স্পষ্ট লাল তিলক, যেন রক্তে আঁকা। তার চিৎকারে স্থানীয় থানা ছুটে আসে। অচিন্ত্য বসু, ডেপুটি কমিশনার (ক্রাইম ব্রাঞ্চ), সকালে ফোন পান—”স্যর, কালীঘাটে অদ্ভুত খুন… একটা সিম্বলিক মার্ডার বলেই মনে হচ্ছে।” সাদা শার্ট গায়ে চাপিয়ে, ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে, তিনি বললেন, “জীবনে কিছুই সিম্বলিক হয় না। সব কিছুরই মানে আছে। পাঠাও লোক।” কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নিজেই ঘটনাস্থলে চলে যান। জায়গাটা দেখে তারও কপালে ভাঁজ পড়ে। মৃতদেহটি ছিল এক পুরুষের—বয়স প্রায় পঁইত্রিশ। কপালে রক্তের তিলকটি যেন কারও হাতে আঁকা নয়, বরং কোনও তন্ত্রমন্ত্রের নিয়মমাফিক বসানো। বুকের ওপর আঁকা ত্রিকোণ চিহ্নটি দেখে তিনি সোজা সত্যজিৎ ঘোষকে বলেন, “ফরেনসিক আর ফটোগ্রাফি তাড়াতাড়ি করাও। এইটা সাধারণ কেস নয়।” পুলিশ লাইন করে মৃতদেহ ঘিরে রাখে, মিডিয়া দূরে রাখা হয়, কিন্তু সেই দুপুরেই একটি নির্ভীক রিপোর্টার ঘটনাটি নিয়ে প্রথম লেখেন—ইরা সেন।
ইরা সেন ছিলেন একরকম চেনা নাম কলকাতার ‘আন্ডারলাইন নিউজ’-এর জগতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার “সিন অ্যান্ড সিম্বল” নামের কলাম অনেক জনপ্রিয়—যেখানে সে কলকাতার অদ্ভুত ও রহস্যময় ঘটনার তদন্ত করে লেখে। কালীঘাটের খুনের খবরটা তার কানে পৌঁছেছিল এক পরিচিত কনস্টেবলের মাধ্যমে। তার ধারণা ছিল, এটা নিছক খুন নয়—তার পেছনে কিছু গভীর রিচুয়ালিক দিক রয়েছে। তার লেখা পোস্টে স্পষ্ট লেখা ছিল: “কে এই খুনি, যে মৃতদেহের কপালে রক্তের তিলক এঁকে রেখে যাচ্ছে? তন্ত্র, না প্রতিশোধ?” পোস্টটি সন্ধ্যার মধ্যেই ভাইরাল হয়। অচিন্ত্য বসুর নজরেও আসে সেই লেখা, এবং তার কপালে ভাঁজ পড়ে আরও। এর আগে সে বহু কেসে সাংবাদিকদের উপর রাগ দেখিয়েছেন, কিন্তু ইরার লেখার ভেতর কিছু ছিল—একটা অদ্ভুত সংবেদন, কিছু বোধগম্যতা। রাত আটটায় তিনি ইরাকে ডাকেন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। ইরা কিছুটা সন্ত্রস্ত হলেও, সাহসী কণ্ঠে বলে, “আমি যা বলেছি, সেটাই দেখেছি। এই খুনের ধরন আগে কখনও হয়নি। তিলকটা শুধু চিহ্ন নয়, এটা বার্তা।” অচিন্ত্য বলেন, “বার্তা যদি হয়, তাহলে সেটা কার জন্য?” ইরা জবাব দেয়, “হয়তো আমাদেরই জন্য, যারা বিশ্বাস করে না। অথবা তাদের জন্য, যারা ভুলে গেছে।” সে রাতে, অফিসে ফিরে এসে অচিন্ত্য কেস ফাইলে নোট করে রাখেন—“প্রতীক-নির্ভর খুন। তদন্তে তান্ত্রিক ব্যাকরণ খুঁজে দেখতে হবে।”
পরদিন ফরেনসিক রিপোর্ট আসে—মৃতদেহে কোনও অস্ত্রের চিহ্ন নেই, মৃত্যু হয়েছে হৃদযন্ত্রের আচমকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, অথচ শরীরে কোনও বিষ নেই। মেডিক্যালি, একে ‘সাডেন কার্ডিয়াক ফেইলিওর’ বললেও, কপালের রক্ততিলক ও বুকের ত্রিকোণ চিহ্ন তদন্তকারীদের মনে সন্দেহ তৈরি করে—এ যেন মৃত্যু নয়, বরং কোনও বিশেষ তিথিতে করা আত্মবলিদান। অচিন্ত্য রিপোর্টের শেষ পাতায় লাল কালিতে লিখে দেন—”প্রাকৃতিক মৃত্যু নয়। Ritualistically induced biological collapse suspected.” সেই সময়েই তদন্তে যুক্ত হয় ঋজুদেব মুখোপাধ্যায়—একজন প্রাক্তন সংস্কৃত অধ্যাপক ও প্রথিতযশা তান্ত্রিক শাস্ত্র গবেষক। পুলিশের পক্ষ থেকে ডাকা হয়নি, বরং ইরার ব্লগে পোস্ট করা ছবিগুলো দেখে নিজেই উপস্থিত হন লালবাজারে। সঙ্গে নিয়ে আসেন তার পুরনো সংরক্ষিত একটি বই—‘রত্নতন্ত্রের মূলসূত্র’। কপালের সেই তিলকের ছবিটা দেখে বইয়ের এক পাতায় হাত রাখেন তিনি—“এই চিহ্নটি ‘অগ্নিমুদ্রা’—এটি খুব কম ব্যবহৃত হয়। রত্নতন্ত্র নামে এক গুপ্ত তান্ত্রিক সম্প্রদায় এটি ব্যবহার করত, বিশেষ শক্তি জাগরণের আগে।” অফিস ঘরে একটা ভারী নিস্তব্ধতা নামে। অচিন্ত্য তখনও বিশ্বাস করেন না এইসব প্রাচীন বিশ্বাসের কথা, কিন্তু ঋজুদেব বলেন, “আপনার হাতে যুক্তির শক্তি, আর আমার কাছে ইতিহাসের ছায়া। হয়তো এই দুই মিলে আমরা কিছু খুঁজে পাব।” আর ঠিক তখনই আসে খবর—বেহালার মন্দিরপাড়ায় পাওয়া গেছে দ্বিতীয় মৃতদেহ, এক কিশোরের… কপালে রক্ততিলক, আর বুকের ওপর ত্রিকোণ চিহ্ন আগুন দিয়ে দগ্ধ করা।
২
বেহালার পুরোনো মন্দিরপাড়ার অলিগলি যেন ছায়ায় মোড়া। দুপুরের রোদ পেরিয়ে গেলে এখানে আলো কেমন নিস্তেজ হয়ে যায়, আর ঠিক সেখানেই পাওয়া গেল দ্বিতীয় মৃতদেহটি। বয়স আনুমানিক ষোলো-সতেরো, গায়ে স্কুল ইউনিফর্মের ছেঁড়া অংশ, মুখে বিস্ময়ের ছাপ। কপালে আগের খুনের মতোই রক্ততিলক, কিন্তু এবার তিলকের রূপ কিছুটা ভিন্ন—এটি যেন কোনো আড়াআড়ি রেখার মাঝখানে একটি ছোট রক্তবিন্দুতে পরিণত, যা নিচের দিকে অদ্ভুতভাবে ঝুলে আছে। ফরেনসিক দল ছুটে এলেও কিছুই খুঁজে পায় না যা “রক্ত” বোঝাতে পারে—কোনো খোলা ক্ষত নেই, না মাথায়, না শরীরে। তবে বুকের ওপর আগুন দিয়ে আঁকা ত্রিকোণ চিহ্ন ছিল—এইবার সেটি পূর্ব দিকের দিকে মুখ করে তৈরি, যার তিনটি কোণ লালচে হয়ে পোড়া। ছেলেটির পরিচয় জানা যায় তার স্কুলব্যাগ থেকে—নাম রাহুল, স্থানীয় উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। অচিন্ত্য বসু ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে শুধু বলেন, “আবারও কোনো চিহ্ন, কোনো অস্ত্রচিহ্ন নেই। তিলকই যেন তার মৃত্যুর ঘোষণা।” এদিকে ইরা সেন, ক্যামেরা ছাড়া, খালি নোটবুক আর কৌতূহল নিয়ে পৌঁছায় ঘটনাস্থলে। সে ছেলেটির ব্যাগ ঘেঁটে দেখে, একটি ছোট খাতা—তাতে আঁকা রয়েছে একটি অদ্ভুত ত্রিকোণীয় গঠন, তিন কোণে তিনটি বিন্দু, যা তার আগের ব্লগে দেখা চিহ্নের সঙ্গে মিলে যায়। সে চুপচাপ পকেটে রেখে দেয় সেই খাতাখানি। অচিন্ত্য বিষয়টি লক্ষ্য করলেও কিছু বলেন না—এই মেয়েটার সাহস, আর অদ্ভুতভাবে ঘটনার গভীরে ডুবে যাওয়ার প্রবণতা তাকে টানছে।
ঋজুদেব মুখার্জী, মৃতদেহের ছবি দেখে বলেন, “এই তিলকটি ‘তপস্বরূপ অগ্নিবিন্দু’—রত্নতন্ত্র মতে এটি দ্বিতীয় স্তরের রক্ত উৎসর্গের চিহ্ন। প্রথমটি ছিল শক্তি উদ্রেক, এটি হচ্ছে আত্মত্যাগের সূচক।” অচিন্ত্য বসু এবার স্পষ্ট বিরক্ত—“আপনি তো বলছেন, খুনগুলো রিচুয়াল হচ্ছে… কিন্তু কেউ যদি রিচুয়াল করতে চায়, সে অস্ত্র ব্যবহার না করে, নিঃশব্দে কিভাবে একজনকে মেরে ফেলছে?” ঋজুদেব বলেন, “এটি তন্ত্রের বিষ। অস্ত্র নয়, মন্ত্র, ধ্বনি বা নিঃশ্বাস ব্যবহার করা হয়। শরীরের ভিতরের প্রাণশক্তি স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, একরকম অন্তর্মৃত্যু।” অচিন্ত্য আর তর্ক করেন না। ইরা তখন চুপ করে এক কোণে বসে ছিল, হঠাৎ বলে ওঠে, “এই ছেলেটা একটা ছবি এঁকেছিল… যা ঠিক ওই ত্রিকোণ চিহ্নের মতো।” সে তার পকেট থেকে রাহুলের খাতা খুলে দেখায়। খাতার শেষ পাতায় আঁকা সেই চিহ্নটি দেখে ঋজুদেব কাঁপা গলায় বলেন, “এটি ‘অগ্নিকোণ মণ্ডল’। একে বলা হয় ‘তৃতীয় চক্রের গেট’। এইসব চিহ্ন আগে কখনও বাস্তবে দেখিনি, শুধু প্রাচীন পুঁথিতে পড়েছি।” ইরা বলে, “একটা কথা বলব, স্যার?” অচিন্ত্য সায় দেন। “আমি ছোটবেলায় কাশীতে গিয়েছিলাম, তখন এক বৃদ্ধ আমার কপালে এমন তিলক এঁকে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘তুই সেদিন আবার দেখবি, আগুনের মুখোমুখি।’ তখন বুঝিনি। এখন… মনে হচ্ছে, এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে আমার কোনো যোগ আছে।” ঘরে নীরবতা নেমে আসে। অচিন্ত্য ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নামিয়ে বলেন, “তোমাকে এখন আমাদের টিমের অঙ্গ করে নিতেই হবে।”
সন্ধ্যায় লালবাজারে অচিন্ত্য ও ঋজুদেব একসঙ্গে বসে খুনের ধরন বিশ্লেষণ করছিলেন। খুন দুটি নির্দিষ্ট ভাবে ঘটেছে—প্রথমটি পূর্ণিমার রাতের পরে, দ্বিতীয়টি চতুর্দশীর আগে। ঋজুদেব বলেন, “এই চক্রটা যদি সত্যি হয়, তবে সাতটি রক্ততিলকের প্রয়োজন। সাত রাশির, সাত বৈশিষ্ট্যের, সাত তিলকের—সবই এক নির্দিষ্ট গ্রহ-ভিত্তিক শক্তিকে উৎসর্গ করার জন্য। এটা এক ‘মহাজাগরণ যজ্ঞ’—যা শেষ হলে এক বিশেষ রত্ন জাগ্রত হয়।” অচিন্ত্য এবার ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেন—এটা কেবল খুন নয়, এটা এক গোপন শক্তির পুনর্জাগরণের আয়োজন। ঠিক তখনই ঋজুদেব বলেন, “আমি একজনকে চিনি, যিনি একসময় এই তন্ত্রের চর্চা করতেন—তার নাম গায়ত্রী। তিনি বর্তমানে এক নির্জন পাহাড়ি আশ্রমে থাকেন। আমাদের সেখানে যেতে হবে।” অচিন্ত্য প্রস্তুতি নিতে বলেন, আর ইরার ব্লগে রাত সাড়ে দশটায় নতুন পোস্ট ওঠে—”দ্বিতীয় তিলক: কে ছুঁয়ে যাচ্ছে আগুনের মুখ?”। পোস্টের শেষে ইরা লেখে—”আমি নিশ্চিত, এই রক্ততিলক কেবল খুন নয়, এর সঙ্গে জড়িত অতীত, রক্ত, ভবিষ্যৎ… আর আমিও তার অংশ।”
৩
নিউ আলিপুর স্টেশনের কেবিনে বসে অচিন্ত্য বসু হাতের সিগারেটটা শেষ করে ছাইদানি ছুঁড়ে ফেললেন। পরপর দুটি খুন, একই প্রতীক, একই ধরণের মৃত্যু—কিন্তু কোথাও কোনও দৃশ্যমান খুনি নেই। পাশে বসে থাকা ঋজুদেব মুখোপাধ্যায়, চুপ করে তার চামড়ার ব্যাগ থেকে বের করলেন একটি পুরনো খয়েরি খাতাবন্দি পুঁথি, পাতাগুলো বিবর্ণ, কোণাগুলো ছেঁড়া। পাতা খুলে তিনি বললেন, “এই বইয়ের নাম ‘রত্নতন্ত্রের মূলসূত্র’। বহু বছর আগে আমার পিতা এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই শাস্ত্র গুজব নয়, সত্যিই অস্তিত্ব ছিল এক গুপ্ত সংগঠনের—‘রত্নতন্ত্র’। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ ‘রত্ন’ বা শক্তিসংবলিত উপাদান সংগ্রহ করে মহাজাগরণ সাধনা করা।” অচিন্ত্য চুপ করে শুনছিলেন, চোখে কৌতূহল আর সন্দেহের ছায়া। ঋজুদেব পৃষ্ঠার একদিকে আঙুল রেখে দেখালেন তিনটি প্রতীক—একটি ত্রিকোণ, তার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি রক্তবিন্দু, এবং তিলকের মতো আঁকা একটি লম্বা রেখা। “এই প্রতীক তিনটি মিলিয়ে গঠিত হয় একটি তান্ত্রিক মণ্ডল। এবং এই মণ্ডল জাগ্রত হয় যখন সাতটি নির্দিষ্ট মানুষের রক্ত ত্যাগ ঘটে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে।”
অচিন্ত্য ধীরে ধীরে বললেন, “এই সাত জন—তারা কি যেভাবে মারা পড়ছে, সেইটা তান্ত্রিক নিয়মে নির্ধারিত?” ঋজুদেব মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, এবং তারা রাশি, জন্মনক্ষত্র ও মানসিক প্রবণতার ভিত্তিতে নির্বাচিত। প্রথম জন ছিল ‘মেষ’ রাশির, আগুন প্রবণ, তাই আগুনের প্রতীক। দ্বিতীয় জন ছিল ‘বৃশ্চিক’ রাশির, যার সঙ্গে আত্ম-ত্যাগ ও গোপনতা জড়িত। এইভাবে প্রতিটি খুন রচিত হয় এক তান্ত্রিক পরিকল্পনার অন্তর্গত হয়ে।” অচিন্ত্য বুঝলেন, এটি শুধু খুনের কেস নয়, এটি একটি পরিকল্পিত ‘আত্মবলিদান সংগ্রহ’, যেখানে খুনি নিজে হয়ত মানুষ নয়, বরং কোন সংগঠন বা চক্র। তখনই সত্যজিৎ এসে জানাল, “স্যর, সেই ব্লগার মেয়েটা—ইরা সেন—তিনি বলছেন, আরও একটা ক্লু পেয়েছেন। এক ছেলেকে ইন্টারভিউ করেছেন, যে প্রথম খুনের আগের রাতে সেই জায়গায় ধ্যানরত এক লোককে দেখেছিল, যার গলায় নীল রঙের পুঁতির মালা ছিল, আর মুখটা লাল কাপড়ে ঢাকা।” অচিন্ত্য ও ঋজুদেব একে তুচ্ছ বলে এড়িয়ে দিতে পারেন না। নীল পুঁতির মালা, মুখ ঢাকা, ধ্যানরত আচরণ—সব কিছু মিলিয়ে এক ধরনের গুরুবাদী উপসর্গ মনে হয়। ইরা সেই ছেলের স্কেচ করিয়ে পাঠিয়েছে—স্কেচ দেখে ঋজুদেব থমকে যান, “আমি এই লোকটিকে চিনেছি। তার নাম মুনীন্দ্র দত্ত।”
মুনীন্দ্র দত্ত—উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজে পরিচিত এক শিল্পপতি, সমাজসেবক এবং শিক্ষানুরাগী। শহরের নানা প্রান্তে বিদ্যালয় ও সংস্কৃতি কেন্দ্র খুলে, তিনি এক ধরণের জনসমর্থন তৈরি করেছেন। কিন্তু ঋজুদেব বলেন, “এই ব্যক্তি তন্ত্রজগতে ‘রক্তাগ্নি সম্প্রদায়’-এর প্রাক্তন সদস্য। সে একসময় হিমাচলের সিদ্ধাশ্রমে সাধনা করত। তারপর হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়, পরে ফিরে এসে সমাজসেবী হিসেবে পরিচিতি পায়।” অচিন্ত্য বলেন, “আমরা লোকটার উপর নজর রাখব, তবে কোনো সরাসরি প্রমাণ না থাকলে তাকে ধরতে পারি না।” ঠিক তখনই ঋজুদেব বলেন, “তবে একটা কাজ করা যায়—আমরা গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে পারি। তিনি ছিলেন রত্নতন্ত্র গবেষণার একজন প্রবীণ অভিভাবক, একসময় আমাদের আচার্য। এখন নির্জনে থাকেন, কিন্তু এখনও অনেক কিছু জানেন।” অচিন্ত্য সিদ্ধান্ত নেন—তারা পরদিন সকালেই রওনা দেবেন বোলপুরের বাইরে, এক ছোট পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে, যেখানে গায়ত্রী দেবীর আশ্রম অবস্থিত। ইরাও সঙ্গে যেতে চায়, অচিন্ত্য প্রথমে মানা করলেও, ঋজুদেব বলেন, “এই মেয়েটার উপস্থিতি কাকতালীয় নয়, এর রক্তেই কিছু আছে। আমি তার সুরক্ষা নিজের কাঁধে নিচ্ছি।” পরদিন সকাল সাতটায় তিনজন রওনা দেন কলকাতা ছেড়ে। গাড়ি ছুটে চলে রাজহাটের মাঠ পেরিয়ে, গ্রামের পথ ধরে, যেখানে সূর্যরশ্মি পাতার ফাঁক দিয়ে পড়ে, আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে শতবর্ষী বটগাছেরা—যেন সাক্ষী পুরনো কোনো ভুলে যাওয়া পাপের।
৪
পাহাড়ি পথের দিকে ছুটে চলছিল গাড়ি—একদিকে দূরে সরু নদীর রেখা, অন্যদিকে ছায়াঘেরা জঙ্গলের শাখা মাথার উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ছে। বোলপুর পেরিয়ে গাড়ি ঢুকল গহন অঞ্চলে, যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক চলে যায় এবং পিচঢালা রাস্তা হঠাৎ করেই মাটির কাঁচা পথে মিশে যায়। এখানেই আশ্রম, যার নাম ‘অগ্নিযাত্রা’। আশ্রম বলতে একটি ছোট বাড়ি, মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি, সামনে তুলসী গাছ, আর পেছনে ঘন বাঁশঝাড়। এক বৃদ্ধা—সাদা কাপড় পরা, মুখে থিতিয়ে থাকা বয়সের ছাপ—দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, যেন পূর্বেই জানতেন কেউ আসবে। এ তিনি গায়ত্রী সন্ন্যাসিনী। তার চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা, যা সময়ে ঘূর্ণায়মান না হয়ে বরং সময়ের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে বলেই মনে হয়। ঋজুদেব এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করেন, “গুরুমা, আমরা আবার এক তিলকের সময় ফিরে এসেছি।” গায়ত্রী শান্ত কণ্ঠে বলেন, “তিলক তো চিহ্নমাত্র, শক্তি জাগে যখন আত্মা নীরব হয়।” ইরা একটু অস্বস্তিতে পড়ে—এই স্থিরতা, এই পাহাড়ি বাতাস যেন তার শরীরে শীতল কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। গায়ত্রী তাকে এক দৃষ্টিতে দেখেন, আর বলেন, “তুই আগুনকে দেখেছিস, তাই তোকে তারা খোঁজে।” ইরার গলা শুকিয়ে আসে। অচিন্ত্য তৎক্ষণাৎ বলে ওঠেন, “আমরা জানতে চাই, এই হত্যাগুলোর পেছনে আসল লক্ষ্য কী?” গায়ত্রী ভিতরে নিয়ে যান সবাইকে, পুরনো কাঠের ঘরে যেখানে দেয়ালে ঝোলানো আছে প্রাচীন পুঁথির পাতাগুলো—সবই হাতে লেখা, বহু পুরনো, সিংহলী ও সংস্কৃত মিশ্র ভাষায়।
ঘরের কেন্দ্রে একটি কাঠের মঞ্চে গায়ত্রী বসেন এবং এক পাতা খোলেন, যেখানে আঁকা ছিল এক চক্রের ভেতরে ত্রিকোণ, আর প্রতিটি কোণে রাশিচক্রের প্রতীক। তিনি বলেন, “এই চক্রের নাম ‘রক্তবিন্দু মণ্ডল’। সাতটি নির্দিষ্ট রক্তের তিলক এঁকে মহাজাগরণ হয়, আর মুনীন্দ্র সেই কাজটাই করছে। তুমি, ঋজুদেব, জানো—‘অগ্নিরথ’ কবে ফিরবে?” ঋজুদেব মাথা নিচু করেন। গায়ত্রী বলেন, “আগামী অমাবস্যা—তখন হবে চতুর্থ রক্ততিলক। স্থান নির্ধারিত হয়েছে পূর্বদিকে, যেখানে তিন নদী মিশেছে। আমি স্বপ্নে দেখেছি এক সাদা গায়ে কালো কালীমার গায়ে লেপ্টে থাকা শিশু, যার কপালে জ্বলছে তিলক। আর সে জায়গা—উলুবেড়িয়ার কাছে, যেখানে আগে রত্নতন্ত্রীদের এক প্রাচীন উপাসনাস্থান ছিল। সময় কম।” অচিন্ত্য সঙ্গে সঙ্গে ফোন তুলে লালবাজারে লোক পাঠাতে বলেন। কিন্তু এদিকে, পাহাড়ি হাওয়া থেমে যায়, আর বাঁশঝাড়ের দিক থেকে আসতে থাকে কুকুরের অদ্ভুত ডাক, যেন কোনো আগন্তুক শক্তি এদিকেই আসছে। গায়ত্রী চোখ বন্ধ করে বলেন, “তারা জেগে উঠছে। তারা শুধু রক্ত চায় না, তারা চায় শরীর, আত্মা ও আগুনের নিয়ন্ত্রণ।”
যখন তারা উলুবেড়িয়ার দিকে রওনা দিচ্ছিল, ঠিক তখনই আসে খবর—চতুর্থ মৃতদেহ পাওয়া গেছে, পূর্বাভাসের মাত্র কিছুক্ষণ আগেই। স্থান—উলুবেড়িয়ার শ্মশান ঘাটের পেছনে পরিত্যক্ত এক গুদামে। মৃত ব্যক্তি এইবার একজন বৃদ্ধ, প্রায় সত্তরের কাছাকাছি, যিনি স্থানীয়ভাবে তান্ত্রিক চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কপালে তিলক আগের তুলনায় ভিন্ন—এইবার এটি পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো, যেন মৃত্যু নয়, আহ্বানের প্রতীক। বুকের ওপর ত্রিকোণ আগুনে দগ্ধ হলেও, আশেপাশে ধূপ ও রক্তমিশ্র ধানের শীষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ঋজুদেব ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেন, “এই হচ্ছে ‘বায়ু তিলক’—চতুর্থ স্তরের রক্ত আহ্বান। এটি এক ধরণের দরজা খোলার কাজ করে, যেটি বাস্তব ও অতিপ্রাকৃত জগতের মাঝে রয়েছে।” ইরা তখন ফিসফিস করে বলে, “তাহলে কি খুনগুলো শুধু আত্মার খোরাক, না কি… অন্য কিছু আসছে?” অচিন্ত্য তখন রুক্ষ গলায় বলেন, “এতদিন আমরা খুন খুঁজছিলাম। এখন বোঝা যাচ্ছে, খুনি আমাদের খুঁজছে।” এই খুনের পরে গোটা শহরে ভয় ছড়িয়ে পড়ে। ক্রাইম ব্রাঞ্চ লোক পাঠায় সকল শ্মশান ও প্রাচীন মন্দিরে। মিডিয়াতে ইরার ব্লগ পোস্ট আগুন ছড়ায়—“চতুর্থ রক্ততিলক: কে জাগাচ্ছে মহাশক্তি?” আর পোস্টের নিচে কেউ একজন গোপনে মন্তব্য করেন—“পঞ্চম আসবে খুব শিগগির। সে নিজের জন্ম জানে না।”
৫
ইরা সেই রাতে ঘুমোতে পারেনি। গায়ত্রী সন্ন্যাসিনীর কথাগুলো তার মগজে ক্রমাগত প্রতিধ্বনি তুলছিল—“তুই আগুনকে দেখেছিস, তাই তোকে তারা খোঁজে।” বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ছোটবেলার কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করে। পাঁচ বছর বয়সে তার মা মারা যান, বাবা প্রায় নির্বিকার ছিলেন সেই শোকে। তখন থেকেই সে অনুভব করত, যেন কিছু একটার অভাব আছে, কোনো জিনিস তাকে বলা হয়নি। একবার তার ঠাকুরদা বলেছিলেন, “তোর কপালে এক সময় তিলক ছিল, জানিস?” সে ভেবেছিল গল্প, আজ বুঝতে পারছে হয়তো সেটাই সত্য। সকালে উঠে পুরনো অ্যালবাম ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে পায় একটি ফটো—কাশীর এক ঘাটে সে বসে, কপালে রক্তের মতো কিছু লেপা, আর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত চেহারার পুরুষ, যার মুখ অর্ধেক ছায়ায় ঢাকা। ইরা সেই ছবিটা নিয়ে ছুটে যায় ঋজুদেবের কাছে। ঋজুদেব ছবিটি দেখে কাঁপা কণ্ঠে বলেন, “এই লোকটি মুনীন্দ্র দত্ত।” অচিন্ত্য বসুও হতবাক হয়ে যান। “তাহলে ইরা তার পূর্বপরিকল্পনার অংশ? এই খুনের পরিকল্পনা কি পঁচিশ বছর আগে থেকেই চলেছে?” ঋজুদেব বলেন, “তাদের পরিকল্পনায় ইরার জন্মও হয়তো ছিল, কিংবা তার রক্ত। জন্ম তারিখ, রাশি, জন্মস্থল—সব এক নির্দিষ্ট মণ্ডলের অন্তর্গত।” ইরা কাঁপা গলায় বলে, “তাহলে কি আমি পরবর্তী তিলক?” কেউ মুখে কিছু না বললেও, নীরবতা ছিলই সব প্রশ্নের উত্তর।
এদিকে, শহরের এক প্রান্তে, দক্ষিণ দমদমের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে মুনীন্দ্র বসে ধূপ জ্বালাচ্ছিলেন। তার সামনে একটি পাথরের ফলক, তাতে খোদাই করা একটি মণ্ডল—চক্রাকার ঘূর্ণি যার কেন্দ্রে লেখা ‘ঈং’, আর তার চারপাশে তিলকগুলোর প্রতীক। একজোড়া চোখ, সাদা ধুতি, আর গলায় নীল রুদ্রাক্ষের মালা—সে হাসছিল। “পঞ্চম তিলক—সেই রক্ত, যা নিজের উৎস জানে না… তাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ,” ফিসফিস করে সে বলে। তার সহচর বলল, “কবে?” মুনীন্দ্র বলেন, “আগামী অষ্টমী। চন্দ্র তমসার ঘরে প্রবেশ করবে, আর আগুনের স্তম্ভ উঠবে… ঠিক তখন।” সে ঘর ছেড়ে বাইরে এলে দেখা যায়, এক যুবক—জীর্ণ দেহ, কিন্তু চোখে অস্বাভাবিক তেজ—তার দিকে এগিয়ে আসে। “এই পঞ্চমজন কি নিজে নিজের রক্ত দেবে?” মুনীন্দ্র মাথা নাড়ে, “না। তাকে ভাবতে হবে সে নিজেই পাপ, নিজেই ত্যাগ। তাকে বুঝিয়ে আনতে হবে, সে জন্মেই এই যজ্ঞের জন্য।” যুবক হাসে, “তার কপালে তিলক আমি এঁকে দেব। তবে আগুন চাই।” মুনীন্দ্র ধীরে বলেন, “আগুন তো আসবেই… একবার যখন পঞ্চম তিলক পড়বে, তখন দ্বার খুলবে, তখন…” সে কথা শেষ করে না। বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে আসে। চারদিকে ধূপের গন্ধে যেন ঘরটা চুল্লির মতো গরম হয়ে ওঠে। মুনীন্দ্র চুপ করে থাকেন, যেন কিছু একটার অপেক্ষায়।
অচিন্ত্য বসু এবার ইরাকে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন—তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখার কথা বলেন, কিন্তু ইরা প্রতিবাদ করে। “আপনারা চাইছেন আমি পালিয়ে থাকি, অথচ আমি তো নিজেই খুঁজছি উত্তর। আমি কি আমারই জন্মের রহস্য থেকে লুকিয়ে থাকব?” ঋজুদেব বলেন, “তোমাকে সরানো হচ্ছে না, বরং রক্ষা করা হচ্ছে। মনে রেখো, তিলক কপালে পড়ে না, পড়ে চেতনাতে।” ঠিক তখনই ফোন আসে—রবীন্দ্র সরোবরের পাশ থেকে পাওয়া গেছে আরেকটি মৃতদেহ। কিন্তু এবারে কপালে তিলক নয়, বরং গালের উপরে রক্তের দাগ, যেন কেউ অসমাপ্ত চেষ্টা করেছিল। মৃতদেহের পাশে পড়ে ছিল ইরার একটি পুরনো ব্লগ প্রিন্ট করা—অর্থাৎ বার্তা পরিষ্কার, পরবর্তী খুন ইরাকে নিয়েই। ইরা এবার আর পিছিয়ে থাকে না। সে বলে, “আমি যাব সেই জায়গায়, আমাকে টোপ করেই যদি কেউ এগোতে চায়, তবে আমি টোপ হব। অন্তত জানব, আমি কে। আমার রক্তে যদি কিছু থাকে, আমি তার মুখোমুখি হব।” এই স্পষ্ট উচ্চারণে অচিন্ত্য আর বাধা দেন না। রাতেই তারা রওনা দেয় গায়ত্রী সন্ন্যাসিনীর দেওয়া একটি নতুন জায়গার দিকে—গঙ্গার পাড়ে এক নির্জন ঘাট, যেখানে পঞ্চম তিলক পড়তে পারে, কিংবা প্রতিরোধ হতে পারে এক চক্রের।
৬
কলকাতার অন্যতম ধনী, জনহিতৈষী শিল্পপতি হিসেবে পরিচিত মুনীন্দ্র দত্ত—যার নাম শহরের প্রায় প্রতিটি স্কুল-বিল্ডিংয়ের ফলকে খোদাই করা, যে নিয়মিত হোম সোসাইটির দান-অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে আসেন, আর যাঁর ছবি প্রায়ই পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয় কোনও না কোনও সমাজকল্যাণমূলক কাজের খবরের সঙ্গে—তাঁর আরেক মুখ রয়েছে, যা কেউ দেখেনি। অথচ সেই মুখই একে একে পাঁচটি রক্ততিলকের যজ্ঞে প্ররোচনা দিচ্ছে, আর আত্মাদের ছিন্ন করছে অস্তিত্ব থেকে। অচিন্ত্য বসুর মাথায় এবার আর সন্দেহ নেই—এই মানুষটাই ওই প্রাচীন রত্নতন্ত্র গোষ্ঠীর পুনরুজ্জীবক। মুনীন্দ্রকে সরাসরি না ধরার একটাই কারণ—প্রমাণ নেই। কিন্তু তবুও, সে ক্রমাগত দৃশ্যপটের ছায়ায় ছায়ায় কাজ করে চলেছে। এর মধ্যেই ইরা নিজের পুরনো বন্ধু, এক সাংবাদিক অন্বেষাকে ফোন করে খোঁজ নিতে বলে, মুনীন্দ্রের কলেজজীবনের ছবি বা ডকুমেন্ট কিছু আছে কিনা। সন্ধ্যায় একটি ছবি আসে—উত্তরবঙ্গের এক ঘন সবুজ পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কয়েকজন যুবক, এবং মাঝখানে মুনীন্দ্র, গলায় নীল পুঁতির মালা। তার পাশেই আরও একজন, তার মুখে ভয়ঙ্কর দৃঢ়তা, নাম লেখা: “অভি”। ঋজুদেব ছবি দেখে শিউরে ওঠেন, “এই ছেলেটা… রত্নতন্ত্রের পুরাতন পাণ্ডুলিপিতে ‘অগ্নিকুল’ নামে পরিচিত একজন ছাত্র ছিল, তার চুল ছাঁটা, চোখে লাল ঘোর… আমি ভেবেছিলাম সে মৃত।” কিন্তু সে বেঁচে আছে।
সেই ‘অভি’ এখন পরিচিত ‘অভিজিৎ ঘোষ’ নামে, মুনীন্দ্রের ‘সোশ্যাল ফাউন্ডেশন’-এর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, যার কাজ বিভিন্ন স্কুলে “শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আধ্যাত্মিক বিকাশ” সংক্রান্ত কর্মশালা পরিচালনা করা। অথচ এই ছেলেটিই পঞ্চম খুনের স্থান ঘিরে ঘুরে বেড়িয়েছিল, এবং এমনকি ইরার একটি পোস্ট শেয়ারের আগেই সেই কমেন্ট করেছিল—”সে নিজের জন্ম জানে না”। অচিন্ত্য বোঝেন, মুনীন্দ্র একা নয়, তার চারপাশে তৈরি হয়ে গেছে এক নতুন রত্নতান্ত্রিক বাহিনী, যারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্ম, সংস্কৃতি—সব কিছুর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে যাচ্ছে শহরের মগজে। ইরা এবার অভিজিৎকে ট্র্যাক করার দায়িত্ব নেয়। সে একটি স্কুলের অনুষ্ঠান উপলক্ষে হাওড়ার একটি অডিটোরিয়ামে যাবে, সেই খবর পেয়ে ইরা নিজে গিয়েই কথা বলে—সাংবাদিক পরিচয় দিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: “আপনি কি বিশ্বাস করেন, আত্মা কোনও চক্রে বাঁধা থাকে?” অভিজিৎ প্রথমে হাসে, তারপর তার চোখে অদ্ভুত লাল রঙ ঝিলিক দেয়, “চক্র যদি থাকে, তাহলে তিলক তার দরজা।” ইরার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সে জানে, অভিজিৎ তাকে চিনেছে, বুঝেছে তার ভিতরের আতঙ্ক, আর সেই আতঙ্কই রক্ততিলকের অঙ্কুর।
এদিকে ঋজুদেব ও অচিন্ত্য একটি পুরনো লাইব্রেরির নিচের ভল্ট থেকে আবিষ্কার করেন রত্নতন্ত্রের শেষ দফার মুদ্রাঙ্কিত চিহ্নসমূহ। সেখানে লেখা—“ষষ্ঠ তিলক পড়বে চাঁদের ছায়ায়, যেখানে আত্মা আর ছায়ার মাঝখানে জল হয় প্রতিবিম্ব।” এই ছত্র পড়ে ঋজুদেব বলেন, “এই খুন হবে নদীর ধারে—এবং এবার খুন হবে কোনও মহিলা, যিনি নিজেই একটি প্রাচীন রক্তশক্তির বাহক।” অচিন্ত্য হতবাক, “ইরাকে আবার টার্গেট?” ঋজুদেব মাথা নাড়িয়ে বলেন, “না। এবার তারা চাইবে এমন কাউকে, যার রক্তে আগুন নয়, বরং প্রতিফলনের শক্তি আছে—যাকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় দরজা’। হয়তো ইরার মা?” ইরা তখন বলে ওঠে, “আমার মা মারা যাননি, তিনি অন্তর্ধান হয়েছিলেন। কেউ খুঁজে পাননি।” আর তখনই গায়ত্রী আশ্রম থেকে সংবাদ আসে—এক সন্ন্যাসিনী স্বপ্নে দেখেছেন, একজন বৃদ্ধা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, কপালে লাল রেখা, চোখ বন্ধ, আর তার পেছনে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে অভিজিৎ। সব হিসেব যেন এবার ইরার অতীতকেই কেন্দ্রে নিয়ে এসে জমাট বাঁধছে। অচিন্ত্য বলেন, “তাদের প্ল্যান আমরা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমরা কি থামাতে পারব?” ঋজুদেব মুখ নিচু করে বলেন, “শুধু প্রতিহত নয়, তাদের জাল ভাঙতে হলে আমাদেরও একটা তিলক আঁকতে হবে—কিন্তু প্রতিক্রিয়ার।”
৭
হাওড়ার সেই পুরোনো স্কুলবাড়ির গুদামে ধুলোয় ঢাকা একটা ট্রাঙ্ক খোলার সময় ইরা জানত না, কী অপেক্ষা করছে তার জন্য। ট্রাঙ্কটা আসলে তার মা, মেঘলা সেনের নামে স্কুলে জমা পড়েছিল প্রায় দুই যুগ আগে। পুরনো এক অফিস সহায়ক তার খোঁজে ইরার হাতে সেই চাবি তুলে দেয়। ভেতরে ছিল একগাদা নথি, আর নিচের দিকে লুকানো একটা ৮মিমি ফিল্ম রিল—যার গায়ে লেখা ছিল, “জন্মতিথির দিন।” ইরা সঙ্গে সঙ্গে ঋজুদেবকে খবর দেয়। তারা ফিল্মটি ডিজিটাইজ করে প্লে করে—এবং যা দেখে তা যেন বাস্তবের ছায়া নয়, বরং আগুনের আয়না। ভিডিওতে দেখা যায়, এক পুরোনো সাধনস্থান, মাঝে আগুন জ্বলছে, আর তার চারপাশে কয়েকজন সাদা বসনে বসা মানুষ। তাদের মধ্যে একজন মহিলা—চোখে অসীম শক্তির দীপ্তি, কপালে স্পষ্ট রক্ততিলক—এটাই ছিল ইরার মা। পেছনে দাঁড়িয়ে এক পুরুষ কণ্ঠ বলছে, “এই কন্যা আত্মবলিদানের ফল, যার মাধ্যমে ষষ্ঠ দরজা খুলবে। সময় আসছে।” ইরা স্তব্ধ। তার মা শুধু এক নারী নন, তিনিও এক বিশেষ চক্রের অংশ ছিলেন, এবং সে নিজেই রত্নতন্ত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ভিডিওর শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, ওই নারী জলের ধারে দাঁড়িয়ে, পেছনে অন্ধকার ছায়া, এক ঝাপসা মুখ—মুনীন্দ্র।
ঋজুদেব বলেন, “এটি রেকর্ড করা হয়েছিল ইরার জন্মের রাতেই। ষষ্ঠ তিলকের জন্য দরকার এমন কারও, যার শরীরে প্রতিফলনের শক্তি আছে—জল ও ছায়া একসঙ্গে যার কাছে প্রতিফলিত হয়। তোর মা সেই শক্তির বাহক ছিলেন। কিন্তু তিনি অন্তর্ধান করেছিলেন যাতে রত্নতন্ত্রের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হয়। এখন তারা বুঝেছে, তাকে পুনরায় জাগিয়ে আনতে হবে—আর তার মাধ্যমেই ষষ্ঠ খুন হবে।” অচিন্ত্য এবার আর চুপ থাকেন না। “আমরা যদি অনুমান করতে পারি, যে জায়গা নদীর ধারে, যেখানে জল প্রতিফলিত করে আত্মাকে—তবে সম্ভবত পুরুলিয়ার ‘শুশুনিয়া গুহা’। সেখানকার গুহা একসময় তান্ত্রিকদের শক্তিকেন্দ্র ছিল, আর গুহার ভেতর দিয়ে এক সরু জলধারা প্রবাহিত হয়।” তারা দল তৈরি করে রওনা দেয় পুরুলিয়ার দিকে। পথে গায়ত্রী দেবীর একটি পত্র আসে—“সাবধান, গুহার গভীরে ছায়া থাকে না, থাকে আত্মার গর্জন। সেখানে আলো শুধু প্রতিফলন, বাস্তব নয়।” এদিকে, মুনীন্দ্র আর অভিজিৎ পৌঁছে গেছে আগেই। তাদের সঙ্গে আছে আরও তিনজন যুবক-যুবতী, যাদের চোখে আগুনের ছায়া। গুহার মুখে বসে থাকা মুনীন্দ্র গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, “সময় এসেছেই। এবার দরজা খুলবে—আর সত্য বেরিয়ে আসবে। পুরোনো রক্ত, পুরোনো ঋণ, সব মুছে যাবে।”
শুশুনিয়া পৌঁছে ইরা যখন গুহার ভেতর প্রবেশ করে, তখন একটা অদ্ভুত নিঃশব্দতা তাকে গ্রাস করে। চারপাশের পাথরের গায়ে আঁকা প্রতীকেরা যেন কাঁপছে তার উপস্থিতিতে। সে হঠাৎ দেখে, পাথরের গায়ে তার নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি, চোখের মাঝে একটি তিলক নিজে থেকেই গাঢ় হচ্ছে। হঠাৎ সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় একজন—মেঘলা সেন, তার মা। কিন্তু সে মৃত নয়, জীবিত। মেঘলা বলেন, “আমি তোকে ছাড়তে চাইনি। আমাকে গায়ত্রী দেবী গোপনে সরিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ তারা জানতেন—তোকে যদি আমার রক্তে পূর্ণ করে জাগায়, তাহলে সপ্তম তিলক নিজের আগুনেই খুলে যাবে।” ইরা কেঁপে ওঠে। “তাহলে ষষ্ঠ খুনের লক্ষ্য তুমি?” মেঘলা মাথা নাড়ে, “না। ওরা চায় আমি নিজে আত্মবলিদান করি, যেন ষষ্ঠ দরজা সহজে খোলে। কিন্তু আমি নিজে পেছনে ছিলাম শুধু এজন্য, তুই যেন শক্তি জানিস, কিন্তু ব্যবহার না করিস। তোর রক্ত চায় না শুধু মুনীন্দ্র, চায় নিজে রত্ন হয়ে উঠতে।” হঠাৎ গুহার গায়ে আগুনের রেখা আঁকা হয়—মুনীন্দ্র প্রবেশ করে। “শেষ হলো নাটক?” সে বলে ওঠে। তার পেছনে অভিজিৎ ও আরও তিনজন—তাদের মুখে বিকৃত হাসি, আর চোখে আগুনের মায়া। মুনীন্দ্র বলে, “এখানেই ষষ্ঠ তিলক, এখানেই আমরা খুলব দরজা—আর সেই দরজা এক নতুন যুগের সূচনা করবে।”
৮
গুহার গা বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের রেখা, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুনীন্দ্র—নির্লিপ্ত, নিঃশব্দ, কিন্তু তার চোখ যেন গহীন রক্তে ডুবে আছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ ও তিনজন তরুণ অনুগামী, যাদের চোখে একরকম পরকালীন দীপ্তি। অচিন্ত্য বন্দুক তুলে বললেন, “এখানেই থামুন, মুনীন্দ্রবাবু। আপনি যা করছেন, তা কেবল খুন নয়, এটা ধর্মবিরোধ, মানবতাবিরোধ, আইনবিরোধ।” মুনীন্দ্র হাসলেন—একটা স্তব্ধ, নিঃশব্দ হাসি। “আইন যেখানে আত্মার দরজা বন্ধ রাখে, সেখানে আমিই ন্যায়,” তিনি বলেন। ইরা তখন মায়ের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু গুহার মেঝে যেন তার পায়ের তলায় নড়ছে। হঠাৎ করে গুহার একপ্রান্ত থেকে উঠে আসে এক ধোঁয়ামাখা হাওয়া, আর সেই হাওয়ার সঙ্গে মিলে যায় মুনীন্দ্রর কণ্ঠস্বর: “ষষ্ঠ তিলকের আগুন তিলক নয়—এ হলো প্রতিচ্ছবি। এবং প্রতিচ্ছবি কেবল প্রতিফলন নয়, এটি নিজেই শক্তি।” অভিজিৎ তখন মেঘলার দিকে এগিয়ে যায়, হাতে একটি ধারালো রুপার ছুরি। কিন্তু ইরা চিৎকার করে ওঠে, “না! যদি দরজা খোলার জন্য আত্মবলিদান লাগে, তবে আমি দিবো। আমি, যাকে জন্ম দিয়েছিল রক্তমণ্ডলের কেন্দ্রে!” সবাই থমকে যায়। এমনকি মেঘলাও।
মুনীন্দ্রর মুখে এবার স্নিগ্ধতা। “তুই নিজেই কি এই বলিদান চাইছিস?” সে জিজ্ঞাসা করে। ইরা মাথা নাড়ে, “না। আমি চাই উত্তর, আর তা পেতে চাই নিজের মতন করে—not your script.” তার গলার স্বর শক্তিশালী, চোখে লালছোঁয়া আলো। তখনই ঘটতে থাকে কিছু অস্বাভাবিক—গুহার দেয়ালে থাকা প্রতীকগুলো কাঁপতে শুরু করে, জলধারার মাঝে ঘূর্ণি উঠতে থাকে, আর ইরার কপালে এক বিন্দু রক্তচিহ্ন নিজে থেকেই ফুটে ওঠে—একটি প্রতিক্রিয়াশীল তিলক, যার তিনটি রেখা আলাদা আলাদা দিকে ছুটে যাচ্ছে। ঋজুদেব হতবাক, “এই চিহ্ন তো কোনো প্রাচীন পুঁথিতেও নেই!” গায়ত্রী তখন, গুহার মুখে এসে উপস্থিত হয়ে বলেন, “এই চিহ্ন তন্ত্রের নয়, এই চিহ্ন সময়ের প্রতিসরণ। এটা বোঝায়, শক্তি প্রতিরোধ করতে পারে, নির্মাণ করতে পারে, ধ্বংস নয়।” মুনীন্দ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গায়ত্রীকে দেখে বলেন, “তুমি থামাতে পারবে না। ষষ্ঠ দরজা তো খুলেই গেছে।” ঠিক সেই মুহূর্তে অভিজিৎ ছুটে আসে ইরার দিকে, কিন্তু হঠাৎ করে তার চোখে ভয় ফুটে ওঠে। “আমার দেহ… পুড়ছে…!” সে গুহার এক প্রান্তে ছিটকে পড়ে। তখনই দেখা যায়, ইরার চারপাশে গঠিত হয়েছে এক অদৃশ্য বলয়, যেটি আগুনকে প্রতিফলিত করছে, নিজেকে জ্বালাচ্ছে না।
ঋজুদেব বলেন, “ও আত্মবলিদান নয় দিয়েছে, ও আত্ম-রূপ প্রকাশ করেছে। ষষ্ঠ দরজা খোলেনি, বন্ধ হয়ে গেছে।” মুনীন্দ্র হতাশ, কিন্তু থামে না। সে মেঘলার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে, “তুই আমাদের বিশ্বাস ভেঙেছিস। এবার তোর রক্তই হবে সপ্তম দরজার চাবি।” কিন্তু মেঘলা এবার দাঁড়িয়ে যান, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি, কণ্ঠে আগুনের মতো শব্দ, “তোর রক্তই শুকিয়ে যাবে, মুনীন্দ্র। তুই যে তন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলি, সে তন্ত্র আজ তোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।” হঠাৎ করে মেঘলা নিজের কপালে ছুরি দিয়ে আঘাত করে, আর রক্তের একটি বিন্দু জলধারার মাঝে ফেলে দেন। গুহা কেঁপে ওঠে, জল ছিটকে পড়ে গুহার ছাদে, এবং এক প্রচণ্ড শব্দে আলো জ্বলে ওঠে—ধোঁয়ার ঘূর্ণি ঘন হয়ে গিয়ে গাঢ় অন্ধকারের মাঝে ঢেকে দেয় মুনীন্দ্র ও তার অনুগামীদের। গুহার প্রবেশপথ ধ্বসে পড়ে। অচিন্ত্য চিৎকার করেন, “ইরা, বেরিয়ে আয়!” এবং ঠিক তখনই ইরা গুহা থেকে বেরিয়ে আসে, হাত ধরে তার মায়ের, আর চোখে সেই দীপ্তি—যে জেনেছে, আত্মা কেবল জন্ম নয়, আত্মার দায়ও বইতে হয়।
৯
শুশুনিয়া গুহার ধ্বংসের পরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে গুজব—গভীর রাতের অরণ্যে কেউ নাকি আগুনের রেখায় কাউকে হাঁটতে দেখেছে, কেউ বলছে রক্তমাখা মুখে এক যুবক হেসে উঠে বলেছে, “এ তো শুরু মাত্র।” প্রশাসন গুহা এলাকাটি সিল করে দেয়, সংবাদমাধ্যমে বলা হয় “ভূমিধ্বস”, কিন্তু ইরার মুখের সামনে আর কোনও মুখোশ থাকে না। সে এখন জানে—তার জন্মের উৎস, তার মায়ের আত্মগোপন, এবং তন্ত্রের নকশায় তার নিজের জড়িয়ে পড়া—সবটাই এক দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ। কলকাতায় ফিরে অচিন্ত্য বসু ও ঋজুদেব তাকে নিয়ে এক গোপন জায়গায় থাকেন, লালবাজারের সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। ইরা বলে, “আমাকে আলাদা করে রাখবেন না। এখন আমি শুধু শিকার নই, আমি নিজেই অস্ত্র।” ঋজুদেব বলেন, “সপ্তম তিলক এখনও পড়েনি, আর ওইটাই সবকিছুর শেষ ও শুরু।” এদিকে গায়ত্রী দেবী একটি পুরোনো পুঁথির পাতার ইঙ্গিত দেন—যেখানে সপ্তম তিলকের বর্ণনা আছে। সেটি পাওয়া যায় এক নেপালি সন্ন্যাসীর কাছ থেকে, যার লেখা ছিল, “অন্তিম চক্রে দগ্ধ হয় না শুধু রক্ত, জ্বলে ওঠে সমস্ত জন্ম, সমস্ত পাপ।”
এদিকে গোপন ঘা থেকে আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় মুনীন্দ্র। গুহায় ধ্বংসের মুখে পড়ে গেলেও সে বেঁচে ছিল—তাকে উদ্ধার করে তারই অনুগামীদের এক গোষ্ঠী, যারা শহরের হাওড়া, কাশী, বারাণসী এমনকি কলকাতার কিছু স্কুল ও অদ্ভুত সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। মুনীন্দ্র জানে, তার ষষ্ঠ চক্র ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু সপ্তম তিলকই চূড়ান্ত জাগরণের সেতু। এবার তাকে প্রয়োজন এমন একজনের, যার মধ্যে সমস্ত তিলকের প্রতিফলন আছে—আর ইরাই সেই মানুষ। কিন্তু সে এখন জানে, জোর করে নয়, ইরার সম্মতি চাই। তাই সে অন্য রাস্তা নেয়। সে শুরু করে ইরার প্রিয় মানুষদের লক্ষ্য করা—তার বাবা, তার ছোটবেলার বন্ধু, এমনকি স্কুলের শিক্ষিকাদের ওপর নজর রাখা হয়। ঠিক তখনই অচিন্ত্য বসু খেয়াল করেন, শহরের নির্জন জায়গাগুলোয় রাতের বেলা অদ্ভুত কিছু জ্যোতিষ্ক, প্রতীক বা আগুনের রেখা আঁকা হচ্ছে। ক্রাইম ব্রাঞ্চ সেইসব চিহ্ন বিশ্লেষণ করে বুঝে যে, এগুলো হচ্ছে “আভিষেক চক্র”—যেখানে কোনও মানুষকে ‘সাধনপাত্র’ করে তৈরি করা হয় উৎসর্গের জন্য। এই চক্র যে ইরাকে ঘিরে আসছে, সে স্পষ্ট। তবে অদ্ভুতভাবে, ইরা এবার নিজেই অনুভব করতে থাকে কিছু। তার স্বপ্নে জ্বলছে আগুন, উঠে আসছে নামহীন মুখ, তার কপাল নিজে থেকেই গরম হয়ে ওঠে রাতে, আর আয়নায় সে নিজের প্রতিচ্ছবিতে দেখে লাল রেখা। মেঘলা সেন বলেন, “তুই পালিয়ে যাস না। তোর রক্তে যদি সত্যি কিছু থাকে, তবে তা নিঃশব্দে নয়, প্রতিধ্বনির সঙ্গে উঠুক।”
ইরার ভেতরে এবার যে শক্তি জাগে, তা শুধু প্রতিরক্ষা নয়—তা আত্মচেতনা। সে বলে, “তারা আমার জন্ম দিয়েছে তিলকের জন্য। আমি আমার অস্তিত্ব তৈরি করব তার উল্টো পথ ধরে।” গায়ত্রী দেবী বলেন, “তবে মনে রাখিস, সপ্তম তিলক ‘দেওয়া’ যায় না। এটি ‘ঘটে।’ কেউ কাউকে দেয় না, এটি জাগে আত্মার নিষ্পত্তিতে।” ঠিক তখনই শহরের এক প্রান্তে ঘটে এক অদ্ভুত মৃত্যু—এক খ্রিস্টান পাদ্রী, যার কপালে ছিল অর্ধেক জ্বলন্ত তিলক। তদন্তে জানা যায়, সেই পাদ্রী একসময় রত্নতন্ত্র চক্রের গুপ্ত সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর আগমুহূর্তে সে লিখে গেছেন, “তিলক এখন ছায়ার বাইরে। আত্মা তাকেই চায়, যে ভয় পায় না।” এটুকু প্রমাণ করে, মুনীন্দ্র এখনও চেষ্টা করছে চক্র পূর্ণ করার। কিন্তু এবার ইরার সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি নিজে যাব সপ্তম তিলকের সামনে। আমি নিজেকে নই, ওদের বিশ্বাসকেই প্রশ্ন করব।” ঋজুদেব বলেন, “তাই হলে পরবর্তী অধ্যায়, শুধু রহস্য নয়, হবে শুদ্ধিরও।”
১০
কলকাতার দক্ষিণে, আদিগঙ্গার ধারে এক নির্জন ঘাট। রাত গভীর। আকাশে চাঁদ নেই, বাতাস থমকে আছে, আর গাছের পাতাও যেন নিঃশব্দে প্রতীক্ষায়। সেই ঘাটে স্থাপন করা হয়েছে সাতটি মাটির প্রদীপ, প্রতিটি তিলকের প্রতীক হয়ে। আর মাঝখানে একটি রক্তরঞ্জিত আসন, যেখানে মুনীন্দ্র বসে আছেন ধ্যানস্থ। চোখ বন্ধ, কপালে আগুনের রেখা, আর চারপাশে তার নতুন অনুসারীরা। সে আজ চূড়ান্ত শক্তির আহ্বান জানাতে প্রস্তুত—শুধু অপেক্ষা, ইরার। গোপনে পৌঁছেছে অচিন্ত্য বসু, ঋজুদেব এবং মেঘলা সেনও। কিন্তু তারা জানে, এই কাজ বাইরের হাতে থামানো যাবে না—শুধু ইরাই পারবে, যার রক্তে রয়েছে প্রতিটি তিলকের প্রতিধ্বনি, প্রতিটি যন্ত্রণা, আর প্রতিটি প্রশ্ন। ইরা পৌঁছায় নিজের পায়ে, একা। তার চোখে ভয় নেই, বরং আছে এক রকম আত্মদীপ্যমান দৃঢ়তা, যেন এই যুদ্ধ তার মধ্যে বহুদিন আগে শুরু হয়েছিল।
মুনীন্দ্র চোখ খোলে। তার মুখে এক প্রশান্তি—যা বহুদিনের তপস্যা শেষে কোনও ঋষির মুখে ফুটে ওঠে। “তুই এলি,” সে বলে, “তোর আগমনের মধ্যেই আমাদের সিদ্ধি। তুই শুধু জন্মা নয়, তোকে জন্মানো হয়েছিলো। তুইই সপ্তম তিলক, তোর রক্তেই ছায়া পুড়বে।” ইরা থামে, আর বলে, “তোমরা চাইছো আমি মাথা নত করি, আমি মাথা তুলব। আমার জন্ম নিয়ে তোমাদের লিপি লেখার প্রয়োজন ছিল না। আমি লিখব আমার রক্ত দিয়ে, কিন্তু সেটা আত্মবলিদান নয়—সত্য প্রকাশ।” সে এগিয়ে যায় আসনের দিকে। তার কপালে ধীরে ধীরে রক্ত জমে—কোনও বাহ্যিক ছোঁয়া ছাড়াই একটি তিলক আঁকা হয়ে যায়। কিন্তু তা আগের ছয়টির মতো নয়। এই তিলক ত্রিকোণ নয়, চক্র নয়, নয় কোনো আগুনের রেখা। এটি একটি নির্ঘোষ বিন্দু—একটি রক্তচিহ্ন, যার কেন্দ্র থেকে আলো বেরোচ্ছে, আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে ছায়াগুলোর চিৎকার। মুনীন্দ্র চিৎকার করে ওঠে, “এটা সম্ভব নয়! এ তো তিলক নয়, এ তো ভাঙন!”
হ্যাঁ, সেটাই ছিল ভাঙন। রক্ততিলক শুধু শক্তির আহ্বান নয়, আত্মার বিচারও বটে। ইরার আত্মচেতনার আগুন সেই বিচার এনে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে বাতাস বদলে যায়, প্রদীপগুলো নিভে যায় একে একে। চারপাশের অনুসারীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, যেন কোনও অদৃশ্য ধ্বংসতরঙ্গ তাদের চেতনায় আঘাত করেছে। মুনীন্দ্রর মুখের আগুন এবার ছায়ায় পরিণত হয়—তার চেহারায় একটা ভাঙা, অসহায় বিস্ময় ফুটে ওঠে। সে বলে, “তুই তো আমাদের রত্ন, তুই কেন এমন করলি?” ইরা বলে, “রত্ন তো জ্বলে আলো দেয়। তুমি আমাকে অন্ধকারে খুঁজেছিলে, আমি নিজেই আলো হয়ে উঠলাম।” মেঘলা এগিয়ে এসে মুনীন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলেন, “আমার মেয়েকে তুই সৃষ্টি করিসনি, সে সৃষ্টি করেছে নিজেকে।” সেই মুহূর্তে, আকাশে এক ঝলক বিজলি, আর নদীর ধারে এক সময়কার প্রাচীন রত্নতন্ত্র চক্র চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়। মুনীন্দ্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, এক বিন্দু রক্ত তার কপাল বেয়ে ঝরে পড়ে, কিন্তু এই রক্ততিলক আর কোনও শক্তি জাগায় না, বরং এক গভীর নিঃশ্বাস হয়ে মিলিয়ে যায় শূন্যে।
—
শেষ