জয় মুখার্জী
এক
কলেজ লাইব্রেরি সেই দিনের বিকেলে প্রায় ফাঁকাই ছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকে কাঠের টেবিলগুলোর উপর লম্বা ছায়া ফেলছিল, পুরনো বইয়ের গন্ধে ভরপুর ঘরে শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ আর কয়েকজন ছাত্রের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল। অরিন্দম সেন, ইতিহাসের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, খুঁজছিল উপনিবেশিক কলকাতার সমাজ নিয়ে কিছু গবেষণার বই। সে লাইব্রেরির প্রায় অচল একটি সেকশনে ঢুকে পড়েছিল, যেখানে ধুলো জমে থাকা পুরনো বইয়ের সারি বছরের পর বছর কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। তার হাত হঠাৎ এক মোটা, ছেঁড়া মলাটের বইতে আটকে যায়। বইটি খুলতেই খসখস করে কয়েকটি আলগা কাগজ নিচে পড়ে গেল। অরিন্দম অবাক হয়ে দেখল, ওগুলো আসলে কোনো ডায়েরির পাতা। চামড়ার মলাটের উপর ক্ষয়ে যাওয়া অক্ষরে মলিনভাবে লেখা—“মেঘনাদ”। নামটা দেখে তার বুকের মধ্যে যেন হালকা কাঁপন উঠল। সে জানত, ১৯৭০-এর দশকে কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন, নকশালপন্থী গোপন সংগঠন আর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড তোলপাড় করে দিয়েছিল শহরকে। হয়তো এই ডায়েরি সেই সময়ের কোনো অজ্ঞাত বিপ্লবীর। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো স্পর্শ করতেই এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হল—যেন ইতিহাসের অন্ধকার কোনো গোপন দরজা খুলে গেছে। পাতাগুলো হলদেটে হয়ে গেছে, কোথাও কোথাও কালি ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু লেখা এখনো স্পষ্ট। প্রথম পাতায় লেখা আছে—“আমার নাম কেউ জানে না, সবাই আমাকে ডাকে মেঘনাদ নামে। হয়তো এটাই যথেষ্ট, কারণ আসল পরিচয় কোনো দিন কারো দরকার হয় না।” অরিন্দম চমকে উঠল, কারণ শব্দগুলোতে এমন এক ব্যক্তিত্বের ছাপ, যেন তিনি নিজের পরিচয় লুকিয়ে থেকেও ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন।
ডায়েরি পড়তে পড়তে অরিন্দম টের পেল, এটা শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা নয়, বরং এক যুদ্ধের, এক গোপন আন্দোলনের দিনলিপি। মেঘনাদ লিখেছেন কিভাবে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে সংগঠিত হয়েছিলেন, কীভাবে কলকাতার গলিঘুঁজি, হোস্টেল, কফি হাউস কিংবা লুকোনো আস্তানায় বৈঠক হতো, আর কেমন করে তারা বিশ্বাস করতেন যে বিপ্লবের আগুন একদিন সমাজকে বদলে দেবে। কিন্তু পাতার পর পাতায় শুধু স্মৃতি নয়, কিছু অদ্ভুত চিহ্ন, কিছু আঁকাবাঁকা লাইন, আবার কোথাও কোথাও কবিতার টুকরো লুকানো আছে। যেমন একটি পাতায় লেখা—“যেখানে তিন নদীর মিলন, অশ্রুর স্রোত সেখানে বয়ে চলে। সময়ের বুকে রেখে এসেছি আমার উত্তরাধিকার।” অরিন্দম প্রথমে ভেবেছিল এটা হয়তো আবেগঘন লেখা, কিন্তু একটু ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারল, এটি এক ধরনের সংকেত। প্রতিটি শব্দ যেন ইঙ্গিত করছে কোনো নির্দিষ্ট জায়গার দিকে, কোনো ঘটনার দিকে। তার চোখ আরও গাঢ় হয়ে এলো, বুক ধকধক করতে লাগল। সে যেন হঠাৎ উপলব্ধি করল—ডায়েরি শুধু অতীত বলছে না, বরং কিছু লুকোনো রহস্য তার ভেতরে আছে। এটা নিছক লেখা নয়, এটা এক সাংকেতিক কোড, যার মানে খুঁজে বের করতে হবে। এই ভাবনাটাই অরিন্দমকে শিহরিত করে তুলল, কারণ ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সে জানত, যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের আসল রূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন, কিন্তু যদি সত্যিই ডায়েরির মধ্যে গোপন সূত্র থাকে, তবে সেটা ইতিহাস উন্মোচনের এক অমূল্য দলিল হতে পারে।
অরিন্দমের ভেতরে তখন দ্বন্দ্ব শুরু হলো—সে কি এ ডায়েরি লাইব্রেরির নিয়ম মেনে কর্তৃপক্ষকে জানাবে, নাকি নিজের কাছে গোপন রেখে রহস্য ভাঙার চেষ্টা করবে? তার কানে যেন শোনা যাচ্ছিল বাইরে হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ, পুরনো কাঠের জানালায় কাঁচ কেঁপে উঠছে, আর ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করছে। মনে হচ্ছিল ডায়েরি যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, তাকে ডাকছে। শেষমেশ সে সিদ্ধান্ত নিল, আপাতত কাউকে না জানিয়ে নিজেই পড়বে। পাতা উল্টিয়ে এক জায়গায় এসে থমকে গেল—সেখানে বড় করে লেখা আছে: “যদি কেউ আমার এই কথা পড়ে, তবে সে জানুক—আমি কেবল ইতিহাসের পাতায় নামহীন নয়, বরং এক উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছি। যা খুঁজে পাবে শুধু সে-ই, যে সত্যিকারের সন্ধানী।” নিচে আবার কিছু সাংকেতিক অক্ষর লেখা—যা একেবারেই বোঝা যায় না। অরিন্দমের মনে হলো, এই ডায়েরি আসলে এক ধাঁধার খেলা, যেটা মেঘনাদ ইচ্ছে করে রেখে গেছেন ভবিষ্যতের কারো জন্য। তার মনে দোলা দিল—সে-ই কি সেই সন্ধানী, যার হাতে হঠাৎ এসে পড়েছে এই ডায়েরি? বুকের ভেতরে হালকা আতঙ্ক আর প্রবল উত্তেজনা একসঙ্গে মিশে গেল। চারপাশে তাকাল সে—কেউ লক্ষ্য করছে কিনা। লাইব্রেরির করিডোরে নিস্তব্ধতা, কিন্তু অরিন্দমের মনে হলো, কোথাও অদৃশ্য চোখ তাকে ঘিরে আছে। ডায়েরির প্রথম অদ্ভুত সংকেতময় বাক্য যেন এক অচেনা পথে তার জন্য দরজা খুলে দিল, আর সেই দরজা একবার খুলে গেলে আর ফিরে আসার পথ থাকবে না। সে জানত না সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু অন্তরে এক অদ্ভুত টান বলছিল—এই ডায়েরির ভেতরে লুকিয়ে আছে শুধু ইতিহাস নয়, এক বিপ্লবীর অমীমাংসিত রহস্য, যা তার জীবনকেই বদলে দেবে।
দুই
পরদিন সকাল থেকেই অরিন্দমের মাথায় ঘুরছিল আগের রাতের ডায়েরির সেই অদ্ভুত বাক্যগুলো। কলেজে আসার পর সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী অনন্যাকে ডাকল। অনন্যা বাংলা সাহিত্য বিভাগের ছাত্রী, তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক ও সাহিত্য বিশ্লেষণে দক্ষ, বিশেষ করে পুরনো কবিতা ও লোকগাথার ভেতরে লুকোনো সাংকেতিক ইঙ্গিত ধরতে তার জুড়ি নেই। অরিন্দম যখন ডায়েরিটি সামনে মেলে ধরে বলল, “দেখো, এটার মধ্যে কী যেন আছে, আমি একা বুঝতে পারছি না,” তখন অনন্যার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক খেলে গেল। তারা কলেজ ক্যান্টিনের এক কোণে বসে পাতা উল্টাতে লাগল। প্রথম পাতাগুলোতে মেঘনাদের লেখা আবেগঘন, আন্দোলনের স্মৃতি ও ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় স্পষ্টতই এক ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়ছিল। শব্দগুলো অনেক সময় ছন্দ ভেঙে অকারণে বসানো, আবার কোথাও লাল কালিতে দাগ টানা চিহ্ন, আর কোথাও প্রাচীন বাংলার লোকসংগীতের পঙক্তির সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছিল। অনন্যা ভ্রু কুঁচকে বলল, “দেখো, এটা শুধু ডায়েরি নয়। এগুলো আসলে সংকেত, হয়তো মানচিত্রের মতো কাজ করছে।” অরিন্দম তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মানে?” অনন্যা বইয়ের একটি লাইন আঙুল দিয়ে দেখাল—“যেখানে নদী তিনটি মিলেছে, সেখানে আমার অশ্রু লুকোনো।” অনন্যা বলল, “এটা তো নিছক কাব্যিক রূপক হতে পারে, কিন্তু আবার গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতীর সঙ্গমের কথা মনে করায়। কিংবা হয়তো কলকাতার আশেপাশে কোথাও তিন নদীর মিলনস্থল।” তারা দু’জনেই বুঝতে পারল, এ শুধু লেখা নয়—এতে এক অদ্ভুত কোড লুকিয়ে আছে।
তাদের বিশ্লেষণ যত এগোতে লাগল, রহস্যও তত গভীর হতে লাগল। এক পৃষ্ঠায় পাওয়া গেল রবীন্দ্রনাথের এক গান থেকে ধার করা কয়েকটি লাইন, যা পরের লাইনে একেবারে ভিন্ন ঢঙে ভাঙা অক্ষরে লেখা হয়েছে। অনন্যা বলল, “এটা ইচ্ছে করেই এলোমেলো করা, যাতে সাধারণ পাঠক কিছুই বুঝতে না পারে।” অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, তারা যেন একটা ধাঁধার খেলা খেলছে, যেখানে প্রতিটি উত্তর নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। আবার আরেকটি পাতায় অরিন্দম আবিষ্কার করল কলকাতার এক পুরনো মানচিত্রের প্রান্তে আঁকা ছোট ছোট বৃত্ত, যা দেখতে এলোমেলো হলেও অনন্যা বলল, “এগুলো তো আসলে ল্যান্ডমার্ক চিহ্ন।” তারা দু’জন মানচিত্র মিলিয়ে দেখে বুঝতে পারল, চিহ্নগুলো কলকাতার পুরনো থিয়েটার, কফি হাউস আর কলেজ স্ট্রিটের গোপন গলির সঙ্গে সম্পর্কিত। অনন্যা চুপচাপ বলল, “অরিন্দম, এটা শুধু ইতিহাস নয়। এটা এমন কিছু নির্দেশ করছে, যা কেউ লুকিয়ে রেখেছিল।” অরিন্দম হাসল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরে আতঙ্কও ছিল, কারণ এর মানে দাঁড়াচ্ছে তারা অজান্তেই এমন কিছু উন্মোচন করতে শুরু করেছে, যা বহু বছর ধরে গোপনে রাখা হয়েছিল। তাদের হাতের তালুতে জমে থাকা ডায়েরির পাতাগুলো যেন ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠছিল। দু’জনের মনে হল, এই ডায়েরি আসলে মেঘনাদের শেষ উত্তরাধিকার, আর এর ভেতরে লুকোনো সংকেত ভাঙতে পারলে এমন কিছু সত্য বেরিয়ে আসবে, যা ইতিহাসে এখনো লেখা হয়নি।
কিন্তু যতই তারা ভেতরে ডুবছিল, ততই অনুভব করছিল চারপাশে এক অদৃশ্য চাপ তৈরি হচ্ছে। ক্যান্টিনে বসে পড়ার সময় অরিন্দম একাধিকবার লক্ষ্য করেছিল, কোণের টেবিলে বসা এক অচেনা ব্যক্তি তাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। অনন্যাও একসময় ফিসফিস করে বলল, “তুমি খেয়াল করেছ? আমাদের আলোচনার সময় বারবার কেউ নজর রাখছে।” অরিন্দম হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল, কিন্তু ভেতরে অস্বস্তি কাজ করছিল। তারা ডায়েরির দ্বিতীয় সূত্রে পৌঁছল—যেখানে লেখা, “রক্তের বিনিময়ে যা গড়া, তা ভাঙতে পারে না সময়। সেই দেয়ালের আড়ালে লুকোনো আছে উত্তর।” অনন্যা সাথে সাথে বলল, “এটা নিশ্চয়ই কোনো পুরনো ভবন, হয়তো আন্দোলনের সময় ব্যবহার হতো।” অরিন্দম উত্তেজিত হয়ে উঠল—এটাই হয়তো তাদের প্রথম বাস্তব সূত্র, যা তাদের ডায়েরির বাইরের পৃথিবীতে নিয়ে যাবে। কিন্তু দু’জনেই জানত না, এর মধ্যেই কারও নজরে পড়েছে তাদের অনুসন্ধান, আর তারা যতই রহস্য উন্মোচন করবে, ততই বিপদের ছায়া ঘনিয়ে আসবে। সন্ধ্যার আলোয় ডায়েরির পাতা যেন আরও বেশি অন্ধকার হয়ে উঠল, আর প্রতিটি শব্দ ফিসফিস করে বলছিল—“তোমরা এগিয়ে যাও, কিন্তু সাবধান।” অনন্যা ডায়েরি বন্ধ করে অরিন্দমের চোখের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল, “তুমি বুঝতে পারছ তো, অরিন্দম? এ খেলাটা আর শুধু পড়াশোনা নয়, আমাদের জীবনটাই এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে।” অরিন্দম গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যাঁ, জানি। কিন্তু এখন আর পিছু হটা যাবে না।” তারা বুঝে গিয়েছিল—মেঘনাদের ডায়েরির সংকেত আসলে এক দুঃসাহসিক পথের সূচনা, যেখানে প্রতিটি সূত্র তাদের আরও গভীরে টেনে নেবে, অজানা ইতিহাসের অন্ধকারে।
তিন
অরিন্দম ডায়েরি হাতে নিয়ে সেদিন বিকেলের অচেনা উত্তেজনা নিয়ে কলেজ স্ট্রিটের এক নিরিবিলি কফিহাউসের কোণে বসেছিল, যেখানে কাগজের গন্ধ আর পুরোনো আলোচনার প্রতিধ্বনি এখনো ছড়িয়ে থাকে। সে অপেক্ষা করছিল ইতিহাসের অধ্যাপক সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জন্য, যার নাম শুনে প্রথমেই ডায়েরির পাতাগুলিতে উঁকি দেওয়া ইতিহাসের টানাপোড়েন মনে হয়েছিল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি—পাতলা গড়নের, মুখে এক ধরনের ক্লান্তি মেশানো স্নিগ্ধতা নিয়ে অধ্যাপক প্রবেশ করলেন। তাঁর চোখদুটো যেন সবসময় আশেপাশে কিছু খুঁজে বেড়ায়, হয়তো অভ্যাসবশত বা হয়তো অচেনা কোনো ভয়ের কারণে। অরিন্দম তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে ডায়েরি মেলে ধরল। প্রথমে অধ্যাপক হেসে উঠেছিলেন, যেন এটিকে নিছক এক কৌতূহলী তরুণের আবিষ্কার বলে উড়িয়ে দিতে চান, কিন্তু যখন চোখ পড়ল পুরু হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার অক্ষরে—যেখানে আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে লেখা ‘মেঘনাদ’ নামটি একাধিকবার উঠে এসেছে—তখন তাঁর মুখের ভঙ্গি মুহূর্তে পাল্টে গেল। তিনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ডায়েরি বন্ধ করলেন, চোখের চশমাটা খুলে রুমালের কোণ দিয়ে মুছতে মুছতে ধীরস্বরে বললেন, “তুমি জানো কি, এই নামটা শুধু নাম নয়, এটা ছিল আশির দশকের গোড়ার দিকের এক ছায়ার মতো ভয়ের প্রতীক। অনেকেই তাঁকে দেখেছে, কিন্তু কেউই ঠিকমতো তাঁর আসল পরিচয় জানেনি।”
অরিন্দমের ভেতরে প্রশ্নের ঢেউ উঠল। সে জানতে চাইল, মেঘনাদ কে ছিলেন? কিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? অধ্যাপক এক গ্লাস জল খেয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইলেন, যেন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কতটা বলা যায়, কতটা গোপন রাখা উচিত। অবশেষে তিনি ধীর গলায় বলতে শুরু করলেন, “সত্তরের দশকে যখন নকশাল আন্দোলনের উত্তাপ কলকাতার গলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন এই শহরের ভেতরে কয়েকজন মানুষ ছিলেন যাঁরা কখনো সামনে আসেননি, অথচ তাঁদের কাজ ছিল ভয়ঙ্কর গুরুত্বপূর্ণ। মেঘনাদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময়। বলা হয়, তিনি ছিলেন অসাধারণ সংগঠক, কবি এবং বাগ্মী, যার কথা শুনে তরুণেরা অনুপ্রাণিত হত। কিন্তু তাঁর আসল নাম, তাঁর আসল পরিবার, এমনকি তাঁর ছবি পর্যন্ত কারো হাতে ছিল না। শুধু কিছু ছদ্মকথা, কিছু অসমাপ্ত ইতিহাসের পাতা।” এই পর্যন্ত বলেই তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন। তাঁর কণ্ঠে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি চারদিকে তাকালেন, যেন আশেপাশের টেবিলে কেউ শুনছে কি না সেটা যাচাই করছেন। অরিন্দম তখন অনুভব করল, তাঁর সামনে বসা মানুষটি কোনো এক গোপন স্মৃতির ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছেন, যেটি তিনি অনেক বছর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছেন।
অধ্যাপক আবার কথা বলতে শুরু করলেন, কিন্তু এবার তাঁর কণ্ঠে দ্বিধা মিশে গেল। “কিছু কথা আছে যা আমার বলা উচিত নয়। আমি শুধু ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে খুঁজে দেখেছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে এমন কিছু সূত্র সামনে আসে যেগুলো আমার পক্ষে একা সামলানো সম্ভব হয়নি। মেঘনাদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা স্রেফ কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, কিংবা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার গল্পও নয়। আমি যতদূর জানি, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের উপস্থিতি মুছে দিয়েছিলেন। কেন, সেটা জানি না। তবে একটা অদ্ভুত জিনিস মনে পড়ছে—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো আর্কাইভে একবার একটা দলিল চোখে পড়েছিল যেখানে কয়েকটা নাম কোডে লেখা ছিল, আর সেই তালিকার শীর্ষে ছিল ‘মেঘনাদ’। আমি তখন বিষয়টা লিখে রাখিনি, কারণ মনে হয়েছিল হয়তো কল্পকাহিনি। কিন্তু আজ তোমার ডায়েরি দেখে মনে হচ্ছে আসলেই কিছু লুকানো ইতিহাস আছে।” এই বলে অধ্যাপক হঠাৎ চুপ করে গেলেন, মুখে গভীর দ্বিধার রেখা। যেন তিনি একদিকে সত্যি প্রকাশ করতে চান, আবার অন্যদিকে ভয় পাচ্ছেন যে, বলা মাত্রই হয়তো তাঁর জীবনে অশান্তি নেমে আসবে। অরিন্দম বুঝতে পারল, এই মানুষটির কাছে আরও অনেক তথ্য আছে, কিন্তু তিনি এখনই সব বলবেন না। হয়তো সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছেন, হয়তো নিজের নিরাপত্তার। কফিহাউসের ধোঁয়াটে আলোয় বসে অধ্যাপক সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়কে অরিন্দম যেন দ্বিধার এক অচল ছবিতে দেখতে পেল—একজন মানুষ যিনি অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, ভয়ের আড়ালে লুকিয়ে আছেন অথচ সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেও একেবারে ছুঁতে পারছেন না।
চার
অরিন্দম প্রথমে ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। সে ভেবেছিল, হয়তো কাকতালীয়—কলেজের ভিড়, ক্যান্টিনের ভিড়, কিংবা কলেজ স্ট্রিটের ব্যস্ত রাস্তার ভিড়েই তাকে এমন মনে হচ্ছে যে কেউ তাকিয়ে আছে। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই সন্দেহটা ক্রমশ ভয়ঙ্কর রূপ নিতে শুরু করল। ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল সে, সেই সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক অপরিচিত ছায়ামূর্তি তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল। তার মুখটা খোলা নয়, টানা কালো ফ্রেমের চশমা আর ধূসর রঙের পাঞ্জাবি যেন তাকে আড়াল করে রেখেছিল। অরিন্দম এক মুহূর্তের জন্য চোখ ঘোরাতেই লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হলো যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। এরপর কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকাকালীন অরিন্দম স্পষ্ট টের পেল, পিছনে কারও হালকা পদশব্দ, অথচ ঘুরে তাকাতেই শুধু ফাঁকা করিডর। এমনকি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলেও সে যেন অদৃশ্য দৃষ্টির চাপা ভারে হাঁটছিল। এই অস্বস্তি তার মনের গভীরে অদ্ভুত এক চাপা সন্ত্রাস তৈরি করল। মেঘনাদের ডায়েরি তার কাছে এখন শুধুই ইতিহাসের দলিল নয়, বরং সেই দলিল যেন কোনো অদৃশ্য যুদ্ধের সূচনা করে দিয়েছে, এমন এক যুদ্ধে অরিন্দমকে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ক্রমশ অরিন্দম বুঝতে শুরু করল, এ শুধু তার ভ্রান্তি নয়। কয়েকবার সে ছায়ামূর্তিকে দূরে হেঁটে যেতে দেখেছে। একবার কলেজের গেটের সামনে, যখন বিকেলের ভিড় কমে এসেছে, সে লক্ষ্য করল একটি কালো কোট পরা মানুষ তাকে কিছু দূর থেকে লক্ষ্য করছে। অরিন্দম এগোতেই লোকটা আচমকা ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার চোখে সেই দৃষ্টি অরিন্দমকে শীতল করে দিল। অরিন্দম ঠিক করল, সে এসব উপেক্ষা করবে, কিন্তু উপেক্ষা করা সহজ হলো না। রাতের ঘরে বসে যখন সে মেঘনাদের ডায়েরি উল্টে-পাল্টে দেখছিল, জানালার কাচে হঠাৎ ছায়া ভেসে উঠল। কেবল ক্ষণিকের জন্য, তারপর অদৃশ্য। ভয়ে সে তাড়াতাড়ি জানালা খুলে বাইরে তাকাল—গলির ভেতর অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। অথচ তার বুকের ভেতর কেমন এক আশঙ্কা জমে উঠছিল, এই ছায়াগুলো কেবল কাকতালীয় নয়, এদের মধ্যে রয়েছে এক অদৃশ্য শক্তি, যে শক্তি তাকে নীরবে অনুসরণ করছে। অরিন্দমের মনে হতে লাগল, মেঘনাদের ডায়েরি কেবল অতীতের নথি নয়, বরং এর ভেতরে আছে এমন গোপন তথ্য, যাকে ঘিরে আজও কেউ অস্থির, আর সেই অস্থিরতা এখন তার চারপাশে রক্তচাপ বাড়িয়ে তুলছে।
একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে ঘটনা প্রায় চূড়ান্ত রূপ নিল। সন্ধ্যার সময়, কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোর ফাঁকে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ খেয়াল করল, একটি লম্বা মানুষ সাদা শার্ট পরে তাকে অনুসরণ করছে। প্রথমে ভিড়ের অজুহাতে সে বিষয়টা উড়িয়ে দিল। কিন্তু বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেল লোকটা সমান দূরত্ব বজায় রেখে পেছনে আসছে। হঠাৎ একসময় অরিন্দম ইচ্ছাকৃতভাবে গলির ভেতরে ঢুকে পড়ল। সরু অন্ধকার গলিতে পা দিতেই তার পদশব্দ যেন দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসছিল। সে থামল, তবু পেছনে স্পষ্ট শোনা গেল থেমে যাওয়া পায়ের আওয়াজ। বুক ধড়ফড় করতে লাগল তার। অরিন্দম দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল, কিন্তু গলির ফাঁকা অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। মনে হলো যেন ছায়াগুলো খেলে বেড়াচ্ছে, তাকে নিয়ে খেলা করছে। সে দৌড়ে বেরিয়ে এল মূল সড়কে, আর চারপাশের ভিড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বুঝতে পারল, এখন আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মেঘনাদের ডায়েরি তার হাতে এসে পড়ার পর থেকেই ইতিহাস, রাজনীতি আর অদৃশ্য শক্তির এই লড়াইয়ের ভেতরে সে জড়িয়ে গেছে। এই ছায়াগুলো কেবল ভীত করার জন্য নয়, বরং সতর্ক করার জন্যও। কিন্তু সতর্কবার্তা কিসের? কে সেই অদৃশ্য শত্রু, আর কোন শক্তি আজও মেঘনাদের নাম শুনে অস্থির হয়ে ওঠে? উত্তর এখনও তার কাছে অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু ছায়ারা তাকে ছাড়বে না—এটা সে স্পষ্ট বুঝে গেল।
পাঁচ
অরিন্দম আর অনন্যা ডায়েরির প্রথম সাংকেতিক সূত্রটি নিয়ে প্রায় দু’দিন ধরে মাথা ঘামাচ্ছিল। ডায়েরির পাতায় অদ্ভুত কিছু চিহ্ন, কিছু ছেঁড়া শব্দ, আর মাঝখানে আঁকা এক অর্ধেক বৃত্ত—সব মিলিয়ে যেন একটি ধাঁধার মতো গড়েছিল। অনন্যা প্রথমে ভেবেছিল এটি হয়তো নিছকই কোনো অদ্ভুত লেখার অভ্যাস, কিন্তু অরিন্দম বারবার বলছিল—“এগুলো কাকতালীয় নয়। মেঘনাদ ইচ্ছে করেই এভাবে লিখেছে।” কলেজের লাইব্রেরিতে প্রাচীন কলকাতার মানচিত্র ঘেঁটে তারা খুঁজে বের করল, অর্ধেক বৃত্তটি আসলে একটি স্থাপত্যের প্রতীক—শহরের এক পুরনো থিয়েটারের অর্ধচন্দ্রাকৃতি প্রবেশদ্বারের। অনেক খোঁজখবরের পর তারা বুঝতে পারল, এটি সেই থিয়েটার যেটি গত পঞ্চাশ বছর ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, যেখানে নাকি একসময় অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল আর যার ফলে অনেক প্রাণহানি ঘটেছিল। স্থানীয় লোকেরা জায়গাটিকে ‘অপয়া’ বলে এড়িয়ে চলে, কিন্তু অরিন্দমের চোখে তা যেন এক অজানা টান তৈরি করল। অনন্যা প্রথমে একটু ভীত হলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হলো—“যদি সত্যিই সূত্র থাকে, তবে ওখানেই লুকোনো থাকবে।” এক শীতল দুপুরে তারা থিয়েটারের ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়াল—ভাঙা দেয়াল, ছিন্ন পর্দা, আর আগাছায় ঢাকা চত্বর, যেটি যেন অতীতের হাহাকার বয়ে বেড়াচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই কেমন এক অদ্ভুত গন্ধ তাদের নাকে এলো—ধুলো, পচন আর স্মৃতির মিশ্রণ।
ধ্বংসপ্রায় থিয়েটারের ভেতরে প্রবেশ করার পর দুজনেই বুঝতে পারল জায়গাটি শুধু জরাজীর্ণ নয়, যেন অদৃশ্য এক আবরণে ঢাকা। দেয়ালের ফাটল দিয়ে ঢুকে আসা সূর্যের আলো ম্লান হয়ে পড়ছিল, আর চারদিকে ছড়িয়ে থাকা কাঠের টুকরো, পোড়া সিঁড়ি আর ছেঁড়া আসনগুলো নিস্তব্ধতাকে আরও ভারী করে তুলছিল। অরিন্দম ডায়েরির পাতার প্রতীকগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে খুঁজতে লাগল, কোন ভাঙা দেয়ালের দিকে তাকাতে হবে। অনন্যা মাঝে মাঝে বলছিল, “অরিন্দম, তুই কি নিশ্চিত আমরা ঠিক জায়গায় খুঁজছি?” অরিন্দম মাথা নাড়ল—“দেখ, ওই দেয়ালটার অর্ধেক বৃত্তটা মিলে যাচ্ছে না?” দুজনেই এগিয়ে গিয়ে ভাঙা দেয়ালের এক ফাঁকা জায়গা দেখতে পেল। অনন্যার বুক ধড়ফড় করছিল, তবু সে সাহস করে অরিন্দমকে সাহায্য করল কিছু ইট সরাতে। প্রায় আধঘণ্টা কষ্টের পর, তারা একটি পুরনো লোহার বাক্স বের করতে পারল। বাক্সটি মরচে পড়ে ক্ষয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ভেতরে কিছু কাগজ চাপা দেওয়া ছিল। অরিন্দম সতর্কভাবে কাগজগুলো খুলে দেখল, আর সেখানেই তারা পেল দ্বিতীয় সূত্রের ইঙ্গিত। কাগজগুলোর মধ্যে একটি ছিল মেঘনাদের নিজস্ব হাতের লেখা, যেখানে লেখা—“রক্তের বিনিময়ে যা গড়া, তা ভাঙতে পারে না সময়।” বাক্যটি পড়তেই দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। এই লাইনটির গভীরতা বোঝা সহজ ছিল না। অনন্যা ধীরে ধীরে বলল, “এটা কি বোঝাতে চাইছে? কোনো প্রতিশোধ? কোনো পাপ?” অরিন্দম মৃদুস্বরে উত্তর দিল, “হয়তো এই সূত্রই আমাদের পরবর্তী পথ দেখাবে।”
কাগজগুলো হাতে পাওয়ার পর থেকে তাদের মন আরও ভারী হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল, এই যাত্রা কেবল রহস্য উন্মোচন নয়, বরং কোনো অশুভ শক্তির দিকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। থিয়েটার থেকে বের হওয়ার সময় দুজনেই খেয়াল করল, বাইরের বাতাস হঠাৎ যেন ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে, আর ভাঙা দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছিল এক অদ্ভুত লালচে আভায়। অনন্যা হাত চেপে ধরল অরিন্দমের বাহু—“তুই কি লক্ষ্য করলি, অদ্ভুত ঠাণ্ডা লাগছে?” অরিন্দম কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু এখন পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। আমরা সূত্র হাতে পেয়েছি।” তারা বাইরে বেরিয়ে আসার পর দূরে ভাঙা সাইনবোর্ডে ঝুলে থাকা অক্ষরগুলো আবার তাদের চোখে পড়ল, যেন ছেঁড়া অক্ষরগুলোও কিসের যেন বার্তা দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে অরিন্দম বুঝতে পারল, ডায়েরির এই খেলায় ঢুকে পড়া মানে শুধু সূত্র খোঁজা নয়, বরং অদৃশ্য শত্রুর ছায়ার সঙ্গেও লড়াই করা। রাস্তায় ফেরার সময় তাদের মনে হচ্ছিল, কেউ যেন অদৃশ্যভাবে তাদের পিছন থেকে হাঁটছে, নজর রাখছে। অরিন্দম বারবার ঘুরে তাকালেও কাউকে দেখতে পেল না, অথচ সেই ছায়ার উপস্থিতি যেন চারপাশে ছড়িয়ে ছিল। দ্বিতীয় সূত্র তাদের হাতে, কিন্তু সেই বাক্য—“রক্তের বিনিময়ে যা গড়া, তা ভাঙতে পারে না সময়”—শহরের অতীতের অন্ধকার রহস্যের দরজা খুলে দিল, যেটি এখন তাদের পথ আরও ভয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তারা জানত, এই খেলা শুরু হয়েছে মাত্র, আর এখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই।
ছয়
অরিন্দম আর অনন্যা সেই বিকেলে কোলাহলপূর্ণ কলেজ চত্বর থেকে অনেক দূরে চলে এল, শহরের এক পুরনো অংশে। এ অংশে বাড়িগুলো কালো ইঁটের, জানালার কপাটে ধুলো জমে আছে, আর রাস্তার পাশে কুঁচকানো আমগাছগুলো যেন যুগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গন্তব্য ছিল রঘুনাথ মালিকের বাড়ি—এক প্রবীণ বিপ্লবী, যিনি একসময় মেঘনাদের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ছিলেন। লোকটা নাকি এখন প্রায় নির্জনবাসী, কারও সঙ্গ পছন্দ করেন না, বাইরের জগতের সঙ্গ থেকে নিজেকে আলাদা করে রেখেছেন। অরিন্দমের মনে কৌতূহল ছিল, কেন এমন একজন মানুষ, যিনি একদিন গর্জনময় বিদ্রোহের সঙ্গী ছিলেন, আজ নীরবতার দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছেন। অনন্যা ধীরে ধীরে হাঁটছিল পাশে, তার চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা—যেন মেঘনাদের ডায়েরির প্রতিটি অক্ষর তাকে এই মুহূর্তে এনে ফেলেছে। তারা একটি পুরনো লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়াল, যার কপাটে মরচে লেগে আছে। ভেতরে উঠোনে বড় একটি বটগাছ, আর একটি কাঠের দোতলা বাড়ি, যার দেওয়ালে ধূসর দাগ আর ফাটা প্লাস্টার ঝরে পড়ছে। দরজার কাছে গিয়ে অরিন্দম কড়া নাড়ল। কিছুক্ষণ কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, কেবল ভেতর থেকে একটা কাশির শব্দ ভেসে এল। অল্প পরে দরজা ধীরে খুলল, আর বেরিয়ে এলেন রঘুনাথ মালিক—এক বৃদ্ধ, কাঁধে ধূসর শাল, মুখে অগোছালো দাড়ি, চোখে শুষ্ক ক্লান্তি। তিনি অবাক দৃষ্টিতে তাদের দেখলেন, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তোমরা কেন এসেছো আমার কাছে?” অরিন্দম নিজের পরিচয় দিল, বলল তারা মেঘনাদের লেখা ডায়েরি পেয়েছে। নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধের চোখে এক অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল, কিন্তু মুহূর্তেই তা ম্লান হয়ে গেল, যেন তিনি নিজেকে আবার নিয়ন্ত্রণ করলেন।
প্রথমদিকে রঘুনাথ মালিক কথা বলতে একেবারেই রাজি হলেন না। তিনি রূঢ়ভাবে বললেন, “পুরোনো দিনের খোঁজ করো না। সব শেষ হয়ে গেছে, সেই স্বপ্ন, সেই লড়াই, সব কাগজের পাতায় আটকে পড়ে আছে।” অনন্যা চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখের গভীরতায় এমন কিছু ছিল, যা বৃদ্ধের কঠোর হৃদয়েও একটুখানি কাঁপন ধরাল। অরিন্দম ধীরে ধীরে তাকে বোঝাতে লাগল—“আমরা শুধু কৌতূহলী নই, স্যার। আমরা বুঝতে চাই মেঘনাদ আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন, তিনি কেন ডায়েরিতে সেই সূত্রগুলো রেখে গেলেন।” রঘুনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার হাতে কাঁপন ধরা আঙুলগুলো শালের প্রান্ত আঁকড়ে ধরল। তিনি একবার দরজা বন্ধ করার মতো ইঙ্গিত দিলেন, তারপর ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে নিয়ে এলেন। ঘর ভরা পুরোনো বই, সেপিয়া রঙের ফটো, কিছু ছেঁড়া পোস্টার, আর দেওয়ালে টাঙানো হলদেটে মানচিত্র। চৌকাঠের পাশে রাখা ভাঙা লণ্ঠন যেন সেই যুগের আলো-অন্ধকারের প্রতীক। রঘুনাথ তাদের কাঠের চেয়ার টেনে বসতে বললেন, কিন্তু নিজে দাঁড়িয়েই রইলেন জানালার পাশে, যেন বাইরের গলির দিকে নজর রাখছেন। তিনি নিচু স্বরে বললেন, “তোমরা বুঝতে পারছো না, এই প্রশ্নগুলো করলে কারা শুনছে। এখনও তারা আছে—অন্ধকারের ছায়ায়, প্রতিটি পদক্ষেপে।” তার কণ্ঠে ভয়ের সঙ্গে একধরনের গোপন সতর্কতা মিশে ছিল। তারপর ধীরে ধীরে তিনি স্বীকার করলেন যে মেঘনাদ মৃত্যুর আগে কিছু কথাই বলেছিলেন—“বিপ্লব শেষ হয়নি, তা কেবল নতুন প্রজন্মের হাতে পৌঁছবে।” এই কথা বলতে গিয়ে বৃদ্ধের কণ্ঠ থেমে গেল, তিনি কাশতে লাগলেন, যেন অতীতের প্রতিটি শব্দ তার বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয়ে জমে আছে।
রঘুনাথ মালিক শেষমেশ দ্বিতীয় সূত্রের এক আংশিক ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, “ডায়েরিতে তোমরা যে চিহ্নটা দেখেছো—তিনটি অগ্নিশিখার প্রতীক—সেটা কেবল আগুন নয়, সেটা তিনটি স্তম্ভের ইঙ্গিত। তিনজন মানুষ, তিনটি দায়িত্ব, আর তিনটি বিশ্বাস। মেঘনাদ বলেছিল, যদি নতুন প্রজন্ম সত্যিই এগিয়ে আসে, তবে সেই প্রতীকের অর্থ বুঝতে হবে। প্রতিটি স্তম্ভ আলাদা পথে দাঁড়ায়, কিন্তু একসাথে জুড়লেই পথটা সম্পূর্ণ হয়।” অনন্যা গভীর মনোযোগে শুনছিল, তার খাতায় প্রতিটি শব্দ লিখে নিচ্ছিল। অরিন্দমের বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত উত্তেজনা জমে উঠল—যেন তারা এক অদৃশ্য ইতিহাসের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধ তখনই আবার চুপ করে গেলেন, চোখ মেলে তাকালেন বাইরের দিকে। তার ঠোঁটে ভয়াবহ আশঙ্কার ছাপ ফুটে উঠল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “আমি বেশি কিছু বলতে পারব না। অনেক চোখ, অনেক কান এখানে লুকিয়ে আছে। যতটুকু বললাম, ততটুকুই তোমাদের যথেষ্ট।” সেই মুহূর্তে যেন ঘরটা আরও ভারী হয়ে উঠল। বাইরের বটগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছিল, কিন্তু সেই আলোও অদ্ভুত অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। রঘুনাথ মালিক তাদের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললেন, “সাবধান থেকো। তোমাদের পদক্ষেপও তারা দেখছে।” তার চোখের দৃষ্টি যেন হঠাৎ অদৃশ্য কারও দিকে স্থির হয়ে গেল। অরিন্দম আর অনন্যা স্তব্ধ হয়ে গেল, তাদের মনে হল এই বৃদ্ধ মানুষটি শুধু অতীত নয়, বর্তমানেরও এক ভয়ঙ্কর সত্য জানেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় দুজনেরই মনে হল—প্রকৃত খেলার শুরু এখনো হয়নি, আর তাদের প্রতিটি শ্বাস যেন নজরে রাখা হচ্ছে।
সাত
অজয় দত্তের আগমন যেন এক অদৃশ্য ঝড়ের মতো গল্পে ঢুকে পড়ে। কলেজের গ্রন্থাগারের অন্ধকার ঘরে যখন অরিন্দম মেঘনাদের ডায়েরির পাতায় লুকোনো সংকেত খুঁজছে, ঠিক তখনই শহরের প্রান্তে তার আগমনকে ঘিরে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। অজয় দত্ত, যাকে একসময় বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছিল, আজ স্যুট-টাই পরা এক ধনী ব্যবসায়ী, যার নাম শেয়ার বাজার, রিয়েল এস্টেট আর রাজনৈতিক লেনদেনে উচ্চারিত হয়। কিন্তু তার হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর অস্থিরতা। সে জানে, মেঘনাদের গুপ্তধনই তার অতীতের অপরাধকে ঢেকে দিতে পারে এবং বর্তমান সাম্রাজ্যের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। ব্যবসায়িক বৈভব থাকা সত্ত্বেও তার চোখে এক অদৃশ্য দহন—যেন প্রতিদিন আয়নায় নিজেকে দেখলেই অতীতের বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘনাদের ডায়েরি ও গুপ্তধনের খোঁজ তাই তার কাছে শুধু লোভ নয়, বরং অতীতের ভুলকে ঢেকে দিয়ে নতুন করে ক্ষমতার সিংহাসনে বসার শেষ সুযোগ।
অরিন্দম ও তার বন্ধুদের অনুসন্ধানের খবর অজয়ের কানে পৌঁছে যায় এক প্রাক্তন ভাড়াটে গুন্ডার মাধ্যমে, যে আজ তার দেহরক্ষী সেজে তার ছায়ার মতো অনুসরণ করে। রাতের আঁধারে, বিলাসবহুল গাড়ির ভেতর সিগারেট টেনে টেনে অজয় ভাবে—যে মেঘনাদকে সে একসময় নিজের স্বার্থে পুলিশ ও শাসকের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল, সেই মেঘনাদের নামই আজ আবার তার জীবনের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। বিদ্রোহীর রক্তে দাগি হাত দিয়ে গড়া সাম্রাজ্যের ভিত কতটা নড়বড়ে, সেটা সে জানে। তাই গুপ্তধনের খোঁজ তার কাছে শুধু ধনসম্পদ নয়, বরং নিজের অপরাধের ওপর বিজয়ের প্রতীক। তার প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয় হিসেবি নিষ্ঠুরতা—লোক লাগানো, ফোনে গুপ্তচর বসানো, আর কলেজের প্রতিটি ছাত্র-শিক্ষকের চলাফেরার খোঁজখবর নেওয়া। অরিন্দম টের পায় না, কিন্তু কলেজের ভেতর থেকে বাইরের শহর পর্যন্ত তার প্রতিটি পদক্ষেপে লেগে আছে অদৃশ্য চোখের দৃষ্টি। মেঘনাদের ডায়েরির পাতায় যে সংকেত সে পাচ্ছে, ঠিক একই সূত্রের পেছনে ছুটছে অজয়ও—তবে ছায়ার আড়ালে, বিশ্বাসঘাতকের মুখোশ পরে।
এদিকে অজয়ের উপস্থিতি যেন পুরো গল্পের গতি বদলে দেয়। শহরের প্রাচীন আড্ডাঘর, কলেজের গলিঘুঁজি, এমনকি ভাঙাচোরা অডিটোরিয়ামের মঞ্চে যেখানেই অরিন্দম ও তার বন্ধুরা কোনো সূত্র খুঁজতে যায়, অজয়ের প্রভাব সেখানে অদৃশ্য অথচ শীতল ছায়া ফেলে। পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি মিডিয়ার কয়েকজনও তার মুঠোয়—তাদের হাত দিয়ে সে খবর ছড়াতে থাকে, আবার তথ্য সংগ্রহ করে নিজের সুবিধামতো। অথচ বাইরে থেকে কেউ বোঝে না, কারণ সে এখন সমাজসেবক রূপে পরিচিত, অনাথাশ্রমে অনুদান দেয়, বড় বড় হাসপাতালের দাতা বোর্ডে তার নাম ঝলমল করে। কিন্তু এই মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক অতীত—যেদিন আন্দোলনের গোপন বৈঠকের ঠিকানা সে ফাঁস করেছিল, সেদিন থেকে তার নাম মুছে গিয়েছিল বিদ্রোহীদের তালিকা থেকে। আজ সেই পাপের ছায়া যেন তার পেছনে লেগে থেকে তাকে গুপ্তধনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অরিন্দম বুঝতে শুরু করে, শুধু ইতিহাস বা ডায়েরির সংকেতই নয়, এখানে আছে বিশ্বাসঘাতকতার এক দীর্ঘ ছায়া, যা আবার ফিরে এসেছে। আর এই ছায়ার নাম—অজয় দত্ত। তার আবির্ভাবে অরিন্দমদের অনুসন্ধান এক নতুন বিপদের মুখে পড়ে, যেখানে শুধু গুপ্তধনের রহস্য নয়, বরং অতীতের প্রতিশোধ আর বর্তমানের ক্ষমতার লোভ মিলেমিশে তৈরি করছে এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার খেলা।
আট
ডায়েরি হাতে পেয়ে অরিন্দম যতদূর এগোচ্ছিল, ততই সে বুঝছিল মেঘনাদের জীবন কেবল রাজনৈতিক বিপ্লব আর সংগঠনের দ্বন্দ্ব দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়, সেখানে ছিল এক গোপন আবেগ, এক নিঃশব্দ অশান্তি। ডায়েরির পাতায় হঠাৎই একদিন তার চোখে পড়ে ভিন্ন হাতের লেখা। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো মেঘনাদের অগোছালো হাতের লেখা, কিন্তু পরক্ষণেই স্পষ্ট বোঝা যায়—এটা অন্য কারও লেখা। মেঘনাদের পাতাগুলোর ভেতরেই মাঝেমধ্যে এক নতুন কণ্ঠস্বর ঢুকে পড়েছে, কখনও কোমল, কখনও কঠোর, কখনও অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ। সেই কণ্ঠস্বরের লাইনগুলো পড়তে গিয়ে অরিন্দমের মনে হতে থাকে যেন দুইজন মানুষের মস্তিষ্ক, দুটি বিপরীত চিন্তাধারা একই পাতার ভেতর দিয়ে লড়াই করছে। কণ্ঠস্বরটি কখনও মেঘনাদের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করছে, কখনও প্রশ্ন তুলছে, আবার কখনও এমন কিছু নির্দেশ দিচ্ছে যা মেঘনাদের নিজের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। অরিন্দমের বুকের ভেতর শীতল স্রোত বইতে শুরু করে—এ কি তবে মেঘনাদের কোনো অচেনা সহযোদ্ধা, নাকি প্রেমিকা, যার কথা চারপাশে গুজবের মতো ছড়িয়ে ছিল? লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন কোনো অদৃশ্য মঞ্চে নাটক চলছে—একজন বিপ্লবীর কণ্ঠস্বর আর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক অচেনা মানুষ, যার দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুকে বদলে দিচ্ছে। ডায়েরি এখন আর এককথনের জার্নাল নয়, বরং হয়ে উঠছে এক অদৃশ্য সংলাপ, যেখানে কে সত্য বলছে আর কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তা বোঝা প্রায় অসম্ভব।
অরিন্দম সেই পাতাগুলো একে একে পড়তে পড়তে উপলব্ধি করে, এ কেবল সংগঠনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা বা আত্মত্যাগের রোমাঞ্চ নয়, বরং এর ভেতরে লুকিয়ে আছে মানুষের গভীর দুর্বলতা, ভালোবাসা আর প্রতারণার চিহ্ন। নতুন হাতের লেখাগুলো অনেক সময় মেঘনাদের সংকেত ভেঙে দেয়, একেবারে ভিন্ন ইঙ্গিত দিয়ে যায়। যেমন এক জায়গায় মেঘনাদ লিখেছে—“রাতের আড়ালে সেতুর কাছে দাঁড়ালে, আগুনের সংকেত দেখবে।” আর তার ঠিক পরেই সেই অচেনা হাতের লেখা—“সেতুর কাছে যেও না, আগুন তোমারই গিলে নেবে।” এমন বিরোধের ভেতরে দাঁড়িয়ে অরিন্দমের মনে প্রশ্ন ওঠে, আসল নির্দেশ কোনটা? কে প্রকৃতপক্ষে মেঘনাদের উত্তরাধিকার বহন করছে? এই দ্বন্দ্বময় কণ্ঠস্বরের ভেতর থেকে কখনও মেঘনাদের একাকিত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেন সে কারও সঙ্গে নিজেকে ভাগ করতে চেয়েছিল, কিন্তু একই সঙ্গে সেই মানুষ তাকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছিল। কলেজের লাইব্রেরির নিস্তব্ধ কোণে বসে অরিন্দম বারবার পাতা উল্টায়, আর প্রতিবারই তার মনে হয়, কেউ যেন ইচ্ছে করে পথের ভেতরে ফাঁদ পেতে রেখেছে। কণ্ঠস্বরটি তাকে আকর্ষণও করছে আবার একই সঙ্গে সন্দেহও জাগাচ্ছে। অরিন্দম বুঝতে পারছে, সত্যিকারের সূত্র যেমন ডায়েরির ভেতরে লুকিয়ে আছে, তেমনি বিভ্রান্তির জালও রচিত হয়েছে সুচারুভাবে, যাতে উত্তর খুঁজতে গিয়ে পথিক হারিয়ে যায়। তার মনে হতে থাকে, মেঘনাদ কি তবে মৃত্যুর আগেই টের পেয়েছিল যে তার চারপাশে বিশ্বাসঘাতকতা ঘনিয়ে আসছে, তাই সে নিজের লেখা আর অন্য কারও কণ্ঠ মিশিয়ে দিয়েছিল?
সন্ধ্যা নামতেই অরিন্দম ডায়েরি বন্ধ করে কলেজের বারান্দায় দাঁড়ায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার মনে চলতে থাকে এক ভয়ঙ্কর খেলা। দ্বিতীয় কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি তার নিঃশ্বাসকে অস্থির করে তুলেছে। এই কণ্ঠস্বর কেবল অতীতের ইতিহাস নয়, যেন তার বর্তমানকেও স্পর্শ করছে। অনেক সময় মনে হচ্ছে, সেই অচেনা হাতের লেখাই তাকে অনুসরণ করছে, প্রতিটি পাতায় ছড়িয়ে থাকা দোলাচল তার চারপাশের অচেনা ছায়াগুলোর সঙ্গে মিল খুঁজে দিচ্ছে। কে এই লেখক? যদি প্রেমিকা হয়ে থাকে, তবে কেন সে মেঘনাদের বিরুদ্ধে যায়? আর যদি সংগঠনের অন্য কেউ হয়ে থাকে, তবে কি সে পরিকল্পনাকে ভেঙে দিয়ে নতুন এক ষড়যন্ত্রের ভিত গড়েছিল? অরিন্দম বুঝতে পারছে, এই দ্বিতীয় কণ্ঠস্বরের রহস্য না ভাঙলে পুরো ডায়েরির মানে কখনও স্পষ্ট হবে না। সেই কণ্ঠস্বরই হয়তো আসল সত্যকে আড়াল করে রেখেছে, আবার হয়তো সেই কণ্ঠস্বরই আসল পথের দিশা। দ্বন্দ্বময় এই পরিস্থিতি অরিন্দমকে আরও গভীরভাবে ডায়েরির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে, আর তার জীবন ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে মেঘনাদের ছায়ায়। সে জানে না পরের মুহূর্তে কোন লেখা তাকে সত্যের আলোয় পৌঁছে দেবে, আর কোনটি ঠেলে দেবে অন্ধকার বিভ্রান্তির গহ্বরে। ডায়েরির পাতাগুলো এখন কেবল শব্দ নয়, যেন জীবন্ত হয়ে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে—সত্যের কিনারায় কিংবা ধ্বংসের দিকে।
নয়
রাতের অন্ধকারে ঢেকে থাকা শহরের প্রান্তে সেই পুরনো কবরখানার দিকে এগোতে গিয়ে অরিন্দম ও অনন্যার মনে হচ্ছিল, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ তাদেরকে এক অজানা ঘূর্ণিপাকে টেনে নিচ্ছে। মেঘনাদের ডায়েরি থেকে পাওয়া শেষ সূত্রটিই তাদের এখানে নিয়ে এসেছে—এক এমন জায়গায়, যাকে এড়িয়ে চলতে চায় অধিকাংশ মানুষ। ঝোপঝাড়ে ভরা সরু পথ পেরিয়ে যখন তারা ভেতরে ঢোকে, কবরখানার বাতাস যেন জমাট হয়ে যায়, ভারী আর স্যাঁতসেঁতে। মাটির গন্ধ, শ্যাওলায় ঢাকা ভগ্ন সমাধি আর কাকের ডানা ঝাপটানোর শব্দ মিশে তৈরি করেছিল এক ভৌতিক আবহ। অনন্যা আলো জ্বালাতে ফোনের ফ্ল্যাশ ব্যবহার করতেই ভাঙাচোরা ফলকের ওপর ছায়া পড়ল, আর সেই ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি কবর যেন একেকটি শীতল ইতিহাস ফিসফিস করে জানাচ্ছিল। ডায়েরির নির্দেশ মেনে তারা একের পর এক ফলক খুঁজে যাচ্ছিল, কিন্তু কোথাও মেঘনাদের নাম নেই। হঠাৎ অরিন্দমের চোখে পড়ে এক নির্দিষ্ট সমাধিফলক—অন্যগুলোর থেকে ভিন্ন, তার গায়ে খোদাই করা অদ্ভুত এক সাংকেতিক প্রতীক। সে প্রতীক যেন ডায়েরির আঁকায় থাকা অর্ধসমাপ্ত সংকেতের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। অরিন্দম হাত বাড়িয়ে ছুঁতেই মনে হলো ফলকের ভেতরে এক গোপন কম্পন, যেন পাথরের নীচে লুকিয়ে আছে বহুদিনের গোপন রহস্য। অনন্যার চোখে শঙ্কা আর কৌতূহল মিশে ওঠে—এখানেই হয়তো শেষ ধাঁধার উত্তর, কিন্তু সেই সঙ্গে বিপদের আভাসও ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে।
তাদের শঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হতে বেশি দেরি হয়নি। অন্ধকার থেকে হঠাৎ একাধিক ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এলো—তাদের প্রতিপক্ষ, যাদেরকে এতদিন ধরে এড়িয়ে চলছিল অরিন্দম ও অনন্যা। হাতে টর্চ আর লোহার রড নিয়ে তারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। নেতৃস্থানীয় একজন কণ্ঠে বিদ্রূপ মিশিয়ে বলল—“এতদূর এসেও ভাবছো সত্যটা শুধু তোমাদের হাতে থাকবে?” মুহূর্তের মধ্যে কবরখানা পরিণত হলো যুদ্ধক্ষেত্রে। ছায়াগুলোর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হল, সমাধির ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি করে প্রাণপণ লড়াই। বাতাসে ধুলো উড়ল, পাথর ভাঙল, টর্চের আলো এদিক-ওদিক দুলে উঠল। এক পর্যায়ে অরিন্দম লক্ষ্য করল, ফলকের চারপাশে অদ্ভুত খাঁজকাটা জায়গা আছে—মনে হলো যেন মারণ ফাঁদ লুকানো। ঠিক তখনই প্রতিপক্ষের একজন সেখানে পা রাখতেই মাটি ভেঙে নীচে গর্ত খুলে গেল, আর বিকট শব্দে সে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে। অনন্যা বিস্মিত হলেও সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল, এই সমাধিক্ষেত্র শুধুই মৃতদের আবাস নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত গোলকধাঁধা যেখানে প্রতিটি ভুল পদক্ষেপ মৃত্যুর ফাঁদ ডেকে আনে। শত্রুরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেও অরিন্দম ও অনন্যা বুঝল—তাদের সতর্কতার শেষ নেই, কারণ এই ফাঁদ যেমন শত্রুর জন্য, তেমনি তাদের জন্যও প্রাণঘাতী হতে পারে।
তীব্র লড়াইয়ের ভেতরেও অরিন্দমের চোখ বারবার স্থির হচ্ছিল সেই সাংকেতিক প্রতীকে খোদাই করা সমাধিফলকে। সে বুঝল, আসল উত্তর লুকিয়ে আছে ওটার নীচেই। লড়াই চালিয়ে যেতে যেতে সুযোগ বুঝে সে হাত বাড়িয়ে ফলকের নিচের অংশ চাপ দিল, আর হঠাৎই পাথরের স্ল্যাব একপাশে সরে গিয়ে দেখা দিল এক গোপন খোপ। ভেতরে লুকানো ছিল এক পুরনো তাম্রলিপি, যার অক্ষর ম্লান হয়ে এলেও বোঝা যাচ্ছিল—এটাই সেই শেষ সত্য, যা মেঘনাদ চেয়েছিলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই প্রতিপক্ষের নেতা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাম্রলিপি ছিনিয়ে নিতে চাইল, আর শুরু হলো চূড়ান্ত ধস্তাধস্তি। চারদিক কাঁপিয়ে উঠল ধ্বংসের শব্দ, সমাধির ভাঙা পাথর, মানুষের হাহাকার আর মৃত্যুভয়ের আতঙ্ক। অনন্যা বুক চেপে দাঁড়িয়ে ছিল অরিন্দমের পাশে, তার চোখে দৃঢ় বিশ্বাস—যে করেই হোক তাদেরকেই এই ধাঁধার আসল উত্তর রক্ষা করতে হবে। কারণ এটা শুধু একটা ইতিহাস নয়, বরং এমন এক গোপন সত্য যা ফাঁস হলে গোটা সমাজের ভিত্তি কেঁপে উঠতে পারে। ধুলোয় ভরা সেই কবরখানার অন্ধকারে তখন আলো জ্বলজ্বল করছিল তাম্রলিপির পাতায় খোদাই করা প্রতীকগুলোতে, আর অরিন্দম স্পষ্ট অনুভব করছিল—এখানেই তাদের যাত্রার আসল পরীক্ষার শুরু, যেখানে বেঁচে থাকা আর হারিয়ে যাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে শুধু সাহস আর বিশ্বাসই পথ দেখাবে।
দশ
অরিন্দম এবং তার সঙ্গীরা শেষ সূত্রটির রহস্য ভেদ করতে গিয়ে বুঝতে পারে, এতদিন ধরে তারা যে প্রতিটি চিহ্ন আর সংকেতের পেছনে ছুটেছে, তার সবকটিই নিছক অলঙ্কার ছিল না বরং ধাপে ধাপে তাদেরকে নিয়ে এসেছে এই শেষ দরজার সামনে। পুরনো মন্দিরের ভূগর্ভস্থ কক্ষের শীতল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অরিন্দম হাতের টর্চটা তুলে ধরে দরজার গায়ে খোদাই করা চিহ্নগুলো পড়তে থাকে। ঘামে ভিজে গেছে তার শার্ট, কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। কয়েক ঘণ্টা আগে পাওয়া শেষ ধাঁধাটির সমাধান তাকে এনে দিয়েছে এখানে, আর এখন দরজার ভেতরে অপেক্ষা করছে সেই গুপ্তধন, যাকে নিয়ে এতদিন ধরে গুজব, আতঙ্ক আর রক্তক্ষয় চলেছে। দরজার ভেতরে ঢুকতেই বাতাসে এক প্রকারের পচা কাগজের গন্ধ ভেসে আসে—যেন বহু দশক ধরে কোনো মানুষ এই ঘরে প্রবেশ করেনি। টর্চের আলোয় দেখা যায় কাঠের পুরনো সিন্দুক, তার উপরে মরচেধরা তালা, আর পাশে ছড়িয়ে থাকা ধুলো জমা বাক্স। সবাই যখন ধরে নিয়েছিল যে ভেতরে নিশ্চয়ই সোনাদানা আর গহনা অপেক্ষা করছে, তখন তালা ভেঙে সিন্দুক খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা হতবাক হয়ে যায়। ভেতরে নেই কোনো রত্নভাণ্ডার বা মুদ্রা, বরং একগাদা কাগজ, ফাইল, নথিপত্র—যা হলুদ হয়ে গেছে সময়ের ভারে। শুরুতে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু অরিন্দম দ্রুত ফাইলগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারে এ শুধু নথিপত্র নয়, বরং রাজনৈতিক ইতিহাসের গোপন দলিল। প্রতিটি কাগজে লেখা নাম, লেনদেন, তহবিলের উৎস আর খরচের খুঁটিনাটি। এগুলো একসময়কার আন্দোলনের আর্থিক রক্তস্রোত, যেখানে লুকিয়ে আছে ৭০-এর দশকের শহুরে রাজনীতি, শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র বিদ্রোহ আর গোপন তহবিলের আসল উৎসের প্রমাণ।
ফাইলগুলো পড়তে পড়তে অরিন্দম যেন সময় ভেদ করে চলে যায় সত্তরের উত্তাল সময়ে। কাগজগুলোয় লেখা নামগুলো পড়তে গিয়ে চমকে ওঠে—যাদের নাম আজ রাজনৈতিক মহলে একেবারে শীর্ষে, যাদেরকে মানুষ আজ দেবতার মতো মানে, তারা সকলে এই গুপ্ত লেনদেনের অংশীদার ছিল। প্রতিটি পাতায় লুকিয়ে আছে একেকটি বিস্ফোরণ—কে কাকে অর্থ দিয়েছিল, কোথা থেকে অস্ত্র এসেছিল, কোন আন্দোলনকারীর মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা ছিল না বরং সুপরিকল্পিত খুন। প্রতিটি লাইন অরিন্দমকে শিহরিত করে তোলে। সে বুঝতে পারে, এতদিন যেটিকে মানুষ গুপ্তধন ভেবে এসেছে, তা আসলে সোনাদানা নয় বরং অমূল্য ঐতিহাসিক সত্য। এই নথিগুলো যদি প্রকাশ্যে আসে, তবে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রই পাল্টে যেতে পারে। যাদেরকে নায়ক বলা হয়, তারা আসলে বহু ষড়যন্ত্রের নেপথ্যকার। সেইসঙ্গে এই কাগজগুলো আন্দোলনের ত্যাগী যোদ্ধাদের আসল ইতিহাসও প্রকাশ করবে, যাদের নাম ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। অরিন্দমের বুকের ভেতর তখন দ্বন্দ্ব চলতে থাকে—সে চাইলে এগুলো বিক্রি করে বিপুল অর্থ পেতে পারে, কিংবা এই গোপন তথ্য চেপে গিয়ে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু ভেতরের কণ্ঠ তাকে বলে দেয়, এটা তার ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, এটা জাতির সম্পদ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার মতো সত্য। তার চারপাশে থাকা বন্ধুরাও ধীরে ধীরে এই উপলব্ধির সঙ্গে একমত হতে শুরু করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভয়ে শঙ্কিত—কারণ এই সত্য প্রকাশ করলে বড় বড় মানুষের মুখোশ খুলে যাবে, আর তাতে তাদের প্রতিশোধের শিকার হতে পারে অরিন্দম। কিন্তু অরিন্দম জানে, সত্য চেপে রাখা মানে ইতিহাসকে হত্যার সমান।
অরিন্দম দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করে—এই আবিষ্কার কেবল একটি ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, এটা ইতিহাসের পুনর্জন্ম। তার সিদ্ধান্ত একটাই—এই কাগজপত্রকে জনসমক্ষে নিয়ে যাওয়া, গবেষক আর সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেওয়া, যাতে সত্যের আলোয় ধরা পড়ে প্রতিটি নাম, প্রতিটি ষড়যন্ত্র, প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকতা। বন্ধুরা তাকে থামানোর চেষ্টা করে, কেউ কেউ বলে, “তুই বুঝিস না, এরা কারা! এদের বিরুদ্ধে গেলে তোর জীবন তছনছ হয়ে যাবে।” কিন্তু অরিন্দমের চোখে তখন দৃঢ়তার আগুন জ্বলছে। সে জানে, প্রতিটি প্রজন্মের কিছু মানুষকে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে সত্যের পাশে দাঁড়াতে হয়, আর এইবার সেই দায়িত্ব তার উপর এসে পড়েছে। বাইরে তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, মন্দিরের প্রাচীন প্রাচীর ভেদ করে সূর্যের প্রথম কিরণ ঢুকে পড়ছে ভূগর্ভস্থ ঘরে। সেই আলোয় সোনার মতো ঝলমল করছে কাগজগুলো—যেন প্রকৃতি নিজেই বলছে, এটাই আসল গুপ্তধন, জ্ঞানের আলো আর সত্যের প্রমাণ। অরিন্দম সেই নথিগুলো যত্ন করে গুছিয়ে নেয়, তার চোখে তখন ভয় নেই, আছে শুধু এক অদম্য প্রতিজ্ঞা—সে এই গুপ্তধনকে নিজের ভেতরে পুঁতে রাখবে না, বরং পৃথিবীর সামনে তুলে ধরবে। সে জানে, তার এই সিদ্ধান্ত হয়তো তার জীবনে ঝড় ডেকে আনবে, কিন্তু ইতিহাসের সামনে সে সত্যিকার অর্থে একজন সৈনিক হয়ে থাকবে। আর সেই মুহূর্তে অরিন্দমের কণ্ঠ যেন গর্জে ওঠে—“সত্যকেই আমি মুক্ত করব, আর এটাই আমার প্রাপ্ত গুপ্তধন।”
-সমাপ্ত-