Post Views: 14
পর্ণা মজুমদার
১
কলকাতার এক নির্জন কোণে, পুরোনো পাঠাগারের চুপচাপ পরিবেশে প্রজ্ঞনাথ দাস তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করলেন। তিনি ছিলেন এক পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষক, যিনি প্রাচীন তন্ত্র, পুরাণ এবং রহস্যময় গ্রন্থের প্রতি প্রবল আগ্রহী। বহু বছর ধরে তিনি নানা পুরনো গ্রন্থের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছিলেন এমন এক বই, যা তাকে রহস্যের গভীরে নিয়ে যাবে। আজ, সেই বইটি তার হাতে এল, একটি পুরানো এবং ক্ষয়প্রাপ্ত চামড়ার বাঁধনযুক্ত গ্রন্থ। বইটির উপর লেখা ছিল না কিছু, শুধু কিছু জটিল নিদর্শন ও অদ্ভুত চিহ্ন, যা প্রজ্ঞনাথের মনের মধ্যে একটি অদৃশ্য আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। বইটি তার হাতে নেওয়ার পর থেকেই, যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে, এমন অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ছেড়ে যাচ্ছিল না। তিনি তার গবেষণাগারে এসে একে একে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলেন, এবং তখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে, এটি শুধু একটি পুরনো গ্রন্থ নয়, বরং একটি নিষিদ্ধ তন্ত্রের বই, যা জানিয়ে দেয় যে, যিনি এটি পড়বেন, তাকে মৃত্যুর তন্ত্রের অভিশাপ ভোগ করতে হবে।
প্রজ্ঞনাথ যখন বইটির পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলেন, তখন বইয়ের অক্ষরগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। একের পর এক অদ্ভুত প্রতীক, মন্ত্র এবং চিহ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ণনা চোখের সামনে ফুটে উঠছিল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এটি কেবল একটি তন্ত্রের বই নয়, বরং একটি দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ, যা তার জীবনকে একেবারে অন্য পথে নিয়ে যাবে। তন্ত্রের মধ্যে লেখা ছিল যে, এই বইটি বহু বছর আগে একটি প্রাচীন পরিবারের হাতে এসেছিল এবং তাদের অমিত ক্ষমতা লাভের জন্য এই বইটি ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে, সেই বইটি ব্যবহারের পরপরই, পরিবারটির সবাই এক এক করে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়, আর তারপর থেকে এই বইটি একেবারে হারিয়ে যায়। প্রজ্ঞনাথের মনের মধ্যে প্রশ্ন জন্ম নেয়, এই তন্ত্রের অভিশাপ কি সত্যিই কার্যকর? কেন এই বইটি তার সামনে এসে পড়ল? এসব প্রশ্ন তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করে। তিনি জানতেন যে, যদি সে এই তন্ত্রের রহস্য উদ্ঘাটন না করে, তাহলে তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে। তাই, এক অদ্ভুত সাহস নিয়ে তিনি বইটি অধ্যায়ন করতে শুরু করেন, তবে এই অধ্যায়নই তাকে এক অশুভ পথে নিয়ে যাবে, যেখানে মৃত্যুর অন্ধকার ছায়া ক্রমশ ঘনিয়ে আসবে।
কিছুদিন পর, প্রজ্ঞনাথ বুঝতে পারলেন যে, তিনি একা এই বইয়ের রহস্য উদঘাটন করতে পারবেন না। তার গবেষণা আরও গভীর করতে হলে, তাকে সাহায্য প্রয়োজন। তাই, তিনি ভাবলেন এক জন তান্ত্রিকের সাহায্য নেওয়া উচিত। শ্রীমন্তী চৌধুরী, কলকাতার একজন প্রখ্যাত তান্ত্রিক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রাচীন তন্ত্রের ওপর কাজ করে আসছেন, তার নাম শুনে প্রজ্ঞনাথ তার কাছে সাহায্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শ্রীমন্তী ছিলেন একজন কঠিন মনোবলসম্পন্ন মহিলা, যিনি নিজের জীবনে বহু অশুভ শক্তির মুখোমুখি হয়েছেন। প্রজ্ঞনাথ তার কাছে গিয়ে বইটির ব্যাপারে বিস্তারিত জানান এবং শ্রীমন্তীকে অনুরোধ করেন, যেন তিনি তার সঙ্গে এই তন্ত্রের রহস্য উদঘাটন করতে সাহায্য করেন। শ্রীমন্তী বইটি দেখে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। তিনি জানতেন, এই বইটির সঙ্গে জড়িত কোনো একটি ভয়াবহ অভিশাপ। তারপরেও, তাঁর মনের গভীরে এক অদৃশ্য শক্তি তাকে এই রহস্য উদঘাটনের দিকে ধাক্কা দেয়। তিনি প্রজ্ঞনাথকে আশ্বাস দেন যে, তারা একসঙ্গে এই তন্ত্রের জটিলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবেন, তবে তাকে সতর্ক থাকতে হবে—কারণ এই বইয়ের রহস্যের মধ্যে এমন কিছু লুকানো আছে যা তাদের জীবনের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।
২
প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী চৌধুরী একসঙ্গে তন্ত্রের বইটি অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিলেন। শ্রীমন্তী প্রথমদিকে বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন, তার চোখে কিছুটা শঙ্কা ছিল, কিন্তু প্রজ্ঞনাথের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, যা তাকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। বইটি ছিল শুধু একটি তন্ত্রের গ্রন্থ নয়, এটি ছিল একটি মৃত্যুর পদ্ধতি, একটি চিরন্তন অভিশাপের মাধ্যম। প্রতিটি পৃষ্ঠার মধ্যে ছিল বিপদ, অমীমাংসিত রহস্য, এবং মৃত্যুর এক অবিশ্বাস্য আকর্ষণ। শ্রীমন্তী জানতেন, এই তন্ত্রের কাজ যদি শুরু হয়, তাহলে তা ঠেকানো খুবই কঠিন হবে। কিন্তু তারও মনে একধরনের সন্দেহ ছিল, কেন এই বই এতদিন পরে তাদের কাছে এসেছে? বইটির সঙ্গে যেসব ঘটনা জড়িত, সেগুলি এতটাই অন্ধকার, যে তাদের জীবনে বড় ধরনের বিপদ নেমে আসবে বলে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন।
একদিন, গভীর রাতের এক মেঘলা আকাশে, যখন তারা তন্ত্রের অদ্ভুত মন্ত্রের অর্থ বের করার চেষ্টা করছিলেন, হঠাৎ করে একটি ভয়াবহ শব্দ তাদের কানে আসে। এটা ছিল কোনো কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ, যেন মাটির নিচে কোনো অশরীরী শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রজ্ঞনাথ আতঙ্কিত হয়ে উঠে বলেন, “শ্রীমন্তী, তুমি শুনতে পাচ্ছো? এটা কি!” শ্রীমন্তী তার কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে প্রজ্ঞনাথকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “চুপ করো, এটা সেই অশুভ শক্তির আগমন হতে পারে, যেটির কথা বইয়ে লেখা ছিল। যদি আমরা এই তন্ত্রের রীতিগুলি না জানি, তবে আমরা বিপদের মধ্যে পড়ে যাবো।” তাদের আশেপাশে কিছুতেই শান্তি ফিরছিল না। ঘরটি যেন এক অন্ধকার শক্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রজ্ঞনাথ জানতেন, তারা যা করতে যাচ্ছেন, তা একটি অন্ধকার পথে নিয়ে যাবে, তবে সে এখনও ফিরতে প্রস্তুত ছিল না। তার মনে মনে ভাবছিল, “এটা কি আমার জীবনের শেষ সুযোগ, যে আমি এক অলৌকিক শক্তির রহস্য উন্মোচন করতে পারব?”
তন্ত্রের বইটি তাদের মধ্যে ভিন্ন ধরণের তর্ক সৃষ্টি করেছিল। শ্রীমন্তী যখন একে সতর্কতার সাথে অধ্যয়ন করছিলেন, তখন প্রজ্ঞনাথ তার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। শ্রীমন্তী বললেন, “প্রজ্ঞনাথ, তুমিই ঠিক বলেছো, আমাদের এই পথে যেতে হবে, কিন্তু মনে রেখো, এর পরিণতি হয়তো আমাদের জীবনের শেষ সময় হতে পারে।” প্রজ্ঞনাথ তার মুখে অদৃশ্য এক আশাবাদ নিয়ে বললেন, “আমি জানি, কিন্তু আমি একদিন এই রহস্যের দিকে এগোতে চেয়েছিলাম, এখন তা আমি বাস্তবে দেখতে চাই। আমি মনে করি, শুধু তন্ত্রের গবেষণা নয়, আমার জন্য এটি একটি আত্মার পরীক্ষা।” শ্রীমন্তী তার চোখের গভীরে একধরনের দুঃখ ও উদ্বেগ দেখতে পেলেন, তবে তিনি এটাও জানতেন যে, একবার এই পথে পা রাখলে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তারা জানতেন, তারা যা শুরু করতে যাচ্ছিল, তাতে তাদের জীবনের সব কিছু পালটে যেতে চলেছে। সেই রাতের পর, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী তাদের প্রথম প্রকৃত পরীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছিলেন, যেখানে অভিশাপের থাবা শিকার হতে সময় নেবে না।
এদিকে, কলকাতার একটি পুরনো এবং খ্যাতনামা বাড়ি, যেখানে শ্রীমন্তী চৌধুরী তার আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, সেখানে এক ভয়ঙ্কর পরিবর্তন আসছিল। অদৃশ্য শক্তি বাড়ির চারপাশে ঘুরছিল, যেন এক প্রাচীন আত্মা পুনরায় জীবিত হয়ে উঠছিল। এমনকি বাড়ির পেছনের উঠোনে হালকা আঁচও দেখা যাচ্ছিল, যার মাধ্যমে শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ বুঝতে পারলেন যে, তারা যে রহস্যে পা রেখেছে, তা আর ফিরে যাওয়ার মতো নয়। এখন তাদের সামনে একমাত্র পথ ছিল সেই অজানা পথে চলা, যেখানে বিপদ এবং অন্ধকার তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
৩
পরবর্তী কিছুদিন ধরে, প্রজ্ঞনাথ ও শ্রীমন্তী তন্ত্রের বইটির প্রতি আরও গভীর আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি অস্থিরতা ছিল, যেন কিছু অজানা বিপদ আসন্ন। শ্রীমন্তী বারবার বলে আসছিলেন যে, তাদের এই পথে হাঁটতে গেলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞনাথের দৃঢ় সংকল্প ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই বইটির মধ্যে কোনো রহস্য নিহিত রয়েছে, যা যদি উদঘাটিত হয়, তাহলে মানব ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে। কিন্তু যখন তারা একা একা তন্ত্রের মন্ত্রগুলি পুনঃপুনঃ পড়তে লাগলেন, তখন প্রজ্ঞনাথ বুঝতে পারলেন, তাদের এই রহস্যের দিকে আগানো কখনোই নিরাপদ হবে না। তন্ত্রের শক্তি ক্রমশ তাদের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল, তাদের চারপাশে এক অদৃশ্য বিপদের আঁচ দেখা যাচ্ছিল।
তাদের সমস্যার সমাধানে একজন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন ছিল, যিনি তাদের জানাতে পারবেন এই তন্ত্রের গোপনীয়তা এবং তার বিপজ্জনক প্রভাব সম্পর্কে। শ্রীমন্তী তখন মনে করলেন, তাকে সাহায্য করতে পারে এক পুরনো বন্ধুর উপস্থিতি। তার নাম মধুরীমা দেবী, একজন অভিজ্ঞ তান্ত্রিক, যিনি বহু বছর আগে এমন এক রহস্যময় শক্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। মধুরীমা দেবী, যিনি এখন একা একান্তে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন, তাকে ফেরানো সহজ ছিল না, কিন্তু শ্রীমন্তী জানতেন, যদি মধুরীমা না আসেন, তবে তারা কোনোদিন এই রহস্যের সঠিক উত্তর পাবেন না।
মধুরীমা দেবী যখন কলকাতার সেই পুরনো বাড়িতে উপস্থিত হলেন, তার মুখাবয়ব ও পরিবেশ যেন এক অদৃশ্য শক্তির ছোঁয়া অনুভব করছিল। তার বয়স প্রায় ৬০ পেরিয়ে গিয়েছে, তবে তার চোখের দীপ্তি এবং শরীরের শক্তি এমন ছিল যেন তিনি কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ করতে সক্ষম। তিনি এসে প্রথমে বইটি হাতে তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তারপর শ্রীমন্তী ও প্রজ্ঞনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই বইটি শুধু একটি তন্ত্রের বই নয়। এটি একটি অভিশাপ, যা কেবল শক্তিশালী ব্যক্তিরাই পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে। তোমরা যদি এটি পড়তে চাও, তাহলে মনে রেখো—কিছুটা মেনে নিতে হবে, কিছুটা ছেড়ে দিতে হবে।”
প্রজ্ঞনাথ তার মুখে কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু মধুরীমা, আমাদের কি এটি রোধ করা উচিত নয়? যদি এই বইটি শুধু অভিশাপ ছড়িয়ে দেয়, তাহলে কি আমরা তা উপেক্ষা করতে পারি?” মধুরীমা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “তুমি কি জানো, প্রজ্ঞনাথ, যে যার নকশা নির্ধারণ করতে চায়, তাকে সবার আগে নিজের আত্মাকে পরীক্ষা করতে হয়। এই বইটি এমন এক শক্তির উৎস যা শুধু একমাত্র এক শক্তিশালী ব্যক্তিই বন্ধ করতে পারে, কিন্তু তাদের নিজস্ব আত্মবিশ্বাস এবং সতর্কতার পরীক্ষা দিয়ে।”
মধুরীমা জানতেন, বইটির ভয়াবহতা কী, তবে তিনি এটাও জানতেন যে, যদি প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী এই পথে যেতে চায়, তবে তাদের হাতে সেই শক্তি থাকতে হবে যা অভিশাপটি প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। তিনি তাদের জানিয়ে দিলেন যে, প্রথমে তাদের অতীতের কিছু ভয়াবহ ঘটনা খুঁজে বের করতে হবে—একটি প্রাচীন পরিবার ছিল যাদের সঙ্গে এই বইটির গভীর সম্পর্ক ছিল। ওই পরিবারটি একসময় তন্ত্রের দানবীয় শক্তি ব্যবহার করেছিল, কিন্তু সেই শক্তির বিপরীতে গিয়ে তারা নিজেদের অস্তিত্বের শেষ সীমানায় চলে গিয়েছিল। বইটির অভিশাপের শিকড় ওই পরিবারে, আর সেই শিকড়ের সন্ধান করলে তারা বইটির রহস্যের সত্যিকার উত্তর পেতে পারে।
তবে মধুরীমা জানতেন, তাদের যাত্রা এখন আর একসাথে কাটানো সহজ হবে না। যেহেতু তন্ত্রের শক্তি বইয়ের মধ্যে লুকানো ছিল, সেহেতু একটি বড় বিপদ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে, যা অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। “এখন তোমাদের উচিত আমাকে অনুসরণ করা, কারণ এই রহস্য কেবল আমি তোমাদের কাছে খুলে ধরতে পারব,” মধুরীমা বললেন। শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ একে অপরকে তাকিয়ে কিছু সময় নীরব থাকলেন, তারপর তাঁরা সম্মত হলেন যে তারা একসাথে এই অন্ধকার পথে চলতে পারবেন।
এখন, মধুরীমা তাদের সামনে সেই পথের দিশা দেখাবেন, যা তাদের জীবনের অন্ধকার দিক উন্মোচন করবে, এবং তারা জানতে পারবে যে, প্রাচীন তন্ত্রের বইটি আসলে একটি মৃত্যুর যন্ত্রণা, যা তাদের একেবারে অতীতের গভীরে নিয়ে যাবে।
৪
মধুরীমা দেবীর আগমনের পর, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী নতুন করে বইটির গভীরতা বুঝতে শুরু করেছিলেন। মধুরীমা বলেছিলেন, “এই বইটির রহস্য শুধুমাত্র তোমরা যদি চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস জানতে পার, তবেই এই তন্ত্রের অভিশাপের মূলে পৌঁছানো সম্ভব।” মধুরীমা জানতেন, চৌধুরী পরিবারই সেই পরিবার, যারা বহু বছর আগে এই বইটির সঙ্গে যুক্ত ছিল, এবং যারা এই বইয়ের অশুভ শক্তি ব্যবহারের পর নিজেদের অবসান ঘটিয়ে ছিল। তবে তাদের ইতিহাস এমন এক অন্ধকার, যা বহু প্রজন্ম ধরে হারিয়ে গিয়েছিল।
প্রথমদিকে, শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ বুঝতে পারছিলেন না, কেন তাদের এই পরিবারের ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে। তবে মধুরীমা তাদের বোঝালেন যে, চৌধুরী পরিবার এই বইটি খুঁজে বের করেছিল এবং তাতে বিপুল ক্ষমতার আশায়, তারা এই বইটি ব্যবহার করেছিল। কিন্তু ক্ষমতা লাভ করার পর, তাদের মধ্যে একের পর এক মৃত্যু ও অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। শ্রীমন্তী তখন জানালেন, “আমার দাদী আমাকে অনেকবার বলেছিলেন যে, চৌধুরী পরিবার নিয়ে এক সময় কিছু গোপন কথা প্রচলিত ছিল, তবে কেউ তাদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতো না।” মধুরীমা জানতেন, এটাই সেই সময় যখন এই পরিবারটির ইতিহাস খুঁজে বের না করলে তারা পুরোপুরি চূড়ান্ত বিপদে পড়বে।
চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস জানার জন্য, মধুরীমা তাদেরকে একটি পুরনো গ্রন্থের সন্ধান দিলেন, যা একসময় চৌধুরী পরিবারে সুরক্ষিত ছিল। গ্রন্থটির নাম ছিল “অতীতের ছায়া”, যা চৌধুরী পরিবারের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় তুলে ধরেছিল। প্রজ্ঞনাথ, শ্রীমন্তী, এবং মধুরীমা একত্রে এই গ্রন্থটি খুঁজে বের করার জন্য কলকাতার পুরনো অঞ্চলে গিয়েছিলেন, যেখানে একটি প্রাচীন চৌধুরী বাড়ি ছিল। বাড়িটি প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল, তার চারপাশে এক ধরনের তীব্র শূন্যতা ছিল। তারা বাড়ির অন্ধকার সরু গলিপথ দিয়ে প্রবেশ করলেন। বাড়ির ভেতরের পরিবেশ অদ্ভুতভাবে শান্ত ছিল, যেন সেখানে কেউ আর থাকত না।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, তারা একটি পুরনো সংগ্রহশালা খুঁজে পেলেন, যেখানে নানান পুরনো বই, পাণ্ডুলিপি, এবং চিত্রকর্ম জমা ছিল। প্রজ্ঞনাথ একটি অচেনা বই হাতে তুলে নিয়ে তার পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলেন। সেই বইটিতে চৌধুরী পরিবারের মূল ইতিহাস লেখা ছিল, আর তাদের তন্ত্রের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অধ্যায় ছিল। বইটির পৃষ্ঠায়, চৌধুরী পরিবারের প্রথম তান্ত্রিক নেতা, অজয়চৌধুরী, যে এই তন্ত্রের বইটি প্রথম খুঁজে বের করেছিলেন, তার কাহিনী বর্ণিত ছিল। অজয়চৌধুরী তন্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে একাধিক চক্রান্তে জড়িত ছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে তার পরিবারকে এক এক করে ধ্বংস করে ফেলেছিল। সেই সময়ের শেষ তান্ত্রিকের মৃত্যু ঘটেছিল এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায়, এবং তার মৃত্যুর পর থেকে চৌধুরী পরিবারের মধ্যে অশুভ শক্তির উপস্থিতি বেড়ে গিয়েছিল।
এখন, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী জানতেন যে, তাদের সামনে আসা বিপদের উৎস সেই চৌধুরী পরিবার এবং তাদের প্রাচীন তন্ত্রের ইতিহাস। মধুরীমা বললেন, “এই ইতিহাস পড়তে পড়তে তোমরা আরও গভীরে চলে যেতে থাকবে, কিন্তু মনে রেখো, এই তন্ত্রের শক্তি ক্রমশ তোমাদের কাছেও চলে আসবে।” শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, তাদের যাত্রা শুধু ইতিহাস জানার জন্য নয়, বরং নিজেদের বাঁচাতে এবং এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে। তাদের অজানা পথে এখন আর এক পা ফেলতে হবে, যেখানে ভয়, রহস্য, এবং অতীতের গভীরতা তাদের ঘিরে থাকবে।
এতগুলো অন্ধকার অধ্যায় এবং রহস্য উন্মোচিত হওয়ার পর, তাদের মনে এক নতুন ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, মধুরীমা তাদের আশ্বাস দিলেন যে, এই ইতিহাসই তাদের জন্য একমাত্র পথ, যা তাদের বইটির অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। এভাবেই, তারা চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস জানার পথে এক নতুন অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে চলল।
৫
চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস জানার পর, প্রজ্ঞনাথ, শ্রীমন্তী এবং মধুরীমা বুঝতে পারলেন যে, তাদের সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। চৌধুরী পরিবার, যার সঙ্গে এই তন্ত্রের বইয়ের গভীর সম্পর্ক ছিল, তাদের অতীতের অন্ধকার রহস্য এখনও শেষ হয়নি। তবে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে জানতেন না যে তার পরিবারও এই অশুভ শক্তির সঙ্গে জড়িত। সেই ব্যক্তি ছিল রুদ্রপ্রতাপ সিংহ। রুদ্রপ্রতাপ কলকাতার এক বিশাল ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল, এবং তার মধ্যে ছিল এক ধরনের আড়ালে চলে যাওয়ার প্রবণতা—সে কোনো ধরনের রহস্য বা অবিশ্বাস্য ঘটনাকে কখনো গুরুত্ব দেয়নি। তবে একদিন, তার পরিবারের কাছে একটি রহস্যময় চিঠি আসে, যা তাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য করে।
চিঠিটি একটি পুরনো অ্যালবামের মধ্যে পাওয়া যায়, যেখানে চৌধুরী পরিবারের শেষ সদস্যের মৃত্যুর পর, তার কোনো উত্তরাধিকারী নেই এমন লেখা ছিল। এই চিঠির মধ্য দিয়ে রুদ্রপ্রতাপ জানতে পারেন যে তার পিতামহ, যিনি ছিলেন একটি তান্ত্রিক ধর্মীয় গ্রন্থের অন্যতম কপিরাইটধারী, তার পরিবারও একসময় চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। একদিন, রুদ্রপ্রতাপ হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি এই অজানা ইতিহাস খুঁজে বের করবেন, এবং সেই সূত্রে তাকে প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তীকে সাহায্য করতে বলা হল। কিন্তু রুদ্রপ্রতাপ যে বিপদের মধ্যে পড়বেন, তা তিনি জানতেন না।
এক সন্ধ্যায়, যখন রুদ্রপ্রতাপ তার পরিবারের পুরনো কাগজপত্র খুঁজছিলেন, তার চোখে পড়ে একটি রহস্যময় ছবি। ছবিটিতে ছিল চৌধুরী পরিবারের একটি পুরনো বাড়ির ছবি, যেখানে একটি তান্ত্রিক উৎসব উদযাপিত হচ্ছিল। সেই ছবির পিছনে লুকানো ছিল কিছু অদ্ভুত চিহ্ন, যা তাকে অবাক করে দেয়। পরবর্তী দিনগুলিতে, তিনি এই বাড়ির ঠিকানা অনুসরণ করতে শুরু করলেন, যা তাকে কলকাতার প্রান্তে এক পুরনো অঞ্চলে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে, তিনি দেখতে পান যে, একটি পুরনো বাড়ি, যা একসময় চৌধুরী পরিবারের অধীনে ছিল, আজও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এখন রুদ্রপ্রতাপ জানতেন যে, এই বাড়ি এবং তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস তাকে এক অজানা পথে নিয়ে যাচ্ছে, এবং যে পথে এগিয়ে গেলে এক ধরনের অদৃশ্য বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। বাড়ির আশপাশের পরিবেশ ছিল অদ্ভুতভাবে শীতল এবং নিঃসঙ্গ। তিনি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে একধরনের শূন্যতা অনুভব করলেন, যেন কোনো অশরীরী শক্তি তাকে লক্ষ্য করছে। বাড়ির মেঝে ছিল ধুলোমাখা এবং পুরনো বই এবং পাণ্ডুলিপি ছড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ, এক কক্ষে একটি পুরনো সিন্দুকের ভিতর একটি বই দেখা গেল, যার ওপর কিছু অদ্ভুত চিহ্ন ছিল। রুদ্রপ্রতাপ বইটি হাতে নিয়ে তার পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করেন। তবে, সে জানত না যে, এই বই তার জন্য একটি বিপদের অশুভ সংকেত বয়ে আনবে।
বইটির পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, “যদি তুমি এই তন্ত্রের শিকার হতে চাও, তবে এই পথ অতিক্রম করো।” রুদ্রপ্রতাপ তার চোখে শঙ্কা নিয়ে বইটি পড়তে থাকেন, এবং তাতে ধীরে ধীরে উপলব্ধি হয় যে, এই তন্ত্রটি শুধু একটি প্রতিশোধের বিষয় নয়, বরং এটি মৃত্যুর এক প্রক্রিয়া, যা আসলে চৌধুরী পরিবারে একসময় শুরু হয়েছিল। বইটির মধ্যে লেখা ছিল যে, যারা এই তন্ত্রে প্রবেশ করবে, তাদের সবকিছু হারাতে হবে, তাদের আত্মাও এই অশুভ শক্তির শিকার হবে।
এদিকে, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী রুদ্রপ্রতাপের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন, কারণ তারা জানতেন যে, রুদ্রপ্রতাপ যদি এই রহস্যে প্রবেশ করে, তবে তার জীবনও বিপদের মধ্যে পড়বে। মধুরীমা বললেন, “রুদ্রপ্রতাপ জানে না যে, তার পরিবারও এই অভিশাপে জড়িত। সে যদি আরও গভীরে যায়, তবে তাকে এক অতীতের দুঃখজনক পরিণতি মুখোমুখি হতে হবে।” শ্রীমন্তী তাড়াহুড়া করে বললেন, “তাকে জানানো দরকার, অন্যথায় এই অভিশাপের ছায়া শুধু তাকে নয়, পুরো পরিবারকেই ধ্বংস করবে।”
এখন, রুদ্রপ্রতাপের জন্য এক ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছিল, যেখানে তার নিজস্ব শিকড়, তার ইতিহাস এবং তন্ত্রের রহস্য একাকার হয়ে যাবে। তার এই পথচলা, যা সে অবিশ্বাস্যভাবে শুরু করেছিল, তাকে শেষ পর্যন্ত তার পরিবারের অন্ধকার অতীতের সঙ্গে মুখোমুখি করাবে।
৬
রুদ্রপ্রতাপ সিংহ যখন পুরনো চৌধুরী বাড়ির সেই তান্ত্রিক বইটি হাতে নিয়ে তার পৃষ্ঠাগুলি উল্টাচ্ছিল, তার মনে এক অজানা উদ্বেগ জন্ম নিতে শুরু করেছিল। বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠার মধ্যে যেন এক অশরীরী শক্তির উপস্থিতি ছিল, যা তাকে শ্বাসরুদ্ধকরভাবে শোষণ করছিল। তন্ত্রের অদৃশ্য শক্তি ক্রমশ তার আত্মাকে শিকার করতে শুরু করেছিল। তবে রুদ্রপ্রতাপের এক অদ্ভুত দৃঢ় বিশ্বাস ছিল—সে শুধু তার অতীত ইতিহাস খুঁজে বের করতে চায়নি, বরং সে নিজেই তন্ত্রের গোপন শক্তি বুঝতে চেয়েছিল। তার সামনে ছিল অতীতের একটি অন্ধকার অধ্যায়, যা তার পরিবার এবং তার নিজস্ব অস্তিত্বের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল।
রুদ্রপ্রতাপ বাড়ির গা dark ় পরিবেশে আরো গভীরে প্রবেশ করতে থাকলেন। তার মন এক অজানা শূন্যতায় ডুবে যাচ্ছিল, তবে তাকে থামানোর মতো কোনো শক্তি আর ছিল না। তিনি যখন বাড়ির প্রাচীন কাঠের দরজাটি খুললেন, একটি ভয়ানক দৃশ্য তার সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরটির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বহু মৃতদেহ, যেন দীর্ঘ সময় ধরে এখানে কোনো ধরনের নিষ্ঠুরতা চলছিল। মেঝে ছিল রক্তে ভিজে, দেওয়ালে লেখা ছিল অদ্ভুত গরু-লিপির মতো কিছু প্রতীক, যা কোন এক মন্দ আত্মার সংকেত ছিল। এর মধ্যে এক মৃতদেহের পকেট থেকে একটি পুরনো পত্রিকা বের হলো, যার ওপর সাদা কাগজে লেখা ছিল একটি বিশেষ বার্তা: “এই বাড়ির অভিশাপ কখনো শেষ হবে না।”
প্রথমদিকে, রুদ্রপ্রতাপ ভেবেছিলেন যে, এটি তার মনের কোনো বিভ্রম, কিন্তু তার চোখের সামনে ছড়ানো মৃতদেহগুলি এক ভয়াবহ সত্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। একের পর এক মৃতদেহের মাংসপিণ্ড সাদা হয়ে পচে গিয়েছিল, তবে তাদের চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা এবং যন্ত্রণার ছাপ ছিল। তার আশপাশে এক নিঃস্তব্ধ অন্ধকার পিছু নিয়েছিল, যেন এই বাড়ির প্রাচীন অভিশাপ এবার তাকে শিকার করতে প্রস্তুত ছিল। মৃত্যুর তন্ত্রের শক্তি তার ওপর ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছিল, আর প্রতিটি মৃতদেহ যেন তাকে একে একে সাবধান করতে চাইছিল।
রুদ্রপ্রতাপ ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হলে, হঠাৎ করে সেই মৃতদেহগুলির মধ্যে একটির চোখ খুলে গেল। সেই চোখের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত শক্তি, যেন মৃতদেহটি জীবন্ত হয়ে উঠছে। রুদ্রপ্রতাপ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গিয়ে পিছিয়ে গেল। তার সারা শরীরে শীতল স্রোত বইছিল, আর মনে হচ্ছিল যেন সবকিছু তার ওপর হানা দিতে চলেছে। সেই মৃতদেহটি ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করেছিল, যেন জীবনের অশরীরী শক্তি আবার ফিরে এসেছে। রুদ্রপ্রতাপ বুঝতে পারলেন, এই বাড়ি শুধু এক পুরনো অভিশাপের জায়গা নয়, বরং এটি এক প্রাচীন শক্তির বসতি, যা কখনোই শান্তি পায়নি।
তৎক্ষণাৎ রুদ্রপ্রতাপ নিজের দৃষ্টি বইয়ের দিকে ফিরিয়ে দেখলেন, যেখানে আবার লেখা ছিল, “যে ব্যক্তি এই শক্তির সম্মুখীন হবে, তাকে নিজের আত্মাকে সমর্পণ করতে হবে।” বইটির মধ্যে অদ্ভুতভাবে কিছু অজানা চিহ্ন তৈরি হচ্ছিল, যা রুদ্রপ্রতাপকে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর মনে এক দুশ্চিন্তা জেগে উঠেছিল—এখন তার জীবনের উদ্দেশ্য কী, এবং এই রহস্যে যদি তিনি আরো গভীরে যান, তাহলে কি তার অন্ধকার পরিণতি অপেক্ষা করছে?
ঠিক তখনই, শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ খবর পেয়ে সেদিন রাতে চৌধুরী বাড়িতে আসেন। শ্রীমন্তী বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন, “রুদ্রপ্রতাপ, তুমি যে পথে চলছ, সেটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই তন্ত্রের অভিশাপ শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে, আর তা তোমাকে শিকার করবে। তুমি যদি এটি না থামাও, তাহলে তুমি নিজেকে এবং তোমার পরিবারকে ধ্বংস করে ফেলবে।” রুদ্রপ্রতাপ তার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন, এবং এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, তিনি যেভাবে এগোচ্ছিলেন, তা শুধু তার জন্য নয়, তার সমস্ত আশেপাশের মানুষদের জন্যও বিপদ ডেকে আনবে।
এদিন রাতে, চৌধুরী বাড়ির গা dark ় পরিবেশ যেন আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। মৃতদেহগুলির চোখ খোলা ছিল, আর তাদের ভিতরে এক অদৃশ্য শক্তির গতি ছিল। ঘরের মধ্যে কিছু অদৃশ্য শক্তি ক্রমশ প্রবাহিত হচ্ছিল, যা রুদ্রপ্রতাপকে এবং তার আশেপাশে সবাইকে শিকার করার জন্য প্রস্তুত ছিল।
মৃত্যুর তন্ত্রের শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে, রুদ্রপ্রতাপকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সেই রাতে, রুদ্রপ্রতাপ এবং তার সঙ্গীরা এক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, যা তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।
৭
রুদ্রপ্রতাপের অন্ধকার পথে চলার পর, চৌধুরী বাড়ির সেই পুরনো অভিশাপটি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। বাড়ির গা dark ় পরিবেশে এক অদৃশ্য শক্তি ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করছিল। মৃতদেহের চোখগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল, এবং সেগুলির মধ্যে এক অজানা শূন্যতার ছাপ স্পষ্ট ছিল। এই অভিশাপের ছায়া ছিল এতটাই গভীর যে, রুদ্রপ্রতাপ এবং তার সঙ্গীরা বুঝতে পারছিল না, তারা কোথায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। তাদের সামনে এক অনাবিষ্কৃত জগৎ ছিল, যেখানে মৃত্যুর অভিশাপ তাদের অন্ধকার দিকের দিকে টেনে নিচ্ছিল।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী বুঝতে পারলেন যে, তাদের জীবনে এক বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। তারা জানতেন, এই পথ থেকে ফিরে আসার কোনো উপায় আর নেই। তন্ত্রের শক্তি তাদের এক অন্ধকার পৃথিবীতে নিয়ে আসছিল, যেখানে একমাত্র আত্মার সংঘাত ও নির্ধারণই তাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে। শ্রীমন্তী, যার আগে থেকেই এই অভিশাপের বীজ পুঁতেছিল, সে জানত যে, তাদের শেষ পরিণতি সামনে। “আমাদের একমাত্র উপায় হল, এই তন্ত্রের অন্ধকার শক্তির মোকাবিলা করা। আর আমাদের নিজেদের আত্মাকে রক্ষা করতে হবে,” শ্রীমন্তী বললেন।
এদিন রাতে, চৌধুরী বাড়ির এক করুণ দৃশ্যের সাক্ষী হতে হয়েছিল রুদ্রপ্রতাপকে। বাড়ির মাঝে একটি পুরনো দরজা খোলা ছিল, যেখানে হালকা বাতাস চলছিল। দরজা খুলে যখন রুদ্রপ্রতাপ প্রবেশ করেন, তখন তার সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য—একটি প্রাচীন কক্ষ, যেখানে এক বিশাল আয়না দাঁড়িয়ে ছিল। সেই আয়নার ভেতর এক অজানা অন্ধকার রূপ দেখাচ্ছিল, যেন সেখান থেকে কোনো অশরীরী শক্তি তাকে ডেকে নিচ্ছে। রুদ্রপ্রতাপ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আয়নার দিকে তাকালেন। তার চোখের সামনে এক একজন পুরনো আত্মা উঠে আসছিল, যাদের মধ্যে চৌধুরী পরিবারের অতীতের ছায়া স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছিল।
মাঝে মাঝে আয়নার মধ্যে এক এক করে তাদের আত্মাদের ছবি ফুটে উঠছিল। সেই আত্মারা যেন নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যেও, তাদের চোখে ছিল এক তীব্র যন্ত্রণা, যেন তারা জীবিত না হলেও পৃথিবীতে কিছু unfinished কাজ রেখে গেছে। রুদ্রপ্রতাপের হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তার মনে হল, এই আত্মারা যেন তাকে প্রত্যেক মুহূর্তে উদ্দেশ্যভ্রষ্ট করতে চাইছে, যেন তাকে তাদের স্থান পূর্ণ করতে হতে হবে।
এভাবে, রুদ্রপ্রতাপ একে একে সমস্ত আত্মাদের মুখোমুখি হতে লাগলেন। তার চোখে এক অদ্ভুত ঘোর সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি দেখতে পেলেন, যে আত্মাগুলি তাকে তাদের অস্তিত্বের খোঁজ দিচ্ছে, তারা আসলে চৌধুরী পরিবারের সেই মৃত সদস্যরা, যারা অতীতে তন্ত্রের শক্তির শিকার হয়েছিল। তাদের মধ্যে কিছু আত্মার মুখ ছিল অপরিচিত, তবে কিছু ছিল অতি পরিচিত—এটি ছিল রুদ্রপ্রতাপের পূর্বপুরুষদের আধ্যাত্মিক শক্তি, যারা তন্ত্রের গোপন পথে পা রেখেছিলেন এবং তারপর তাদের জীবনে ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল।
এই আত্মাদের সামনে দাঁড়িয়ে, রুদ্রপ্রতাপ নিজের ভেতরের অন্ধকার দিকের সঙ্গে এক নতুন লড়াই শুরু করেন। তার মাথায় মনে হচ্ছিল, “আমার কী করতে হবে? আমি কি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবো, না আমি নিজেই এর শিকার হবো?” তাঁর মনে এ এক মর্মান্তিক প্রশ্ন ছিল—যারা এই অভিশাপের শিকার হয়েছে, তারা কি কখনো মুক্তি পেতে পেরেছিল?
মধুরীমা দেবী, শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ তখন কক্ষে প্রবেশ করলেন। তাদের চোখে এক ধরনের উদ্বেগ ছিল, যেন তারা জানতেন যে, রুদ্রপ্রতাপ এই আত্মাদের সঙ্গে এক কঠিন যুদ্ধে শামিল হয়েছে। মধুরীমা দ্রুত রুদ্রপ্রতাপের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুমি যদি এই আত্মাদের মধ্যে গা ভাসিয়ে দাও, তবে তাদের শক্তি তোমাকে একেবারে তছনছ করে দেবে। তোমার উচিত হবে তাদের থেকে দূরে সরে গিয়ে এই অভিশাপের শেষ পরিণতি জানা।”
প্রজ্ঞনাথ গভীর চিন্তায় পড়লেন, “যারা এই তন্ত্রের শিকার হয়েছিল, তাদের আত্মাদের মধ্যে একটা টান ছিল, যেন তারা তাদের কাজ শেষ করতে চায়। কিন্তু তাদেরকে মুক্তি দিতেই হবে, নাহলে তাদের অসীম কষ্ট অব্যাহত থাকবে।”
তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য শক্তি ছিল, যে শক্তি মৃতদের জীবিত করে তুলছিল এবং রুদ্রপ্রতাপকে তাদের সঙ্গে এক হয়ে যেতে বাধ্য করছিল। তবে মধুরীমা জানতেন, যে যদি তারা আত্মাদের কাছে গিয়ে তাদের মনের টান অনুভব করতে পারে, তবে তারা তন্ত্রের শক্তি চিরতরে শেষ করতে পারবে। তাই, মধুরীমা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আজ রাতে, তোমরা যদি এই আত্মাদের শান্তি দিতে চাও, তাহলে তোমাদের নিজেদের আত্মাকে পরীক্ষা করতে হবে, এবং এই শক্তির সঙ্গে এক হয়ে তাকে রুখে দিতে হবে।”
এভাবে, রুদ্রপ্রতাপ এবং তার সঙ্গীরা একত্রিত হয়ে একটি বড় সংগ্রামে প্রবৃত্ত হলেন, যেখানে তাদের নিজের আত্মার শুদ্ধতা এবং তন্ত্রের অন্ধকার শক্তির মধ্যে চূড়ান্ত যুদ্ধে তাদের পরিণতি নির্ধারিত হবে।
৮
রুদ্রপ্রতাপ ও তার সঙ্গীদের জন্য এক অনিশ্চিত পরিণতি অপেক্ষা করছিল। তারা জানতেন যে, চৌধুরী পরিবারের অতীতের অন্ধকার এবং মৃত্যুর তন্ত্রের শক্তি ক্রমশ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তন্ত্রের অভিশাপ এবং আত্মাদের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে তাদের এক শক্তিশালী আধ্যাত্মিক সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। সেই সাহায্যটি তাদের কাছে এসেছিল জয়ন্তী ব্যানার্জীর মাধ্যমে, যিনি একদিকে শ্রীমন্তী চৌধুরীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক গবেষণায় বেশ অভিজ্ঞ।
জয়ন্তী প্রথমে শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথের কাছে এই ঘটনার কথা শুনে বিশেষ উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। তিনি জানতেন যে, চৌধুরী পরিবারের অতীতের রহস্যগুলোই তাদের বর্তমান জীবনের উপর ছায়া ফেলছে, তবে তন্ত্রের শিকার হওয়ার আগে সেই অতীতের গোপন তথ্য জানা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাদের কাছে এক পুরনো পাণ্ডুলিপি নিয়ে আসেন, যা খুব কম লোকই জানত—”অতীতের দুঃখ”, একটি রহস্যময় গ্রন্থ যা একমাত্র কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির হাতে পাস ছিল। এই পাণ্ডুলিপি তন্ত্রের শক্তির সম্পর্কে এক গভীর ধারণা প্রদান করেছিল এবং এটি ছিল সেই সময়ের একমাত্র দলিল, যা তাদের সেই অন্ধকার পথ থেকে মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারত।
জয়ন্তী বললেন, “এই বইটির মধ্যে যে তথ্য লুকানো আছে, তা যদি আমরা ব্যবহার করতে পারি, তবে হয়তো আমরা এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারব। কিন্তু এটির জন্য আমাদের প্রাচীন তন্ত্রের মন্ত্রগুলো সঠিকভাবে পালন করতে হবে।” তিনি জানতেন যে এই প্রক্রিয়া খুবই জটিল এবং বিপদজনক হতে পারে, তবে এখন তাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। তাদের সামনে একটাই পথ ছিল—যতটা সম্ভব গভীরভাবে তন্ত্রের রহস্য উদঘাটন করা।
বইটির পৃষ্ঠাগুলি যখন উল্টানো হচ্ছিল, তখন প্রজ্ঞনাথ ও শ্রীমন্তী অবাক হয়ে দেখলেন, বইটির মধ্যে অনেক গোপন মন্ত্র ছিল যা চৌধুরী পরিবারের মৃত্যুর তন্ত্রের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। সেগুলি ছিল এমন একধরনের প্রাচীন আধ্যাত্মিক মন্ত্র, যেগুলি মানুষকে মৃত্যুর পরেও জীবিত করতে পারত, তবে এই শক্তি ব্যবহারের ফলে অশুভ আত্মা সৃষ্টি হত, যা কখনোই শান্তি পেত না। এসব মন্ত্রের মাধ্যমে, সেই মৃত আত্মারা জীবিত হয়ে উঠত, কিন্তু তাদের কোনো আত্মিক মুক্তি পাওয়া সম্ভব হতো না। জয়ন্তী জানালেন, “এই তন্ত্রের শক্তি এমনভাবে কাজ করে যে, আত্মারা তাদের পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় না, বরং তারা অশান্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়।”
এতক্ষণে, রুদ্রপ্রতাপও বুঝতে পারলেন যে, তন্ত্রের শক্তি শুধু একজন ব্যক্তি নয়, পুরো পরিবার এবং তার আশেপাশের মানুষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। অতীতের তন্ত্রের ব্যবহারকারীরা তাদের আত্মার মুক্তি প্রার্থনা করেনি, যার কারণে তাদের আত্মা পৃথিবীতে আবদ্ধ হয়ে আছে, এবং তাদের কষ্টগুলো এক অবিরাম দুঃখে পরিণত হয়েছে।
যতই তারা তন্ত্রের শক্তি সম্পর্কে জানছিল, ততই তাদের আশেপাশে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করছিল। বাড়ির মধ্যে প্রতিনিয়ত নিঃশব্দ অশরীরী শক্তি অনুভূত হচ্ছিল। একদিন রাতে, ঘরটি অদ্ভুতভাবে শীতল হয়ে গেল এবং কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের চারপাশে ঘুরতে থাকল। রুদ্রপ্রতাপ জানতেন, এই শক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হল তন্ত্রের মন্ত্রগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করা। কিন্তু, মন্ত্রগুলোর প্রতিটি শব্দই এক ভীষণ শক্তির অভ্যন্তরীণ স্তরকে স্পর্শ করত, এবং সেই শক্তি ছড়িয়ে পড়লে, এটি তাদের সবার জন্য বিপদের কারণ হতে পারত।
এখন, জয়ন্তী, শ্রীমন্তী, প্রজ্ঞনাথ, এবং রুদ্রপ্রতাপ একসঙ্গে একটি বিশেষ রীতি পালন করতে প্রস্তুত হলেন। রীতির মধ্যে ছিল তন্ত্রের মন্ত্রোচ্চারণ, প্রাচীন চিহ্ন তৈরি করা, এবং সর্বশেষে, অশুভ আত্মাদের শান্তির জন্য একটি বিশেষ পুজো করা। এই পুজোটি যে কোন অসীম বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে, এমন একটি বিশ্বাস ছিল। তারা যখন এই তান্ত্রিক রীতি সম্পন্ন করতে শুরু করলেন, তান্ত্রিক মন্ত্রের শক্তি পুরো বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, এবং ঘরের ভেতরে এক অদ্ভুত প্রভাব সৃষ্টি হল।
এই সময়ের মধ্যে, বাড়ির ভিতর থেকে একটি অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। রুদ্রপ্রতাপ ভয়ে কাঁপছিলেন, কিন্তু তখনই জয়ন্তী তাকে সাহস দিয়ে বললেন, “তুমি যদি সত্যিকারভাবে এই শক্তির মোকাবিলা করতে চাও, তবে তোমাকে এই রীতির মধ্যে নিজেকে শুদ্ধ করতে হবে। যদি তুমি এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো, তবে তুমি মুক্তি পাবে।”
অবশেষে, পুজো এবং মন্ত্রোচ্চারণের পর, অশুভ শক্তির উপস্থিতি ধীরে ধীরে কমে যেতে শুরু করল। বাড়ির ভেতরে সাড়া পড়ল এবং একটি অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করল। শ্রীমন্তী বললেন, “এখন আমরা জানি, এই শক্তি আর আমাদের উপর ক্ষমতা রাখবে না। কিন্তু এর জন্য আরো এক ধাপ বাকি রয়েছে—আমাদের নিজেদের শুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে।”
এভাবে, জয়ন্তী এবং তার সঙ্গীরা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলেন। তন্ত্রের শক্তি তাদের থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই তারা নিজেদের মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
৯
গভীর রাতের অন্ধকারে, চৌধুরী বাড়ি এক তীব্র শীতলতা ও বিষাদে ভরে উঠেছিল। বাড়ির চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছিল, যেন সেখানে কোনো প্রাণ ছিল না, তবে একই সঙ্গে কিছু অশরীরী শক্তি দানা বাঁধছিল। রুদ্রপ্রতাপ, শ্রীমন্তী, প্রজ্ঞনাথ, এবং মধুরীমা একে একে ঘরের মধ্যে এক মন্ত্রের চক্র তৈরি করেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তন্ত্রের শেষ পরীক্ষা সম্পন্ন করা এবং অতীতের সব অশুভ শক্তিকে একবারে পরাজিত করা। কিন্তু তারা জানতেন, এই পথ খুবই বিপদজনক এবং যে কোনো মুহূর্তে তারা বিপদের মুখোমুখি হতে পারেন।
জয়ন্তী, যিনি এতদিন তাদের সঙ্গে ছিলেন, জানতেন যে, শেষ পরিণতির আগে কোনো ভুল হওয়া যাবে না। তিনি অত্যন্ত সংকল্পবদ্ধভাবে বললেন, “আমাদের শেষ রীতি সম্পন্ন করতে হবে, আর সেটা করতে গিয়ে আমাদের আত্মার শুদ্ধতা পরীক্ষা হবে। শুধু মন্ত্র নয়, আমাদের হৃদয়েও এক নির্মলতা থাকতে হবে।”
সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত, তারা একযোগে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। বাড়ির ভিতরের বাতি নিভে গেল, এবং ঘরটি অদ্ভুতভাবে আঁধারে ডুবে গেল। তন্ত্রের শক্তি, যা এতদিন শান্ত ছিল, এবার তার পূর্ণ রূপে প্রকাশ পেতে শুরু করল। বাইরে, আকাশের দিকে, অন্ধকার মেঘ জমে উঠছিল, এবং কিছুক্ষণ পর এক তীব্র বজ্রপাত ঘটল, যেন আকাশও তাদের এই কল্পনা-ভঙ্গ করা শক্তির বিরুদ্ধে ছিল।
তন্ত্রের মন্ত্রগুলি প্রতিটি অক্ষরে শক্তি সঞ্চয় করছিল। শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ, একে অপরকে শক্তি দিয়ে, মন্ত্রের উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। রুদ্রপ্রতাপ, যিনি এই শক্তির মুখোমুখি হয়ে অনেক বার দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন, এবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে তন্ত্রের প্রতিটি শাব্দিক স্তর বর্ণনা করছিলেন। মধুরীমা জানতেন, একবার যদি তারা এই তন্ত্রের অভিশাপের কোর সমাপ্ত করতে পারে, তবে তাদের আত্মা সত্যিই মুক্ত হবে, তবে যদি কিছু ভুল হয়, তবে এই অভিশাপ তাদের চিরকাল অনুসরণ করবে।
তাদের সামনে এক ভয়ংকর দৃশ্য ফুটে উঠল। বাড়ির চারপাশে অশরীরী উপস্থিতির অনুভূতি বাড়তে লাগল। একটি অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের ঘিরে ধরেছিল। রুদ্রপ্রতাপ আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, “এটা কি? এই শক্তি কি আমাদের মন্ত্রকে মেনে চলবে না?” ঘরের মধ্যে তখন এক অদ্ভুত কাঁপন শুরু হল। ঠিক তখনই, বাড়ির ভেতরের দেয়ালগুলো কাঁপতে শুরু করল, এবং একটি ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা গেল—যেন কোথাও অন্ধকার পৃথিবী থেকে কিছু গর্জন করছিল।
বাড়ির অন্ধকার কোণে, একসময় মৃতদের আত্মা তাদের সামনে দৃশ্যমান হতে শুরু করল। মৃতদের চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তাদের দেহ থেকে এক ভয়ানক শক্তি বের হয়ে আসছিল। প্রতিটি আত্মা যেন তাদের মনের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল, তাদের অতীতের পাপের বোঝা ভর করে ছিল। কিছু আত্মা ছিল চৌধুরী পরিবারের সদস্য, যারা একসময় তন্ত্রের শক্তি লাভ করতে গিয়ে নিজেদের আত্মাকে শিকার করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল অজয়চৌধুরী, পরিবারের তৃতীয় তান্ত্রিক নেতা, যার মৃত্যুর পর পুরো পরিবার এক অশুভ শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল।
এখন, তারা সেই আত্মাদের মুখোমুখি হচ্ছিল। মৃতদের চোখের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা ছিল, যেন তারা নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। রুদ্রপ্রতাপের মুখে এক বিভ্রান্তি ছিল, কিন্তু মধুরীমা জানতেন, তাদের এই মুহূর্তেই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। “তোমরা যদি আত্মাদের শান্তি দিতে চাও, তবে তোমাদের নিজেদের আত্মিক শক্তি সক্রিয় করতে হবে,” মধুরীমা বললেন। “এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে, তোমাদের নিজেদের ভয়ের সঙ্গেও লড়তে হবে।”
শ্রীমন্তী, প্রজ্ঞনাথ, এবং রুদ্রপ্রতাপ একে অপরকে দৃঢ় সংকল্পের সাথে দেখলেন। তারা জানতেন, এই মুহূর্তেই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি তারা আত্মাদের শান্তি দিতে সক্ষম হন, তবে এই অভিশাপ চিরকাল শেষ হবে। তবে যদি তারা失败 হন, তাহলে তারা তাদের জীবনের মূল্য দেয়ার সুযোগ পাবে না।
অতীতের শক্তির প্রতি তাদের ভক্তি ও সাহসের পরীক্ষা শুরু হলো। রুদ্রপ্রতাপ চোখ বন্ধ করে মন্ত্রের শেষ পর্যায়ে পৌঁছালেন। তন্ত্রের শক্তি একেবারে আকাশ পর্যন্ত উঠে গেল, এবং শেষ মুহূর্তে, একটি অদ্ভুত সাদা আলোর ঝলক দেখা গেল। বাড়ির সব কিছু যেন এক লহমায় শান্ত হয়ে গেল।
শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল, এবং চারপাশে গা dark ় পরিবেশটি হারিয়ে গেল। আত্মারা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল, এবং তাদের চোখের মধ্যে যে কষ্টের ছায়া ছিল, তা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। ঘরটি হালকা হয়ে উঠল, আর রাতের অন্ধকার সরে গিয়ে এক নতুন প্রভাতের সূচনা হল।
শেষে, রুদ্রপ্রতাপ, শ্রীমন্তী, প্রজ্ঞনাথ, এবং মধুরীমা একে অপরকে সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারা জানতেন, তারা এখন মুক্ত। কিন্তু এই মুক্তির পেছনে ছিল তাদের আত্মবিশ্বাস, সাহস, এবং একে অপরের প্রতি অটুট বিশ্বাস। তাদের জন্য এখন এক নতুন জীবনের সূচনা অপেক্ষা করছিল, যেখানে অতীতের অভিশাপ আর তাদের উপর থাকবে না।
তন্ত্রের শক্তি শেষ হয়ে গেছে। এক অন্ধকার অধ্যায় শেষ হল, আর একটি নতুন শুরুর জন্য আকাশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
১০
চৌধুরী বাড়ির তান্ত্রিক অভিশাপের শেষ মুহূর্তে, এক অদ্ভুত শান্তি পুরো বাড়ির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাড়ির বাতাস, যা এতদিন অশুভ শক্তির দ্বারা ভারাক্রান্ত ছিল, এখন শান্ত ও প্রশান্ত হয়ে উঠেছিল। মৃতদের আত্মারা তাদের শাস্তি শেষ করে শান্তি পেয়েছিল, এবং বাড়ির চারপাশে যে অন্ধকার ছিল, তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। রুদ্রপ্রতাপ, শ্রীমন্তী, প্রজ্ঞনাথ, এবং মধুরীমা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে—এক সম্পর্ক যা তাদের জীবনের এই অন্ধকার অধ্যায়টিকে শেষ করতে সাহায্য করেছে।
তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, অভিশাপ ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু এর পরিণতি কী হবে, সেটা এখনও অস্পষ্ট ছিল। চৌধুরী বাড়ি এখন শান্ত ছিল, কিন্তু তার মধ্যে যে অতীতের ভয়ানক ইতিহাস লুকানো ছিল, তা কখনও মুছে যাবে না। তারা জানতেন, তারা যা করলেন, তা শুধু নিজেদের জন্য নয়, পুরো চৌধুরী পরিবার এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ছিল। তবে, এক প্রশ্ন ছিল যা তাদের mindsকে ছেঁয়ে ছিল—এ অভিশাপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী ছিল?
মধুরীমা, যিনি দীর্ঘদিন ধরে এসব অন্ধকার শক্তির সঙ্গেই সংগ্রাম করে এসেছেন, এবার বললেন, “এটা ছিল আমাদের আত্মার পরীক্ষার একটি অদৃশ্য পথ। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, আমরা এক নতুন জীবনের দিকে চলতে শুরু করলাম, কিন্তু মনে রেখো, যেখান থেকে আমরা এসেছি, সেখান থেকে কিছু অভিশাপ কখনও সম্পূর্ণভাবে চলে যায় না। কিছু কিছু অতীতের কষ্ট, কিছু কিছু আত্মা, আমাদের মনে এক অদ্ভুত ছায়া হয়ে থাকে।”
এটি শোনার পর, রুদ্রপ্রতাপ ভাবলেন, “হ্যাঁ, অভিশাপ ভেঙে গেল, কিন্তু সেই ভয়াবহতা এবং কষ্ট, যা আমাদের সামনে এসেছিল, তা যদি আমাদের চিরকাল অনুসরণ না করে তবে কেন এত ভয়? কেন এত আঘাত?” শ্রীমন্তী তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই অভিশাপ শিখিয়েছে যে, আত্মিক শক্তি এবং সাহস আমাদের মধ্যে সেই তন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়ানোর জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আমরা যদি নিজেদের বিশ্বাসের উপর দৃঢ় থাকি, তাহলে অন্ধকারের শক্তি আমাদের শাসন করতে পারবে না।”
এদিন রাতে, চৌধুরী বাড়ির চারপাশে এক শান্তি বিরাজ করছিল, যা এতদিন একদম অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। রুদ্রপ্রতাপ এবং তার সঙ্গীরা বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালেন। তারা জানতেন, এখন তারা পুরনো জীবনে ফিরে যেতে পারবেন। তবে তাদের মনে একটি অদ্ভুত খালি জায়গা তৈরি হয়েছিল—যতই মুক্তি পেয়েছিল, ততই যেন একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন তাদের ভিতরে জমে ছিল।
মধুরীমা রুদ্রপ্রতাপের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি বুঝতে পারছো না, রুদ্র। এই তন্ত্রের শক্তি শুধু অন্ধকার নয়, তার মধ্যে আলোরও এক প্রবাহ রয়েছে। এই অভিশাপের পরবর্তী কাহিনী শুধু তোমাদের নয়, পুরো পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আজ আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছালাম, কিন্তু জানো, আমাদের সত্যিকার মুক্তি কখন হবে? যখন আমরা আমাদের অতীতের অভিশাপের ধারাবাহিকতা বুঝতে পারব, তখনই আমাদের মুক্তি আসবে।”
প্রজ্ঞনাথ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “তাদের চোখের মধ্যে শান্তি ছিল, কিন্তু আমাদের নিজেদের চোখের মধ্যে এক তীব্র প্রশ্নের ছায়া রয়ে গেছে। আমরা কি শুধুমাত্র চৌধুরী পরিবারের অভিশাপ ভেঙেছি, না তাদের পথ অনুসরণ করার কারণে আমাদের নিজেদের ভেতরে এক নতুন অভিশাপ বয়ে এনেছি?”
এদিন রাতে, যখন তারা বাড়ির দরজা বন্ধ করছিলেন, এক অদ্ভুত অনুভূতি তাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছিল। তারা জানতেন যে, তারা যখন এই বাড়ি ছেড়ে যাবেন, তখন তাদের মধ্যে কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। তবে, অভিশাপের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, তারা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনে ফিরতে চলেছিল।
চৌধুরী বাড়ি, যে এক সময় মৃত্যুর তন্ত্রের দ্বারা শাসিত ছিল, এখন একটি নতুন দিকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল—একটি জীবনের দিকে যেখানে অতীতের ছায়া মিলিয়ে গেছে, তবে এটি একটি নূতন অধ্যায়ের সূচনা।
তাদের কাছে তখন শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন ছিল: “কীভাবে তাদের ভবিষ্যত হবে, এবং সেই ভবিষ্যতে তারা তাদের অন্ধকার অতীতকে পরিত্রাণ দিতে পারবে কিনা?”
এভাবে, এক দীর্ঘ রাত্রি শেষে, তারা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন, কিন্তু তাদের মনের মধ্যে এক অস্থির প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিল, যে তারা কি কখনও সত্যিকার অর্থে নিজেদের অতীত থেকে মুক্ত হতে পারবেন?
–
অনেক বছর পার হয়ে গেছে চৌধুরী পরিবারের অভিশাপ ভেঙে যাওয়ার পর, কিন্তু সেই ভয়ংকর রাতগুলির স্মৃতি এখনো জীবিত ছিল তাদের মনে, যারা কখনও সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল। রুদ্রপ্রতাপ, যাকে একসময় রুদ্রপ্রতাপ সিংহ বলা হতো, এখন শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে এসেছে। তার চোখে, যা একসময় সত্যের খোঁজে ছিল, এখন শান্তির আভা বিরাজিত—তবে সেই শান্তি এসেছে বহু বছর ধরে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে।
চৌধুরী বাড়ি, যা একসময় ভয়ের প্রতীক ছিল, এখন ইতিহাসের একটি নিস্তব্ধ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দেয়ালগুলো, যা একসময় অন্ধকার শক্তির দ্বারা প্রভাবিত ছিল, এখন শূন্য এবং শান্ত। মাঝে মাঝে, কৌতূহলী মানুষ বাড়িটি দেখতে আসে, তবে এখন সেখানে কোনো ভৌতিক উপস্থিতি নেই। বাড়িটি শান্ত, কিন্তু তার অতীতের ভয়াবহ ইতিহাস কখনো পুরোপুরি মুছে যাবে না। তারা জানতেন, যে যাত্রা তারা শুরু করেছিলেন, তা শুধু তাদের নয়, চৌধুরী পরিবারের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও ছিল। কিন্তু এক প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই অভিশাপের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী ছিল?
শ্রীমন্তী, যিনি এতদিন এই অন্ধকার শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন, এবার বললেন, “এটা ছিল আমাদের আত্মার পরীক্ষার এক অদৃশ্য পথ। এই অভিশাপ ভাঙার পর, আমরা এক নতুন জীবনের দিকে এগিয়ে চললাম, তবে মনে রেখো, যেখান থেকে আমরা এসেছি, সেখান থেকে কিছু অভিশাপ কখনও সম্পূর্ণভাবে চলে যায় না। কিছু অতীতের কষ্ট, কিছু আত্মা, আমাদের মনে এক অদৃশ্য ছায়া হয়ে থাকে।”
রুদ্রপ্রতাপ তখন ভাবলেন, “হ্যাঁ, অভিশাপ ভেঙে গেল, কিন্তু সেই ভয়াবহতা এবং কষ্ট, যা আমাদের সামনে এসেছিল, তা যদি আমাদের চিরকাল অনুসরণ না করে, তবে কেন এত ভয়? কেন এত আঘাত?” শ্রীমন্তী তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই অভিশাপ শিখিয়েছে যে, আত্মিক শক্তি এবং সাহস আমাদের মধ্যে সেই তন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়ানোর জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আমরা যদি নিজেদের বিশ্বাসের উপর দৃঢ় থাকি, তাহলে অন্ধকারের শক্তি আমাদের শাসন করতে পারবে না।”
এদিন রাতে, চৌধুরী বাড়ির চারপাশে এক শান্তি বিরাজ করছিল, যা এতদিন একদম অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। রুদ্রপ্রতাপ এবং তার সঙ্গীরা বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালেন। তারা জানতেন, এখন তারা পুরনো জীবনে ফিরে যেতে পারবেন। তবে তাদের মনে একটি অদ্ভুত খালি জায়গা তৈরি হয়েছিল—যতই মুক্তি পেয়েছিল, ততই যেন একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন তাদের ভিতরে জমে ছিল।
মধুরীমা রুদ্রপ্রতাপের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি বুঝতে পারছো না, রুদ্র। এই তন্ত্রের শক্তি শুধু অন্ধকার নয়, তার মধ্যে আলোরও এক প্রবাহ রয়েছে। এই অভিশাপের পরবর্তী কাহিনী শুধু তোমাদের নয়, পুরো পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আজ আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছালাম, কিন্তু জানো, আমাদের সত্যিকার মুক্তি কখন হবে? যখন আমরা আমাদের অতীতের অভিশাপের ধারাবাহিকতা বুঝতে পারব, তখনই আমাদের মুক্তি আসবে।”
প্রজ্ঞনাথ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “তাদের চোখের মধ্যে শান্তি ছিল, কিন্তু আমাদের নিজেদের চোখের মধ্যে এক তীব্র প্রশ্নের ছায়া রয়ে গেছে। আমরা কি শুধুমাত্র চৌধুরী পরিবারের অভিশাপ ভেঙেছি, না তাদের পথ অনুসরণ করার কারণে আমাদের নিজেদের ভেতরে এক নতুন অভিশাপ বয়ে এনেছি?”
এদিন রাতে, যখন তারা বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিলেন, এক অদ্ভুত অনুভূতি তাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছিল। তারা জানতেন যে, তারা যখন এই বাড়ি ছেড়ে যাবেন, তখন তাদের মধ্যে কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। তবে, অভিশাপের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, তারা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনে ফিরতে চলেছিল।
চৌধুরী বাড়ি, যে এক সময় মৃত্যুর তন্ত্রের দ্বারা শাসিত ছিল, এখন একটি নতুন দিকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল—একটি জীবনের দিকে যেখানে অতীতের ছায়া মিলিয়ে গেছে, তবে এটি একটি নূতন অধ্যায়ের সূচনা।
তাদের কাছে তখন শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন ছিল: “কীভাবে তাদের ভবিষ্যত হবে, এবং সেই ভবিষ্যতে তারা তাদের অন্ধকার অতীতকে পরিত্রাণ দিতে পারবে কিনা?”
এভাবে, এক দীর্ঘ রাত্রি শেষে, তারা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন, কিন্তু তাদের মনের মধ্যে এক অস্থির প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিল, যে তারা কি কখনও সত্যিকার অর্থে নিজেদের অতীত থেকে মুক্ত হতে পারবেন?
এন্ড… অথবা, হয়তো কিছু আরম্ভ হতে চলেছে।
___