Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

রক্তকরবীর নিচে

Spread the love

শ্যামল মণ্ডল


শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে বিস্তৃত মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট্ট আশ্রম, যার বয়স অন্তত একশো বছরের কাছাকাছি। চারপাশে তাল, শাল আর আমগাছের ছায়ায় আশ্রমটিকে দূর থেকে মনে হয় যেন সময়ের থেকে আলাদা কোনো টুকরো জায়গা, যেখানে আধুনিকতার কোলাহল ঢুকতে পারেনি। আশ্রমের মূল প্রবেশপথের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল করবীর গাছ—গোটা এলাকার সবচেয়ে বেশি আলোচিত আর ভয়ভীতির কেন্দ্রবিন্দু। আশ্রমের সন্ন্যাসী আর আশ্রমে পড়তে আসা অনাথ ছেলেমেয়েরা সবাই জানে, দিনের বেলায় করবীর গাছ স্বাভাবিক মনে হলেও সন্ধ্যা নামলেই তার চেহারা পাল্টে যায়। প্রতিদিনই গাছের ডালে ফোটে অদ্ভুত টকটকে লাল ফুল, যার রং এতটাই গাঢ় যে অনেকেই বলে, রক্তের মতো দেখায়। আশ্রমের বয়স্করা দাবি করেন, এই গাছের তলায় একসময় এক সন্ন্যাসী গভীর তান্ত্রিক সাধনা করতেন, কিন্তু অসমাপ্ত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই এখানে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। কেউ বলে, রাত নামলেই গাছের তলায় বসে অচেনা কারও কান্নার শব্দ শোনা যায়, আবার কখনও মন্ত্রোচ্চারণের মতো গম্ভীর আওয়াজ কানে আসে। আশ্রমে বহু বছর ধরে যারা আছেন, তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এইসব অস্বস্তিকর ঘটনাকে এড়িয়ে যেতে। তবু প্রতিটি নতুন মানুষ যখন আশ্রমে আসে, গাছটির সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বুকের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়—যেন অদৃশ্য কেউ নজর রাখছে।

এই সময়েই আশ্রমে নতুন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন অমিতাভ। বয়স তিরিশের কাছাকাছি, কলকাতার এক কলেজ থেকে পাশ করে তিনি সিদ্ধান্ত নেন শহরের চাকচিক্য ছেড়ে গ্রামীণ ছেলেমেয়েদের পড়াবেন। ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন রোমান্টিক স্বভাবের মানুষ, লোককথা আর রহস্য নিয়ে তাঁর আগ্রহ বরাবরই প্রবল। তাই আশ্রমে প্রথম দিন পা রেখেই করবীর গাছ তাঁকে অদ্ভুতভাবে টেনে নেয়। সন্ধের পর মাটির রাস্তা দিয়ে আশ্রমে ঢুকছিলেন, তখন গাছটির নিচে থেমে গেলেন হঠাৎ। মাটির উপর ঝরে পড়া লাল ফুলগুলোকে দেখে মনে হলো যেন কেউ সদ্য রক্ত ছিটিয়ে দিয়েছে। হালকা বাতাসে ফুলগুলো কেঁপে উঠতেই তাঁর মনে হলো, যেন অদৃশ্য কোনো শ্বাস গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে তাঁর কানে ভেসে এল ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট এক শব্দ—যেন দূরে কোথাও কেউ মৃদু গলায় কাঁদছে। চারদিকে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন, আশেপাশে কেউ নেই। আশ্রমের মূল ভবন অনেকটা দূরে, আর বাকি সন্ন্যাসীরা ইতিমধ্যেই রাতের ভোজন শেষ করে প্রার্থনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবু সেই কান্নার শব্দ যেন স্থির থেকে গেল বাতাসে। অমিতাভ বুকের ভেতর এক অকারণ শিহরণ অনুভব করলেন, কিন্তু অদ্ভুতভাবে ভয় নয়, বরং কৌতূহল তাঁকে আচ্ছন্ন করল।

পরের দিন থেকে আশ্রমের কাজকর্মে মিশে যেতে লাগলেন তিনি। সকালবেলা প্রার্থনা, তারপরে ছেলেমেয়েদের পড়ানো, দুপুরে বিশ্রাম আর সন্ধের সময় আবার প্রার্থনা। আশ্রমের জীবনযাপন সহজ, নির্লোভ আর শান্ত। কিন্তু করবীর গাছকে ঘিরে গোপন ভয়টা প্রতিদিনই তাঁর চোখে পড়তে লাগল। শিশুরা কখনও গাছের কাছে যায় না, এমনকি খেলার সময়েও তারা করবীর গাছটিকে এড়িয়ে খোলা মাঠে চলে যায়। একদিন দুপুরে অমিতাভ এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা ওদিকে খেলো না কেন?” ছোট্ট ছেলেটি ভয়ে চোখ বড় করে বলল, “ওখানে যাওয়া মানা। সন্ধের পর গেলে দুষ্ট আত্মা ধরে নেয়।” এই উত্তর তাঁকে চমকে দিলেও তিনি হাসি চাপলেন। তবে রাতে তাঁর ঘুম আসতে দেরি হলো—গাছের তলায় শোনা কান্নার শব্দ যেন কানে লেগে রইল। তিনি ভাবতে লাগলেন, এত বছর ধরে আশ্রমে থাকা মানুষজন যদি সত্যিই এসব শুনে থাকেন, তবে কেন এ নিয়ে কখনও কেউ তদন্ত করেনি? স্থানীয় গ্রামবাসী বা প্রশাসন কি কখনও কৌতূহলী হয়নি? নাকি সবাই অজ্ঞাত ভয় বা বিশ্বাসের কাছে মাথা নত করে চুপ করে গেছে?

তৃতীয় দিন সন্ধ্যায়, অমিতাভ নিজের অজান্তেই আবার করবীর গাছের তলায় চলে গেলেন। আকাশ তখন ধীরে ধীরে গাঢ় নীল হয়ে আসছে, পাখিরা নীড়ে ফিরছে, আর দূরে মাঠের প্রান্তে সূর্য লালচে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিক তখনই গাছের ফুলগুলো একসঙ্গে হেলে পড়ল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত সেগুলোকে নেড়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর কানে এলো সেই পরিচিত শব্দ—একটি ভারী, গভীর গলা থেকে ভেসে আসা মন্ত্রোচ্চারণ। শব্দ এতটাই অস্পষ্ট যে তিনি শব্দগুলো আলাদা করতে পারলেন না, কিন্তু সুর আর ছন্দ স্পষ্ট। মনে হলো, যেন গাছের তলায় কোনো অদৃশ্য সাধক বসে প্রার্থনা করছে। হঠাৎ এক ঝটকা হাওয়ায় ফুলগুলো উড়ে এসে তাঁর পায়ের কাছে জমা হতে লাগল। অমিতাভ নিচু হয়ে একটি ফুল হাতে তুলে নিতেই দেখলেন, আঙুলে অদ্ভুত লালচে দাগ লেগে গেছে। তিনি চমকে উঠে হাত ঝেড়ে ফেললেন, কিন্তু দাগ মিলিয়ে গেল না। বুকের ভেতর কাঁপুনি নিয়ে তিনি আশ্রমের দিকে ছুটলেন। সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম আসেনি। তাঁর মনে হলো, করবীর গাছ তাঁকে ডাকছে, যেন তার অদ্ভুত রহস্য উন্মোচন করার দায়িত্ব তাঁর ওপরেই ন্যস্ত। আশ্রমের সবাই যেখানে গাছটিকে এড়িয়ে চলে, সেখানে তিনি এক অদৃশ্য টানের শিকার হচ্ছেন।

এই প্রথম অধ্যায়ে অমিতাভ বুঝতে পারলেন, আশ্রমে তাঁর আসাটা হয়তো নিছক কাকতালীয় নয়। করবীর গাছের রহস্য তাঁকে টেনে আনছে নিজের দিকে, আর সেই রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু বছরের অজানা ইতিহাস। হয়তো সত্যিই কোনো তান্ত্রিকের অসমাপ্ত সাধনার ছায়া এই গাছের শিকড়ের সঙ্গে মিশে গেছে, হয়তো কান্নার শব্দ সেই অপূর্ণতার প্রতিধ্বনি। কিন্তু আরেকদিকে, বাস্তববাদী মন বলছে—সবই কেবল কুসংস্কার, মানুষের ভয় আর বিশ্বাসের মিশ্রণে তৈরি ভ্রান্ত ধারণা। দুই মনের টানাপোড়েনে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। পরের দিন থেকে তিনি গাছটির কাছে আরও সময় কাটাতে শুরু করলেন—দিনে, সন্ধ্যায়, আর মাঝেমধ্যেই রাতে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন গাছের দিকে। ক্রমশ তাঁর মধ্যে জন্ম নিল এক সিদ্ধান্ত—এই করবীর লাল ছায়ার রহস্য তিনি উদ্ঘাটন করেই ছাড়বেন, তা সে যতই বিপজ্জনক হোক না কেন। কারণ তাঁর অন্তরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি স্পষ্ট হচ্ছিল—যদি এই রহস্য উন্মোচন না হয়, তবে গাছের তলায় ভেসে আসা কান্না আর মন্ত্রোচ্চারণ কোনোদিনও থামবে না।

*

আশ্রমে কাটতে কাটতে অমিতাভ ধীরে ধীরে বুঝতে লাগলেন, এখানে শুধু শিশুরাই নয়, আরও বহু মানুষ তাদের জীবনের গল্প নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বেশ কয়েকজন বিধবা মহিলা, যারা সমাজের কঠিন নিয়মে বঞ্চিত হয়ে এখানে এসে শান্তি খুঁজেছেন, তারা দিনের বেলায় প্রার্থনা ও আশ্রমের কাজে ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু রাতে যেন সবার চোখে এক চাপা ভয় ভাসে। সন্ধ্যা নামলেই তারা বারান্দার আলো জ্বেলে বসে থাকেন, অথচ আশ্রমের উঠোনের করবীর গাছের দিকে তাকাতে পর্যন্ত চান না। আবার কিছু প্রবীণ শিক্ষক, যারা একসময় শহরের কলেজে পড়াতেন, অবসর গ্রহণের পর এখানে এসে থাকছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলাদা ছিলেন হেমাঙ্গবাবু—বয়সে প্রায় সত্তরের কাছাকাছি, সাদা ধবধবে দাড়ি আর তীক্ষ্ণ চোখ, কিন্তু কণ্ঠে সবসময় এক ধরনের মমতা মেশানো দৃঢ়তা। অমিতাভ প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলেন, করবীর গাছ নিয়ে প্রশ্ন তুললেই আশ্রমবাসীরা বিষয়টা এড়িয়ে যান। কিন্তু হেমাঙ্গবাবুর চোখে মাঝে মাঝে এমন এক ঝলক ধরা পড়ত, যেন তিনি অনেক কিছু জানেন, শুধু বলতে চান না। অমিতাভের কৌতূহল ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল। একদিন দুপুরে, যখন অন্যরা বিশ্রামে, তখন তিনি হেমাঙ্গবাবুর সঙ্গে লাইব্রেরির ছোট্ট ঘরে বসে আলাপ শুরু করলেন। বইপত্রে ভরা ঘরে ধূপের হালকা গন্ধ ভেসে আসছিল, আর জানালা দিয়ে দূরে করবীর লাল ফুল দেখা যাচ্ছিল।

হেমাঙ্গবাবু প্রথমে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন, যেন কথাগুলো বলবেন কি না তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “তুমি নতুন এসেছ, তাই হয়তো তোমার চোখে গাছটা কেবল রহস্যময় মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা এখানে বহু বছর ধরে আছি, জানি এই গাছ কেবল একটি গাছ নয়—এটি এক অভিশাপের চিহ্ন।” অমিতাভ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হেমাঙ্গবাবু গলা নামিয়ে বলতে লাগলেন, “এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রঘুনাথ নামের এক তান্ত্রিক। অনেকে তাঁকে সাধু বলত, আবার কেউ কেউ ভয় করত। তাঁর সাধনার উদ্দেশ্য কী ছিল, তা কেউ নিশ্চিত জানত না। তবে শোনা যায়, তিনি মৃত্যুর আগে করবীর নিচে এক অদ্ভুত যজ্ঞ করেছিলেন। সেই যজ্ঞে নাকি এমন মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল, যা আত্মার মুক্তি দেয় না, বরং বেঁধে রাখে অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে। কিন্তু যজ্ঞ অসমাপ্ত রয়ে যায়। কেউ বলে, হঠাৎ মৃত্যু ঘটে তাঁর; কেউ বলে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেই যজ্ঞ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। যাই হোক, তার পর থেকেই গাছটি অভিশপ্ত হয়ে ওঠে। রাত নামলেই শোনা যায় তাঁর অপূর্ণ সাধনার প্রতিধ্বনি—কান্না, মন্ত্র, আর অচেনা ছায়া।” কথাগুলো বলতে বলতে হেমাঙ্গবাবুর চোখ যেন অতীতের অন্ধকারে ডুবে গেল।

অমিতাভ প্রথমে এসবকে লোককথা ভেবেছিলেন, কিন্তু হেমাঙ্গবাবুর কথার ভেতরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল। তিনি বুঝলেন, আশ্রমের মানুষজন এই রহস্য নিয়ে শুধু ভয়ই পোষণ করেন না, বরং তাঁদের জীবনের গভীরে মিশে আছে সেই অভিজ্ঞতা। অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কেউ কি কখনও চেষ্টা করেনি রহস্যটা উন্মোচন করার?” হেমাঙ্গবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “অনেকেই চেষ্টা করেছিল। বছর কুড়ি আগে এক গবেষক এসেছিলেন। তিনি ইতিহাস আর তন্ত্রবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন, করবীর গাছকে নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ জন্মায়। কয়েক রাত ধরে তিনি গাছের কাছে বসেছিলেন, নোট লিখেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা গেল তিনি নিখোঁজ। আশ্রম থেকে কয়েক মাইল দূরে তাঁর দেহ পাওয়া গিয়েছিল, আর শরীরে কোনো আঘাত না থাকলেও মুখমণ্ডলে এক ভয়ানক আতঙ্কের ছাপ জমে ছিল। তারপর থেকে আর কেউ সাহস করেনি। আমরা আশ্রমবাসীরা শিখে গেছি গাছটিকে এড়িয়ে চলতে, তাকে যেমন আছে তেমনই থাকতে দিতে। কিন্তু তুমি নতুন, তোমার চোখে কৌতূহল আছে। তবে সাবধান, অতিরিক্ত কৌতূহল বিপদ ডেকে আনে।” হেমাঙ্গবাবুর কণ্ঠে এক অদ্ভুত কম্পন ছিল, যেন তিনি অতীত থেকে কিছু দেখেছেন বা অনুভব করেছেন, যা কথায় প্রকাশ করা যায় না।

অমিতাভ নীরবে শুনলেন, কিন্তু তাঁর অন্তরের কৌতূহল আরও তীব্র হলো। তিনি জানতেন, যে আশ্রমে এত মানুষ শান্তি খুঁজতে এসেছে, সেখানে এমন এক অভিশপ্ত গোপনীয়তা তাদের নিত্যদিনের জীবনকে ছায়ার মতো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বিধবা মহিলাদের মুখের বিষণ্ণতা, শিশুদের খেলার আনন্দে গাছটিকে এড়িয়ে চলা, আর প্রবীণদের চোখে চাপা ভয়—সবকিছুর শিকড় লুকিয়ে আছে করবীর গাছের নিচে। রাতের বেলায় জানালার ফাঁক দিয়ে যখন তিনি গাছটির দিকে তাকান, মনে হয় গাছের ছায়া আশ্রমের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। হেমাঙ্গবাবুর সতর্কবার্তা মনে পড়লেও অমিতাভের ভিতরের মানুষটি বুঝতে পারলেন, তিনি আর পিছু হটতে পারবেন না। অভিশাপ সত্যি হোক বা মিথ, অসমাপ্ত যজ্ঞ সত্যিই ঘটে থাকুক বা লোককথা মাত্র হোক—তিনি এই রহস্যকে না জানা পর্যন্ত শান্তি পাবেন না। আর সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তাঁর ভেতরে জন্ম নিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা—যেমনভাবে আশ্রমবাসীরা গোপন স্মৃতি বুকে চেপে রেখেছেন, তেমনভাবে তিনি আর চুপ করে থাকতে পারবেন না। করবীর লাল ছায়ার অন্ধকার ভেদ করেই তিনি খুঁজে বার করবেন সত্য।

*

রাতটা ছিল অমাবস্যার, আকাশে চাঁদ নেই, শুধু ঝিলমিল করা তারা ছড়ানো। আশ্রমে সবাই প্রার্থনা শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে, কেবল দূরে দূরে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। অমিতাভের মন তখনও অস্থির। হেমাঙ্গবাবুর সতর্কতা আর আশ্রমবাসীদের চাপা ভয় বারবার মনে পড়ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর কৌতূহলও যেন দ্বিগুণ জেগে উঠছিল। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ রাতে তিনি নিজেই সত্যটা দেখবেন। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠলেন, হাতে কেবল একটি লণ্ঠন নিলেন, আর আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলেন আশ্রমের মূল ভবন থেকে। রাতের বাতাস ছিল শীতল আর ভারী, যেন চারদিকের প্রকৃতি নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে। করবীর গাছের দিকে পা বাড়াতেই মনে হলো, যেন অন্ধকার আরও ঘন হচ্ছে, আর গাছটি দূর থেকে তাঁকে চুপচাপ আহ্বান করছে।

গাছের কাছে পৌঁছতেই অমিতাভের বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো, তবু তিনি সাহস জোগাড় করে গাছতলার মাটিতে বসলেন। চারদিকে নির্জনতা, লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয় লাল ফুলগুলো রক্তের ফোঁটার মতো ঝলমল করছিল। হঠাৎই এক ঝোড়ো হাওয়া এল, আর গাছ থেকে ঝরে পড়তে লাগল লাল ফুল। অমিতাভ প্রথমে ভেবেছিলেন, এ কেবল প্রকৃতির খেলা। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তিনি অনুভব করলেন, সেই ফুলগুলো একসঙ্গে এসে তাঁর কোল ভরে তুলছে। তাঁর আঙুলে ছুঁয়ে গেল আর্দ্রতা, যেন ফুল নয়, কণকণ রক্ত জমে উঠেছে। বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কপালে ঠান্ডা ঘাম। ঠিক তখনই শোনা গেল এক নারীকণ্ঠ—কোমল অথচ যন্ত্রণায় ভরা—“আমাকে মুক্তি দাও…” কণ্ঠস্বর এত কাছে, এত স্পষ্ট যে অমিতাভ চমকে উঠে চারদিক তাকালেন। কেউ নেই, কেবল লাল ফুলের স্তূপ আর করবীর ডালপালা দুলছে।

ভয় তাঁকে গ্রাস করল। তবু কান থেকে কণ্ঠস্বর সরে গেল না, বরং মনে হলো তা তাঁর বুকের ভেতরে, হৃদয়ের গভীরে বাজছে। তিনি তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালেন, কাঁপতে কাঁপতে আশ্রমের দিকে দৌড়লেন। লণ্ঠনের আলো এদিক-ওদিক দুলছিল, আর মনে হচ্ছিল পিছন থেকে কেউ অনুসরণ করছে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন তিনি, কিন্তু কণ্ঠস্বর থামল না। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে সেই বাক্য বাজতে লাগল—“আমাকে মুক্তি দাও।” বিছানায় বসে তিনি কানে হাত চেপে ধরলেন, কিন্তু শব্দ আরও স্পষ্ট হলো। চোখ বন্ধ করলে ভেসে উঠল এক নারীর অস্পষ্ট অবয়ব, সাদা শাড়ি, কপালে লাল আভা, আর চোখে অপার দুঃখ। অমিতাভের মনে হলো, তিনি যেন অন্য কোনো জগতে টেনে নেওয়া হচ্ছেন। অবশেষে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

পরদিন সকালেই আশ্রমের অন্যরা বুঝতে পারলেন, অমিতাভের সঙ্গে কিছু ঘটেছে। তাঁর মুখে ক্লান্তি, চোখ লাল, আর শরীর কাঁপছিল। এক বিধবা মহিলা চুপচাপ তাঁর সামনে এক গ্লাস জল রেখে ফিসফিস করে বললেন, “ওখানে গেলে ফেরার পথ থাকে না।” আরেকজন প্রবীণ শিক্ষক কড়া গলায় সতর্ক করলেন, “তুমি ভুল করেছ। সেই গাছের ছায়ায় একবার যে বসে, তার জীবনে শান্তি আর থাকে না।” হেমাঙ্গবাবু কিছু বলেননি, কেবল গভীরভাবে তাকালেন তাঁর চোখে, আর অমিতাভ অনুভব করলেন, যেন বৃদ্ধ অধ্যাপক জানেন তিনি আসলে কী শুনেছেন। সবাই মিলে তাঁকে সাবধান করল, কিন্তু অমিতাভ বুঝলেন, তিনি আর পিছিয়ে যেতে পারবেন না। কণ্ঠস্বর এখনও তাঁর ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যেন অদৃশ্য কোনো আত্মা তাঁর সাহায্য চাইছে। ভয় তাঁকে কুরে খাচ্ছে, তবু কৌতূহল আর দায়িত্ববোধ তাঁকে তাড়িত করছে—এই রহস্য না ভাঙলে তাঁর মন কখনও শান্তি পাবে না। আশ্রমবাসীরা ভয় দেখালেও, অমিতাভ বুঝলেন—প্রথম রাতের আহ্বান তাঁর জন্য কেবল শুরু।

*

দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু অমিতাভর মনে সেই নারীকণ্ঠের প্রতিধ্বনি যেন আরো জোরালো হয়ে উঠছিল। আশ্রমবাসীরা যতই তাঁকে সতর্ক করছিলেন, ততই তাঁর কৌতূহল বাড়ছিল। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আশ্রমের পুরনো লাইব্রেরিতে খোঁজ করবেন। সেখানে বহু পুরনো পুঁথি, ছেঁড়া কাগজে ভরা তামার সিন্দুক আর গুঁড়ো হয়ে যাওয়া খাতা ধুলোর আস্তরণে চাপা পড়ে আছে। এক বিকেলে, যখন অন্যরা বিশ্রামে, তিনি নিঃশব্দে লাইব্রেরির তালা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। খোলা জানালা দিয়ে হালকা আলো এসে পড়ছিল, আর বাতাসে ধূপকাঠির মতো পুরনো কাগজের গন্ধ ভেসে আসছিল। অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর তিনি খুঁজে পেলেন এক অদ্ভুত পুঁথি—চামড়ার মলাটে বাঁধা, ভেতরে কালি বিবর্ণ হয়ে গেছে, তবু অক্ষরগুলো স্পষ্ট। পুঁথির শুরুতে আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনাথের সাধনা ও যজ্ঞের কথা লেখা ছিল। কিন্তু যতই তিনি পড়তে লাগলেন, ততই তাঁর শরীর শীতল হয়ে আসছিল। সেখানে স্পষ্ট লেখা ছিল—রঘুনাথ এক বিশেষ যজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, যা পূর্ণ করতে প্রয়োজন ছিল মানববলির।

পুঁথির ভেতর লেখা ছিল, রঘুনাথের সাধনার লক্ষ্য ছিল দেবীর প্রত্যক্ষ দর্শন পাওয়া। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, এর জন্য প্রয়োজন ছিল এক কুমারী যুবতীর প্রাণদানের আয়োজন। আশ্রমেই আশ্রিত এক অনাথ কিশোরীকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন, আর বহুদিন ধরে গোপনে তাঁকে প্রস্তুত করছিলেন। সেই সময়ের অন্য আশ্রমবাসীরা এই ভয়ংকর গোপনীয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। পুঁথির এক জায়গায় স্পষ্টভাবে লেখা ছিল, যজ্ঞের রাত ছিল পূর্ণিমা—রাতের অন্ধকারে রক্তমাখা করবীর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল যজ্ঞবেদী। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে। রঘুনাথ নিজেই হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কেউ বলেন, তাঁর হৃদপিণ্ড হঠাৎ থেমে গিয়েছিল, কেউ বলেন অদৃশ্য শক্তি তাঁকে হত্যা করে। যাই হোক, যজ্ঞ অসমাপ্ত থেকে যায়। তবে পুঁথিতে লেখা ছিল, “যুবতীর আত্মা মুক্তি পায়নি, সে রয়ে গেছে করবীর তলায় বন্দি, অপূর্ণ যজ্ঞের আগুনে। আর তাই আজও গাছের ফুল রক্তের মতো টকটকে লাল।” অমিতাভ এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে অনুভব করলেন, যেন বুকের ভেতর ভারি পাথর চাপা পড়ছে।

তিনি একে একে সব কথা মিলিয়ে দেখতে লাগলেন। প্রথম রাতেই যে নারীকণ্ঠ তাঁর কাছে মুক্তি চাইছিল, সে আসলে সেই অনাথ যুবতী। যার প্রাণদানের প্রস্তুতি হয়েছিল, কিন্তু যজ্ঞ অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায় তার আত্মা মুক্তি পায়নি। তাই এতদিন ধরে সে করবীর গাছের ছায়ায় বন্দি, আর রাত নামলেই কণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে মুক্তি চায়। অমিতাভর মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব জাগল। একদিকে তাঁর হৃদয় কেঁপে উঠল সেই যন্ত্রণার কথা ভেবে, অন্যদিকে ভয়ও গ্রাস করল তাঁকে। যদি সত্যিই কোনো আত্মা সেখানে বন্দি থাকে, তবে তাকে মুক্তি দেওয়ার পথ কী? পুঁথির শেষদিকে লেখা ছিল, “যজ্ঞ অসমাপ্ত থাকলে ভূমি অভিশপ্ত হয়, ফুল রক্তসিক্ত হয়, আর আত্মা শান্তি পায় না। তার মুক্তির জন্য আবারো সাধনা প্রয়োজন—কিন্তু এ পথ বিপজ্জনক।” তিনি এই বাক্য পড়তেই টের পেলেন, আশ্রমবাসীরা কেন সব গোপন রেখেছেন। সত্য প্রকাশ পেলে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। তাই এতদিন সবাই করবীর গাছের অশরীরী রহস্যকে লোককথা বলে এড়িয়ে গেছে।

অমিতাভ বইটি বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। বাইরে তখন সূর্য ডুবতে শুরু করেছে, জানালা দিয়ে করবীর গাছের ডালপালা দেখা যাচ্ছে, আর তাতে ফুটে থাকা লাল ফুলগুলো যেন রক্তে ভিজে ঝলমল করছে। তাঁর মনের ভেতর এক প্রশ্ন তীব্র হয়ে উঠল—তিনি কি এই অভিশাপের সত্যিই ইতি টানতে পারবেন? ভেতরে ভয় জাগলেও, সেই নারীকণ্ঠের আহ্বান তাঁর কানে আবার প্রতিধ্বনিত হলো—“আমাকে মুক্তি দাও।” তিনি বুঝলেন, আশ্রমের ইতিহাস শুধু অতীত নয়, বর্তমানকেও ছায়ার মতো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর এই গোপন সত্য তিনি একবার জেনে ফেলেছেন। এবার আর তিনি পিছিয়ে আসতে পারবেন না। হয়তো এ পথ বিপদে ভরা, কিন্তু সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের জালে বন্দি আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই এসে পড়েছে। করবীর লাল ফুল তখন বাতাসে দুলছিল, যেন অদৃশ্য কোনো হাত আবার তাঁকে আহ্বান করছে।

*

অমিতাভের ঘুম এখন এক ভয়ঙ্কর ছায়ার কাছে বন্ধক পড়ে গেছে। প্রতিদিন রাত নামলেই যেন তাঁর শরীর ক্লান্তি মেনে নেয়, কিন্তু মনের ভেতর জমে ওঠা আতঙ্ক আর সন্দেহ তাঁকে জাগিয়ে রাখতে চায়। অথচ সে চেষ্টার কোনো মানেই হয় না—চোখ বুজলেই সেই স্বপ্ন তাঁকে টেনে নিয়ে যায় করবীর গাছের নিচে। অন্ধকারে ভেজা মাটি, চাঁদের আলোয় লালচে ফুলের ছায়া, আর গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবতী—সাদা শাড়ি জড়ানো, চুল উন্মুক্ত, ফ্যাকাশে মুখ। প্রতিবারই একই দৃশ্য, শুধু চোখের বদল ঘটে। কখনো সেই চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে ওঠে, আবার কখনো তা রক্তে ভিজে ঝরে পড়ে গাল বেয়ে। অমিতাভ চেষ্টা করেন কাছে যেতে, ডাকতে, কিন্তু তাঁর কণ্ঠ যেন গলায় আটকে যায়। হাত বাড়ালেই দূরে সরে যায় চেহারাটি। প্রতিটি রাতে একই ঘুরপাক—যেন ঘুম আর জাগরণের মাঝখানে বন্দী হয়ে তিনি এক অচেনা নারীর আকুতি শুনে চলেছেন। এ সবকিছু নিছক মনের ভ্রম নাকি আশ্রমের নিস্তব্ধতা তাঁকে গ্রাস করছে, তা বুঝতে না পেরে অমিতাভের বুকের ভেতর অস্বস্তি বাড়তেই থাকে।

কিন্তু সেই অস্বস্তি স্বপ্নের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে না। একদিন ভোরবেলা হঠাৎই তাঁর চোখ খুলে যায়। জানলার বাইরে করবীর গাছ দেখা যায় না, অথচ তাঁর কানে বাজতে থাকে এক অদ্ভুত সুর—না গান, না কান্না, বরং দুইয়ের মাঝামাঝি এক টানটান শব্দ। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েই তিনি শুনলেন করিডর পেরিয়ে শিশুরা খেলছে, হেসে দৌড়চ্ছে। কিন্তু সেই শিশুর আওয়াজের মাঝেই হঠাৎ কানে এল এক ভিন্ন কণ্ঠ—স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ আর ভয়ঙ্করভাবে শান্ত—“দিদি ডাকছে।” অমিতাভের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তিনি ছুটে গেলেন বাইরে, কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের কেউই মুখ ঘোরাল না, কারও চোখে দেখা গেল না সেই অস্বাভাবিকতা। যেন কথাটা উচ্চারণই হয়নি। অথচ তিনি নিশ্চিত ছিলেন, কণ্ঠস্বরটা বাস্তবেই কানে এসেছে, নিছক কল্পনা নয়। পরের কয়েকদিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে—কখনো ভোরে, কখনো সন্ধ্যায় হঠাৎই কানে ভেসে আসে শিশুর মতোই কোনো কণ্ঠ, আর প্রতিবার একই বাক্য—“দিদি ডাকছে।”

অমিতাভ এখন বুঝতে পারলেন, এ কেবল তাঁর ব্যক্তিগত বিভ্রম নয়। আশ্রমে কিছু অদ্ভুত ঘটছে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো দীর্ঘ যাত্রা, কাজের চাপ, আর নিস্তব্ধ পাহাড়ি পরিবেশ তাঁকে অস্থির করে তুলছে। কিন্তু যখন দেখলেন অন্যরাও অকারণে অদ্ভুতভাবে নীরব হয়ে যায়, কারও চোখে ঝলকানি, কারও হাসি হঠাৎ থেমে যায় মাঝপথে, তখন সন্দেহ আরও ঘনীভূত হলো। তিনি লক্ষ্য করলেন আশ্রমের বাচ্চারা করবীর গাছের দিকে অকারণেই তাকিয়ে থাকে, অনেকটা যেমন মন্ত্রমুগ্ধ কেউ তাকিয়ে থাকে দীপশিখার দিকে। মাঝে মাঝে তারা খেলার সময় হঠাৎ থেমে গিয়ে এক অচেনা সুরে গুনগুন করে—যেন তাদের অজান্তেই কেউ অন্য সুর তাদের মুখ দিয়ে বের করাচ্ছে। আর আশ্রমের প্রৌঢ়রা এই সবকিছু দেখে যেন চুপ করে থাকেন, যেন অনেক আগে থেকেই তাঁরা জানেন এখানে এক অদৃশ্য শক্তি বাস করছে। অমিতাভ একদিন সাহস করে জিজ্ঞেসও করেছিলেন প্রধান সন্ন্যাসিনীকে—“করবীর গাছটা নিয়ে কি কোনো ইতিহাস আছে?” কিন্তু উত্তরে তিনি কেবলমাত্র মৃদু হাসলেন, যেন সবই জানা, কিন্তু প্রকাশ করার সময় আসেনি।

রাতগুলো আবারও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকে। প্রতিদিনের মতোই অমিতাভ স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু এ বার পরিবর্তন হয় এক নতুন উপাদান। যুবতীটির মুখে আর রক্ত নেই—এবার তিনি ঠোঁট নড়িয়ে কিছু বলছেন। অমিতাভ অনেক চেষ্টা করেও শব্দগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারেন না, শুধু ঠোঁটের আকার দেখে মনে হয় যেন তিনি একটাই কথা বারবার উচ্চারণ করছেন—“ফিরে এসো।” তাঁর শরীর ঘেমে যায়, বুক ধড়ফড় করে, ঘুম ভেঙে গেলেও সেই আওয়াজ কান থেকে মুছে যায় না। আশ্রমের ভেতরে প্রতিদিন যেন ছড়িয়ে পড়তে থাকে অদৃশ্য সন্ত্রাস। বাচ্চাদের চোখে এখন মাঝে মাঝেই ফাঁকা শূন্যতা, বড়রা এড়িয়ে যান প্রশ্ন, আর করবীর ফুলগুলো অস্বাভাবিক লাল হয়ে ওঠে। অমিতাভ বুঝলেন, তিনি আর পালিয়ে যেতে পারবেন না। যেই হোক না কেন, সেই যুবতী—তিনি ডাকছেন শুধু তাঁকেই নয়, আশ্রমের প্রত্যেককেই। আর এই ডাকের অর্থ যে শুভ নয়, তা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবুও, অমিতাভ অনুভব করলেন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—ভয় এবং আকর্ষণ মিশে তৈরি হলো এক রহস্যময় টান, যা তাঁকে করবীর গাছের নীচে পৌঁছে দেবে, যেখান থেকে হয়তো ফিরে আসা সম্ভব হবে না।

*

দিনের পর দিন আতঙ্কে ঘেরা রাতের পর অবশেষে অমিতাভ সিদ্ধান্ত নিলেন, আর এভাবে অচল দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। আশ্রমের নীরবতা যেন এখন তাঁর শ্বাসরোধ করছে। প্রতিটি কোণে এক অদ্ভুত অদৃশ্য উপস্থিতি, প্রতিটি শিশুর চোখে যেন আটকে থাকা কোনো রহস্য, আর প্রতিটি প্রৌঢ়র নীরবতায় চাপা পড়ে থাকা দীর্ঘ ইতিহাস। তিনি জানতেন, এ রহস্যের উত্তর শুধু স্বপ্ন কিংবা শিশুদের কণ্ঠে খুঁজে পাওয়া যাবে না, চাই কোনো পুরোনো পথপ্রদর্শক, যিনি এই মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাস আর প্রাচীন জ্ঞানের সন্ধান জানেন। দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর এক সকালে গ্রামের প্রান্তের একটি গামছা-ঝুলানো কুঁড়েঘরের সামনে এসে পৌঁছালেন তিনি। সেখানেই বসে ছিলেন সুবল, এক বাউল সাধক। তাঁর গায়ে ফকিরি পোশাক, হাতে একতারা, আর চোখে এক শান্ত অথচ দীপ্ত দৃষ্টি। যেন তিনি বহু আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন অমিতাভের জন্য। অমিতাভ তাঁর কাছে বসেই সব খুলে বললেন—করবীর গাছের নিচে দাঁড়ানো সেই যুবতীর ছায়া, রক্তমাখা চোখ, শিশুদের অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। সব শুনে সুবল শান্ত হাসি দিয়ে বললেন, “তুমি বুঝেছ ঠিক, এ শুধু দুঃস্বপ্ন নয়। এ হলো এক অসমাপ্ত যজ্ঞের বাঁধন, যাকে মুক্তি না দিলে এই গাছ আর আশ্রম কারও শান্তি আনতে পারবে না।”

সুবলের কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তার সঙ্গে স্নিগ্ধ শান্তি। তিনি বললেন, বহু বছর আগে আশ্রমে এক মহাসাধনা শুরু হয়েছিল। এক নারী তান্ত্রিক আত্মাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সাধনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রক্তপাত আর ভয়ঙ্কর মন্ত্রে সেই যজ্ঞ বাঁধা পড়ে যায় অন্ধকারে। তাই আজও সেই আত্মা মুক্তি খুঁজছে, বারবার ফিরে আসছে পূর্ণিমার রাতে। “কিন্তু মনে রেখো,” সুবল বললেন, তাঁর একতারার তারে আঙুল বুলিয়ে, “অন্ধকারকে আলো দিয়ে ভাঙা যায়, রক্ত দিয়ে নয়। সত্যিকার মুক্তি আসে ভক্তি থেকে, আসে সুর থেকে। যদি তুমি সত্যিই আত্মাকে শান্তি দিতে চাও, তবে যজ্ঞ আবার করতে হবে, তবে তার রূপ হবে ভিন্ন। করবীর ফুল, গান, আর প্রার্থনার সুরে আত্মার যন্ত্রণা শেষ হবে।” অমিতাভ মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। তাঁর বুকের ভেতর জমে থাকা ভয় ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল এক অদ্ভুত আশ্বাসে। যেন তিনি প্রথমবার বুঝলেন, মুক্তির পথ ভয়ের নয়, ভালোবাসার। সুবল তখনই জানালেন, আসন্ন পূর্ণিমার রাতে তাঁরা একসাথে চেষ্টা করবেন অসমাপ্ত সাধনাকে পূর্ণ করতে।

অমিতাভের মনে এখন আর কেবল আতঙ্ক নয়, বরং দায়িত্বের ভার। তিনি আশ্রমে ফিরে এসে দেখলেন, শিশুরা খেলছে ঠিকই, কিন্তু তাদের চোখে আগের মতোই শূন্যতার ছায়া। বড়রা এখনও প্রশ্ন এড়িয়ে যান, যেন তাঁরা সব জানেন কিন্তু মুখ খুলতে চান না। এবার অমিতাভ তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “ভয় পেয়ে কোনো লাভ নেই। মুক্তির উপায় আছে, আর আমরা সবাই মিলে তা করব।” কেউ সাড়া দিল না, কিন্তু তিনি বুঝলেন, তাঁদের চোখে যে দ্বিধা, তা ধীরে ধীরে গলে যাবে। এরপর কয়েকদিন ধরে অমিতাভ আর সুবল একসাথে প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। করবীর তাজা ফুল সংগ্রহ করা হলো, আশ্রমের প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করা হলো, আর প্রতিদিন ভোরবেলা সুবল তাঁর একতারায় বাউল গান গেয়ে আশ্রমে নতুন সুর ছড়িয়ে দিলেন। সেই সুর শুনে শিশুদের হাসি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগল। রাতের বেলা করবীর নিচে দাঁড়ালে অমিতাভ আর সেই রক্তমাখা চোখের বিভীষিকা দেখতেন না; বরং তিনি টের পেতেন, কোনো অদৃশ্য কান্না মিশ্রিত হলেও তা এখন শান্ত হতে চাইছে। যেন আত্মাটিও বুঝতে পারছে, মুক্তির সময় কাছাকাছি।

পূর্ণিমার রাত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আশ্রমের আকাশে এক অন্যরকম আবহ ছড়িয়ে পড়ল। চারিদিকে নীরবতা, কিন্তু সেই নীরবতায় ভয় নয়, বরং প্রত্যাশার সুর বাজছিল। অমিতাভ আর সুবল করবীর গাছের নিচে একটি আসন তৈরি করলেন—রক্ত নয়, সিঁদুর নয়, শুধুই করবীর ফুল আর প্রদীপ। চারপাশে শিশুরা নীরবে দাঁড়িয়ে, চোখে এক অদ্ভুত বিস্ময়। সুবল তাঁর একতারা হাতে নিলেন, আর গলা ভরে বাউল গান গাইতে শুরু করলেন—ভক্তির, মুক্তির, আর আলোর গান। অমিতাভ চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করলেন, যেন যে আত্মা এতদিন ধরে অন্ধকারে বন্দী ছিল, সে এখন আলোয় ফিরে শান্তি পায়। মুহূর্তে মুহূর্তে গানের সুর ভারী হতে লাগল, বাতাসে ভেসে এল করবীর ফুলের মিষ্টি গন্ধ, আর আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হঠাৎ করবীর পাতার ফাঁক দিয়ে এক নারীমূর্তি ঝলক দিল—সাদা শাড়ি, ভেজা চোখ, কিন্তু এ বার রক্ত নয়, বরং প্রশান্তির অশ্রু। অমিতাভ বুঝলেন, তাঁরা সঠিক পথে এগোচ্ছেন। তবে এ কেবল শুরু—পূর্ণ মুক্তির জন্য প্রার্থনা আর ভক্তির আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হবে সারা রাত। আর সেই রাতই নির্ধারণ করবে, করবীর ছায়ায় বন্দী আত্মা সত্যিই মুক্তি পাবে কি না।

*

পূর্ণিমার সেই রাতে আশ্রমের আঙিনায় এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। আকাশে পূর্ণ চাঁদ যেন আগুনের মতো জ্বলছিল, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল সাদা আলো। করবীর গাছের তলায় সুবল একতারা হাতে বসে, চারপাশে আশ্রমবাসীরা নীরবে জড়ো হয়েছেন। কারও চোখে ভয়, কারও চোখে কৌতূহল, আবার কারও চোখে অব্যক্ত প্রত্যাশা। অমিতাভ মাঝখানে বসে প্রদীপ জ্বালালেন, আর চারদিকে করবীর লাল ফুল সাজিয়ে দিলেন। বাতাসে ভেসে আসছিল ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ, কিন্তু তার নিচে লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত চাপা গন্ধ, যেন বহুদিনের পুরোনো রক্তমাখা মাটির গন্ধ। সুবল তাঁর একতারা বাজিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করলেন বাউলগান, তাঁর কণ্ঠস্বর রাতের অন্ধকার চিরে এক অপার্থিব সুর তৈরি করছিল। শিশুরা ভয়ে একে অপরের হাত ধরে ছিল, আর বৃদ্ধ মহিলারা চোখ বুজে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসেছিলেন। অমিতাভ প্রথমবার মনে করলেন, তাঁরা সবাই মিলে যেন কোনো বিশাল অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন, আর তাঁর হৃদয় কাঁপলেও অন্তরে এক দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিচ্ছিল যে এই রাতেই হয়তো মুক্তি মিলবে।

গান যত এগোতে লাগল, বাতাস তত ভারী হতে থাকল। হঠাৎ করবীর ডালে ডালে এক প্রচণ্ড ঝড় উঠল, যেন আকাশ থেকে ঝড় নেমে এসেছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছিল, আর লাল ফুলগুলো ঝরে পড়ে মাটিকে ঢেকে দিল। অল্প সময়ের মধ্যেই গাছের নিচের জমি যেন রক্তে ভিজে উঠল—লাল ফুলগুলো মিশে এক লাল সাগর তৈরি করল। হঠাৎ সেই ভয়ঙ্কর শব্দ—নারীকণ্ঠের চিৎকার। যেন কোনো বন্দী আত্মা দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা প্রকাশ করছে। “আমাকে মুক্তি দাও!” কণ্ঠস্বরটি আকাশ কাঁপিয়ে দিল। সেই চিৎকারের সাথে সাথে মাটির নিচ থেকে যেন করুণ সিসকানি ভেসে আসছিল। আশ্রমবাসীরা ভয়ে চমকে উঠলেন, অনেকেই প্রার্থনার শব্দ জোরে জোরে বলতে লাগলেন। শিশুরা কেঁদে উঠল, কিন্তু সুবল থামলেন না। তাঁর গলায় সুর আরও তীব্র হলো, একতারা যেন ঝড়ের শব্দ ভেদ করে এক আলোকরেখা আঁকছিল। অমিতাভ চোখ বুজে গলা কাঁপিয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন, “তুমি মুক্ত হও… তোমার যন্ত্রণা শেষ হোক।” তাঁর হৃদয়ে কোনো ভয় রইল না, কেবল একটাই উদ্দেশ্য—আত্মাটিকে শান্তি দেওয়া।

হঠাৎ অদৃশ্য শক্তির মতোই সেই নারী কণ্ঠ চিৎকার থেকে কাঁদায় পরিণত হলো। যেন শতাব্দীর যন্ত্রণা ধীরে ধীরে গলে জল হয়ে বেরিয়ে আসছে। ঝড় আরও প্রবল হলো, করবীর ফুলগুলো উড়ে এসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। লাল রঙের ঢেউয়ের মধ্যে অমিতাভ চোখ বন্ধ রেখেই দেখতে পেলেন, সাদা শাড়ি পরা সেই নারীমূর্তি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চোখ থেকে রক্ত নয়, অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তিনি হাত বাড়িয়ে যেন কিছু চাইছেন, যেন অবশেষে মুক্তির আহ্বান জানাচ্ছেন। সেই দৃশ্য দেখে অমিতাভের গলায় আরও জোর এলো, তিনি উচ্চস্বরে বারবার বলতে লাগলেন, “তুমি মুক্ত হও… তুমি মুক্ত হও।” প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে যেন এক অদৃশ্য কম্পন ছড়িয়ে পড়ছিল। আশ্রমবাসীদের কণ্ঠস্বর মিলিত হলো বাউলগানে, যেন শতাব্দীর ভয় ধীরে ধীরে সাহসে রূপ নিচ্ছে। শিশুরাও অজান্তে গলা মেলাল প্রার্থনায়। রাতের আকাশে ঝড় বইছিল ঠিকই, কিন্তু তার ভেতরেই যেন নতুন এক আলো জন্ম নিচ্ছিল।

তারপর হঠাৎই সবকিছু বদলে গেল। করবীর লাল ফুলগুলো, যেগুলো মাটিকে রক্তের মতো ঢেকে রেখেছিল, তারা একে একে সাদা হতে শুরু করল। প্রথমে এক-দু’টি, তারপর পুরো গাছ ভরে গেল সাদা ফুলে। মাটির লাল সাগর মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি সমস্ত রক্তের দাগ ধুয়ে সাদা শান্তির চাদরে ঢেকে দিল। নারীকণ্ঠ আর শোনা গেল না, কেবল বাতাসে এক দীর্ঘ নিশ্বাসের মতো শব্দ ভেসে উঠল, যেন শতাব্দীর বেদনা শেষে শান্তি এসেছে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর করবীর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা শাড়ির নারী ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল চাঁদের আলোয়। আশ্রমে নেমে এল এক গভীর নীরবতা—কিন্তু এ নীরবতা আর ভয়ের নয়, এ শান্তির। অমিতাভ চোখ খুলে দেখলেন, তাঁর চারপাশে আশ্রমবাসীরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁদের চোখ ভিজে উঠেছে কিন্তু মুখে এক প্রশান্ত হাসি। সুবল একতারা নামিয়ে নিলেন, তাঁর ঠোঁটে মৃদু গান থেমে এল। মনে হলো, অবশেষে অসমাপ্ত যজ্ঞ পূর্ণ হয়েছে—রক্ত নয়, ভক্তির সুরে। করবীর গাছ দাঁড়িয়ে আছে সাদা ফুলে ঢাকা, মুক্তির প্রতীক হয়ে। আর অমিতাভ বুঝলেন, এই রাত শুধু এক আত্মাকে মুক্ত করেনি, মুক্ত করেছে আশ্রমের শতাব্দী পুরোনো ভয়কেও।

*

ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই আশ্রম যেন নতুন এক জীবন পেয়েছে। দীর্ঘদিনের আতঙ্কে বন্দী এই প্রাচীন স্থানের প্রতিটি কোণ আজ যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। সকালবেলা শিশুরা দৌড়ে বেরিয়ে এসে দেখল করবীর গাছে আর সেই রক্তলাল ফুল নেই। গাছ ভরে আছে কেবল সাদা ফুলে, যাদের মৃদু সুবাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এক প্রশান্তির আবহ তৈরি করছে। বিধবা মহিলারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁদের চোখে বিস্ময় আর অশ্রুজল মিশ্রিত কৃতজ্ঞতা। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছিলেন, “অভিশাপ মুছে গেছে… এতোদিন পর আশ্রমে শান্তি ফিরল।” বৃদ্ধ অধ্যাপক হেমাঙ্গ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তাঁর ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটে উঠল—যেন এক ভারী বোঝা নামল বুকে থেকে। রাতের ঝড়, রক্তমাখা ফুল আর নারীর আর্তচিৎকার যেন সবকিছু কোনো এক অদৃশ্য শক্তির হাত ধরে ইতিহাসের পাতায় বিলীন হয়ে গেছে। আজকের সকাল শুধু নতুন দিন নয়, আশ্রমের জন্য এক নতুন জন্ম।

আশ্রমবাসীরা সেই দিনটিকে উৎসবের মতো কাটালেন। সকলে মিলে প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করা হলো, প্রদীপ জ্বালানো হলো গাছের তলায়, আর শিশুদের হাসি যেন দীর্ঘদিন পর আবার আশ্রমের বাতাস ভরিয়ে দিল। বিধবারা প্রথমবার করবীর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে প্রার্থনা করলেন—কোনো ভয়ের ছায়া তাঁদের মনে আর নেই। আশ্রমে এতদিন যে নিস্তব্ধতা ছিল, তা ছিল চাপা আতঙ্কের; কিন্তু আজকের নীরবতা অন্যরকম—এ এক শান্তির নীরবতা, যেখানে হৃদয় ধীরে ধীরে হালকা হয়ে ওঠে। হেমাঙ্গ অমিতাভের কাছে এসে বললেন, “তুমি সাহস না করলে হয়তো এই মুক্তি কখনও আসত না। আমরা শুধু ভয় পেতে শিখেছিলাম, কিন্তু তুমি আমাদের দেখালে বিশ্বাস কীভাবে ভয়কে জয় করতে পারে।” অমিতাভ কিছু বললেন না, শুধু হাসলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, এ কৃতিত্ব তাঁর একার নয়—এ সুবলের গান, আশ্রমবাসীর প্রার্থনা আর সেই আত্মার নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষাই মিলিত হয়ে এনেছে এই মুক্তি।

তবে গভীর অন্তরে এক গোপন অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়াচ্ছিলেন অমিতাভ, যা তিনি কাউকে জানাননি। পূর্ণিমার রাতের যজ্ঞ শেষে তিনি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন, তখন এক স্বপ্ন তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। তিনি দেখেছিলেন করবীর নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেই সাদা শাড়ি পরা মেয়েটি—যার চোখে আর রক্ত নেই, আছে প্রশান্তির অশ্রু। তাঁর ঠোঁটে এক মৃদু হাসি, যেন শতাব্দীর বেদনা শেষে অবশেষে তিনি মুক্ত হয়েছেন। তিনি ধীরে ধীরে অমিতাভের দিকে তাকালেন, চোখে এক নিঃশব্দ কৃতজ্ঞতা। তারপর চাঁদের আলোয় তাঁর দেহ ক্রমশ মিলিয়ে গেল, যেন গলে গিয়ে আলোতে রূপান্তরিত হলো। স্বপ্নে অমিতাভ অনুভব করেছিলেন, তাঁর বুকের গভীরে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে—যেন তিনি এক আত্মার মুক্তির সাক্ষী হয়েছেন, যিনি এখন শান্তির পথে যাত্রা শুরু করেছেন। সেই দৃশ্য ছিল এতই স্পষ্ট, এতই জীবন্ত, যে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও মনে হচ্ছিল তিনি সত্যিই তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

পরদিন সকাল থেকে আশ্রমে আর কোনো অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল না। রাতে আর করুণ কান্না নয়, ভয়ের শীতলতা নয়—বরং বাতাস ভরা থাকল ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জনে আর গাছের পাতার মৃদু দোলায়। অমিতাভ একা জানতেন, মুক্তি সম্পূর্ণ হয়েছে। করবীর লাল ছায়া আজ চিরতরে মুছে গিয়ে জায়গা করে দিয়েছে সাদা শান্তির ফুলকে। আশ্রমবাসীরা হয়তো ভাববেন এ কেবল অভিশাপ মুক্তির গল্প, কিন্তু অমিতাভ জানতেন, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গভীর সত্য। যে আত্মা এতদিন বন্দী ছিল, সে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছে। তাঁর হাসি আজও অমিতাভের চোখে ভেসে ওঠে, আর মনে করিয়ে দেয়—বিশ্বাস, ভক্তি আর ভালোবাসাই পারে সবচেয়ে কঠিন অন্ধকারকেও আলোয় ভাসিয়ে দিতে। করবীর নীরবতা এখন আর ভয়ের নয়, বরং মুক্তির প্রতীক। আর সেই মুক্তির ইতিহাস চিরদিন বেঁচে থাকবে আশ্রমের প্রতিটি ইট, প্রতিটি পাতা, প্রতিটি শিশুর হাসিতে।

শেষ

1000063432.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *