Bangla - প্রেমের গল্প

রক্তগোলাপের গন্ধ

Spread the love

নিলয় সেন


পর্ব ১

রুদ্রর চোখে ঘুম নেই। জানলার ফাঁক গলে ঢুকে পড়া মধ্যরাতের নিঃশব্দ হাওয়ায় বুকের ভেতরটা যেন হালকা হালকা ব্যথা করছে। ঘরের অন্ধকারে হঠাৎ চাদরের ভাঁজে শাড়ির পাড় উঁকি দেয়। দেয়ালের ছায়ার মতোই এখনো রয়ে গেছে অনন্যার উপস্থিতি—তার গন্ধ, তার শরীরের ঘাম, চুলের ভেজা ছোঁয়া। এই কক্ষ, এই বিছানা, এমনকি বাতাসও যেন অনন্যায় মাখা। অথচ সে নেই। চলে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই, যেমনটা সে সবসময় করে। শরীর দেয়, কিন্তু নিজেকে নয়। আর রুদ্র? সে সব জেনে বুঝে তবু বারবার জড়িয়ে ধরে তাকে, যেন আগুনকে ঠোঁটে ছুঁয়ে রাখা যায়।

আজ দুপুরে হঠাৎ করেই এসেছিল অনন্যা। দরজায় কোনো শব্দ না করে ঠেলে ঢুকে পড়া একফোঁটা বৃষ্টি যেন। রুদ্র তখন বই পড়ছিল, কিন্তু চোখে মন ছিল না। অনন্যাকে দেখেই বুঝেছিল, আজ সে এসেছে অন্য এক রূপে। ভেজা হালকা পিচ রঙা শাড়ি, ছিমছাম জড়ানো, পাতলা ব্লাউজের ভেতর লুকোনো শরীরের রেখা যেন ইচ্ছা করেই স্পষ্ট করে রেখেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি জানো, আজকের বৃষ্টির গন্ধটা ঠিক নতুন কাপড়ের মতো। কিংবা, কারও প্রথম চুমুর মতো। পুরোনো স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নতুন কিছু।”

রুদ্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অনন্যার এই কথাগুলো তাকে বারবার কাঁপিয়ে দেয়। এই মেয়েটি জানে, সে কীভাবে কথা বললে শরীর কেমন করে সাড়া দেয়। সে জানে, চোখে কতটা জল রাখলে তা মনে হয় কাজল। সে জানে, স্পর্শ না করেও একজন পুরুষকে ছুঁয়ে ফেলা যায়।

রুদ্র ধীরে ধীরে উঠে এসেছিল। বারান্দা থেকে আলো এসে পড়ছিল ঘরের এক কোণে। সে পিছন থেকে অনন্যার কাঁধে হাত রেখেছিল, খুব ধীরে, যেন কোনও ফুলে হাত রাখছে। অনন্যা চমকে উঠেনি, শুধু চোখ বুজে বলেছিল, “আজ আমাকে একটু বেশি সময় দিও, রুদ্র।” এই কথায় শরীরের ভিতর কেমন একটা হালকা ঢেউ উঠেছিল। রুদ্র তাকে ঘুরিয়ে সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। অনন্যার চোখে তখনও একরকম অস্বস্তি, আবার একটা ঝড়ো ইচ্ছাও।

প্রথম চুমুটা এসেছিল খুব ধীরে, ঠোঁটের পাশে, গালের নিচে, তারপর একটুখানি কানের পেছনে। অনন্যার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল। তার আঙুলগুলো রুদ্রর পিঠে আঁচড় ফেলছিল, একধরনের তীব্রতা নিয়ে। আর রুদ্র যেন নিজের দম ফুরিয়ে ফেলছে এই চুমুতে চুমুতে। তার ঠোঁট খুঁজে নিচ্ছিল অনন্যার সমস্ত অনুচ্চারিত ইচ্ছাকে।

ঘরের ভিতর তখন এক ধরনের উত্তপ্ত নিস্তব্ধতা। চাদরটা বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়েছে, শাড়ির আঁচল ধীরে ধীরে নেমে এসেছে মেঝেতে। রুদ্র অনন্যার শরীরের প্রতিটা বাঁক স্পর্শ করছিল—কখনও ঠোঁটে, কখনও আঙুলে, কখনও নিঃশ্বাসে। অনন্যার বুকের উপর তার হাত রাখা, সেখান থেকে ধীরে নেমে যাওয়া, ঠিক সেইখানে যেখানে হৃদয়ের স্পন্দন আর কামনার স্পন্দন মিশে যায়।

অনন্যা তখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিল না। সে নিজেই খুলে দিচ্ছিল নিজের গন্ধ, নিজের দহন, নিজের ইচ্ছার গোপন পর্দা। তার চোখ বুজে ছিল, কিন্তু ঠোঁট খোলা। সে শুধু বলেছিল, “আমাকে পুরোটা দাও আজ, রুদ্র, এক বিন্দুও রেখে দিও না।” এই কথায় রুদ্রর মধ্যে যেন বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অনন্যাকে বিছানার গভীরে, চাদরের নিচে, ঘামে আর নিশ্বাসে।

তাদের শরীরের মধ্যে তখন আলো আর অন্ধকার একসাথে খেলা করছিল। জানালার বাইরে তখনও বৃষ্টি, মেঘের গর্জন। অথচ ঘরের ভিতর ছিল শরীরের ছন্দ—ঘুমের মতন তীব্র, স্বপ্নের মতন ধোঁয়াটে। রুদ্রর ঠোঁট নামছিল অনন্যার গলার নিচে, বুকের ওপরে, নাভির পাশে। সে যেন পড়ে নিচ্ছিল এক একটা দেহপদ্য, প্রতিটি রেখা পড়ছিল গ্লানিহীন কবির মতন।

হঠাৎ অনন্যা বলেছিল, “তুমি জানো, আমি কাঁটাওয়ালা গোলাপ পছন্দ করি। রক্ত দেখে যদি ভয় না পাও, তবেই স্পর্শ করো।” রুদ্র বলেছিল, “তাহলে আমি সেই কাঁটাতেই নিজেকে ছুঁড়ে দিচ্ছি।” তার আঙুলের ছোঁয়া ছিল আগুনের মত, আবার ঠোঁটের ছোঁয়া ছিল জলের মত।

অনেকক্ষণ পরে, যখন তাদের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়, তখন অনন্যা মাথা রেখেছিল রুদ্রর বুকে। চুপচাপ। শুধু মাঝে মাঝে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছিল তার বুকের হাড় বরাবর। রুদ্র চোখ বন্ধ করেছিল। যেন এই মুহূর্তটাই অনন্ত হোক। যেন শরীরের গন্ধটা থেমে না যায় এত তাড়াতাড়ি।

কিন্তু সেই মুহূর্ত অনন্ত নয়। অনন্যা উঠে পড়েছিল, চুপচাপ। আবার সেই হালকা শাড়ি জড়িয়ে, চুল ঠিক করে, রুদ্রকে একবারও না দেখে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বলেছিল, “আমরা একে অপরের নেশা, কিন্তু ভালোবাসা না। ভুলে যেও না।”

দরজা বন্ধ হয়েছিল। ঘরটা শূন্য হয়ে পড়েছিল আবার। শুধু চাদরে রয়ে গেছে তার ঘাম, ঠোঁটে তার রক্তগোলাপের গন্ধ।

পর্ব ২

রুদ্রর ঘুম ভাঙে ভোরবেলায়, হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটায় জানলার কাঁচ কেঁপে ওঠে। কুয়াশায় ঢাকা সকাল, ঘরের চারপাশে হালকা সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু তাতে তেমন উষ্ণতা নেই। বিছানার পাশের টেবিলে এখনো অনন্যার লিপস্টিক পড়ে আছে—একটা সিলভার কেসিং, যার ঢাকনা ভেঙে গেছে একটু, যেন তার মতোই, পরিপাটি অথচ অস্থির।

রুদ্র সেটাকে হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ, তারপর নিজের ঠোঁটে রেখে দেখে লাল রং লেগে যায় কিনা। কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না সেই স্পর্শ, সেই শরীর, সেই রাতের ঘ্রাণ। সে জানে, এই সম্পর্কের কোনও নাম নেই। অনন্যা যেমন করে আসে, তেমনি করে চলে যায়। মাঝখানে রেখে যায় ধোঁয়াশা, উষ্ণতা আর একরাশ অনুচ্চারিত ইচ্ছা।

সেই সন্ধ্যায় রুদ্র অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে হাঁটে। বটতলার মোড়ে পুরনো চায়ের দোকানে বসে, যেখানে ছেলেবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে গল্প হতো, চুপচাপ একটা ধোঁয়া ওঠা কাপে চা খায়। মাথায় ঘুরতে থাকে অনন্যার শরীর, চোখ, ঠোঁট, আর সেই কথাটা—“আমরা নেশা, ভালোবাসা না।”

রুদ্রের বন্ধু অরিন্দম এসে বলে, “তোর চোখদুটো এমন খালি খালি দেখাচ্ছে কেন, রে?”

রুদ্র হেসে বলে, “খালি না… শুধু পুরনো হয়ে গেছে।”

অরিন্দম ভাবে ও বুঝেছে, প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছে, হয়তো একটা সিরিয়াস রিলেশনশিপ ভেঙেছে। কিন্তু রুদ্র তো জানে, প্রেমের ছ্যাঁকা নয় এটা—এটা এক ধরনের তৃষ্ণার ক্লান্তি। এমন এক খিদে যা কখনও মেটে না, শুধু বাড়তে থাকে।

রাত্রি নামতেই সে বাড়ি ফিরে আসে, আর হঠাৎ করেই দেখে অনন্যার একটা মেসেজ—
“আগামী শুক্রবার আসতে পারবে? দুপুর বারোটায়, আগারপাড়ার ওই পুরনো হোটেলটা মনে আছে?”

রুদ্রর গায়ে একটা শিহরণ খেলে যায়। অনন্যা কখনো এমন করে আগেই বলে না। সবসময় হঠাৎ আসে, হঠাৎ চলে যায়। এবার মনে হচ্ছে সে কিছু ভেবে এসেছে।

শুক্রবারে হোটেলটা একেবারে ফাঁকা, যেন অনেক বছর কেউ আসেনি। সিঁড়িগুলো ধুলোমাখা, দেওয়ালে পুরনো ছোপ ছোপ পানির দাগ, লিফট বন্ধ। তারা ওঠে সোজা সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায়। দরজা খুলেই রুদ্র চমকে যায়।

অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে, সাদা শাড়ি পরা, লাল পাড়, চুল খোলা। চোখে কাজল নেই, ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, তবু সে আগুনের মতো জ্বলছে।

রুদ্র বলল, “তুমি আজ একেবারে আলাদা লাগছে।”

অনন্যা শুধু একটুও হাসে না, বলে, “আজ আমি শুধু শরীর নিয়ে আসিনি। মনও এনেছি।”

এই কথাটা শোনার পর রুদ্র যেন ভিতর থেকে কেঁপে ওঠে। এতদিনের অভ্যস্ত শরীরী সম্পর্কটা আজ হঠাৎ করে গভীর হয়ে উঠছে? নাকি এটাও শুধুই এক খেলা?

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, আর অনন্যা তাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু আজকের জড়ানোটা আলাদা। সেটা শুধু কামনায় ভরা নয়, তার মধ্যে একরকম অবসাদও আছে, একরকম বিদায়ের ইঙ্গিত।

অনন্যা বলল, “তুমি আমার ভালোবাসা হতে পারতে, যদি সময়টা ঠিক হতো।”

রুদ্র বলল, “তবে কি এবার তোমার মনেও কিছু বদল এসেছে?”

অনন্যা বলল, “বদল আসেনি… শুধু ক্লান্তি এসেছে। আর শরীর দিয়ে সব বলা যায় না, সেটা বুঝেছি।”

রুদ্র তার ঠোঁটে চুমু খায়। কিন্তু আজকের চুমুটা আলাদা। সেটা আর আগুন নয়, যেন ঠান্ডা জলের মতো একটা তৃপ্তি। তারা ধীরে ধীরে মিশে যায় বিছানায়।

আজ তারা কোনও তাড়াহুড়ো করে না, আজ কোনও পোশাক ছিঁড়ে যায় না, চাদর নষ্ট হয় না। আজ শরীরের গভীরে গিয়ে তারা খুঁজে পায় নিজেদেরও।

অনন্যা ফিসফিসিয়ে বলে, “তোমার বুকের নিচে মাথা রাখলে আমি কেমন করে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারি। অথচ জানি, এই মুহূর্তটা শেষ হয়ে যাবে।”

রুদ্র বলল, “তাহলে কি আমরা এটাই ছিলাম সবসময়? এক একটা মুহূর্ত, এক একটা নিঃশ্বাস?”

অনন্যা কিছু বলে না। শুধু চোখে জল এসে পড়ে।

রাত গভীর হলে অনন্যা উঠে দাঁড়ায়। চুপচাপ পোশাক পরে, নিজের চুল বাঁধে।

রুদ্র বলে, “আরও কিছুক্ষণ থাকো। আজ যেও না।”

অনন্যা বলে, “থাকলে আমি তোমায় ছেড়ে যেতে পারব না। আর আমার পক্ষে ভালোবাসা মানে একটা ধ্বংস। আমি সেটা চাই না, রুদ্র।”

সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বলে, “আলো যতটা উজ্জ্বল, তার নিচেই ততটা অন্ধকার। আমরা সেই অন্ধকার।”

রুদ্র চুপ করে থাকে। অনন্যা চলে যায় আবার, দরজা বন্ধ হয় এক চিরচেনা শব্দে।

কিন্তু এবার রুদ্র জানে—এই গল্পটা শেষ হয়নি। শুধু অন্য রূপ নিচ্ছে, হয়তো অন্য কোনও রাতে, অন্য কোনও আলোর নিচে।

পর্ব ৩

রুদ্র জানে, এই সম্পর্কের কোনও গন্তব্য নেই, তবু সে প্রতিটি মুহূর্তকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। অনন্যার চলে যাওয়া মানেই তার একরকম খালি হয়ে পড়া—শরীরে, মনে, বিছানায়, অলিন্দে। দিনের আলো যত তীব্র হয়, তার ছায়াও তত ঘনিয়ে আসে; অনন্যা যেন তেমনি, যত বেশি কাছে আসে, তত দূরে চলে যায়।

সে কয়েকদিন পর হঠাৎ অফিসে ঢুকেই অবাক হয়ে যায়—তার টেবিলের উপর একটা সাদা খাম। ওপরে অনন্যার হাতের লেখা, বাঁকা ও নিখুঁত। খোলার পরে একটা ছোট কাগজে লেখা—

“আজ বিকেল পাঁচটায়, গাড়ির পেছনের আসনে বসো। চালক জানে কোথায় যেতে হবে। কেবল এসো, বাকিটা আমায় ছাড়ো।”

এই অদ্ভুত আমন্ত্রণে উত্তেজনার সঙ্গে একরকম আশঙ্কাও ঢুকে যায় রুদ্রর মনে। এতদিন যা ছিল শুধু শরীরী সম্পর্ক, আজ তার ভিতরে ঢুকে পড়ছে নাটকীয়তা, গোপনতা। তবু সে বিকেল পাঁচটায় গেটের সামনে গাড়িতে উঠে বসে—একটা কালো, কাঁচঢাকা SUV। চালক কিছু বলে না, শুধু হালকা মাথা নাড়ে আর গাড়ি চালায় দক্ষিণ কলকাতার দিকে।

যতই রাস্তা এগোয়, শহরের আওয়াজ ফিকে হয়ে আসে। তারা ঢুকে পড়ে একটা নির্জন লেনে—দু’ধারে গাছ আর পুরনো ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের দালান। গাড়ি থেমে যায় একটা নীরব বাংলোর সামনে। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে—অনন্যা।

আজ সে পরেছে একখানা গাঢ় নীল সিল্কের শাড়ি, চুল খোলা, চোখে হালকা কাজল, কিন্তু মুখে একরকম অবসাদ। রুদ্র দরজার কাছে দাঁড়াতেই সে বলল, “এই বাড়িটা আমার ঠাকুরদার। এখন আর কেউ আসে না। আমি শুধু নিজেকে হারিয়ে ফেলতে এলে এখানে আসি।”

রুদ্র ধীরে বলে, “তুমি আমায় এখানে ডেকেছো কেন, অনন্যা?”

সে উত্তর দেয় না। শুধু হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। ঘরটা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরোনো কাঠের গন্ধে ভরা, যেমন গন্ধ থাকে বহুদিন ছোঁয়া না-পাওয়া ডায়েরির পাতায়। সেখানে একটা পুরোনো গ্রামোফোন চলছিল—রাধা আর কৃষ্ণের নৃত্যবর্ণনা এক পুরনো নজরুলগীতির মধ্য দিয়ে গড়িয়ে আসছিল।

অনন্যা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি জানো, রুদ্র, আমি যখন খুব ছোট, তখন প্রথম এই ঘরের পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রথমবার একটা চুমু দেখেছিলাম। দাদুর বন্ধুরা এসেছিলেন, কেউ একজন তার স্ত্রীর ঠোঁটে হালকা করে চুমু খেয়েছিল। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, কারণ তাতে কোনও শব্দ ছিল না, কিন্তু চোখে একরকম আলো ছিল। তখন বুঝিনি, স্পর্শ কেমন নীরব ভাষা। আজ বুঝি।”

রুদ্র পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। অনন্যার পিঠে রুদ্রর হাতের উষ্ণতা ধীরে ধীরে নামে। তার কাঁধে ঠোঁট রেখে রুদ্র বলে, “আজও কি তুমি শুধু শরীর চাও, নাকি কিছু বেশি?”

অনন্যা ঘুরে তাকায়, চোখে জল জমে ওঠে, কিন্তু ফোটে না। সে বলে, “আজ আমি নিজেকে ছেড়ে দিতে চাই, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে। আমার ভিতরে যা লুকোনো ছিল এতদিন, সব খুলে দিতে চাই তোমার কাছে।”

তারা ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগোয়। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোন উত্তাপ নেই—এটা এক নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি। রুদ্র অনন্যার কপালে চুমু খায়, গালে, গলার পাশে, আর হাত ধরে রাখে যতক্ষণ না সে চোখ বুজে নিজেকে মুক্ত করে দেয়।

সেই মুহূর্তে ঘরের মধ্যে একধরনের বৃষ্টি নেমে আসে—তাদের চামড়ার ভেতর, স্নায়ুর গভীরে। রুদ্র অনন্যার পিঠে হাত রাখে, আর অনন্যা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “তুমি আমায় এমন জায়গায় নিয়ে গেলে, যেখানে আমি আগে কোনওদিন ছিলাম না।”

তার নাভির চারপাশে রুদ্রর ঠোঁটের টানে জেগে ওঠে ঘুমন্ত আগুন। গলার নিচে, বুকের বাঁকে, পাঁজরের ফাঁকে, সে পড়তে থাকে অনন্যার শরীরের গোপন ছন্দ। অনন্যা কখনও চোখ বন্ধ করে, কখনও ঠোঁটে কামড় বসায়, কখনও নিঃশ্বাস ফেলে গভীরভাবে। তাদের শরীর আজ আর রক্তে নয়, আবেশে ভাসছে।

অনন্যা ধীরে বলে, “তুমি জানো, আমার ভিতরে অনেক পুরনো ক্ষত আছে। কেউ জেনেছে না। কিন্তু আজ তুমি সেগুলো ছুঁয়েছ, আর আমি ব্যথা পাইনি। আজ আমায় ভালো লেগেছে।”

রুদ্র তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে, “কারণ আমি তোমার ক্ষতকে ভালোবাসি, তোমার আলো-ছায়ার মিলনকেও।”

কয়েক ঘণ্টা পর, বৃষ্টি নামে। বাইরে বাস্তবে, জানলার ওপারে। ভিতরে, তাদের গায়ে জলের মতো ঘাম, বাতাসে শরীরের গন্ধ, আর চোখে শান্তি।

অনন্যা তখন রুদ্রর গায়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘরের ভেতর রয়ে যায় গ্রামোফোনের হালকা আওয়াজ, জানালার কাঁচে টুপটাপ জল, আর বিছানার চাদরে তাদের ভালবাসার ছাপ।

রুদ্র বুঝে যায়, এই সম্পর্ক এখন আর শুধু কামনার নয়। এটা একটা পুরোনো বাতিঘরের মতো—যেখানে আলো কম, কিন্তু পথ হারানো মানুষেরা আশ্রয় খোঁজে।

পর্ব ৪

ভোর পাঁচটায় রুদ্রর ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। জানালার বাইরে অল্প অন্ধকার, ঘরের ভেতর তীব্র নিস্তব্ধতা। পাশ ফিরে দেখে অনন্যা নেই। মাথার নিচে একটা সাদা কাগজ—ছোট্ট একটুখানি নোট।

“আমি চলে গেলাম, রুদ্র। আজকের সকালে আমার কাছে কোনও প্রশ্ন রেখো না। শরীরকে ধুয়ে নেওয়ার মতো, কিছু সম্পর্ককেও বারবার ধুয়ে ফেলতে হয়, যাতে তার গন্ধ না জমে। এই শহরে বেঁচে থাকতে হলে স্মৃতি নয়, বিস্মৃতি শিখতে হয়।”

রুদ্র কাগজটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। তার বুকের ভেতর কিছু একটা হালকা করে ছিঁড়ে যায় যেন। এই নিয়ে কতবার, কতরকম করে অনন্যা এসে গেছে, আবার চলে গেছে। কিন্তু এইবার কি একটু আলাদা ছিল না সবকিছু? এতটা শান্তি, এতটা ঘন অনুভূতির ভিতর থেকে কীভাবে কেউ চলে যেতে পারে?

সে জানে, অনন্যার ভিতরে রয়েছে অনুশোচনা, আত্মরক্ষা, হয়তো একরকম অপরাধবোধও। কিন্তু সে আর ঠিক করতে পারে না, সে অনন্যার কাছে কী—শুধু শরীর, নাকি কিছু গভীর, যা ছুঁয়ে গেলেও বলা যায় না।

দিন কাটে ভারী বৃষ্টিতে। রুদ্র অফিস যায় না। ছাদে উঠে ভেজে, জল ধরে চুল থেকে চুঁইয়ে পড়ে গালে, সে ভাবে—এই শরীরও কি একদিন পুরোটাই অনন্যার স্মৃতি হয়ে যাবে? নাকি সে নিজেই একদিন এত অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এই ‘এসো-চলে যাও’র খেলায় যে ব্যথা আর লাগবে না?

তিন দিন পরে, সে হঠাৎ অনন্যার অফিসে গিয়ে দাঁড়ায়। রিসেপশন তাকে চিনে ফেলে, কিন্তু অবাক হয়। সে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া চলে এসেছে, শুধু অনন্যার চোখে চোখ রাখার জন্য।

অনন্যা সেদিন ঘন ধূসর রঙের কুর্তি পরেছিল, হালকা মেকআপ, কিন্তু চুল খোলা নয়। চোখে কালি, মুখে ক্লান্তি। সে বলে, “এখানে কেন?”

রুদ্র তার দিকে চেয়ে বলে, “তোমার চলে যাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু আমি চাই একবার, একটাই বার তুমি চোখে চোখ রেখে বলো, সবকিছু শুধুই শরীর ছিল। ভালোবাসা কিছুই ছিল না।”

অনন্যা চুপ। ঠোঁট কাঁপে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। তারপর বলে, “তুমি কি জানো, রুদ্র, একটা মেয়ের জীবনে কতভাবে সে নিজেকে হারায়? কখনও নাম বদলাতে হয়, কখনও পরিচয়। আর কখনও শরীরটা থেকেও সে নিজে থাকে না। আমি তোমাকে সবটাই দিয়েছিলাম, কিন্তু আমার ভয় হয়—ভালোবাসলে নিজেকে আবার হারিয়ে ফেলব।”

রুদ্র এগিয়ে আসে, তার আঙুলে অনন্যার হাতের স্পর্শ রাখে। বলে, “হারানো যায় সেই জায়গায়, যেখানে খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছেও থাকে। আমি চাই না তুমি হারাও। আমি চাই তুমি থাকো। তোমার মতো করে। তোমার গতিতে। কিন্তু আমায় ছাড়া না।”

তখন প্রথমবার অনন্যা নিজে রুদ্রর হাত ধরে। নিঃশব্দে বলে, “আসবে আজ রাতে আমার ফ্ল্যাটে?”

রুদ্র কিছু বলে না। শুধু মাথা নাড়ে।

সেই রাতে, তারা প্রথমবার একে অপরকে খুঁজে পায় ঘরের বাইরে, বিছানার বাইরে, আলো-আঁধারির ছায়ার বাইরে। অনন্যার ছোট্ট ফ্ল্যাটে যেন এক আশ্রয় তৈরি হয়। ঘরের এক কোণে ইনডাকশনে গরম হচ্ছে স্যুপ, আর অনন্যা বলছে, “তুমি খেয়েছো তো কখনো ডার্ক চকলেট আর রেড ওয়াইন একসাথে?”

রুদ্র হেসে বলে, “না, তবে শুনেছি—তাতে শরীর হালকা উত্তেজনায় থাকে, কিন্তু মন শান্ত থাকে।”

অনন্যা একটা গ্লাস এগিয়ে দেয়, তারপর তার পাশ ঘেঁষে বসে বলে, “তবে আজ শিখে নাও, শরীর যতটা বলে, মন তারও বেশি চায়।”

তারা একে অপরকে ছুঁতে শুরু করে আরেকভাবে—কেবল তৃষ্ণা মেটাতে নয়, বরং একে অপরকে পড়তে, বুঝতে, স্পর্শের নিচে যে অভিমান, যে ইতিহাস জমে থাকে তাকে আলতো করে খুলে দিতে।

রুদ্র অনন্যার কাঁধে চুমু খায়, গলার পাশে স্নিগ্ধভাবে হাত রাখে। বলে, “তুমি যখন কাঁপো, আমি বুঝি, তুমি ভয় পাও—ভালোবাসার চেয়ে হারানোকে।”

অনন্যা তখন পুরোপুরি খুলে দেয় নিজেকে। সেই শাড়ির আড়াল, সেই স্তনের কোণে জমানো দাগ, বুকের খাঁজে লুকানো কষ্ট—সব তুলে ধরে রুদ্রর হাতে।

তারা সেই রাতে চাদরের ভাঁজে বারবার একে অপরকে হারায়, আবার খুঁজে পায়। রুদ্র আজ অনন্যার নাভির গভীরে চুমু খেয়ে বলে, “তোমার শরীরের প্রতিটা রেখা যেন পুরনো নদীর পাড়ের মতন—কখনও ভাঙা, কখনও গড়া, কিন্তু চিরন্তন।”

অনন্যা হেসে ফেলে, বলে, “তুমি আমায় কবিতা বানিয়ে ফেলছো রুদ্র। আমি তো শরীর ছাড়া কিছু ছিলাম না এতদিন।”

রুদ্র বলে, “কবিতা তো শরীর দিয়েই শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় চোখে। আমি এখন তোমার চোখে লিখছি।”

তারা ঘুমোয় পাশাপাশি, একে অপরের স্পর্শে ঢাকা। আর রাতটা নামে খুব ধীরে, যেন জানে, এ এক প্রেম যা কামনায় শুরু হলেও অনুভবে শেষ হবে।

পর্ব ৫

ঘুম ভাঙে সকাল আটটায়। রুদ্র চোখ মেলে দেখে, তার ডান পাশে অনন্যা নেই। কিন্তু এবার আর তার বুকটা কেঁপে ওঠে না। এবার সে জানে, এই অনুপস্থিতি কোনও পালিয়ে যাওয়া নয়, কোনও ফাঁকিও নয়। সে উঠে বসে, দেখে রান্নাঘর থেকে আসছে কফির হালকা গন্ধ। হ্যাঁ, অনন্যা এবার রয়ে গেছে, অন্তত এই সকালটা তার সঙ্গেই।

বসার ঘরের লাইট নরম, জানালার পর্দা হালকা সরিয়ে সূর্যরশ্মি ঢুকেছে রোদ্দুরের মতো নয়, বরং চেনা শরীরের মতো আলতো, মোলায়েম। অনন্যা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছে, তার পিঠটা ঘেরা এক হালকা গোলাপি স্যাটিনের কামিজে, নীচে ঢেউ খেলানো চুলের নিচে ঝুলছে একটা ছোট্ট কালো দাগ—যা রুদ্র আগে কখনও দেখেনি।

সে পেছন থেকে এসে বলল, “এই দাগটা কি জন্মচিহ্ন?”

অনন্যা একটু চমকে ফিরে তাকালেও হেসে ফেলে, “না, একবার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। সেই ফাটার দাগ। কিন্তু তুমি তো কখনও আগে দেখোনি, সেটা কিভাবে বুঝলে?”

রুদ্র বলল, “তোমার শরীরটা যেন একটা মানচিত্র, আর আমি তার প্রতিটি রেখা, বাঁক, নদী আর গহ্বর পড়ছি। কোথাও থেমে যাচ্ছি, কোথাও আবার এগিয়ে যাচ্ছি। তোমার মধ্যে কোথাও আমার নিজের নাম খুঁজে পাই আমি।”

অনন্যা কফির কাপ হাতে এগিয়ে এল, তার চোখে এবার আর ক্লান্তি নেই, বরং একটা কোমলতা। সেই কোমলতা যা আসে গভীর আত্মসমর্পণের পরে।

তারা দুজনে জানলার ধারে বসে থাকে, কফির কাপে ঠোঁট ছুঁয়ে, চুপচাপ। আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। যেন কথা শেষ হয়ে গিয়েছে গতরাতে, এখন শুধুই অনুভবের পালা।

হঠাৎ অনন্যা বলল, “রুদ্র, তুমি কি জানো, ছোটবেলায় আমি একটা দুঃস্বপ্ন বারবার দেখতাম—একটা বড় জলাশয়, যার মধ্যে আমি একা, চারপাশে কেউ নেই। চিৎকার করলেও কেউ শুনছে না। কখনো ডুবি না, কিন্তু সাঁতারও কাটি না। শুধু জলের মধ্যে স্থির হয়ে থাকি। বড় হয়ে বুঝলাম, সেটা আসলে আমার জীবন ছিল।”

রুদ্র কিছু বলে না। সে জানে, অনন্যা যতই শরীরের দিকে এগিয়ে আসুক, তার ভিতরে একটা স্তর আছে, যা সে এখনো আগলে রেখেছে। একটা স্তর যা ঠিক নিরাপত্তাহীনতার পাঁকে ডুবে আছে।

সে অনন্যার হাত ধরে বলে, “এই জলাশয়ে আমি থাকতে পারি তোমার পাশে। তুমি ডুবলে আমি ডুবব, তুমি সাঁতার কাটলে আমি দেখব। কিন্তু আমি থাকব, শুধু এটাই চাই।”

অনন্যা তাকায় তার দিকে। এবার সে এগিয়ে এসে রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে, মাথা রাখে বুকের উপর। তার ঠোঁটের খুব কাছে কানের পাশ দিয়ে বলে, “তুমি যদি সত্যিই থাকো, তবে আমার দেহের গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে যেও না। প্রতিবার নতুন করে শুঁকো, যেন প্রথম প্রেম।”

তাদের চুমু হয় খুব ধীরে। সকালবেলার আলোতে, কোনও রকম তাড়াহুড়ো ছাড়া। ঠোঁটের ভেতরে শরীরের দোলা নয়, বরং আত্মার মতো এক অনুভূতি—চুপ করে নিজের অবস্থান জানান দেয়।

এইবার তাদের শরীর স্পর্শ করে সম্পূর্ণ অন্য এক ঘরানায়। আগের উত্তেজনার ছায়া নেই, বরং শান্ত অথচ গভীর ছন্দ। রুদ্র অনন্যার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, “তোমার এই অংশটা যেন সবথেকে নিঃসঙ্গ, অথচ সবচেয়ে জোরালো।”

অনন্যা চোখ বুজে থাকে, তার ঠোঁটের পাশে একটা কাঁপুনি ওঠে। তার শরীর এখন আর একা নয়, সে এবার প্রথমবার নিজের সমস্ত কিছু খুলে দেয় রুদ্রর সামনে—ভয়, দুঃখ, অসহায়তা, কামনা—সব।

চাদরের নীচে তাদের শরীর ভিজে যায় ঘামে, তবু তাতে ক্লান্তি আসে না। বরং একরকম নরম আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। যেন শরীর থেকে মন পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি হয়, এবং সেই রাস্তায় তারা হেঁটে যাচ্ছে হাতে হাত ধরে।

অনন্যা বলে, “আমরা কি এভাবে বাঁচতে পারি, রুদ্র? এই শহরে, এই টানাপোড়েনের মধ্যে, একে অপরের শরীর আর মনের ভিতর আশ্রয় নিয়ে?”

রুদ্র উত্তর দেয়, “যদি কেউ আশ্রয় খুঁজে পায়, তবে সে থাকবেই। আমরা আশ্রয় না হই, আশ্বাস হই। তুমি যদি কখনো না পারো ভালোবাসতে, আমায় ছুঁয়ো। আমি বুঝে নেব।”

অনন্যা এবার তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি ভালোবাসি, রুদ্র। কিন্তু আমার ভালোবাসা অনেকখানি জলের মতো—যেটা তুমি ধরতে পারবে না, কিন্তু তোমায় ভিজিয়ে দেবে। তুমি সেই আগুন, যার পাশে আমি একটু একটু করে গলছি। তুমি সেটা বোঝো তো?”

রুদ্র বলে, “আমি চাই তুমি জল থেকেও আগুন হও। তুমি আমায় পোড়াও, ভাসাও, তবু থেকো। এই থাকা-না-থাকার মাঝেও থেকো।”

সকালের ঘরে তখন কেবল কফির গন্ধ, শরীরের উষ্ণতা, আর এক অনুপম উপলব্ধির স্তর। যে স্তরে ভালবাসা আর কামনা আলাদা হয় না, বরং একে অপরকে গলে মিশে যায়।

এই দিনের শেষেও অনন্যা আবার চলে যায়, কিন্তু এবার আর ফেলে রেখে যায় না কোনও খালি বিছানা। সে বলে, “আমি আবার আসব, কিন্তু শুধু শরীর নিয়ে নয়। আমি এবার মন নিয়েও আসব।”

রুদ্র জানে, এই প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে কি না, তাও সে জানে না। কিন্তু একটিবারের জন্য হলেও সে অনুভব করল—এই নারী, এই প্রেম, এই শরীর—সবকিছু এক অনন্য গন্ধে জড়ানো। রক্তগোলাপের মতো—যা রঙিন, কামনাময়, অথচ চিরন্তনভাবে ক্ষতবিক্ষত।

পর্ব ৬

রুদ্রের জন্য দিনগুলো এখন ধীরে চলা কুয়াশার মত। ঘড়ির কাঁটা যত এগোয়, তত অনন্যার কথা মনে পড়ে—তার মুখের ছায়া, নাভির পাশে জমে থাকা ঘামের বিন্দু, অথবা বিছানার চাদরে বাকি থাকা সেই আলতো চুলের রেখা। কিন্তু এখন সে আর শুধুই শরীরের কথা ভাবে না। এখন অনন্যার চোখের ভিতরের ঘরগুলোও তার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে।

একদিন বিকেলে, অফিস ফেরার পথে, সে হঠাৎ থেমে যায় এক পুরনো বইয়ের দোকানে। গন্ধে ভরা সেই কাঠের তাক, পুরনো পৃষ্ঠার শব্দ, সব যেন অনন্যার সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটা বই—“The Sensual Philosophy of Touch”—একটা হালকা, পাতলা প্রবন্ধের বই, কিন্তু পৃষ্ঠা উলটে সে দেখে, সেখানে একটি বাক্য আছে যা যেন অনন্যার মতোই সরল অথচ দুর্ভেদ্য—

“Spoken words reach the ear, but a touch reaches the self.”

সে বইটা কিনে ফেলে। ঠিক তখনই মোবাইলটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে অনন্যার নাম।

“রুদ্র, আজ একটু আসবে? আমি আজ একা, খুব একা…”

তার গলা শুনেই বোঝা যায়, সে আজ শরীর চায় না। সে আজ চাইছে একটা বুক—যেখানে মাথা রাখা যায়, চোখ বুজে থাকা যায়, যেখান থেকে কেউ বারবার উঠে চলে যায় না।

রুদ্র পৌঁছোয় সন্ধ্যে নামার ঠিক আগে। দরজা খুলতেই অনন্যা যেন অন্যরকম দেখায়। চোখে কাজল নেই, ঠোঁটে রঙ নেই, চুল বেঁধে রাখা, আর পরনে সাদা সালোয়ার কামিজ। সে বলে, “আজ তোমাকে ছুঁবো না। তুমি শুধু বসো আমার পাশে।”

রুদ্র কিছু না বলে বসে। অনন্যা একটা নরম আলো জ্বালায়, ঘরটা কমলা আলোর ভিতরে যেন গলে যায়। তারপর ধীরে ধীরে অনন্যা তার কাঁধে মাথা রাখে। রুদ্র অনুভব করে, অনন্যার দেহ এখন জ্বরের মতো উত্তপ্ত, কিন্তু সে তা লুকিয়ে রেখেছে।

“জানো রুদ্র, ছোটবেলায় একটা গল্প শুনেছিলাম—একটা মেয়ে ছিল, যার গায়ে যে-ই হাত দিত, সে আগুনে পুড়ে যেত। তাই সে কাউকে ছুঁতো না। আমি অনেকটা সেরকম। আমার শরীর হয়তো কামনাকে জাগায়, কিন্তু মনটা ভয় পায়… ভয় পায় ভালোবাসাকে।”

রুদ্র চুপচাপ বসে থাকে। তারপর হাত রাখে অনন্যার আঙুলে। বলে, “তাহলে তুমি কি আমায় পুড়িয়ে মারবে, অনন্যা?”

অনন্যা একবার তাকিয়ে হেসে ফেলে, সেই পুরোনো হাসি—যেটা তার ঠোঁটের বাঁকে শুরু হয়ে চোখের কোণে গিয়ে থামে। বলে, “তুমি তো নিজেই আগুন, রুদ্র। আমি শুধু তোমায় আয়না দেখাচ্ছি।”

তাদের মাঝে ততক্ষণে একটা অদৃশ্য উত্তাপ জমে ওঠে। রুদ্র এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, অনন্যার মুখে হাত রাখে, আর আলতো করে বলে, “আজ আমি তোমায় ছুঁবো, কিন্তু কামনার জন্য নয়। আজ আমি তোমায় ছুঁবো, যেন এক পাণ্ডুলিপির উপর হাত রাখি—যার প্রতিটি অক্ষর আমি পড়ে নিতে চাই, ধীরে ধীরে, যত্ন করে।”

অনন্যা উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে জল। ধীরে ধীরে নিজের কামিজ খুলে ফেলে, বুকের পাজরের নিচে, পেটের পাশে, গলার রেখায় জমে থাকা সমস্ত অনুচ্চারিত ভয় খুলে দেয় রুদ্রর সামনে।

রুদ্র এগিয়ে আসে, তাকে বুকে টেনে আনে, কিন্তু এবার সে চুমু খায় না প্রথমে। সে কপালে ঠোঁট রাখে, কাঁধে, নাভির পাশে, তারপর পিঠের গভীর রেখায়। যেন সে এই দেহটাকে ধ্বংস করতে নয়, পরম পূজার মতো ছুঁতে চায়।

চাদরের নিচে এবার আর শরীরের উত্তেজনা নেই, আছে আত্মার মেলবন্ধন। অনন্যার বুকের নিচে সে শোনে একেকটা শ্বাস, একেকটা হৃদস্পন্দন—যা শুধু রক্তে চলে না, ভালোবাসার ভাষাতেও কথা বলে।

অনন্যা বলে, “তুমি জানো, আমি কখনও কারও সাথে এমন করে নিঃস্ব হয়ে যাইনি। আমি সবসময় একটু রেখে দিয়েছি, একটু লুকিয়ে রেখেছি নিজের জন্য। কিন্তু তোমার সঙ্গে পারলাম না।”

রুদ্র তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে, “তোমার যা ছিল, যা নেই, যা হবে—সবটাই আমি চাই। কিছু রেখে দিও না, অনন্যা। আমি জানি, সেই ঝড়ের ভেতরেও তুমি আছো। আমি খুঁজে নিতে পারব।”

তারা দু’জনে একসাথে তীব্র দহন আর প্রশান্তির মাঝে দুলে ওঠে। রাত গভীর হয়, কিন্তু ঘরের ভেতরে কোনও অন্ধকার নেই—আলো ছড়িয়ে থাকে তাদের গায়ে, চোখে, নিঃশ্বাসে।

ভোর হতেই অনন্যা উঠে জানালার ধারে দাঁড়ায়। রুদ্র তখনও শুয়ে, চোখ আধবোজা। অনন্যা ফিরে তাকিয়ে বলে, “আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না এবার। শুধু একটু সময় চাই, নিজেকে পুরোনো ছায়া থেকে বের করে আনতে। তুমি থাকো, এই আলোটা জ্বেলে রেখো আমার জন্য।”

রুদ্র কিছু বলে না। শুধু হাত বাড়িয়ে বলে, “এসো…”

অনন্যা এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ে তার বুকে। আর এই প্রথমবার রুদ্র মনে করে—তারা হয়তো সত্যিই ভালোবাসছে, না শুধু শরীর দিয়ে, না শুধুই মন দিয়ে—একটা ধোঁয়া আর আগুনের মিশ্রণে, যেখানে প্রত্যেক স্পর্শ মানে একটা চিহ্ন, আর প্রত্যেক চিহ্ন মানে একটা কবিতা।

পর্ব ৭

রুদ্র ঘুম থেকে ওঠে দুপুরে। জানালার ফাঁক দিয়ে রোদের রেখা পড়েছে বিছানার মাঝখানে, অনন্যার গায়ে। সাদা চাদরের উপর তার নগ্ন পিঠটা যেন একখানা নিঃশব্দ ক্যানভাস, যেখানে কাল রাতের সমস্ত আবেগের রঙ ছড়িয়ে পড়ে আছে। শরীরটা এতটাই শান্ত, এতটাই কোমল লাগছিল যে, রুদ্রর সাহস হচ্ছিল না ছুঁয়ে দিতে। তার মনে হচ্ছিল, একটু ছোঁয়াই হয়তো এই মুহূর্তটাকে ভেঙে ফেলবে।

অনন্যার চুল এলোমেলো, এক পাশের গালে ভাঁজ পড়ে গেছে বালিশে চেপে। কিন্তু সেই মুখটাকে এত অপূর্ব, এত নিখুঁত লাগছিল যে রুদ্র যেন প্রথমবার দেখছে তাকে। প্রতিবার তারা কাছাকাছি এসেছে শরীরের টানে, কিন্তু এই সকালটা যেন আলাদা। এই ঘন নীরবতার ভেতর যে প্রেম আছে, তা শুধু কামনায় বাঁধা নয়—তা অনেক গভীর, অনেক আন্তরিক।

রুদ্র উঠে গিয়ে ঠোঁটে চা ছোঁয়ায়, তারপর একটা পুরোনো খাতা টেনে নিয়ে কিছু লিখতে শুরু করে। লেখাটা যেন একরকম আত্মা-মেলে-ধরা।

“যখন তোমার শরীরকে ছুঁই, আমার মধ্যে শব্দ জমে ওঠে। সেই শব্দগুলো শুধুই কামনার নয়, তারা ডাকে, কাঁদে, হাসে—তোমার নাম ধরে। তুমি হয়তো জানো না, তুমি আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের ছায়া।”

এই সময় অনন্যার ঘুম ভাঙে। সে ধীরে চোখ মেলে রুদ্রকে দেখে, তারপর নিজের চুল সামলাতে সামলাতে বলে, “তুমি লিখছো?”

রুদ্র হেসে বলে, “তোমাকে।”

অনন্যা হাসে, কিন্তু চোখে একধরনের ধোঁয়াটে আবেগ। সে উঠে আসে, চাদরটা শরীর জড়িয়ে নিয়ে রুদ্রর পাশে বসে। তার গায়ে এখনো রাতের ঘ্রাণ লেগে আছে।

সে বলে, “আমার জীবনে অনেক পুরুষ এসেছে, কিন্তু কেউ কখনো আমায় কবিতায় পরিণত করেনি। তুমি আমাকে ভালোবাসো?”

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলে, “ভালোবাসা কি শুধুই কথায় হয়, অনন্যা? তোমার শরীরকে ছুঁয়ে আমি তোমার মন পড়েছি। তোমার চোখে তাকিয়ে আমি জেনেছি, তুমি কি চাও আর কাকে লুকাও। আমি তোমার ভিতরের সেই নারীকেও ভালোবাসি, যে বাইরে কাউকে দেখায় না নিজেকে।”

অনন্যা কফির মগ হাতে নিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। রোদের ঝিলিক তার চুলে খেলছে। সে বলে, “তুমি জানো, আমি ভেবেছিলাম, পুরুষরা শরীর ছাড়া কিছু বোঝে না। তারা চায়, ছুঁয়ে, চলে যায়। কিন্তু তুমি… তুমি থেকে যাও। এই থাকাটা আমার কাছে অচেনা ছিল। ভয় পাই এখনও।”

রুদ্র তার পেছন থেকে গিয়ে দাঁড়ায়। সে অনন্যার চুলে মুখ গুঁজে বলে, “ভয় পেও না। আমি এখানে আছি—শুধু তোমার শরীরের জন্য নয়, তোমার একাকীত্বের জন্যও।”

অনন্যা চোখ বন্ধ করে। তারপর ধীরে ধীরে চাদরটা ফেলে দেয় নিজের শরীর থেকে। নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকে রুদ্রর সামনে, সম্পূর্ণ, নিঃস্ব, তবু শক্তিশালী।

সে বলে, “এই আমি। কোনও সাজানো প্রেমিকা নই, কোনও মেকআপে ঢেকে ফেলা শরীর নই। আমি এই ত্রুটিপূর্ণ, এই দাগ-মাখা, এই আবেগে ভেজা নারী। তুমি কি আমায় এখনো ভালোবাসো?”

রুদ্র ধীরে তার কপালে চুমু খায়। বলে, “এই তুমি-ই আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি তোমার শরীরকে ভালোবাসি, কারণ তা তোমার আত্মার শরীরী রূপ।”

তারা একে অপরকে আবার ছুঁয়ো, কিন্তু এবার স্পর্শটা অন্যরকম। এবার তারা চুমু খায় অনেকক্ষণ ধরে, যেন প্রতিটি চুমুর মধ্যে জমে আছে অভিমান, আশ্রয়, আবেগ আর অপেক্ষা। রুদ্র অনন্যার বুকের উপর হাত রাখে আর বলে, “এই হৃদয়টা আমার নাম ধরে ডাকে কিনা আমি শুনতে চাই।”

অনন্যা হেসে ফেলে। তার চোখে জল জমে ওঠে, কিন্তু ঠোঁটে প্রশান্তি। সে বলে, “আজ আমার শরীর যে রকম শান্ত, সে রকম শান্ত আমি অনেক বছর হইনি।”

তারা আবার মিশে যায়। রুদ্রর আঙুল চলে যায় তার গলার নিচে, তারপর বুকের বাঁকে, তারপর পেটের কোণে। প্রতিটা বাঁকে সে থামে, চুমু খায়, যেন নিজের উপস্থিতি রেখে যায়।

তাদের শরীর এখন আর তাড়াহুড়ো করে না। কামনার জায়গাটা একধরনের ভালোবাসায় মিশে গিয়েছে। যেন শরীর যেখানে থামে, প্রেম সেখানেই শুরু হয়।

অনন্যা চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ, রুদ্র তার হাত ধরে থাকে। তারপর হঠাৎ সে বলে, “রুদ্র, আমি চেয়েছিলাম তুমি একদিন বলো, আমি তোমায় শুধু চাওয়ার জায়গা নই, থাকার জায়গাও। আজ মনে হচ্ছে, তুমি বুঝেছো।”

রুদ্র বলে, “আমরা কেউই নিখুঁত নই, অনন্যা। কিন্তু আমরা একে অপরের ভিতরে যে শান্তি খুঁজে পেয়েছি, সেটা সত্যি। তুমি যেদিন প্রথম আমার ঠোঁটে বলেছিলে, ‘আমরা শুধু শরীর’, সেদিনও আমি জানতাম—তোমার ভিতরেও প্রেম আছে। শুধু সময় লাগবে। আজ তুমি নিজেই সেটা স্বীকার করলে।”

অনন্যা তার বুকের উপর মাথা রাখে। বলে, “তুমি থাকো। আমি আর পালাতে চাই না। আমি আর দেহ হয়ে থাকতে চাই না শুধু—আমি প্রেম হয়ে উঠতে চাই। তুমি আমার সেই আলো, যা অন্ধকারেও জ্বলে ওঠে।”

রুদ্র তাকে জড়িয়ে ধরে। বিছানার চাদরটা আবার গায়ে মুড়ে তারা চোখ বন্ধ করে। ঘরে তখন শুধুই নিঃশ্বাসের শব্দ, শরীরের উষ্ণতা, আর ভালোবাসার ছায়া।

পর্ব ৮

সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসে অনন্যার ছোট্ট ফ্ল্যাটের জানালার পর্দায়। বাইরের শহরটা যেন দুরে সরে যায়—রাস্তায় গাড়ির হর্ণ, লোকের হাঁটাচলা, হেঁচকা ব্রেকের শব্দ—সব যেন অনেক দূরের কোনও জীবন, যার সঙ্গে রুদ্র আর অনন্যার এই মুহূর্তের কোনও সংযোগ নেই। বিছানার একপাশে চুপ করে বসে থাকা অনন্যার মুখে পড়ে ছায়ার টান। তার চোখের কোণে জল জমে থাকলেও, ঠোঁটে ছিল এক আশ্চর্য শান্তি।

রুদ্র রান্নাঘর থেকে দুটো কফির মগ হাতে নিয়ে আসে। একটা এগিয়ে দেয় অনন্যাকে। সে মগটা হাতে নিয়ে বলে, “জানো রুদ্র, একটা সময় ছিল যখন আমি ভাবতাম—আমি কারও সাথে এক বিছানায় শুয়ে থাকলেও, সে আসলে আমায় স্পর্শ করে না। আমি যেন একটা শরীর, যে শুধু নেওয়ার জন্য তৈরি। কিন্তু তুমি… তুমি যেন আমার গভীরতাকে ছুঁয়ে গিয়েছ। আমার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গায় তুমি আলো জ্বেলে দিয়েছ।”

রুদ্র মগের ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “আমি তোমার দেহের মোহে পড়িনি, অনন্যা। আমি পড়েছি তোমার শরীরের পিছনে লুকিয়ে থাকা কুয়াশায়। আমি প্রতিবার তোমায় ছুঁয়েছি, যেন তোমার ভেতর ঢুকে পড়ি। তোমার চোখের অন্ধকারেই আমি আলো খুঁজে পেয়েছি।”

অনন্যা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, “আমার মনে হয়েছিল, আমার ভেতরের এইসব কেউ কোনোদিন দেখতে চাইবে না। কেউ বুঝবে না আমি শুধু কামনার ঠোঁট নই, আমি একজন মেয়েও—ভাঙা, জোড়া দেওয়া, আবার ভেঙে পড়া। তুমি সেই প্রথম পুরুষ যে আমার চামড়ার নিচের কথা শুনতে চেয়েছো।”

রুদ্র তার হাত ধরে। হাতটা একটুখানি কাঁপে। তাদের মাঝে একটা দীর্ঘ নিঃশব্দতা এসে দাঁড়ায়—কিন্তু সেটা অস্বস্তির নয়, বরং তা এক গভীর নির্ভরতার।

তাদের চোখে চোখ পড়ে। কোনো কথা নেই, তবু যেন হাজার কথা বলা হয়ে যায়। রুদ্র ধীরে অনন্যার দিকে এগিয়ে আসে, কফির মগটা টেবিলে রাখে। তারপর তার ঠোঁট ছোঁয়ায় অনন্যার কপালে।

এই চুমুটা আগের কোনও চুমুর মতো নয়। এতে কামনা নেই, কাঁপন নেই, তাড়াহুড়ো নেই। এতে আছে কেবল দায়িত্ব। ভালবাসার, আশ্রয়ের, এবং একে অপরকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব।

অনন্যা ধীরে বিছানার দিকে যায়। শুয়ে পড়ে। কিন্তু এবার সে নিজে রুদ্রর হাত ধরে টেনে আনে। তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি—তৃষ্ণার নয়, স্বস্তির।

সে বলে, “আজ তুমি আমায় চাও, কিন্তু যেভাবে কবি কাগজকে চায়। যেখানে একটাও শব্দ ভুল হলে গোটা কবিতা নষ্ট হয়ে যায়। আজ আমাকে লেখো, রুদ্র। তোমার ইচ্ছার কালি দিয়ে, তোমার ভালোবাসার কলমে।”

রুদ্র ধীরে অনন্যার গায়ে উঠে আসে। চাদর সরিয়ে ফেলে। তার আঙুল চলে যায় গলার ভাঁজে, বুকের উপত্যকায়, কোমরের বাঁকে। প্রতিটা স্পর্শে যেন সে কোনও প্রাচীন মুদ্রার মতো শব্দ খুঁজে বের করছে।

তাদের নিশ্বাস ঘনিয়ে ওঠে। রুদ্র তার চোখে চোখ রেখে বলে, “তোমার এই শরীর আমার কাছে আর কোনও অজানা ভূমি নয়। এখন তুমি আমার নিজস্ব মহাকাশ, যেখানে আমি বারবার হারিয়ে যেতে চাই। আমি তোমার গভীরতাই চাই, তোমার আলো-অন্ধকার সব।”

অনন্যা চোখ বন্ধ করে বলে, “তুমি আমার ভিতরে ঢুকে পড়ো। শরীর দিয়ে নয়, অস্তিত্ব দিয়ে। আমি এখন শুধু তোমার ভিতরে থাকতেই চাই।”

তাদের মিলন হয় দীর্ঘ, ধীর, গভীর। রুদ্রর ঠোঁট প্রতিটা স্পর্শে একটি করে চিহ্ন রেখে যায়—যেমন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে কবিতায় অমর করে তোলে, তেমনই। অনন্যার শরীর থেকে সব ক্লান্তি, সব ব্যথা, সব গোপন কান্না যেন গলে বেরিয়ে আসে।

তারপর তারা পাশাপাশি শুয়ে থাকে। জানালার বাইরে তখন বৃষ্টি নামে। ছোট ছোট জলের ফোঁটা কাঁচে পড়ে, যেন ওদের ভিতরের কিছু ছুঁয়ে যাচ্ছে বাইরে থেকে।

অনন্যা মাথা রাখে রুদ্রর বুকে। বলে, “আমার জীবনে যতো পুরুষ এসেছে, সবাই আমার ঠোঁটে চুমু খেতে চেয়েছে। কিন্তু তুমি প্রথম, যে আমার আত্মাকে ছুঁয়েছ। আর আজ, আমি আর শরীর নই, আমি তোমার প্রেম। রক্তগোলাপের মতো—আঘাত দেয়, তবু ছাড়তে ইচ্ছে করে না।”

রুদ্র তার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “তোমাকে পেয়ে আমার জীবনের কবিতা সম্পূর্ণ হয়েছে, অনন্যা। তুমি আমার কামনা, কিন্তু তার চেয়েও বড় কিছু—তুমি আমার কবিতা। আমার শুরু, আমার শেষ। আমার আলো, আমার ছায়া।”

ঘর নিঃশব্দ হয়ে যায়। শুধু শরীরের উত্তাপ, নিঃশ্বাসের আওয়াজ, আর সেই গন্ধ—যা একদিন কেবল শরীরের ছিল, আজ তা ভালোবাসার গন্ধ হয়ে গেছে।

তারা একে অপরের মধ্যে হারিয়ে যায়, আবার খুঁজে পায়। আর এই ফিরে পাওয়াটাই শেষ নয়—এই ভালোবাসার শুরু।

[সমাপ্ত]

1000024840.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *