সুশান্ত নস্কর
গ্রামটা ছোট হলেও রহস্যে ভরা। চারদিকে সবুজ ধানখেত, মাঝে কাঁচা রাস্তা আর পাড়াগাঁয়ের সেই স্নিগ্ধ নীরবতা—দিনে যত শান্ত, রাতে ঠিক ততটাই অদ্ভুত। শীতের শেষ আর গরমের শুরু, মাঝের সময়ে হঠাৎই গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এক ভয়ানক গুজব। মানুষ বলে, মাটির ভেতর থেকে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর—কখনো বিলাপের মতো, কখনো প্রার্থনার মতো, আবার কখনো এমন এক অস্পষ্ট আহ্বান, যা শুনে শরীরে কাঁটা দেয়। প্রথম প্রথম দু-একজন গ্রামবাসী শুনলেও পরে অনেকে একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে লাগল। কৃষক নিত্যানন্দ একরাতে গরু ঘরে বাঁধতে গিয়ে শুনেছিল অচেনা কারও কান্না। ভাবল হয়তো পাশের জমির খাঁজে কোনো মানুষ আটকে আছে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখে কিছুই নেই, শুধু মাটির ভেতর থেকে আসছে ক্ষীণ শব্দ। ভয়ে সে সারা রাত ঘরে ফিরে বসে থাকে। পরদিন সকালেই সে ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। মানুষ বলতে থাকে, “মাটির নিচে ভূত বাঁধা আছে, তাই রাতে সে কেঁদে ওঠে।” কেউ আবার বলে, “এ গ্রাম অভিশপ্ত, হয়তো শত বছর আগের কোনো অপমৃত্যুর আত্মা ফিরে এসেছে।”
গ্রামের মানুষরা ভয় পেতে শুরু করল। সন্ধ্যার পর কাঁচা রাস্তা প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। মাঠে আর কেউ কাজ করত না রাতের বেলা, এমনকি মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিও ফিকে হয়ে উঠল। একসময় গ্রামের আড্ডাখানা—বটতলার আসর—খালি পড়ে থাকল, কারণ ভয়ে কেউ রাতে বাইরে বেরোতে চাইত না। শুধু শোনা যেত ভীতসন্ত্রস্ত ফিসফিসানি—কে কাকে কী শুনেছে, কোন বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। কণ্ঠস্বরের কোনো নিয়ম নেই, কখনো রাতের প্রথম ভাগে, কখনো আবার গভীর নিশীথে শোনা যায়। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে শব্দ যেন তীব্র হয়ে ওঠে, এমন এক বিলাপ, যেন কেউ মাটির নিচ থেকে মুক্তির জন্য হাত-পা ছুঁড়ে আর্তনাদ করছে। এই আতঙ্কেই গ্রামের তরুণীরা বিশেষভাবে ভয়ে দিন কাটাতে লাগল। গ্রামের এক প্রান্তে, কমলিনীর বাড়ি। সরল মনের সেই কিশোরী প্রায়শই রাতে জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে মাঠের দিকে। সেদিনও পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাচ্ছিল চারদিক, হঠাৎ করেই সে শুনল স্পষ্ট শব্দ—“আমাকে মুক্তি দাও… মুক্তি দাও।” একবার ভেবেছিল এটা তার মনের ভুল, কিন্তু শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসতে লাগল, যেন মাটি ফুঁড়ে বেরোচ্ছে। কমলিনীর বুক ধকধক করতে লাগল, চোখ অন্ধকার হয়ে এল, আর সে হঠাৎ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
কমলিনীকে প্রথম অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেল তার ঘরের মেঝেতে। পরিবারের লোকজন দৌড়ে এল, তাকে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল। জ্ঞান ফিরলেও সে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। চোখে ছিল আতঙ্কের ছাপ, ঠোঁট কাঁপছিল। অনেক কষ্টে সে বলল, “আমি শুনেছি… আমি সত্যিই শুনেছি… মাটির ভেতর থেকে কেউ ডাকছিল।” প্রথমে তার মা-বাবা ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো ভয় পেয়ে ভুল শুনেছে, কিন্তু পরে কমলিনীর কথায় দৃঢ়তা দেখে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল। চারদিকে আলোচনার ঝড় উঠল—একজন মেয়েই তো নয়, অনেকে একই কথা বলছে। গ্রামের মোড়ল গদাধর ঘোষণা করল, “এ ভূতের কাণ্ড। গ্রামের কেউ ওই প্রান্তে যাবে না।” তার গলা ভারী, চোখ কঠিন। গ্রামবাসীরা তার কথাই মেনে নিল, কারণ এমন ভয়ঙ্কর ঘটনার মুখে সবাই দিশেহারা। তবে কমলিনীর মন কিন্তু শান্ত হলো না। ভয়ের পাশাপাশি তার ভেতরে জন্ম নিল এক অদ্ভুত কৌতূহল। সে মনে মনে ভাবল, “যদি সত্যিই কেউ মাটির নিচে বন্দী থাকে? যদি সেটা ভূত না হয়ে অন্য কিছু হয়? তবে কি কেউ আছে, যে মুক্তি চাইছে?” তার মনে বারবার ভেসে উঠতে লাগল সেই অস্পষ্ট কণ্ঠ, আর অচেনা আকুতির সুর।
এইভাবেই পুরো গ্রাম জুড়ে আতঙ্ক আর কৌতূহলের পরিবেশ তৈরি হলো। মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল নানা গল্প—কেউ বলল একসময়ে শ্মশান ঘাটে সাধনা করতে এসে মারা গিয়েছিল এক তান্ত্রিক, তার আত্মাই কণ্ঠ দিচ্ছে। কেউ বলল গ্রামের পুরোনো পুকুরের ধারে নাকি অশুভ বলি হয়েছিল, সেই অশান্ত আত্মারই আর্তনাদ ভেসে আসছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গল্পগুলো আরও রঙিন হলো, কিন্তু সত্যিটা অজানাই রয়ে গেল। একদিকে ভয়, অন্যদিকে কৌতূহল—এই দুইয়ের মধ্যে গ্রামবাসী বন্দি হয়ে পড়ল। তবে কমলিনী ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, ভয় পেলেও সত্যিটা তাকে খুঁজতেই হবে। সে ভেতরে ভেতরে সিদ্ধান্ত নিল—যতই ভয় হোক, সে একদিন খুঁজে বের করবে, আসলে মাটির ভেতর থেকে যে কণ্ঠ ভেসে আসে, তা কার? ভূত, অভিশাপ, না কি কোনো অজানা বন্দী আত্মা? এভাবেই গ্রামের প্রান্তের নৈশব্দে এক ভয়ঙ্কর রহস্যের সূত্রপাত হলো, আর সেই সূত্রটাই পরবর্তী দিনে নিয়ে যাবে কমলিনীকে ও অন্যদের অদ্ভুত এক অভিযাত্রায়।
–
গ্রামের আতঙ্ক যখন চরমে পৌঁছেছে, তখনই এক সন্ধ্যায় কাঁচা রাস্তার ধুলো মেখে দেখা গেল এক নতুন আগন্তুককে। তার গায়ে কালো ধুতি-পাঞ্জাবি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে কাঠের দণ্ড, আর চোখে যেন অদ্ভুত এক দীপ্তি। সে নীরবে গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিল, যেন চারপাশের ভয়ের আবহাওয়া তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। লোকটির নাম অরিন্দম—শহর থেকে আগত এক তরুণ তান্ত্রিক, বয়স সবে সাতাশ-আটাশ। তার চেহারায় কোনো ভীতির ছাপ নেই, বরং এক দৃঢ়তা, এক জেদী শান্তি। গ্রামের মানুষ প্রথমে তাকে দেখে অবাক হয়ে গেল, পরে ধীরে ধীরে কৌতূহলী হয়ে উঠল। খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল—“এক তান্ত্রিক এসেছে গ্রামে।” মানুষ দলে দলে ছুটে এল তাকে দেখতে। কেউ আশা করল, হয়তো এই মানুষটিই ভৌতিক কণ্ঠস্বরের রহস্য ভেদ করতে পারবে, কেউ আবার শঙ্কিত হলো—“যদি তারাও বিপদ ডেকে আনে?” তবে গদাধর মোড়ল, গ্রামের নেতা, দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকল, চোখে কৌতূহল আর সন্দেহের ঝিলিক।
অরিন্দম বসানো হলো গ্রামের মন্দির প্রাঙ্গণে। সবাই তাকে ঘিরে ধরল—কেউ হাত জোড় করে প্রণাম করল, কেউ আবার কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “বাবা, আমাদের বাঁচাও। রাতের বেলা আমরা ঘর থেকে বেরোতে পারি না।” অরিন্দম ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল, তারপর মাটির দিকে দণ্ড ঠেকিয়ে বসে পড়ল ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর সে চোখ খুলে শান্ত গলায় বলল, “যা শুনেছ, তা কোনো সাধারণ ভূতের নয়। এ হলো আত্মাবন্দনের ফল। বহু বছর আগে কোনো সাধক বা শক্তিধর তান্ত্রিককে তন্ত্রবল দিয়ে মাটির নিচে বন্দী করা হয়েছিল। তার আত্মা আজও মুক্তি চায়।” তার কণ্ঠে কোনো ভীতি ছিল না, বরং ছিল অটল বিশ্বাস। লোকেরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এর আগে কেউ এত স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দেয়নি। কেউ বলল, “তাহলে সত্যিই মাটির নিচে মানুষ আছে?” অরিন্দম মাথা নেড়ে বলল, “মানুষ নয়, তার আত্মা। তাকে মুক্তি না দিলে গ্রামের অশান্তি কাটবে না।”
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে চাপা শোরগোল উঠল। কেউ বিশ্বাস করতে চাইল, কেউ আবার আরও ভয়ে কুঁকড়ে গেল। এক বৃদ্ধা কাঁপা গলায় বলল, “বাবা, তাকে মুক্ত করলে কি আমাদের ক্ষতি হবে না?” অরিন্দমের চোখে দৃঢ়তা—“যে আত্মাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করা হয়েছে, সে মুক্তির দাবিদার। কিন্তু মুক্তির পথ সহজ নয়। অশুভ শক্তি তার পাহারায় আছে। সেই বাঁধন ভাঙা বিপদসঙ্কুল।” গ্রামের মানুষ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। সবাই জানে, অদ্ভুত কণ্ঠস্বর তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু মুক্তি চাইতে গিয়ে যদি আরও ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসে! তবু আতঙ্কের মাঝেই মানুষের মনে ক্ষীণ আশা জাগল—এই তরুণ তান্ত্রিক হয়তো কোনো উপায় জানেন। গদাধর মোড়ল কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। তার চোখে সন্দেহ, ঠোঁটে বাঁকা হাসি। হয়তো ভেতরে ভেতরে সে ভয় পাচ্ছিল, আবার অন্যদিকে সে জানে, আত্মাবন্দনের ইতিহাসে তার পূর্বপুরুষদের নাম জড়িয়ে আছে। যদি সত্যিই রহস্য উন্মোচিত হয়, তবে তার গোপন কলঙ্ক ফাঁস হয়ে যাবে। তাই সে সবার সামনে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অরিন্দমের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করতে শুরু করল।
অরিন্দম সেদিন রাতে গ্রামের প্রান্তে গিয়ে নিজেই কান পাতল মাটির কাছে। গভীর নীরবতা, চারপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হঠাৎ করেই সে শুনতে পেল ক্ষীণ কিন্তু পরিষ্কার কণ্ঠস্বর—“মুক্তি… মুক্তি চাই…”। কণ্ঠস্বরটা এত গভীর যন্ত্রণা আর আকুতি নিয়ে ভেসে আসছিল যে, অরিন্দমের চোখে এক মুহূর্তের জন্য অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল। সে ঠোঁটে মৃদু মন্ত্র উচ্চারণ করে মাটিতে দণ্ড ঠুকল, আর ফিসফিস করে বলল, “আমি তোমাকে শুনেছি। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তোমার বাঁধন আমি ভাঙব।” সেই মুহূর্তে হাওয়া যেন একটু জোরে বইল, গাছের পাতা কাঁপল, আর দূরে গ্রামের ভেতরে কিছু মানুষ ভয় পেয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। কিন্তু অরিন্দম দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল ভঙ্গিতে, যেন চারপাশের ভয় তাকে স্পর্শ করল না। তার চোখে শুধু প্রতিজ্ঞার ঝিলিক—সে জানে, এই রহস্য উন্মোচন করাই হবে তার সাধনার পথের অন্যতম লক্ষ্য। আর সেই পথেই শুরু হলো গ্রামের অন্ধকারে আলো খোঁজার অভিযান।
–
পরের দিন দুপুরে, যখন গ্রামের আতঙ্ক কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে, অরিন্দম গিয়েছিল বটতলার আড্ডায়। সেখানে বসে ছিলেন গ্রামের প্রবীণতম মানুষ, হরিপদ জ্যাঠামশাই। তাঁর বয়স প্রায় নব্বই ছুঁই ছুঁই, তবুও চোখে-মুখে এখনও অদ্ভুত এক জ্যোতি। অন্যরা তাঁকে গ্রামের জ্ঞানভাণ্ডার বলে মানত। অরিন্দমের আগমন ও আত্মাবন্দনের কথা শোনার পর তিনি চুপচাপ ছিলেন, কিন্তু সেদিন বিকেলে তিনি নিজেই ডাক দিলেন অরিন্দমকে। গ্রামের অন্যরা অবাক হয়ে গেল—কারণ হরিপদ জ্যাঠামশাই সচরাচর এ ধরনের বিষয়ে কথা বলেন না। তিনি ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে বললেন, “বাবা, তুমি যে সত্য বলেছ, তা আমি অনেকদিন ধরে জানি। এই গ্রামের ইতিহাসে এমন এক অধ্যায় আছে, যা আজও কেউ মুখে আনে না।” তাঁর গলায় কাঁপন, চোখে যেন এক শীতল আতঙ্ক খেলে গেল। অরিন্দম আগ্রহ ভরে এগিয়ে এল, আর বিনম্র স্বরে অনুরোধ করল, “জ্যাঠামশাই, দয়া করে সব বলুন। হয়তো সত্যিই এই রহস্য উন্মোচনে তা সাহায্য করবে।” চারপাশের কৌতূহলী মানুষজন নীরবে জড়ো হয়ে বসল, যেন বহুদিনের অন্ধকার থেকে আলো বেরিয়ে আসতে চলেছে।
হরিপদ ধীরে ধীরে গল্প শুরু করলেন। “প্রায় একশো বছর আগে এই গ্রামে এসেছিলেন অনন্তানন্দ নামে এক মহাসাধক। তিনি ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী, তন্ত্র ও সাধনশক্তির উচ্চস্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। দিনের পর দিন তিনি নিভৃতে সাধনা করতেন শ্মশানঘাটে, আবার কখনো বটগাছতলায়। তাঁর চোখে ছিল এমন জ্যোতি, যা দেখলেই মানুষ মনে শান্তি পেত। গ্রামের সাধারণ মানুষ তাঁকে দেবতুল্য মানত, অনেকেই তাঁর কাছে আশীর্বাদ চাইত, সমস্যার সমাধান পেত। বলা হয়, তিনি প্রায় সিদ্ধিলাভের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের কল্যাণে যে সাধক জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তার জীবনেই নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র।” হরিপদ থামলেন একবার, গলা শুকিয়ে এলো। পাশের এক বালক জল এনে দিল, তিনি চুমুক দিয়ে আবার বললেন, “সেই সময় এই অঞ্চলে আরও কয়েকজন শক্তিধর তান্ত্রিক ছিল, কিন্তু তাদের মন কলুষিত। তারা চাইত ক্ষমতা, খ্যাতি, আর মানুষের উপর দমন চালাতে। অনন্তানন্দের আধ্যাত্মিক শক্তি তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর আলো তাদের অন্ধকারকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। তাই তারা একত্রিত হয়ে ষড়যন্ত্র করল—এই মহাসাধককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে।”
“এক অমাবস্যার রাতে,” হরিপদ বলতে লাগলেন, “তান্ত্রিকদের এক গোপন সভা বসে। সেখানে ঠিক হয়, অনন্তানন্দকে শারীরিকভাবে হত্যা না করে তাঁর আত্মাকে চিরদিনের জন্য বন্দী করে ফেলা হবে। কারণ তাঁর দেহ বিনষ্ট হলে আত্মা মুক্ত হয়ে যেত, আর তিনি পুনর্জন্ম নিতে পারতেন। কিন্তু আত্মা বন্দী হলে তিনি চিরকাল মুক্তি পাবেন না, তাঁর সাধনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, আর গ্রাম অভিশাপে জর্জরিত হবে। সেই ষড়যন্ত্র অনুযায়ী এক ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে তারা মন্ত্রোচ্চারণ করে তন্ত্রবল প্রয়োগ করল। অনন্তানন্দ তখন গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন। হঠাৎ চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল, আকাশ বিদ্যুৎ চমকালো, আর সেই দুষ্ট তান্ত্রিকেরা তাঁর সাধনাস্থলের চারদিকে অগ্নিবৃত্ত তৈরি করল। তারা একসঙ্গে মন্ত্র জপ করতে করতে তাঁর আত্মাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মাটির নিচে আবদ্ধ করল। তাঁর শরীর তখনই নিথর হয়ে গেল, কিন্তু আত্মা গৃহবন্দী হলো মৃত্তিকার গভীরে। গ্রামের মানুষ সেদিন কেবল দূর থেকে বজ্রপাত আর অদ্ভুত শব্দ শুনেছিল, কেউ কাছে যাওয়ার সাহস করেনি। পরদিন সকালে শুধু দেখা গেল, সাধকের দেহ নিখোঁজ, আর মাটির নিচে এক অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে আছে।” হরিপদের গলা ভারী হয়ে এল, যেন একশো বছরের পুরোনো শোক এখনও বুকে রয়ে গেছে।
অরিন্দম স্থির হয়ে সব শুনছিল। তার ভেতরে আগুনের মতো জ্বলে উঠল ক্রোধ আর দুঃখ। সে মনে মনে কল্পনা করতে লাগল সেই সাধকের যন্ত্রণার কথা—একজন মহাসাধক, যিনি মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তিনি শতবর্ষ ধরে অন্ধকারে বন্দী। তার চোখে জেদ জমাট বাঁধল। হরিপদ আবার বললেন, “বাবা, আজকের যে কণ্ঠস্বর তোমরা শুনছ, তা সেই অনন্তানন্দের আত্মার আর্তনাদ। সে মুক্তি চাইছে, সে চাইছে তার অসমাপ্ত সাধনা পূর্ণ হোক। কিন্তু তার বাঁধন ভাঙা সহজ নয়। যে দুষ্ট তান্ত্রিকেরা তাঁকে বন্দী করেছিল, তাদের অভিশাপও মাটির সঙ্গে মিশে আছে। ভুল করলে শুধু আত্মা নয়, গোটা গ্রাম ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।” চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। গ্রামের মানুষ ভয়ে-শঙ্কায় কাঁপতে লাগল, কিন্তু অরিন্দমের মুখে কোনো ভীতি দেখা গেল না। বরং সে মাটির দিকে তাকিয়ে শপথ করল, “যত কঠিন বাঁধনই হোক, আমি তা ভাঙব। সাধকের আত্মাকে মুক্ত করবই। শতবর্ষের অন্যায় আর অন্যায্য শৃঙ্খল ভাঙা আমার সাধনারই অংশ।” তার কণ্ঠে এমন দৃঢ়তা ছিল যে, গ্রামের মানুষ মুহূর্তের জন্য যেন ভয়ের সঙ্গে আশার আলোও দেখতে পেল। সেই রাতে আকাশে পূর্ণিমার আলো ঝলমল করছিল, আর গ্রাম নিস্তব্ধতার মধ্যে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করছিল—যেখানে অতীতের অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে জেগে উঠতে চলেছে এক তরুণ তান্ত্রিকের প্রতিজ্ঞা।
–
সেই রাতে, যখন পূর্ণিমার আলো গ্রামকে এক অদ্ভুত আবেশে ঢেকে রেখেছিল, তখন কমলিনী প্রথম অনুভব করল তার ভিতরের অস্থিরতা। দিনের বেলায় অরিন্দম আর হরিপদ জ্যাঠামশায়ের মুখে যে বন্দী সাধকের করুণ কাহিনি সে শুনেছে, তা তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু যখন রাত গভীর হলো, গ্রামের নিস্তব্ধতা যেন তার ঘরে ঢুকে গেল। হাওয়া থেমে গেল, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক থেমে এল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সে এক স্বপ্নের ভেতরে প্রবেশ করল। স্বপ্নে সে দেখল, অন্ধকার আকাশের নিচে এক জটাজুট সাধু দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে দীপ্তি, শরীর থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করলেন গ্রামের মাটির দিকে। কণ্ঠস্বর ভারী অথচ কোমল—“মাটির ভেতরে আমি আছি… শত বছর ধরে বন্দী হয়ে আছি… মুক্ত করো।” সেই কণ্ঠস্বর যেন বাতাস কাঁপিয়ে তুলল, যেন স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝের দেয়াল ভেঙে দিল। কমলিনীর শরীর শীতল হয়ে এল, তবু সেই চোখমুখে কোনো ভীতি নয়, বরং অসীম বেদনা আর এক আশ্চর্য বিশ্বাস দেখা গেল। সে অনুভব করল, সাধুটি তাকে বেছে নিয়েছেন—একজন সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে, যার কাছে এর আগে এমন কোনো অলৌকিক অভিজ্ঞতা আসেনি।
ঘুম ভাঙার পর কমলিনী ভয়ে কাঁপছিল। রাত তখনও শেষ হয়নি, চারপাশে অন্ধকার, কেবল পূর্ণিমার আলো জানালা দিয়ে ঢুকছিল। তার বুক ধড়ফড় করছিল, তবু সে জানত, স্বপ্নটিকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। সে ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করল না। মশালের ক্ষীণ আলো হাতে নিয়ে সরাসরি মন্দির প্রাঙ্গণে গেল, যেখানে অরিন্দম ধ্যানস্থ ছিল। অরিন্দম চোখ খুলে তার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে চমকে উঠল। কমলিনী কাঁপা গলায় সব বলল—“আমি স্বপ্নে এক সাধুকে দেখেছি। তাঁর জটাজুট, দীপ্ত চোখ… তিনি বললেন, তিনি মাটির নিচে বন্দী, আর আমাকে ইঙ্গিত দিলেন। তিনি মুক্তি চাইছেন, অরিন্দমদা, তিনি চাইছেন আমরা তাঁকে মুক্ত করি।” অরিন্দম মনোযোগ দিয়ে শুনল। তার চোখে কোনো বিস্ময় ছিল না, বরং গভীর এক চিন্তার ছায়া। সে শান্ত কণ্ঠে বলল, “তুমি তাঁকে দেখেছ মানে তিনি তোমাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তোমার স্বপ্ন কোনো কল্পনা নয়, বরং এক ধরনের আহ্বান। সাধকের আত্মা তোমাকে বিশ্বাস করছে।” কমলিনীর বুক কেঁপে উঠল—এত বড় দায়িত্ব হঠাৎ তার কাঁধে এসে পড়েছে!
কিন্তু এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গদাধর মোড়ল খবর পেল যে কমলিনী স্বপ্নে বন্দী সাধুকে দেখেছে। সে রাগে ফুঁসে উঠল। মোড়লের চোখে ভয় লুকোনো থাকলেও মুখে সে কটাক্ষ করল—“এ সব বাজে কথা। স্বপ্ন দেখে কেউ কখনো সত্য জানতে পারে না। এসব হলো তান্ত্রিক আর মেয়েদের কল্পনা, যা গ্রামকে বিপদে ফেলবে।” সে প্রকাশ্যে সবাইকে বলল, “যদি সাধক সত্যিই বন্দী থাকেন, তাহলে এতদিনে আমাদের ক্ষতি করতেন। এখন এসব নতুন নাটক সাজানো হচ্ছে।” কিন্তু তার ভিতরে ভিতরে আতঙ্ক বাড়তে লাগল। কারণ সে জানত, তার পূর্বপুরুষরা অনন্তানন্দকে বন্দী করার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। এই সত্য প্রকাশ হলে তার পরিবার কলঙ্কে ডুবে যাবে। তাই সে চাইল যত দ্রুত সম্ভব কমলিনী ও অরিন্দমকে থামানো হোক। প্রকাশ্যে সে কমলিনীকে সতর্ক করল—“মেয়ে, এসব স্বপ্নের গল্প বলো না। গ্রামের সর্বনাশ ডেকে আনবে।” কমলিনী এক মুহূর্ত ভয় পেলেও তার চোখে দৃঢ়তা এল। সে উত্তর দিল, “আমি যা দেখেছি, তা সত্য। আমি ভয় পাব না। সাধুর আত্মা মুক্তি চাইছে, আমি পিছিয়ে যাব না।” তার স্পষ্ট জবাব শুনে চারপাশে চাপা গুঞ্জন উঠল—গ্রামের মানুষ বুঝতে পারল, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একটা লড়াই শুরু হয়ে গেছে।
অরিন্দম কমলিনীর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “যদি ভয় দেখিয়েই সত্যকে চেপে রাখা যায়, তাহলে গ্রাম কোনোদিন মুক্ত হবে না। সাধকের আত্মা শত বছর ধরে আহ্বান জানাচ্ছে। এবার সময় এসেছে বাঁধন ভাঙার।” গদাধরের চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল, কিন্তু লোকসমক্ষে কিছু না বলে সে সরে গেল, মনে মনে আরও গভীর ষড়যন্ত্রের ফাঁদ বুনতে লাগল। এদিকে কমলিনী অনুভব করছিল, তার স্বপ্ন তাকে শুধু ভয় পাইয়ে দেয়নি, বরং এক শক্তি দিয়েছে। সে প্রথমবার উপলব্ধি করল, নিজের ভিতরে সে কেবল এক সাধারণ মেয়ে নয়, বরং এমন একজন যাকে নিয়তি বেছে নিয়েছে। সেই রাতের স্বপ্ন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। আর অরিন্দমও বুঝল, এই যাত্রায় সে একা নয়—কমলিনী হবে তার সহযাত্রী, সাধকের মুক্তির লড়াইয়ে তার সবচেয়ে বড় আশ্রয়। পূর্ণিমার আলো মিলিয়ে গিয়ে ভোরের সূর্য উঠল, কিন্তু গ্রামের আকাশে যেন নতুন করে অশান্তির মেঘ জমতে শুরু করল। কারণ অন্ধকার জানত, তাদের বাঁধন ভাঙতে এলে প্রতিরোধও আসবেই—এবার লড়াই হবে মুক্তি আর অভিশাপের, আলো আর অন্ধকারের মধ্যে।
–
গদাধর মোড়ল তার অবস্থান শক্ত করতে সময় নষ্ট করল না। এক সকালে সে গ্রামসভা ডেকে সবাইকে জমায়েত করল বটগাছের তলায়। তার গলা ভারী, চোখে লালচে ঝিলিক—“শুনো সবাই, তোমরা কি জানো না? মাটির ভেতর থেকে যে কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, সেটা কোনো সাধুর নয়, ওটা ভূতের কণ্ঠ! শয়তানি আত্মা আমাদের ধ্বংস করতে চাইছে। খুঁড়লেই গ্রাম ধ্বংস হবে, বংশে অভিশাপ নেমে আসবে।” তার কথায় চারপাশে গুঞ্জন উঠল। গ্রামের অনেকেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল, তারা ভয় পেতে শুরু করল। কেউ বলল, “সত্যিই তো, আগে তো আমরা শান্তিতে ছিলাম, এখন হঠাৎ এ কণ্ঠ কেন?” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল, “মোড়ল যা বলছে, মিথ্যা হতে পারে না। এতদিন তো সে-ই আমাদের হাল ধরেছে।” ভয় আর সন্দেহ গ্রামকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করতে লাগল। গদাধর ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলল। সে জানত, ভয়ই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র—একবার মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেলে তারা আর যুক্তি শুনতে চাইবে না।
কিন্তু সবাই যে গদাধরের কথায় বিশ্বাস করল, তা নয়। গ্রামের একাংশ ইতিমধ্যেই অরিন্দমের প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেছে। তারা মনে করত, এতবড় জ্ঞান আর সাহসের অধিকারী তান্ত্রিককে অকারণে সন্দেহ করা ঠিক হবে না। অরিন্দম শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, “যা শুনছ তোমরা, তা ভূতের কণ্ঠ নয়। এটি হলো এক সাধকের বন্দী আত্মার আর্তনাদ। যদি আমরা ভয় পেয়ে পেছনে হটে যাই, তাহলে শত বছরের অভিশাপ কখনো ভাঙবে না। কুসংস্কার কেবল অন্ধকারকে শক্তিশালী করে, কিন্তু সত্য আলো ছড়িয়ে দেয়।” তার কথায় অনেকে নতুন করে সাহস পেল। বিশেষত কমলিনী এগিয়ে এসে বলল, “আমি নিজে স্বপ্নে সাধুকে দেখেছি। তিনি আমাকে আহ্বান জানিয়েছেন। যদি এটা ভূত হতো, তবে কেন সে মুক্তি চাইত? ভূত তো ক্ষতি করতে চাইত।” তার সরল অথচ আন্তরিক কণ্ঠস্বর গ্রামের অনেকের মনে দোলা দিল। ফলে গ্রাম এক অদৃশ্য রেখায় ভাগ হয়ে গেল—একপাশে যারা অরিন্দম আর কমলিনীর কথায় আস্থা রাখল, অন্যপাশে যারা গদাধরের ভয়ে অন্ধকারে বিশ্বাস করল।
এই বিভাজন দ্রুত গ্রামের জীবনে প্রতিফলিত হতে লাগল। যারা অরিন্দমের পক্ষে দাঁড়াল, তাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল গদাধরের দলে থাকা মানুষজন। হাটে একসঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়া বন্ধ হলো, খেয়া নৌকায় ওঠার সময়ও দলাদলি শুরু হলো। এমনকি পুজোর সময় কোন দিকের লোক আগে পূজার ফুল দেবে, তা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক দেখা দিল। গ্রামের মানুষ, যারা এতদিনে একসঙ্গে সুখে-দুঃখে ছিল, তারা হঠাৎ করেই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। গদাধরের দল আরও ভয় ছড়াতে লাগল—“ওরা যদি সাধককে খুঁড়ে তোলে, তাহলে মাটি ফেটে যাবে, আগুন বেরোবে, গ্রাম ভস্মীভূত হবে।” আবার অরিন্দমের সমর্থকেরা বলল, “যদি আমরা মুক্ত না করি, তাহলে চিরকাল অশান্তি থাকবে।” গ্রামের আকাশে যেন অদৃশ্য দ্বন্দ্বের মেঘ জমে উঠল। প্রতিটি সন্ধ্যা ভরে উঠল সন্দেহ, আতঙ্ক আর অস্থিরতায়।
অরিন্দম এ বিভাজন দেখে মনের মধ্যে ভার অনুভব করল। সে জানত, এই দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক নয়—গদাধর শুধু ভয়ের গল্প বলছে না, সে ইচ্ছাকৃতভাবে অভিশাপের আবরণ ঘন করছে। তবু অরিন্দম পিছিয়ে এল না। এক রাতে সে কমলিনীকে পাশে বসিয়ে বলল, “এই লড়াই শুধু এক সাধকের মুক্তির নয়, বরং মানুষের মনের মুক্তিরও। যতদিন পর্যন্ত তারা কুসংস্কারে বন্দী থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কোনো আলোই তাদের কাছে পৌঁছাবে না। আমাদের কাজ শুধু বাঁধন ভাঙা নয়, তাদের চোখ খুলে দেওয়া।” কমলিনী শান্তভাবে মাথা নাড়ল। তার চোখে ভয় থাকলেও সেই ভয় ছাপিয়ে জেগে উঠছিল দৃঢ়তা। সে জানত, অরিন্দম একা নয়—সে-ও পাশে আছে। আর গ্রামে যারা সাহসী, তারাও ধীরে ধীরে একত্র হচ্ছিল। বিভক্ত গ্রাম আসলে আসন্ন লড়াইয়ের পূর্বাভাস ছিল, যেখানে সত্যের আলো আর কুসংস্কারের অন্ধকার মুখোমুখি হবে। আকাশে চাঁদ উঠল, শীতল হাওয়া বয়ে গেল, আর গ্রামের বুক যেন ফিসফিস করে বলল—এ লড়াই কেবল শুরু হলো, শেষ নয়।
–
অরিন্দমের মনে তখন দৃঢ় সংকল্প। বহুদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েই সে গ্রামে এসেছিল, আর এখন যখন সত্য উদ্ঘাটনের মুহূর্ত এসেছে, সে জানত তাকে পিছিয়ে যাওয়া চলবে না। সেই রাতে, অমাবস্যার কালো আকাশের নীচে, গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে ঘুমিয়ে ছিল। দূরে কেবল শেয়ালের ডাক আর হাওয়া কাঁপিয়ে তোলা বাঁশঝাড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হাতে কুশপাতার ধূপ, কপালে রক্তচন্দনের তিলক, আর সামনে ত্রিকোণ যন্ত্র আঁকা—অরিন্দম ধীরে ধীরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল। তার ঠোঁট নড়তেই বাতাস ভারী হয়ে এল, যেন চারদিক থেকে অদৃশ্য চোখ তাকে দেখতে লাগল। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তার কণ্ঠে মন্ত্রের শক্তি ছড়িয়ে পড়তেই মাটির নিচ থেকে এক অদ্ভুত কাঁপুনি উঠল। অরিন্দম চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারছিল, কণ্ঠের উৎসের দিক সে ধরতে পারছে—যেন মাটির গভীরে এক আলো বন্দী হয়ে কাঁপছে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই চারপাশে বাতাস ছিঁড়ে উঠল ভয়ঙ্কর হাহাকার, মন্ত্রোচ্চারণ থামিয়ে সে চোখ খুলল, আর তখনই দেখল—তার সামনে ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে এক কালো ছায়া।
ছায়াটি প্রথমে অস্পষ্ট ছিল, তারপর তা রূপ নিল এক বিশাল কালো কুকুরের মতো দানবীয় আকৃতিতে। চোখ জ্বলছিল আগুনের মতো, দাঁত বেরিয়ে ভয়ঙ্কর হাসি দিচ্ছিল। গর্জন করতে করতে সেটা অরিন্দমের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অরিন্দম বুঝল, এ কোনো সাধারণ আত্মা নয়, বরং অশুভ শক্তির প্রহরী—যাকে বিশেষ উদ্দেশ্যে এখানে বেঁধে রাখা হয়েছে। মন্ত্র উচ্চারণ আরও তীব্র করে সে নিজের চারপাশে সুরক্ষা চক্র তৈরি করল। কালো কুকুরের মতো ছায়াটি তার চারপাশে ঘুরতে লাগল, যেন অপেক্ষা করছে চক্র ভাঙার। হঠাৎই মাটি কেঁপে উঠল, চারপাশে বাঁশঝাড় দুলে উঠল, আর দূরবর্তী গ্রামে কুকুরেরা একসঙ্গে ডেকে উঠল। যেন সমগ্র প্রকৃতি এই সংঘর্ষের সাক্ষী হয়ে গেল। অরিন্দম ঠান্ডা মাথায় বুঝল, এ শুধু এক প্রহরীর আক্রমণ নয়—কোনো এক শক্তিশালী তান্ত্রিক ইচ্ছাকৃতভাবে এই অভিশপ্ত প্রহরীকে বেঁধে রেখেছে, যাতে বন্দী সাধকের কাছে কেউ পৌঁছতে না পারে।
সংঘর্ষ তখন চূড়ান্ত রূপ নিল। কালো ছায়াকুকুর গর্জন করে আছড়ে পড়ল অরিন্দমের সুরক্ষা বৃত্তে। এক মুহূর্তের জন্য চক্র কেঁপে উঠল, ধূপের আগুন নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো। অরিন্দম মন্ত্রপাঠ জোরালো করতেই তার কপাল থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। সে বুঝল, একা শক্তি দিয়ে এ অশুভ প্রহরীকে হারানো সম্ভব নয়, প্রয়োজন গভীর একাগ্রতা আর ভেতরের আলোকে জাগিয়ে তোলা। চোখ বন্ধ করে সে অনন্তানন্দ সাধকের নাম স্মরণ করল—যেন বন্দী সাধকের আত্মার শক্তি থেকে কিছু দিশা পাওয়া যায়। তখন হঠাৎই বাতাসে ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে এল, করুণ অথচ দৃঢ়—“ভয় পেয়ো না, আমি আছি।” কণ্ঠটি যেন অরিন্দমের মনে এক প্রবল শক্তির সঞ্চার করল। তার চোখ জ্বলে উঠল, মন্ত্রের ধ্বনি আরও গর্জে উঠল, আর সুরক্ষা চক্রের ভেতর থেকে আলো বেরোতে লাগল। আলোয় ভীত হয়ে কালো ছায়াকুকুর হাউমাউ করে পিছিয়ে গেল, কিন্তু তাও পুরোপুরি অদৃশ্য হলো না—বরং আড়াল থেকে গর্জন করে জানিয়ে গেল, সে আবার আসবে।
সংঘর্ষ শেষে অরিন্দম হাঁপিয়ে পড়ল, শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু চোখে জ্বলছিল দৃঢ়তার আগুন। সে জানল, পথ কঠিন—কারণ বন্দী সাধকের আত্মাকে শুধু খুঁজে পেলেই হবে না, তার পথ পাহারা দিচ্ছে ভয়ঙ্কর অশুভ শক্তি। সেই প্রহরী হলো প্রতীক, শত বছরের বাঁধনের প্রহরা। গ্রামে ফিরে এসে সে কমলিনীকে সব বলল। কমলিনী আতঙ্কিত হয়ে গেল, কিন্তু তার চোখে ভয়কে ছাপিয়ে উদ্বেগ ফুটে উঠল। “এ মানে কি কেউ ইচ্ছে করে সাধুকে বন্দী রেখেছে?”—তার কণ্ঠ কাঁপছিল। অরিন্দম মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আর সেই শক্তি এখনও সক্রিয়। কেউ চাইছে না সত্য প্রকাশ পাক। আমাদের লড়াই শুধু আত্মা মুক্ত করার নয়, বরং অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধেও।” সেই রাতে গ্রামের আকাশ আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কিন্তু সবাই জানত না, নিস্তব্ধতার আড়ালে জমছে আরও বড় ঝড়। অরিন্দম উপলব্ধি করল, এ শুধু শুরু—প্রথম সংঘর্ষ মাত্র, সামনের পথ আরও বিপজ্জনক।
–
সেদিনের সংঘর্ষের পর অরিন্দম যেন বুঝে গেল, এই রহস্যের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। সে যখন আবার হরিপদ জ্যাঠামশাইয়ের কাছে গেল, বৃদ্ধ তখন গ্রামের পুরনো খড়ের চালের ঘরে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বসেছিলেন। অরিন্দমের মুখ দেখে তিনি বুঝলেন, রাতের অভিজ্ঞতা তাকে গভীর চিন্তায় ফেলেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিপদ বললেন, “তোর ভেতর আমি সেই আলো দেখি, অরিন্দম। তাই আজ তোকে এমন এক কথা বলব, যা এত বছর আমি কাউকে বলিনি।” তাঁর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, কিন্তু দৃঢ়তাও ছিল। তিনি জানালেন, একশো বছর আগে যখন অনন্তানন্দ সাধক তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী তান্ত্রিক তাকে ভয় পেতে শুরু করেছিল। তারা আশঙ্কা করেছিল, যদি অনন্তানন্দ সিদ্ধিলাভ করেন, তবে তাদের সমস্ত প্রভাব মুছে যাবে। তাই তারা মিলে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র করল—অনন্তানন্দকে জীবন্ত মৃত্তিকার নিচে বন্দী করা। সেই তান্ত্রিকদের মধ্যে একজন ছিল গদাধরের পূর্বপুরুষ।
অরিন্দম স্তব্ধ হয়ে গেল। টুকরো টুকরো করে সবকিছু যেন পরিষ্কার হতে লাগল তার চোখে। গদাধরের অকারণ ভয় ছড়ানো, সবসময় সাধুর কণ্ঠকে ভূতের অভিশাপ বলে চিৎকার করা—এসব আসলে তার বংশগত স্বার্থরক্ষা। অরিন্দম ধীর গলায় বলল, “তাহলে গদাধর আসলে জানে সত্যিটা। সে ভয় পায়, সত্য প্রকাশ পেলে তার পূর্বপুরুষের অপকর্ম প্রকাশ হয়ে যাবে।” হরিপদ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। তিনি জানালেন, তার নিজের দাদু সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, আর সেই কাহিনি পরিবারের ভেতরেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গোপনে বয়ে এসেছে। “কিন্তু আমরা কেউ সাহস করিনি প্রকাশ করতে। কারণ গদাধরের বংশ সবসময় ক্ষমতার দাপটে ছিল। আর গ্রামবাসী অন্ধ কুসংস্কারে বিশ্বাসী, তাদের বোঝানো কঠিন ছিল।” হরিপদের চোখে জল এসে গেল, “কিন্তু তুই এসেছিস বলেই আজ এই গোপন ইতিহাস মুখে আনলাম। মনে রাখিস, তোর পথের বিপদ শুধু অশুভ শক্তি নয়, মানুষের ভেতরের অন্ধকারও।”
অরিন্দম এ সত্য জানার পর আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। কিন্তু সে জানত, শুধু কথায় হবে না, প্রমাণও চাই। তাই সে কমলিনীকে সব বলল। প্রথমে কমলিনী ভয় পেয়ে কেঁপে উঠল, কারণ সে বুঝতে পারল, গদাধর শুধু গ্রামের মোড়ল নয়, আসলে অন্ধকার ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। কিন্তু তার সাহস ভয়কে ছাপিয়ে গেল। সে বলল, “আমরা যদি সত্য খুঁজে না বের করি, তবে এই গ্রাম কখনো মুক্তি পাবে না। আমি তোমাকে সাহায্য করব।” অরিন্দম ও কমলিনী দু’জন গোপনে তথ্য খোঁজার কাজে নেমে পড়ল। তারা রাতের অন্ধকারে হরিপদের পুরনো ট্রাঙ্ক ঘেঁটে বের করল কিছু হলদে হয়ে যাওয়া পুঁথি, পুরনো তালপাতার গ্রন্থ, আর ভাঙা মাটির পাতিলের ভেতরে রাখা কিছু গুপ্ত চিহ্ন। এইসব প্রমাণ ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে দিল, অনন্তানন্দকে বন্দী করার পেছনে গদাধরের পূর্বপুরুষদের হাত ছিল। আরও জানা গেল, অশুভ প্রহরীকে মাটির নিচে বেঁধে রাখার জন্য রক্তবলি দেওয়া হয়েছিল, আর সেই রক্তবলি আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অভিশাপ হয়ে বয়ে চলছে।
দিনের বেলা কমলিনী স্বাভাবিকভাবে গ্রামের কাজকর্মে মিশে থাকত, কিন্তু রাতে চুপিচুপি অরিন্দমকে সাহায্য করত। তারা গোপনে গ্রামের প্রাচীন শ্মশানঘাটে গেল, যেখানে এক ভাঙা শিবমন্দির দাঁড়িয়ে ছিল। মন্দিরের ভেতরে পাথরের দেয়ালে কিছু গোপন তান্ত্রিক চিহ্ন খোদাই করা ছিল, যা দেখে অরিন্দম নিশ্চিত হলো—এখানেই একসময় গোপন সাধনাসভা বসত, যেখানে ষড়যন্ত্রকারীরা মিলিত হয়েছিল। কমলিনী প্রদীপের আলো তুলে বলল, “এটাই প্রমাণ। সত্য চাপা দেওয়া যায়, কিন্তু মুছে দেওয়া যায় না।” তার চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন গ্রামীণ সরলতার আড়ালে এক দুর্নিবার সাহস লুকিয়ে আছে। অরিন্দম তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, এই গ্রামকে মুক্তি দিতে হলে শুধু নিজের শক্তিই নয়, মানুষের সাহসও দরকার। হরিপদের বলা গোপন ইতিহাস এখন তাদের হাতে অস্ত্র হয়ে উঠল। তবে তারা জানত, এ অস্ত্র প্রকাশ করলেই গদাধর তাদের প্রাণঘাতী শত্রুতে পরিণত হবে। তাই দু’জন ঠিক করল—সময় এলেই, সবার সামনে সত্য প্রকাশ করা হবে। তার আগে তাদের প্রস্তুত হতে হবে, কারণ অশুভ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ এখন অনিবার্য।
–
অরিন্দম যতই গভীর গবেষণা করছিল, ততই বুঝতে পারছিল বন্দী সাধকের মুক্তি কোনো সহজ কাজ নয়। মাটির নিচে একশো বছরের পুরোনো তান্ত্রিক বাঁধন, যাকে ভাঙতে হলে চাই এক মহাযজ্ঞ—যজ্ঞ যেখানে আগুন হবে মাধ্যম, মন্ত্র হবে অস্ত্র আর রক্ত হবে উৎসর্গ। সে জানত, রক্ত ছাড়া এ বাঁধন ভাঙা সম্ভব নয়, কারণ রক্ত দিয়েই একসময় এ শৃঙ্খল তৈরি হয়েছিল। এই কথা সে যখন হরিপদ জ্যাঠামশাইয়ের কাছে প্রকাশ করল, বৃদ্ধ গভীর নিশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ, তুই ঠিক বলছিস। অনন্তানন্দকে মাটির নিচে বেঁধে রাখতে তাদের পূর্বপুরুষেরা রক্তবলি দিয়েছিল। তাই রক্ত দিয়েই মুক্তি সম্ভব। তবে ভুল করিস না—এ বলি মানে অন্ধকার রক্তপিপাসা নয়, এ মানে আত্মোৎসর্গ।” অরিন্দম গভীর মনোযোগে সব শুনল এবং মনের ভেতরেই প্রতিজ্ঞা করল—যদি প্রয়োজন পড়ে, নিজের রক্ত দিতেও সে পিছপা হবে না। এ কাজ তার জন্য শুধু সাধক মুক্তির লড়াই নয়, বরং এক অন্ধকার ইতিহাসকে চিরতরে ধ্বংস করার ব্রত।
কিন্তু গ্রামে যখন এ সংবাদ পৌঁছাল, তখন এক ভয়ঙ্কর অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। সবাই শুনল, বন্দী আত্মাকে মুক্ত করতে হলে রক্তের প্রয়োজন, আর সঙ্গে থাকবে ভয়ঙ্কর যজ্ঞ। সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠল। কারও মনে হলো, এ নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কালো যাদু; কারও মনে হলো, এ হলে গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে। গদাধর এই সুযোগেই আগুনে ঘি ঢালল। সে গ্রামের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল, “দেখেছিস তো? আমি বলেছিলাম—ও কণ্ঠ ভূতের। আর এখন এই তান্ত্রিক বলছে, রক্ত চাই! এটা কোনো মুক্তি নয়, সর্বনাশ ডেকে আনা।” ভয়ে সন্ত্রস্ত মানুষ অরিন্দমকে সন্দেহ করতে শুরু করল। কিন্তু তখনই এগিয়ে এল কমলিনী। তার কণ্ঠে ভয় ছিল না, ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমরা ভুল করছ। আমি নিজের চোখে দেখেছি অরিন্দম কীভাবে অশুভ ছায়ার সঙ্গে লড়াই করেছে। যদি ও না চাইত, তবে আমি হয়তো আজ বেঁচে থাকতাম না। রক্ত মানে কোনো নিরীহ প্রাণীর মৃত্যু নয়, রক্ত মানে ত্যাগ। এই গ্রাম বাঁচাতে যদি রক্ত দিতে হয়, তবে আমি দেব।” তার এই অকপট উচ্চারণ গ্রামবাসীর মনে আলোড়ন তুলল। যারা মুহূর্ত আগে সন্দেহ করছিল, তারা এখন দ্বিধায় পড়ে গেল।
অরিন্দম যজ্ঞের প্রস্তুতি শুরু করল। গোপনে সে রাতের আঁধারে শ্মশানঘাটের পাশে একটি যজ্ঞমণ্ডপ তৈরি করল। সেখানে শুকনো কাঠ, কুশপাতা, কালো তিল আর ঘৃত দিয়ে অগ্নিকুণ্ড সাজানো হলো। মন্ত্রে অভিষিক্ত জল, লাল সুতোর বাঁধন আর শালপাতার থালায় রাখা প্রসাদ সবই প্রস্তুত ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আত্মোৎসর্গের প্রতীকী রক্ত—যা দিতে হবে যজ্ঞ চলাকালীন সময়ে। কমলিনী পাশে দাঁড়িয়ে বারবার বলছিল, “তুমি একা নও, আমি আছি।” অরিন্দম মৃদু হেসে উত্তর দিল, “আমি জানি। হয়তো তোর সাহস ছাড়া আমি এতদূর আসতেই পারতাম না।” যজ্ঞ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বাতাস বদলে গেল। আগুনের শিখা উঁচু হতে লাগল, মন্ত্রপাঠে চারপাশ কেঁপে উঠল। গ্রামবাসীরা দূর থেকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে ছিল, যেন অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। ঠিক তখনই দেখা দিল গদাধর। সে একদল মানুষ নিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল, “থামাও! এই যজ্ঞ মানে গ্রাম ধ্বংস। তোমরা যদি থামাও না, আমি নিজেই রুখে দেব।” তার চোখে তখন ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ক্রোধও ছিল।
কিন্তু অরিন্দম থামল না। সে চোখ বন্ধ করে আরও জোরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল। আগুন তখন নীলাভ আভা ছড়াচ্ছিল, আর হঠাৎই মাটির নিচ থেকে করুণ কণ্ঠ ভেসে উঠল—“মুক্তি দাও, মুক্তি দাও…” সেই কণ্ঠে গ্রামের মানুষ কেঁপে উঠল। গদাধর ভয়ে পিছিয়ে গেলেও তার রাগ থামল না। সে হাতে লাঠি তুলে যজ্ঞমণ্ডপের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল, কিন্তু গ্রামের কয়েকজন তাকে থামিয়ে দাঁড় করাল। সেই মুহূর্তে অরিন্দম নিজের আঙুলে ছুরি চালাল, কয়েক ফোঁটা রক্ত আগুনে ফেলল। আগুন যেন সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আলোয় ফেটে পড়ল, আকাশে ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠল, আর ভেসে এলো অশুভ শক্তির হাহাকার। এক অদৃশ্য প্রতিরোধ যেন যজ্ঞকে থামাতে চাইছিল। কিন্তু অরিন্দম মন্ত্র জারি রাখল, আর কমলিনী তার হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়াল, যেন নিজের সাহস দিয়ে তাকে শক্তি দিচ্ছে। গদাধর শেষবারের মতো গর্জে উঠল, “এ যজ্ঞ চলতে দেব না।” কিন্তু গ্রামের লোক এবার দ্বিধা ভাঙল—তারা গদাধরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলল, “থামো! এতদিন আমরা ভুল করেছি, এখন আর নয়।” গদাধর হতবাক হয়ে পিছিয়ে গেল, আর আগুনের শিখা আরও উঁচু হলো। যজ্ঞ তখন পূর্ণতায় পৌঁছে গিয়েছিল, আর সবার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল—সত্যকে আর থামানো যাবে না।
–
পূর্ণিমার রাত। সারা গ্রাম সেদিন নিস্তব্ধ হয়ে ছিল, যেন অদ্ভুত ভয়ে আচ্ছন্ন। আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ, তার সাদা আলো গ্রামপ্রান্তের সেই প্রাচীন শ্মশানমাঠে অরিন্দমের সাজানো যজ্ঞকুণ্ডকে ভৌতিকভাবে উজ্জ্বল করে তুলেছে। চারপাশে শীতল বাতাস বইছে, কিন্তু যজ্ঞকুণ্ডের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, অগ্নিশিখা যেন মন্ত্রোচ্চারণের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে। অরিন্দম বসে আছে আসনে, তার সামনে প্রসারিত রয়েছে লালচে কপালচিহ্ন, মন্ত্রলিখিত তাম্রপত্র আর বলির জন্য আনা পবিত্র উপকরণ। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে গুরুগম্ভীর মন্ত্র, প্রতিটি শব্দ যেন বিদ্যুতের মতো আঘাত করছে চারপাশের অন্ধকারে। সেই মুহূর্তে হঠাৎই মাটির গভীর থেকে ভেসে এলো করুণ কণ্ঠস্বর, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি তীব্র—“আমাকে মুক্ত করো… শতবর্ষের অন্ধকার ভেঙে দাও…।” গ্রামবাসীরা যারা দূর থেকে ভয়ে তাকিয়ে ছিল, তারা একে অপরের হাত চেপে ধরল। কমলিনী দাঁড়িয়ে আছে অরিন্দমের পাশে, হাতে দীপশিখা ধরে সে মন্ত্রপাঠে সঙ্গ দিচ্ছে। তার চোখে ভয় থাকলেও মুখে দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট—যেন এই যজ্ঞে অরিন্দম একা নয়, তার সঙ্গী হিসেবে সে-ও লড়ছে।
কিন্তু মুক্তির দ্বার এত সহজে খোলা যাবে না। হঠাৎই চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, অদ্ভুত গর্জন শোনা গেল শ্মশানমাঠের অন্ধকার দিক থেকে। মাটির ভেতর থেকে যেন কিছু একটা বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। অরিন্দম মন্ত্রপাঠ জোরালো করতেই চারপাশের মাটিতে ফাটল ধরল। সেই ফাটল থেকে ধোঁয়া আর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, আর একের পর এক ছায়া অবয়ব বের হতে লাগল—কালো কুকুরের মতো, লাল চোখ জ্বলা দানবসদৃশ প্রাণী, যারা যেন অশুভ শক্তির প্রহরী। তারা একসাথে গর্জন করে অরিন্দমের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অরিন্দম মুহূর্তের মধ্যে তার তান্ত্রিক শক্তি ব্যবহার করল, যজ্ঞকুণ্ড থেকে অগ্নিশিখা উঁচু হয়ে ছায়াগুলিকে পেছনে ঠেলে দিল। কিন্তু সেই শক্তি সাময়িক, প্রতিটি আক্রমণের সাথে সাথে মনে হচ্ছিল অশুভ শক্তি আরও প্রবল হয়ে উঠছে। কমলিনী কেঁপে উঠলেও সাহস হারায়নি। সে হাত তুলে দীপশিখা ঘুরিয়ে এক পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করল, আর তার আলো এক মুহূর্তের জন্য অন্ধকারকে চিরে ছায়াগুলিকে দুর্বল করে দিল। গ্রামের মানুষ দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে কেঁদে উঠল, কেউ চিৎকার করে উঠল, “ওরা টিকতে পারবে তো?”
যজ্ঞ এগোতে থাকতেই অরিন্দম বুঝল, এটা শুধু মন্ত্রপাঠের লড়াই নয়, এটা এক আধ্যাত্মিক পরীক্ষা। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে তার শরীর ভারী হয়ে আসছিল, রক্ত ঝরছিল নাকে-মুখে, কিন্তু সে থামেনি। কারণ সে জানত, যদি থামে তবে সাধকের মুক্তি অসম্ভব হয়ে পড়বে, আর গ্রামের সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না। মাটির ফাঁটল আরও প্রশস্ত হয়ে উঠল, গর্জন আরও তীব্র হলো, যেন পৃথিবী ফেটে যাবে। সেই গর্জনের ভেতর থেকে আবারও ভেসে এলো সেই করুণ কণ্ঠ—“অরিন্দম, শেষ অবধি লড়ো, মুক্তির দ্বার খুলে দাও।” কণ্ঠস্বর শুনে তার চোখে অদ্ভুত জ্যোতি নেমে এলো। কমলিনী তখন তার পাশে বসে পড়ল, দু’হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করে জপ শুরু করল। তার সেই জপ অরিন্দমের মন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করে তুলল। যজ্ঞকুণ্ড থেকে অগ্নি যেন আকাশ ছুঁতে লাগল, শিখার ভেতর থেকে উদ্ভাসিত হলো রহস্যময় প্রতীক, যা দেখে ছায়াগুলো ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে এক বিশাল কালো ছায়া মাটির ফাঁটল ভেঙে উঠে এলো—অশুভ শক্তির রূপ, লাল চোখ, বিশাল দাঁত আর বিকট চিৎকারে আকাশ কাঁপিয়ে দিল।
অরিন্দম তখন দাঁড়িয়ে উঠে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল, তার কণ্ঠে রক্ত জমে গেলেও সে থামল না। কমলিনী তার হাত ধরে তাকে শক্তি দিল। গ্রামের মানুষ সেই দৃশ্য দেখে বুঝল—এ লড়াই কেবল তান্ত্রিক আর অশুভ শক্তির নয়, এ লড়াই বিশ্বাস আর ভয়ের, মুক্তি আর সর্বনাশের। মাটি তখন প্রবলভাবে কেঁপে উঠছে, শ্মশানমাঠের চারপাশে গাছপালা উপড়ে পড়ছে, দূরে নদীর জল ফেনিয়ে উঠছে। পূর্ণিমার আলো সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যকে আরও রহস্যময় করে তুলছিল। অরিন্দম শেষ মন্ত্রোচ্চারণের জন্য চোখ বন্ধ করল, তার চারপাশে অগ্নিশিখা বৃত্ত তৈরি করল, আর সেই বৃত্তের ভেতর কমলিনীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে সে ছায়াটির মুখোমুখি হলো। দু’পক্ষের শক্তি একসাথে সংঘর্ষ করলে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ হয়ে উঠল, গর্জনে ভরে গেল সমগ্র গ্রাম। আর সেই মুহূর্তেই খুলে গেল মুক্তির দ্বার—মাটির গভীর থেকে আলো ফুঁড়ে উঠল, যা এতদিন ধরে বন্দী আত্মাকে মুক্তি দিতে চাইছিল। গ্রামবাসীরা বিস্ময়ে, ভয়ে আর আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল—এই আলোর স্রোত কি তাদের মুক্তি দেবে, নাকি সর্বনাশের নতুন অধ্যায় শুরু করবে?
–
যজ্ঞের আগুন তখন শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। অরিন্দমের কণ্ঠে উচ্চারিত মন্ত্রগুলো যেন শূন্য আকাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, প্রতিটি শব্দ গর্জে উঠছিল ঝড়ের মতো। চারদিকের বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা নেমে এসেছিল, অথচ অগ্নিকুণ্ডের শিখাগুলো ক্রমেই উঁচু হচ্ছিল, যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। কমলিনী দাঁড়িয়ে আছে অরিন্দমের পাশে, তার মুখে ভয় নেই, আছে অদ্ভুত দৃঢ়তা। হঠাৎই মাটির গভীর থেকে ভাঙার শব্দ ভেসে এলো, যেন শতবর্ষ ধরে শক্ত হয়ে থাকা বন্ধনগুলো একে একে ভেঙে যাচ্ছে। মাটির ফাঁটল দিয়ে ধোঁয়া উঠতে লাগল, কাঁপতে লাগল ভূমি, আর এক প্রচণ্ড আলোর বিস্ফোরণে যেন রাতের অন্ধকার কেঁপে উঠল। গ্রামের মানুষজন আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠল, কেউ দৌড়ে পালাতে চাইলো, কেউ আবার বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সেই দৃশ্যের দিকে। তারপর মুহূর্তেই মাটি ফুঁড়ে উঠে এল এক আলোকোজ্জ্বল অবয়ব—জটাজুট, গেরুয়া বসন আর শান্ত অথচ দীপ্তিময় চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অনন্তানন্দ মহাসাধক। তার চারপাশে আলো এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে অন্ধকারের প্রতিটি কোণ ভেদ করে যেন পবিত্রতা ছড়িয়ে দিল। অরিন্দম বিস্ময়ে কেঁপে উঠে প্রণাম করল, আর কমলিনী অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল মুক্ত সাধকের দিকে।
অনন্তানন্দের কণ্ঠ ছিল করুণ অথচ গম্ভীর, তার চোখে এক অনন্ত ক্লান্তির ছাপ। তিনি বললেন, “অরিন্দম, তোর ব্রত সফল হয়েছে। শতবর্ষের বন্ধন ভেঙে গেল, আজ আমি মুক্তি পেলাম।” সেই মুহূর্তে গ্রামের মানুষজন আনন্দ আর স্বস্তিতে কেঁদে ফেলল। কেউ হাঁটু গেড়ে প্রণাম করল, কেউ আবার হাত জোড় করে মুক্তির জন্য ধন্যবাদ জানাতে লাগল। কিন্তু অনন্তানন্দের মুখে তখনও এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য রয়ে গেল। তিনি গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “কিন্তু তোরা ভুল করিস না, এ কেবল আমার মুক্তি। যে শক্তি আমাকে এতদিন ধরে বন্দী করে রেখেছিল, সেই অশুভ শক্তি এখন এই মাটির গভীর থেকে মুক্ত হয়ে গেছে।” তার কণ্ঠে শীতলতা ছিল, যা গ্রামের মানুষকে আবারও আতঙ্কে আচ্ছন্ন করল। চারপাশে ফিসফাস শুরু হলো—“তাহলে কি সর্বনাশ আসছে?” কেউ কেউ আবার গদাধরের দিকে তাকিয়ে বলল, “এ তোকে বলেছিল, সর্বনাশ হবে।” গদাধর যদিও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে তখনও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশের আকাশে অদ্ভুত অন্ধকার জমতে শুরু করল। যেন মুক্ত সাধকের আলো আর মুক্ত অশুভ শক্তির ছায়া একই সঙ্গে জন্ম নিয়েছে। বাতাসে হাহাকার ভেসে এলো, দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে ভয় বাড়তে লাগল। অরিন্দম দাঁড়িয়ে থাকলেও তার কপালে ঘাম জমতে লাগল। সে জানত, এই মুহূর্তই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। অনন্তানন্দ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “অরিন্দম, তুই সাহসী, কিন্তু এখন গ্রামের ভবিষ্যৎ তোর হাতে। আমি মুক্ত হয়েছি, এ আমার ধন্যতা। কিন্তু আমি চলে গেলে যে শক্তি তোর মুখোমুখি হবে, তা ভয়ঙ্কর।” কমলিনী কেঁপে উঠল, কিন্তু অরিন্দম তার হাত শক্ত করে ধরল। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আপনার মুক্তি আমার ব্রত ছিল। কিন্তু অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়াই আমার কর্তব্য।” গ্রামের মানুষজন আবারও বিভক্ত হয়ে পড়ল—কেউ বিশ্বাস করল অরিন্দম পারবে, কেউ আবার ভয়ে ভেঙে পড়ল। গদাধর একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তার মুখে তখন অনুতাপ আর আতঙ্কের ছাপ। হয়তো সে নিজেও বুঝতে পারছিল, পূর্বপুরুষদের পাপের বোঝা আজও গ্রামটাকে ছেড়ে যায়নি।
অনন্তানন্দের অবয়ব ধীরে ধীরে আলোর স্রোতে মিলিয়ে যেতে লাগল। তিনি শেষবারের মতো গ্রামবাসীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি আশীর্বাদ দিচ্ছি, তোরাদের অন্তর যদি পবিত্র থাকে তবে অশুভ শক্তি যতই প্রবল হোক, তা জয় করা সম্ভব। কিন্তু সতর্ক থাক, লোভ আর ভয়ের ফাঁদে যদি পড়িস, তবে সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না।” এত কথা বলে তিনি আলো হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেলেন। গ্রামে আবারও নেমে এলো গভীর অন্ধকার, আর দূরে কোথাও থেকে ভেসে এলো অশুভ হাসি—যেন মুক্তি আর সর্বনাশ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে কেঁপে উঠল, অরিন্দম দাঁড়িয়ে রইল মন্ত্রপাঠের প্রস্তুতিতে, আর কমলিনী তার পাশে অটল। গল্প থেমে গেল সেই মুহূর্তেই—গ্রামের ভবিষ্যৎ আলোর পথে যাবে, নাকি অন্ধকারের? উত্তর রয়ে গেল এক অদ্ভুত দ্বিধারেখায়, যেখানে মুক্তি আর সর্বনাশ একে অপরকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে।
____