Bangla - ভ্রমণ

মেঘালয়ের লিভিং রুট ব্রিজ

Spread the love

সোহম ঘোষ


অধ্যায় ১ – অজানার ডাক

শহরের ব্যস্ত জীবনে আটকে থাকা সেই তরুণ অভিযাত্রীর প্রতিদিনের দিন যেন একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, অফিসে ছুটে যাওয়া, ট্রাফিকের শব্দ, যান্ত্রিক মুখের ভিড়—সবকিছু মিলেমিশে এক অনন্ত চক্রের মতো মনে হতো। মাঝে মাঝে জানালার বাইরে তাকিয়ে সে কেবল ভাবত, এর বাইরে কি আর কোনো জীবন নেই? অজানা পথে হাঁটার, নতুন মানুষ ও নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার বুকের ভেতরে অনেকদিন ধরেই দানা বাঁধছিল। শহুরে আলো ঝলমলে জীবন তাকে কখনোই সম্পূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারেনি; বরং তার মনে এক অদৃশ্য শূন্যতার জন্ম দিয়েছিল। একদিন অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে, বইয়ের দোকানে হঠাৎই একটি ভ্রমণ কাহিনি হাতে নিয়ে পড়ে সে মেঘালয়ের গভীর অরণ্যের কথা—যেখানে পাহাড়ি মানুষরা নিজেদের জীবনের সাথে জড়িয়ে রেখেছে এমন এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, যা মানুষের হাতের কাজ নয়, বরং প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া এক জীবন্ত চমৎকার। বইয়ের পাতায় লেখা ছিল—“লিভিং রুট ব্রিজ, যেখানে গাছের শিকড় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের পদচিহ্ন বহন করেছে।” এই বাক্যগুলো যেন তার হৃদয়ে বজ্রপাতের মতো আঘাত করল। মনে হলো, এটাই সেই ডাক, যা সে এতদিন ধরে অপেক্ষা করছিল। শহরের কংক্রিটের দেওয়ালের বাইরে প্রকৃতি তাকে ডেকেছে, আর সেই ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

এই ডাক উপেক্ষা না করে সে সিদ্ধান্ত নেয় অচেনা পথে বেরিয়ে পড়ার। পরিবার ও বন্ধুদের বিস্ময়কর দৃষ্টি সত্ত্বেও সে ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয়, বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা আর ভয় মিশে থাকে। ট্রেনে, বাসে, আবার কখনো হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছে যায় মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর দিকে। পাহাড়ি বাতাস, ভেজা মাটির গন্ধ, মেঘের ফাঁকে লুকোচুরি খেলা সূর্যের আলো—সবকিছুই তাকে মনে করিয়ে দেয় যে সে এক অন্য পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, এখানে প্রতিটি মুহূর্ত যেন ধীর গতিতে বয়ে চলে। এক পাহাড়ি চায়ের দোকানে বসে গরম চা খাওয়ার সময় সে প্রথম শোনে স্থানীয়দের কাছ থেকে সেই কিংবদন্তির কথা। তারা হাসিমুখে বলে, “আমাদের পূর্বপুরুষরা কোনো পাথর বা লোহা দিয়ে নয়, গাছের শিকড় দিয়ে সেতু বানিয়েছিল। এই সেতু দিয়ে শুধু মানুষ নয়, প্রজন্মের ইতিহাসও চলাচল করে।” কথাগুলো শুনে তার শরীর কেঁপে ওঠে। চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে এক জীবন্ত সেতু, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের মিলন এক অবিনাশী বন্ধনে জড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারে, এই ভ্রমণ শুধু একটি পথচলা নয়, বরং এক আত্মিক খোঁজ—নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক নতুন যাত্রা।

রাত নেমে এলে স্থানীয় এক পরিবারের আতিথেয়তায় সে আশ্রয় নেয়। অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসে সবাই যখন লোকগান গাইতে শুরু করে, তখন তরুণ অভিযাত্রীর মনে হয় যেন কোনো প্রাচীন গল্পের ভেতর প্রবেশ করেছে। আগুনের আলোয় মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাদের হাসির মধ্যে মিশে থাকে অরণ্যের গোপন সুর। বৃদ্ধ গ্রামপ্রধান তাকে বলেন, “লিভিং রুট ব্রিজ কোনো সাধারণ সেতু নয়। এটা ধৈর্যের প্রতীক। আমাদের পূর্বপুরুষরা শিকড়কে গড়ে তুলতে শত বছর অপেক্ষা করেছেন। তাই এই সেতু পেরোনো মানে কেবল একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়া নয়—বরং ধৈর্য, বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের পথে হাঁটা।” কথাগুলো শুনে অভিযাত্রীর মনে আরও দৃঢ় হয় যে তার এই যাত্রা কেবল ভৌগোলিক নয়, বরং আত্মার গভীরে এক অনুসন্ধান। শোবার ঘরে শুয়ে সে জানালার বাইরে তাকায়। পাহাড়ের কোলে মেঘেরা তখন নাচছিল, আকাশে তারারা জ্বলজ্বল করছিল। তার মনে হয়, অজানার ডাক তাকে কেবল একটি সেতুর কাছে টেনে নিচ্ছে না, বরং জীবনের নতুন দিগন্তের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আগামীকাল থেকেই শুরু হবে সেই পথচলা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ হবে বিস্ময়ের, প্রতিটি শ্বাস হবে প্রকৃতির সঙ্গে নতুন এক বন্ধনের। সে চোখ বন্ধ করে ভাবে—শহরের একঘেয়েমি জীবন পেরিয়ে অবশেষে সে খুঁজে পেয়েছে নিজের জন্য সত্যিকারের ডাক। অজানার সেই ডাক, যা তার জীবন চিরকালের মতো বদলে দেবে।

