Bangla - উপন্যাস

মেঘবালিকার ডায়েরি

Spread the love

ঋতা মিত্র


বাড়ির পেছনের ছোট উঠোনটাতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল মেয়েটা। নাম তার মেঘলা, কিন্তু আকাশে তখন মেঘ ছিল না—ছিল একরাশ বিস্ময় আর প্রশ্ন। পাড়ার লোকেরা বলে, “এই মেয়েটা নাকি ছেলেদের মতো, এত পড়াশোনা কিসের?” মা মাঝে মাঝে কাঁদে—চুপচাপ, রান্নাঘরের কোণে, যেন হাঁড়ির ফুটতে থাকা ডালের গন্ধে কান্নার লোনা গন্ধ মিশে যায়।

মেঘলা পড়ে বারো ক্লাসে। ছোট শহরের এই স্কুলে এমনিতেই মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতে গোনা। তার মধ্যে মেঘলা—যার চোখে রয়েছে খবরের কাগজের শিরোনাম, রিপোর্টারের মাইক ধরা হাত আর সত্যি বলার সাহস। সে চায় সাংবাদিক হতে। এ শহরে সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নটা প্রায় অপরাধের মতো। শিক্ষক বলেছে, “তুই যদি ম্যাডাম হয়ে যা, তোর বিয়েটা হবে তো?” পেছন থেকে কিশোররা বলে, “দেখো দেখি, মেঘলা আবার খবরের লোক হবে!”

তবে মেঘলার মাথা নত হয় না। সন্ধ্যায় যখন তার বাবা একটা ভাঙাচোরা টোটো নিয়ে বাড়ি ফেরে, সে তার হাতে জল দেয়, মায়ের মুখ দেখে বলে, “একদিন আমি তোমাদের জন্য আলাদা জীবন আনব।” মা হাসে, সেই হাসিতে আশার চেয়ে বেশি থাকে ভয়।

শহরের একমাত্র কলেজে মেঘলার চান্স হয়। ইংরেজি অনার্স। কিন্তু ফর্ম ফিলআপ করতে গিয়ে বোঝা যায়, হাজার তিনেক টাকার দরকার। বাবা সোজা চলে যায় বাজারে, তার টোটোটার ব্যাটারি বন্ধক রাখে। “আমার মেয়ে বড় হবে, না কি আর আমি কদিন টোটো চালাবো”—এটুকু বলে দেয়।

কলেজে গিয়ে মেঘলা নতুন পৃথিবী দেখে। অচেনা শহরের কোলাহল, মেট্রো স্টেশনের লোক, ক্লাসের স্যারের ব্রিটিশ টোন। সে ভয় পায়, কিন্তু ভয় দেখায় না কাউকে। তার মোবাইলটা অনেক পুরোনো, কিন্তু সে তাতে রেকর্ড করে শহরের দৃশ্য, বাসে শোনা গল্প, মেয়েদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়। আর রাতে ছোট্ট ব্লগে লিখে ফেলে সব। কেউ পড়ে না, কেউ দেখে না, তবু সে ছাড়ে না। লেখে—একজন মেয়ের স্বপ্ন, লড়াই আর সমাজের নীরবতা নিয়ে।

একদিন হোস্টেলের এক সিনিয়র এসে বলে, “তুই লিখিস ভালো, কিন্তু তুই না কি গ্রামের মেয়ে?” মেঘলা মাথা নিচু করে না, বলে, “হ্যাঁ, কিন্তু স্বপ্নটা তো শহরের থেকেও বড়।”

একটা ঘটনা মেঘলার জীবন বদলে দেয়। হোস্টেলের পাশের বস্তিতে একটি কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টা হয়। সবাই চুপ, পত্রিকায় এক কলাম নেই। কিন্তু মেঘলা লেখে, ভিডিও করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়। রাতারাতি ভাইরাল হয় তার পোস্ট। কেউ প্রশংসা করে, কেউ প্রশ্ন তোলে, কলেজ থেকে ডাক পড়ে।

কলেজের প্রিন্সিপাল বলেন, “তুমি সাহস দেখিয়েছো, তবে সাবধানে চলবে।” সংবাদ সংস্থা থেকে ফোন আসে, “তোমার মত একজন রিপোর্টার আমরা খুঁজছিলাম। এক সপ্তাহ ইন্টার্নশিপের সুযোগ আছে, আগ্রহী?”

মেঘলা হাসে, তখনও তার মায়ের মুখ ভেসে ওঠে—রান্নাঘরের কোণে দাঁড়িয়ে, চোখে জল। বাবার কাঁধে পুরোনো চাদর জড়িয়ে ঘুম। সে বলে, “হ্যাঁ, আমি আগ্রহী। কিন্তু শুধু নিজের জন্য না, তাদের জন্য যারা কথা বলতে ভয় পায়।”

পথ এখনও শেষ হয়নি। পথ এখনও কাঁটার। ইন্টার্নশিপে গেলে দুপুরে কিছু না খেয়ে ফিরতে হয়, লোকাল ট্রেনে ঠেলাঠেলি করে যাওয়া, স্টুডিওর বড়লোক মেয়েদের বাঁকা কথা, “গ্রাম থেকে এসেছো তো, বাংলাও ঠিক করে বলতে পারো না!”—এসব শুনেও মেঘলা হাঁটে। রোজ রাতে সে ডায়েরিতে লেখে, “আজও হেরে যাইনি।”

তার ডায়েরির পাতাগুলো একদিন হয়ে ওঠে অন্য মেয়েদের অস্ত্র। সে এখন কলেজে বক্তৃতা দেয়, মেয়েদের নিজের গল্প বলে। এক শিক্ষক একদিন জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি feminist?” সে উত্তর দেয়, “আমি শুধু মানুষ, কিন্তু মেয়েদের পক্ষে দাঁড়ানো এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।”

মেঘলা জানে—এই সমাজ এখনো তার জায়গা দিতে চায় না। সে জানে—তার সাফল্যে কেউ করতালি দেবে না, বরং বলবে, “লাক পেয়েছে।” কিন্তু সে জানে একথাও—যে মেয়েটি একদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবত, “আমার কি কোনো ঠিকানা আছে?”—আজ সেই মেঘবালিকা নিজের ঠিকানাটা নিজেই লিখে ফেলেছে।

মেঘলার ইন্টার্নশিপ শেষ হয় এক ঝড়ের দুপুরে। ক্যামেরা হাতে, চপটে মুখে সে যখন একটা দুর্ঘটনার কভারেজ করতে গিয়েছিল, তখন এক সিনিয়র রিপোর্টার বলেছিল, “এইটুকু মেয়ে, তুমি পারবে?” সে কিছু বলেনি, শুধু নিজের ক্যামেরা চালু রেখেছিল। খবরের ভিতরের খবর, মানুষের মুখের হাহাকার, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা—সব তুলে এনেছিল মেঘলার ছোট্ট লেন্স। এবং সেদিন তার কাজ দেখে যে চ্যানেল তাকে অবহেলা করেছিল, তারাই অফার পাঠায়—চাকরির।

চাকরি মানে একটা নতুন জীবন, কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয়—স্বীকৃতি। কিন্তু সেই স্বীকৃতির সঙ্গে আসে পুরনো শহরের কথা, বাবা-মার মুখ, এবং সমাজের পুরনো রক্তচক্ষু। বাড়ি ফোন করলে বাবা এখন একটু ধীর গলায় কথা বলে, ভাবে কোথা দিয়ে কী বলে। মা রোজ দুপুরে ফোন করে, “খাবার ঠিকমতো খাস তো তোরা?”

কিন্তু সমস্যাগুলো এত সহজে যায় না। মেঘলার এক সহকর্মী তাকে কভারেজ থেকে বাদ দিতে চায় কারণ তার উচ্চারণ গ্রাম্য। চ্যানেলের চিফ বলে, “তুমি একদিন হয়ত ভালো করবে, কিন্তু এখন আমাদের স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করতে হয়।” মেঘলা কাঁদে না, কিছু বলে না। রাতে শুধু ডায়েরিতে লেখে, “তারা হয়ত এখনো বোঝে না—ভাষার চেয়ে সাহস বেশি জরুরি।”

তবে সবটাই অন্ধকার ছিল না। তার সেই ভাইরাল রিপোর্ট একদিন এক পুরস্কার এনে দেয়। “ইয়ং উইমেন ইন মিডিয়া” অ্যাওয়ার্ড। মঞ্চে উঠে প্রথমবার সে একথা বলে, “আমি কোনোদিন ভাবিনি, আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের শহরের কথা বলব। আমি এসেছি এমন এক জায়গা থেকে, যেখানে মেয়েরা স্বপ্ন দেখলে বলে—বিয়ের কথা ভাবো আগে। কিন্তু আমি জেদ করেছিলাম, কারণ আমি জানতাম, কেউ না কেউ আমার কথা একদিন শুনবে।”

অডিয়েন্সে তখন হাততালি। তার পাশে বসে এক বৃদ্ধ, নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক, বলে ওঠেন, “তুমি আমাদের মতো মানুষদের ঘুম ভাঙাও, তোমাকে দেখলে মনে হয়—আসলে মেয়েরাই আগুন।”

পুরস্কার নিয়ে ফেরার সময় ট্যাক্সির জানালা দিয়ে সে আবার আকাশের দিকে তাকায়। শহরের আলো জ্বলে উঠছে, কিন্তু তার চোখে ফিরে আসে ছোট শহরের গলির ধুলো, ছেলেবেলার গাছ, স্কুলের সিঁড়ি, আর সেই চেনা প্রশ্ন—“তুই সাংবাদিক হতে চাস?”

সে নিজেই এবার উত্তর দেয়—“আমি শুধু সাংবাদিক না, আমি এক মেঘবালিকা, যে নিজের ডায়েরির পাতায় সমাজের মুখ আঁকে।”

শেষাংশে মেঘলা নিজের শহরে ফিরে আসে একটা চ্যারিটি রিপোর্ট কভার করতে। স্টেশন চত্বরে তাকে দেখে অনেকে চমকে ওঠে—”মেঘলা তো এখন টিভিতে দেখে রে!”—কেউ বলে, কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু একজন এসে বলে, “তুই পালিয়ে যাসনি, তুই ফিরে এসেছিস। সেটা অনেক বড় কথা।”

শেষ দৃশ্য, মেঘলা হেঁটে চলে যাচ্ছে তার পুরোনো বাড়ির দিকে। বাড়ির উঠোনে মা দাঁড়িয়ে, হাতে একটা ছোট্ট খাম। খামের ভিতরে আছে একটা চিঠি—বাড়ির ছোট মেয়েদের স্কুল থেকে এসেছে, তারা চায় মেঘলা গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলুক।

মেঘলা চিঠিটা বুকে চেপে ধরে। তারপর মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে, “এই তো আমার ঠিকানা, এই ছোট শহর, এই মেঘেদের ভিড়ে আমি নিজের রং খুঁজে পেয়েছি।”

জীবনটা যেমন একটার পর একটা খবরের শিরোনাম হয় না, তেমনি প্রতিটা মেয়ের গল্পও শুধু ট্র্যাজেডি নয়। কিছু গল্প বেঁচে থাকার, এগিয়ে যাওয়ার, ভেঙে না পড়ার।

মেঘলার ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা থাকে—

“আমি একটা মেয়ে। আমি স্বপ্ন দেখি। আমি হেরে যাই, আবার উঠে দাঁড়াই। আর একদিন আমিও হয়ে উঠি কারও অনুপ্রেরণা। হয়ত তুমিও। হয়ত একদিন তুমিও।”

Lipighor_1750101158991.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *