অন্বেষা চৌধুরী
অধ্যায় ১
আগমনের দিন
কলকাতা থেকে শিলংয়ের ফ্লাইটটা ধরার সময় অরণ্যার চোখে একধরনের অদ্ভুত নির্লিপ্তি ছিল। সানগ্লাসের আড়ালে লুকোনো চোখে যেন ক্লান্তির ছায়া ছিল, আবার কোথাও একটা উন্মুখ প্রত্যাশার কাঁচা আলোর রেখাও। গত তিন বছর ধরে মুম্বইয়ের কর্পোরেট জীবন তাকে কেবল কাজের বোঝা আর অনিদ্রার অভিশাপই দিয়েছে। সৃষ্টিশীল মানুষ হয়েও, নিজের মধ্যেকার সৃষ্টিকে সে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করে এসেছে; সবকিছু যেন স্বয়ংক্রিয় হয়ে গিয়েছিল—এক রোবোটিক দিনের পর দিন। তাই এক সকালে, চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে মুম্বইয়ের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল—আর নয়। কিছুতেই আর নয়। অফিসে ই-মেইল করে দিয়েছিল, “I resign, effective immediately.” তারপর মাকে ফোন করে বলেছিল, “কিছুদিন কোথাও যাচ্ছি, নিজের মতো করে থাকতে চাই।” মা প্রথমে অবাক, পরে বিরক্ত, শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে শুধুই বলেছিলেন, “নিজেকে খুঁজতে কতদূর যেতে হয় আজকাল তোমাদের, না রে?” শিলং তার কাছে কোনও ট্যুরিস্ট প্ল্যান ছিল না—বরং একটা পালানোর জায়গা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার জায়গা। পাহাড়, মেঘ, নীরবতা—এই তিনটের আশ্রয়ে সে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছিল, ঠিক না জেনেই।
শিলং বিমানবন্দরে পা রাখতেই অনুভব করল, এখানকার বাতাসে কিছু একটা অন্যরকম। হালকা ঠাণ্ডা, একটা স্যাঁতসেঁতে হাওয়া আর সেই অদ্ভুত নিরবতা যা শব্দের চেয়ে অনেক বেশি বলিষ্ঠ। হোমস্টে-র গাড়ি তাকে নিতে এসেছিল, চালক ছিলেন সলোমন—জুন মালসাওমার ভাই। গাড়িতে বসে পাহাড়ি রাস্তাগুলোর দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল ঝিরিঝিরি মেঘ গাড়ির জানালা ঘেঁষে চলছে, আর দূরে দূরে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পাহাড়ের শীর্ষ যেন ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। এই প্রথম নিজের মনের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব করল না, বরং সেই শূন্যতাটাকেই অনুভব করতে শুরু করল। হোমস্টেটা ছিল শহরের মূল কেন্দ্র থেকে একটু দূরে—পাইন গাছ ঘেরা এক ছোট্ট বাগানঘেরা কাঠের বাড়ি। দরজা খুলেই জুন তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন—সেই হাসিতে ছিল অভ্যর্থনার চেয়ে বেশি কিছু, যেন বলা হচ্ছিল, “চিন্তা কোরো না, তুমি ঠিক জায়গায় এসেছ।” অরণ্যা জানত না, জুনের সঙ্গে এই বন্ধুত্বই তাকে অনেককিছু শিখিয়ে দেবে। হোমস্টের ঘরটা ছিল উষ্ণ, কাঠের দেয়াল, ছোট্ট এক কাচের জানালা দিয়ে পাহাড় দেখা যায়, আর বিছানার পাশেই রাখা ছিল এক টুকরো হাতের বোনা কম্বল। ঘরে ঢুকে সুটকেস রেখে সে নিঃশব্দে জানালার পাশে বসে পড়ল—নিচে মেঘ, উপরে মেঘ, আর মাঝখানে এই মুহূর্তের মতো জীবনটা যেন থেমে আছে।
সন্ধ্যেবেলা জুন চা নিয়ে এলো। অরণ্যা বলল না কিছু, জুনও জোর করল না। দু’জনেই একসঙ্গে বারান্দায় বসল—চুপচাপ। দূরে পাহাড়ের গায়ে আলো জ্বলছে, যেন তারা ক্ষীণভাবে জানান দিচ্ছে মানুষ এখনও আছে। হঠাৎ একটা বাঁশির সুর ভেসে এলো, পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে থেকে। অরণ্যা মাথা ঘুরিয়ে তাকাল—দেখল একজন যুবক, ধূসর জ্যাকেট পরা, বাঁশিতে বাজাচ্ছে এক মন খারাপ করা সুর। জুন বলল, “ও রিদম। মিউজিশিয়ান, আর মাঝে মাঝে গাইডের কাজও করে। ওর সুরে অনেক গল্প লুকানো থাকে।” অরণ্যা কিছু বলল না, শুধু বাঁশির সুরটা বুকের মধ্যে ধরে রাখল। সে জানত না সেই বাঁশিওয়ালা যুবক, জুনের অব্যক্ত কষ্ট, আর এই পাহাড়ি নিঃসঙ্গতা মিলে এক অদ্ভুত নতুন যাত্রা শুরু হবে। সে শুধু জানত—আজ সে প্রথমবার নিজের নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছে, আর সেই নিঃশ্বাসের শব্দটাই যেন জীবনের প্রথম সত্যি অনুভব।
অধ্যায় ২
মেঘে ঢাকা সকাল
পরের দিন খুব ভোরেই ঘুম ভাঙে অরণ্যার। বাইরের জানালা দিয়ে কুয়াশা ঢুকেছে ঘরের ভেতরে, কাঠের ঘরের মেঝেতে শিশির জমেছে হালকা পাতলা ধুলোয়। একটা অদ্ভুত গন্ধ—ভেজা পাইনগাছ আর কাঠের ঘ্রাণ মিলেমিশে এক ধরনের আরাম দিচ্ছিল তাকে। বিছানায় বসেই সে সানগ্লাস ছাড়াই চোখ মেলে বাইরের দিকে তাকাল—সেই একরাশ সাদা, ভেসে বেড়ানো মেঘে ঢাকা শহর। বাথরুমে ঢুকে মুখ ধুয়ে সে আয়নায় তাকাল, নিজের ক্লান্ত মুখটা এক নতুন আলোয় ধরা দিল। যাকে এতদিন ধরে অফিসের আলোয়, ব্যস্ততার ছায়ায় হারিয়ে ফেলেছিল, সেই মুখটাই আবার একটু একটু করে চিনতে শুরু করল সে। জুন তখন রান্নাঘরে নরম গলায় গুনগুন করছে খাসি ভাষায় একটা লোকগান। এই পরিবেশে শব্দ আর নীরবতার মধ্যে কোনও সীমারেখা ছিল না—সবকিছু একধরনের স্থির অথচ চলমান অনুভব। সকালের জলখাবারে জুন পরোটা আর মিষ্টি আলুর তরকারি দিয়েছিল। খাওয়ার টেবিলে অরণ্যা বলল, “এখানে এত চুপচাপ লাগে… যেন কেউ কথা না বলেও অনেক কিছু বলছে।” জুন হেসে বলল, “কারণ পাহাড় চেঁচিয়ে কথা বলে না, সে শুধু অপেক্ষা করে—তুমি কখন শুনবে।”
জুন হালকা কাঁচের বোতলে লেবুপাতা দেওয়া গরম জল এনে দিল, আর সঙ্গে একটা কাগজের মানচিত্র। “এই রাস্তাগুলো ধরা থাকল তোমার জন্য, কিন্তু তুমি পথ হারালে ভয় পেও না—এখানে পথ হারালেই মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়,” বলল সে। অরণ্যা মানচিত্র হাতে নিয়ে এক ঝলকে দেখে নিল; চোখে পড়ল ‘Laitlum Canyons’, ‘Mawphlang Sacred Grove’, ‘Ward’s Lake’—কিছু নাম আগে শোনেনি, কিছু ছবি দেখা ছিল ট্যুরিস্ট পোস্টারে। কিন্তু এবার সে পোস্টারের পর্যটক হয়ে নয়, একজন নিজেকে হারিয়ে ফেলার মত যাত্রী হয়ে এসেছে। সে ঠিক করল প্রথমে হেঁটে যাবে হোমস্টের পেছনের পাহাড়ি পথে—কোনও গন্তব্য ছাড়াই, শুধু হাঁটবে। ব্যাগে একটা স্কেচবুক, পেনসিল আর ছাতাটা রেখে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তা কুয়াশার চাদরে ঢাকা, কিন্তু তাতে কোনও অনিশ্চয়তা নেই—বরং একটা আশ্বাস আছে, যেন প্রকৃতি নিজেই বলছে, “এসো, আমি তোমায় আগলে রাখব।” পাইনগাছের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে সে একটা খোলা ঘাসের মাঠে এল, যেখানে কুয়াশার ভেতর কিছু স্থানীয় শিশু ফুটবল খেলছে, হাসছে, দৌড়চ্ছে—মেঘের মধ্যে যেন তাদের ছায়া মিশে যাচ্ছে বারবার। সেখানে বসে সে স্কেচ করতে লাগল তাদের, ধরা পড়ল ছায়া, আনন্দ আর অনন্ত খোলামন।
ঠিক তখনই পিছন থেকে ভেসে এলো সেই চেনা বাঁশির সুর। অরণ্যা চমকে পিছন ফিরে দেখল—রিদম দাঁড়িয়ে আছে একটা পাইনগাছের গুঁড়ির পাশে, সাদা ধোঁয়া উঠছে তার কাপ থেকে—সম্ভবত লাল চা। সে অরণ্যাকে দেখেই মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল, কোনও কথা না বলে। অরণ্যা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “তোমার সুরটা কাল রাতেও শুনেছিলাম… খুব সুন্দর।” রিদম মৃদু হাসল, বলল, “পাহাড়ে গান না থাকলে পাহাড়ও বোবা হয়ে যায়।” তারা পাশাপাশি বসে, ধীরে ধীরে কথায় জড়িয়ে পড়ল। রিদম বলল, তার বাবা ইংল্যান্ডে থাকতেন, মা ছিলেন খাসি সম্প্রদায়ের—সে নিজেও কখনো পুরোপুরি কোনও জায়গার নয়, যেন পাহাড়ে জন্মে পাহাড়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। অরণ্যা তাকিয়ে রইল তার চোখের দিকে—সেখানে ছিল গভীরতা, যন্ত্রণার ছায়া, আর এক অদ্ভুত শান্তি। “তুমি ছবি আঁকো?” জিজ্ঞেস করল রিদম। “সপ্তাহে একদিন আঁকতাম, এখন আবার চেষ্টা করছি,” বলল অরণ্যা। রিদম বলল, “এই পাহাড়ে আঁকা সহজ, কারণ প্রকৃতি নিজেই রঙ করে দেয়, শুধু চোখ খোলা রাখতে হয়।” কথাগুলো যেন অরণ্যার মনে একটা চাবির কাজ করল—জীবনের তালা খুলে ফেলার প্রথম শব্দ। তারা পাশাপাশি বসে রইল অনেকক্ষণ—নীরবতায়, যেখানে মেঘ, মানুষ আর মন একে অপরকে চিনে নিতে শুরু করে।
অধ্যায় ৩
নীরবতার সুর
পরের কয়েকদিন এক আশ্চর্য ছন্দে কেটে গেল অরণ্যার—সকালে কুয়াশার মধ্যে হাঁটা, হোমস্টের বারান্দায় বসে জুনের সঙ্গে চা খাওয়া, দুপুরে স্কেচবুক নিয়ে পাহাড়ি পথের ধারে বসে কিছু না কিছু আঁকা, আর সন্ধ্যায় বাঁশির সুরে ঘিরে থাকা সেই রহস্যময় ছেলেটির সঙ্গে নীরব বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। অরণ্যা বুঝতে পারছিল যে, শব্দের চেয়ে নীরবতা এখানে অনেক বেশি বলিষ্ঠ; কথার চেয়ে চোখের দৃষ্টি, উপস্থিতির চেয়ে অনুভব এখানে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে ধীরে ধীরে নিজের ভেতরকার ক্লান্তি, অবসাদ, আর বিষণ্ণতাকে অনুভব করতে শিখল—সেগুলোকে লুকোবার দরকার নেই এখানে। একদিন সকালে জুন তাকে বলল, “তুমি চাইলে আজ তোমাকে Sacred Grove দেখাতে পারি—আমার ছোটবেলার জায়গা, আমার ঠাকুমা বলতেন, সেখানে গাছেরা কথা বলে।” অরণ্যা মাথা নাড়ল, হাঁটতে হাঁটতে যেতে চাইছিল সে—জানাল, “তুমি শুধু রাস্তা দেখাও, আমি শুনব গাছেদের গল্প।” জুন হেসে তার খাসি গলার সুরে বলল, “তবে আজ তুমি প্রকৃতির পরীক্ষায় বসবে, প্রস্তুত তো?”
তারা দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল একটা ঘন অরণ্যের কিনারে। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না—কেবল পাইন আর অরণ্যলতার ছায়া। ভিতরে ঢুকতেই অরণ্যা অনুভব করল এক ধরণের অলৌকিক ঠাণ্ডা, নিস্তব্ধতা, এবং বাতাসে হালকা বুনো ফুলের গন্ধ। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো নরম শব্দ করে তার পায়ে ভাঙছিল, আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে মেঘের রেখা ঢুকে পড়ছিল বনের শরীর জুড়ে। জুন বলল, “এই জায়গায় কোনও গাছ কাটা যায় না, কোনও শব্দ করা যায় না—গাছেরা এখানে জন্মায়, মরে, আবার জন্মায়। আমার ঠাকুমা বলতেন, যদি মন থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করো, গাছেরা উত্তর দেয়।” অরণ্যা ধীরে ধীরে একটা পুরনো গাছের নিচে বসে পড়ল, চোখ বন্ধ করল, আর নিজের মনকে প্রশ্ন করল—সে কে, কেন এখানে এসেছে, কোথায় নিজেকে হারিয়েছিল? তার চোখের কোণ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল—না কষ্টে, না আনন্দে—একধরনের চূড়ান্ত আত্মপ্রকাশে। সে বুঝতে পারল, এতদিন ধরে সে নিজেকেই চুপ করিয়ে রেখেছিল, অথচ আসল কথা ছিল—নিজের মনের সঙ্গে কথা বলার সাহস।
সেই সন্ধ্যায় হোমস্টেতে ফিরে এসে সে চুপচাপ বসে ছিল বারান্দায়, আকাশে তখন রং বদলে যাচ্ছে—হালকা সোনালি থেকে ধূসর, ধূসর থেকে বেগুনি। হঠাৎ বাঁশির সেই সুর আবার ভেসে এল, এবার যেন একটু বেশি গাঢ়, একটু বেশি ব্যক্তিগত। সে নিচে তাকিয়ে দেখল—রিদম দাঁড়িয়ে আছে হোমস্টের নিচের বাগানে, তাকিয়ে আছে সোজা তার দিকে। তাদের মধ্যে তখনও কোনও “বন্ধুত্ব” বলে নাম দেওয়া সম্পর্ক তৈরি হয়নি, তবু তাদের দু’জনের চোখেই যেন স্বীকারোক্তির মত একটা নীরবতা ছিল। রিদম বলল, “আজকে তুমি গাছেদের কথা শুনলে?” অরণ্যা মাথা নাড়ল, বলল, “তারা আমার নীরবতাকে ভয় পায়নি।” রিদম বলল, “আমারও প্রথমবার ঠিক এমনটাই লেগেছিল।” সেই রাতে অরণ্যা তার ডায়েরি খুলে লিখল: “আজ আমি বুঝলাম—নিজেকে হারিয়ে ফেলার মানে সবসময় খারাপ নয়। কখনো কখনো হারিয়ে গিয়ে তবেই তো একটা নতুন রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়, যেটা আসলে ছিল খুব চেনা, খুব নিজের।” বাইরের মেঘ এবার জানালার কাঁচে ধাক্কা দিচ্ছিল—যেন তার ভিতরের কথাগুলো জানালার ওপারে কাউকে বলার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে।
অধ্যায় ৪
হারিয়ে যাওয়ার শিল্প
একদিন সকালে, হঠাৎই শিলং শহরের ওপর বৃষ্টির চাদর নেমে এল। হালকা ঝিরিঝিরি নয়, বরং পুরোনো অভিমান ভেঙে পড়া বৃষ্টির মতো একটানা ঝমঝম করে ঝরতে লাগল। অরণ্যা জানালার পাশে বসে কফির কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখে দেখল বাইরের ঝাপসা পাহাড় আর পাইনগাছের মাথা কুয়াশা আর জলের ছোঁয়ায় দুলছে। হোমস্টের খোলামেলা বারান্দা আজ তার আঁকার স্টুডিও হয়ে উঠেছে—স্কেচবুক খুলে সে জলরঙে ধুয়ে দিচ্ছিল পাহাড়ের ছায়া, গাছের অবয়ব আর বৃষ্টির রেখা। জুন তার জন্য একটা হালকা কাঁথা রেখে দিয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে কিছু গরম মোমো আর পুদিনা চা। অরণ্যা অনুভব করল—প্রথমবার নিজের তৈরি জগতে সে শান্তি পাচ্ছে, যেটা অফিসের এসি কেবিন কিংবা কফিশপে পাওয়া যেত না। হঠাৎ সে নিজের আঁকা পাহাড়টার পাশে লিখে ফেলল: “To be found, first be lost.” দুপুরে বৃষ্টি কিছুটা কমতেই রিদম এল—আজও তার হাতে বাঁশি, আর কাঁধে একটা পুরনো খাকি ব্যাগ। সে জানাল, “আজ আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে শহরের আওয়াজ নেই, কেবল বাতাস আর ছায়ার গল্প।”
তারা বেরিয়ে পড়ল, পায়ে হাঁটা পথ ধরে। রিদম জানত অরণ্যা এখন আর গন্তব্য জানতে চায় না, বরং পথটাই তার কাছে সব। রাস্তা এবড়োখেবড়ো, মাঝে মাঝে পাথর, মাঝে মাঝে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে। কিছু দূর হেঁটে তারা পৌঁছল এক পাহাড়ের ঢালে, যেখানে পাইনগাছের ফাঁকে এক পুরনো কাঠের চেয়ার রাখা, পেছনে একটা ঝর্নার শব্দ। অরণ্যা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “এখানে তো কেউ থাকে না?” রিদম বলল, “এটা আমার জায়গা, যখন কেউ কিছু বোঝে না, তখন আমি এখানে এসে বসি। এই চেয়ারে বসে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাইনি, কিন্তু মনে হয়েছে—উত্তর না পাওয়াটাই হয়তো উত্তর।” তারা পাশাপাশি বসে রইল, রিদম বাঁশিতে একটা ধীর সুর তুলল—সেই সুরে ছিল গভীর একাকীত্ব, আবার আশ্চর্য শান্তি। হঠাৎ অরণ্যার গলা ভিজে এল, সে বলল, “আমি এতদিন শুধু চেয়েছিলাম কেউ আমায় বুঝুক, অথচ নিজেই জানতাম না, আমি আসলে কাকে খুঁজছি।” রিদম বলল, “তুমি কি এখনও খুঁজছো?” অরণ্যা তাকাল দূরের মেঘমেঘ পাহাড়ের দিকে, বলল, “না… এখন আমি শুধু হাঁটছি।”
সন্ধ্যায় ফিরে এসে জুন তাকে বলল, “তুমি এখন অনেকটা বদলে গিয়েছ।” অরণ্যা হেসে বলল, “আমি নিজের মুখ চিনতে পারছি আবার।” জুন জবাবে বলল, “তবে সাবধান, পাহাড়ের সবচেয়ে বড় জাদু হল—এখানে মানুষ নিজেকে পছন্দ করতে শিখে যায়।” সেই রাতে হোমস্টের চেম্বারে বসে, অরণ্যা তার ডায়েরির পাতা খুলে এক দীর্ঘ চিঠি লিখল মাকে—কোনও ব্যাখ্যা নয়, কেবল অনুভবের গল্প। শেষ লাইনে সে লিখল, “মা, আমি ভালো আছি না বললে ভুল হবে। বরং বলি, আমি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে উঠছি, কারণ এখানে কিছুই জোর করে হয় না—প্রকৃতিও না, জীবনও না।” চিঠিটা পাঠাবে কিনা জানত না সে, কিন্তু লেখার পর মনে হল—প্রথমবার নিজের অনুভবকে বিশ্বাস করল সে। বাইরের মেঘ জানালার কাঁচে হালকা টোকা দিচ্ছিল—তখন শিলং শহর আর অরণ্যার ভেতরটা সমানভাবে ভিজে যাচ্ছিল।
অধ্যায় ৫
নীল চিঠি ও পুরনো সুর
পরদিন সকালটা কুয়াশায় ভরা হলেও, আকাশে ছিল এক রকম উজ্জ্বলতা। অরণ্যা বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখে দূরের পাহাড়গুলো যেন রোদের সঙ্গে মেঘকে লুকোচুরি খেলছে। জুন টেবিলে চা রেখে বলে গেল, “আজ তোমার নামে একটা চিঠি এসেছে।” চমকে উঠল অরণ্যা—এখানে কেউ জানে না তার ঠিকানা, কেউ জানে না সে কোথায়। সে নিচে গিয়ে দেখল, একটা পাতলা নীল খামে, অদ্ভুত হাতের লেখা। প্রেরক লেখা নেই। খাম খুলে দেখে—একটি একপাতার ছোট চিঠি, ইংরেজিতে লেখা, কিন্তু লাইনগুলো যেন খুব ব্যক্তিগত।
“You once told me that silence was your first language. Here, in these mountains, I see you finally speaking it. Walk a little more into the clouds—you’ll find that some people left traces in the mist just for you to find.”
তার নিচে কোনো নাম নেই, কেবল একটা সুরের চিহ্ন আঁকা। অরণ্যার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল—এই কি রিদমের লেখা? নাকি জুন? নাকি আরও কেউ, যে তাকে নিরবেই চিনে ফেলেছে? তার মাথায় ঘুরতে থাকল প্রশ্নের ঝড়, কিন্তু আশ্চর্যভাবে সে বিচলিত নয়, বরং উৎসুক। এই শহরে, এই পাহাড়ে, প্রতিটি ছায়া যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে নতুন গল্প নিয়ে।
সেই বিকেলেই সে ঠিক করল—আজ সে Ward’s Lake-এ যাবে একা। শহরের মধ্যে হলেও, লেকটার চারপাশে সবুজ ছায়া, হাঁটার রাস্তা আর কুয়াশার আবরণে এক ধরনের একাকী সৌন্দর্য থাকে। রিকশা করে লেকের ধারে পৌঁছে সে হাঁটতে লাগল। চারপাশে পর্যটকের ভিড়, কিন্তু তার কানে কেবল জল পড়ার শব্দ, পাখির ডাক আর নিজের পায়ের ছাপের আওয়াজ। হঠাৎ লেকের এক প্রান্তে ছোট্ট একটা বেঞ্চে বসে থাকা একজনকে দেখে চমকে গেল—রিদম। তবে আজ সে বাঁশি বাজাচ্ছিল না, বরং একটা খাতা নিয়ে কিছু লিখছিল। অরণ্যা নিঃশব্দে গিয়ে পাশে বসতেই রিদম বলল, “তুমি সেই চিঠির কথাই ভাবছো, তাই তো?” অরণ্যা একটু থমকে বলল, “তুমি জানো?” রিদম মৃদু হাসল, বলল, “জানি না, তবে জানার প্রয়োজনও নেই। পাহাড়ে কিছু জিনিস ঘটে—যেগুলো যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় না। যেমন এই মুহূর্তটা।” তারা দু’জনে নীরবে বসে রইল—রোদ, ছায়া, আর হাওয়ার মধ্যে যেন তাদের কথার বাইরে আরও অনেক কথা চলছিল। রিদম বলল, “তুমি জানো, এখানে আগে একটা মেল-বাক্স থাকত, যেখানে মানুষ নিজেদের না-বলা কথা লিখে রেখে যেত, ঠিকানাবিহীন, নামছাড়াই। হয়ত কেউ আজও সেই বাক্সে খুঁজে পায় কাউকে।”
সন্ধ্যা নামার আগে হোমস্টে-তে ফিরে এসে অরণ্যা বারান্দায় বসে আবার সেই চিঠিটা খুলে পড়ল। এবার মনে হল—এটা কাউকে দিয়ে লেখা নয়, বরং পাহাড় নিজেই যেন তার সঙ্গে কথা বলছে। সেই রাতে সে ঘরের জানালার পাশের টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে একটা চিঠি লিখল, কোন ঠিকানায় নয়, কোনও প্রাপককে নয়—শুধু নিজের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য। লিখল, “এই দিনগুলোতে আমি যা শিখছি, তা কোনো কর্পোরেট সেমিনারে শেখা যায় না। এখানে প্রতিটি মেঘ, প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি নীরবতা আমার শিক্ষক। আমি ফিরে যাবো হয়তো, কিন্তু এই পাহাড় আমার ভেতরের একটা খিড়কি জানালা খুলে দিয়েছে—যেটা আমি আর কখনও বন্ধ করতে পারব না।” চিঠি লিখে সে জানালার বাইরে তাকাল—আজকের চাঁদ হালকা নীল আলো ফেলে মেঘের শরীরে সুর তুলেছে। সেই সুরে যেন কোনও পুরনো অনুভব ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে মনে, যেমন করে পুরনো ভালোবাসা চুপচাপ আবার মনে পড়ে যায়।
অধ্যায় ৬
পাহাড় যখন প্রশ্ন করে
পরদিন খুব সকালে, সূর্য উঠার অনেক আগেই অরণ্যার ঘুম ভাঙে। বাইরে তখনো অন্ধকার আর কুয়াশার রাজত্ব। জানালার কাচে জলকণা জমেছে, আর দূরের গাছগুলো হালকা বাতাসে দুলে উঠছে যেন স্বপ্নের ভেতর সরে যাচ্ছে কোনো ছায়া। আজ তার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা আছে যা সে বুঝতে পারছে না—কিন্তু অনুভব করতে পারছে গভীরভাবে। যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে পাহাড় নিজেই। সে উঠে পড়ে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে—এই প্রথমবার জুন বা রিদমকে কিছু না জানিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে আসে শহরের বাইরে একটা পুরনো ট্রেইলে, যেটা জুন একদিন ম্যাপে দেখিয়ে বলেছিল—”এই রাস্তায় গেলে একটা পরিত্যক্ত ক্লক টাওয়ার পড়বে, এখন আর কেউ যায় না, কিন্তু অনেক গল্প আছে সেখানে।” পথটা ছিল নির্জন, পাইন গাছের ফাঁকে স্যাঁতসেঁতে মাটি আর মেঘের ফোঁটা জমে ছিল পাতায় পাতায়। হাঁটার সময় অরণ্যার মনে হচ্ছিল যেন প্রতিটি পা ফেলা কোনও অদৃশ্য ইঙ্গিতের দিকে যাচ্ছে। তার মন বলছিল, “এখানে কিছু আছে যা তোমার ভেতরের প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারবে।”
প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর, হঠাৎ করে একটা পুরনো ঘড়ি-ওয়ালা টাওয়ার দেখা গেল। কুয়াশার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কাঠের গঠনটা যেন সময়ের বাইরে কোন স্থানে আটকে আছে। ঘড়ির কাঁটা বন্ধ, কাঠের গায়ে শ্যাওলার ছোপ, আর চারপাশে ছায়া। অরণ্যা ভেতরে ঢুকে পড়ল ধীরে ধীরে। ভিতরের দেয়ালে কারও আঁকা কিছু পুরনো লেখার দাগ ছিল—খাসি ভাষায়, কিছু ইংরেজিতে। একটা জায়গায় লেখা ছিল: “Even when time stops, stories breathe.” সে হালকা করে দেয়ালে হাত রাখে, চোখ বন্ধ করে দাঁড়ায়। চারপাশে নিঃশব্দ, শুধু দূরে দূরে ঝিঁঝিঁর ডাক। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় মুম্বইয়ের দিনগুলোর কথা—প্রতিদিন একই রুটিন, একঘেয়ে জীবন, মানুষের ভিড়ের মধ্যেও একা থাকা। এখানে, এই ঘড়ি বন্ধ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে, সে অনুভব করল—সময় থেমে গেলেও আত্মা বাঁচে, যদি সে প্রকৃতিকে ছুঁতে পারে।
হঠাৎ পিছন থেকে একটা পরিচিত সুর বাজল—রিদমের বাঁশি। সে চমকে পিছন ফিরে তাকাল, রিদম ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে টাওয়ারে এসে পৌঁছল। তার চোখে অবাক কিছু ছিল না, বরং একরকম মৃদু প্রশ্রয়। “আমি জানতাম তুমি আজ এখানে আসবে,” সে বলল। অরণ্যা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি সব কিছু আগে থেকেই জানো?” রিদম একটু হেসে বলল, “না, কিন্তু আমি জানি যে পাহাড় যখন কারও ভেতর ডাকে, তখন সে এড়াতে পারে না।” তারা দু’জনে টাওয়ারের ছায়ায় বসে পড়ল, আর রিদম একটা ছোট্ট কাগজ এগিয়ে দিল অরণ্যাকে। তাতে লেখা ছিল একটিমাত্র লাইন: “You came here not to forget, but to remember who you are.” অরণ্যার চোখ ভিজে এল, সে কোনও উত্তর দিল না, কেবল তাকিয়ে রইল টাওয়ারের মাথার দিকে, যেখান থেকে সময়ের কাঁটা বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু তার ভেতরের যন্ত্রটা যেন আবার চলতে শুরু করেছে। সেই মুহূর্তে, মেঘ, টাওয়ার, আর সুর মিলিয়ে পাহাড় তার হৃদয়ের এক অদৃশ্য তাল খুলে দিল—একটা জায়গা যেখানে শব্দ না থাকলেও কথারা বেঁচে থাকে।
অধ্যায় ৭
ফিরে দেখা পথে
শিলংয়ে অরণ্যার শেষ সপ্তাহটা শুরু হলো এক অভূতপূর্ব স্থিতির অনুভবে। প্রতিটি ভোর যেন এক কবিতার মতো, প্রতিটি সন্ধ্যা যেন পুরনো কোনও সুরের স্মৃতি। জুন বলল, “তুমি এবার পুরোপুরি পাহাড়ের মানুষ হয়ে গেছো—তোমার হাঁটা, চাওয়া, চুপ থাকা—সবটাতেই এখন প্রকৃতির ছায়া পড়েছে।” অরণ্যা তার ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছিল, কিন্তু প্রতিটি জামা ভাঁজের ফাঁকে সে যেন রেখে যাচ্ছিল একেকটা মুহূর্ত—ঝরনার পাশে বসে থাকা, বৃষ্টিতে ভেজা দুপুর, জানালার কাঁচে লেখা মেঘের গল্প, বা রিদমের বাঁশির সুরে ভেসে ওঠা নিজের নামহীন এক অনুভব। সেদিন সকালে জুন তাকে বলল, “চলো, আজ এক শেষ ট্রিপে যাই—Cherrapunji, আমার প্রিয় জায়গা। পাহাড়ের শেষ বাঁকে দাঁড়িয়ে তুমি যা খুঁজেছিলে, সেটা খুঁজে পেতে পারো।” অরণ্যা কিছু না বলে মাথা নাড়ল, কারণ সে জানত—এই যাওয়াটা কোনও সফর নয়, বরং এক চূড়ান্ত নির্যাসের খোঁজ।
রাস্তাটা ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল, কিন্তু চারপাশে মেঘের নাচন শুরু হয়ে গিয়েছিল। গাড়ি ধীরে ধীরে উপরে উঠছিল, পাইন গাছের ছায়া রাস্তার দু’ধারে পড়ে যেন কোনো লুকানো গেটওয়ের মতো অনুভব হচ্ছিল। তারা পৌঁছল এক উঁচু ভ্যালিতে—সামনে অনন্ত বিস্তার, দূরে দূরে ঝরনার ধারা দেখা যায়, আর মাথার ওপর হালকা নীল আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ ভেসে চলেছে। জুন দূরে দাঁড়িয়ে থাকল, আর অরণ্যা এগিয়ে গিয়ে এক পাথরের চাতালে দাঁড়াল। তার চোখে হঠাৎ করে জল এলো—না কোনও বিশেষ কারণে, বরং এতদিন ধরে জমে থাকা অনুভবগুলো যেন বেরিয়ে আসার পথ পেল। সে চোখ বন্ধ করে শুধু শ্বাস নিতে থাকল—মনে হচ্ছিল, প্রত্যেকটা নিশ্বাসে সে নিজের পুরনো ভার ফেলে আসছে। হঠাৎ সে শুনতে পেল পেছনে একটা পরিচিত সুর বাজছে—রিদমের বাঁশি। সে ঘুরে তাকাল—রিদম দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে কোনও প্রশ্ন নেই, কেবল এক শান্ত দৃষ্টি। অরণ্যা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি কি জানো, আমি তোমার বাঁশিতে কী শুনি?” রিদম হেসে বলল, “নিজেকে।” তারপর তারা একসঙ্গে বসে রইল, কোনও কথা নেই, শুধু দূরের পাহাড়ের নিচে চলতে থাকা মেঘ, আর সেই মেঘের ফাঁকে দেখা যেতে থাকা এক অজানা ভবিষ্যৎ।
ফেরার সময় গাড়িতে বসে অরণ্যা তার ডায়েরি খুলে শেষ পৃষ্ঠায় লিখল: “আমি ফিরছি, কিন্তু পালিয়ে নয়। ফিরে যাচ্ছি, কারণ এখন আমি জানি কোথা থেকে এসেছি। আমি সেই মেয়েটা নই যে এসেছিল এখানে নিজেকে ভুলতে, আমি সেই মানুষটা যিনি নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলার ভাষা শিখেছে। এখন আমি আর নিজেকে ভয় পাই না।” সে জানত, এই শহর, এই পাহাড়, এই মেঘ, আর এই নীরবতা চিরকাল তার ভেতরে থেকে যাবে—একটি আলোর মতন, যেটা দরকার হলেই চোখ বন্ধ করে দেখা যায়। গাড়ি নামতে শুরু করল নিচের দিকে, পেছনে রয়ে গেল শিলংয়ের মেঘ, আর তার সঙ্গে রয়ে গেল এক নতুনভাবে জন্ম নেওয়া অরণ্যার আত্মা।
অধ্যায় ৮
বিদায়ের চিঠি
শিলং ছাড়ার আগের দিন সন্ধ্যায় অরণ্যা বারান্দায় বসে ছিল চুপচাপ। চারপাশে ছড়িয়ে ছিল তার শেষ সপ্তাহের শব্দহীন স্মৃতিগুলো—কখনো একটা পাইনগাছের পাতার ওপর ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা, কখনো রিদমের বাঁশির এক নিঃশব্দ ভেসে ওঠা সুর, আবার কখনো জুনের চায়ের কাপে দাগ পড়ে থাকা গল্প। পাহাড়ে কাটানো সময়টা যেন কোনও ঘড়ির সঙ্গে চলে না, এখানে সূর্য অস্ত যায় অল্প আলো রেখে, আর রাত নামে খুব ধীরে, ঠিক যেমন করে অরণ্যার মনটা এখন নেমে যাচ্ছে এক অনন্ত প্রশান্তির দিকে। তার ব্যাগ গোছানো শেষ, কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন—এই অনুভবগুলোকে কি রেখে যাওয়া যায়? নাকি হৃদয়ে বয়ে নিয়ে যেতে হয়? ঠিক তখনই সে তার ডায়েরির শেষ পাতায় বসে লিখে ফেলল এক চিঠি—এই পাহাড়ের উদ্দেশ্যে, এই মেঘের উদ্দেশ্যে, এবং শেষ পর্যন্ত নিজের উদ্দেশ্যে।
“প্রিয় মেঘালয়,”
“তুমি যখন প্রথম আমায় নিজের কোলে বসালে, আমি ছিলাম ক্লান্ত, ভীত, ভাঙা। চারপাশে শব্দ ছিল, কিন্তু ভেতরে ছিল এক চুপচাপ শূন্যতা। তখন জানতাম না—তুমি নীরবতার মধ্যে কত কথা বলো, আর মেঘের ছায়ায় কত স্মৃতি রাখো। আমি পাহাড়ে এসেছিলাম পালাতে, কিন্তু তুমি আমায় থামিয়ে দিলে। তুমি শিখিয়েছো কীভাবে নিজেকে আবার ধীরে ধীরে ভালবাসতে হয়—অসন্তোষ নিয়ে নয়, আত্ম-সম্মানের সঙ্গে। তুমি আমায় রিদমের মতো এক বন্ধুর দেখা দিলে, যার বাঁশি শুনে আমি নিজের মুখোমুখি হতে পেরেছি। তুমি আমায় জুনের মতো একজন মানুষ দিল, যিনি মাতৃভাষার বাইরেও হৃদয়ের ভাষায় কথা বলেন। তুমি আমায় নিজেকে চিনতে শিখিয়েছো, সেই নিজেকে যে এতদিন নিজের মধ্যেই বন্দী ছিল। আজ আমি ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু আর পালিয়ে নয়। আমি যাচ্ছি, কারণ এবার আমি জানি—যেখানে থাকি না কেন, এই পাহাড়, এই নীল চিঠি, এই সুর, সবসময় আমার ভেতরেই থাকবে।”
“ভালো থেকো, তোমার পাহাড়ি মেয়ে—অরণ্যা”
সে চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে দিল হোমস্টের কাঠের বইয়ের তাকের একটি পুরনো ডায়েরির ভেতরে—এক জায়গায়, যেখানে আগেও কেউ হয়ত রেখে গিয়েছিল নিজের কথা। সকালে গাড়ি এসে দাঁড়ানোর সময় জুন এসে তাকে জড়িয়ে ধরল—কোনও শব্দ ছিল না, শুধু চোখে ছিল এক ছায়াময় কৃতজ্ঞতা। রিদম শুধু একটা কাগজ এগিয়ে দিল, সেখানে লেখা ছিল—”Keep walking, the sky listens.” আর নিচে ছোট্ট একটা বাঁশির ছবি।
গাড়ি চলতে শুরু করল, পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে নামতে জানালার পাশে বসে অরণ্যা দেখছিল—মেঘেরা ধীরে ধীরে পেছনে পড়ে থাকছে, আর শিলং শহর যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে কোনও দূর বাস্তবতায়। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল না সে কিছু হারাচ্ছে। বরং মনে হচ্ছিল, এই প্রথম, সে কিছু নিয়ে ফিরছে—একটি নতুন পরিচয়, একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, আর একটি সাহস, যা দিয়ে সে আবার এক ভিন্ন শহরের মধ্যেও নিজেকে খুঁজে নিতে পারবে। আর জানালার বাইরে হালকা করে বয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ি হাওয়া—যেন বিদায় জানাচ্ছিল না, বরং বলছিল, “ফিরে এসো… যখনই মনে পড়ে যাবে নিজের কথা।”
সমাপ্ত




