অর্কপ্রভ দাস
এক
শুভঙ্কর সেন নামটা অফিসে নতুন কেউ শোনে না, যতক্ষণ না কেউ রিপোর্টে তার নাম দেখে বা মিটিংয়ে প্রশ্ন করে—“শুভ, তুমি কি এনালাইসিসটা রেডি রেখেছো?” সহকর্মীদের মুখে “শুভ” নামটাও যেন একটা দায়সারা উচ্চারণ, আর শুভঙ্করের জীবন ঠিক ততটাই নিষ্প্রভ। দক্ষিণ কলকাতার একটা একতলা বাড়িতে বৃদ্ধ মা আর একটা বিড়াল নিয়ে তার একঘেয়ে রুটিন চলে—সকালে অফিস, রাতের খাবারের পর বিছানা, তার মাঝে কেবল একটা জায়গায় সে নিজের মতো করে বাঁচে—সোশ্যাল মিডিয়ায়। “Mr. SilentVerse”—এই ছদ্মনামে সে একটা ফেসবুক পেজ চালায়, যেখানে সে তার নিজের লেখা কবিতা, দু-চার লাইন প্রেম, আর জীবনের অন্ধকার কোণার কথা শেয়ার করে। আশ্চর্যভাবে, সেখানে হাজার তিনেক ফলোয়ার আছে, যাদের অনেকেই অচেনা, অনেকেই সক্রিয়। বাস্তব জীবনে কারো সঙ্গে কথা বলতে গেলে তার গলা শুকিয়ে আসে, অথচ ভার্চুয়ালে সে দিব্যি নিজের মন খুলে কথা বলতে পারে। আর সেই ভার্চুয়াল জগতেই একদিন সন্ধ্যায়, অফিস থেকে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে পায় একটা নতুন মেসেজ—“তোমার কবিতাগুলো খুব গভীর, যেন কারো চুপ করে কাঁদার মতো।” প্রোফাইলটা দেখে সে একটু থমকে যায়। নাম: @MeghBristi07। প্রোফাইল পিকচারে মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না, কেবল একটুকরো মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টির ফোঁটার ওপরে আধা ভেজা হাতে আঁকা একটা গোলাপ।
প্রথমে শুভঙ্কর মেসেজটা দেখে রেখে দেয়, রিপ্লাই করে না। কিন্তু মনের ভেতর একটা কৌতূহল কাজ করে—কে এই মানুষটা? তার লেখা এত মন দিয়ে পড়ছে কে? পরদিন সকালে মেসেজটা আবার পড়ে, তারপর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে প্রোফাইলে গিয়ে দেখে, MeghBristi07-এর প্রোফাইলে অনেক কবিতা শেয়ার করা, অনেকটা তার নিজের লেখার মতো। একটা জিনিস দারুণ লাগে—এই মেয়েটি উত্তর না পাওয়ার পরেও আবার লিখেছে: “তুমি কি কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পাও?” শুভঙ্করের মনে পড়ে যায় তার কলেজের প্রেম, যেখানে সে প্রথম এক মেয়েকে ভালোবেসেছিল, আর সেই মেয়ে হঠাৎই একদিন অন্য একজনের সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে দিয়ে চলে যায়। তখন থেকেই তার মধ্যে একটা ভয় জন্মে—সম্পর্ক মানেই বিশ্বাসভঙ্গের আশঙ্কা। কিন্তু @MeghBristi07-এর কথায় যেন একটা অদ্ভুত মমতা আছে। ধীরে ধীরে দুজনের আলাপ বাড়ে। শুভঙ্কর নিজের লেখা কবিতা পাঠায়, আর মেঘবৃষ্টি মেয়েটি তার প্রতিটা লাইনের বিশ্লেষণ করে। দিন গড়িয়ে যায় রাত, আর শুভঙ্কর তার জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধুটাকে খুঁজে পায় এই অদেখা মেয়েটির মধ্যে।
অন্যদিকে নয়না ধর, সদ্য জয়েন করা কন্টেন্ট লিড, যিনি অফিসে অত্যন্ত পেশাদার এবং কার্যকরী—তিনিই এই MeghBristi07। শুভঙ্করের ডেস্কের তিন চেয়ারের ব্যবধানেই সে বসে, কিন্তু শুভঙ্কর তাকে যেন চিরকালই উপেক্ষা করে চলে। নয়না প্রথম দিনেই বুঝে গিয়েছিল—এই ছেলেটা কিছুটা অন্যরকম, অন্তর্মুখী, কিন্তু চোখে গভীর কিছু লুকানো আছে। সে যখন প্রথম শুভঙ্করের কবিতার পেজ পায়, তার ভেতর একধরনের আত্মীয়তা অনুভব করে। নিজের নাম-পরিচয়ে না গিয়ে, সে তৈরি করে MeghBristi07, আর ধীরে ধীরে শুভঙ্করের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলাপ শুরু করে। নয়না জানে না সে ঠিক কী চায়—শুভঙ্করের মনটা, না তার কবিতার পিছনের মানুষটিকে। তবে এটা সে বুঝে গেছে—এই ছেলেটার মন ভাঙা, অথচ মেরামতের মতো সুন্দর। নয়না প্রতিদিন অফিসে শুভঙ্করের পাশে বসে থাকে, অথচ কথা বলে তার ছদ্মনামে। এই দ্বৈত পরিচয়ের ভার তাকে মাঝেমাঝেই ভীষণ প্যাঁচিয়ে দেয়। কিন্তু সে থেমে যেতে পারে না, কারণ MeghBristi07-এর প্রতি শুভঙ্করের টান দিনে দিনে সত্যিকারের প্রেমে পরিণত হচ্ছে—তাতে নয়নার নিজের হৃদয়ও জড়িয়ে পড়ছে গভীরভাবে।
দুই
দিনের আলোয় শুভঙ্কর আর নয়না দুটি আলাদা জগতে বাস করে, অথচ রাতে যখন ফোনের আলো জ্বলে ওঠে, তাদের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তৈরি হতে থাকে এক অনির্বচনীয় বন্ধন। শুভঙ্করের কাছে MeghBristi07 হয়ে ওঠে তার জীবনের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ শ্রোতা—যার কাছে সে নির্দ্বিধায় নিজের ভয়, দুঃখ, অনিশ্চয়তা খুলে বলে। প্রতিদিন অফিসের পরে সে প্রায়শই মেসেজের অপেক্ষায় থাকে, আর রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা গড়ায়, কল্পনার ভিতর এক গোপন শহর তৈরি হয়—যেখানে শুভঙ্কর তার কবিতার লাইন গুলো পাঠায়, আর মেয়েটি তার প্রতিটি শব্দের ব্যাখ্যা করে, মাঝে মাঝে প্রশ্ন তোলে, আবার কখনো কেবল নীরব ভালোবাসা জানায়। একটা গভীরতা তৈরি হয়, যার মধ্যে শরীর নেই, আছে শুধু মন—ভাঙা মন, বৃষ্টি-ভেজা মন। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, মেয়েটি কখনও ভিডিও কল বা ফোনে কথা বলতে চায় না। শুভঙ্কর কিছুটা অবাক হলেও বুঝিয়ে নেয়—সবাই তো আর মুখ খুলে কথা বলতে পারে না, কেউ কেউ শুধু লেখায় বাঁচে। এদিকে নয়না, অফিসে প্রতিদিন শুভঙ্করের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, কিন্তু তার মুখে একটিও অতিরিক্ত শব্দ ফোটে না। শুভঙ্করের গম্ভীর মুখ, মাথা নিচু করে টাইপ করা, মাঝে মাঝে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা—সব সে দেখে, চুপচাপ। তার নিজের মনে প্রশ্ন ওঠে—এই কি সেই মানুষ যার সঙ্গে আমি রাতভর কথা বলি? যাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি? আর সে কি আমায় ভালোবাসে?
তবে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয় যখন এক সন্ধ্যায় শুভঙ্কর পেজে একটা নতুন কবিতা পোস্ট করে—”তুমি আসো মেঘের মতো, আর রেখে যাও বৃষ্টির লজ্জা… আমি জানি না তোমার মুখ, কিন্তু মনে রেখেছি তোমার প্রতিটি শব্দ।” সেই কবিতার কমেন্ট সেকশনে MeghBristi07 লেখে: “আর যদি বলি, আমি এই শহরের খুব কাছেই থাকি?” শুভঙ্করের বুক ধড়ফড় করে ওঠে। সে উত্তর দেয় না সোজাসুজি, বরং লিখে—”কাছে থাকো না দূরে, তাতে কিছু যায় আসে না… তুমি শব্দে আমার খুবই কাছে।” পরের দিন অফিসে নয়না গা ঢাকা দিয়ে থাকে, চোখে সানগ্লাস, বলার মতো কোনো শব্দ নেই, যেন গত রাতের কথা তারই ভিতর পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মন অন্য কিছুতে নেই, সে অফিসের কাজ ভুলে শুভঙ্করের প্রতিটি প্রতিক্রিয়া, প্রতিটি মেসেজের শব্দ বিশ্লেষণ করছে। অফিসের ক্যান্টিনে বসে শুভঙ্কর ফোন স্ক্রল করছে, নয়না দূর থেকে তাকিয়ে দেখে—মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। নয়না হঠাৎ অনুভব করে, এটা আর খেলাচ্ছলে শুরু হওয়া কিছু নয়—এ প্রেম তার অস্তিত্ব ছুঁয়ে ফেলেছে, আর এখন মুখোশ খুললে সেই অস্তিত্ব হয়তো টিকবে না। সে চুপ করে নিজের ডেস্কে ফিরে যায়, আর নিজের মনের মধ্যে দুটো আত্মা দেখে—একটা MeghBristi07, অন্যটা নয়না ধর।
শুভঙ্করের জীবনে বহুদিন পর এমন অনুভব আসে—কাউকে সে ভরসা করতে পারছে, কাউকে সে ‘আমি’ দিয়ে ভাবতে পারছে। কলেজের প্রেমিকা নন্দিনীর চলে যাওয়ার পর সে নিজেকে দেয়ালে তুলে রেখেছিল। কিন্তু এই মেয়েটি, যার কোনো মুখ নেই, কোনো শরীর নেই, কেবল শব্দ আছে—সে শুভঙ্করের মধ্যে সেই দেয়ালকে ভেঙে ফেলছে আস্তে আস্তে। সে কল্পনা করতে শুরু করে, মেয়েটি কেমন দেখতে হতে পারে, তার কণ্ঠস্বর কেমন, তার চোখে কি জল আছে, সে কি বাস্তবেও শুভঙ্করকে ভালোবাসতে পারবে? আর ঠিক এই জায়গাতেই সাসপেন্স জন্ম নেয়—কারণ শুভঙ্কর জানে না, মেয়েটি প্রতিদিনই তার পাশেই বসে থাকে, প্রতিদিন তার দিকে তাকায়, প্রতিদিন তার সঙ্গে নীরবভাবে কাজ করে। একদিন রাতে শুভঙ্কর হঠাৎ MeghBristi07-কে লেখে, “তুমি যদি আমার চোখের সামনে থেকো, তবুও আমি তোমাকে চিনতে পারব না—তুমি কি কখনও মুখ দেখাবে?” মেসেজটা দেখেই নয়নার হাত কাঁপে। সে জানে, এই মুহূর্তটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে লিখে—“মুখ নয়, মনটাই তো বেশি সত্যি।” শুভঙ্কর চুপ করে যায়, কিন্তু তার ভেতরটা শূন্য হয়ে পড়ে। সত্যিই কি এই সম্পর্ক কেবল শব্দে টিকে থাকবে? না কি সে একদিন মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে এই সম্পর্কের সামনে? নয়না বুঝে যায়, সময় খুব কাছে চলে এসেছে—যদি মুখোশ খুলতে হয়, সেটা এখনই, নাহলে সবকিছু হারিয়ে যাবে। কিন্তু সেই সাহস যেন তার নিজের কাছেই নেই। আর তাই, সম্পর্কটা এগোতে থাকে—ভালোবাসা আর মিথ্যার এক আশ্চর্য দোলনায় দুলতে দুলতে।
তিন
নয়নার ভেতরে একটা যুদ্ধ প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হচ্ছিল, একদিকে ছিল MeghBristi07-এর গভীর সম্পর্ক—যেটা সে নিজেই সৃষ্টি করেছে, আর অন্যদিকে ছিল শুভঙ্কর, যে তার সামনে বাস্তব মানুষ, অথচ চিনছে না তাকে। সে প্রতিদিন সকালে অফিসে ঢুকে শুভঙ্করের দিকে তাকায়, তার চোখে কোনও ভেজা সন্ধ্যার চিহ্ন খোঁজে, কিংবা আগের রাতের কথোপকথনের ছাপ। অথচ শুভঙ্কর এমনভাবে ডেস্কে মাথা নামিয়ে কাজ করে, যেন নয়না নামের কেউ তার জীবনে অস্তিত্বই রাখে না। তবুও নয়না হাল ছাড়ে না, কারণ তার মনে একটা ভয়ংকর বিশ্বাস জন্মেছে—যদি মুখোশ খুলে দেয়, শুভঙ্কর তাকে হয়তো আর গ্রহণ করবে না। সে ভাবতে থাকে, MeghBristi07 যে আবেগ, যে কাব্যিকতা, যে মায়া নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে, নয়না কি সেই মাত্রার? বাস্তব জীবনে তো সে এতটাও নরম নয়, বরং মেজাজি, কম কথা বলা, কাজপাগল এক নারী। এই দ্বৈততা তাকে পুড়িয়ে দেয় প্রতিদিন। একদিন অফিসের লাঞ্চ আওয়ারে সে দেখে, শুভঙ্কর একা বসে জানালার ধারে একটা কবিতার লাইন টাইপ করছে, হয়তো পেজে পোস্ট করার জন্য। নয়না দূর থেকে শুধু তার আঙুলের নড়াচড়া দেখে বোঝে, আজ কিছু একটা লিখছে সে, যার মধ্যে প্রচণ্ড আবেগ আছে। ঠিক তখনই তার ফোনে আসে শুভঙ্করের মেসেজ—“তুমি কি জানো, তোমার শব্দগুলোই আমাকে আবার বাঁচতে শিখিয়েছে?” নয়না চোখ বন্ধ করে ফোনটা বুকের কাছে টেনে ধরে।
সেই রাতেও কথোপকথন চলে গভীর রাত পর্যন্ত। শুভঙ্কর মেসেজে লিখে—“আমার একটা স্বপ্ন আছে। একদিন আমি একটা ক্যাফেতে বসে থাকব, বাইরে বৃষ্টি পড়বে, আর তুমি এসে আমার সামনে বসে বলবে, ‘তোমার কবিতাগুলোর মাঝে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি’। আমি তোমার চোখে চোখ রেখে বলব, ‘তোমাকে চিনতাম অনেক আগে থেকেই’।” নয়নার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে যায়, কিন্তু সে কিছু লেখে না প্রথমে। অনেকক্ষণ পর, কেবল একটি লাইন টাইপ করে পাঠায়—“আমিও তো চাই, একদিন তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো, তুমি আমায় ভালোবাসো, নাম বা চেহারা দেখে নয়—শুধু মনে রেখো আমাকে।” সেই মেসেজটা পাঠানোর পর নয়না ফোন বন্ধ করে দেয়, আর বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। সকাল পর্যন্ত সে জানে না, শুভঙ্কর কী উত্তর দিল। পরদিন অফিসে গিয়ে তার চোখ যায় ডেস্কের ওপর রাখা নোটবুকটার দিকে, যেখানে শুভঙ্কর তার কবিতার লাইনগুলো লেখে। নয়না দেখে, একটা পাতায় লেখা—“মুখ নয়, মনেরই ছবি আঁকি এখন, কারণ মুখে ভুল থাকে, মনে থাকে সত্য।” নয়নার গলা শুকিয়ে যায়। সে অনুভব করে, এখন যদি মুখোশ না খোলে, তাহলে সেই সত্যটাই একদিন হারিয়ে যাবে। অথচ ভয় তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না—ভয়টা এখন সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার নয়, বরং সেই বন্ধুত্ব, সেই নির্ভরতা, সেই রাতের কথাগুলো হারিয়ে যাওয়ার।
নয়না এখন একপ্রকার ছায়া হয়ে উঠেছে—অফিসে সে যান্ত্রিক, ফোনে সে কবিতা। শুভঙ্কর যেমন ওর কথা শুনে ভরসা করে নিজের সমস্ত দুঃখ শেয়ার করছে, নয়না তেমনই নিজের বাস্তবতাকে লুকিয়ে রেখে এক কল্পনার জগতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। তার প্রতিটি দিন, প্রতিটি সন্ধ্যা এমন একটা চক্রের মধ্যে আটকে গেছে, যেখানে সে নিজেকেই ভুলে যাচ্ছে। তার আর ভালো লাগে না নিজের মুখ, নিজের নাম, এমনকি আয়নার সামনে দাঁড়াতেও ভয় করে এখন। কারণ সে জানে, শুভঙ্কর যাকে ভালোবেসেছে, সেই মানুষটা বাস্তবে তার চেয়েও বেশি স্বপ্নে তৈরি। এই ভার্চুয়াল প্রেম ধীরে ধীরে তার নিজের আত্মপরিচয়কে মুছে দিচ্ছে। একদিন সোহিনী, শুভঙ্করের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, কফি খেতে খেতে নয়নার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার মুখটা একটু যেন চিনতে পারছি… তুমি কি কখনও কবিতা লেখো?” নয়না চমকে যায়, তার ভেতরটা যেন থেমে যায় এক মুহূর্তে। সে কেবল মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, আমি শুধু শব্দ ভালোবাসি।” সোহিনী হয়তো ব্যাপারটা বোঝে না, কিন্তু নয়না বুঝে যায়, তার ছদ্মনামের জগত আর বাস্তব জগতের মধ্যে দূরত্ব প্রতিদিন কমছে, আর সেই সংঘর্ষ খুব শীঘ্রই ঘটতে চলেছে। এখন প্রশ্ন একটাই—মুখোশ খুলবে, না আরও গভীরে ডুবে যাবে এই মিথ্যার প্রেমে?
চার
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই শহরের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছিল, আর মায়ার মনও যেন নিঃশব্দে এক অনামা আশঙ্কায় ভরে উঠছিল। ক্লাসের পর রুটিনমাফিক লাইব্রেরিতে বসার কথা থাকলেও আজ সে কিছুতেই মন বসাতে পারল না। এক ধরনের আকর্ষণ, এক রহস্যময় টান তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সেই পুরনো প্রাসাদের দিকে, যেখানে সে প্রথমবার দেখা পেয়েছিল মুখোশপরা সেই অচেনা ছেলেটির। শহরের গলিপথ পেরিয়ে যখন সে প্রাসাদের সামনে পৌঁছল, সূর্য তখন দিগন্তরেখায় লাল টিপ এঁকে বিদায় নিচ্ছে। প্রাসাদের দরজাটা আজ খোলা ছিল, যেন কেউ তার জন্যই অপেক্ষায়। মায়ার পা যেন নিজে থেকেই এগিয়ে গেল। নিঃশব্দ ধাপে সে প্রবেশ করল অন্দরমহলে। সবকিছু আগের মতোই, শুধু বাতাসে আজ একটু বেশি সুগন্ধ—চন্দনের মতো, অদ্ভুতভাবে আশ্বস্তকারী। আচমকা এক ছায়া তার পেছনে এসে দাঁড়াল। মায়া ঘুরে তাকাল—সেই মুখোশ, সেই চোখ, সেই গভীরতা। কেউ একজন নিঃশব্দে বলে উঠল, “তুমি এসেছো… জানতাম!” মায়া কিছু বলল না, শুধু তাকিয়ে রইল। চোখে চোখ রেখে থাকা সেই নিরবতা ভেঙে দিয়ে, ছেলেটি আবার বলল, “তুমি কি জানো, আমি প্রতিদিন এই জায়গায় এসে বসি? শুধু এই আশায়, যদি কখনও তুমি ফিরে আসো…”
একটা অদৃশ্য আবরণ যেন খুলে যাচ্ছিল মায়ার ভেতর থেকে। ছেলেটির কণ্ঠে ছিল এমন এক বিষণ্ণতা, যা কেবল চেনা মানুষই বুঝতে পারে। “তুমি কে?” মায়া অবশেষে জিজ্ঞেস করল। ছেলেটি ধীরে মুখোশটা খুলল, কিন্তু আলো এত কম ছিল যে তার চেহারা তখনও আবছা থেকে গেল। সে বলল, “আমি সে, যে ভালোবাসে… ভালোবাসে এমন কাউকে, যাকে সে কখনও ছুঁতে পারে না।” মায়ার কণ্ঠ জড়িয়ে এল, “আমাকে তুমি চেনো?” ছেলেটি হেসে বলল, “চিনি… তোমার ছায়া পড়েছিল একদিন আমার মনপটে… তারপর থেকে আমি শুধু ছায়ার পেছনে ছুটেছি।” মায়ার মনে পড়ে গেল সেই স্বপ্নের কথা—যেখানে এক অচেনা মুখ তাকে ডাকছিল। সবকিছু যেন ধীরে ধীরে গাঁথা হতে লাগল এক অলৌকিক জালে। ছেলেটি বলল, “তুমি কি জানো, এই প্রাসাদ এক সময় প্রেমিকদের সাক্ষাৎস্থল ছিল? মুখোশপরা রাজপুত্র এখানে অপেক্ষা করত তার ভালোবাসার জন্য… আর সেই গল্পটাই আমার জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।” মায়া যেন আবিষ্টের মতো শুনে যাচ্ছিল সবকিছু। তাদের মাঝখানে তখন আর কোনও ভয় ছিল না, কেবল ছিল এক গভীর টান—অদৃশ্য এক ছন্দ, যা প্রেমের থেকেও বেশি কিছু।
হঠাৎ এক ঝাপটা বাতাস জানালার পর্দা উড়িয়ে নিয়ে গেল, আর আলোটা নিভে গেল প্রায়। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মায়া অনুভব করল ছেলেটির হাত তার হাতে। “তুমি কি মুখোশ সরিয়ে আমাকে সত্যি দেখতে চাও?”—এই প্রশ্নে সে শুধু মাথা নাড়ল। ঠিক তখন, হালকা চাঁদের আলোয় ছেলেটির মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠল। একটা গভীর দাগ ছিল মুখের একপাশে, যা সমাজের চোখে তাকে ‘অপূর্ণ’ বানিয়েছে, কিন্তু মায়ার চোখে ছিল সেটাই সবচেয়ে নিখুঁত। মায়া ধীরে এগিয়ে এল, তার কপালে একটি আলতো চুম্বন রাখল। এই প্রথম মায়া বুঝতে পারল, ভালোবাসা আসলে মুখোশের ওপারে নয়, তার ভেতরেই বাস করে। ছেলেটি বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল, “তুমি তো ভয় পাওনি?” মায়া হাসল, “ভালোবাসা যদি মুখোশে লুকিয়ে থাকে, তবে আমি সেই মুখোশকেই ভালোবাসি।” বাইরে তখন শুরু হয়েছে হালকা বৃষ্টি। ছায়ার চুম্বন আর বৃষ্টির ছোঁয়ায় গলে যাচ্ছিল সব দূরত্ব, সব প্রশ্ন। সেই পুরনো প্রাসাদের ভিতর জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন প্রেম—যা মুখোশের নয়, বরং আত্মার।
পাঁচ
শহরের ঘন নীরবতায় এক ধোঁয়াটে সন্ধ্যা নামছে। পুরোনো উত্তর কলকাতার অলিগলিতে হালকা গা-ছমছমে বাতাস, রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টে ফড়িংয়ের মতো লেগে আছে কিছু রক্তচক্ষু স্মৃতি। গৌরব ওই পুরোনো মুখোশটা হাতে নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল এক অন্যরকম দোলাচলে—সে কি প্রেমে পড়েছে নাকি শুধুই মোহে, সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। অথচ প্রতিটি সন্ধ্যা, যখনই ও মুখোশ পরে বাইরে বেরোয়, যেন রক্তমাখা রহস্য এসে ওর গায়ে লেগে যায়। একটা অদ্ভুত শিহরণ, একটা অসম্পূর্ণতা, আর সেই মুখোশের পেছনের সেই মেয়ে—যার চোখ জ্বলে ওঠে রোদ পড়ার সময়। নাম জানে না, ঠিকানা জানে না, এমনকি মুখটাও জানে না, অথচ তার প্রেমে পড়ে গেছে—এটাই কি বাস্তব? সেই রাতে আবার সে বেরোল মুখোশ পরে, ডানহাতের তালুতে টানা তিনদিনের লুকোনো চিঠি, যা সে দিতে চায় মেয়েটিকে—যদি আবার দেখা হয়। কিন্তু যেদিকে সে গেল, গলির শেষপ্রান্তে একটা হালকা নীল আলো, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেই মুখোশধারী, যার চোখে এক অসম্ভব প্রশান্তি। গৌরব বুকের ভিতরটা ধুকধুক করতে করতে এগিয়ে গেল, চিঠিটা এগিয়ে দিতেই সে মেয়েটা হঠাৎ কেঁপে উঠল, পেছনে এক পা পিছিয়ে গেল—তুমি কেন আমাকে খুঁজছো? তুমি জানো না তুমি কী নিয়ে খেলছো?
হঠাৎই শহরের নিঃশব্দ আকাশে বাজ পড়ার মতো সাউন্ড হল, অদৃশ্য এক বিকট আওয়াজ। মেয়েটা মুখোশ খুলে না দেখিয়ে বলল, “তুমি জানো এই মুখোশটা আসলে কী?” গৌরব চমকে গেল। সে বলল, “আমি জানি না, কিন্তু আমি জানি আমি এটা পরলে আমি অন্য একজন হয়ে যাই, যে তোমার প্রেমে পড়ে যায়।” মেয়েটি গভীরভাবে তাকাল, এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ঝরল তার চোখে—“এই মুখোশ তোমায় শুধু আমার কাছে নিয়ে আসেনি, এটা তোমার চেতনার পেছনে ঘুমিয়ে থাকা এক প্রাচীন সত্যকে জাগিয়ে তুলেছে। এই মুখোশ এক সাধকের ছিল, যে প্রেম আর আত্মত্যাগের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। তারই শক্তি আজ তোমার ভিতর কাজ করছে।” গৌরব যেন থেমে গেল, চেতনার আড়ালে কোনো অতীতস্মৃতি নাড়া দিল। সে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমি কি আগে ওকেই চিনি?” মেয়েটি মাথা নিচু করে বলল, “হয়তো, কোনো এক জন্মে তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে, আর আমি… তোমাকে ফাঁকি দিয়েছিলাম। এই মুখোশ আমার সাজা, আর তোমার প্রাপ্তি।” গৌরবের বুক ফেটে কান্না আসতে লাগল, অথচ সে জানে না কেন। শুধু বোঝে, এই মেয়েটিকে সে কোনো জন্মে হারিয়েছিল—এ জন্মে আবার পাওয়ার স্বপ্নে ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই আশপাশের আলো নিভে গেল, নীল আলোটা বেড়ে উঠল তীব্র হয়ে, আর মেয়েটি বলল, “তুমি চাও আমি তোমার সঙ্গে থাকি? তবে মুখোশটা ছিঁড়ে ফেলো। তবেই তুমি জানবে এটা প্রেম নাকি প্রতারণা।” গৌরব দ্বিধায় পড়ে গেল। যদি সত্যিই সে শুধু মুখোশের ছায়ায় প্রেমে পড়ে থাকে? যদি মেয়েটা আদৌ বাস্তব না হয়?
তবু সে ধীরে ধীরে মুখোশটা খুলে ফেলল, নিজের সমস্ত স্মৃতি, ভয়, প্রেম একপাশে রেখে। ঠিক তখনই বাতাস কেঁপে উঠল, সময় যেন জমাট বাঁধল। মেয়েটি আর সামনে নেই—শুধু একটি কাগজ উড়ে এল গৌরবের পায়ে পড়ে। সেখানে লেখা ছিল, “তোমার ভালবাসা সত্য ছিল, মুখোশ নয়।” গৌরব ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, হাতে মুখোশ, সামনে শূন্যতা, আর মনের ভিতর এক ঘূর্ণিপাক আবেগ—সে কি কাউকে খুঁজে পেল, নাকি হারাল? দূরে একটা শঙ্খধ্বনি ভেসে এলো, জানালো—এই প্রেম মুখোশের ছিল না, এটি চিরন্তন, সময়ের প্রাচীনতম আত্মার প্রেম। বাতাসে একটা গন্ধ, বেলফুলের মতো—মেয়েটির প্রিয় গন্ধ—যেটা এখন গৌরবের চেতনাতেই গেঁথে গেল।
ছয়
শান্তিনিকেতনের আকাশ সেদিন ভারী ছিল—দিগন্তজোড়া মেঘে ঢাকা আকাশ যেন কোনও গোপন বার্তা লুকিয়ে রেখেছে। রুদ্রর মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা; যেন কী আসছে, সে নিজেও জানে না ঠিক কী, তবে সেটা যে ভাল কিছু নয়, এই বিশ্বাস গভীরভাবে তার ভেতর চেপে বসেছে। রাত্রির আকাশে সাদা সাদা বক উড়ছিল, আর দূরে কোনো সাঁওতাল বস্তিতে মাদলের শব্দ ভেসে আসছিল ঝাপসা হাওয়ার সঙ্গে। রুদ্রর স্টুডিওর আলো জ্বলছিল—একলা বসে সে মুখোশ তৈরি করছিল, এক নতুন ধরণের মুখোশ, যার চোখে ছিল রহস্য, আর ঠোঁটে অল্প হাসি। ঠিক এমন মুখোশ সে আগে কখনও বানায়নি। তার মনে পড়ছিল, কৌশানীর মুখের অবয়ব, তার চোখের গভীরতা, আর সেই হাসি—যেটা কিছুই বলে না, কিন্তু অনেক কিছু বোঝায়। হঠাৎ করেই তার কাঁধে কারও হালকা ছোঁয়া, আর ঘুরে দেখল—কৌশানী। শান্ত গলায় বলল, “তোমার মুখোশ আজ অনেকটা জীবন্ত লাগছে।” রুদ্র চমকে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না। কৌশানী একটু থেমে বলল, “তোমার কি মনে হয়, আমরা আসল মুখে ভালোবাসতে পারি না বলেই মুখোশ পরে থাকি?” কথাটার মধ্যে যেন এক তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ ছিল। রুদ্র মাথা নিচু করে বলল, “মুখোশ না থাকলে আমরা সাহস পাই না, কৌশানী। সবাই ভয় পায় নিজেকে খুলে দিতে।” সে কিছুটা রাগ, কিছুটা হতাশা নিয়ে জবাব দিল, “তুমি সাহসী ছিলে রুদ্র। কিন্তু এখন তুমি শুধু একজন শিল্পী—যার শিল্পে প্রেম আছে, জীবন নেই।”
রুদ্র কিছু বলল না, তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কৌশানী বলল, “আমি কাল ফিরে যাচ্ছি কলকাতায়। এই শান্ত, রঙিন মিথ্যে আমাকে টানে না আর। আমি আসল শহরের কোলাহল, অসংলগ্নতা, আর রক্তমাংসের জীবন চাই।” রুদ্র উঠে দাঁড়াল, চোখে কুয়াশার মতো ছায়া, বলল, “তুমি যা খুঁজছো, কৌশানী, তা আমি দিতে পারি না—এই রঙ, এই মুখোশ, এই নিঃশব্দ প্রেম—এগুলোই আমার জগৎ।” কৌশানী কিছু বলল না। দুজনের মাঝে শীতল হাওয়া বইছিল, যেন এক অন্তিম শ্বাস। হঠাৎ করে রুদ্র একটা চাবি বাড়িয়ে বলল, “স্টুডিওর পেছনে একটা ঘর আছে—যেখানে আমার সবচেয়ে ব্যক্তিগত কাজগুলো থাকে। যাও, দেখো, তুমি যা জানতে চাও।” কৌশানী চুপচাপ চাবি নিল, কিছুক্ষণ পর একা একা স্টুডিওর ভেতরের পেছনের দরজায় ঢুকল। ঘরের মধ্যে অগণিত মুখোশ, প্রতিটি যেন জীবন্ত মুখের মতো। হঠাৎ তার চোখ পড়ল একটা ছোট কাঠের বাক্সে—তাতে জমানো চিঠি, কিছু পুরনো ছবি আর একটি মুখোশ—এক মেয়ের মুখ। সে বুঝল, এটা তার নিজের মুখোশ—হুবহু তার মুখের মতো, চোখ, ঠোঁট, কপালের ভাঁজ—সব। এক মুহূর্তে তার শরীর কেঁপে উঠল, যেন কেউ তার গভীর গোপনতাকে ফাঁস করে দিয়েছে। সে হঠাৎ বুঝল, রুদ্র তাকে ভালোবাসে, তার মুখই সে বহু বছর ধরে আঁকছে। কিন্তু এই ভালোবাসা কখনো প্রকাশ পায়নি। এই মুখোশ ছিল একান্ত রুদ্রর স্বপ্নের, নীরব আর্তির বহিঃপ্রকাশ।
রাত্রি তখন গভীরতর। কৌশানী ফিরে এল, মুখে অস্পষ্ট অভিব্যক্তি। সে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ—তার চোখে প্রথমবার জল। তারপর বলল, “তুমি যদি আগে বলতে… আমি থাকতাম, রুদ্র। আমি চেয়েছিলাম কেউ আমাকে এইভাবে ভালোবাসুক, আমার রূপে নয়, আমার অস্তিত্বে।” রুদ্র একটু হাসল, বিষাদ মেশানো সেই হাসি, বলল, “ভালোবাসা মুখে বললেই তো আর ভালোবাসা হয় না, কৌশানী। আমি জানি, আমার প্রেম মুখোশেই বন্দি ছিল—তোমার সামনে কখনও সে মুখ খুলতে পারিনি।” কৌশানী এগিয়ে এসে রুদ্রর হাতে মুখোশটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এই মুখোশের মধ্যে যদি সত্যি প্রেম থাকে, তবে সেটা ফেলে দিও না। আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু একদিন যদি সাহস হয়, এসো আমার শহরে, আমার মুখোমুখি দাঁড়াতে।” সে ফিরে গেল। রুদ্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ, আর তারপর মুখোশটা হাতে নিয়ে জানলার পাশে বসে পড়ল। জানালার ওপার দিয়ে হাওয়া বইছিল, পাতা কাঁপছিল, আর অদূরে মাদলের ছন্দে মিশে যাচ্ছিল তার হৃদয়ের স্পন্দন। মুখোশটা সে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল। সেই মুহূর্তে, হয়তো কৌশানী গাড়িতে উঠে দূরে চলে যাচ্ছে, কিংবা রুদ্রর স্টুডিওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে শেষবারের মতো। হয়তো প্রেম এখানেই শেষ নয়—শুধু রঙ বদলেছে। হয়তো সামনে একটা ঝড় আসছে—কিন্তু তার আগে এই নিস্তব্ধতাও তো এক ধরনের গল্প।
সাত
পূজোর শেষদিনে, বিসর্জনের আগের মুহূর্তে চারদিক যেন অন্য এক আবেশে মোড়া থাকে। সিঁদুরখেলায় মুখ রাঙিয়ে হাসিতে ফেটে পড়া মেয়েদের ভিড়, ঢাকের তাল, কাশের ধোঁয়া—সব মিলে শহরের বাতাস হয়ে ওঠে বিদায়ের গন্ধমাখা। সেই মুহূর্তে শোভনের হৃদয়জুড়ে চলছিল অন্যরকম বিসর্জন। রূপার সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর প্রতিটি স্মৃতি যেন তার শরীরের প্রতিটি কোষে বাজছিল। রূপা, যাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে অবলীলায়, সেই রূপার পরিচয় আজও এক অপার রহস্য। এতদিনে একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে এলেও রূপা নিজের অতীত সম্পর্কে কোনোদিনই কিছু বলেনি। এমনকি তার মুখোশের নীচে থাকা বেদনার কথাও নয়। কিন্তু আজ, এই বিসর্জনের আগে, রূপা হঠাৎ করে বলেছিল, “চলো, তোমায় আমার একটা জায়গা দেখাই।” শোভন কোনো প্রশ্ন না করে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। তারা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় গঙ্গার ধারে এক নির্জন ঘাটে, যেখানে খুব কম মানুষ আসে। সেই ঘাটে এসে রূপা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তার চোখ যেন অতীতের দিকেই স্থির। তারপর সে ধীরে ধীরে মুখ খুলে বলে, “তুমি কি জানো, আমি এই ঘাটেই প্রথম মুখোশ পরেছিলাম?” শোভন অবাক হয়, প্রশ্ন করে না, শুধু তাকিয়ে থাকে।
রূপা বলতে থাকে, তার কণ্ঠস্বর যেন ছায়ায় ঢাকা — “তিন বছর আগে এই ঘাটেই আমার জীবনের সবকিছু বদলে গিয়েছিল। আমি এক সময় থিয়েটারে অভিনয় করতাম। তখন আমার স্বপ্ন ছিল একদিন বড় মঞ্চে নামবো, নিজের পরিচয়ে বাঁচবো। কিন্তু… এক রাতে সেই স্বপ্ন ধুলো হয়ে গেল। আমার প্রাক্তন প্রেমিক, অরিত্র, যে কিনা আমার সঙ্গেই অভিনয় করত, তার ঈর্ষা আর সন্দেহ আমাকে শেষ করে দিল। আমাকে ভুল বোঝানো, অপমান করা, হেনস্থা করা—সব শুরু হলো এক এক করে। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম, থিয়েটার ছাড়ার হুমকিও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে সে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে। এক রাতে রিহার্সালের পরে সে আমার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে দেয়।” শোভনের বুক ধক করে ওঠে, সে যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। রূপার গলা তখন আরও গম্ভীর, আরও শান্ত — “তিন মাস হাসপাতালে ছিলাম। মুখটা… আয়নায় নিজেকে চিনতেই পারিনি। আমার চারপাশে যে বন্ধুরা ছিল, তারা একে একে সবাই দূরে সরে গিয়েছিল। এমনকি থিয়েটার গ্রুপও বলে দেয়, আমার ‘অভিনয়-উপযোগী’ মুখ আর নেই। তারপর আমি মুখোশ পরে বেরোতে শুরু করি। প্রথমে লুকোবার জন্য, পরে অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য। আমি মুখোশে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম — সেই রূপা, যে আর কারো কাছে করুণা চায় না, শুধু নিজের শক্তিতে বাঁচতে চায়।”
শোভন তখন নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে জল। সে এগিয়ে এসে রূপার হাত ধরে, আস্তে করে বলে, “তুমি জানো, আমি কখনই তোমার মুখোশকে ভালোবাসিনি। আমি ভালোবেসেছি তোমার ভেতরের মানুষটাকে, তোমার সাহসকে।” রূপা ধীরে ধীরে শোভনের দিকে তাকায়, মুখোশের ফাঁক দিয়ে তার চোখে ধরা পড়ে এক ফোঁটা জল। সে বলে, “কিন্তু আমি আজও ভয় পাই, যদি তুমি আমাকে দেখে পালিয়ে যাও?” শোভন মৃদু হেসে বলে, “তোমার চোখ আমি চিনেছি, তোমার ব্যথা আমি অনুভব করেছি। তুমি মুখোশ খুলে দেখাও বা না দেখাও, আমার ভালোবাসা বদলাবে না।” হঠাৎ করে রূপা ব্যাগ থেকে এক খোলা চিঠি বের করে শোভনের হাতে দেয়। “এটা আমার শেষ চিঠি। যদি তুমি চাও, আমি আর মুখোশ পরে থাকব না। কিন্তু যদি তুমি চাও আমি দূরে সরে যাই, তাও পারব। শুধু আজকের বিসর্জনের আগেই উত্তর দিও।” এরপর সে আস্তে করে ঘাট ছেড়ে চলে যায়, রেখে যায় নিঃশব্দ ঢেউ আর এক মর্মন্তুদ স্নিগ্ধতা। শোভন চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে, তার ভেতর তখন বিসর্জনের আগুন জ্বলছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটি রাস্তা—একটা রূপার অতীতভরা জীবনের পাশে দাঁড়ানোর, আরেকটা সেই মুখোশের প্রেমকে স্রেফ স্মৃতি করে রাখার। সে জানে, তার উত্তর শুধু একটি জীবন বদলাবে না, এক পূজার প্রণয়ও বাঁচাবে।
আট
রুদ্রর মনভরা আশঙ্কা নিয়ে, রাত্রি গভীরতর হয়ে উঠছিল। অরণ্যের নির্জনতায় মাধবীলতা আর রুদ্র একসাথে হাঁটছিল, যেন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ নিঃশব্দে মিলিয়ে গেছে তাদের চারপাশ থেকে। আকাশে চাঁদ উঠেছে—ভাঙা ভাঙা মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে তার বিবর্ণ আলো। রুদ্রর মনে হচ্ছিল, আজকের রাত যেন কোনো এক অদ্ভুত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য অপেক্ষা করছে। মাধবীলতার চোখে এক অনবদ্য শান্তি—এক ধরনের ধৈর্য্য, যা একমাত্র বহুকালের অভিজ্ঞতা থেকেই আসে। হঠাৎ সে থেমে গেল, একটি শুকনো গাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কখনো ভাবো নি, কেন আমি তোমার দিকে এতটা আকৃষ্ট?” রুদ্র কিছু বলল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল তার পাশে। মাধবীলতা কাঁধ থেকে তার ছোট্ট ব্যাগটি নামিয়ে ভিতর থেকে একটা পুরনো চিঠির মতো কিছু বার করল। সেটি রুদ্রর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা পড়ো। কিন্তু পড়ার আগে প্রতিশ্রুতি দাও, তুমি কিছুতেই ভয় পাবে না।” রুদ্র ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। চিঠিটি খুলতেই চোখে পড়ল কয়েকটি অদ্ভুত প্রতীক—তন্ত্রমন্ত্রের মতো, আর তার নিচে একটি নাম—‘অমর মুখার্জী’। সেই নামটি যেন রুদ্রর মস্তিষ্কে বাজ পড়ার মতো আঘাত হানল। এ নাম সে বহু আগে শুনেছিল—মা’র পুরনো ডায়েরিতে লেখা ছিল এই নাম, এক প্রাচীন প্রেমের চিহ্ন, যার কথা তার মা কখনো প্রকাশ্যে বলেননি।
চিঠির বাক্যগুলো ধীরে ধীরে তার সামনে এক অন্য জগৎ উন্মোচিত করছিল। লেখা ছিল, “তোমার প্রেম কোনো সাধারণ মানব-মানবীর গল্প নয়, এটা সেই প্রাচীন দণ্ডিত আত্মার মুক্তির লিপি।” এরপর কিছু সংকেত ছিল, এক অলৌকিক মন্ত্র, এক মৃত আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের নিয়ম। রুদ্রর ঠোঁট শুকিয়ে গেল। সে মাধবীলতার দিকে তাকাল, যার চোখে তখনও সেই রহস্যময় প্রশান্তি। মাধবীলতা ধীরে ধীরে বলল, “রুদ্র, আমার আসল নাম মাধবীলতা নয়। আমি সেই চিঠির লেখক অমর মুখার্জীর মেয়ের রূপে জন্ম নিয়েছিলাম, কিন্তু আমার আত্মা আজও আটকে আছে সেই এক জন্মের মধ্যেই। আমি সেই নারীর পুনর্জন্ম—যাকে তোমার পূর্বপুরুষ এক অভিশপ্ত প্রেমে ফেলেছিল। আমি মুখোশ পরেছি, কারণ এই পৃথিবী আমার মুখ চিনলে ভয় পাবে, যেমন পেত তোমার মা। তুমি জানো না, কিন্তু তোমার মা আর আমি এক সময়ে একই মানুষকে ভালোবেসেছিলাম—অমর। তিনি তখনও জানতেন না, প্রেম যদি আত্মাকে জয় না করতে পারে, তবে সে শুধু শরীরের খেলা হয়। আমার প্রেম ছিল আত্মিক, আর তোমার মা’র ছিল পার্থিব। ফলস্বরূপ, আমি এক রাতে এই অরণ্যেই আত্মহত্যা করি, আর তখনই জন্ম হয় মুখোশের অভিশাপের। আমি ফিরে এসেছি, এই জন্মে আবার সেই প্রেম খুঁজতে।” রুদ্রর বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। তার শরীর কাঁপছিল, আর সে বুঝতে পারছিল না, নিজের প্রেমিকা, যার জন্য সে সমস্ত কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল, সে কি আসলে এক অতৃপ্ত আত্মা?
সন্ধ্যা পেরিয়ে মধ্যরাত। অরণ্য যেন নিঃস্ব শব্দে কথা বলছে। হঠাৎ সেই মুখোশ—যা মাধবীলতার সাথে প্রথম সাক্ষাতের স্মারক, সেটি সে নিজেই খুলে ফেলল। আর রুদ্র দেখল, এক অপার্থিব সুন্দর মুখ—কিন্তু তার চোখদুটি যেন হাজার বছরের ক্লান্তি আর এক অতলান্ত শূন্যতা ধারণ করে। মাধবীলতা বলল, “তুমি যদি আমায় সত্যি ভালোবাসো, তবে আমাকে মুক্ত করো এই জন্ম-চক্র থেকে। আমার আত্মা চায় না আর ফিরে আসতে। এই প্রেম, যা মুখোশের আড়ালে শুরু হয়েছিল, তাকে সত্য করে তুলো এই শেষ চুম্বনে।” রুদ্র এগিয়ে গেল, হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। তাদের ঠোঁট যখন মিলল, তখন এক বিশাল কাঁপুনি উঠল মাটি জুড়ে। পাখিরা চিৎকার করে উঠল অরণ্যের গাছে গাছে। রুদ্র বুঝল, এই চুম্বন কোনো মানবিক অনুভূতি নয়—এ এক অনন্ত মুক্তির পথ। পরম মুহূর্তে, মাধবীলতার দেহ নিঃশব্দে ধুলো হয়ে গেল, আর তার মুখোশটা রুদ্রর হাতে থেকে গেল—এক টুকরো কাল, এক টুকরো প্রেম, এক অভিশপ্ত ইতিহাসের একমাত্র সাক্ষী।
নয়
সন্ধ্যার নরম আলোয় ভিজে যাচ্ছিল দক্ষিণ কলকাতার গলি। আকাশ যেন তার সমস্ত অভিমান ঝরিয়ে দিচ্ছে, আর সেই বৃষ্টির ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে ঋদ্ধি। তার পরনে আজ কোনও মুখোশ নেই, চোখে অশ্রু আর বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার। সে জানে, অনেক দেরি হয়ে গেছে। অথচ, আজ কথা ছিলো তিশার সঙ্গে দেখা করার, মুখোশহীন, সমস্ত সত্যি নিয়ে। কিন্তু তিশার ফোন বন্ধ, কোথাও নেই তার খোঁজ। গত পরশু থেকে তিশা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, ঋদ্ধির মনে সন্দেহ জেগেছিলো, হয়তো সে সব জেনে গেছে। কিন্তু কীভাবে? সে তো কাউকে বলেনি কিছু। তারপর কাল রাতে সেই অচেনা নম্বর থেকে এসেছিলো ছবি—ঋদ্ধির মুখোশ খুলে রাখা ছবি, তার বাবা-মায়ের অতীত, এমনকি কলেজ জীবনের সেই ছেলেটি, যার আত্মহত্যার দায় অজান্তেই ঋদ্ধির ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। সব যেন সাজিয়ে রাখা এক ফাঁদ। কে করছে এসব? কেন করছে? নিজের তন্ন তন্ন খুঁজেও সে খুঁজে পায়নি কোনও সূত্র। আজ, সে আর পালাতে চায় না। তিশাকে খুঁজে বার করতেই হবে। আজ সে সব সত্যি নিয়ে দাঁড়াতে চায়, হোক না ফল যা হয়।
কলেজ ক্যাম্পাসের কাছে পৌঁছাতেই ঋদ্ধির বুক ধুকপুক করতে থাকে। এক সময়কার সেই স্মৃতিমেদুর ক্যান্টিনের পাশে আজ দাঁড়িয়ে আছে সে—ভিজে এক টুকরো অতীত হয়ে। হঠাৎই একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে তার দিকে। মুখোশে ঢাকা, কিন্তু চোখ দুটো বড় চেনা। “তুমি তো ভয় পাবে,” কাঁপা গলায় বলে ওঠে ছায়ামূর্তিটা। ঋদ্ধি থমকে যায়। ছায়ামূর্তিটা মুখোশ খুলে ফেলে—তিশা। চোখে দুঃখের জল, মুখে অভিমান। “সব জেনেছি ঋদ্ধি,” বলে ওঠে সে, “তুমি কি জানো, মুখোশের প্রেম কতটা বিপজ্জনক?” ঋদ্ধি কিছু বলতে পারে না। তিশা ব্যাগ থেকে বের করে দেয় সেই ছবি, যে ছবিগুলো রাতের অন্ধকারে এসেছিলো অচেনা নম্বর থেকে। “তুমি এসব গোপন রাখতে চাইলে বুঝতাম, কিন্তু তুমি মুখোশের আড়ালে আমাকে ঠকাতে পারো না,” কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে তিশা। ঋদ্ধি এবার এগিয়ে এসে তিশার দুই হাত ধরে। “আমি ভয় পেয়েছিলাম তিশা, হারানোর ভয়। তাই গোপন করেছিলাম। কিন্তু আমার প্রেমটা তো সত্যি ছিল। আমি জানতাম না কে এগুলো পাঠাচ্ছে, তবে আমি জানি, এখন আর পালানোর সময় নেই।” তিশার চোখে তখন বিস্ময়ের ছায়া, আঘাতের চিহ্ন, আর এক অসমাপ্ত বিশ্বাস।
ঠিক তখনই গলির অন্যপ্রান্ত থেকে এক দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। কেউ দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টির ঘনছায়ায়। তারা তাকিয়ে দেখে, এক পরিচিত মুখ—অথচ ভুলে যাওয়া নাম। কলেজ জীবনের সেই অধ্যাপক, যিনি একসময় ঋদ্ধিকে অসম্মান করেছিলেন, এবং যাঁর ছেলেটির আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ঋদ্ধির নাম। সেই অধ্যাপক শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, “তোমরা ভাবো আমি ভুলে গেছি? আমার ছেলেকে কে নিয়ে খেলেছিলো সেই মুখোশের খেলা?” ঋদ্ধি শিউরে ওঠে, তিশা পিছিয়ে আসে। অধ্যাপক এক চিলতে হাসি হেসে বলে, “আমি এসব ছবি পাঠিয়েছি, ঋদ্ধি। আমি চেয়েছিলাম, তোমার মুখোশ খুলে দিই, যেমন আমার ছেলের মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়েছিলো তোমার কারণে। কিন্তু আজ তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে, তোমাদের ভালোবাসার মুখোশটা অন্তত সত্যি।” বলেই তিনি ফিরে যান ধীর পায়ে। ঋদ্ধি ও তিশা দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ, বৃষ্টির নিচে, মুখোশহীন, নগ্ন এক সত্যের মুখোমুখি। হয়তো এটাই প্রেম—যেখানে মুখোশ খুলে দাঁড়ানোর সাহস পাওয়া যায়, চরম ভয় নিয়েও।
দশ
সন্ধ্যের গোধূলিবেলায় কলকাতার গলি গুলো যেন একেকটা ছায়া-পাখির ডানা মেলে দেয়। রুদ্রর ঘরে আলো জ্বলছে না, শুধুমাত্র জানালার ফাঁক দিয়ে আসা শেষ সূর্যের আভা তার মুখে মুখোশের মতো ছায়া ফেলে রেখেছে। তার বুকের ভেতর কাঁপছে এক অদৃশ্য ভূমিকম্প। সে বুঝেছে, অনিন্দিতার মনে এখনো তার জন্য একটা জায়গা আছে—কিন্তু সেই ভালোবাসা বারবার আঘাত পায় রুদ্রর গোপন সত্যে, তার মুখোশে, তার অন্তহীন দ্বিধায়। সে জানে, যতদিন না সত্যিটা সে স্বীকার করছে, ততদিন ভালোবাসা আর বিশ্বাসের মাঝখানে এক অদৃশ্য দেয়াল থাকবে। কিন্তু মুখোশ খুলে দিলে, যদি অনিন্দিতা তাকে ছেড়ে চলে যায়? যদি সে আর কোনোদিন কথা না বলে? তবুও, আজ যেন একটা অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিচ্ছে সেই দিকেই। ঘরের কোণে রাখা সেই পুরনো কাঠের সিন্দুকটা খুলে রুদ্র একে একে বার করে তার আঁকা সেই মুখোশগুলো—প্রতিটি মুখোশই তার নিজের একেকটা রূপ, একেকটা অব্যক্ত কষ্ট। শেষের দিকের একটা মুখোশ সে হাতে নেয়—লাল-কালোর মিশেলে তৈরি এক অদ্ভুত প্রতিবিম্ব। এটাই সেই মুখোশ, যেটা পরে সে প্রথম অনিন্দিতার সামনে দাঁড়িয়েছিল, সেই প্রদর্শনীতে।
ওদিকে অনিন্দিতা এখন গিয়েছে ‘ছায়া’র সেই পুরনো স্টুডিওতে, যেটা আজকাল প্রায় বন্ধ। রুদ্রর অনুপস্থিতিতে তার মনে হয়েছে—সে যদি খুঁজে পায় রুদ্রর আঁকা সেই প্রাচীন স্কেচবুকটা, যদি কোনোক্রমে আঁচ করতে পারে রুদ্র আসলে কে ছিল, হয়তো সে নিজেই নিজের সন্দেহকে দূর করতে পারবে। কিন্তু স্টুডিওটা এখন আগাছায় ভরা, ধুলোর স্তর সব ছবি ঢেকে রেখেছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে একটা পরিত্যক্ত তাকের কোণে সে খুঁজে পেল সেই চেনা খাতা—স্কেচবুকটা। সে পাতা উল্টাতে থাকে—প্রথমে কিছু কিশোর বয়সের রূপবতী মুখ, তারপর কাঁচা হাতে আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি, তারপর একটা পাতায় থেমে যায়—অনিন্দিতার মুখ! তবু আঁকা নয়, বরং তার চোখ, তার চুল, তার অভিব্যক্তি—সবটা যেন ভালোবাসার আদরে আঁকা। নিচে লেখা—”এই মুখটাই আমাকে মুখোশ পরায়, আবার খোলাতেও শেখায়।” অনিন্দিতার চোখ ভিজে আসে। রুদ্র কখনো তাকে বলেনি এসব, কোনোদিন বুঝতেও দেয়নি। আরেকটু পেছনে উল্টাতেই, সে দেখে—রুদ্রর নিজের মুখোশহীন প্রতিকৃতি। না, কোনো মুখোশ নয়—একটা ক্লান্ত, গুটিয়ে থাকা ছেলেকে যেন আবিষ্কার করে অনিন্দিতা, যাকে মুখোশে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল নিজেকে। বাইরে বৃষ্টির শব্দ বাড়ছে। অনিন্দিতা জানে, আজই যেতে হবে রুদ্রর কাছে। আর নয়—না বোঝা, না জিজ্ঞাসা, না অপেক্ষা।
রুদ্রর দরজায় নক পড়তেই, সে ধাক্কা খায় বাস্তবতায়। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে সেই মেয়েটা—ভিজে চুল, কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ, চোখে ছায়া-ভেজা কোমলতা। অনিন্দিতা মুখ তুলে শুধু বলে, “আমার এখন সবটা জানার দরকার নেই। শুধু একটা কথা বলো—তুমি ভালোবাসো?” রুদ্র চুপ করে থাকে এক মুহূর্ত, তারপর ধীরে ধীরে তার মাথা নোয়ায়, মুখোশটা এগিয়ে দেয় অনিন্দিতার দিকে। সে ভাবে, এবার হয়তো চলে যাবে। কিন্তু অনিন্দিতা মুখোশটা হাতে নিয়ে হেসে বলে, “এই মুখোশটাই তো আমি ভালোবেসেছি রুদ্র। কিন্তু এখন সময় হয়েছে সেটা নামিয়ে দেওয়ার।” রুদ্র কাঁপা হাতে তার মুখের উপর থেকে ধীরে মুখোশটা সরিয়ে ফেলে দেয়। অনিন্দিতা প্রথমবার দেখছে তার চেনা রুদ্রকে—ভয়পাওয়া, ক্লান্ত, কিন্তু সততায় ভরা। সে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রুদ্রকে। বাইরে বজ্রপাতের আলোয় তাদের ছায়া পড়ে জানালায়—একটা ছায়া, দুটো হৃদয়ের মিলন। সেই প্রথম, সত্যিকারের মুখোশহীন প্রেমের শুরু হয়, যেখানে কোনো ছায়া নেই, শুধু আলো আর একে অপরকে বোঝার অঙ্গীকার।
সমাপ্ত




