Bangla - প্রেমের গল্প

মেট্রোরেল প্রেম

Spread the love

সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়


পর্ব ১ – প্রতিদিনের দেখা

সকালের মেট্রো যেন শহরের ভেতরে আলাদা এক নদী। সেই নদীতে প্রতিদিন ভেসে যায় অসংখ্য মুখ, হাজারো ব্যস্ততা, কোলাহলের ঢেউ। অরণ্যের দিনও শুরু হয় ঠিক সেভাবেই—আলোর ফোঁটায় ভেসে ওঠা সল্টলেকের এক অচেনা ফ্ল্যাটবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে, অগণিত মানুষের সঙ্গে গা ঘেঁষে দক্ষিণমুখী মেট্রোরেলের কোচে উঠে বসা। অফিসের টাইমকার্ড, মিটিং, ল্যাপটপ—সবই যেন এক অদৃশ্য নিয়মের বাঁধনে বাঁধা। অথচ এই অচেনা যাত্রার মাঝেই কখন যে একটা মুখ ধীরে ধীরে তার দিনের শুরু আর শেষ হয়ে উঠতে লাগল, সে নিজেও টের পেল না।

প্রথম দিনটিতে কিছু বিশেষ ছিল না। এসপ্ল্যানেডের ভিড়ভাট্টার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অরণ্য হঠাৎ খেয়াল করল সামনের সিটে বসে থাকা এক মেয়ের দিকে। চওড়া ফ্রেমের চশমা, পরনে সাধারণ সুতির শাড়ি, কাঁধে ঝোলানো একখানা কাপড়ের ব্যাগ। মেয়েটি যেন পুরো ভিড়ের মধ্যে আলাদা। কোনো আড়ম্বর নেই, কোনো অতিরিক্ত ভঙ্গি নেই—কিন্তু তবুও তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। হয়তো সেই স্থির দৃষ্টি, কিংবা সামান্য ক্লান্ত অথচ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিমাই অরণ্যকে আকর্ষণ করেছিল।

এরপর প্রতিদিনই কেমন করে যেন তাদের দেখা হতে লাগল। সময়টা প্রায় একই। অরণ্য কোচে ঢুকেই খুঁজে নিতে লাগল সেই চেনা মুখ। কখনো মেয়েটি জানলার পাশে বসে থাকে, কখনো মাঝের সিটে, আবার কখনো দাঁড়িয়ে থাকে ভিড়ের মাঝে। অরণ্যের মনে হতে লাগল, শহরের এই যান্ত্রিক যাত্রার মধ্যে একমাত্র নিশ্চিত ব্যাপারটি হচ্ছে সেই মুখটিকে দেখা।

ধীরে ধীরে অরণ্যের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেল মেয়েটির ছোট ছোট অভ্যাসে। মেয়েটি বই পড়ে—কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো সমকালীন লেখক। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় না তাকে। কখনো চুল কানের পেছনে সরায়, কখনো শাড়ির আঁচল টেনে নেয় বুকের উপর। এইসব ক্ষুদ্র দৃশ্যই অরণ্যের ভেতর অদ্ভুত এক উষ্ণতা জাগাতে লাগল।

অরণ্য নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল—এ তো শহরের ভিড়, এখানে প্রতিদিনই নতুন মুখ দেখা যায়। কিন্তু তবুও সে মানতে পারল না, এই দেখা অন্যরকম। অচেনা হলেও মেয়েটির উপস্থিতি তার দিনের গতি বদলে দিচ্ছে। অফিসে পৌঁছনোর পর ক্লান্ত ভিড়ের থেকেও মুখে হাসি ফুটে ওঠে, সহকর্মীরা অবাক হয়ে বলে—“আজকেও বুঝি ভালো ঘুম হয়েছে?” অথচ অরণ্য জানত, সেই ভালো লাগার উৎস মেট্রোরেলের ভিড়ের মাঝেই লুকিয়ে আছে।

কিছুদিনের মধ্যে সে বুঝল, কেবল তাকিয়েই সে থেমে নেই। নিজের অজান্তেই তার দিনচর্যার অংশ হয়ে উঠছে সেই অচেনা মেয়ে। সিট ফাঁকা থাকলে মনে মনে আশা করে, মেয়েটি এসে বসুক সেখানে। জানলার বাইরের অন্ধকার টানেলের বদলে সে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির মুখের দিকে, যেন ভেতরে কোনো গল্প লেখা আছে।

একবার হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে অরণ্যের ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ মাটিতে পড়ে গেল। সে ব্যস্ত হয়ে নিচু হলো কুড়োতে, তখনই দেখল মেয়েটির হাত এগিয়ে এসেছে। দু’জনের হাত ছুঁয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য। কোনো কথা হয়নি, শুধু একটা ছোট্ট হাসি—যেন শহরের কোলাহলের মাঝখানে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে গেল।

সেই দিন অরণ্যের ভেতরে প্রথমবার কেমন এক অচেনা ধাক্কা লাগল। সে ভাবল, এ কি তবে কেবলই দেখা হওয়া? নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আরও কিছু?

কোচ থেকে নামার সময় অরণ্য পিছন ফিরে তাকাল। মেয়েটিও সেই মুহূর্তে জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিল। ভিড়ের ভেতর অরণ্যের মনে হলো, এ যাত্রা কেবল যাতায়াত নয়—এ যেন অচেনা এক গল্পের শুরু।

পর্ব ২ – চুপচাপ চোখের ভাষা

মেট্রো যেন প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে অরণ্যের কাছে, কিন্তু সেই অভ্যাসে এখন একটা অদ্ভুত উচ্ছ্বাস লুকিয়ে আছে। ট্রেনটা যখন শ্যামবাজার থেকে ধীরে ধীরে গতি নেয়, চারপাশে যাত্রীরা ঠাসাঠাসি করে জায়গা নেয়, তখনও অরণ্যের চোখ খুঁজে বেড়ায় সেই একটিমাত্র মুখ। অদ্ভুতভাবে, প্রায় প্রতিদিনই তাদের দেখা হয়—যেন কোনো অদৃশ্য সূক্ষ্ম নিয়মে বাঁধা।

প্রথম কয়েকদিন শুধু তাকানোই চলছিল। মেয়েটির দৃষ্টি সাধারণত বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ থাকত, কিংবা কখনো জানলার কাঁচে প্রতিফলিত নিজের মুখের দিকে। অরণ্যের চোখ তার উপর পড়লেও সে যেন টের পেত না। অথচ অরণ্য বুঝতে শুরু করল, তাকানোর ভেতরেও নীরব কথোপকথন লুকিয়ে থাকে।

একদিন ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অরণ্য খেয়াল করল, মেয়েটি ব্যাগ কোলের ওপর রেখে বই পড়ছে। ঠিক তখন এক বৃদ্ধ যাত্রী ভিড় ঠেলে দাঁড়িয়ে পড়লেন, আর অরণ্য সিট ছাড়তে গিয়ে অনিচ্ছায় মেয়েটির কাঁধে হালকা ধাক্কা লাগিয়ে ফেলল। অরণ্য তৎক্ষণাৎ দুঃখ প্রকাশ করল চোখে চোখ রেখেই। মেয়েটি এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর ঠোঁটে একফোঁটা হাসি খেলে গেল। কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়নি, অথচ সেই হাসিই যেন অরণ্যের সারা দিনের প্রাণশক্তি হয়ে দাঁড়াল।

এরপর থেকেই অরণ্য লক্ষ্য করল, তাদের মধ্যে চুপচাপ একটা বোঝাপড়া তৈরি হচ্ছে। যখনই ভিড় বাড়ে, অরণ্য অজান্তেই তার পাশে একটু জায়গা করে দেয়। আবার মেয়েটিও কখনো ব্যাগ সরিয়ে বসার জায়গা বানিয়ে দেয় অন্যদের জন্য, অথচ সেই ইঙ্গিত অরণ্যের দিকে পৌঁছোয় আগেভাগেই।

এক সন্ধ্যায়, অফিস থেকে দেরি করে বেরিয়েছিল অরণ্য। ট্রেনে লোক কম, চারপাশে ফাঁকা সিট। তবুও সে দাঁড়িয়ে রইল, কারণ সামনের সিটে মেয়েটি বসে আছে। জানলার বাইরের অন্ধকার টানেলে আলো-ছায়া খেলে যাচ্ছে, আর মেয়েটির মুখের উপর তার প্রতিফলন। অরণ্যের মনে হলো, এ শহরের অগণিত শব্দের ভেতরেও এক ধরনের স্থিরতা আছে, যা শুধু এই চোখের ভাষাতেই ধরা দেয়।

চোখের দৃষ্টির এই টানাপোড়েন কেবলই মুগ্ধতা নয়—তার মধ্যে ভাসছিল এক ধরনের প্রশ্নও। অরণ্যের মনে হচ্ছিল, মেয়েটি কি সত্যিই তার দিকে খেয়াল করে? নাকি সবটাই কেবল নিজের কল্পনা? তবুও সে সাহস করে কোনোদিন কথা বলতে পারল না। প্রতিদিনই ভেবেছে, আজ হয়তো একটা সাধারণ কথা বলবে—“বইটা কেমন?” অথবা “এই ট্রেনেই নামেন?” কিন্তু কথাগুলো যেন গলায় আটকে যায়।

তবুও, নীরবতারও এক বিশেষ শক্তি আছে। ভিড়ের মধ্যে যখন অরণ্যের হাত ধরে রাখা রডে মেয়েটির হাত এসে ছুঁয়ে গেল, দু’জনেই হাত সরায়নি। এক মুহূর্তের জন্য তারা চোখে চোখ রাখল, আর সেই দৃষ্টি যেন বলে দিল—কোনো শব্দের দরকার নেই, বোঝার জন্য এটাই যথেষ্ট।

অরণ্য তখনই বুঝল, এই অচেনা যাত্রা নীরবে হলেও কোথাও গাঢ় হয়ে উঠছে। কোনো ফোন নম্বর নেই, কোনো নাম জানা নেই, তবুও দু’জনের মধ্যে এক অদৃশ্য সুতোর বাঁধন তৈরি হচ্ছে। মেট্রোরেল কেবল শহরের স্টেশন থেকে স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে না, দু’জন অচেনা মানুষকেও ধীরে ধীরে টেনে আনছে একে অপরের কাছে।

অরণ্যের দিনলিপিতে যেন নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো—একটা অধ্যায় যেখানে শব্দ নেই, শুধু চোখের ভাষাই যথেষ্ট।

পর্ব ৩ – হালকা হাসি

কলকাতার ভিড়ভাট্টা মেট্রো যেন প্রতিদিন একইভাবে বয়ে চলে—একই গতি, একই স্টেশন, একই হর্নের শব্দ। অথচ অরণ্যের কাছে প্রতিদিনই নতুন হয়ে ধরা দিচ্ছিল, কারণ প্রতিদিনই সে তাকাচ্ছিল একই মুখের দিকে, নতুন কোনো অজুহাত খুঁজছিল চোখ রাখার। নীরব দৃষ্টির খেলা এতদিন ধরে চলছিল, কিন্তু একটাও শব্দ হয়নি। যেন শব্দ বেরোলে এই গোপন সমঝোতা ভেঙে যাবে।

একদিন সকালবেলা এসপ্ল্যানেড স্টেশন থেকে ভিড় ঠেলে কোচে ঢুকতে গিয়ে অরণ্যের ব্যাগের ভেতর থেকে হঠাৎ কয়েকটা কাগজ মাটিতে পড়ে গেল। অফিসের নোট, একাধিক প্রেজেন্টেশনের খসড়া। অরণ্য তাড়াহুড়ো করে নিচু হয়ে কাগজ কুড়োতে লাগল। ঠিক তখনই পাশে বসা মেয়েটির হাতও এগিয়ে এল। দু’জনের আঙুল একসঙ্গে ছুঁয়ে গেল কাগজের কোণায়।

এক মুহূর্তের জন্য সময় থমকে দাঁড়াল। চারপাশের ভিড়ের ধাক্কাধাক্কি, ঘোষকের কণ্ঠস্বর, মেট্রোর গর্জন—সব মিলেমিশে যেন আবছা হয়ে গেল। শুধু রইল হাত ছোঁয়ার উষ্ণতা আর মুখোমুখি হওয়া দৃষ্টি।

অরণ্য চোখ তুলে তাকাতেই মেয়েটি হালকা হাসল। এমন হাসি, যা কোনো আলাপের দরকার রাখে না। সরল অথচ গভীর। যেন সেই একফোঁটা হাসির ভেতরেই গোপন ছিল অগণিত কথার সম্ভার।

অরণ্য কাগজগুলো গুছিয়ে ব্যাগে রাখতে রাখতে ভেতরে এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করল। এতদিনের দৃষ্টিসংলাপের ভেতর সেই প্রথম প্রকাশিত স্বীকৃতি। এমনকি অফিসে পৌঁছে সহকর্মীরা যখন তাকে জটিল প্রজেক্টের ডেডলাইন নিয়ে জিজ্ঞেস করছিল, তার মাথার ভেতরে শুধু সেই হাসিটাই ঘুরছিল।

পরদিনও দেখা হলো। মেয়েটি এবার জানলার ধারে বসেছিল, অরণ্য সামনের দিকেই দাঁড়িয়ে। স্টেশন পার হওয়ার সময় ট্রেন ঝাঁকুনি খেল, অরণ্য সামলে নিতে গিয়ে জানলার ফ্রেমে হাত রাখল। মেয়েটি হেসে তাকাল তার দিকে, যেন আগের দিনের ঘটনার অনুবাদ দিচ্ছে।

সেই হাসিটাই হয়ে উঠল অরণ্যের দিনরাতের সঙ্গী। অফিসের কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়েও সে যেন কল্পনায় সেই চোখদুটি খুঁজে বেড়াত। লাঞ্চব্রেকের আড্ডায় সহকর্মীরা যখন সিনেমা বা খেলাধুলোর আলোচনা করত, অরণ্যের মনে হতো, এইসব কোলাহলের বাইরে তার নিজের একটা গোপন জগৎ আছে, যেখানে কেবল সেই মেয়েটির হাসি।

অরণ্য বুঝতে পারছিল, এটা আর কেবলই যাতায়াত নয়। প্রতিদিনের যাত্রা যেন ধীরে ধীরে গল্প হয়ে উঠছে। আর সেই গল্পের প্রথম অক্ষর লেখা হয়ে গেল এই হালকা হাসির মাধ্যমে।

পর্ব ৪ – অনামিকা

অরণ্য এখন আর নিজেকে বারণ করতে পারে না। প্রতিদিন সকালে মেট্রো ধরার সময় তার প্রথম চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে—আজ কি দেখা হবে? মেয়েটি কি আজ একই কোচে উঠবে? ভিড়ের মাঝে তার মুখটা কি আবার চোখে পড়বে?

এই প্রশ্নগুলো যেন অরণ্যের ভেতরে এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি করেছে। অফিসে প্রেজেন্টেশনের আগে যেমন উদ্বেগ হয়, বা পরীক্ষার হলের সামনে দাঁড়িয়ে যেমন কাঁপুনি লাগে, তেমনি এক অদৃশ্য উত্তেজনা তার ভেতর দানা বাঁধছে।

তবে এত কিছু সত্ত্বেও একটা ব্যাপার তাকে অস্থির করে তোলে—সে এখনও মেয়েটির নাম জানে না। কোনো কথাই হয়নি তাদের মধ্যে। অথচ নামহীন সেই মেয়েটিই যেন ধীরে ধীরে অরণ্যের জীবনে সবচেয়ে আপন হয়ে উঠছে।

একদিন বিকেলে, কাজের চাপ সামলে মেট্রোয় উঠেছিল অরণ্য। ক্লান্ত মুখ, কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। চোখ ঘুরিয়ে দেখল, মেয়েটি সামনের সিটে বসে আছে। হাতে একখানা বই—‘শেষের কবিতা’। পাতার ফাঁক দিয়ে মেয়েটির আঙুল নরম ভঙ্গিতে বইয়ের রেখা ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

অরণ্যের মনে হলো, এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। নামটা না জেনেও সে মেয়েটির হাসি, চুলের খোঁপা বাঁধার ভঙ্গি, বই ধরার কায়দা, এমনকি নীরবে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা চোখের ভাষা পর্যন্ত চেনে। অথচ নামটাই জানে না। নামহীনতা যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছে।

সে অনেকবার ভেবেছে, আলাপ শুরু করবে। হয়তো বলবে—“আপনি প্রতিদিন এই ট্রেনেই ওঠেন, তাই না?” অথবা “এই বইটা আমিও পড়েছি।” কিন্তু ঠোঁট পর্যন্ত গিয়েও শব্দগুলো বেরোয় না। ভয় হয়—যদি মেয়েটি অবাক হয়ে তাকায়? যদি ভ্রূ কুঁচকে ওঠে? যদি সবকিছু শেষ হয়ে যায়?

তবুও নীরবতা সত্ত্বেও তাদের মাঝে সম্পর্কটা যেন গাঢ় হচ্ছিল। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা একে অপরের উপস্থিতি টের পেত। হাতের স্পর্শ, দৃষ্টির বিনিময়, কিংবা হাসির ছোট্ট ইঙ্গিত—এই সবকিছুই নামের অভাব পূরণ করে দিচ্ছিল।

অরণ্যের ডায়েরির পাতায় এখন এক নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে। প্রতিদিনের শেষে সে লিখে রাখে—“আজও দেখা হলো।” কখনো যোগ করে, “আজ বই পড়ছিল।” আবার কোনোদিন লিখে, “আজ একটু ক্লান্ত লাগছিল ওর।” অরণ্যের কাছে সেই অচেনা মেয়েটি এখন আর কেবল যাত্রী নয়, এক নামহীন অথচ আপন অনামিকা।

এভাবেই নামহীনতা আর নীরবতা মিলে তৈরি হলো এক অনিশ্চিত অথচ গভীর বন্ধন। অরণ্য বুঝতে পারছিল, সে ধীরে ধীরে এক গল্পের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, যেখানে নাম জানা নেই, কিন্তু অনুভূতি দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে।

পর্ব ৫ – হঠাৎ অনুপস্থিতি

অরণ্যের দিনযাপনের ছন্দ এখন আর শুধু অফিসের মিটিং, ফাইল, বা কম্পিউটারের টেবিলে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিদিন সকালে মেট্রো ধরার মুহূর্ত থেকেই তার দিন শুরু হয়, আর সেই শুরুটা পূর্ণ হয় যখন চোখে পড়ে সেই মেয়েটিকে—তার অনামিকাকে। নাম এখনও জানা হয়নি, তবু তার উপস্থিতিই অরণ্যের প্রতিদিনকে আলাদা করে তোলে।

কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই তাল কেটে গেল।

সকালটা ছিল অন্য দিনের মতোই। অরণ্য তাড়াহুড়ো করে নেমে এসেছিল বাড়ি থেকে, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে কফির কাগজের কাপ। মেট্রোতে উঠে ভিড় ঠেলে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখ বারবার ঘুরে যাচ্ছিল সেই দিকেই, যেখানে প্রায় প্রতিদিন বসে থাকে মেয়েটি। কিন্তু আজ সিট ফাঁকা। স্টেশন পেরোলো, ভিড় নামল-ওঠল, কিন্তু মেয়েটি এল না।

প্রথমে অরণ্য ভেবেছিল—হয়তো আজ অন্য কোচে উঠেছে। পরক্ষণেই মনে হলো, হয়তো সময়টা মেলেনি। কিন্তু যখন মেট্রো শেষ স্টেশনে এসে পৌঁছল, আর মেয়েটির মুখ একবারও দেখা গেল না, তখন বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা নামল।

সেই একদিনেই বোঝা গেল, কতখানি জায়গা দখল করে ফেলেছে মেয়েটি অরণ্যের ভেতরে। অরণ্য অফিসের ফাইলে মন বসাতে পারল না। সহকর্মী বলল, “আজ এত চুপচাপ কেন?” সে উত্তর দিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, শহরের কোলাহল যেন হঠাৎ নীরব হয়ে গেছে।

পরদিন আবার মেট্রো ধরল অরণ্য। মনে মনে প্রার্থনা করল—আজ যদি আসে। কিন্তু না, আবারও অনুপস্থিতি। সিট ফাঁকা, জানলার ধারে কোনো বই নেই, ব্যাগ কোলের উপর রাখা নেই। শুধু অরণ্যের চোখ এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াল, যেন অচেনা ভিড়ের মাঝে সেই এক পরিচিত মুখ খুঁজে ফিরছে।

দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল। তিন দিন, চার দিন—তবুও মেয়েটি এল না। প্রতিদিন সকালটা অরণ্যের কাছে এক অনিশ্চয়তায় ভরা হয়ে উঠল। কখনো মনে হতো, হয়তো আর কোনোদিনই দেখা হবে না।

অরণ্য প্রথমবার টের পেল, সে কেবল চোখের ভাষায় গড়ে তোলা এক নীরব সম্পর্কের ভেতর আটকে পড়েনি—সে আসলে সেই সম্পর্কেই বেঁচে উঠেছে। মেয়েটি নেই, অথচ তার অনুপস্থিতিই যেন আরও বেশি করে মেয়েটির উপস্থিতিকে স্পষ্ট করে তুলছে।

রাতের বেলা ডায়েরি খুলে লিখল—
“আজও এল না। জানি না, কাল আসবে কি না। অথচ অদ্ভুতভাবে বুঝতে পারছি, আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারি না।”

পর্ব ৬ – খোঁজাখুঁজি

অরণ্যের দিন যেন হঠাৎ থমকে গেছে। সকালবেলার মেট্রোতে সেই মুখ নেই, জানলার ধারে রাখা বই নেই, কোলের উপর ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ নেই। একসময়ের নিশ্চিত ছন্দ এখন অনিশ্চয়তার শূন্যতায় ভেঙে পড়েছে। তিনদিন, চারদিন, তারপর পুরো এক সপ্তাহ—তবু মেয়েটি আর উঠল না মেট্রোয়।

প্রথম দু’দিন অরণ্য নিজেকে বোঝাতে চেয়েছিল—এ শহর ব্যস্ত, হাজারো কারণ থাকতে পারে। হয়তো অসুস্থ হয়েছে, হয়তো অফিসের সময় বদলে গেছে, কিংবা হয়তো নতুন রুটে যাচ্ছে। কিন্তু সময় যতই কেটে যাচ্ছিল, সেই যুক্তিগুলো অরণ্যের মনকে আর শান্ত করতে পারছিল না। বরং অস্থিরতা বাড়ছিল।

সে অদ্ভুতভাবে খুঁজতে শুরু করল মেয়েটিকে। ভিড়ের মধ্যে প্রতিটি মুখের দিকে তাকাত, যেন মেয়েটি হঠাৎ ফিরে আসবে। কোনো কোনো স্টেশনে নামতে নামতে চারপাশে চোখ বুলাত। মনে হতো, হয়তো মেয়েটি অন্য কোচে উঠেছে। কিন্তু না, কোথাও নেই।

একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে সে সিদ্ধান্ত নিল—আজ একটু সময় নিয়ে খুঁজবে। মেয়েটির নাম সে জানে না, কোথায় থাকে তাও জানে না, কিন্তু ভরসা একটাই—মেট্রো। অরণ্য এসপ্ল্যানেডে নেমে কয়েকটা কোচ ঘুরল, লোকজনের ভিড়ের মাঝে তাকাল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল প্ল্যাটফর্মে, মনে হলো, হয়তো হঠাৎ করেই চলে আসবে। কিন্তু না।

ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল—প্ল্যাটফর্মের ওপারে, ভিড়ের ফাঁক গলে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। হৃদস্পন্দন এক মুহূর্তে বেড়ে গেল অরণ্যের। সে দৌড়াতে গিয়েও থেমে গেল। কারণ মেয়েটি একা নয়। পাশে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে, মনে হলো বেশ চেনা সম্পর্ক। দু’জনের হাসি, কথোপকথন দেখে অরণ্যের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল।

সে একপা এগোল, আবার থেমে গেল। ভিড়ের মাঝেই মেয়েটির মুখ হঠাৎ তার চোখে পড়ল—চশমার কাঁচে আলো ঝিলিক দিচ্ছে, আর সেই একই শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলছে। কিন্তু মেয়েটি অরণ্যকে খেয়াল করল কি না, সে জানল না। এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব ভর করল মনে—এতদিন যে মুখটা কেবল তার চোখে ছিল, তা যদি আসলে অন্য কারও কাছে নিবেদিত হয়?

সেই রাতে ডায়েরির পাতায় লিখল অরণ্য—
“আজ ওকে দেখলাম। কিন্তু একা নয়। পাশে একজন ছিল। আমি জানি না সে কে। জানি না কেন বুকটা হঠাৎ খালি হয়ে গেল।”

অরণ্য বুঝতে পারল, তার ভেতরে শুধু অস্থিরতা নেই, হিংসা নামক এক নতুন অনুভূতিও জন্ম নিচ্ছে। মেয়েটির নামহীনতার মতোই এখন তার সম্পর্কটাও এক ধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পর্ব ৭ – অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ

দিন কয়েক ধরে অরণ্যের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করছিল। প্রতিদিন সকালবেলা মেট্রো ধরলেও তার চোখে সেই মুখ আর ধরা দিচ্ছিল না। কেবল একবার প্ল্যাটফর্মে হঠাৎ দেখা—আর সেদিনই মেয়েটির পাশে থাকা সেই যুবক যেন অরণ্যের সমস্ত কল্পনাকে চূর্ণ করে দিয়েছিল।

অরণ্য চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল অফিসে। কাজের ফাইল খোলা থাকলেও মন বসছিল না। সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করছিল, “কী হয়েছে রে? এত উদাস কেন?” অরণ্য হাসি দিয়ে এড়িয়ে যেত। আসলে সে নিজেও উত্তর জানত না।

এক রবিবার বিকেলে অরণ্য বেরিয়ে পড়ল বইমেলায়। বহুদিন ধরেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু অফিস আর ব্যক্তিগত অস্থিরতায় হয়ে ওঠেনি। ভিড়ভাট্টার স্টলে ঘুরতে ঘুরতে সে যেন অন্য এক জগতে পৌঁছে গেল—নতুন বইয়ের গন্ধ, স্টলের আলো, মানুষের কোলাহল।

ঠিক তখনই ভিড়ের ভেতর চোখে পড়ল সেই পরিচিত মুখ। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে একটা বুকস্টলের সামনে, হাতে বইয়ের থরে ভরা ব্যাগ। চশমার কাঁচে আলো ঝিলিক দিচ্ছে, ঠোঁটে স্বাভাবিক হাসি। অরণ্যের হৃদস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে গেল।

সে থমকে দাঁড়াল। মনে হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখছে। তবে এবার মেয়েটি একা। পাশে কোনো যুবক নেই। অরণ্য সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল। বুকের ভেতর কাঁপন থাকলেও ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল।

“এই বইটা ভালো?” অরণ্যের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, তবুও প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।

মেয়েটি তাকাল তার দিকে। প্রথমবার শব্দে তাদের আলাপ হলো। মেয়েটি সামান্য বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ, খুব ভালো। আপনি পড়েননি?”

অরণ্য মাথা নাড়ল। মেয়েটি একটু হেসে বইটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। “চেষ্টা করে দেখুন।”

অরণ্যের মনে হচ্ছিল, এ মুহূর্তে চারপাশের ভিড়, হট্টগোল, বিক্রেতার ডাক—সবকিছুই মিলিয়ে গেছে। কেবল তারা দু’জন দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত নীরবতার ভেতরে।

“আমি অরণ্য,” সে নাম বলল প্রায় ফিসফিস করে।

মেয়েটি তাকাল তার চোখের দিকে, তারপর শান্ত স্বরে বলল, “আমি অনন্যা।”

অরণ্যের বুকের ভেতর ঝড় বয়ে গেল। অনন্যা—একটা নাম, যেটার জন্য সে এতদিন অপেক্ষা করছিল। সেই নাম যেন হঠাৎই পরিচিত মুখটিকে নতুন আলোয় ভরে দিল।

সেদিন বইমেলার ভিড়ের ভেতর তারা কিছুক্ষণ হাঁটল একসঙ্গে। প্রিয় লেখক নিয়ে কথা হলো, কোন বই কখন পড়েছে সেই নিয়ে আলোচনা হলো। অরণ্য টের পেল, এতদিনের নীরব দৃষ্টিসংলাপ যেন হঠাৎ কথায় রূপ নিল।

রাতের ডায়েরিতে লিখল সে—
“আজ প্রথমবার নাম জানলাম। অনন্যা। হয়তো আজ থেকেই সত্যি সত্যি আমাদের গল্প শুরু হলো।”

পর্ব ৮ – কাছাকাছি আসা

সেদিন বইমেলায় অনন্যার সঙ্গে প্রথম আলাপের পর থেকেই অরণ্যের দিনগুলো যেন অন্য রঙে ভরে উঠল। এতদিন যে মুখটা শুধু চোখের ভাষায় ধরা দিত, এখন তার একটা নাম আছে, একটা কণ্ঠস্বর আছে। নাম বলার পর অনন্যা যে হাসি দিয়েছিল, তা বারবার ভেসে উঠছিল অরণ্যের মনে।

এরপর মেট্রোযাত্রা আর আগের মতো রইল না। আগে তারা নীরব থেকে শুধু চোখের দৃষ্টি বিনিময় করত, আর এখন দু’জনের মধ্যে কথোপকথন শুরু হয়েছে। প্রথমে বইয়ের প্রসঙ্গেই কথা হতো। অনন্যা বলত, “এই লেখকের লেখায় আমি সবসময় একটা আশ্চর্য নীরবতা পাই।” অরণ্য মন দিয়ে শুনত, তারপর নিজের মতামত জানাত। ধীরে ধীরে সিনেমা, গান, এমনকি শৈশবের স্মৃতিও আলাপের বিষয় হয়ে উঠল।

অরণ্য অবাক হয়ে দেখল, অনন্যার সঙ্গে কথা বলতে কোনো চাপ নেই। শহরের কোলাহলের মাঝেও যেন তারা দু’জন নিজেদের জন্য একটা আলাদা জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। একদিন অনন্যা হেসে বলল, “আপনি প্রতিদিন এত ভিড়ের মধ্যেও দাঁড়িয়ে যান কেন? সিট ফাঁকা থাকলেও বসেন না।” অরণ্য একটু লজ্জা পেয়ে উত্তর দিল, “হয়তো জানালার বাইরে নয়, ভেতরেই তাকানোর কিছু থাকে।” অনন্যা তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল, চোখে হালকা ঝিলিক খেলে গেল।

দিন যত এগোতে লাগল, তাদের সম্পর্কও যেন অদৃশ্য বাঁধন থেকে বেরিয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল। অফিসের ফাঁকে ফাঁকেও অরণ্যের মনে অনন্যার কণ্ঠ বাজতে লাগল। অনন্যা বলেছিল, তার বাড়ি উত্তর কলকাতায়, ছোটবেলা থেকেই বইয়ের ভেতরেই ডুবে থাকতে ভালোবাসে। আর অরণ্য শোনাচ্ছিল তার নিজের অফিসের ব্যস্ততা, রাত জেগে ডেডলাইন সামলানোর গল্প।

মেট্রোরেল তাদের একসঙ্গে করে দিলেও এখন তারা মেট্রোর বাইরে দেখা করার কথাও ভাবতে শুরু করল। অনন্যা একদিন বলল, “আপনি কি রবিবার সময় পাবেন? কলেজ স্ট্রিটে নতুন একটা বইয়ের দোকান খুলেছে।” অরণ্যের বুকের ভেতর কেমন একটা আলোড়ন উঠল। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল।

সেই রবিবার বিকেলে তারা প্রথম মেট্রোর বাইরে হাঁটল। কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানের ভিড়ের মধ্যে অনন্যা উচ্ছ্বাসে বই দেখাচ্ছিল, অরণ্য তাকিয়ে থাকছিল তার প্রাণবন্ত মুখের দিকে। ভিড়ের মধ্যে তাদের হাঁটাহাঁটি, মাঝে মাঝে চায়ের দোকানে দাঁড়ানো, পুরোনো বইয়ের গন্ধ—সবকিছুই যেন প্রেমের প্রথম দিনের মতো মনে হচ্ছিল।

অরণ্যের ডায়েরিতে সেদিন লেখা হলো—
“আজ বুঝলাম, অনন্যাকে শুধু মেট্রোর জানালার ফ্রেমে বাঁধা যায় না। ওর হাসি, ওর কথা, সব মিলিয়ে আমার প্রতিদিনের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। আমরা কাছে আসছি—আর এই কাছে আসাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে সত্যি ঘটনা।”

পর্ব ৯ – স্বীকারোক্তি

শহরের ভিড়, অফিসের চাপ, মেট্রোর শব্দ—সবকিছুর মাঝেই অরণ্যের দিনগুলো বদলে যাচ্ছিল। কারণ এখন প্রতিটি দিন সে অনন্যার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারছিল। একসময় যে নীরব দৃষ্টিসংলাপই তাদের একমাত্র সেতু ছিল, তা এখন কথায়, আলাপে, হাসিতে ভরপুর হয়ে উঠেছে।

তবুও অরণ্যের ভেতরে একটা অস্থিরতা থেকেই গেল। সে জানত, এই অনুভূতি আর শুধু দেখা-সাক্ষাৎ বা বইয়ের গল্পে সীমাবদ্ধ নেই। প্রতিদিনের এই একসঙ্গে সময় কাটানো, অনন্যার হাসি, কথোপকথনের ভেতর অরণ্য নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতিতে বাঁধা। আর সেই প্রতিশ্রুতি প্রকাশ না করলে বুকের ভেতরের ভার যেন বেড়েই চলবে।

এক সন্ধ্যায়, অফিস থেকে ফেরার পথে মেট্রো ফাঁকা ছিল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে, জানলার কাঁচে জলবিন্দু জমে শহরের আলো ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। অনন্যা জানলার ধারে বসেছিল, অরণ্য তার সামনে দাঁড়িয়ে। চারপাশে খুব বেশি লোকজন ছিল না।

অরণ্য হঠাৎ সাহস করে বলল, “শোনো, একটা কথা বলব তোমাকে।”

অনন্যা বই বন্ধ করে তার দিকে তাকাল। “হ্যাঁ, বলুন।”

অরণ্যের কণ্ঠ কেঁপে উঠছিল, তবুও সে বলল, “জানো, আমি প্রতিদিন মেট্রোতে উঠি শুধু তোমাকে দেখার জন্য। তোমাকে না দেখলে আমার দিনটাই ফাঁকা মনে হয়। আমি জানি না, তুমি কীভাবে নেবে, কিন্তু… আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই অরণ্যের বুক থেকে যেন একটা ভার নেমে গেল। অথচ ঠিক পরের মুহূর্তেই ভয়ের ঢেউ আছড়ে পড়ল—অনন্যা কী উত্তর দেবে?

অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার চোখে অদ্ভুত একটা আলো ফুটে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁটে হাসি খেলে গেল। “আপনাকে প্রথম দেখেই আমি ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো কেবল একজন যাত্রী। কিন্তু যখন বুঝলাম প্রতিদিনের এই দেখা আমারও দিনকে বদলে দিচ্ছে, তখনই মনে হয়েছিল… হয়তো এর নাম ভালোবাসাই।”

অরণ্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ভিড়ভাট্টার শহরে, শব্দের কোলাহলে, তারা দু’জন বসে রইল এক অদ্ভুত নীরবতায়—যেখানে কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই, শুধু হৃদয়ের স্পন্দনই যথেষ্ট।

সেই রাতের ডায়েরিতে অরণ্য লিখল—
“আজ স্বীকার করলাম। আর অনন্যা আমাকে ফিরতি উত্তর দিল। মনে হলো, আমি আর একা নই। আমার যাত্রা এখন থেকে আমাদের যাত্রা।”

পর্ব ১০ – শেষ স্টেশন, নতুন শুরু

শহরের আকাশ মেঘে ঢেকে আছে। সকাল থেকে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তায় জল জমেছে। অরণ্য অফিস শেষে মেট্রোয় ওঠার আগেই মনে মনে ভেবেছিল—আজ অনন্যার সঙ্গে দেখা হলে কিছু আলাদা করবে। স্বীকারোক্তির পর থেকে দু’জনের মধ্যে যেন অদ্ভুত এক স্বস্তি নেমে এসেছে। আর আজকের দিনটা তাদের কাছে নতুন মানে বহন করছিল।

মেট্রো গর্জন তুলে অন্ধকার টানেলের ভেতর ছুটছিল। জানলার কাঁচে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল, আর সেই ফোঁটার আড়ালে দেখা যাচ্ছিল অনন্যার মুখ। সে হাসিমুখে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “বৃষ্টির দিনে শহরটা যেন আরও কাছে টেনে নেয়।”

অরণ্য মৃদু হেসে উত্তর দিল, “হয়তো আমাদেরও তাই করছে।”

স্টেশন থেকে নামতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ভিড়ভাট্টা যাত্রীরা ছাতা মেলে দৌড়ে গেল রাস্তায়। কিন্তু অরণ্য আর অনন্যা থেমে গেল প্ল্যাটফর্মের ধারে। তারপর একসঙ্গে নামল ভিজে রাস্তায়। ছাতা খোলা হয়নি, তারা দু’জনেই ভিজছিল—হয়তো এই ভিজে যাওয়া তাদের সম্পর্কের প্রথম মুক্ত উন্মোচন।

অরণ্য হাত বাড়িয়ে দিল। অনন্যা এক মুহূর্তের জন্য তাকাল, তারপর চুপচাপ হাত রাখল তার হাতে। শহরের ভিড়ের মধ্যে, বৃষ্টিভেজা আলোছায়ায় তারা হাঁটতে লাগল পাশাপাশি। রাস্তার আলো ভিজে কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছিল, ট্যাক্সি হর্ন দিচ্ছিল, ভিজে পাতার গন্ধ ভেসে আসছিল—সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন এক অদৃশ্য ছবির মতো হয়ে উঠল।

অরণ্য ফিসফিস করে বলল, “তুমি জানো, মেট্রোরেল আমাদের কেবল যাত্রী থেকে একে অপরের কাছে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমরা আর যাত্রী নই—আমাদের যাত্রা একসঙ্গেই চলবে।”

অনন্যা তার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, “শেষ স্টেশন বলে কিছু হয় না। প্রতিটা স্টেশনই আসলে নতুন শুরু।”

তাদের হাসি মিশে গেল বৃষ্টির শব্দে। ভিজে শহর, ভিজে হাত, ভিজে চোখ—সব মিলিয়ে মনে হলো, আজ থেকেই শুরু হলো নতুন গল্প।

রাতের ডায়েরিতে অরণ্য শেষ লাইন লিখল—
“আজ শেষ স্টেশনে নেমে বুঝলাম, আমাদের যাত্রা আসলে সবে শুরু হয়েছে।”

WhatsApp-Image-2025-09-15-at-2.31.46-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *