Bangla - তন্ত্র - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

মৃত্যুর তালিকা

Spread the love

শৌনক দে


গ্রামের সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধ সেন অনুভব করলেন যে, এখানে কোনো সাধারণ শীতলতা নেই; বরং এক অদ্ভুত শীতলতা আছে, যা হাড় কাঁপানোর মতো ঠান্ডা না হলেও, মনকে স্থির করে, চুপচাপ করে রাখে। গ্রামটি চুপচাপ, রাস্তার ধুলো উঠছে নিঃশব্দে, এবং বাতাসে যেন অদৃশ্য কোনো দমনের গন্ধ ভাসছে। গ্রামের মানুষের চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক, যা তাদের মুখের হাসিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। তারা খুব সাবধানভাবে চলাফেরা করে, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তাদের প্রতি তাকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধ একটি ছোট কুঁড়েঘরের কাছে রিকশা থামালেন, যেখানে গ্রামের মানুষ সাধারণ জীবনযাপন করছে বলে মনে হলেও, তাদের আচরণে যেন প্রতিটি মুহূর্তে এক অনিশ্চয়তার চাপ অনুভূত হচ্ছে। তিনি তার নোটবুক বের করলেন, কলম ধরলেন, এবং গ্রামের বৃদ্ধ, কৃষক ও দোকানদারদের কাছে কথোপকথন শুরু করলেন। একে একে তারা নিজেরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, পূর্ণিমার রাতে অদৃশ্য হওয়া ব্যক্তিদের গল্প বলল। কেউ বলল, “গত পূর্ণিমায় চেয়ারগামী হরদয়পুর দাদা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।” আরেকজন বলল, “আমরা শুনেছি, পূর্ণিমার রাতে কেউ যদি অন্ধকারে বের হয়, সে আর ফিরে আসে না।” অনিরুদ্ধ লিখে নিচ্ছিলেন, কিন্তু একটি অদ্ভুত হতাশা এবং শীতলতা তার রক্তের গতি ধীর করে দিয়েছিল।

রাত হয়ে এলে গ্রামের প্রতিটি ঘর যেন আরও সংকীর্ণ এবং চুপচাপ হয়ে উঠল। চাঁদের আলো পড়ছিল জমিনে, গাছের ছায়া দীর্ঘ এবং ভীতিকর। অনিরুদ্ধ নিজেকে প্রস্তুত করলেন, সত্যের খোঁজে রাতের অন্ধকারে হেঁটে চলার জন্য। তিনি গ্রামের শেষ প্রান্তের একটি খোলা মাঠের দিকে এগিয়ে গেলেন, যেখানে গ্রামের কিছু যুবক এবং বৃদ্ধেরা বসে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন যুবক উঠে চিৎকার করল, “দেখুন! সে চলে গেল!” অনিরুদ্ধ চোখ ফেরালেন, কিন্তু কোনো দৃশ্যমান কিছু ছিল না। শুধু বাতাসে অদ্ভুত শব্দ, গাছের হাহাকার, এবং এক ধরনের নিঃশব্দ চাপ। যুবক বলল, “হরদয়পুর দাদার মতোই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।” অনিরুদ্ধ আশ্চর্য হলেন, তাঁর সাংবাদিক মনের প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলল, এ নিশ্চয় কোনো মানসিক বা শারীরিক ঘটনা; কিন্তু চোখে যা দেখলেন, তা একরকম বাস্তব এবং ভয়ঙ্কর। তিনি দ্রুত তার কলম ধরলেন এবং সেই মুহূর্তের প্রতিটি সূক্ষ্ম সংবেদন লিখতে শুরু করলেন—কিভাবে বাতাস হঠাৎ থেমে গেল, কিভাবে চাঁদের আলো নিঃসঙ্গভাবে প্রতিফলিত হচ্ছিল, এবং কিভাবে যুবকটির চোখে আতঙ্ক ভেসে উঠল।

মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অনিরুদ্ধ অনুভব করলেন যে, গ্রামটির ভীতিকর নিস্তব্ধতা যেন তার চারপাশে এক অদৃশ্য দেহের মতো মোড়ানো। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, একটি ছায়া গাছের পাশ দিয়ে অদৃশ্যভাবে সরে যাচ্ছে। তিনি হাঁক দিলেন, কিন্তু শব্দ কিছুই ফিরল না। ছায়াটি যেন বাতাসের মতো হালকা, অথচ তার অস্তিত্বে এক অদ্ভুত জোর ছিল। অনিরুদ্ধ তখন বুঝতে পারলেন যে, গ্রামে শুধু আতঙ্ক নয়, এখানে কোনো অদ্ভুত শক্তি কাজ করছে, যা নিয়মিত পূর্ণিমার রাতে মানুষদের নিখোঁজ করে নিচ্ছে। তিনি নোটবুকে দ্রুত লিখলেন, “প্রতি পূর্ণিমায় অদৃশ্য হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। গ্রামবাসী এটি নিয়ে মুখ খোলেন না, ভয়ে চুপ থাকে। পূর্ণিমার রাতে তাদের শোনানো কাহিনী সত্যিই বাস্তব।” রাতের অন্ধকারে ফিরে এসে তিনি একটি কুঁড়েঘরে রাত কাটালেন, কিন্তু ঘুম তাকে এড়িয়ে গেল। মনোযোগ এবং শীতল আতঙ্ক মিলে একটি অদ্ভুত সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল, যা তাকে বলছিল, গ্রামে ঘটে চলা এই নিখোঁজের ঘটনাগুলি কেবল শুরুর প্রহর, এবং সত্য উন্মোচনের জন্য তার আরও গভীর অনুসন্ধান করা প্রয়োজন হবে।

অনিরুদ্ধ সেন গ্রামের নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের কেস নিয়ে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান শুরু করলেন। তিনি তার নোটবুক খুলে গত তিন বছরের সমস্ত খবর এবং কেস সংগ্রহ করতে লাগলেন। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেল, এই সময়ে মোট ১৮ জন মানুষ অদৃশ্য হয়েছে। কেউ বলল, “সারা গ্রামে আমাদের মধ্যে যে কেউ রাতের অন্ধকারে বের হলে সে আর ফিরে আসে না।” অনিরুদ্ধ দেখতে পেলেন, নিখোঁজ হওয়া মানুষের বয়স, পেশা এবং সামাজিক পরিচয় একেবারেই ভিন্ন, কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার সময়ের মিল এক: সবাই পূর্ণিমার রাতেই হারিয়েছে। এই তথ্য সংগ্রহ করে অনিরুদ্ধের মনে আরও এক অদ্ভুত প্রশ্ন জন্মাল—কি কারণে শুধু পূর্ণিমার রাতেই মানুষ অদৃশ্য হয়? তিনি গ্রামের বৃদ্ধদের কাছে গেলেন, যারা নিজেদের জীবনের গল্প বলার সময় অদ্ভুতভাবে থেমে গিয়ে কাঁপতে লাগল। তারা জানাল, প্রথমবার কেউ “মৃত্যুর তালিকা” শব্দটি ব্যবহার করল, এবং তারপর থেকেই গ্রামের মানুষরা এই শব্দ শুনলেই ভয়ে কাঁপতে শুরু করে।

অনিরুদ্ধ জানতে পারলেন, মৃত্যুর তালিকা তৈরি করেন গ্রামীয় তান্ত্রিক মহাদেবী। তার নাম নিয়ে গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত। কেউ বলল, তিনি সব কিছু জানেন, অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনা প্রায়শই তার হাতের তালিকায় থাকে। অনিরুদ্ধের সাংবাদিক মন তখন অবাক হয়ে গেল—কিন্তু তিনি সন্দেহও করলেন, এ কি বাস্তব, নাকি কেবল লোককাহিনী? তিনি একটি বৃদ্ধের কাছে আরও গভীর তথ্য চাইলেন। বৃদ্ধ গোপনে বললেন, “তুমি যদি জানতে চাও, তবে সাবধান হও। মহাদেবীর চোখ সর্বদা এখানে। যারা এই তালিকায় থাকে, তাদের ভাগ্য নিখোঁজ হয়ে যায়, কেউ ফেরে না।” অনিরুদ্ধ নোটবুকে লিখছিলেন, “গত তিন বছরে যারা নিখোঁজ হয়েছে, তাদের নাম ও পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতিটি নিখোঁজের ক্ষেত্রে, পূর্ণিমার রাতের আগের দিনই তাদের আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।” তিনি গ্রামের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে, নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে কথা বললেন। এক পরিবারের সন্তান হঠাৎ অদৃশ্য হওয়ার গল্প শুনে অনিরুদ্ধের মনে ভয় এবং কৌতূহলের এক অনন্য মিশ্রণ জন্মাল।

পরীক্ষামূলকভাবে অনিরুদ্ধ কিছু অদৃশ্য কেসের নিখোঁজ সময়, স্থান এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেন। তিনি দেখতে পেলেন, নিখোঁজদের মধ্যে কেউ রাস্তার মাঝখানে, কেউ ঘরের উঠোনে, কেউ আবার নদের ধারে হারিয়েছে। কিন্তু মিলন একটাই—সবাই পূর্ণিমার রাতে। গ্রামের মানুষরা বলল, মহাদেবী তালিকা তৈরি করার আগে সেই পরিবারের কাছ থেকে অদৃশ্য ব্যক্তির নাম নেন, এবং তারপরই ব্যক্তি নিখোঁজ হয়ে যায়। অনিরুদ্ধের মনে একটি নতুন প্রশ্ন জেগে উঠল: এই তালিকার পেছনে কি কেবল ভয়ঙ্কর লোককাহিনী, নাকি এর পেছনে সত্যিই কোনো অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে? তার সাংবাদিক মন বলছিল, এই রহস্য উন্মোচন করতে হলে তাকে সরাসরি মহাদেবীর কাছে যেতে হবে। রাতের অন্ধকারে তিনি তার নোটবুক বন্ধ করলেন, কিন্তু চাঁদের আলোয় গ্রামের প্রতিটি কোণ যেন তাকে ডাকছে। নিখোঁজদের হিসাব, মৃত্যুর তালিকার অস্তিত্ব, এবং মহাদেবীর অদ্ভুত ক্ষমতা—সবকিছুই অনিরুদ্ধকে আরও গভীর অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করছিল। এই রাতটি শুধু তথ্য সংগ্রহের নয়, বরং এক নতুন ভয় এবং রহস্যের সূচনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রইল।

গ্রামের ছোট একটি মন্দিরের অন্ধকার ঘরে অনিরুদ্ধ সেন বসে আছেন। বাতাসে মোমবাতির জ্বলন্ত শিখা এবং মাটির গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করছে। মন্দিরের পুরোহিত কালীপদ ঝা, যিনি সাধারণ সময়ে অত্যন্ত সংযমী এবং ভদ্র, আজ অনিরুদ্ধকে গোপনে কিছু বলার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। তাঁর চোখে অনিশ্চয়তার ছায়া এবং অদ্ভুত ভয় লক্ষ্য করা যায়। তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অনিরুদ্ধকে বলেন, “তুমি যে ‘মৃত্যুর তালিকা’ নিয়ে অনুসন্ধান করছ, তার ইতিহাস একশ বছরেরও বেশি পুরোনো। এই তালিকা কেবল সাম্প্রতিক তিন বছরের জন্য নয়—এটির জন্ম ঘটেছে অনেক আগে, একটি অভিশাপের ফলশ্রুতিতে।” অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে তাকালেন। তিনি জানতেন না যে, এই গ্রামে শুধু নিখোঁজ হওয়া মানুষের ঘটনা নয়, এর পেছনে এত পুরোনো ইতিহাসও লুকিয়ে আছে। কালীপদ ঝা বললেন, “প্রায় একশ বছর আগে গ্রামে একজন শক্তিশালী তান্ত্রিক ছিলেন। তার ক্ষমতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, তিনি মানুষের জীবন ও মৃত্যুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারতেন। মৃত্যুর পর তার অভিশাপ এই তালিকার মাধ্যমে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। যাদের নাম তালিকায় থাকত, তারা নিখোঁজ হয়ে যেত।” অনিরুদ্ধ নোটবুকে দ্রুত লিখছিলেন, প্রতিটি শব্দ যেন ইতিহাসের গভীর ভয় প্রকাশ করছে।

পুরোহিত কালীপদ আরও বললেন, “শুরুতে, তান্ত্রিক নিজে এই তালিকা তৈরি করতেন। তবে তার মৃত্যুর পর, তালিকার কাজটি পরবর্তী কেউ নিয়েছিলেন, এবং শেষপর্যন্ত মহাদেবী গ্রহণ করেছেন। গ্রামের মানুষদের ধারণা, মহাদেবী এখন তালিকার রক্ষক। তিনি তালিকায় নাম লিখে রাখেন এবং পূর্ণিমার রাতে সেই ব্যক্তির ভাগ্য স্থির করেন। তালিকার নিয়ম কঠোর এবং অমান্য করার সুযোগ নেই। কেউ যদি চেষ্টাও করে, অদৃশ্য শক্তি তাকে থামিয়ে দেয়।” অনিরুদ্ধের মন যেন জ্ঞান এবং ভয়ের মধ্যে আটকা পড়ে। তিনি বুঝতে পারলেন, শুধু নিখোঁজ হওয়া মানুষের ঘটনা নয়, গ্রামীয়দের বিশ্বাস, ইতিহাস এবং এক অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি মিলিত হয়ে এক অশুভ কাহিনি তৈরি করছে। পুরোহিতের চোখে অসংখ্য রহস্যের ছায়া ভেসে উঠছে, এবং তিনি স্পষ্টভাবে সতর্ক করলেন, “যদি তুমি সত্যের অনুসন্ধান করতে চাও, সাবধান হও। এই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হলে, নিজেও যে কোনো সময় তালিকার শিকার হতে পারো।”

অনিরুদ্ধ গ্রামের অন্য স্থানগুলোতে ঘুরে দেখলেন এবং জানতে পারলেন, তালিকার অশুভ ইতিহাস কেবল গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে নেই—এটি প্রমাণিত ঘটনা। শতাব্দী আগে যে তান্ত্রিক ছিলেন, তার ক্ষমতা এতই শক্তিশালী ছিল যে, তার মৃত্যুর পরও গ্রামে ভয়, অদৃশ্য শক্তি এবং নিখোঁজ হওয়া মানুষের ঘটনা চলছেই। মহাদেবীর নাম এখানে শুধু রহস্য নয়, বরং গ্রামীণ ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু। অনিরুদ্ধ বুঝলেন, এই কাহিনি কোনো সাধারণ লোককাহিনী নয়; এটি ইতিহাস, অভিশাপ, এবং অদৃশ্য শক্তির মিশ্রণ। তিনি নিজেকে প্রস্তুত করলেন, কারণ সত্য উন্মোচন করার জন্য তাকে এই অশুভ কাহিনির গভীরে যেতে হবে। রাতের অন্ধকার, চাঁদের আলো, গ্রামের নিস্তব্ধতা এবং পুরোহিতের কথাগুলো মিলিত হয়ে অনিরুদ্ধকে একটি ভয়ঙ্কর জ্ঞান ও কৌতূহলের জালে আবদ্ধ করল। এই রাতে অনিরুদ্ধ বুঝতে পারলেন, যে রহস্যের খোঁজ তিনি শুরু করেছেন, তা শুধু নিখোঁজের ঘটনা নয়—এটি এক শতাব্দীজুড়ে চলমান এক অশুভ কাহিনি, যা গ্রামকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

গ্রামের শান্তি আবারও ভেঙে গেল, যখন স্কুলশিক্ষিকা আরিত্রি দত্তের ছোট ভাই হঠাৎ নিখোঁজ হল। অনিরুদ্ধ সেন খবর পেলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার স্থান ধরে তদন্ত শুরু করলেন। গ্রামের মানুষরা বলল, “পুরো গ্রাম চুপচাপ ছিল, কিন্তু আরিত্রির ভাই হঠাৎ রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। কেউ কিছু বলতে সাহস পেল না।” অনিরুদ্ধ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখলেন, ঘর এবং উঠোনে কোনো লড়াই বা অস্বাভাবিক চিহ্ন নেই, যা নির্দেশ দিচ্ছিল, নিখোঁজ হওয়া মানুষের সঙ্গে কোনো দৈনন্দিন ঘটনার সম্পর্ক। তবে গ্রামের মানুষদের কথায় স্পষ্ট হলো, নিখোঁজ হওয়ার আগের রাতেই ভাইটি অদ্ভুতভাবে দুশ্চিন্তায় ছিল। অনিরুদ্ধ নোটবুকে লিখলেন, “এবার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক নয়। পূর্বের সমস্ত নিখোঁজের সঙ্গে মিল রয়েছে, এবং এটি প্রমাণ করছে যে, মৃত্যুর তালিকায় নাম ওঠা মানেই মৃত্যু নিশ্চিত।”

কিছুদিন পর, নদীর ধারে ভাইটির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। আরিত্রি দত্তের চোখে অশ্রু, মুখে ভাঙা ভঙ্গি, এবং কণ্ঠে অদ্ভুত কাঁপানী—সবই অনিরুদ্ধকে ভয় এবং দুঃখের মধ্যে আটকে দিল। তিনি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, তবে আরিত্রি নিজের কষ্টে ভেঙে পড়েছিলেন। সেই সন্ধ্যায়, নদীর কুলের শীতল বাতাস, জলে প্রতিফলিত চাঁদ, এবং মৃতদেহের দৃশ্য অনিরুদ্ধকে গভীরভাবে আঘাত করল। আরিত্রি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি চাই না, অন্য কেউ এভাবে হারাক। সত্য খুঁজে বের কর, অনিরুদ্ধ। আমাদের পরিবারকে আর কেউ নিখোঁজ হতে দেব না।” অনিরুদ্ধ শপথ নিলেন, শুধু নিখোঁজের কারণ খুঁজে বের করা নয়, বরং এই অদৃশ্য শক্তির মোকাবিলা করা। তিনি বুঝতে পারলেন, মৃত্যুর তালিকা কেবল গল্প নয়; এটি বাস্তব এবং ভয়ঙ্কর। আরিত্রির দৃঢ় সংকল্প এবং তার ব্যক্তিগত শোক অনিরুদ্ধকে আরও দৃঢ়ভাবে সত্য অনুসন্ধানে চালিত করল।

এই ঘটনার পর, গ্রামের মানুষদের মধ্যে মৃত্যুর তালিকার আতঙ্ক আরও শক্তিশালী হলো। অনিরুদ্ধ খেয়াল করলেন, নিখোঁজ হওয়া মানুষদের পরিবার, প্রতিবেশী, এবং এমনকি স্থানীয় কর্মকর্তা সবাই তালিকার ভয়ে অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে উঠেছে। তারা চুপচাপ ঘরে থাকছে, রাতে কোনো অপ্রয়োজনীয় কার্যকলাপ করছে না, এবং কেউ চাঁদের আলোতে বাইরে বের হচ্ছে না। আরিত্রি দত্তের পরিবারের কষ্ট এবং ভাইয়ের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর প্রভাব স্পষ্ট; গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়ে গেছে—যদি তালিকায় নাম ওঠে, মৃত্যু অটল। অনিরুদ্ধ নোটবুকে লিখলেন, “এখন আমি নিশ্চিত, মৃত্যুর তালিকা শুধু গল্প নয়। এটি অদৃশ্য শক্তির প্রতিফলন, এবং এই তালিকার নিয়মকে অমান্য করলে পরিণতি ভয়ঙ্কর।” রাতের নিস্তব্ধতা, নদীর ধারে ভাইয়ের মৃতদেহ, আরিত্রির চোখের অশ্রু, এবং গ্রামের মানুষের ভয়—সব মিলিয়ে অনিরুদ্ধকে এক অদ্ভুত চাপের মধ্যে ফেলেছে। তিনি বুঝলেন, তার অনুসন্ধান শুধু তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া, যেখানে মানুষের জীবন, ভয় এবং অতিপ্রাকৃত শক্তি একসাথে মিলিত।

গ্রামের হাসপাতালের ছোট ঘরে অনিরুদ্ধ সেন বসে ছিলেন, আর সামনে বসেছিলেন গ্রামের একমাত্র ডাক্তার ডাঃ শঙ্কর নন্দী। ডাঃ নন্দী একজন যৌক্তিক চিন্তাধারার মানুষ; তিনি বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞান, যুক্তি, এবং প্রমাণ ছাড়া কোনো ঘটনা সত্য নয়। তিনি অনিরুদ্ধকে বললেন, “এই সব নিখোঁজের ঘটনা, পূর্ণিমার রাতের অদৃশ্যতা—সবই কুসংস্কার। মানুষ ভয়ে অতিরিক্ত কল্পনা করছে। ‘মৃত্যুর তালিকা’? এমন কিছু নেই।” ডাঃ নন্দী নিজেই প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করেছিলেন, রোগীর ইতিহাস, মানসিক অবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে মনে করতেন, গ্রামের মানুষের ভয়ই এই রহস্যকে বড় করে দেখাচ্ছে। অনিরুদ্ধ তার নোটবুকে লিখছিলেন, ডাক্তার যে যুক্তি-ভিত্তিক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তাতে গ্রামের ভয় এবং অতিপ্রাকৃত ধারণার মধ্যে একটি স্পষ্ট দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ তাকে এক অদ্ভুত অবস্থায় ফেলল। ডাঃ নন্দীর একজন রোগী হঠাৎ মারা গেল। রোগীটির মৃত্যু ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত—কোনো পূর্বনির্ধারিত শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াই। ডাঃ নন্দী নিজেই অবাক হয়ে পড়লেন। তিনি রোগীর শারীরিক পরীক্ষা, চিকিৎসা ইতিহাস এবং গ্রামে চলমান সমস্ত রোগের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলেন, কিন্তু কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা বের করতে পারলেন না। অনিরুদ্ধ লক্ষ্য করলেন, যিনি বিজ্ঞানকে অস্ত্র হিসেবে ধরে রেখেছেন, তিনি নিজের চোখের সামনে এমন অদ্ভুত মৃত্যু দেখে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন। ডাঃ নন্দীও ভেতরে ভেবেছিলেন, “এ কি সত্যিই কাকতালীয়? না কি কিছু অদৃশ্য শক্তি আছে যা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না?” এই প্রশ্ন তার মনে দানা বাঁধল, এবং তিনি অনিরুদ্ধকে আরও গভীর তদন্ত করার পরামর্শ দিলেন। অনিরুদ্ধ নোটবুকে লিখলেন, “যেখানে যুক্তি ব্যর্থ, সেখানে কুসংস্কারের দিক দিয়ে চিন্তা করতেই হয়। কিন্তু বাস্তবতায় কি সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি কাজ করছে, তা খুঁজে বের করা এখনই জরুরি।”

রাতের নিস্তব্ধতা, হাসপাতালের ধুলোময় বাতাস, এবং রোগীর হঠাৎ মৃত্যু—সব মিলিয়ে অনিরুদ্ধের অনুসন্ধানকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। গ্রামের মানুষের মধ্যে যুক্তি বনাম কুসংস্কারের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠল। ডাঃ নন্দী তার সমস্ত যুক্তি ব্যবহার করে মৃত্যুর তালিকার ব্যাখ্যা করতে চাইলেন, কিন্তু নিজের রোগীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু তাকে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ফেলল। অনিরুদ্ধ বুঝলেন, শুধুমাত্র প্রমাণ বা কুসংস্কার নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়; তাকে উভয় দিকই বিবেচনা করতে হবে। তিনি আরও দৃঢ়ভাবে ঠিক করলেন, গ্রামে ঘটে চলা নিখোঁজ, মৃত্যু এবং ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলোর পেছনে সত্য কি, তা উদ্ঘাটন করতে হবে। যুক্তি এবং কুসংস্কারের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব তাকে শেখালো, যে কোনো রহস্য শুধুমাত্র দৃঢ় পর্যবেক্ষণ, গভীর বিশ্লেষণ এবং সাহসিকতার মাধ্যমে সমাধান করা যায়, এবং এই রহস্যের গভীরে নামার সময় তার নিজের বিশ্বাস ও যুক্তি পরীক্ষা হবে।

অনিরুদ্ধ সেন দীর্ঘ সন্ধ্যার পর গ্রামের শেষ প্রান্তে অবস্থিত এক অদ্ভুত পুরোনো বাড়িতে পৌঁছালেন। বাড়িটি একরকম নীরব, এবং বাইরে চাঁদের আলো পড়ছে ধূসর দেয়ালে। তিনি জানতেন, আজকের রাতটি তার অনুসন্ধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ—মহাদেবীর সঙ্গে দেখা। ভিতরে প্রবেশ করলে, তিনি দেখলেন মহাদেবী এক শান্ত কিন্তু শক্তিশালী উপস্থিতিতে বসে আছেন। তার চোখে এমন এক গভীরতা, যা ভয়ে ও জিজ্ঞাসার মধ্যে সমানভাবে মিশে আছে। অনিরুদ্ধ তার সামনাসামনি বসে, সমস্ত সাহস নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। মহাদেবী বললেন, “তুমি জানতে চাও মৃত্যুর তালিকার রহস্য। আমি এটি তৈরি করি না, তালিকা আমার কাছে আসে। কখনও কখনও স্বপ্নে কেউ আসে, এবং তার নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালিকায় লেখা হয়ে যায়।” অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে তাকালেন। তিনি ভাবতে শুরু করলেন, এমনকি মহাদেবীর মতো একজন শক্তিশালী ব্যক্তি এ ঘটনার নিয়ন্ত্রণে নেই—কেন যেন তার নিজস্ব বিশ্বাসও কার্যকর হতে পারছে না।

মহাদেবীর কথায় এমন অদ্ভুত গভীরতা ছিল, যা অনিরুদ্ধকে এক অদ্ভুত দিশাহীন অবস্থায় ফেলল। তিনি আরও বলেন, “যার নাম তালিকায় ওঠে, তাকে রক্ষা করা যায় না। আমি যত চেষ্টা করি, কিছুতেই তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এটি একটি প্রাকৃতিক নিয়ম নয়; এটি একটি অতিপ্রাকৃত নিয়ম, যা সময় এবং মহাশক্তির বাইরে।” অনিরুদ্ধের মনে প্রশ্ন জন্মাল, এই তালিকা কি কেবল ভয় এবং অভিশাপের প্রতিফলন, নাকি কোনো শক্তিশালী অতিপ্রাকৃত নিয়ম যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে? মহাদেবীর কথায় স্পষ্ট হলো, যদিও তিনি শক্তিশালী, কিন্তু এই তালিকার সঙ্গে তার কোনো সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই—তালিকা যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছে। অনিরুদ্ধ নোটবুকে লিখলেন, “এটি মানব বোধের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তালিকা তৈরি হয় না, আসে, এবং যার নাম ওঠে, তার নিয়ন্ত্রণ আমাদের নেই। এটি শিখতে হচ্ছে—ভয়, বিশ্বাস এবং অদ্ভুত শক্তির মধ্যে মানবের সীমাবদ্ধতা।”

মহাদেবীর সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনের মধ্যে অনিরুদ্ধ অনুভব করলেন যে, এই তালিকার রহস্য শুধুমাত্র ভয় বা কুসংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি অতিপ্রাকৃত শক্তি, মানবীয় সীমাবদ্ধতা, এবং ভাগ্যের অদ্ভুত জালিয়াতির একটি মিশ্রণ। মহাদেবীর কণ্ঠে যেমন দৃঢ়তা, তেমনি রহস্যের আবরণ—এটি অনিরুদ্ধকে বুঝিয়ে দিল, যে তালিকার রক্ষক শুধু একজন ব্যক্তি নয়; তিনি একটি মাধ্যম, যার কাছে তালিকা আসে এবং যা মানব ক্ষমতার বাইরে কাজ করে। অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলেন, যে নিখোঁজ, মৃত্যু, এবং তালিকার সাথে যুক্ত সমস্ত ঘটনাই একটি বড় প্রাকৃতিক নিয়ম এবং অতিপ্রাকৃত সত্যের প্রতিফলন। মহাদেবীর কথার মধ্যে থাকা এই গভীর রহস্য—যা বোঝা যায় না, যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়—অনিরুদ্ধকে এক নতুন পর্যায়ে পৌঁছে দিল। তিনি বুঝলেন, এখন তাঁর কাজ শুধু তথ্য সংগ্রহ বা বিশ্লেষণ নয়, বরং এই অদ্ভুত বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে চলা এবং সত্য উন্মোচন করার জন্য ধৈর্য ও সাহস প্রয়োগ করা।

পূর্ণিমার রাত ছিল এক অদ্ভুত মায়াময়, চাঁদের আলো নদীর ধারে ঝলমল করছিল, বাতাসে শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছিল এবং আশেপাশের পাখির ডাকও নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। অনিরুদ্ধ সেন আর স্কুলশিক্ষিকা আরিত্রি দত্ত একসাথে শ্মশানঘাটের দিকে এগোলেন। তারা জানতেন, নিখোঁজ হওয়া যুবকের আত্মা বা কোনো অদ্ভুত শক্তির উপস্থিতি হয়তো এখানে দেখা যেতে পারে। শ্মশানঘাটের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়, তাদের পা যেন অজান্তেই নীরবতার সঙ্গে মিলিত হচ্ছিল। নদীর ধারে ছায়ার প্রতিফলন এবং আগুনের ধোঁয়া এক মৃদু আতঙ্ক তৈরি করছিল। অনিরুদ্ধ নোটবুক হাতে নিয়েছিলেন, কিন্তু এমন রাতের নিস্তব্ধতা, অদ্ভুত বাতাস এবং ছায়ার খেলায় তার কলমও যেন স্থির হয়ে গেল। হঠাৎ, তারা লক্ষ্য করলেন এক ছায়ামূর্তি—এক যুবকের মতো, যার উপস্থিতি নিখোঁজ হওয়া যুবকের সঙ্গে মিল রাখছিল।

ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে সামনে আসল, কিন্তু এটি কোনো মানুষের মতো ছিল না। চাঁদের আলোয় তার দেহ আংশিক ভেসে উঠছিল, চোখে অদ্ভুত দুঃখ এবং আকাঙ্ক্ষা ভেসে উঠছিল। অনিরুদ্ধ বললেন, “আরিত্রি, তুমি কি দেখছো?” আরিত্রি কাঁপতে কাঁপতে বলল, “হ্যাঁ, এটা সে—আমার ভাই। কিন্তু কীভাবে?” অনিরুদ্ধ তার কলম ধরলেন, কিন্তু নোটবুকে লিখে রাখতে পারলেন না, কারণ ছায়ামূর্তির উপস্থিতি এত ক্ষণস্থায়ী এবং অতিপ্রাকৃত ছিল যে, প্রতিটি মুহূর্তই মুছে যাচ্ছিল। ছায়ামূর্তির চোখে এমন এক বিষাদ, যা তাদের দুজনের হৃদয়ে অদ্ভুত কাঁপন ধরাল। তারা চেষ্টা করল তা ছবি বা ভিডিওতে ধারণ করতে, কিন্তু যন্ত্রপাতি, হাতের স্পর্শ বা চোখের সামনে—সবই ব্যর্থ হলো। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারলেন, এই আত্মা বা ছায়ামূর্তি মানবজগৎ বা প্রযুক্তির দ্বারা ধরে রাখা সম্ভব নয়; এটি একমাত্র চোখের দেখা এবং মনের অনুভবের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

হঠাৎ, ছায়ামূর্তিটি নীরবভাবে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। বাতাস, নদীর জল, চাঁদের আলো—সবই যেন আবার শান্ত হয়ে গেল। অনিরুদ্ধ আর আরিত্রি দাঁড়িয়ে থেকে তাকালেন, কিন্তু কোনো প্রমাণ হাতে রাখতে পারলেন না। অনিরুদ্ধ মনে মনে লিখলেন, “এই রাতের ঘটনা আমাদের কেবল অনুভব করতে দিল, কিন্তু প্রমাণ রাখতে পারল না। এই ছায়ামূর্তি নিখোঁজ যুবকের আত্মা কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, কিন্তু হৃদয় এবং মন এই সত্যকে গ্রহণ করেছে।” এই অভিজ্ঞতা অনিরুদ্ধকে আরও গভীরভাবে বুঝিয়ে দিল যে, গ্রামে ঘটছে এমন নিখোঁজ, আত্মার উপস্থিতি এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলো মানুষের সীমিত জ্ঞানের বাইরে। রাতটি কেবল ভয়ের নয়, বরং অনিরুদ্ধ ও আরিত্রির জন্য এক অভিজ্ঞতা, যা তাদের অনুসন্ধানকে আরও দৃঢ় এবং রহস্যময় করে তুলল। নিখোঁজ যুবকের আত্মার এই সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি, ছায়ামূর্তির ক্ষণস্থায়ী রূপ, এবং প্রমাণের অভাব—সবই তাদের মনে গভীর প্রশ্ন তুলল, এবং সত্যের সন্ধানের পথে তাদের অদ্ভুতভাবে পরিচালিত করল।

অনিরুদ্ধ সেন গ্রামের মন্দিরে বসে এক অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে কালীপদ ঝার মুখের দিকে তাকালেন। পুরোহিতের চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা, অতীতের বেদনায় ভরা স্মৃতি ভেসে উঠছিল। কালীপদ ঝা নীরবতা ভেঙে বললেন, “অনিরুদ্ধ, তুমি যতই যৌক্তিক বিশ্লেষণ করো না কেন, এই গ্রামের রহস্যের শিকড় বহু আগে, এক অভিশপ্ত কাহিনিতে লুকিয়ে আছে।” অনিরুদ্ধ আগ্রহী হয়ে কলম ধরলেন, এবং কালীপদ ঝা শুরু করলেন এক গোপন কাহিনি। অনেক বছর আগে, গ্রামে এক ধনী মহাজন ছিলেন, যার প্রভাব এবং ক্ষমতা সম্পূর্ণ গ্রামের উপর ছড়িয়ে ছিল। তিনি তান্ত্রিককে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন, শুধু তার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করার কারণে। গ্রামের মানুষ জানত, তান্ত্রিক ছিলেন শক্তিশালী, তবে মহাজনের প্রতাপ এবং ধনী ক্ষমতার সামনে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মৃত্যুর আগে, তান্ত্রিক ধীরে ধীরে মহাজনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “প্রতি পূর্ণিমায় তোমাদের বংশধররা মরবে।” অনিরুদ্ধ শোনার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলেন, যে এই কাহিনির মধ্যে শুধুমাত্র অতিপ্রাকৃত ভয় নয়, বরং বঞ্চনা, অন্যায় এবং প্রতিশোধের গভীর ইতিহাস লুকিয়ে আছে।

কালীপদ ঝা আরও গভীরে গেলেন। তিনি বললেন, “এই অভিশাপ এত প্রভাবশালী যে, আজও গ্রামে প্রতিটি নিখোঁজ ব্যক্তি এবং মৃত্যুর ঘটনায় এই শিকড় দেখা যায়। যে তালিকায় নাম ওঠে, তারা হয় মহাজনের বংশধর, অথবা তার অন্যায়ের শিকার পরিবারের সদস্য। প্রথম দিকে তালিকা তৈরি হতো তান্ত্রিকের দ্বারা, তবে তার মৃত্যুর পর মহাদেবীর হাতে আসল। মহাদেবী তালিকাকে রক্ষা করে, কিন্তু তৈরি করেন না; তালিকা যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে। অতিপ্রাকৃত শক্তি এবং মানুষের ইতিহাস মিলিত হয়ে এটি কার্যকর হয়।” অনিরুদ্ধ নোটবুক খুলে সমস্ত তথ্য দ্রুত লিখলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, গ্রামে চলমান নিখোঁজের ঘটনা এবং মৃত্যুর তালিকার ভয়ঙ্কর প্রভাব শুধুমাত্র অতিপ্রাকৃত নয়; এটি একটি ইতিহাস, যা শতাব্দী ধরে বঞ্চিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে শিকড় গেড়েছে। কালীপদ ঝার কণ্ঠে ছিল গভীর আঘাত, কিন্তু একই সঙ্গে সতর্কবার্তা, যেন অনিরুদ্ধ বুঝতে পারবে—এই কাহিনির প্রভাব এবং রহস্যের গভীরতা মানুষের সীমার বাইরে।

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলেন যে, গ্রামের নিখোঁজ হওয়া মানুষ এবং মৃতদেহের ঘটনা শুধুমাত্র একটি তালিকা বা অভিশাপের গল্প নয়। এটি এক বৃহৎ প্রাচীন অভিশাপের প্রতিফলন, যা ইতিহাস, প্রতিশোধ এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির মিশ্রণ। মহাজনের অন্যায় এবং তান্ত্রিকের অভিশাপ এক ধরনের প্রাকৃতিক নিয়ম তৈরি করেছে—যেখানে নাম ওঠে, সেই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিপদ অটল। অনিরুদ্ধ বুঝলেন, সত্য উদ্ঘাটন করতে হলে তাকে অতীত এবং বর্তমান, ইতিহাস এবং বাস্তবতা, যুক্তি এবং কুসংস্কার—সবকিছুর মধ্যে মিল খুঁজতে হবে। রাতের নিস্তব্ধতা, কালীপদ ঝার গোপন কাহিনি, এবং গ্রামে ছড়িয়ে থাকা ভয়—all মিলিয়ে অনিরুদ্ধের মনে একটি দৃঢ় সংকল্প তৈরি করল, যে এই অভিশপ্ত কাহিনির শিকড় উন্মোচন না করা পর্যন্ত গ্রামের রহস্য চিরকাল অমোঘ এবং অপ্রকাশ্য থাকবেই।

অনিরুদ্ধ সেনের অনুসন্ধান তাকে একটি অপ্রত্যাশিত সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাল। বহু রাতের পর্যবেক্ষণ, গ্রামের মানুষের সাক্ষ্য এবং মহাদেবীর সঙ্গে কথোপকথনের বিশ্লেষণের পর তিনি বুঝলেন যে, যা তিনি এতদিন অতিপ্রাকৃত শক্তি ও অভিশাপ মনে করছিলেন, তা আসলে বাস্তবে ছিল একটি গোপন পরিকল্পনা। তালিকা—যার নাম উঠেছে, সেই ব্যক্তি নিখোঁজ হয়—মহাদেবী তৈরি করেন না। বরং একটি শক্তিশালী গোপন দল, যাদের সদস্যরা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালী, প্রাচীন অভিশাপের কাহিনি ব্যবহার করে মানুষকে ভয় দেখিয়ে হত্যা সাজায়। তারা তালিকাকে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে, যেন প্রত্যেক ঘটনাই অতিপ্রাকৃত ও অনিয়ন্ত্রিত মনে হয়। অনিরুদ্ধ নোটবুকে লিখলেন, “যতদিন আমরা তালিকার পেছনের সত্য খুঁজে পাইনি, গ্রামের মানুষরা এই ভয় এবং রহস্যে বিভ্রান্ত ছিল। তবে বাস্তবতায় এটি মানুষের পরিকল্পনা এবং লোভের ফল।”

অনিরুদ্ধ আরও খুঁজে বের করলেন যে, এই গোপন দলের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল গ্রামের জমি দখল করা। তারা সম্পত্তির মালিকানার সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবারগুলোকে লক্ষ্য করেছিল, এবং প্রত্যেককে নিখোঁজ বা মৃত বলে প্রদর্শন করে তাদের ভয় দেখাত। আরিত্রির ভাইও শুধুমাত্র নিখোঁজ হয়নি—তিনি আসলে হত্যা হয়েছিলেন। তার মৃত্যুকে অতিপ্রাকৃত ঘটনা মনে করানোর জন্য তারা সূক্ষ্মভাবে সবকিছু সাজিয়েছিল, যেন গ্রামের মানুষ এবং বাহ্যিক তদন্তকারীর চোখে এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত “অভিশপ্ত ঘটনা” হিসেবে প্রতীয়মান হয়। অনিরুদ্ধ যখন এই তথ্য সংগ্রহ করছিলেন, তখন তিনি অনুভব করলেন যে, মানুষের লোভ, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা এবং ভয়কে কাজে লাগিয়ে একটি নিখুঁত ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। তিনি লিখলেন, “মহাজন এবং তার বংশধরের প্রভাবকে তারা ব্যবহার করেছে, অতীতের অভিশাপের গল্পকে তারা কৌশল হিসেবে চালিয়েছে, আর গ্রামের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।”

রাত্রির নিস্তব্ধতা, নদীর ধারে আরিত্রির কষ্ট এবং সমস্ত প্রমাণের সংযোগ অনিরুদ্ধকে এই সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করালো। তিনি বুঝলেন, অতিপ্রাকৃত, ভয় এবং কুসংস্কার কেবল ছদ্মবেশ; প্রকৃত রহস্য হচ্ছে মানুষের লোভ এবং পরিকল্পনা। আরিত্রি এখন সম্পূর্ণভাবে অনিরুদ্ধের সঙ্গে ছিল, কারণ তার ভাইয়ের হত্যার প্রকৃত কারণ জানা গেছে। অনিরুদ্ধ এবং আরিত্রি মিলে ঠিক করলেন, এই গোপন দলকে উন্মোচন করতে হবে এবং গ্রামের মানুষকে সঠিক তথ্য জানাতে হবে। এই মুহূর্তে অনিরুদ্ধ অনুভব করলেন, দীর্ঘ অনুসন্ধান, নিখোঁজের ঘটনা, মহাদেবীর রহস্য এবং ছায়ামূর্তির সাক্ষ্য—সবই একত্রিত হয়ে তাকে সত্যের কাছে নিয়ে এসেছে। শেষ পর্যন্ত, তিনি বুঝলেন যে, বাস্তবতা কখনোই যেমন দেখা যায়, তেমনই থাকে না; কিন্তু ধৈর্য, পর্যবেক্ষণ এবং সাহসিকতার মাধ্যমে সত্যের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব।

গ্রামের আকাশে ধীরে ধীরে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, আর তার নরম আলো গ্রামকে যেন এক রহস্যময় পর্দার আড়ালে ঢেকে দেয়। অনিরুদ্ধ ও আরিত্রি শেষ পর্যন্ত সত্যের মুখোমুখি হয়। দীর্ঘদিন ধরে গ্রামের মানুষদের অজানা ভয়ের উৎস হয়ে থাকা রহস্যময় তালিকার সমস্ত কাহিনী ধীরে ধীরে সামনে আসে। যারা ভাবছিল এই তালিকা শুধুই অন্ধকারের গল্প, তারা এখন বুঝতে পারে—এটি শুধুই গল্প নয়, বাস্তবের ভয়ানক প্রতিচ্ছবি। অনিরুদ্ধ তার সাংবাদিক মনোভাব দিয়ে প্রতিটি ঘটনা যাচাই করে এবং আরিত্রি, যার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও তান্ত্রিক জ্ঞান রয়েছে, গ্রামবাসীর কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করে। তারা ধীরে ধীরে খুনিরা কে, তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল, এবং তালিকার পিছনের রহস্যগুলো উদঘাটন করে। গ্রামবাসী শোনে শোনে শিহরিত হয়ে ওঠে, কারও চোখে আনন্দের অশ্রু, কারও চোখে ভয় ও বিস্ময়ের মিশ্রণ। খুনিরা গ্রেপ্তার হয় এবং তাঁদের অপরাধের পূর্ণাঙ্গ ছবি ধরা পড়ে, যা গ্রামের মানুষদের মনে এক ধরণের শান্তি আনে।

এই শান্তি অবশ্য ক্ষণস্থায়ী। মহাদেবী, যিনি সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু, গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার আগে একটি হিমশীতল সতর্কবার্তা দেন—“তালিকার অভিশাপ এখনো বেঁচে আছে।” এই বাক্য শুধু গ্রামবাসীর নয়, পাঠকের মনে গভীর চিহ্ন রেখে যায়। মহাদেবীর রহস্যময় উপস্থিতি এবং তাঁর বিদায়ের মুহূর্তে যে অনুভূতি তৈরি হয়, তা গ্রামের বাতাসে আজও মিশে আছে। গ্রামবাসীর মনে এই ভয়ের মিলিত অনুভূতি থাকে যে, যদিও আজ খুনিরা ধরা পড়ে গেছে, তালিকা এবং তার অভিশাপ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়নি। গ্রামের প্রাচীন কূপ, বনাঞ্চল, নদীর তীরে সব কিছু যেন আগের মতোই স্থির, কিন্তু চুপচাপ প্রত্যেকটি কোণে যেন নতুন রহস্যের সূত্র লুকানো রয়েছে। অনিরুদ্ধ ও আরিত্রি এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝতে পারে যে, সত্যের প্রকাশ এবং অপরাধের বিচার কখনোই চূড়ান্ত শৃঙ্খলা আনে না; বরং এটি শুধু নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটায়।

শেষ দৃশ্যে, আবার আসে পূর্ণিমার রাত। গ্রামের বুকে নিঃশব্দে এক অজানা ব্যক্তি অদৃশ্য হয়ে যায়। তার ছায়া, চরণের শব্দ, এবং বাতাসে মিশে থাকা রহস্যময় উপস্থিতি পাঠকের মনে এক অদ্ভুত আশঙ্কা ও উত্তেজনা তৈরি করে। কেউ জানে না সে কে, এবং সে কী কারণে গ্রামে আসে। গ্রামবাসী হয়তো স্বস্তি অনুভব করে, কিন্তু অভিজ্ঞ অনিরুদ্ধ ও আরিত্রি বোঝে, যে রহস্য কখনো সম্পূর্ণরূপে শেষ হয় না। এটি শুধু মানুষের দৃষ্টিতে অদৃশ্য থেকে যায়, কিন্তু তার প্রভাব এবং ভয়াবহতা সবসময় বিদ্যমান থাকে। এই নতুন, অজানা উপস্থিতি গল্পে এক ধরণের চক্রাকারে চলমানতা সৃষ্টি করে—যেখানে সমাপ্তি কখনো চূড়ান্ত নয়, এবং প্রতিটি সমাপ্তি নতুন শুরুকে আহ্বান করে। পাঠকের চোখে গল্পের শেষ দৃশ্যটি যেমন রহস্যময়, তেমনই এটি ভাবতে বাধ্য করে—রহস্য কখনো মরে না, তা শুধু অন্য রূপে, অন্য সময় ও স্থানে প্রবেশ করে। এই অধ্যায়টি পাঠককে শুধু সমাপ্তির স্বস্তি দেয় না, বরং নতুন অধ্যায়ের অজানা সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে, যা মনে করিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর অন্ধকার ও আলো সর্বদা একসাথে বিদ্যমান।

1000055493.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *