অর্জন লাহা
প্রথমবারের দেখা
দার্জিলিংয়ের হাওয়া যেন একেকটা কথা বলে—ভোরের মেঘে ঢাকা রাস্তা, কুয়াশায় গা ঢাকা স্কুল বিল্ডিং, আর দূর থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক—সব মিলিয়ে একরকম মায়া তৈরি করে। “সেন্ট পলস হিল স্কুল” আমার দ্বিতীয় বাড়ি ছিল অনেকটা। কাঠের পুরনো দরজা, খাড়া সিঁড়ি, আর ছাদে লতানো গাছ—এই স্কুলে সময় যেন একটু ধীরে চলে। আমি তখন ক্লাস টেনের ছাত্র, অয়ন চক্রবর্তী, আর আমার সবথেকে প্রিয় জায়গা ছিল স্কুল লাইব্রেরির জানালার ধারে চেয়ারটা।
সেই চেয়ারেই একদিন বসে ছিলাম যখন প্রথম দেখলাম ওকে—মীরা সেন। সাদা স্কুল শার্ট আর নীল স্কার্টে, যেন এক মেঘভেজা সকাল হাঁটতে হাঁটতে এসে বসেছে লাইব্রেরির কোণে। মাথার চুলগুলো নেমে এসেছে কপাল ছুঁয়ে, আর হাতে ধরা ছিল “Anne of Green Gables”। ওর চোখে ছিল এমন একধরনের স্থিরতা, যা খুব কম বয়সেই আসে, অনেকটা পাথরের নিচে চাপা জলধারার মতো। আমি দূর থেকে চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম। ঠিক তখনই মীরা চোখ তুলে আমার দিকে তাকায়, আর হালকা একটা হাসি দেয়। সেই হাসি ছিল নিঃশব্দ, অথচ এমন গভীর যে বুকের ভিতর কেমন যেন ধক করে ওঠে।
মীরা নতুন ভর্তি হয়েছিল আমাদের স্কুলে। শুনেছিলাম তার বাবা পাহাড়ে বদলি হয়ে এসেছেন, তাই ওর মা ওকে ভর্তি করে দিয়েছেন এখানে। স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী প্রথম ক’দিন একটু আড়ষ্ট থাকাই স্বাভাবিক, কিন্তু মীরা ছিল অন্যরকম। কারও সঙ্গে বিশেষ মিশত না, আবার একেবারে একা থাকতও না। যেন একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলত সবার সঙ্গে। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল, ওর সঙ্গে আমার পরিচয় আগে থেকেই আছে, শুধু মনে নেই ঠিক কবে বা কোথায়।
আমার এই নীরব মুগ্ধতা হয়তো কেউ টের পায়নি, কিন্তু আমি নিজে জানতাম প্রতিদিন ওকে দেখার অজুহাতেই হয়তো আমি লাইব্রেরিতে বেশি সময় কাটাচ্ছিলাম। সেই সুযোগটা এল ইংরেজি প্রজেক্টের হাত ধরে। মিসেস চ্যাটার্জি আমাদের গ্রুপে ভাগ করে দিয়েছিলেন—পাঁচজনের একটা দল, আর বিষয় ছিল “পাহাড়ের ঋতু পরিবর্তন ও আমাদের অনুভব।” ভাগ্য এমনই যে আমি, মীরা, অনিরুদ্ধ, রেশমি আর দীপ্ত এক দলে পড়লাম। আমি তখন চুপচাপ মনে মনে আনন্দে ছিলাম।
প্রজেক্টের প্রথম দিন আমরা সবাই লাইব্রেরির কোণে জড়ো হলাম। আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলাম, “তুমি কী নিয়ে কাজ করতে চাও?” মীরা সরাসরি চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “তুমি কী নিয়ে ভাবছো সেটা আগে বলো।” আমি তখন একটু হেসে বলেছিলাম, “আমি ভাবছিলাম শরতের আলো আর দার্জিলিংয়ের কুয়াশা নিয়ে।” ওর মুখে তখন প্রথম একটা খোলামেলা হাসি দেখি। বলল, “তাহলে আমরা একদম ঠিক পথেই আছি।”
এরপর থেকে আমাদের কথা বাড়তে থাকে। প্রথমে শুধু প্রজেক্ট, তারপর কবিতা, সিনেমা, গল্প, বই—সব মিলিয়ে আমাদের আলাপ যেন একটা দীর্ঘ ভোরের মতো হতে থাকে, যেটার শেষ কোথায় জানি না। মীরা নিজের মধ্যে খুব শান্ত ছিল, কিন্তু ওর চোখে ছিল এক অদ্ভুত রকমের ব্যথা। কেউ না বললেও বোঝা যেত, এই মেয়েটার মধ্যে অনেক কিছু জমে আছে, যা হয়তো বলার জায়গা পায়নি।
একদিন স্কুল ছুটির পর আমরা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটেছিলাম। চারদিকে কুয়াশা জমছিল। ও হঠাৎ বলল, “তুমি কি কখনও নিজেকে চিঠি লেখো?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “নিজেকে?” মীরা বলল, “হ্যাঁ, আমি মাঝে মাঝে লিখি। যা কাউকে বলতে পারি না, সেগুলো লিখে ফেলি। হয়তো কখনও পড়বে কেউ, হয়তো কখনও না। কিন্তু নিজের সঙ্গে কথা বলা দরকার।”
আমি চুপ করে ওর কথা শুনছিলাম। মনে হচ্ছিল, এই মেয়েটা যেন এক অন্য পৃথিবী থেকে এসেছে, যার রাস্তা শুধু কুয়াশায় দেখা যায়, কখনও পুরোটা নয়। সেদিন ওর দেওয়া ছোট্ট নোটবুকটা আমি হাতে পেলাম। বলল, “এটা তোমার জন্য নয়, কিন্তু যদি মন চায়, পড়ে নিও।”
বাড়ি ফিরে জানালার ধারে বসে আমি অনেকক্ষণ ধরে নোটবুকটা হাতে নিয়ে ছিলাম। পড়িনি তখনও, শুধু ওর হাতের গন্ধ আর কাগজের গায়ে লেগে থাকা সময়টুকু অনুভব করছিলাম। জানালার বাইরে তখন কাঞ্চনজঙ্ঘা অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি কিছু একটা হারাতে বসেছি, অথচ জানি না ঠিক কী।
সেই প্রথমবার বুঝলাম, পাহাড়ের মতো মানুষও হয়—দূর থেকে সুন্দর, কাছ থেকে গভীর, আর একবার মেঘে ঢাকা পড়লে তাকে আর সহজে দেখা যায় না।
কুয়াশায় লেখা কবিতা
পরদিন স্কুলে গিয়ে আমি মীরাকে খুঁজছিলাম, কিন্তু ওর দেখা মেলেনি সকালে। লাইব্রেরির জানালার ধারে চেয়ারটা খালি ছিল, খেলার মাঠে ভোরের কুয়াশার ভেতর ছাত্রছাত্রীদের ছায়া ছায়া চলাফেরা—সব কিছুই যেন একটু বেশি নিঃসঙ্গ লাগছিল সেদিন। ক্লাসে বসেও মনটা বারবার বাইরে চলে যাচ্ছিল, যেন কেউ ফিসফিস করে ডেকে চলেছে দূরের দিক থেকে। স্কুলের ঘন্টা পড়ার সময় ও এল—ধীর পায়ে, হাতে সেই নোটবুক, আর চোখে একরাশ অদ্ভুত শূন্যতা। আমার দিকে একবার তাকিয়ে হালকা মাথা নাড়ল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। আমি শুধু বুঝে গেলাম, আজ কিছু বলতে নেই।
ছুটির পর আমি লাইব্রেরির পেছনের কাঠের বেঞ্চিতে বসে ছিলাম, হাতে ধরা সেই নোটবুকটা, যা গতকাল ও দিয়েছিল। চারপাশটা নিরিবিলি, পাখিরা আর পাইন গাছের ছায়া ছাড়া আর কেউ ছিল না। বুকের ভেতরে একধরনের অস্থিরতা নিয়ে আমি নোটবুকটা খুললাম। ভেতরে লেখা ছিল, ছোট ছোট কিছু কবিতা, কিছু ভাবনা—বুকের ভেতর জমে থাকা কথা, যা কাউকে বলা হয়নি কখনও।
এক জায়গায় লেখা ছিল,
“আমি আজও জানি না, কীভাবে একটা সকাল মানুষের ভেতর ঢুকে যায়, আর তারপর সেখানে গাছপালা গজিয়ে ওঠে। তুমিও কি সেই সকালে এসেছিলে?”
আরেকটা পাতায় লেখা ছিল,
“কুয়াশা ভেজা পাহাড় বলে দেয় না কিছু, শুধু টেনে নিয়ে যায়। আমি সেই টানটায় হাঁটতে শিখেছি।”
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, আমি যেন ওর একান্ত গোপন জায়গায় পা রেখেছি, যেখানে কেউ আগে কখনও ঢোকেনি। ওর লেখা শব্দগুলো যেন আমার চারপাশে কুয়াশার মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল, আর আমি ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছিলাম। আমি ওকে চিনতাম না, কিন্তু ওর প্রতিটা শব্দ যেন আমাকেই খুঁজে ফিরছিল।
ঠিক তখন মীরা এসে দাঁড়াল পেছনে। আমি একটু চমকে উঠে বসে পড়লাম, বইটা বন্ধ করে রাখতে যাব, কিন্তু ও বলল, “পড়ছো?” আমি ধরা পড়ে যাওয়া মুখে হালকা মাথা নাড়লাম। ও পাশে বসে বলল, “ভেবেছিলাম, তুমি রাখবে। পড়ে দেখবে না।” আমি বললাম, “না, আমি চাইনি, কিন্তু… এটা পড়া মানে তোমার মনের দরজা খোলা দেখা। আর তুমি তো জানলে না, তুমি কীভাবে লেখো।”
মীরা তখন নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক জায়গা পাল্টেছি। কোথাও কিছু রেখে এসেছি, কোথাও কিছু পাইনি। শুধু লেখাগুলো থেকে গেছে আমার সঙ্গে।” আমি বললাম, “তুমি যা লেখো, তা শুধু শব্দ না—তাতে একটা অদৃশ্য মানচিত্র আছে। আমি মনে করি, তুমি হারিয়ে যাওনি, বরং তুমি নিজের ভেতরে একটা পথ খুঁজে নিচ্ছো।”
মীরা তখন হেসে বলল, “তুমি খুব অদ্ভুত, অয়ন। সাধারণ ছেলেরা এসব বলে না।” আমি হেসে বললাম, “আমিও তো সাধারণ নই, আমি পাহাড়ের ছেলে।” ও তখন জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, “হয়তো তাই। পাহাড়ের ছেলেরা হয়তো একটু অন্যরকম হয়।”
সেদিন আমরা স্কুল থেকে বেরিয়ে কিছু না বলেই হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম ম্যাল রোডের দিকে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে ধীরে ধীরে আমরা যখন নির্জন জায়গায় পৌঁছাই, তখন আকাশে সন্ধ্যার আভা। মীরা বলল, “তুমি কখনও কাউকে নিজের লেখা দেখিয়েছো?” আমি একটু দ্বিধায় পড়ে বললাম, “আমি লিখি না তেমন কিছুই।”
ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি না লিখলেও, আমার মনে হয়, তোমার ভেতর অনেক কথা জমে আছে। সেগুলো যদি বের না হয়, তাহলে একদিন তারা তোমাকে ভেতর থেকে ভেঙে দেবে।”
আমি কিছু বললাম না। শুধু মাথা নিচু করে হেঁটে চললাম ওর পাশে। একটা সময় ও হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরল, নিঃশব্দে। আমি চমকে গেলেও কিছু বললাম না। ওর আঙুলে ছিল হালকা ঠান্ডা, কিন্তু সেই ছোঁয়ায় যে একটা আশ্বাস ছিল, সেটা অস্বীকার করা যায় না। যেন বলছে, “আমি আছি”—নীরবতায়, চোখে চোখে, ভাঙা শব্দে, কবিতায়।
সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। মাথার ভিতরে ঘুরছিল মীরার লেখা শব্দগুলো। যেন পাহাড়ের ওপারে কোথাও একটা গান বাজছে, যে গানের কথা মনে নেই, কিন্তু সুরটা চেনা। আমি জানি না কী হতে চলেছে আমাদের মধ্যে, কিন্তু এটুকু বুঝেছিলাম, এই সম্পর্কটা অন্যরকম—নির্ভার, ধীর, কিন্তু গভীর।
চুপকথার বারান্দা
সেই সন্ধ্যার পর থেকে কিছু বদলে গিয়েছিল। আমি আর মীরা যেন কোনো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ছিলাম না, অথচ আমরা কেউ কাউকে কিছু বলিনি। হাত ধরা মানেই তো সম্পর্ক নয়, কিন্তু সেই মুহূর্তটা যেন আমাদের দুজনের মধ্যকার এক অদৃশ্য চুক্তি ছিল—তুমি আর আমি, দুজনেই নিজের মতো করে, কিন্তু একসঙ্গে।
পরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে আমি মীরাকে খুঁজে পেলাম বারান্দার কোণে বসে। আমাদের স্কুলের পুরোনো কাঠের বারান্দাটা ছিল আমার প্রিয় জায়গাগুলোর একটা—সেখানে বসলে নিচে স্কুলের বাগান দেখা যেত, আর দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথা। ও সেদিন বারান্দার কাঠের রেলিংয়ে পিঠ দিয়ে বসেছিল, চুল হালকা এলোমেলো, চোখে গভীর কিছু ভাবনার ছায়া।
আমি পাশে গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালাম। ও কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর হালকা গলায় বলল, “কাল রাতে ঘুম হয়েছিল তোমার?” আমি মাথা নাড়লাম, “না, তোমার কবিতা মাথায় গেঁথে ছিল।” ও একটা ছোট হাসি দিল, তারপর বলল, “আমিও ঘুমোতে পারিনি। হঠাৎ করে কারো সঙ্গে এমন কিছু ভাগ করে নেওয়া যায়, সেটা ভাবিনি কোনোদিন।” আমি জানি, ওর বলা কথাগুলো সহজ শোনালেও ওর কাছে তা খুব ব্যক্তিগত ছিল।
ওর পাশে বসে আমি বললাম, “তুমি খুব একা ছিলে, তাই না?” মীরা একটু থেমে বলল, “আসলে আমি এমন জায়গায় বড় হয়েছি, যেখানে বেশিদিন কেউ থাকত না। আমার মা ছিলেন ব্যস্ত, বাবা বদলির কাজ নিয়ে শহর থেকে শহরে ছুটতেন। ফলে আমি শিখে গিয়েছিলাম, কীভাবে একা থাকা যায়। কিন্তু তুমি… তুমি অন্যরকম।”
আমি একটু হেসে বললাম, “আমিও একা থাকি, কিন্তু হয়তো সেটা নিজের ইচ্ছেতেই। আমি কথা কম বলি, কিন্তু শুনতে ভালোবাসি। তুমি বললে, আমি শুনতে পারি।”
ও চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সেই চুপচাপ দৃষ্টিতে যেন একটা কথা ছিল—ধন্যবাদ। আমি জানি না সেই সময় আমরা কীভাবে যেন একে অপরকে একটু একটু করে জানতাম। শুধু শব্দ নয়, চুপ করে বসেও অনেক কথা বলা যায়, সেটা মীরার সঙ্গে থেকেই শিখেছিলাম।
প্রজেক্টের কাজ এগোচ্ছিল। আমরা কুয়াশা, আলো, গন্ধ আর ঋতু নিয়ে একটা গল্পগাথার মতো তৈরি করছিলাম, যাতে আমাদের অনুভব মিশে ছিল। মীরা বলেছিল, “শুধু তথ্য দিয়ে কিছু বোঝানো যায় না, অনুভব দরকার।” ওর কথায় আমি মাথা নেড়েছিলাম—হ্যাঁ, এই মেয়েটা শুধু পড়ে না, বোঝে।
সেই দিনটার কথা আমার খুব মনে পড়ে। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, সবাই নিচে মাঠে খেলছে বা বাড়ি ফিরে গেছে। আমরা দুজন তখন লাইব্রেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, রোদ আর ছায়ার খেলা আমাদের মুখে এসে পড়ছে। হঠাৎ মীরা বলল, “তুমি জানো, আমি গান লিখি?” আমি বললাম, “তোমার লেখা কবিতা থেকেই বোঝা যায় তুমি গান লিখলেও তাতে সুর থাকে।”
ও একটু লাজুক হাসল, তারপর বলল, “চাও?” ব্যাগ থেকে একটা ছোট কাগজ বের করল—হাতে লেখা, নীল কালি দিয়ে, একটু এলোমেলো কিন্তু প্রাণবন্ত।
“মেঘ ভেজা দিনে আমি তোমাকে খুঁজি
কুয়াশার আড়ালে যে চোখ দুটো লুকিয়ে থাকে
তুমি কি জানো, সেই চোখে
আমার ছোটবেলার বাড়ির বারান্দা লুকানো আছে?”
আমি চুপ করে কাগজটা নিলাম, আর বললাম, “তুমি যদি কখনো গান করো, আমি পাশে গিটার বাজাব।” ওর মুখটা একদম উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো এত তীব্রভাবে মনে পড়ে—যেমনভাবে সকালবেলা রোদ এসে কপালে পড়ে, অথবা কুয়াশার ভেতর কেউ হাত ধরে হাঁটে, কোনো কথা না বলে। আমরা তখনো “প্রেম” শব্দটা ব্যবহার করিনি। দরকারও ছিল না। আমরা জানতাম, এই বন্ধুত্বে একরকম উষ্ণতা আছে, যা বাকি দুনিয়ার চেয়ে আলাদা।
শুধু একদিন, হঠাৎ করেই মীরা বলল, “তুমি কি কখনো চলে যাওয়ার কথা ভেবেছো?” আমি একটু থেমে বললাম, “মানে?” ও বলল, “যদি হঠাৎ করে কোথাও যেতে হয়, কাউকে না জানিয়ে, খুব দূরে?” আমি তখন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “না, আমি বরং কাউকে জানিয়ে যেতে চাই, না হলে ফিরে আসার ইচ্ছে থাকবে না।”
মীরা সেদিন আর কিছু বলেনি। শুধু পায়ে পায়ে হেঁটে স্কুলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল, চুল উড়ছিল, পিঠে রোদ পড়েছিল—আর আমার মনে তখন শুধুই একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল—ও কী কিছু লুকোচ্ছে?
পাহাড়ে লেখা গোপন চিঠি
মীরার সেই শেষ প্রশ্নটা—“তুমি কি কখনো চলে যাওয়ার কথা ভেবেছো?”—আমার মাথায় ঘুরে বেড়াতে লাগল পরদিন সকাল পর্যন্ত। অনেক কথাই হয়, অনেক শব্দ বাতাসে ভেসে যায়, কিন্তু কিছু কথা যেন মাটির নিচে বীজ হয়ে রয়ে যায়—চুপচাপ, নিঃশব্দ, অথচ অদ্ভুত ভারী। আমি ভাবছিলাম, মীরা কী বলতে চেয়েছিল আসলে? ও কি চলে যেতে চায়? নাকি ওর জীবনে এমন কিছু আছে, যা থেকে পালাতে চায়?
সেই সকালে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে ওকে দেখতে পেলাম না কোথাও। লাইব্রেরির কোণ খালি, বারান্দার কাঠের বেঞ্চে শুধুই ছায়া পড়ে আছে। আমি কিছুটা অস্থিরতায় পুরো স্কুল চত্বর ঘুরে এলাম, তারপর খেলার মাঠের পাশের বাঁশবাগানের দিকটায় হাঁটা শুরু করলাম। সেখানে একটা ছোটো পাথরের ঘাট ছিল, যেখান থেকে পাহাড়টা নেমে গিয়ে ঘাসের গালিচা ছুঁয়েছে। ঠিক সেই জায়গায় ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম—মীরা, একা, পিঠে ব্যাগ, হাতে নীল একটা খাম।
আমি ধীরে ধীরে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও ফিরে তাকাল না। চোখ সরাসরি দূরের গাছে, যেখানে পাখির ডাক ধীরে আসছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি ঠিক আছো?”
ও একটু মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “তুমি কী ভাবছো, সেটা আমি বুঝতে পারি, অয়ন। কিন্তু সব কথা বলা যায় না।”
আমি বললাম, “তুমি যদি না বলো, আমি কীভাবে বুঝব?”
ও তখন খুব আস্তে করে বলল, “সব কথা বুঝতে হয় না। কিছু শুধু অনুভব করতে হয়। যেমন আমরা অনুভব করি, পাহাড় কখন যেন কুয়াশায় ভরে যায়—কেউ কিছু বলে না, তবু জানি।”
আমি তখন চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওর হাতে সেই নীল খামটা তখন আমার চোখে পড়ল। আমি বললাম, “ওটা কী?”
মীরা আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, “একটা চিঠি। আমি নিজেকে লিখেছি।”
আমি একটু বিস্ময়ে বললাম, “তোমার নিজের জন্য?”
ও বলল, “হ্যাঁ। কারণ আমি জানি, কাউকে না কাউকে যেতে হয় একদিন। যদি আমি একদিন চলে যাই, অন্তত আমার ভেতরের মেয়েটা যেন জানে, আমি তাকে ছেড়ে যাইনি। আমি শুধু আর থাকতে পারিনি।”
আমি আর কিছু বলিনি। আমার ভেতর তখন একধরনের অজানা ভয় ঢুকে পড়েছে। আমার হৃদপিণ্ড একটু জোরে ধুকপুক করছিল। আমি মীরার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কারণ সেখানে এমন কিছু ছিল যা আমার চোখে জল এনে দিচ্ছিল।
তবে সেই মুহূর্তে আমি জানতাম, ওকে এখন কিছু বলা যাবে না। কথা নয়, পাশে থাকা দরকার। তাই আমি শুধু বললাম, “আমি তোমার চিঠিটা পড়তে পারি?”
মীরা একটু থেমে বলল, “তুমি যদি পড়ে আমাকে ভুল না বুঝো, তবে হ্যাঁ।”
ও হাতে চিঠিটা দিল। আমি তা খুললাম না তখনই। ব্যাগে ভরে ফেললাম, কারণ কিছু কিছু লেখা একা বসে পড়তে হয়, নিজের সময় অনুযায়ী। তারপর আমরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম—কথা নেই, সুর নেই, শুধু নিঃশব্দে পাহাড়ে মিশে থাকা নিজেদের অস্তিত্ব।
স্কুলে ফেরার পথে মীরা বলল, “তুমি কি বিশ্বাস করো, মানুষ একাধিক জীবন পায়?”
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “মানে পুনর্জন্মের মতো?”
ও বলল, “না, এই এক জীবনেই। একেকটা সময়, একেকটা শহর, একেকটা সম্পর্ক—সব মিলিয়ে একেকটা জীবন। আর কিছু মানুষ থাকে, যাদের সঙ্গে হয়তো একটা জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।”
আমি হেসে বললাম, “তুমি কি বলছো আমাদের জীবন অসম্পূর্ণ?”
ও বলল, “আমি বলছি না কিছুই। আমি শুধু ভাবছি, যদি এই জীবনটা শেষ হয়, পরেরটায় কি আমরা আবার একই স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে পড়ব?”
সেই কথা শুনে আমি আর হাসতে পারিনি। কেমন যেন বুকের মধ্যে একটা ভার জমে গিয়েছিল।
সেদিন বিকেলে আমি বাড়ি ফিরে গিয়ে চিঠিটা খুললাম।
লেখা ছিল—
“অয়ন,
তুমি জানো না তুমি কী করে আমার জীবনে এসে পড়েছো। আমি জানতাম না, কেউ এভাবে কারো চোখে বসবাস করতে পারে। কিন্তু তোমার চোখে আমি আমার একটুকু ঘর খুঁজে পেয়েছিলাম।
তবে এই ঘরটা আমি রাখতে পারব না। আমার জীবন অন্যরকম। অনেক আগে থেকেই ঠিক করা, অনেকটা ঠাকুরমার গল্পের মতো—যেখানে রাজপথ ধরা থাকে, কিন্তু মেয়েটা গোপনে চুপিচুপি নদীর ধারে বসে থাকে।
তুমি যদি কোনোদিন এই চিঠি পাও, বুঝে নিও—আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, আমার মতো করে। হয়তো খুব নিঃশব্দে, হয়তো অনেকটা দূর থেকে, কিন্তু সত্যি করে।
মীরা।”
চিঠি পড়ে আমি জানতাম, এবার হয়তো কিছু একটা হারাতে চলেছি। বা হয়তো কিছু তৈরি হচ্ছে—একটা এমন সম্পর্ক, যেটা উপস্থিত থেকেও ধরা যায় না, চলে গিয়েও পাশে থাকে।
কিছু না বলার গল্প
মীরার সেই চিঠিটা আমি অন্তত দশবার পড়েছিলাম। প্রতিবার মনে হতো, কিছু একটা নতুন খুঁজে পেলাম। কিছু না বলা কথা, কিছু লুকনো অক্ষর, যা প্রথমবার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। ওর হাতের লেখা ছিল গোলগাল, পরিষ্কার, কিন্তু কিছু অক্ষর যেন ইচ্ছে করেই একটু তাড়াহুড়ো করে লেখা—যেন মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা ছিল, অথবা সময় ছিল কম।
পরের ক’দিন আমি খুব কম কথা বলেছি। মীরাও তেমনভাবে কিছু বলেনি। আমরা পাশাপাশি থেকেছি, একই লাইব্রেরির জানালার ধারে বসেছি, প্রজেক্টের পাতা উল্টেছি, কিন্তু সেই আগের মতো হালকা কিছু যেন আর ছিল না। আমাদের মাঝখানে একটা নীরব পর্দা পড়ে গেছে, যেটা কেউ টানেনি, অথচ উড়ছে।
স্কুলে একদিন সন্ধ্যাবেলা মিসেস চ্যাটার্জি আমাদের ডেকে বললেন, “তোমাদের গ্রুপের প্রজেক্টটা খুব সুন্দর হচ্ছে। শব্দের ভেতরে অনুভব আছে। বিশেষ করে মীরা আর অয়নের লেখাগুলো আলাদা।” আমি চুপ করে ছিলাম। পাশে বসা মীরার মুখে একটু হাসি দেখলাম, কিন্তু সেটা চোখ অবধি পৌঁছায়নি।
প্রজেক্ট জমা দেওয়ার আগের দিন, আমরা দুজন স্কুলের পুরোনো রেকর্ডরুমের পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসেছিলাম। এই জায়গাটা আমাদের তৈরি করা, অন্য কেউ তেমন আসত না এখানে। সেখানে বসে আমি বললাম, “তুমি চিঠিতে লিখেছিলে, আমি তোমার চোখে একটা ঘর। তাহলে তুমি ঘর ছেড়ে চলে যেতে চাও কেন?”
মীরা একটু চমকে তাকাল, তারপর হালকা গলায় বলল, “কারণ সেই ঘরটা আমি ধরে রাখতে পারব না, অয়ন। কখনও কখনও আমাদের ভালোবাসা কারো কাছে থাকলেও, আমাদের জায়গা থাকে না।” আমি বললাম, “তুমি কি চাও আমি কিছু বলি না?”
ও মাথা নাড়ল, “তুমি শুধু পাশে থাকো। যতদিন আছো।”
সেদিন আমি অনুভব করলাম, ভালোবাসা শুধু থাকাটার মধ্যেই। বলা, না বলা—সবটাই বড় হয়ে ওঠে পাশে থাকার মধ্যে। ওর গলায় একটা ক্লান্তি ছিল, অথচ চোয়ালে ছিল দৃঢ়তা। ওর ভেতরের দ্বন্দ্ব যেন নিঃশব্দেই আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
পরদিন সকালটা অদ্ভুত রকমের রোদে ভরা ছিল। পাহাড়ের গায়ে হালকা কুয়াশা, পাইনগাছের ছায়া দীর্ঘ, আর আকাশটা একদম পরিষ্কার। যেন কেউ ধুয়ে মুছে রেখেছে। আমি ভেবেছিলাম, মীরা হয়তো আজ একটু ভালো থাকবে, হয়তো হেসে বলবে—সব ঠিক আছে। কিন্তু মীরাকে স্কুলে দেখা গেল না।
আমি প্রথমে ভাবলাম হয়তো শরীর খারাপ, হয়তো একদিন ছুটি নিয়েছে। কিন্তু দুপুরের পরেও যখন ও এল না, তখন বুকের ভেতর চাপা একটা দুশ্চিন্তা জমতে লাগল। আমি টিফিনের পর লাইব্রেরিতে গিয়েও ওর খোঁজ করলাম, পুরোনো বারান্দায়, মাঠের ধারে বাঁশবনের পেছনে—সবখানে। কিন্তু ও নেই।
সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে আমি ছাদে গিয়ে বসে ছিলাম। হাতে ওর চিঠি, চোখে দূরের পাহাড়। একটা সময় হাওয়া উঠে এল, হঠাৎ যেন ছাদে ঝুপ করে নামল সন্ধ্যে। আমি তখন জানি না, ঠিক কোন ভয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি কুরে খাচ্ছে—ওর চলে যাওয়া, না ওর চলে যাবার ইচ্ছেটা।
সেই রাতে মীরা একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠায়—
“আমি ঠিক আছি। কয়েকদিন ছুটি নিচ্ছি। মনে করো না আমি পালিয়ে যাচ্ছি। আমি শুধু নিজেকে একটু খুঁজে নিচ্ছি।”
আমি সেই মেসেজের পর আর কোনো প্রশ্ন করিনি। শুধু জানালার পাশে বসে থেকেছি অনেক রাত, পাহাড়ি হাওয়ার শব্দ শুনেছি, আর বারবার ভেবেছি—ওর এই না থাকা, এটাও কি একরকম উপস্থিতি?
দুদিন পর মীরা স্কুলে ফিরে এলো। চোখের নিচে হালকা কালি, মুখে একরকম স্তব্ধতা। আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। শুধু পাশে গিয়ে বলেছিলাম, “তুমি লিখে দাও, আমি পড়ব।”
ও হেসে বলেছিল, “তুমি না থাকলে, লিখে কার জন্য রাখতাম?”
সেই মুহূর্তটা ছিল নরম, নীরব, অথচ গভীর। আমাদের সম্পর্কটা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যেখানে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব ছিল না। শুধু কিছু কথা, যা বলিনি—তবু রয়ে গেছে বাতাসে, বারান্দায়, কবিতায়।
দোলনার ছায়া
স্কুলে ফিরেও মীরা যেন কোথাও ঠিক ফেরেনি। ক্লাসে ছিল, প্রজেক্টে ছিল, কথা বলত, হেসেও ফেলত মাঝে মাঝে, কিন্তু ওর মধ্যে একটা দীর্ঘ ছায়া নেমে এসেছিল। আমি সেটা বুঝতাম, কিন্তু কখনও বলতাম না—কারণ জানতাম, ও চাই না কেউ ওর ভিতরের আলো-ছায়ার মানচিত্রে পা রাখুক অনাহূতের মতো। আমরা মাঝে মাঝে বিকেলে বারান্দায় বসে থাকতাম, কিছু না বলে শুধু সময়টাকে পাশে রাখতাম।
একদিন ছুটির পরে আমি আর মীরা আমাদের পুরোনো প্রিয় জায়গা—পাইনগাছ ঘেরা ছোট্ট বাগানটায় এলাম। সেখানে একটা পুরোনো দোলনা ছিল, কেমন যেন কাঁপতে কাঁপতে দুলত, যেন তারও মন খারাপ। আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ নীরবে দোলার পাশে বসে থাকলাম। চারপাশটা যেন সময়চাপা হয়ে গিয়েছিল—শুধু দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল পাহাড়ি পাখির ডানার শব্দ।
মীরা হঠাৎ বলল, “তুমি জানো, এই দোলনাটা আমার খুব প্রিয়। যখন ছোট ছিলাম, আমার বাড়ির পাশে একটা বাগানে এরকম দোলনা ছিল। আমি একা থাকতাম প্রায়ই। সেই দোলনায় চুপ করে বসে থাকতাম, যেন আমি নই—কেউ অন্য, একটা চরিত্র, যাকে কেউ চিনতে পারবে না।”
আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম, “তাহলে তুমি তখন থেকেই অভিনয় করো?”
ও হাসল, “হয়তো। বা হয়তো তখন থেকেই লুকিয়ে থাকতে শিখেছিলাম। তোমার কাছে মনে হতে পারে আমি কথা বলি, লিখি, গল্প করি… কিন্তু জানো, ভেতরে আমি এখনো অনেকটাই একা।”
আমি কিছু বললাম না। শুধু মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাটা হাতে নিয়ে বললাম, “তোমার কথা আমার মনে থাকে, এমনকি তুমি যখন বলো না তখনও। জানো কেন? কারণ ওগুলো সব কবিতা হয়ে যায় আমার মাথায়।”
মীরা একটু চমকে তাকাল আমার দিকে, তারপর ধীরে বলে উঠল, “তুমি কী করো যখন কেউ একদিন হঠাৎ চলে যায়? এমন কারো কথা বলছি, যে হয়তো প্রতিদিন আসত, পাশে বসত, কথা বলত… আর একদিন সকালে উঠে তুমি দেখো, সে নেই।”
আমি একটু থেমে বললাম, “আমি অপেক্ষা করি। কারণ আমার মনে হয়, কেউ চুপ করে চলে গেলে সে ফিরতে পারে। আর কেউ যদি শব্দ করে চলে যায়, সে আর আসে না।”
মীরা তখন নিচু গলায় বলল, “তুমি বুঝে গেছো, আমি আবার চলে যেতে চাই, তাই না?”
আমি মাথা নাড়লাম, “আমি জানি না তুমি যাবে কি না। আমি শুধু জানি, তুমি যাওয়ার কথা ভাবো। কিন্তু আমি ভাবি, তুমি থাকতেও পারো।”
সেই কথা শোনার পর অনেকক্ষণ মীরা কিছু বলেনি। দোলনাটা হালকা দুলছিল, যেন বাতাসের সঙ্গে কথা বলছে। আমি ওর পাশেই বসে ছিলাম, হাতে হাতে আলতো ছোঁয়া, কিন্তু কিছু বলা হয়নি আর। ওই মুহূর্তটাই ছিল আমাদের সম্পর্কের আসল পরিচয়—নীরবতা, কিন্তু একসঙ্গে।
সেদিন সন্ধ্যায় মীরা বলল, “তুমি জানো, আমি তোমাকে যতটা বলেছি, তার চেয়ে বেশি লুকিয়েছি।”
আমি বললাম, “তুমি যা বলো, সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট।”
ও বলল, “তুমি যদি কখনো জানতে চাও, আমি বলব। কিন্তু হয়তো সময় লাগবে।”
আমি তখন শুধু বলেছিলাম, “আমি সময়ের থেকেও ধৈর্যবান।”
সে রাতে বাড়ি ফিরে আমি আর ঘুমোতে পারিনি। জানলার পাশে বসে ভাবছিলাম—ভালোবাসা কি এইরকমই হয়? যেখানে মানুষ পাশে থাকে, অথচ প্রতিদিন একটু একটু করে চলে যায়? আমাদের কোনো দাবি ছিল না একে অপরের ওপর, কোনো নির্দিষ্ট নামকরণও না, কিন্তু এই না বলা কথাগুলো—এসব কি প্রেম নয়?
পরদিন সকালে মীরা একটা ছোট চিরকুট দিয়েছিল আমাকে। তাতে লেখা ছিল—
“তুমি জানো, ভালোবাসা যদি একটা শব্দ না হয়ে একটা অনুভব হতো, তবে সেটা ঠিক তোমার মতো হতো—চুপচাপ, কিন্তু আশ্রয় হয়ে ওঠে।”
আমি সেই কাগজটা যত্ন করে রাখলাম খাতার ভিতরে। জানতাম, সময় হয়তো আমাদের ছিন্ন করবে একদিন, কিন্তু কিছু কথা কাগজে রেখে দিলে, তারা থেকে যায়—চুপ করে, মৃদু আলো হয়ে।
অপেক্ষার প্রতিধ্বনি
পাহাড়ি হাওয়া একটু একটু করে কনকনে ঠান্ডা হয়ে উঠছিল। অক্টোবরের শেষভাগে দার্জিলিংয়ের সকালের আলো কেমন ছড়ানো ছড়ানো, ঘুম জড়ানো চোখের মতো। পাইনগাছের ছায়া আরও লম্বা আর ঘন হয়ে যাচ্ছিল, আর স্কুলের জানালা বেয়ে ঢুকে পড়ছিল কুয়াশা। আমরা বুঝতে পারছিলাম, শীতে ঢুকে পড়ছি। কিন্তু আমার ভেতরে যে ঠান্ডা পড়ছিল, তা কেবল ঋতুর জন্য ছিল না—তা ছিল মীরার অদ্ভুত নীরবতার জন্য।
সেই দিনগুলোয় ওর চোখে একটা গাঢ় ক্লান্তি ছিল, আর মুখে কোনো ছন্দ থাকত না। হাসত, কথা বলত, কিন্তু সব যেন অভ্যেসের মতো। আমি পাশে থাকতাম, কিন্তু ওর ভেতরে পৌঁছোতে পারছিলাম না যেন। এমনভাবে একজন পাশে থেকেও দূরে চলে যায়—তা আমি আগে কোনোদিন অনুভব করিনি।
একদিন ছুটির পর, স্কুলের গেট পেরিয়ে আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ মীরা থেমে গিয়ে বলল, “তুমি কি ভাবো, কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে?”
আমি একটু থেমে বললাম, “বাঁচাতে না পারি, পাশে তো দাঁড়াতে পারি।”
ও কিছু বলল না। শুধু গেটের ধারে একটা পাথরের সিঁড়িতে বসে পড়ল। ওর হাতে তখন একটা পুরোনো চিঠি।
আমি পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা নতুন?”
ও মাথা নাড়ল, “না, এটা পুরোনো। আমার দাদার লেখা।”
আমি একটু চমকে গেলাম, “তোমার দাদা?”
ও বলল, “আমার একমাত্র দাদা ছিল। খুব ছোটবেলা থেকে আমার সব ছিল—বন্ধু, গল্পসাথী, পাহাড়ের পথ চিনিয়ে দেওয়া মানুষ। কিন্তু সে একদিন নিজেই হারিয়ে গেল। কেউ জানল না কেন। একটা সুইসাইড নোট, একরাশ প্রশ্ন, আর আমাদের পরিবারের ওপর নেমে আসা নীরব অভিশাপ।”
আমি তখন ওর হাত ধরে ফেলেছিলাম। খুব ধীরে, যেন আঙুলে শক্তি না লাগে। মীরা বলছিল, “আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। কোনো কিছু বোঝার মতো বয়স ছিল না। শুধু বুঝেছিলাম, একরকম শূন্যতা জন্ম নিলো আমার ভেতরে। সেই থেকে আমি লেখে ফেলি, যাতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি না।”
ওর চোখ তখন অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছিল। আমি ওকে কখনও এতটা খোলা দেখিনি। মনে হচ্ছিল, তার মধ্যে জমে থাকা একটা বড়ো নদী আজ স্রোত পেয়ে গেছে।
আমি বললাম, “তুমি কাউকে হারিয়েছো, কিন্তু নিজেকে হারাওনি। আমি তো দেখছি, তুমি এখনও কাঁদতে পারো—তাহলে তুমি এখনো বেঁচে আছো।”
মীরা একটু হেসে বলল, “তুমি এমন কথা বলো, যেগুলো কবিতা হয়ে যায়।”
আমরা অনেকক্ষণ সেই সিঁড়িতে বসে ছিলাম। ওর চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল, আর সন্ধ্যের আলো আসছিল ধীরে ধীরে। আমি বললাম, “চলো, বাড়ি যাই?”
ও মাথা নাড়ল, “আজ একটু বসি। আজকের রোদটা আমার দাদার মতো মনে হচ্ছে—হালকা, উষ্ণ, আর হঠাৎ চলে যাবে।”
আমি বললাম, “তুমি কি বিশ্বাস করো, কিছু লোক চলে গেলেও থেকে যায়?”
মীরা বলল, “হ্যাঁ। আমি বিশ্বাস করি, কেউ কেউ কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ফিরে আসে, আমাদের ছুঁয়ে যায়, আবার মিলিয়ে যায়।”
সেদিন বাড়ি ফিরে আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করলাম—
“তুমি যদি চলে যাও, তাহলে তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব। জানালার ধারে বসে, পাইনগাছের ছায়ায় চুপ করে, প্রতিদিন। হয়তো তুমি ফিরবে না, কিন্তু আমি জানব—তুমি একদিন ছিলে, এবং তাতেই আমার জীবন বদলে গিয়েছে।”
পরদিন আমি মীরাকে আমার লেখা পাতা গুলো দিলাম। ও কিছু বলল না, শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর হালকা গলায় বলল, “তুমি আমায় বাঁচাওনি, অয়ন। তুমি আমায় ভাবতে দিয়েছো যে আমি এখনও অনুভব করতে পারি।”
সেই দিন প্রথম, আমি মনে মনে মীরাকে “ভালোবাসি” বলেছিলাম। শব্দটা উচ্চারণ করিনি, কারণ জানতাম—এই প্রেমটা শব্দে নয়, অপেক্ষায়।
চিঠির নিচে পড়ে থাকা পাতা
নভেম্বরের শুরুতেই দার্জিলিং যেন আরও একটু চুপ করে গেল। গাছের পাতা কমে আসছিল, কুয়াশা নামছিল ক্লাস শুরুর আগেই, আর সকালের ঠান্ডায় স্কুল ইউনিফর্মের ওপর হালকা সোয়েটার চাপাতে হচ্ছিল। আমরা সবাই ঋতু বদলের শরীরী ভাষা বুঝতে শিখে গিয়েছিলাম—একটু বেশি চা খাওয়া, লাইব্রেরির জানালাটা আর না খোলা, আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলেও হাতদুটো পকেটে ঢুকিয়ে রাখা।
এই সময়ে মীরা যেন একেবারে নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছিল। ক্লাসে ঠিকঠাক ছিল, উত্তর দিত, হাসতও মাঝেমধ্যে, কিন্তু আমার দিকে আর সেই আগের মতো তাকাত না। ওর চোখে একটা পর্দা ছিল, যেন ভেতরে কী চলছে, সেটা কেউ জানুক—ও আর চাইছে না।
আমিও কিছু জোর করিনি। শুধু দূর থেকে খেয়াল রাখতাম, পাশে থাকতাম। আমরা একই টেবিলে বসতাম লাইব্রেরিতে, কিন্তু মাঝখানে একটা শব্দহীন দূরত্ব জমে গিয়েছিল, যেটা পার হতে গেলেই মনে হতো, একপা বাড়ালেই হয়তো ও আরও দূরে সরে যাবে।
একদিন, মীরা স্কুলের পর আমার হাতে একটা খাম দিল। বলল, “এটা তুমি একা থাকতে পড়বে। আজ না পড়লেও চলবে, কিন্তু কোনোদিন ফেলে দিও না।”
আমি কিছু না বলেই খামটা ব্যাগে ভরে নিলাম। ওর মুখে এমন একধরনের ক্লান্তি ছিল, যেটা দেখে মনে হচ্ছিল—এই খামের ভেতরই যেন ওর ভেতরের পাহাড়টা ভেঙে পড়েছে।
সেদিন বাড়ি ফিরে আমি জানালার ধারে বসে চিঠিটা খুললাম। লিখেছিল—
“অয়ন,
তুমি তো জানো, আমি যেখানেই যাই, একটা নিজস্ব ঘর খুঁজি। তুমি ছিলে সেই ঘরের জানালা। কিন্তু জানালা দিয়েই যেমন আলো আসে, তেমনি বাইরে যাওয়ার পথও থাকে। আমি জানি, তুমি ভাবছো আমি পালাতে চাই। কিন্তু না, আমি পালাচ্ছি না, বরং আমি এমন একটা কিছু খুঁজছি, যেখানে নিজেকে আর লুকিয়ে রাখতে হবে না।
আমি জানি না, আমি কতদিন এখানে থাকব। বাবার চাকরি ফের বদল হচ্ছে। হয়তো পরের মাসেই চলে যাব। তাই আজ বলছি—তুমি যদি কখনো এই পাহাড়ে আসো, আমার ছায়া পাবে কোথাও। আমি হয়তো থাকব না, কিন্তু আমি যেসব চিঠি লিখেছি, যেসব কবিতা ছেঁড়া পাতায় রেখেছি, সেগুলো থাকবেই। হয়তো তোমার জন্যই।
ভালো থেকো, অয়ন। তুমি একদিন খুব ভালো লেখক হবে। তুমি যে ভালোবাসা দিতে জানো—এই পৃথিবীতে তার খুব দরকার।
– মীরা”
চিঠি পড়ে আমার হাত কাঁপছিল। জানালার ওপাশে তখন অন্ধকার। আমি জানি না, ঠিক কতক্ষণ বসে ছিলাম। শুধু জানতাম, মীরা চলে যাবে। হয়তো আর দেখা হবে না। হয়তো চিরতরে।
পরদিন ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলিনি। মীরাও কিছু বলেনি। আমরা দুজনেই জানতাম, এই নীরবতাই সবথেকে গভীর কথা।
সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই খবর এল—মীরার বাবা বদলি হয়েছেন। ওর পরিবার দার্জিলিং ছেড়ে চলে যাচ্ছে পরের সোমবারেই।
স্কুলের শেষ দিন, আমি আর মীরা খেলার মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও বলল, “তুমি যদি কখনো আমাকে খুঁজো, একদিন আবার দেখা হবে।”
আমি বললাম, “আমি তো প্রতিদিন তোমাকে খুঁজি।”
ও তখন হালকা হেসে বলেছিল, “তাহলে দেখা হবেই।”
গেটের বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। মীরা পেছন ফিরে একবার তাকিয়েছিল, ঠিক সেই পাইনগাছটার দিকে, যেখানে দোলনা দুলত। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল।
আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, মাঠের শেষ ধারে, গায়ে ঠান্ডা পড়ছিল, বাতাসে ভেসে আসছিল ওর গলার সেই পরিচিত গন্ধ—বইয়ের, কুয়াশার, এবং না বলা প্রেমের।
চলে যাওয়া আর থেকে যাওয়ার মাঝে
মীরা চলে যাওয়ার পর দার্জিলিং যেন একটু অন্যরকম হয়ে গেল। পাইনগাছগুলো আগের মতোই দুলছিল, সকালের কুয়াশা জানালার কাচে জমে থাকত ঠিক আগের মতো, কিন্তু সব কিছুর মধ্যে একটা স্তব্ধতা এসে পড়েছিল—যা শব্দ করে নয়, অনুভবে টের পাওয়া যায়।
স্কুলে প্রতিদিন যেতাম, ক্লাস হতো, প্রজেক্ট জমা দিয়েছি, এমনকি মিসেস চ্যাটার্জিও বললেন, “তোমাদের কাজটা আলাদা ছাপ ফেলেছে”—কিন্তু কিছু একটা যেন প্রতিদিন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। লাইব্রেরির সেই চেয়ারটা এখনো খালি, কিন্তু জানালার আলোটা আগের মতো পড়ে না। বারান্দার দোলনাটা দুললেও তাতে এখন আর কেউ বসে না।
আমি জানি, মীরা আর নেই এখানে, কিন্তু ওর ছায়া কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে—আমার নোটবুকে, লাইব্রেরির জানালায়, বা পাহাড়ের বাঁকে কোনো চুপ থাকা বিকেলে।
সেদিন বিকেলে আমি একা হাঁটতে বের হয়েছিলাম, সেই পাথরের সিঁড়ি পেরিয়ে বাঁশবনের পথ ধরে। যেখানে আমরা একসাথে বসে থেকেছি, চিঠি পড়েছি, সেখানে গিয়ে বসেছিলাম। হাওয়ার মধ্যে হঠাৎ করেই একটা পাতার খসখসানি এল, আর তার সঙ্গে যেন ভেসে এল মীরার কণ্ঠ—”তুমি যদি কখনো আমাকে খুঁজো, একদিন আবার দেখা হবে।”
আমি চোখ বন্ধ করলাম। এমন কিছু মুহূর্ত থাকে, যা কোনো চিঠিতে লেখা হয় না, কিন্তু মনের পাতায় অম্লান থেকে যায়। মীরার চলে যাওয়া একধরনের চুপ থাকা বিদায় ছিল—যেটা শব্দ করে কাঁদে না, শুধু হাওয়ার সঙ্গে মিশে থাকে।
সেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আমি টেবিলের ওপর মীরার সব চিঠি, কবিতা আর নোট একসাথে বের করলাম। পাতাগুলোতে ওর হাতের ছাপ ছিল, কিছু শব্দ অপ্রকাশিত। একটা কবিতার খণ্ড ছিল—
“যে চলে যায়, সে সবসময় একা যায় না
তার সঙ্গে রয়ে যায় অপেক্ষা,
একটা নির্জন জানালা,
আর কেউ, যে এখনও তার জন্য বসে আছে।”
আমি জানতাম, এই কবিতা আমি পড়ছি, কিন্তু সেটা যেন আমাকেই উদ্দেশ্য করে লেখা—যেন মীরা জানত, একদিন আমি একা বসে ওর লেখা পড়ব, হাওয়ার গন্ধ শুঁকে ভাবব, ও ঠিক কোথায় আছে এখন?
পরদিন আমি স্কুলে গিয়ে লাইব্রেরির সেই চেয়ারে বসলাম যেখানে ও বসত। একটা নোটবুক খুলে লিখতে শুরু করলাম—
“প্রিয় মীরা,
তুমি চলে যাওয়ার পর আমি বুঝেছি, কারও চলে যাওয়া মানেই তার চলে যাওয়া নয়। কেউ কেউ থেকে যায় তাদের লেখা, দৃষ্টি, আর না বলা কথার মধ্যে। তুমি বলেছিলে আমি ভালোবাসা দিতে পারি—সত্যি বলতে, তোমার কাছ থেকেই আমি ভালোবাসা বুঝতে শিখেছি।”
আমি সেই পাতা ছেঁড়ে স্কুলের রেকর্ডরুমের পাশের ছোট্ট কাঠের বক্সে রেখে এলাম—সেই জায়গায়, যেখানে তুমি একদিন বলে গিয়েছিলে, ‘তুমি যদি ফিরে আসো, আমি এখানেই থাকব।’
দিন পেরোয়। ঋতু বদলায়। স্কুল শেষে এখন অনেকটা সময় আমি একা হাঁটি, মীরার ছায়া নিয়ে, ওর লেখার শব্দ নিয়ে। কেউ কেউ বলে, প্রথম প্রেম বোকামি—কিন্তু আমি জানি, প্রথম প্রেম কোনো এক শীতল বিকেলে পাইনগাছের ছায়ায় বসে থাকাকেই বলে, কারো হাতে লেখা একটা চিঠি বুকের কাছে নিয়ে সারা রাত জেগে থাকাটাই বলে।
মীরার চলে যাওয়া একটা হারানো নয়—এটা ছিল একটা নতুন অনুভবের জন্ম। আমি জানি, ও হয়তো অন্য কোনো শহরে, অন্য কোনো জানালায় বসে আবার লিখছে। আমি এখানেই আছি—আমাদের সেই দোলনার পাশে, লাইব্রেরির জানালায়, আর পাহাড়ের প্রতিটা ভোরে যেখানে আলো পড়লে মনে হয়, ও ফিরে এসেছে।
যেখান থেকে আর চিঠি আসে না
শীত পুরোপুরি নেমে এসেছে দার্জিলিংয়ে। জানালার কাচে জমেছে শিশির, আর লাইব্রেরির ভেতর কাঠের মেঝে ঠান্ডা হয়ে আছে ধাতব জলের মতো। ক্লাসে বসেও মাঝে মাঝে আমি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি—যেদিকে মীরা একদিন চলে গিয়েছিল।
আজ অনেকদিন হয়ে গেছে ওর চলে যাওয়ার। প্রথম প্রথম প্রায় প্রতিদিন ওকে চিঠি লিখতাম—না পাঠানোর জন্য, শুধু লিখে রাখার জন্য। একটা ডায়েরি ছিল, যেখানে প্রতিটি পাতায় আমি ওকে একবার করে ফিরে আসার অনুরোধ করেছিলাম, কখনো খোলাখুলি, কখনো রূপক দিয়ে।
কিন্তু একসময় শব্দও ক্লান্ত হয়। একসময় লেখাও চুপ হয়ে যায়। সেই চুপ থাকা থেকেই জন্ম নেয় একটা অন্যরকম স্বাভাবিকতা। আমি এখন মীরাকে নিয়ে আর লিখি না ঠিক, কিন্তু ও আমার মধ্যে থেকে গেছে—আমার হাঁটার ভঙ্গিতে, চুপচাপ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা অভ্যাসে, বা বইয়ের পাতায় পাতায় একটা নাম খুঁজে বেড়ানোর অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষায়।
আজকের দিনটা একটু আলাদা। স্কুলের ছুটির দিন, সকাল থেকেই রোদ ঝলমলে। আমি অনেকদিন পর সেই দোলনার জায়গায় গিয়েছিলাম, যেখানে একসময় আমরা বসতাম। পাইনগাছের ছায়া, দোলনার খসখস শব্দ, আর নির্জন দুপুরটা ঠিক ওরই মতো লাগছিল—ধীর, শান্ত, আর গভীর।
হঠাৎ একটা হাওয়া বয়ে গেল, আর দোলনাটা নিজে থেকেই দুলে উঠল। আমি চমকে উঠলাম না, বরং চোখ বন্ধ করে ভাবলাম—হয়তো আজ মীরা এসেছে। কোনো রূপে না, কোনো শব্দে না, কেবল উপস্থিতির মধ্যে।
আমার মনে পড়ে গেল, মীরা বলত, “ভালোবাসা মানে হাত ধরা নয়, ভালোবাসা মানে কখনো কারো পাশে না থেকেও তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা।” সেই বিশ্বাসটা আমি আজও হারাইনি।
আমি ব্যাগ থেকে আমার পুরোনো ডায়েরিটা বের করলাম। অনেক পাতা লেখা, কিছু আঁচড় কাটা, কোথাও কোথাও জলছাপের দাগ। ঠিক মাঝখানের পাতায় একটা চিঠি ছিল—যেটা আমি একদিন ঠিক করেছিলাম, মীরা যদি কখনো ফিরে আসে, তাকেই দেব। আমি আজ প্রথম সেই চিঠিটা আবার পড়লাম।
“মীরা,
তুমি চলে যাওয়ার পর আমি বুঝেছি, সব বিদায় শব্দ করে হয় না। কেউ কেউ শুধু হারিয়ে যায় চোখের আড়ালে, কিন্তু থেকে যায় সময়ের মাঝে।
তুমি যদি এই চিঠি পড়ো, জেনো—আমি আজও লাইব্রেরির জানালার পাশে বসি। সেই জায়গাটা আমি কারও বসতে দিই না। কারণ জানি, কোনো একদিন, হঠাৎ করে তুমি চলে আসবে।
তুমি যে ভালোবেসেছিলে, সেটাই আমার জীবন হয়ে গেছে।
অয়ন”
চিঠিটা পড়া শেষ হলে আমি তা ভাঁজ করে রেখে দিলাম। আজ আর পাঠাব না, কারণ আমি জানি—মীরা যেখানেই থাকুক, এই কথাগুলো ও আগেই জেনে গেছে।
সেই বিকেলে আমি পাহাড়ের গায়ে বসে সূর্য ডুবে যেতে দেখছিলাম। আলো ঢলে পড়ছিল স্কুলের ছাদের গায়ে, পাইনগাছের মাথায়। হঠাৎ করে খুব তীব্র মনে হল, এই যে সময়টা যাচ্ছে, তাতেই মীরার ছায়া মিশে আছে। যেন আমাদের গল্পটা এখন কেবল আমি বলছি না—পাহাড়ও বলছে, হাওয়া বলছে, আর সেই পুরোনো দোলনাও গুনগুন করে যাচ্ছে আমাদের না বলা কথাগুলো।
স্কুল বছর শেষ হয়ে এল। নতুন ক্লাস, নতুন বই, নতুন কিছু মুখ। আমি বড় হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কিছু স্মৃতি আছে যা সময়কে অগ্রাহ্য করে পাশে থাকে। মীরা তার মধ্যেই একটা। হয়তো চিঠির পাতায় নয়, কিন্তু হৃদয়ের একধারে স্থায়ী ঠিকানা করে আছে।
আমি জানি না, ওর সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা। হয়তো হবে, হয়তো না। কিন্তু আমার গল্পে, আমার প্রতিটি লেখায়, মীরা একটা অনুচ্চারিত চরিত্র হয়ে থাকবে—যাকে একদিন ভালোবেসেছিলাম, এবং যাকে একদিন ভালোবাসতে শিখেছিলাম।
আর এটাই বোধহয় সেই প্রেম, যা কখনো শেষ হয় না—শুধু গল্প হয়ে যায়।
চিঠি ছাড়া ভালোবাসা
সমাপ্তি সবসময় চিঠির মতো নয়, যার ঠিকানা থাকে, ডাকটিকিট থাকে, এবং পৌঁছনোর নিশ্চয়তা থাকে। কিছু সমাপ্তি নিঃশব্দে আসে—একটা ধীরে হাওয়া ওঠার মতো, একটানা বিকেলের আলো বদলের মতো। আমি জানি, মীরার সঙ্গে আমার যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল, তারও এমনই এক সমাপ্তি হয়েছে—চুপচাপ, অথচ গভীর।
শীত পেরিয়ে দার্জিলিংয়ের বসন্ত যখন ধীরে ধীরে পাতার ডগায় ফিরে আসে, আমি বুঝি, ঋতুর বদল হয় ঠিক যেমন মানুষের ভেতরেও কিছু বদলায়—বলার মতো নয়, টের পাওয়ার মতো। মীরা চলে গেছে বহুদিন, কিন্তু এখনও যখন স্কুলের লাইব্রেরির সেই পুরোনো জানালার ধারে বসি, মনে হয় ও পাশেই আছে, একটা কবিতার বই খুলে পড়ছে। মাঝে মাঝে খোলা খাতা পেলে আমি এখনও “মীরা” নামটা লিখে ফেলি, না ভেবে—আবেগে, অভ্যাসে, অথবা প্রার্থনায়।
মীরার চলে যাওয়া একটা মুহূর্তের ছিল না—তা ছিল ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাওয়ার মতো, একটা মেঘের ছায়া যেমন কুয়াশায় মিশে যায়, অথচ তার স্পর্শ থেকে যায় পাতার গায়ে। আমি কখনো ওকে থামাতে পারিনি, চাইওনি আসলে। জানতাম, মীরার মতো মানুষের কোনো গন্তব্য নেই—ও হাঁটে, কারণ ওর ভেতরে একটা প্রশ্ন আছে, যার উত্তর একজায়গায় থেকে পাওয়া যায় না।
তবু আমি মাঝেমাঝেই লিখি। কবিতা নয়, গল্প নয়—একটা নিজের ভেতরের ডায়েরি। মীরা যেদিন চলে গিয়েছিল, আমি সেই দিনটা প্রতিদিন নিজের মতো করে লিখে রাখি—একটা ভিন্ন আকারে, ভিন্ন আবেগে। কেউ যদি পড়তে বসে, হয়তো বুঝবেই না কতটা সত্যি, কতটা কল্পনা। কিন্তু আমার কাছে সবটাই বাস্তব—কারণ ভালোবাসার গল্প কখনো যুক্তিতে টিকে না, তা টিকে হৃদয়ের নির্জন আলমারিতে।
আমি এখন কলেজে পড়ি, শিলিগুড়িতে। দার্জিলিংয়ে খুব কম যাওয়া হয়। তবে প্রতি বছর একবার করে স্কুলে যাই, পুরোনো শিক্ষকদের খোঁজ নিই, লাইব্রেরির সেই জানালার ধারে গিয়ে বসি। স্কুলের পেছনের দোলনাটা এখনও আছে—একটু মরচে পড়েছে, কিন্তু দুলে ঠিক আগের মতো। ওখানে বসে থাকলে মনে হয়, একশো বছর আগে মীরা এখানেই হেসেছিল, কেঁদেছিল, কিংবা আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তুমি যদি আমাকে খুঁজো, আমি কোথাও থাকব।”
একবার স্কুলে গিয়ে আমি দেখেছিলাম, লাইব্রেরির পুরোনো আলমারির ভেতর রাখা আছে কয়েকটি পুরোনো লেখা—পুরোনো ছাত্রদের প্রজেক্ট, কবিতা, চিঠি। আমি খুব ধীরে একটা পাতায় চোখ রাখলাম—হাতের লেখাটা চেনা। মীরার লেখা। কিছু লাইন পড়লাম—
“আমার মনে হয় কেউ যদি কারো চোখে নিজের বাড়ি খুঁজে পায়, তবে সেই ঘরটা একদিনও যদি ভেঙে পড়ে, তার টুকরোগুলো বাতাসে রয়ে যায়। আমি হয়তো থাকব না, কিন্তু আমার কিছু শব্দ থাকবে এখানে। কেউ না কেউ হয়তো একদিন পড়বে—আর ভেবে নেবে, এই মেয়েটা বুঝত ভালোবাসা মানে হারিয়ে যাওয়াও হতে পারে।”
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সময়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেন এক মুহূর্তে ফিরে গিয়েছিলাম স্কুল ইউনিফর্মের সেই দিনে। আমি ঠিক জানি না কেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হল, মীরা কোথাও থেকে আমাকে দেখে যাচ্ছে। হয়তো অন্য কোনো শহরে, অন্য কোনো বইয়ের পাতায়, অথবা কোনো জানালার ধারে বসে লেখা শুরু করছে নতুন চিঠি—যেটা সে কখনো পাঠাবে না, শুধু লিখেই রাখবে।
আজ আমি জানি, মীরা আর কখনো ফিরবে না। হয়তো সে কোথাও নিজের মতো নতুন ঘর বানিয়েছে। হয়তো কেউ এক কাপ চায়ে তার কাছে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে। কিংবা হয়তো ও এখনও হেঁটে চলেছে, কোনো এক পাহাড়ি রাস্তায়, যেখানে দূরত্ব আর নৈঃশব্দ্য ছাড়া কিছুই নেই।
কিন্তু আমি ওকে দোষ দিই না। কারণ মীরাকে ভালোবাসা মানে ছিল তাকে বোঝা—তার নির্জনতা, তার ভয়, তার চলে যেতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকেও। কেউ কেউ ভালোবাসে পাশে থেকে, আর কেউ কেউ ভালোবাসে দূর থেকে, নিঃশব্দে, অভিশাপের মতো নয়—প্রার্থনার মতো।
আমার লেখালেখির শুরু মীরার হাত ধরে। সে আমাকে দেখিয়েছে, ভালোবাসা শব্দে খুঁজে পাওয়া যায় না, অনুভবে ধরা পড়ে। সে দেখিয়েছে, অপেক্ষা একটা শক্তি, সেটা যদি নিঃস্বার্থ হয়। এবং সবচেয়ে বড় শিক্ষা—প্রেমের সব গল্প শেষ হওয়ার জন্য লেখা নয়, কিছু গল্প শুধু হৃদয়ে বহন করার জন্য।
তাই আজও যখন জানালার ধারে বসে লিখি, আমি একটা পাতায় নিঃশব্দে ওর নাম লিখি। তার নিচে তার কোনো ঠিকানা দিই না। শুধু একটুকরো আকাশ আঁকি, আর লিখি—
“যেখান থেকে আর চিঠি আসে না, আমি সেখানেই লিখে যাই।”
শেষ