Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

মেঘের ভেতর রোদ্দুর

Spread the love

মৌসুমী সেনগুপ্ত


এক

অর্পিতা সেনগুপ্তের জীবনে যেন এক অচেনা ঝড় নেমে এসেছে হঠাৎই। বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় সম্পর্ক ভাঙনের সিলমোহর এসে পড়ল তার কপালে। চারপাশের মানুষজনের মুখে একরাশ ফিসফিসানি, একরাশ হাহাকার, আর হাজারো প্রশ্ন—সবকিছুই যেন তাকে এক নিমেষে নীচে ফেলে দিল। দিন কয়েক আগেও যে সংসারের স্বপ্ন চোখে ভাসতো, ঘর সাজানোর পরিকল্পনা করতো, মনের গোপনে ভবিষ্যতের ছবি আঁকতো—আজ সেসব কিছুই যেন ধুলোয় মিশে গেছে। রোহিতের সঙ্গে তার সম্পর্কটা শুরু থেকেই খুব মসৃণ ছিল না। রোহিত চেয়েছিল অর্পিতা সংসারে ডুবে যাক, তার নিজের ক্যারিয়ার, নিজের স্বপ্ন যেন গুটিয়ে রেখে দেয়। অথচ অর্পিতা চেয়েছিল নিজের পড়াশোনা, নিজের মেধা আর পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সমাজে দাঁড়াতে। এই মতভেদের শুরু থেকেই ছোট ছোট অশান্তি হয়ে উঠেছিল, আর সেসব ধীরে ধীরে জমে জমে একদিন পাহাড় হয়ে গেল। রোহিতের চোখে অর্পিতা হয়ে উঠলো “অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী” নারী, যে সংসারের বাঁধনে বাঁধা পড়তে জানে না। অথচ অর্পিতার চোখে নিজের স্বপ্ন ভাঙা মানে নিজের অস্তিত্ব হারানো। এই দ্বন্দ্ব, এই অশান্তির শেষ অবধি একটাই পরিণতি হলো—তাদের আলাদা হয়ে যাওয়া। যখন আদালতের কাগজে সই হলো, যখন আইনিভাবে সম্পর্কটা ভেঙে গেল, তখন যেন এক প্রবল শব্দে ভেঙে পড়ল অর্পিতার ভেতরের ভরসার দেওয়াল। মানুষের চোখে সেটা ছিল কেবল কাগজে লেখা কয়েকটা লাইন, কিন্তু অর্পিতার কাছে সেটাই ছিল নিজের স্বপ্নের মৃত্যু।

তবে বাইরের মানুষের দৃষ্টিটাই ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর। আত্মীয়স্বজনেরা, যারা একসময় বিয়েতে আনন্দ করে নেচেছিল, আজ তারা বিদ্রূপে ভরিয়ে তুলল অর্পিতাকে। কাকিমার মুখে শোনা গেল—“মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব জেদি ছিল, না হলে সংসার ভাঙে কেন?” প্রতিবেশীর মন্তব্য—“আজকালকার মেয়েরা তো সংসার করতে জানেই না, সবকিছুতেই স্বাধীনতা চাই।” এমনকি আত্মীয়স্বজনের ভেতরেও অনেকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিল—“এখন আবার কী করবে? দ্বিতীয় বিয়ে?” যেন একজন নারীর পরিচয় কেবল কারো স্ত্রী হয়ে থাকাতেই সীমাবদ্ধ। এইসব মন্তব্য প্রতিদিন অর্পিতার কানে ঢুকে তাকে আরও ভেঙে দিচ্ছিল। একসময় সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাত, কিন্তু মনে হতো এ কি সত্যিই সেই অর্পিতা, যে হাসিখুশি মুখে কলেজে যেত? যে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করত, কবিতা লিখত? আজ তার চোখের নিচে ঘন ক্লান্তি, মুখে একরাশ নির্লিপ্ততা। ঘরের কোণে জমে থাকা কাগজপত্র, দেয়ালে ঝোলানো অ্যালবাম—সবকিছুই যেন তাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই জীবনের কথা, যে জীবনটা আজ তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। বাইরে বেরোলে প্রতিবেশীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ভেতরে ফিরে এলে মায়ের চোখের জল আর বাবার নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস—সবকিছুই তাকে এক অসহ্য অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছিল।

কিন্তু এই ভাঙনের শব্দ শুধু সম্পর্ককে ভেঙে দেয়নি, অর্পিতার ভেতরটাকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। সে বুঝতে পারছিল না, কাকে দোষ দেবে—নিজেকে, না সমাজকে? একদিকে এক অজানা অপরাধবোধ গ্রাস করছিল তাকে; মনে হতো, হয়তো সত্যিই তার মধ্যেই ছিল কোনো ত্রুটি, না হলে সংসার ভাঙে কেন? আবার অন্যদিকে সমাজের নিষ্ঠুর দৃষ্টিই যেন তাকে ক্রমাগত ধিক্কার দিয়ে যাচ্ছিল। রাতের পর রাত সে ঘুমাতে পারতো না, চোখে অশ্রুর ধোঁয়া জমে থাকত, বুকের ভেতর একটা হাহাকার ঘুরপাক খেত। যেন ভেতরের কণ্ঠস্বর চিৎকার করে বলতে চাইছে—“আমি তো কিছু ভুল করিনি, আমি তো শুধু আমার স্বপ্ন বাঁচাতে চেয়েছিলাম।” তবু সেই চিৎকার কেউ শুনলো না। এই সময়ে তার মা বারবার চেষ্টা করতেন মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে, কিন্তু মায়ের নিজের চোখেই তখন অবিরাম জল। বাবাও বাইরে থেকে কঠোর মুখ করে রাখলেও অর্পিতার ভাঙা স্বপ্ন তাকে অস্থির করে তুলেছিল। এই ঘনঘোর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অর্পিতা বুঝতে পারছিল—জীবনকে এগিয়ে নিতে হলে তাকে একা দাঁড়াতে হবে, কিন্তু সেই শক্তি তখনো তার ভেতরে জাগেনি। তার জীবনের প্রথম অধ্যায় তাই শুরু হলো এক ভাঙনের শব্দ দিয়ে, যে শব্দ তার সমস্ত আত্মবিশ্বাস, সমস্ত রঙ, সমস্ত স্বপ্নকে খান খান করে দিল।

দুই

রাত নামলে অর্পিতার পৃথিবী যেন আরও নিস্তব্ধ, আরও ভারী হয়ে উঠত। দিনের আলোয় বাইরে থেকে আসা প্রতিবেশীর মন্তব্য, আত্মীয়দের ফিসফিসানি, কিংবা অফিস থেকে আসা কাগজপত্রের খামচে ধরা ক্লান্তি অন্তত তাকে ব্যস্ত রাখত, কিন্তু রাত হলেই একাকীত্বের হাহাকার তাকে আছড়ে পড়ত। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা অবস্থায় সে শুনত নিজের বুকের ভেতরের শব্দ—হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিশে যাওয়া ভয়, অস্বস্তি আর নিঃসঙ্গতা। জানলার বাইরে গলির আলো ঝিমিয়ে পড়েছে, দূরের কুকুরের ডাক, আর মাঝে মাঝে হুইসেল বাজিয়ে যাওয়া লোকাল ট্রেন—এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে রাতের নীরবতা যেন তার ভেতরে ছুরি চালিয়ে দিত। অর্পিতা ভাবত, “আমি কি সত্যিই ব্যর্থ?”—এই প্রশ্ন তার মাথায় হাজারবার ঘুরে বেড়াত। বিয়ের ভাঙনকে সমাজে অনেকেই ব্যর্থতা হিসেবে দেখত, আর অর্পিতাও সেই তীরের আঘাতে দুলে উঠত। সে ভাবতে শুরু করত, হয়তো সত্যিই তার মধ্যেই কোনো ত্রুটি ছিল। যদি সে আরও ধৈর্যশীল হতো, আরও সমঝোতা করত, তবে কি সংসার টিকে যেত? তার মনের ভেতর বারবার ওঠা এই প্রশ্নগুলো রাতের নীরবতাকে আরও অসহনীয় করে তুলত।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে গেলে তার বুকটা হুহু করে উঠত। আয়নাতে সে যাকে দেখত, তাকে সে চিনতে পারত না। একসময় যে মেয়ে লম্বা চুলে বিনুনি করে, হাসি মুখে কলেজে যেত, কবিতা লিখত, বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাফেতে চা খেত—আজ তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এক মলিন, ক্লান্ত, হতাশ দৃষ্টি। চোখের নিচে কালো দাগ, চুল এলোমেলো, মুখে একরাশ নিরাশা—এ কি সেই অর্পিতা? আয়নার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা যেন অপরিচিতা, দূরের কেউ। মাঝে মাঝে সে নিজেকেই প্রশ্ন করত, “তুই আসলে কে? তুই কি কেবল একজন পরিত্যক্তা স্ত্রী? নাকি তার বাইরে তোরও কোনো পরিচয় আছে?” এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলাতে পারত না সে। আয়নার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অপরিচিত ছায়া যেন তার সঙ্গে কথা বলতে চাইত, কিন্তু কথাগুলো তার কানে পৌঁছাত না। আয়নার ভাঙা প্রতিবিম্বে অর্পিতা যেন খুঁজে পেত নিজের ভাঙা আত্মবিশ্বাসের টুকরো। প্রতিদিনের কটু কথা, আত্মীয়স্বজনের শীতল দৃষ্টি আর সমাজের বিদ্রুপ যেন ধীরে ধীরে তার ভেতর থেকে শক্তিটুকু কেড়ে নিচ্ছিল।

এইসব রাতগুলোয় অর্পিতা বুঝতে পারত, জীবনের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হলো একাকীত্ব। মানুষের ভিড়ে থেকেও সে একা, পরিবারে থেকেও যেন আলাদা। তার মা মাঝেমধ্যে চুপিচুপি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়ের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করতেন, কিন্তু অর্পিতা তখনও নিজের গোপন লড়াইয়ে আটকে থাকত। নিজের বিছানার কোণে বসে সে ভাবত—“আসলে আমি কি কোনোদিন ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না?” প্রশ্নটা যেন তার বুকের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় তুলত। অতীতের দিনগুলো মনে পড়ত—বিয়ের প্রথম কয়েকটা মাস, যখন মনে হয়েছিল সব ঠিক হয়ে যাবে, যখন সে বিশ্বাস করত ভালোবাসা সবকিছু জয় করতে পারে। অথচ আজ সেই বিশ্বাস ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে গেছে। তার ভেতরের ভাঙনটা এতটাই গভীর হয়ে উঠেছিল যে, সে মাঝে মাঝে ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে গিয়েও আঁধারে আটকে যেত। নীরব রাতের ভেতর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখত, আসলে সে কেবলই টুকরো টুকরো এক অস্তিত্ব—যা সমাজ, পরিবার আর নিজের প্রশ্নে ভেঙে গেছে। সেই ভাঙনের শব্দ এখনও তার কানে বাজে, আর আয়নার ভেতর সেই অপরিচিতা মেয়েটি যেন বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়—“তুই এখনও নিজেকে চিনিসনি।”

তিন

অর্পিতার প্রতিদিনের জীবন যেন এক অদৃশ্য আদালতের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করেছিল, যেখানে সমাজের মানুষজন বিচারকের আসনে বসে তাকে প্রতিনিয়ত দোষারোপ করত। সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে গেলেই প্রতিবেশী কাকিমার ফিসফিসানি কানে আসত—“মেয়েটা সংসার টিকিয়ে রাখতে পারল না, আজকালকার মেয়েদের ধৈর্য কই!” পাশের ফ্ল্যাটের দিদির মুখে শোনা যেত—“এখন আবার নতুন করে বিয়ে করবে নাকি?” এমনকি বাজারে গিয়ে সবজি কিনতে গেলেও হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ না কেউ বলেই ফেলত, “ওই যে, বিয়ে ভেঙে যাওয়া মেয়ে।” যেন তার নিজের নাম নেই, নিজের অস্তিত্ব নেই, তার পরিচয় কেবল এই একটা শব্দেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে—“বিয়ে ভাঙা।” আত্মীয়দের বাড়িতে গেলেও অবস্থা একই রকম। পিসিমা বা কাকিমারা করুণ মুখ করে বলতেন—“কী করবি এখন? আবার যদি কাউকে পছন্দ হয় তাহলে বিয়ে করে নে, এভাবে একা থাকা যায় না।” কারও কারও চোখে ছিল দয়া, কারও চোখে ছিল তিরস্কার। অথচ অর্পিতা জানত, তার জীবনে দুঃখটা আসলে কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মতো নয়, তার বেদনা সে একাই বহন করছে। সমাজের এই দৃষ্টি, এই প্রশ্ন তাকে প্রতিদিন একটু একটু করে ভেতর থেকে একা করে দিচ্ছিল।

সবচেয়ে কষ্টকর ছিল আত্মীয়স্বজনের মন্তব্য। উৎসবের সময়, কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে গেলে, অর্পিতাকে ঘিরে শুরু হয়ে যেত নানা প্রশ্নের বন্যা। একদল সরাসরি বলত—“এখনো তো বয়স আছে, আবার একটা চেষ্টা করতে পারিস।” কেউবা কৌতুকের সুরে বলত—“তোর কপাল খারাপ, নাহলে এত তাড়াতাড়ি ভাঙে!” অথচ অর্পিতার ভেতরটা চিৎকার করে উঠত—“এটা কি আমার একার ব্যর্থতা? সম্পর্ক ভাঙার দায় কি কেবল আমাকেই বইতে হবে?” কিন্তু সে মুখ খুলত না। মুখ খুললেই যে নতুন করে আঙুল তুলবে সমাজ, সেটা সে জানত। আত্মীয়দের অনেকেই তাকে যেন বোঝাত—একজন নারী জীবনের পূর্ণতা পায় কেবল সংসার গড়ে, সন্তান জন্ম দিয়ে। অর্পিতা যখন নিজের কাজের কথা বলত, নিজের ক্যারিয়ারের স্বপ্নের কথা শেয়ার করত, তখনও তির্যক হাসি শুনতে পেত—“ক্যারিয়ার দিয়ে পেট ভরবে ঠিকই, কিন্তু তাতে তো সংসারের শূন্যতা মেটানো যায় না।” এইসব কথাগুলো তার কানে বিষের মতো ঢুকত। চারপাশের মানুষ যেন ভুলে গিয়েছিল, সংসার ভাঙা মানে শুধু একটা সম্পর্কের সমাপ্তি নয়, সেটা একজন নারীর মানসিক ভাঙনের দিকেও ঠেলে দেয়। অথচ কেউ তার মানসিক যন্ত্রণাকে বোঝার চেষ্টা করত না, কেবল বারবার জিজ্ঞাসা করত—“আবার কবে বিয়ে করছিস?”

এই চাপ, এই সমাজের চোখের দৃষ্টি অর্পিতাকে ধীরে ধীরে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলল। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল, আত্মীয়দের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করত না, এমনকি বাজারে বেরোনোও তার কাছে যন্ত্রণার মতো হয়ে উঠল। সমাজের চোখে সে যেন এক প্রকার কৌতূহলের বিষয়, এক দাগ কাটা অস্তিত্ব। রাতে বিছানায় শুয়ে সে ভাবত, “আমার পরিচয় কি সত্যিই শুধু এটাই? আমি কি সত্যিই কিছুই নই, শুধু একজন ‘বিয়ে ভাঙা মেয়ে’?” প্রশ্নটা তার বুকের ভেতরে গুমরে মরত। অথচ ভেতরের অন্য এক কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলত, “না, তুই শুধু এটুকুই নোস, তোর নিজের একটা পৃথিবী আছে।” কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর তখনো দুর্বল, সমাজের কটূক্তির ঝড়ের ভেতর সেটি প্রায় হারিয়েই যেত। প্রতিটি মন্তব্য, প্রতিটি বিদ্রুপ অর্পিতার ভেতরে ক্ষতের মতো জমতে শুরু করল। তবু এই যন্ত্রণার ভেতর দিয়েই অর্পিতা এক অচেনা সত্য বুঝতে শিখছিল—যে সমাজ কখনোই তার ব্যথা বোঝার চেষ্টা করবে না, তাকে একদিন নিজের জোরেই দাঁড়াতে হবে। এই উপলব্ধি এখনো স্পষ্ট হয়নি, কিন্তু অর্পিতার ভেতরে সেই শক্তির বীজ তখনই ধীরে ধীরে জন্ম নিতে শুরু করেছে।

চার

অন্ধকারে ডুবে থাকা অর্পিতার জীবনে হঠাৎই একদিন শৈশবের বান্ধবী সঞ্চিতা এসে উপস্থিত হলো। বহুদিন পর দেখা, অথচ সঞ্চিতার মুখের হাসিটা যেন আগের মতোই উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। সঞ্চিতা যখন অর্পিতার ঘরে ঢুকল, তখন ঘরের কোণে গুমড়ে বসে থাকা অর্পিতাকে দেখে মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল। তারপর ধীরে ধীরে তার হাত ধরে বলল, “কী রে, তুই এমন ভেঙে পড়েছিস কেন? এটাই কি তোর শেষ পথ?” অর্পিতা ভাঙা গলায় কিছু উত্তর দিতে পারল না, শুধু নিঃশব্দ চোখের জলে বুক ভিজিয়ে ফেলল। সঞ্চিতা পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, ঠিক যেমন ছোটবেলায় করত। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎই বলল, “তুই হারিসনি অর্পি, এখনও সব শুরু করা যায়।” সেই কথাটা যেন এক অদৃশ্য বিদ্যুতের মতো অর্পিতার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। এতদিন ধরে চারপাশের মানুষ কেবল ব্যর্থতা, ত্রুটি আর একাকীত্বের ছবি এঁকেছিল তার সামনে, অথচ সঞ্চিতার এই একটিমাত্র বাক্য যেন প্রথমবার তাকে নতুন এক জানালার আভাস দিল।

সেই রাতে অর্পিতা অনেক দিন পর শান্তিতে ঘুমোতে পারল। সঞ্চিতার কথাগুলো কানে বাজতে থাকল বারবার—“সব শুরু করা যায়।” তার মনে হলো, সত্যিই তো, জীবন মানে কেবল একবার নয়, বহুবার নতুন করে শুরু করা। বিয়ে ভেঙে যাওয়াটা হয়তো এক অধ্যায়ের সমাপ্তি, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, পুরো বই শেষ হয়ে গেছে। অর্পিতা সেই রাতেই নিজের শৈশবের অনেক স্মৃতি মনে করতে লাগল—যখন সে স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে কান্না করেছিল, তখন সঞ্চিতা বলেছিল, “হার মানলে তো আর জিতবি না।” সেই কথার জোরে পরের বছরই আবার চেষ্টা করে জয় এনেছিল সে। সেই সঞ্চিতাই আজ আবার তাকে নতুন করে লড়াইয়ের সাহস দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখল, চোখের নিচের কালো দাগ, মুখের ক্লান্তি—সব কিছু একই আছে, কিন্তু ভেতরে যেন একটা হালকা আলো জ্বলে উঠেছে। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলল, “আমি ব্যর্থ নই। আমি আবার শুরু করব।” সেই মুহূর্তে মনে হলো, আয়নার ভেতরের সেই অপরিচিতা মেয়েটা আর একা নয়, তার ভেতরে আবার প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে।

পরবর্তী দিনগুলোয় সঞ্চিতা তার সবচেয়ে বড় আশ্রয় হয়ে উঠল। যখনই অর্পিতা দমে যেত, সঞ্চিতা ফোনে কথা বলে, দেখা করে, বা কখনো স্রেফ মেসেজে ভরসা জোগাত। বলত, “তুই তো অনেক মেধাবী, নিজের ক্যারিয়ারটা গড়ে তুল, তাহলেই দেখবি পৃথিবী তোকে অন্য চোখে দেখবে।” অর্পিতা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল, সত্যিই তার জীবনের মূল লড়াই সংসার টিকিয়ে রাখা নয়, বরং নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। সমাজ তাকে কেবল “বিয়ে ভাঙা মেয়ে” নামেই চিনতে চাইছে, কিন্তু সে যদি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, নিজের জায়গাটা করে নিতে পারে, তাহলে সেই পরিচয়টাই ম্লান হয়ে যাবে। সঞ্চিতার দৃঢ় কথাগুলো, তার অকৃত্রিম ভালোবাসা, আর শৈশবের বন্ধুত্বের উষ্ণতা অর্পিতার ভেতরে অচেনা শক্তি জাগিয়ে তুলল। এতদিন যে অন্ধকারে ডুবে সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল, সেখানেই যেন হঠাৎ প্রথম আলো ফুটল—আশার, পুনর্জীবনের, নতুন শুরু করার আলো। অর্পিতা বুঝতে পারল, হয়তো পথটা সহজ হবে না, তবুও হাঁটা শুরু করাই সবচেয়ে বড় সাহস। আর সেদিন থেকে তার হৃদয়ে প্রথমবারের মতো জন্ম নিল বিশ্বাস—“হ্যাঁ, আমি পারব।”

পাঁচ

অর্পিতার জীবনে সঞ্চিতার কথাগুলো যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল। অনেকদিনের অচলাবস্থা ভেঙে সে এবার সত্যিই নিজের জন্য কিছু করতে চাইল। প্রথমেই ঠিক করল, তাকে একটা চাকরি খুঁজতেই হবে। প্রতিদিন সকালে উঠে সে ল্যাপটপ খুলে বসত, চাকরির ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখত, কোথায় কী ধরনের সুযোগ আছে। সিভি তৈরি করে সে নানা প্রতিষ্ঠানে আবেদন পাঠাতে শুরু করল। শুরুটা সহজ ছিল না। প্রথম কিছু ইন্টারভিউতে গিয়েই অর্পিতা ভীষণ ভয় পেত—মনে হতো, যদি আবার ব্যর্থ হয়? কিন্তু প্রতিবার সঞ্চিতা তাকে সাহস দিত, বলত, “ব্যর্থ হওয়া মানেই থেমে যাওয়া নয়, ব্যর্থতাই তো শেখায়।” অর্পিতা ধীরে ধীরে শিখতে লাগল, আত্মবিশ্বাস ছাড়া কোনো কাজেই সাফল্য আসে না। প্রতিটি ইন্টারভিউর পর সে নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে নিত, কোথায় কী ভুল হলো লিখে রাখত, আবার অনুশীলন করত। কিছুদিনের মধ্যে তার ভেতরে ভিন্নরকম এক দৃঢ়তা জন্ম নিল। আগে আয়নায় তাকালে যে অপরিচিত মুখটা দেখত, এবার সেখানে দেখতে পেল নতুন এক উদ্যমী মানুষ—যে নিজের জীবনটা আবার শুরু করতে চায়।

চাকরি খোঁজার এই সময়টা ছিল অর্পিতার কাছে এক গভীর সংগ্রামের সময়। অনেক আত্মীয় বলত, “চাকরির এত ঝামেলায় কি হবে, আবার সংসার করলেই তো সব মিটে যেত।” কিন্তু অর্পিতা এবার আর কারও কথায় কান দিত না। তার মনে হলো, এটাই সেই সময়, যখন তাকে নিজের পথ নিজেকেই গড়ে নিতে হবে। প্রতিদিন সকালে নতুন উদ্যমে প্রস্তুতি নিত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পড়াশোনা করত, বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় পোশাক কিনে নিত যাতে ইন্টারভিউতে ভালো প্রেজেন্টেশন দিতে পারে। একসময় মনে হলো, সত্যিই সে ধীরে ধীরে নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পরও এবার সে ভেঙে পড়ল না, বরং আরও জোর দিয়ে প্রস্তুতি নিল। অবশেষে একদিন, এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে তার ইন্টারভিউ হলো। সেদিন সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমি পারব।” আর ঠিক সেদিনই, তার ভেতরের শক্তিটা যেন অন্যরকম এক দীপ্তি ছড়ালো। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে গিয়ে নির্ভয়ে নিজের যোগ্যতার কথা বলল, নিজের স্বপ্নের কথা শেয়ার করল।

কিছুদিন পরেই যখন নিয়োগপত্রটা হাতে এলো, অর্পিতার চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এই কান্না আগের কান্নার মতো ছিল না—এটা ছিল মুক্তির, বিজয়ের, নিজের উপর নতুন করে বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার অশ্রু। অর্পিতা জানল, তার পথচলা এখনও দীর্ঘ, সামনে আরও চ্যালেঞ্জ আছে, কিন্তু অন্তত সে বুঝে গেছে—জীবন থেমে থাকে না। যদি নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলা যায়, তবে নতুন করে সবকিছু শুরু করা সম্ভব। প্রথম দিন অফিসে ঢোকার সময় তার মনে হয়েছিল, এই যেন জীবনের আরেকটা অধ্যায় শুরু হলো, যেখানে সে আর কেবল সমাজের চোখে “বিয়ে ভাঙা মেয়ে” নয়, বরং একজন দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী নারী। ডেস্কে বসে ল্যাপটপ খোলার মুহূর্তে অর্পিতার মনে হলো, সত্যিই সে এবার নিজের পথচলা শুরু করেছে—যেখানে কষ্ট আছে, লড়াই আছে, কিন্তু আছে জয়ের আলোও।

ছয়

নতুন অফিসে প্রথম দিন পা রাখার পর অর্পিতার মনে হয়েছিল, সে যেন এক নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। কর্পোরেট পরিবেশ, সবার ব্যস্ত দৌড়ঝাঁপ, কোলাহল—সবই তার কাছে অচেনা হলেও এক ধরনের রোমাঞ্চও এনে দিয়েছিল। কাজের চাপ কম ছিল না, প্রতিদিন নতুন কিছু শিখতে হতো। কিন্তু এখানেও অর্পিতা দেখল সমাজের প্রতিচ্ছবি—কেউ তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করল, কেউ আবার বিদ্রুপের সুরে কথা বলল। কিছু সহকর্মী আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করত, কাজ শেখাত, আবার কয়েকজনের চোখে-মুখে সবসময় কৌতূহল—“ওই যে, বিয়ে ভাঙা মেয়েটা এসেছে।” অফিসের কফি কর্নারে দাঁড়ালেই সে টের পেত, কেউ কেউ ফিসফিস করে তার অতীত নিয়ে আলোচনা করছে। প্রথম দিকে বিষয়টা তাকে আহত করত, কিন্তু এবার সে ঠিক করল, আর ভেঙে পড়বে না। বরং সে নিজের কাজ দিয়েই প্রমাণ করবে, তার পরিচয় শুধু তার অতীত দিয়ে নয়, বরং তার বর্তমান আর যোগ্যতা দিয়েই তৈরি হবে। ধীরে ধীরে অর্পিতা অফিসের পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে শিখল। তার কর্মদক্ষতা, সময় মেনে কাজ শেষ করার অভ্যাস, আর সমস্যার সমাধানে দৃঢ় মনোভাব অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

এমন সময়েই তার সঙ্গে পরিচয় হলো অনিরুদ্ধর। একই টিমে কাজ করায় প্রায়ই আলোচনা ও সমন্বয় করতে হতো তাদের। প্রথম থেকেই অনিরুদ্ধর আচরণ অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল। যেখানে কেউ কেউ তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতূহল দেখাত, অনিরুদ্ধ সেখানে কেবল কাজের প্রসঙ্গেই কথা বলত। ধীরে ধীরে অর্পিতা বুঝতে পারল, এই মানুষটি শুধু তার দক্ষতাকেই মূল্য দিচ্ছে, তার প্রতি কোনো দয়া দেখাচ্ছে না, বরং সত্যিকারের সম্মান দেখাচ্ছে। একদিন একটি বড় প্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা দু’জন। অর্পিতা নিজের মতামত জানালে অনিরুদ্ধ মন দিয়ে শুনল, তারপর বলল, “তোমার আইডিয়াটা দারুণ, এভাবেই আমরা টিমে নতুন কিছু আনতে পারব।” সেই মুহূর্তে অর্পিতার বুক ভরে উঠল এক অচেনা প্রশান্তিতে। এতদিন পরে প্রথমবার সে অনুভব করল, কেউ তাকে কেবল “অতীতের দাগ” হিসেবে নয়, একজন সক্ষম মানুষ হিসেবেই দেখছে। এই উপলব্ধি তার আত্মবিশ্বাসকে আরও শক্ত করল।

দিনগুলো যেতে যেতে অর্পিতা দেখল, অনিরুদ্ধর মধ্যে এক ধরনের পরিণত ও আন্তরিক দৃষ্টি আছে, যা অন্যদের থেকে আলাদা। অফিসের কোলাহল, প্রতিযোগিতা, বিদ্রুপের মাঝেও যখন অনিরুদ্ধ তার পাশে দাঁড়িয়ে বলত, “তুমি পারবে,” তখন অর্পিতার মনে হতো, অফিসের জানালার বাইরে যেন সত্যিই একটু আলো ঢুকে পড়ছে। সহকর্মীদের কেউ কেউ এখনও কটাক্ষ করত, “এমন মেয়ে কি আর ক্যারিয়ারে টিকতে পারবে?” কিন্তু অর্পিতা আর ভেঙে পড়ত না, কারণ সে জানত, তার যোগ্যতাকে যিনি সত্যিই চিনতে পেরেছেন, তিনি তার মূল্য দিতে জানেন। অনিরুদ্ধর সমর্থন অর্পিতাকে বুঝতে শিখাল, পৃথিবীতে এখনও এমন মানুষ আছে যারা নারীকে কেবল সম্পর্কের পরিচয়ে বিচার করে না, বরং তার প্রতিভা ও মেধাকে গুরুত্ব দেয়। আর সেই জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলো অর্পিতাকে প্রতিদিন নতুন করে দৃঢ় করে তুলল। অফিসের দিনগুলো আর কেবল চাপ ও সংগ্রামের প্রতীক রইল না, বরং হয়ে উঠল আত্মপ্রকাশ আর নতুন পরিচয়ের মঞ্চ।

সাত

অর্পিতার জীবন যেন এখন প্রতিদিন এক নতুন লড়াইয়ের নাম। বাইরে বেরোলেই তাকে মোকাবিলা করতে হয় সমাজের কটূক্তি, ভেতরে অফিসে চলতে থাকে নিরন্তর প্রতিযোগিতা আর কাজের চাপ। প্রতিবেশীরা এখনও কটাক্ষ করে বলে, “এই বয়সে একা মেয়েমানুষ কতদিন টিকতে পারবে?” আত্মীয়রা সুযোগ পেলেই প্রশ্ন তোলে, “আবার বিয়ে করছিস না কেন? নারী একা থাকতে পারে না।” এসব শুনে অর্পিতার বুকের ভেতর কখনও কখনও ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু এবার সে আর কান্নায় ভেঙে পড়ে না। বরং প্রতিটি কথা যেন তার ভেতরে নতুন আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে, এই লড়াই কেবল নিজের জন্য নয়, বরং প্রতিটি সেই মেয়ের জন্য, যাদের সমাজ এখনও বোঝা ভাবে। প্রতিটি কটূক্তি তার দৃঢ়তাকে শাণিত করে, প্রতিটি বিদ্রুপ তাকে মনে করিয়ে দেয়—নারী মানে দুর্বলতা নয়, নারী মানে শক্তি।

অফিসেও চাপ কম ছিল না। ডেডলাইন মেনে কাজ শেষ করা, প্রতিদিন নতুন টার্গেট ছোঁয়া, সহকর্মীদের মাঝে নিজের জায়গা ধরে রাখা—সবকিছুই ছিল কঠিন। তার উপর কিছু সহকর্মীর ঈর্ষামিশ্রিত বিদ্রুপ তাকে আরও বিপদে ফেলত। কেউ কেউ বলত, “ওকে তো প্রমোশন দেওয়া হচ্ছে করুণার কারণে।” এসব মন্তব্য প্রথমে অর্পিতার মনে কষ্ট দিত, কিন্তু ধীরে ধীরে সে শিখে গেল, কথার উত্তর কথায় নয়, বরং কাজে দিতে হয়। এক প্রজেক্টে রাত জেগে কাজ করেছিল সে। সকালবেলা অফিসে গিয়ে প্রেজেন্টেশনে যখন তার পরিশ্রম ফুটে উঠল, তখন ম্যানেজমেন্ট প্রকাশ্যে তার কাজের প্রশংসা করল। সেই মুহূর্তে যারা তাকে বিদ্রুপ করেছিল, তাদের মুখ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অর্পিতা বুঝল, আসল শক্তি হলো ধৈর্য আর নিষ্ঠা। প্রতিটি সাফল্যের মুহূর্তে সে নিজের ভেতরের ক্ষতগুলো একটু একটু করে সেলাই করে নিচ্ছিল।

এই নিরন্তর সংঘর্ষের মাঝেই অর্পিতা নিজের ভেতরে এক নতুন শক্তি আবিষ্কার করল। সে উপলব্ধি করল, এতদিন যাকে সমাজ “বিয়ে ভাঙা মেয়ে” নামে চিনত, সেই আসলে এক যোদ্ধা। প্রতিদিন সকালে আয়নায় তাকিয়ে সে নিজের চোখে সেই দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেত। কাজের চাপ, সামাজিক বিদ্রুপ, একাকীত্ব—সবকিছু পেরিয়ে সে প্রমাণ করছিল, নারী কোনো বোঝা নয়, নারী নিজেই এক পূর্ণ শক্তি, এক পূর্ণ পৃথিবী। সে জানত সামনে পথ আরও কঠিন, আরও সংগ্রাম অপেক্ষা করছে, তবুও সে আর ভয় পেত না। কারণ প্রতিটি দিন তাকে শিখিয়েছে—ঝড় যতই তীব্র হোক, মেঘের ভেতর দিয়েই একদিন রোদ্দুর ফুটবেই। আর সেই রোদ্দুরই হবে তার জয়, তার প্রমাণ, তার অস্তিত্বের আসল আলো।

আট

সময়ের স্রোতে অর্পিতা আর অনিরুদ্ধর সম্পর্ক বদলাতে শুরু করল। প্রথমে ছিল কেবল সহকর্মীসুলভ সহযোগিতা, ধীরে ধীরে সেটা গাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হলো। অফিস শেষে কফি খেতে খেতে নানা বিষয় নিয়ে গল্প হতো তাদের—কাজ, বই, সিনেমা, এমনকি জীবনের ছোট ছোট দুঃখ-সুখ নিয়েও। অনিরুদ্ধ কখনও তার অতীত নিয়ে কৌতূহল দেখাত না; বরং যখন অর্পিতা নিজে থেকে কিছু শেয়ার করত, তখন মন দিয়ে শুনত। এই মনোযোগ, এই আন্তরিকতা অর্পিতার মনে অন্যরকম প্রশান্তি এনে দিত। অথচ ভেতরে ভেতরে সে দ্বিধায় ভুগত—আবার কি ভরসা করা যায়? একবার ভরসা করে তো ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিল, আবার যদি সম্পর্ক মানে নতুন কষ্ট হয়? অনেক রাত নিরব ঘরে বসে আয়নার সামনে সে নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবত, “আমার হৃদয়ের দরজা কি আবার খুলব?” উত্তরটা তার কাছে সহজ ছিল না। ভয় তাকে বারবার গ্রাস করত।

কিন্তু অনিরুদ্ধ যেন ধীরে ধীরে সেই ভয়কে ভাঙতে শিখিয়ে দিল। ছোট ছোট আচরণে সে বুঝিয়ে দিল, সম্মান ছাড়া কোনো সম্পর্ক বাঁচে না। একদিন অফিসে একটা মিটিং চলাকালীন অর্পিতার একটি প্রস্তাব কেউ গুরুত্ব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছিল। তখন অনিরুদ্ধ দৃঢ়ভাবে বলেছিল, “আমার মতে অর্পিতার আইডিয়াটা যথেষ্ট কার্যকর। আমাদের সেটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত।” সেই মুহূর্তে অর্পিতা অনুভব করেছিল, অনিরুদ্ধ তার পাশে শুধু সহকর্মী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। পরে কফি খাওয়ার সময় অনিরুদ্ধ বলেছিল, “দেখো, সম্পর্ক যদি হয় তবে সেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা জরুরি। যেখানে সম্মান নেই, সেখানে ভালোবাসা থাকলেও তা টেকে না।” কথাগুলো অর্পিতার মনে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। হয়তো এটাই ছিল সেই শিক্ষা, যা সে এতদিনে খুঁজছিল—ভালোবাসা নয়, প্রথমে চাই সম্মান।

ধীরে ধীরে অর্পিতার হৃদয়ের দরজা খানিকটা হলেও খোলার সাহস পেল। সে বুঝতে পারল, ভয়কে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকলে জীবন কখনও নতুন দিগন্ত দেখাতে পারে না। অনিরুদ্ধর উপস্থিতি তাকে শুধু আশ্রয় দেয়নি, বরং আত্মবিশ্বাসকেও দৃঢ় করেছে। তবু সে জানত, তাকে সতর্ক থাকতে হবে; জীবনের পথচলায় হঠাৎ আসা যেকোনো মোড়ে আবার কষ্ট আসতেই পারে। কিন্তু এবার সে ভিন্ন—আগের মতো দুর্বল আর ভেঙে পড়া অর্পিতা নেই। এবার সে জানে, সম্পর্ক মানেই অন্ধ ভরসা নয়, বরং সম্মানের ভিত্তিতে দাঁড়ানো এক বন্ধন। তাই ধীরে ধীরে সে নিজের ভেতরের শীতল দেওয়ালগুলো সরিয়ে দিল, অনিরুদ্ধর দিকে এক টুকরো আলো বাড়িয়ে দিল। হয়তো এটাই ছিল তার জীবনের আরেকটি নতুন শুরু—যেখানে সম্পর্ক আর বাঁধন নয়, বরং মুক্তির দিশারি।

নয়

অর্পিতার জীবনে ধীরে ধীরে সাফল্যের আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। অফিসে তার পরিশ্রম, একাগ্রতা আর প্রতিভা এতদিনে সবার চোখে পড়েছে। একের পর এক বড় প্রজেক্টের দায়িত্ব তার হাতে আসছে, আর প্রতিবারই সে নিজের দক্ষতায় সেগুলো সফলভাবে শেষ করছে। ম্যানেজমেন্ট তার আত্মনিবেদনকে কেবল স্বীকৃতি দেয়নি, বরং তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতিও দিয়েছে। সেই পদোন্নতির সঙ্গে এসেছে এক অন্যরকম সম্মান—যা অর্পিতার জীবনের প্রতিটি কষ্টের ক্ষতকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলছে। একসময় যে অফিসের করিডরে ফিসফিস করে তাকে নিয়ে কটূক্তি করা হতো, আজ সেই একই করিডরে সহকর্মীরা তার কাছে এসে পরামর্শ চায়। এই সাফল্যের পথে দাঁড়িয়ে অর্পিতা বুঝল, মানুষ আসলে শক্তিকে প্রণাম করে, দুর্বলতাকে নয়। তাই সে ঠিক করল, আর কোনোদিন নিজেকে দুর্বল হতে দেবে না। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন হয়ে উঠল প্রতিরোধের উত্তর, যেন প্রত্যেককে বলতে চাইছে—“আমি কেবল অতীতের ছায়া নই, আমি আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।”

পরিবারও ধীরে ধীরে অর্পিতার পাশে এসে দাঁড়াতে শুরু করল। মা, যিনি একসময় প্রায়ই আক্ষেপ করে বলতেন, “তুই তো সব ভেঙে ফেললি অর্পি,” আজ তিনি গর্ব করে আত্মীয়দের কাছে বলেন, “আমার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।” বাবা, যিনি প্রথম দিকে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন সমাজের চোখ এড়িয়ে মেয়েকে সমর্থন দিতে, তিনিও ধীরে ধীরে বদলে গেলেন। একদিন তিনি হেসে বললেন, “তুই আমাকে শিখিয়ে দিলি, মেয়ে মানে বোঝা নয়, মেয়ে মানে শক্তি।” এই কথাগুলো শুনে অর্পিতার চোখ ভিজে গেল, কিন্তু এবার সেটা দুঃখে নয়, গর্বে। একসময় আত্মীয়রা যারা প্রতিবার তাকে বিদ্রুপ করত, আজ তার সাফল্যের গল্প শুনে নীরব হয়ে যায়। তারা আর তাকে শুধু “বিয়ে ভাঙা মেয়ে” বলে চিহ্নিত করতে পারে না, কারণ অর্পিতা প্রমাণ করেছে—নারী কেবল সম্পর্ক দিয়ে সংজ্ঞায়িত হয় না, তার নিজের ক্ষমতা, যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাস দিয়েই তার আসল পরিচয় তৈরি হয়।

সমাজও ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল। প্রতিবেশীরা যারা একসময় কৌতুক করে বলত, “কতদিন আর টিকবে?” আজ তারা সম্মানের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, “মেয়েটা সত্যিই সাহসী।” অর্পিতার প্রতিটি সাফল্য যেন এক একটি উত্তর হয়ে সমাজের চোখে ধুলো মুছে দিল। সে এখন কেবল একজন ভাঙা সম্পর্কের মানুষ নয়, বরং একজন আত্মনির্ভরশীল নারী, যার গল্প অন্য মেয়েদের অনুপ্রাণিত করে। তার নিজের জীবন হয়ে উঠল অনেকের কাছে উদাহরণ—যেভাবে ভাঙন থেকেও দাঁড়ানো যায়, ভরসাহীনতা থেকেও শক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। অর্পিতা জানত, এই রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থাকাই তার জীবনের আসল জয়। কারণ আজ সে বুঝেছে, মানুষকে সম্মান করাতে গেলে প্রথমে নিজের অস্তিত্বকে সম্মান দিতে হয়। তাই সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল, নিজের অর্জিত আলোর ভেতরে, যেখানে আর কোনো বিদ্রুপ নেই, কেবল দৃঢ়তার দীপ্তি।

দশ

অর্পিতার জীবনের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে সে দাঁড়াল এক নতুন দিগন্তে—যেখানে তার চারপাশে আর কেবল অন্ধকার নয়, বরং আলোয় ভরা এক বিশাল পৃথিবী। একসময় যে মেয়েটি ভাঙা সম্পর্কের তিক্ততায়, সমাজের বিদ্রুপে, আত্মীয়দের প্রশ্নবাণে ভেঙে গিয়েছিল, সেই অর্পিতাই আজ নিজের নামকে নতুন সংজ্ঞা দিয়েছে। তার সাফল্য, তার আত্মবিশ্বাস, তার দৃঢ়তা যেন প্রমাণ করে দিয়েছে—নারী মানেই দুর্বলতা নয়। অর্পিতা জানত, সমাজ তাকে কখনোই সহজে জায়গা দেবে না, তবুও সে থেমে থাকেনি। প্রতিটি বাধাকে সে মাটির মতো ব্যবহার করেছে, আর সেই মাটির ওপরই দাঁড়িয়ে গড়েছে নিজের অস্তিত্বের ভবন। যখন সে আয়নায় তাকায়, তখন আর এক ভাঙা মেয়েকে দেখে না; দেখে এক যোদ্ধাকে, দেখে এক আলোর প্রতীককে, যে অন্ধকার ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে নিজস্ব রোদ্দুর হয়ে।

তার সাফল্যের গল্প শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। অর্পিতা এখন অনেক তরুণীর অনুপ্রেরণা, যারা জীবনের ভাঙনকে নিজের শেষ ভেবে নেয়। তারা অর্পিতার গল্পে খুঁজে পায় সাহস—যে সাহস বলে, “তুমিও পারবে।” সেমিনারে, আলোচনায়, এমনকি ছোট ছোট পরামর্শ সেশনে গিয়ে অর্পিতা মেয়েদের বোঝায়, জীবনকে সম্পর্কের ব্যর্থতায় মাপা যায় না, জীবনের আসল মাপকাঠি হলো তুমি নিজেকে কতটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারছো। তার প্রতিটি কথা যেন একেকটি প্রদীপ হয়ে অন্যদের অন্ধকার ভেদ করে আলো দেখায়। অর্পিতা অনুভব করে, এটাই তার জয়—নিজেকে প্রমাণ করার পাশাপাশি অন্যদেরও বাঁচার প্রেরণা দিতে পারা। অনিরুদ্ধ তার পাশে থেকেও কখনও তাকে ছাপিয়ে যায়নি; বরং তার শক্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই সম্পর্ক তাই অর্পিতার কাছে বাঁধন নয়, বরং মুক্তির এক পরশ।

সবশেষে অর্পিতা উপলব্ধি করল, নারী কোনো সম্পর্কের ছায়া নয়, নারী নিজেই এক পূর্ণ পৃথিবী। একসময় যে সমাজ তাকে কেবল “বিয়ে ভাঙা মেয়ে” বলে ডেকেছিল, সেই সমাজই আজ তাকে দেখে একজন সফল মানুষ, একজন স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে। তার ভেতরের সমস্ত অন্ধকার ভেদ করে আজ সে হয়ে উঠেছে রোদ্দুর, যে আলো ছড়ায় শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও। অর্পিতা জানে, জীবনের পথচলায় ঝড় আসবেই, কিন্তু সেই ঝড় তাকে ভাঙতে পারবে না। কারণ আজ সে আর কেবল কারও নামের ছায়া নয়, বরং নিজেই নিজের পরিচয়। তার চোখে আজ প্রতিফলিত হয় অদম্য শক্তি, তার হাসিতে ঝলমল করে স্বাধীনতার দীপ্তি। অর্পিতার গল্প যেন এক ঘোষণা—নারী মানেই পূর্ণতা, নারী মানেই আলো, নারী মানেই পৃথিবী।

শেষ

1000058234.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *