ছত্তিসগড়ের গভীর জঙ্গলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারদিকটা যেন অদৃশ্য কোনো চাপা রহস্যে ঘেরা—গা ছমছমে নিরবতা, ঘন কুয়াশা আর মাঝে মাঝে শোনা যায় অজানা পাখির ডানার শব্দ। ডঃ নীলয় সেনগুপ্ত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান, জিপ থেকে নেমেই চারপাশটা একবার ঠান্ডা চোখে স্ক্যান করলেন। পিছনে তাঁর দলের বাকি সদস্যরা: তরুণ তথ্যচিত্র নির্মাতা অরিন্দম পাল, প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্র বিশারদ ডঃ শ্রুতি দত্ত, ইতিহাসের গবেষক তনুশ্রী মুখার্জী এবং স্থানীয় গাইড兼ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট রাহুল কোসলে। তাঁরা আজ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছেন, তার হদিশ পেয়েছিলেন কিছু দুর্লভ আদিবাসী নকশা বিশ্লেষণ করে। কথিত আছে, এই নির্জন জঙ্গলের মধ্যেই আছে এক প্রাচীন মন্দির, যার অবস্থান এতদিন মানুষের নজর এড়িয়ে গিয়েছে—বা হয়তো কেউ ইচ্ছে করেই এই জায়গাকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। জায়গাটার নামও পাওয়া গিয়েছিল এক পুরনো খণ্ডিত শিলালিপিতে—“মোহিনী মন্দির”।
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে, দলটি যখন ক্যাম্প বসাতে শুরু করে, তখন সূর্য প্রায় দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। রাহুল স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে বহুবার শুনেছে এই মন্দির নাকি অভিশপ্ত—যেখানে মানুষের ছায়া নিজের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু নীলয় সেসব কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেন। “ইতিহাস মানে তথ্য, ভূতের গল্প নয়,” বলেই তিনি ঠোঁটে হাসি টানেন। তবে তনুশ্রী একবার বলেছিল, মোহিনী তন্ত্র আসলে এক ধরণের নারীতান্ত্রিক তন্ত্রচর্চা—যেখানে নারীর সৌন্দর্য, কামনা ও ছলনাকে ব্যবহার করে তপস্যা ভঙ্গ করা হত। এই তন্ত্রের দেবী বা মন্ত্রদাত্রী এক মহাশক্তি, যিনি তন্ত্রজগতে মোহিনী নামে পরিচিত। যদিও প্রমাণের অভাবে বিষয়টি গবেষণার বাইরে রয়ে গিয়েছিল। শ্রুতি, ক্যামেরা হাতে মন্দিরের খোঁজে সামনে এগোতেই হঠাৎই থমকে দাঁড়ান। সামনে ঘন জঙ্গলের মাঝখানে ধূসর পাথরের ওপর বন্য লতা-পাতায় ঢাকা একটা স্থাপত্য দেখা যাচ্ছে—মনে হচ্ছে বহু পুরনো, কিন্তু তবুও স্থির, নিশ্চুপ। সবাই ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দেখে—এটি একটি ছোটো মন্দির, যার প্রবেশপথ ধ্বংসাবশেষে ভরা। দরজার পাশের পাথরে খোদাই করা চিহ্নে ভাসছে একটি নারীমূর্তি—চোখ নেই, কিন্তু মুখে এক অদ্ভুত আকর্ষণ, আর তার পেছনে ছায়ার মতো অসংখ্য হাত যেন উঠে আসছে।
ক্যাম্প সেই রাতেই মন্দিরের আশেপাশে গড়ে তোলা হয়। মশারির নিচে বসে শ্রুতি লিপির বিশ্লেষণে ব্যস্ত, আর অরিন্দম ক্যামেরা সেট করছে পরদিন শুটের জন্য। রাত বাড়তেই জঙ্গলের নিঃসাড় শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে—মাঝে মাঝে দূরে সাঁ সাঁ করে হাওয়া বইছে, কিন্তু গা ছমছমে ঠাণ্ডা লাগে কারও কারও। রাহুল হঠাৎ বলে ওঠে, “আপনারা জানেন, এই মন্দিরের ছায়া নাকি কাউকে ছাড়ে না। একবার যার ছায়া মোহিনী দেখে নেয়, সে আর বাঁচে না।” নীলয় ধমকের স্বরে বলে ওঠেন, “এসব গল্প এবার বন্ধ করো, রাহুল। আমরা এখানে ইতিহাস খুঁড়তে এসেছি, আতঙ্ক ছড়াতে নয়।” কিন্তু কেউ খেয়াল করেনি—মন্দিরের প্রবেশপথে, এক ধূলিধুসর আয়না সদৃশ কালো পাথরে, একটুখানি নড়ে উঠেছে কারো ছায়া। রাতের অন্ধকারে সেই ছায়া যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে… গাছের গায়ে, ক্যাম্পের পাশের চেয়ারে, এমনকি ক্যামেরার লেন্সে। প্রথম রাতেই তারা অনুভব করলো, এ মন্দির শুধুই প্রাচীন নয়—এখানে অতীত নিজেই নিজের গল্প বলে, আর সেই গল্পের ভাষা… ছায়া।
***
পরদিন ভোরবেলা, পাখির ডাকের সঙ্গে ক্যাম্পের সকলে জেগে উঠল, কিন্তু চারদিকে একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধতা ছিল। পাখিদের ডাকেও যেন ছন্দ ছিল না, যেন কোনও গোপন সংকেত দিচ্ছে অরণ্যের গভীর থেকে। শ্রুতি আর তনুশ্রী সকালের আলোয় মন্দিরের পাথরগুলো পরখ করছিলেন—পাথরের ওপর অস্পষ্ট কিছু তাম্রলিপির মতো দাগ পাওয়া গেছে যেগুলো তারা আগের দিন রাতে দেখতেই পায়নি। অরিন্দম ইতিমধ্যেই ক্যামেরা হাতে রেকর্ডিং শুরু করেছে। সে বলল, “আলো বদলালেই ছায়ার দাগগুলো আলাদা ভাবে ফুটে উঠছে। এ জায়গাটা যেন আলোতে নিজেকে বদলে ফেলে।” রাহুল তখন দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, গাছের গোড়ায় খোঁজ নিচ্ছিল কোনও প্রাচীন নির্মাণ কাঠামোর—অথচ সে আচমকা চিৎকার করে উঠে পড়ে যায়। সবাই ছুটে যায় তার কাছে। সে বলে, “আমি পরিষ্কার দেখলাম… এখানে আমার ছায়া দুটো।” সবাই থমকে যায়, কিন্তু নিচে তাকিয়ে কেউই দ্বিতীয় ছায়া দেখতে পায় না। নীলয় বললেন, “ভুল দেখেছো, রাহুল। জঙ্গলে আলো-ছায়ার খেলায় এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।”
তবে সেই রাতটা অন্যরকম হয়ে উঠল। ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে বসে সবাই যখন দিনের কাজের গল্প করছিল, তখন অরিন্দম তার ড্রোন ফুটেজ চালিয়ে দেখায়—উড়ন্ত ড্রোনে মন্দিরের ছাদ ক্যাপচার করতে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য একটি ছায়ামূর্তি দেখা গিয়েছিল। সেটা স্পষ্টভাবে একজন মানুষের মতো—কিন্তু কারো নেই চেহারা, শুধু ছায়া। “এটা কেমন ফুটেজ?” নীলয় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। “এটা তো প্রমাণ হতে পারে আমাদের আবিষ্কারের!” কিন্তু তনুশ্রী চুপচাপ বসে ছিল, মুখে আতঙ্কের ছাপ। সে বলল, “আমি… গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি মন্দিরে দাঁড়িয়ে আছি, আর আমার ছায়া আমাকে মন্দিরের ভেতর টেনে নিচ্ছে।” নীলয় তা হেসে উড়িয়ে দিলেও রাহুল আবার বলল, “আপনারা যতই উপেক্ষা করুন, আমি জানি এই মন্দিরে কিছু আছে। আমার দাদু বলতেন, ‘মোহিনী তন্ত্র’ এমনই এক শক্তি যা ছায়াকে জীবন্ত করে তোলে।” নীলয় বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন, কিন্তু বাকিরা চুপ করে রইল। তখনই হঠাৎ বাতাসের ঝটকা উঠে গেল ক্যাম্পের চারদিকে, আগুন নিভে গেল মুহূর্তে। সবাই একসঙ্গে টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজতে শুরু করল কী হলো, আর তখনই ক্যাম্পের একদম পেছনে থাকা একটি কাঠের খুঁটি পড়ে থাকতে দেখা গেল, যেটা তারা সকালেই শক্ত করে বেঁধেছিল।
রাতে ঘুম আসেনি কারোর। অরিন্দম ক্যামেরা নিয়ে মন্দিরের দিকটা পর্যবেক্ষণ করছিল। রাত একটা নাগাদ, সে দেখতে পেল—রাহুল নিঃশব্দে উঠে বাইরে যাচ্ছে। সে চুপচাপ তাকে অনুসরণ করতে লাগল। মন্দিরের প্রবেশপথে রাহুল দাঁড়িয়ে পড়ে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে যেন কিছুর সঙ্গে কথা বলছে। অরিন্দম দূর থেকে ক্যামেরায় জুম করে দেখে—রাহুল বলছে, “আমার কি ক্ষমা নেই? আমি তো চাইনি।” হঠাৎ করেই অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসে, ছায়াগুলো যেন ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে, আর তারপর একটি ছায়া রাহুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অরিন্দম চিৎকার করে ওঠে, দৌড়ে ফিরে আসে ক্যাম্পে। সকলে উঠে পড়ে তাকে দেখে। কিন্তু যখন সকলে মন্দিরের দিকে ছুটে যায়, তখন সেখানে আর রাহুল নেই—শুধু পড়ে আছে তার মাথার ক্যাপটা, আর মাটিতে লেখা অদ্ভুত এক প্রতীক যা তারা কেউ চেনে না। মন্দিরের প্রবেশপথে তখন চাঁদের আলো পড়ছে, আর সেখানে দেখা যাচ্ছে একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি—হাতে ছুরি বা খড়্গের মতো কিছু। ছায়াটা ধীরে ধীরে ভিতরে মিলিয়ে যায়, আর অরণ্য আবার নীরব হয়ে যায়, যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু সবাই জানে, আজ প্রথম মৃত্যুর হাতছানি দেখা গেছে—এবং এই অভিযান এখন আর শুধুই ইতিহাসের খোঁজ নয়। এখন এটি সময়ের ছায়ার বিরুদ্ধে লড়াই।
***
পরদিন সকালে, ক্যাম্প এক অদ্ভুত স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। রাহুলের অনুপস্থিতি নিয়ে কেউ কিছু বলেনি, যেন সবাই বুঝে গিয়েছে—সে আর নেই। অরিন্দম রাতের ভিডিও কার্ড থেকে ফুটেজ বের করে দেখায়—রাহুলের ছায়া যেন আলাদা হয়ে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেছে। কিন্তু ডঃ নীলয় কিছুতেই মানতে চান না। তিনি বলেন, “এইসব বিভ্রম—মানসিক আতঙ্ক। আমাদের চোখ ধোঁকা খাচ্ছে। আমরা এখানে প্রত্নতত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে এসেছি, ছায়ার পেছনে দৌড়াতে নয়।” তবে তার গলায়ও একটু দ্বিধা ছিল—যা মুখে আনতে পারছিলেন না। শ্রুতি সেই সময় খুঁজে পায় মন্দিরের দক্ষিণ পাশের একটি অংশে অদ্ভুত ত্রিভুজাকার খোদাই। প্রতিটি চিহ্ন ঘিরে আছে চোখবিহীন নারীমূর্তি আর তার চারপাশে গোল ঘূর্ণির মতো প্রতিচ্ছবি। তনুশ্রী ছবিগুলো দেখে বলে, “এগুলো নারীতান্ত্রিক তন্ত্রচর্চার প্রতীক। মোহিনী দেবী এই রূপেই চিত্রিত হন। এই ‘ত্রিচক্র’ আসলে এক তান্ত্রিক আবদ্ধতা, যেখানে আত্মা নিজেই নিজের ছায়ায় বন্দী হয়ে যায়।” মন্দিরের গায়ে খোদাই থেকে একটা লিপির টুকরো উদ্ধার হয়—“যে জানে না নিজের সত্য, সে নিজের ছায়ায় পুড়ে মরে।” এই বাক্যটা সকলকে স্তব্ধ করে দেয়। অরিন্দম বলে ওঠে, “তাহলে… ছায়াগুলো কি আমাদের ভেতরের কোনও দাগ, ভুল, বা অপরাধকে চিনে নিচ্ছে?” কেউ কোনো উত্তর দিতে পারে না।
মন্দিরের ভেতরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দিন দুপুরে, চারজন নিজেদের প্রস্তুত করে প্রবেশ করে কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে। ভিতরে প্রবেশ করতেই একধরনের ভারী গন্ধ—পুরনো তেল, ধূপ আর রক্তের গন্ধ যেন বাতাসে মিশে আছে। মাঝখানে গোল আকৃতির এক মণ্ডপ, যেটার মধ্যে আঁকা আছে একটি চক্র—এবং সেই চক্রের মাঝখানে একটা কালো পাথরের আয়না। আয়নার দিকে তাকাতেই প্রত্যেকেই একসঙ্গে থমকে যায়—নিজেদের প্রতিচ্ছবি কোথাও নেই, শুধু ছায়া। একটি ছায়া নয়—দুটি। একটার আকৃতি তাদের মতো হলেও অন্যটা বিকৃত—চোখহীন, হাঁ করে থাকা মুখ, যেন চিৎকার করছে অথচ শব্দহীন। তনুশ্রী ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে যায়, কিন্তু আচমকাই তার সামনে থাকা ছায়াটা নড়ে ওঠে। সে পিছু হটতে গিয়েই পিছলে পড়ে যায়। তখনই সবাই বুঝতে পারে—এই আয়না আসলে বাস্তবকে প্রতিবিম্বিত করে না, এটা আত্মার গঠন চিত্রায়িত করে। শ্রুতি একটা ছোট খোদাই করা পাথর তোলে, যেখানে লেখা, “মোহিনী কেবল তাদের খোঁজে, যাদের মন পাপ ঢেকে রেখেছে।” এই সূত্র ধরেই তারা উপলব্ধি করতে শুরু করে, এই মন্দির শুধু প্রাচীন নয়, বরং এক মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ।
সন্ধ্যার মুখে ফিরে এসে ক্যাম্পে বিশ্রাম নেওয়ার পর, তনুশ্রী আবার সেই বিভ্রান্তি অনুভব করে। সে বারবার নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে—এবং দেখতে পায়, তার ছায়া হাঁটু গেড়ে বসে আছে, মাথা নিচু করে কাঁদছে। কিন্তু সে তো দাঁড়িয়ে আছে! সে ছায়ার দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কলেজের দিনের এক ঘটনা—তার এক সহপাঠিনী আত্মহত্যা করেছিল, আর সে তার কষ্ট বুঝেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সেই অপরাধবোধ তার ভিতর এতদিন ঘুমিয়ে ছিল, আর এখন সেই পাপের ছায়াই হয়তো রূপ নিচ্ছে। সে চিৎকার করে ওঠে। বাকিরা ছুটে এসে দেখে—তনুশ্রী হুঁশ হারিয়ে পড়ে আছে, ঘামছে, চোখ খোলা কিন্তু চেতনাহীন। নীলয় বলে, “এটা নিছক মানসিক চাপ। এখান থেকে ওকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে।” কিন্তু অরিন্দম বলে, “আর বেরনোর পথ আছে তো?” ক্যাম্পের পাশে সেই সময় বাতাস থেমে যায়, জঙ্গল নিস্তব্ধ। আকাশে পূর্ণচাঁদ উঠেছে। এবং সেই আলোয় আবার দেখা যাচ্ছে এক দীর্ঘ ছায়া, মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, স্থির… অথচ নিঃশ্বাস নিচ্ছে, একটানা, গম্ভীর। যেন তনুশ্রীর স্মৃতির ভিতর থেকে জন্ম নিয়েছে এক ছায়ামূর্তি—যে এবার বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে।
***
রাত গভীর হলে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা এক অদ্ভুত রূপ নেয়। অন্ধকার যেন ঘন নীল কুয়াশার মতো ঘুরে বেড়ায়, আর মন্দিরের ধূসর পাথরগুলো যেন নিজেই নিঃশব্দে নিশ্বাস নিচ্ছে। ক্যাম্পে আতঙ্কের ছায়া ঘনিয়ে আসে। তনুশ্রী গভীর অবচেতনে এক অদ্ভুত ঘোরে চলে গেছে, তার চোখ খোলা থাকলেও সে যেন দেখতে পাচ্ছে না কিছুই—শুধু একটানা বিড়বিড় করে বলে চলেছে, “সে আমাকে ডেকেছে… আমি মুখ ফিরিয়েছিলাম… সে ফিরে এসেছে…” শ্রুতি পাশে বসে তার হাত চেপে ধরে ছিল, অরিন্দম ক্যামেরা বন্ধ করে শান্ত থাকার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার ভেতরে চলছিল এক অজানা উদ্বেগ—রাতের ফুটেজ সে এখনো কাউকে দেখায়নি। সেই ফুটেজে তনুশ্রীর ছায়া হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখে, তার দিকে তাকিয়ে হাসে। একটা ছায়া কি ক্যামেরার দিকে তাকাতে পারে? যদি পারে, তবে সেটা কি ছায়া?
ডঃ নীলয় পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছিলেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার নিজস্ব যুক্তির ভরসা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। তিনি গভীর রাতে একা মন্দিরের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন—হয়তো প্রকৃত সত্য জানতে, অথবা নিজেকে শান্ত করতে। মন্দিরের গর্ভগৃহে পৌঁছে, তিনি আবার সেই আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। এবার তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন—নিজের ছায়া তাকে অনুসরণ করছে না, বরং আগেই গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। সে নিজে পরে এসেছে। তিনি আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলেন না, কিন্তু ছায়ার মুখে যেন অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠেছে। “তুই কে?” নীলয় ধীরে ধীরে বলে উঠলেন। তার ছায়া হঠাৎ আয়নার বাইরে উঠে এসে তার দিকেই এগিয়ে আসে—আর তখনই একটি অদ্ভুত শব্দ হয়, যেন মন্দিরের ভেতরে কিছু খুলে যাচ্ছে। সে দৌড়ে ফিরে আসে ক্যাম্পে, মুখ ফ্যাকাশে, গলায় কাঁপুনি। কিন্তু ফিরে এসে দেখে তনুশ্রী নেই। ঘুমন্ত অবস্থায় সে কোথায় গেল, কেউ টেরও পেল না! শ্রুতি কাঁপা গলায় বলে, “ওর ছায়া ছিল এখানে। কিন্তু মানুষটা নেই।” সবাই টর্চ নিয়ে ছুটে যায় জঙ্গলের দিকে, অন্ধকার গাছেদের ভেতর দিয়ে ডাকে, চিৎকার করে, কিন্তু কোনো সাড়া মেলে না। ঘন জঙ্গলের ভেতর কুয়াশায় দেখা যায় কেবল একজন নারীর চলমান প্রতিচ্ছবি—পেছন ফিরে দেখছে না, কিন্তু হাঁটছে মন্দিরের দিকে। ছায়ার মতো সাদা জামা, খোলা চুল, আর নিঃশব্দ পায়ের শব্দ।
পরদিন সকালে, নিখোঁজ তনুশ্রীর খোঁজে চিরুনি তল্লাশি শুরু হয়। জঙ্গলের ভেতর, কিছুটা দূরে, একটা গাছের ডালে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। চোখ খোলা, মুখে এক ধরণের স্থিরতা, যেন সে আগেই জানত এই শেষ। তার নীচে ছায়াটা এখনো স্থির—যেন সে মারা গেলেও ছায়া ছাড়েনি। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল গাছের গায়ে আঁকা প্রতীক—এক খণ্ডিত ত্রিচক্র, যার মাঝে খোদাই করা একটি বাক্য: “যে মেনে নেয়, সে মুক্ত। যে পালাতে চায়, সে আমার।” নীলয় স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না—এটা কিসের প্রতিক্রিয়া? অপরাধবোধ? না কি কোনো উচ্চতর বুদ্ধিসম্পন্ন ছায়াশক্তি, যারা আত্মার দোষ চিনে তাকে শাস্তি দেয়? কিন্তু অরিন্দম তখন জানায়—সে আগের রাতে আরও কিছু রেকর্ড করেছে। ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে, তনুশ্রী নিঃশব্দে ঘুম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল, তার ছায়া আগে হাঁটছিল, আর সে তার ছায়াকে অনুসরণ করেছিল ঠিক যেন জাদুতে বাঁধা পড়ে।
শ্রুতি তখন বলে ওঠে, “এই মন্দির একটা ফাঁদ, কিন্তু ধর্মীয় নয়। এটা মনস্তত্ত্ব, আত্মজিজ্ঞাসা, আর অপরাধবোধকে ছায়ায় রূপান্তর করে। ছায়াগুলো আমাদের মুখ নয়—আমাদের দোষের প্রতিবিম্ব।” নীলয় একবার কাঁপা গলায় বললেন, “তাহলে আমরা কেউ নিরাপদ নই।” তখন মন্দিরের ওপাশ থেকে ধীরে ধীরে এক ছায়ামূর্তি ভেসে ওঠে। এবার আর তা অস্বচ্ছ নয়, স্পষ্ট নারীমূর্তি—মোহিনী। চোখ নেই, মুখে হাসি, আর পেছনে ছায়ার পাখার মতো কিছু। সে দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দেখে, এবং ধীরে ধীরে নিজের হাতে তৈরি করে আরেকটি ছায়ামূর্তি—যার মুখ অরিন্দমের মতো। এবার ছায়া শুধু ছায়া নেই—এরা শিকারী।
***
চন্দ্রনির্মল রাতের ঘন অন্ধকারে যখন সমস্ত জঙ্গল নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে, তখনই যেন মন্দিরের অন্তর্গত কোন অদৃশ্য শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। পাণ্ডবেশ্বর মন্দিরের সেই কেন্দ্রীয় কক্ষে রাখা ছিল এক রহস্যময় শিলা–তাতে খোদাই করা অজানা ভাষার মন্ত্র এবং চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পুরনো মৃত্তিকা-ভাস্কর্য। সেইদিন রাতে, নীলয় হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে তাঁর তাঁবুর ঠিক বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছায়ার মত গড়ন, মুখ দেখা যায় না, কিন্তু স্থিরভাবে তাঁকে তাকিয়ে দেখছে। প্রথমে ভেবেছিল রণজয় হয়তো, অথবা শ্বেতা, কিন্তু সেই অস্তিত্ব যখন নড়ে না, কথা বলে না, বরং ধীরে ধীরে গলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়—তখন সে বুঝতে পারে, এ কিছু মানুষের ব্যাপার নয়। ঘামে ভেজা গায়ে সে ছুটে যায় বাকি দলের দিকে। রণজয় ও শ্বেতা তখন ঘুমোচ্ছিল, আর অনির্বাণ ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখেছিল। সে জানায়, সে কিছুই দেখেনি। কিন্তু নীলয়ের বর্ণনা শুনে দলের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সকাল হতেই তারা মন্দির চত্বর আবার পরিদর্শনে যায়, যেখানে শ্বেতা আবিষ্কার করে মাটি খোঁড়া অবস্থায় কিছু ছিন্নভিন্ন মানুষের হাড় এবং একটি ভাঙা আয়না—যেটিতে প্রতিফলিত হয় না কোনও মুখ, শুধুই ছায়ার আভাস।
দিন যত এগোয়, মোহিনী তন্ত্রের জটিলতা বাড়তে থাকে। রণজয় সেই ভাঙা আয়নাটি পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে হঠাৎ অসাড় হয়ে পড়ে, চোখ দুটি ফাঁকা হয়ে যায়। তার ঠোঁট কাঁপে, আর সেই কাঁপা ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসে এক অজানা ভাষার স্তব—যেটা দলের কেউ বুঝতে পারে না, কিন্তু সবাই অনুভব করে, ওটা কোনো মানুষিক অবস্থার ফসল নয়। শ্বেতা আর নীলয় মিলে রণজয়কে ধরে তাঁবুতে নিয়ে যায়। অনির্বাণ সেই প্রাচীন মন্ত্রের কিছু অংশ অনুবাদ করতে সক্ষম হয়। তাতে লেখা, “যে নিজের ছায়াকে অস্বীকার করে, সে তার মৃত্যুর চিহ্ন নিয়ে ফিরে আসবে।” সেই বাক্য পড়ে গিয়ে সকলে শিউরে ওঠে, কারণ সেই রাতে নীলয়ই ছিল প্রথম ব্যক্তি যে নিজের ছায়ার সাথে মুখোমুখি হয়েছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর বাতি নিভে যায় বারবার, চারপাশে শোনা যায় ছায়াদের ফিসফাস। দলের প্রত্যেকে অনুভব করে, তারা যেন এক বিভ্রমের গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে, যেখানে রাত আর দিন, বাস্তব আর বিভ্রমের সীমানা হারিয়ে গেছে। সেই রাতে শ্বেতা নিজের ছায়াকে আয়নার মধ্যে দেখে—ছায়াটি তারই মত কিন্তু চোখে রক্তরঙের আলোর ঝলকানি আর ঠোঁটে একটি অদ্ভুত হাসি। শ্বেতা দৌড়ে বেরিয়ে আসে তাঁবু থেকে, কিন্তু বাইরে তখন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছায়ার সারি, নিঃশব্দে তাকিয়ে।
পরদিন সকালে দেখা যায় রণজয় নিখোঁজ। তাঁবুর পাশে মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় রক্তে লেখা একটা বাক্য—“আমি তো তোমারই ছায়া!” দলে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনির্বাণ বুঝতে পারে, এই মোহিনী তন্ত্র আসলে একটি শক্তিশালী বক্রশক্তি যা মানুষের আত্মপরিচয়ের সত্তা ভেঙে তাকে নিজেকেই গ্রাস করায়। তারা মন্দিরের কেন্দ্রে ফিরে গিয়ে দেখতে পায়, সেই আয়নার সামনে রাখা রণজয়ের ব্যাকপ্যাক—আর সেই আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে শুধু ছায়া, কোনও মানুষ নয়। শ্বেতা এইবার ঠিক করে, আর অপেক্ষা নয়, ওরা যতটা পারে, এই মন্দির থেকে দূরে চলে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জিপের GPS পুরোপুরি বিকল হয়ে গেছে, কম্পাস ঘোরাফেরা করছে গোলের মধ্যে, আর জঙ্গল যেন প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। রাত হলে দেখা যায়, ছায়ারা আর আড়াল থেকে তাকিয়ে নেই—তারা চলে এসেছে সামনেই। তাদের হেঁটে যাওয়ার শব্দ হয় না, কথা বলে না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকে দলের চারপাশে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের এই দলে এখন আর কেউ শুধু অনুসন্ধানে নেই, সবাই কেবল বাঁচার পথ খুঁজছে। কিন্তু বেঁচে থাকা কি এত সহজ, যখন ছায়াই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু?
***
মন্দিরের গর্ভগৃহে পা রেখেই দীপ্তর মনে হল যেন কেউ তার কানে কানে ফিসফিস করছে। দেওয়ালে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা মশালের আলোয় তাদের ছায়াগুলো অদ্ভুতভাবে নাচছিল, যেন জীবন্ত। ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো অস্থিরতা ছিল সেই ছায়াগুলোর চলনে। ত্রিপাঠী কাঁপা গলায় বললেন, “আমরা যা খুঁজছি, সেটা এখানেই আছে।” দীপ্তর গলা শুকিয়ে গেল—এক অদৃশ্য ঠান্ডা তার ঘাড় বরাবর বয়ে গেল। রুদ্র মাটির দিকে তাকিয়ে একটা টুকরো ফলক দেখিয়ে বলল, “এটা… মোহিনী তন্ত্রের চিহ্ন হতে পারে।” তাৎক্ষণিকভাবে, একটা অদৃশ্য বলয় যেন ঘিরে ফেলল পুরো কক্ষটিকে। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর তারপর সবাই শুনতে পেল সেই আওয়াজ—অস্পষ্ট, নারীকণ্ঠে উচ্চারিত এক প্রাচীন মন্ত্র। “যে নিজেকে দেখে, সে নিজের বিনাশ ডাকে।” শব্দটা কানে যেতেই হঠাৎ করে নীলার ছায়া ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এক দেওয়ালের সামনে। নীলা চেঁচিয়ে উঠল, “আমার ছায়া… ওটা… আমার মতো না! ওটা হাসছে!” সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, দেওয়ালে প্রতিফলিত সেই ছায়াটা সত্যিই অন্যরকম। নীলার ঠোঁট শক্ত, কিন্তু ছায়াটা যেন মৃদু হাসছে।
পরমুহূর্তেই মশাল নিভে গেল। গাঢ় অন্ধকারে কেবলমাত্র নিঃশ্বাস আর দ্রুত পদচারণার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কেউ একজন চিৎকার করে উঠল—সম্ভবত অরিন্দম, কিন্তু তারপর সব আবার স্তব্ধ। দীপ্ত ছুটে গিয়ে খুঁজে পেল রুদ্রকে, যার হাতে একটা পুরনো শিবলিঙ্গের গায়ে খোদাই করা পুঁথি ছিল। পুঁথিতে লেখা ছিল—“যে একবার মোহিনীকে দেখে, সে আর নিজের হতে পারে না।” দীপ্তর মনে হল, এ কথা যেন তার হৃদয়ে দগদগে আগুনের মতো জ্বলছে। এই মুহূর্তে নীলা নিখোঁজ, অরিন্দম নিস্তেজ, আর ত্রিপাঠী স্থবির। দীপ্ত চারদিকে তাকিয়ে অনুভব করল, মন্দিরের ছায়াগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। তার নিজের ছায়াটাও আলাদা হয়ে গেছে, দেয়ালে থাকা তার প্রতিবিম্ব যেন তাকে অনুসরণ করছে না, বরং পথ দেখাচ্ছে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমাদের নিজেদের সত্ত্বার সঙ্গেই যুদ্ধ করতে হবে।” রুদ্র বলল, “এই মন্দির, এই তন্ত্র, সবকিছুর পেছনে কোনো প্রাচীন শক্তি আছে… এ শুধু অতীত নয়, এ ভবিষ্যৎও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”
কিছুক্ষণ পর, তারা গর্ভগৃহের অন্তিম চৌকাঠে পৌঁছায়। সেখানে ছিল এক কাচের আবরণে ঘেরা অদ্ভুত প্রতিমা—অর্ধনারী, অর্ধসাপ আকৃতির এক দেবী যার চোখ দুটি যেন পাথরের নয়, রক্তমাংসের। রুদ্র আবরণ ছুঁতেই এক প্রবল কাঁপুনি বয়ে যায় সারা মন্দিরে। তখনই তারা দেখতে পায়—ত্রিপাঠীর ছায়া হঠাৎ করেই মাটিতে ছটফট করছে, আর ত্রিপাঠী নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সেই প্রতিমার দিকে। ছায়া তার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে প্রতিমার পাদদেশে আত্মসমর্পণ করে। সে মুহূর্তেই ত্রিপাঠী ধসে পড়েন, নিঃস্পন্দ। রুদ্র চিৎকার করে বলে উঠল, “এটা একটা ছায়ার বলি! প্রতিমা শক্তি চায়!” দীপ্ত তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে তাদের বেরোতে হবে। কিন্তু মন্দির এখন তাদের ছাড়বে না, কারণ তাদের ছায়াগুলো এখন নিজেরাই বেঁচে থাকতে চায়। মন্দিরের অন্তরালে নেমে এল ঘোরতর নৈঃশব্দ্য, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন এক অনির্বচনীয় সংলাপ বয়ে চলেছে—ছায়া আর মানুষের, অস্তিত্ব আর বিভ্রমের মধ্যে।
***
ভোরের আলো এখনও জঙ্গলের পাতা ভেদ করে পুরোপুরি মাটিতে পৌঁছাতে পারেনি, অথচ মোহিনী মন্দিরের আশেপাশে ঘন অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে—অস্বাভাবিকভাবে। রুদ্রর নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন সকালেই প্রত্নতত্ত্ববিদ দলের বাকিরা বিভ্রান্ত, ভীত এবং ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। অনির্বাণ চেষ্টা করছিলো দলের মনোবল ধরে রাখতে, কিন্তু চোখের কোণে তার নিজেরও উদ্বেগের রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। রোহিণী কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, ঠিক কীভাবে একটা ছায়া কারও জীবন নিতে পারে—তাও একের পর এক! প্রভাতী নিঃশব্দে অনুরাধার পাশে বসে ছিল, তার দৃষ্টিতে ছিল অপার আতঙ্ক, যেন মন্দিরের ভেতরের সেই ‘মোহিনী তন্ত্র’-এর গোপন কোনও দিক বুঝে ওঠার আগেই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা সবাই সিদ্ধান্ত নিল, আজই আবার মন্দিরের নিচের কুঠুরির সন্ধান নিতে হবে, কারণ তাদের মনে হচ্ছিল, রুদ্র সেই জায়গাতেই আটকা পড়ে থাকতে পারে, অথবা…
তারা মন্দিরে প্রবেশ করতেই টের পেল, বাতাস আগের থেকেও ভারী। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন মাটির নিচ থেকে কারও নিঃশ্বাসের শব্দ আসছিল। নিচে নেমে যখন তারা গর্ভগৃহের বাম পাশে থাকা গোপন সিঁড়ি অবশেষে আবিষ্কার করল, তখনই রোহিণী একটা অদ্ভুত ছায়া দেখতে পেল—সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে যেন তারই প্রতিচ্ছবি তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে ভয়ে পেছনে ফিরে তাকালো, কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। তাদের প্রত্যেকের মাথায় এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—এই ছায়াগুলো কি সত্যিই তাদের নিজের? না কি মোহিনী তন্ত্রে বন্দি কোনও পরকালের অস্তিত্ব তাদের ছায়ার আকারে ধরা দিচ্ছে? অনির্বাণ হাতে জ্বলন্ত টর্চ নিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামছিল, তার পেছনে বাকিরা। সিঁড়ি শেষ হলে তারা ঢুকল একটি বিস্ময়কর চেম্বারে, যেখানে দেয়ালের গায়ে খোদাই করা ছিল অর্ধনগ্ন নারীমূর্তির চিত্র—প্রতিটি মূর্তির চোখ যেন প্রাণবন্ত, যেন তারা চুপিচুপি দেখে চলেছে আগন্তুকদের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ।
চেম্বারের এক কোণে হঠাৎ তারা দেখতে পেল রুদ্রর ব্যাগ আর একটি পুরনো সোনালি পাতার পুঁথি, যা দেখে অনির্বাণের মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে গম্ভীর গলায় বলল, “এটা… মোহিনী তন্ত্রের মূল পাঠ। এখানে লেখা আছে—যে ব্যক্তি এই তন্ত্র পাঠ করবে, তার ছায়া ধীরে ধীরে আলাদা অস্তিত্বে রূপ নেবে এবং মূল ব্যক্তির জীবনশক্তি গ্রহণ করে তাকে বিলীন করে দেবে।” বাকিরা হতবাক হয়ে গেল। তাহলে কি রুদ্র সেই ভুল করে ফেলেছিল? ঠিক তখনই, হঠাৎ চারদিকে বাতি নিভে গেল, এবং রোহিণীর ছায়া যেন মেঝেতে কেঁপে উঠল। সে চিৎকার করে উঠল, “আমার ছায়া… এটা নড়ছে আমার থেকে আলাদা!” মুহূর্তের মধ্যে পুরো চেম্বার অন্ধকারে ভরে গেল, ছায়ারা যেন ঘন হয়ে চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। চিৎকার, দৌড়ঝাঁপ, আর হঠাৎ নিঃস্তব্ধতা। আরেকটি প্রাণের অবসান হলো কি না, কেউ বুঝে ওঠার আগেই আবার আলো জ্বলে উঠল। মেঝেতে অনুরাধার কণ্ঠরুদ্ধ দেহ, তার চোখ ফাঁকা, আর তার পাশে… শুধু তার ছায়া।
***
অরণ্যের নিস্তব্ধতা যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল মন্দিরের অভ্যন্তরে ঘটে চলা প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে। সপ্তম রাত ছিল সেটি, যেদিন রুদ্রর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বাকিরা একে অপরের চোখে শুধুই সন্দেহ দেখতে শুরু করেছিল। জয়িতা ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছিল, তার চোখে যেন সব কিছুই কুয়াশায় ঢাকা। দীপ্তিমান ক্রমশ খোলসে ঢুকে যাচ্ছিল, তার স্পষ্ট ধারনা ছিল, মোহিনী তন্ত্র কোনও মানুষের সৃষ্টি নয়—এটি এক অতিপ্রাকৃত শক্তির চক্র, যা ছায়ার আড়ালে নিজস্ব শিকার বেছে নিচ্ছে। রাতের অন্ধকারে তারা যখন তিনজন মিলে মন্দিরের মূল কক্ষের কাছে পৌঁছায়, সেই সময় অদ্ভুত এক ঠান্ডা বাতাস তাদের ঘিরে ধরে। জয়িতা আচমকাই বলে ওঠে, “তোমরা আমার ছায়া দেখছো? এটা কি ঠিক আমার মতো?” দীপ্তিমান আর প্রফেসর গোস্বামী ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখেন, জয়িতার ছায়া আসল জয়িতার তুলনায় অনেক উঁচু, আর তার দুই চোখ জ্বলজ্বল করছে গাঢ় সবুজ আলোয়। এই দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গেই জয়িতা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আর তার মুখ থেকে বেরোয় অবিশ্বাস্য এক কণ্ঠস্বর—যেটা জয়িতার নয়, বরং যেন শতাব্দী প্রাচীন কোনও এক নারীর। ছায়া যেন তখন তন্ত্রের আসল মালিক, আর সে ঘোষণা করে—“মোহিনী কেউ নয়, আমি নিজে! তোমরা সবাই ছিলে শুধু পুতুল।”
প্রফেসর গোস্বামী তাঁর জীবনের সব যুক্তিবাদী চিন্তা একপাশে সরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমরা হয়তো এমন কিছু জাগিয়ে তুলেছি, যা ঘুমন্ত থাকাই ভালো ছিল।” দীপ্তিমান তখন সাহস করে তার ল্যাপটপের ক্যামেরা অন করে ছায়াটির প্রতিচ্ছবি ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু অবাক হয়ে দেখে তার স্ক্রিনে তারা কেউই নেই—শুধু ঘন কালো এক দাগ, যেটা ধীরে ধীরে স্ক্রিন থেকে বাস্তব জগতে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জয়িতা তখন যেন নিজের মধ্যেই দুই সত্তার টানাপোড়েনে লড়ছে। তার এক দিক চাইছে পালিয়ে বাঁচতে, আরেক দিক চাইছে তন্ত্রের আধিপত্য ধরে রাখতে। এমন সময়, গোস্বামী হঠাৎ করে স্মরণ করেন মন্দিরে খোদিত একটি শ্লোক—“ছায়ার প্রকৃত আয়না হোক আগুন।” সে বুঝে যায়, অগ্নি ছাড়া এই অশরীরী শক্তিকে রোধ করা যাবে না। তৎক্ষণাৎ তারা ঘর জুড়ে কয়েকটি মশাল জ্বালিয়ে দেয়। আগুনের আলোয় ছায়া প্রথমে চিৎকার করে ওঠে, আর তারপর নিজেকে গুটিয়ে নেয় এক স্তম্ভের মধ্যে। জয়িতা ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পায়, কিন্তু চোখে মুখে এক অজানা শূন্যতা। দীপ্তিমান তখন বুঝতে পারে—এটা সাময়িক বিজয়, কিন্তু ছায়া এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।
তাদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল এক প্রাচীন মন্দিরকে পুনরুদ্ধার করা, কিন্তু সেই পথেই তারা যেন মুক্ত করে ফেলেছে এমন এক শক্তিকে, যার অস্তিত্ব সময়ের সঙ্গে বিলীন হয়েছিল। পরের সকাল, চারদিক তখনও কুয়াশায় ঢাকা। প্রফেসর গোস্বামী আর দীপ্তিমান মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার মন্দিরকে আবার সেই প্রাচীন নৈঃশব্দ্যে ফিরিয়ে দিতে হবে। মন্দিরের প্রবেশপথে তারা পাথরের মোটা দরজা বন্ধ করে দেয়, আর চারপাশে আগুনের বৃত্ত তৈরি করে। জয়িতা তখনও অনেকটাই নিস্তেজ, কিন্তু সে কিছুটা স্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেছে। শেষবারের মতো তারা তিনজন মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, আর ছায়ার কণ্ঠস্বর একবার বলে উঠল, “এবার তবে আবার ঘুম।” যেন একটি আত্মা, এক দীর্ঘ শিকার পর্ব শেষে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। কিন্তু দীপ্তিমানের মনে রয়ে গেল সেই প্রশ্ন—যদি কেউ আবার আসে, আবার যদি ছায়াকে ডাকে, তবে কী হবে তখন? মোহিনী মন্দির তখন হয়তো আর কাউকে ছাড়বে না।
***
অরণ্যের গাঢ় অন্ধকারে, ভোরের আলো ফোটার আগেই একটি গুমোট পরিবেশ তৈরি হয়েছিল মোহিনী মন্দির চত্বরে। চারিদিকে ধোঁয়া এবং ছায়া এক অদ্ভুত আবরণে ঢেকে রেখেছিল মন্দিরটিকে। ড. রুদ্রনীল মুখার্জি আর মাত্র চারজন জীবিত সদস্যকে নিয়ে এখন অবশিষ্ট দল। তারা ক্রমশ দিশেহারা হয়ে পড়ছিলেন, কারণ প্রতিটি রাতেই একজন করে নিখোঁজ হচ্ছিল—আর পরদিন মিলছিল তার ছায়াচাপা মৃতদেহ। নিশীথ রাত্রির সেই মুহূর্তে, কৌশিক ঘোষ হঠাৎ করে নিজের ছায়াকে ঘরে দেখতে পান, সে যেন একটি আলাদা সত্তা হয়ে গিয়েছে। কৌশিক ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলেও কেউ কিছু করতে পারেনি। তার চিৎকার থেমে যাওয়ার পরে নিস্তব্ধতার গর্জন যেন চারদিকে বেজে উঠেছিল। পরদিন সকালে তারা কৌশিকের মৃতদেহ খুঁজে পেল—চোখদুটো বিস্ফারিত, ঠোঁটে জমাট বাঁধা আতঙ্ক, আর তার ঠিক পেছনে এক বিকৃত ছায়ার আভাস।
এই ঘটনার পরে দলের মধ্যে এক বিভ্রান্তিকর বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। ড. রুদ্রনীল সিদ্ধান্ত নেন যে এবার তন্ত্রবিদ্যার প্রাচীন পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করে মন্দিরের রহস্য উন্মোচন করতে হবে। তিনি অনুসন্ধান করতে গিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি ভাঙা সিংহাসনের নিচে মাটির মধ্যে পুঁতে রাখা এক অদ্ভুত পুঁথি খুঁজে পান। পুঁথির পৃষ্ঠাগুলোতে উৎকীর্ণ ছিল একটি নিষিদ্ধ তন্ত্র—‘মোহিনী তন্ত্র’। বলা ছিল, যে এই তন্ত্রে দীক্ষিত হবে, সে নিজের ছায়াকে নিজের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তবে মূল্য হিসেবে দিতে হবে আত্মার স্বাধীনতা। আরও লেখা ছিল, “যে নিজেকে দেখতে ভয় পায়, সে কখনও মোহিনীর দৃষ্টিকে সহ্য করতে পারে না।” ড. রুদ্রনীল উপলব্ধি করলেন—ছায়ার মাধ্যমে মৃত্যুগুলি আসলে আত্মিক প্রতিচ্ছবির প্রতিশোধ। মোহিনী তন্ত্রকে বিরক্ত করায় প্রতিটি সদস্য তার নিজস্ব ছায়া দ্বারা শাস্তি পাচ্ছে।
এই গভীর উপলব্ধি থেকে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে তারা মন্দির থেকে সরে যাবে। কিন্তু এই ত্যাগ এত সহজ ছিল না। সেই রাতে, বাকিদেরও ছায়া একে একে আক্রমণ করে। সমর দত্ত নিজের ছায়ার হাতে গলা টিপে খুন হন। শ্রেয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মন্দিরের ছাদ থেকে পড়ে যান, ছায়া যেন তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। সবশেষে, ড. রুদ্রনীল একা পড়ে যান সেই পুরনো পুঁথি হাতে। তিনি পুঁথির তন্ত্রবাক্য উচ্চারণ করার সময় দেখেন, তার নিজের ছায়া ধীরে ধীরে তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসছে, মুখে তৃপ্তির ছায়া। তখন তিনি বুঝলেন, শেষ রক্ষা আর সম্ভব নয়। নিজের তৈরি অন্ধকারের পাঁকে তিনি নিজেই ডুবে যাচ্ছেন, আর মোহিনী মন্দির তার রহস্যময় ত্রাসের কাহিনি আরও একবার পূর্ণ করল।
***
ভোরের আগেই মন্দির চত্বরের গা-ছমছমে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল এক অদ্ভুত গন্ধ—পোড়া ধূপ, নোনা ঘামের দহন, আর যেন অতীতের কান্নার ধ্বনি। ড. রুদ্রনীল মুখার্জির নিথর দেহটিকে মন্দিরের সিংহদুয়ারের সামনে পড়ে থাকতে দেখে বন বিভাগের প্রহরীরা আতঙ্কে পিছু হটে যায়। খবর দ্রুত পৌঁছে যায় জেলা প্রশাসন পর্যন্ত। আধিকারিকরা প্রথমে ভাবেন এটি হয়তো কোনো সাধুর মৃত্যু, অথবা কোনো অনধিকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানকারীর বিপদ। কিন্তু ঘটনাস্থলের অদ্ভুত পরিবেশ, মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা সেই পুরনো, ছেঁড়া চামড়ার বাঁধানো পুঁথি, এবং সেই কষ্টিপাথরের বেদির উপরে লেপ্টে থাকা এক মিশ্র ছায়া যেন সবার চেতনায় ছায়ার মতো আঁচড় কেটে দেয়।
স্থানীয় থানার তদন্তে দায়িত্ব পান অফিসার রাকেশ হালদার—এক অভিজ্ঞ, কিন্তু বাস্তববাদী পুলিশ অফিসার। তিনি প্রাথমিকভাবে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা ভেবেই তদন্ত শুরু করেন, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি অস্বাভাবিক ঘটনা তাঁর যুক্তিবাদী মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে। ফরেনসিক রিপোর্টে দেখা যায়, রুদ্রনীলের গলায় কোনও বাইরের আঘাত নেই, অথচ শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, তার শরীরে ছায়ার মতো ছোপ ছোপ দাগ পাওয়া যায়—যেগুলোর কোনও ব্যাখ্যা নেই।
রাকেশ ঘটনাস্থলের চারপাশে অনুসন্ধান করতে করতে খুঁজে পান ড. রুদ্রনীলের লেখা একটি খাতা। তাতে শেষ পৃষ্ঠায় আঁকা একটি ছায়ামূর্তি, যার চোখ দুটি কেবল শূন্যতা নয়—মনে হয় যেন কিছু একটা চেয়ে আছে পাঠকের দিকেই। আর তার নিচে লেখা:
“মোহিনী মন্দির নিছক পুরাকীর্তি নয়। এটি এক ‘জাগ্রত’ তন্ত্রমঞ্চ, যেখানে ছায়া আর আত্মার মধ্যে রচিত হয় অব্যক্ত চুক্তি। আমি মুক্তি চাইনি, আমি জ্ঞান চেয়েছিলাম—আর সেই চাওয়ার ফল আজ আমার শরীর ঘিরে দাঁড়িয়ে। যারা আমার পেছনে আসবে, তারা যেন আলো দেখে, ছায়াকে নয়।”
রাকেশের মনে সংশয় জন্মায়—এ কি সত্যি কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত অধ্যাপকের আত্মপ্রলাপ, না কি এই জায়গাটির সঙ্গে সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির যোগ আছে? তিনি স্থির করেন আরও অনুসন্ধান চালাবেন, মন্দিরের ভিতরে আরও ঢুকবেন। কিন্তু এক বৃদ্ধ পুরোহিত তাকে সাবধান করেন—“ছায়া দেখে ভয় পেলে তুমি শুধু হারাবে না, তুমি ভুলে যাবে নিজেকেও।”
রাকেশ এক রাতে গোপনে প্রবেশ করেন মোহিনী মন্দিরের গর্ভগৃহে, যেখানে সেই বেদি এবং পুঁথির ছিন্ন পৃষ্ঠাগুলি রাখা ছিল। তিনি দেখেন, সেই বেদির সামনে আবার একবার নিজের ছায়াকে ঘনিয়ে আসতে, নিজস্ব অঙ্গ থেকে যেন আলাদা হয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু রাকেশ, স্থির মনের মানুষ, পা পিছিয়ে না গিয়ে সামনে এগিয়ে যান। তিনি তার ছায়ার দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে বলেন, “তুই আমি—আমিই তুই। যতদিন আমি আলোকে মানি, ততদিন তুই অন্ধকারেই থাকবি।”
অবাক করা ঘটনা—ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় বেদির ছায়ায়। বেদির পাশ থেকে ভেসে আসে একটি স্তব—পুরনো পালি ভাষার এক তন্ত্রমন্ত্র, যেন চক্র পূর্ণ হয়ে গেছে।
সেই রাতের পর, মোহিনী মন্দির আর কাউকে গ্রাস করেনি। সরকার মন্দিরটিকে “Restricted Spiritual Zone” ঘোষণা করে বন্ধ করে দেয়। রাকেশ হালদার সে রিপোর্টে লেখেন—“বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু কিছু সত্যি বোঝা নয়, অনুভব করার। মোহিনী মন্দির এমনই এক জায়গা, যেখানে ছায়া কেবল ছায়া নয়—এক প্রাচীন চুক্তির সাক্ষর।”
এবং সেই ছায়া—হয়তো এখনও অপেক্ষায় আছে, কোনো এক নতুন মন, নতুন আকাঙ্ক্ষার, যে আলো আর অন্ধকারের পার্থক্য ভুলে গিয়ে আবার সেই চুক্তিতে সই করবে।
(সমাপ্ত)