শুভদীপ দাস
১
কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর এক কোণে লুকিয়ে থাকা সেই বুথটা আজও দাঁড়িয়ে আছে—একটি মৃত সাক্ষীর মতো, শহরের কোলাহলের মাঝেও তার গায়ে নেমে আছে এক নিস্তব্ধতার আবরণ। রাস্তার পাশে এক পুরনো বাজারের পেছনে, ছোট্ট একটা গলিতে ঢুকলে চোখে পড়ে সেই ভাঙা টেলিফোন বুথটি—যার কাচ অর্ধভাঙা, ভিতরে ধুলো জমে ছাইয়ের মতো বসে আছে, আর তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাগজের ঠোঙা, পচা ফলের খোসা, আর মাঝে মাঝে ভবঘুরে বিড়ালদের বিশ্রামের স্থান। অনেক বছর ধরেই কেউ ওখানে ফোন করতে আসে না, কারও দরকার পড়ে না এমন একটা প্রযুক্তির যা এখন কেবল ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। তবুও, রাত বারোটার পর, ঠিক নির্দিষ্ট একটা সময়ে, সেখানে একটা বাজে ওঠা শব্দ শোনা যায়—একটা মৃত ফোনের ঘণ্টা, যার কোনো সংযোগ নেই। শহরের নিয়মিত পথচারীরা বিষয়টাকে কাকতালীয় বা বাতাসের শব্দ বলে উড়িয়ে দিলেও, কিছু স্থানীয়ের চোখে ছিল আতঙ্ক। অনন্ত সেনগুপ্ত, শহরের একজন প্রতিভাবান ক্রাইম রিপোর্টার, এই বিষয়টা প্রথম শোনে মালবিকা দত্তের কাছ থেকে—তার সহকর্মী, যিনি বলেছিলেন, “তুই বিশ্বাস করবি না অনন্ত, কিন্তু আমি নিজে সেই বুথের সামনে দাঁড়িয়ে শুনেছি… একটা বাজছে, অথচ ভিতরে কোনো ডায়াল টোন নেই, কোনো লাইন-সংযোগ নেই!”। অনন্ত হেসে বলেছিল, “বাতাসে তার ছিঁড়ে গেছে, বা কোনো কারিগরি গোলমাল। সবকিছুর একটা যুক্তি থাকে।” কিন্তু অনন্ত তখনও জানত না—এই যুক্তির বাইরে আরেকটা স্তর আছে, যেটা তার বাস্তবের ভিতকে কাঁপিয়ে দেবে।
অনন্ত রাতে রিপোর্ট ফাইল করে বাড়ি ফিরছিল, যখন সে সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন দুপুরেই বুথটা দেখতে যাবে। তার পত্রিকা অফিস “সত্যসন্ধান” মূলত ক্রাইম, প্যারানর্মাল আর মিথভিত্তিক রিপোর্ট নিয়ে কাজ করে, ফলে একটা অলৌকিক ফোন বুথের কাহিনি নিছক অবাস্তব মনে হলেও রিপোর্টিংয়ের জন্য যথেষ্ট আকর্ষণীয়। পরদিন দুপুরে, মালবিকাকে সঙ্গে নিয়ে, সে পৌঁছয় সেই বুথে। গলিটার ভিতরে বাতাস ছিল অস্বাভাবিক ঠান্ডা, যেন অন্য সময়ের তুলনায় কয়েক ডিগ্রি কম। বুথটার আশপাশে কয়েকজন ফুটপাতবাসী আর একটি চায়ের দোকান ছিল—সেই দোকানের মালিক অম্বুজ ঘোষ একজন প্রাক্তন টেলিফোন কর্মী, যিনি আজ আর দোকান থেকে নড়েন না। “এই বুথ তো একুশ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে বাবু,” সে বলল কাপে চা ঢালতে ঢালতে, “তবে একটা আশ্চর্য কথা বলি? ঠিক বারোটা বাজার পাঁচ মিনিট পর ফোনটা বাজে… এমনভাবে বাজে, যেন ভিতরে কেউ অপেক্ষা করছে।” অনন্ত সেই সময় শুধু মুচকি হেসে ফোনের ছবি তুলছিল, ভিডিও করছিল, ও বুথের ভিতরে হাত দিয়ে দেখছিল কোনো সংযোগ আছে কি না। কিন্তু মালবিকার মুখে ছিল অস্বস্তির ছাপ—তার বিশ্বাস ছিল, এমন কিছু ঘটছে যা শুধু চোখে দেখা যায় না। অম্বুজ হঠাৎ নিচু গলায় বলল, “আমার বউ ঐ ফোন ধরে ছিল একবার… তারপর পাঁচদিন বাদে ট্রাকের নিচে পড়ে গেল। অনেক আগের কথা। পুলিশ বলল দুর্ঘটনা, আমি জানি ও নিজেই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল—জানি কারণ ফোন ধরার পর থেকে সে বদলে গিয়েছিল। চোখে ঘুম ছিল না, মুখে হালকা হাসি, আর একদিন বলল—‘তোমার সময় শেষ… পাঁচ রাত বাকি।’” সেই সন্ধ্যায় অনন্ত সেই বুথের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে রাত বারোটা পর্যন্ত। মালবিকা বারবার অনুরোধ করছিল ফিরে যেতে, কিন্তু অনন্তর মধ্যে কাজ করছিল একধরনের জেদ—না, ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই, সবকিছুর পিছনে ব্যাখ্যা থাকে। রাত বারোটার পর যেন পুরো এলাকা চুপ করে যায়, আশেপাশের কুকুর পর্যন্ত আর ডাকে না। আর ঠিক তখনই, নির্জনতায় বিদ্ধ সেই ক্ষীণ শব্দ—ট্রিঙ্ক… ট্রিঙ্ক… ট্রিঙ্ক…—ভেসে ওঠে সেই মৃত বুথের ভিতর থেকে।
সেই শব্দ অনন্তর শরীর কাঁপিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সে কাঁপা গলায় এগিয়ে গিয়ে ফোনটা তোলে। ফোনের রিসিভার ঠাণ্ডা, অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা, আর এক মুহূর্তের নীরবতার পর, সেই কণ্ঠস্বর—একজনের নয়, যেন অনেকগুলো স্তরের কণ্ঠ একসাথে মিশে আছে, ধীরে, শীতল গলায় বলল, “তোমার সময় শেষ… পাঁচ রাত বাকি।” অনন্ত কিছু বলার আগেই ফোন কেটে যায়। চারপাশে বাতাস যেন হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে ফিরে যায় মালবিকার সাথে, কিছু না বলে, শুধু ফোনের রেকর্ডটা সেভ করে রাখে। রাত কাটে বিভ্রান্তির মধ্যে—ঘুম আসে না, কানে বারবার বাজে সেই কণ্ঠস্বর। পরদিন সকালে পত্রিকা অফিসে গিয়ে সে যখন রেকর্ডটা খুলে প্লে করে দেখায়—সবাই হতভম্ব, কারণ অডিও ফাইলটি সম্পূর্ণ নিঃশব্দ। কোনও শব্দ নেই। অনন্ত তবু নিজেকে বোঝায়—হয়ত কিছু ভুল হয়েছে, হয়ত সে কল্পনা করেছে। কিন্তু সেই রাতেই তার ফ্রিজ খুলে নিজে দেখল ভিতরে রাখা খাবার হিম হয়ে গেছে এক অদ্ভুত মাত্রায়, ফোনে বারবার আসে “ব্ল্যাঙ্ক কল”, জানালার কাঁচে ভোরবেলায় ভিজে হাতের ছাপ—আর তৃতীয় রাতের শেষে সে শুনতে পায় ঘরের ফোন বেজে উঠছে, অথচ ল্যান্ডলাইনের সংযোগ বিগত তিন বছর ধরেই বিচ্ছিন্ন। ততদিনে মালবিকা তার বাসায় আসা বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ সে ভয় পাচ্ছে। অফিসে তার সহকর্মীরা বলে, “তুই ঠিক আছিস তো? দেখছি তুই ঘুমাস না, চোখ কালি পড়ছে।” অনন্ত জানে সে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে—কিন্তু তার জেদ এখন সত্য খোঁজার। বুথে ফিরে যেতে হবে আবার, জানতে হবে কে সেই কণ্ঠ, কেন সে বার্তা দেয়, আর কীভাবে থামানো যায় এই মৃত্যুর দিনপঞ্জি। অনন্ত জানে—এই খেলা আর কেবল কল্পনা নয়, এটি বাস্তব, আর তার সময় হাতে মাত্র দুই রাত।
২
পঞ্চম রাতের আগের সকালটা অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ ছিল অনন্ত সেনগুপ্তর জীবনে। তার ফোনের ঘড়িতে সকাল আটটা বাজলেও ঘরের বাতাসে ছিল গভীর রাতের মতো একটা ভারী অন্ধকার। পাঁচদিনের মধ্যে সে যেন এক অন্য বাস্তবতায় ঢুকে পড়েছে—খাবারের স্বাদ বদলে গেছে, ঘুম ভেঙে যায় রাতে হঠাৎ বুক ধড়ফড় করে উঠলে, আয়নায় নিজের মুখ যেন অচেনা লাগে। মুখের নিচে কালি, চোখের পাতা ভারি, শরীরে কাঁপুনি। মালবিকা ততদিনে তার ফোন তোলা বন্ধ করে দিয়েছে—শেষ রাতে অনন্তর সাথে থাকা, বুথে কণ্ঠস্বর শোনা, আর তার পরদিনই চায়ের দোকানি অম্বুজের রহস্যময় মৃত্যু—সব মিলিয়ে মালবিকা বুঝে গিয়েছিল, এই খেলা এখন যুক্তির বাইরে চলে গেছে। কিন্তু অনন্ত হাল ছাড়েনি। তার ভিতরে গেঁথে বসেছে এক অদম্য সত্য-উন্মোচনের জেদ—যতই ভয় হোক, যতই মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে আসুক, সে শেষ পর্যন্ত খুঁজবে এর পেছনের ইতিহাস। সেই সকালে সে আবার গেল সেই গলির দিকে, একা। গলির পাশের দোকানপাট বন্ধ, রাস্তার কুকুররা এক চিলতে রোদে গা গরম করছে, আর ঐ বুথ—সেই মৃতবৎ দাঁড়িয়ে আছে যেমনটা পাঁচদিন আগেও ছিল। এবার অনন্ত সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল একটা পুরনো পুলিশ ফাইল—যেটা শহরের পুরনো ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুগুলোর রিপোর্ট সংরক্ষিত থাকে। আশ্চর্যের বিষয়, তার মধ্যে অন্তত তিনটি মৃত্যু ছিল এই বুথের সাথে সম্পর্কিত। ২০০২ সালে এক কলেজ ছাত্র, ২০০৯ সালে এক স্কুলশিক্ষিকা, আর ২০১৬ সালে এক ভবঘুরে, যারা সকলেই মাঝরাতে ঐ বুথের সামনে থাকতেন এবং প্রত্যেকেই ফোন ধরার পর পাঁচ দিনের মধ্যে ‘অজানা কারণ’ বা ‘আত্মহত্যা’ বলে রেকর্ডেড মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাদের মৃত্যুর সময় কিংবা স্থান ছিল বিচ্ছিন্ন, কিন্তু সময়কাল ছিল হুবহু একই—পাঁচ দিনের ব্যবধানে।
অনন্ত ফাইল দেখে আঁতকে উঠেছিল—যেমন ভাবে নিজের নামকে ভবিষ্যতের কোনো অনুচ্ছেদে দেখে কেউ আতঙ্কিত হয়। এই মৃত্যু কি শুধুই দৈব ঘটনা, নাকি কোনও অভিশাপ যা ফোনের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে? সে ভাবতে লাগল, যদি ফোনটা সত্যিই বন্ধ থাকে—তবে কণ্ঠস্বর আসে কোথা থেকে? যদি এই বুথ অভিশপ্ত হয়—তবে কে অভিশাপ দিয়েছে? তার মাথায় তখনই একটা নাম আসে—ডলি মুখোপাধ্যায়, সেই স্কুলশিক্ষিকা যিনি ২০০৯ সালে ফোন ধরার পাঁচ দিনের মাথায় নিজের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। অনন্ত খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ডলি দেবীর পরিবারের কেউ এখনও শহরে থাকে—তার ভাই, অর্জুন মুখোপাধ্যায়। অনন্ত সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা করে তার সাথে—এক নিঃসঙ্গ মানুষ, বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, ভাঙা ফ্ল্যাটে একা থাকে। সে ডলির নাম শুনে প্রথমে চুপ করে যায়, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “ডলির মৃত্যুর আগে পাঁচদিন ধরে সে বলত, কেউ তাকে ডাকছে। রাতে ঘুম থেকে উঠে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকত, বারবার ফোন বাজার শব্দ শোনার ভান করত। আমি বলেছিলাম মানসিক ডাক্তার দেখাতে—সে শুধু বলেছিল, ‘আমার সময় শেষ… পাঁচ রাত বাকি।’ আমি ভেবেছিলাম মানসিক চাপ… কিন্তু এরপর সে…।” অর্জুন থেমে গেল, চোখে জলের ছায়া। “সেই ফোন বুথের দিকেই ইশারা করত, বারবার… কিন্তু কেউ বিশ্বাস করত না।” অনন্ত এবার স্পষ্টভাবে বুঝে যায়, কণ্ঠটা একটাই, এবং অভিশাপও একটাই—যেটা বছর বছর মানুষকে টেনে নিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। তবে কে এই কণ্ঠ? আর কেন এই পাঁচ দিনের নিয়ম? অর্জুনের কাছ থেকে সে একটি পুরনো ছবি পায়—ডলি বুথের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে একজন দাঁড়িয়ে—এক অল্পবয়সী যুবক, গায়ে পুলিশের পোষাক, চোখে দৃষ্টি… আর আশ্চর্যের বিষয়, সেই মুখটা একরকম ভাবে অনন্তর মতো দেখতে।
রাত নামার আগেই অনন্ত বুথে ফিরে আসে। আজ পঞ্চম রাত—শেষ রাত। বুথের আশপাশ জনশূন্য, বাতাস ভারী, মোবাইল ফোনে নেটওয়ার্ক আসছে না, আর দূরে কোনো গাড়ির শব্দও নেই। যেন শহর থেমে গেছে এই এক রাতের জন্য। সে ফোনের পাশে দাঁড়িয়ে রেকর্ডার চালু করে, নোটবুকে লিখে রাখে—“আমি অনন্ত সেনগুপ্ত, এই অভিশপ্ত বুথে শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে আছি। যদি কিছু ঘটে, যদি আমি না থাকি—তবে এই রেকর্ড কেউ শুনুক।” বারোটা বাজে। এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পর সেই চেনা শব্দ—ট্রিঙ্ক… ট্রিঙ্ক… এবার অনন্ত একটু দ্বিধায় পড়ে। তার হাত কাঁপে। তবুও সে ফোন তোলে। রিসিভার ঠান্ডা, শব্দহীন। এবার সেই কণ্ঠস্বর বলে, “তুমি এসেছো, অনন্ত। এবার সব জানো… এবার মৃত্যুর পালা।” অনন্ত বলে, “তুমি কে?” উত্তর আসে—“যে একদিন এই বুথে প্রতিশ্রুতি ভেঙেছিল। যে ভালোবাসা দিয়ে প্রতারিত হয়েছিল। এই ফোন প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যু বহন করে… আর এবার তোমার পালা।” হঠাৎ করেই বুথের আলো জ্বলে ওঠে, চারপাশের কাচে ভেসে ওঠে অস্পষ্ট মুখ, আর ফোনটা হঠাৎ গরম হয়ে ওঠে। রিসিভার হাত থেকে ফেলে দেয় অনন্ত। সে বাইরে বেরিয়ে পড়ে, দৌড়ে গলির মুখে পৌঁছয়, কিন্তু সবকিছু ঘোলা, চোখের সামনে ধূসরতা, কানে শোনা যায় অনেকগুলো কণ্ঠস্বর একসাথে বলছে—“শেষ রাত… শেষ রাত… শেষ রাত।”
৩
অনন্ত দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই গলি থেকে, যেন এক অদৃশ্য কিছুর হাত তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সেই বুথের দিকেই, কিন্তু তার ইচ্ছাশক্তি শেষ মুহূর্তে তাকে মুক্তি দিয়েছিল। গলির মুখে এসে সে হাঁপাতে হাঁপাতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঘামে ভিজে গেছে গা, বুকের ভেতর তীব্র এক ধুকপুকানি—কিন্তু তার মাথায় তখনো একটাই শব্দ ঘুরছে: “প্রতিশ্রুতি ভাঙা… প্রতারিত ভালোবাসা…।” এই কণ্ঠস্বর কোনো দৈব আত্মা নয়, কোনো শূন্য থেকে আসা ভয়াবহ অভিশাপও নয়, এর পেছনে আছে কোনো গল্প, কোনো বেদনা, যেটা জমে জমে পরিণত হয়েছে মৃত্যুর ধ্বনিতে। পরদিন সকালে উঠে অনন্ত সিদ্ধান্ত নেয়—সে যতক্ষণ বেঁচে আছে, ততক্ষণ এই কাহিনির শিকড় খুঁজে বার করবে। যেহেতু সে জানে তার সময় ফুরিয়ে এসেছে, আর তার নিজের ছায়াও যেন ধীরে ধীরে হালকা হয়ে যাচ্ছে আয়নায়—তবে তার কাছে আর কিছু হারানোর নেই। প্রথমেই সে যায় কলকাতা টেলিকম মিউজিয়ামে, যেখানে পুরনো বুথ, ফোন, সংযোগ নথিভুক্ত করা আছে। সেখানে রেকর্ড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে পারে, সেই বুথটি ১৯৯৯ সালে স্থাপন হয়েছিল, একটি স্থানীয় এনজিও’র চাহিদায়—যেখানে শহরের নারীরা কম দামে ফোন করতে পারতেন পরিবারের সদস্যদের কাছে। ২০০১ সালের মাঝামাঝি, একদিন সেই বুথের সংযোগ হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়—কারণ, এক পুলিশ অফিসার সেখানেই নাকি আত্মহত্যা করেন, ফোনে দীর্ঘ সময় কথা বলার পর। রিপোর্ট অনুযায়ী তার নাম ছিল সুবীর সাহা, বয়স ২৮, পোস্টিং ছিল গার্ডেনরিচে, এবং মৃত্যুর সময় তিনি ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন। মৃত্যু-পরবর্তী রিপোর্ট বলেছিল আত্মহত্যা, কিন্তু স্থানীয়রা বলেছিল, ফোনে কারও সাথে কথা বলছিলেন তিনি, আর হঠাৎ করেই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে যান সেই বুথের ভেতরেই। এই প্রথমবার অনন্ত এই নামটি শুনে থমকে যায়—কারণ, ডলির পুরনো ছবিতে যে পুলিশ অফিসারকে দেখা যাচ্ছিল, তার মুখ সুবীর সাহার সাথেই মিলে যায়।
অনন্ত তার অফিসে ফিরে আসে, সুবীর সাহার ব্যক্তিগত জীবন ঘেঁটে দেখতে চায় কিছু। পুরনো পত্রিকা, থানার রেকর্ড, এমনকি এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবলের সাহায্যে জানতে পারে—সুবীর সাহা ও ডলি মুখোপাধ্যায় একসময় সম্পর্কে ছিলেন, এবং বিয়ের আগের দিন হঠাৎ করেই সুবীর ডলিকে বিয়েতে রাজি না হয়ে বার্তা পাঠিয়েছিল ঐ ফোন বুথ থেকেই। অনন্ত ধীরে ধীরে বুঝে যায়—সেই রাতেই ডলি ফোন ধরেছিল, এবং তার জীবনও সেই রাত থেকেই বিষাদে ভরে গিয়েছিল। ডলি পাগলের মতো বুথে ফিরত বারবার, সুবীরের কণ্ঠ শোনার আশায়, আর একদিন, পাঁচ রাত পরে সে নিজেই ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল। এই অমীমাংসিত ভালোবাসা, বিশ্বাসভঙ্গ আর অপূর্ণতা—সব কিছু যেন মিশে তৈরি করেছে এক অলৌকিক অভিশাপ। বুথটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেই স্থান যেন হয়ে উঠেছে এক আবেগ, এক ব্যথা আর প্রতিহিংসার সমাধিক্ষেত্র—যেখানে প্রতিটি ফোনকল মানে একটি প্রতিশ্রুতির বিচ্ছিন্নতা আর একটি মৃত্যুর ইঙ্গিত। অনন্ত এবার নিজের নাম ঐ তালিকার মধ্যে খুঁজে পায় না—কারণ সে কেউ প্রতারণা করেনি, তবে হয়তো সেই অভিশাপ নিজের মতো করে শিকার খোঁজে, কণ্ঠস্বর যার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। অনন্ত ভাবে, তবে কি সুবীর সাহার আত্মা এখনো টেলিফোন লাইনের মধ্যে লুকিয়ে আছে? তবে কি সেই প্রতিটি কলের কণ্ঠ সুবীরের, যে প্রতিবার কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, যাতে নিজের ভুলের ভারটা ভাগ করে নেওয়া যায়?
রাত আসে আবার, আর অনন্ত ফিরে আসে সেই বুথের সামনে—এইবার সে ভয় পায় না, বরং তার ভেতরে এক আশ্চর্য শান্তি। সে চায় সুবীর সাহার সাথে কথা বলতে, যদি সম্ভব হয় তার যন্ত্রণার উৎস খুঁজে পেতে। এবার সে একটি পুরনো ক্যাসেট রেকর্ডার সঙ্গে আনে, কারণ ডিজিটাল ডিভাইসে শব্দ ধরা পড়ে না—সেই বুথে কিছু প্রযুক্তি বিকল হয়ে পড়ে থাকে, যেন অভিশাপ নিজেই ডেটা মুছে দেয়। সে ফোন ধরে, এবং ঠিক তেমনি করেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—কিন্তু এবার আর হুমকি নয়, বরং হাহাকার, একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস, আর একটি দুঃখময় স্বীকারোক্তি—“আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম… আমি পালিয়ে গেছিলাম… আর এখন আমি আটকে গেছি এই তারের ভেতর, এই শব্দের লুপে… আমার ভুলের শাস্তি পাচ্ছি… যদি কেউ কথা রাখে, তবে আমি মুক্তি পাবো…” অনন্ত এবার বুঝে যায়, অভিশাপের চাবিকাঠি হলো ‘প্রতিশ্রুতি’। সে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি কথা দিচ্ছি—তোমার গল্প আমি সবাইকে শোনাবো, তোমার ভুলটা শুধু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নয়, সত্য বলার মধ্য দিয়েও মুক্তি পেতে পারে।” ফোনের ওপারে তখন আর কোনো কণ্ঠ নেই, কেবল এক দীর্ঘ নিঃশব্দতা, তারপর হঠাৎ ফোন নিজে থেকে নেমে যায় হুকে। বুথের আলো নিভে যায়, আর বাইরের বাতাস হালকা হয়ে আসে। অনন্ত বাইরে বেরিয়ে দেখে, গলির উপর চাঁদের আলো পড়ছে শান্তভাবে, যেন কোনো অদৃশ্য আত্মা মুক্তি পেয়ে গেছে। রেকর্ডারে সেই কণ্ঠস্বর ধরা পড়েছে—সুবীর সাহার শেষ শব্দ—“তাকে বলো… আমি দুঃখিত।” অনন্ত এবার ফিরে আসে, জানে না সে বেঁচে থাকবে কিনা, কিন্তু জানে অভিশাপের শেষ পর্বটা সে বুঝতে পেরেছে। আর কোনো মৃত্যুর দরকার নেই—শুধু সত্যটা শোনার, আর একবার প্রতিশ্রুতি রাখার।
৪
যে রাতটায় অনন্ত সেই বুথ থেকে ফিরেছিল, সে রাতটি ছিল অবিশ্বাস্যভাবে শান্ত। চেনা পৃথিবীর নিয়মে বর্ণনা করা যায় না এমন এক হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল, যেন শতাব্দীর পুরনো কারাগার থেকে এক আত্মা মুক্তি পেয়েছে। অনন্ত তার বাসায় ফিরে এসে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে চুপ করে ছিল অনেকক্ষণ, দূরে কলকাতার সাদা আলো ছড়ানো ছাদের রেখা, আর মাথার ওপর ম্লান চাঁদ। তার মনে হচ্ছিল, সে কোনো যুদ্ধ জিতে ফিরেছে—নিজের নয়, অন্য কারো পাপের অভিশাপ ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু সে জানত, কাহিনি এখানেই শেষ নয়। প্রতিশ্রুতি ছিল, সে সুবীর সাহার গল্প সবাইকে জানাবে। তাই পরদিন সকালেই সে অফিসে গিয়ে রিপোর্ট বানানো শুরু করে। শিরোনাম দেয়: “একটি মৃত বুথের আত্মদহনের গল্প”। সেখানে সে সব কিছু তুলে ধরে—সুবীর ও ডলির সম্পর্ক, সেই অভিশপ্ত ফোনকল, পাঁচ রাতের নিয়ম, আর শেষে সেই কণ্ঠস্বরের মুক্তির আবেদন। মালবিকা আবার ফিরে আসে তার পাশে—এই রিপোর্ট তারাই একসাথে সম্পাদনা করে, যেন শব্দগুলো কেবল তথ্য বহন না করে, একটা আত্মার প্রার্থনাও শোনায়। প্রকাশিত হওয়ার পর শহরজুড়ে আলোড়ন ওঠে। পাঠকরা বিশ্বাস করে কেউ, কেউ ভাবে নাটক, কিন্তু স্থানীয়রা—যারা ঐ বুথের অদ্ভুত আচরণ নিজের চোখে দেখেছে, তারা জানে এটা নিছক গল্প নয়। এমনকি পুলিশের একটি পুরনো বিভাগ এই রিপোর্ট দেখে নিজেই ফাইল খুলে অনুসন্ধান শুরু করে। সেন্ট্রাল কলকাতার সেই বুথটি রাতারাতি হয়ে ওঠে রহস্যপ্রেমী আর সাংবাদিকদের এক ঘন ভিড়ের কেন্দ্র। কেউ কেউ ফোন তুলতে চায়, কেউ ভিডিও করতে আসে, আবার কেউ কেউ শুধু দাঁড়িয়ে অনুভব করতে চায় সেই ঠান্ডা শ্বাস।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরে, এক রোববার সকালে অনন্ত একটি অদ্ভুত ফোনকল পায়—এক মহিলা, নাম দেয় না, শুধু বলে, “আমি ডলির বোন, তুমি যা করেছো, তার জন্য কৃতজ্ঞ… কিন্তু তুমি জানো না, এটা এখানেই থেমে নেই।” অনন্ত প্রথমে ভাবে এটা হয়তো কারো বানানো নাটক, কিন্তু ওই কণ্ঠে ছিল একটা অদ্ভুত ঠান্ডা সতর্কতা। সে আবার ফিরে যায় সেই বুথের সামনে, এবার রেকর্ডার ছাড়াই। দেখতে পায়, একটি কিশোর ছেলে ফোনের পাশে দাঁড়িয়ে, চোখে ঘোর, কানে হেডফোন, আর হঠাৎ সে ফোন তুলে নেয়। অনন্ত দৌড়ে গিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়, “না! ফোন ধরবি না!” ছেলেটি ভয়ে পেছিয়ে যায়, কিন্তু সে বলে, “ভাইয়া, কেউ একটা বলছিল… আমার নাম নিচ্ছিল… আমি তো জানিই না এই ফোন কাজ করে!” অনন্ত বুঝে যায়, এখানে কিছু নতুন শুরু হয়েছে। সেদিন রাতেই সে নিজে ফোন তোলে, কৌতূহল থেকে, শুধু নিশ্চিত হবার জন্য—কণ্ঠস্বর কি থেমেছে? কিন্তু এবার ফোনে বাজে এক অজানা মেয়ের কণ্ঠ—“তুমি কথা রেখেছো… কিন্তু আমি এখন একা… আমি কোথায় যাবো?” এই কণ্ঠ ডলির হতে পারে, অথবা অন্য কোনো নারীর, যিনি সেই চক্রের পরবর্তী ভিকটিম। অনন্তের গা শিউরে ওঠে—অভিশাপটা কি সুবীর সাহার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল, নাকি এখন ডলির আত্মা শুরু করেছে নিজের খোঁজ, নিজের মুক্তির আহ্বান? এইবার আর পাঁচ রাতের নিয়ম নেই, এবার সময় অগণিত, কারণ কেউ জানে না, কবে এবং কে হতে পারে পরবর্তী ফোনের উত্তরদাতা।
এখন অনন্তের রিপোর্টটি নতুনভাবে ছাপা হয়—“মুক্তি নয়, এক নতুন আহ্বান” নামে। শহর জুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কেউ বলে বুথটা ভেঙে ফেলতে হবে, কেউ বলে সেখানে পূজো দিতে হবে। কিন্তু অনন্ত জানে, একটা আত্মা কখনো পূজোয় শান্ত হয় না, সে চায় সত্য, চায় গল্পটা বলা হোক ঠিকমতো। এক সন্ধ্যায়, মালবিকা বলে, “তুই আবার ফিরবি না তো?” অনন্ত হাসে, বলে, “আমি ফিরেছি… কিন্তু কেউ তো এখনও উত্তর পায়নি।” সেই রাতেই সে শেষবারের মতো বসে একটি চিঠি লেখে—যেটি একটি সম্পূর্ণ বিবরণ, ফোন বুথের ইতিহাস, অভিশাপ, সব। চিঠির নিচে সে লেখে, “যদি আমি হারিয়ে যাই, কেউ যেন সত্যটা ধরে রাখে। কারণ মৃত কণ্ঠ কখনো চুপ করে না… শুধু কান বদলায়।” তার চোখে তখন ক্লান্তি, কিন্তু মুখে ছিল একরকম প্রশান্তি—কারণ সে জানে, এবার গল্প শেষ না হলেও, কেউ অন্তত শুরুটা জানে।
৫
সন্ধ্যা তখন কলকাতার ব্যস্ততার শেষ পর্যায়ে, বাতাসে পাঁপড়ি ও ধোঁয়ার মিশেল, আর শ্যামবাজার মোড়ের ট্রামলাইন ছুঁয়ে আসা আলোয় শহরের ক্লান্তি ঝিমিয়ে পড়ে আছে। অনন্ত সেনগুপ্ত সেই সময় নিজের ডেস্কে বসে দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছিল, যখন একটি মেইল এসে ঢোকে তার ইনবক্সে—বিষয়: “আমি ডলিকে চিনি”। মেইলটি লিখেছেন কেউ একজন—নাম পূর্ণিমা চক্রবর্তী, বয়স ২২, দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। সে লেখে, “আমি একা থাকি না, আমি জানি, আমার পাশে কেউ আছে। গত চার রাত ধরে আমার কানে এক কণ্ঠ বলছে, ‘ভুলটা আমার ছিল…’ আমি আগে ভাবতাম এগুলো মানসিক সমস্যা। কিন্তু এরপর যখন আমি আপনার সেই আর্টিকেলটি পড়ি, তখন বুঝি—যাকে আমি শুনি, সে ডলিই হতে পারে।” অনন্ত প্রথমে দ্বিধায় পড়ে, কারণ সাংবাদিক হিসেবে বহুবার সে নানা অলৌকিক দাবি শুনেছে, বহুবার এগুলো নাটক হয়ে গেছে। কিন্তু পূর্ণিমার চিঠির ভাষায় ছিল কোনও অতিনাটকীয়তা নয়, বরং হালকা আতঙ্ক ও করুণার গন্ধ। সে উত্তর পাঠায়, দেখা করতে চায়। পরদিন দুপুরে, এক ক্যাফেতে পূর্ণিমার সাথে দেখা হয়—এক শান্ত স্বভাবের ছাত্রী, ইতিহাস নিয়ে মাস্টার্স করছে। মুখে অস্পষ্ট ক্লান্তি, চোখের নিচে ঘুমহীনতার দাগ। সে ধীরে ধীরে বলে, “ডলির আত্মা আমার ঘরে আসে না, সে আমার আয়নায় থাকে। প্রতিদিন সকালে আমি উঠে আয়নায় তাকালে তাকে পেছনে দেখি, ছায়ার মতো। প্রথম দিন ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু এখন সে শুধু চায় আমি শুনি। আমি লিখে রেখেছি তার কথা—সে নিজের নাম বলেছে, নিজের গল্প বলেছে… এবং বলেছে, ‘আমার মৃত্যুর কথা আজও ঠিকভাবে কেউ বলে না। আমি কাউকে দোষ দিই না, শুধু চাই কেউ আমার ভুলে যাওয়া কথাগুলো মনে করুক।’”
অনন্ত তখন পূর্ণিমার লেখা খাতা পড়ে। পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে একটি আত্মার একতরফা যন্ত্রণার কথা—যে জীবন স্রোতে ভেসে গিয়েছিল ভালোবাসার একটা অসমাপ্ত যুদ্ধে। সেখানে ডলির গলায় ছিল অভিযোগ নয়, বরং আকুতি। সে চায় না কেউ সুবীর সাহাকে শাস্তি দিক, বরং চায় কেউ তাকে স্মরণ করুক তার মানুষটি হিসাবে—not as “the woman who jumped.” পূর্ণিমার এই বয়ানে নতুন মাত্রা আসে—এটি শুধুই এক বুথের ফোনকলের গল্প নয়, এটি একজন নারীর বিস্মৃত কণ্ঠের আত্মরক্ষা। অনন্ত এবার স্পষ্ট বুঝে যায়, ডলি যেন এখন কাউকে খুঁজছে যে তাকে শুধু স্মরণে রাখবে, ভুলে দেবে না, যেমন শহর ভুলে গেছে। সেই রাতে সে আবার ফিরে যায় বুথের সামনে—এবার আর ফোন ধরার জন্য নয়, বরং এক খোলা ডায়েরি নিয়ে, যেখানে ডলির গল্প, ডলির লেখা, পূর্ণিমার হাতের বর্ণনা—সব একত্র। সে বুথের ভিতর সেই ডায়েরি রেখে আসে, আর জানালার কাঁচে এক লাইন লিখে দেয়—”তুমি কথা দিয়েছিলে, এবার তোমার কথা আমরা রাখবো।” বুথের ভিতর আলো জ্বলে ওঠে কিছুক্ষণের জন্য, হালকা বাতাসে পাতাগুলো উড়ে উঠে আবার স্থির হয়ে পড়ে। সে জানে না, এতে কিছু ঘটবে কিনা, কিন্তু তার মনে হয় ডলি এবার শান্ত হতে পারে। সে ফোন তোলে না, সে শোনেও না কোনও কণ্ঠ, শুধু বুথের ভিতরে নেমে আসে এক হালকা নীলাভ আলো, আর বাতাসে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পাঁপড়ি আর ছেঁড়া কাগজের—যা হয়ত এক আত্মার মুক্তির ছায়া।
তবে সব কিছু এত সহজে থেমে যায় না। এক সপ্তাহ পর, পূর্ণিমা আবার যোগাযোগ করে। এবার কণ্ঠটা পাল্টে গেছে। আয়নায় আর ডলিকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু প্রতিটি ঘড়িতে সে শুনছে এক নতুন আওয়াজ—একজন ছেলের গলা, কণ্ঠে ধমক নয়, বরং অনুনয়, “ডলি… এবার আমাকেও যেতে দাও।” অনন্ত আঁচ করে, সুবীর সাহার আত্মা এখন মুক্ত নয়—তাকে আটকে রেখেছে হয়ত অপরাধবোধ, কিংবা ডলির অপ্রকাশিত ক্ষমা। এবার কাহিনির মোড় ঘুরে যায়। হয়ত তারা দু’জনেই আটকে পড়েছে এক পেন্ডুলামের মতো চক্রে—প্রতিশ্রুতি, ব্যথা, দুঃখ আর অপেক্ষার বন্ধনে। অনন্ত ভাবে, তবে কি এবার তার কর্তব্য এই দুই আত্মাকে একত্র করানো? তবে কি ফোনবুথটি শুধু এক মৃত্যুর স্মারক নয়, বরং দুটি জীবনের অসমাপ্ত মিলনের মধ্যবর্তী স্থান? সে এবার সিদ্ধান্ত নেয়—ডলির পুরনো বাড়িতে যাবে, সেই ঘরে যা এখনো অন্ধকারে ঢাকা, সেই জানালায় যা একদিন দৃষ্টি রেখেছিল এক প্রতীক্ষমান নারী। সে জানে, এখন আর মৃতরা ভয় দেখায় না—তারা চায় শুধু কেউ তাদের গল্প শেষ করে দিক। আর সেই কাজটাই অনন্ত করে যাবে, যতদিন না মৃত কণ্ঠগুলো শান্ত হয়ে যায় চিরতরে।
৬
ডলির পুরনো বাড়িটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে বালিগঞ্জের এক চুপচাপ গলিতে—চারদিকে বহুতল উঠলেও সেই দোতলা পুরনো কাঠ-লোহার ফ্ল্যাটের বাইরের দেয়ালে জমেছে কালো ছাঁচ, রেলিংয়ের কাঁটাতারে চড়া লতানো গাছ। পাশের ফ্ল্যাটগুলোর মানুষজন নতুন, ডলির নাম শুনলে যেন কাঁধ ঝাঁকায়—“ওই বাড়ির মেয়েটা? ঝাঁপ দিয়েছিল না?” কেউ বলে শীতে, কেউ বলে গরমে। অথচ কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই কারও মনে, কেবল একজন ছাড়া—ডলির ভাই অর্জুন মুখোপাধ্যায়। অনন্ত তাকে ফোন করে বলে, “আমি ডলির গল্প লিখছি, তবে শেষ করতে পারছি না। তার ঘরটা একবার দেখতে চাই। অনুমতি দেবে?” দীর্ঘ নীরবতার পর অর্জুন শুধু বলে, “চাবিটা পুরনো আলমারির পেছনে রাখা ছিল, আমি রেখে এসেছিলাম… যদি দরকার হয়, গিয়ে নিয়ে নাও।” সেই বিকেলেই অনন্ত সেখানে যায়। বাড়ির মেইন গেট তালাবন্ধ, কিন্তু পাশের এক পুরনো কেয়ারটেকার তাকে চিনে নেয়—সংবাদপত্রে তার মুখ বারবার দেখে অভ্যস্ত। চাবি পাওয়ার পর অনন্ত ঘরের দরজা খোলে, আর ভেতরে ঢুকতেই এক পচা ধুলোর গন্ধ, পুরনো আসবাবের কর্কশ শব্দ, আর একধরনের ঠান্ডা অন্ধকার তার দিকে ছুটে আসে। ডলির ঘর ছিল বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণায়, যেখানে জানালার গা ঘেঁষে পড়ত সকালের আলো—অথচ এখন জানালার কাচে জমে আছে মরচে, পেছনে ধুলোমাখা পর্দা।
ঘরে ঢুকেই সে লক্ষ্য করে, দেওয়ালে এখনও লাগানো কিছু পোস্টার—রবীন্দ্রনাথের কবিতা, একটি পুরনো ব্যালে ফেস্টিভালের সিডিউল, আর একটি ছোট ফ্রেমে ডলির নিজের হাতে লেখা একটি চিঠির অংশ—“আমি কারো জন্য অপেক্ষা করিনি, আমি শুধু চেয়েছিলাম কেউ কথা রাখুক।” বিছানার নিচে ধুলো ঝেড়ে একটি বাক্স পায়, যার ভিতরে পুরনো পত্রিকা, কলেজের রেজাল্ট কার্ড, আর কয়েকটি সাদা খাম—অধিকাংশই খালি, তবে একটিতে লেখা, “ডলি, যদি একদিন ভুল বুঝে ফিরে আসিস, তবে জেনে নিস… আমি এখানেই আছি।” হ্যান্ডরাইটিং পুরুষের, নিঃসন্দেহে সুবীর সাহার। কিন্তু সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কার হয় জানালার নিচে—ফ্রেমের পাশে লুকানো ছোট্ট ফাঁকা জায়গায়, কাঠের প্যানেলের নিচে গুঁজে রাখা একটি চিঠি—হাতের লেখা কাঁপা, হিন্দি ও বাংলা মিশ্র, যেন কেউ নিজের অনুভূতি লেখার জন্য ভাষার গন্ডি ভুলে গেছে। চিঠিতে লেখা—“আমি চাইনি ও যাক। আমি শুধু চেয়েছিলাম সময়। কিন্তু আমি জানতাম না, আমার নীরবতাই ওকে শেষ করে দেবে। আমি ফোন করেছিলাম… বলেছিলাম, ‘আমার সময় লাগবে’। ও কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়। তারপর আমি আর সাহস পাইনি। আজ রাতেও যদি ও ফিরে আসে… আমি বলব—‘আমি দুঃখিত, আমি ভয় পেয়েছিলাম।’” চিঠির নিচে কোনও নাম নেই, কিন্তু লেখার ভঙ্গিতে স্পষ্ট যে এটি সুবীর লিখেছিল—হয়তো সেদিনই, অথবা ডলির মৃত্যুর পরে, এক অব্যক্ত অনুশোচনায়।
অনন্ত চিঠিটি পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে জানে, এই কাগজের টুকরোই পারে দুই আত্মার মুক্তি ঘটাতে—এটা প্রমাণ নয়, এটা ক্ষমা। সে চিঠি নিয়ে ফিরে আসে বুথের সামনে, আর সাথে নেয় পূর্ণিমাকে—যে এখনও মাঝে মাঝে আয়নায় ভেসে ওঠা ছায়ার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, ঠিক যেন জানে সেই নারী একদিন মাংস-মজ্জার ছিল। সেই রাতে তারা একসাথে দাঁড়িয়ে থাকে বুথের সামনে। অনন্ত চিঠিটা পড়ে শোনায়—সেই কাঁপা কণ্ঠে লেখা আত্মবিনাশের স্বীকারোক্তি। বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, আশেপাশে কেউ নেই, কেবল ভাঙা ফোনবুথের কাচে প্রতিবিম্বে দেখা যায় দুটো ছায়া—একটা ডলির, আরেকটা সুবীরের মতো। তারা কোনও শব্দ করে না, কেবল দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি। তারপর ফোনটা একবার বাজে, ট্রিঙ্ক… আর থেমে যায়। অনন্ত ফোন ধরে, ওপার থেকে আসে একটি শান্ত কণ্ঠ, “এইবার আমি বুঝেছি… তুমি আমাদের কথা রেখেছো।” তারপর নিঃশব্দ, ফোন নিজে থেকেই কেটে যায়। পূর্ণিমার চোখে জল, সে ফিসফিস করে বলে, “আয়নাটা আজ প্রথমবার একেবারে পরিষ্কার।” তারা দুজনে বুঝে যায়, এই অভিশাপের শেষ শব্দ হয়ে গেছে। শহরের বুক থেকে মুছে গেছে এক অদৃশ্য বোঝা, আর সেই বুথ—সেই পুরনো, ধুলো ধরা ভাঙা কাঁচের ঘর—এখন শুধু এক স্মারক, যেখানে কথা ফুরিয়েছে, আর কণ্ঠ হারিয়ে গেছে বাতাসে।
৭
অনন্ত ভেবেছিল সব শেষ হয়ে গেছে। ডলির চিঠি, সুবীরের স্বীকারোক্তি, পূর্ণিমার আয়নার ছায়া মুছে যাওয়া—সব মিলিয়ে যেন শহরের বুক থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল। “মৃত টেলিফোন” নিয়ে তার লেখা সিরিজ জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়, বহু মানুষের প্রশংসা আসে। কেউ বলে, সত্যিই অলৌকিক, কেউ বলে নিছক কাকতালীয়। অনন্ত এসবের পেছনে আর যায় না। সে এখন নিজের লেখালিখিতে মন দিয়েছে, মাঝে মাঝে পূর্ণিমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়, যেন তারা দুজনেই এক অভিজ্ঞতার পরস্পর—যা অন্যরা কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু ঠিক এক মাস পর, এক অদ্ভুত দিন আসে। দুপুরে অনন্তর কাছে একটি ডাকে একটি মোটা খাম আসে—প্রেরক অনির্দিষ্ট, ভিতরে একটি মাত্র চিঠি, যেখানে শুধু লেখা—“ডলির ফোন তুমি থামালে, কিন্তু অন্য কণ্ঠ অপেক্ষা করছিল। পাঁচ রাত বাকি…”। চিঠিতে কোনও নাম নেই, কালি ছড়িয়ে গেছে, যেন কেউ তাড়াহুড়োতে লিখেছে। অনন্ত প্রথমে ভাবেছিল কেউ তার লেখার প্রভাব নিয়ে খেলছে, কিন্তু ঠিক তখনই তার ফোন বেজে ওঠে। অজানা নম্বর। সে ধীরে ধীরে ফোন তোলে, ওপাশে কোনও শব্দ নেই, শুধু হালকা নিঃশ্বাসের মতো কিছু। সে ‘হ্যালো’ বলতেই ফোন কেটে যায়। তখনো সে ঘাবড়ে যায় না—নিজেকে বোঝায়, হয়তো কাকতালীয়, হয়তো কেউ মজা করছে।
কিন্তু রাত যত গড়াতে থাকে, চারপাশ যেন আবার সেই পুরনো অনুভূতিতে ডুবে যেতে থাকে। ঘরের বাতাস ভারী, আয়নায় প্রতিবিম্ব অস্পষ্ট, ল্যাম্পের আলো মাঝে মাঝে দপ করে নিভে যাচ্ছে। পঞ্চম রাতের আগে ঠিক যেমনটা হত—অনন্তের মনে পড়ে। সে উঠে বসে, পূর্ণিমাকে ফোন করে সব জানায়। পূর্ণিমা এবার প্রথমবারের মতো চুপ করে যায়, তারপর বলে, “গতরাতে আমার ঘরের সামনে একটা আওয়াজ শুনেছিলাম, যেন কেউ খুব ধীরে জানালায় হাত বোলাচ্ছে। আমি ভয় পাইনি, কিন্তু জানি, এটা ডলি নয়। এই ছায়া… অন্য।” অনন্ত এবার বুঝে যায়, কণ্ঠ হয়তো ডলির ছিল না শেষ পর্যন্ত। হয়তো অনেক কণ্ঠ এই বুথের মধ্যে আটকে ছিল, যার একটিকে সে সাহায্য করেছে মুক্তি পেতে—বাকি সবাই? তারা তো এখনও প্রতীক্ষায়। সে এবার নিজের অফিসের পুরনো আর্টিকেলগুলো খুঁজে, সেখানে আরও তিনটি মানুষের কথা ছিল যারা মৃত্যুর আগে সেই বুথের সামনে দেখা গিয়েছিল—তাদের কেউই সুবীর বা ডলির সময়ের ছিল না। তাহলে? তাহলে কি সেই ফোনবুথ শুধুই ডলির স্মৃতি নয়, বরং এক কালো দরজা—যার ভিতর আছে অনেক অনুতপ্ত আত্মা, পরিত্যক্ত প্রতিশ্রুতি আর অসমাপ্ত সম্পর্কের আওয়াজ?
পঞ্চম রাতের সন্ধ্যায়, অনন্ত নিজেকে প্রস্তুত করে। সে জানে এবার সে কেবল কাহিনির লেখক নয়, সে এখন এক অংশ, এক শ্রোতা। সে আবার সেই বুথে যায়—বাইরের লোকজন এখন আর আসে না, শহর এই গল্প ভুলতে শুরু করেছে, নতুন ট্রেন্ড, নতুন খবর এসে গেছে। কিন্তু বুথ ঠিক আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে—নির্জন, ধুলোমাখা, কাচে কেবল নিজের ছায়া। সে ভেতরে ঢোকে, রেকর্ডার নিয়ে নয়, কেবল একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে। ফোন নিজে থেকেই বেজে ওঠে। ট্রিঙ্ক… ট্রিঙ্ক… এবার সে দ্বিধাহীন ভাবে ফোন তোলে। ওপারে আসে এক পুরুষ কণ্ঠ—চেনা নয়, স্নিগ্ধ নয়, বরং ধীর, গভীর আর ভয়াবহভাবে শান্ত। “তুমি ভাবছো সব শেষ… কিন্তু আমি অপেক্ষা করছি সেই দিনের জন্য, যেদিন কেউ আমায় ভুলে যাবে না। আমার নাম নেই, মুখ নেই, শুধু একটা আক্ষেপ… যা এই ফোনে রয়ে গেছে।” অনন্ত এবার প্রশ্ন করে, “তুমি কে?” জবাব আসে, “যে কথা বলতে পারেনি। যে ভালোবেসেও চুপ ছিল। আমি সেই সব কণ্ঠ, যারা একটা শেষ সুযোগ চায়।” ফোন কেটে যায়। মোমবাতির আলো নিভে যায় হঠাৎ। এবং সেই মুহূর্তে, অনন্তর মনে হয়, এই কাহিনি শেষ হয়নি—এটি কেবল নতুন করে শুরু হল।
৮
দুইদিন পেরিয়ে গেছে সেই ফোনকলের পর, কিন্তু অনন্তের ঘুম আর আগের মতো ফিরছে না। মাথার ভিতরে সারাক্ষণ সেই কণ্ঠটা ঘুরে—”আমি সেই সব কণ্ঠ, যারা একটা শেষ সুযোগ চায়।” সে বুঝে গেছে, ডলি আর সুবীরের অভিশাপ হয়তো মুক্ত হয়েছে, কিন্তু সেই বুথ শুধুমাত্র তাদের গল্পের সমাধিক্ষেত্র নয়—এটি যেন এক জমে থাকা আত্মার ভাণ্ডার, যেখান থেকে এক একটি কণ্ঠ সময় মতো জেগে ওঠে, নিজের ব্যথা জানান দেয়, আর আবার হারিয়ে যায় বাতাসে। অনন্ত ঠিক করেছিল কিছুদিন লেখালেখি থেকে ছুটি নেবে, মাথা হালকা করবে। কিন্তু সেদিন সকাল ১১টা নাগাদ, তার কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে এক আশি বছরের বৃদ্ধা—সাদা শাড়ি, ছোট গড়ন, কাঁপা কাঁপা পা, কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা। বৃদ্ধা বলেন, “আপনি অনন্ত সেনগুপ্ত?” সে মাথা নাড়তেই তিনি চুপচাপ একটি চিঠির খাম তার হাতে দিয়ে বলেন, “এই চিঠি আমার ছেলে পাঁচ বছর আগে লিখে রেখে গিয়েছিল, মৃত্যুর আগের রাতে। সে বলেছিল, আমি যেন কাউকে না দিই। কিন্তু এখন আমি জানি, আপনিই পারেন ওর মৃত্যুর সত্যিটা সামনে আনতে।” অনন্ত ভেতরে বসতে বলে, বৃদ্ধা নাম বলেন—মীরা নন্দী, তার ছেলে ছিল অনিকেত নন্দী, একসময় শহরের নামী কলেজের ছাত্র, নাটকের সাথে জড়িত, ২০১৮ সালে হঠাৎ হারিয়ে যায়। পরে তার মৃতদেহ উদ্ধার হয় হাওড়ার এক খালের পাশ থেকে, মাথায় গুরুতর আঘাত, পুলিশের রিপোর্ট: আত্মহত্যা।
অনন্ত চিঠিটা খোলে, ছেলেমানুষি হ্যান্ডরাইটিং—কিন্তু শব্দে তীব্র আতঙ্ক: “মা, যদি আমি আর ফিরি না, তবে বুঝে নিও, আমি যা বলছিলাম সত্যি। আমি সেই ফোন বুথে গিয়েছিলাম, যেখানে পুরনো কথাগুলো আটকে থাকে। সেখানে একটা মেয়ের কণ্ঠ আমাকে ডেকেছিল—নাম বলেছিল না, কিন্তু সে বলছিল, আমি তার কথা শুনেছি, তাই আমাকে যেতে হবে। আমি জানি না এটা স্বপ্ন, না পাগলামি… কিন্তু আমি জানি, আমি ফিরে আসব না।” চিঠি পড়ে অনন্ত স্তব্ধ। ডলি কিংবা সুবীরের নাম নেই, বরং এক অনামিকা নারী কণ্ঠ—যে হয়তো ডলির আগের, বা তারপরে সেই বুথে বন্দি হওয়া অন্য কেউ। মীরা নন্দী কাঁদতে কাঁদতে বলে, “পুলিশ বিশ্বাস করেনি, বলেছিল প্রেমঘটিত বিষণ্নতা। কিন্তু আমি জানি, ও খুব সাহসী ছিল। কিন্তু সেই বুথে যাওয়ার পরই সে বদলে গিয়েছিল।” অনন্ত এবার স্পষ্ট বুঝে যায়—বুথটি যেন আত্মাদের এক প্রাচীন আকর্ষণস্থল, যেখান থেকে কিছু একটা—হয়তো মৃত নয়, বরং এমন কিছু যা বেঁচে থাকা মানুষের কণ্ঠ ব্যবহার করে তাদের ভেতরের শূন্যতায় প্রবেশ করে, আর নিয়ন্ত্রণ করে মন ও সিদ্ধান্ত। এবং সেই সত্তা হয়তো এক নয়, অনেকগুলো—ডলি একটিমাত্র আত্মা ছিল, কিন্তু আরও বহুজন আটকে আছে এই শব্দ-শূন্য চক্রে।
সন্ধ্যায় অনন্ত সেই বুথে আবার যায়—মাঝে মাঝে আশপাশে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ দূর থেকে ছবি তোলে, কিন্তু কেউই আর ফোন ধরার সাহস করে না। বুথের কাচে এখনও লেখা আছে পুরনো বাক্য, “তুমি কথা দিয়েছিলে, এবার তোমার কথা আমরা রাখবো।” কিন্তু এবার সে দেখে, জানালার কাচে খোদাই করে লেখা এক নতুন লাইন—“এবার আমি বলবো।” এই লাইনটা আগে ছিল না। অনন্ত বুথের ভেতরে ঢোকে, ফোনটা নীরব, আলো নিভে থাকা। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই ফোন নিজে থেকেই বাজে ওঠে। সে ধীরে ধীরে ফোন তোলে—আর ওপারে আসে এক নারীকণ্ঠ, ঠান্ডা, স্থির, কিন্তু তীব্রভাবে অচেনা—“তোমার লেখা দিয়ে তুমি অনেককে কথা বলতে দিয়েছো… এবার আমি বলবো।” অনন্ত কাঁপা কণ্ঠে বলে, “তুমি কে?” কণ্ঠটা হাসে, “আমি সেই যাকে কেউ চেনে না, নাম নেয় না, মুখ মনে রাখে না। আমি সেই, যার কথা আটকে থাকে বাতাসে… আর এখন আমি কাউকে খুঁজছি, যে আমার গল্প লিখবে।” ফোনটা আবার নিঃশব্দ হয়ে যায়, কেবল কাচে নিজের প্রতিবিম্বে অনন্ত দেখতে পায় পেছনে এক ছায়া—নারীর, কিন্তু চোখহীন, মুখহীন। সে বুঝে যায়—এই কাহিনি নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। এবার আর শুধু মুক্তি নয়, এবার কেউ নিজের কণ্ঠ চাইছে ফিরে পেতে। আর সেই কণ্ঠের জন্য সে যে কতদূর যাবে, তা হয়তো এই শহর এখনও জানে না।
৯
যে কণ্ঠটি বলেছিল, “এবার আমি বলবো”, তার মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক কর্তৃত্ব, যেন শহরের সব হাহাকার জমে একটি আত্মায় রূপ নিয়েছে। অনন্ত প্রথমে ভাবছিল হয়তো এটি অন্য কোনো আত্মার বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু যত বেশি সময় যায়, ততই স্পষ্ট হতে থাকে—এটি কোনো ব্যক্তি নয়, বরং একটি “ভুলে যাওয়া আত্মার” চেতনা। এক সন্ধ্যায় কলকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পুরনো অপরাধ ও অজ্ঞাত মৃত্যুর রেকর্ড খুঁজতে গিয়ে সে একাধিক রহস্যময় ঘটনায় হোঁচট খায়—১৯৭৪, ১৯৮২, ১৯৯১… প্রত্যেক দশকে কেউ না কেউ ঐ ফোন বুথের আশেপাশে অদ্ভুত পরিস্থিতিতে নিখোঁজ হয়েছিল, মৃত্যুর আগে কোনো ফোনকলের কথা বলেছিল, কিংবা কারো কণ্ঠ শুনে আতঙ্কে চুপ মেরে গিয়েছিল। অনন্ত খেয়াল করে, প্রত্যেক ঘটনায় একটি বিষয় কমন—তারা কেউই পরে শহরের ইতিহাসে জায়গা পায়নি। নাম ছিল ফাইলের শেষ লাইনে, অথবা ভুল করে অন্য পরিচয়ে সংরক্ষিত। সে তখন বুঝতে পারে, সেই ‘কণ্ঠ’ আসলে ঐ সব নামহীন, মুখহীন মানুষদের সমষ্টিগত আর্তি—যারা চেয়েছিল কেউ একবার বলুক, “তোমার কথা আমরা মনে রেখেছি।” ফোনবুথটি হয়তো একধরনের শব্দ-স্মৃতির পাত্র হয়ে উঠেছে, যেখানে হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠগুলি জমা হয়… তাদের নাম না থাকলেও ব্যথা ছিল ঠিক ততটাই তীব্র।
এক রাতে, অনন্ত আবার বুথে গিয়ে একটি কাজ করে—সে তার নিজের লেখা রিপোর্টগুলোর ছাপা কপি কেটে কেটে বুথের ভিতরে টাঙিয়ে দেয়, যেন সেই কণ্ঠগুলোর কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দিতে পারে—তাদের গল্প কেউ বলেছে, কেউ লিখেছে, কেউ মনে রেখেছে। সে খেয়াল করে, বুথের কাচে এবার এক নতুন ছায়া দেখা যাচ্ছে—এক নারীর, কিন্তু এ যেকোনো এক আত্মা নয়, বরং যেন অসংখ্য আত্মার সমষ্টি হয়ে তৈরি এক রূপ। সে ফোন তোলে, এবার কোনো কথা নয়, বরং অনেকগুলো overlapping কণ্ঠ একসাথে বলে—“তুমি শোনো, লিখো, কিন্তু এবার আমাদের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নাও, যে কথা বলবে সবার হয়ে।” এইবার কণ্ঠে ছিল আবদার নয়, বরং এক অন্তিম আহ্বান। অনন্ত ভাবে, যদি সে পারত একজনকে খুঁজে বের করতে, সেই প্রথম আত্মাকে, যে প্রথম ফোন ধরেছিল, যার কারণে এই চক্র শুরু। সে থানায়, লাইব্রেরিতে, সংবাদপত্রের পুরনো রিপোর্টে খোঁজ নিতে থাকে। একদিন হঠাৎ সে পায় একটি অস্পষ্ট রিপোর্ট— ১৯৭১ সালের জুন মাসে, এক ‘জয়া রায়’ নামের মেয়েকে শেষবার দেখা যায় সেই গলির কাছেই, এবং সে নাকি এক ফোন বুথের ভেতর ঢুকে দীর্ঘ সময় ধরে কারো সাথে কথা বলছিল… তারপর তাকে আর কেউ কখনও দেখেনি। কোনো মৃত্যুর প্রমাণ নেই, কোনো দেহও পাওয়া যায়নি। কেস ফাইল ক্লোজড। অনন্ত নিশ্চিত হয়—এই জয়া রায়ই সেই প্রথম কণ্ঠ, যার নাম ভুলে গিয়েছিল শহর, যাকে কেউ খুঁজেও বের করেনি।
তবে তাকে খোঁজা মানে এখন শুধু তার তথ্য জোগাড় নয়, বরং সেই আত্মাকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে তাকে ‘আবরণ’ দেওয়া। সে শহরের এক পুরনো কবরখানায় গিয়ে একটি অচিহ্নিত সমাধিফলকের সামনে দাঁড়ায়—সেখানে কেউ নাম লেখেনি, শুধু লেখা ‘অজানা নারী, ১৯৭১’। অনন্ত সেখানে বসে তার ডায়েরিতে লিখে, “তোমার নাম জয়া রায়, তুমি হারিয়ে যাওনি, তুমি আমাদের কণ্ঠের গভীরে আছো, আমরা তোমাকে মনে রেখেছি।” সেই মুহূর্তে বাতাস থেমে যায়, গাছের পাতা ঝরে পড়ে মাটিতে, আর তার ফোন নিজে থেকেই রিং করে। সে তাড়াতাড়ি ফোন তোলে, ওপার থেকে একটাই লাইন—“আমার নাম মনে পড়েছে, এবার বাকিরা মুক্তি পাবে।” তারপর সব চুপচাপ। সেই রাতে বুথে গিয়ে সে দেখে, সব কাচে আগের ছায়াগুলো মুছে গেছে, শুধু একদম মাঝখানে লেখা একটি লাইন—“তুমি যাকে মনে রাখো, সে কখনো সত্যিই মরে না।” অনন্ত বোঝে, গল্পের শেষ পর্ব এবার শুরু হয়েছে। এই শহর, এই ফোনবুথ আর এই সব কণ্ঠ—সবই জেগে ওঠে শুধু মনে রাখার আকাঙ্ক্ষায়।
১০
শহর আবার নিঃশব্দ হয়েছে, যেন বহুদিন পর কোনও ভার নেমে গেছে বুক থেকে। সেই রহস্যময় ফোনবুথ এখনো দাঁড়িয়ে আছে আগের মতো, কিন্তু তার গায়ে আর ছায়া পড়ে না, কাচে আর কুয়াশা জমে না, রাত্রিবেলায় আর হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে না। স্থানীয় মানুষরাও যেন ভুলে যেতে শুরু করেছে, ঠিক যেমন শহর সবসময় করে—অপ্রয়োজনীয় স্মৃতিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আধুনিক ব্যস্ততায়। কিন্তু অনন্ত জানে, কিছু একটা এখনও বাকি। জয়াকে সে মনে করিয়ে দিয়েছে, ইতিহাসে তার জায়গা ফিরিয়ে দিয়েছে, হয়তো বাকিরাও সেই স্মরণের আলোয় শান্তি পেয়েছে। তবে এক গভীর অনুভব বলে, সে নিজে এখন আর শুধুই একজন পর্যবেক্ষক নয়। এক সন্ধ্যায়, নিজের ডেস্কে লেখা শেষ করতে করতে হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে—এক অজানা নম্বর। সে ফোন তোলে, এবং পরম বিস্ময়ে শুনতে পায় নিজেরই কণ্ঠস্বর—কিন্তু বয়সে কিছুটা ভারী, গভীরতর, যেন দশ বছরের বৃদ্ধ সংস্করণ। ওপাশে কণ্ঠটা বলে, “তুই যা করেছিস, তাতে অনেকের শান্তি হয়েছে, কিন্তু তুই জানিস না, এই শান্তি কতটা ভঙ্গুর। এই ফোনবুথ এক সময় ‘শ্রোতা’ খুঁজত, এখন ‘উত্তরদাতা’ চায়। এবার যারা আসবে, তারা শুধু বলবে না, তারা চাইবে কেউ তাদের হয়ে কাজ করুক।” অনন্ত ভয় পায় না, শুধু ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে?” কণ্ঠটা হাসে, “তুই, তোর ভবিষ্যৎ—যেদিন তোকে কেউ স্মরণ করবে না, সেদিন তুইও এই কণ্ঠগুলোর একটায় পরিণত হবি। গল্প লেখা শেষ করিস, কিন্তু ভুলে যাস না—তোর নামও হয়তো একদিন কেউ ভুলে যাবে, যদি না তুই নিজেকে মনে রাখিস।”
এই অদ্ভুত ঘটনা তার ভিতর গভীর দাগ ফেলে। সে ভাবে—মানুষ বাঁচে যতদিন কেউ তার কথা মনে রাখে, তার নাম উচ্চারণ করে, তার ভুলে যাওয়া সত্যগুলো তুলে আনে। ঠিক সেই কারণেই হয়তো এই ফোনবুথ দাঁড়িয়ে আছে—এটা মৃতদের নয়, বরং ‘ভুলে যাওয়া জীবন্তদের’ শ্রবণযন্ত্র। সে জানে, এখনও বহু কণ্ঠ প্রতীক্ষায় আছে, বহু কথা বলা হয়নি, বহু গল্প হারিয়ে গেছে যেগুলো কাউকে না কাউকে বলা উচিত ছিল। অনন্ত এবার ঠিক করে, সে কেবল সাংবাদিক নয়, সে “শ্রোতা”—শহরের হারিয়ে যাওয়া শব্দদের শ্রোতা। সে একটি নতুন প্রকল্প শুরু করে—“অডিও অর্কাইভ অফ আনটোল্ড লাইভস”, যেখানে শহরের লোকেরা এসে তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়, বন্ধুর, প্রেমিক বা অপরিচিত মানুষের কথা বলে যেতে পারে। সে ফোনবুথটি মেরামত করিয়ে তাকে রাখে একটি নির্দিষ্ট স্থানে—স্মারক নয়, বরং গল্প বলার কেন্দ্র হিসেবে। বুথে ঢুকে মানুষ তাদের নিজের বয়ান রেকর্ড করতে পারে—যাদের কেউ কখনও শোনেনি। প্রথম প্রথম লোক আসে কম, তারপর ধীরে ধীরে শহরের কোণাকুণি থেকে আসতে থাকে মানুষ, গলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে থাকে, “মা, আমি তোমার ভুল বুঝেছিলাম…”, “আমি বলিনি, কিন্তু আমি ভালোবাসতাম…”, “আমি জানি তুমি ফিরবে না, কিন্তু এই কথাটা শুধু তোমার জন্য…”
শেষ দৃশ্যটা অনন্তর জীবনের সবচেয়ে গভীর স্মৃতি হয়ে থাকে—এক অন্ধকার রাত, সমস্ত রেকর্ডিং শেষ, সে ফোনবুথে দাঁড়িয়ে আছে একা, বাতাস নিঃস্তব্ধ, চারপাশে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ ফোনটা আবার বাজে। সে এবার ধীরে ধীরে ফোন তোলে—ওপারে কোনো ভয়ের কণ্ঠ নয়, বরং এক শিশুর গলা, যেন নবজাত স্বরের মতোন, অচেনা, কিন্তু সম্পূর্ণ শান্ত। গলা বলে, “ধন্যবাদ… আমি এখন আছি… কারণ কেউ আমাকে মনে রেখেছে।” অনন্ত বুঝে যায়, এবার সে শুধু এক কাহিনির সমাপ্তি দেখল না, বরং এক উত্তরসূত্র তৈরি করল—যেখানে মৃতরা আর বন্দী নয়, তারা ভেসে বেড়ায় সেই শব্দে, যেগুলো শ্রোতা পায়, আর যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ শোনে, ততক্ষণ মৃত্যুও নিশ্চুপ।
শহরের বুকের ভেতর অনেক গল্প হারিয়ে যায়—কেউ শোনে না, কেউ জিজ্ঞেসও করে না। কিছু কাহিনি দাফন হয় চুপিসারে, কিছুর মৃত্যু হয় ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু একটি ফোনবুথ—একটুকরো ধুলো ধরা কাঁচ, মরচে ধরা লোহা, আর ছেঁড়া তারের গায়ে লেগে থাকা নিঃশব্দ কান্না—সেই হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠগুলোর শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছিল।
অনন্ত সেনগুপ্ত আজও বেঁচে আছে, তার লেখা আজও মানুষ পড়ে। কিন্তু কেউ জানে না, শহরের এক কোণায় আজও একটা বুথ দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিদিন হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ, কখনও রাতের একদম গভীরে হঠাৎ করে বাজে—একটা ট্রিঙ্ক, একটা নিঃশব্দ, একটা অপেক্ষা।
এখানে কেউ আর ভয় পায় না, বরং কেউ ফোন তোলে এই ভেবে—”আজ হয়তো কারো শেষ না বলা কথাটা আমি শুনতে পাব।”
কারণ এই বুথ আজ আর মৃতদের নয়, এটি স্মৃতির শ্রদ্ধালয়—যেখানে শব্দ হারিয়ে যায় না, তারা চিরকাল ঘুরে ফিরে আসে, যতক্ষণ কেউ শোনে।
—
শেষ