Bangla - প্রেমের গল্প

রংবেরঙের কাগজের নৌকা

Spread the love

অরিজিৎ মুখার্জি


বেলপাহাড়ি শহরটা যেন ছোট্ট একটা রঙিন খাঁচা—চারপাশে পাহাড় ঘেরা, মাঝখানে বয়ে চলেছে শান্ত নদীটা। বর্ষার সময় নদীটা ফুলেফেঁপে ওঠে, যেন শহরটাকে নিজের ভালোবাসায় ভাসিয়ে রাখে। আর ঠিক সেই নদীর পাড়েই তৈরি হয়েছিল রুদ্র আর মায়ার শৈশবের রঙিন ক্যানভাস।

রুদ্র আর মায়া—দুজনেই ছোটবেলা থেকে একই পাড়ায় বড় হয়েছে। স্কুলের ছুটি মানেই নদীর পাড়ে বসে গল্প করা, সাদা কাগজ ছিঁড়ে নৌকা বানানো আর বৃষ্টি হলে সেই নৌকা ভাসানো। রুদ্র বরাবরই একটু শান্ত স্বভাবের, ভাবুক, বইপাগল। আর মায়া ঠিক তার উল্টো—চঞ্চল, প্রাণবন্ত, নদীর ঢেউয়ের মতো খোলা হাসি।

রুদ্রের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। তার মা সংগীতশিল্পী, বাবা সাহিত্যানুরাগী। ছেলেবেলা থেকেই রুদ্রের হাতে বই ধরিয়ে দিতেন তাঁরা। অন্যদিকে মায়ার বাবা দোকান চালাতেন আর মা ছিলেন সংসারের মেয়েবেলা। তবু দুই পরিবারেই ছিল অদ্ভুত এক আন্তরিকতার ছোঁয়া। মায়া প্রায়ই রুদ্রদের বাড়িতে গিয়ে রুদ্রের মায়ের কাছে গান শিখত। মায়ার মা মাঝে মাঝে রুদ্রকে মিষ্টি খেতে দিতেন, যেন আপন ছেলে।

বর্ষা নামলেই ওদের কাগজের নৌকা বানানোর ধুম পড়ে যেত। মায়া সবসময় রঙিন কাগজ চাইত—কখনো লাল, কখনো হলুদ, কখনো সবুজ। রুদ্র অবশ্য সাদা কাগজেই খুশি থাকত। মায়া হাসতে হাসতে বলত,
“দেখেছো রুদ্র? রঙ না হলে নদীতে ভেসে যাবে না! স্বপ্নগুলো রঙিন হলে নদীর ঢেউও এগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে দূর দেশে!”
রুদ্র ম্লান হাসি হেসে বলত,
“তবে স্বপ্নগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে দিও না। আমাদের নদীর পাড়েই রাখো।”
তাদের এই খেলা যে কেবল খেলাই নয়, সেটা বুঝতে পারত ওরা দুজনেই—একটা বন্ধনের গল্প, একটা শৈশবের গল্প।

স্কুলে রুদ্র ছিল খুবই মেধাবী। পরীক্ষায় ভালো ফল, গল্প-আবৃত্তি প্রতিযোগিতা—সবেতেই প্রথম। মায়া পড়াশোনায় ততটা মন না দিলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার জুড়ি মেলা ভার। পুজোর মণ্ডপে মায়া একবার নাচতে নেমে পুরো স্কুলের নজর কেড়ে নিয়েছিল। রুদ্র মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল, আর মায়া মঞ্চ থেকে হাত নেড়ে হাসছিল ওর দিকে। সেই হাসি যেন রুদ্রের বুকের ভেতর কেমন কাঁপন তুলেছিল।

এক বছর সরস্বতী পুজোর দিন, মায়া সাদা শাড়ি আর হলুদ গাঁদা ফুলের মালা পরে এসেছিল স্কুলে। রুদ্র তখনই বুঝতে পেরেছিল—মায়া শুধু তার শৈশবের সাথী নয়, তার মনের গোপন কোঠায় জন্ম নেওয়া কাঁচা কাঁচা ভালোবাসা। মায়াকে সে নিজের মনের কথা বলতে চাইলেও সাহস পায়নি তখন। ওদের বন্ধুত্বের ভেতরেই সে লুকিয়ে রাখল সেই অজানা ভালোবাসা।

মাঝে মাঝে মায়া বলত,
“রুদ্র, আমাদের নৌকাগুলো কি সত্যি ভেসে যাবে দূরদেশে?”
রুদ্র হেসে বলত,
“যদি যায়, তাহলে সেগুলো আমাদের গল্প নিয়েই যাবে, মায়া। আমাদের ছোটবেলার সব গল্প।”
মায়া হেসে বলত,
“তুমি না বড় হয়েও এমন বাচ্চার মতো কথা বলো!”
কিন্তু রুদ্র জানত, মায়াও ওর কথায় মজা পায়, মায়াও ঠিক ওর মতোই কাগজের নৌকায় ভাসতে চায়।

ওদের গল্পগুলো নদীর পাড়েই জমে থাকত—কখনো স্কুল ফাঁকি দিয়ে নদীর ধার ঘেঁষে হেঁটে যাওয়া, কখনো মায়ার নতুন জামার গল্প, কখনো রুদ্রের পছন্দের গল্পের বই। কাগজের নৌকা আর সেই নৌকায় ভেসে থাকা রঙিন স্বপ্ন—সবটাই যেন নদীর স্রোতের মতো ওদের জীবনের অংশ।

একদিন, বৃষ্টি নামার পর রুদ্র মায়াকে নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বলল,
“মায়া, কখনো ভেবেছো আমরা বড় হলে কী হবে?”
মায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বড় হয়ে আবার কী হবে! তখন আমরা আরও মজার মজার নৌকা বানাবো। আর নদী তখন আমাদের কাছে আসবে, দূরে চলে যাবে না।”
রুদ্র মৃদু হাসল। মায়া তখনও সেই ছোট মেয়েটাই, যে রঙিন কাগজে স্বপ্ন ভাসায়। অথচ রুদ্রের বুকের ভেতর তখন অন্যরকম কষ্ট—কেন জানি ওর ভয় হচ্ছিল, বড় হলে মায়া বদলে যাবে, আর ওদের গল্পগুলো নদীর স্রোতে হারিয়ে যাবে।

সেদিন থেকেই ওর মনে ভালোবাসার সেই আলো জ্বলে উঠেছিল, যা বন্ধুত্বের দেওয়ালের ওপারে উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু মায়া কিছু বুঝতে পেরে হয়তো সে আলোকে নিভিয়ে দিতে চাইত না, আবার জ্বালাতেও চাইত না।

একদিন মায়া বলল,
“রুদ্র, আমরা কি সারাজীবন বন্ধুই থাকব?”
রুদ্র একটু চমকে বলল,
“কেন? আমরা তো বন্ধু, তাই না?”
মায়া মাথা নিচু করে বলল,
“হুম, তবে জানি না, তুমি অনেক বেশি আপন লাগে। বন্ধুর থেকেও বেশি…”
রুদ্র কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইল। বুকের ভেতর ঢেউয়ের মতো কেমন কাঁপন উঠল। মায়া যদি কখনো জানতে পারে যে ওর মনের ভেতর অন্যরকম অনুভূতি—তাহলে কী হবে? বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে না তো?

সেদিনের আকাশটা অদ্ভুত রঙের ছিল—কিছুটা ধূসর, কিছুটা লাল। নদীর জলে সেই রঙ লেগে যেন কাগজের নৌকাগুলোও রঙিন হয়ে যাচ্ছিল। রুদ্রের মনে হলো, ওদের বন্ধুত্বের নৌকাগুলোও ঠিক নদীর জলের মতোই বদলে যাবে—কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল, কখনো রঙিন।

স্কুলের শেষ দিনগুলোতে রুদ্র মায়ার হাত ধরে বলেছিল,
“মায়া, আমাদের গল্পগুলো কি নদীর স্রোতে ভেসে যাবে? নাকি থেকে যাবে আমাদের কাগজের নৌকায়?”
মায়া হেসে বলেছিল,
“থাকবে। কারণ আমাদের গল্পগুলো তো নদীর স্রোতের থেকে অনেক বেশি শক্ত। আমরা ওগুলোকে হারাতে দেব না।”
রুদ্র বিশ্বাস করেছিল, মায়া ঠিকই বলছে। ওদের গল্পগুলো কাগজের নৌকায় ভেসে থাকবে, যতক্ষণ না সেই নৌকা ডুবে যায়।

কিন্তু কাগজের নৌকা কি কখনো চিরকাল ভাসে?

একদিন বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। রুদ্রের মনে হচ্ছিল, তার ভেতরের মেঘও কেটে যাবে। কিন্তু মায়া তখন অন্যদিকে তাকিয়ে, নতুন গল্পের খোঁজে। রুদ্র চুপ করে তার কাগজের নৌকা নদীতে ছেড়ে দিল। নদীর স্রোত টেনে নিল সেই নৌকাগুলোকে—কোনোটা ডুবে গেল, কোনোটা ভেসে গেল দূর অজানায়।

সেদিন থেকেই রুদ্র বুঝতে পারল—ছেলেবেলার নদী আর কাগজের নৌকাগুলো আসলে কোনোদিন চিরকাল ভেসে থাকে না। সেগুলো ভেসে যায় দূর অজানায়, নতুন গল্পের খোঁজে। আর সঙ্গী হয়ে থাকে কেবল সেই নদীর ধারে জমে থাকা অদৃশ্য রঙের ছোঁয়া, যা কেবল ওদের দু’জনেরই জানা।

রুদ্র ম্লান হেসে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। মায়া পাশে এসে দাঁড়াল। কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি দেখো, আমাদের নৌকা ঠিকই যাবে দূর দেশে। তবু আমাদের গল্প থেকে যাবে এই নদীর পাড়ে।”
রুদ্র চুপ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবল, এই গল্পগুলোই একদিন ওদের বন্ধুত্বের রঙ বদলে দেবে। আর সেই গল্পেই হয়তো কেউ একজন অজানা স্রোতের মতো এসে ওদের জীবন পাল্টে দেবে।

কলেজে ভর্তি হওয়ার পর রুদ্র আর মায়ার জীবন অনেকটাই বদলে গেল। ছোট্ট শহরের সীমা ছাড়িয়ে তারা পা রাখল নতুন দুনিয়ায়। বড় ক্যাম্পাস, নতুন বন্ধু, ক্লাসের ব্যস্ততা—সবকিছু মিলিয়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল হাওয়ার গতিতে। তবু নদীর পাড়ে কাগজের নৌকা ভাসানোর সেই স্মৃতি ওদের মনে থেকে গেল অমলিন।

রুদ্র ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হল, আর মায়া নিল সমাজবিজ্ঞানে। কলেজের গেট পেরোতেই নতুন বন্ধুদের ভিড়, গ্রুপের আড্ডা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রিহার্সাল—সবকিছুতেই মায়া ছিল সবার মধ্যমণি। মায়ার প্রাণচাঞ্চল্য যেন সবার মন জয় করে নিল। রুদ্র কিছুটা লাজুক প্রকৃতির, তাই বন্ধুদের ভিড়ে হারিয়ে যেতে থাকল।

তবে প্রতিদিন দুপুরের খাবারের পর কলেজের বটগাছের নিচে মায়া আর রুদ্র ঠিকই দেখা করত। মায়া সেদিনের ক্লাসের গল্প, নতুন বন্ধুদের মজার কাণ্ড, আর রুদ্রের লেখা কবিতা—সবকিছু একসাথে মিলিয়ে নতুন আড্ডার জন্ম দিত। কখনো কখনো মায়া রুদ্রের লেখা কবিতা পড়ে বলত,
“তুমি না—একদম কবিদের মতো! এভাবে কথাগুলো বুনে ফেলো, আর আমি তো ভাবতেও পারি না!”
রুদ্র হেসে বলত,
“তুমি বুঝতে পারো না, তাই তো আমার কবিতা। তুমি বুঝলে কবিতা থাকত না—সেই কাগজের নৌকার মতো ভেসে যেত।”
মায়া গাল ফুলিয়ে বলত,
“তোমার নৌকা আমার নদীর পাড়েই থাকবে, হারাবে না!”

তাদের এই বন্ধুত্ব যেন কলেজের সবার কাছেই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিন শোভন নামে একটি ছেলে, যিনি সমাজবিজ্ঞানে মায়ার সহপাঠী, রুদ্রকে বলেছিল,
“তোমরা কি প্রেম করো নাকি?”
রুদ্র একটু হেসে বলেছিল,
“না, আমরা তো শৈশব থেকে বন্ধু। প্রেম—সেটা…”
কথা শেষ করার আগেই শোভন হেসে বলেছিল,
“বন্ধুত্ব আর প্রেমের মাঝখানে একটা পাতলা পর্দা থাকে, জানো তো? ওটা না থাকলেই মজা!”
রুদ্রের বুকের ভেতরটা কেমন ধড়াস করে উঠেছিল। শোভনের কথা মায়ার মনেও কি কখনো ঢোকে? ও কি ওদের বন্ধুত্বের ভেতরে কখনো প্রেম খুঁজেছে?

এরপর থেকে শোভন প্রায়ই মায়ার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করত। প্রায়ই ওদের আড্ডায় এসে যোগ দিত। প্রথমদিকে মায়া বিরক্ত হতো, কিন্তু শোভন মজার জোকস, সিনেমার গল্প, কলেজ ফেস্টের প্ল্যান—সবকিছুতে মায়াকে হাসিয়ে তুলত। রুদ্র ওদের আড্ডায় একটু আড়ষ্ট হয়ে যেত। মনে হতো, মায়া হয়তো শোভনের দিকে একটু বেশিই মনোযোগ দিচ্ছে।

একদিন কলেজ ক্যান্টিনে বসে রুদ্র মায়াকে বলল,
“তুমি শোভনের সাথে এত সময় দিচ্ছো কেন?”
মায়া অবাক হয়ে বলল,
“তুমি পাগল! শোভন তো আমার ফ্রেন্ড। আর তুমি তো জানো, ও কত মজার!”
রুদ্র চুপ করে রইল। বলতে ইচ্ছে হলো—“কিন্তু আমিও তো তোমার বন্ধু! আর আমারও অনেক কথা বলার ছিল, যেগুলো তুমি শুনতে চাইলে না!”
কিন্তু রুদ্রের মুখ থেকে শব্দ বেরোল না।

তাদের বন্ধুত্বের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল গজিয়ে উঠল। মায়া সেটা বুঝতে পারলেও প্রকাশ করল না। ও বরাবরের মতোই প্রাণবন্ত রইল, আর রুদ্র ধীরে ধীরে নিজের ভেতরেই গুটিয়ে নিল নিজেকে। একদিন কলেজ ফেস্টের আগে মায়া হঠাৎ রুদ্রকে ফোন করে বলল,
“রুদ্র, আমাকে একটা গানের অনুষ্ঠান করতে হবে। তুমি কি আমার জন্য কবিতা লিখবে? তোমার লেখা ছাড়া আমি নাচতে পারব না!”
রুদ্র অবাক হয়ে বলল,
“তুমি এখনো আমার লেখা চাইছো?”
মায়া হেসে বলল,
“তুমি না থাকলে আমার গল্পগুলো অপূর্ণ। তুমি তো জানো, আমার সব স্বপ্নে তুমিই রঙ করে দাও!”
রুদ্রের বুকের ভেতর কেমন একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। হ্যাঁ, মায়া এখনো ওর কথা ভাবছে। ওর কবিতা, ওর গল্পগুলো মায়ার জীবনের অংশ।

রুদ্র সারা রাত জেগে কবিতা লিখল মায়ার জন্য। কলেজ ফেস্টের দিন মায়া সেই কবিতায় সুর বেঁধে মঞ্চে পারফর্ম করল। তার নাচে, তার চোখে, তার হাসিতে রুদ্রের লেখা কবিতার প্রতিটি অক্ষর যেন প্রাণ পেল। মায়া যখন মঞ্চের শেষে এসে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, রুদ্র বুঝতে পারল—এই বন্ধুত্বের ভেতরে কিছু একটাও চিরকাল থাকবে, যা কোনো শোভন, কোনো নতুন বন্ধু, কোনো দূরত্ব মুছে ফেলতে পারবে না।

তবু শোভন যেন একটা ছায়ার মতো মায়ার জীবনে জায়গা করে নিচ্ছিল। রুদ্র সেটা প্রতিদিন অনুভব করত। মায়া আর রুদ্রের আড্ডায় শোভনের হাসি, তার গল্প, তার সিনেমার প্ল্যান—সবকিছু ঢুকে পড়ছিল। মায়া সেইসব গল্পে মজে যেত, হাসত, আবার রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলত,
“তুমি কেন চুপ করে বসে আছো? গল্প বলো না কেন?”
রুদ্র ম্লান হেসে বলত,
“তোমাদের গল্পের ভিড়ে আমার গল্প হারিয়ে যাচ্ছে…”
মায়া কিছুটা থমকে যেত, তারপর বলত,
“তুমি পাগল! তোমার গল্পগুলো আমার কাছে কখনো হারাবে না!”
রুদ্র মায়ার সেই কথায় ভরসা পেতে চাইত, কিন্তু মনে হতো শোভনের ছায়া ওদের কাগজের নৌকাগুলোতে রঙ মেখে দিচ্ছে—কখনো লাল, কখনো ধূসর। সেই রঙে ওদের বন্ধুত্ব কেমন যেন কাঁচা রঙের মতো অস্থির হয়ে উঠছিল।

একদিন বিকেলে কলেজের মাঠে বসে রুদ্র মায়াকে বলল,
“মায়া, আমরা কি আগের মতো থাকব? নাকি বদলে যাচ্ছি ধীরে ধীরে?”
মায়া একগাল হেসে বলল,
“বদল মানেই তো নতুন গল্প, নতুন রঙ। তুমি কি সেই রঙে ভয় পাচ্ছো?”
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“আমি তো চাই, আমাদের কাগজের নৌকাগুলো যেন ভেসে চলে সেই আগের মতো। ভাঙা না পড়ে।”
মায়া ওর হাত ধরল,
“রুদ্র, তুমি বুঝতে পারছো না। আমাদের নৌকাগুলো ভাঙলেও, ওগুলো থেকে গল্পের রঙ মুছে যাবে না। কারণ তুমি আছো, আর আমি আছি।”
রুদ্রের বুকের ভেতর কেমন উজান স্রোত বইতে থাকল। হয়তো সত্যিই, বন্ধুত্ব ভেঙে যায় না। তবু শোভনের উপস্থিতি, মায়ার নতুন জীবনের টানাপোড়েন—সবকিছু মিলে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি করছিল। রুদ্র যেন সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজের গল্প খুঁজে পাচ্ছিল না।

সেদিন আকাশের রঙটা আবার অদ্ভুত ধূসর লেগেছিল। কলেজের মাঠে কাগজের নৌকা বানানোর খেয়াল হয়নি কারোর। কিন্তু রুদ্র জানত, সেই নদীর পাড়ে একদিন আবার নৌকা ভাসানো হবে—হয়তো তখন মায়ার পাশে শোভন থাকবে, অথবা রুদ্র একাই বসে থাকবে সেই নদীর ধারে। কিন্তু মায়ার চোখে তখনো কি রুদ্রের গল্পের রঙ থাকবে?

বন্ধুত্বের ছায়া ঠিক নদীর স্রোতের মতো—কখনো গভীর, কখনো অগভীর, কখনো ঝড়ো, কখনো শান্ত। রুদ্র জানত, সেই ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে ওদের গল্পের কাগজের নৌকা ভেসে যাবে—কখনো রঙিন, কখনো ফ্যাকাসে।

রুদ্র আর মায়ার জীবন যখন কলেজের শেষ বর্ষে পৌঁছাল, ঠিক তখনই ওদের গল্পে এল নতুন এক চরিত্র—অর্ণব। অর্ণব শহরের বিখ্যাত একটি পরিবারের ছেলে, যিনি পড়াশোনার জন্য শহরে এসেছিলেন দূরের বড় শহর থেকে। ছায়া মাখা চোখ, সহজ-সরল কথাবার্তা আর ভদ্র হাসি নিয়ে অর্ণব সবার কাছে খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তবে বিশেষ করে মায়ার চোখে সে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

শুরুতে অর্ণব মায়ার কাছেই বেশি যেত, তাদের একই বিভাগের ছাত্র হওয়ায়। আর মায়া নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপ-পরিচিতিতে মগ্ন থাকত, মনে খুব একটা খেয়াল দিল না যে রুদ্র একটু দূরে সরে যাচ্ছে। রুদ্র নিজেও ওদের আড্ডায় নিজেকে আর মিশতে পারছিল না। ওর মনে হচ্ছিল, যেন তার জীবনের সেই শান্ত নদী ভাঙছে, আর নতুন ঢেউ এসে ভেসে আসছে।

একদিন কলেজের বাগানে অর্ণব মায়াকে বলে বসল,
“তুমি একদম আলাদা, মায়া। তোমার হাসি আর কথা, যেন নতুন রঙের ফোয়ারা।”
মায়া লাজুক হয়ে হেসে বলল,
“তুমি কি না অনেক সুন্দর কথা বলো!”
অর্ণব হেসে বলল,
“তবে তোমার জন্যই তো সব কথা।”
রুদ্র দূরে থেকে তাদের কথোপকথন দেখছিল। মনের ভিতরে অদ্ভুত এক জ্বালা জাগছিল—কেন জানে না, কিন্তু ওর বুক চেপে আসছিল।

মায়া আর অর্ণবের বন্ধুত্ব দিন দিন বাড়তে থাকল। শোভনের মতো অর্ণবও মাঝে মাঝে মায়ার কাছে নানা ধরনের কথা বলত, কখনো সাহস যুগাত, কখনো স্বপ্ন দেখা শিখাত। কিন্তু অর্ণবের সঙ্গে মায়ার সম্পর্ক ছিল একটু ভিন্ন—অর্ণব যেন মায়াকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শেখাচ্ছিল। মায়া বুঝতে শুরু করল, যে রুদ্রের সুরে বাঁধা বন্ধুত্বের বাইরে নতুন এক সুর বাজছে তার জীবনে।

এক সন্ধ্যায় নদীর ধারে তারা তিনজন একসঙ্গে বসেছিল। মায়া আর অর্ণব মিশে কথা বলছিল, আর রুদ্র একটু চুপচাপ ছিল। অর্ণব হঠাৎ বলল,
“তোমরা দুজনের মধ্যে একটা গল্প আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ওটা বন্ধুত্বের গল্প নাকি প্রেমের, সেটা বোঝা মুশকিল।”
রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাদের গল্প তুমি বোঝবে না। ওটা আমাদের দুই জনের।”
মায়া কিছু বলতে গেলে রুদ্রের চোখে অদ্ভুত ব্যথা দেখতে পেয়ে সে চুপ করল। অর্ণব হাসি দিল,
“তুমি চুপ করো না, মায়া। আমাদের গল্পগুলো সামনে আসতেই হবে।”

রুদ্র তখন বুঝতে পারল, এই তৃতীয় মানুষের আগমন শুধু ওদের বন্ধুত্বের মাঝখানে ঝড় তোলে নি, ওদের সম্পর্কের ভাঙন এনে দিয়েছে। নদীর ধারে ভাসমান তাদের কাগজের নৌকাগুলো যেন একে অপর থেকে আলাদা হতে শুরু করেছে।

রাত্রি গিয়ে তিন জনের আড্ডায় নানা ধরনের টানাপোড়েন বাড়তে থাকল। মায়া অর্ণবের সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করল, আর রুদ্র একাকী থাকল। মাঝে মাঝে রুদ্র নিজের হাতে ছোট ছোট কাগজের নৌকা বানিয়ে নদীর জলে ছেড়ে দিত, যেন ভেসে যাওয়া বন্ধুত্বের রঙগুলো ফেরানোর চেষ্টা। কিন্তু নদী নৌকাগুলোকে তার মত করে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল—কেউ ফিরছিল না।

একদিন মায়া অর্ণবের কাছে বলল,
“তুমি আমার জীবনে নতুন রঙ এনেছো। তবে রুদ্রও তো আমার পুরনো বন্ধু, ওর জন্য কেমন যেন দুঃখ লাগে।”
অর্ণব কোমল হেসে বলল,
“তাহলে তোমাকে হয়তো ঠিকই বলতে হবে, তোমার হৃদয়ে কে বেশি গা ঘেঁষে আছে।”
মায়া তখন ভাবল, ওর হৃদয় কত বড়? দুই বন্ধুর জন্য কি তা যথেষ্ট? ওর মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল নানা প্রশ্ন—বন্ধুত্ব কি প্রেমের পথে গড়িয়ে যায়? নাকি বন্ধুত্বের মধ্যেই থাকে চিরস্থায়ী ভালোবাসা?

রুদ্রও অনেকবার মায়াকে জিজ্ঞেস করেছিল,
“তুমি কি আমাকে আর আগের মতো ভাবো?”
মায়া সবসময় মৃদু হেসে বলত,
“তুমি আমার বন্ধু, রুদ্র। আর তুমি জানো, বন্ধুদের জন্য ভালোবাসা আলাদা।”
কিন্তু রুদ্র জানত, মায়ার চোখে নতুন কোনো দৃষ্টি এসে গিয়েছে। সে দৃষ্টি রুদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়।

শেষ বর্ষের শেষ দিনে কলেজে সাংস্কৃতিক উৎসব। মায়া নাচতে চলেছিল, আর রুদ্র তার জন্য কবিতা লিখেছিল। অর্ণবও সেখানে উপস্থিত ছিল। মঞ্চের আলোয় মায়ার চোখ ঝলমল করছিল, আর রুদ্রের কবিতার শব্দগুলো যেন ওর মুখে নতুন প্রাণ দিচ্ছিল।
কিন্তু মায়া যখন অর্ণবের দিকে তাকালো, রুদ্র দেখল ওর চোখে এক অদ্ভুত কোমলতা। সেই মুহূর্তে রুদ্র বুঝতে পারল—বন্ধুত্বের রঙ বদলে গেছে, আর প্রেমের রং সেই নৌকার ওপরে উঠে এসেছে।

রাত্রি শেষে নদীর ধারে তিন জনের গল্পে ঢেউ উঠল, ভাঙন তৈরি করল। কিন্তু একই সাথে সেখানে নতুন রঙ, নতুন গল্পের সূচনা হল। রুদ্র জানল, কাগজের নৌকাগুলো আর আগের মতো রঙিন থাকবে না—তবে তার মানে এই নয়, ওরা হারিয়ে গেছে। বরং ওরা নতুন পথে হাঁটবে, নতুন স্বপ্নে ভাসবে।

মায়ার চোখে অর্ণবের জন্য এক নতুন আলো জ্বলে উঠল। রুদ্রের ভেতরে বয়ে গেল এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। তবু ওদের তিনজনের গল্প একটা রংবেরঙের ছবি হয়ে বেঁচে থাকবে—কাগজের নৌকার মতো, যা নদীর স্রোতে ভেসে যাবে চিরকাল।

কলেজের শেষ বর্ষ শেষ হতে চলল। রুদ্র, মায়া আর অর্ণবের সম্পর্ক যেন একটা টানাপোড়েনের মাঝেই আটকা পড়েছিল। তিনজনের হৃদয়ে একে অপরের জন্য নানা রঙের অনুভূতি জেগে উঠেছিল, কিন্তু সেই রঙগুলো কখনো একত্রে মিশতে পারত না। বন্ধুত্ব, প্রেম, শিখর ছোঁয়া স্বপ্ন—সবকিছু মিলিয়ে তাদের জীবনের ক্যানভাসে নতুন করে আঁকা হচ্ছিল এক অদ্ভুত ছবি।

একদিন সন্ধ্যায়, কলেজ ক্যাফেটেরিয়ায় তারা তিনজন বসেছিল। মায়ার চোখে তখন অশ্রুজল ছিল, আর রুদ্র ও অর্ণব কিছু বলতে পারছিল না। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মায়া বলল,
“আমরা কি আসলেই বুঝতে পারছি, আমরা একে অপরকে কী চাই?”
রুদ্র গভীর শ্বাস নিল, তারপর বলল,
“আমার কাছে আমাদের সম্পর্কটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মায়া, তুমি জানো না, তোমার জন্য আমার মনের ভেতর কত গল্প লুকিয়ে আছে।”
অর্ণবও বলল,
“আমিও চাই তোমার পাশে থাকব, মায়া। তোমার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে পরিণত করতে সাহায্য করব।”
মায়ার চোখ থেকে এক অশ্রু ঝরে পড়ল,
“তাহলে আমি কি করব? আমার মন বিভক্ত হয়ে গেছে। তোমরা দুজনেই আমার জীবনের একটা বিশেষ অংশ।”

তারা তিনজন একটা বড় বাঁক সামলাতে শুরু করল। রুদ্র আর অর্ণব মায়ার জন্য নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করল। কিন্তু মায়ার মনের ভিতরে সবকিছু পরিস্কার ছিল না। সে জানত, তার কাছে রুদ্রের বন্ধুত্ত্ব আর অর্ণবের ভালোবাসার ভিন্নতা আছে, কিন্তু কোনটিই সে হারাতে চায় না।

রাত্রি শেষে তারা নদীর ধারে গিয়ে ছোট ছোট কাগজের নৌকা বানিয়ে জলে ছেড়ে দিল। নৌকাগুলো ভেসে গেল আলাদা আলাদা দিকে, ঠিক তাদের মতই—তিনজনের অনুভূতির আলাদা আলাদা পথ।

সেই রাতে মায়া ভাবল, বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা দুটোই কি একসাথে বেঁচে থাকতে পারে? না কি তাদের রঙ আলাদা আলাদা রেখেই চলে যেতে হবে?

পরের দিন কলেজ ফেস্টের শেষ দিনে মায়া মঞ্চে উঠে নাচ করল। রুদ্রের লেখা কবিতা তার নাচের সঙ্গে মিলিয়ে মন ছুঁয়ে গেল সবার। অর্ণবও মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে মায়ার প্রতি ভালোবাসা ছড়াল।

তবে মায়ার মনে প্রশ্ন ছিল, এই ভালোবাসার রঙ কি তার জীবনে চিরকাল থাকবে? নাকি কেবল একটা ঝলক মাত্র?

সেই সন্ধ্যায় তারা তিনজন নদীর ধারে বসে একে অপরের চোখে চোখ রেখে জানল, জীবনের অনেক গল্প এখনও বাকি, অনেক রঙ মিশবে। বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার সেই মিলনমেলা তাদের কাগজের নৌকাগুলোকে রংবেরঙের করে তুলবে, যেগুলো নদীর স্রোতে ভেসে যাবে চিরকাল।

 

1000023541.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *