এক
গ্রামের নাম শালপুকুর। নদীর ধার ঘেঁষে, সবুজ ক্ষেত আর তালগাছে ঘেরা এই গ্রাম বরাবরই শান্ত, নিরিবিলি। কোলাহলহীন জীবনযাত্রায় মানুষজন এখনো প্রথা মেনে চলে। গ্রামের মাঝখানে একটি পুরনো পুকুর—যার নাম থেকেই গ্রামটির নামকরণ। শালগাছ আর পুকুরের শাপলা মিলেমিশে গ্রামটিকে সাজিয়ে রেখেছে অন্যরকম আবহে। আধুনিকতার ছোঁয়া খুব কমই পৌঁছেছিল এই গ্রামে। ইন্টারনেট ধরা দিত কেবল পাহাড়ি মেঘের মতো—কখনো আসত, আবার হঠাৎ হারিয়ে যেত। ঠিক এই কারণে সরকার ও মোবাইল কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে শালপুকুর গ্রামে একটি আধুনিক 5G টাওয়ার বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামের মানুষজন প্রথমে খুশি হয়ে ওঠে। তারা ভাবে, অবশেষে তাদের ছেলে-মেয়েরা শহরের মতো ভিডিও কল করতে পারবে, অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারবে। চাষিরা বাজার দর যাচাই করতে পারবে সরাসরি মোবাইলে। এমনকি গ্রামের লোকেরা ভাবতে থাকে, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাদের যোগসূত্র অনেক বেশি দৃঢ় হয়ে উঠবে। তাই কাজ শুরুর দিন সকালেই কৌতূহলী মানুষ ভিড় জমায় নির্দিষ্ট জায়গায়। মাঠের কোণে বড় ট্রাক থেকে নামানো হয় লোহার খুঁটি, তারপরে বিশাল যন্ত্রপাতি। কংক্রিটের ভিত্তি খুঁড়তে খুঁড়তে জমিতে ধুলো আর কাদা উড়ে যায়। শিশুদের চোখে সেই দৃশ্য অন্য রকম কৌতূহল জাগায়—যেন গ্রামের বুকে নতুন যুগের আগমন ঘটছে।
কাজের দায়িত্বে আসে রাজীব ঘোষ। বয়স মাত্র আঠাশ, শহুরে যুবক, চশমা পরা, ছোট দাড়ি রাখা। হাতে সবসময় ট্যাবলেট আর ফাইল। লোকজনের সঙ্গে কথা বলার ভঙ্গি কিছুটা অস্থির, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। তার কাছে এই কাজ কেবল একটা প্রোজেক্ট, সফল হলে পদোন্নতি এবং মোটা বোনাস। গ্রামীণ আবহে সে স্বস্তি পায় না, বরং দ্রুত কাজ শেষ করে শহরে ফিরে যেতে চায়। সকালবেলায় যখন রাজীব কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছিল, তখনই দূরে বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রঘুনাথ মাঝি। বয়স পঁয়ষট্টি, গায়ের চামড়া রোদে পোড়া, মুখজুড়ে সাদা দাড়ি। গ্রামের সবাই তাকে সম্মান করে, কারণ তিনি বহুদিনের বাসিন্দা, বহু ইতিহাস-গল্প জানেন। রঘুনাথ হাঁটতে হাঁটতে টাওয়ার বসানোর জায়গার দিকে এগিয়ে এলেন। ভিড় সরিয়ে তিনি রাজীবের সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন—“বাবু, এই জায়গাটা ভুল। এখানে টাওয়ার বসানো উচিত হবে না।” চারপাশে কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন ফিসফিস করতে থাকে।
রাজীব ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। “কেন? কোম্পানির জমি অধিগ্রহণের সব কাগজপত্র ঠিক আছে। সমস্যা কোথায়?”
রঘুনাথ মাটির দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “কাগজের সব ঠিক থাকতে পারে। কিন্তু মাটির ইতিহাস কে দেখবে? এই মাঠটা একসময় কবরস্থান ছিল। ব্রিটিশ আমলে এখানে অগণিত অচেনা মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছিল। অনেকের নাম নেই, অনেকের ঠিকানা নেই। বছরের পর বছর এই জায়গা পরিত্যক্ত ছিল। রাতে কেউ আসতে চাইত না। কিন্তু এখন তোমরা এখানে টাওয়ার বসাচ্ছ। যাদের দেহ এই মাটির তলায় ঘুমিয়ে আছে, তারা কি শান্তিতে ঘুমোতে পারবে?” তাঁর কণ্ঠে ভয় এবং সতর্কবার্তার সুর এতটাই স্পষ্ট ছিল যে গ্রামের মানুষজন স্তব্ধ হয়ে যায়। তবে রাজীব হাসলেন। “এগুলো সব গুজব। কবরস্থান হলে কোথায় তার প্রমাণ? এত বছর ধরে তো এ মাঠ খালি পড়ে ছিল। এখন তো গ্রামকে এগোতে হবে। 5G টাওয়ার হলে আপনাদেরই লাভ হবে।” তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কর্মীদের কাজ চালিয়ে যেতে বললেন।
কিন্তু রঘুনাথ থামলেন না। তাঁর চোখ চকচক করছিল। “বাবু, প্রযুক্তি যতই আসুক, মাটির অভিশাপ মুছে ফেলা যায় না। আমি ছোটবেলায় দেখেছি, রাতে এই মাঠ দিয়ে গেলে হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া বইত, কারও কারও কানে অচেনা আওয়াজ ভেসে আসত। মানুষ বলত, কবরের নিচে থাকা আত্মারা শান্তি পায়নি। আর এখন তোমরা তাদের ঘুম ভাঙাতে চলেছ।” চারপাশে উপস্থিত জনতার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কেউ ফিসফিস করে বলে উঠল, “তাহলে কি সত্যিই এটা কবরস্থান ছিল?” কেউ আবার বলল, “গোরস্থানের জায়গায় টাওয়ার বসালে সর্বনাশ হবে না তো?” কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ আধুনিক সুবিধার আশায় রাজীবের কথাই মেনে নিল। তারা ভাবল, রঘুনাথ বুড়ো মানুষ, পুরোনো কাহিনি মনে করে ভয় দেখাচ্ছেন। রাজীবও গম্ভীর মুখে বললেন, “এইসব ভয়ের গল্প দিয়ে উন্নয়ন থামানো যাবে না। কয়েকদিনের মধ্যেই টাওয়ার দাঁড়িয়ে যাবে, তারপর আপনারা নিজের চোখে সুবিধে দেখবেন।” রঘুনাথ আর কিছু বললেন না। তিনি ধীরে ধীরে সরে গিয়ে বাঁশঝাড়ের আড়ালে মিলিয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর চোখে ছিল অদ্ভুত এক শঙ্কা—যেন তিনি আগাম অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন।
সন্ধ্যা নামতেই কাজ থেমে গেল। লোহার কাঠামো ইতিমধ্যে অর্ধেক গড়ে উঠেছে। গ্রামের আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছিল, আর দূরে লাল সূর্যের আলো টাওয়ারের খাঁচার ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। অমল দত্ত, গ্রামের স্কুলশিক্ষক, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, “আধুনিক যুগের দরজা খুলছে আমাদের গ্রামে। ছাত্ররা এখন আর পিছিয়ে থাকবে না।” তাঁর স্ত্রী সুজাতাও পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “ভালোই হলো, এতদিন নেটওয়ার্কের জন্য ভুগতে হতো।” কিন্তু সুজাতার চোখে খানিকটা অস্বস্তির ছায়া ছিল—কারণ তিনিও রঘুনাথের গল্প শুনেছেন। সেই রাতে গ্রামে অনেকেই শুতে গেল একধরনের অস্বস্তি নিয়ে। তারা জানত, আগামীকাল আবার কাজ চলবে, টাওয়ার ক্রমশ উঁচু হবে। কিন্তু প্রশ্নটা থেকে গেল—রঘুনাথ কি সত্যিই ভুল বলছেন, নাকি সত্যিই টাওয়ারটা এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে ঘুমিয়ে আছে অসংখ্য অতৃপ্ত আত্মা?
দুই
সেই রাতে শালপুকুর গ্রামে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। গ্রীষ্মের শেষভাগ, বাতাসে গরমের সঙ্গে অদ্ভুত এক ঘনত্ব মিশে আছে। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর দূরের তালগাছের পাতায় হালকা সোঁ সোঁ শব্দ। অমল দত্ত দিনের ক্লান্তি শেষে পড়ার ঘরে বসে ছাত্রদের খাতা যাচ্ছিলেন। স্কুলের কাজের সঙ্গে সঙ্গে টাওয়ার নিয়ে গ্রামের গুঞ্জনও তাঁর কানে এসেছে। তিনি শহরে পড়াশোনা করে গ্রামে শিক্ষকতা করতে এসেছেন; তাই কুসংস্কারকে কখনো গুরুত্ব দেননি। কিন্তু রঘুনাথ মাঝির সতর্কবাণী তাঁকেও খানিকটা ভাবিয়েছে। অমল মনে মনে ভেবেছিলেন, “বৃদ্ধ মানুষ, নিশ্চয়ই ভয় দেখাতে এসব বলছেন। নতুন প্রযুক্তি এলে অনেক সুবিধা হবে। ভয় পেলে চলবে কেন?” ঘরে তাঁর স্ত্রী সুজাতা সেলফোনে কিছু দেখছিলেন। গ্রামের মতো জায়গায় ইন্টারনেট প্রায় কাজই করত না, তবে নতুন টাওয়ারের জন্য আশার আলো জেগেছিল। হঠাৎ রাত সাড়ে দশটার দিকে ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটি অচেনা নম্বর। শহরে থাকা অমলের ভাই বা ছেলেমেয়ের নম্বর হলে চিনতে পারতেন, কিন্তু এই নম্বর পুরোপুরি অজানা। তবুও তিনি ফোন ধরলেন। ওপাশ থেকে ভেসে এল এক ক্ষীণ, কর্কশ, কাঁপা কণ্ঠ—“আমার ঘুম ভাঙিও না… এখানে টাওয়ার বসিও না…”
অমল প্রথমে চমকে উঠলেন। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো লাইন সমস্যার কারণে অদ্ভুত আওয়াজ আসছে। “হ্যালো, কে বলছেন? শুনতে পাচ্ছি না…” তিনি কয়েকবার বললেন, কিন্তু ওপাশে কোনো নাম-পরিচয় নেই, শুধু সেই ফিসফিসে কণ্ঠ, যা শুনলে মনে হয় কেউ খুব দূর থেকে, অনেক গভীর গর্ত থেকে ডাকছে। কথাগুলো এতটাই স্পষ্ট যে ভুল শোনার প্রশ্নই নেই। সুজাতা ভয়ে অমলের দিকে তাকালেন, তাঁর চোখে প্রশ্ন—“কে বলছে?” অমল দ্রুত কল কেটে দিলেন, কপালে ঘাম জমে উঠেছে। তিনি নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, “এটা নেটওয়ার্কের গোলমাল ছাড়া কিছু নয়। হয়তো কোনো অচেনা লোকের মজা।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অজানা অস্বস্তি তাঁকে আঁকড়ে ধরল। তিনি নিজেকে সাহস দেওয়ার জন্য সুজাতাকে বললেন, “বুঝলে তো, নতুন টাওয়ার বসানোর কাজ চলছে, তাই সিগনালের সমস্যা হচ্ছে। অচেনা নম্বর থেকে এমন আজগুবি আওয়াজ আসতেই পারে।” সুজাতা তবুও শান্ত হলেন না। তিনি ধীরে বললেন, “কিন্তু কথাগুলো কী অদ্ভুত ছিল—‘আমার ঘুম ভাঙিও না… এখানে টাওয়ার বসিও না।’ এর মানে কী?” অমল জোর করে হাসলেন, “আরে, এগুলো সব কাকতালীয়।” কিন্তু তাঁর কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের অভাব লুকানো গেল না।
ফোনের সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে করতেই রাত এগোল। বাইরে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। শালপুকুর পুকুরপাড়ে কুয়াশার মতো হালকা ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছিল। অমল ঘুমোতে গেলেও বারবার মনে হচ্ছিল ফোনটা আবার বাজবে। তিনি কয়েকবার ফোন চেক করলেন—কোনো মিসড কল নেই। কিন্তু ঠিক বারোটার পর আবার ফোন কাঁপল। একই অচেনা নম্বর। অমল এবার সাহস করে ধরলেন। ওপাশে একই কণ্ঠ, তবে এবার আরও স্পষ্ট, আরও শীতল—“আমাদের জায়গা থেকে সরাও… ঘুম ভাঙিও না…” অমলের গা শিউরে উঠল। তিনি বললেন, “তোমরা কারা? কী চাইছ?” কিন্তু তারপরে শুধু নিস্তব্ধতা। হঠাৎ যেন মাইক্রোফোনে ভেসে এল হাহাকারের মতো এক আওয়াজ, তারপর কল কেটে গেল। সুজাতা ভয়ে কাঁপছিলেন। তিনি অমলকে অনুরোধ করলেন, “কালকেই গ্রামসভায় বলো ব্যাপারটা। হয়তো রঘুনাথ মাঝি ঠিকই বলেছিলেন।” অমল মাথা নাড়লেন, কিন্তু এখনো নিজেকে বোঝাচ্ছিলেন—“না না, এগুলো হ্যালুসিনেশন বা টাওয়ারের সিগনালের ত্রুটি। ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই।” তবুও তাঁর বুকের ভেতর যে শীতল শূন্যতা জমে উঠেছিল, তা সহজে মুছে গেল না।
পরদিন সকালে স্কুলে গেলেও অমল স্বাভাবিক থাকতে পারলেন না। ছাত্রদের পড়ানোর সময় তাঁর কানে যেন বারবার সেই ফিসফিসে কণ্ঠ বাজতে লাগল। খাতার অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। দুপুরে টিফিনের সময় সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন, তখনও মন অন্য কোথাও। গ্রামের লোকজন স্কুলের আঙিনায় দাঁড়িয়ে আলোচনা করছিল—“রাতে কেউ কেউ আবার অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছে।” এক কিশোরী দাবি করছিল, সে স্বপ্নে মৃত বান্ধবীর কণ্ঠ শুনেছে। অমল চুপচাপ শুনছিলেন, কিছু বলেননি। তিনি জানতেন, নিজের অভিজ্ঞতা বললে হয়তো ভয় আরও ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে একটা অদৃশ্য ছায়া গোটা গ্রামকে গ্রাস করছে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে তিনি মাঠের কোণে নির্মীয়মাণ টাওয়ারের দিকে তাকালেন। অর্ধেক খাড়া লোহার দণ্ডগুলো পূর্ণিমার আলোয় ঝকঝক করছিল। সেগুলো যেন মৃতের অস্থি দাঁড়িয়ে আছে। বুক কেঁপে উঠল তাঁর। তিনি মনে মনে বললেন, “যদি সত্যিই এ জায়গাটা কবরস্থান হয়ে থাকে? যদি সত্যিই মৃতেরা শান্তি না পায়?” অমল আবার নিজেকে বোঝালেন, “আমি একজন শিক্ষক, যুক্তির বাইরে যাওয়া উচিত নয়।” তবুও তাঁর মনে এক অদ্ভুত সংশয় থেকে গেল—প্রথম কণ্ঠস্বর কি শুধুই বিভ্রম, নাকি সত্যিই মৃতেরা টাওয়ারের বিরোধিতা করছে?
তিন
শালপুকুর গ্রামে টাওয়ার বসানোর কাজ যত এগোতে লাগল, ততই অস্বাভাবিক ঘটনাও বাড়তে থাকল। প্রথমে লোকজন ভেবেছিল অমল দত্তের মতো কয়েকজনের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে কিছু ঘটেছে, নেটওয়ার্ক বা যন্ত্রের ত্রুটিই দায়ী। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামের মেয়েরা ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করল এক অদ্ভুত ঘটনার বিষয়ে। তারা দাবি করল, তাদের ফোনে অচেনা নম্বর থেকে আসা কল ধরলে ভেসে আসে এক পরিচিত কণ্ঠস্বর—যে কণ্ঠ তারা অনেকদিন ধরে চেনে, কিন্তু এখন পৃথিবীতে নেই। সে হলো তাদের বান্ধবী নন্দিনী। বছরখানেক আগে নন্দিনী এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। গ্রামের স্কুলে পড়ত সে, ছিল প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মেয়ে। দুর্ঘটনার দিন থেকে তার বন্ধুরা গভীর শোকে ডুবে যায়। সময়ের সাথে তারা সামলে উঠলেও সেই ক্ষত এখনো পুরোপুরি ভোলেনি। আর এখন তারা শপথ করে বলছে, মোবাইলের ওপাশে শোনা যাচ্ছে নন্দিনীরই কণ্ঠ। প্রথমে দুই-একজন মেয়ে সাহস করে ব্যাপারটা বললে কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না। কিন্তু পরের দিন তিনজন, তারপর পাঁচজন একসঙ্গে একই অভিজ্ঞতার কথা জানালে গোটা গ্রামই শোরগোল তুলে দিল। মেয়েদের বর্ণনা প্রায় একই রকম—ফোন ধরামাত্র ভেসে আসে ভাঙা-গলায় ফিসফিস শব্দ, তারপর নন্দিনীর কণ্ঠ বলে ওঠে, “আমার কবর চাপা পড়েছে… আমার কবর চাপা পড়েছে…”
এই সংবাদ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। কিশোরীরা আতঙ্কে কেঁপে উঠছিল, রাতে ঘুমোতে পারছিল না। তাদের মায়েরা ছুটে গেল গ্রামের প্রবীণদের কাছে। কেউ বলল, “এ নিশ্চয়ই দুষ্ট আত্মার খেলা।” কেউ আবার বলল, “রঘুনাথ মাঝি ঠিকই বলেছিলেন, টাওয়ার কবরের ওপর বসানো হচ্ছে।” অমল দত্ত খবরটা শুনে শিউরে উঠলেন। মনে পড়ল নিজের ফোনের অভিজ্ঞতা, যেখানে এক ক্ষীণ কণ্ঠ তাঁকে সতর্ক করেছিল। এখন যদি সত্যিই মেয়েদের কাছে নন্দিনীর কণ্ঠ ভেসে আসে, তবে ব্যাপারটা নিছক প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়। তিনি প্রথমে শিক্ষকের মতো যুক্তি দাঁড় করাতে চাইলেন, বললেন, “সম্ভবত কোনো লোক ভয় দেখানোর জন্য এই সব করছে। নকল ভয়েস রেকর্ডার দিয়ে ফোন করছে।” কিন্তু অন্তরে তিনি নিজেও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। কারণ মেয়েরা যে ভয়ে কাঁপছিল, তা অভিনয় বলে মনে হচ্ছিল না। তারা একে একে বর্ণনা করছিল কেমনভাবে হঠাৎ রাতের বেলায় ফোন বেজে উঠত, আর ওপাশে ভেসে আসত নন্দিনীর পরিচিত কণ্ঠস্বর। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, সেই কণ্ঠে ছিল একধরনের যন্ত্রণা, এক অদ্ভুত হাহাকার, যেন কেউ অন্ধকারের ভেতর থেকে মুক্তির আর্তি জানাচ্ছে।
নন্দিনীর মা শ্যামলী দেবীও ঘটনাটি শুনে ভেঙে পড়লেন। মেয়ে মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, আর এখন শোনার পর বিশ্বাস করলেন, সত্যিই তাঁর মেয়ে কবর থেকে কথা বলছে। শ্যামলী দেবী রাতভর কান্নাকাটি করে বললেন, “আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাচ্ছে না। ওর কবরের জায়গায়ই নিশ্চয়ই টাওয়ার বসানো হচ্ছে।” রঘুনাথ মাঝি এগিয়ে এসে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর নিজের চোখেও এক ধরনের আতঙ্ক ফুটে উঠেছিল। তিনি বললেন, “আমি আগেই সতর্ক করেছিলাম। কবরের মাটি খুঁড়লে মৃতেরা নিশ্চুপ থাকবে কেন? এখন তারাই নিজেদের কণ্ঠে জানাচ্ছে, তারা শান্তি পাচ্ছে না।” গ্রামসভা বসে গেল। টাওয়ার বসানোর কাজ সাময়িক থামানোর দাবি উঠল। কিন্তু রাজীব ঘোষ, যিনি এই প্রোজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন, এসবকে নিছক গুজব বলে উড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “একজন মৃত মেয়ে কীভাবে ফোনে কথা বলতে পারে? এসব অবাস্তব। ভয় পেয়ে কাজ বন্ধ করলে পিছিয়ে পড়বেন আপনারাই।” রাজীব দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন, কাজ চলবে। তাঁর চোখে এটি কেবল গ্রামীণ অশিক্ষা ও কুসংস্কারের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু গ্রামের মানুষদের ভেতর বিভাজন তৈরি হলো—কেউ রাজীবের মতো যুক্তি মানতে চাইল, আবার কেউ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করল, নন্দিনীর আত্মা সত্যিই কথা বলছে।
সেই রাতে গ্রাম অদ্ভুতভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাতাসে অজানা এক চাপা ভয় ঘুরপাক খাচ্ছিল। নন্দিনীর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নিজেদের ঘরে বসে ভয়ে ভয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ এক কিশোরীর ফোন আবার বেজে উঠল। সবাই হুড়মুড় করে তার চারপাশে জড়ো হলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল সেই চেনা করুণ কণ্ঠস্বর—“আমার কবর চাপা পড়েছে… কেন তোমরা কিছু করছ না?” মেয়েরা হাহাকার করে কেঁদে উঠল। ফোনটি হাত থেকে পড়ে গেল মাটিতে, তবুও ওপাশের আওয়াজ কেঁপে কেঁপে বেরোচ্ছিল স্পিকারের ভেতর থেকে। ঘরের বাতাস যেন ঠান্ডা বরফে জমে গেল। মনে হচ্ছিল দেয়ালের আড়াল থেকে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে, ছায়া নড়ছে। সেই মুহূর্তে উপস্থিত সবাই বুঝে গেল, এ কেবল কাকতালীয় নয়। নন্দিনীর আত্মা সত্যিই কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—তার কবরের ওপর কি সত্যিই টাওয়ারের পিলার বসানো হয়েছে? নাকি কোনো গভীর অভিশাপ গ্রামকে আঁকড়ে ধরেছে? উত্তর কেউ জানল না, তবে নিশ্চিত হলো একটি বিষয়—টাওয়ার উঠতে যতদিন বাকি, ততদিন এই কণ্ঠস্বর, এই ছায়া, গ্রামকে আরও ভীত করে তুলবে।
চার
রাজীব ঘোষ ভোরবেলা টাওয়ার নির্মাণস্থলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। লোহার খাঁচার মতো কাঠামো ধীরে ধীরে মাথা তুলছে আকাশের দিকে। ভোরের কুয়াশার ভেতর দিয়ে টাওয়ারের দণ্ডগুলো যেন অশুভ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজীব শহর থেকে আসা একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, কোম্পানির নিয়মিত কর্মকর্তা। তার চোখে গ্রামীণ কুসংস্কার মানে কেবল অজ্ঞতা, সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু কয়েকদিন ধরে গ্রামের মধ্যে যে অদ্ভুত গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, তা কোম্পানির কানে পৌঁছে গেছে। সেদিন ভোরেই হেড অফিস থেকে ফোন এসেছিল। ফোনের ওপাশে কড়া কণ্ঠে জানানো হলো—“রাজীব, খবর পেয়েছি ওখানে মানুষ ভয় পাচ্ছে। ভূতের গল্প ছড়াচ্ছে। এটা যদি আরও ছড়ায় তবে প্রোজেক্ট আটকে যাবে। মনে রেখো, এই টাওয়ার চালু করা কোম্পানির কাছে অগ্রাধিকার। দ্রুত কাজ শেষ করো, কোনো অজুহাত শুনব না।” ফোন কেটে দেবার পর রাজীব বুঝলেন, এখন আর গাফিলতির সুযোগ নেই। কোম্পানি কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। গ্রামে ভয়-গুজব ছড়ালেই শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে না, তাঁর নিজের ক্যারিয়ারও প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন—যে করেই হোক, কাজ শেষ করতেই হবে।
গ্রামে এসে তিনি প্রথমেই কাজের গতি বাড়িয়ে দিলেন। শ্রমিকদের বললেন, রাতে-দিনে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। যদিও কিছু শ্রমিক নিজেরাও ভয় পাচ্ছিল, বিশেষত তারা যারা রাতে পাহারায় থাকত। তাদের মধ্যে একজন ফিসফিস করে রাজীবকে বলেছিল, “সার, রাতে টাওয়ারের পিলারের কাছে কেমন যেন শব্দ শোনা যায়, যেন মাটি থেকে কেউ কথা বলছে।” রাজীব এসবকে বাজে কল্পনা বলে উড়িয়ে দিলেন। তাঁর চোখে গ্রামের মানুষ মানে ভীত, অশিক্ষিত গোষ্ঠী, যাদের সামান্য গুজবও আতঙ্কিত করে তোলে। তিনি কর্মীদের বললেন, “যত কম সময় এখানে থাকবেন, ততই ভালো। টাওয়ার শেষ হলে কাজ শেষ। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।” অথচ ভেতরে ভেতরে রাজীব নিজেও স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি রাতে ঘুমোতে গেলে মাঝে মাঝে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতেন। কখনো শুনতেন কর্কশ ফিসফিসানি—“আমাদের জায়গা দিও না…” কখনো দেখতেন অন্ধকার মাটির নিচ থেকে ফ্যাকাসে হাত উঠে আসছে। তবে রাজীব নিজের মনে কঠোর হয়ে বলতেন, “এগুলো ক্লান্তি আর গুজবের ফল ছাড়া কিছু নয়।” তাঁর বিশ্বাস ছিল, ভয়কে পাত্তা দিলে কাজ এগোবে না।
কিন্তু গ্রামের মানুষের সঙ্গে প্রতিদিনের সংঘর্ষ বাড়ছিল। কিশোরীরা একে একে টাওয়ারের সামনে এসে কান্নাকাটি করত, বলত তারা নন্দিনীর কণ্ঠ শুনছে। তাদের বাবা-মায়েরা এসে চিৎকার করত, “আমাদের মেয়েদের ভয় দেখাচ্ছে কে? কেন এই কবরের জায়গা খুঁড়ছ?” রঘুনাথ মাঝি প্রকাশ্যে বললেন, “টাওয়ার বসালে গ্রাম ধ্বংস হবে। মৃতেরা আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না।” রাজীব এসব শুনে হেসে ফেললেন। তিনি গ্রামবাসীদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন, “দেখুন, এই টাওয়ার হলে আপনাদের ছেলেমেয়েরা শহরের মতো পড়াশোনা করতে পারবে। চিকিৎসার জন্য দ্রুত ডাক্তার ডাকা যাবে। ইন্টারনেটের সুবিধা পাবেন। আপনারা কেন এত কুসংস্কারাচ্ছন্ন হচ্ছেন?” কিন্তু গ্রামের চোখে তাঁর কথার কোনো দাম ছিল না। কারণ তারা বিশ্বাস করেছিল, নন্দিনীসহ মৃতদের আত্মা সত্যিই কথা বলছে। সেই বিশ্বাস ভেঙে দেওয়া কোনো যুক্তিতেই সম্ভব হচ্ছিল না।
অবশেষে রাজীব সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি স্থানীয় ভীতি উপেক্ষা করেই কাজ চালাবেন। গ্রামে সভা-সমিতি যতই হোক, তাঁর কাছে প্রোজেক্টই মুখ্য। রাতে কাজের তদারকি করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, শ্রমিকরা অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। ভয় তাদের পেয়ে বসেছে। রাজীব বাধ্য হয়ে কড়া গলায় বললেন, “কে কাজ করবে না, কালই শহরে ফেরত পাঠাব। চাকরি থাকবে না।” আতঙ্কে শ্রমিকরা আবার কাজে নেমে পড়ল। চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। যেন টাওয়ারের চারপাশে এক অদৃশ্য ছায়া পাক খাচ্ছে। রাজীব এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলেও মাথা ঝাঁকিয়ে সেই অনুভূতি সরিয়ে দিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর কানে হেড অফিসের সতর্কবাণী গুনগুন করছে—“কাজ থেমে গেলে সর্বনাশ হবে।” তাই তিনি আরও জোরে ঘোষণা করলেন, “যত ভয়ই আসুক, এই টাওয়ার সময়মতো দাঁড়াবে।” আর গ্রামের আকাশে তখনও অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন মাটি নিচ থেকে কেউ শুনছে তাঁর কথাগুলো, প্রতিটি শব্দ গিলে নিচ্ছে আর প্রতিশোধের অপেক্ষায় আছে।
পাঁচ
গ্রামের উঠোনে সেই রাতে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছিল। আকাশে চাঁদ আধো-আলো ছড়িয়ে রেখেছে, বাতাসে মাটির গন্ধ ভেসে আসছে। টাওয়ারের চারপাশে গ্রামবাসী জড়ো হয়েছিল। ভয়ে কেউ চিৎকার করছে না, তবু সবার চোখে এক অজানা আতঙ্ক খেলে যাচ্ছে। সেই সময় রঘুনাথ মাঝি এগিয়ে এসে গভীর গলায় বলতে শুরু করলেন, “তোরা জানিস না, এই জায়গার ইতিহাস কেমন অন্ধকার। আজকের কবর আর আজকের ভুতুড়ে কণ্ঠস্বর কোনো নতুন ঘটনা নয়। এই মাটির নিচে বহু পুরনো অভিশাপ চাপা পড়ে আছে।” তাঁর কণ্ঠ যেন সবার হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই গা সেঁধিয়ে শুনতে লাগল তাঁর কথা। রঘুনাথ মাঝি ছিলেন গ্রামের প্রবীণতম মানুষদের একজন, বয়সের ভারে তাঁর চোখ ধূসর, কণ্ঠস্বর কর্কশ, কিন্তু বিশ্বাসের দৃঢ়তায় তাঁর কথা শোনার সময় কেউ অবিশ্বাস করতে পারল না। তিনি বললেন, “ব্রিটিশ আমলে এখানে ছিল এক গোরস্থান। নাম-পরিচয়হীন লাশ এনে এখানে কবর দেওয়া হতো। তখন রেললাইন বানানোর কাজ চলছিল। খাটাল, কলেরা, দুর্ভিক্ষ—কতশত মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল! যাদের কোনো আত্মীয় ছিল না, কিংবা যাদের দাফন করার জায়গা ছিল না, সেই সব মৃতদেহ এখানে এনে ফেলা হতো। রাতের অন্ধকারে সেপাইরা এসে লাশ নামিয়ে যেত, গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রেখে চলে যেত।”
রঘুনাথ মাঝির গলা যেন ভারী হয়ে উঠল, যেন অতীতের ছায়াগুলো তাঁর মনে জীবন্ত হয়ে উঠছে। তিনি বললেন, “আমি ছোট থাকতে আমার ঠাকুরদার মুখে এসব শুনেছি। তিনি বলতেন, রাত নামলেই লোকজন এই জায়গা এড়িয়ে যেত। বাতাস ভারী হয়ে যেত, যেন হাজারো নিঃশ্বাস জমাট বেঁধে আছে চারপাশে। গোরস্থানের ধার দিয়ে গেলে লোকজন কানে ফিসফিস আওয়াজ শুনত, কেউ যেন নাম ধরে ডাকছে। মাঝে মাঝে মাটির ভেতর থেকে হাহাকার উঠত, অথচ কোথাও কাউকে দেখা যেত না। গ্রামের পুরোনো মানুষরা বিশ্বাস করত, সেই লাশগুলোর আত্মা কখনো শান্তি পায়নি। তাদের পরিবার নেই, প্রার্থনা নেই, কবরের ওপর প্রদীপ জ্বালানোর কেউ নেই। তাই তারা রয়ে গেছে অভিশপ্ত আত্মা হয়ে।” তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যেখানে এতগুলো অশান্ত আত্মা শুয়ে আছে, সেই জায়গায় যদি কেউ মাটি খুঁড়ে লোহা পুঁতে, টাওয়ার তোলে, তবে তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন?” গ্রামবাসীরা একে অপরের দিকে তাকাল, যেন ভয় আরও গভীর হলো।
বৃদ্ধ লোকটির চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক দেখা গেল। তিনি স্মৃতির গহ্বর থেকে আরও অন্ধকার টেনে আনলেন। বললেন, “আমার ঠাকুরদা একবার বলেছিলেন, এই গোরস্থানের ধার ঘেঁষে এক সাহসী বালক রাতে গিয়েছিল। গ্রামের লোকেরা বলেছিল, ভূতের ভয়ে যেন না যায়। কিন্তু সে গিয়েছিল কৌতূহলবশত। পরদিন ভোরে লোকজন দেখল, সে মাঠের মধ্যে অচেতন পড়ে আছে। তার মুখে কোনো রঙ নেই, ঠোঁট নীলচে, চোখে আতঙ্ক জমাট বাঁধা। জ্ঞান ফেরার পর সে বলেছিল, সে শুনেছে শত শত কণ্ঠস্বর একসঙ্গে কাঁদছিল, কেউ যেন তার পা টেনে ধরছিল। সেদিনের পর সে আর স্বাভাবিক হতে পারেনি। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে জীবনের বাকি সময়টা অর্ধপাগল হয়ে কাটিয়েছিল।” রঘুনাথ মাঝি থেমে সবাইকে তাকালেন। তাঁর গলা ভারী হয়ে গেল, “এই গোরস্থান শুধু কবর নয়, এটা এক অভিশপ্ত মাটি। এই অভিশাপ যতদিন থাকবে, ততদিন এখানে শান্তি আসবে না।” লোকজন ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। কেউ কেউ চোখ মুছল, কেউ আবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন এক দম বন্ধ করা অন্ধকার তাদের বুকের ভেতর ঢুকে গেছে।
হঠাৎ করেই দূরে টাওয়ারের অর্ধনির্মিত কাঠামোর দিকে সবার চোখ গেল। লোহার দণ্ডগুলো চাঁদের আলোয় কেমন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। মনে হচ্ছিল, যেন সেই লোহার শরীর আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠছে, আর মাটির নিচে শুয়ে থাকা মৃতেরা ক্ষুব্ধ হয়ে কাঁপছে। রঘুনাথ মাঝি মৃদু কণ্ঠে বললেন, “এই টাওয়ারের নিচে শুধু তার আর লোহা নেই, এর নিচে আছে মৃতদের প্রতিশোধ। যতদিন এ জায়গায় হাত দেবে, তারা বারবার ফিরে আসবে।” গ্রামবাসীদের চোখেমুখে আতঙ্ক ঘনীভূত হলো। অনেকে বলল, “কাজ বন্ধ করো, না হলে অমঙ্গল হবে।” কিন্তু সমস্যাটা হলো—কাজ থামানো রাজীব ঘোষের হাতে নেই। তিনি কোম্পানির চাপের মধ্যে রয়েছেন। আর কোম্পানি তো এসব বিশ্বাস করে না। তাই গ্রামের মানুষ ভয়ে দিন গুনতে থাকল, আর প্রত্যেক রাতে বাতাসে শোনা যেতে লাগল অদ্ভুত কান্নার সুর—যেন শত শত অচেনা কণ্ঠে বলা হচ্ছে, “আমাদের কবর অক্ষত রেখো… আমাদের কবর অক্ষত রেখো…”
ছয়
গ্রামজুড়ে ভয়ের ঢেউ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল। প্রথমে কয়েকজন কিশোরী মৃত নন্দিনীর কণ্ঠ শুনেছে বলে দাবি করেছিল, পরে আরও কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা একই অভিজ্ঞতার কথা জানাতে লাগল। কেউ শুনল তার বহু বছর আগে মারা যাওয়া দাদার কণ্ঠস্বর—“এই জায়গায় কেউ শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না।” কারও ফোনে ভেসে এল সদ্য মৃত এক আত্মীয়ের কান্না, যেন কবর থেকে ওঠা সুর। দিন যত যাচ্ছিল, ভয় তত বাড়ছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা, এগুলো ঘটছিল নির্দিষ্ট সময়ের পর—গভীর রাতে, যখন চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কেউ রাতের বেলা ফোন বেজে উঠলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছিল। গ্রামের মহিলারা বলতে লাগল, “এই টাওয়ার অশুভ। এটাকে ভেঙে ফেলো, না হলে গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে।” ভয়ে অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও ভাবছিল। অভিযোগের ঝড় উঠল। অবশেষে গ্রামের কয়েকজন সাহসী মানুষ একত্রিত হয়ে থানায় খবর দিল। পুলিশের কাছে জানানো হলো—মোবাইল ফোনে মৃত মানুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, আর এর জন্য দায়ী সেই নতুন টাওয়ার।
থানা থেকে প্রথমে খবরটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অফিসাররা হেসে বলল, “গ্রামীণ কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। আজকাল ভূতের গল্প শোনে কে?” কিন্তু গ্রামের মানুষের বারবার অনুরোধে অবশেষে দায়িত্ব দেওয়া হলো ইন্সপেক্টর তপন সেনকে। তিনি ছিলেন শহুরে মানসিকতার এক কঠোর মানুষ। ভূতপ্রেতের গল্প শুনলে রাগে গর্জে উঠতেন—“সব বাজে বকওয়াস! কুসংস্কারের জন্যই দেশ পিছিয়ে আছে।” তাই যখন তাঁকে বলা হলো টাওয়ারের ভয়ংকর গল্প তদন্ত করতে হবে, তিনি মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলেন, “দেখব একবার। এসব গুজব ছড়িয়ে যারা ভীতি সৃষ্টি করছে, তাদের পাকড়াও করব।” পরদিন বিকেলে তিনি গ্রামে পৌঁছলেন। গ্রামের লোকজন তাঁকে ঘিরে ধরল। ভয়ে ভরা চোখে সবাই বলল, “স্যার, ফোন বাজলেই মৃতদের কণ্ঠ পাওয়া যায়। আমরা শান্তিতে নেই।” তপন সেন ব্যঙ্গ করে হেসে ফেললেন, “ফোনের নেটওয়ার্ক গোলমাল হলে তোমরা ভূত দেখতে পাচ্ছো! এসব কুসংস্কার মনে থেকে ঝেড়ে ফেলো।” তিনি রাজীব ঘোষের সঙ্গেও দেখা করলেন। রাজীব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “স্যার, এরা গুজব ছড়াচ্ছে। আমি প্রতিদিন শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছি। আপনারা চাইলে ফোন টেস্ট করতে পারেন, কিছুই পাবেন না।” তপন মাথা নেড়ে বললেন, “আমি নিজে দেখব।”
সেদিন রাতে গ্রাম পরিদর্শনের পর তিনি থানায় ফিরে এলেন। ভেবেছিলেন, অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু রাত গভীর হলে পরিস্থিতি অন্য রূপ নিল। থানার মধ্যে সবার ফোন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, তবুও হঠাৎ করেই থানার পুরনো ডেস্কটপ ফোনটি বাজতে শুরু করল। গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে ফোনের রিংটোন যেন গর্জন তুলল। তপন সেন নিজেই এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুললেন। ওপাশে প্রথমে এক অদ্ভুত শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা গেল, তারপর কর্কশ, গম্ভীর কণ্ঠ—“আমার ঘুম ভাঙিও না… এখানে টাওয়ার বসিও না।” ইন্সপেক্টরের শরীর মুহূর্তের জন্য জমে গেল। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, যা শুনছেন তা বাস্তব কি না। আরও কয়েক সেকেন্ড পর স্পষ্ট কণ্ঠে ভেসে এল—“আমি ওই কয়েদি, যাকে তোরাই মেরেছিলি। এই থানার সেলে আমি মরেছিলাম।” কথা শেষ হতেই ফোন লাইন কেটে গেল। এক মুহূর্তের জন্য থানার ভেতর নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ল, তারপর বাতাসে যেন একটা শীতল স্রোত বইতে লাগল। উপস্থিত কনস্টেবলরা ভয়ে থরথর কাঁপতে শুরু করল। তারা চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে তাকাল ইন্সপেক্টরের দিকে।
তপন সেন সাধারণত শক্ত মানুষ ছিলেন, ভয় বলে কিছু চিনতেন না। কিন্তু এবার তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর থেকে রক্ত সরে যাচ্ছে। তিনি চেষ্টা করলেন দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে, কিন্তু কণ্ঠ কাঁপছিল। ধীরে ধীরে বললেন, “এটা নেটওয়ার্ক গ্লিচ হতে পারে… হ্যাঁ, তাই।” অথচ ভেতরে ভেতরে তিনি অনুভব করছিলেন, এ শুধু প্রযুক্তির গোলমাল নয়। সেই কণ্ঠ ছিল অতি পরিচিত। বহু বছর আগে থানায় ঘটে যাওয়া এক ঘটনার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল—এক কয়েদি সত্যিই মারা গিয়েছিল, হেফাজতে থাকার সময়। অফিসিয়াল রিপোর্টে বলা হয়েছিল, অসুস্থতার জন্য মৃত্যু, কিন্তু গ্রামে গুঞ্জন ছিল, পুলিশের অত্যাচারে সে মারা যায়। তপন হঠাৎ উপলব্ধি করলেন, সেই অশান্ত আত্মার কণ্ঠই তিনি শুনেছেন। আতঙ্ক তাঁর কঠোর মনকেও কাঁপিয়ে দিল। বাইরে তখন ঝড়ো বাতাস বইছিল, থানার জানলার কাচ কাঁপছিল, আর গ্রামের দিকে টাওয়ার অন্ধকার আকাশের বুক চিরে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন মৃতদের প্রতিশোধের প্রতীক হয়ে। সেই মুহূর্তে তপন বুঝলেন, গ্রামবাসীদের ভয় হয়তো এতটা ভিত্তিহীন নয়। আতঙ্ক ধীরে ধীরে শুধু গ্রামেই নয়, এখন পুলিশের মনেও জায়গা করে নিচ্ছে।
সাত
অমল দত্ত ছিলেন গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষদের একজন। তিনি স্কুলের শিক্ষক, পড়াশোনায় যুক্তিবাদী এবং গ্রামের কুসংস্কার দূর করতে বহুবার নানা সভায় বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর কাছে ভূতপ্রেত, আত্মা বা অভিশাপ সবই ছিল অজ্ঞতা ও অন্ধকারের প্রতীক। যখন প্রথম গ্রামে গুজব উঠল যে টাওয়ার বসানোর পর থেকে মৃত মানুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, অমল সবার সামনে দাঁড়িয়ে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “মৃতরা ফিরে আসে না। এসব কণ্ঠস্বর শুধুই নেটওয়ার্কের সমস্যা। ভয় পাওয়া মানেই নিজেদের দুর্বল করা।” কিন্তু ধীরে ধীরে গ্রামের ভেতর যখন আতঙ্ক বাড়তে লাগল, তখন তাঁর বক্তব্য আর মানুষের মধ্যে কোনো স্বস্তি আনতে পারল না। মানুষ তাঁকেই প্রশ্ন করতে লাগল, “স্যার, আপনি বলেছিলেন ভয় নেই, কিন্তু আমাদের ফোনে তো কণ্ঠ আসছে!” অমল বিরক্ত হতেন, কিন্তু নিজের মনে একটা দৃঢ়তা রেখেছিলেন—এইসব কেবলই মানুষের কল্পনা। কিন্তু সেই বিশ্বাস ভেঙে পড়ল এক গভীর রাতে, যখন তাঁর নিজের জীবনে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নেমে এলো।
সেদিন রাতটা ছিল আশ্চর্য নীরব। বাইরে পূর্ণিমার আলোয় গ্রাম ঝলমল করছিল। স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, বাড়ি নিস্তব্ধ। হঠাৎ করে অমলের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তিনি ঘুম ভাঙা চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকালেন। নম্বরটি অচেনা, তবু কোনো অদ্ভুত কারণে তাঁর হাত কাঁপছিল। ফোন ধরার পর প্রথমে ভেসে এল শূন্যতার শব্দ—মৃদু বাতাসের মতো, যেন ফোন লাইনের ভেতরে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। তারপর ধীরে ধীরে এক ক্ষীণ কণ্ঠ উচ্চারিত হলো—“স্যার… আপনি শুনতে পাচ্ছেন?” অমল প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো কোনো দুষ্টুমি। কিন্তু কণ্ঠস্বর যত স্পষ্ট হতে লাগল, তাঁর বুকের ভেতর ঠান্ডা হয়ে গেল। সেই কণ্ঠ একেবারেই পরিচিত। বছর দুয়েক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া তাঁর প্রাক্তন ছাত্রী, শ্রাবণীর কণ্ঠ ছিল সেটা। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, “কে? শ্রাবণী, তুমি?” ওপাশ থেকে আসল উত্তর, “হ্যাঁ স্যার… আমি ফিরতে চাই… আমার কবর চাপা পড়েছে… আলো দেখতে চাই।” এক মুহূর্তে অমলের সমস্ত যুক্তি ভেঙে গেল। তাঁর চোখে ভেসে উঠল সেই উজ্জ্বল মেয়েটির মুখ, যে একসময় ক্লাসে প্রাণবন্ত হয়ে পড়াশোনা করত, আর হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনা তাঁকে গ্রাস করেছিল।
অমলের শরীর ঘামে ভিজে গেল। তিনি ফোন শক্ত করে ধরে বসে রইলেন, কিন্তু আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। কণ্ঠস্বর আরও কেঁপে উঠল, যেন কবরের ভেতর থেকে আসছে—“স্যার… টাওয়ারটা আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে… আমরা শান্তি পাচ্ছি না।” তারপর লাইন কেটে গেল। ফোনের স্ক্রিন আবার অন্ধকার হয়ে গেল। ঘরে এক ভয়ার্ত নীরবতা নেমে এল। অমল বসে রইলেন স্তব্ধ হয়ে। এতদিন তিনি যেটাকে মিথ্যে ভেবেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা আজ তাঁকে কাঁপিয়ে দিল। যুক্তি, বিজ্ঞান, সব যেন অর্থহীন মনে হলো তাঁর কাছে। তিনি বিছানায় শুতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ঘুম এলো না। মনে হচ্ছিল, চারপাশে অসংখ্য অদৃশ্য চোখ তাঁকে তাকিয়ে দেখছে। জানলার বাইরে বাতাসে হাহাকার বয়ে যাচ্ছিল, যেন মৃতেরা সত্যিই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। রাতের অন্ধকারে তিনি প্রথমবার অনুভব করলেন, গ্রামবাসীদের ভয় কোনো কল্পনা নয়। তাঁর নিজের ছাত্রীর আত্মাই যেন তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে গেল—এই টাওয়ার মৃত্যুর ঘুম ভাঙাচ্ছে।
পরদিন সকালে অমলের চেহারা বদলে গিয়েছিল। চোখ লাল, মুখ ফ্যাকাসে। তিনি স্কুলে গেলেন বটে, কিন্তু আর স্বাভাবিকভাবে পড়াতে পারলেন না। সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? তিনি কিছু বলতে পারলেন না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক ভয়াবহ সত্য তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তিনি জানতেন, এ অভিজ্ঞতা তিনি আর কারও সামনে হাস্যকরভাবে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। সেদিন সন্ধ্যায় যখন কয়েকজন গ্রামবাসী তাঁর কাছে এল ভয়ে ভরা চোখে, তাঁরা বলল, “স্যার, আপনি তো বলেছিলেন এসব গুজব… কিন্তু এখন?” অমল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “না… এটা গুজব নয়। আমি নিজে শুনেছি।” গ্রামের লোকেরা বিস্মিত হয়ে গেল। যে মানুষ এতদিন বিজ্ঞানের কথা বলে তাদের ভয়কে মিথ্যে বলে আসছিলেন, তিনিই আজ বলছেন, এটা সত্যি। সেই মুহূর্ত থেকে অমলের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন শুরু হলো। তিনি শুধু যুক্তিবাদী শিক্ষক নন, এখন তিনিও গ্রামবাসীদের ভয়ের সঙ্গী হয়ে উঠলেন। তাঁর বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল, আর সেই ভাঙা বিশ্বাসের জায়গা নিয়েছিল এক গভীর আতঙ্ক—যেটা এখন পুরো গ্রামকে গ্রাস করতে চলেছে।
আট
রাজীব ঘোষ কখনোই অলৌকিক শক্তি বা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ছিলেন আধুনিক প্রযুক্তির এক নিবেদিত কর্মী, যিনি মনে করতেন—নেটওয়ার্ক, সিগনাল, সার্ভার—এসবই মানুষের জীবন সহজ করে তোলে, ভয়ের কোনো স্থান নেই। কিন্তু গ্রামের অদ্ভুত ঘটনাগুলো, বারবার মানুষের ফোনে মৃতদের কণ্ঠ ভেসে ওঠা, এমনকি ইন্সপেক্টর তপন সেনের স্তম্ভিত মুখ দেখে ফেরার পর থেকে তাঁর মনেও অস্বস্তি জন্মেছিল। কোম্পানির হেড অফিস থেকে চাপ আসছিল—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাওয়ার চালু করতে হবে, কোনো গুজব ছড়াতে দেওয়া যাবে না। তবু রাজীবের মনে প্রশ্ন জন্মাল, “এই ভয়গুলো কি কেবল গ্রামীণ কুসংস্কার? নাকি সত্যিই এর পেছনে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে?” সেই প্রশ্ন তাঁকে এক অস্থির কৌতূহলে ঠেলে দিল। এক সন্ধ্যায় তিনি কোম্পানির পাঠানো নথিগুলো আবার খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন। টেবিলের ওপর ল্যাপটপ খোলা, চারপাশে কাগজপত্র ছড়িয়ে, আর জানলার বাইরে নিস্তব্ধ অন্ধকার।
প্রথমদিকে সব কিছু স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। জমির মালিকানা, অনুমোদন, গ্রাম পঞ্চায়েতের সই—সব কিছু ঠিকঠাক। কিন্তু গভীর রাতে হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে তাঁর চোখ আটকে গেল। জমির পুরোনো নথির কপি, যা অফিস থেকে আনা হয়েছিল, সেখানে এক অদ্ভুত ফাঁকফোকর দেখা গেল। জমির যে প্লট নম্বর টাওয়ার বসানোর জন্য নেওয়া হয়েছিল, সেটার পাশেই একটি ক্ষুদ্র মন্তব্য লেখা—“Non-Residential, Past Usage: Burial Ground (record archived).” রাজীব আঁতকে উঠলেন। এর মানে, এই জমি আগে কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু হেড অফিস থেকে পাঠানো চূড়ান্ত অনুমোদনের কাগজে এই তথ্যটি ছিল না। সেটি গোপন করা হয়েছিল। রাজীব হৃৎকম্পিত হয়ে সমস্ত ফাইল একসাথে মিলিয়ে দেখতে লাগলেন। তাঁর সামনে স্পষ্ট হলো—কোম্পানি ইচ্ছাকৃতভাবে আসল তথ্য লুকিয়ে রেখেছে, কারণ কবরস্থানের জমিতে টাওয়ার বসানোর অনুমতি কখনো মিলত না। সব কিছু লুকিয়ে কাজ এগোনো হয়েছে।
রাজীবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। তাঁর চোখে ভেসে উঠল গ্রামের মানুষদের আতঙ্কিত মুখ, রঘুনাথ মাঝির সতর্কবাণী, অমল দত্তের আকস্মিক বদল। তিনি বুঝলেন, এতদিন ধরে যা কুসংস্কার ভেবে অবহেলা করা হচ্ছিল, তার আসলে এক নির্মম সত্যি আছে। সত্যিই এই জায়গাটা ছিল এক কবরস্থান, যেখানে বহু অচেনা মৃতদেহ শায়িত। হয়তো সেখানকার আত্মারাই অশান্ত হয়ে উঠেছে, তাদের ঘুম ভাঙানো হয়েছে। রাজীব কপালে হাত চাপড়ালেন। তিনি ভাবলেন, “আমি তো জানতামই না… আমি যদি জানতাম, তাহলে হয়তো শুরুতেই বাধা দিতাম।” কিন্তু মনের ভেতর আরেকটা কণ্ঠ বলল—“তুমি তো কোম্পানির চাকুরে, তোমার কাজ শুধু নির্দেশ মেনে চলা। কিন্তু এখন তুমি জানো, আর জানার পর চুপ করে থাকা অপরাধ।” সেই রাতে তিনি এক মুহূর্তও ঘুমোতে পারলেন না। ঘরের চারপাশের অন্ধকার যেন তাকে চেপে ধরছিল।
ভোর হওয়ার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সত্যকে লুকিয়ে রাখা আর সম্ভব নয়। গ্রামবাসীদের সামনে এই তথ্য প্রকাশ করতেই হবে। হয়তো চাকরি যাবে, হয়তো শাস্তি আসবে, কিন্তু নীরব থাকা মানে মৃত্যুর ওপরে দাঁড় করানো এই টাওয়ারের সঙ্গী হওয়া। জানলার বাইরে তখন গ্রামের ওপর ধূসর আলো ফুটছিল, দূরে অর্ধেক তৈরি টাওয়ার দাঁড়িয়ে যেন মৃতদের আর্তনাদের প্রতীক হয়ে। রাজীব মনে মনে বললেন, “আমি সত্যিটা জানাবো। যাদের কবরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই লোহা-পাথরের দানব, তাদের আত্মা শান্তি না পাওয়া পর্যন্ত আমিও শান্তি পাবো না।” তিনি জানতেন, এই পদক্ষেপ তাঁকে বিপদে ফেলবে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি তাঁকে এগিয়ে নিয়ে চলল। সত্য উন্মোচনের পথে দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন—এখন আর এটা শুধু চাকরি বা টাওয়ারের প্রশ্ন নয়, এটা জীবিত আর মৃতের মধ্যে এক অদৃশ্য লড়াই, যেখানে তাঁর দায়িত্ব হলো অন্ধকারের পর্দা সরানো।
নয়
টাওয়ারের কাজ শেষ হতেই এক ভোরবেলা পুরো গ্রাম বিদ্যুতের মতো চমকে উঠল। আকাশের গায়ে যেন বিশাল ধাতব দৈত্য দাঁড়িয়ে আছে, তার অ্যান্টেনা থেকে মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কোম্পানির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো—আজ থেকে গ্রামে 5G নেটওয়ার্ক চালু। প্রথমে সবাই কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। অনেকে মোবাইলে ইউটিউব চালাল, কেউ ভিডিও কল করল, নেটওয়ার্ক আগের চেয়ে কত দ্রুত কাজ করছে তা দেখে গ্রামবাসীরা বিস্মিত হলো। কিন্তু সেই বিস্ময় স্থায়ী হলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই ভয়ঙ্কর পরিবর্তন শুরু হলো। হঠাৎ করে বহু মানুষের ফোন থেকে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে উঠতে লাগল। কারও ফোনে শোনা গেল বাচ্চার কান্না, কারও ফোনে মৃত স্বজনের কণ্ঠ, আবার কোথাও কোথাও কবরের ভেতর থেকে আসা গম্ভীর হাহাকার। এমনকি যখন নেটওয়ার্কের কল একেবারেই না থাকা উচিত, তখনও ফোনে বেজে উঠত অচেনা নম্বর, আর ওপাশে শোনা যেত মৃতদের ফিসফিসানি—“আমাদের ঘুম ভাঙিও না…”
গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। অমল দত্ত, যিনি আগেই নিজের ছাত্রীর কণ্ঠ শুনে বদলে গিয়েছিলেন, এবার নিজেই ছুটে বেরোতে লাগলেন বাড়ি বাড়ি। প্রত্যেকেই একই অভিযোগ করছেন—তাদের মৃত আত্মীয়রা ফোনে ফিরে আসছে। কারও দাদী বলছেন, “আমার দেহ মাটিতে শান্তি পাচ্ছে না।” কারও ভাই বলছে, “টাওয়ারের আলো আমাদের দগ্ধ করছে।” রাজীব ঘোষ গ্রামবাসীদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন—“হয়তো এটা নেটওয়ার্কের গোলমাল, টাওয়ার নতুন, তাই এমন হচ্ছে।” কিন্তু তাঁর নিজের কণ্ঠে আর দৃঢ়তা ছিল না। কারণ সেও জানত, এই জমি ছিল কবরস্থান, আর এই সব কণ্ঠস্বর কেবল বিভ্রান্তি নয়, এরা অস্থির আত্মারা, যারা প্রযুক্তির তারে ভর করে ফিরে আসছে। রাত যত গড়াচ্ছিল, ফোনগুলো থেকে তত অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছিল। কখনও শোনা যেত চিৎকার, কখনও আবার শ্বাসরোধ হওয়া মানুষের দীর্ঘশ্বাস। মানুষ ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল, যেন গোটা গ্রাম এক দুঃস্বপ্নে আটকা পড়েছে।
ইন্সপেক্টর তপন সেন, যিনি তদন্ত করতে এসেছিলেন, তিনিও এবার ভয় পেয়ে গেলেন। থানার ভেতরে রাতের বেলায় তাঁর ফোনে ভেসে এলো এক কয়েদির কণ্ঠ, যে কয়েক মাস আগে জেলে মারা গিয়েছিল। কণ্ঠটি বলছিল, “আমি মুক্তি চাই… কিন্তু এই টাওয়ার আমার পথ আটকে দিয়েছে।” তপন কাঁপা হাতে ফোন ছুঁড়ে ফেললেন। পরদিন সকালে তিনি প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন, “এটা আর সাধারণ সমস্যা নয়। এখানে এমন কিছু ঘটছে, যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।” গ্রামবাসীরা উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারা দল বেঁধে পঞ্চায়েত অফিসের সামনে জমা হলো। সবার দাবি একটাই—“টাওয়ার ভাঙো! আমাদের মৃতেরা শান্তি পাচ্ছে না।” মহিলারা হাহাকার করে কাঁদতে লাগল, পুরুষেরা মুষ্টি উঁচিয়ে চিৎকার করতে লাগল। কেউ কেউ টাওয়ারে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিল। গ্রামের চারপাশে যেন ভয় আর ক্রোধের মিলিত ঝড় বয়ে গেল।
রাজীব দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। তাঁর মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল—একদিকে চাকরির দায়িত্ব, অন্যদিকে মানুষের অস্থিরতা আর মৃতদের প্রতিশোধের ছায়া। রাতের অন্ধকারে টাওয়ারকে তাঁর কাছে আর প্রযুক্তির প্রতীক মনে হলো না, মনে হলো বিশাল এক অশুভ ছায়া, যে মৃতদের আত্মা বন্দি করে রেখেছে। প্রতিটি ফোনের ভেতর দিয়ে যে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে, তা কেবল শব্দ নয়, বরং অজানা ক্রোধ, অজানা অভিশাপের বহিঃপ্রকাশ। গ্রামবাসীরা যেভাবে আতঙ্কে একত্রিত হচ্ছে, তা দেখে তাঁরও মনে হলো—টাওয়ার ভাঙা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু কোম্পানি যদি বাধা দেয়? যদি তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়? তবু ভেতরে ভেতরে তিনি জানলেন, সত্য আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। ছায়ারা এখন প্রতিশোধ চাইছে। আর এই প্রতিশোধের ভার বহন করতে পারবে না শুধু গ্রাম, ধ্বংসের স্রোত একদিন বাইরে গিয়েও ছড়িয়ে পড়বে। রাজীব ঠোঁট কামড়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন—যেভাবেই হোক, এই মৃত্যুর টাওয়ার ভেঙে ফেলতে হবে, নাহলে কারও মুক্তি হবে না।
দশ
সেই রাতটিকে কেউ কোনোদিন ভুলতে পারবে না। আষাঢ়ের কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গিয়েছিল, বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা নেমে এসেছিল। গ্রামজুড়ে তখন বিদ্যুতের আলো টিমটিম করছে, টাওয়ারটা দূর থেকে ধূসর ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। লোকেরা জানত, কিছু একটা ঘটবেই—গ্রামজুড়ে মৃত্যুর আর্তনাদ, ফোনে মৃতদের কণ্ঠস্বর, আর দিনকে দিন বেড়ে চলা অস্থিরতা এক অসহনীয় চাপ তৈরি করেছিল। সেই চাপ যেন আকাশও টের পেল। রাত গভীর হতে না হতেই হঠাৎ করে এক ঝটকায় শুরু হলো ঝড়। বাতাসে হু হু শব্দ, তালগাছ দুলে উঠছে, বাড়ির চাল উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। গ্রামের সবাই মাটিতে বসে প্রার্থনা করতে লাগল। ঠিক সেই সময়, টাওয়ারের মাথায় এক মহা বজ্রপাত আঘাত করল। প্রচণ্ড শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল, আর মুহূর্তেই টাওয়ারের অ্যান্টেনা থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়ল। মাটির নিচ থেকে যেন হাহাকারের ঢেউ উঠে আকাশ ভরিয়ে দিল।
বজ্রাঘাতের পর পুরো গ্রাম অন্ধকারে ডুবে গেল। বিদ্যুৎ চলে গেল, ফোনের নেটওয়ার্ক হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল—“টাওয়ার শেষ! আত্মারা শান্তি পেল!” মহিলারা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে উঠল, পুরুষেরা সশব্দে শঙ্খ বাজাতে লাগল, কেউ কেউ ধূপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করল। রঘুনাথ মাঝি অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন, “ওরা মুক্তি পেল… অবশেষে এই মাটির আত্মারা শান্তি পেল।” সত্যিই সবার ফোন হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। যেসব ফোন এতদিন ধরে ভয়ঙ্কর কণ্ঠে ভরে উঠত, সেগুলো এখন কেবল অন্ধকার স্ক্রিন হয়ে পড়ে আছে। রাজীব ঘোষ দম নিতে পারছিলেন না, তাঁর বুক থেকে যেন পাহাড় নেমে গেল। এতদিনের অপরাধবোধ, চাপা আতঙ্ক—সব মিলিয়ে তিনি ভাবলেন, অবশেষে হয়তো সব শেষ হলো। অমল দত্তও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ছাত্রীর কণ্ঠ আর শুনতে হবে না। মনে হলো—গ্রামটা আবার বাঁচল।
কিন্তু রাত তখনও শেষ হয়নি। বাইরে ঝড় থেমে এলেও অদ্ভুত নীরবতা গ্রামকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মাটির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শুকনো পাতার মতো মানুষের হৃদয়ও তখন কাঁপছিল। গ্রামের লোকেরা বাড়ির ভেতরে ফিরতে শুরু করল, কেউ কেউ খাটে শুয়ে প্রার্থনা করতে লাগল, আবার কেউ ক্লান্ত শরীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। অমল দত্ত জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর ভেতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি জন্মেছিল, যেন একটা দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের শেষ দেখেছেন। কিন্তু সেই প্রশান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ তাঁর টেবিলে রাখা পুরোনো ফোনটা কেঁপে উঠল। শব্দটা স্পষ্ট, ফোনটা বেজে চলেছে। অমল হতবাক হয়ে তাকালেন—নেটওয়ার্ক তো নেই, বিদ্যুতও নেই, তবু ফোন কিভাবে বাজছে? বুকের ভেতর এক অজানা শীতল স্রোত বয়ে গেল। ধীরে ধীরে কাঁপা হাতে তিনি ফোনটা কানে তুললেন।
ওপাশে যে কণ্ঠ ভেসে এল, সেটি পরিচিত। মৃত নন্দিনীর কণ্ঠ, স্পষ্ট আর শীতল—“স্যার… আমরা এখনো এখানে আছি…” কথাটা শেষ হতেই যেন চারপাশের অন্ধকার ঘন হয়ে এলো। অমলের হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। তাঁর কানে তখন শুধু সেই ফিসফিসানি—মৃত আত্মাদের অনন্ত উপস্থিতির ঘোষণা। বাইরে ঝড় থেমে গিয়েছিল, কিন্তু ভিতরের ঝড় আর থামল না। গ্রামবাসীরা হয়তো ভেবেছিল, বজ্রপাত সব শেষ করে দিয়েছে, আত্মারা শান্তি পেয়েছে। কিন্তু আসলে টাওয়ারের ছায়া তখনও বিরাজমান, কবরের নিচে শায়িত আত্মারা তখনও অস্থির, আর নন্দিনীর কণ্ঠ ছিল সেই অস্থিরতার প্রমাণ। অমল ঠায় বসে রইলেন, মনে হলো তাঁর বুকের ভেতর জমে থাকা ভয় যেন রক্তে মিশে গেছে। সেই মুহূর্তে তিনি বুঝলেন—এ লড়াই শেষ হয়নি, টাওয়ার ভেঙে গেলেও ছায়ারা থেকে যাবে, আর প্রযুক্তির তারে ভর করে তাদের কণ্ঠ ফিরে আসতে থাকবে। গ্রামের রাতটা নীরবতায় আচ্ছন্ন হলেও, ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই অনুভব করল—মৃতরা এখনো এই মাটিতেই আছে, তারা শুধু অপেক্ষা করছে পরের আহ্বানের জন্য।
সমাপ্ত