Bangla - তন্ত্র

রক্তছাই

Spread the love

অরিত্র ভট্টাচার্য


 

পর্ব ১: নিশির আহ্বান

পূর্ব ভারতের গভীর এক প্রাচীন গ্রাম, নাম তার ঝোপশিরি। চারপাশে ঘন সেগুন, শাল, আর মহুয়া গাছের জঙ্গল; গ্রামের ঘরগুলো খড়ের ছাউনি দেওয়া, কাদামাটির দেয়ালে শ্যাওলা জমে আছে। দিনের বেলায় এই গ্রামকে নিরীহ মনে হলেও, সন্ধ্যা নামলেই এক অদ্ভুত সন্ত্রস্ত ভাব নেমে আসে। বাচ্চারা আঁচল আঁকড়ে ধরে মায়ের পাশে বসে থাকে, পুরুষেরা দাওয়ায় মশারি গুটিয়ে মন্ত্র পড়ে আগুন জ্বালায়, আর নারীরা খুব গোপনে দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়। তারা জানে, এই অরণ্যের ভেতর কিছু আছে—যা মানুষ নয়, আবার সম্পূর্ণ অতিপ্রাকৃতও নয়।

অয়ন কলকাতার এক তরুণ গবেষক। বয়স উনত্রিশ, কপালে হালকা ভাঁজ, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। লোককথা ও প্রাচীন তান্ত্রিক সাধনার উপর তার গবেষণার বিষয়। বহুদিন ধরে সে ঝোপশিরির নাম শুনেছে—কোথাও পাওয়া যায় না এমন কিছু পুঁথি নাকি এই গ্রামেই লুকিয়ে আছে, আর আছে এক রহস্যময় অগ্নিমান্ডলের কাহিনি। প্রথমবারের মতো সে এই গ্রামে এল এক বর্ষার সন্ধ্যায়। বাস থেকে নামতেই তার গায়ে সোঁদা গন্ধ মাখা বাতাস এসে লাগল। কাদা ভিজে আছে, চারপাশের বনভূমি গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।

গ্রামে ঢুকে সে প্রথমেই লক্ষ্য করল লোকজন তাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে। যেন বাইরের মানুষ এখানে স্বাগত নয়। একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “কোথা থেকে এসেছ?”
অয়ন বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিল, “কলকাতা থেকে। গবেষণার কাজ করছি। এই অঞ্চলের লোককথা নিয়ে পড়াশোনা করি।”
বৃদ্ধ চোখ সরু করে তার দিকে তাকালেন, বললেন, “গবেষণা করতে হলে অনেক দূরে যাও। ঝোপশিরি তোর জায়গা নয়।”

কথাটা শুনে অয়নের ভেতরে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। যখন কেউ কোনো জায়গা নিয়ে এভাবে গোপনীয়তার আবরণ চাপায়, তখনই সে বুঝতে পারে সেখানে সত্যিই কিছু আছে।

সন্ধ্যা গভীর হতে থাকল। অয়ন একটা ভাঙাচোরা কুটিরে উঠল—গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের বাড়ি, যিনি শহর থেকে আসা মানুষদের সামান্য ভাড়া নিয়ে রাখেন। কুটিরে বিছানার পাশে পুরোনো হারিকেন, দেয়ালে ফাটল দিয়ে ঢুকে পড়া কেঁচো আর টিকটিকি। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ যেন আরও ভয়াল করে তুলছে রাতকে।

অয়ন চা খেতে খেতে তার ডায়েরি বের করল। লিখল—
“ঝোপশিরি গ্রাম। আজ রাত থেকেই অনুভব করছি, এখানে বাতাস ভারী, যেন অদৃশ্য কোনো উপস্থিতি চাপিয়ে রেখেছে আকাশকে।”

তখনই হঠাৎ সে এক অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে মনে হল বাতাসের শিস, কিন্তু পরক্ষণেই শব্দটা স্পষ্ট হয়ে উঠল—এক নারী কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ। অয়ন থমকে গেল। অন্ধকারে জানালা দিয়ে তাকাতেই সে দেখল দূরে বনপথ ধরে সাদা শাড়ি পরা এক নারী হাঁটছে। তার ঠোঁট নড়ছে, শব্দ ভেসে আসছে—অদ্ভুত, অচেনা ভাষার মন্ত্র।

অয়নের শরীর কেঁপে উঠল, অথচ ভয় নয়—বরং প্রবল কৌতূহল তাকে এগোতে বাধ্য করল। সে হারিকেন হাতে বেরিয়ে পড়ল কুটির থেকে।

বৃষ্টিভেজা কাদা মাড়িয়ে সে ধীরে ধীরে নারীটির পিছু নিল। নারীটি জঙ্গলের গভীরে ঢুকে গেল, আর তার কণ্ঠের মন্ত্র যেন বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। মাঝে মাঝে অয়ন অনুভব করল, তার হারিকেনের আলো নিভে যাবে হয়তো, কারণ বাতাস অস্বাভাবিকভাবে ঘুরছে।

একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছেই নারীটি দাঁড়িয়ে গেল। অয়ন গাছের আড়াল থেকে তাকাল। সে দেখল মাটির উপর যেন এক অদৃশ্য বৃত্ত, যেখানে বৃষ্টি পড়লেও শুকনো রয়ে যাচ্ছে। নারীটি বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাত আকাশের দিকে তুলেছে। তার গলার স্বর ক্রমে চিৎকারে পরিণত হচ্ছে। হঠাৎ বজ্রপাত হল, আর সেই আলোয় অয়ন পরিষ্কার দেখতে পেল—নারীর চোখ দুটো রক্তলাল।

এক মুহূর্তের জন্য অয়ন ভেবে নিল, এ কি তার বিভ্রম? কিন্তু না—নারীটি তখনই তার দিকে তাকাল। যেন অন্ধকার ভেদ করে তার দৃষ্টির উপর আঘাত করল সে। অয়ন কেঁপে উঠল। কিন্তু নারীর ঠোঁট নড়ে উঠল—“এসো।”

অয়ন ভয়ে পিছিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু তার পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। নারীটি আবারও বলল, “এসো। অগ্নিচক্র তোমার অপেক্ষায়।”

ঠিক তখনই অয়নের কানে এল গ্রামের ঘণ্টার শব্দ। হয়তো রাতের পূজোর সময় হয়েছে। কিন্তু সেই শব্দে নারীটির মুখ বিকৃত হয়ে গেল, চোখ জ্বলে উঠল আগুনের মতো, আর হঠাৎ করেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু মাটির উপর অদ্ভুত ছাইয়ের রেখা থেকে গেল—একটা বৃত্ত, যেখানে যেন আগুন নেই অথচ পোড়া গন্ধ স্পষ্ট।

অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে কুটিরে ফিরে এল। হারিকেনের আলো কাঁপছিল, যেন ভয়ে কেঁপে উঠছে। বিছানায় বসে সে ডায়েরি খুলল আবার। লিখল—
“আজ আমি দেখলাম, ঝোপশিরির অরণ্যে কেউ আছে। হয়তো মানুষ নয়, হয়তো অন্য কিছু। সে আমাকে ডেকেছে। নাম শুনলাম—অগ্নিচক্র।”

কাগজে লেখা শেষ করতেই অয়ন বুঝল, বাইরে আবার সেই কণ্ঠ ভেসে আসছে—মন্ত্রোচ্চারণ। কিন্তু এ বার কণ্ঠটা কেবল তার কানে নয়, তার মনের ভেতরও প্রবেশ করছে।

সে আলো নিভিয়ে অন্ধকারে বসে রইল। জানত, এই রাতটা ঝোপশিরিতে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।

 

পর্ব ২: অগ্নিচক্রের রেখা

পরদিন ভোরে অয়ন ঘুম ভাঙল ভেজা কাদার গন্ধে। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু আকাশে মেঘের স্তূপ জমে আছে। কুটিরের বাইরে বেরোতেই সে দেখল গ্রামের লোকজন তাদের স্বাভাবিক কাজ করছে, কিন্তু মুখে চাপা আতঙ্ক। যেন সবাই খুব তাড়াতাড়ি সব সেরে ঘরে ঢুকে পড়তে চায়।

অয়ন স্থানীয় পুরোহিতের সঙ্গে দেখা করতে গেল। পুরোহিত গাঢ় লাল পোশাক পরে বসেছিলেন মাটির মন্দিরের বারান্দায়। তাঁর চুল পাকধরা, চোখে গভীর রেখা। অয়ন ভদ্রভাবে প্রণাম করতেই পুরোহিত জিজ্ঞেস করলেন, “কোথা থেকে আসা?”
অয়ন বলল, “কলকাতা থেকে এসেছি। লোককথা আর তন্ত্রসাধনা নিয়ে গবেষণা করি।”
পুরোহিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “ঝোপশিরিতে গবেষণা মানে অগ্নির সঙ্গে খেলা করা। এখানে এমন কিছু আছে, যা বাইরের মানুষ বোঝে না। বেশি অনুসন্ধান করো না।”

অয়ন দ্বিধায় পড়ল। তবে ভেতরের কৌতূহল তাকে ছাড়ল না। সে সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “অগ্নিচক্র নামটা কি এখানে প্রচলিত?”
পুরোহিতের মুখ হঠাৎ থমকে গেল। তিনি কপালে হাত দিয়ে বললেন, “সে নাম নিও না। অগ্নিচক্র মানে অসমাপ্ত সাধনা। যে একবার তার মধ্যে ঢোকে, সে আর ফিরতে পারে না। ঝোপশিরির জঙ্গলে এখনও তার ছায়া আছে।”

অয়ন কিছু না বলে সরে গেল। কিন্তু মনে এক অদ্ভুত টান অনুভব করতে লাগল। যেন ‘অগ্নিচক্র’ শব্দটাই তার শরীরের মধ্যে ঢুকে গেছে।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। অয়ন কুটির থেকে বেরিয়ে আবার জঙ্গলের দিকে গেল। গতরাতের সেই জায়গাটা খুঁজতে খুঁজতে সে পৌঁছে গেল বনভূমির এক ফাঁকা অংশে। চারপাশে ভেজা মাটি, মশার গুনগুনানি, আর বাতাসে একধরনের গুমোট গন্ধ।

ঠিক মাঝখানে সে দেখল একটা গোলাকার ছাইয়ের রেখা। বৃত্তটা যেন খুব যত্ন করে আঁকা হয়েছে, অথচ আগুনের ছোঁয়া কোথাও নেই। অয়ন হাঁটু গেড়ে কাছে গিয়ে মাটি ছুঁলো। ছাই তার আঙুলে লেগে গেল, কিন্তু ছাইয়ের গন্ধে স্পষ্টভাবে ধোঁয়া নেই—বরং একধরনের মিষ্টি গন্ধ, যেন পুরোনো ধূপকাঠি পুড়েছে।

সে মনে করল, গতরাতে নারীর চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল এই বৃত্তের ভেতরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ যেন বৃত্তের ভেতর থেকে বাতাস উঠল। অয়নের হারিকেন নেই, তবু আকাশ মেঘে ঢাকা হয়ে অন্ধকার নেমে এলো।

সে ডায়েরি খুলে ছাইয়ের বৃত্তের ছবি আঁকতে লাগল। তখনই কানে ভেসে এল ফিসফিসানি—
“অগ্নিচক্র অসম্পূর্ণ। শেষ করো।”

অয়ন আতঙ্কে চারপাশে তাকাল। কেউ নেই। শুধু বাতাস থেমে গেছে, পাখির ডাক থেমে গেছে। গাছপালার পাতাও নড়ছে না। যেন পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেছে।

একটা বজ্রপাত হঠাৎ আকাশ ছিঁড়ে পড়ল। সেই আলোয় অয়ন দেখতে পেল ছাইয়ের বৃত্তের ভেতর ছায়ার মতো এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা চুল, শরীর ঝাপসা, চোখ দুটো অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। মূর্তিটি হাত তুলে বলল—“তুমি আমার উত্তরাধিকার।”

অয়ন কেঁপে উঠল, তবু কৌতূহল জিতল। সে কাঁপা গলায় বলল, “কে তুমি?”
উত্তর এল—“ভৈরবানন্দ।”

নামটা উচ্চারিত হতেই চারপাশে শিহরণ জেগে উঠল। অয়ন অনুভব করল তার বুক ধড়ফড় করছে। নামটা সে আগে কোনো বইতে পড়েছে মনে হচ্ছে, কিন্তু এখন মনে করতে পারছে না।

ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে উঠল। বাতাস বইতে লাগল, গাছের পাতায় ঝিরঝির শব্দ। কিন্তু ছাইয়ের বৃত্ত যেন আরও ঘন হয়ে অয়নকে ডেকে চলল।

সে দ্রুত কুটিরে ফিরে এল। হাত কাঁপছিল, ডায়েরিতে লিখল—
“আজ আমি অগ্নিচক্রকে স্পর্শ করেছি। এক ছায়া আমাকে ডাকল, বলল তার নাম ভৈরবানন্দ। কে ছিল এই মানুষ? কেন তার সাধনা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল?”

রাত নামতেই আবার অদ্ভুত স্বপ্ন এল। স্বপ্নে সে দেখল, এক তান্ত্রিক আগুনের চারপাশে বসে আছে। তার শরীরে ভস্ম মাখানো, কপালে লাল টিপ। বজ্রপাতের শব্দে তার দেহ ভস্ম হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার ঠোঁট এখনও মন্ত্রোচ্চারণ করছে। স্বপ্নে অয়ন চিৎকার করে উঠল—“থামো!” কিন্তু কণ্ঠস্বর বেরোল না।

চোখ মেলতেই দেখল, কুটিরের জানালার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে না। বাইরে পূর্ণ অন্ধকার। অথচ দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে সেই একই মন্ত্রধ্বনি—
“অগ্নিচক্র অসম্পূর্ণ… শেষ করো… শেষ করো…”

অয়ন বুঝল, ঝোপশিরিতে তার থাকা আর সাধারণ গবেষণা নয়। তাকে কোনো শক্তি বেছে নিয়েছে।

 

পর্ব ৩: গুপ্ত মন্ত্রপাঠ

ঝোপশিরির সকাল অয়নকে অদ্ভুত ভারী লাগছিল। পাখির ডাক থাকলেও বাতাসে একটা অস্পষ্ট নিস্তব্ধতা। গ্রামবাসীরা তাকে এড়িয়ে চলে, কেউ সেভাবে কথা বলে না। কিন্তু গ্রামের এক বৃদ্ধা, নাম তার শশিবালা, দুপুরে কুটিরে এসে হাজির হলেন। মাথায় সাদা আঁচল, চোখে ঝাপসা ছানি, কিন্তু কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা।

“বাবু, তুমি যেটা খুঁজছ, সেটা সহজে পাবা না,” তিনি বললেন।
অয়ন অবাক হয়ে তাকাল। “আপনি জানেন আমি কী খুঁজছি?”
বৃদ্ধা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ভৈরবানন্দকে যে ভুলে গেছে, সেই মানুষকে আর রক্ষা করতে পারে না কেউ। তুমি গতরাতে তার ডাক পেয়েছ, তাই না?”

অয়ন থমকে গেল। অবাক বিস্ময়ে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। নামটা শুনেছি।”
শশিবালা মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন, “ভৈরবানন্দ ছিল এই গ্রামের তান্ত্রিক। এক অগ্নিমান্ডল তৈরি করে সে চাইছিল দেবীকে আহ্বান করতে। কিন্তু বজ্রপাতের রাতে, সাধনার মাঝেই আগুনে তার দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কেউ জানে না তার আত্মা কোথায় গেছে। তবে গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করে, তার মন্ত্র অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। সেই কারণেই এই বন আজও অভিশপ্ত।”

অয়নের শরীরে কাঁপুনি উঠল। তবু প্রশ্ন করল, “কিন্তু আমি কেন? কেন আমাকে সে ডাকছে?”
বৃদ্ধা তাকালেন তার দিকে। “তুমি এসেছ গবেষণার নাম করে, কিন্তু তোমার ভেতরে অন্য এক খিদে আছে—জানার, ছোঁয়ার, অন্ধকারকে ভেদ করার খিদে। ভৈরবানন্দ সেই খিদেকে চিনেছে।”

অয়ন কিছু বলতে পারল না। শুধু শশিবালার চোখের ভেতর এক অদ্ভুত আলোকরেখা দেখতে পেল।

সন্ধ্যা গড়াল। অয়ন ঠিক করল আজ সে ভগ্ন মন্দিরে যাবে—যেটা গ্রাম থেকে আধ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের ভেতর। কথিত আছে, সেখানেই ভৈরবানন্দের সাধনা শুরু হয়েছিল।

হারিকেন হাতে নিয়ে সে অন্ধকারে পথ চলতে লাগল। কাদা, ঝোপঝাড়, পোকামাকড় সব সত্ত্বেও তার মনে হচ্ছিল, কেউ তাকে দিকনির্দেশ করছে।

হঠাৎই জঙ্গল ভেদ করে এক ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ল। ভগ্ন মন্দির—দেয়ালগুলো ভেঙে পড়েছে, মূর্তি মাথাহীন, শ্যাওলা আর লতাগুল্মে ঢেকে গেছে সব। মন্দিরের ভেতর ঢুকতেই অয়ন কানে শুনল এক অদ্ভুত শব্দ। যেন অদৃশ্য কেউ মন্ত্র জপ করছে।

“ওঁ অগ্নি… জ্যোতি… অমর…”

শব্দটা প্রতিধ্বনির মতো বারবার ফিরে আসছিল। অথচ মন্দির ফাঁকা। অয়ন হারিকেন উঁচিয়ে চারদিকে আলো ফেলল। কোথাও কেউ নেই।

তখন তার চোখে পড়ল মন্দিরের মেঝেতে কিছু অক্ষর খোদাই করা। অতি পুরোনো সংস্কৃত লিপি, অর্ধেক মুছে গেছে। অয়ন ঝুঁকে পড়ল, ডায়েরিতে নোট করতে লাগল। কিন্তু যতই পড়ছে, ততই শব্দগুলো তার শরীর কাঁপিয়ে তুলছে।

হঠাৎ অয়ন অনুভব করল, তার ঠোঁট নিজে থেকেই নড়ে উঠছে। সে বুঝতে পারছে না কেন, কিন্তু সে নিজেই মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করেছে—
“ওঁ অগ্নি… জ্যোতি… অমর…”

তার কণ্ঠে সেই মন্ত্র বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ঘূর্ণির মতো উঠল। হারিকেনের আলো নিভে গেল। মন্দিরের অন্ধকার যেন দম বন্ধ করে দিল।

অয়ন হাত কাঁপিয়ে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু তখনই সে দেখল—ভগ্ন মূর্তির ছায়া থেকে এক অদ্ভুত আকার বেরিয়ে আসছে। কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “মন্ত্র তুমি শেষ করবে। অসম্পূর্ণতা ঘুচবে।”

অয়ন দম নিতে পারছিল না। গলা শুকিয়ে আসছিল। সে চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। তার চোখের সামনে দৃশ্যটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল—মন্দিরের ভাঙা স্তম্ভে আগুনের রেখা আঁকা হয়ে যাচ্ছে, যেন অগ্নিমান্ডল নিজেই পুনরায় জীবিত হচ্ছে।

মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, সে যদি এক কদম এগোয় তবে এই অগ্নিচক্রের ভেতরেই ঢুকে যাবে। কিন্তু তখনই বজ্রপাতের আলোয় পুরো জঙ্গল কেঁপে উঠল। ভয়ের চোটে অয়ন পিছিয়ে পড়ল। আবার সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

শ্বাসকষ্টে ভুগতে ভুগতে সে কুটিরে ফিরে এল। কপালে ঘাম, হাতে এখনও ছাইয়ের দাগ। ডায়েরি খুলে কাঁপা হাতে লিখল—
“আজ আমি মন্ত্র উচ্চারণ করেছি, যদিও নিজের ইচ্ছায় নয়। কেউ যেন আমাকে দিয়ে করিয়েছে। ভগ্ন মন্দির এখনও জীবিত। ভৈরবানন্দ এখনও অমর।”

আকাশে তখন বজ্র গর্জে উঠল। অয়ন জানত, এ কেবল শুরু।

 

পর্ব ৪: রক্তের আহুতি

ঝোপশিরির রাতগুলো যেন দিন দিন আরও অস্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। অয়ন যত দিন এখানে থাকছে, তার আশেপাশের বাতাস ততই ভারী হয়ে আসছে, যেন কোনো অদৃশ্য চক্র ধীরে ধীরে তাকে আবৃত করছে। ভগ্ন মন্দিরে মন্ত্রোচ্চারণের অভিজ্ঞতা তার মাথায় এখনো বাজছে। চোখ বন্ধ করলেই সেই লিপির অক্ষর ভেসে ওঠে, আর ঠোঁট অজান্তেই নড়ে ওঠে।

এক সন্ধ্যায়, যখন আকাশে চাঁদ ঝাপসা হয়ে উঠেছে মেঘের আড়ালে, শশিবালা তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন গ্রামপ্রান্তের এক গোপন উঠোনে। চারপাশ ঘন বাঁশঝাড়ে ঢাকা, মাঝখানে ছোট্ট মাটির চাতাল। অয়নের বিস্ময়ের শেষ রইল না—ওখানে জড়ো হয়েছে কয়েকজন পুরুষ, কারও চোখে আতঙ্ক, কারও চোখে এক ধরনের উন্মাদনা।

চাতালের উপর রাখা ছিল একটা পেতলের থালা। থালায় লাল রঙের তরল ভরে আছে। অয়ন প্রথমে ভেবেছিল রঙ বা সিঁদুর, কিন্তু শশিবালা ফিসফিস করে বললেন, “এটা পশুর রক্ত। ভৈরবানন্দের আহুতি আজও চলে। আমরা প্রতি অমাবস্যায় রক্ত ঢালি, যাতে তার আত্মা শান্ত হয়।”

অয়ন গলা শুকিয়ে গেল। তার বৈজ্ঞানিক মন বলল, এগুলো নিছক গ্রাম্য কুসংস্কার। কিন্তু মনের গভীরে আরেকটা কণ্ঠ বলল—না, এ কেবল প্রথা নয়। এ এক অসমাপ্ত শক্তির খিদে।

একজন পুরুষ সামনে এগিয়ে গিয়ে থালার রক্ত মাটির বৃত্তে ঢেলে দিল। মাটির উপরে যে বৃত্ত তৈরি হল, তা অয়নের কাছে অদ্ভুতভাবে পরিচিত মনে হল। হ্যাঁ—এ তো সেই ছাইয়ের বৃত্ত, অগ্নিচক্র!

হঠাৎই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কুকুরের ডাক, পাতার শব্দ—সব বন্ধ। অয়ন স্পষ্ট শুনতে পেল সেই পুরোনো মন্ত্র—
“ওঁ অগ্নি… জ্যোতি… অমর…”

কিন্তু এ বার শব্দটা চারদিক থেকে আসছে, যেন অদৃশ্য বহু কণ্ঠ একই সঙ্গে উচ্চারণ করছে। পুরুষেরা চোখ বন্ধ করে মন্ত্রে যোগ দিল। শশিবালা অয়নকে ঠেলে চাতালের কাছে নিয়ে গেলেন।

“তুই নির্বাচিত, বুঝলি? ভৈরবানন্দের সাধনা শেষ করার দায় তোরই। পশুর রক্ত আর চলবে না। তোর রক্ত চাই।”

অয়ন আঁতকে উঠল। “কি বলছেন আপনি! আমি তো গবেষক—”
শশিবালা তাকে থামিয়ে দিলেন। “না, তুই শুধু গবেষক নস। তুই তার উত্তরাধিকার।”

অয়নের বুক কেঁপে উঠল। সে বুঝল, গ্রামের এই মানুষরা তাকে আর বাইরের কেউ ভাবছে না। তারা তাকে ভাবছে সেই তান্ত্রিক সাধনার অংশ।

বৃত্তের ভেতর হঠাৎ শিখার মতো আলো জ্বলে উঠল। রক্ত যেন আগুনে রূপান্তরিত হচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য অয়ন স্পষ্ট দেখল—ভেতর থেকে এক মুখ ভেসে উঠেছে। সেই মুখ ভৈরবানন্দের, ভস্মমাখা শরীর, রক্তলাল চোখ।

অয়ন দৌড়ে পালাতে চাইলো, কিন্তু তার পা যেন শিকলে বাঁধা। শরীর ভারী হয়ে আসছে। কেউ তাকে ধরে রাখেনি, অথচ সে নড়তে পারছে না। ভৈরবানন্দের কণ্ঠ তার কানে ভেসে এলো—
“তোর রক্ত ছাড়া আমার সাধনা পূর্ণ হবে না।”

অয়ন চিৎকার করে উঠল, কিন্তু গলায় যেন শব্দ আটকে গেল। এক অদ্ভুত যন্ত্রণায় তার বুক ফেটে আসছে। হঠাৎই তার ডান হাতের তালুতে তীব্র ব্যথা অনুভব করল। চোখ নামাতেই দেখল—হাত থেকে এক ফোঁটা রক্ত পড়ছে মাটিতে।

সেই ফোঁটা পড়া মাত্র বৃত্তের আলো তীব্র হয়ে উঠল। পুরুষেরা আরও উন্মত্তভাবে মন্ত্রপাঠ করতে লাগল। শশিবালা দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন, কিন্তু তার কান্না যেন আনন্দের।

অয়ন বুঝতে পারল—এই মুহূর্তে তার রক্ত ভৈরবানন্দের সাধনাকে পুনর্জীবিত করছে। কিন্তু তার ভেতরে অন্য এক শক্তি জেগে উঠল। সে হঠাৎ সমস্ত জোর দিয়ে চিৎকার করল—“থামো!”

অদ্ভুতভাবে মন্ত্রপাঠ থেমে গেল। বাতাস স্থির হয়ে গেল। আর বৃত্তের আলো নিভে গিয়ে মাটি আবার অন্ধকারে ঢেকে গেল।

সবাই হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। অয়ন কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ল। হাতের রক্ত থেমে গেছে, কিন্তু ব্যথা থেকে যাচ্ছে।

শশিবালা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বললেন, “তুই থামালিস… মানে তোর ভেতরে শক্তি আছে। সে তোকে মান্য করেছে।”

অয়ন মাথা ঘুরতে ঘুরতে বুঝল—সে আর আগের মতো গবেষক নেই। সে এখন এক খেলার মধ্যে ঢুকে গেছে, যেখানে জীবন আর মৃত্যু সমান দামে বিকোচ্ছে।

সে কুটিরে ফিরে এল ভোর হওয়ার আগেই। জানত, এ ঘটনা কাউকে বোঝানো যাবে না। ডায়েরি খুলে লিখল—
“আজ আমার রক্ত পড়েছে অগ্নিচক্রে। আমি থামিয়েছি, তবু জানি, এটা কেবল সময়ের খেলা। আমি হয়তো ধীরে ধীরে টেনে নেওয়া হচ্ছি এক অদৃশ্য পথে, যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়।”

আকাশের গায়ে তখন প্রথম সূর্যের আলো ফুটছে। কিন্তু অয়নের চোখে শুধু আগুনের লালচে রেখা ভাসছে।

 

পর্ব ৫: ছায়ার সংসর্গ

ঝোপশিরির দিন যত গড়াচ্ছিল, অয়ন অনুভব করছিল তার প্রতিটি পদক্ষেপে কেউ যেন অদৃশ্যভাবে অনুসরণ করছে। রাতে সে যতই দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখুক, ভেতরে অদ্ভুত হাওয়া ঢুকে পড়ত, হারিকেনের আলো কেঁপে উঠত, আর তার বুকের ভেতর থেকে বেরোত অজানা আতঙ্কের ঘাম।

চতুর্থ রাতের দিকে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে অয়ন অনুভব করল—কেউ তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হারিকেন নিভে গেছে। কেবল অন্ধকারে ফিসফিস শব্দ—
“শক্তির পথ কষ্টের পথ…”

অয়ন হঠাৎ চমকে উঠে তাকাল। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো আসছিল, সেই আলোয় সে দেখল নিজের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এ প্রতিচ্ছবি আয়নায় নয়—ওটা যেন ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে। অয়নই, অথচ নয়। চোখ দুটো রক্তিম, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি।

“কে তুমি?” কাঁপা গলায় অয়ন বলল।
প্রতিচ্ছবিটি মৃদুস্বরে উত্তর দিল, “আমি তোর ছায়া। ভৈরবানন্দের সাধনা অসম্পূর্ণ ছিল, তাই আমাকে তোর শরীরে পাঠানো হয়েছে।”

অয়ন ভয়ে বিছানার কোণে সরে গেল। “আমি চাই না এসব। আমি গবেষক, আমি শুধু জানতে এসেছি।”
ছায়াটি এগিয়ে এল। তার চোখে আগুনের শিখা দপদপ করছিল। “তুই চাইলি বা না চাইলি, তোকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তোর শরীর, তোর রক্ত, তোর কণ্ঠ—সবই এখন মন্ত্রের অংশ।”

অয়ন ঠোঁট শুকনো হয়ে গেলেও সাহস করে বলল, “যদি আমি অস্বীকার করি?”
ছায়াটি হেসে উঠল, হাড় ভাঙার মতো শব্দে। “অস্বীকার মানে মৃত্যু। গ্রহণ মানে অমরত্ব। বেছে নে।”

কথা শেষ হতেই ছায়াটি মিলিয়ে গেল। কিন্তু অয়ন বুঝতে পারল, সে আসলে মিলিয়ে যায়নি। ছায়াটি এখন তার ভেতরেই ঢুকে গেছে। বুকের গভীরে এক অদ্ভুত ভার সে অনুভব করল, যেন তার শ্বাস-প্রশ্বাসও আর কেবল তার নিজের নয়।

পরদিন সকাল। গ্রামবাসীরা স্বাভাবিক কাজকর্ম করছে, অথচ তাদের চোখে যেন অয়নকে দেখে ভয়। শিশুেরা কাছে আসে না, নারীরা তার পথ এড়িয়ে যায়। অয়ন বুঝতে পারল—গ্রামের সবাই জানে, সে আর কেবল বাইরের মানুষ নেই। সে এখন এক অদ্ভুত রূপান্তরের পথে।

ডায়েরিতে লিখতে বসে তার হাত কাঁপছিল। কলম দিয়ে লিখল—
“আমার ভেতর কেউ আছে। ছায়া। সে বলে, আমি বেছে নেওয়া। ভয় পাচ্ছি, তবে এ ভয়েও এক অদ্ভুত আকর্ষণ আছে।”

সন্ধ্যায় সে আবার ভগ্ন মন্দিরে গেল। সূর্যাস্তের আলো গাছের ডালে ঝুলে আছে, পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। মন্দিরের ভেতরে ঢুকতেই অয়ন অনুভব করল বুকের ভেতর ছায়াটি ফিসফিস করছে—
“দেখিস, আজ তোকে কিছু শেখাব।”

মন্দিরের ভাঙা মেঝেতে বসতেই চারপাশে অদৃশ্য মন্ত্রধ্বনি শুরু হল। অয়ন অবাক হয়ে দেখল, তার ঠোঁট নিজে থেকেই নড়ছে, অচেনা শব্দ বেরিয়ে আসছে—
“ওঁ হ্রীং ক্রীং অগ্নি-শক্তি স্বাহা…”

শব্দগুলো সে কখনো শোনেনি, কিন্তু যেন জন্মগতভাবে জানত। ছায়া তাকে দিয়ে উচ্চারণ করাচ্ছে। আর সেই মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের ভেতর হালকা শিখা জ্বলে উঠল।

অয়ন ভয়ে হারিকেন ফেলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ছায়ার কণ্ঠ তার ভেতর থেকে গর্জে উঠল—“থামিস না! এগো!”

অগ্নিশিখা ধীরে ধীরে আকার নিল। শিখার ভেতর থেকে কয়েকটি হাত বেরিয়ে এল, যেন মৃত মানুষের হাত। তারা অয়নের দিকে বাড়িয়ে দিল হাত, আঙুলগুলো জ্বলছে আগুনে। অয়ন শিউরে উঠল, তবু তার হাত অদৃশ্য শক্তিতে বাধ্য হয়ে সামনে গেল। মুহূর্তের জন্য সে সেই আগুনের হাত ছুঁয়ে ফেলল।

এক তীব্র দাহ বুক ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ব্যথা নয়, বরং অদ্ভুত শক্তির স্রোত অনুভূত হল। চোখে ঝলসে উঠল আগুনের রেখা, মাথার ভেতর ভৈরবানন্দের হাসি প্রতিধ্বনিত হল।

মন্ত্র থেমে গেল। আলো নিভে গেল। মন্দির আবার অন্ধকারে ঢেকে গেল। কিন্তু অয়ন বুঝল—সে আর আগের মতো নেই। তার ভেতর ছায়াটি স্থায়ী হয়ে গেছে।

কুটিরে ফিরে এসে সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের চোখে তাকিয়ে দেখল, চোখের সাদা অংশে হালকা লালচে রেখা ভেসে উঠেছে। শরীর ক্লান্ত, অথচ মনে হচ্ছে অদ্ভুত শক্তিতে ভরে আছে।

হারিকেনের আলোয় সে লিখল—
“আজ আমি ছায়াকে গ্রহণ করেছি। ভয় আর কৌতূহল মিলেমিশে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে এক গভীর পথে। আমি জানি না, এ পথ মৃত্যু নাকি অমরত্বের।”

বাইরে তখন হাওয়া বইছিল। কিন্তু অয়নের মনে হচ্ছিল, সেই হাওয়া আর প্রকৃতির নয়—এটা ছায়ার নিশ্বাস, যা এখন তার সঙ্গে মিশে গেছে।

 

পর্ব ৬: দীক্ষার আচার

অয়নের শরীর আর মন দিন দিন বদলাতে লাগল। একসময় যে সে ছিল শহুরে তরুণ গবেষক, এখন সে নিজের প্রতিচ্ছবি চিনতে পারে না। ভগ্ন মন্দিরের আগুনের হাত ছোঁয়ার পর থেকে তার শিরায় রক্ত যেন অন্য ছন্দে বইছে। কখনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়, বুকের ভেতর আগুনের মতো দপদপ করে, আর তার ঠোঁট থেকে অজান্তেই বেরিয়ে আসে মন্ত্র।

এমন এক রাতে, দরজায় হালকা শব্দ হল। বাইরে তাকিয়ে অয়ন দেখল, শশিবালা দাঁড়িয়ে আছে। কণ্ঠ ভারী, “সময় এসেছে। দীক্ষার জন্য তোকে ডাকা হয়েছে।”

অয়ন চুপচাপ তার পিছু নিল। বাঁশঝাড়ের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে তারা পৌঁছাল গ্রামের এক গোপন প্রান্তে। চারপাশে অন্ধকার, কেবল কিছু মশালের আলো দপদপ করছে। মশালের চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুরুষ আর নারী, চোখে এক ধরনের মগ্নতা। মাঝখানে মাটির চাতাল, তাতে সাতটি বৃত্ত আঁকা—প্রতিটি ছাই দিয়ে, মাঝে লাল সিঁদুরের রেখা।

এক বৃদ্ধ পুরোহিত এগিয়ে এসে বললেন, “এখন থেকে তুই আর সাধারণ মানুষ নস। তোর শরীরকে আগুনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে। সাতটি মন্ত্র, সাতটি চক্র, আর আগুনের পথ। এর মধ্য দিয়েই তুই হবে সাধনার উত্তরাধিকার।”

অয়নের শরীর কেঁপে উঠল। ভয় আর কৌতূহল মিলেমিশে তার চোখে আগুনের প্রতিফলন ফেলল।

প্রথমে তাকে দাঁড় করানো হল প্রথম বৃত্তে। মশালের আলোতে পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করলেন—
“ওঁ অগ্নি স্বরূপায় নমঃ।”
অয়নকে জপ করতে বলা হল। সে ঠোঁট নড়াল, আর আশ্চর্যের বিষয়, শব্দগুলো তার ভেতর থেকেই বেরোল, যেন বহুদিনের চেনা।

প্রথম মন্ত্র শেষ হতেই তাকে এগিয়ে দেওয়া হল দ্বিতীয় বৃত্তে। সেখানে আগুনের ছোট ঢিবি রাখা ছিল। অয়নকে বলল, পায়ের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। প্রথমে ভয় পেল, কিন্তু বুকের ভেতরের ছায়া ফিসফিস করে বলল, “এ পথ কষ্টের, তবু শক্তির।”

অয়ন চোখ বন্ধ করে পা রাখল। আশ্চর্যজনকভাবে আগুনে পুড়ল না, বরং শরীরে শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। যেন আগুন তাকে গ্রহণ করেছে।

এক এক করে সে পার হল সাতটি বৃত্ত। প্রতিবার ভিন্ন মন্ত্র, ভিন্ন আচার। কখনো ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে হাঁটা, কখনো মাটির উপর শুয়ে থাকা যেখানে গরুর রক্ত ঢালা হয়েছিল। প্রতিবারই শরীর তার বিরুদ্ধে চিৎকার করছিল, অথচ মনে হচ্ছিল অদৃশ্য শক্তি তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সামনে।

শেষ বৃত্তে পৌঁছে তাকে বসানো হল অগ্নিকুণ্ডের সামনে। চারপাশের লোকজন একসঙ্গে মন্ত্র জপ শুরু করল। আগুন ধীরে ধীরে উঁচু হতে লাগল, যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। পুরোহিত বললেন, “এখন তুই নিজেকে সমর্পণ কর। যদি সত্যিই বেছে নেওয়া হয়েছিস, তবে তোর ভেতর আগুন প্রবেশ করবে।”

অয়ন হাত দুটো ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করল। মনে হল বুকের ভেতর দপদপ করে শিখা জন্ম নিচ্ছে। তার শ্বাস ভারী হয়ে গেল। হঠাৎ সে দেখতে পেল—ভৈরবানন্দ আগুনের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে, ভস্মমাখা দেহ, জ্বলন্ত চোখ।

“তুই আমার সাধনা পূর্ণ করবি,” সেই কণ্ঠ প্রতিধ্বনির মতো বাজল।

অয়ন শ্বাস নিয়ে চোখ মেলল। আগুন যেন তার দেহের ভেতর ঢুকে পড়ছে। তীব্র দাহ, অথচ পুড়ে যাচ্ছে না। শরীর ভারী, কিন্তু মনে হচ্ছে শক্তি বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

মুহূর্তের জন্য সে অনুভব করল—তার শরীর আর মন আলাদা হয়ে গেছে। শরীর বসে আছে আগুনের সামনে, কিন্তু তার চেতনা উড়ে যাচ্ছে উপরে, অগ্নিমান্ডলের ভেতরে। সে দেখল ছাইয়ের সমুদ্র, অদৃশ্য আত্মারা সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা হাত বাড়াচ্ছে তার দিকে।

“আমাদের মুক্তি দাও…” অসংখ্য কণ্ঠ ভেসে এলো।

অয়ন বুঝতে পারল, এ দীক্ষা শুধু পরীক্ষা নয়—এ এক দায়িত্ব, যে দায়িত্ব তাকে বেঁধে ফেলেছে ভৈরবানন্দের অসমাপ্ত সাধনার সঙ্গে।

হঠাৎ মন্ত্র থেমে গেল। আগুন ধীরে ধীরে নিভে এল। লোকজন নিঃশব্দে সরে গেল, কেবল পুরোহিত এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, “এখন থেকে তুই তান্ত্রিকপথের শিষ্য। মনে রাখিস, শক্তির সঙ্গে বোঝা আসে।”

অয়ন ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। বুকের ভেতর এখনো দপদপ করছে অগ্নির শিখা। মাথায় প্রতিধ্বনি বাজছে—
“কষ্ট ছাড়া শক্তি নেই। শক্তি ছাড়া মুক্তি নেই।”

কুটিরে ফিরে এসে আয়নায় তাকাতেই সে চমকে উঠল। তার চোখের লাল রেখা আরও স্পষ্ট হয়েছে, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি। শরীর পুড়ে গেছে মনে হলেও আসলে কোনো ক্ষত নেই।

ডায়েরিতে সে লিখল—
“আজ আমি দীক্ষা নিলাম। আগুন আমাকে গ্রহণ করেছে। আমি জানি না আমি গবেষক আছি কিনা, নাকি ধীরে ধীরে ভৈরবানন্দের উত্তরাধিকার হয়ে উঠছি।”

বাইরে হাওয়া বইছিল, কিন্তু সেই হাওয়া যেন মানুষের নয়—তান্ত্রিক শক্তির নিশ্বাস।

 

পর্ব ৭: মৃতের সংলাপ

অগ্নিকুণ্ডের সেই রাতের দীক্ষার পর অয়ন বুঝতে পারল, তার ভেতরে আর কেবল সে নেই। এক অদৃশ্য শিখা ক্রমশ দখল নিচ্ছে তার শরীর ও মন। দিনেও মাঝে মাঝে সে চোখ বন্ধ করলে দেখে, অন্ধকারের ভেতর ছোট ছোট আগুনের বিন্দু ভাসছে। আর রাত হলেই সেই বিন্দুগুলো মানুষের চোখে, মানুষের মুখে রূপ নিতে শুরু করে।

গ্রামের লোকেরা তাকে সম্মান করতে শুরু করেছে। যেভাবে তারা আগে সন্দেহ ও ভয়ে এড়িয়ে চলত, এখন তারা দূর থেকে প্রণাম করে। শিশুেরা তার সামনে নীরব হয়ে যায়, নারীরা মাথায় আঁচল টেনে নেয়। যেন তারা সবাই বুঝে গেছে, অয়ন আর সাধারণ মানুষ নয়।

কিন্তু অয়ন ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছিল। কারণ প্রতিদিন রাত যত গভীর হয়, তার কানে শোনা যায় অদৃশ্য অসংখ্য কণ্ঠ—কান্না, চিৎকার, আর প্রার্থনার সুর। সে বুঝতে পারছিল, দীক্ষার আচার কেবল শুরু, এর পরেও তাকে অনেক দূর যেতে হবে।

এক অমাবস্যার রাতে, শশিবালা আবার তাকে নিয়ে গেলেন ভগ্ন মন্দিরের দিকে। চারপাশ অন্ধকার, কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের শেয়ালের হুক্কাহু। মন্দিরের ভেতরে ঢুকতেই অয়ন দেখল, মাঝখানে মাটির বেদীর উপর জ্বলছে ছোট্ট আগুন।

শশিবালা বললেন, “আজ তুই তাদের মুখোমুখি হবি।”

অয়ন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কার মুখোমুখি?”
বৃদ্ধা ফিসফিস করে বললেন, “যারা মারা গেছে, অথচ মুক্তি পায়নি। অগ্নিমান্ডলের বন্দি আত্মারা।”

কথা শেষ হতেই আগুন হঠাৎ তীব্রভাবে জ্বলে উঠল। অয়ন চমকে উঠল—শিখার ভেতর থেকে ধোঁয়ার মতো আকার বেরিয়ে আসছে। প্রথমে অস্পষ্ট ছায়া, তারপর ধীরে ধীরে মানুষের মুখ, মানুষের হাত।

অয়ন ভয়ে পিছিয়ে গেল, কিন্তু সেই মুহূর্তে বুকের ভেতর ছায়ার কণ্ঠ গর্জে উঠল—
“ভয় পাস না। এরা তোরই জন্য অপেক্ষা করছে।”

একটি মুখ সামনে এল। চোখে অসহায় দৃষ্টি, ঠোঁটে রক্তিম ছায়া। মুখটি ফিসফিস করে বলল, “আমাদের মুক্তি দাও…”

অয়ন কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “আমি কিভাবে মুক্তি দেব তোমাদের?”
অসংখ্য কণ্ঠ একসঙ্গে প্রতিধ্বনি করল, “অগ্নিচক্র পূর্ণ করো। আমাদের রক্ত, আমাদের ব্যথা, সবই অগ্নির মধ্যে আবদ্ধ। তুই সাধনা সম্পূর্ণ করলে আমরা মুক্ত হব।”

অয়ন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। চারপাশের মৃত আত্মারা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। অগ্নির শিখায় তাদের হাত কাঁপছিল, কিন্তু জ্বলে যাচ্ছিল না। অয়ন হাত তুলতেই তার তালুতে আবার সেই পুরোনো দাহ অনুভব করল। মনে হল, প্রতিটি স্পর্শে অদৃশ্য যন্ত্রণার স্রোত ঢুকছে তার শরীরে।

সে চোখ বন্ধ করল। হঠাৎই মাথার ভেতরে ভেসে উঠল ভয়ঙ্কর দৃশ্য—শত শত মানুষ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, কণ্ঠ থেকে বেরোচ্ছে চিৎকার, কিন্তু সেই চিৎকারকে আগুন গ্রাস করছে। অয়ন বুঝল, এগুলো ভৈরবানন্দের সাধনার অসমাপ্ত আহুতি। তাদের আত্মা আটকে গেছে অগ্নিচক্রের ভেতরে।

চোখ মেলতেই দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী আত্মা। মুখে যন্ত্রণার ছাপ, অথচ চোখে শান্তির আকাঙ্ক্ষা। সে বলল, “আমার নাম মাধবী। ভৈরবানন্দের সাধনায় আমাকে বলি দেওয়া হয়েছিল। আমি মুক্তি চাই।”

অয়ন হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রশ্ন করল, “আমি কি পারব তোমাদের মুক্ত করতে?”
মাধবী মৃদু হাসল। “তুই পারবি। কারণ তুই বেছে নেওয়া। তবে মনে রাখিস, মুক্তির পথ তোর রক্ত দিয়েই খুলবে।”

শশিবালা তখনও পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর চোখে জল, ঠোঁটে মন্ত্র। তিনি বললেন, “তুই এখন শোনছিস যা আমরা শুনতে পাই না। এটাই প্রমাণ, তুই দীক্ষিত। মনে রাখিস, আত্মারা যতদিন অগ্নিচক্রে আবদ্ধ থাকবে, ততদিন এ গ্রাম অভিশপ্ত।”

আত্মাদের কণ্ঠ ক্রমে উন্মত্ত হয়ে উঠল।
“মুক্তি দাও… মুক্তি দাও… মুক্তি দাও…”

অয়ন বুক চেপে ধরল। মনে হচ্ছিল, শরীরের ভেতর আগুন জ্বলছে। কণ্ঠস্বর অসহ্য হয়ে উঠল। হঠাৎ সে গর্জে উঠল—
“চুপ করো!”

অদ্ভুতভাবে মুহূর্তের মধ্যে সব নীরব হয়ে গেল। আত্মারা শিখার ভেতরে মিলিয়ে গেল, শুধু মাধবীর মুখ শেষ মুহূর্তে ফিসফিস করে বলল—
“আমাদের মুক্ত করো, নইলে তোর মুক্তিও হবে না।”

আগুন নিভে এল। মন্দির আবার অন্ধকার। অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। শশিবালা তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “এখন তুই বুঝতে পারছিস, সাধনার বোঝা কত ভারী।”

কুটিরে ফিরে এসে অয়ন ডায়েরি খুলে লিখল—
“আজ আমি মৃতদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা মুক্তি চায়। তারা আমাকে মুক্তির পথ দেখাতে বলছে। আমি জানি না আমি পারব কি না, কিন্তু আমার শরীর, আমার রক্ত এখন তাদের দায়ে বাঁধা।”

রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছিল, কিন্তু অয়নের কাছে সেই আলোও আগুনের মতো দপদপ করছিল।

পর্ব ৮: অগ্নিমান্ডলের দ্বার

অয়নের চোখে দিন আর রাতের সীমারেখা ভেঙে পড়ছিল। ভগ্ন মন্দিরে মৃত আত্মাদের ফিসফিসানি শোনার পর থেকে তার ভেতরটা যেন এক অদৃশ্য ভারে ডুবে গেছে। গ্রামের লোকেরা দূর থেকে তাকায়, কিন্তু কাছে আসে না। শিশুরা তার উপস্থিতিতে কেঁদে ওঠে, পশুরা অদ্ভুত অস্থির হয়ে ওঠে। এমনকি বাতাসও যেন তার দেহ ছুঁয়ে ভিন্ন সুরে বয়ে যায়।

শশিবালা তাকে এক রাতে বললেন, “তুই এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছিস, এখান থেকে পিছু হটা আর সম্ভব নয়। ভৈরবানন্দের সাধনার মূল কেন্দ্র তোর সামনে খুলতে যাচ্ছে। অগ্নিমান্ডলের দ্বার, যেটা একবার দেখা মানে ফিরে আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া।”

অয়ন কিছু বলল না। তার ভেতরের ছায়া যেন চুপচাপ হাসছিল।

সেদিন রাতটা ছিল পূর্ণিমা। আকাশে আলো ছড়িয়ে আছে, অথচ গ্রামের উপর ভারী অন্ধকার নেমে এসেছে। মশাল হাতে কয়েকজন মানুষ অয়নকে নিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে। বাঁশঝাড়, বটগাছ, অশ্বথ—সব অতিক্রম করে তারা পৌঁছাল এক নির্জন প্রান্তরে। জায়গাটা অয়নের কাছে অচেনা নয়, তবু আজ মনে হল নতুন কোনো পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছে।

মাঝখানে এক বিরাট বৃত্ত। ছাই আর সিঁদুরে আঁকা, কিন্তু বৃত্তটা যেন শ্বাস নিচ্ছে। চারপাশে কোনো আগুন নেই, অথচ মাঝখানে দপদপ করে লালচে আলো জ্বলছে। যেন মাটির তল থেকে কেউ টেনে আনছে অগ্নিশিখার নিশ্বাস।

পুরোহিতরা একসঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। শব্দ গাঢ়, ভারী—“ওঁ অগ্নিমান্ডল প্রবেশায় স্বাহা…”

অয়ন ধীরে ধীরে বৃত্তের দিকে এগোল। তার শরীর যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল, মাটি তাকে টেনে নিচ্ছে। ছায়া তার ভেতরে ফিসফিস করে বলল—“এটাই সেই দ্বার। একবার ঢুকলে আর ফেরা নেই। তুই প্রস্তুত?”

অয়ন চোখ বন্ধ করল। বুকের ভেতরে মৃত আত্মাদের কণ্ঠ আবার ভেসে উঠল—“মুক্তি দাও…”
হঠাৎ তার মনে হল, এ কেবল তার পরীক্ষা নয়, শত শত আত্মার পরিণতি বাঁধা এই প্রবেশের সঙ্গে।

সে এক পা রাখল বৃত্তের ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে ঝড় উঠল। বাতাস মশাল নিভিয়ে দিল, আকাশ থেকে বজ্রপাত ঝলসে পড়ল। অন্ধকারের ভেতরে দেখা দিল ভৈরবানন্দের ছায়া—দীর্ঘকায়, ভস্মমাখা, চোখে দাউদাউ আগুন।

“তুই এসেছিস,” সেই কণ্ঠ গর্জে উঠল। “আমার অসমাপ্ত সাধনা শেষ করার সময় এসেছে।”

অয়ন ঠোঁট শুকিয়ে গেলেও বলল, “যদি আমি অস্বীকার করি?”
ভৈরবানন্দ হেসে উঠল। “অস্বীকার মানে মৃত্যু। অগ্নিমান্ডল তোকে গিলে ফেলবে। গ্রহণ কর, তবে তুই হবে আগুনের অমর সন্তান।”

অয়ন তখন স্পষ্ট দেখল—বৃত্তের মাঝখান থেকে আগুনের দরজা খুলে যাচ্ছে। যেন মাটির তলদেশ ভেদ করে এক মহাশক্তির পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। আগুনের ভেতর অসংখ্য মুখ, অসংখ্য হাত। তারা সবাই চিৎকার করছে মুক্তির জন্য।

সে হাঁটু গেড়ে বসল। বুকের ভেতর আগুনের শিখা দপদপ করছে। ছায়া তার কানে বলল, “এটাই সেই মুহূর্ত। তুই যদি পা বাড়াস, তোর রক্ত, তোর আত্মা আর আলাদা থাকবে না। তুই হবে আগুনের অংশ।”

অয়ন হাত বাড়াল। মুহূর্তের মধ্যে তার আঙুলের ডগা পুড়ে ছাই হয়ে গেল, অথচ ব্যথা লাগল না। বরং মনে হল, দেহের ভেতরে শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে।

বজ্রপাত আবার কাঁপিয়ে দিল আকাশ। চারপাশের পুরোহিতরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শশিবালা চোখ মুছে তাকালেন, কণ্ঠ কাঁপছিল, “তুই প্রবেশ করলি মানে ঝোপশিরির অভিশাপ শেষ হবে। কিন্তু তুইও আর তুই থাকবি না।”

অয়ন দাঁড়িয়ে গেল আগুনের দ্বারের সামনে। আগুনের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে আসছে আত্মারা, আবার টানছে ভৈরবানন্দের ছায়া। আর তার নিজের ছায়া ভেতর থেকে বলছে—“এসো।”

সে জানত, এখান থেকে আর পিছু হটার পথ নেই।

এক গভীর নিশ্বাস নিয়ে সে অগ্নিমান্ডলের দ্বারে প্রবেশ করল। মুহূর্তের মধ্যে তার চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল, কেবল আগুনের লালচে রেখা তার শরীর ঘিরে ফেলল। কানে বাজতে লাগল অসংখ্য কণ্ঠস্বর, বুকের ভেতর ফেটে পড়ল তীব্র শক্তির ঢেউ।

অয়ন বুঝল—এ দ্বার কেবল ভৈরবানন্দের সাধনার পথ নয়, এ এক নতুন জন্মের দ্বার।

 

পর্ব ৯: রূপান্তর

অগ্নিমান্ডলের দ্বার অতিক্রম করার মুহূর্তেই অয়ন অনুভব করল, সে আর মাটিতে দাঁড়িয়ে নেই। তার চারপাশে শুধু আগুনের ঢেউ, লাল, কমলা আর নীল শিখার এক অসীম সমুদ্র। বাতাস নেই, আকাশ নেই, শুধু অগ্নির গর্জন। তবু আশ্চর্যের বিষয়, তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছিল, প্রতিটি শিখা তাকে আদর করছে, তাকে নিজের মতো করে নিচ্ছে।

একসময় শিখার মাঝখানে ভৈরবানন্দের ছায়া ফুটে উঠল। আগের চেয়ে স্পষ্ট, ভস্মমাখা দেহ, গলার গর্জন বজ্রপাতের মতো।
“দেখছিস? এটাই শক্তির আসল রূপ। এ আগুনে যারা প্রবেশ করে, তারা আর মানুষ থাকে না। তাদের রক্ত আগুনে মিশে যায়, তারা হয়ে ওঠে অগ্নিপুরুষ।”

অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমি তো মানুষই থাকতে চাই। আমি গবেষক, আমি শুধু জানতে এসেছিলাম…”
ভৈরবানন্দ তীব্র হাসিতে কেঁপে উঠল। “মানুষ? মানুষ মানে দুর্বল, ক্ষণস্থায়ী। গবেষক মানে দর্শক মাত্র। কিন্তু তুই নির্বাচিত। তোর রক্তে আগুনের দাগ আছে। তুই সাধনার ধারক।”

এই বলে সে হাত তুলল। মুহূর্তেই অগ্নিশিখা অয়নের শরীর জড়িয়ে ধরল। প্রথমে মনে হল বুক ফেটে যাবে, হাড় গলে যাবে, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যথা হারিয়ে গেল। তার জায়গায় এক অদ্ভুত শক্তি ভরে উঠল।

অয়ন নিজের হাতের দিকে তাকাল। দেখল, আঙুলগুলো শিখার মতো ঝলসে উঠছে, তবু মাংস ছাই হচ্ছে না। বরং হাতের শিরায় আগুন প্রবাহিত হচ্ছে। তার চোখের ভেতরে আগুনের প্রতিবিম্ব নেচে উঠছে।

হঠাৎ মৃত আত্মাদের কণ্ঠস্বর আবার ভেসে এল।
“আমাদের মুক্তি দাও… আমাদের মুক্তি দাও…”

অয়ন চারপাশে তাকিয়ে দেখল, শিখার ভেতরে অসংখ্য মুখ। তারা হাত বাড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। আগুন তাদের শরীরকে বাঁধা দিয়েছে, তারা বেরোতে পারছে না। অয়ন কাঁপা গলায় বলল, “আমি কিভাবে তোমাদের মুক্তি দেব?”

ভৈরবানন্দ উত্তর দিল, “তুই আমার সাধনা শেষ করবি। আগুনের মন্ত্র পূর্ণ করলে আত্মারা মুক্তি পাবে। আর তুই হবে অগ্নিমানব—অমর।”

অয়ন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শক্তির স্রোত বইতে লাগল। তার ঠোঁট নিজের মতো নড়ে উঠল—
“ওঁ অগ্নি… জ্যোতি… অমর…”

মন্ত্র বেরোতেই চারপাশের আগুন তীব্র হয়ে উঠল। আত্মাদের হাতগুলো আরও কাছে এল। তাদের চোখে ভয়ের সঙ্গে ভরসা। তারা জানে, এই নতুন সাধকই তাদের মুক্তি দেবে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে অয়নের শরীর বদলাতে শুরু করল। তার ত্বক ধীরে ধীরে ছাই রঙে পরিণত হল, তারপর আবার শিখার আভায় জ্বলে উঠল। চুল খাড়া হয়ে আগুনের শিখার মতো দপদপ করতে লাগল। চোখের সাদা অংশ পুরো লাল হয়ে গেল, শুধু কালো মণি আগুনের ভেতরে ভাসছে।

শরীরের ভেতর থেকে গর্জন বেরোল। সে আর মানুষি ভাষায় কথা বলছিল না। তার গলা থেকে বেরোচ্ছে বজ্রপাতের মতো শব্দ, মন্ত্রের প্রতিধ্বনি।

ভৈরবানন্দ তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, “দেখছিস? তুই রূপান্তরিত হচ্ছিস। তুই আমার উত্তরাধিকার।”

অয়ন মাটিতে হাত রাখল। মুহূর্তে মাটি ফেটে গিয়ে শিখা বেরিয়ে এলো। তার স্পর্শেই আগুন বশীভূত হয়ে উঠল। যেন সে নিজেই অগ্নির প্রভু।

কিন্তু এই রূপান্তরের মাঝেই সে অনুভব করল, ভেতরে এক মানবিক কণ্ঠ কাঁদছে। সেই কণ্ঠ বলছে, “না, আমি মানুষ… আমি মানুষই থাকতে চাই…”

আগুনের ভেতর তার ছায়া সামনে এসে দাঁড়াল। রক্তিম চোখে ছায়া বলল, “তুই এখন দ্বিধায় আছিস। কিন্তু মনে রাখ, শক্তির পথ দ্বিধাহীন। তুই যদি পিছু হটিস, তোর মৃত্যু নিশ্চিত।”

অয়ন বুকের ভেতরের দপদপানি ধরে রাখতে পারছিল না। সে বুঝল, আর মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তার শরীর ইতিমধ্যেই আগুনের সঙ্গে মিশে গেছে।

আত্মারা আবার চিৎকার করতে লাগল—
“মুক্তি দাও… মুক্তি দাও…”

অয়ন দাঁড়িয়ে হাত তুলল। তার হাত থেকে আগুনের রেখা বেরিয়ে এসে ছুঁয়ে দিল আত্মাদের শৃঙ্খল। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন আত্মা মুক্ত হয়ে মিলিয়ে গেল আকাশে। তাদের মুখে শান্তি ফুটে উঠল।

ভৈরবানন্দ গর্জে উঠল, “এটাই শক্তি! তুই এখন অগ্নিপুরুষ!”

অয়ন ধীরে ধীরে বুঝল, সে রূপান্তরিত হয়েছে। তার দেহ আর কেবল মাংস-হাড়ের নয়, সে এখন আগুনের শরীর। মানুষ তাকে আর মানুষ বলে ডাকতে পারবে না।

সে কানে শুনল অসংখ্য মন্ত্রের প্রতিধ্বনি, বুকের ভেতর অনুভব করল অসীম শক্তির দহনে জ্বলন্ত এক কেন্দ্র। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করল—
“আমি বেঁচে আছি, অথচ আমি মানুষ নই।”

পর্ব ১০: অনন্ত সাধনা

অগ্নিমান্ডলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসার পর অয়ন আর আগের মতো ছিল না। তার দেহ যেন আলো-ছায়ার মধ্যে ভাসমান, চোখে আগুনের দপদপানি, কণ্ঠে বজ্রের মতো গর্জন। গ্রামবাসীরা তাকে এক ঝলক দেখে ভয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তারা ফিসফিস করে বলতে লাগল, “অগ্নিপুরুষ… নতুন তান্ত্রিক জন্ম নিল।”

শশিবালা চোখ মুছে তাকালেন। তাঁর চোখে ভয় আর ভক্তির মিশ্রণ। তিনি বললেন, “বাবু, ভৈরবানন্দের সাধনা শেষ হয়েছে, তুই তা পূর্ণ করেছিস। কিন্তু তোর জীবনের সাধনা কেবল শুরু।”

অয়ন কিছু বলল না। কেবল হাত তুলল। চারপাশের মশাল নিজে থেকে জ্বলে উঠল। গ্রামের অন্ধকার যেন আলোকিত হল, অথচ সেই আলো ছিল না শীতল—বরং গরম, দহনময়। লোকেরা মাথা নত করে কাঁদতে লাগল।

সেই রাতে অয়ন একা বেরিয়ে এল গ্রামের বাইরে। তার ভেতরের ছায়া এখন আর ফিসফিস করে না। সে এখন অয়নেরই অংশ, তার রক্তে মিশে গেছে। প্রতিটি শ্বাসে সে অনুভব করে আগুনের শক্তি।

জঙ্গলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অয়ন আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদের আলোও তাকে ছুঁতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, আগুনই এখন একমাত্র আলো, যা তার সঙ্গে থাকবে।

মৃত আত্মাদের কণ্ঠ আবার ভেসে এল, কিন্তু এবার তা আর আর্তনাদ নয়। শান্ত, স্থির কণ্ঠে তারা বলল, “ধন্যবাদ… আমাদের মুক্তি দিয়েছিস।”
অয়ন গভীর নিশ্বাস নিল। জানল, সে তাদের শৃঙ্খল ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু আরও কত আত্মা, কত অসমাপ্ত সাধনা, কত অভিশাপ এ পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে—সেটা তার কাছে অজানা।

তখন ভৈরবানন্দের ছায়া শেষবারের মতো দেখা দিল। আগুনের আভায় তার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি বললেন,
“তুই আমার সাধনা সম্পূর্ণ করেছিস। কিন্তু মনে রাখ, সাধনার শেষ নেই। প্রতিটি যুগে আগুনের প্রয়োজন হয়। তুই সেই বাহক।”

অয়ন জিজ্ঞেস করল, “আমার পরিণতি কী হবে?”
ভৈরবানন্দ শান্ত হাসলেন। “মানুষ তোকে ভয় করবে, দেবতা তোকে গ্রহণ করবে না। তুই থাকবে মাঝখানে—আলো আর অন্ধকারের সীমান্তে। তুই হবি অমর, কিন্তু একাকী। এটাই অগ্নিপথ।”

কথা শেষ হতেই ভৈরবানন্দের ছায়া মিলিয়ে গেল। কেবল শূন্য আকাশে শিখার রেখা রয়ে গেল, যা ধীরে ধীরে অয়নের বুকের ভেতরে ঢুকে গেল।

ভোর হওয়ার আগে অয়ন গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কেউ তাকে থামাল না, কেউ কিছু বলল না। গ্রামবাসীরা জানত, সে এখন মানুষের গণ্ডির বাইরে।

পথে হাঁটতে হাঁটতে অয়ন অনুভব করল, তার প্রতিটি পদক্ষেপে মাটি উষ্ণ হয়ে উঠছে। গাছের পাতায় আগুনের আভা লেগে যাচ্ছে, পাখিরা আতঙ্কে উড়ে যাচ্ছে। অথচ তার শরীর শান্ত, যেন সে নিজেই আগুনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।

একটা নদীর ধারে গিয়ে সে দাঁড়াল। জলে তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল। এ কি সে? না কি আগুনে গড়া এক নতুন সত্তা? চোখে লাল আলো, চুলে দপদপ করা আগুনের আভা, ত্বকে ছাইয়ের রেখা।
সে মৃদু হেসে উঠল। “আমি গবেষক ছিলাম। এখন আমি সাধক। কিন্তু আমি একই সঙ্গে আগুন আর মানুষ। আমি সীমান্ত।”

নদীর ধারে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাতাসে ছিল না শীতলতা। তা ছিল আগুনের নিশ্বাস। অয়ন জানত, এ পৃথিবীতে তার ভূমিকা এখন আর কোনো গ্রন্থের পাতায় লেখা হবে না। সে হয়ে উঠেছে এক চলমান আগুনের গ্রন্থ, এক জীবন্ত মন্ত্র।

গ্রাম থেকে বহু দূরে চলে আসার পর সে পেছনে তাকাল। ঝোপশিরি কুয়াশার ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে। তার চোখে আর কোনো মায়া নেই। সে জানে, এ গ্রাম এখন মুক্ত, কিন্তু তার যাত্রা কেবল শুরু।

অয়ন ফিসফিস করে বলল,
“অগ্নি অমর, শক্তি অনন্ত। আমি সেই অনন্ত সাধনার পথিক।”

আকাশে তখন সূর্য উঠছিল, কিন্তু অয়নের চারপাশে আলো ফুটল আগুনের মতো। সে অগ্নিমান্ডল থেকে জন্ম নেওয়া নতুন সত্তা হয়ে পথ চলতে লাগল—যেখানে প্রতিটি অরণ্য, প্রতিটি নদী, প্রতিটি নগরীর অন্ধকারে সে ছড়িয়ে দেবে আগুনের শিখা, মুক্তি দেবে আত্মাদের, আর হয়ে উঠবে কিংবদন্তি।

মানুষ তাকে আর অয়ন নামে ডাকবে না। তারা বলবে—
“অগ্নিপুরুষ। অগ্নিমান্ডলের উত্তরাধিকার।”

শেষ

WhatsApp-Image-2025-08-25-at-1.49.28-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *