Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

যতটা গোপন, ততটা সত্যি

Spread the love

পৌষালী চক্রবর্তী


সন্ধেটা ছিল অদ্ভুতভাবে নির্জন। রবিবারের শহর যেন ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। গোলপার্ক থেকে পায়ে হেঁটে সাউথ সিটির দিকে আসার মাঝপথে রূপা থেমেছিল লেকের ধারে। শরৎশেষের নরম বাতাস বইছে, কানের পাশে চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। সে বসে আছে গোল বেঞ্চে, পাশেই কফির কাপ, কোলের ওপর একটা বই—তবে পাতাগুলো নড়লেও মন আটকে ছিল অন্য কোথাও।

রূপার বয়স পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। দক্ষিণ কলকাতার এক বহুতলে থাকে অরিন্দমের সঙ্গে—তার স্বামী। আট বছরের দাম্পত্য। ছেলেটা এখন ক্লাস থ্রিতে। সংসার চলে, নিয়ম মেনে, নিঃশব্দে। ভালোবাসা বলে যে আবেগটা একসময় বুকের ভেতর চড়চড় করে উঠত, সেটা যেন এখন নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়েছে, চাদর মুড়ে।
অরিন্দম তাকে কখনো কষ্ট দেয় না। বরং সময়মতো বাজার করে, ওষুধ মনে রাখে, দরকারে ড্রাইভ করে পৌঁছে দেয় ডাক্তারখানায়। কিন্তু এই টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় কোথাও একটা ‘তাকে চাওয়া’ বলে যে তৃষ্ণা ছিল—তা উধাও।

সেই তৃষ্ণাটার কথাই মনে হচ্ছিল লেকের পাশে বসে। রূপা জানে, সে কোনও দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিতে আসেনি। কেবল একটু একা থাকতে, একটু নিজের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল।

ঠিক তখনই ছায়ার মতো পাশে এসে দাঁড়ায় এক অচেনা পুরুষ।

সাদা লিনেনের শার্ট, ধূসর ট্রাউজার, হাতে একটা নোটবুক, চোখে স্পষ্ট ক্লান্তি আর একটা অনুচ্চারিত স্থিরতা।

— “আপনাকে দেখে থমকে যেতে হল,” গলায় টানটান ধ্বনি, তবু চোখে অদ্ভুত বিনয়।

রূপা তাকাল। চিনতে পারছে না।

— “চিনেছেন না?”
— “না তো।”

— “আপনার মুখটা খুব চেনা লাগছে। আসলে… আমার একটা গল্পের চরিত্রের সঙ্গে হুবহু মিল। মনে হল, কাগজ থেকে উঠে এসে আপনি এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন।”

রূপা একটু অবাক হল। এভাবে কেউ কথা বলে আজকাল? অচেনা পুরুষ, তবু গলায় কোনও কষ্টকল্পিত ভনিতা নেই। বরং কথার মধ্যেও যেন শব্দ বেছে নেওয়ার ভদ্রতা।

— “তাই নাকি? গল্পের চরিত্র?”
— “হ্যাঁ। আমি রুদ্র। লেখালিখি করি—অন্তত চেষ্টা করি। আপনাকে দেখে মনে হল, একদিন লেখা হয়ে যাওয়া একটা মেয়ের মুখটা আবার সামনে এল।”

রূপা একটু হেসে ফেলল। এমন কথা কেউ বলে না এখন আর। তার দিকে কেউ এভাবে তাকায় না। চোখ সরাতে চাইল, কিন্তু পারল না। রুদ্র তাকিয়ে ছিল গভীর অথচ শান্ত এক দৃষ্টিতে, কোনও দাবি নেই, কোনও স্পর্শের লোভ নেই—শুধু যেন চেনার আর বোঝার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

— “আপনার নাম জানব?”
রূপা থেমে বলল, “রূপা।”

— “নামটাও ঠিক গল্পের মতো। রূপা মানে কি শুধুই রূপ? নাকি তার গভীরে অন্যরকম হাহাকারও থাকে?”

— “আপনি কি সব মেয়ের সঙ্গে এভাবেই গল্প শুরু করেন?” কণ্ঠে সামান্য বিদ্রুপ, কিন্তু ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি।

— “না। আমি সব মেয়েকে গল্প বলি না। কাউকে কাউকে দেখি, আর দেখি তো দেখি। আপনার ভেতরে একধরনের নরম অন্ধকার আছে। আমি সেইখানেই লিখি।”

আর কিছু না বলে রুদ্র উঠে দাঁড়াল।
— “সময় থাকলে, আর একদিন দেখা হোক? আপনি যদি চান।”

রূপা মাথা নাড়ল না। বললও না কিছু। কেবল চোখের ভেতরে রেখে দিল তার মুখটা।
রুদ্র হেঁটে চলে গেল, বুকপকেটের ভাঁজে একটা গল্প নিয়ে।

সে দিন বাড়ি ফিরেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছিল রূপা। রান্নাঘরে ঢুকেছে, ছেলের হোমওয়ার্ক দেখেছে, অরিন্দমকে রাতের খাবার গরম করে দিয়েছে। কিন্তু কোথাও একটা শূন্যতা উথলে উঠছিল। সেই শূন্যতা বহুদিন পর প্রথমবার কোনও পুরুষের চোখে দেখে নিজের অস্তিত্বের দিকে ফিরে তাকানোর ইচ্ছা জাগিয়েছিল।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে, পাশ ফিরে থাকা অরিন্দমের পিঠে হাত রেখে মনে হল—এই পিঠটা কতদিন ছুঁয়েও কিছু অনুভব করেনি? স্পর্শ কতটা ঠান্ডা হলে শরীর নিঃশব্দ হয়ে যায়?

চোখে ঘুম এল না। সে উঠে দাঁড়াল। বারান্দায় এল।
কলকাতার আকাশে তখন আধচাঁদ, ট্রামের ঘণ্টা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে দূরে কোথাও, আর ল্যাম্পপোস্টের আলোয় নেমে আসছে একধরনের ছেড়ে যাওয়া রোম্যান্স।

রূপা জানে, এ প্রেম নয়। এ কোনও অপরাধ নয় এখনও। কিন্তু এ যেন কোনও আগাম ঘোষণা—একটা গোপন জলরেখা, যা তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে ধীরে, মৃদু উত্তাপে।

পরদিন বিকেলবেলা সে আবার বেরিয়ে পড়বে। কোনও পরিকল্পনা নেই, কেবল কিছুটা পথ হাঁটার ইচ্ছে।
হয়তো রুদ্র থাকবে না। কিন্তু যে কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আপনার ভেতরে একধরনের নরম অন্ধকার আছে”—এই বাক্যটা থেকেই আরেকটা বিকেল জন্ম নেবে।

রূপা জানত না, সে কোথায় যাচ্ছে। শুধু জানত, ফিরে যেতে চায় সেই বেঞ্চে, যেখানে এক অপরিচিত পুরুষ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—তোমার ভেতরে একধরনের নরম অন্ধকার আছে।
এমন কথা কেউ বলেনি বহু বছর।
সে দিন সোমবার, কাজের দিন। ছেলেকে স্কুলে দিয়ে, রুটিন ফেলে দিয়ে রূপা হাঁটছিল ঢিমে পায়ে—গোলপার্ক থেকে দক্ষিণের দিকে, একরকম অভ্যাসের বাইরে গিয়ে। বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা মৃদু কাঁপুনি, পায়ের তলায় অস্থিরতা। হাতটা কাঁপছে না, তবু মনে হচ্ছিল, কেউ বুঝি তার স্পর্শ চায়।

লেকের পাশে সেই বেঞ্চটা তখনও খালি। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে দূর থেকে, মাঝে মাঝে গাছের পাতায় আলো পড়ে চকচক করছে। সে বসে পড়ল, চোখ বন্ধ করে থাকল কিছুক্ষণ।

সময় পার হচ্ছিল। রুদ্র আসবে কি না, জানে না। অপেক্ষা শব্দটা এখন আর কষ্ট দেয় না, বরং একধরনের প্রস্তুতির মতো মনে হয়। যেন নিজেকে আলতো করে খুলে রাখা কারও আসার জন্য।

দশ মিনিট। পনেরো।
আরও একটু পরেই সে উঠে পড়ত।
ঠিক তখনই গলার এক নম্র সুর কানে বাজল।

— “আপনি এসেছেন।”

চমকে তাকাল। রুদ্র দাঁড়িয়ে। আজ সাদা শার্টের ওপর একটা কালচে নীল সোয়েটার। চোখে আগের মতোই শান্ত আত্মবিশ্বাস, আর মুখে সেই অলক্ষ্য হাসি, যেটা প্রশ্ন ফেলে যায়, উত্তর নয়।

— “আপনিও তো,” রূপা বলল। স্বরটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা, কিন্তু ভিতরে কোথাও যেন জল ঢেউ খেলছে।

— “আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না,” রুদ্র বলল। পাশে বসে পড়ল। “অথচ আমি চেয়েছিলাম, আপনি আসুন। দেখুন, আবার বসে আছি আমরা, একই জায়গায়। ঠিক গল্পের মতো।”

— “আপনি খুব গল্প ভাবেন, মনে হয়।”

— “আপনার মনে হয় না? এই শহরের প্রতিটা কোণ গল্পে ভর্তি। যেমন এখন। আপনি আর আমি—দুজন অচেনা মানুষ, অথচ একটা বিকেল ভাগ করে নিচ্ছি, কোনও নাম নেই, কোনও পরিচয় নেই—তবুও সবটা কী পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে।”

রূপা চুপ করে গেল। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল দুলে উঠল, হাতে ধরা কাপটা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, তবু কিছু বলল না।

রুদ্রও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বলল, “আপনার চোখের নিচে হালকা গাঢ়তা। আপনি ঠিকমতো ঘুমোন না, তাই তো?”

রূপা অবাক। এ কথা কেউ বলে না। কেউ দেখে না। সে ঘুমায় না, এটা তার স্বামীও জিজ্ঞেস করে না। জিজ্ঞেস করে, দুধ কিনে এনেছো কি না। ছেলের প্রজেক্ট জমা হয়েছে কি না।

— “আপনি এত খুঁটিয়ে দেখেন কেন?”

— “কারণ আমি শুনতে চাই। আপনি যা বলেন না, সেটাই তো শুনতে সবচেয়ে বেশি ইচ্ছে করে।”

রূপা তাকাল রুদ্রের চোখে। কোনও কুৎসিত স্পর্শ নেই সেখানে, নেই লোভ, নেই দাবি। আছে কেবল একরকম আগ্রহ—তাকে বোঝার, পড়ে ফেলার, খুলে নেওয়ার আগ্রহ। এমন কেউ আগে আসেনি তার জীবনে।

— “আপনার স্ত্রী আছে?”

রুদ্র হেসে ফেলল। — “ছিল। এখন আমরা আছি, কিন্তু একসাথে থাকি না। কাগজে নাম আছে, জীবন একসাথে নেই।”

— “আপনি সুখী?”

— “সুখ কথাটার মানে আমার খুব অস্পষ্ট। তবে আমি তৃপ্ত নই। আর আপনি?”

রূপা উত্তর দিল না। মাথা নিচু করল। উত্তর জানে না।

— “আপনার গলায় অদ্ভুত এক ধরণের নরমতা আছে,” রুদ্র বলল। “সেই গলায় যদি আমার গল্প পড়া যেত, তাহলে শব্দগুলো আর একরকম হত।”

রূপা এবার হেসে ফেলল, চাপা, একটানা। যেন অনেকদিন পর নিজের হাসির আওয়াজ শুনল।

তারা বসে রইল অনেকক্ষণ। মাঝে মাঝে পাখি উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে, আলো ঝিমিয়ে পড়ল গাছের ফাঁকে। একসময় রুদ্র হাত বাড়িয়ে তার কাপটা ছুঁয়ে বলল, “ঠান্ডা হয়ে গেছে। চলুন, আজ একটু অন্যভাবে কফি খাওয়া যাক।”

রূপা না বলল না, না বলল হ্যাঁ। শুধু উঠে দাঁড়াল।

তারা হাঁটতে লাগল ধীরে, রাস্তার ধারে, গাড়ির হর্ণ পেরিয়ে, ছোট ছোট দোকানের পাশ দিয়ে। দুজনেই জানে, এই হাঁটা এক ধরনের অবিচার। সংসার নামক নৌকো থেকে আলগা হওয়া। তবু হাঁটছে। কোনও অপরাধবোধ ছাড়াই।

কফিশপটা ছোট, অন্ধকার, কাঠের টেবিল। এক কোনায় বসে তারা। রুদ্র তার হাত ছুঁয়েছে কি না, মনে নেই। কিন্তু টেবিলের নিচে পায়ের আঙুল যেন আড়ালে একে অপরকে চিনে নিচ্ছে। খুব সামান্য কিছু, কিন্তু অসীম গভীর।

রুদ্র বলল, “আপনার কাঁধে হাত রাখতে ইচ্ছে করছে। পারি?”

রূপা কিছু বলল না। কিন্তু চোখের পাতা নামিয়ে আনল ধীরে।

রুদ্র এগিয়ে এল। আলতো করে তার হাত রাখল রূপার কাঁধে। কোনও চাহিদা নেই, কেবল স্পর্শ।
আর সেই মুহূর্তে, শহরের সমস্ত শব্দ যেন থেমে গেল। বাইরে হর্ণ বাজছে, মোবাইল কাঁপছে ব্যাগের ভেতর, ওয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অর্ডার নিতে—কিন্তু রূপার ভেতর, যেন কেউ ধীরে ধীরে দরজা খুলছে এক নিষিদ্ধ আলোয়।

রাত গভীর। ছেলের ঘরে হালকা আলো জ্বলছে—সাদা পর্দার ফাঁক দিয়ে তার ছায়া পড়ে বিছানায়। অরিন্দম তখন ঘুমিয়ে, মোবাইল পাশে রেখে পাশ ফিরে শুয়ে আছেন।
রূপা চুপচাপ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। একটা পাতলা চাদর গায়ে, ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ানো নীরবতা। হাতে ধরা ফোনে মেসেজ—

“ঘুমোচ্ছেন?”
— রুদ্র।

রূপা লিখল না কিছুক্ষণ। তারপর শুধু একটা “না”।

সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে উঠল। রুদ্র।
সে ধরল না।

পাঁচ মিনিট পর আবার বেজে উঠল।
এইবার সে কানে নিল।
— “কইলেন না যে না ঘুমোচ্ছেন, তাহলে ফোন ধরলেন না কেন?”
রুদ্রের গলায় কণ্ঠস্বর নরম, কিছুটা চাপা, যেন জানে—এই মুহূর্তে কথার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চুপ করে থাকা।

— “সব কথা বলা যায় না,” রূপা বলল। “বিশেষ করে এই ঘরে দাঁড়িয়ে।”

— “তবু তো কথা বলছি,” রুদ্র ফিসফিস করে। “এই চুপচাপটুকুও আমার জন্য অনেক।”

রূপা জানে না, কেন তার বুকের নিচে আজ এইরকম ধকধক করছে। যেন এই গভীর রাতেও, এই প্রাচীন শহরের কোনো এক প্রান্তে, এক পুরুষ তাকিয়ে আছে তার দিকে—না শরীরের দিকে, না গলার দিকে—তবে যেন ঠিক ভেতরে, সেইখানে, যেখানে এক সময় সে নিজেও ঢুকতে সাহস পায়নি।

— “আজ বারান্দার বাতাস কেমন জানো?” রূপা বলল, হঠাৎ। “একটুও শীত লাগছে না, অথচ শরীর কেমন কেঁপে উঠছে।”

— “তুমি জানো, আমি আজ দুপুর থেকে বারবার ভাবছি, তোমার চুল ছুঁয়ে দেখলে কেমন লাগবে। ঘাড়ের ঠিক নিচে, গলার কাছে যেখানে শাড়ির আঁচল পড়ে—সেইখানে।”

রূপা চোখ বন্ধ করল। পাশে অরিন্দমের ঘুম ভাঙলে কী হবে, জানে না। কিন্তু ফোনটা রাখার ইচ্ছে করল না। এই ফিসফিস করে বলা কথাগুলোর মধ্যে যেন একটা আলাদা শরীর তৈরি হচ্ছে—ছোঁয়াছুঁয়ির বাইরেও, কল্পনার ভিতরে।

— “রুদ্র…” সে বলল, গলা নামিয়ে, “আমার ভয় করে।”

— “কেন?”

— “এই যে এত কিছু বলছো, শুনছি… একটা সময় আসবে, যখন আর ফেরা যাবে না। তুমি হয়তো ফিরে যাবে, কিন্তু আমি আটকে পড়ব।”

রুদ্র বলল না কিছুক্ষণ। তারপর গলা আরও গভীর হয়ে উঠল।

— “আমিও আটকে পড়ছি, রূপা। তুমি ভাবছো আমি একা খেলছি, অথচ আমি তোমার মতোই এক গভীর জলে নামছি, যেখানে তলা দেখা যায় না। আমি জানি না, তুমি আমাকে শেষ পর্যন্ত ভালোবাসবে কি না, ছুঁতে দেবে কি না—তবে আমি জানি, আমি চাই। আর আমি থাকব।”

রূপার চোখ জলে ভরে এল। তার নিজের শরীর যেন আজ প্রথমবার নিজের দিকে ফিরে তাকাল—যেভাবে রুদ্র তাকায়। স্বামী, সংসার, সন্তান—সব কিছু রয়েছে, তবু কোথাও একটা অন্ধ জায়গা ছিল, যা কারও চোখে পড়েনি আগে।

সেই অন্ধত্বের ভেতরে আলো হয়ে এসেছে এই পুরুষ।

— “একদিন দেখা হবে, রাতে?”
রুদ্র বলল খুব আস্তে। “তোমার ইচ্ছে হলে।”

— “কোথায়?”

— “তোমার বারান্দায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকব নিচে, আর তুমি জানলা খুলে রাখবে।”

রূপা হাসল। এই হাসি কেউ শোনেনি বহুদিন।
— “তুমি সত্যিই আমার জীবনে একটা গল্প হয়ে এসেছো, রুদ্র। হয়তো ঝড়ের মতো যাবে একদিন। কিন্তু যেটা রেখে যাবে, তা কেউ নিতে পারবে না।”

— “আমাকে তোমার শরীরে দরকার নেই, রূপা,” রুদ্র বলল। “আমাকে তোমার আত্মায় একটু জায়গা দাও। শুধু একটা কোণ, যেখানে রাতে এসে বসে থাকি, কথা বলি, আর তোমার নিঃশ্বাস শুনি। তাতেই আমার থাকা হয়ে যাবে।”

রূপার গলার নিচে কেমন একটা টান লাগল। এই পুরুষ তাকে কামনা করে—তবু দাবী করে না। এই ভালোবাসা, তার চেনা সংসারের ভাষা নয়।

রাত গড়ায়। ফোন কেটে যায়।
রূপা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে আরও কিছুক্ষণ। কলকাতার আকাশে কুয়াশা নামে, দূরের ট্র্যাফিক আলো নিঃশব্দে পালটে যায়।
তার বুকের ভেতর এখন আর কোনও শূন্যতা নেই—আছে এক নরম, গাঢ় আলো। নিষিদ্ধ, কিন্তু উষ্ণ।

রাত্রি তখন এগারো পেরিয়ে বারোটার দিকে যাচ্ছে।
বাড়ির ভিতর সমস্ত আলো নিভে গেছে, কেবল রান্নাঘরের কোণ থেকে একটা হালকা হলুদ আভা এসে পড়ছে বসার ঘরে। রূপা চুপ করে বসে আছে সোফায়, পরনের সুতির শাড়ির আঁচল পায়ের কাছে গুটিয়ে রাখা, মোবাইল হাতে।

রুদ্র লিখেছে—

“দরজা খুলে রেখো।”

কাঁপা কাঁপা হাত। তবু সে উঠল।
ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ভেতরের দরজাটা খোলা রাখল। তারপর আবার ফিরে এসে বসে পড়ল, বুকের ভিতর এমনভাবে ধুকধুক করছে, যেন শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসবে।

ছেলেটার ঘুম ভাঙেনি। স্বামী—আজ অফিসের জরুরি কাজ বলে রাত্রি কাটাচ্ছে শেওড়াফুলিতে, ক্লায়েন্ট ভিজিট।

ঘড়িতে বারোটা চার।

একটা ট্যাক্সির হালকা আলো বাইরে এসে থামল। কোনও শব্দ নেই।
রূপার বুকের ভিতর হঠাৎ করে একটা খালি জায়গা খুলে গেল—না ভয়, না রোমাঞ্চ—একধরনের নিঃশব্দে গিলে নেওয়া প্রস্তুতি।

রুদ্র ঢুকল পা টিপে টিপে। মুখে কোনও কথা নেই। চোখে সেই আগের আলোটা, আরও গাঢ় হয়ে এসেছে।

দুটো মানুষ, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে।
এই প্রথম, কারও সামনে রূপা একা।
এই প্রথম, শরীর এত চুপচাপ।

রুদ্র তার দিকে এগিয়ে এল।
— “আমি কিছু বলব না। শুধু থাকব। যদি তুমি চাও, ছুঁব। যদি না চাও, বেরিয়ে যাব।”

রূপার চোখে জল এসে গেল—না দুঃখে, না আনন্দে—একটা হালকা ফাটল, যেটা কেউ এতদিন টেরই পায়নি।

— “থাকো,” সে বলল, গলায় কাঁপন। “তুমি শুধু বসো। আমি কিছু চাইছি না এখন, শুধু—তুমি থাকো। এইটুকু থাকাটাই অনেক।”

রুদ্র পাশে বসল। দুজনেই চুপ। বাইরের কুয়াশা জানালায় জমে জমে ধোঁয়া তৈরি করেছে। রূপার শরীরের গা ঘেঁষে রুদ্র বসে আছে, কিন্তু স্পর্শ করেনি। তবু মনে হচ্ছে, যেন শরীরের ভিতর কিসের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।

রূপার হাতে ধরা ছিল কফির কাপ। রুদ্র কাপটা নিয়ে রাখল টেবিলে। তারপর তার হাত ধরল—অস্ফুটে, আলতো করে।

এই স্পর্শে কামনা ছিল, কিন্তু দাবি ছিল না।
এই হাত ধরা যেন কেবল জানিয়ে দেওয়া—”আমি আছি। একা নও তুমি।”

রূপা প্রথমে চোখ বন্ধ করল। তারপর ধীরে ধীরে মাথাটা রেখে দিল রুদ্রের কাঁধে।

তখনই রুদ্র তার অন্য হাতটা তুলল। শাড়ির ফাঁক দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিল ঘাড়ের নিচে, সেই জায়গাটা, যেটার কথা একদিন বলেছিল ফোনে।

রূপার শরীর কেঁপে উঠল।
কোনও প্রতিরোধ নেই। শুধু একটি নিঃশ্বাস দীর্ঘ হয়ে বেরিয়ে এল তার ফুসফুস থেকে।

এই প্রথম, কারও স্পর্শে সে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করল।

রুদ্র চুমু খেল তার কানের কাছে—আস্তে, কোনও শব্দ ছাড়াই। তারপর গলায়, তারপর আরও নিচে… যেখানে গল্প আর শরীর একাকার হয়ে যায়।

শব্দহীন এক রাত, কোনও কনডাক্টর ছাড়া দুটি শরীর বাজাতে লাগল নিজস্ব সঙ্গীত। জানলার বাইরে কুয়াশা ঘন হচ্ছিল, আর ঘরের ভেতর তাপ বাড়ছিল নিঃশব্দে।

রূপা কোনও শব্দ করল না। শুধু চোখে জল এল, যেন শরীরটা হঠাৎ মুক্তি পেয়েছে—শুধু কামনা থেকে নয়, নিজের ভিতরের যে অপরিচিত জায়গাটায় এতদিন সে ঢুকতে পারেনি, সেখান থেকেও।

রুদ্র তার বুকের ওপর মুখ রেখে বলল, — “তুমি কাঁদছো?”

রূপা মাথা নেড়ে বলল, — “হ্যাঁ। কারণ এত বছর পর, আমি আবার নিজেকে ভালোবাসতে পারছি। তোমার চোখ দিয়ে।”

রুদ্র কিছু বলল না। শুধু তাকে জড়িয়ে ধরল আরেকটু শক্ত করে।

সেই রাতে, কোনও ভোর হয়নি।
কেবল এক শরীর আরেক শরীরকে পড়ল, লেখার মতো। কাগজ আর কালি হয়ে উঠল তারা—একটি নিষিদ্ধ কবিতা, যার নাম কেউ জানে না।

রূপার ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে। চোখ মেলতেই প্রথম যে ব্যাপারটা সে টের পেল, তা হল—রুদ্র আর পাশে নেই।
ঘরের মধ্যে আলো ঢুকছে আধা-পসরা রোদ হয়ে, জানালার গ্লাসে এখনও কুয়াশার ছোঁয়া। বিছানার একপাশে রাখা আছে রুদ্রের মাফলারটা। ভাঁজ করা নেই, যেন হঠাৎ করে রেখেই চলে গেছে।

রূপা উঠে বসে। তার শরীরের উপর, গলার কাছে, বুকের নিচে—যেখানে যেখানে রুদ্র ছুঁয়েছে, সেখানে সেখানে এখনও ছায়া লেগে আছে। কোনও দাগ নেই, তবু তার প্রতিটা কোষ মনে রাখছে আগের রাতের একেকটা মুহূর্ত।

বিছানায় হাত রাখতেই সে টের পেল—সেই স্পর্শ আর নেই, কিন্তু শরীর এখনও জেগে আছে। মন নয়, শরীর। জেগে থাকা বলতে শুধু কামনা নয়—এক ধরনের টান, যা চাইলেও ছিন্ন করা যায় না।

রুদ্র চলে গেছে। কিন্তু শুধু রুদ্র নয়—সেই রাত, সেই ছোঁয়া, সেই চোখ রাখার মুহূর্তগুলো এখনও ঘরের মধ্যে বাতাস হয়ে রয়েছে।

বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সে এক মুহূর্ত থমকে গেল। মুখটা যেন অন্যরকম লাগছে। চুল কিছুটা এলোমেলো, চোখে লালচে রেখা—তবু একটা আলো এসেছে মুখে।

এই কি অপরাধবোধ?
নাকি মুক্তির পর ক্লান্তি?

সকাল আটটায় ছেলেটা উঠে পড়ল। পাশের ঘর থেকে আওয়াজ এল, — “মা, আমার মোজা কোথায়?”
রূপা চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে গুছিয়ে দিল। চুলে তেল লাগিয়ে চিরুনি চালাল ছেলের মাথায়। রান্নাঘর থেকে ভাপ উঠছে ডিম সিদ্ধের।
সব যেন আগের মতো, অথচ কিছুই আগের মতো নয়।

ফোনে কোনও মেসেজ নেই। রুদ্র একটাও কিছু লেখেনি।
রূপা একটা মেসেজ লিখল—“ভালো আছো?”
সেন্ড করল না। মুছে দিল।

শুধু জানালার পর্দাটা সরিয়ে বাইরের রাস্তায় তাকাল কিছুক্ষণ। রাস্তা ধুয়ে নিচ্ছে পুরসভার লোকজন। দোকানগুলো খুলছে এক এক করে। ট্রাম লাইন ধরে ছায়া গড়াচ্ছে রাস্তার পাশে।

সে হঠাৎ নিজের দিকে তাকাল, যেন বাইরের পৃথিবী তার ভিতরের স্তব্ধতা বুঝে ফেলবে এই ভয়।

দুপুরে অরিন্দম ফিরে এল। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। বলল, — “কাল রাতে ক্লায়েন্ট অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখল, ফোন করতেও পারিনি। তুমি কেমন ছিলে?”
রূপা হাসল, স্বাভাবিক মুখ করে বলল, — “ভালো।”
অরিন্দম বলল, — “তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
রূপা শুধু বলল, — “রাতে ঘুম ভাল হয়নি।”

তাদের মধ্যে কোনো ফাটল তৈরি হয়নি এখনও। তবু যেন রূপা অনুভব করছে—সে এক অদৃশ্য বেড়ার এপার থেকে কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে।

সন্ধ্যায়, বাড়ি গুছিয়ে সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
রুদ্র ছিল এখানেই। আজ নেই।
না ফোন, না চিঠি, না শব্দ।

সে জানে, রুদ্র ফিরে আসবে কি না—তা নিশ্চিত নয়।
তবে সে এটুকু নিশ্চিত যে, এই রাত তার জীবনে থেকে যাবে। এই অভিজ্ঞতা, এই তীব্রতা, এই নীরবতার মধ্যেও শরীরের যে স্পষ্ট জেগে ওঠা, তা আর অস্বীকার করা যাবে না।

রূপা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বহু বছর পর।
একবার রুদ্র বলেছিল, — “তুমি সিগারেট খাও?”
সে বলেছিল, — “আগে খেতাম। এখন না।”
রুদ্র বলেছিল, — “তোমার ঠোঁটে ধোঁয়া কেমন দেখায়, সেটা আমি কল্পনায় রেখেছি।”

রূপা আজ সেই কল্পনাকে বাস্তব করল। ধোঁয়ার কুন্ডলী তুলে দিল আকাশের দিকে। যেন বলতে চাইছে, “তুমি আমাকে খুঁজলে, এই ধোঁয়ার ভিতরে খুঁজো। আমি আর আগের আমি নই।”

চারদিন কেটে গেছে। কোনও ফোন, কোনও মেসেজ নয়।
রূপা নিজের কাজ করছে—শরীর ছুঁয়ে থাকা ছায়াগুলো যেমন ফিকে হতে হতে একসময় ভুলে যেতে চায়, তেমনি ভাবে সে নিজেকে ঘিরে নিচ্ছে দৈনন্দিনতায়।
কিন্তু একটা জায়গায় কিছু আটকে গেছে।

রুদ্র না বলেই চলে গিয়েছিল। আর ফেরেনি।
তবু প্রতিটি দুপুরে, যখন ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফেরে সে—প্রতিবারই একটা মোবাইলের স্ক্রিন দেখে।
একবারও রুদ্র লিখেনি—“কেমন আছো?”

এই অবহেলা কি ইচ্ছে করে?
নাকি ভয়?

সেইসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ার এক দুপুরে সে বেরিয়ে পড়ে কলেজ স্ট্রিটে। ছেলেকে রেখে, বাড়িতে বলে—“পুরনো কিছু বই আনতে হচ্ছে, লিটল ম্যাগাজিনের জন্য।”
হাতের ব্যাগে একটি নীল খাতা। তাতে তার নিজের লেখা কিছু চিঠি, যা সে রুদ্রকে পাঠায়নি। শুধু লিখে গেছে।
প্রত্যেক পাতায় একেকটা দিন, একেকটা স্মৃতি, একেকটা ভেতরের অনুরণন।

কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ ভরা বই আর বইয়ের গন্ধ। শীতের দুপুরের কুয়াশা তখন একটু ফিকে হয়ে রোদে গলে গেছে।
রূপা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল কফি হাউজের সামনে। ভেতরে ঢুকবে কি না—এই নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধায় রইল। তারপর ঢুকল।

একটা কর্নার টেবিলে বসে, কফি অর্ডার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

এমন সময় কার যেন ছায়া এসে পড়ল তার টেবিলের পাশে।
চোখ তুলে দেখল—রুদ্র।

কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই, কোনও শব্দ না করে সে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখের নিচে হালকা কালি, মুখে দাড়ির রেখা। পরনে একটা ধুতি-পাঞ্জাবি, গলায় কাশ্মীরি গলা-চাদর।

রূপা চুপ। চোখ থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না—না অভিযোগ, না উষ্ণতা।
রুদ্র আস্তে বসে পড়ল।

— “ভেবেছিলাম আর দেখা হবে না,” সে বলল।
রূপা চুপচাপ রইল।

— “তুমি এসেছিলে। চলে গিয়েছিলে। আমি শুধু জানতাম, আর ফিরে পাবে না। তবু অপেক্ষা করছিলাম। তারপর ভাবলাম, হয়তো এটাই ঠিক।”

রুদ্র নিঃশব্দে শুনছে।

— “তুমি লিখোনি কেন?”
রূপা জিজ্ঞেস করল, চায়ের কাপ থেকে চোখ না সরিয়ে।

রুদ্র একটু সময় নিয়ে বলল,
— “কারণ তোমার মুখটা মনে ছিল, চোখে জল নিয়ে বলা কথাগুলো। মনে হচ্ছিল, আমি যদি আবার কথা বলি, তাহলে হয়তো সব শেষ হয়ে যাবে। আমি সেই স্পর্শটাকেই রাখতে চেয়েছিলাম, যেটা আমরা একসাথে বানিয়েছিলাম। তারচেয়ে বেশি কিছু চেয়ে তা ভেঙে ফেলতে চাইনি।”

রূপা বলল,
— “তুমি জানো, এভাবে চলে গেলে তবু একটা গল্প অসমাপ্ত থেকে যায়। যার শেষ লাইন কেউ লেখে না।”

রুদ্র আস্তে বলল,
— “তুমি লিখে রেখেছ?”

রূপা কিছু না বলে ব্যাগ থেকে সেই নীল খাতাটা বের করল।
— “লিখেছিলাম। কিন্তু তোমাকে দেব কিনা, জানি না। হয়তো কখনও না। কারণ সেই শব্দগুলোতে আমার শরীর আছে, আমার ভয় আছে, আমার তৃষ্ণা আছে। আর তুমি যদি ওগুলো পড়ে ফিরে আসো, আমি জানব না তুমি আমাকে চাও, না সেই ভাষাকে।”

একটা দীর্ঘ নীরবতা নামল। কফি হাউজের মধ্যে লোকজন, হাসি, চা-পানের আওয়াজ—সব কেমন যেন পেছনে চলে গেল।

রুদ্র হঠাৎ বলল,
— “আজ যদি আবার বলি, তোমার পাশে বসে শুধু তোমার চুল ছুঁয়ে থাকতে চাই—তুমি কি তাড়িয়ে দেবে?”

রূপা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
— “না, তাড়াব না। কিন্তু বলব—আজ বসো না। আজ না। কারণ আজ আমি নিজেকে আবার চিনছি। আজ আমি শুধু নিজেকে ছুঁতে চাই।”

রুদ্র মাথা নোয়াল।
তার চোখে জল নয়, একটা প্রশান্তি।

— “তুমি যদি আর কখনও ডাকো…”
রুদ্র বলল, “আমি আসব। শুধু শরীর নিয়ে নয়, সমস্ত অপেক্ষা নিয়ে।”

রূপা শুধু বলল,
— “যদি আর কখনও দেখা হয়, আমি চাই সেটা হোক বৃষ্টি ভেজা কোনো বিকেলে। যখন আমাদের মধ্যে কোনো স্পর্শ নেই, শুধু চেনা চাওয়া।”

রুদ্র উঠে দাঁড়াল।
চলে গেল।
রূপা তাকিয়ে রইল তার চলে যাওয়ার দিকে।

আজ তার ভিতর খালি হয়নি।
বরং ভরে উঠেছে—একটা অসম্পূর্ণ গল্পকে নিজের ভিতর রেখে দেওয়া সাহসে।

রূপা এখন আর রুদ্রকে মিস করে না।
অন্তত নিজেকে সেটাই বোঝায়।

রাতের পর রাত কেটে যাচ্ছে। সময় আর ঘড়ির কাঁটা নিজের নিয়মে চলে।
তবু যখন আয়নায় দাঁড়ায়, নিজের শরীরের দিকে তাকায়—তার মনে হয়, এই শরীরটা আগের মতো নেই।

না কোনও দৃশ্যমান চিহ্ন, না ক্ষত।
তবু যেন কোথাও একটা রেখা পড়ে আছে—একটানা টানা এক দাগ, যা মুছে ফেলতে চাইলেও থেকে যায়।

অরিন্দম এখন আবার আগের মতো কথা বলছে, ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে, রূপার পছন্দের সবজিও কিনে আনছে।
কিন্তু এই পুরো ছবিটা যেন ক্যানভাসে আঁকা—যার নিচে একটা আরেকটা স্তর লুকিয়ে আছে।

এক রাতে, শুতে যাওয়ার আগে অরিন্দম জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি কি সত্যিই ভালো আছো?”
রূপা তাকাল। বলল,
— “হ্যাঁ, আমি ভালো থাকার অভিনয়ে পারদর্শী হয়ে গেছি।”
অরিন্দম হেসে বলল,
— “তুমি আগের মতোই আছো।”
রূপা মনে মনে বলল, “তুমি বোঝো না, আমি আর আগের মতো নেই।”

সেই রাতে রূপা একা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। শীত এসেছে ধীরে ধীরে। শহরের গলিতে কুয়াশার চাদর পাতছে।
আকাশে চাঁদ নেই। শুধু হালকা একটা কুয়াশা মেশানো নীল।

রূপা ভাবল—রুদ্র আর আসবে না।
তবু তার ফেলে যাওয়া সেই মাফলারটা সে এখনও রেখেছে কাপড়ের আলমারির শেষ তাকে, যত্নে।

হাত বাড়িয়ে একবার খুলে দেখল।

মাফলারটায় এখনও তার গায়ের গন্ধ লেগে আছে?
না, বোধহয় নয়।
কিন্তু মনে আছে গন্ধটা কেমন ছিল।
সেই মিশ্রিত গন্ধ—তামাক, নেপালিটিক কাঠের সুগন্ধ, আর রুদ্রর ত্বকের ঘামের গন্ধ—সব মিলিয়ে একটা শরীরের চিহ্ন।

এমনই তো দাগ হয়। চোখে দেখা যায় না। তবু শরীর মনে রাখে।
যেভাবে কোনও এক দুপুরে শাড়ির ভাঁজে ছুঁয়ে যাওয়া একটা আঙুলের স্পর্শ রয়ে যায় হাজারবার ধুয়ে ফেলার পরেও।

রূপা বুঝতে পারছিল, সে আর রুদ্রর কাছে কিছুই চায় না। না দেখা, না কথা, না প্রতিশ্রুতি।
সে শুধু নিজের ভিতর থেকে যেতে দেওয়া সেই ‘নারীটিকে’ আবার চিনতে চাইছে।
যে একদিন রাতে বলেছিল—“তুমি ছুঁলেই আমি নিজেকে মনে রাখি।”

সেই নারীটি কি এখনও আছে?
না সে একরাতেই শেষ হয়ে গেছে?

রূপা জানত না।
তবু তার মনে হচ্ছিল, শরীর যদি একবার জেগে ওঠে—সে আর ঘুমিয়ে যেতে পারে না।
সে হয়তো সঙ্গী পায় না, কিন্তু সে নিজেকে খুঁজে নেয় নতুন করে।

এক বিকেলে, সে বইয়ের তাক পরিষ্কার করছিল।
হঠাৎ নীল খাতাটা পড়ে গেল।
রুদ্রর উদ্দেশে লেখা সেইসব চিঠি।

তাকিয়ে থাকল পাতাগুলোর দিকে। হাতে তুলে কিছু লাইন পড়ল।
— “তুমি চলে যাওয়ার পরও আমি দরজাটা খোলা রাখি।”
— “তোমার স্পর্শে যে ভয় ছিল, সেই ভয়টাই আমাকে মুক্তি দিয়েছে।”
— “আমি জানি, তুমি আর ফিরবে না। তবু জানো, আমার শরীর আর মন—দুটোই আজও তোমাকে মনে রাখে।”

চোখের কোনায় জল এল না।
কারণ সে কাঁদতে ভুলে গেছে।

সে চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলল না। ছিঁড়েও ফেলল না।
আলমারির একটা লকারে রেখে দিল, নামহীন একটা খামে।

নিজের মনকে বলল, “এগুলো আমার নয়, এক মেয়ের লেখা, যে একরাতে নিজেকে ছুঁয়ে ফিরে এসেছিল।”

সেই রাতে ঘুমানোর সময়, তার স্বামী পাশে এসে হাত রাখল কোমরে।
রূপা চমকাল না। কেবল চোখ বন্ধ করল।

সে জানত, এই সম্পর্কের ভেতরে, এই দৈনন্দিন সংসারের চাদরের নিচে, একটা গল্প চিরকাল থেকে যাবে—যা কারও জানা হবে না।
শুধু তার শরীর জানবে, মন জানবে, জানবে সেই দাগ, যা মুছে যায় না।

পোস্তায় এক পুরনো বইয়ের দোকান আছে—ছাদের তলায় ছোট্ট কাঠের তাক, যার গায়ে ধুলো জমে বছরের পর বছর। সেখানে মাঝে মাঝে পুরনো কাগজ, ব্যবহৃত খাতা, এমনকি পাণ্ডুলিপিও বিক্রি হয়—জলের দামে।

রুদ্র সেদিন হঠাৎ করে ওদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। শুধু মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা গন্ধটা—ধুলো, পুরনো বই, আর স্মৃতির মিশ্রণে তৈরি এক নিজস্ব টান, তাকে ভেতরে ডেকে নিয়েছিল।

দোকানের এক কোণে, বাঁধাই না-করা কিছু নোটবুকের মাঝে সে খুঁজে পেল একটা পাতলা নীল খাতা। পাতার নিচে হালকা করে লেখা, পেনের কালি ম্লান হয়ে গেছে—”তোমার জন্য, বলিনি কখনও”।

রুদ্র প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না।
পাতা উল্টাতেই দেখতে পেল, সেই লেখা—যা সে চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পেত একসময়।
রূপার হাতের লেখা।

প্রতিটি বাক্যে যেন তার শরীরে সুর কাঁপে উঠল।
— “সেদিন তোমার চলে যাওয়ার পর আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ। তোমার ছায়াটা যেন সিঁড়ি দিয়ে নামছিল আবার ফিরে আসছিল।”
— “আমি জানি, তুমি দাগ রেখে গিয়েছিলে। কিন্তু তুমি কি জানো, আমি সেই দাগকে প্রতিদিন পরি, ঠিক যেমন পরি নিজের শরীর।”

চোখের ভেতর কুয়াশা জমে গেল রুদ্রর।
এই চিঠি কিভাবে এখানে এলো?
রূপা কি ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছিল?
নাকি ভুল করে হারিয়ে গেছে?

সে বুঝতে পারল না।
শুধু অনুভব করল—চিঠিটা আজ তার হাতে আসার ছিল। যেমন কিছু কথা, যেগুলো আমরা শুনতে পাই তখনই, যখন আমাদের শোনার সাহস জন্মায়।

চিঠির এক জায়গায় লেখা ছিল,
— “তুমি যদি আর কখনও দেখো আমাকে—শুধু চোখে চোখ রাখো। বলো না কিছু। কারণ এখন আমি শব্দে নয়, নীরবতায় বাঁচি।”

রুদ্র দোকানদারকে দশ টাকা দিয়ে খাতাটা ব্যাগে ভরল।
বেরিয়ে এল রাস্তায়।

কলকাতার বাতাসে তখন বিকেলের ছায়া পড়ছে। হাওড়ার দিক থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের সিটি। মানুষের ভিড়ে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়ার মতো সময়—যেখানে মন নিজেকে খুঁজে পায় আবার।

রুদ্র হাঁটতে হাঁটতে ভাবল,
“সে কি জানে, আমি এখনও তার গলা শুনি? যে গলা একসময় বলত, ‘আজ রাতটা থাকো’।
আর আমি বলতাম, ‘থেকে গেলে তোমার জীবন বদলে যাবে’।
সে বলত, ‘তা হোক। বদলে যাক।’”

আজ এতদিন পর, সেই পরিবর্তন হয়ে গেছে।
রূপা বদলে গেছে।
রুদ্রও।

কিন্তু এই চিঠি প্রমাণ করে—কিছু বদলায় না। শুধু সময়ের আলগা চাদরের নিচে ঢেকে যায়।

সেই রাতে রুদ্র তার ছোট্ট ফ্ল্যাটের ছাদে দাঁড়িয়ে চিঠির শেষ পৃষ্ঠাটা পড়ল।
সেখানে লেখা ছিল—

— “তুমি যদি কোনওদিন আমার লেখা খুঁজে পাও, জানবে—আমি অপেক্ষা করিনি।
আমি শুধু একদিন সাহস করে লিখেছিলাম।
কারণ কিছু অনুভব বলা হয় না কারও জন্য,
বলতে হয় নিজের জন্য।”

রুদ্র চিঠিটা বুকের ওপর রাখল।
তার চোখ বন্ধ।

সেই পুরনো বিকেল, সেই শরীর, সেই দীর্ঘশ্বাস—সব একসঙ্গে ফিরে এলো।
আর সে বুঝল, রূপার স্পর্শ তার মধ্যে এখনও আছে, যেমন গানের মধ্যে থেকে যায় এক হারিয়ে যাওয়া সুর।

রূপার ঘরটা অনেকদিন ধরে শান্ত ছিল না।
নিজের অন্তরে এক ঝড়, এক তুফান বয়ে চলছিল—কেউ দেখত না, কেউ বোঝত না।
অরিন্দম তখন শহরের অফিসে ব্যস্ত, ছেলে স্কুলে, আর রূপা নিজেকে ঘিরে রেখে দিন পার করছিল।
কিন্তু সেই ‘নিজেকে রেখে দেয়া’ এতটাও সহজ ছিল না।

সন্ধ্যার পরে যখন ঘরটা একটু ফাঁকা হয়, তখন রূপা বারান্দায় বসে Cigarette-এর আগুন জ্বালানোর সময়ই ভাবত—এই আগুনের মতো তার জীবনও একদিন নিভে যাবে?
কতদিন আগের কথা মনে পড়ে—রুদ্রের হাত ছুঁয়ে যাওয়া, তার কথা, তার গন্ধ।
তখন সে বলেছিল, “আমি তোমার জন্য আছি।”
আর আজ? আজ সে তার জন্য নেই।

রূপার চোখে তখন জল আসতো না। শুধু হ্রদয়ের গভীরে একটা বিষাদের নীরব স্রোত বয়ে চলত।
সেই রাতগুলো, যখন সে কাঁদত, যখন সে চাইত অজান্তেই বাঁচতে না পারা সেই মুহূর্ত থেকে মুক্তি পেতে।

একদিন রাতে, যখন অরিন্দম আর ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছিল, রূপা তার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
চাঁদটা অর্ধেক কেটে গেছে। বাতাস কিছুটা ঠান্ডা।

সে জানত, আর কোনো রাতে ফিরে আসবে না রুদ্রের ছায়া।
আর সে চাইত আর ফিরে যাক না।

এই বার তার হৃদয়ের সব দরজা বন্ধ ছিল।
সে বুঝেছিল, সময় এসেছে নিজের জন্য জেগে উঠার।

রূপা কাঁধে আলতো করে একটি শাল দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ধরল।
তার চোখে একটা নতুন দৃঢ়তা, যা আগে কখনো দেখেনি কেউ।

তখন অরিন্দম বেরিয়ে এসে বলল,
— “তুমি কি বাইরে? খুব ঠাণ্ডা।”

রূপা হালকা করে হাসল,
— “হ্যাঁ, একটু ঠাণ্ডা লাগছে।”
অরিন্দম একটু এগিয়ে এসে বলল,
— “তুমি জানো, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”

রূপা মনেই ভাবল, এটা সত্যি।
যখন পৃথিবী তার বিরুদ্ধে থাকবে, তখন অরিন্দমই হবে তার আশ্রয়।

পরদিন থেকে রূপা ঠিক করল নিজের জন্য কিছু সময় বের করবে।
কতদিন ধরে থেমে থাকা স্বপ্নগুলোকে একটু জল দেবেন।
নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেবে।

সে একদিন ডায়েরিতে লিখল,
— “আজ থেকে আমি শপথ করছি—আর কোনো রাতে অন্ধকারে হারাব না নিজেকে। আমি নিজেকে ফিরে পাব।”

সেই দিন থেকে রূপা নিজের চারপাশে ছোট ছোট পরিবর্তন আনল।
নতুন বই পড়া শুরু করল, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করল, ছোট ছোট হাঁটাহাঁটি করল শহরে।
কখনো কখনো নিজের জন্য এক কাপ কফি নিয়ে নদীর ধারে বসে নিজেকে সময় দিল।

এই পরিবর্তন কোনো একদিন বড় হয়ে উঠবে, সে জানত।
আর সে জানত, এই জাগরণ হবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।

তবে রূপা এখনও বুঝত—এই জীবনের সব দাগ, সব স্মৃতি থাকবে সঙ্গে।
কিন্তু এবার সে তাদের কাছে দাস নয়, বরং মালিক।

১০

রূপার জীবন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল।
সে জানত, আজকের এই নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।
একটু আগে যে দিনগুলো অন্ধকারে কেটে যেত, আজ সে নিজেকে ফেরার পথে দেখতে পাচ্ছিল।

দিন শুরু হতো এখন একটু আলাদা ভাবে।
বাড়ির বাগানে উঠে আসা সূর্যের রশ্মি যখন দরজার কাঁচে পড়ে, রূপা খেয়াল করত তার মনও যেন একরকম আলোকিত হয়ে ওঠে।
আগে যেখানে শুধু ঘুমাতে ভালো লাগত, এখন সেই সময়টা একটু নিজেকে খোঁজার জন্য বরাদ্দ করতে ভালো লাগত।

সে জানত, এই পথ সহজ ছিল না।
প্রতিদিনের সংগ্রামে তার অন্তর একটুও ভেঙে পড়েনি—তাই আজ সে দাঁড়িয়ে আছে নিজের জীবনের নতুন পথে।

একদিন সকালে, রূপা সিদ্ধান্ত নিল বাগানের কিছু ফুল লাগাবেন।
ফুলের গন্ধ, রঙ আর স্পর্শ তার মনে একরকম তাজা সুর তোলে।
বাড়ির পুরনো ধুলোয় ঢাকা কোণ থেকে সে বেগুনি গন্ধরাজের গুটি তুলে এনে মাটিতে রোপণ করল।
ফুলগুলো যেন তার হৃদয়ের কথাগুলো শোনার মতো।

আসলে, রূপা জানত এই ফুলের মতো সে নিজেও একদিন ফুলে ফোটবে।
যতই ঝড় আসুক, যতই বৃষ্টি পড়ুক, সে সবের মধ্যেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে।

কিছুদিন আগে সে পুরনো দিনের স্মৃতি থেকে নিজেকে বের করে আনতে শুরু করেছিল।
রুদ্রের সঙ্গে কাটানো রাতগুলো, সেই সম্পর্কের সব জটিলতা, সুখ-বেদনা সব যেন এখন দূরের একটা গল্পের মতো।
রূপা বুঝেছিল, সব স্মৃতি যেমন জীবনকে গঠন করে, তেমনি তাদের সঙ্গে বসবাস করেও নতুন জীবন লেখা যায়।

সকালের কফির কাপ হাতে নিয়ে সে জানত, আর কোনো ‘ছায়া’ তার হৃদয়ে লুকিয়ে নেই।
একবার ছিল, যখন সে ভেবে ভাবতেই হত—নিজেকে কীভাবে জাগিয়ে রাখবে, কীভাবে জীবনের পথে এগোবে।
আজ সে তা জানত।

এক সন্ধ্যায়, অরিন্দম তার কাছে এসে বলল,
— “তুমি কি জানো, তোমার বদলাটা আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছি। তোমার চোখে এখন এক অন্য রকম দীপ্তি।”

রূপা হেসে বলল,
— “হয়তো এটা আমার জীবনের নতুন সূর্যোদয়।”

অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ ছিল। তারপর বলল,
— “তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সমর্থন। তোমার মতো একজন নারীকে পাশে পেয়ে আমি ধন্য।”

রূপা মনে মনে ভাবল, মানুষ অনেক সময় ভুলে যায় পাশে থাকা মানুষটার মূল্য।
কিন্তু আজ সে জানে, সে ওর পাশে আছে শুধু দায়িত্বে নয়, ভালোবাসায়।

বাড়ির সেই ছোট্ট বাগান এখন রূপার কাছে শুধু ফুল লাগানোর জায়গা নয়, বরং তার জীবনের প্রতীক।
প্রতিটি নতুন পাতা, প্রতিটি ফুলের কুঁড়ি যেন তার নিজের আত্মার পরিচয়।

একদিন রূপা একটা পুরানো খাতা খুলে পড়ল।
তার নিজের লেখা কিছু কথা ছিল—যখন সে তখন হতাশায় ডুবে ছিল।
তার লেখা ছিল,
— “আমি নিজেকে হারিয়েছি, কিন্তু হারিয়ে যাওয়াটাও তো একটা খেলা, যা থেকে উঠে দাঁড়ানোই জীবন।”

আজ সেই কথাগুলো পড়তে পড়তে সে বুঝল, জীবন একসাথে হারানো আর পাওয়া—এ দুইয়ের সমন্বয়।
যখন আমরা হারাই, তখনই কিছু কিছু জিনিস পেতে শুরু করি।
আর রূপা পেয়ে গিয়েছে নিজের মুক্তি।

তার ফোনে একবার নীলের ম্যাসেজ এলো—”কেমন আছো?”
রূপা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর টাইপ করল,
— “ভালো, অনেক ভালো। নতুন শুরু…”

নতুন সূর্য উঠেছে তার জীবনে।
আর সে জানে, এই নতুন ভোর আর কোনো রাতে ফিরে আসবে না।

শেষ

 

1000017383.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *