Bangla - তন্ত্র

মৃত্যুর তন্ত্র

Spread the love

পর্ণা মজুমদার


কলকাতার এক নির্জন কোণে, পুরোনো পাঠাগারের চুপচাপ পরিবেশে প্রজ্ঞনাথ দাস তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করলেন। তিনি ছিলেন এক পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষক, যিনি প্রাচীন তন্ত্র, পুরাণ এবং রহস্যময় গ্রন্থের প্রতি প্রবল আগ্রহী। বহু বছর ধরে তিনি নানা পুরনো গ্রন্থের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছিলেন এমন এক বই, যা তাকে রহস্যের গভীরে নিয়ে যাবে। আজ, সেই বইটি তার হাতে এল, একটি পুরানো এবং ক্ষয়প্রাপ্ত চামড়ার বাঁধনযুক্ত গ্রন্থ। বইটির উপর লেখা ছিল না কিছু, শুধু কিছু জটিল নিদর্শন ও অদ্ভুত চিহ্ন, যা প্রজ্ঞনাথের মনের মধ্যে একটি অদৃশ্য আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। বইটি তার হাতে নেওয়ার পর থেকেই, যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে, এমন অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ছেড়ে যাচ্ছিল না। তিনি তার গবেষণাগারে এসে একে একে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলেন, এবং তখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে, এটি শুধু একটি পুরনো গ্রন্থ নয়, বরং একটি নিষিদ্ধ তন্ত্রের বই, যা জানিয়ে দেয় যে, যিনি এটি পড়বেন, তাকে মৃত্যুর তন্ত্রের অভিশাপ ভোগ করতে হবে।

প্রজ্ঞনাথ যখন বইটির পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলেন, তখন বইয়ের অক্ষরগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। একের পর এক অদ্ভুত প্রতীক, মন্ত্র এবং চিহ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ণনা চোখের সামনে ফুটে উঠছিল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এটি কেবল একটি তন্ত্রের বই নয়, বরং একটি দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ, যা তার জীবনকে একেবারে অন্য পথে নিয়ে যাবে। তন্ত্রের মধ্যে লেখা ছিল যে, এই বইটি বহু বছর আগে একটি প্রাচীন পরিবারের হাতে এসেছিল এবং তাদের অমিত ক্ষমতা লাভের জন্য এই বইটি ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে, সেই বইটি ব্যবহারের পরপরই, পরিবারটির সবাই এক এক করে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়, আর তারপর থেকে এই বইটি একেবারে হারিয়ে যায়। প্রজ্ঞনাথের মনের মধ্যে প্রশ্ন জন্ম নেয়, এই তন্ত্রের অভিশাপ কি সত্যিই কার্যকর? কেন এই বইটি তার সামনে এসে পড়ল? এসব প্রশ্ন তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করে। তিনি জানতেন যে, যদি সে এই তন্ত্রের রহস্য উদ্ঘাটন না করে, তাহলে তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে। তাই, এক অদ্ভুত সাহস নিয়ে তিনি বইটি অধ্যায়ন করতে শুরু করেন, তবে এই অধ্যায়নই তাকে এক অশুভ পথে নিয়ে যাবে, যেখানে মৃত্যুর অন্ধকার ছায়া ক্রমশ ঘনিয়ে আসবে।

কিছুদিন পর, প্রজ্ঞনাথ বুঝতে পারলেন যে, তিনি একা এই বইয়ের রহস্য উদঘাটন করতে পারবেন না। তার গবেষণা আরও গভীর করতে হলে, তাকে সাহায্য প্রয়োজন। তাই, তিনি ভাবলেন এক জন তান্ত্রিকের সাহায্য নেওয়া উচিত। শ্রীমন্তী চৌধুরী, কলকাতার একজন প্রখ্যাত তান্ত্রিক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রাচীন তন্ত্রের ওপর কাজ করে আসছেন, তার নাম শুনে প্রজ্ঞনাথ তার কাছে সাহায্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শ্রীমন্তী ছিলেন একজন কঠিন মনোবলসম্পন্ন মহিলা, যিনি নিজের জীবনে বহু অশুভ শক্তির মুখোমুখি হয়েছেন। প্রজ্ঞনাথ তার কাছে গিয়ে বইটির ব্যাপারে বিস্তারিত জানান এবং শ্রীমন্তীকে অনুরোধ করেন, যেন তিনি তার সঙ্গে এই তন্ত্রের রহস্য উদঘাটন করতে সাহায্য করেন। শ্রীমন্তী বইটি দেখে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। তিনি জানতেন, এই বইটির সঙ্গে জড়িত কোনো একটি ভয়াবহ অভিশাপ। তারপরেও, তাঁর মনের গভীরে এক অদৃশ্য শক্তি তাকে এই রহস্য উদঘাটনের দিকে ধাক্কা দেয়। তিনি প্রজ্ঞনাথকে আশ্বাস দেন যে, তারা একসঙ্গে এই তন্ত্রের জটিলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবেন, তবে তাকে সতর্ক থাকতে হবে—কারণ এই বইয়ের রহস্যের মধ্যে এমন কিছু লুকানো আছে যা তাদের জীবনের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।

প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী চৌধুরী একসঙ্গে তন্ত্রের বইটি অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিলেন। শ্রীমন্তী প্রথমদিকে বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন, তার চোখে কিছুটা শঙ্কা ছিল, কিন্তু প্রজ্ঞনাথের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, যা তাকে অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। বইটি ছিল শুধু একটি তন্ত্রের গ্রন্থ নয়, এটি ছিল একটি মৃত্যুর পদ্ধতি, একটি চিরন্তন অভিশাপের মাধ্যম। প্রতিটি পৃষ্ঠার মধ্যে ছিল বিপদ, অমীমাংসিত রহস্য, এবং মৃত্যুর এক অবিশ্বাস্য আকর্ষণ। শ্রীমন্তী জানতেন, এই তন্ত্রের কাজ যদি শুরু হয়, তাহলে তা ঠেকানো খুবই কঠিন হবে। কিন্তু তারও মনে একধরনের সন্দেহ ছিল, কেন এই বই এতদিন পরে তাদের কাছে এসেছে? বইটির সঙ্গে যেসব ঘটনা জড়িত, সেগুলি এতটাই অন্ধকার, যে তাদের জীবনে বড় ধরনের বিপদ নেমে আসবে বলে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন।

একদিন, গভীর রাতের এক মেঘলা আকাশে, যখন তারা তন্ত্রের অদ্ভুত মন্ত্রের অর্থ বের করার চেষ্টা করছিলেন, হঠাৎ করে একটি ভয়াবহ শব্দ তাদের কানে আসে। এটা ছিল কোনো কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ, যেন মাটির নিচে কোনো অশরীরী শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রজ্ঞনাথ আতঙ্কিত হয়ে উঠে বলেন, “শ্রীমন্তী, তুমি শুনতে পাচ্ছো? এটা কি!” শ্রীমন্তী তার কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে প্রজ্ঞনাথকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “চুপ করো, এটা সেই অশুভ শক্তির আগমন হতে পারে, যেটির কথা বইয়ে লেখা ছিল। যদি আমরা এই তন্ত্রের রীতিগুলি না জানি, তবে আমরা বিপদের মধ্যে পড়ে যাবো।” তাদের আশেপাশে কিছুতেই শান্তি ফিরছিল না। ঘরটি যেন এক অন্ধকার শক্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রজ্ঞনাথ জানতেন, তারা যা করতে যাচ্ছেন, তা একটি অন্ধকার পথে নিয়ে যাবে, তবে সে এখনও ফিরতে প্রস্তুত ছিল না। তার মনে মনে ভাবছিল, “এটা কি আমার জীবনের শেষ সুযোগ, যে আমি এক অলৌকিক শক্তির রহস্য উন্মোচন করতে পারব?”

তন্ত্রের বইটি তাদের মধ্যে ভিন্ন ধরণের তর্ক সৃষ্টি করেছিল। শ্রীমন্তী যখন একে সতর্কতার সাথে অধ্যয়ন করছিলেন, তখন প্রজ্ঞনাথ তার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। শ্রীমন্তী বললেন, “প্রজ্ঞনাথ, তুমিই ঠিক বলেছো, আমাদের এই পথে যেতে হবে, কিন্তু মনে রেখো, এর পরিণতি হয়তো আমাদের জীবনের শেষ সময় হতে পারে।” প্রজ্ঞনাথ তার মুখে অদৃশ্য এক আশাবাদ নিয়ে বললেন, “আমি জানি, কিন্তু আমি একদিন এই রহস্যের দিকে এগোতে চেয়েছিলাম, এখন তা আমি বাস্তবে দেখতে চাই। আমি মনে করি, শুধু তন্ত্রের গবেষণা নয়, আমার জন্য এটি একটি আত্মার পরীক্ষা।” শ্রীমন্তী তার চোখের গভীরে একধরনের দুঃখ ও উদ্বেগ দেখতে পেলেন, তবে তিনি এটাও জানতেন যে, একবার এই পথে পা রাখলে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তারা জানতেন, তারা যা শুরু করতে যাচ্ছিল, তাতে তাদের জীবনের সব কিছু পালটে যেতে চলেছে। সেই রাতের পর, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী তাদের প্রথম প্রকৃত পরীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছিলেন, যেখানে অভিশাপের থাবা শিকার হতে সময় নেবে না।

এদিকে, কলকাতার একটি পুরনো এবং খ্যাতনামা বাড়ি, যেখানে শ্রীমন্তী চৌধুরী তার আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, সেখানে এক ভয়ঙ্কর পরিবর্তন আসছিল। অদৃশ্য শক্তি বাড়ির চারপাশে ঘুরছিল, যেন এক প্রাচীন আত্মা পুনরায় জীবিত হয়ে উঠছিল। এমনকি বাড়ির পেছনের উঠোনে হালকা আঁচও দেখা যাচ্ছিল, যার মাধ্যমে শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ বুঝতে পারলেন যে, তারা যে রহস্যে পা রেখেছে, তা আর ফিরে যাওয়ার মতো নয়। এখন তাদের সামনে একমাত্র পথ ছিল সেই অজানা পথে চলা, যেখানে বিপদ এবং অন্ধকার তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

পরবর্তী কিছুদিন ধরে, প্রজ্ঞনাথ ও শ্রীমন্তী তন্ত্রের বইটির প্রতি আরও গভীর আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি অস্থিরতা ছিল, যেন কিছু অজানা বিপদ আসন্ন। শ্রীমন্তী বারবার বলে আসছিলেন যে, তাদের এই পথে হাঁটতে গেলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞনাথের দৃঢ় সংকল্প ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই বইটির মধ্যে কোনো রহস্য নিহিত রয়েছে, যা যদি উদঘাটিত হয়, তাহলে মানব ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে। কিন্তু যখন তারা একা একা তন্ত্রের মন্ত্রগুলি পুনঃপুনঃ পড়তে লাগলেন, তখন প্রজ্ঞনাথ বুঝতে পারলেন, তাদের এই রহস্যের দিকে আগানো কখনোই নিরাপদ হবে না। তন্ত্রের শক্তি ক্রমশ তাদের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল, তাদের চারপাশে এক অদৃশ্য বিপদের আঁচ দেখা যাচ্ছিল।

তাদের সমস্যার সমাধানে একজন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন ছিল, যিনি তাদের জানাতে পারবেন এই তন্ত্রের গোপনীয়তা এবং তার বিপজ্জনক প্রভাব সম্পর্কে। শ্রীমন্তী তখন মনে করলেন, তাকে সাহায্য করতে পারে এক পুরনো বন্ধুর উপস্থিতি। তার নাম মধুরীমা দেবী, একজন অভিজ্ঞ তান্ত্রিক, যিনি বহু বছর আগে এমন এক রহস্যময় শক্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। মধুরীমা দেবী, যিনি এখন একা একান্তে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন, তাকে ফেরানো সহজ ছিল না, কিন্তু শ্রীমন্তী জানতেন, যদি মধুরীমা না আসেন, তবে তারা কোনোদিন এই রহস্যের সঠিক উত্তর পাবেন না।

মধুরীমা দেবী যখন কলকাতার সেই পুরনো বাড়িতে উপস্থিত হলেন, তার মুখাবয়ব ও পরিবেশ যেন এক অদৃশ্য শক্তির ছোঁয়া অনুভব করছিল। তার বয়স প্রায় ৬০ পেরিয়ে গিয়েছে, তবে তার চোখের দীপ্তি এবং শরীরের শক্তি এমন ছিল যেন তিনি কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ করতে সক্ষম। তিনি এসে প্রথমে বইটি হাতে তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তারপর শ্রীমন্তী ও প্রজ্ঞনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই বইটি শুধু একটি তন্ত্রের বই নয়। এটি একটি অভিশাপ, যা কেবল শক্তিশালী ব্যক্তিরাই পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে। তোমরা যদি এটি পড়তে চাও, তাহলে মনে রেখো—কিছুটা মেনে নিতে হবে, কিছুটা ছেড়ে দিতে হবে।”

প্রজ্ঞনাথ তার মুখে কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু মধুরীমা, আমাদের কি এটি রোধ করা উচিত নয়? যদি এই বইটি শুধু অভিশাপ ছড়িয়ে দেয়, তাহলে কি আমরা তা উপেক্ষা করতে পারি?” মধুরীমা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “তুমি কি জানো, প্রজ্ঞনাথ, যে যার নকশা নির্ধারণ করতে চায়, তাকে সবার আগে নিজের আত্মাকে পরীক্ষা করতে হয়। এই বইটি এমন এক শক্তির উৎস যা শুধু একমাত্র এক শক্তিশালী ব্যক্তিই বন্ধ করতে পারে, কিন্তু তাদের নিজস্ব আত্মবিশ্বাস এবং সতর্কতার পরীক্ষা দিয়ে।”

মধুরীমা জানতেন, বইটির ভয়াবহতা কী, তবে তিনি এটাও জানতেন যে, যদি প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী এই পথে যেতে চায়, তবে তাদের হাতে সেই শক্তি থাকতে হবে যা অভিশাপটি প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। তিনি তাদের জানিয়ে দিলেন যে, প্রথমে তাদের অতীতের কিছু ভয়াবহ ঘটনা খুঁজে বের করতে হবে—একটি প্রাচীন পরিবার ছিল যাদের সঙ্গে এই বইটির গভীর সম্পর্ক ছিল। ওই পরিবারটি একসময় তন্ত্রের দানবীয় শক্তি ব্যবহার করেছিল, কিন্তু সেই শক্তির বিপরীতে গিয়ে তারা নিজেদের অস্তিত্বের শেষ সীমানায় চলে গিয়েছিল। বইটির অভিশাপের শিকড় ওই পরিবারে, আর সেই শিকড়ের সন্ধান করলে তারা বইটির রহস্যের সত্যিকার উত্তর পেতে পারে।

তবে মধুরীমা জানতেন, তাদের যাত্রা এখন আর একসাথে কাটানো সহজ হবে না। যেহেতু তন্ত্রের শক্তি বইয়ের মধ্যে লুকানো ছিল, সেহেতু একটি বড় বিপদ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে, যা অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। “এখন তোমাদের উচিত আমাকে অনুসরণ করা, কারণ এই রহস্য কেবল আমি তোমাদের কাছে খুলে ধরতে পারব,” মধুরীমা বললেন। শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ একে অপরকে তাকিয়ে কিছু সময় নীরব থাকলেন, তারপর তাঁরা সম্মত হলেন যে তারা একসাথে এই অন্ধকার পথে চলতে পারবেন।

এখন, মধুরীমা তাদের সামনে সেই পথের দিশা দেখাবেন, যা তাদের জীবনের অন্ধকার দিক উন্মোচন করবে, এবং তারা জানতে পারবে যে, প্রাচীন তন্ত্রের বইটি আসলে একটি মৃত্যুর যন্ত্রণা, যা তাদের একেবারে অতীতের গভীরে নিয়ে যাবে।

মধুরীমা দেবীর আগমনের পর, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী নতুন করে বইটির গভীরতা বুঝতে শুরু করেছিলেন। মধুরীমা বলেছিলেন, “এই বইটির রহস্য শুধুমাত্র তোমরা যদি চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস জানতে পার, তবেই এই তন্ত্রের অভিশাপের মূলে পৌঁছানো সম্ভব।” মধুরীমা জানতেন, চৌধুরী পরিবারই সেই পরিবার, যারা বহু বছর আগে এই বইটির সঙ্গে যুক্ত ছিল, এবং যারা এই বইয়ের অশুভ শক্তি ব্যবহারের পর নিজেদের অবসান ঘটিয়ে ছিল। তবে তাদের ইতিহাস এমন এক অন্ধকার, যা বহু প্রজন্ম ধরে হারিয়ে গিয়েছিল।

প্রথমদিকে, শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ বুঝতে পারছিলেন না, কেন তাদের এই পরিবারের ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে। তবে মধুরীমা তাদের বোঝালেন যে, চৌধুরী পরিবার এই বইটি খুঁজে বের করেছিল এবং তাতে বিপুল ক্ষমতার আশায়, তারা এই বইটি ব্যবহার করেছিল। কিন্তু ক্ষমতা লাভ করার পর, তাদের মধ্যে একের পর এক মৃত্যু ও অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। শ্রীমন্তী তখন জানালেন, “আমার দাদী আমাকে অনেকবার বলেছিলেন যে, চৌধুরী পরিবার নিয়ে এক সময় কিছু গোপন কথা প্রচলিত ছিল, তবে কেউ তাদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানতো না।” মধুরীমা জানতেন, এটাই সেই সময় যখন এই পরিবারটির ইতিহাস খুঁজে বের না করলে তারা পুরোপুরি চূড়ান্ত বিপদে পড়বে।

চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস জানার জন্য, মধুরীমা তাদেরকে একটি পুরনো গ্রন্থের সন্ধান দিলেন, যা একসময় চৌধুরী পরিবারে সুরক্ষিত ছিল। গ্রন্থটির নাম ছিল “অতীতের ছায়া”, যা চৌধুরী পরিবারের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় তুলে ধরেছিল। প্রজ্ঞনাথ, শ্রীমন্তী, এবং মধুরীমা একত্রে এই গ্রন্থটি খুঁজে বের করার জন্য কলকাতার পুরনো অঞ্চলে গিয়েছিলেন, যেখানে একটি প্রাচীন চৌধুরী বাড়ি ছিল। বাড়িটি প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল, তার চারপাশে এক ধরনের তীব্র শূন্যতা ছিল। তারা বাড়ির অন্ধকার সরু গলিপথ দিয়ে প্রবেশ করলেন। বাড়ির ভেতরের পরিবেশ অদ্ভুতভাবে শান্ত ছিল, যেন সেখানে কেউ আর থাকত না।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, তারা একটি পুরনো সংগ্রহশালা খুঁজে পেলেন, যেখানে নানান পুরনো বই, পাণ্ডুলিপি, এবং চিত্রকর্ম জমা ছিল। প্রজ্ঞনাথ একটি অচেনা বই হাতে তুলে নিয়ে তার পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলেন। সেই বইটিতে চৌধুরী পরিবারের মূল ইতিহাস লেখা ছিল, আর তাদের তন্ত্রের বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অধ্যায় ছিল। বইটির পৃষ্ঠায়, চৌধুরী পরিবারের প্রথম তান্ত্রিক নেতা, অজয়চৌধুরী, যে এই তন্ত্রের বইটি প্রথম খুঁজে বের করেছিলেন, তার কাহিনী বর্ণিত ছিল। অজয়চৌধুরী তন্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে একাধিক চক্রান্তে জড়িত ছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে তার পরিবারকে এক এক করে ধ্বংস করে ফেলেছিল। সেই সময়ের শেষ তান্ত্রিকের মৃত্যু ঘটেছিল এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায়, এবং তার মৃত্যুর পর থেকে চৌধুরী পরিবারের মধ্যে অশুভ শক্তির উপস্থিতি বেড়ে গিয়েছিল।

এখন, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী জানতেন যে, তাদের সামনে আসা বিপদের উৎস সেই চৌধুরী পরিবার এবং তাদের প্রাচীন তন্ত্রের ইতিহাস। মধুরীমা বললেন, “এই ইতিহাস পড়তে পড়তে তোমরা আরও গভীরে চলে যেতে থাকবে, কিন্তু মনে রেখো, এই তন্ত্রের শক্তি ক্রমশ তোমাদের কাছেও চলে আসবে।” শ্রীমন্তী এবং প্রজ্ঞনাথ একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, তাদের যাত্রা শুধু ইতিহাস জানার জন্য নয়, বরং নিজেদের বাঁচাতে এবং এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে। তাদের অজানা পথে এখন আর এক পা ফেলতে হবে, যেখানে ভয়, রহস্য, এবং অতীতের গভীরতা তাদের ঘিরে থাকবে।

এতগুলো অন্ধকার অধ্যায় এবং রহস্য উন্মোচিত হওয়ার পর, তাদের মনে এক নতুন ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, মধুরীমা তাদের আশ্বাস দিলেন যে, এই ইতিহাসই তাদের জন্য একমাত্র পথ, যা তাদের বইটির অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। এভাবেই, তারা চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস জানার পথে এক নতুন অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে চলল।

চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস জানার পর, প্রজ্ঞনাথ, শ্রীমন্তী এবং মধুরীমা বুঝতে পারলেন যে, তাদের সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। চৌধুরী পরিবার, যার সঙ্গে এই তন্ত্রের বইয়ের গভীর সম্পর্ক ছিল, তাদের অতীতের অন্ধকার রহস্য এখনও শেষ হয়নি। তবে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে জানতেন না যে তার পরিবারও এই অশুভ শক্তির সঙ্গে জড়িত। সেই ব্যক্তি ছিল রুদ্রপ্রতাপ সিংহ। রুদ্রপ্রতাপ কলকাতার এক বিশাল ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল, এবং তার মধ্যে ছিল এক ধরনের আড়ালে চলে যাওয়ার প্রবণতা—সে কোনো ধরনের রহস্য বা অবিশ্বাস্য ঘটনাকে কখনো গুরুত্ব দেয়নি। তবে একদিন, তার পরিবারের কাছে একটি রহস্যময় চিঠি আসে, যা তাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য করে।

চিঠিটি একটি পুরনো অ্যালবামের মধ্যে পাওয়া যায়, যেখানে চৌধুরী পরিবারের শেষ সদস্যের মৃত্যুর পর, তার কোনো উত্তরাধিকারী নেই এমন লেখা ছিল। এই চিঠির মধ্য দিয়ে রুদ্রপ্রতাপ জানতে পারেন যে তার পিতামহ, যিনি ছিলেন একটি তান্ত্রিক ধর্মীয় গ্রন্থের অন্যতম কপিরাইটধারী, তার পরিবারও একসময় চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। একদিন, রুদ্রপ্রতাপ হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি এই অজানা ইতিহাস খুঁজে বের করবেন, এবং সেই সূত্রে তাকে প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তীকে সাহায্য করতে বলা হল। কিন্তু রুদ্রপ্রতাপ যে বিপদের মধ্যে পড়বেন, তা তিনি জানতেন না।

এক সন্ধ্যায়, যখন রুদ্রপ্রতাপ তার পরিবারের পুরনো কাগজপত্র খুঁজছিলেন, তার চোখে পড়ে একটি রহস্যময় ছবি। ছবিটিতে ছিল চৌধুরী পরিবারের একটি পুরনো বাড়ির ছবি, যেখানে একটি তান্ত্রিক উৎসব উদযাপিত হচ্ছিল। সেই ছবির পিছনে লুকানো ছিল কিছু অদ্ভুত চিহ্ন, যা তাকে অবাক করে দেয়। পরবর্তী দিনগুলিতে, তিনি এই বাড়ির ঠিকানা অনুসরণ করতে শুরু করলেন, যা তাকে কলকাতার প্রান্তে এক পুরনো অঞ্চলে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে, তিনি দেখতে পান যে, একটি পুরনো বাড়ি, যা একসময় চৌধুরী পরিবারের অধীনে ছিল, আজও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

এখন রুদ্রপ্রতাপ জানতেন যে, এই বাড়ি এবং তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস তাকে এক অজানা পথে নিয়ে যাচ্ছে, এবং যে পথে এগিয়ে গেলে এক ধরনের অদৃশ্য বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। বাড়ির আশপাশের পরিবেশ ছিল অদ্ভুতভাবে শীতল এবং নিঃসঙ্গ। তিনি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে একধরনের শূন্যতা অনুভব করলেন, যেন কোনো অশরীরী শক্তি তাকে লক্ষ্য করছে। বাড়ির মেঝে ছিল ধুলোমাখা এবং পুরনো বই এবং পাণ্ডুলিপি ছড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ, এক কক্ষে একটি পুরনো সিন্দুকের ভিতর একটি বই দেখা গেল, যার ওপর কিছু অদ্ভুত চিহ্ন ছিল। রুদ্রপ্রতাপ বইটি হাতে নিয়ে তার পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করেন। তবে, সে জানত না যে, এই বই তার জন্য একটি বিপদের অশুভ সংকেত বয়ে আনবে।

বইটির পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, “যদি তুমি এই তন্ত্রের শিকার হতে চাও, তবে এই পথ অতিক্রম করো।” রুদ্রপ্রতাপ তার চোখে শঙ্কা নিয়ে বইটি পড়তে থাকেন, এবং তাতে ধীরে ধীরে উপলব্ধি হয় যে, এই তন্ত্রটি শুধু একটি প্রতিশোধের বিষয় নয়, বরং এটি মৃত্যুর এক প্রক্রিয়া, যা আসলে চৌধুরী পরিবারে একসময় শুরু হয়েছিল। বইটির মধ্যে লেখা ছিল যে, যারা এই তন্ত্রে প্রবেশ করবে, তাদের সবকিছু হারাতে হবে, তাদের আত্মাও এই অশুভ শক্তির শিকার হবে।

এদিকে, প্রজ্ঞনাথ এবং শ্রীমন্তী রুদ্রপ্রতাপের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন, কারণ তারা জানতেন যে, রুদ্রপ্রতাপ যদি এই রহস্যে প্রবেশ করে, তবে তার জীবনও বিপদের মধ্যে পড়বে। মধুরীমা বললেন, “রুদ্রপ্রতাপ জানে না যে, তার পরিবারও এই অভিশাপে জড়িত। সে যদি আরও গভীরে যায়, তবে তাকে এক অতীতের দুঃখজনক পরিণতি মুখোমুখি হতে হবে।” শ্রীমন্তী তাড়াহুড়া করে বললেন, “তাকে জানানো দরকার, অন্যথায় এই অভিশাপের ছায়া শুধু তাকে নয়, পুরো পরিবারকেই ধ্বংস করবে।”

এখন, রুদ্রপ্রতাপের জন্য এক ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছিল, যেখানে তার নিজস্ব শিকড়, তার ইতিহাস এবং তন্ত্রের রহস্য একাকার হয়ে যাবে। তার এই পথচলা, যা সে অবিশ্বাস্যভাবে শুরু করেছিল, তাকে শেষ পর্যন্ত তার পরিবারের অন্ধকার অতীতের সঙ্গে মুখোমুখি করাবে।

WhatsApp-Image-2025-07-02-at-6.30.34-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *