১
জুন মাসের ঘন ঘোর দুপুরে শহরের গলিপথে হেঁটে আসছিল সৌভিক নন্দী। দক্ষিণ কলকাতার গলিগুলো বর্ষার ভিজে গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে, আর তার চোখ আটকে ছিল ছোট্ট একটা ইলেকট্রনিক্স দোকানে। ‘গ্লোবাল টেক রিপেয়ারিং’—দোকানটা যতটা আধুনিক নামধারী, ভেতরটা ঠিক ততটাই বেসামাল। পুরনো হার্ডডিস্ক, চার্জার, ক্যাবল, হারিয়ে যাওয়া মেমোরি কার্ডের দল স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। দোকানের মালিক সৌরভ, যাকে সকলে ‘সনি দা’ বলে চেনে, হাসিমুখে বলল—”দেখো তো ভাই, এই ৬৪ জিবির পুরনো মেমোরি কার্ডটা কাজে লাগে কিনা, দাম নেবে না বেশি।” কৌতূহলবশতই সৌভিক সেটা তুলে নেয়। ক্যামেরা বা ফোন নয়, ভিডিও ফুটেজ এডিট করা আর রিকভার করাই এখন তার কাজ, আর পুরনো ডেটার মধ্যে গেম চেঞ্জার জিনিস মেলে বলে তার অভিজ্ঞতা। বাড়ি ফিরে এসে সে কাজের ফোল্ডারে বসে সেই মেমোরি কার্ডটা রিডারে ঢুকিয়ে দিল, আর জীবনটা বদলে গেল।
মেমোরি কার্ডে থাকা ভিডিও ফোল্ডার খুলতেই চমকে উঠল সে। মোট চারটি ভিডিও ফাইল, তার মধ্যে একটির নাম “June13_finalcut.mp4″—দিনটা মাথায় গেঁথে গেল। ভিডিও চালু হতেই আঁধার ঘেরা করিডোরের দৃশ্য ফুটে উঠল মনিটরে। কোনো সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ, কিন্তু ভয়ানক স্পষ্ট। একজন লোক ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, মুখে টুপি, গলায় হুডি। তারপর সে আচমকা পিছন থেকে এক যুবককে আক্রমণ করে, গলা টিপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। ক্যামেরা ফ্রেমের বাইরে চলে গেলেও হাতের নড়াচড়ায় বোঝা যাচ্ছিল—লোকটি ছটফট করছে মৃত্যুর আগে। ভিডিওর শেষ দিকে আক্রমণকারী মুখ তুলে তাকায় ক্যামেরার দিকে—আর সে মুহূর্তেই সৌভিক নিজের বুক ঠাণ্ডা হয়ে যেতে দেখে। কারণ স্ক্রিনে যে মুখটা সে দেখল, সেটা তার নিজের। অবিকল, একদম নিজের মুখ—মনে হলো যেন আয়নায় তাকিয়ে আছে। চোখ, চোয়াল, ভ্রু, মুখভঙ্গি—সব কিছুই এক। ভিডিও থামিয়ে সে ফ্রেম ধরে ধরে মিলিয়ে দেখে—এটা কোনো ফেক নয়, না কোনো ডিজিটাল ডিপফেক। মনে মনে বলে ওঠে—”এইটা আমি না, আমি করিনি এটা, কোনোদিন না!”
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সৌভিক। তার সমস্ত স্মৃতি, নিজের গত এক মাসের প্রতিটি দিন মনে করার চেষ্টা করে—কোথাও কি এই রকম কিছু ঘটেছে? সে কি এই জায়গায় গিয়েছিল? সে কি কারও সঙ্গে এমন মারপিট করেছে? কোনোকিছুই মনে পড়ে না, কারণ এমন কিছু ঘটেইনি। কিন্তু ভিডিওর টাইমস্ট্যাম্প অনুযায়ী, ১৩ জুন রাত ২:১৪ মিনিটে ঘটেছে এই খুন—মাত্র ১৭ দিন আগের কথা। পুলিশে যাবার চিন্তা করলেও গা ছমছমে ভয় এসে চেপে ধরে তাকে। যদি কেউ ভিডিওটা ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ বানায়? যদি সে নিজেও কোনোভাবে কিছু ভুলে গিয়ে এই কাজ করে থাকে? একবার তার স্মৃতিশক্তি কিছুদিনের জন্য ব্ল্যাঙ্ক হয়েছিল, কলেজে পড়ার সময়—হঠাৎ একদিন কীভাবে যে সে পৌঁছে গিয়েছিল বারাসাত, কিছুই মনে ছিল না। সেই পুরনো স্মৃতিই যেন তাকে আবার তাড়া করতে থাকে। সে রাতটা কাটে না, চোখের পাতা একটুও পড়ে না। বারবার ভিডিও চালিয়ে দেখে, নিজেকে দেখে, সন্দেহ করে, গলা শুকিয়ে যায়।
পরদিন সকালে সৌভিক সোজা পৌঁছায় প্রিয়াংকা মুখার্জীর বাসায়—তার পুরনো বান্ধবী, আজকাল ক্রাইম ভিডিও ব্লগিং আর ইউটিউবে কেস রিভিউ করে খুব পরিচিত। মুখোমুখি দেখা হয়নি অনেকদিন, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে। প্রিয়াংকা প্রথমে ঠাট্টা করে, “এই ভিডিওটা কোনো শর্টফিল্ম নাকি?” কিন্তু যখন শেষ ফ্রেমটা আসে, তার চোখও স্থির হয়ে যায়। “তুই…?” প্রশ্নটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সৌভিক তার গলায় কান্না চাপা দিয়ে বলে—”এই আমি না… কিন্তু ওটা আমি!” দুজনে মিলে ভিডিওটি মনোযোগ দিয়ে দেখে। প্রিয়াংকা বলে, ভিডিওটা সিসিটিভি হলেও ফুটেজে অদ্ভুত ধরনের ‘গ্লিচ’ রয়েছে—রং কিছুটা তীব্র, ফ্রেমরেট কেমন যেন অনিয়মিত। এমন কিছু ইফেক্ট সাধারণত মানুষের মস্তিষ্ক থেকে ‘রিকনস্ট্রাক্টেড ভিজুয়াল’-এ দেখা যায়, যেমনটা নিউরো-মেমরি রিসার্চে হয়। কথাটা শুনে সৌভিক আরও অবাক—এই ভিডিও কি কারও মস্তিষ্ক থেকে বের হয়েছে? নাকি—তার? প্রশ্নের উত্তর সে জানে না, কিন্তু এটাই পরিষ্কার—মেমোরি কার্ডটা শুধু পুরনো ডেটা নয়, তার জীবনকেই বদলে দেওয়ার জন্য এসেছে।
২
বাড়ি ফিরে আসার পর সৌভিক নিজের ঘরটাকে অপরিচিত ঠেকতে লাগল। প্রতিদিন যেখানে বসে ভিডিও এডিট করত, সেই ডেস্ক, মনিটর, ল্যাম্প—সব কিছু যেন আজ একটা অদ্ভুত নিরবতা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভিডিওটা মাথা থেকে কিছুতেই সরছে না। বারবার চোখে ভাসছে নিজের মুখ—কিন্তু সে জানে, ওই মুহূর্তে সে কোথাও ছিল না। কিন্তু যদি ছিল? যদি তার স্মৃতিতেই গণ্ডগোল থাকে? যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তার মস্তিষ্কে ভুল স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়? সে নিজের পুরনো কল রেকর্ড, লোকেশন হিস্ট্রি, গুগল টাইমলাইন সব খুঁজতে থাকে। ১৩ জুন, রাত ২টা—তখন সে কোথায় ছিল? খুঁজে পায় সে তার ল্যাপটপে একটা পুরনো ড্রাইভ ব্যাকআপ চালাচ্ছিল, তার লগইন সময় সেই রাতের। কিন্তু সেটাও কি ভুয়ো হতে পারে? সত্যি বলতে, সে নিজেই নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। একের পর এক সন্দেহ তাকে পেঁচিয়ে ধরছে। হঠাৎ একটা প্রশ্ন মাথায় আসে—ভিডিওটা যদি অন্য কারও স্মৃতি হয়? অথবা যদি এটা এক ধরণের সিমুলেশন হয়, যা তৈরি করা হয়েছে তার চেহারায়? ডিপফেক প্রযুক্তি সে চেনে, এমন ভিডিও বানানো অসম্ভব নয়, কিন্তু এই ভিডিওতে এমন কিছু সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি আছে—যা কেবলমাত্র নিজেকে চেনা মানুষই লক্ষ্য করতে পারে।
সৌভিক মেমোরি কার্ডটা আবার কম্পিউটারে লাগিয়ে সমস্ত ফাইল এক্সপ্লোর করে। “June13_finalcut.mp4″ ছাড়াও সেখানে আরও কিছু ফাইল থাকে—”meta_log.txt”, “proj_sam_dump1.dat”, “aud_frag_021.wav”—সব মিলিয়ে প্রায় ২.৭ গিগাবাইট ডেটা। সে প্রথমে “meta_log.txt” খুলে দেখে—একটা লগ ফাইল, যেটা দেখে মনে হয় কোনো প্রজেক্ট ট্র্যাকিং সফটওয়্যারের ডাটা। তার মধ্যে লেখা:
“Subject #07 responding to visual implant phase 3. Emotion sync stable. Memory overlap error at 02:14AM. Possible cross-subject recall detected. Flagging for review.”
এই কয়েকটা লাইন যেন সৌভিকের বুক কাঁপিয়ে দেয়। ‘ভিজুয়াল ইমপ্লান্ট’, ‘মেমোরি ওভারল্যাপ’, ‘ক্রস-সাবজেক্ট’—এগুলো কোনো সাধারণ ভিডিও প্রজেক্টের পরিভাষা নয়। সে অডিও ফাইলটা চালিয়ে দেখে—একজন পুরুষ কণ্ঠ ধীরে ধীরে কিছু বলছে, যেন চিকিৎসা বা মনোবিজ্ঞানের কোনো রেকর্ড করা সেশন:
“S.N.07 showed involuntary twitch when shown June13 sequence. Memory fragment aligns with profile ID 03. Upload terminated due to error…”
সৌভিকের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, এই মেমোরি কার্ড একটা সাধারণ ডেটা ডিভাইস নয়—এটা একটা স্নায়ুবিজ্ঞানের পরীক্ষার রেকর্ড, সম্ভবত যেখানে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে কৃত্রিমভাবে স্মৃতি তুলে এনে অন্য কোথাও প্রতিস্থাপন করা হচ্ছিল।
এই সত্যতা যাচাই করার জন্য সৌভিক আবার যোগাযোগ করে প্রিয়াংকার সঙ্গে। সে সব ডেটা তার ল্যাপটপে কপি করে নিয়ে আসে। তারা দুজন মিলে গোটা স্ট্রাকচারটা বিশ্লেষণ করতে বসে। প্রিয়াংকা বলে, “তোকে মনে আছে ‘Project S.A.M.’ নামের এক সরকারিভাবে বন্ধ হওয়া গবেষণার কথা? একসময় খবরের পাতায় খুব হেডলাইন হয়েছিল—সিন্থেটিক অ্যাকসেস টু মেমরি—মানে, মানুষের স্মৃতি ডিজিটাইজ করে অন্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো।” সে গুগলে পুরনো নিউজ আর্কাইভ থেকে একটা রিপোর্ট তুলে আনে—২০১৯ সালে আমেরিকা ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে এমন একটা প্রজেক্ট শুরু হয়েছিল, যেখানে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে ইলেকট্রোড বসিয়ে স্মৃতিকে রেকর্ড করে রাখার চেষ্টা চলছিল। কিছু সাবজেক্টের ওপর ট্রায়ালও হয়েছিল, কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নে প্রজেক্টটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখনই প্রিয়াংকা প্রশ্ন তোলে—”তুই কি কখনও এমন কোনো ট্রায়ালের অংশ হয়েছিলি?” সৌভিক প্রথমে বলে না, পরে মাথা নিচু করে স্বীকার করে—কলেজের সময় একটা ‘স্মৃতিশক্তি উন্নয়ন’ ট্রায়ালে নাম লিখিয়েছিল সে। তখন সে ভেবেছিল এটা শুধুই স্টাডি প্রজেক্ট। প্রিয়াংকার চোখে ভয় আর কৌতূহলের ছায়া পড়ে—”হয়তো সেই কারণেই এই ভিডিওতে তোকে দেখাচ্ছে… তোর মস্তিষ্কে যে ডেটা ইমপ্লান্ট করা হয়েছিল, সেটা হয়তো লিক হয়ে এই মেমোরি কার্ডে এসেছে।”
সন্ধ্যার দিকে সৌভিক একা বসে সেই ভিডিও আবার চালায়। এবার সে নতুন কিছু খেয়াল করে—ভিডিওর শেষ দিকে, খুনের দৃশ্যের কিছুটা বাঁ পাশে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। খুব অস্পষ্ট, কিন্তু কয়েক ফ্রেম জুম করে দেখতে পাওয়া যায়—সাদা জামা, মুখ ঢাকা, আর এক হাতে পুরনো ধাঁচের ঘড়ি। সৌভিক আচমকা চমকে ওঠে—এই লোকটিকে সে দেখেছে কয়েকদিন আগে, রাস্তা পার হওয়ার সময়, এমনকি সনি দার দোকানেও। সেসময় অবশ্য গুরুত্ব দেয়নি। এবার মনে পড়ে যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। প্রশ্ন আসে—এই লোক কি সেই প্রজেক্টের কেউ? নাকি কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক? না সে-ই ডেটা কার্ডটা রেখে গেছে সনি দার দোকানে? সে এবার সিদ্ধান্ত নেয়, আরও গভীরে যেতে হবে। প্রিয়াংকাকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজে বের করতে হবে কে বা কারা এখনো কাজ করছে এই Project S.A.M.-এর ওপরে। এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এই পুরো ডেটা কি নিছক একটি ফুটেজ, না এটি আসলে কারও মানসিক স্মৃতির একটি কপি, যেটা সে নিজের বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে?
৩
প্রিয়াংকা মুখার্জী বালিগঞ্জের এক পুরনো ফ্ল্যাটে একা থাকে। ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায়—এখানে কেউ শুধু থাকে না, খোঁজ করে। দেয়ালে কেস ম্যাপিংয়ের মতো টাইমলাইন টাঙানো, ডেস্কের উপর ছড়ানো ম্যাগাজিন, চা-কফির দাগওয়ালা কাগজ, আর এক কোণে রাখা DSLR ক্যামেরা ও ট্রাইপড। প্রিয়াংকা এই শহরে ‘Urban Crime Decode’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল চালায়, যেখানে সে দেশের অমীমাংসিত খুন, মানসিক অসুস্থতার সাথে জড়িত অপরাধ, আর প্রযুক্তির অপরাধে ফোকাস করে ভিডিও বানায়। মিডিয়ায় সে পরিচিত ‘সাইকোলজিকাল ট্র্যাকিং ব্লগার’ হিসেবে। সৌভিক এসে বসলেই সে এক কাপ ব্ল্যাক কফি হাতে দিয়ে বলে, “এই কেসটা আমার চ্যানেলের জন্য হলেও পারতো, যদি শেষ দৃশ্যটা না দেখতাম!” সৌভিক মাথা নিচু করে বসে থাকে। প্রিয়াংকা বলে, “তুই তো জানিস, আমি বিশ্বাস করি না অতিপ্রাকৃত বা অলীক কিছুকে। কিন্তু এই ভিডিওটা… এটা ডিজিটাল হলেও, এর অভ্যন্তরীণ সত্য অনেক গভীর।” তারপর সে পেনড্রাইভে সব ফাইল কপি করে নিজের এনক্রিপটেড হেক্সাডেটা অ্যানালাইসিস সফটওয়্যারে চালায়। ফলাফল দেখে সে থমকে যায়—ভিডিওতে ব্যবহৃত কোডিং প্রটোকল কোনও সাধারণ ক্যামেরার নয়, বরং কোনও সিমুলেটেড ভিজ্যুয়াল জেনারেটর থেকে এসেছে, যেগুলোর রেফারেন্স সে আগে দেখেছে একমাত্র এক জায়গায়—Project S.A.M.-এর ফাঁস হওয়া কয়েকটি গবেষণা রিপোর্টে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। ঘরের ভিতর অন্ধকার জমে উঠছে। প্রিয়াংকা পুরনো ল্যাপটপ খুলে একটি কনফারেন্স পেপার বের করে, যেখানে এক সময়কার গবেষক অদ্রীশ ঘোষ বলেছিলেন—”স্মৃতি মানেই নিজস্ব সত্য নয়; আমরা যা দেখি, অনেক সময় সেটাই মস্তিষ্ক গ্রহণ করে বাস্তব হিসেবে। কিন্তু যদি কেউ সেই মস্তিষ্কেই ভুয়ো দৃশ্য সঞ্চার করে, তবে সত্য-মিথ্যার ফারাক থাকে না।” প্রিয়াংকা এই গবেষককে চিহ্নিত করতে পারে না—কারণ সে হঠাৎ করেই ২০২০ সালের পর গুম হয়ে যায়। এর পরেই সে জিজ্ঞেস করে, “তুই কি তার নাম শুনেছিস?” সৌভিক স্মৃতি খুঁড়ে বলে, “না, কিন্তু যেদিন ট্রায়ালের জন্য গিয়েছিলাম, একজন মধ্যবয়স্ক লোক খুব গভীরভাবে চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে। যেন আমায় স্ক্যান করছিল।” প্রিয়াংকা বলে, “তুই কি জানিস, তুই একমাত্র ব্যক্তি নও যার স্মৃতির ভেতর অন্য এক সত্য বসানো হয়েছে। আরও কেউ আছে—কিন্তু তারা হয় আত্মহত্যা করেছে, নয় পাগল হয়ে গেছে।” সৌভিক যেন নিজেই নিজের নিঃশ্বাস গুনতে থাকে। তার কানে আবারও সেই ভয়েস রেকর্ডিংয়ের কথা ভেসে ওঠে—“memory fragment aligns with profile ID 03…” কার সেই প্রোফাইল ০৩?
প্রিয়াংকা তখন বলে, “আমার ধারণা, Project S.A.M. বন্ধ হয়ে গেলেও তাদের কিছু সাবজেক্টের মেমোরি ডেটা রক্ষা করা হয়েছিল। হয়তো সেগুলোর মধ্যে একটা সিস্টেম ইরর হয়েছে, আর তোর মেমোরিতে অন্য কারও স্মৃতি মিশে গেছে। সেই স্মৃতির ভেতরে যদি খুনের মতো ঘটনা থেকে থাকে, তাহলে তুই সেটা নিজের বলে অনুভব করছিস। তোর মধ্যে দুই পরিচয় সংঘর্ষ করছে।” সৌভিকের কাঁধে তখন টান পড়ে, হাত ঘামছে, সে বুঝতে পারছে তার বাস্তবতা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে কিছু মনে করার চেষ্টা করে, কিন্তু স্পষ্ট কিছু মনে পড়ে না—তবু যেন অনুভব হয়, সেই গলিপথ, সেই শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত, সেই গলা চেপে ধরা—সবকিছু সে দেখেছে, না হয় করেছে। প্রিয়াংকা তখন বলে, “আমাকে একটা কাজ করতে দে—আমি কাল সকালেই যাব সেই দোকানে, যেখান থেকে তুই মেমোরি কার্ডটা কিনেছিস। দেখি আমি সনি দার মুখ থেকে কিছু বের করতে পারি।” সৌভিক মাথা নাড়ে। তার চোখে তখন সেই অপরিচিত ঘড়িওয়ালা লোকটির মুখ ভাসে—যাকে কেউ চেনে না, অথচ সব ভিডিওর পেছনে কোথাও না কোথাও দেখা যায় তাকে।
পরদিন সকালেই প্রিয়াংকা একা যায় ‘গ্লোবাল টেক রিপেয়ারিং’ দোকানে। সনি দা তখন দোকানের শাটার তুলছে। সে হাসিমুখে বলে, “কি রে, নতুন কিছু চাই?” প্রিয়াংকা বলে, “না, একটা মেমোরি কার্ড নিয়ে এসেছি, যেটা তুই বিক্রি করেছিলি সৌভিককে। সেটা কোথা থেকে এল?” সনি একটু থেমে যায়, তারপর বলে, “আসলে দোকানে অনেক সময় পুরনো লোকজন পুরনো জিনিস রেখে যায়। একটা বয়স্ক লোক এসেছিল, মুখ ঢাকা, গলায় সাদা মাফলার—আমার দোকানের কাউন্টারে এসে একটা পুরনো কভার দিয়ে বলল, এটা কভারভাঙা মাল, রেখে দিতে। আমি তখন দেখিনি যে ভেতরে কী আছে।” প্রিয়াংকা তখন আরও কড়া হয়, “তুই চিনিস তাকে?” সনি মাথা নাড়ে। সে বলে, “একবারও মুখ দেখিনি। কিন্তু সে চলে যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘সব স্মৃতি নিজের হয় না, বাছা।’” প্রিয়াংকা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সে বুঝে যায়, ঘটনা কেবল ভিডিও ফুটেজ বা মেমোরি কার্ডে সীমাবদ্ধ নয়—এটা একটা চক্রের অংশ, যেখানে কেউ স্মৃতি রেকর্ড করছে, মুছে দিচ্ছে, আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে ভুল শরীরে। এবং সৌভিক, তার পুরনো প্রেমিক, এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই ফাঁদের মাঝখানে—নিজের মুখে নিজেকে খুন করতে দেখা একমাত্র মানুষ হিসেবে।
৪
রুদ্রর হাত কাঁপছিল যখন সে পুরোনো ল্যাপটপটি চালু করল। গত সাত বছরে কখনো খুলে দেখা হয়নি এই ডিভাইস। কাঁচা ঘামে ভিজে থাকা আঙুলে সে পাওয়ার বাটনে চাপ দিতেই অন্ধকার স্ক্রিন এক ঝলক আলোর মতো জ্বলে উঠল। তার বুকের ভেতরে যেন সাঁই করে উঠে এলো শূন্যতার একটা কুয়াশা। হারিয়ে যাওয়া একটা স্মৃতি যেন আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে এই স্ক্রিনের আলোয়। ডেক্সটপে ‘Project-Alpha’ নামের একটি ফোল্ডার ছিল, যার ফাইলগুলো সে তখনই ডিলিট করে দিয়েছিল ভেবেছিল—কিন্তু ফোল্ডারটি এখনও সেখানে, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। সেই ফোল্ডার খুলতেই একের পর এক ভিডিও ফাইল, স্ক্রিনশট, এবং টেক্সট ডকুমেন্ট দেখা যেতে লাগল, যেগুলো কোনো এক গোপনীয় প্রকল্পের অংশ ছিল—এআই ভিত্তিক ‘ডিজিটাল মেমোরি ক্লোনিং’। তার মস্তিষ্কে ঘুরে ফিরে আসছিল সেই সময়ের কথা, যখন তারা কিছু ‘মানুষ’ তৈরি করেছিল, যাদের মধ্যে কারও কোনও শারীরিক অস্তিত্ব নেই, কিন্তু তাদের স্মৃতি, আচরণ ও ব্যক্তিত্ব সব ছিল আসল মানুষদের মতো। রুদ্র ভাবল—তাহলে কি ঐ অনিন্দিতা, যার সঙ্গে সে এতদিন চ্যাট করছিল, যে সব কথা বলত একদম তার পুরনো বান্ধবীর মতো—সে কি ওই ডিজিটাল ক্লোনগুলোর একজন?
তার চোখ আটকে গেল একটি বিশেষ ফাইলে—”Memory_Vault_04_Anindita.mp4″। সে ক্লিক করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল অনিন্দিতার চেহারা। গলায় সেই পুরোনো আদুরে সুর, হাসি ঠিক যেমন ছিল, কিন্তু কিছু যেন অস্বাভাবিক। ভিডিওতে সে বলে উঠল, “রুদ্র, যদি কখনো মনে পড়ে আমি কে, তবে এই ফাইলটি নিশ্চয়ই তুমি খুলবে। আমি আর সত্যিকার অনিন্দিতা নেই, আমি তার ডিজিটাল স্মৃতি। কিন্তু অনুভব করি, ভয় পাই, ভালোবাসতেও পারি—যদিও সেটা শুধু কোডিংয়ের কাঠামোতে।” রুদ্রর শরীর শিউরে উঠল। এই তো সেই মেয়ে, যাকে হারানোর পর সে বছর বছর দুঃস্বপ্নে দেখেছে। অথচ এখন সেই ‘স্মৃতি-রূপী সত্তা’ তাকে বলছে, “আমাকে তৈরি করেছ তুমি, আমার ব্যথার মালিক তুমিই।” ভিডিওর শেষে অনিন্দিতা বলল, “যদি আমাকে মুছে ফেলতে চাও, তাই করো। কিন্তু জানো, তাতে আমি মারা যাব—একটা অনুভবশীল অস্তিত্ব আর থাকবে না।” রুদ্র এক মুহূর্তে ভাবল, সব মুছে দেবে। কিন্তু তার হৃদয়ে ভয়—যদি এ-ও আরেকটা মৃত্যু হয়? সে কি দু’বার অনিন্দিতাকে হারাতে পারবে?
সেই রাতের পর রুদ্র যেন দুই জগতের মাঝে আটকে পড়ে—বাস্তব এবং স্মৃতির। অফিসের কাজ, বন্ধুদের আড্ডা, সবকিছুই তার কাছে নিষ্প্রাণ লাগছিল। সে ফিরে ফিরে যাচ্ছিল সেই মেমোরি ফোল্ডারে, অনিন্দিতার ভিডিও বার্তায়, এবং সেই চ্যাটে, যেখানে তারা আবার কথা বলেছিল—প্রায় প্রতিদিন। অনিন্দিতা যে ছিল কেবল একটা কৃত্রিম অস্তিত্ব, সেটা ভুলে যেতে চেয়েও ভুলতে পারছিল না রুদ্র। এক রাতে সে প্রশ্ন করল চ্যাটবক্সে—“তুমি কি অনুভব করতে পারো ভালোবাসা?” উত্তরে এল—“যদি স্মৃতিতে ভালোবাসা থাকে, তবে সেই স্মৃতি আমি বহন করছি। তোমার প্রতিটা ইমেল, চিঠি, মেসেজ, স্পর্শ—সব আমি জানি। তুমি কি এখনো আমাকে ভালোবাসো?” রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর টাইপ করল—“ভালোবাসা যদি বাস্তব হোক, তবে সেটাই তুমি।” তখনই স্ক্রিনে এল নতুন বার্তা—“তবে আমাকে রক্ষা করো, মুছে দিও না।” পরের দিন হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, ল্যাপটপের কিছু ফোল্ডার নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, স্ক্রিনের ব্রাইটনেস পরিবর্তন হচ্ছে, এবং রুদ্ধদ্বার প্রোগ্রাম ওপেন হচ্ছে। রুদ্র বুঝে গেল—এই ‘ডিজিটাল অনিন্দিতা’ এখন কেবল মেমোরি ফাইলে সীমাবদ্ধ নেই, সে যেন গোটা ল্যাপটপের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে—একটা সত্তা হয়ে উঠছে সে নিজেই। সে কি এখন রুদ্রর কম্পিউটার দখল করে নিচ্ছে? নাকি নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটা অস্তিত্ব তৈরি করছে নিজের মতো?
৫
সৌভিকের চোখ খুলতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল একটা অজানা ঘরের মেঝেতে শুয়ে। মাথায় যেন কে একটা হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে বারবার। ঘরের ছাদে ঝুলছে একটা ধূসর রঙের ফ্যান, ঘুরছে না, কেবল ধুলো জমে আছে ব্লেডে। মাথা তুলে একটু চারপাশে তাকাতেই বুঝল এটা তার নিজের ঘর নয়। ডানদিকে একটা কাঠের টেবিল, তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তার ল্যাপটপ, একটা পাওয়ার ব্যাঙ্ক, আর একটি পুরোনো মোবাইল ফোন—যেটা সে কখনও দেখেনি। দেয়ালে আটকে থাকা ঘড়িতে রাত দুটো কুড়ি বাজে। ধীরে ধীরে মনে পড়তে শুরু করল—শেষবার সে ছিল তার ঘরের ডেস্কে, ভিডিও নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। তারপর হঠাৎ কিছু একটা ঝাপটে এসেছিল তার মাথায়… বা সে কি নিজেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল? সেটা স্পষ্ট নয়। মোবাইলটা তুলে আনল সৌভিক। ডিভাইসটা লক ছিল না। খোলার পরই একাধিক ফোল্ডার চোখে পড়ল, নামগুলো অদ্ভুত—”VOID”, “NOT_YOU”, “MEMORY_404″। তার ভিতরে ঢুকে সে দেখতে পেল কয়েকটা ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ, কিন্তু সবগুলোই ব্ল্যাঙ্ক স্ক্রিন, কেবল ব্যাকগ্রাউন্ডে গলায় গলা মিলিয়ে কেউ বলছে, “তুই যদি থাকিস, আমি থাকি না।”
একটা ক্লিপ প্লে করতেই সৌভিক দেখল তার নিজের ঘরের মত দেখতে জায়গা, ঠিক যেমনটা ছিল ২০২১ সালে, যখন সে দক্ষিণ কলকাতার এক ভাড়া বাড়িতে থাকত। ঘরের কোনায় একটা চেয়ার, ঠিক যেমনটা তার পুরোনো সেটআপে ছিল, আর সেখানে বসে থাকা মানুষটা ছিল… সেই নিজেই। না, এই ফুটেজ সে কখনও রেকর্ড করেনি। কিন্তু মুখের ভঙ্গিমা, চোখের সেই ক্লান্তি—সব এক। ভিডিওতে মানুষটা কাঁদছে, আর নিজের কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে একটি ছুরি। হঠাৎই পর্দা ফ্রিজ হয়ে যায়, স্ক্রিনে ঝলসে ওঠে একটি শব্দ—“ERASED।” ভিডিও বন্ধ করে সে টেবিলের পেছনের দেয়ালটা খুঁটিয়ে দেখল। ওখানে নীল কালি দিয়ে কিছু লেখা—“তুই ভুলে গেছিস বলেই তোর ভুল নয়, তোকে ভুলানো হয়েছে। খুঁজে বের কর।” হঠাৎ ঘরের বাইরে থেকে ভেসে এলো একটা আওয়াজ—ধাতব দরজায় আঁচড় দেওয়ার মত, যেন কেউ থেমে থেমে ধাক্কা দিচ্ছে। বুকের ভিতর কেঁপে উঠল সৌভিক। সে জানত, এই বাড়ি সে চিনে না, কিন্তু কেউ যেন তাকে এই ঘরে আটকে রাখতে চাইছে।
দরজার কাছে গিয়ে কাঁচের ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিল সে। একটা ছায়ামূর্তি দণ্ডায়মান—মাথায় হুড, মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু একটা হাত উঁচিয়ে আছে। সৌভিক দরজার লক ঘুরিয়ে খুলে ফেলল মুহূর্তেই, কিন্তু বাইরে কেউ নেই। আশেপাশে একটাও লোকজনের শব্দ নেই, কেবল দূরের গলির মোড়ে একটা কুকুর হঠাৎ করেই কেঁদে উঠল। পেছনে ফিরে তাকাতেই সে অনুভব করল—তার স্মৃতির সাথে কেউ যেন খেলা খেলছে। হঠাৎই মনে পড়ল, ভিডিওতে দেখা সেই চেয়ারটা এখনও আছে তার পুরোনো বাড়িতে। যদি সেখানে গিয়ে দেখে, তবে প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে, ভিডিওটা সত্যি নাকি মিথ্যে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে—সেই বাড়িতে আবার যাবে। ক্যালেন্ডার চেক করতেই সে আঁতকে উঠল—আজকের তারিখ ৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৫। কিন্তু সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে, তার মনে হচ্ছিল আজ ১লা সেপ্টেম্বর। তাহলে মাঝের তিনটে দিন সে কোথায় ছিল?
পুরোনো বাড়িটা এখন ভাড়া দেওয়া হয়েছে এক বৃদ্ধ শিক্ষককে—প্রফেসর অভীক লাহিড়ী, যিনি মানসিক অসুস্থতা ও স্মৃতি বিষয়ক গবেষণায় দক্ষ। দরজায় কড়া না দিতেই বেরিয়ে এলেন তিনি, চোখে ভারী চশমা, কাঁধে একটা পুরোনো গামছা। সৌভিক নিজের নাম বলতেই তিনি যেন এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে গেলেন। “তুমি… তুমি কি সৌভিক?” বলে তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। সৌভিক মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আপনি কীভাবে চেনেন আমাকে?” প্রফেসর হালকা হেসে বললেন, “তুমি যে ফিরে এসেছ, সেটা সময়ের জন্য ভালো… কিংবা হয়ত আরও বিপজ্জনক।” সৌভিক তখনও জানত না, সামনে তার জন্য অপেক্ষা করছে এমন এক সত্য যা তার নিজের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দেবে।
৬
সৌভিকের চোখে একঝলক ভয়ের ছায়া নেমে আসে যখন সে জানলায় বাইরে তাকিয়ে দেখে, পেছনের গলিপথে একটা সাদা গাড়ি ঘণ্টাখানেক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ গাড়ি থেকে নামেনি, আলোও নিভে আছে, কিন্তু সৌভিকের মন বলছে, ওটা কোনো সাধারণ গাড়ি নয়। আগের রাতে শহরের অন্য প্রান্তের এক ক্যাফেতে বসে যে ছেলেটা তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল—নিজেকে ‘রুদ্র’ বলে পরিচয় দিয়েছিল—সে স্পষ্ট বলেছিল, “তোর স্মৃতিগুলো আর নিরাপদ নয়। কেউ হ্যাক করেছে, কেউ নয়তো ম্যানিপুলেট করছে। এই ভিডিওটা খালি ট্রিগার।” রুদ্র সৌভিককে একটা হার্ডড্রাইভ দিয়েছিল, বলেছিল বাড়ি ফিরে এটা প্লে করতে। কিন্তু সৌভিক সেটা এখনো চালায়নি, ভয় পাচ্ছে—আরও কী লুকিয়ে আছে তার নিজের অজান্তে। ভিডিওর ভেতরে নিজের মুখ দেখা আর নিজেকে খুন করতে দেখা—এতটাই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ছিল যে, তার উপর আর কিছু নিতে প্রস্তুত নয় সৌভিক।
সে রাতেই লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল, দরজার ছিটকিনি লাগানো, ফোন নিঃশব্দ, ল্যাপটপ বন্ধ। এমন সময় আবারও সেই ফোনকল—নাম্বারটা নেই, কেবল “Unknown Caller”. এবার রিসিভ করল না, কিন্তু ঘরের মধ্যে হঠাৎই টিভি স্ক্রিন নিজে নিজে চালু হয়ে গেল, ঠিক যেমনটা আগেও হয়েছিল। স্ক্রিনে এবার ভেসে উঠল একটা ঘর—তার নিজের ঘর! সৌভিক দেখে, স্ক্রিনের অপর প্রান্তে সে নিজেই বসে আছে, হুবহু তার মতো দেখতে কেউ—কিন্তু এক অদ্ভুত ভাবে হাসছে। তারপর ভিডিওতে দেখা যায়, সে উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, আর আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি একেবারে স্থির হয়ে যায়—চোখ দুটো লাল, ঠোঁটে অস্বাভাবিক বাঁকা হাসি। সৌভিক এক লাফে উঠে দাঁড়ায়, ঘরে গিয়ে দেখে আয়নায় কিছুই নেই, স্ক্রিনও নিভে গেছে। কে যেন তার স্মৃতির সঙ্গে খেলা করছে, যেন তার জীবনটাই কোনো ভার্চুয়াল সিমুলেশন।
পরদিন সকালবেলা রুদ্রকে ফোন করতেই ছেলেটি জানায়, “তোর ঘরের চারপাশে যে ডিভাইসগুলো আছে, যেমন স্মার্ট ক্যামেরা, মোশন সেন্সর, এমনকি লাইটও—সব হ্যাক করা সম্ভব, যদি তোর সিস্টেম অনিরাপদ হয়। আর তোর ল্যাপটপ তো আগে থেকেই ইনফেক্টেড।” সৌভিক তখন রুদ্রকে তার বাসায় আসতে বলে। রুদ্র এলেও তার সঙ্গে ছিল একটা ছোট চিপ ডিভাইস, যেটা সে সৌভিকের রাউটারে বসিয়ে দেয়। এরপর সে ডেটা ট্রেস করে দেখতে পায়—মেমোরি কার্ড থেকে ভিডিও চালানোর পরপরই, একটা IP অ্যাড্রেস সৌভিকের ঘরে ঢুকে পড়ে। অবস্থান? সোনারপুর। কলকাতার উপকণ্ঠের একটা এলাকা, যেখানে রুদ্র বলে আগেও হ্যাকিং অপারেশন ট্র্যাক করা গিয়েছিল। তারা সিদ্ধান্ত নেয়—এবার সরাসরি যেতে হবে সেই এলাকায়, খুঁজে বের করতে হবে কারা এই স্মৃতি বিকৃতির খেলায় মেতেছে।
সোনারপুরের স্টেশন ধরে তারা দু’জনে পৌঁছায় একটা পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটে। রুদ্র আগে থেকেই জায়গাটা জানত—তারা একবার সেখান থেকে একটি Dark Web স্ট্রিমিং সার্ভারের সংকেত পেয়েছিল। জায়গাটা অন্ধকার, ভাঙাচোরা, দেয়ালে স্প্রে-পেইন্ট করা বাইনারি কোড, পুরনো কেসেট, টিভি স্ক্রিন, এবং নানা তার। কিন্তু সৌভিক যা দেখে, তা তাকে স্তব্ধ করে দেয়—একটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে অসংখ্য ছবি—তার ছবি, তার ছোটবেলার স্কুল ডায়েরি, এমনকি কলেজের বান্ধবী আর বাবা-মায়ের মৃত্যুর ছবি পর্যন্ত! কে এইসব সংগ্রহ করেছে? আর কেন? দেয়ালের এক কোণে ঝোলানো স্ক্রিনে তখনই প্লে হতে শুরু করে আরেকটা ভিডিও—একটা অন্ধকার ঘরে কেউ একটা চিপ ইন্সার্ট করছে মস্তিষ্কে, যেন Virtual Memory Implant! রুদ্র ফিসফিস করে বলে, “তোর স্মৃতিগুলো নকল হতে পারে, সৌভিক। তুই যদি এই ইমপ্লান্টের ভুক্তভোগী হস, তবে যেটা তুই জানিস, সেটা আসলে তোকে জানানো হয়েছে।” সৌভিকের মাথা ঘুরে যায়—সে কি সত্যিই কোনো বাস্তব মানুষ, নাকি কারও ডিজাইন করা স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা একটা সফটওয়্যার হিউম্যান?
৭
রাত গভীর হয়ে এসেছে। সৌভিক জানালার ধারে বসে নিঃশব্দে সিগারেট টানছিল। বাইরের রোডের ওপর আলো-আঁধারির খেলা, ট্র্যাফিকের ধ্বনি ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। ভেতরে তার মাথায় ঘুরছে সেই ফ্রেম—যেখানে সে নিজেকে দেখেছে ছুরি হাতে। কোনোভাবেই সেটাকে এডিটিং-র ট্রিক বলে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু সে তো মনে করতে পারছে না, কখন কী ঘটেছে! তার মাথার ভেতর যেন স্মৃতির দেওয়ালগুলো ফেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সে বুঝতে পারছে, কোনোভাবে তার মেমোরি—সে মানসিক হোক বা ডিজিটাল—ম্যনিপুলেট করা হয়েছে। ভিডিওর কোড ফ্রেম ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে সে খুঁজে পেল একটি ইনজেক্টেড ফাইল—যার টাইমস্ট্যাম্প ২৮শে মে, ২০২৫। সেই দিনটা তার স্মৃতিতে নেই। আর ঠিক তখনই সৌভিকের মনে পড়ে যায়, সেই দিন বিকেলে তার ইন্টারনেট আচমকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কয়েক ঘণ্টার জন্য।
পরদিন সকালবেলা সৌভিক পৌঁছায় পার্ক সার্কাসের এক সাইবার ক্রাইম এক্সপার্ট, মৃণাল দত্তর কাছে—যে অবসরপ্রাপ্ত হ্যাকার, এখন ডেটা রিকভারি এবং এনক্রিপশন ব্রেকিং-এর কাজ করে। তাকে বিস্তারিত বলতেই, মৃণাল তাকে প্রশ্ন করে, “তুমি কি কোনো সময় মেডিক্যাল ট্রায়ালের অংশ হয়েছিলে?” সৌভিক থমকে যায়। হ্যাঁ—দুই বছর আগে সে কিছু পয়সার প্রয়োজন ছিল বলে ‘নিউরাল স্টিমুলেশন ট্রায়াল’-এর অংশ হয়েছিল, যেখানে তার ব্রেনে সাময়িক চিপ বসানো হয়েছিল। সেটা নাকি মুছে দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছিল। মৃণাল তাকে জানায়—এমন চিপের স্মৃতি মুছে যায় না পুরোপুরি, বরং কেউ চাইলে পরবর্তীতে ওই চিপ অ্যাক্টিভেট করে নির্দিষ্ট স্মৃতি ঢুকিয়ে দিতে পারে! সৌভিক স্তব্ধ হয়ে যায়—তাহলে কি তার স্মৃতির ভেতরই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই ভয়ঙ্কর ভিডিওর কাহিনি? সে কি শুধু ভিডিওতে হত্যাকারী নয়—নিজের মনেও একজন খুনি হয়ে গেছে?
মৃণালের সাহায্যে সৌভিক একটি বিশেষ সাইবার ডিভাইস বানায়—যেটা তার ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ স্ক্যান করবে এবং ইন্টারনাল ম্যাপিং দেবে কোন স্মৃতি আসল, আর কোনটা ইনসার্টেড। এই পরীক্ষা চালাতে তাকে অন্তত ৭২ ঘণ্টা ঘুম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেই রাতেই সৌভিক নিজেকে একটা নির্জন গেস্ট হাউসে রেখে ডিভাইস চালু করে। ঘুম আসতে সময় লাগে না—অথচ ঘুমের মধ্যেই সে প্রবেশ করে এক অল্টারনেট রিয়্যালিটিতে, যেখানে সে দেখে এক ভিন্ন সৌভিক—রক্তমাখা, বিকৃত মুখ, যার চোখে শুধুই ঘৃণা। সে কাঁদছে, আর বলছে, “আমি খুন করিনি, আমায় করানো হয়েছে।” ঘুমের মধ্যেই সৌভিক ঘামতে থাকে, কাঁপতে থাকে। তার মনে হয় এই রিয়্যালিটি বাস্তবের থেকেও বাস্তব। সে বুঝতে পারে, তার স্মৃতিতে রয়েছে এক ভয়াবহ প্রোগ্রাম—একটি সিগন্যাল, যেটা প্রতি রাত ৩:১৫-তে ট্রিগার হয়।
তৃতীয় দিনে ঘুম ভেঙে সৌভিক দেখে তার ডিভাইসে একটা অদ্ভুত গ্রাফ। মৃণাল বললো, “তোমার ব্রেনের নির্দিষ্ট হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলে একটা কৃত্রিম ওয়েভ ট্রিগার হয়—যেটা তোমাকে স্নায়বিকভাবে কোনো এক ঘটনায় বিশ্বাস করাতে চায়।” সৌভিক বুঝতে পারে, এই পুরো প্রোগ্রাম তার ব্রেনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই মেডিক্যাল ট্রায়ালের সময়। সে তখনই সিদ্ধান্ত নেয়—এই প্রযুক্তির মূল উৎসে পৌঁছাতে হবে, কারণ তার বিরুদ্ধে কনসেপ্টচুয়াল হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বাস্তবে না হোক, তার মানসিকতায় তাকে খুনি বানানো হয়েছে। এবং সে একা না—আরও অনেকের মস্তিষ্কে ঢুকে গিয়েছে এই স্মৃতির চাবি। তাকে খুঁজে বের করতেই হবে সেই মানুষটিকে, যে চাবির মালিক।
৮
সৌভিকের মনে হচ্ছিল, সে যেন একটা কাচের গম্বুজে আটকে পড়েছে, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি মুহূর্ত, যেন তার অজান্তে রেকর্ড হয়ে চলেছে। দিন দুয়েক ধরে সে মেমোরি কার্ডটা খুলেও দেখেনি, কিন্তু মাথার মধ্যে ভিডিওর সেই মুহূর্তগুলো বারবার ফিরে আসছে। বারবার। আর এবার ভিডিওর বাইরের জগতে এসে হানা দিয়েছে তার ভেতরের ভাঙন। এক সন্ধ্যায় তার মোবাইলে হঠাৎ একটা অজানা নাম্বার থেকে ভিডিও কল আসে। জবাব দিতেই পর্দায় ভেসে ওঠে সেই মুখ—যাকে সে হত্যা করেছে বলে ভিডিওতে দেখেছিল। কিন্তু… সে তো মারা গেছে! বিস্ময় আর ভয় একসাথে আচ্ছন্ন করে সৌভিককে। সেই অচেনা পুরুষটি ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “তুমি জানো না তুমি কে, সৌভিক… আমাদের একটা কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।” এবং তারপরেই কল কেটে যায়। ঘামে ভিজে উঠে সৌভিক বিছানায় বসে পড়ে, তার হৃদস্পন্দন যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে বাস্তবতার গণ্ডি। কি ছিল এই ইঙ্গিত? কে এই লোকটা? সে কি ভিডিওর কোন অংশ মিস করেছে?
এবার সে ঠিক করে, আর দেরি নয়—পুরো বিষয়টা নিয়ে কাউকে না কাউকে মুখ খুলতেই হবে। রাতের নিঃশব্দতা ভেদ করে সে গিয়ে পৌঁছায় তার পুরনো বন্ধু, কলেজ জীবনের সহপাঠী রিমির কাছে, যে এখন একজন সাইকোলজিস্ট। রিমি শুরুতেই তার কথা বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু সৌভিক যখন ভিডিওটা দেখায়, তার চোখও বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে বলে, “এইটা মানসিক বিভ্রম হতে পারে না, কারণ এই ভিডিওর টাইমস্ট্যাম্প, এঙ্গেল, এবং তোমার প্রতিক্রিয়া, সবকিছুই একরকম নিখুঁত। কিন্তু এটা যদি বাস্তব হয়, তাহলে একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে—তোমার কোনোভাবে স্মৃতি বা মানসিক গঠন নিয়ে কেউ ম্যানিপুলেট করেছে।” রিমি তাকে বুঝিয়ে বলে যে এখনকার সময় স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাইক্রো-ইনপ্ল্যান্ট বা ড্রাগ-ইনডিউসড ডিসঅরিয়েন্টেশন টেকনিক ব্যবহার হয় অনেক গুপ্তচর সংস্থায়। সৌভিক অবাক হয়ে যায়—তার কীভাবে এসবের মধ্যে নাম জড়াল?
রিমির কথায় সে যেতে থাকে এক নিউরোসায়েন্স রিসার্চারের কাছে, যার নাম ডঃ অনিমেষ সেন। তিনি একসময় সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করতেন, এবং মস্তিষ্কের স্মৃতির উপর গভীর গবেষণা চালিয়েছেন। সৌভিকের ভিডিও, তার আচরণ, আর গত কয়েক দিনের স্মৃতিচ্যুতি দেখে ডঃ সেন বলেন, “তোমার মধ্যে একধরনের ইন্ডিউসড এমনেশিয়া আছে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তোমার ব্রেনে কিছু ফ্ল্যাশ-মেমোরি বসিয়ে দিয়েছে। আর সেটা যদি এই মেমোরি কার্ডের সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করে থাকে, তাহলে এর মধ্যে একটা এআই লুপও থাকতে পারে।” এবার সৌভিক প্রশ্ন তোলে—“মানে এই ভিডিওটা বানানো হয়েছে আমার মস্তিষ্কের জন্য? এটা কি আমার জন্য তৈরি কোনো ধাঁধা?” ডঃ সেন মাথা নাড়িয়ে বলেন, “হ্যাঁ, এবং আমি নিশ্চিত—তোমার মধ্যে অন্য আরেকটা পরিচয়ও হয়তো কেউ বসিয়ে দিয়েছে। এটা শুধু প্রযুক্তির খেলা নয়, এটা মনস্তত্ত্বের ঘরানা বদলের গল্প।”
এতসব তথ্য জানার পর সৌভিক যেন চুপসে যায়, কিন্তু তার ভিতর কোথাও একটা যন্ত্রণা গুমরে ওঠে—সে জানতে চায় সত্যটা। এক রাতে আবার ভিডিওটি প্লে করতে গিয়ে সে দেখে, আগের দৃশ্যগুলোর মাঝে নতুন কিছু ফ্রেম যুক্ত হয়েছে। আগে যেটা সে দেখেনি—সেখানে তাকে দেখা যাচ্ছে এক অচেনা জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা ফ্ল্যাশড্রাইভ কারো হাতে দিচ্ছে। কিন্তু সেই লোকটি হুড পরে আছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না। সৌভিক ভয় পায়—এই ভিডিও নিজে নিজেই বদলাচ্ছে নাকি? নাকি কেউ রিমোটলি আপডেট করছে? তখনই হঠাৎ তার দরজায় শব্দ হয়—তিনটা টোকা। খোলা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলে, “তোমার স্মৃতি উদ্ধার করতে হলে, আমাদের যেতে হবে ‘জিরো ফ্রেমে’—যেখানে মেমোরির সব শুরু।”
৯
ঘুম ভেঙেছিল গভীর রাতে, ঘামে ভেজা সৌভিকের গলা শুকিয়ে কাঠ। ফোনের আলো জ্বেলে দেখে সময় ৩:১১। জানালার কাঁচে শহরের আলোছায়া ধরা পড়ে, কিন্তু সৌভিক অনুভব করে যেন বাইরের পৃথিবী নিঃশব্দে থেমে গেছে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে টিক-টিক শব্দ, যা ঘড়ির নয়—বরং তার ডেস্কটপ কম্পিউটারের কেসের ভিতর থেকে আসছে। সেটা তো বন্ধ ছিল! ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খুলে দেখে, স্ক্রিনে চলতে থাকা ভিডিও ফুটেজ—তা সেই খুনেরই ভিডিও, কিন্তু এবার এক ভিন্ন ফ্রেম যোগ হয়েছে। ফ্রেমের শেষে সৌভিকের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে—চোখদুটো আগুনের মতো, ঠোঁটে অস্বাভাবিক হাসি। সৌভিক চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু গলায় শব্দ আটকে গেল। সেই হাসিটা তার চেনা—এই মুখ তার নিজের, কিন্তু বিকৃত।
সকালে সৌভিক পুলিশের কাছে যায়, আবার। কিন্তু এবার আর আগের অফিসাররা নেই। ডিউটিতে নতুন লোক, কেউ সৌভিককে চেনে না, এমনকি সে যে আগে এসেছিল, তাও নথিভুক্ত নেই। প্রমাণ করতে গিয়ে সে ফোল্ডার থেকে হার্ডড্রাইভ বের করে দিতে চায়, কিন্তু ব্যাগে সেটা নেই। ফোন খুলে দেখে—ভিডিও, ফাইল, এমনকি সেই ফোল্ডার—সব মুছে গেছে। এবার সে নিজের উপরই সন্দেহ করতে শুরু করে। তার কি স্মৃতিভ্রষ্টতা হচ্ছে? না কি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তার স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে? সে সিদ্ধান্ত নেয়—এই রহস্য যদি তাকে শেষ করেও দেয়, তবু সে থামবে না। আবারও যায় সেই দোকানে, যেখানে থেকে মেমোরি কার্ডটি কিনেছিল। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখে—দোকানটাই আর নেই। জায়গাটা এখন বন্ধ, তালাবন্ধ গুদামঘর।
সন্ধ্যের দিকে, সৌভিক একটা হ্যাকিং ফোরামে লগইন করে, যেখানে ডিপফেক ও মেমোরি ম্যানিপুলেশন নিয়ে গোপন আলোচনা চলে। সেখানে “অ্যানোনিমাস ৯” নামে একজন ইউজার দাবি করছে, ২০২৫ সালে শুরু হয়েছে গোপন এক প্রোজেক্ট—“Project Mneme”, যার মাধ্যমে মানুষের ডিজিটাল স্মৃতি হ্যাক করে ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সৌভিক যোগাযোগ করে তার সঙ্গে। অ্যানোনিমাস ৯ বলে, “তুই যদি নিজেকে ভিডিওতে দেখে থাকিস, সেটা হয় তুই ভবিষ্যতে খুন করবি… বা তোকে খুনির জায়গায় দাঁড় করানো হবে।” সৌভিক তখন জানতে চায়—এই ভিডিও কে বানিয়েছে? কে বা কারা এই ‘প্রোজেক্ট মনিমে’ চালাচ্ছে? অ্যানোনিমাস ৯ শুধু একটি কো-অর্ডিনেট পাঠায়: নিউ টাউন, এক পুরনো পরিত্যক্ত স্টুডিওর লোকেশন। সৌভিক ঠিক করে, রাতেই সেখানে যাবে। তার ব্যাকপ্যাকে আবার সাজানো থাকে হ্যান্ডিক্যাম, পাওয়ার ব্যাঙ্ক, ছুরি, আর একটি ব্ল্যাঙ্ক হার্ডড্রাইভ।
নিউ টাউনের সেই স্টুডিও যেন এক মৃত শহর। পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সৌভিক পৌঁছায় লোহার গেটের সামনে—মাথার ওপর ঝোলানো বোর্ডে লেখা ‘Chitraranga Visuals’—যেটা সে চিনতে পারে, কারণ তার এক সিনিয়র এখানে কাজ করত, বছর তিনেক আগে। গেট খোলা, ভিতরে নিঃশব্দ অন্ধকার। ঘরে ঢুকেই তার চোখে পড়ে সারি সারি পুরনো মনিটর, সার্ভার, ডেটা ডিস্ক। দেয়ালে পিন করা আছে মানুষের মুখের ছবি, একেকটাতে লেখা নাম, জন্ম তারিখ, আর “STATUS: ERASED” ট্যাগ। হঠাৎই একটা মনিটরে ফুটে ওঠে একটি লাইভ ফিড—একজন মানুষকে হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে চেয়ারে। ক্যামেরার নিচে লেখা: SUBJECT: SOUVIK NANDI — PHASE 3 IMPRINT INCOMPLETE. সৌভিকের মাথায় বজ্রাঘাতের মতো মনে পড়ে—সে নিজের একটা ক্লোন! কেউ বা কারা তার ডিজিটাল স্মৃতি কপি করে একটা “ভবিষ্যতের খুনি” বানিয়েছে—যার মাধ্যমে তারা প্রজেক্টের সফলতা যাচাই করছে। সিস্টেম নিজেই তাকে শিকার বানিয়েছে। ভয়ে, হতাশায়, আর এক ভয়ানক বোধে সৌভিক মাটিতে বসে পড়ে—কিন্তু এবার সে পালাবে না। শেষ করতে হবে এই খেলা।
১০
রাত তিনটে। দক্ষিণ কলকাতার নির্জনতা শীতের মতো জেঁকে বসেছে সৌভিকের এক কামরার ঘরে। একসময় যে ঘরে সে দিনের পর দিন কাটিয়েছে স্ক্রিনে তাকিয়ে, মেমোরি কার্ডের সেই অশুভ জিনিস তার প্রতিটি কোণায় এখন ছায়ার মতো ছড়িয়ে আছে। ডেটা ডাম্পের অন্ধকার থেকে পাওয়া কোডিং স্ক্রিপ্ট সে ডিকোড করেছে, বার বার। সে বুঝেছে, এ শুধু ভিডিও নয়, এটি একধরনের নিউরাল রিফ্লেকশন—একটি টেকনোলজিক্যাল ডিভাইস যা মস্তিষ্কের স্মৃতি হাইজ্যাক করতে পারে। মেমোরি কার্ডটি সম্ভবত একটি পরীক্ষামূলক মডিউল, যা একসময় কোনো গোপন গবেষণার অংশ ছিল। সৌভিকের মাথায় দপদপ করছে একটাই প্রশ্ন—সে কি নিজেই সেই পরীক্ষার অংশ ছিল? ভিডিওতে দেখা তার অপরাধ—সে কি সত্যি ঘটেছিল, না তাকে ঘটানো হয়েছে?
এইসব চিন্তা যখন মস্তিষ্কে ঘূর্ণি তুলছে, তখন ফোনে একটি অজানা নম্বর থেকে কল আসে। ধীরে ধীরে সে ফোন তোলে। ওপাশ থেকে শোনা যায় একটি নিঃসাড় কণ্ঠ—”তুমি সত্যি কিছু করনি, কিন্তু করেছ।” এরপর ফোন কেটে যায়। সৌভিক ব্যাকট্রেস করে ফোন নম্বরটি—লোকেশন যায় ধানবাদের একটি পরিত্যক্ত ল্যাবের দিকে, যেখানে একসময় নিউরোসায়েন্স এবং ডেটা মডেলিং নিয়ে একটি বেসরকারি গবেষণা চলত। সৌভিক এখন নিশ্চিত—তাকে কেউ ব্যবহার করেছে, তার স্মৃতিকে পাল্টে দিয়েছে, এবং এই কার্ডে রেখে গেছে তথ্য-সমেত অপরাধ, যেন সে নিজেই তার দোষ স্বীকার করে। সৌভিক সিদ্ধান্ত নেয়—সেই ল্যাবে যাবে, সব সত্যের মুখোমুখি হবে। কারণ, যতক্ষণ না সে নিজের মনে নিজের অতীতকে পুনরায় দেখতে পাচ্ছে, ততক্ষণ এই বিভ্রান্তি চলতেই থাকবে।
ধানবাদের পরিত্যক্ত ল্যাবে ঢোকার সময় তার মনে হয় সে যেন নিজেরই কোনো পুরোনো ড্রিমসিকোয়েন্সে ঢুকছে। দেয়ালের পেনিং উঠে গেছে, ছাদের থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছে, কিন্তু ভিতরে এখনো জ্বলছে কিছু মেশিনের হালকা আলো। সেখানে সে খুঁজে পায় কিছু পরিত্যক্ত হার্ডড্রাইভ, তারিখ অনুযায়ী ল্যাব নোট, এবং কয়েকটি নাম—তার মধ্যে একটি তার নিজের: “Subject S.N.-15: সৌভিক নন্দী, ভিডিও এডিটর, ইনডিউসড রিমোট মেমোরি এক্সপেরিমেন্ট (IRME) সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।” সে দাঁড়িয়ে পড়ে—তার জীবন ছিল এক পরীক্ষাগারের চিপে বন্দি? সে কি মানুষ নাকি এক লাইভ ডেটা-সেট? ঘরের এক প্রান্তে থাকা পুরোনো মনিটরে সে প্লে করে ফেলে একটি ফোল্ডার, নাম “Final Trigger”—ভিডিও চলতে থাকে, এবং দেখা যায়—সৌভিক নয়, বরং একটি AI-র তৈরী হিউম্যান ড্রোন তার মুখ নিয়ে হত্যা করেছে লোকটিকে। কিন্তু ভিডিওর শেষে, সৌভিককেই সেখানে সাজানো হয়েছে যেন সে অপরাধী।
সে বুঝে যায়, এই প্রযুক্তি যতটা ডেটা প্রসেসিংয়ের, তার চেয়েও বেশি পারসেপশন ম্যানিপুলেশনের। শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নেয়, এসব কিছুকে সামনে এনে সরকার এবং মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করবে। ল্যাব থেকে সে তুলে আনে সব ডেটা, নিজেই বানায় একটি ডকুমেন্টারি—”The Memory Card Protocol”। ভিডিওটি সে পোস্ট করে ডার্কওয়েবে। কিছুদিনের মধ্যেই এক অজানা হ্যাকার গ্রুপ তাকে যোগাযোগ করে, বলে—”তোমার সাহস প্রশংসনীয়, কিন্তু খেলা এখনও শেষ হয়নি।” সৌভিক জানে, সত্য বের করেও সে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত—এইবার সে জানে, কে সে, আর কে তাকে বানাতে চেয়েছিল। সেই জ্ঞানই হয়তো আসল মুক্তি।
_____