অধ্যায় ২ – রওনা অরণ্যের পথে

ভোরবেলা কুয়াশার আবরণে মোড়া পাহাড়ি গ্রামটি যেন অন্য এক স্বপ্নরাজ্যের মতো লাগছিল। তরুণ অভিযাত্রী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রওনা দিল জীবনের সবচেয়ে অজানা এক যাত্রার উদ্দেশ্যে। পায়ের তলায় ভেজা মাটি, চারপাশে ঘন অরণ্যের ফিসফিস শব্দ, দূরে কোথাও নাম না-জানা পাখির ডাক—সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশ যেন এক রহস্যময় আবেশে ভরে উঠল। আঁকাবাঁকা সরু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগোতে গিয়ে সে প্রথম বুঝতে পারল অরণ্যের কঠিন রূপ। সামনে পথ অদৃশ্য হয়ে গেছে কুয়াশার সাদা চাদরে; কখনো মনে হয় এক কদম দূরেই গহীন খাদ, আবার কখনো মনে হয় মেঘের ভেতরেই সে হাঁটছে। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ভেজা বাতাস তার শরীরে ছুঁয়ে যায়, আর মনে হয় প্রকৃতি যেন তাকে বারবার পরীক্ষা করছে। ভয় আর উত্তেজনা পাশাপাশি হাঁটছিল তার সঙ্গে। শহরে বসে এমন অভিজ্ঞতার কথা সে শুধু বইয়ের পাতায় পড়েছিল, কিন্তু আজ নিজের শরীর দিয়ে সেই রোমাঞ্চ অনুভব করছে। প্রতিটি পদক্ষেপে সে বুঝতে পারছিল, সে আর আগের মানুষ নেই; এক অচেনা শক্তি তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অজানার গভীরে।

যাত্রার মাঝপথেই শুরু হলো মেঘালয়ের বিখ্যাত অঝোর বৃষ্টি। আকাশ হঠাৎ কালো হয়ে নেমে এলো, মুহূর্তের মধ্যেই বৃষ্টি ঝাপটা মারতে লাগল পাহাড় আর অরণ্যের বুক ভিজিয়ে। তার গায়ে থাকা রেইনকোট কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিজে গেল, পায়ের নিচে কাদা আর পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জল জমতে শুরু করল। তবে অদ্ভুতভাবে ভয় আর কষ্টের পাশাপাশি তার ভেতরে জন্ম নিল এক অজানা আনন্দ। প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা যেন তাকে শহুরে ধুলো আর ক্লান্তি থেকে ধুয়ে দিচ্ছিল, যেন এক নতুন জন্ম দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে পাহাড়ি ঝরনা দেখা যাচ্ছিল, যেগুলো প্রবল স্রোতে নিচে নেমে আসছিল। সেই দৃশ্য দেখে তার মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে—অরণ্যের গোপন সৌন্দর্যে ভিজিয়ে দিচ্ছে। তবে অচেনা পথের ভয়ও তাকে তাড়া করছিল। কোথাও হঠাৎ পথ থেমে গিয়ে অদৃশ্য গহ্বরের ইঙ্গিত দিচ্ছিল, কোথাও আবার পিছল পাথরে পা পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এখানে প্রতিটি মুহূর্তই বেঁচে থাকার এক নতুন পরীক্ষা। তবুও এক ধরনের দৃঢ় সংকল্প তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কারণ সে জানত, এই পরীক্ষার শেষে অপেক্ষা করছে সেই কিংবদন্তির জীবন্ত সেতু, যার স্বপ্ন নিয়ে সে এই দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেছে।

বৃষ্টি থেমে গেলে আবার প্রকৃতির অন্য রূপ ফুটে উঠল। কুয়াশার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ধীরে ধীরে অরণ্যের ভেতর প্রবেশ করল, ভেজা পাতায় চিকচিক করে উঠল রূপোলি ঝিলিক। বাতাসে মাটির আর ভেজা কাঠের গন্ধ ভেসে আসতে লাগল, যা শহরে বসে কখনো কল্পনাও করা যায় না। অভিযাত্রী গভীরভাবে শ্বাস নিল, মনে হলো প্রকৃতির বুক থেকে সে নতুন শক্তি আহরণ করছে। এ পথে চলতে চলতে সে পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে দেখা পেল, যারা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে অরণ্যের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল। তারা হাসিমুখে তাকে দিকনির্দেশ দিল, কেউ কেউ আবার হাতে তৈরি বাঁশের লাঠি এগিয়ে দিল, যাতে পথ চলা সহজ হয়। তাদের সরলতা আর আন্তরিকতা দেখে তার মনে হলো, এই অরণ্যের ভেতর মানুষ আর প্রকৃতি সত্যিই একে অপরের পরিপূরক হয়ে গেছে। পথ যত গভীরে যাচ্ছিল, ততই অভিযাত্রী অনুভব করছিল যে ভয় ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে বিস্ময়ে, আর আনন্দ তার প্রতিটি রক্তকণায় ছড়িয়ে পড়ছে। এই যাত্রা শুধু শারীরিক নয়, বরং মানসিক এক অভিযাত্রা—অচেনাকে গ্রহণ করার, ভয়কে জয় করার, আর জীবনের অন্য রূপের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার এক মহান অভিজ্ঞতা। সে বুঝতে পারল, অরণ্যের এই পথই তাকে গড়ে তুলছে, ধৈর্য শেখাচ্ছে, আর আসন্ন বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত করছে। অরণ্যের পথে তার রওনা তাই এক যাত্রার সূচনা নয়, বরং জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রথম পৃষ্ঠা।

অধ্যায় ৩ – বৃষ্টির ফাঁদে

অরণ্যের গভীরে যতই এগোচ্ছিল, আকাশের রূপ ততই বদলে যাচ্ছিল। সকালবেলার কোমল আলো আর ভেজা মাটির গন্ধ ধীরে ধীরে জায়গা দিল কালো মেঘের ঘন ছায়ায়। হঠাৎই বাতাসের গতি বেড়ে গেল, গাছপালার ডালে ডালে অস্থিরতার শব্দ ছড়িয়ে পড়ল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো প্রবল বর্ষণ। অঝোর বৃষ্টি যেন এক নিমেষেই সবকিছু ঢেকে দিল—অরণ্যের মেঠোপথ, দূরের ঝোপঝাড়, এমনকি আকাশের দিকও আর বোঝা যাচ্ছিল না। অভিযাত্রী রেইনকোট মাথায় টেনে নিলেও কোনো লাভ হলো না, কারণ জল তার শরীর ভেদ করে হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করতে লাগল। চারপাশের মাটি মুহূর্তের মধ্যে পিচ্ছিল হয়ে উঠল, পায়ের নিচে কাদা আর ছোট ছোট ঝরনার মতো বয়ে যাওয়া জলের স্রোত পথ চলা দুর্বিষহ করে তুলল। ঘন পাতার আড়াল থেকেও বৃষ্টির তীব্রতা কমছিল না, বরং প্রতিটি ফোঁটা যেন তাকে পরীক্ষা করতে চাইছিল। সে অনুভব করল, প্রকৃতির কাছে মানুষ আসলে কতটা অসহায়—যন্ত্রপাতি, পরিকল্পনা কিংবা মানচিত্র কিছুই এখানে কাজে আসে না।

পিচ্ছিল মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তার পা পিছলে গেল। ভারসাম্য হারিয়ে ধপ করে পড়ে গেল মাটির উপর। কাদা আর বৃষ্টির জলে ভিজে এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো যাত্রা এখানেই শেষ। পিঠে ব্যাগের ওজন পড়ে শরীর ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল, হাতে কেটে গেল ধারালো পাথরে। হতাশা হুড়মুড় করে ভর করল তার মনে—শহরের আরামদায়ক জীবনের তুলনায় এই অরণ্যের পথ যেন অসহনীয়। সে মাটিতে বসে হাঁপাতে লাগল, মনে হচ্ছিল আর এক কদমও এগোনো সম্ভব নয়। দূরে কোথাও বজ্রপাতের শব্দ গর্জে উঠল, অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসছিল, আর বৃষ্টির ফোঁটা তার চোখের জল মিশিয়ে দিল ভিজে কাদার সঙ্গে। এই মুহূর্তে তার মনে হলো, প্রকৃতি তাকে আটকে ফেলেছে, যেন পরীক্ষা করছে সে আদৌ যোগ্য কি না এই পথে চলার। কিন্তু সেই হতাশার ভেতরেই এক অদ্ভুত শক্তি জেগে উঠল। সে মনে করল, শহর ছেড়ে বেরোনোর সময় সে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে যাই হোক না কেন, কিংবদন্তির সেই জীবন্ত সেতু না দেখা পর্যন্ত সে ফিরবে না। এই প্রতিজ্ঞাই তাকে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য করল। শরীর ব্যথায় অবশ হলেও সে দাঁড়াল, জামা থেকে কাদা ঝেড়ে আবার এগিয়ে চলতে শুরু করল।

প্রবল বর্ষণের ভেতর দিয়ে তার প্রতিটি পদক্ষেপ এখন একেকটি সংগ্রাম, তবে প্রতিটি সংগ্রামই তাকে শিখিয়ে দিচ্ছিল ধৈর্যের অর্থ। বৃষ্টি যতই কষ্ট দিক, মাটির পিচ্ছিলতা যতই তাকে নিচে ফেলে দিক, অভিযাত্রী বুঝতে পারল এই প্রতিকূলতাই তার প্রথম প্রকৃত পরীক্ষা। জীবনের যেকোনো বড় স্বপ্নপূরণের পথে যেমন বাধা আসে, তেমনি এই যাত্রার পথেও বাধা অনিবার্য। কিন্তু সেগুলো জয় করেই এগোতে হয় সামনে। তার ভেতরের ভয় আর ক্লান্তি ধীরে ধীরে রূপ নিতে লাগল এক অটল সংকল্পে। সে মাথা উঁচু করে অরণ্যের গভীরে তাকাল, বৃষ্টির ঝাপটা চোখে লাগলেও তার দৃষ্টি ছিল অটল। মনে হলো, প্রতিটি ফোঁটা তাকে দুর্বল করছে না, বরং আরও শক্ত করছে। পায়ের নিচে কাদা, কাঁধে ভিজে ব্যাগ, শরীরে ক্ষত—সবকিছু সত্ত্বেও সে হাঁটছিল, আর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন প্রকৃতিকে বার্তা দিচ্ছিল: “আমি হাল ছাড়ব না।” প্রকৃতি তার শত্রু নয়, বরং এক কঠিন গুরু, যে তাকে শিখিয়ে দিচ্ছে সহনশীলতা, সাহস আর ধৈর্য। আর অভিযাত্রী বুঝতে পারল, এই বৃষ্টির ফাঁদে পড়ে গিয়েই সে সত্যিকার অর্থে যাত্রার মূল শিক্ষা পেতে শুরু করেছে।

অধ্যায় ৪ – গ্রামীণ মানুষের ছোঁয়া

দিনভর বৃষ্টির সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত অভিযাত্রী যখন পাহাড়ি অরণ্যের সরু পথ ধরে হাঁটছিল, তখনই দূরে ম্লান আলো দেখতে পেল। কাছে যেতেই বুঝল, এটি এক পাহাড়ি গ্রামের কুটির, যেখানে খড়ের ছাউনি আর মাটির দেয়াল যেন অরণ্যের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে। শরীর ভিজে কাঁপছিল, পা ভারী হয়ে আসছিল, তবুও আলো দেখে তার মনে আশার সঞ্চার হলো। গ্রামে পৌঁছাতেই কয়েকজন মানুষ তাকে দেখে বিস্মিত হলো, তবে মুখে ভেসে উঠল আন্তরিক হাসি। তারা কোনো প্রশ্ন না করেই ভেজা কাপড় আর কাদা-মাখা শরীর দেখে তাকে ভেতরে ডেকে নিল। এক বৃদ্ধা হাতে ধরিয়ে দিল গরম চায়ের কাপে ভরা ধোঁয়া ওঠা পানীয়, যার প্রতিটি চুমুক যেন তার শরীরের হাড়ে হাড়ে জমে থাকা শীতকে গলিয়ে দিল। আগুনের পাশে বসে সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, অরণ্যের কঠিন পথ আর প্রকৃতির প্রতিকূলতার পর এই মানবিক স্পর্শই তাকে নতুন প্রাণ দিচ্ছে। শহরের ভিড়ে যেখানে মানুষ মানুষকে চিনতেও চায় না, সেখানে এই অচেনা গ্রামে অপরিচিতরা তাকে ঘরের মতো আপন করে নিল।

রাত বাড়তে থাকল, আর গ্রামবাসীরা তাকে ঘিরে গল্প বলতে শুরু করল। কেউ বলল অরণ্যের ভয়াল বাঘের গল্প, কেউ শোনাল মেঘালয়ের পাহাড়ি দেবতার কিংবদন্তি। তাদের কথার ভেতর লুকিয়ে ছিল প্রকৃতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আর গভীর বিশ্বাস। অভিযাত্রী মুগ্ধ হয়ে শুনছিল, কারণ সে বুঝতে পারছিল—এই মানুষগুলো শুধু প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করছে না, বরং প্রকৃতিকে তারা আপনজনের মতো সম্মান করে। আগুনের আলোয় তাদের হাসি, চোখের দীপ্তি, আর সহজ ভাষায় বলা গল্পগুলো যেন তাকে অদ্ভুত এক শান্তির ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলল। চায়ের ধোঁয়ার গন্ধ, কড়াইতে সেদ্ধ হওয়া ভাত আর শাকের সুগন্ধ, আর পাহাড়ি লোকগানের সুর মিশে রাতটিকে করে তুলল এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। অভিযাত্রীর মনে হলো, এই গ্রামটি কোনো সাধারণ আশ্রয় নয়, বরং অরণ্যের কঠিন পথ পেরোনোর আগে প্রকৃতির দেওয়া এক উপহার। এই মানুষগুলোর হাসি আর গল্প যেন তার মনোবলকে দ্বিগুণ করে তুলল।

খাওয়াদাওয়া আর আড্ডার শেষে গ্রামপ্রধান তাকে ডাকলেন। ধীরে ধীরে বৃদ্ধ মানুষটি তাকে বুঝিয়ে দিলেন, সামনে যে জঙ্গল পড়বে তা কেবল বিপদসংকুল নয়, বরং ধৈর্য আর বুদ্ধির পরীক্ষার জায়গা। তিনি হাতে একটা বাঁশের লাঠি দিয়ে বললেন, “পিচ্ছিল পথে ভারসাম্য রাখতে এটাই তোমার বন্ধু হবে। নদী পেরোতে হলে স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ কোরো না, বরং স্রোতের ভাষা বোঝার চেষ্টা করো। আর মনে রেখো, ভয়কে জয় করার একমাত্র পথ হলো ধৈর্য।” এই উপদেশগুলো অভিযাত্রীর কাছে যেন দিকনির্দেশনার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠল। রাতে যখন সে ঘুমোতে গেল, বাইরে তখনও হালকা বৃষ্টি পড়ছিল, মাটির ঘ্রাণ ভেসে আসছিল বাতাসে। তার মনে হলো, প্রকৃতির সব প্রতিকূলতার পর এই উষ্ণ আতিথেয়তা শুধু শরীর নয়, তার আত্মাকেও শক্তি জুগিয়েছে। চোখ বন্ধ করার আগে সে বুঝল, অরণ্যের অন্ধকার পথ আর অচেনা ভয়কে পেরিয়ে যেতে হলে মানুষের এই ভালোবাসা আর নির্দেশই হবে তার সবচেয়ে বড় সম্বল। এভাবেই অভিযাত্রী উপলব্ধি করল—যাত্রার প্রতিটি ধাপে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষও তাকে গড়ে তুলছে, শিখিয়ে দিচ্ছে সহমর্মিতা, ধৈর্য আর সাহসের অর্থ।

অধ্যায় ৫ – নদীর গর্জন

ভোরবেলা কুয়াশা সরতেই অভিযাত্রী আবার রওনা দিল অরণ্যের পথে। আগের রাতের আতিথেয়তা তাকে নতুন শক্তি দিয়েছে, তবে আজকের যাত্রায় কী অপেক্ষা করছে তা সে জানত না। কিছুটা পথ পেরোতেই দূর থেকে কানে এলো এক অদ্ভুত গর্জন, প্রথমে মনে হলো বজ্রপাতের শব্দ, কিন্তু যত এগোতে লাগল ততই স্পষ্ট হলো—এটা নদীর স্রোতের গর্জন। পাহাড়ের বুক চিরে ছুটে আসা সেই নদী যেন এক বন্য জানোয়ারের মতো গর্জে উঠছিল। গাছের ফাঁক দিয়ে প্রথমবার যখন নদীটিকে চোখে পড়ল, তার বুক কেঁপে উঠল। সাদা ফেনায় ভরা পানির স্রোত প্রবল বেগে ছুটে চলেছে, চারপাশের পাথরে ধাক্কা খেয়ে গর্জন যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। শহরে বসে নদীর ছবি বা ভিডিও দেখা আর এখানে দাঁড়িয়ে সেই নদীর সামনে দাঁড়ানো—দুটোর মধ্যে তফাৎ যেন আকাশ-পাতাল। প্রকৃতির এই শক্তি তাকে মুগ্ধ করলেও একইসঙ্গে ভয়ে শিহরিত করে তুলল। মনে হলো, এক ভুল পদক্ষেপ মানেই এই স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অজানার গভীরে।

গত রাতের গ্রামপ্রধানের কথা তখন তার মনে পড়ল—“স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ কোরো না, বরং স্রোতের ভাষা বোঝার চেষ্টা করো।” সেই উপদেশ মনে রেখেই সে নদীর তীরে পৌঁছাল। সেখানে কয়েকজন গ্রামবাসী আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল, তারা বাঁশ দিয়ে তৈরি এক ভেলা এনে দিল। ভেলাটা দেখতে যতটা সরল, ততটাই ভরসাহীন মনে হচ্ছিল তার কাছে। ভিজে বাঁশের গায়ে হাত রাখতেই মনে হলো, এত ভয়ংকর নদীর সামনে এই ভেলাটা তার জীবনরক্ষার শেষ অবলম্বন। গ্রামবাসীরা হাসিমুখে ভেলাটা নদীতে নামাল, আর তাকে সাহস জুগিয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না, নদীকে বন্ধু ভাবো, তাহলেই সে তোমাকে পথ দেখাবে।” তাদের বিশ্বাস আর নিশ্চিন্ত দৃষ্টি কিছুটা হলেও তার সাহস বাড়াল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয় যেন তার শিরায় রক্তের মতো প্রবাহিত হচ্ছিল। তবুও যাত্রা থামানো যাবে না—এই দৃঢ়তা তাকে ভেলায় চড়ে বসতে বাধ্য করল। নদীর ঠান্ডা জল ভেলাকে কাঁপিয়ে তুলল, আর ভেলার প্রতিটি দোলায় তার বুকের ভিতর ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেল।

নদীর স্রোত শুরুতেই তার সাহসকে কাঁপিয়ে দিল। ভেলা তীব্র বেগে ভেসে যাচ্ছিল, পানির গর্জন কানে বজ্রধ্বনির মতো বাজছিল, আর প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ভেলাটা উল্টে যাবে। অভিযাত্রী দুই হাতে বাঁশের লাঠি আঁকড়ে ধরেছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিল, এখানে শক্তি দিয়ে লড়াই করে কোনো লাভ নেই—শুধু ভেসে থাকা আর ভারসাম্য রক্ষা করাই বাঁচার একমাত্র উপায়। মাঝে মাঝে স্রোত এত জোরে আছড়ে পড়ছিল যে তার শরীর পুরোপুরি কেঁপে উঠছিল, চোখ বন্ধ করে শুধু মনে মনে প্রার্থনা করছিল—“আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে।” নদী যেন বারবার তাকে ভয় দেখাচ্ছিল, কিন্তু সেই ভয়ই আবার তাকে আরও দৃঢ় করে তুলছিল। কিছুক্ষণ পর, যেমন হঠাৎ স্রোত বেড়ে গিয়েছিল, তেমনই ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করল। ভেলা নদীর অপর পাড়ে এসে থামতেই অভিযাত্রীর শরীর ভিজে কাঁপছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল সে যেন এক বিশাল যুদ্ধ জিতে এসেছে। ভয় তাকে ঘিরে রেখেছিল পুরোটা সময়, কিন্তু সেই ভয়কে নিয়েই সে পার হয়েছে নদীর গর্জন। তীরে উঠে দাঁড়ানো মাত্রই তার মনে হলো, এটি শুধুই নদী পার হওয়া নয়—এটি ছিল জীবনের এক গভীর শিক্ষা। প্রকৃতির কাছে মাথা নত করতে হয়, তার শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ নয়, বরং বোঝাপড়া করেই পথ খুঁজে নিতে হয়। এই উপলব্ধি নিয়ে সে আবার অরণ্যের ভেতর যাত্রা শুরু করল, আরও একধাপ এগিয়ে কিংবদন্তির সেই জীবন্ত সেতুর পথে।

অধ্যায় ৬ – ভয়ংকর অরণ্যপথ

নদীর গর্জন পেরিয়ে আসার পর অভিযাত্রী ভেবেছিল হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাবে, কিন্তু অরণ্যের পথ তাকে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করল। দুপুর গড়িয়ে আসতেই আকাশে মেঘ জমল, আর অল্প সময়ের মধ্যেই জঙ্গল ঢেকে গেল ঘন অন্ধকারে। সূর্যের আলো গাছের ঘন পাতার আড়ালে ঢুকে পড়তে পারছিল না, ফলে পথ যেন এক অদৃশ্য পর্দায় ঢাকা পড়ে গেল। চারপাশে শুধু অদ্ভুত শব্দ—কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, কোথাও অজানা পাখির চিৎকার, আবার কোথাও দূর থেকে শোনা গেল বন্য জন্তুর গর্জন। প্রতিটি শব্দই অভিযাত্রীর মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে চাইছিল। পায়ের নিচে শুকনো ডাল ভাঙার শব্দও তাকে কেঁপে উঠতে বাধ্য করছিল, মনে হচ্ছিল কেউ তাকে অনুসরণ করছে। জঙ্গলের নিস্তব্ধতার ভেতর সেই শব্দগুলো যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল। নিঃসঙ্গতা তাকে ঘিরে ধরেছিল, যেন এই বিশাল অরণ্যে সে একাই শুধু মানুষ, আর বাকিরা সবাই অদৃশ্য চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

একসময় মনে হলো ছায়ার ভেতর দিয়ে কিছু নড়ছে। ভেজা পাতার আড়ালে হঠাৎ দুটি জ্বলজ্বলে চোখ দেখা দিল, আর অভিযাত্রীর শরীর মুহূর্তে শীতল হয়ে গেল। বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন এত জোরে হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল চারপাশের অরণ্যও তা শুনতে পাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল, তবে ভয় থেকে গেল আগের চেয়ে আরও বেশি। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল অজানা কোনো জন্তু তাকে আক্রমণ করবে। তার মনের ভেতর দ্বন্দ্ব চলতে লাগল—এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি পালিয়ে যাবে? কিন্তু পালানোর পথও অচেনা, চারপাশে কেবল অন্ধকার আর ঘন ঝোপ। ভয়ের দমবন্ধ করা বাতাস তাকে স্থবির করে দিতে চাইছিল, ঠিক তখনই সে মনে করল গ্রামপ্রধানের কথাগুলো—“ভয়কে জয় করার একমাত্র পথ হলো ধৈর্য।” এই স্মৃতি তার ভেতরে ধীরে ধীরে সাহসের আগুন জ্বালাল। সে নিজেকে বলল, “আমি যদি ভয়কে কাছে টেনে নিই, তবে সেটাই আমাকে গ্রাস করবে। কিন্তু আমি যদি তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং যাত্রার অংশ হিসেবে মেনে নিই, তবে ভয় আমাকে থামাতে পারবে না।” এই উপলব্ধি তাকে নতুনভাবে দম দিল, আর সে দৃঢ়ভাবে বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করল।

অরণ্যের ভয়াল ছায়া আর অদ্ভুত শব্দ তাকে পুরোপুরি কাবু করতে পারেনি, কারণ অভিযাত্রী বুঝে গিয়েছিল—ভয় মানেই মৃত্যুর ইঙ্গিত নয়, ভয় অনেক সময় বেঁচে থাকার শক্তিও জাগিয়ে তোলে। ধীরে ধীরে তার কান সেই শব্দগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেল; বন্য জন্তুর ডাক এখন আর তাকে আতঙ্কিত করছিল না, বরং মনে হচ্ছিল প্রকৃতি তার নিজের ভাষায় কথা বলছে। নিঃসঙ্গতার ভারও আর তাকে চেপে ধরছিল না, কারণ সে বুঝতে পারল, এই অরণ্যে সে একা নয়—প্রকৃতির প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাতা, প্রতিটি জীব তার সঙ্গী। এই সাহসই তাকে এগিয়ে দিল ভয়ংকর অরণ্যপথের ভেতর দিয়ে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ এখন আত্মবিশ্বাসে ভরা, প্রতিটি নিঃশ্বাস এখন জয়ের গান। যদিও অন্ধকার এখনও ঘন, যদিও ছায়ার আড়ালে এখনও অজানা চোখ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে, তবুও সে এগিয়ে চলল। কারণ অভিযাত্রী জানে, ভয়ের দেয়াল পেরোলেই অপেক্ষা করছে আলো, আর সেই আলোই তাকে পৌঁছে দেবে তার স্বপ্নের গন্তব্যের পথে। ভয়ংকর অরণ্যপথ তাই তার কাছে শুধুই আতঙ্ক নয়, বরং এক জীবন্ত শিক্ষা—সাহস হলো ভয়ের অনুপস্থিতি নয়, বরং ভয়ের মাঝেও এগিয়ে চলার দৃঢ় সংকল্প।

অধ্যায় ৭ – প্রথম দর্শন

ঘন অরণ্যের আঁধার, বৃষ্টিতে ভেজা গাছপালার মৃদু কাঁপন, আর ঝিঁঝিঁ পোকার সুরের মাঝেই অভিযাত্রী এগোতে থাকে। বহু দিনের যাত্রা, ক্লান্তি, ভয়ের ছায়া আর বিপদসংকুল পথ তার শরীর ও মনকে ভারী করে তুলেছে, কিন্তু ভেতরে অদ্ভুত এক টান তাকে সামনে টেনে নিয়ে চলেছে। ঘন জঙ্গলের প্রতিটি বাঁকে মনে হয়, এখানেই বুঝি লুকিয়ে আছে সেই রহস্যময় সেতু যার কথা সে এতদিন শুনে এসেছে। হঠাৎ এক পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়ে যখন শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়ে আসে, তখন চোখে পড়ে গাছের ফাঁকের মধ্য দিয়ে অচেনা আলোর ঝলকানি। সে থমকে দাঁড়ায়, বুকের ভেতর ধুকপুকানি দ্রুত হয়ে ওঠে। বাতাসে ভিজে পাতার গন্ধ আর নদীর স্রোতের গর্জনের সঙ্গে মিশে এক অন্যরকম সুর যেন ডাক দিচ্ছে তাকে। সেই মুহূর্তে অভিযাত্রী প্রথমবার অনুভব করে—সে আর সাধারণ কোনো পথে হাঁটছে না, সে প্রবেশ করতে চলেছে এক জীবন্ত কিংবদন্তির ভেতরে।

কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই দৃশ্যপট খুলে যায়। তার চোখের সামনে ধরা দেয় সেই স্বপ্নিল চিত্র—দূরে পাহাড়ি উপত্যকার মাঝখানে ঝুলে আছে জীবন্ত রুট ব্রিজ। বিশাল রবার গাছের শেকড় জড়িয়ে, বেঁকে, বাঁধা হয়ে তৈরি করেছে এক প্রাকৃতিক সেতু, যা নদীর ওপর দিয়ে সুনিপুণভাবে ছড়িয়ে আছে। দূর থেকেই বোঝা যায়, এটি মানুষের তৈরি নয়, বরং প্রকৃতির নিজস্ব এক বিস্ময়, যেখানে মানুষের ধৈর্য ও প্রজ্ঞা যোগ করেছে শেকড়ের দোলায় প্রাণ। অভিযাত্রীর শরীর ঘামে ভিজে, চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, বুকের ভেতর ভরে ওঠে এক অদ্ভুত বিস্ময়ে। এতদিন কেবল গল্পে শোনা, কল্পনায় আঁকা এই সেতুটি এখন তার চোখের সামনে বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হয়, সে যেন সময়ের সীমা পেরিয়ে কোনো স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করেছে—যেখানে মানুষ আর প্রকৃতি মিলে তৈরি করেছে এক অমর চিহ্ন।

অভিযাত্রী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, যেন চোখ সরাতেই ভয় পাচ্ছে এই দৃশ্য হারিয়ে যাবে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটির দিকে তাকিয়ে তার মনে এক প্রবল আবেগের স্রোত বইতে শুরু করে। সে ভাবে, এ শুধু একটি সেতু নয়, এ যেন মানুষের বিশ্বাস, অধ্যবসায় আর প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের এক জীবন্ত প্রতীক। পথের সমস্ত কষ্ট, ভয়, বৃষ্টির ফাঁদ, নদীর গর্জন, অরণ্যের ভয়ানক অন্ধকার—সবকিছু যেন এক মুহূর্তে অর্থ খুঁজে পায় এই দৃশ্যের ভেতর। চোখ ভিজে আসে তার অজান্তেই, আর ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক নিঃশব্দ হাসি। সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, তার যাত্রা বৃথা যায়নি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জীবন্ত রুট ব্রিজ তাকে আহ্বান করছে, ডেকে নিচ্ছে আরও গভীরে, আরও কাছে—যেন বলছে, “এসো, তুমি তোমার সত্যিকারের পরীক্ষার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছ।”

অধ্যায় ৮ – সেতুর পরীক্ষা

সেদিন সকালের আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা, বাতাসে ভিজে মাটির গন্ধ আর নদীর গর্জন মিশে এক অচেনা উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। অভিযাত্রী দাঁড়িয়ে আছে সেই জীবন্ত রুট ব্রিজের সামনে, চোখের সামনে প্রসারিত হয়েছে শত শত বছরের ধৈর্যে গড়া এক বিস্ময়। দূর থেকে যেটি স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল, এখন কাছে এসে যেন ভীতিকর বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভেজা শেকড়গুলো বৃষ্টিতে চকচক করছে, যেন পিচ্ছিল সাপের শরীর, আর নিচে ভয়ংকর খাত, যার গভীরে নেমে যাচ্ছে প্রবল স্রোতের নদী। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়—এটা পেরোনো কি আদৌ সম্ভব? মনের ভেতর ভয় আর সাহসের এক অদ্ভুত লড়াই শুরু হয়। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়তে থাকে, ঘাম জমতে শুরু করে কপালে, অথচ শরীর ভিজে আছে ইতিমধ্যেই বৃষ্টির ফোঁটায়। সে জানে, এই মুহূর্তে পা বাড়ানো মানেই মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাওয়া। তবুও কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ঠেলে দেয় সামনে।

সেতুর প্রথম ধাপে পা রাখতেই মনে হলো গোটা পৃথিবী দুলে উঠল। শেকড়ের বোনা দড়ির মতো পথটি তার ওজন টের পেয়ে সামান্য কেঁপে উঠল, আর নিচে স্রোতের গর্জন যেন আরও জোরালো হয়ে উঠল। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে মনে হচ্ছিল পা পিছলে গেলেই সরাসরি অজানার অন্ধকারে গড়িয়ে পড়তে হবে। বাতাসে ভিজে গাছের পাতার গন্ধ আর নদীর কুয়াশা মিশে এক অদ্ভুত ভয়াবহতা তৈরি করেছিল। চোখ যতই সামনে রাখে, মনে হচ্ছিল সেতুর অপর প্রান্ত কখনও আসবে না। মাঝেমাঝি এসে সে থেমে যায়, বুকের ভেতর শ্বাস আটকে যায় যেন, হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে একটি মোটা শেকড়। সেই মুহূর্তে মনে হয়, মানুষ কতটা ক্ষুদ্র আর প্রকৃতি কতটা বিশাল। তার চোখের সামনে শুধু পিচ্ছিল শেকড় আর নিচে অনন্ত গভীরতা। ভয় তাকে গ্রাস করে, কিন্তু একইসাথে একটা দৃঢ় সংকল্প ভেতর থেকে জেগে ওঠে—যদি এতদূর আসা যায়, তবে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রামবাসীদের হাসিমুখ, যারা তাকে আশীর্বাদ করেছিল, সেই বয়স্ক মানুষের পরামর্শ, আর নিজের অন্তরের সেই ডাক যা তাকে এই অরণ্যে এনেছে।

ধীরে ধীরে সে আবার পা বাড়ায়, প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হয় মৃত্যু হাত বাড়িয়ে আছে, আবার জীবনও যেন সামনে থেকে আহ্বান করছে। শেকড়গুলো তার শরীরের নিচে কাঁপছে, বাতাসে ভিজে চুল এলোমেলো হয়ে চোখ ঢেকে ফেলছে, তবুও সে এগিয়ে চলে। একসময় যখন সেতুর শেষ প্রান্ত কাছে আসে, তার ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি জমা হতে শুরু করে। মনে হয়, এই সেতু কেবল একটি প্রাকৃতিক কাঠামো নয়, বরং তার সাহসের পরীক্ষা, জীবনের এক বড় শিক্ষা। শেষ পদক্ষেপে যখন সে সেতুর অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে পড়ে, তখন বুক ভরে ওঠে এমন এক স্বস্তিতে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সে ফিরে তাকায় সেতুটির দিকে—যেন জীবন্ত প্রাণী, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের ভরসার প্রতীক হয়ে। তার চোখে জল এসে যায়, ঠোঁটে ফুটে ওঠে নিঃশব্দ হাসি। সে জানে, আজ সে শুধু একটি সেতু পেরোয়নি, বরং নিজের ভেতরের ভয়কে জয় করেছে, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে। জীবন্ত রুট ব্রিজ তাকে শিখিয়ে দিয়েছে, জীবন সবসময় এক সেতুর মতো—পিচ্ছিল, ভয়ংকর, অনিশ্চিত, কিন্তু বিশ্বাস আর সাহস থাকলে এর অপর প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব।

অধ্যায় ৯ – বিজয়ের মুহূর্ত

অবশেষে সেই মুহূর্ত এসে যায়, যার জন্য এতদিনের যাত্রা, সংগ্রাম আর সহ্যশক্তি। ভেজা শেকড়ের কাঁপুনি আর নিচে গর্জন করা নদীর ভয়াবহ শব্দ পেরিয়ে অভিযাত্রী যখন শেষ পদক্ষেপ ফেলে সেতুর অপর প্রান্তে পৌঁছে দাঁড়াল, তখন যেন বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস এক ঝটকায় বেরিয়ে এলো। বাতাসে তখনো বৃষ্টির ছিটে, কুয়াশার ঘন আবরণে পাহাড়ি উপত্যকা আধো-অন্ধকারে মোড়া, কিন্তু তার চোখের সামনে দৃশ্য যেন রঙিন হয়ে উঠল। সেই মুহূর্তে পৃথিবী একেবারে অন্যরকম মনে হলো—যেন চারপাশের পাহাড়, গাছ, নদী, আকাশ সবাই একসঙ্গে তার বিজয়কে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সেতুর অপর পাশে এসে দাঁড়ানো মানে শুধু একটি প্রাকৃতিক কাঠামো অতিক্রম করা নয়, বরং ভয়, হতাশা আর মৃত্যু-সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের শক্তিকে নতুন করে চিনে নেওয়া। সে অনুভব করল, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জয়গুলো কখনও সহজে আসে না, আসে ভয়ের ভিতর দিয়ে, আসে সীমা ভাঙার সাহসে।

তার শরীর ভিজে কাঁপছে, হাঁটুর ওপর কাঁদামাটি, হাতের তালুতে শেকড় আঁকড়ে ধরা থেকে রক্তের দাগ, তবুও মুখে ফুটে উঠেছে অদ্ভুত এক প্রশান্তির হাসি। মনে হলো, এ পর্যন্ত আসতে যে ভয় আর অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে, তা-ই যেন এই হাসির আসল মানে তৈরি করেছে। বৃষ্টির শব্দ আর নদীর গর্জন মিলেমিশে এক অদ্ভুত সঙ্গীত তৈরি করেছিল, আর সেই সঙ্গীতে সে খুঁজে পেল নিজের ভেতরের জয়ের সুর। গ্রামবাসীদের কথাগুলো মনে পড়ল—“ভয়কে জয় করলেই তুমি সেতুর আসল শক্তি অনুভব করতে পারবে।” সত্যিই, এই অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে তার মনে হচ্ছিল, সে আর আগের মতো নেই। তার ভিতরের দুর্বলতা আর দ্বিধা গলে গিয়ে জায়গা নিয়েছে সাহস আর আত্মবিশ্বাস। প্রকৃতির নির্মমতা যেমন তাকে পরীক্ষা করেছে, প্রকৃতির সৌন্দর্যও তাকে পুরস্কার দিয়েছে। সেই পুরস্কার হলো এই অনুভূতি—সে পারে, তার ভেতরে শক্তি আছে, আর জীবন যত প্রতিকূল হোক, তা অতিক্রম করার ক্ষমতা তার মধ্যেই নিহিত।

সে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, চোখের সামনে বিশাল অরণ্য, নিচে গর্জন করা নদী, আর পেছনে জীবন্ত রুট ব্রিজ। সেই দৃশ্যকে মনে গেঁথে নিল, কারণ জানত—এ অভিজ্ঞতা আজীবন তার পথচলার সঙ্গী হয়ে থাকবে। বিজয়ের এই মুহূর্ত তাকে শিখিয়ে দিল, জীবনের আসল জয় বাইরের কিছুকে হারানো নয়, বরং নিজের ভেতরের ভয়কে জয় করা। পথের প্রতিটি কষ্ট—ঝড়, বৃষ্টি, পিচ্ছিল মাটি, বন্য জন্তুর ভয়, অচেনা অরণ্য—সব মিলিয়ে আজ অর্থবহ মনে হলো, কারণ সেই সমস্ত কষ্টই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তার মনে হলো, জীবন্ত রুট ব্রিজ শুধু একটি সেতু নয়, বরং জীবনের প্রতীক, যা শেখায়—জীবন যতই অনিশ্চিত হোক, সাহস আর ধৈর্য থাকলে একদিন অপর প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব। সেই মুহূর্তে অভিযাত্রী গভীরভাবে শ্বাস নিল, বুক ভরে নিল অরণ্যের বাতাস, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—এই জয় শুধু আজকের নয়, বরং তার ভবিষ্যতের প্রতিটি যাত্রার প্রেরণা হয়ে থাকবে।

অধ্যায় ১০ – ফিরে আসা, কিন্তু নতুন আমি

গ্রামে ফিরে আসার মুহূর্তটা যেন অভিযাত্রীর কাছে ছিল এক স্বপ্নের মতো। যেখান থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই পাহাড়ি গ্রামটি এবার তাকে ভিন্নভাবে স্বাগত জানাল। মানুষগুলো হাসিমুখে এগিয়ে এলো, কেউ হাতে গরম লাল চায়ের পেয়ালা ধরিয়ে দিল, কেউ কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল তার কষ্টের কথা। তাদের উষ্ণতায় ভিজে গিয়ে অভিযাত্রী হঠাৎ অনুভব করল—সে আর আগের সেই মানুষটি নেই, যে শহরের একঘেয়েমি থেকে পালাতে এসে অরণ্যের অজানায় ঝাঁপ দিয়েছিল। এখন সে জানে, প্রকৃতি কেবল ভয় আর রহস্যের আবরণ নয়, প্রকৃতি হলো এক অদৃশ্য শিক্ষক, যে মানুষকে কষ্টের ভেতর দিয়ে দৃঢ়তা শিখিয়ে দেয়। বৃষ্টির ভেজা পথ, অরণ্যের অন্ধকার, সেতুর দোলানো শেকড়—সবকিছু তার ভেতরে এক নতুন আলো জ্বালিয়েছে। গ্রামবাসীদের সরলতা আর আতিথেয়তায় সে কৃতজ্ঞতার আসল মানে খুঁজে পেল।

চায়ের ধোঁয়া আর পাহাড়ি গানের সুরের মাঝখানে বসে সে ভেবে দেখল—লিভিং রুট ব্রিজ আসলে কেবল একটি পথ নয়, বরং জীবনের প্রতীক। প্রতিটি ভেজা শেকড়ের মতোই মানুষের জীবনও ভরা থাকে অনিশ্চয়তা, ভয় আর পিচ্ছিলতায়। কিন্তু ধৈর্য ধরে, দৃঢ় মন নিয়ে একে একে পদক্ষেপ ফেললে একদিন অপর প্রান্তে পৌঁছানো যায়। সে উপলব্ধি করল, ভয়কে জয় করা মানেই কেবল বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা নয়, বরং নিজের ভেতরের দুর্বলতাকে হারানো। শহরে ফেরা মানে তার কাছে আর আগের মতো কোলাহল, ক্লান্তি আর একঘেয়েমি নয়; এবার সে জানে, জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জই এক একটি সেতু, যেগুলো পার হওয়ার পর মানুষ হয়ে ওঠে আরও পরিপূর্ণ। তার চোখে জল এসে গেল কৃতজ্ঞতায়, কারণ সে অনুভব করল—অরণ্য তাকে কেবল একটি গল্প উপহার দেয়নি, দিয়েছে নতুন করে বেঁচে থাকার শক্তি।

বিদায়ের আগের রাতে আকাশে তারাভরা অন্ধকার নেমে এলো, আর সেই আকাশের নিচে বসে অভিযাত্রী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—এই অভিজ্ঞতা সে কোনোদিন ভুলবে না। শহরে ফিরে গিয়ে হয়তো সে আবার ব্যস্ততায় ডুবে যাবে, কিন্তু ভেতরে এক অটল আত্মবিশ্বাস তাকে পথ দেখাবে। জীবন্ত রুট ব্রিজ তাকে শিখিয়েছে—মানুষ যদি প্রকৃতির সঙ্গে হাত মেলাতে পারে, তবে অসম্ভবকেও জয় করা যায়। পাহাড়ি মানুষের হাসি, নদীর গর্জন, অরণ্যের অন্ধকার, আর সেতুর পিচ্ছিল শেকড়—সব মিলিয়ে তার জীবনে এক অমলিন শিক্ষা হয়ে রইল। সে জানে, আজকের পর তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি যাত্রা আর প্রতিটি স্বপ্নে এই অভিজ্ঞতা শক্তি যোগাবে। গ্রামকে বিদায় জানিয়ে সে যখন দূরে পা বাড়াল, তার মনে হলো—সে ফিরে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এবার একজন নতুন মানুষ হয়ে, যে জানে ভয়, কষ্ট আর অনিশ্চয়তার ওপারেই লুকিয়ে আছে জীবনের সবচেয়ে বড় বিজয়।

সমাপ্ত

1000068590.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *