১
শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নাট্যমঞ্চের নাম একসময় উচ্চারণ করলেই লোকেদের চোখে ভাসত জৌলুশ, আলো, করতালির ঝড় আর অভিনয়ের এক অদ্ভুত মায়াবী মঞ্চ। থিয়েটারের আসল গর্ব ছিল এর দল, যেখানে দেশের প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমাগম হতো। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মঞ্চে উঠেছিল বহুল প্রতীক্ষিত নতুন নাটক—“রক্তচক্ষু।” শহরের সাংস্কৃতিক মহলে বহুদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই নাটক, কারণ এটি পরিচালনা করেছিলেন কিংবদন্তি নাট্যকার অমরেশ সেন নিজে। অডিটোরিয়াম ভর্তি দর্শকেরা অধীর আগ্রহে বসেছিলেন, তাদের চোখে মুখে আলো ঝলমল করছিল মঞ্চের প্রথম দৃশ্যের অপেক্ষায়। পর্দা উঠল, আলো জ্বলে উঠল, আর নাটকের সংলাপে ভেসে গেল চারপাশ। শুরুটা ছিল নিখুঁত, অভিনেতাদের অভিনয়, সঙ্গীত, আলো-ছায়ার খেলা—সবকিছু মিলে যেন মানুষ অন্য এক জগতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু কে জানত, সেদিনকার রাত শহরের ইতিহাসে কালো দাগ হয়ে থাকবে, যেখানে নাটক আর বাস্তবের সীমারেখা গলে গিয়ে মিশে যাবে আগুন, ধোঁয়া আর মৃত্যুর সঙ্গে।
প্রথম অঙ্ক শেষ হওয়ার আগেই দর্শকেরা মুগ্ধ হয়ে উঠেছিল। করতালির শব্দ মঞ্চ আর অডিটোরিয়াম কাঁপিয়ে দিয়েছিল। অভিনেতাদের মধ্যে কাবেরী দত্ত লাল শাড়ি পরে মঞ্চে উঠেছিলেন, তাঁর সংলাপের দৃঢ়তা আর কণ্ঠের মায়া মুহূর্তেই হল ঘরের প্রতিটি মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিল। পেছন থেকে আলো-সাউন্ডের নিখুঁত পরিচালনা করছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। হাস্যরসের জায়গায় দর্শককে মাতাচ্ছিলেন শঙ্কর পাল, আর অল্প বয়সী নতুন অভিনেত্রী মীনা সেনগুপ্ত লাজুক চোখে প্রথমবার এত বড় মঞ্চে অভিনয় করে কাঁপছিলেন, কিন্তু দর্শকেরা তাঁর প্রতিটি সংলাপে হাততালি দিচ্ছিল। সবকিছু ঠিকই চলছিল, হঠাৎ যেন কোথা থেকে আসা বাতাসে এক ভয়ঙ্কর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে সবাই ভেবেছিল কোনো বৈদ্যুতিক তার পুড়ছে হয়তো। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠল—মঞ্চের এক পাশ থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। সাউন্ড সিস্টেমের তারে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছিল বলে পরে জানা যায়, কিন্তু তখন কেউ সেটা বোঝার সময় পায়নি।
মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠল। আগুন যেন হিংস্র দানবের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল পর্দা, কাঠের মঞ্চ, চেয়ার—সবকিছুর ওপর। দর্শকেরা হুড়োহুড়ি করে পালাতে শুরু করল। চিৎকার, কান্না, ঠেলাঠেলি—চারপাশে এক মৃত্যুভয় ছড়িয়ে গেল। যারা সামনের সারিতে বসেছিল, তারা দৌড়ে দরজার দিকে ছুটল, কিন্তু পেছনের সারিতে বসা লোকেরা আটকে গেল ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে। ধোঁয়া এতটাই ঘন হয়ে উঠল যে কারও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনেতারা প্রথমে বুঝতেই পারেননি কী হচ্ছে। কাবেরী চিৎকার করে সহঅভিনেতাদের মঞ্চ থেকে নামতে বললেন। শঙ্কর, যিনি সবসময় মানুষকে হাসাতেন, সেই রাতেই মৃত্যুর ভয়াবহ দৃশ্যের সাক্ষী হলেন। তিনি দর্শকদের বেরিয়ে যেতে সাহায্য করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আগুন তখন প্রবল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন অভিনেত্রী মীনা আতঙ্কে চিৎকার করছিলেন, কিন্তু তাঁর ছোট্ট শরীর ভিড়ের ধাক্কায় কোথাও চাপা পড়ে গেল। টেকনিশিয়ান সুধীর মরিয়া চেষ্টা করছিলেন স্পটলাইট ও মেশিন বন্ধ করতে, যাতে আগুন আরও না বাড়ে, কিন্তু তাঁর হাত-পা গলতে থাকা তারে জড়িয়ে গেল। সেকেন্ডের মধ্যে পুরো থিয়েটারটা এক ভয়ঙ্কর দহনক্ষেত্রে পরিণত হল।
শেষ মুহূর্তগুলো ছিল অমানবিক। বাইরের লোকেরা দমকল ডেকেছিল, কিন্তু সেই পুরনো থিয়েটারের ভেতরে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল এত দ্রুত যে কারওর পক্ষে কিছু করার ছিল না। যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল, তারা বলেছিল—সেদিন মঞ্চের পর্দা যেন নিজে থেকেই নেমে আসছিল, আবার কখনো উঠছিল, ঠিক যেন নাটক চলতেই থাকছে। ধোঁয়ার ঘন কুয়াশার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল অভিনেতাদের ছায়া, কারও সংলাপ অর্ধেক উচ্চারণ করা অবস্থায় থেমে গেছে, কারও মুখ বিকৃত হয়ে আগুনের শিখায় হারিয়ে গেছে। দর্শক গ্যালারির অনেকেই চিরতরে আটকা পড়েছিলেন, তাদের চিৎকার বাইরের রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। রাতভর দমকল আগুন নেভানোর চেষ্টা করল, ভোর নাগাদ শুধু ছাই আর পোড়া গন্ধ ছাড়া কিছু অবশিষ্ট থাকল না। খবরের কাগজে শিরোনাম হয়েছিল—“আগুনে গ্রাস খ্যাতনামা নাট্যমঞ্চ—মৃত অভিনেতা, নিভে গেল আলো।” থিয়েটারটি বন্ধ করে দেওয়া হল, কিন্তু সেই রাতের মৃত্যুচিৎকার, পোড়া মাংসের গন্ধ আর অসমাপ্ত নাটকের অদ্ভুত আবহ যেন বাতাসে ভেসে রইল। আর এরপর থেকেই মানুষ বলতে লাগল—সেই নাট্যমঞ্চে রাতের আঁধারে আজও নাটক হয়, কিন্তু অভিনেতারা সবাই মৃত।
২
আগুনের সেই ভয়াবহ রাতের পর শহরের মানুষ ধীরে ধীরে ভুলতে চেয়েছিল ঘটনাটি। থিয়েটারটি সিল করে দেওয়া হয়েছিল, চারপাশে লোহার গেট বসানো হয়েছিল যাতে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। দিনের বেলা লোকজন রাস্তা দিয়ে গেলেও গেটের ভেতরে চোখ তুলতে চাইত না, যেন পোড়া দেয়াল আর ভস্মীভূত চেয়ারের মধ্যে এখনও সেই রাতের করুণ আর্তনাদ লুকিয়ে আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের অন্য জায়গায় নতুন হল তৈরি হলো, নতুন নাটক মঞ্চস্থ হতে লাগল, মানুষ বিনোদনের নতুন পথ খুঁজে পেল। কিন্তু পুরনো এই নাট্যমঞ্চকে কেউ আর ছুঁতে চাইল না। অথচ অদ্ভুতভাবে, রাতের বেলা আশেপাশের দোকানিরা বা পথচারীরা শপথ করে বলত, তারা ভেতর থেকে আলো জ্বলে উঠতে দেখেছে, কখনও আবার করতালির শব্দ শুনেছে। কেউ বলত—মধ্যরাতে পর্দা নিজে থেকেই খুলে যায়, মঞ্চে অভিনেতাদের ছায়া দাঁড়িয়ে সংলাপ দিচ্ছে। শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এই সব গুজব। ধীরে ধীরে থিয়েটারের নামের সঙ্গে জুড়ে গেল আরেকটি বিশেষণ—“অভিশপ্ত।”
এই গুজবের টানেই কয়েক বছর পর কিছু তরুণ বন্ধুর মনে হলো জায়গাটা একবার ঘুরে দেখা যাক। তারা ছিল আজকের প্রজন্ম, ভূত-প্রেতের গল্পকে মজা হিসেবে নিত, আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কেউ যদি “হন্টেড থিয়েটার” ভিজিট করে ভিডিও বানাতে পারে তবে তা সহজেই ভাইরাল হবে। চারজনের দল—অর্ণব, দীপা, রাহুল আর জয়িতা। তারা সবাই কলেজে পড়ে, বয়স বিশের কাছাকাছি। রাত্রিবেলা ফাঁকা রাস্তায় মোটরবাইক চালিয়ে তারা পৌঁছাল থিয়েটারের সামনে। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে তারা ভেতরে তাকাল, অন্ধকারে পোড়া দেয়ালগুলো যেন এখনও ধোঁয়া ছাড়ছে। দীপা একটু শঙ্কিত কণ্ঠে বলল, “এখনো এখানে আসার কি দরকার ছিল? শোনা যায়, যারা ভেতরে ঢোকে তারা আর স্বাভাবিক থাকে না।” কিন্তু বাকিরা হেসে উড়িয়ে দিল তার কথা। রাহুল ফোনের ক্যামেরা চালু করে বলল, “এটাই তো আসল অ্যাডভেঞ্চার, কাল সকালে আপলোড করব।” ধীরে ধীরে গেটের তালা ভাঙা জায়গা দিয়ে সবাই ভেতরে ঢুকল।
ভেতরে ঢুকতেই তাদের বুক কেঁপে উঠল। অডিটোরিয়ামের ভেতরটা পোড়া কাঠের গন্ধে এখনো ভরা, ভাঙা চেয়ারগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, আর মঞ্চের দিকে তাকাতেই যেন মৃত আলো ছড়িয়ে পড়ল। অর্ণব এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দেখেছ, মঞ্চের পর্দা আস্তে আস্তে নড়ছে?” সত্যিই, বাতাস না থাকলেও মঞ্চের পুরনো লাল পর্দাটা যেন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। জয়িতা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল, মনে হলো কারও অদৃশ্য হাত ধরে টানছে। হঠাৎ মঞ্চের স্পটলাইট জ্বলে উঠল। দীপা ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কে ওখানে?” কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না। বরং পরের মুহূর্তেই যেন কোনো অদৃশ্য অভিনেতা সংলাপ বলা শুরু করল—শব্দগুলো স্পষ্ট নয়, কিন্তু ছন্দময়, নাটকের সংলাপের মতো। চারপাশ নিস্তব্ধ, অথচ অডিটোরিয়ামের ভেতরে ভেসে আসছিল পুরোনো নাটকের ধ্বনি। তাদের মনে হচ্ছিল, কেউ যেন দর্শকাসনে বসে আছে, অস্পষ্ট ছায়াগুলো নড়ছে, কেউ আবার হাততালি দিচ্ছে। চারজন একে অপরের দিকে তাকাল, কিন্তু কারও মুখে কথা বেরোল না।
কিছুক্ষণ পর মঞ্চে হঠাৎ দেখা গেল কুয়াশার মতো কিছু জমাট বাঁধছে। সেই কুয়াশা ধীরে ধীরে মানুষের আকার নিল। কারও শরীরে লাল শাড়ির ছায়া, কারও মুখে অদ্ভুত হাসি, কেউ আবার ভয়ে কাঁপছে। ঠিক যেন সেই আগুনে মৃত অভিনেতাদের আত্মারা নিজেদের চরিত্রে আবার ফিরে এসেছে। দীপা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “চলো, এখনই বেরিয়ে যাই।” কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে তারা বুঝল, গেটটা আর খোলা নেই। বাইরে বেরোনোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ভিতরে তখনো মঞ্চে নাটক চলছে—অসমাপ্ত নাটক, যেখানে প্রতিটি সংলাপ মিশে আছে মৃত্যু আর অভিশাপের অদৃশ্য বন্ধনে। সেই মুহূর্তে চারজন তরুণ প্রথমবার উপলব্ধি করল, এই থিয়েটার সত্যিই অভিশপ্ত, আর তারা ভুল জায়গায় এসে পড়েছে।
৩
অডিটোরিয়ামের ভেতরটা তখন আর কেবল ভাঙা ইট, পোড়া কাঠ বা ধূলোমাখা চেয়ার ছিল না—বরং এক অদ্ভুত জীবন্ত নাট্যমঞ্চ, যেখানে অদৃশ্য অভিনেতারা তাদের অসমাপ্ত চরিত্র নিয়ে অভিনয় করে চলেছে। হঠাৎই আলো কাঁপতে লাগল, আর মঞ্চের মাঝখানে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেতে খেতে জমাট বাঁধল। কুয়াশার মতো সেই ধোঁয়া ধীরে ধীরে এক মানুষের আকার নিল। উচ্চ দেহ, কাঁধে চাদর, হাতে একটি লাঠি—চেহারাটা যেন ভেসে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। তরুণেরা আতঙ্কে দম বন্ধ করে তাকিয়ে রইল, আর সেই মুহূর্তেই বুঝল, এই যে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি আর কেউ নন—নাট্যকার অমরেশ সেনের ছায়া। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন কঠোর শাসক, মঞ্চে তাঁর কথা ছাড়া একটি সংলাপও উচ্চারিত হতো না। আর আজ মৃত্যুর পরও, তাঁর আত্মা যেন সেই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন, মঞ্চ শাসন করছেন। অমরেশের চোখদুটো আগুনের মতো লাল, তাঁর হাতের লাঠি বারবার মঞ্চের মেঝেতে ঠকঠক শব্দ তুলছিল, যেন অদৃশ্য অভিনেতাদের তিনি এখনও নির্দেশ দিচ্ছেন—“এখানে দাঁড়াও”, “এই সংলাপটা জোরে বলো”, “তোমার অভিব্যক্তি ঠিক নয়।”
অর্ণব প্রথমেই সাহস করে ফিসফিস করে বলল, “ওই যে… ওকে দেখছ? ও কি… অমরেশ সেন?” দীপা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তার বাহু আঁকড়ে ধরল। জয়িতা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল, তার ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাহুল, যে সবসময় এসবকে মজা মনে করত, ফোনের ক্যামেরা তুলল রেকর্ড করার জন্য। ঠিক তখনই অমরেশের ছায়া তার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিটা এত ভয়ঙ্কর ছিল যে রাহুলের শরীর জমে গেল, তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল মেঝেতে। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে অমরেশ এগোতে লাগলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর যদিও অস্পষ্ট, কিন্তু সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারল—তিনি আসলে অভিনেতাদের উদ্দেশে নির্দেশ দিচ্ছেন। মঞ্চে যেন কুয়াশার ছায়াগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল—কাবেরী দত্ত লাল শাড়িতে দাঁড়িয়ে সংলাপ দিচ্ছেন, শঙ্কর পাল ভাঁড়ামি করছে, আর মীনা কান্নাভেজা মুখ নিয়ে সেই অসমাপ্ত সংলাপ শেষ করার চেষ্টা করছে। তারা সবাই যেন আবার বেঁচে উঠেছে, তবে মাংস-রক্তের মানুষ হিসেবে নয়—বরং অভিশপ্ত আত্মা হিসেবে। আর তাদের পরিচালক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন অমরেশ সেন।
এই দৃশ্য দেখে দীপা আর সামলাতে পারল না। ভয়ে সে জোরে চিৎকার করে দৌড় দিল অডিটোরিয়ামের দরজার দিকে। দরজাটা বাইরের দিক থেকে তালাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ভয়ের চোটে সে পাগলের মতো হাত-পা দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগল। বাকিরা পেছনে তাকিয়ে দেখল, অমরেশের ছায়া ধীরে ধীরে দীপার দিকে ঘুরছে। তার চোখের লাল শিখা যেন আঁধার চিরে দীপাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সেই মুহূর্তে দীপা প্রাণপণে দরজা ভেঙে বাইরে ছুটে বেরিয়ে গেল। দরজা কীভাবে খুলে গেল, কেউ বুঝতে পারল না—হয়তো তার মরিয়া চেষ্টায় ভেঙে গিয়েছিল, আবার হয়তো ভেতরের অভিশপ্ত আত্মারাই তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বাকি তিনজন স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারা শুধু দীপার চিৎকার শুনতে পেল, তারপর তার পদধ্বনি মিলিয়ে গেল বাইরের আঁধারে। কিন্তু ভেতরে থাকা তিনজনের সামনে তখনও অমরেশের ছায়া দাঁড়িয়ে ছিল, লাঠি ঠকঠক করে মঞ্চের নির্দেশ দিচ্ছিল।
মুহূর্তগুলো যেন সময়কে থামিয়ে দিয়েছিল। অমরেশ সেনের আত্মা কোনো মানুষের মতো নয়, বরং মঞ্চের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর মৃত্যুর পরও তিনি নাট্যকার, পরিচালক আর শাসক—তাঁর থিয়েটারই তাঁর রাজ্য। অদৃশ্য অভিনেতারা তাঁর নির্দেশে এখনও অভিনয় করে চলেছে, অসমাপ্ত নাটক শেষ করার জন্য হয়তো বারবার ফিরে আসছে। অর্ণব, জয়িতা আর রাহুল বুঝতে পারল তারা এমন এক জগতে ঢুকে পড়েছে, যেখান থেকে বের হওয়া হয়তো আর সম্ভব নয়। তাদের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল, মনে হলো প্রতিটি নিঃশ্বাসে তারা আগুনের ধোঁয়া আর মৃত্যুর গন্ধ টেনে নিচ্ছে। আর অমরেশের সেই লাল দৃষ্টি যেন তাদের দিকে ঘুরে এলো, তাঁর লাঠি ঠকঠক করে জানিয়ে দিল—এখন তারা-ও হয়তো এই অভিশপ্ত নাটকের চরিত্র হয়ে যাবে, চিরকালের জন্য।
৪
অডিটোরিয়ামের ভেতরের বাতাসটা হঠাৎই বদলে গেল। চারপাশে জমে থাকা কুয়াশার ভিতর দিয়ে যেন এক অচেনা আলো ভেসে আসতে লাগল। মঞ্চের ধুলো জমা মেঝে থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল এক আলোকরেখা, আর সেই আলো মঞ্চকে ঘিরে ধরতেই পর্দার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক নারীর ছায়া। প্রথমে মনে হলো হয়তো এটা ধোঁয়ার খেলা, কিংবা আলোর বিভ্রম, কিন্তু ধীরে ধীরে ছায়াটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তিনি ছিলেন কাবেরী দত্ত—সেই অভিনেত্রী, যিনি জীবদ্দশায় সৌন্দর্য আর প্রতিভায় শহরের দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন, আর মৃত্যুর রাতে আগুনের ভেতর দাউদাউ করে পুড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তিনি দাঁড়িয়ে আছেন মঞ্চে, লাল শাড়ি পরে, যেন ঠিক আগের মতো নাটকের চরিত্রে অভিনয় করছেন। শাড়িটার রঙ লাল হলেও তাতে ছড়িয়ে আছে পোড়া দাগ, যেন আগুনের ছোঁয়া চিরকালের জন্য আঁচড় কেটে রেখে গেছে। তার মুখের গালে পোড়া চিহ্ন, তবুও চোখদুটো উজ্জ্বল—একটা অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তরুণেরা শিউরে উঠল, অথচ চোখ সরাতে পারল না।
কাবেরীর কণ্ঠ ভেসে এল ধীরে ধীরে, সংলাপ বলতে শুরু করলেন তিনি। প্রথমে মনে হলো যেন মঞ্চের পুরনো কোনো নাটকের টেপ চালু হয়েছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর স্পষ্ট বোঝা গেল—এটা কোনো রেকর্ড নয়। কণ্ঠটা সরাসরি তাদের সামনে থেকে আসছে। তার সংলাপে নাটকীয়তা আছে, কিন্তু সেই নাটকের মধ্যে মিশে আছে এক অদ্ভুত ব্যথা—যেন আগুনে পুড়ে যাওয়ার আর্তনাদ তার প্রতিটি শব্দের ভেতর ঢুকে আছে। তিনি যখন বললেন, “জীবন একটি প্রদর্শনী, আর প্রদর্শনীর শেষে থাকে নিঃশ্বাসহীন অন্ধকার”—তখন মনে হলো তার গলায় দম আটকে আসছে, শ্বাসরোধী কষ্ট মিশে আছে সংলাপে। তরুণদের মনে হলো তারা সত্যিই একটি নাটক দেখছে, তবে সেটি আর সাধারণ নাটক নয়—এটা যেন মৃত্যুর পরের অভিনয়, এক ভৌতিক প্রদর্শনী, যেখানে বাস্তব আর অলীক মিলে গেছে। জয়িতার গলা শুকিয়ে গেল, ফিসফিস করে সে বলল, “সে আসলেই কাবেরী দত্ত…”
দর্শকাসনে বসে থাকা তরুণদের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে লাগল। প্রথমে তারা ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু কাবেরীর কণ্ঠ যেন তাদের ধীরে ধীরে মুগ্ধ করে ফেলছিল। অর্ণব চোখ না সরিয়ে তাকিয়ে ছিল মঞ্চের দিকে, মনে হচ্ছিল সে নিজেই নাটকের দর্শক নয়, বরং কোনো চরিত্র, যে কাবেরীর সংলাপ শুনে সাড়া দেবে। রাহুলের বুক কাঁপছিল, কিন্তু তবুও সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফিসফিস করে সংলাপটা পুনরাবৃত্তি করছিল। মঞ্চের আলো লাল হয়ে উঠেছিল, যেন পুরো অডিটোরিয়াম এক আগুনের খাঁচা, আর সেই আগুনের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন কাবেরী দত্ত। তার চোখে ছিল অদ্ভুত দুঃখ, সেই দুঃখ যেন তরুণদের হৃদয়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। দীপার অনুপস্থিতি তখন আর তারা মনে রাখছিল না, যেন চারপাশের সব ভয় তারা ভুলে গেছে। তারা শুধু বসে আছে, এবং মঞ্চের নাটক দেখছে, যেভাবে একসময় শহরের মানুষরা কাবেরীর অভিনয় দেখতে বসত। কিন্তু পার্থক্য হলো—এই নাটকের দর্শক তারা একমাত্র, আর এই নাটক আর কখনো শেষ হবে না।
কাবেরীর সংলাপ ধীরে ধীরে ক্রমশ করুণ হয়ে উঠছিল। তিনি বললেন, “আমরা সবাই চরিত্র, যাদের লেখা হয়েছে, যাদের মৃত্যু আগুনে লেখা ছিল। এখনো আমরা অভিনয় করি, কারণ অসমাপ্ত নাটককে শেষ করতেই হবে।” তার কণ্ঠে দহনমিশ্রিত যন্ত্রণার সঙ্গে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা মিশে ছিল। তিনি যেন তরুণদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, যেন বলতে চাইছিলেন—এখন তোমরাও এই নাটকের দর্শক নও, তোমরাও চরিত্র। তরুণদের গা শিরশির করে উঠল। তারা বুঝতে পারল কাবেরীর আত্মা কেবল সংলাপ দিচ্ছে না, বরং তাদেরও টেনে নিচ্ছে সেই অভিশপ্ত মঞ্চের ভেতর। রাহুল হঠাৎ চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল, “চল, এখান থেকে বেরোই, না হলে আমরাও শেষ!” কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়েই তারা বুঝল, বেরোনোর পথ আবার অদৃশ্যভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কাবেরীর সংলাপ তখনও চলছে, তার লাল শাড়ি দুলছে বাতাসে, চোখে জল চিকচিক করছে, আর সেই দৃশ্য তরুণদের মনে অমোঘ ছাপ ফেলে যাচ্ছিল। তাদের বোঝা যাচ্ছিল—এখন তারা আর দর্শক নয়, বরং এই মঞ্চের অভিশপ্ত প্রদর্শনীর অংশ হয়ে গেছে।
৫
মঞ্চের লাল আলোর আবেশ তখনও মিলিয়ে যায়নি, কাবেরীর কণ্ঠ যেন দেয়ালের ভেতর প্রতিধ্বনির মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎই থিয়েটারটা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল, যেন অচেনা কোনো কম্পন ভেতর থেকে উঠে আসছে। অর্ণব প্রথমেই আঁচ করল, এ আর কোনো সাধারণ শব্দ নয়—এটা হাসি। কিন্তু সে যে হাসি শোনে তাতে কোনো প্রাণ নেই, বরং সেই হাসি যেন মৃত্যুর অন্ধকার থেকে ছুটে আসছে। এক মুহূর্তে শব্দটা নরম খিলখিল হাসি থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে উচ্চকণ্ঠ, বিকৃত অট্টহাসিতে পরিণত হলো। আর সেই অট্টহাসি ছড়িয়ে পড়ল পুরো অডিটোরিয়ামে, যেন চারপাশের প্রতিটি ভাঙা চেয়ার, প্রতিটি ধুলোমাখা দেয়াল একসাথে হেসে উঠছে। জয়িতা কানে হাত চাপল, তবুও হাসিটা তার মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। রাহুল কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এই হাসি… এটা শঙ্করের!” সত্যিই, যিনি জীবদ্দশায় থিয়েটারের প্রিয় হাস্যরস অভিনেতা ছিলেন, দর্শকদের খিলখিল করে হেসে উঠতে বাধ্য করতেন, তাঁর আত্মাই যেন আজ মঞ্চে ফিরে এসেছে। কিন্তু সেই হাসি আর আনন্দের নয়—এটা ভৌতিক, কণ্ঠভাঙা, আর্তনাদে মিশ্রিত।
শঙ্করের আত্মা হঠাৎ মঞ্চে আবির্ভূত হলো, তবে তাঁর চেহারা আগের মতো নয়। যে মানুষ জীবিত অবস্থায় চোখে-মুখে প্রাণবন্ত হাসি নিয়ে উপস্থিত হতেন, তিনি এখন আগুনে পোড়া ছায়ার মতো। তাঁর ঠোঁটগুলো কাটা, দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে, আর ঠোঁটের কোণে জ্বলন্ত দাগ যেন হাসির রেখাকেই বিকৃত করে তুলেছে। তিনি হাততালি দিয়ে হাসতে লাগলেন, আর প্রতিটি হাততালির শব্দ অডিটোরিয়ামের ভাঙা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল। তাঁর চোখে জল টলমল করছে, কিন্তু সেই জলও রক্তের মতো লাল, যা প্রতিটি ফোঁটা মেঝেতে পড়েই অদৃশ্য হয়ে যায়। হাসির ফাঁকে হাহাকার শোনা যাচ্ছিল, যেন প্রতিটি অট্টহাসির গভীরে রয়েছে দমবন্ধ কান্না। অর্ণব আর জয়িতা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল, যেন এই হাসির বৃত্ত থেকে পালাতে চায়। কিন্তু শঙ্করের হাসি যত এগোতে লাগল, তারা তত অনুভব করতে লাগল—এই থিয়েটারে আর কোনো আনন্দ নেই, কেবল বিকৃত স্মৃতি আর মৃত্যুর ছায়া।
দর্শকাসনে বসা তরুণরা দেখল, শঙ্করের ছায়া তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপে একবার করে হেসে উঠছেন, আর সেই হাসির ধাক্কায় মেঝের ধুলো উড়ে যাচ্ছে। রাহুল ভয়ে হিম হয়ে গেল, কারণ হঠাৎ সে দেখল শঙ্করের চোখ সরাসরি তার দিকে স্থির হয়েছে। একসময়কার প্রিয় হাস্যরস অভিনেতা যেন আজ রাহুলকে বিদ্রূপ করছে, তার বুক কাঁপছে, তবুও গলা শুকনো হয়ে গেছে বলে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। শঙ্কর এক অদ্ভুত সুরে বলতে লাগলেন—“হাসো… হাসো… থামো না! এই নাট্যমঞ্চে সবাই হাসবে, সবাই কাঁদবে, তারপর আবার হাসবে।” তাঁর কণ্ঠের প্রতিটি শব্দে একটা পাগলামি লুকিয়ে ছিল। জয়িতা আঁচ করল যে এই হাসি কেবল ভয় জাগাচ্ছে না, বরং তাদের মনের ভেতরে প্রবেশ করছে। তাদের মস্তিষ্কে এক অদ্ভুত বিভ্রম তৈরি হচ্ছিল, যেন চারপাশের ভাঙাচোরা চেয়ারগুলো দর্শকে পরিণত হয়েছে, আর সেই দর্শকেরা সবাই শঙ্করের সঙ্গে অট্টহাসি করছে।
সময়ের বোধ তখন হারিয়ে যাচ্ছিল। শঙ্করের ভৌতিক হাসি যেন তরুণদের আত্মাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, তারা বুঝতে পারল এটা কেবল শোনার মতো শব্দ নয়, বরং এক অভিশাপ। যতক্ষণ তারা এই হলে থাকবে, ততক্ষণ হাসির সঙ্গে কান্নার এই বিভীষিকা তাদের ভেতর ছড়িয়ে পড়বে। অর্ণব হঠাৎই বুঝতে পারল, এই হাসি তাদের স্বাভাবিক মানসিকতা ভেঙে দিচ্ছে। তাদের পাগল করে দেওয়ার জন্যই হয়তো শঙ্করের আত্মা এখানে রয়েছে। একসময়কার শিল্পী এখন কেবল যন্ত্রণার প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন, তাঁর অট্টহাসির আড়ালে চাপা পড়া রয়েছে দগ্ধ দেহের আর্তনাদ। জয়িতা কাঁদতে কাঁদতে ফিসফিস করে বলল, “ও হাসছে না… ও কাঁদছে। ওর হাসির ভেতরে ওর মৃত্যু লুকিয়ে আছে।” রাহুল তখনই বুঝল, এখান থেকে পালানো যতটা জরুরি, ততটাই অসম্ভব। শঙ্করের হাসি পুরো থিয়েটারকে জড়িয়ে ধরেছে, আর তারা—তারা এখন সেই হাসির ভৌতিক নাটকের বন্দি।
৬
অডিটোরিয়ামটা তখনও শঙ্করের বিকৃত হাসির প্রতিধ্বনিতে কাঁপছিল। তরুণদের বুকের ভেতর সেই ভৌতিক কম্পন ছড়িয়ে পড়ছিল যখন হঠাৎই এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। যেন থিয়েটারটা এক নিঃশ্বাসে থেমে গেল। আর সেই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে হঠাৎ করেই মঞ্চের স্পটলাইটগুলো জ্বলে উঠল একে একে। ধুলোমাখা ছাদ থেকে আলো এসে পড়ল মঞ্চে, ভাঙাচোরা ফ্লোরে লাল, নীল, সাদা রঙের আভা ছড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তেই মনে হলো যেন এক অদৃশ্য হাত পুরো আলোকসজ্জা আবার চালু করে দিয়েছে। অর্ণব বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলল, “এটা অসম্ভব! এখানে তো কোনো অপারেটর নেই!” তার গলা কেঁপে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বজ্রপাতের শব্দ কাঁপিয়ে দিল পুরো হল, যেন বাইরে ভয়াবহ ঝড় চলছে, অথচ বাইরে আকাশ ছিল শান্ত ও তারাভরা। আলো আর শব্দের এই অস্বাভাবিক খেলা দেখে জয়িতা কাঁপা গলায় বলল, “এটা… এটা সুধীর চক্রবর্তীর কাজ।” মৃত্যুর আগে যিনি ছিলেন থিয়েটারের আলো-সাউন্ড অপারেটর, সেই মানুষই কি আজও নিজের কাজে বেঁচে আছেন?
স্পটলাইট হঠাৎ ঘুরে এসে তরুণদের ওপর পড়ে গেল। চোখ ধাঁধানো আলোয় তারা কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল তারা এখনো কোনো নাটকের চরিত্র, মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে। আলো একবার নীল হলো, একবার লাল হলো, আর প্রতিটি রঙের সঙ্গে ভেসে এলো ভিন্ন ভিন্ন শব্দ—বজ্রপাত, ঝড়ের গর্জন, শিস বাজানো বাতাস, ভাঙাচোরা দরজার কড়কড় আওয়াজ। এসব শব্দ এত বাস্তব লাগছিল যে অর্ণব অনুভব করল তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। সে তাকাল অপারেটর রুমের দিকে—সেটা অন্ধকার, দরজা ভাঙা, ভেতরে কেউ নেই। তবু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, অদৃশ্য এক আত্মা সেখানেই বসে, নিয়ন্ত্রণ করছে সব। রাহুল দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সুধীর চক্রবর্তী… তুমি মারা যাওয়ার পরও নাটকের আলো-সাউন্ড ছেড়ে যেতে পারোনি, তাই না?” হঠাৎই শব্দ থেমে গিয়ে কেবল একটি স্পটলাইট অডিটোরিয়ামের মাঝখানে পড়ে রইল, যেন সেই আলোতেই লুকিয়ে আছে সুধীর চক্রবর্তীর উত্তর।
এরপর আবার শুরু হলো সেই ভৌতিক প্রদর্শনী। আলো নাচতে লাগল চারপাশে, কখনো মঞ্চে আগুনের মতো লাল আভা তৈরি হলো, কখনো অডিটোরিয়ামজুড়ে সাদা আলোর ঝলকানিতে মনে হলো এক ঝড় এসে পড়েছে। শব্দযন্ত্র যেন জীবিত হয়ে উঠল—অর্কেস্ট্রার ভাঙাচোরা বাক্স থেকে ভেসে এলো বেহালার করুণ সুর, কোথাও থেকে বাজল ঢাকের বিকট আওয়াজ। সবকিছু মিলে এক অদ্ভুত অর্কেস্ট্রা তৈরি করল, যেখানে সুর আর অসুর মিশে একাকার। তরুণদের মনে হচ্ছিল তারা কেবল দর্শক নয়, বরং মঞ্চের অভিনেতা, যাদের ওপর এই আলো আর শব্দের অভিশাপ নেমে এসেছে। জয়িতা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল, “ও আমাদের সঙ্গে খেলছে… ও নিজের মতো করে নাটক সাজাচ্ছে।” সত্যিই তাই—যেভাবে একসময় সুধীর চক্রবর্তী আলো-সাউন্ডের মাধ্যমে নাটককে জীবন্ত করে তুলতেন, আজ তিনি মৃত্যুর পরেও ঠিক একইভাবে মৃত আত্মাদের মঞ্চনাটককে বাস্তব রূপ দিচ্ছেন। কিন্তু পার্থক্য হলো, আজকের এই নাটক আনন্দ দেওয়ার জন্য নয়, বরং ভয়ের গভীরে ঠেলে দেওয়ার জন্য।
তরুণরা চারদিকে তাকিয়ে বুঝল, তারা এক অভিশপ্ত প্রদর্শনীর মধ্যে বন্দি হয়ে গেছে। তাদের চারপাশের আলো-সাউন্ড কেবল ভিজ্যুয়াল বা শ্রাব্য নয়, বরং অনুভূত হচ্ছে চামড়ার ভেতরেও। বজ্রপাতের শব্দে তাদের বুক কেঁপে উঠছে, বাতাসের হাহাকার তাদের কানে শিরশিরে ব্যথা দিচ্ছে। অর্ণব হঠাৎই মঞ্চের ধারে দেখতে পেল এক অস্পষ্ট ছায়া—মাথায় হেডফোন, হাতে কন্ট্রোল বোর্ডের লিভার। ছায়াটা এক মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট হলো—এটাই সুধীর চক্রবর্তী। তাঁর চোখ শূন্য, মুখের কোণে পোড়া দাগ, কিন্তু হাত এখনো যন্ত্রের ওপর চলছে, আলো-সাউন্ডের খেলা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁর ঠোঁট নড়ছে, যেন সংলাপ বলছেন, কিন্তু সেই সংলাপ কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কেবল শব্দ আর আলোর অরাজক খেলা চলছেই। রাহুল ভয়ে চিৎকার করে উঠল, “আমরা যদি এখান থেকে না বেরোই, তবে আলো-সাউন্ড আমাদের গিলে খাবে!” কিন্তু দরজাগুলো আবারও বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশে আলো ঝলসে উঠছে, বজ্রপাতের শব্দ কানে বিদ্ধ হচ্ছে, আর সুধীর চক্রবর্তীর আত্মা নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, মৃত্যুর পরেও, চিরন্তন নাটকের অপারেটর হয়ে।
৭
স্পটলাইটের ঝলকানি আর বজ্রপাতের বিকট শব্দ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এলো। যেন থিয়েটার ক্লান্ত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলল, আর ভেতরে নেমে এলো এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। তরুণদের মনে হচ্ছিল তারা কোনো ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় থেকে বেরিয়ে হঠাৎ অচেনা এক অন্ধকারে ঢুকে পড়েছে। ঠিক তখনই শোনা গেল এক ভিন্ন শব্দ—মৃদু কান্না। শব্দটা এত করুণ, এত হৃদয়বিদারক যে প্রথমে মনে হলো যেন কোথাও কোনো বাস্তব মানুষ আটকে আছে। জয়িতা সবার আগে কান পাতল, ধোঁয়াটে অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে আসা সেই কান্না ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। অর্ণব কাঁপা গলায় বলল, “শোনো… এটা মানুষের কান্না… কিন্তু এই হলে তো আমাদের ছাড়া কেউ নেই।” তারা একে অপরের দিকে তাকাল, কিন্তু চোখেমুখে ছিল কেবল বিভ্রান্তি আর আতঙ্ক। কান্নার উৎসটা এবার স্পষ্ট হলো—পর্দার আড়াল থেকে ভেসে আসছে। মঞ্চের বড় লাল পর্দার পেছনে যেন কেউ অদৃশ্যভাবে দাঁড়িয়ে হাহাকার করছে। সেই শব্দে এক ধরনের অজানা বেদনা ছিল, যা বুকের ভেতর ছুরি চালিয়ে দিচ্ছিল।
অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে অর্ণব, জয়িতা আর রাহুল মঞ্চের দিকে এগোল। তাদের পায়ের শব্দ ফাঁকা হলে প্রতিধ্বনি তুলল, যেন তারাও কোনো নাটকের চরিত্র হয়ে যাচ্ছে। পর্দার সামনে দাঁড়াতেই কান্নার শব্দ আরও তীব্র হলো। মৃদু শ্বাস নিতে নিতে জয়িতা ফিসফিস করে বলল, “ওখানে… কেউ আছে।” ধীরে ধীরে তারা পর্দা সরাল, আর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ছায়ামূর্তি। এক তরুণী—সাদা ছায়ার মতো, কিন্তু শরীরটা কাঁপছে কান্নায়। তাঁর গায়ে একটা ফ্যাকাশে পোশাক, চুল এলোমেলো, আর চোখ ভরা জল। তিনি ছিলেন মীনা সেনগুপ্ত, যিনি জীবদ্দশায় এক উঠতি অভিনেত্রী ছিলেন। কিন্তু সেই ভয়াবহ আগুনের রাতে মঞ্চে ওঠার আগেই মারা যান, তার প্রথম প্রধান চরিত্র অভিনয়ের স্বপ্ন কখনো পূরণ হয়নি। এখন তিনি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন, ঠিক যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন মৃত্যুর আগের মুহূর্তে, ভয়ে মঞ্চে উঠতে পারছেন না। তাঁর ঠোঁট কাঁপছিল, যেন কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু বেরোচ্ছিল কেবল কান্নার শব্দ।
মীনার উপস্থিতি দেখে তরুণদের হৃদয় ভারী হয়ে উঠল। শঙ্করের বিকৃত হাসি কিংবা সুধীরের আলো-সাউন্ডের অভিশাপ যতটা ভয় জাগিয়েছিল, মীনার কান্না তার থেকেও বেশি যন্ত্রণা ছড়িয়ে দিল। জয়িতার মনে হলো, এই কান্নায় কেবল ভূতের ভয় নেই, বরং অপুর্ণতার যন্ত্রণা, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা মিশে আছে। মীনা মঞ্চে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে রইল, যেন অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রেখেছে। তার চোখে এত গভীর দুঃখ যে তা সরাসরি তরুণদের হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিল। রাহুল একসময় সাহস করে বলল, “তুমি কি… আমাদের কিছু বলতে চাইছো?” মীনা মুখ খুলল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। কেবল কান্না। তারপর হঠাৎ তাঁর দেহ আরও কেঁপে উঠল, চোখ থেকে অশ্রুধারা গড়িয়ে মাটিতে পড়তে লাগল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই অশ্রু মাটিতে পড়েই মিলিয়ে যাচ্ছিল, কোনো চিহ্ন থাকছিল না, যেন এ কান্না বাস্তব জগতের নয়। হঠাৎ এক মুহূর্তে আলো নিভে গেল, আর কান্নার শব্দ থেমে গিয়ে বাতাসে শূন্যতা নেমে এলো। তরুণরা চোখ মেলে তাকাল, দেখল—মীনা আর নেই।
মীনার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যেন তাদের মনে আরও শূন্যতা তৈরি করল। জয়িতা শ্বাস নিতে নিতে ফিসফিস করে বলল, “ও আমাদের কাছে সাহায্য চাইছিল… কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারিনি।” অর্ণবের বুকের ভেতর চাপা ব্যথা জমে উঠল, কারণ সে বুঝতে পারছিল, মীনার আত্মা আজও আটকে আছে সেই অসম্পূর্ণ মুহূর্তে—যখন তাকে মঞ্চে উঠতে হতো, কিন্তু ভাগ্য তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর অন্ধকারে। সেই অসম্পূর্ণতা আজও তাকে পর্দার আড়ালে আটকে রেখেছে। তরুণরা অনুভব করল, এই থিয়েটারের প্রতিটি আত্মা তাদের নিজস্ব যন্ত্রণা নিয়ে এখানে বাঁধা, কেউ বিকৃত হাসিতে, কেউ আলো-সাউন্ডের খেলায়, আর কেউ কান্নায়। মীনার কান্না যেন একটা অদৃশ্য দাগ কেটে গেল তরুণদের হৃদয়ে—এমন দাগ, যা তাদের সারাজীবন তাড়া করবে। কিন্তু তারা তখনও জানত না, এই যন্ত্রণা কেবল শুরু, কারণ থিয়েটারের প্রতিটি কোণে অপেক্ষা করছে নতুন ভৌতিক অধ্যায়।
৮
অডিটোরিয়ামজুড়ে তখনও মীনার কান্নার ছাপ রয়ে গেছে। তরুণদের বুক কাঁপছিল, যেন প্রতিটি শ্বাসের ভেতর দিয়ে সেই অদৃশ্য যন্ত্রণা ঢুকে যাচ্ছে। তারা একে অপরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই আবার নেমে এলো ভয়ঙ্কর নীরবতা। এত গভীর নিস্তব্ধতা যে নিজেদের হৃদস্পন্দনও মনে হচ্ছিল কোনো ভৌতিক সঙ্গীতের অংশ। হঠাৎ সব আলো নিভে গেল। থিয়েটারের ভেতরটা একেবারে অন্ধকার, যেন পৃথিবী থেকেই আলো শুষে নেওয়া হয়েছে। সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবাই প্রথমে বিভ্রান্ত হলো, তারপর আতঙ্কে জমে গেল। হঠাৎ কোথা থেকে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে এল—পোড়া কাঠ আর মানুষের দগ্ধ মাংসের গন্ধ। মুহূর্তেই তাদের মনে সেই ভয়াবহ আগুনের রাত ভেসে উঠল। ঠিক তখনই মঞ্চের মাঝখানটা কাঁপতে শুরু করল, আর অন্ধকারের বুক চিরে আবির্ভূত হলো এক মুখোশধারী চরিত্র—যাকে সবাই কেবল শুনে এসেছে গুজবে, “রক্তচক্ষু।”
তার উপস্থিতি মুহূর্তেই পুরো হলকে এক অদ্ভুত আতঙ্কে ভরে দিল। সে দাঁড়িয়ে ছিল লম্বা কালো পোশাকে, শরীর থেকে যেন ধোঁয়া উঠছে, মুখে এক ভয়ঙ্কর মুখোশ। মুখোশটা অদ্ভুত—মধ্যযুগীয় নাটকের মঞ্চোচিত মুখোশ, কিন্তু এর চোখের জায়গায় আগুনের মতো লাল আভা জ্বলছিল। সেই চোখের দপদপে আলো অন্ধকার ছেদ করে মঞ্চের প্রতিটি কোণ আলোকিত করছিল। তরুণদের মনে হচ্ছিল তারা আর মানুষের চোখ দেখছে না, বরং আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই তার চোখের দিক থেকে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল অডিটোরিয়ামের প্রতিটি আসনে, আর মনে হলো প্রতিটি আসনে বসে থাকা অদৃশ্য দর্শকেরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সেই মুখোশধারীর দিকে। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন শ্বাস নিতে গেলেই আগুন গলায় ঢুকে পড়ছে। জয়িতা ঠোঁট শুকনো করে ফিসফিস করে বলল, “ও… ও-ই রক্তচক্ষু… আগুনের অভিশপ্ত ছায়া।”
রক্তচক্ষু কোনো শব্দ উচ্চারণ করল না। সে কেবল দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু তার উপস্থিতিই ছিল ভয়ের থেকেও ভয়ঙ্কর। মুহূর্তেই মঞ্চে আবির্ভূত হতে লাগল অন্যান্য আত্মারা—অমরেশ সেন তার লাঠি ঠুকতে ঠুকতে দাঁড়িয়ে গেলেন, কাবেরী তার লাল শাড়ি উড়িয়ে সংলাপ বলতে শুরু করলেন, শঙ্করের বিকৃত হাসি ভরিয়ে দিল চারদিক, আর সুধীর চক্রবর্তী আলো-সাউন্ডের খেলা বাড়িয়ে তুললেন। যেন সবাই রক্তচক্ষুর ইশারায় নড়ছে, তার শাসনে বাঁধা। মীনার কান্না আবার ভেসে এল পর্দার আড়াল থেকে। তরুণরা বুঝল, রক্তচক্ষু কেবল একজন চরিত্র নয়, বরং সেই আগুনেরই প্রতীক, যে আগুনে সবাই মারা গিয়েছিল। এই ছায়াই মৃতদের আত্মাকে বন্দি করে রেখেছে, কাউকে মুক্ত হতে দিচ্ছে না। রক্তচক্ষুর লাল চোখ যেন প্রতিটি আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছে। আর তরুণদের দিকে তাকিয়ে সে ধীরে ধীরে হাত তুলল, যেন এবার তাদেরও সেই অদৃশ্য নাটকের অংশ হতে হবে।
অর্ণব বুক ধুকপুক করতে করতে পিছু হটল। তার মনে হচ্ছিল, এই চোখদুটো যদি আরও এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে, তবে সে জীবিত থেকেও আগুনে পুড়ে যাবে। জয়িতা আতঙ্কে অর্ণবের হাত আঁকড়ে ধরল, আর রাহুল মঞ্চ থেকে নামার চেষ্টা করল, কিন্তু পা যেন আটকে গেল মেঝেতে। তারা বুঝল, রক্তচক্ষুর উপস্থিতি কেবল ভয়ের নয়, বরং এক অশুভ শক্তি—যে শক্তি মানুষকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে থিয়েটারের নাটকে আটকে রাখে। অদৃশ্য দর্শকেরা যেন করতালি দিচ্ছে, তাদের ছায়া মেঝেতে নড়ছে। মঞ্চজুড়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছিল, তার ভেতর দিয়ে রক্তচক্ষুর চোখ আরও দপদপে লাল হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, এই চোখ আগুনেরই রূপ, সেই আগুন যেটা কোনোদিন নিভে যায়নি। তরুণরা কেবল একটি জিনিসই বুঝতে পারল—এটা কোনো আত্মা নয়, কোনো মানুষ নয়। এটা হলো অভিশাপের জীবন্ত প্রতীক। রক্তচক্ষু থিয়েটারের প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি যন্ত্রণা আর প্রতিটি অসমাপ্ত স্বপ্নকে একত্র করে আগুনের ছায়ায় বেঁধে রেখেছে। আর আজ সে তাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে, এই নাটক কখনো শেষ হবে না।
৯
থিয়েটারের ভেতরে রক্তচক্ষুর ভৌতিক আবির্ভাব তরুণদের মনকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। তারা যেন জীবন্ত দুঃস্বপ্নে আটকে পড়েছে। কিন্তু হল থেকে পালিয়েও মুক্তি পাওয়া গেল না। বাইরে বেরোতে গিয়ে তারা বুঝল, দরজা আর খোলা নেই—যেন অদৃশ্য এক শক্তি তাদের ভেতরেই আটকে রেখেছে। অবশেষে যখন ভোরের আলো ফুটল, তখনই সেই ভৌতিক প্রভাব কিছুটা স্তিমিত হলো। তরুণরা তাড়াতাড়ি স্থানীয়দের কাছে ছুটল। আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে তারা সবটা বলল—কীভাবে তারা রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হয়েছে, কীভাবে মৃত অভিনেতাদের আত্মারা এখনো মঞ্চে অভিনয় করছে। স্থানীয়রা ভয়ে কেঁপে উঠল, কিন্তু তাদের চোখেমুখে বিস্ময়ের চেয়ে বেশি ছিল হতাশার ছাপ। এক বৃদ্ধ লোক, যিনি একসময় থিয়েটারের আলো নিয়ন্ত্রণ করতেন, ধীরে ধীরে সত্য প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, “রক্তচক্ষু কোনো সাধারণ ভূত নয়। ও আসলে অসম্পূর্ণ নাটকের প্রতীক। যেই নাটক আগুনের রাতে শেষ হতে পারেনি, সেই নাটকই রক্তচক্ষুর জন্ম দিয়েছে। আগুনের সঙ্গে মিশে অভিনেতাদের আত্মা এই চরিত্রে বন্দি হয়ে গেছে।”
তরুণরা হতবাক হয়ে শুনছিল। জয়িতা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল, “মানে… রক্তচক্ষু কোনো আলাদা আত্মা নয়?” বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। তিনি বললেন, “না। রক্তচক্ষু আসলে সবার যন্ত্রণা, সবার অপূর্ণতা, সবার ভয় এক হয়ে তৈরি করেছে। নাটকটা শেষ হয়নি বলে তার প্রতিটি চরিত্র অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। কাবেরী দত্ত লাল শাড়ি পরে সংলাপ শেষ করতে পারেননি, শঙ্কর তার হাসি দিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে পারেননি, মীনা প্রথমবার মঞ্চে উঠতে পারেননি… আর অমরেশ সেনও শেষ নির্দেশ দিতে পারেননি। তারা সবাই মিলে রক্তচক্ষুর ছায়ায় বাঁধা পড়েছে।” অর্ণব ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল সত্যিটা। এ কেবল ভূতের অভিশাপ নয়, এ হলো অসম্পূর্ণ শিল্পের প্রতিশোধ। যখন কোনো শিল্পী অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তার আত্মা শান্তি পায় না। সেই অসম্পূর্ণতাই এক অশুভ শক্তি হয়ে আবির্ভূত হয়েছে।
রাহুল কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। “তাহলে মুক্তির উপায় কী?”—সে প্রশ্ন করল। বৃদ্ধ লোক গভীর নিশ্বাস ফেললেন। “একটাই উপায় আছে। নাটকটা শেষ করতে হবে। রক্তচক্ষু তখনই মিলিয়ে যাবে, যখন নাটকটা শেষ অঙ্ক পর্যন্ত মঞ্চস্থ হবে। যতদিন নাটক অসম্পূর্ণ থাকবে, আত্মারা মুক্তি পাবে না।” কথাটা শোনার পরই তরুণদের মনে ভয় আর দায়িত্ব দুই-ই জন্ম নিল। জয়িতা বলল, “কিন্তু আমরা তো অভিনেতা নই! আমরা কীভাবে ওই নাটক মঞ্চস্থ করব?” বৃদ্ধের চোখে যেন অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল। তিনি বললেন, “তোমরাই পারবে। ওরা তোমাদেরকে দেখে মনে করেছে নতুন অভিনেতা এসেছে। তাই তো তোমাদের ছাড়েনি। হয়তো ভাগ্য তোমাদের দিয়েই নাটকটা শেষ করাতে চায়।” কথাগুলো শুনে তরুণদের বুক কেঁপে উঠল। তারা বুঝল, নিজেদের অজান্তেই তারা এমন এক নাটকের অংশ হয়ে পড়েছে, যেখান থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই।
অর্ণব সবার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, “আমাদের ভয় পাওয়া যাবে না। যদি নাটক শেষ করলেই আত্মারা মুক্তি পায়, তবে আমাদের সেটা করতেই হবে।” জয়িতা ও রাহুল প্রথমে দ্বিধায় ছিল, কিন্তু পরে মাথা নেড়ে রাজি হলো। তারা জানল, এখন আর এটি কেবল কৌতূহল নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর দায়িত্ব। রাত নামার আগেই তারা পুরনো পাণ্ডুলিপি জোগাড় করল—অমরেশ সেনের অসম্পূর্ণ নাটকের শেষ অঙ্ক। পাতাগুলো পোড়া আর ছেঁড়া ছিল, কিন্তু ভেতরের সংলাপ এখনো স্পষ্ট। পড়তে পড়তে তারা উপলব্ধি করল, নাটকটা আসলে মানুষের অহংকার আর আগুনের প্রতীকী কাহিনি—যেখানে শেষ দৃশ্যে রক্তচক্ষুর মুখোশ খোলা হয়, আর তার ভেতরকার মানুষটাকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেই মুহূর্তে তরুণদের মনে হলো, এ শুধু নাটকের গল্প নয়, বরং সত্যিই মুক্তির চাবিকাঠি। তারা সিদ্ধান্ত নিল, যে কোনো মূল্যে এই নাটকটা শেষ করতে হবে, নাহলে রক্তচক্ষু চিরকাল বেঁচে থাকবে এই থিয়েটারে।
১০
রাত নেমে এসেছে। আকাশজুড়ে মেঘ জমে অদ্ভুত গাঢ় অন্ধকার তৈরি করেছে, যেন পুরো পৃথিবী কোনো চূড়ান্ত দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করছে। তরুণরা তিনজন—অর্ণব, জয়িতা আর রাহুল—মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল, হাতে অমরেশ সেনের অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি। তাদের বুক ধুকপুক করছে, কিন্তু আর ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। ঠিক তখনই মঞ্চের মাঝখানে আলো জ্বলে উঠল, আর ধোঁয়ার ভেতর থেকে আবির্ভূত হলো অমরেশ সেনের আত্মা। তার চোখে সেই চিরচেনা কঠোর শাসকের ছাপ, কিন্তু ভেতরে কোথাও এক অদৃশ্য যন্ত্রণা। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “আমাদের শেষ প্রদর্শনী শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি মিলবে না। তোমরাই আমাদের উত্তরাধিকারী, তোমরাই শেষ অঙ্ক সম্পূর্ণ করবে।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশ থেকে একে একে আত্মারা জড়ো হলো। কাবেরী লাল শাড়ি পরে এলেন, মুখে এক অদ্ভুত শান্তির ছাপ; শঙ্কর তার অদ্ভুত হাসি থামিয়ে গম্ভীরভাবে দাঁড়ালেন; সুধীর আলো-সাউন্ড নিয়ন্ত্রণে পুরো মঞ্চ সাজিয়ে তুললেন; আর পর্দার আড়াল থেকে মীনা চোখ মুছে সামনে এসে দাঁড়ালেন। তরুণদের মনে হলো, এ আর কোনো ভূতের খেলা নয়—এ যেন ইতিহাসের এক অপূর্ণ অধ্যায় পূর্ণ হতে চলেছে।
মঞ্চে শুরু হলো অসম্পূর্ণ নাটকের সমাপ্তি। প্রতিটি সংলাপে আগুনের স্মৃতি ভেসে উঠছিল, কিন্তু এবার তার ভেতরে আর ভয়ের চেয়ে বেশি ছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। কাবেরী সংলাপ বলতে বলতে মঞ্চজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তার কণ্ঠে পোড়া যন্ত্রণার ছাপ থাকলেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি ভেসে আসছিল। শঙ্কর, যিনি সবসময় হাসি দিয়ে মানুষের মন জয় করতেন, আজ কোনো বিকৃত হাসি নয়, বরং করুণার সুরে কথা বলছিলেন। সুধীর বজ্রপাতের শব্দ, বৃষ্টির ঝড়, আলো-আঁধারির খেলা দিয়ে এমন এক আবহ তৈরি করলেন যে তরুণদের মনে হলো তারা বাস্তব আর অতীতের মাঝামাঝি কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। আর মীনা—যিনি এতদিন মঞ্চে আসতে ভয় পেয়েছিলেন—তিনি এবার কাঁপা কাঁপা পায়ে মঞ্চে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে অশ্রু ঝরছিল, কিন্তু সেই অশ্রু আর ভয়ের ছিল না; বরং মুক্তির আশায় ভেজা। তরুণরা নিজেদের সংলাপ পড়তে পড়তে অনুভব করছিল, তারা যেন কোনো নাটক নয়, বরং এক আত্মিক সাধনা সম্পন্ন করছে। প্রতিটি সংলাপ তাদের বুকের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, যেন মৃত আত্মাদের সঙ্গে তাদের হৃদয়ের যোগসূত্র গড়ে উঠছে।
শেষ দৃশ্যের সময় পুরো অডিটোরিয়াম থমথমে হয়ে গেল। চারদিক থেকে অদৃশ্য দর্শকের করতালি ভেসে আসছিল, কিন্তু সেই শব্দে ভয়ের কোনো ছাপ ছিল না; বরং এক অদ্ভুত তৃপ্তি। মঞ্চে আবির্ভূত হলো রক্তচক্ষু—তার মুখোশের লাল চোখ আরও দপদপে হয়ে উঠেছিল। তরুণরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু নাটকের নির্দেশনা অনুযায়ী অর্ণব ধীরে ধীরে রক্তচক্ষুর দিকে এগিয়ে গেল। জয়িতা সংলাপ বলতে বলতে তার মুখোশের দিকে হাত বাড়াল। মূহূর্তের জন্য থিয়েটার কেঁপে উঠল, বজ্রপাত হলো, আগুনের শিখা যেন দেয়াল থেকে বেরিয়ে এল। রাহুল ভয় পেয়েও থেমে রইল না; সে শেষ সংলাপটা উচ্চারণ করল—“আগুন মানুষকে পোড়ায়, কিন্তু আলো মানুষকে মুক্তি দেয়।” সেই মুহূর্তেই মুখোশটা খুলে পড়ল মাটিতে। রক্তচক্ষুর ভেতরকার শূন্যতা থেকে এক অসীম আলো বেরিয়ে এসে পুরো মঞ্চ ভরিয়ে দিল। তরুণদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল, কিন্তু তারা অনুভব করল—এটা আর আগুন নয়, এটা মুক্তির আলো।
আলো থেমে গেলে দেখা গেল, একে একে আত্মারা মিলিয়ে যাচ্ছে। কাবেরী শেষবারের মতো মাথা নত করলেন, তাঁর লাল শাড়ির ভাঁজ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হলো; শঙ্কর মৃদু হাসি দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় নিলেন; সুধীরের আলো-সাউন্ড নিভে গেল নিঃশব্দে; মীনা চোখের অশ্রু মুছে শান্ত মুখে মিলিয়ে গেলেন। সবশেষে অমরেশ সেন লাঠি ঠুকে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে এক অদ্ভুত শান্তির ছাপ, আর কণ্ঠে গভীর প্রশান্তি। তিনি বললেন, “ধন্যবাদ। আজ নাটক শেষ হলো। আজ আমরা মুক্ত।” তাঁর শরীর ধীরে ধীরে আলোতে বিলীন হয়ে গেল। অডিটোরিয়াম আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল, যেন কিছুই কখনো ঘটেনি। মঞ্চে পড়ে রইল শুধু খালি আসন, অর্ধেক পুড়ে যাওয়া পর্দা আর গভীর অন্ধকার। তরুণরা নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, কিন্তু বুঝল—আজ “রক্তচক্ষুর থিয়েটার” তার শেষ প্রদর্শনী সম্পন্ন করেছে। ভেতরে কোনো আত্মা আর নেই, আছে শুধু নীরবতা। থিয়েটারটি আবার অন্ধকারে ডুবে গেল, কিন্তু এবার সে অন্ধকার ছিল শান্তির, ভয়ের নয়।
শেষ
				
	
	


