রুদ্রপ্রতিম সেন
১
কলকাতা বিমানবন্দর, সকাল ছ’টা দশ। মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একটি কালো সেডান গাড়ি ধীরে ধীরে থামে টার্মিনালের সামনে। চালক দরজা খুলে দেয়, এবং একটি উঁচু কাঁধ, রূপালি চুল আর ধীর পদক্ষেপে নামেন এক মধ্যবয়স্ক মানুষ—সমরেশ মিত্র, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পপতি। তাঁর গায়ে হালকা ধূসর স্যুট, চোখে এক জোড়া ধাতবচশমা। এক হাতে ছোট চামড়ার ব্রিফকেস, অন্য হাতে ধরা একটি পুরনো চামড়ার বাঁধাই করা বই—“দ্য লাস্ট সামার রেইন”, সম্ভবত তাঁর প্রিয়। সবসময় বিমানে ওঠার আগে এই বইটি তিনি পড়ে থাকেন, যেন আকাশের নির্জনে বইয়ের পাতার ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। সিকিউরিটি চেকিং, লাউঞ্জ, বোর্ডিং—সবকিছুতে ছিল অভ্যস্ত ও নিখুঁত শৃঙ্খলা। কর্মচারীরা তাঁকে চিনে সম্ভ্রমে নমস্কার জানায়, কিন্তু তিনিও ছিলেন বরাবর শীতল, নিয়ন্ত্রিত, একরকম বিচ্ছিন্ন। বিজনেস ক্লাসের আসন D2, জানালার ধারে। এয়ার হোস্টেস তাঁকে এক গ্লাস তাজা কমলার রস দেন, তিনি কেবল একবার কৃতজ্ঞতাসূচক মাথা নোয়ান। পাশে কোনো সহযাত্রী ছিল না, একাকী বসে বই খুলে পড়া শুরু করেন। জানালার বাইরে তখন মেঘ জমেছে, কলকাতার আকাশে ভেসে উঠছে সূর্যরশ্মি—আর এই মেঘের ভিতর দিয়ে তিনি পাড়ি দিচ্ছেন জীবনের আরও একটি যাত্রা। বিমান ছাড়ে সকাল ৬:৩৫-এ। প্রথম ৪৫ মিনিট কেটে যায় নিঃশব্দে। কেবিন ক্রু একবার এসে দেখে যান সব ঠিক আছে কিনা। তিনি তখনো বইয়ের পাতার মাঝখানে, কমলার রসের গ্লাসে চুমুক দিয়েছেন একবার মাত্র।
প্রায় এক ঘণ্টা পর, সহকারী ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট দেবাংশু পাল এসে সমরেশ মিত্রকে নাশতার মেনু দিতে গেলে খেয়াল করেন—তিনি একদম নিথর। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, বুক ওঠানামা বন্ধ। সহকর্মীদের ডাকে কেবিন ক্রু ম্যানেজার ছুটে আসে, পালস চেক করে, কিন্তু না… ধমনি নিঃশেষ। অবিলম্বে ককপিটে খবর যায়, বিমানে একজন যাত্রী সম্ভবত মৃত। অধিনায়ক বাধ্য হয়ে নির্দেশ দেন—দেহটিকে ধীরে ধীরে কম্বল দিয়ে ঢেকে আলাদা করে রাখা হোক। কিন্তু সমরেশ মিত্রর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মৃত্যু এভাবে? কেবিনে চাপা উত্তেজনা ছড়ায়, বিজনেস ক্লাসের যাত্রীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়—“হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি?” কেউ কেউ বলেন, “বয়স হয়েছে তো, যেকোনো সময় এমন হতে পারে।” কিন্তু ঠিক তখনই একটি বিষয় চোখে পড়ে ফ্লাইট সুপারভাইজারের—সমরেশের গ্লাসে রস শেষ হয়নি, বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা এলোমেলো হয়ে আছে, যেন হঠাৎ কিছু ঘটেছে। আর তাঁর মুখে ছিল একটুখানি বিষণ্ণ শান্তির রেখা—এক রকম বেদনাহীন মৃত্যু। বিমান যখন দিল্লিতে অবতরণ করে, তখন তাঁকে নামানো হয় নিঃশব্দে। সংবাদ তখনও প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু এটিই ছিল সেই যাত্রা, যার পরে মেঘের ওপারে এক অদৃশ্য রহস্য শুরু হতে চলেছে, আর এক দুঃসহ প্রশ্ন ঘনিয়ে আসে—বিমানের মধ্যে, মাঝ আকাশে, একজন মানুষ কীভাবে বিষক্রিয়ায় মারা যায়?
২
দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সকাল ৮:৪৫। AI-719 ফ্লাইট টারমাকে থামতেই জেটব্রিজ জুড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু অন্যান্য যাত্রীদের তুলনায় বিজনেস ক্লাস থেকে নামানো হয় কিছুটা বিলম্বে। কেননা কেবিনের এক কোণায় ধবধবে সাদা কম্বলে মোড়া এক মৃতদেহকে সুরক্ষিতভাবে নামাতে হবে, যাতে গণমাধ্যম বা যাত্রীদের কেউ অযাচিত চিত্র না ধারণ করে ফেলে। গ্রাউন্ড স্টাফ, এয়ারপোর্ট মেডিক্যাল ইউনিট, সিকিউরিটি অফিসারদের এক অপূর্ব সমন্বয় দেখে যেন বোঝাই যায়, ঘটনাটি গুরুত্বহীন নয়। পুলিশ আসে, রিপোর্ট নেয়, এবং প্রাথমিকভাবে ডাক্তারি পরীক্ষায় বলা হয়, “Cardiac arrest suspected.” কিন্তু প্রশ্ন আসে—একজন সুস্থ, সদ্য মেডিকেল ক্লিয়ার করা যাত্রী হঠাৎ মাঝ আকাশে মারা গেলেন, তাও কোনো শারীরিক কষ্ট বা অসুস্থতার লক্ষণ ছাড়াই? বিমান সংস্থা AI-এর চিফ অপারেটিং অফিসার পর্যন্ত ফোন করেন, “সমরেশ মিত্র… আমাদের ফ্লাইটে মৃত? এটি কেবল দুর্ঘটনা না কি… অন্য কিছু?” সিসিটিভি ফুটেজ ও কেবিন ক্রুদের জবানবন্দি নেওয়ার কাজ শুরু হয়। এদিকে, সাংবাদিকদের গন্ধ লাগতেই খবর চাউর হয়: “বিমানেই মৃত্যু শিল্পপতি সমরেশ মিত্রর!” নিউজ চ্যানেলগুলোতে হেডলাইন বয়ে যায়: “আকাশে মৃত্যু… দুর্ঘটনা না কি ষড়যন্ত্র?”
দেহটি নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লি পুলিশ মর্গে, এবং ফরেনসিক টিম আসে দ্রুত। আর এখানেই আসে প্রথম অস্বাভাবিক মোড়—পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উঠে আসে বিষক্রিয়ার অস্তিত্ব। শরীরে ধরা পড়ে Tetrodotoxin নামক এক মারাত্মক বিষের উপস্থিতি—যেটি সচরাচর পাওয়া যায় জাপানি ফুগু মাছের মধ্যে, এবং যার সামান্য উপস্থিতিতেই স্নায়ুতন্ত্র অবশ করে দিয়ে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এত দ্রুত ও নিঃশব্দ মৃত্যুর পিছনে এর থেকে নিখুঁত অস্ত্র আর হতে পারে না। পুলিশ, যা শুরু করেছিল প্রথাগত তদন্ত হিসেবে, এখন সেটি রূপ নেয় হত্যা মামলায়। প্রশ্নের পাহাড়—বিমানের ভেতরে কীভাবে এমন বিষ গেল? কেবিন ক্রুদের কি কেউ গোপনে প্ররোচিত করেছিল? খাবারের উৎস কি বিশ্বাসযোগ্য? বিমান ওঠার আগে কোথায় কোথায় ছিলেন সমরেশ মিত্র? যাত্রী তালিকায় কে ছিল, কে তাঁর কাছে এসেছিল? আর যে বইটি তিনি পড়ছিলেন—তার ভেতরে কি কিছু লুকিয়ে ছিল? এর উত্তর খুঁজতেই পুলিশ মন্ত্রকের বিশেষ নির্দেশে নামানো হয় দেশের অন্যতম কুখ্যাত কিন্তু দক্ষ গোয়েন্দা, অর্জুন মুখার্জিকে। আর এখান থেকেই শুরু হয় এক ভয়াবহ খেলাধুলা—মেঘের ওপারে লুকিয়ে থাকা একজন খুনির অনুসন্ধান, যিনি মৃত্যুকে একেবারে বিমানের ভিতরে এনে দিয়েছে, অদৃশ্য বিষে, নিঃশব্দে, নিখুঁতভাবে।
৩
দিল্লি শহরের অপরাহ্নের ঘোলা আলোয়, যেন আকাশ জানে কিছু অশুভ ঘটেছে। লালবাতি চৌমাথায় দাঁড়িয়ে কালো স্করপিও গাড়িটা ধীরে ঢুকে পড়ে তুঘলক রোডের একটি পুরনো দোতলা কোয়ার্টারে—যেখানে সাদা অক্ষরে লেখা রয়েছে: “Criminal Intelligence and Analysis Bureau (CIAB)”। অর্জুন মুখার্জি, যার মুখের চোয়ালে বয়সের রেখা থাকলেও চোখে আছে অদ্ভুত এক সতর্কতা, গাড়ি থেকে নামতেই সহকারী অফিসার মেহর সিদ্দিকি এগিয়ে এসে বলে, “স্যার, রিপোর্টটা এসেছে। এটা শুধু খুন না—অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, নিখুঁত পরিকল্পিত হত্যা।” অর্জুন মুচকি হাসেন না, শোনেন চুপ করে। তাঁর কাছে মৃত্যু মানে গণিতের মতো—ধাঁধা, কিন্তু উত্তরযোগ্য। টেবিলে রাখা সামগ্রী: বিমানের খাবারের তালিকা, যাত্রী তালিকা, কেবিন ক্রুদের বয়ান, এবং সর্বশেষ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। সেখানে লেখা: “Presence of Tetrodotoxin in circulatory and digestive system.” এই বিষ পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুত ক্রিয়া করা স্নায়ুবিষ, যা হার্ট এবং ফুসফুস বন্ধ করে দেয় কোনো বাহ্যিক লক্ষণ ছাড়াই। বিশেষজ্ঞরাও অবাক—“এটা তো জাপানি ফুগু মাছের বিষ, ভারতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।” কিন্তু অর্জুন জানেন, অসম্ভব বলে কিছু নেই, বিশেষত খুনিদের জগতে।
পরের ঘন্টাগুলোয় মেহর সিদ্দিকি আর অর্জুন একসাথে বিশ্লেষণ করতে থাকেন—সমরেশ মিত্রের খাবার, পানীয়, বসার আসন, এমনকি বইয়ের কভার পর্যন্ত। বোর্ডিং আগে কে কোথায় ছিল, কাকে কখন কফি দেওয়া হয়েছিল, সমস্ত ভিডিও ফুটেজ খুঁটিয়ে দেখা হয়। এবং ঠিক তখনই একটি প্যাচ খোলার ইঙ্গিত আসে—সমরেশের ব্যবহৃত জিনিসগুলোর মধ্যে একমাত্র যা অন্যের স্পর্শে ছিল, সেটি হলো তাঁর বই। এয়ার হোস্টেসদের বয়ান অনুযায়ী, বইটি তিনি হাতে এনেছিলেন বোর্ডিং-এর সময়, কিন্তু ভিতরে কেউ সেই বইটি দেখেনি। আর ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়—বোর্ডিং গেটের বাইরে একজন মহিলা হালকা নীল শাড়ি পরে সেই বইটি হাতে করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুখটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু বইয়ের চামড়ার বাঁধাইয়ের সঙ্গে মিল রয়েছে ১০০%। প্রশ্ন ওঠে—ওই মহিলা কে? সে কি যাত্রী ছিল? না কি কেবল বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসেছিল? অর্জুন মুচকি হেসে বলেন, “বিষ সবসময় দেহে ঢুকে মারে না… কখনো কখনো গল্পের পাতার মধ্যেও মৃত্যু লুকিয়ে থাকে।” এরপর তিনি নির্দেশ দেন—“এই বইটা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাও। পাতাগুলোর কাগজ, প্রিন্ট, সবকিছু বিশ্লেষণ চাই।” বইয়ের ভেতরে যদি বিষ থাকে, তাহলে খুনি কোনো ট্রিগার ছাড়াই এমন কৌশলে হত্যা করেছে যা স্রেফ বুদ্ধিদীপ্ত নয়, ভয়াবহ রকম নিষ্ঠুরও। আকাশে উড়তে উড়তেই একজন মানুষ মারলেন আর কেউ টেরই পেল না—এখন সময় এসেছে, মেঘের ভিতর লুকিয়ে থাকা সেই হাতটিকে চিহ্নিত করার।
৪
দিল্লির দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ইন্দিরা বিমানবন্দরের ভিতরের একটি কনফারেন্স কক্ষ—এখানেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই তদন্তের প্রথম আনুষ্ঠানিক জিজ্ঞাসাবাদ। ঘরটি নিঃশব্দ, ফ্লোরে পাতলা কার্পেট, সামনে একটি মাল্টিস্ক্রিন মনিটর যেখানে বিমানের ভিতরের সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজ ধীরে ধীরে ঘুরছে। অর্জুন মুখার্জি ঢুকলেন, তাঁর মুখে কোনো বিশেষ অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু চোখের তীক্ষ্ণতা যেন ঘরের প্রতিটি ছায়াকেও পর্যবেক্ষণ করছে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন মেহর সিদ্দিকি, নোটপ্যাড হাতে। কক্ষের একপাশে বসে আছেন বিমানবালারা—নয়না দত্ত, দেবাংশু পাল এবং ফ্লাইট সুপারভাইজার অনিকা রাও। অর্জুন সরাসরি প্রশ্ন করেন, “আপনারা সমরেশ মিত্রকে শেষ কখন জীবিত দেখেছিলেন?” নয়না বলেন, “স্যার, ওনার কাছে আমরা একবার গ্লাসে জুস পৌঁছে দিই। তখন তিনি বই পড়ছিলেন।” অনিকা যোগ করেন, “কিছুটা বাদে দেখি উনি আর নড়ছেন না। আমরা ধরে নিই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু পরে বুঝি—না, উনি তো নিঃশ্বাসই নিচ্ছেন না।” অর্জুন টেবিলের উপর রাখা ছবিগুলো দেখান—সমরেশের বই, গ্লাস, আসনের পাশে রাখা জিনিসপত্র। “এই বইটা কি আপনি আগে কোনো যাত্রীর হাতে দেখেছেন?”—তিনি জিজ্ঞাসা করেন। অনিকা একবার ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, “এই বইটা… ফ্লাইটে উঠার আগেই এক মহিলার হাতে দেখেছিলাম গেটের পাশে দাঁড়িয়ে। উনি আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, সমরেশ বাবু ফ্লাইটে উঠেছেন কি না।” অর্জুনের চোখে মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে যায়। “ওনার নাম জানেন?” অনিকা মাথা নাড়ে, “না স্যার, তিনি যাত্রী ছিলেন না। শুধু বলে গেলেন, ‘এই বইটা উনাকে ফিরিয়ে দিন, এটা ওনার পুরনো।’”
এখন পর্যন্ত ময়নাতদন্ত, ভিডিও ফুটেজ এবং সাক্ষ্য মিলে একটি প্রাথমিক চিত্র তৈরি হয়েছে—বইটির ভেতরে থাকতে পারে বিষক্রিয়ার উৎস। ফরেনসিক টিম থেকে ফোন আসে ঠিক তখনই। অর্জুন ফোন ধরেন, শোনেন কয়েক মুহূর্ত, এরপর বলেন, “নিশ্চিত তো? ভালো।” ফোন রেখে মেহরকে বলেন, “বইয়ের পাতাগুলোতে মাইক্রো-কোটেড Tetrodotoxin পাওয়া গেছে। চামড়ার বাঁধাইয়ের নিচে ইনজেক্ট করা হয়েছিল। শরীরের তাপমাত্রায় পাতায় দ্রবীভূত হয়ে হাতের চামড়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করেছে বিষ।” মেহর বিস্ময়ে বলে ওঠে, “মানে… উনি বই পড়তে পড়তেই…!” অর্জুন মাথা নেড়ে বলেন, “হ্যাঁ, বইয়ের পাতায় হাত বোলাতেই বিষ চামড়ার নিচে ঢুকে গেছে। আর মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে স্নায়ুব্যবস্থা নিঃশেষ।” এরপর তিনি বলেন, “এই বিষ শুধু তীব্র নয়—প্রযুক্তি আর মানসিক প্রতিহিংসার সংমিশ্রণ। যিনি পরিকল্পনা করেছেন, তিনি শুধু খুন করতে চাননি—চেয়েছেন মৃত্যুকে যেন কবিতার মতো নিঃশব্দ করা যায়।” সেই সময়, যাত্রী তালিকায় হঠাৎ এক নাম চিহ্নিত হয়—তিথি সেন, সাবেক বিমানসেবিকা, বর্তমানে লেখিকা, যার একটি সাক্ষাৎকারে প্রকাশ পেয়েছিল, “সমরেশ মিত্র আমার জীবন ধ্বংস করেছিলেন, আমি তাঁকে কখনও ক্ষমা করিনি।” অর্জুন চুপচাপ একটি কফির চুমুক নেন। বলেন, “তিথি সেন… এবার দেখা যাক, আকাশ থেকে নামার আগে তিনি কোনো ছায়া ফেলে গেছেন কি না।”
৫
সকাল ৭টা ৪৫। দক্ষিণ দিল্লির ফরেনসিক টক্সিকোলজি ল্যাবের ভেতর অদ্ভুত নিঃশব্দতা। বড় কাঁচের ঘরে রাখা আছে সেই চামড়ার বাঁধাই করা বইটি—“The Last Summer Rain”—যেটি হয়তো সমরেশ মিত্রের জীবনের শেষ গল্প হয়ে উঠেছে। অর্জুন মুখার্জি ধীরে পা ফেলে ভিতরে প্রবেশ করেন। তাঁর চোখ প্রথমে স্থির হয় বইয়ের মলাটে, তারপরে পাতাগুলোর দিকে। টেবিলের অপর প্রান্তে বসে রয়েছেন ড. শঙ্কর রায়, এই বিভাগের সিনিয়র টক্সিকোলজিস্ট। তিনি জানান, “বইটির নির্দিষ্ট কয়েকটি পাতায়, মাইক্রোডোজে Tetrodotoxin প্রয়োগ করা হয়েছিল। আমরা নিশ্চিত হয়েছি—কেউ পাতার নিচে বিশেষ রাসায়নিক কোটিং ব্যবহার করেছে, যা শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সক্রিয় হয়ে চামড়ার স্পর্শের মাধ্যমে বিষ শরীরে প্রবেশ করায়।” অর্জুন কৌতূহল নিয়ে জানতে চান, “এই ধরনের কৌশল কি আগে কখনও দেখা গেছে?” ড. রায় মাথা নাড়ে, “না, এটি একধরনের ‘contact transmission poisoning’—কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠা ব্যবহার করে এমন পদ্ধতি নজিরবিহীন।” তিনি একটি ছোট আল্ট্রাভায়োলেট লাইট জ্বালিয়ে দেখান—পাতার কোণাগুলো আলাদা রকমের প্রতিফলন তৈরি করছে, যা বিষ প্রয়োগের প্রমাণ। “সবচেয়ে বড় প্রশ্ন,” অর্জুন বলেন, “এই বইটিই কেন? সমরেশ মিত্র কি নিয়মিত এটি পড়তেন?” মেহর জানান, “জি স্যার, এটি তাঁর প্রিয় বই। প্রায় সব ফ্লাইটে তিনি এটি সঙ্গে রাখতেন। কিন্তু ফুটেজে দেখা গেছে—এই কপি তিনি নিজে সঙ্গে আনেননি। কেউ একজন এটি তাঁকে ফ্লাইট গেটের কাছে হস্তান্তর করে।”
ঠিক তখনই CIAB-এর টেক টিম একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আনে। বইটির ভিতরের প্রচ্ছদের ভাঁজে মিলেছে এক অদৃশ্য স্ট্যাম্প—“T.S.”—শব্দদুটি কেবলমাত্র লাইট সেন্সিটিভ ইনক দিয়ে লেখা। অর্জুন চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, “T.S.—তিথি সেন।” তাঁর কণ্ঠে একরকম বিষণ্ণ নিশ্চিতি। তিথি সেন, যিনি সমরেশ মিত্রর বিরুদ্ধে অতীতে যৌন হেনস্তার অভিযোগ তুলেছিলেন, কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে মামলা ঠেকানো যায়নি। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন, একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লেখেন—“Unheard Cabin”, যাতে একাধিক জায়গায় অন্ধকারে ঢাকা শিল্পপতিদের গল্প বলা হয়েছিল। অর্জুন বলেন, “কেউ যদি কোনো কারণে খুন করে, সেটি হয় তাৎক্ষণিক প্রতিহিংসা। কিন্তু কেউ যদি বছর ধরে বিষ তৈরি করে, বইয়ের পৃষ্ঠা বেছে নেয়, বিষ ঢোকায়, বইটি গিফট করে—তাহলে সেটা প্রতিহিংসা নয়, এক শৈল্পিক ঘৃণা।” অর্জুন নির্দেশ দেন—তিথি সেনকে খুঁজে বের করো। শেষ এক মাসে ও কোথায় ছিলেন, কার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, বইটির উৎস কী, এবং তিনি কি বিমানে উঠেছিলেন অন্য কোনো পরিচয়ে? গোয়েন্দা দফতরের ছায়া ঘন হয়, আর আকাশে যেন প্রতিটি মেঘ বলছে—এই হত্যার গল্পে কেবল বিষ নয়, রয়েছে এমন একটি মন যা দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যু আঁকছিল পাতার পর পাতা।
৬
শহরটা তখন প্রায় ঘুমোতে চলেছে। রাত ১১টা বাজে। অথচ গোয়েন্দা দপ্তরের একটি কক্ষে আলো এখনো জ্বলছে—আলোকের কেন্দ্রে অর্জুন মুখার্জি, চোখে গভীর চিন্তার ছায়া। দেয়ালে আটকে দেওয়া হয়েছে তিথি সেনের ছবি, তাঁর জীবনরেখা, অতীত ঘটনার টাইমলাইন, এবং সমরেশ মিত্রর সঙ্গে সংযোগসূত্র। মেহর সিদ্দিকি সবিস্তার জানায়, “তিথি সেন, বয়স ৪৩, একসময়ে AI-এর সেরা কেবিন সুপারভাইজার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী, দায়িত্ববান, জনপ্রিয়ও। ২০১৫ সালে হঠাৎ অভিযোগ আনেন—সমরেশ মিত্র, তখন AI-এর বিশেষ কর্পোরেট প্রতিনিধি হিসেবে এক ফ্লাইটে ছিলেন, এবং তাঁদের মধ্যে ঘটে ‘অগ্রহণযোগ্য আচরণ’। তদন্ত হয়, কিন্তু CCTV না থাকা, সহকর্মীদের নীরবতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অভিযোগ অগ্রাহ্য করা হয়।” মেহর একগাল নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “তিথির সেই সময়ের জবানবন্দি রিপোর্ট পড়ে শিউরে উঠতে হয়, স্যার।” অর্জুন শান্ত কণ্ঠে বলেন, “প্রতিহিংসা একমাত্র তখনই জন্ম নেয়, যখন ন্যায়বিচার মরে যায়।” এরপর খুঁজে পাওয়া যায়—তিথি বর্তমানে দিল্লিতে থাকেন না, তিনি ডেরাদুনে একটি শান্ত লেখকজীবন যাপন করছেন, ছদ্মনামে বই লেখেন—‘T. Sen’। এবং বইয়ের একটি দোকান থেকে খুঁজে পাওয়া যায় তার অটোগ্রাফ দেওয়া সেই বইয়ের একটি মিল—”To the man who forgot the rain, I bring the last summer.” সেই লেখা ছিল বিষমাখানো বইটির প্রথম পাতায়ও।
এরপরের পদক্ষেপ হয় অবধারিত। CIAB-র একটি বিশেষ টিম পাঠানো হয় ডেরাদুনে, যেখানে তিথি একটি একতলা পুরনো বাংলো ভাড়া নিয়ে থাকেন। বাড়িটি অদ্ভুত নিঃস্তব্ধ—দেয়ালে বইয়ের তাক, চারদিকে ধুলোমলিন প্রুফ-কপি, চায়ের দাগ, আর ডায়েরির পাতায় লেখা বিক্ষিপ্ত সংলাপ। তিথি সেন নিজে দরজা খোলেন। তাঁর চেহারায় বয়সের চিহ্ন, কিন্তু চোখে কঠিন স্তব্ধতা। অর্জুন মুখোমুখি হন তিথির। প্রথম প্রশ্নই করেন, “আপনি কি সমরেশ মিত্রকে হত্যা করেছেন?” তিথি চুপ থাকেন, একটানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন অর্জুনের চোখে। তারপর হালকা কণ্ঠে বলেন, “আমি শুধু বই ফিরিয়ে দিয়েছি। ঠিক সেই বইটা, যেটা আমার জীবনের সবচেয়ে কালো মুহূর্তে ওনার কাছেই পড়ে ছিল।” অর্জুন বলেন, “আপনি কি জানতেন, সেই বইয়ে Tetrodotoxin লুকিয়ে আছে?” তিথির ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে, “আপনি তো সব জানেন। তাহলে আমি শুধু এটা বলি—কখনও কখনও বিচার আদালতে হয় না, হয় শব্দহীন পাতার ভাঁজে। আমি শুধুই গল্প লিখি।” সে মুহূর্তে অর্জুন বোঝেন—এই নারী একজন খুনি হয়তো বটে, কিন্তু তাঁর খুন কোনো অস্ত্রের নয়, এক দীর্ঘ পুঞ্জীভূত অসহায়তার বহিঃপ্রকাশ। অর্জুন সিদ্ধান্ত নেন—এ তদন্ত আর আদালতের নয়, বরং মানুষের মনস্তত্ত্বের। এবং ঠিক তখনই, একটি ফোন আসে মেহরের কাছে—“স্যার, নতুন তথ্য পেয়েছি। তিথি হয়তো একমাত্র নয়, আরও কেউ জড়িত ছিল।” অর্জুন মুখ ঘুরিয়ে বলেন, “খুনির গল্প কখনও এক পাতায় শেষ হয় না, মেহর—চলো, আমরা বাকিগুলো খুঁজি।”
৭
হাওয়ায় হালকা গন্ধ—পুরনো বই আর কালি মিশ্রিত একধরনের শূন্যতা, যেখানে শব্দের চেয়েও বেশি কথা বলে নীরবতা। সন্ধ্যার আলোর নিচে অর্জুন মুখার্জির গাড়ি এসে দাঁড়াল দিল্লির হজরতগঞ্জ লেনের এক পুরনো টাউনহাউজের সামনে। ভেতরে বসবাস করেন—সঞ্জয় কেশব। পেশায় সাহিত্য সম্পাদক, একসময় বিখ্যাত প্রকাশনী ‘Bindu & Ray’–এর কর্ণধার, পরবর্তীকালে নিজেই সরে যান লাইমলাইট থেকে। তদন্তে উঠে এসেছে, তিথি সেনের “Unheard Cabin” উপন্যাসটির চূড়ান্ত সম্পাদনা তিনিই করেছিলেন। চমকপ্রদ তথ্য হলো, সমরেশ মিত্রর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ঘটনাবলি ও ভাষা প্রকাশিত গল্পের সঙ্গে ভয়াবহভাবে মিলে যায়, কিন্তু এই অংশগুলি পরে উপন্যাস থেকে বাদ পড়ে। কে বাদ দিয়েছিল? কেন বাদ দিয়েছিল? অর্জুনের বিশ্বাস—এই ঘটনার ছায়া তিথির বাইরে কেউ জেনেছিল, এবং হয়তো সেই কেউই বিষ প্রয়োগের প্রকৃত কারিগর। সঞ্জয় কেশব চা হাতে বেরিয়ে এসে বলেন, “আসুন, আমি অপেক্ষা করছিলাম।” তাঁর কণ্ঠে যেন ক্লান্ত এক স্বীকারোক্তি লুকিয়ে। তিনি অর্জুনকে নিয়ে যান ছোট এক লাইব্রেরি ঘরে—দেয়ালজোড়া বুকশেলফ, মাঝখানে চেয়ারের পাশে রাখা একটি কালো ডায়েরি। তিনি বলেন, “এই ডায়েরিটা তিথি আমাকে দিয়েছিল, ২০১৭ সালে। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কখনও আমি না থাকি, কেউ যেন জানে, আমি কেন লিখি।’”
অর্জুন ডায়েরির পাতাগুলি খুঁটিয়ে পড়েন। সেখানে কেবল উপন্যাসের খসড়া নয়, আছে এমন কিছু চিঠি, যা সমরেশ মিত্রর হাতে লেখা এবং কেবল তিথির জন্য—অপমান, ক্ষমা প্রার্থনা, ভয়, এবং সর্বশেষে একটি শোকজ-সদৃশ হুমকি। সঞ্জয় বলেন, “তিথি তাঁর লেখায় প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাঁকে থামাই—বলেছিলাম, ‘সত্য লিখো, কিন্তু আইন ভেঙো না।’ এরপর একদিন দেখি, বইয়ের বিশেষ সংস্করণ নিয়ে তিনি ব্যস্ত, বললেন, ‘আমি নিজেই বাঁধাই করাব, এটা হবে ব্যক্তিগত উপহার।’ আমি তখন জানতাম না, এই ‘উপহার’ কাকে দেওয়া হবে।” অর্জুন ধীরে বলেন, “আপনি কি জানতেন বিষ প্রয়োগের কথা?” সঞ্জয় মাথা নাড়ে, কিন্তু তাঁর চোখের পেছনে একরকম শীতলতা। তিনি বলেন, “আমি জানতাম, ও ক্ষুব্ধ। কিন্তু আমি ভাবিনি—ও সত্যিই কিছু করে ফেলবে। হয়তো আমি ভুল করেছিলাম, ওর লেখায় হাত দিয়ে। ওর রাগ শুধু সমরেশের ওপর ছিল না… আমার ওপরও।” হঠাৎ, সঞ্জয়ের ডেস্ক থেকে একটি চিঠি উদ্ধার হয়, যেটি এক সপ্তাহ আগে তিথি পাঠিয়েছিলেন—লিখেছেন, “তুমি হয়তো আরেকটা বই সম্পাদনা করছো, কিন্তু আমি এবার নিজের চ্যাপ্টার শেষ করেছি।”—T.S. অর্জুন বুঝলেন, তিথি একাই এই পরিকল্পনার নকশা আঁকেননি। কেউ না কেউ চুপ করে থেকে তাঁকে সাহায্য করেছে। সঞ্জয়ের হাত সাদা, কিন্তু ছায়া রয়ে গেছে শব্দে—আর সেই ছায়াই হয়তো সত্যিকারের সহ-লেখক। অর্জুন এবার বলেন, “আমরা এতদিন ধরে বইয়ের বিষ খুঁজছিলাম… এখন দেখি, বিষ তো আসলে চরিত্রদের মধ্যেই ছিল। কিছু চরিত্র শব্দে বিষ মেশায়, কিছু চরিত্র নীরব থেকে বিষ ছড়িয়ে দেয়।” ঘড়ির কাঁটা রাত ১২ ছুঁই ছুঁই। এই তদন্ত এখন আর শুধু খুনের নয়, এটি হয়ে উঠছে সেই ‘অজানা লেখার’ অনুসন্ধান—যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠা মৃত্যু বয়ে আনে।
৮
বিমানের ভেতর প্রায় ১২০ জন যাত্রী ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের নাম, ঠিকানা, টিকিট এবং গতিবিধির রেকর্ড একাধিকবার খতিয়ে দেখা হয়েছিল। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে একটি নাম এতদিন বাদ পড়ে ছিল—দ্বৈপায়ন রাহা। যাত্রীর আসনে তাঁর নাম ছিল ঠিকই, পরিচয়পত্র ছিল অরিজিনাল, কিন্তু সিসিটিভি-তে যিনি ওই নামের টিকিটে ওঠেন, তাঁর মুখ কেমন যেন অচেনা, খুব সাধারণ, যেন ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যাবার মতো। অর্জুন আবার সেই ভিডিও প্লে করেন—৫৪সি সিটের যাত্রী, কাঁধে একটি ফেডেড ব্যাগ, কানে হেডফোন, চোখে পাতলা চশমা। বিমানে ওঠার সময় এক ঝলক তাঁকে দেখা গেল বইটি হাতে তুলতে, তারপর সারাটা ফ্লাইট তাঁর কার্যকলাপ খুব বেশি দৃশ্যমান নয়। আরেকটি বিশেষ বিষয় নজরে আসে—তাঁর পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে ভিডিওতে দেখা চেহারার এক সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, যা কেবল ফেস রিকগনিশন সফটওয়্যার ধরতে পারে। তদন্ত জোরদার হয়। যখন CIAB-এর একটি টিম রাহার আসল পরিচয় বের করে, সবার চমকে যাওয়ার সময়। দ্বৈপায়ন রাহা নামটি আসলে একটি ছদ্মনাম, আসল নাম—জয়ন্ত সেনগুপ্ত, একজন প্রাক্তন কেমিস্ট, যিনি আগে DRDO-তে কাজ করতেন এবং বিষের অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত গবেষণায় জড়িত ছিলেন। তাঁর চাকরি ছিন্ন হয় ২০১৮ সালে—কারণ হিসেবে বলা হয় “আচরণগত অস্বাভাবিকতা”। কিন্তু একটি পুরনো রিপোর্টে দেখা যায়, তিথি সেনের বইয়ের বিষ প্রয়োগের ধরন প্রায় হুবহু মেলে জয়ন্তর একটি অসমাপ্ত গবেষণার সঙ্গে।
অর্জুন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যান। জয়ন্ত সেনগুপ্ত—কোনো সাহিত্যিক নন, কোনো প্রতিহিংসার মূল চরিত্র নন, তবুও এই খুনে তাঁর উপস্থিতি? প্রশ্নের উত্তর আসে তিথির পুরনো চিঠিপত্র ঘেঁটে। সেখানে একটি কাগজে মাত্র তিনটি শব্দ লেখা—“He believed me.” তিথি যখন অভিযোগ করেছিলেন, তখন পুরো দুনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, কেবল জয়ন্ত একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি তাঁর কথা বিশ্বাস করেছিলেন। সম্ভবত সেখান থেকেই জন্ম নেয় এক নিঃশব্দ বন্ধন—সাহিত্যিক না হলেও জয়ন্ত চেয়েছিলেন সেই ‘ন্যায়’-কে বাস্তবে রূপ দিতে, এবং তিথির বইয়ের মাধ্যমে একটি মৃত্যুর চিত্র আঁকতে। অর্জুন বলেন, “তিথি মস্তিষ্ক ছিলেন, জয়ন্ত ছিল হাত। একসঙ্গে ওরা তৈরি করেছিল এক নিখুঁত প্রতিশোধের নকশা।” তিথিকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি চুপ করে থাকেন, শুধু বলেন, “আমার গল্প আমি লিখেছি, কিন্তু কেউ একজন তাকে বাস্তব করে তুলেছে। আমি তাকে থামাতে পারিনি।” জয়ন্ত এখন পলাতক, সম্ভবত অন্য একটি পরিচয়ে অন্য শহরে। অর্জুন বুঝতে পারেন—এই খুনের গল্পের পর্দা পড়েনি এখনো। মৃত্যু ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে জন্ম নিয়েছে একটি নতুন গল্প—যেখানে সত্যিকারের খলনায়ক একজন নিঃশব্দ যাত্রী, যে সবার মাঝে থেকেও অদৃশ্য ছিল।
৯
হিমালয়ের উপত্যকার শান্ত পাহাড়ঘেরা গ্রাম—মালসারি, যেখানে দিনের আলো যেন কুয়াশার সঙ্গে মিশে একরকম ধোঁয়াটে হয়ে যায়, সেখানে হঠাৎ কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে এক অচেনা মানুষকে। নাম বলেছে “অভিষেক মিত্র”, কাজ করেন একটি এনভায়রনমেন্টাল NGO-তে, প্রকৃতি নিয়ে লেখেন, একা থাকেন গ্রামের শেষপ্রান্তে ভাড়া নেওয়া একটি কাঠের কুঁড়ে ঘরে। কিন্তু সেই মানুষটিই—জয়ন্ত সেনগুপ্ত। CIAB-এর সাইবার শাখা যেভাবে তাঁর গতিবিধি ট্রেস করছিল, অবশেষে তাঁদের সন্দেহ গিয়ে পড়ে এই গ্রামে। অর্জুন এবং মেহরের নেতৃত্বে একটি বিশেষ অপারেশন টিম গ্রামে পা রাখে, প্রতিটি পদক্ষেপে নিরবিচারে পর্যবেক্ষণ করে সেই কুঁড়েঘর। অর্জুন জানেন—এটি কেবল একটি খুনির খোঁজ নয়, এটি এক আদর্শিক মননের মুখোমুখি হওয়া। রাত ১টা নাগাদ, অর্জুন একা গিয়ে দাঁড়ান জয়ন্তর ঘরের সামনে, দরজা খোলা। ভেতরে উষ্ণ আলো, দেয়ালে হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি, বইয়ের স্তূপ, আর মাঝখানে বসে আছেন জয়ন্ত—কোনো চাঞ্চল্য নেই মুখে, যেন অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, “জানতাম তুমি আসবে। একমাত্র তুমি পারো আমাকে খুঁজে পেতে। বাকিরা শুধু খুন খোঁজে, তুমি খুঁজো খুনের নকশা।”
অর্জুন ধীরে বলেন, “তুমি একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলে, কেন এই পথে এলে?” জয়ন্ত হাসেন, “বিজ্ঞান তো আমাদের শুধু বলে কীভাবে কাজ হবে, কিন্তু কেন হবে—সে প্রশ্ন করে না। তিথির কান্না যখন কেউ শুনল না, আমি বুঝলাম—ন্যায় শুধু আদালতের শব্দ নয়, সেটা একটা ঘটনা, যেটা মানুষ সৃষ্টি করে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা চাইলে বাঁচতে পারি, কিন্তু কেউ আমাদের শোনে না বলেই আমরা শাস্তি দিই। আমি কারও বিরুদ্ধে নই, আমি শুধু প্রতিশোধকে নিয়মে বাঁধতে চেয়েছিলাম।” অর্জুন প্রশ্ন করেন, “তুমি কি জানো, তুমি একজন খুনি?” জয়ন্ত জবাব দেন, “তুমি কি জানো, আমি একজন মুক্তিকামী?” সেদিন জয়ন্ত ধরা দেন, কিন্তু প্রতিটি কথার মধ্য দিয়ে অর্জুন বোঝেন—এই মানুষটির মধ্যে হিংসা নেই, বরং গভীর দার্শনিক তৃষ্ণা আছে, যা সমাজ আর আইনকে অতিক্রম করে ‘ন্যায়’-কে নিজের মতো করে রচনা করে। অপারেশন শেষ হয়, জয়ন্তকে হেফাজতে নেওয়া হয়, কিন্তু তাঁর লেখাগুলি, বিষ প্রয়োগের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, এবং ন্যায়বিচারের বিকল্প দর্শনের ব্যাখ্যা রাষ্ট্রীয় তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। অর্জুন গাড়িতে বসে ভাবেন—আমরা যারা শিকার খুঁজি, তারা অনেকসময় ছায়ার মধ্যেই আটকে যাই। কিন্তু ছায়ার পেছনে যে আলো থাকে, তা কখনও কখনও এমন মানুষ সৃষ্টি করে—যারা খুন করে না, বরং সমাজকে তার মুখোশ খুলে দেখায়।
১০
CIAB সদরদপ্তরে ফিরে আসার পর, জয়ন্ত সেনগুপ্তকে জেরা শুরু হয় নিরবিচারে। তাঁর মুখে কোনো অনুশোচনা নেই, বরং তিনি যেন ধাপে ধাপে গোটা পরিকল্পনাটিকে বিশ্লেষণ করছেন—একজন গবেষক যেমন করে নিজ গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা করে। অর্জুন মুখার্জি যতই এগোতে থাকেন, ততই পরিষ্কার হতে থাকে যে, সমরেশ মিত্রর মৃত্যু ছিল কেবল শুরু। জয়ন্তের লেখা খসড়াগুলি, তার ‘ধারাবাহিক বিষচক্র’ নামক গোপন নথি, একাধিক স্কেচ আর প্যাথোজেনিক ডায়াগ্রাম পরীক্ষা করে জানা যায়—এই লোকটি সমাজের সেইসব মানুষদের “প্রতীকি নিধন”-এর পরিকল্পনা করেছে, যারা তাঁর মতে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরপরাধের জীবন নষ্ট করেছে’। খসড়ার পাতাগুলিতে প্রতিটি ‘টার্গেট’-এর কাছে উপস্থাপন করার জন্য একটি করে বিষাক্ত বস্তু পরিকল্পিত—কেউ পাবে একটি কবিতার বই, কেউ এক জোড়া চশমা, কেউ একটি কফির কাপ। প্রতিটি বস্তুই বাহ্যিকভাবে নিরীহ, কিন্তু তাতে বিষক্রিয়ার এমন নকশা রয়েছে যা নির্দিষ্ট সময়ে শরীরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্র ধ্বংস করে। সবচেয়ে অদ্ভুত তথ্য ছিল—তিথি সেন এই পুরো পরিকল্পনার বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন না। তিনি কেবল নিজের প্রতিশোধের গল্পটুকু লিখেছিলেন, বাকি চরিত্রগুলিকে জয়ন্ত নিজেই সংযোজন করেছে।
অর্জুন আর মেহর সিদ্দিকি যখন বসে এই খসড়াগুলির প্রতিটি অংশ বিশ্লেষণ করেন, তখন একটি ভয়াবহ সত্য সামনে আসে। খসড়ার একটি পাতায় লেখা—“নেক্সট: প্রতাপ রায় — কারণ: ২০১৪, রোহিণী কাণ্ড।” প্রতাপ রায়, একজন প্রাক্তন আমলা, বর্তমানে প্রভাবশালী কর্পোরেট অ্যাডভাইজার—তিনি একসময় একটি কনস্ট্রাকশন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন যেখানে এক তরুণী ইঞ্জিনিয়ার আত্মহত্যা করেন। সেই ঘটনার পর মামলা চলেও ধামাচাপা পড়ে যায়। আর সেই তরুণীর নাম ছিল—রোহিণী সেনগুপ্ত—জয়ন্তের ছোট বোন। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি এখন ব্যক্তিগত প্রতিশোধের চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে। অর্জুন দেরি না করে প্রতাপ রায়ের বাড়িতে স্পেশাল প্রটেকশন টিম পাঠান, কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়—একটি সোনালি খামে মোড়া কবিতার বই ইতিমধ্যেই তার হাতে পৌঁছে গেছে। বইটি এখনও খোলা হয়নি, কিন্তু সম্ভাবনা রয়েছে—বইয়ের পাতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই ঘাতক বিষ। টিম দ্রুত বইটি কন্টেইন করে, ল্যাবে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হয়—হ্যাঁ, পাতাগুলোর প্রান্তে Tetrodotoxin প্রলেপ ছিল, যা স্পর্শের মাধ্যমে প্রবেশ করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নায়বিক পতন ঘটায়। প্রতাপ রায় বেঁচে যান অল্পের জন্য। জয়ন্ত জিজ্ঞাসাবাদে কেবল বলেন, “এই দেশ শুধু শাসকের নয়, এই দেশ সেই সব আত্মাদের—যাদের নাম নেই, শুধু গল্প আছে। আমি তাঁদের গল্প লিখে গেছি, বিষ দিয়ে।” অর্জুন তখন বলেন, “তোমার গল্প হয়তো শেষ, কিন্তু এই শহরের গল্প এখন শুরু হবে—সেই সব মানুষদের নিয়ে, যারা বেঁচে থেকেও বিচার পায়নি।” সেই রাতেই বিষক্রিয়ার খসড়া নথিগুলি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেন কোনও অপরাধী ভবিষ্যতে সেই জ্ঞান ব্যবহার না করতে পারে। অর্জুন জানেন—জয়ন্ত ছিল নিখুঁত, কিন্তু ভাগ্য আর বিবেক তাঁকে থামিয়েছে।
১১
সেই রাতটায় তিথি সেন দীর্ঘ সময় জানালার পাশে বসে থাকেন—অন্ধকার জানালায় প্রতিফলিত হয় তার নিজের মুখ, যার চোখে তীব্রতা নেই, বরং ক্লান্তি আর একরাশ মৌনতা। সংবাদমাধ্যমে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে ‘Poison Plot’ নামে জয়ন্ত সেনগুপ্তের ধরা পড়ার খবর, সঙ্গে তাঁর তৈরি বিষের পরিকল্পনার কিছু বিস্ময়কর বিশ্লেষণ। কিন্তু তিথির জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল—তাঁর গল্পের প্রতিশোধ কীভাবে একটি ধারাবাহিক মৃত্যু-প্রক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন, “Unheard Cabin” হবে একটি গল্প, যার ভেতর কেবল থাকবে সাহস, ভাঙনের ইতিহাস, আত্মপ্রত্যয়ের জন্ম। কিন্তু তিনি জানতেন না—সেই বইয়ের ছায়ায় কেউ একজন নিজের ‘ধারাবাহিক হত্যার ক্যানভাস’ রচনা করে ফেলেছে। অর্জুন মুখার্জি যখন তাঁকে দেখতে এলেন, তিথি মুখ তুললেন না, শুধু বললেন, “আমি শুধু লিখেছিলাম আমার ক্ষত। আমি জানতাম না কেউ তা অস্ত্র বানাবে।” অর্জুন চুপচাপ তাঁর পাশে বসে রইলেন, তারপর একটি সাদা খাম তাঁর দিকে এগিয়ে দিলেন—ভেতরে জয়ন্তের লেখা শেষ চিঠি। সেখানে লেখা—“তুমি আমায় শিখিয়েছিলে কিভাবে যন্ত্রণাকে শব্দে পরিণত করতে হয়, আমি কেবল শব্দগুলোর অনুবাদ করেছিলাম বাস্তবে।” তিথি কিছুক্ষণ পর খামটা টেবিলে রেখে চোখ বন্ধ করে বললেন, “আমি জয়ন্তকে থামাতে পারতাম। আমি চাইলে বইটা অন্যভাবে শেষ করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করিনি।”
সেই রাতে তিথি তাঁর লেখার টেবিলের সামনে বসে, “Unheard Cabin: Revisited” নামে একটি নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপি শুরু করেন। এবার আর কোনও রহস্য নেই, কোনও বিষক্রিয়া নেই—এই বইতে থাকবে তাঁর স্বীকারোক্তি, তাঁর সীমাবদ্ধতা, এবং তাঁর অবচেতন সহযোগিতা। তিনি জানেন, এই বই কারও শাস্তি দেবে না, কিন্তু হয়তো কিছু পাঠককে চিনিয়ে দেবে—যে একটি গল্প কেবল শিল্প নয়, সেটি দায়িত্বও। মেহর সিদ্দিকি পরে বলেন, “তিথির চোখে তখন ক্ষমার চেয়ে বেশি ছিল বোঝাপড়া। কেউ যদি নিজের গল্পের কাঁটায় অন্যের মৃত্যু দেখে, সে তখন আর শিল্পী থাকে না—সে হয়ে ওঠে বিচারক।” নতুন বইয়ের শেষ পাতায় তিথি লেখেন, “এই শহর আমাদের শুনতে চায় না, তাই আমরা চিৎকার করি। কিন্তু সেই চিৎকার যদি বিষে ভরে যায়, তবে গল্প আর মুক্তি দেয় না—গল্প তখন বন্দী করে।” তিথির সেই পুনরায় লেখা বই আজও সাহিত্যের পাঠ্যভাগ নয়, কিন্তু বিচারব্যবস্থার পাঠ্য হয়ে উঠেছে—‘ন্যারেটিভ ন্যায়’ কীভাবে অপরাধের অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে, তার নির্ভুল উদাহরণ।
১২
এক বছর কেটে গেছে। “IV-947” ফ্লাইটটি আবার আকাশে উঠছে—এবার এক বিশেষ ‘মেমোরিয়াল ফ্লাইট’, যেখানে নিহত সমরেশ মিত্রর পরিবার, বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা, তদন্তকারী কর্মকর্তারা এবং সাহিত্যিক তিথি সেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই ফ্লাইট শুধুই প্রতীকী, পুনরুজ্জীবনের যাত্রা, যেখানে প্রতিটি আসন একবার খালি রেখে স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানানো হবে। অর্জুন মুখার্জি বিমানে ওঠেন নিরুত্তাপ মুখে, কিন্তু তাঁর চোখ খুঁজে ফেরে চেনা ছায়া—ভবিষ্যতের হুমকি, অচেনা প্রস্থান। সবকিছু স্বাভাবিক। মেঘ পেরিয়ে বিমান যখন cruising altitude-এ পৌঁছায়, তখন হঠাৎই একটি ককপিট মেসেজ পাওয়া যায়—“Warning: system override detected.” প্লেন কাঁপে না, কেউ অজ্ঞান হয় না, কোনও যাত্রী অস্বাভাবিক আচরণ করে না। কিন্তু অর্জুন জানেন—এটি নিছক প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়, বরং কারও ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপ। তখনই কেবিন ক্রুর একজন এগিয়ে এসে বলেন, “স্যার, আপনাকে দেখা করার জন্য একজন যাত্রী বারবার অনুরোধ করছে—সিট 45B।” অর্জুন সোজা হন, তাঁর ভিতরের গোয়েন্দাটি জেগে ওঠে। 45B-তে গিয়ে তিনি দেখেন—একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, চোখে গাঢ় চশমা, হাতে “Unheard Cabin: Revisited”-এর নতুন সংস্করণ। তিনি মাথা নোয়ান, বলেন, “আমার নাম অরূপ নন্দী। আমি জয়ন্ত সেনগুপ্তের ছাত্র ছিলাম। আমার শিক্ষক যা শেষ করে যেতে পারেননি, আমি তা সম্পূর্ণ করতে চাই।”
অর্জুন এক মুহূর্ত থেমে যান। কথাগুলোর ভেতর অহংকার নেই, বরং এক প্রকার ঠান্ডা স্থিরতা। অরূপ তাঁর ব্যাগ থেকে একটি সাদা ফাইল বের করেন—তার নাম “V-Protocol: Second Iteration.” অর্জুন বুঝে যান—এটা নতুন কোনো বিষ-পরিকল্পনার খসড়া। তবে এবার বিষয়টা আরও ভয়ঙ্কর। অরূপ বলেন, “প্রথমবার ছিল একান্তভাবে ন্যায়বিচারের প্রতিক্রিয়া। এবার—প্রতিক্রিয়ার অভ্যুত্থান। আমরা প্রতিশোধ নেবো সমাজের উদাসীনতার বিরুদ্ধে। জয়ন্ত কেবল শুরু করেছিল। আমরা শেষ করব।” অর্জুন তাঁর হাতে রাখা ফাইলটি নিয়ে ধীরে বলেন, “তুমি জানো, এটা সন্ত্রাস নয়, এটা দর্শনের নামে বিষ প্রয়োগ।” অরূপ মাথা নাড়েন, “দর্শন যখন সমাজে প্রবেশের পথ পায় না, তখন সেটা বিষ হয়। তুমি একে অপরাধ ভাবো, আমি ভাবি আন্দোলন।” অর্জুন ফাইলটি ধীরে ধীরে ছিঁড়ে ফেলেন, আর কেবিনের এক কোণে লুকিয়ে রাখা স্যুটকেসটিও সিকিউরিটি টিম আটক করে—যার ভেতরে ছিল তিনটি ‘অ্যাডাপ্টিভ পারফিউম কার্ট্রিজ’, যেগুলি নির্দিষ্ট এনজাইম পদ্ধতিতে বিষ মিশিয়ে বাতাসে ছড়াতে সক্ষম। মুহূর্তে বিমান ল্যান্ড করার সিদ্ধান্ত হয়, অরূপ নন্দী গ্রেপ্তার হন, এবং এই পুরো ঘটনাকে ‘Silent Sky Plot’ নামে অভিহিত করা হয়।
নিচে নামার সময় অর্জুন জানালার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাইরে আকাশে সূর্য ওঠে ধীরে, মেঘ ছুঁয়ে আসে আলো। তাঁর মনে হয়—মৃত্যু হয়তো একটা ঘটনা, কিন্তু মৃত্যু আটকানোর প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের একেকটা গল্প। “IV-947” সেই গল্প, যেখানে সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায়, বিশ্বাস-প্রতিশোধ সবকিছু মিশে গেছে আকাশের ওই অনন্ত ধোঁয়ার রেখায়। গল্পের শেষ নয়, বরং শুরু সেখানেই।
—
শেষ