প্রশান্ত দত্ত
এক
সেই দিনটা ছিল এক আশ্চর্য রকমের নীরব সকাল। আশ্রমের চারপাশে যেন শব্দেরাও হাঁটুর উপর বসে ধ্যান করছিল। গ্রীষ্মের হালকা বাতাস রক্তকরবী গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে ছায়া ফেলছিল সিঁড়ির ওপর। মীনাক্ষীদেবী প্রতিদিনের মতো ছাতা হাতে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, চোখে ছিল হালকা ঘুম আর মনে কিছুদিন আগের জলছবি। তখনই তিনি প্রথম দেখেন সেই লোকটিকে—ধুলো মাখা গেরুয়া কাপড়, গলায় একতারা ঝুলছে, চোখে এমন এক প্রগাঢ় শূন্যতা, যা যেন হঠাৎই জীবনের বহুদূরের কোনো রঙ ভুলে এসে বসেছে শান্তিনিকেতনের প্রান্তে। রাস্তার পাশের সেই পুরনো কদম গাছটার ছায়ায় বসে ছিল সে। সে কারো দিকে তাকাচ্ছিল না, বরং তাকিয়ে ছিল বাতাসে ভেসে বেড়ানো কোনো অদৃশ্য সুরের দিকে, যেন সে শুনছিল এমন কোনো গান যা এখনকার এই পৃথিবীর জন্য নয়।
আশ্রমে আগন্তুকদের খুব একটা জায়গা দেওয়া হয় না, অন্তত প্রথম দিনেই নয়। কিন্তু মীনাক্ষীদেবী এই মানুষটিকে দেখে ঠিক করতে পারেন না তিনি ভয় পাবেন, না মুগ্ধ হবেন। বিকেলের দিকে তিনি সুধাংশুবাবুর সঙ্গে কথা বলেন—সেই প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত সংস্কৃত শিক্ষক যিনি আশ্রমের শিশুদের পড়াতে এসে নিজের একাকিত্ব ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। সুধাংশুবাবু রামকেলির গলায় একতারা দেখে খানিক বিস্মিত হন—”এই জিনিস তো এখন আর দেখা যায় না,” বলেন তিনি, “যুগ পাল্টে গেছে, এখন গানও প্লাস্টিকের মতো ঝকঝকে।” কিন্তু তবু তারা সিদ্ধান্ত নেন এক রাত থাকতে দিলে কী হবে—যদি সে ঝামেলা না করে, থাকুক এক কোণায়। আশ্রমের প্রাচীন খড়ের ঘরের পেছনে এক পরিত্যক্ত কুঠুরি খুলে দেওয়া হয় তার জন্য। সেই রাতে রামকেলি কিছুই বলেন না, শুধু একতারা নিয়ে বসে থাকেন চুপ করে, এমনভাবে যেন শব্দ করাও এক ধরণের অপচয়।
রাতের পর রাত কেটে যায়। রামকেলি খুব বেশি কথা বলেন না, শুধু দুপুরের রোদ যখন গাছের পাতায় নেমে আসে, তখন তিনি একতারা হাতে গেয়ে ওঠেন একটা পুরনো বাউল গান—”মানুষ ভজলে সোনার মানুষ, দেখবি রে ভাই…”। প্রথম প্রথম শিশুরা ভয় পেত, ছেলেরা ভেবেছিল সে হয়তো পাগল, আর মেয়েরা কৌতূহলে তাকে জানালার আড়ালে দেখে যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে একটা নীরবতা চারপাশে গড়ে ওঠে তার গানের সময়। মীনাক্ষীদেবী এক দুপুরে এসে দাঁড়ান দূরে—তিনি গান বোঝেন না, কিন্তু কান্না চেনেন। সেই গানে কান্না লুকিয়ে ছিল, প্রাচীন কোন পরিতপ্ততার মতো। সুধাংশুবাবু একদিন বলেন, “এই লোক তো স্রেফ গাইছে না, কোনো অতীতকে ছুঁয়ে যাচ্ছেন, যেন আঙুল ছুঁইয়ে স্মৃতি ফেরাচ্ছেন।” এরপর থেকে, আশ্রমের অনেকে দুপুরগুলোতে তার গান শোনে, আর বিস্ময়ের সঙ্গে বোঝে—এই নীরব লোকটা যেন তাদের প্রত্যেকের ভিতরের কোনও অজানা দরজা খুলে দিচ্ছে।
একদিন সন্ধ্যায়, সুধাংশুবাবু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রামকেলির পাশে বসেন। প্রশ্ন করেন, “তুমি এইখানে এলে কেন?” রামকেলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, “একটা জায়গা খুঁজছিলাম, যেখানে শব্দ কম, কিন্তু কান শোনে… যেখানে মানুষ এখনো নিজেকে খোঁজে।” এরপর থেকে তাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়, এক ধরণের মৌন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। শিশুদের জন্য রামকেলি গান শেখাতে শুরু করেন—না, তালিম নয়, বরং অনুভব শেখান। তিনি বলেন, “গানের আগে কান থাকতে হয়, মন থাকতে হয়, গলা তো পরে আসে।” আশ্রমের বাতাস বদলে যেতে শুরু করে। বিধবা মহিলারা যারা সেলাই করতেন চুপচাপ, তারাও মাঝে মাঝে গুনগুন করেন। মনে হয় যেন বহুদিন পর রক্তকরবী গাছের নিচে সত্যি করে লাল ফুল ফুটেছে।
দুই
শান্তিনিকেতনের সেই আশ্রমে দিনগুলো যেন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে না চলে, বরং বাতাস, আলো আর পাখির সুরের সঙ্গে চলতে শেখে। রামকেলির আসার পরে আশ্রমের সেই অদৃশ্য ঘড়ি যেন এক নতুন তাল পায়। প্রতিদিন দুপুরের পর, যখন রোদের ঝাঁজ কিছুটা কমে আসে, তখন সে বসে পড়ে সেই পুরনো জামরুল গাছের ছায়ায়। একতারা হাতে নেয় ধীরে, যেন কোনও প্রাচীন আচার পালনের মতো। তার গান শুরু হয় এক ধরণের ধ্বনিময় নিঃশব্দতায়, যেখানে শুরুর আগে কিছুই শোনা যায় না, আর গান চলাকালীন যেন পৃথিবীর অন্য সব শব্দ থেমে যায়। আশ্রমের শিশুরা দূর থেকে তাকিয়ে থাকে—তারা জানে না এই মানুষটি কে, কিন্তু জানে তার গানের মধ্যে যেন তারা নিজেদের এক অচেনা দুনিয়ায় খুঁজে পায়। যাদের বাবা-মা নেই, বা আছে কিন্তু অনুপস্থিত, তারা রামকেলির গানে যেন এক গোপন আশ্বাস খুঁজে পায়—‘তোমাদের জন্য কেউ আছে’।
একদিন বিকেলে, আশ্রমের ছোট্ট এক ছেলে, নাম রোহন, লুকিয়ে আসে গাছের পেছনে। সে কথা বলত না কারো সঙ্গে, এক ধরণের নির্বাকতা তার জীবনের নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সেই দিন সে প্রথমবার রামকেলির গানের সঙ্গে ঠোঁট নাড়ায়—অন্তত সে চেষ্টা করে তার স্বর মেলাতে। রামকেলি তা লক্ষ্য করেন। গানের শেষে তিনি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটুকু হাসেন, তারপর বলেন, “তুই তো গাইতে চাস। ভয় করিস না, গান তো ভুল করলে রাগ করে না।” এই বাক্যটা যেন এক চাবির মতো খুলে দেয় রোহনের ভিতরের চুপ করে থাকা দরজা। তারপর থেকে সে প্রায় প্রতিদিন এসে বসে রামকেলির পাশে। আর শুধু রোহন নয়—ধীরে ধীরে আরো কিছু ছেলে-মেয়ে এসে যোগ দেয়। তারা গান গায় না ঠিক, কিন্তু কান পেতে থাকে। রামকেলি কখনও গল্প বলেন, কখনও গান শেখান না—তিনি কেবল বলেন, “শোন, কীভাবে আকাশ গায়, বা বাতাস বাজায় বাঁশি। আগে শুনতে শেখ। তখন তোর গলা আপনাআপনি খুঁজে পাবে সুর।”
আশ্রমের নারী অধিবাসীরাও এই বদলে যাওয়া দুপুরগুলোর গন্ধ পেতে শুরু করেন। কল্পনা মাসি, যিনি পাঁচ বছর ধরে এখানে রান্না করেন—তাঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন খড়ার সময় ট্রেনে, আর তাঁর জীবনের গান শেষ হয়ে গিয়েছিল সেই থেকে। তিনিও এক দুপুরে এসে বসেন দূরে। কাঁধে কাপড়ের ঝাঁপি, কপালে গামছা। কিন্তু সেই মুখে একটা আলগা শান্তি। পরে তিনি বলেন, “ওই লোকটার গানে মনে হয় কেউ চুপিচুপি মাথায় হাত রাখছে।” আশ্রমের অন্যরা প্রথমে মৃদু বিদ্রূপ করলেও পরে তারাও টের পায়—এই গান কেবল গান নয়, যেন কোনও লুকিয়ে থাকা দুঃখের জলপথ। সুধাংশুবাবু, যিনি সংস্কৃত ভাষার শিক্ষক হয়েও নিজেই জীবনের অনুবাদ করতে পারেননি, তিনি একদিন বলেন, “ও যেন রাগ গায় না, মনের পুরনো অক্ষর গায়।” সন্ধ্যাবেলায় তিনি নিজে তুলে আনেন তার পুরনো বাঁশি, যেটা বহুদিন আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর ত্যাগ করেছিলেন। সেই দিন প্রথম আশ্রমে এক সঙ্গে বাজে একতারা আর বাঁশির সুর।
এইভাবে, এক অদৃশ্য তরঙ্গে বদলাতে থাকে আশ্রমের ভিতরের আবহ। রামকেলি কখনো ধর্মের কথা বলেন না, কখনো সমাজনীতি নিয়ে বিতর্ক করেন না—কিন্তু তার উপস্থিতি যেন এক ধরণের অনুরণন তৈরি করে, যা মানুষকে নিজের ভিতরের জমে থাকা স্তব্ধতা ভাঙতে শেখায়। সেই নিঃশব্দ দুপুরগুলো, যা আগে ছিল শুধু তন্দ্রার, এখন হয়ে ওঠে অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের সময়। শিশুরা শেখে, দুঃখের মধ্যেও গান থাকে, আর প্রাপ্তবয়স্করা বোঝে, বয়স যতই হোক, হৃদয়ের দরজাগুলো নতুন করে খোলার সময় আসে। রক্তকরবীর গাছের নিচে একতারা বাজে, আর আশ্রমের দেয়ালের মাঝে ধীরে ধীরে বেজে ওঠে এমন এক জীবনসঙ্গীত, যা বইয়ে শেখা যায় না—শুধু অনুভব করা যায়।
তিন
রামকেলির গলায় একতারা বাজানোর ভঙ্গি দেখে সুধাংশুবাবুর মনে পড়ে যায় তাঁর কাশীতে দেখা সেই বাউলদার কথা—যিনি বলেছিলেন, “মানুষ একটুকু গন্ধ, একটুকু ছায়া, একটুকু হাওয়া—এর বেশি কিছু নয়।” সেইদিন বিকেলে, রামকেলিকে একটু খোলসা করে জানতে চাইলে সে একটুও বিরক্ত হয়নি। বরং চুপচাপ একগাল হাসি হেসে বলেছিল, “আমি একদিন ছিলাম কীর্তনের দলে, তারপর বাউলের দলে, তারপর কারও দলে না। এখন শুধু হাওয়া যেখানে নেয়, আমি সেখানে যাই।” সুধাংশুবাবু উৎসাহী হয়ে বলে ওঠেন, “কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে ‘আত্মা খোঁজো’, তা হলে তুমি কীভাবে বুঝলে সেই আত্মা কোথায়?” রামকেলি তার একতারা কোলের উপর রেখে একবার আকাশের দিকে তাকায়—তারপর বলে, “আত্মা ছায়ার মতো, সে গাছ না হলে ও ধরা দেয় না। কিন্তু গাছ নিজেই জানে না যে তার তলায় কী গন্ধ জমে আছে।”
এই কথাগুলি শুনে সুধাংশুবাবুর ভিতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন ওঠে। আশ্রমে তিনি বহু বছর ধরে পড়িয়ে আসছেন—ভগবদ গীতা থেকে শুরু করে বেদান্তের উপপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বাউলের একটা গানেই যেন সব উত্তর ধরা আছে যা আজীবন তিনি খুঁজে গেছেন বইয়ের পাতায়। তিনি রাতে নিজের ঘরে বসে রামকেলির গান শুনতে শুনতে পুরনো একটা চিঠির খাম খোলেন—যেখানে তাঁর স্ত্রীর লেখা ছিল, “তুমি যত ব্যাখ্যা খোঁজো, আমি শুধু চাই তুমি একদিন গেয়ে ওঠো।” সেদিন রাতে তিনি তার বাঁশি তোলেন হাতে, গালে জল টের পান, কিন্তু মুখে থাকে এক টুকরো হাসি। সে হাসি যেন বলে—তিনি দেরিতে হলেও ঠিক সময়ে বুঝেছেন, যে সুর শব্দ নয়, অভ্যন্তরের ছায়াপথ।
রামকেলির অতীত নিয়ে কৌতূহল জন্মায় অনেকের। সেলিমা খাতুন, যিনি গ্রামের একমাত্র সেলাই প্রশিক্ষিকা হিসেবে আশ্রমে মাঝে মাঝে আসতেন, একদিন সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন—“আপনি কি আগে নামী বাউল ছিলেন? কেউ তো বলছিল ‘রামকেলি বাউল’ নামে একসময় রেডিওতেও গাইতেন আপনি।” রামকেলি একটু চুপ করে থেকে বলেন, “হ্যাঁ, একসময় লোক আমাকে চিনত। কিন্তু তখন আমার গানের মধ্যে আমি ছিলাম না। এখন আর কেউ চেনে না, কিন্তু আমি নিজের মধ্যে ফিরে এসেছি।” সেই কথায় আশ্রমের সবাই বুঝে যায়—সে নাম খুঁজতে আসেনি, এসেছে হারানো নিজস্বতার গন্ধ নিতে। একদিন দুপুরে, এক ঝড়ের আগে, রামকেলি আশ্রমের শিশুদের নিয়ে খেলার ছলে একটি বৃত্ত তৈরি করায়, এবং বলে, “এটা হচ্ছে তোমার নিজের আকাশ। তাতে যদি তুমি নিজের সুর ফেলতে পারো, তবে বুঝবে—তুমি একা নও।” শিশুরা খেলতে খেলতে ভাবে, আর বড়রাও চুপচাপ দূর থেকে দেখে—এই মানুষটা বুঝি সত্যিই এক ধরণের শিক্ষক, যে শব্দে নয়, নিঃশব্দে পাঠ দেন।
ততদিনে আশ্রমে একটি অদ্ভুত বদল দেখা যায়। দুপুরগুলো আর নিঃশব্দ নয়, এখন তারা গানের প্রতিধ্বনি ধারণ করে। ছেলেমেয়েরা ধীরে ধীরে নিজেদের স্বর খুঁজে পায়। বৃদ্ধারাও নিজের গলার গান আবার মনে করতে শুরু করে। সুধাংশুবাবু, যিনি এতদিন ধরে সংস্কৃত শ্লোকের মধ্যেই আটকে ছিলেন, এখন গান শেখেন শিশুদের থেকে। আর মীনাক্ষীদেবী, যিনি সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইতেন, এখন প্রতিদিন বিকেলে এসে বসে পড়েন রক্তকরবীর গাছের নিচে—কোনও বই ছাড়াই। তিনি একদিন চুপচাপ বলেন, “এই ছেলেটা (রামকেলি) বুঝি এই আশ্রমে হাওয়া আনল।” আর ঠিক সেইদিন রাতের বৃষ্টিতে যখন একতারা ভিজে ওঠে, তখন সবাই মিলে তা রোদে শুকোতে দেয়—যেন সে শুধু একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, বরং আশ্রমের হৃদস্পন্দনের অংশ হয়ে উঠেছে।
চার
একদিন সকালে সুধাংশুবাবু দেখেন, আশ্রমের বাম পাশের পুরনো কড়ই গাছটার তলায় কেউ একটা বাঁশের কুর্সি রেখে গেছে। তার গায়ে কাঠখোদাই করা, পিছনে মাটির রঙের কাপড়ের ঢাকনি, আর বসার জায়গায় ঘাসের গন্ধ। এটা নতুন নয়—বরং এমনভাবে বানানো যেন সময়ের ছাপ লেগে থাকুক। মীনাক্ষীদেবী জানান, আশ্রমের এক প্রাক্তন ছাত্র, এখন কুড়ুলের কাজ শেখা কারিগর, সে বানিয়ে দিয়ে গেছে এই কুর্সিটা। বলেছে, “যিনি গান গেয়ে সবাইকে জাগান, তিনি যেন বসে থাকেন এমন জায়গায়, যা তাঁর সুরের মতোই নরম আর স্থায়ী।” সবাই জানে—ওটা রামকেলির জন্যই বানানো। কিন্তু রামকেলি প্রথমে বসতে চান না। তিনি বলেন, “আমি তো পথচলার মানুষ, আমার পায়ের নিচে মাটি থাকলেই হয়।” কিন্তু সেই দিন যখন দুপুরের আলো রক্তকরবীর পাতার ফাঁকে নেমে আসে, রোহন এসে বলল, “ওখানে বসলে আপনার গলা বেশি স্পষ্ট শোনা যায়”—তখন প্রথমবার তিনি কুর্সিটায় বসেন, একটু হেলে, একতারা হাতে।
সেই কুর্সির চারপাশে গড়ে ওঠে এক অলিখিত সভা। শিশুরা গোল হয়ে বসে, কেউ কেউ খাতা নিয়ে আসে, কেউ মাটির উপর আঁকতে থাকে কাঠি দিয়ে। রামকেলির গান ধীরে ধীরে শিক্ষার নতুন মাধ্যম হয়ে ওঠে—সে বলে না ‘শিখো’, সে শুধু ‘শোনো’ বলে। মীনাক্ষীদেবী লক্ষ্য করেন, যেসব ছেলেমেয়েরা আগেও পড়াশোনায় অনাগ্রহী ছিল, এখন তারা শব্দের মানে নিয়ে আলোচনা করছে। গানের ভাষা, তার ভিতরের আখ্যান—সব কিছু যেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হয়ে উঠেছে। সুধাংশুবাবু খেয়াল করেন, “এ এক নতুন শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে প্রশ্ন আগে আসে, উত্তর পরে।” এইভাবে কুর্সিটা আশ্রমে শুধু বসার আসন নয়, এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
তবে এই বদল সবাই ভালভাবে নেয়নি। পাশের গ্রামের কিছু মানুষ বলতে শুরু করে, “বাউলদের তো সংসারধর্ম নেই, তারা কী শেখাবে?” কেউ কেউ মীনাক্ষীদেবীর কাছে অভিযোগ জানায়—“আশ্রমে ধর্মীয় শৃঙ্খলা শিথিল হচ্ছে, গানে গানে শিশুরা ভুল পথে যাচ্ছে।” মীনাক্ষীদেবী প্রথমে মৃদু ধাক্কা খান। তিনি অনেকদিন ধরে সমাজের চোখ বুঝে চলেছেন—এমন সময় এই নতুন আলোয় পড়লে ছায়াগুলিও দীর্ঘ হয়। তিনি সুধাংশুবাবুর সঙ্গে আলোচনা করেন। সুধাংশুবাবু বলেন, “আলো মানেই শুধু জ্বলে ওঠা নয়, সে ছায়াও ফেলে। কিন্তু যিনি আলো জ্বালান, তিনি জানেন তার পথ কোথায়।” এরপর একদিন রামকেলিকে ডেকে তিনি বলেন, “সবাই তোমাকে বুঝবে না, কিন্তু তুমি বদল এনেছ। আমি চাই তুমি এই আশ্রমেই থাকো, আমাদের গান শেখাও, মানুষ চিনতে শেখাও।” রামকেলি তখন হেসে বলেন, “আমি থাকব না হয়, যদি সবাইকে শোনার সুযোগ পাই। কথা শোনানো নয়, শুধু শুনে যাওয়া।”
সেই থেকে কুর্সিটা রোজ বিকেলে রোদে বসে থাকে, তার ওপর বসে রামকেলি গান করে, আর আশ্রমের বাতাসে মিশে যায় এক অন্যরকম সুর। আশ্রমে যারা একসময় শুধুই বাঁচতে এসেছিল, তারা এখন বাঁচার মানে খুঁজে পায় সেই গানের মধ্যে। নতুন করে ফিরে আসে পুরনো রোদের ছায়া, যেটা কোনও বইয়ে লেখা ছিল না, শুধু হৃদয়ের পাতায় জমে ছিল বছরের পর বছর। এখন তা বেরিয়ে আসে প্রতিটি শিশুর চোখে, প্রতিটি নারীর মুখে। আর কুর্সির নিচে পড়ে থাকা ধুলো—তা যেন হয়ে ওঠে ইতিহাস, একটুকু গন্ধ আর একটি অসমাপ্ত রূপকথা।
পাঁচ
শরতের শেষ দিকে, রক্তকরবীর পাতা যেন হঠাৎই রং পাল্টাতে শুরু করল। আগে যে পাতাগুলো সবুজের নরম আভায় ঘেরা ছিল, সেগুলো একদিন সকালে লাল হয়ে গেল—একটা দগ্ধ স্মৃতির মতো। আশ্রমের শিশুরা তা লক্ষ্য করে বলে উঠল, “দেখো, গাছটা রেগে গেছে!” কিন্তু রামকেলি সেই পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “ও রাগে না, ও মনে রাখে। রক্তকরবীর লাল পাতা মানেই ওর পুরনো স্মৃতি জেগে উঠেছে।” সেদিন রোহন হঠাৎ করে তার মায়ের কথা বলে। এতদিন সে কিছু বলত না—শুধু জানত সে এই আশ্রমে এসেছে ট্রেন দুর্ঘটনায় মাকে হারিয়ে। কিন্তু লাল পাতার আলোয় সে বলে, “আমার মা বলত, শরতের রোদে গাছও কথা বলে।” সেই কথা শুনে রামকেলি বলে, “তাহলে তো তোর মায়ের কথা এই গাছেই আছে রে। শুনে রাখিস, বিস্মৃতি মানেই ভুলে যাওয়া নয়—তা কখনও কখনও রঙ বদলে ফিরে আসে।”
আশ্রমের বৃদ্ধারা যারা অনেকটা সময় এই নির্জনে কাটিয়েছেন, তারা হঠাৎই নতুন করে পুরনো কথা বলতে শুরু করলেন। হরিপ্রিয়াদেবী, যিনি আশ্রমে এসে ছেলেকে হারিয়ে মৌনব্রত নিয়েছিলেন, একদিন বিকেলে এসে বলেন, “রামকেলি, তোর গানে একটা পল্লবী শুনে মন পড়ে গেল সেই পুজোর দিনের, যখন গায়ে হলুদে আমি শেষবার নেচেছিলাম।” সুধাংশুবাবু বলেন, “তুমি তো কখনও বলেননি তুমি নাচতে?” হরিপ্রিয়াদেবী মৃদু হেসে বলেন, “এই আশ্রমে এসেই তো আমি নিজেকেই ভুলে গেছিলাম।” এরপর আশ্রমে শুরু হয় এক অলিখিত স্মৃতি-বলয়। সবাই একে একে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া গান, ছবি, নাচ, গল্প খুলে বলে। এমনকি মীনাক্ষীদেবী নিজেও বলেন, “আমার বাবার গলা ছিল খুব সুরেলা, কিন্তু সংসারের দায়িত্বে আমি সেই গান বয়ে আনতে পারিনি। এখন বুঝি—আমি শুধু সেই গানকেই ভুলে গেছি, নিজেকে নয়।”
এই পরিবর্তনের মধ্যে সেলিমা খাতুন একদিন রামকেলিকে বলেন, “তোমার গান আমাদের পুরনো কষ্টকে যেন নাম দেয়।” তিনি বলেন, “মানুষ কাঁদে, কিন্তু সে জানে না সে কিসের জন্য কাঁদছে। তুমি যেন সেই কান্নার নাম বলে দাও।” রামকেলি চুপচাপ একতারা টেনে বলেন, “আমি কিছু দিই না—আমি শুধু খুলে দিই সেই ঘরটা, যেখানে আমরা নিজেদের রেখে আসি।” সেই দিন আশ্রমে প্রথমবার এক ‘স্মৃতি-দিবস’ পালন করা হয়—সাধারণ পোশাকে, গানের মধ্যে দিয়ে, যেখানে প্রত্যেকে নিজের একটুকরো হারানো মুহূর্ত শেয়ার করে। কেউ এক পুরনো চিঠি পড়ে, কেউ ছবি আঁকে, কেউ একটি ভুলে যাওয়া ছড়া বলে। যেন রক্তকরবীর পাতায় সেইসব স্মৃতিগুলো জমা পড়ে, এক এক করে ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া মুখের ছায়া।
তখন আশ্রম এক নতুন রূপ নেয়। দেয়ালে ঝুলে থাকা পুরনো ক্যালেন্ডার, ভাঙা রেকর্ড প্লেয়ার, এমনকি ধুলো ধরা হারমোনিয়াম— এক অদ্ভুত জীবন্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। শিশুদের খেলায় যোগ দেয় বৃদ্ধা, আর বাউলের গানে মিলিয়ে পড়তে শেখে সংস্কৃত পণ্ডিত। আশ্রম তখন শুধুই একটি বসবাসের স্থান নয়, একটি সময়ের অনুবাদ—যেখানে ভুলে যাওয়া মানে হারিয়ে ফেলা নয়, বরং একটি নতুন আকারে ফিরে পাওয়া। সেই সময়, সেই গান, সেই কুর্সি, আর সেই লাল পাতাগুলি যেন বলে ওঠে, “তুমি যদি ভুলে যাও, আমি তোমাকে মনে করিয়ে দেবো।” আর এইভাবেই, রক্তকরবীর নিচে গড়ে ওঠে বিস্মৃতির মধ্য দিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়ার এক আশ্চর্য পবিত্র ভূমি।
ছয়
হঠাৎ একদিন রোহনের খাটের নিচে ধুলোর মধ্যে পাওয়া গেল একটি খাতা—হালকা নীল রঙের, কোনার কাগজগুলো ভাঁজ খেয়ে গেছে, পাতায় পাতায় পুরনো পেনের দাগ, আর মাঝখানে কোথাও লেখা নেই, শুধু আঁকা, ছোট ছোট চিহ্ন, কিছু গোল বৃত্ত, ছড়ানো তারের মতো লাইন, আর মাঝে মাঝে এক একটি শব্দ—“চুপ”, “চাইনি”, “দেখেছি”, “ঘাসের নীচে”। আশ্রমের শিশুরা এই খাতাটি নিয়ে প্রথমে মজা করলেও, পরে তারা দেখতে শুরু করে সেটি যেন কারও না বলা কথা দিয়ে ভরা। কেউ কেউ বলে, এটা নিশ্চয়ই পুরনো কোনো ছাত্রের খাতা, যেটা সে ফেলে গেছিল। কিন্তু রামকেলি খাতা খুলে চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর বলে, “এটা কারো লেখা নয়, এটা একরকম শোনার খাতা। শব্দ নয়, শব্দের অভাব লেখা আছে এখানে।”
সেই সন্ধ্যায় রামকেলি সেই খাতাটা নিয়ে গিয়ে বসেন তাঁর বাঁশের কুর্সিতে। তিনি গাইতে শুরু করেন এক অদ্ভুত গান—যার সুর ধরা যায়, কিন্তু কথা যেন নেই। শিশুরা চমকে ওঠে, “ও গানটা তো ফিসফিস করে বলা কথা মনে হচ্ছে!” মীনাক্ষীদেবীও বাইরে এসে দাঁড়ান, তিনি বলেন, “এটা তো শুধু গান নয়, এটা যেন কারও মনে জমে থাকা দুঃখের দিনলিপি।” রামকেলি বলেন, “হ্যাঁ, সবাই তো বলে, কথা বলতে শিখতে হয়। কিন্তু চুপ থাকা শিখতেও সময় লাগে। এই খাতা সেই চুপ থাকা শেখার ফল।” এরপর আশ্রমে নতুন একটা নিয়ম শুরু হয়—প্রতি সপ্তাহে একদিন সবাই মিলে লিখবে ‘চুপকথা’—যেটা তারা মুখে বলতে পারে না, সেটা তারা আঁকবে, লিখবে, কিংবা স্রেফ রেখে দেবে একফাঁকা পাতায়। শিশুরা প্রথমে হেসে নেয়, কিন্তু পরে তারাও খুঁজে পায়, চুপকথা মানে শুধু না বলা কথা নয়, তা একরকম ভেতরের আলো, যেটা অন্ধকারের মধ্যে জ্বলে।
সেই খাতা একদিন আশ্রমের এক নীরব বৃদ্ধা, বাসন্তীদেবীর হাতে গিয়ে পড়ে। যিনি বহু বছর কথা বলেননি, শুধু চোখ দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন। রামকেলি খাতাটা তাঁর হাতে দিলে, তিনি প্রথমে হেসে ফেলেন। তারপর খাতার এক পাতায় বড় করে লেখেন—“আমি চাইলেও কেউ শুনত না। এখন কেউ না বললেও আমি শুনি।” আশ্রমে এই লেখা পড়া মাত্রই হঠাৎ এক অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে আসে। সবাই যেন বুঝে যায়, চুপ থাকা মানে কখনও কখনও প্রার্থনা, কখনও অপেক্ষা, আর কখনও প্রতিবাদ। সেই দিন থেকে খাতার নাম হয়—“চুপকথার খাতা”, এবং তা ঘুরে বেড়ায় ঘরে ঘরে, মানুষে মানুষে। কেউ লিখে—“বাবা মারা যাওয়ার দিন আমিও ভাত খেয়েছিলাম।” কেউ লিখে—“আমার পুতুল ভেঙে গিয়েছিল, আমি কাউকে বলিনি।” কেউ লিখে—“আমি ভুল করেছিলাম, কিন্তু ক্ষমা চাইতে পারিনি।”
রক্তকরবীর পাতার নিচে সেই খাতা মাঝে মাঝে রেখে দেওয়া হয়, আর পাতাগুলো যেন ঝরে পড়ে এক একটি না বলা শব্দের মতো। একতারা বাজে, কিন্তু সুর থাকে চুপ। রামকেলি বলেন, “এই খাতাগুলো একদিন আমাদের গান হয়ে উঠবে। এমন গান, যা গাওয়া হয় না, শুধু বোঝা যায়।” সুধাংশুবাবু বলেন, “আমার সারাজীবনের শিক্ষা তো কথার ভিতরেই ছিল, আজ বুঝছি, চুপও একটা ভাষা।” এইভাবে ‘চুপকথার খাতা’ হয়ে ওঠে আশ্রমের জীবনের একটি জরুরি অংশ—যেখানে প্রত্যেকে শিখে চুপ থাকাটাও একধরনের আত্মপ্রকাশ। আর সেই চুপ, রক্তকরবীর ছায়ায় গড়িয়ে পড়ে, ঘাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায়, আর একসময় রোদ হয়ে ওঠে কারও গলার শব্দে।
সাত
রাধামণি আশ্রমে এসেছিলেন দশ বছর আগে, এক নিঃশব্দ সন্ধ্যায়। বিধবা অবস্থায় এসেছিলেন, মেয়েকে হারিয়ে, মুখে কথা কম, চোখে যেন একটি ঘূর্ণির মতো বিষণ্নতা। এতদিন ধরে তিনি ছিলেন নিঃশব্দ সেবিকা—আশ্রমের রান্নাঘরে, বাগানে, কখনও সেলাই-কাটিং-এর কাজে—সবসময় নিঃশব্দ। কিন্তু রামকেলির আসার পরে, ধীরে ধীরে তার চলনে-বলনে একটি ভিন্ন ঢেউ লক্ষ করা যায়। একদিন বিকেলে, সবাই যখন রক্তকরবীর নিচে বসে গান শুনছে, তখন রাধামণি হঠাৎ একটা প্রশ্ন করেন—“এই গানের মধ্যে কি কেউ হারিয়ে যাওয়াদের নাম রাখে?” প্রশ্নটি সহজ ছিল না, গভীর ছিল। সবাই চমকে ওঠে—কারণ এত বছর ধরে রাধামণি কখনও এমনভাবে কথাও বলেননি, প্রশ্ন করাও তো দূরের কথা। রামকেলি তাঁর একতারার তারটা টেনে বলে, “এই গানেই তো ওরা ফিরে আসে, ঠিক যেমন প্রতিধ্বনি পাহাড়ে ফিরে আসে হাঁক দিলে।”
পরদিন সকালে, আশ্রমের উত্তরপ্রান্তে যেখানে নারকেল গাছগুলো দাঁড়িয়ে, রাধামণি হঠাৎ একটানা গাইতে শুরু করেন। সেই সুর কারও চেনা নয়, এক পুরনো পালাগানের মতো, যেটা মুখে মুখে বাঁচে, কিন্তু কোনো বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না। আশ্রমবাসীরা দৌড়ে আসে, বিস্ময়ে দেখে যে, রাধামণির গলায় এক অনবদ্য যন্ত্রণা—তাঁর গান গল্প হয়ে ওঠে। তিনি গাইছেন তার মেয়ের কথা—যে ছিল পঁচিশ বছর আগে এক ছোট স্কুলের ছাত্রী, নদীর ধারে একদিন হারিয়ে গিয়েছিল বন্যার জলে। সেই কাহিনি তিনি আজ অবধি কাউকে বলেননি, কিন্তু রামকেলির গানের মধ্যে একটা ছায়া খুঁজে পেয়ে আজ তাঁর ভিতরের গানের দরজা খুলে যায়। সবাই শুনে থাকে নিঃশব্দে, চোখে জল আসে মীনাক্ষীদেবীর। সুধাংশুবাবু বলেন, “এই তো হল প্রতিধ্বনি—এমন কিছু যা প্রথমে হারিয়ে যায়, তারপর কোনোদিন হঠাৎ ফিরে আসে।”
এই ঘটনার পরে রাধামণির মধ্যে শুরু হয় এক অভ্যন্তরীণ জাগরণ। তিনি আশ্রমের শিশুদের গান শেখাতে শুরু করেন—না শুধুই সুরে, বরং গল্পে গল্পে। “প্রতিটা সুরে একটা গল্প থাকে”—এই মন্ত্র তিনি শেখান সবাইকে। শিশুদের কেউ কেউ গান লেখা শুরু করে, কেউ কেউ নিজের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা গানে রূপ দিতে চায়। রোহন একবার বলে, “আমি তো দুঃখের গান লিখব, কিন্তু শেষে হাসি থাকবে।” রাধামণি হেসে বলেন, “তাই তো গান, যেখানে কান্নাও আলো হয়ে ওঠে।” এই নতুন উদ্যোগের নাম দেওয়া হয় “প্রতিধ্বনি”—এটা এখন আশ্রমের অভ্যন্তরীণ সংগীতচর্চার নাম। যারা কখনও নিজের কণ্ঠ শুনতে পেত না, তারা আজ নিজেরাই প্রতিধ্বনির খোঁজে গাইতে শুরু করে। পুরনো শব্দে নতুন মানে খোঁজা শুরু হয়।
সেই প্রতিধ্বনি একদিন ফেরত আসে রক্তকরবীর গাছের পাতায়। গাছের নিচে, যেখানে রাধামণি প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন, সেখানে বসে এখন শিশুরা গান গায়, নিজেদের লেখা সুরে। রাধামণি এখন শুধুই গায়িকা নন—তিনি এক প্রতীক, যিনি শিখিয়েছেন হারিয়ে যাওয়া মানে শেষ নয়, ফিরে আসাটাও একরকম জীবন। রামকেলি বলেন, “সেইসব মানুষই গান গায়, যারা শব্দ হারিয়ে ফেলে। আর যারা প্রতিধ্বনি খোঁজে, তারা অন্যকে গান শোনায়।” আশ্রম যেন সেই সুরের কারখানা হয়ে উঠেছে—যেখানে প্রতিটি কণ্ঠ একেকটি মুখরতা, আর প্রতিটি চুপ থাকাও একদিন ফিরিয়ে আনে রাধামণির মতো এক প্রতিধ্বনি।
আট
সেই পুরনো, কাঠের বারান্দাটা আশ্রমের পূর্বপ্রান্তে। সকালবেলায় সেখানে আলো পড়ে ছায়ার মতো, আর বিকেলে ছায়া পড়ে আলোয়। বহু বছর ধরে সে বারান্দা যেন ছিল একটা নীরব দর্শক—কারও কথা শোনেনি, কারও সামনে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়নি। কিন্তু রামকেলির আগমনের পরে, একদিন কেউ সেখানে টাঙিয়ে দেয় একটি সাদা কাপড়—তাতে লেখা, “এখানে কথা হয় না, কিন্তু শোনা যায়।” এরপরই ধীরে ধীরে আশ্রমবাসীরা নাম দেয়—“চন্দনের বারান্দা”, কারণ বারান্দার পুরনো কাঠের গায়ে কেউ একদিন ঘষে দিয়েছিল চন্দনের পেস্ট, হয়তো কোনও পুজোর সময়, আর সেই গন্ধ এখনও ভাসে বাতাসে। সেই থেকে বারান্দাটায় বসে শুরু হয় এক নতুন অভ্যাস—কেউ কেউ সকালে চুপ করে বসে থাকে, কেউ কাগজে আঁকে, কেউ জানালার বাইরের রোদ্দুর গুনে, আর কেউ কেউ নিজের চিঠি পড়ে—যা কোনোদিন পাঠানো হয়নি।
একদিন রোহন সেই বারান্দায় বসে বলল, “আমার বাবার কথা আমি কিছুই জানি না, শুধু জানি, উনি একটা কবিতা লিখে গিয়েছিলেন মায়ের জন্য।” সেই কথা শুনে হরিপ্রিয়াদেবী বলেন, “তোর বাবার কবিতার ভাষা যদি তুই জানিস, তাহলে তো তুইও ওর মতোই।” এ কথায় রোহনের চোখ চকচকে হয়ে ওঠে। তারপর থেকে, চন্দনের বারান্দায় শুরু হয় একটি “আত্মকথন প্রকল্প”—যেখানে প্রত্যেকে নিজের অদেখা, অজানা, অচেনা মানুষটিকে চিঠি লিখে। কেউ বাবা-মাকে, কেউ পুরনো বন্ধুকে, কেউ এমন কাউকে যাকে কোনোদিন দেখেনি। একেকটি চিঠি হয় কবিতার মতো, আবার কিছু চিঠি হয় নিঃশব্দ আর্তির মতো—একটি অসমাপ্ত প্রশ্নের দিকে ফেলে আসা উত্তর।
রাধামণি একদিন নিজের চিঠি পড়ে শোনান—“তুই যদি আজ থাকতিস, আমি তোকে বলতাম, আমি কখনও মা হতে পারিনি, কিন্তু আশ্রমের বাচ্চাদের যখন মাথায় হাত রাখি, তখন যেন তুইও আমার মধ্যে একটু করে জন্মাস।” সেই চিঠি পড়া শুনে শিশুরা চুপ হয়ে যায়, আর তারপর কেউ বলে, “আমি একটা চিঠি লিখব আকাশকে, কারণ মা বলে, আকাশ সব জানে।” এইভাবে চন্দনের বারান্দা হয়ে ওঠে এক চিঠির জায়গা, যেখানে শব্দগুলো শুধু লেখা নয়, অনুভূতির অনুবাদ হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ বলে, এই বারান্দা যেন একটা ডাকঘর, যেখান থেকে পত্র পৌঁছায় হৃদয়ের অতলে, ঠিকানাবিহীন মানুষদের কাছে।
সেই বারান্দার দেয়ালে ধীরে ধীরে জমতে থাকে চিঠির কাগজ, ছেঁড়া ডায়েরির পৃষ্ঠা, সাদা রুমালে লেখা কথা। আশ্রমের নিয়ম হয়—প্রতি পূর্ণিমার রাতে সবার লেখা চিঠি পড়ে শোনানো হবে, যার পাঠক হবে রাতের আকাশ। সেই রাতে রামকেলি একতারা হাতে বলে ওঠেন, “চিঠি মানে অপেক্ষা নয়, চিঠি মানে বিশ্বাস—যে কেউ না কেউ শুনবে।” চন্দনের বারান্দা তখন শুধু কাঠের নির্মাণ নয়, সে হয়ে ওঠে স্মৃতি ও বর্তমানের এক সংযোগসেতু—যেখানে ভাষা নেই, শুধু আত্মার বার্তা। সেই বারান্দা আজও নিঃশব্দে অপেক্ষা করে, তার গায়ে বাতাসে ভেসে থাকা চন্দনের গন্ধে, যেন সে বলে—“যা বলা যায় না, তা বারান্দায় রেখে যেও, আমি তা আগলে রাখব।”
নয়
সুধাংশুবাবু ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, পরে এসে থেকে গিয়েছেন এই শান্তিনিকেতনের প্রান্তিক আশ্রমে। যাঁরা তাঁকে চিনতেন, তাঁরা জানতেন, সন্ধ্যা নামক একটি শব্দ যেন তাঁর সত্তার সঙ্গে মিশে গেছে। প্রতিদিন সূর্য ডোবার কিছু আগে, তিনি হেঁটে হেঁটে চলে যেতেন আশ্রমের পশ্চিমপ্রান্তে, যেখানে বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে শেষ আলোটা পড়ে চুপচাপ। সেখানে বসে তিনি একা একা গুণগুণ করতেন রবীন্দ্রসংগীত, কখনও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আবৃত্তি করতেন, আবার কখনও পুরনো ছাত্রদের গল্প মনে করে হাসতেন আপনমনে। কিন্তু এসব ছিল বাইরে থেকে দেখা; ভিতরে ছিল এক গভীর নিঃসঙ্গতা, যেটা কেউ জানত না। সুধাংশুবাবুর সন্ধ্যা ছিল একাকীত্বের জলছবি, যেখানে ভাষা ছিল শুধু নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা।
রামকেলির আসার পর সেই সন্ধ্যাগুলো ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। একদিন রামকেলি পাশে বসে বলে ওঠেন, “আপনি কি কখনও গান লেখার চেষ্টা করেছেন?” সুধাংশুবাবু একটু হেসে বলেন, “আমি তো সারাজীবন অন্যদের লেখা পড়িয়ে গেছি, নিজে কখনও কলম ধরিনি।” রামকেলি বলেন, “তাহলে এখন সময় হয়েছে আপনার নিজের সুর খোঁজার।” সেই সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় তাঁদের মধ্যে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব—একজন কথা দিয়ে গাঁথেন, অন্যজন সুরে বোনেন। সুধাংশুবাবু প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও, ধীরে ধীরে আশ্রমের একটি পুরনো ডায়েরি বের করেন, যেখানে বহু পুরনো দিনলিপি লেখা—কিছু তাঁর ছাত্রজীবনের, কিছু প্রিয় ছাত্রদের বিদায়বেলায় লেখা অনুভূতি, আর কিছু সেই সময়কার, যখন তিনি প্রথম কলকাতা ছেড়ে এসেছিলেন।
এই পুরনো ডায়েরিগুলো নিয়ে রামকেলি সুর বসাতে শুরু করেন। “এগুলো গান নয়”—সুধাংশুবাবু বলতেন—“এগুলো তো আমার স্মৃতি।” রামকেলি জবাব দেন, “স্মৃতিও গান হতে পারে, যদি তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়।” সেই ডায়েরি থেকে উঠে আসে “অর্পণ”, “ছায়ার খোলা জানালা”, “আলো ফুরনোর আগে”—এমন সব গান, যা শুনে আশ্রমবাসীরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। শিশুদের কাছেও সুধাংশুবাবু হয়ে ওঠেন নতুন মানুষ—শুধু এক বৃদ্ধ অধ্যাপক নন, বরং একজন যিনি জীবনের সন্ধ্যাবেলায় আলো খুঁজে পান শব্দে, সুরে। এক সন্ধ্যায়, ছোট্ট রিনু বলে ওঠে, “দাদু, আপনি তো গল্পের মতো কথা বলেন।” সুধাংশুবাবু হেসে ফেলেন, আর বলেন, “তুই যদি শুনিস, তাহলে আমি বলে যাব। কারণ তোর মতো শ্রোতা পেলে, যে কেউ কবি হয়ে যায়।”
শেষ বিকেলের আলোয় একদিন আশ্রমের এক অনুষ্ঠানে সুধাংশুবাবু পড়েন নিজের লেখা—একটি চিঠি, যেটা তিনি কোনওদিন পাঠাননি, তাঁর সেই ছাত্র অর্ঘ্যর জন্য, যে একটা পথ দুর্ঘটনায় অকালে চলে গিয়েছিল। সেই চিঠি পড়ে শোনাতে শোনাতে তাঁর গলা কেঁপে ওঠে, কিন্তু পাশে বসা রামকেলি তার একতারা টেনে সুর ধরেন। আর সেই সন্ধ্যায়, রক্তকরবীর গাছের নিচে বসে আশ্রমবাসীরা বুঝে যান—সন্ধ্যা মানে শুধু অবসান নয়, সন্ধ্যা মানে সঞ্চয়, যেখানে দিনের আলো মিশে যায় রাত্রির অপেক্ষায়। সুধাংশুবাবুর সন্ধ্যা আজ আর একাকী নয়, তা এখন বহু কণ্ঠের, বহু অনুভবের এক গোধূলি সংগীত।
দশ
রক্তকরবীর গাছটা আশ্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে—মাঝখানে যেন এক সজীব স্তম্ভ, যার নিচে একটার পর একটা গল্প জমা হয়ে আছে। কেউ বলে এখানে কোনও এক আশ্রমিকের অস্থি মিশে আছে, কেউ বলে রবীন্দ্রনাথ একবার এই গাছের নিচে বসেই এক পংক্তি লিখেছিলেন: “প্রাণের মাঝখানে বসে আছি নির্ভীক”। এই গাছটাকে ঘিরেই যেন গড়ে উঠেছে আশ্রমের মৌল সুর—যেখানে শিশুরা খেলে, বৃদ্ধারা বসে সূর্য ডোবার দিকে তাকায়, মাঝবয়েসিরা একটানা গুনগুন করে। কিন্তু আজকের এই বিকেলটা অন্যরকম। কারণ রামকেলি, যিনি সাত মাস আগে এই আশ্রমে এসেছিলেন, আজ বলছেন তিনি চলে যাবেন। আশ্রমের সবাই চুপ। এই রক্তকরবীর নিচেই এখন জড়ো হয়েছে সকলের নিরবতা, প্রত্যাশা, আর অশ্রুতে রঙিন হয়ে ওঠা বিদায়।
রামকেলি বললেন, “আমি এসেছিলাম আমার নিজের গানের সুর হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে। এখন দেখছি, তোমাদের ভেতরেই সেই সুর খুঁজে পেয়েছি। তাই এবার অন্য কোথাও যাওয়া দরকার—কারণ গান থেমে গেলে তার নতুন পথ খুঁজে নিতে হয়।” তিনি হাত দিয়ে একতারার শেষ তারটা ছুঁয়ে দেখেন, যেন নিশ্চিত হন সুর এখনও জেগে আছে। হরিপ্রিয়াদেবী বললেন, “আপনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে নিজেদের ভেতরের সুরকে খুঁজে নিতে হয়। আপনি শুধু বাউল নন, আপনি সত্তার সন্ধানী।” শিশুরা কাঁদছিল, আর সুধাংশুবাবু চুপ করে একটা ছোট নোটবুক রামকেলির হাতে তুলে দেন—তাতে লেখা ছিল, ‘আশ্রমবাসীদের লেখা গান’—যেগুলো রামকেলি চালিয়েছেন, বদলেছেন, আর তৈরি করেছেন।
রক্তকরবীর নিচে শুরু হয় এক বিদায়ের গান। সবার কণ্ঠে, রাধামণির সুরে, সুধাংশুবাবুর ভাষায়, রোহনের তালি আর রিনুর ছন্দে—সব একসঙ্গে মিশে যায় এক অদ্ভুত সমবেত বাউল ধ্বনিতে। গানের মধ্যে বলে ওঠে—“যারা আসে, তারা রেখে যায় আলো; যারা যায়, তারা রেখে যায় ছায়া।” সেই গানের মাঝখানে হঠাৎ বাতাসে উড়তে থাকে সাদা কাগজ, শিশুরা যেগুলো আকাশের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেয়—তাদের লেখা চিঠি, প্রার্থনা, আর স্বপ্ন। আশ্রম যেন আজ একত্র হয়ে গিয়েছে কোনও চিরন্তন উৎসবের মতো—যেখানে বিদায় মানে বিচ্ছেদ নয়, বরং নতুনের ডাক। রামকেলি মাথায় গামছা জড়িয়ে একবার রক্তকরবীর গাছের গুঁড়িতে হাত রাখেন—“এই গাছটার নিচে থেকেই তো সব শুরু হয়েছিল, তাই এখান থেকেই শেষ হওয়া উচিত।”
সন্ধ্যা নামতে নামতে রামকেলি চলে যান ধুলোবালি পথ বেয়ে, কিন্তু তাঁর গান, তাঁর সুর, তাঁর অস্তিত্ব রয়ে যায় আশ্রমে—প্রত্যেক কণ্ঠ, প্রতিটি চিঠির শব্দে, প্রতিটি রক্তকরবীর পাতায়। আশ্রমবাসীরা জানে, তাঁকে আর হয়তো দেখা যাবে না, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, তাঁর দর্শন, আর তাঁর জাগিয়ে তোলা আত্মস্বর সবসময় বাজবে এই মাটির ভেতরে। রক্তকরবীর নিচে এখন আরও এক ইতিহাস জমা হল—এক আগন্তুক বাউলের, যিনি এসে হৃদয়ের পরতে পরতে রেখে গিয়েছেন এক প্রবল জাগরণ। আর গাছটা দাঁড়িয়ে রইল—জীবনের কেন্দ্রস্থলে, রক্তকরবীর রঙে, গান ও গল্পের সাক্ষী হয়ে।
এগারো
রিনু আশ্রমের সবচেয়ে ছোট বাসিন্দা। বয়স ছয়, কিন্তু চোখে একরকম ধরা না-পড়া আকাশ থাকে, আর হাতে সবসময় থাকে একটা পুরনো টিনের বাক্স, যার ভেতর থাকে তার ‘ধন’—রঙপেন্সিলের ছোট্ট সংগ্রহ। কারও ফেলা দেওয়া, কারও ছেঁড়া বাক্স থেকে কুড়িয়ে আনা, আর আশ্রমে কেউ উপহার দিলে তার জন্য লেখা থাকে একটা কাগজে: “লালটা দাদু দিল, সবুজটা মিঠিদি, হলুদটা রামকেলিদা।” সেই রঙপেন্সিল দিয়ে সে শুধু ছবি আঁকে না, বরং নিজের ভিতরটাও রাঙিয়ে ফেলে। রিনু যখন রঙ তোলে, তখন আশ্রমের দেওয়াল হয়ে ওঠে ক্যানভাস, শুকনো পাতাও তার কাছে গল্প বলে। সে বলে, “আমি তো রঙ দিয়ে কথা বলি। আমার কথা তো কেউ বোঝে না।” আশ্রমবাসীরা জানে—রিনু কোনোদিন স্বাভাবিক ভাষায় নিজেকে পুরোটা প্রকাশ করতে পারেনি, কিন্তু তার আঁকায় ছিল বিস্ময়কর এক মূর্ত সত্যের ছায়া।
রামকেলির যাওয়ার পরে রিনু চুপ হয়ে গিয়েছিল। তার প্রিয় ‘কাঁধে গামছাওয়ালা গানওয়ালা দা’ আর প্রতিদিন সকালবেলা তাকে ডাকত না, গানের সুরে রিনুর আঁকা খুঁজে নিত না। একদিন হরিপ্রিয়াদেবী দেখতে পেলেন, রিনুর রঙপেন্সিলের বাক্সে লালটা নেই। জিজ্ঞেস করায় সে বলল, “ওটা আমি দিয়ে দিয়েছি গাছটাকে, যাতে সে রামকেলিদার গান মনে রাখে।” আশ্রমের রক্তকরবীর গাছে তখন একটি লাল পেন্সিল ঝুলছিল সুতো দিয়ে বাঁধা। সুধাংশুবাবু বললেন, “এই পেন্সিলটা যদি ওর ভাবনার অনুবাদ হয়, তাহলে আমাদেরও বোঝা উচিত, এই ছোট্ট মেয়েটা কত বড় কথা বলছে।” তারপর থেকেই রিনুর আঁকা নিয়ে শুরু হয় আশ্রমের ‘রঙ কথার পাঠশালা’—প্রতি রবিবার দুপুরে রিনু তার আঁকা ছবি দেয়ালের পাশে সাজায়, আর সবাই মিলে ছবির গল্প বলে।
এই পাঠশালায় ধীরে ধীরে যুক্ত হয় রোহন, রাধামণি, এমনকি সুধাংশুবাবুও—তাঁরা নিজের নিজের জীবন থেকে নেওয়া দৃশ্য রিনুর আঁকায় খুঁজে পান। একটা ছবিতে দেখা গেল একটি ঘুমন্ত মেয়ে, তার বুকের ওপর বসে আছে একটা রঙিন পাখি। সবাই বলল, “এটা কি তুই?” রিনু মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, এটা তো হরিপ্রিয়াদিদি। উনি যখন গল্প বলেন, তখন আমি উড়তে পারি।” এমনভাবে রিনুর রঙপেন্সিল হয়ে ওঠে আশ্রমের নতুন ভাষা—একটি অলিখিত অনুবাদ, যা শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ, নির্বাক, অতীতস্মৃতিবাহী সবার মনের কথাকে রঙে প্রকাশ করে। একবার এক নতুন আগত আশ্রমবাসী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “এই দেয়ালের আঁকাগুলো কার?” উত্তর আসে একসঙ্গে—“রিনুর, আমাদের সবার।”
অবশেষে, আশ্রমে সিদ্ধান্ত হয়, ‘রিনুর রঙপেন্সিল’ নামে একটি দেওয়াল পত্রিকা তৈরি হবে, যেখানে তার আঁকা আর আশ্রমবাসীদের লেখা একসঙ্গে প্রকাশ পাবে। আর এই দেওয়াল পত্রিকার নিচে থাকবে একটা বাক্স—যেখানে যে কেউ তার নিজের রঙ হারালে একটা করে রঙপেন্সিল রেখে যেতে পারবে, যেন নতুন কেউ এসে সেটা খুঁজে নেয়। সেই দিন রিনু আবার একটা লাল পেন্সিল পায়—পুরনো নয়, একেবারে নতুন। পেন্সিলে লেখা ছিল—“শোন, আমি তোর গান শুনেছি”—স্বাক্ষর: আর.কে. (রামকেলি)। রিনু চুপচাপ সেটা বাক্সে রাখে না, বরং হাতে নিয়ে বলে, “এটা দিয়ে আমি এমন কিছু আঁকব, যেটা কেউ কোনোদিন ভুলবে না।” আর সেই মুহূর্তে রক্তকরবীর গাছের নিচে, বাতাসে, আলোর ছায়ায়, যেন দেখা গেল—একটা সুর হালকা হেসে ফিরে তাকালো।
বারো
বসন্তকাল এসে পড়েছে শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে। রক্তকরবীর গাছে আবার ফুল ফুটেছে—আগুনের মতো রঙ, নীরবতার গায়ে ছড়িয়ে পড়া এক প্রতিশ্রুতি। আশ্রমের আঙিনায় নতুন মুখ এসেছে, পুরনো মুখরা নিজেদের মতো ব্যস্ত—কিন্তু কোথাও যেন একটা সূক্ষ্ম বদলের ছাপ পড়েছে সকলের স্বরে, চোখে, কাজে। হরিপ্রিয়াদেবী সকালে উঠে দেখে চৌকাঠে রাখা একটা চিঠি—কোনও প্রেরকের নাম নেই, শুধু লেখা: “রক্তকরবীর নীচে খুলবেন।” তাঁরা সবাই মিলে সেই গাছের নিচে জড়ো হলেন। সুধাংশুবাবু চিঠি পড়ে শোনালেন—“আমি চলে গেছি, ঠিকই, কিন্তু রেখে গেলাম কিছু। না, শুধু গান না। রেখে গেলাম তোমাদের ভিতরের আলো, যেটা আমি শুধু খুঁজে দিয়েছি, সৃষ্টি নয়। আমার থাকাটা শেষ হল, কিন্তু তোমাদের শুরু হোক সেই আলোর ভিতর দিয়ে। — রামকেলি।”
চিঠির সঙ্গে ছিল একটা খাম—তার ভেতর কাগজে আঁকা নকশা, যেটা দেখে সুধাংশুবাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “এটা তো একটি পাঠশালার নকশা—একটি খোলা জায়গা, যেখানে বই, গান, গল্প, আর ছবি একসাথে মেলে ধরা হবে। নাম রাখা হয়েছে—‘রক্তকরবীর ছায়া’।” হরিপ্রিয়াদেবী বললেন, “এটা শুধু এক পাঠশালা নয়, এ এক উত্তরাধিকার।” সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আশ্রমের পাশে ফাঁকা মাঠে শুরু হবে এই নতুন পাঠশালা—শিশুরা যেমন শিখবে, তেমনি বড়রাও শোনাবে নিজেদের কথা। ভাষা, সুর, রঙ, দৃষ্টিভঙ্গি—সব একসাথে মিলে তৈরি হবে নতুন সম্পর্কের ভুবন। সবাই স্বেচ্ছায় অংশ নিলেন, সেলাই জানেন যিনি, তিনি কাপড় পড়াতে রাজি হলেন, কবিতা জানেন যিনি, তিনিও উৎসাহ দিলেন। আর রিনু? সে বলল, “আমি দেয়াল আঁকব। বড় বড় ফুল, রঙিন মানুষ, আর একটা গাছ—যার পাতা কখনো ঝরে না।”
সেই পাঠশালার প্রথম দিনে একটা ছোট্ট মঞ্চ তৈরি হয়। কেউ কিছু লেখেনি, কেউ কোনও উদ্বোধনী বক্তৃতাও দেয়নি। শুধু সুধাংশুবাবু গেয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের সেই চিরন্তন পংক্তি—“আজি এ প্রভাতে রবি তব উদয় গিরিধারে…”। আর রিনু, তার হাতে এক গুচ্ছ পেন্সিল নিয়ে সামনে এসে বলে, “আজ থেকে আমরা সবাই মিলে গল্প বলব। কেউ শুনবে, কেউ বলবে, কেউ ছবি আঁকবে।” হঠাৎ করে ছোট্ট এক ছেলেও উঠে বলে, “আমি গান গাইব”—এমনভাবে, যেন রামকেলির আত্মা আবার একতারা হাতে পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। আশ্রমের পুরনো দেওয়ালে একটা নাম লেখা হল—‘রক্তকরবীর নীচে’—নিচে ছোট করে, “যেখানে গান থামে না।” যেন একটা আন্দোলন শুরু হল—নীরব, ধুলোবালি মেশানো, কিন্তু অশেষ শক্তিশালী।
রাত্রি নামার আগে, সুধাংশুবাবু একবার একা হাঁটতে বেরোলেন রক্তকরবীর গাছের নিচে। দেখলেন, সেই গাছে বাঁধা আছে লাল রঙের এক পেন্সিল—নতুন, ঠিক যেমন রিনু রেখেছিল। পাশে লেখা: “আমরা সবাই লিখছি এখন।” বাতাসে যেন কারও একতারার ঝংকার বাজে, অজানা একটা সুর ফিরে আসে—চেনা, অথচ নতুন। সুধাংশুবাবু মনে মনে বলেন, “শেষ চিঠির উত্তর দিয়ে গেল রিনু, রোহন, হরিপ্রিয়া… সবাই। আমরা শুধু গল্পের চরিত্র নই, গল্পের লেখকও। আর এই গাছ? এটি সাক্ষী থাকবে, যতদিন রঙ থাকবে, সুর থাকবে, ভালোবাসা থাকবে।” আশ্রমের ওপর, শান্তিনিকেতনের সেই উপকণ্ঠে, নতুন দিনের প্রথম তারা জ্বলে ওঠে—রক্তকরবীর ছায়ায়।
সমাপ্ত




