Bangla - ভূতের গল্প

মৃত্যুস্থান বনাম মুক্তিস্থান

Spread the love

দীপঙ্কর মাহাতো


পুরুলিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটিতে ঢোকার পথটাই যেন শহরজীবনের ব্যস্ততা থেকে এক অলক্ষ্য ছেঁটে ফেলা। ঝাউগাছ, শাল, পিয়াল আর মহুয়ার সারি সারি গাছের ফাঁকে রাস্তা বেঁকে গেছে পাহাড়ের বুক চিরে। মে মাসের শুকনো রোদ আর ধুলোভরা বাতাসের মধ্যেও সেখানে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই শব্দ চেপে বসে আছে। এমনই নিঃসঙ্গ, প্রায় বিস্মৃতপ্রায় এই জায়গাতেই নিজের শেষ জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডা. অনিরুদ্ধ গুহ। কলকাতার এক খ্যাতনামা হাসপাতালে চব্বিশ বছর ধরে সার্জারি বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি, সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিলেন এক কঠোর অথচ নীতিনিষ্ঠ পথপ্রদর্শক। তবে সময়ের নিয়মে অবসরের দিন ঘনিয়ে এলে তিনি আর শহরের কোলাহল বা সম্মান-আবদ্ধ জীবনধারা নিয়ে ভাবেননি। বরং শহর ছেড়ে চলে আসার পিছনে ছিল এক চাপা ক্লান্তি, এক অব্যক্ত দায়বোধ, এক অপূর্ণতা। তাই অবসরের ঠিক পরের সপ্তাহেই তিনি পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এক পাহাড়ের কোলে পুরনো ব্রিটিশ আমলের পরিত্যক্ত একটি বাংলো কিনে ফেলেন। যদিও সেই বাংলো ঘিরে স্থানীয়দের মাঝে কিছু গুজব রটেছিল—নাকি ওখানে রাত নামলেই অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়, আগের মালিক আচমকাই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। তবে ডা. গুহ এসব কথা পাত্তা দেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ভূত বলে কিছু নেই—আছে মানুষের ভিতরে জমে থাকা স্মৃতি, গ্লানি আর মানসিক ক্লান্তি, যেগুলো মাঝে মাঝে রূপ নেয় আতঙ্কের।

বাংলোটির অবস্থান এমন এক উচ্চভূমিতে, যেখান থেকে দূরের পাহাড়ের রেখা আকাশের সঙ্গে মিশে গেছে। প্রতিদিন ভোরে উঠে চা হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেন অনিরুদ্ধবাবু, পাখিদের ডাক শুনে মনে হতো শহরের যান্ত্রিক শব্দ যেন বহু জন্ম আগের কোনো স্মৃতি। বাড়ির পরিচর্যার জন্য স্থানীয় কেয়ারটেকারের ছেলে রতন মাঝে মাঝে এসে হাত লাগাত—জল আনা, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, কিংবা বাজার থেকে সামগ্রী আনা। ছেলেটি সরল, হাসিখুশি আর খানিকটা কৌতূহলী। ডা. গুহের একাকীত্বে সে একমাত্র মানুষের ছায়া, যে গায়ে পড়েই কথা বলত, প্রশ্ন করত কলকাতা নিয়ে। কিন্তু ডা. গুহ খুব বেশি কথা বলতেন না—তাঁর মুখে সবসময় একটা ধীর, নিরপেক্ষ অভিব্যক্তি থাকত, যেন তিনি সজীব হলেও অনুভূতির সীমানা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলোর অভ্যন্তর সাজানো ছিল নির্ভেজাল গাম্ভীর্যে—মেডিকেল বই, পুরনো নোট, একজোড়া স্টেথোস্কোপ এখনও পড়ে আছে একটা ডেস্কে। মাঝরাতে কখনও তাঁর ঘুম ভেঙে যেত হঠাৎ করেই—কারণ হয়তো স্বপ্নে আবার অপারেশন থিয়েটারে ফিরে গেছেন, যেখানে আলো ঝলমলে ঘরে কেউ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, আর তাঁর হাতে সময় বাঁচানোর রাস্তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। ডা. গুহ এসব স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে শান্তির খোঁজে এসেছিলেন, কিন্তু নিজের মনে জমে থাকা মৃত্যুদের হাত থেকে পালানো এত সহজ নয়। সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল, যতক্ষণ না এক রাতে, ঘরের সামনের দরজায় একটি নক শোনা গেল—ধীরে, স্পষ্ট, নিরুত্তর। রাত তখন প্রায় বারোটা।

প্রথম রাতের নককে তিনি বাতাসে ভেবে ভুল বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় রাতে সেই শব্দ আবার আসে, আরও জোরে—এইবার দরজায় গিয়ে চোখ রাখতেই বাইরের হলুদ আলোয় ঘোলাটে ছায়ামূর্তি দেখতে পান। কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে, মাথা নিচু করে, কোনো শব্দ নেই, নড়াচড়া নেই। চমকে উঠেছিলেন অনিরুদ্ধ, কিন্তু ডাক্তারি জীবনের অভ্যাসে নিজেকে দ্রুত সামলে নেন। দরজা খোলেন না। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর ছায়াটি হঠাৎ করেই মিলিয়ে যায়, যেন কোনো ধোঁয়ার রেখা ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল বাতাসে। পরদিন রতনকে জিজ্ঞেস করলেও সে কিছুই দেখতে পায়নি। কিন্তু তৃতীয় রাতে, এই দৃশ্য যেন আরও কাছাকাছি আসে। এবার ছায়াটি সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, মুখ ঘোরায়, এবং ডাক্তারবাবু নিশ্চিত—সে মুখটি তিনি আগে দেখেছেন। একটি কিশোর—মাথায় গজবাঁধা, নাকে অক্সিজেনের নল, চিৎ হয়ে পড়ে থাকা সেই রোগীটির মুখ, যাকে তিন বছর আগে ICU-তে হারিয়েছিলেন। অনিরুদ্ধ গুহ ধীরে ধীরে অনুভব করেন, এই বাংলোটি হয়তো একমাত্র বাড়ি নয়—এটা এক শ্মশান, যেখানে তার চিকিৎসকের পরিচয় এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর রাত যত গভীর হয়, এই বাংলোর দরজায় দাঁড়ায় সেইসব মুখ, যাদের তিনি হারিয়েছেন, যাদের মৃত্যুর সময় তিনিই ছিলেন শেষ আশ্রয়, আর এখন… এখন তাঁরাই তাঁকে খুঁজে ফিরছে।

তৃতীয় রাতের অভিজ্ঞতা ডা. অনিরুদ্ধ গুহকে মানসিকভাবে নাড়া দিয়ে গেলেও তিনি বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন না। পরদিন সকালটা শুরু হয় স্বাভাবিক ছন্দে—রতন এসে ঘরের সামনের বাগান পরিষ্কার করে, বাজার থেকে দুটো পাঁউরুটি আর ডিম এনে দেয়, আর ডাক্তারবাবু নিজের বারান্দায় বসে এক কাপ লিকার চায়ে চুমুক দিতে দিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু তাঁর চোখের কোণায় সেই অস্বস্তিকর চেনা ছায়ার ছবি জমে থাকে—চোখ বুজলেও যেন দেখতে পান ছেলেটার নিস্তেজ মুখ, চোখে মৃত্যুর প্রান্তরেখা আঁকা। তিনি জানেন, এটাকে শুধুমাত্র “হ্যালুসিনেশন” বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এত বাস্তব, এত স্পষ্ট, এতখানি অনুভূতির চাপ—তা নিছক মানসিক ক্লান্তি হতে পারে না। তবু নিজের পেশাগত অভিজ্ঞতাই তাঁকে কঠিন করে গড়ে তুলেছে—মন থেকে উঠতে চাইলেও মুখে তিনি কিছুই প্রকাশ করেন না। তবে রাতে আর আগের মতো নিশ্চিন্ত ঘুম আসে না। খাওয়ার টেবিলে বসে তিনি অতীতের কয়েকটি মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেন—রুগ্ন বৃদ্ধা, যার শরীরের কোষে ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যানসার, সদ্যবিবাহিতা তরুণী, যাকে দুর্ঘটনার পর রাতভর বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিংবা সেই ছেলেটি… অজস্র রোগী, অজস্র পরিণতি, অথচ কিছু মুখ এমনভাবে থেকে যায়, যেন মৃত্যুর পরেও তাদের সাথে চিকিৎসকের সম্পর্ক শেষ হয় না।

চতুর্থ রাতে তিনি একটু প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন—সামনের উঠোনের আলো জ্বালিয়ে দেন, দরজার ছিটকিনি পরীক্ষা করে নেন, আর জানালার পাশে একটি চেয়ারে বসে থাকেন রাত বারোটার পর। তাঁর পাশে রাখা মেডিকেল ডায়েরি আর পেন, যেন কোন অজানা তথ্য নথিভুক্ত করার জন্য প্রস্তুত। ঘড়িতে সময় যখন ১২টা ১১, তখন আবার সেই শব্দ—একটা ধীর কিন্তু নিশ্চিত কড়া নাড়া। এবার আর কোনো দ্বিধা নেই, তিনি ধীরে ধীরে দরজার পাশে যান, চোখ রাখেন জানালার ফাঁকে, এবং এক নিঃশ্বাসে বুক আটকে যায়। ঠিক সামনের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে একজন বৃদ্ধ—চোখে গভীর শূন্যতা, বুকে একটি বড় গজ বাধা, এবং মাথার চারপাশে একটি কালো ধূসর হ্যালো, যেন কিছু একটা অতীত থেকে তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তাঁর মুখেও সেই পরিচিতি—একবার যিনি স্ট্রোকের শিকার হয়ে তাঁর হাতে ভর্তি হয়েছিলেন, আর যাবার সময় স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন—”আপনি ঈশ্বর না, তাও ভরসা করে এসেছি।” সেই মুখ, সেই নিস্পন্দ চাহনি, আবার দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বাংলোর সামনে। এবার তিনি আর নিজেকে আটকাতে পারেন না। ধীরে ধীরে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলেন, শব্দ করে নয়, নিঃশব্দে—কিন্তু দরজা খোলার আগেই যখন বাইরে তাকান, তখন কেউ নেই। উঠোন খালি, বাতাস স্তব্ধ, ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও থেমে গেছে যেন।

তিনি দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে ফিরে আসেন ঘরের ভেতরে। ঘুম আর আসে না সারা রাত। ভোরবেলা উঠে বারান্দায় যান, এবং তাঁর পায়ের নিচে অনুভব করেন ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে এক জায়গা—যেখানে ছেঁড়া হাসপাতালের স্লিপার পড়ার মতো ছাপ রয়ে গেছে। এবার আর তিনি নিজেকে প্রতারণা করতে পারেন না। বাংলোটি হয়তো ফাঁকা, পাহাড়ে ঘেরা নির্জন, তবু এখানে কিছু আছে—কিছু বা কেউ, যারা এখনো রয়ে গেছে। কিংবা বলা ভালো, যারা ফিরছে… রাতের পর রাত। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন—কেন? এত বছর পর? এই মুখগুলো কেন তাঁকে খুঁজে ফিরছে? তিনি কি ব্যর্থ হয়েছেন চিকিৎসক হিসেবে? না কি মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তাঁদের যে অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা এখনো এই পাহাড়ের বাতাসে ঘুরে বেড়ায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই, তবুও একটা সত্য ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে—এই বাংলো এখন আর নিছক ‘বসতঘর’ নয়, এটা এক ‘যোগস্থল’—বেঁচে থাকা আর না-থাকার মাঝখানে এক অনন্ত দোলাচল, যেখানে তিনি স্বেচ্ছায় পা রেখেছেন। আর এই স্থানের নিয়ম ঠিক শহরের মতো নয়—এখানে অতীত ঘুমায় না, মৃত্যুরাও সহজে বিদায় নেয় না।

ডা. অনিরুদ্ধ গুহ এবার আর নিজের মনকে বোঝাতে পারছিলেন না যে সবকিছু কেবল মস্তিষ্কের খেলা। গত চার রাত ধরে এই পাহাড়ি বাংলোর সামনে প্রতিনিয়ত মৃত রোগীদের উপস্থিতি যে শুধু স্মৃতি নয়, তা তিনি বুঝে ফেলেছেন। কিন্তু এখানকার নিস্তব্ধ বাতাসে যে অদৃশ্য কিছু ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সত্যতা নিয়ে কথা বলার মতো কেউ তাঁর আশেপাশে নেই। রতনকে কিছু বলতে পারেন না—সে বালক, সরল ও ভয়প্রবণ, এই ধরনের কিছু শুনলে আর এ বাড়িতে পা রাখবে না। তাই নিজের মনেই খুঁজতে থাকেন—এই বাংলোটা কী? কে থাকত এখানে আগে? এমনই এক বিকেলে পাহাড়ে হেঁটে ফেরার পথে গ্রামের স্কুলে গিয়ে উপস্থিত হন। সে স্কুলেই প্রথম পরিচয় হয় তনুশ্রী সেনের সঙ্গে—স্থানীয় স্কুলের ইতিহাস শিক্ষিকা ও গ্রন্থপাল। ধবধবে সাদা শাড়ি, চোখে ফ্রেমহীন চশমা, আর কণ্ঠে একরাশ নির্লিপ্ত কৌতূহল নিয়ে তনুশ্রী ডা. গুহকে দেখেই চিনতে পারেন, কারণ তাঁর আগমনের খবর ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামে। তাঁকে চা খেতে আমন্ত্রণ জানিয়ে এক কোণে বসিয়ে নেন তনুশ্রী, এবং সেখানে প্রথমবার ডা. গুহ কিছু বলার চেষ্টা করেন—স্বল্পভাষী হলেও তিনি জানান, “রাত হলেই আমার দরজায় কেউ আসে। চেনা কেউ। জীবিত নয়।” তনুশ্রী প্রথমে নীরব, তারপর বলেন, “আপনার বাংলোটা শুধু একটা বাড়ি নয়, ডাক্তরবাবু, এটারও একটা অতীত আছে… যেটা আপনি জানেন না।”

এরপর তনুশ্রী টানা কথা বলতে থাকেন—এই বাংলোটি একসময় ছিল এক ব্রিটিশ ডাক্তার, রবার্ট ক্লার্কের। ১৯৩৫ সালে এক ইজারা প্রক্রিয়ায় এই পাহাড়ি জমি দখল করে সে এখানে ছোটো একটা চেম্বার চালাত, যেখানে আশেপাশের আদিবাসীদের চিকিৎসা করত। লোকমুখে শোনা যায়, এক অজানা রোগে এক রাতে গ্রামের বহু লোক আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুর মুখে পড়ে। রবার্ট তখন একটি ওষুধ প্রয়োগ করেন, কিন্তু সেই ওষুধে অধিকাংশ রোগীর মৃত্যু ঘটে। এরপর গ্রামবাসীরা তাঁকে অভিশপ্ত ঘোষণা করে এবং এক রাতে হঠাৎ করেই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। কেউ বলে সে আত্মহত্যা করে বাংলোর পেছনের জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিল, আবার কেউ বলে গ্রামের লোকেরা তাকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। তখন থেকেই এই বাংলো পরিত্যক্ত হয়ে যায় বহু বছর। মাঝে কয়েকজন শহরের মানুষ এখানে থাকার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তারা বেশিদিন থাকেননি—কারও কারও মতে, এখানে “মৃতেরা কথা বলে”, কেউ কেউ তাদের স্বপ্নে দেখে আর কেউ নাকি বাস্তবেই। তনুশ্রী বলেন, “আপনি যদি চিকিৎসক হন, তবে আপনি তো মৃত্যুর খুব কাছে ছিলেন বহুবার। এখানে এসে আপনি হয়তো তাঁদের কাছেই ফিরে এসেছেন।” তাঁর চোখে ভয় নেই, বরং এক ধরনের বিস্ময় মিশ্রিত উপলব্ধি, যেন তিনিও অনেকদিন ধরে এই বাংলোর গল্প জানতেন এবং ডা. গুহর উপস্থিতিতে কোনও যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন।

ডা. গুহ এবার আর নিরুত্তর থাকতে পারেন না। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “আমি কাউকে হত্যা করিনি, আমি চেষ্টা করেছি… অনেকের জীবন ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু কিছু মৃত্যু আমার ভিতরেই থেকে গেছে। এবার হয়তো তারাই ফিরেছে।” তনুশ্রী মাথা নাড়েন, বলেন, “এই জায়গা মানুষকে ছেড়ে দেয় না, বিশেষত যারা মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। এটা মৃত্যুস্থান… অথবা মুক্তিস্থান।” এই কথাটাই যেন ডা. গুহর মনের ভিতর কোথাও গেঁথে যায়। তিনি জানেন, তাঁর শহরের পরিচয়, তাঁর ডিগ্রি, তার বাস্তববাদ—এই সব কিছুই এই বাংলোর দেয়ালের চিড় ধরে নিঃশব্দে গলে যাচ্ছে। তনুশ্রী এরপর তাকে কিছু পুরাতন দলিল ও রেকর্ড ঘেঁটে দেখার প্রস্তাব দেন, যেখানে রবার্ট ক্লার্কের চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু পুরনো কেস-নোটস আর গ্রামবাসীদের বিবৃতি লেখা আছে। ডা. গুহ এবার বুঝতে পারেন, এই বাংলোকে বোঝা শুধুমাত্র অতিপ্রাকৃত এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়, বরং এক গভীর অনুসন্ধান—নিজেকে, নিজের অতীতকে, আর সেই মুখগুলোর প্রতি নিজের দায়কে স্বীকার করার এক উপায়। ফিরে আসার সময় পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি মনেই বলেন, “তারা ফিরছে, কারণ আমি পালিয়ে এসেছি। আর বাংলোটি… সে শুধু স্থান নয়, সে এক আয়না।” আর এই আয়নায় তাকাতে হলে, তাঁকে যে সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে—তা তিনি এবার বুঝতে পারছেন।

রাতের নিকষ আঁধারে বাংলোর জানালার ওপারে যখন ছায়াগুলো আসতে শুরু করল, তখন ডা. অনিরুদ্ধ গুহ ধীরে ধীরে অনুভব করলেন যে এই আগমন কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সমষ্টি নয়—এ এক ধারাবাহিক মিছিল, যেখানে প্রতিটি মুখ কোনো না কোনোভাবে তাঁর জীবনের সঙ্গে বাঁধা, কিন্তু মাটির নিচে ঘুমিয়ে থেকেও যেন তাকে ডাক দিয়ে ফিরিয়ে আনছে। পঞ্চম রাত, তিনি নির্ঘুম চোখে বসেছিলেন জানালার পাশে, কলম হাতে, কাগজে অদৃশ্য লিপি লেখার মতো প্রস্তুত। বারোটার কিছু পরেই আবার সেই শব্দ—ধীরে, ছন্দে কড়া নাড়া, এবার যেন অপেক্ষাকৃত ভারী ও আত্মবিশ্বাসী। জানালার কাঁচে চোখ রাখতেই প্রথমে বোঝা গেল না কিছু—কিন্তু আলো-আঁধারির মাঝখানে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল এক তরুণীর মুখ, হাসপাতালের গাউন গায়ে, মাথার পাশে একটা স্যালাইন স্ট্যান্ড—যেন কিছুক্ষণ আগেই অপারেশন টেবিল থেকে উঠে এসেছে। তাঁর গালের বাম পাশে ছিল একটা চাঁদের মত দাগ, যা ডা. গুহ একদম চিনে ফেলেন। তিনি এই তরুণীকে দেখেছিলেন ছয় বছর আগে—মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার পর ভর্তি হয়েছিল। অপারেশন সফল হয়নি, এবং পরিবারের অভাব, বিল বকেয়া, আর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু—সব মিলিয়ে সেই রোগীটি ছিল একটি অনাক্রম্য বেদনার প্রতিচ্ছবি। এবার সেই মুখ, চোখের কোনায় জমে থাকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর জানালার ঠিক বাইরে, যেন বলছে—”আপনি আমাকে ছেড়ে চলে এসেছেন।”

তারপর আসতে শুরু করে আরও মুখ—একজন বৃদ্ধ, শ্বাসকষ্টে কাতর, সিলিন্ডারহীন মুখে নিঃশ্বাসের আকুতি, একজন কিশোর, যার বুকে তাজা সেলাইয়ের দাগ, একজন মাতৃহীন সদ্যজাত, যাকে এক রাতে কোলে তুলে ধরে মৃত্যু ঘোষণা করতে হয়েছিল—তাঁরা সবাই যেন একে একে এসে দাঁড়ায় বাংলোর চারপাশে, ছায়ার মতো নিঃশব্দে, কোনো অভিযোগ বা প্রশ্ন ছাড়াই, শুধু চোখে একরাশ অপেক্ষা নিয়ে। ডা. গুহ চুপ করে থাকেন, শরীর কাঁপে না, চোখে জল আসে না—তাঁর ভিতরে কেবল এক বিস্ময় কাজ করে। এরা কি তাঁরই ভুলের সাক্ষ্য বহন করে এসেছে? নাকি এরা মৃত্যুর পরের নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি চায়, একজন শেষ আশ্রয়দাতার কাছ থেকে? এই মুহূর্তে তিনি নিজেকে আর প্রাক্তন সার্জন বলে মনে করেন না, বরং এক স্বীকারোক্তিকারী, যাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছে তাঁর জীবনের প্রতিটি অসমাপ্ত অধ্যায়—যেখানে কোনো সিগনেচার নেই, কোনো ডিসচার্জ সার্টিফিকেট নেই, আছে শুধু এক মৌন উপস্থিতি। তনুশ্রী সেনের কথা মনে পড়ে—”এই বাংলো আয়না,” তিনি বলেছিলেন। ডা. গুহ বুঝতে পারেন, এই মুখগুলোর মিছিল যেন তাঁর মন ও দেহের প্রতিটি খণ্ড থেকে অতীতকে টেনে এনে বলছে, “তুমি কি ভুলে গেছ?” না, তিনি ভুলে যাননি, কখনও পারেননি। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যা তাঁকে শিখিয়েছিল কীভাবে আবেগ ছাড়াই মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়। সেই আবেগহীনতাই হয়তো আজ ভেঙে যাচ্ছে এই বাংলোর গায়ে, প্রত্যেক রাতে, এক একটি ছায়ামূর্তির কণ্ঠহীন আবেদনে।

রাত শেষ হলে বারান্দায় এসে বসেন তিনি, চোখে রোদ পড়ে না, বাতাসে পাখির ডাক শোনা যায় না—এ এক অদ্ভুত নিঃশব্দ সকাল। বাংলোর চারপাশে শুকনো পাতা ছড়ানো, কিন্তু এগুলোর গায়ে কেউ যেন হেঁটে গেছে তার চিহ্ন রেখে—হালকা, সাপের মত আঁকাবাঁকা দাগ। তিনি নিচে নেমে কিছুক্ষণ সেসব চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি ফিরে এসেছি। এবার আমিও শুনব তোমাদের।” বাংলোর দেয়ালজুড়ে ভাঙা রং, প্যাচপ্যাচে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, আর বাতাসে ঝুলে থাকা শব্দহীনতার মধ্যেও তিনি অনুভব করেন এক পরিবর্তন—মৃত্যুরা এবার কথা বলতে চায় না, তারা শুধু চায় কেউ তাদের দেখতে পাক, বুঝতে পাক। এবং এই অধ্যায়ে এসে তিনি উপলব্ধি করেন—তাঁর একাকীত্ব, তাঁর পলায়ন, তাঁর ক্লান্তি—সবই তাঁকে নিয়ে এসেছে এই মুখগুলোর সামনে দাঁড়াতে। আর সেখানেই তিনি এক নতুন দায়িত্বের মুখোমুখি হন—শুধু দেহ সারানো নয়, এই আত্মাগুলোকেও মুক্তি দেওয়া, কথা না বলা মুখগুলোর বোঝা ভাগ করে নেওয়া। এর নাম হয়তো চিকিৎসা নয়, কিন্তু এর নাম “প্রত্যাবর্তন”—এবং এই বাংলো এখন আর নীরব নয়, এটা এক চলমান স্মৃতিস্থান।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে। ডা. অনিরুদ্ধ বসুর বাংলোটিকে ঘিরে নিঃসঙ্গতা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের গায়ে হালকা কুয়াশা জমেছে, দূরের শুকনো পাথরের খাঁজে বাঁশি বাজানোর মতো করে বাতাস ঢুকে যাচ্ছে। অনিরুদ্ধ বসু এখন আর প্রথম রাতের মতো ভীত নন, তবে স্বস্তিতেও নেই। প্রতিরাতে যে অদ্ভুত দর্শনার্থী তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়, সেই রুগীসদৃশ ছায়া, তার চোখের ভেতরের অপূর্ণতা যেন তাঁকে পিছু ছাড়তে নারাজ। প্রতিটি রাত, একটি নাম, একটি রোগ, একটি অতীত—যা তিনি ভুলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারছেন না। আজ রাত দশটার সময় তিনি খোলা বারান্দায় চুপচাপ বসে ছিলেন, হাতে ধরা ছিল পুরনো রুগী খাতার পাতা, যেখানে অদ্ভুতভাবে তিনি খুঁজে পেয়েছেন সেই সব নাম—যারা প্রতি রাতে এসে তাঁকে স্মরণ করিয়ে যাচ্ছে নিজের ভ্রান্তি। আজকের পাতায় লেখা ছিল, ‘শান্তি ঘোষ, ৩২, অতিরিক্ত মাদক গ্রহণে মৃত্যু—নেশা সংশ্লিষ্ট পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রেরণ করার সময় দেরি হয়েছিল।’ মনে পড়ে সেই তরুণীর মা তাঁর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিল, “আপনার ওপর বিশ্বাস ছিল, স্যার… আপনি হলে ওকে বাঁচাতে পারতেন।” সেই দৃশ্য, সেই আর্তি, আজ এত বছর পর আবার যেন পুনর্জীবিত হয়ে উঠেছে।

রাত বারোটা বাজতে না বাজতেই, হাওয়ার দমকে জানালার পর্দা ছিঁড়ে গেল। ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ নামল। অনিরুদ্ধ বুঝলেন, সেই আগন্তুক এসে গেছে। কিন্তু এবার কার পালা? টেবিলের ল্যাম্প জ্বলে উঠল একা একাই, আর তারপরেই দরজার সামনে একটা ফসফসে আওয়াজ—“আমি… আমি শান্তি।” ধীরে ধীরে সে ছায়া ঘরে প্রবেশ করল, তার শরীরে ছিল মলিন হাসপাতালের গাউন, চুলগুলো এলোমেলো, চোখ দুটি ভেজা, অথচ দৃষ্টিতে ছিল অপরাধবোধের চেয়ে বেশি একটা প্রশ্ন—“আপনি কি সত্যিই চেষ্টা করেছিলেন?” অনিরুদ্ধ বসু নীরবে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখের সামনে সেই সময়গুলো ভেসে উঠছিল যখন হাসপাতালের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী জটিলতায় তাঁকে রোগী ফেলে রীতিমতো বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হতো। শান্তির মৃত্যুর জন্য তিনি সরাসরি দায়ী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর একটুখানি সাহস, একটুখানি সময় বা সিস্টেম ভেঙে একটু লড়ার মন থাকলে, হয়তো সেই মেয়েটি আজ বেঁচে থাকত। শান্তির ছায়া ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি কি মনে করেন, আমরাই মৃত্যুর জন্য দায়ী? না কি আমাদের চিকিৎসকেরা আস্তে আস্তে মৃত্যুর সঙ্গে আপোস করে নেয়?” তার কণ্ঠে ছিল না কোনো আক্রমণ, বরং ছিল এক নিঃসঙ্গের আত্মপ্রকাশ।

অনিরুদ্ধ বসুর চোখে জল চলে এলো, কিন্তু তিনি জানেন, এ জল এখন আর কাউকে ফিরিয়ে আনবে না। তিনি বললেন, “আমি চেয়েছিলাম ছুটি নিতে… একটু ঘুমোতে… নিজেকে সামলাতে… কিন্তু তোর সময় তখন ছিল না।” শান্তির ছায়া নিঃশব্দে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ ঘরের বাইরের বুনো জঙ্গল থেকে এক গর্জনের মতো আওয়াজ উঠল। অনিরুদ্ধ দৌড়ে জানালার দিকে তাকালেন—দূরের পাহাড়ের মাথায় যেন শত শত আলো জ্বলছে, প্রতিটি আলো যেন এক একটি অপূর্ণ রুগীর আত্মা, যারা আজ তাঁর মুক্তি বা ক্ষমা চায়। শান্তি ধীরে ধীরে বলল, “আপনার নির্জনতা আপনার মুক্তি নয়… এটা আপনার বিচারের স্থান। মৃত্যুরও একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে, আর আপনি এখন আছেন সেই ঠিকানার মাঝখানে… মৃত্যুস্থান বনাম মুক্তিস্থান।” এরপর ছায়াটি মিলিয়ে গেল রাতের কুয়াশার ভেতর। অনিরুদ্ধ বসু চেয়ারে বসে থাকলেন নিস্তব্ধ, কিন্তু তাঁর ভেতরে যেন এক ভয়ানক পরিবর্তনের সূচনা হয়ে গেছে—তিনি বুঝতে পারছেন, এই বাংলো হয়তো শান্তির জায়গা নয়, বরং তাঁর নিজের অপরাধবোধের প্রেতমন্দির।

গভীর রাতের নিস্তব্ধতা চুঁইয়ে পড়ছে পাহাড় ঘেরা পুরুলিয়ার অরণ্যবেষ্টিত সেই বাংলোর চারদিকে। চারদিকে কুয়াশা জমে এক অদ্ভুত ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে, যেন বাস্তব ও অবাস্তবের মাঝখানে এক কাচের পর্দা। ডা. রুদ্রনারায়ণ মুখার্জি আগের রাতের ঘটনার পর এই প্রথম একটানা ঘুমাতে পেরেছিলেন, কিন্তু সকাল বেলা বাংলোর পেছনের উঠোনে মানুষের পায়ের ছাপ দেখে আবার আঁতকে উঠলেন। বৃষ্টিও হয়নি, তবুও পায়ের ছাপ ছিল কাদামাটির মতো নরম মাটিতে—নতুন, তাজা, এবং একেবারে তাঁর শোবার ঘরের জানালার ঠিক নিচে এসে থেমে গেছে। মাথার ভেতর বারবার বাজতে লাগল সেই ডাক্তারির জীবনের অপূর্ণতা, ভুল চিকিৎসা, যেসব রোগী আর ফেরেনি, অথবা যারা ফেরে জীবনের শেষ বাঁকে। তিনি ভাবলেন, এই কি তবে তাদের কেউ? না কি এ শুধুই তাঁর ক্লান্ত মনের কল্পনা? মনোবিজ্ঞান বলবে এ হ্যালুসিনেশন, কিন্তু হৃদয় বলছে—না, এটা বাস্তব, কিছু একটা আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে কুয়াশার ফাঁক গলে একটা মুখ ফুটে উঠল জানালার ধারে—বড় বড় চোখ, ফ্যাকাশে মুখ, এক সময়ের পরিচিত রোগী, নাম ছিল রাহুল দাস—শিশু বয়সে হার্টের অসুখে ভুগছিল, এক অপারেশনের পরে কিছুটা ভালো হলেও হঠাৎ একদিন হার্ট ফেইলিউর…। রুদ্রনারায়ণ কেঁপে উঠলেন, কারণ রাহুল তাঁর জীবনের অন্যতম ব্যর্থতা ছিল। যে অপারেশন তাঁকে বাঁচাতে পারত, তাতে সামান্য গাফিলতিই সব শেষ করেছিল।

এরপর কয়েকটা দিন অস্বাভাবিক দ্রুত কেটে গেল। দিনের বেলা সব স্বাভাবিক, পাহাড়ে হাওয়ার নাচন, পাখির ডাক, পাশের গ্রাম থেকে আসা লোকজনের হাসি-ঠাট্টা, বাজারের ছেলেটার “বাবু ডাক্তার” বলে সম্ভাষণ—সব যেন রুদ্রনারায়ণকে ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ছায়া চলাচল, জানালার কাচে ধাক্কা, বাতাসের ভেতর ভেসে আসা চেনা কণ্ঠস্বর—”ডাক্তারবাবু, আমি বাঁচতে চাই” কিংবা “আপনি তো বলেছিলেন আমি ঠিক হয়ে যাব!” এক রাতে তিনি উঠোনে গিয়ে দেখলেন, দাঁড়িয়ে আছে মীনাক্ষী সাহা—যার জরায়ুর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল অনেক দেরিতে। তাঁর চিকিৎসায় একটু দেরি হওয়ায় মীনাক্ষীর স্বামী ও পরিবার তাঁর ওপরে দোষ চাপিয়ে ছিল। মীনাক্ষীর চোখে ছিল না কোনো অভিযোগ, শুধু একটা দৃষ্টিতে মিশে ছিল অপার বেদনা আর একটাই প্রশ্ন—”আপনার এত অভিজ্ঞতা, এত বছরের প্র্যাকটিস, তবুও আপনি বুঝলেন না আমি মরছি?” রুদ্রনারায়ণ হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন—”আমি তো ডাক্তার, ঈশ্বর নই!” কিন্তু অরণ্য যেন তাতে সাড়া দিল না, নিঃশব্দে ঘনিয়ে এলো গাঢ় কুয়াশা, মীনাক্ষীর অবয়ব মিলিয়ে গেল তাতে।

সকালে উঠে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই। কোথাও লিখে রাখতে হবে তাঁর অপরাধ, তাঁর ভুল, তাঁর ভ্রান্তি—হয়তো আত্মশুদ্ধির কোনো পথ খুলবে। বাংলোর ছোট লাইব্রেরির পাশে বসে তিনি খুললেন একটা মোটা খাতা—“মৃত্যু ও মুক্তির মধ্যবর্তী স্থান” শিরোনামে লিখে ফেললেন প্রথম লাইন—“আমি রুদ্রনারায়ণ মুখার্জি, একজন চিকিৎসক, যার প্রতিটি সফল অস্ত্রোপচারের মাঝে চাপা পড়ে রয়েছে কোনো ব্যর্থতা, কোনো হারিয়ে যাওয়া প্রাণ।” এরপর তিনি লিখলেন রাহুলের ঘটনা, লিখলেন মীনাক্ষীর কথা, লিখলেন সেই বৃদ্ধ অশোকবাবুর কথা—যিনি একবার তাঁকে বলেছিলেন, “ডাক্তারবাবু, আমার আর সুস্থতা নয়, শান্তি চাই।” প্রতিটি শব্দ লিখে যেন তাঁর শরীরটা একটু হালকা হল, মনের উপর চাপ কমল। কিন্তু শেষ পৃষ্ঠায় যখন লিখতে যাচ্ছিলেন—“আমি ক্ষমাপ্রার্থী, আমি মুক্তি চাই”—ঠিক তখনই খোল জানালার বাইরে আবার সেই মুখ, রক্তমাখা, চোখ দিয়ে গলে পড়ছে জল বা রক্ত, সে বলল—“আপনার মুক্তি হবে না, কারণ আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন না কে বাঁচতে চেয়েছিল, আর আপনি কাকে বাঁচাতে চাননি।” রুদ্রনারায়ণ তখন স্পষ্ট বুঝলেন—এ শুধু অতীত নয়, এ তাঁর আত্মার বিচার, নিজেরই মুখোমুখি হওয়া। এই বাংলোটা শুধু বসবাসের নয়, এ এক স্থান—যেখানে মৃত্যু ও মুক্তি একই সাথে তাঁর দ্বারে কড়া নাড়ছে।

ডাক্তার চন্দ্রনাথ সেনের জীবনে আগের মতো নির্ঝঞ্ঝাট নৈঃশব্দ্য আর রইল না। প্রতিটি রাত্রি যেন এখন অপেক্ষা করে সেই ছায়ামূর্তির জন্য। আজ সপ্তম দিন—পাহাড়ের আকাশে চাঁদ অর্ধেক, ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাসে বনভূমির পাতারা কাঁপছে। দিনের আলোয় অবশ্য সবকিছুই স্বাভাবিক। ভোরে উঠে ডালমা পাহাড়ের দিকে হেঁটে গিয়ে ফিরলেন চন্দ্রনাথ, হাতে কিছু ঔষধি গাছের পাতা আর পুরনো অভ্যাসমতো ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্র। বেলা দশটার দিকে স্থানীয় পোস্টম্যান রঘুনাথ একটা চিঠি নিয়ে আসে, পাঠক অজানা। হাতে লেখা খামে শুধু লেখা—‘ডাঃ চন্দ্রনাথ সেন, ঝাড়গ্রাম রোড, পুরুলিয়া’। খোলার পর দেখা যায়, ভিতরে ছোট করে একটি লাইন: “আপনার শেষ রোগীর নাম আপনি জানেন না, কিন্তু সে আপনাকে জানে।” চন্দ্রনাথের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল। তিনি চিঠি হাতে নিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে পড়লেন। কে পাঠাতে পারে এমন চিঠি? কেনই বা এমন অদ্ভুত বাণী?

সন্ধ্যেবেলা পাহাড়ের নীচে একদম নির্জন হওয়া শুরু হলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—আজ তিনি অপেক্ষা করবেন সেই ছায়ার জন্য, যেন নিজেই মুখোমুখি হবেন তার। রাত দশটার পর বাংলোর দরজা খুলে রাখলেন। একটা মোমবাতি জ্বলছে টেবিলের ওপর, রেডিও বন্ধ, ঘড়ির কাঁটা একটানা টিকটিক করছে। হঠাৎ মাঝরাতে হাওয়ার সাথে একটা গন্ধ ভেসে এল—ফেনল আর স্পিরিটের। চন্দ্রনাথ জানেন, এই গন্ধ সেই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের। দরজার কাছে আস্তে আস্তে একটা ছায়া গড়িয়ে এলো। এবার সে স্পষ্টতই এক নারী। তার পরনে হাসপাতালের গাউন, মুখ ঢাকা অন্ধকারে, হাতে যেন একটা পুরনো ফাইল। চন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন, কাঁপা গলায় বললেন, “কে আপনি?” ছায়াটি কিছু বলল না, কিন্তু ফাইলটা টেবিলের ওপর রেখে চলে গেল জানালার দিকে। জানালার কাঁচে তার ছায়া ফুটে উঠল, আর তারপর হঠাৎ ভেঙে পড়ল মেঝেতে। জানালা কিন্তু বন্ধই ছিল। ফাইল খুলে চন্দ্রনাথ অবাক হয়ে দেখেন, সেটি একটি অপারেশনের রিপোর্ট—তার হাতেই সই আছে, কিন্তু রোগীর নামের জায়গায় লেখা ‘অজানা’। অপারেশনের তারিখ: ১৯৯৮ সালের ১২ই জুন। চন্দ্রনাথের স্মৃতিতে ওই দিন কোনো অজানা রোগীর অস্ত্রোপচার নেই। তবে তিনি জানেন, তখন সরকারি হাসপাতালে কাজ করতেন, আর একদিন হঠাৎ ইমার্জেন্সিতে এক অচেনা রোগী এসেছিল, যার পেট ফেটে গিয়েছিল—কথা বলতে পারেনি, নাম বলতেও পারেনি। চন্দ্রনাথ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বাঁচাতে পারেননি।

রাত তিনটার দিকে চন্দ্রনাথ আর ঘুমোতে পারলেন না। বারবার মনে পড়তে লাগল সেই রোগীর ফ্যাকাশে মুখ, নিস্তেজ চোখের দৃষ্টি। হয়তো সেই মৃত্যু এখনও তার কাছে মুক্তি হয়ে ওঠেনি। তাহলে কি এই বাংলো, যেখানে তিনি মুক্তি খুঁজতে এসেছেন, সেই মৃত্যুর খোঁজেই তাঁকে ফিরিয়ে আনছে? সকালে উঠে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—আর পালিয়ে নয়। তাঁকে খুঁজে বার করতে হবে কে ছিল সেই নামহীন রোগী, কোথা থেকে এসেছিল, কেন তার মৃত্যু এইভাবে অনিশ্চিত স্মৃতিতে থেকে গেছে। চন্দ্রনাথ ফোন করলেন কলকাতার এক পুরনো সহকর্মী ডাঃ প্রতুল ঘোষকে। প্রতুল বললেন, “তুই যদি ১৯৯৮-এর জুন মাসের রেকর্ড খুঁজতে চাস, তাহলে তো ওগুলো ফাইল রুমেই পড়ে থাকার কথা।” চন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কি একবার দেখতে পারিস? আমি এখনই কলকাতা যেতে পারছি না।” প্রতুল সম্মত হলো, বলল, “ঠিক আছে, আমি খোঁজ নিই। কিন্তু বলতো হঠাৎ এত বছর পর সেই নামহীন রোগীকে মনে পড়ল কেন?” চন্দ্রনাথ জানালেন না রাতে কি হয়েছে, শুধু বললেন, “মনে হয় সে এখনো আমার একটা সই চায়, যে সই একদিন আমি দিতে পারিনি।” ফোন রাখার পর, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি—জানেন না মুক্তি কত দূরে, কিন্তু এখন মৃত্যুর ছায়া খুব কাছে।

সেই রাতটা ছিল অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা। পুরুলিয়ার পাহাড়ঘেরা বাতাসে আজ একরকম ভিন্ন সুর বেজে উঠছিল, যেন নিস্তব্ধতাও কোনও কিছু গোপন করতে চাইছে। ডাঃ অরবিন্দ মুখার্জি বাংলোর পুরনো কাঠের জানালাগুলো বন্ধ করে কেরোসিন হিটার জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর মুখে আজ কোনও প্রশ্নের রেখা নেই, বরং এক ধরনের স্থির বিষণ্ণতা। তিনি জানেন, আজও কেউ আসবে—কোনও মুখ, কোনও স্মৃতি, কোনও অপরাধের ছায়া। বিগত সাত রাত ধরে যে অচেনা আত্মার পরিস্ফুটন তাঁর চোখের সামনে ঘটছে, তা যেন প্রতিটি দিনের পর আরও গভীর কোনও রহস্যে তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—তিনি পালাবেন না, লুকোবেন না। আজ তিনি মুখোমুখি হবেন, বুঝতে চেষ্টা করবেন এই রহস্যের কেন্দ্র কোথায়। মোমবাতির আলোয় নিজের পুরনো মেডিকেল ডায়েরি বের করে টেবিলে রাখলেন, যেন প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো পাতার শব্দ, মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার স্তব্ধ সঙ্গীত, সব মিলিয়ে যেন একটি অনন্তকালীন অপেক্ষার সময় শুরু হয়েছে।

রাত তখন প্রায় বারোটা। বাংলোর দক্ষিণ পাশের জানালার কাছে হালকা কুয়াশার ফাঁকে কেউ দাঁড়িয়ে, স্থির। অরবিন্দ জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলেন বহুক্ষণ, জানতেন সেই ছায়ামূর্তি ফিরবেই। কিন্তু আজ ছায়াটি ছিল পরিচিত—তাঁর মেডিকেল কলেজের এক প্রাক্তন রোগী, নাম সায়ন্তনী পাল। বছর দশেক আগে হাসপাতালে তাঁর পেটের এক জটিল অপারেশন করেন অরবিন্দ। অপারেশন সফল হলেও কয়েক মাস পর সায়ন্তনীর মৃত্যু হয় ইনফেকশনে। মৃত্যুর খবর তিনি সংবাদপত্রে পড়েছিলেন। সেই সায়ন্তনীর মুখ আজ জানালার পাশে! কিন্তু তার চোখে ছিল না কোনও অভিযোগ, বরং এক ধরনের করুণ অনুরোধ, এক নীরব আবেদন। হঠাৎ করেই বাংলোর বাতি নিভে যায়, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সুইচ অফ করেছে। অন্ধকারের মধ্যে সেই মুখ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। দরজা খুলে যায় আপনা থেকেই। সায়ন্তনী মুখ না খুলে শুধু হাত বাড়িয়ে দেয়, যেন ডাকছে কোথাও। অরবিন্দ কোনও প্রতিরোধ করেন না। এক ধরনের আত্মসমর্পণ তাঁর ভেতর থেকে উঠে আসে। তিনি চুপচাপ হাঁটতে থাকেন তার পেছনে, পাহাড়ি ঘাসের ওপর পা রাখার শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। সেই পথ তাদের নিয়ে যায় পাহাড়ের এক গুহার মুখে—একটি নিস্তব্ধ, অন্ধকার গহ্বর। ভিতরে প্রবেশ করতেই হঠাৎ চারপাশে আলো জ্বলে ওঠে, যেন কোনও পুরাতন হাসপাতালের ওটি ঘর। চারদিকে তাঁরই পুরোনো রোগীদের মুখ—সবাই মৃত। কেউ অস্ত্রোপচারের পরে মারা গেছে, কেউ ভুল ওষুধে, কেউ আত্মহত্যা করেছে তার অসহ্য যন্ত্রণায়। তারা কেউ কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। ডাঃ অরবিন্দ সেই মুহূর্তে বুঝে যান, তিনি কোথায় এসেছেন—এটা ‘মৃত্যুস্থান’, তাঁর পাপের গুহা, যা তিনি এতদিন ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু সেই গুহার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, তিনি এক নতুন চেতনার জন্ম অনুভব করেন। এই মৃত্যুস্থান হয়তো তাঁর জন্য মুক্তিস্থানও হতে পারে। তিনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন, হাতজোড় করে বলেন, “আমি কোনও ঈশ্বর নই, কিন্তু আমি চেষ্টা করেছিলাম… আমি ভুল করেছি, আমি ক্ষমা চাই।” সেই মুহূর্তে বাতাসে এক অদ্ভুত কাঁপুনি অনুভব করেন তিনি, যেন পুরো গুহা জুড়ে এক অদৃশ্য ঝড় বয়ে যায়। চারপাশের ছায়ামূর্তিগুলো এক এক করে মিলিয়ে যেতে থাকে। শুধু সায়ন্তনী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর মাথা নিচু করে অদৃশ্য হয়ে যায়। গুহার দেওয়ালে হালকা সোনালি আলো দেখা যায়—লেখা আছে একটি মাত্র শব্দ: “মুক্তি”। অরবিন্দ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান, বোঝেন এই পাহাড় তাঁকে ক্ষমা করেছে। মৃতরা তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে বা ক্ষমা দিয়েছে—এটা বোঝা যায় না, কিন্তু তিনিও যেন নিজেকে কিছুটা ক্ষমা করতে পেরেছেন। রাতের অন্ধকারের মধ্যে, গুহার বাইরে ফিরে আসা সেই মানুষটা আর আগের মত নন—একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে যা অশরীরী থেকেও বেশি বাস্তব।

শরৎপুরের সেই ধূসর সকালের বাতাসে পাহাড়ের গায়ে কুয়াশা ঠিক যেন এক বিশাল ভূতের চাদর হয়ে লেপ্টে ছিল। ডঃ অনিরুদ্ধর মন ততক্ষণে বহুদিন পর এমন এক অনুরণনের ভেতর জেগে উঠেছে, যা তার বহুদিনের বিজ্ঞানের জগতের বাইরে। তাঁর হাতে তখন ‘তালপাতার খাতা’—বহুকালের পুরোনো হস্তলিপি, যা তিনি পেয়েছিলেন জয়ন্তর ঘরের পুরোনো আলমারি থেকে। তাতে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল প্রাচীন এক তান্ত্রিক চিকিৎসকের নোট, যার নামও অনিরুদ্ধর মতোই ‘অনি’। এই ‘অনি’ শত বছর আগে এখানেই বসবাস করতেন, এবং পাহাড়ে তাঁর বানানো ওষুধ ও চিকিৎসা দিয়ে বহুজনকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু ওই নোটবুকের এক কোণায় লেখা ছিল এমন কিছু কথা, যা পড়ে অনিরুদ্ধর বুক কেঁপে ওঠে—“প্রাণ রক্ষা করিতে হইলে মৃত্যু বন্ধুর সাথেই আঁতাত করিতে হয়।” রাতের পর রাত যেসব মৃত রোগী এসে দাঁড়াত তাঁর বাংলোর জানালায়, তাদের কারও কারও নামই মিলে যায় সেই পুরোনো নোটবুকের রোগীর তালিকার সাথে। এবং জয়ন্তর কণ্ঠে উচ্চারিত ‘চরণবাবু’ নামটির উল্লেখও সেখানে ছিল, কিন্তু সেই চরণবাবু তো গত শতাব্দীর মানুষ!

এই খাতার সূত্র ধরেই অনিরুদ্ধ পৌঁছন জয়পুর হাটের উত্তর দিকে এক পরিত্যক্ত শ্মশানঘাটে—যেখানে স্থানীয়দের মতে, প্রতি পূর্ণিমা রাতে নাকি আগুন জ্বলে ওঠে আপনাআপনি। সেই রাতটিই ছিল শারদীয়া পূর্ণিমা। তাঁর সাথেই ছিল রমেশ, স্থানীয় এক যুবক যে এখন তাঁর পরিচারক হলেও পূর্বে ছিল একজন ভূমিপুজার দলভুক্ত পুরোহিতের নাতি। শ্মশানের ছাই মেখে সেখানে একটি নিঃশব্দ বেদি দেখা গেল, যার চারদিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত তাম্রমূর্তি ছড়ানো। ঠিক সেই বেদির নিচে কুয়োর মত একটি গহ্বর খুঁজে পান তারা, এবং সেই গহ্বর থেকেই আসছিল অস্পষ্ট একটা নিঃশ্বাসের শব্দ, যেন মৃতরা বেঁচে আছে সেখানে! গহ্বরের ভেতর তারা খুঁজে পায় এক তাম্রপাত—লিপিবদ্ধ আছে: “যে স্থানে মৃত্যু স্থির হয়, সেখানেই মুক্তি সন্ধান করে।” অনিরুদ্ধ বোঝেন, তাঁর বাংলোর অবস্থান এই ‘মৃত্যুস্থান’—যা মৃত্যু নয়, বরং মৃত্যুর পরবর্তী এক সীমানা।

ফিরে এসে তিনি বুঝলেন, তাঁর বাংলো একটি ‘সংক্রমণ-পথ’—প্রেতলোকের পেছনের দরজা। রাতে জানালায় দাঁড়িয়ে যারা ডাকছে, তারা অনিরুদ্ধকে চাইছে না চিকিৎসক হিসেবে, বরং একজন সত্তার বাহক হিসেবে—যে তাদের দুঃখ, পাপ, অসমাপ্ত জীবন শেষ করতে সাহায্য করবে। অনিরুদ্ধর কাছে এটা এক দার্শনিক মুহূর্ত—তার চিকিৎসাবিদ্যার বাইরের এক পূর্ণতা, যা তাকে দিয়ে যাচ্ছে ‘মুক্তিস্থান’ তৈরি করার দায়িত্ব। সেই রাতে, বাংলোর বারান্দায় একসাথে দশজন মৃতরূপী রোগী হাজির হয়। তাদের চোখে ছিল না বিভীষিকা, ছিল আশাবাদ। তারা শুধু চেয়েছিল সেই নামহীন বেদনার মুক্তি। অনিরুদ্ধ, প্রথমবারের মতো তাদের সঙ্গে এক আত্মিক চিকিৎসার পথে পা রাখলেন—বিজ্ঞান নয়, চেতনার ঔষধ নিয়ে।

বিকেলের রোদ যখন পুরুলিয়ার পাহাড় ঘেঁষে নেমে আসে, তখন ডঃ অরবিন্দর মনেও সেই শেষ আলোটা যেন পড়ে—ঝিরঝিরে, সোনালি আর অনিবার্য। গত রাতে সঞ্জীবের আত্মা যেভাবে তাঁকে নিজের মৃত্যুর বিবরণ দিয়ে গেল, সেটা যেন তাঁর বুকের ভিতর গেঁথে গেছে। তিনি জানতেন, আজ রাতেই শেষ মুখোমুখি হবে। সারা দিন বাংলোর সমস্ত দরজা জানলা খোলা রেখেছিলেন—যেন বাতাস ওর মতো অস্তিত্বদের আরও অবাধে আসতে দেয়। সন্ধ্যার পর, সেই চেনা ঠকঠক শব্দটা আবার এল, কিন্তু আজ কোনও এক নিস্তব্ধ সম্মতি নিয়ে। ডঃ অরবিন্দ এবার উঠে দাঁড়ালেন, দরজা খুলে দাঁড়িয়ে দেখলেন—রোগী নয়, দাঁড়িয়ে আছে সেই বৃদ্ধ ভিক্ষুক, যাকে তিনি প্রথম দিনে দেখেছিলেন। চোখে তার অপার শূন্যতা, আর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। সে বলল, “আপনার শুশ্রূষা শেষ, ডাক্তারবাবু। এবার নিজেকে মুক্তি দিন।”

ডঃ অরবিন্দ বুঝতে পারলেন—এই মানুষটিই আসলে প্রতিটি আত্মার দূত। যে তাঁর জীবনে প্রতিটি গোপন পাপকে, অস্বীকারকে, ভুল নির্ণয়কে, অপ্রয়োজনে চাপিয়ে দেওয়া জীবনকে এনে সামনে রেখেছিল। যে সকল আত্মা এসে দাঁড়িয়েছিল তাঁর বাংলোর সামনে, তারা প্রত্যেকে কিছু না কিছু চেয়েছিল—কেউ বিচার, কেউ ক্ষমা, কেউ কেবল স্বীকৃতি। তাঁর নিজের চিকিৎসা-কর্মজীবন যেন একটি ভুলে ভরা ল্যান্ডস্কেপ ছিল, যেখানে কখনও কখনও সঠিক ডায়াগনোসিস, সময় মতো অস্ত্রোপচার, কিংবা সহানুভূতির অভাব রোগীর জীবনকে ধ্বংস করেছে। তিনি কখনও জানতেন, কখনও জানতেন না। কিন্তু পাহাড়ের এই নিঃশব্দ বাংলো যেন সেই জীবনের কাফেলা নিয়ে হাজির হয়েছিল, একে একে তাঁকে মুখোমুখি করানোর জন্য। আজ শেষ রাতে, ভিক্ষুক বলল, “আপনার রক্তে যে দোষ, সে আপনি জানতেন। কিন্তু যাদের রক্ত আপনি ছিঁড়েছিলেন অপারেশন থিয়েটারে, তারা তো জানত না। চলুন ডাক্তার, এবার আপনার মুক্তিস্থান।”

ডঃ অরবিন্দ জানেন না কীভাবে, কিন্তু তিনি সেই ভিক্ষুকের হাত ধরলেন। হালকা বাতাসে শরীরটা যেন হালকা হয়ে গেল, আর চোখের সামনে একফোঁটা অন্ধকার নেমে এল। পরদিন সকালে পাহাড়ি গ্রামে এক কাঠুরে এসে দেখে, বাংলোর সদর দরজা খোলা, চেয়ারে বসে আছেন ডঃ অরবিন্দ—নিশ্চল, নিঃশ্বাসহীন, চোখ দু’টো অদ্ভুতভাবে শান্ত। তাঁর পাশে রাখা একটা পুরনো সুটকেস, তাতে লেখা—“মুক্তিস্থান – উদ্দেশ্য অনন্ত।” আর দরজার গায়ে কালি দিয়ে কেউ লিখে গেছে—“তাঁর চিকিৎসা শেষ, এবার তাঁর মুক্তি।”

– সমাপ্ত –

1000046767.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *