Aparna Basu
অধ্যায় ১: স্বপ্নের বীজ
শীতলডাঙ্গা গ্রামের সকালগুলো খুব বেশি বদলায় না, বছরের পর বছর ধরে একই ছন্দে বয়ে যায় এখানকার সময়। মাটির রাস্তা বেয়ে গরুর গাড়ির চাকা আঁকিবুঁকি কেটে চলে, ঝুপড়ি ঘরের চালার ফাঁক দিয়ে প্রথম রোদের আলো মাটির উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে, আর বনে-পাহাড়ে শাল-পলাশের গন্ধ মিশে যায় হাওয়ার সাথে। সেই হাওয়াতে ভেসে আসে পাখিদের ডাক, যেটা প্রতিদিন ঘুম ভাঙায় গ্রামের মানুষদের। শীতলডাঙ্গার শেষপ্রান্তে, বাঁশঝাড়ের পাশে এক মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি দেওয়া। সেই ঘরে থাকে মুক্তা, বারো বছরের কিশোরী মেয়ে, যার চোখে আছে বিশাল স্বপ্নের জগৎ, যদিও সেই স্বপ্ন এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মায়ের ডাকেই তার সকাল শুরু হয়। “ওরে মুক্তা, কুয়ো থেকে জল তুলবি না? হাঁস-মুরগি খোঁয়াড়ে ঢোকাতে হবে।” শীতের সকালের ঘন কুয়াশায় গা জড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। মাটির খাটের পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু কাপড়, ভাঙা হাঁড়ি আর কাঠকয়লার ছাই। মুক্তার বাবা চিত্তরঞ্জন মণ্ডল একজন গরিব চাষি, অন্যের জমিতে মজুরি খেটে যা আনে, তাতে কোনো রকমে ভাত জোটে পেটে। মা সরলা মণ্ডল অন্যের বাড়িতে খেঁটে, শাকপাতা বুনে, মাছ কেটে সংসার চালায়। শীতলডাঙ্গার মানুষজনের জীবনে বড় স্বপ্নের জায়গা নেই, জীবনের চাওয়া-পাওয়া সীমাবদ্ধ থাকে দুবেলা দুটো ভাতের জোগাড় আর বছর ঘুরে ফসলের আশায়। কিন্তু এই সাধারণ গ্রাম্য জীবনের মাঝে মুক্তার মন অন্য রকম কিছু চায়। প্রতিদিন সকালে যখন সে মাঠের আল দিয়ে হাঁটে, দূরের স্কুলের দিকে চোখ চলে যায়। সেখানে ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যায়—কেউ নোংরা ব্যাগ কাঁধে, কেউ বই হাতে চেপে ধরে হাঁটে। তাদের হাসি, গল্প, আর স্কুলের ঘণ্টার আওয়াজ মুক্তার বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক শূন্যতা তৈরি করে। সে ভাবে, যদি তারও হাতে এমন বই থাকত, যদি সে লিখতে পারত নিজের নামটা, যদি তার কপালে থাকত সেই স্কুলের আঙিনায় পা রাখার সৌভাগ্য! মাঝে মাঝে সে থেমে দাঁড়িয়ে স্কুলের দিকের মেঠো পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, দূর থেকে ভেসে আসা পাঠশালার আওয়াজ শোনে—“অ আ ক খ…”। সেই শব্দগুলো যেন তার কানের মধ্যে গান বেঁধে বাজে। বাড়ি ফিরে আসে নীরব পায়ে, কিন্তু তার চোখের মধ্যে রয়ে যায় স্কুলের দিকে হেঁটে যাওয়া শিশুদের স্বপ্নময় ছবি।
বাড়ি ফিরে এসে মা যখন তাকে হাঁড়ির ভেতর থেকে খুন্তি দিয়ে ভাত বাড়িয়ে দেয়, সেই ভাতের গন্ধে পেটের ক্ষুধা মেটে, কিন্তু মনের ক্ষুধা মেটে না। একদিন সাহস করে বাবাকে বলেই ফেলল, “বাবা, আমি স্কুলে যেতে চাই।” কথাটা শুনে চিত্তরঞ্জন থমকে গেল। তার চোখে ক্লান্তি, সমাজের ভয় আর দারিদ্র্যের হাহাকার স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপর নিচু গলায় বলল, “মেয়েমানুষের আবার পড়ালেখা! মেয়েরা পড়ে কী করবে? শাড়ি পরে ঘরে কাজ করবে, শাক কাটবে, বাপের ঘর থেকে শ্বশুর বাড়ি যাবে, ব্যাস। পড়ে কী হবে বল তো?” মুক্তা কিছু বলল না। সে জানে, বাবার কথার পেছনে লুকিয়ে আছে সমাজের ভয়, কুসংস্কার, অভাবের কষ্ট। মায়ের দিকে তাকাল মুক্তা। মা সরলা কেবল চোখ মেলল, চোখে জল, মুখে কোনো কথা নেই। সেই রাতে ঘুম হলো না তার। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখল আকাশ ভরা তারা। ভাবল, তারা নাকি পথ দেখায়, তারা কি তাকে পথ দেখাবে স্কুলের দিকে? পরদিন সকালে আবার সেই একই দৃশ্য—ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, মুক্তা মাঠের আল ধরে গরু নিয়ে যাচ্ছে চারণভূমিতে। মনে মনে অক্ষরগুলো উচ্চারণ করছে—“অ আ ক খ গ ঘ…”। কুঞ্জ, তার একমাত্র বন্ধু, যে স্কুলে যায়, সে মাঝে মাঝে নতুন অক্ষর শেখায় মুক্তাকে। কুঞ্জ একবার ছেঁড়া এক খাতা দিয়ে বলেছিল, “দেখ, এইটাতে আমি লিখি। তুইও চেষ্টা কর।” সেই খাতার পাতা মুক্তার কাছে অমূল্য ধন হয়ে উঠেছে। রাতে কুপির আলোয় বসে বসে খাতার পাতায় আঙুল বুলিয়ে অক্ষর চেনার চেষ্টা করে। কাঠকয়লা দিয়ে মাটিতে অক্ষর আঁকে। বারবার চেষ্টা করে, ভুল করে, আবার ঠিক করে। অক্ষরের নিচের ছবিগুলো দেখে নিজে নিজে ভাবতে থাকে—এই হলো আম, এই হলো কাক, এই হলো কলম। স্কুলের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের কোলাহল শোনে। ভয়ে ভয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে মধুসূদন মাস্টারমশাই ক্লাস নিচ্ছেন। সে স্বপ্ন দেখে, একদিন সেও ওদের পাশে বসে অক্ষরগুলো শিখবে, মাটির ঘরের ভেতর বই নিয়ে বসে থাকবে। কিন্তু বাস্তব জানে, সেই স্বপ্নের পথ খুব কঠিন। সমাজের চোখ, দারিদ্র্য, কুসংস্কার—সব তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে।
একদিন মায়ের সাহসী স্পর্শ পায় মুক্তা। রাতে যখন কুপির আলো নিভে আসে, মা তার কাঁধে হাত রাখে আর বলে, “মুক্তা, তুই পড়তে চাস, আমি তোর জন্য কিছু করব রে মা।” সেই রাতে মুক্তা ঘুমাতে পারে না। কেবল ভাবতে থাকে কীভাবে সে স্কুলে যাবে, কীভাবে অক্ষরের মানে জানবে, কীভাবে সমাজের চোখ উপেক্ষা করে সে অক্ষর শেখার শক্তি পাবে। কুয়োর জলে মুখ ধুতে গিয়ে সকালে নিজের মুখের ছায়া দেখে মনে হয়, সেই মুখ একদিন বইয়ের পাতায় নিজের নাম লিখবে। মা গোপনে হাট থেকে ছেঁড়া এক পুরনো বই এনে দেয়। মুক্তা সেই বইয়ের পাতা উল্টে অক্ষরগুলো দেখে। একদিন সাহস করে স্কুলের গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, মধুসূদন মাস্টারমশাই তার চোখে চোখ রাখেন। “তুই কি পড়তে চাস?” মাস্টারমশাই প্রশ্ন করেন। মুক্তা কেবল মাথা নাড়ে। মাস্টারমশাই বলেন, “আয়, বস। পড়তে চাইলে কেউ আটকাতে পারবে না।” কিন্তু সে জানে, গ্রামে কথা উঠবে, পঞ্চায়েতের লোকেরা বাঁকা কথা বলবে, মোড়লরা বলবে “মেয়েমানুষ পড়ে কী হবে?” তবু সে পায় এক নতুন সাহস, পায় অজানা শক্তি। রাতের আঁধারে, কুপির আলোয়, বইয়ের পাতায় আঙুল বুলিয়ে, মুক্তা ভাবে, এই অক্ষর একদিন তার জীবন বদলে দেবে। সে জানে না, কত লড়াই অপেক্ষা করছে, কত ঝড় আসবে তার জীবনে, তবু বুকের ভেতর স্বপ্নের বীজ অটুট থাকে। অক্ষরের প্রতি তার ভালোবাসা, স্কুলের প্রতি তার টান, আর শিক্ষার জন্য তার আকাঙ্ক্ষা—এসব একদিন তার জীবনকে নতুন দিকে নিয়ে যাবে। প্রথম অধ্যায়ের শেষে সেই স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে, অন্ধকারে আলো দেখার প্রথম কিরণ হয়ে ওঠে।
অধ্যায় ২: মাটির দেওয়াল আর সমাজের চোখ
শীতলডাঙ্গার চারপাশে শাল-গাছের জঙ্গল, লাল মাটির রাস্তা আর কুয়াশায় ঢাকা মাঠ যেন প্রতিটি ভোরে নতুন আশার কথা শোনায়, কিন্তু এই গ্রামের বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকে সমাজের চোখ রাঙানির অদৃশ্য দেওয়াল। সেই দেওয়াল পেরোনো সহজ নয়, বিশেষ করে কোনো গরিব চাষির মেয়ের পক্ষে, যে স্কুলের পথে পা বাড়াতে চায়। মুক্তা প্রতিদিন সকালেই স্কুলের পথে হাঁটা ছেলেমেয়েদের দেখত, কিন্তু এখন সে তাদের দিকে আর শুধু তাকিয়ে থাকে না, সে তাদের মতো হতে চায়। কিন্তু সেই চাওয়াই যেন আশেপাশের মানুষদের চোখে অভিশাপের মতো দেখা দিতে থাকে। একদিন বিকেলে, যখন মাঠের কাজ সেরে চিত্তরঞ্জন মণ্ডল চৌকিতে বসে বিড়ি টানছিল, তখন পাশের বাড়ির গজারু কাকা এসে হেসে বলল, “শুনছিস চিত্ত, তোর মেয়ে নাকি স্কুলে যেতে চাইছে? কিরে! মেয়েমানুষের আবার বিদ্যা! এই বয়সে মেয়েকে বই পড়া শেখাবি না, বিয়ে দিতে হবে, বুঝলি?” সেই কথায় চিত্তরঞ্জনের মুখ শক্ত হয়ে গেল। গজারু চলে গেলেও তার কুটিল হাসি আর কথার গন্ধ বাতাসে রয়ে গেল। পরের দিন সকাল থেকে পাড়া-পড়শিরা, বাজারে চায়ের দোকানে, মাঠে আলের ধারে ফিসফিসিয়ে এই নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। “মণ্ডলের মেয়ে তো নাকি খুব বিদ্যা শিখবে!” “বাপরে! মেয়েমানুষ বই পড়বে! কাল যে আবার খারাপ কিছু না ঘটে!” গ্রামের প্রাচীন মোড়ল, কুশল বাবু, পঞ্চায়েতে বসে বললেন, “দেখ, সমাজের নিয়ম ভাঙলে সর্বনাশ হবে। বাপ-মা বুঝুক, মেয়েমানুষের বিদ্যা দুঃখের মূল।” এই ফিসফিসানির মধ্যেই মুক্তার বুক কাঁপতে থাকে, কিন্তু তার চোখে জেদ আরও পাকা হয়।
রাতে যখন কুপির আলো নিভে আসে, আর মাটির ঘরের অন্ধকারে নিশ্বাস ফেলে ঘুমের চেষ্টা করে পরিবার, মুক্তার চোখে ঘুম আসে না। জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের তারাগুলো দেখে সে ভাবে, তারা নাকি সত্যিই পথ দেখায়? সেই তারা কি তাকে দেখাবে অক্ষরের জগতে পৌঁছনোর পথ? পরদিন সকাল হতেই সে মায়ের সাথে কুয়ো থেকে জল তুলতে গিয়ে দেখে, মাঠের ধারে কয়েকজন মহিলা দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলছে, “মুক্তা বই পড়বে! দেখি না কী হয়!” তাদের চোখের বাঁকা চাহনি, মুখের কুটুক্তি যেন আগুনের মতো ছুঁয়ে যায় মুক্তার কোমল মনটাকে। মায়ের হাত শক্ত করে ধরে সে বাড়ি ফেরে। মা বুঝতে পারে, মেয়ের মনের ভেতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা সহজে থামার নয়। সেই রাতে মা চুপিচুপি মুক্তার কাছে এসে বলে, “মুক্তা, মন খারাপ করিস না রে মা। তুই যা চাস, সেটা তুই একদিন পাবি। আমি তোর জন্য ঈশ্বরে প্রার্থনা করি।” মা তার আঁচল দিয়ে মুক্তার চোখের জল মুছে দেয়। কিন্তু এই সমাজ, এই কুসংস্কার আর এই দেওয়াল যেন দিনের পর দিন আরও শক্ত হতে থাকে। পঞ্চায়েত ডাকা হয় একদিন। কুশল বাবু গম্ভীর মুখে বলে, “চিত্তরঞ্জন, মেয়েমানুষ বিদ্যা শিখবে? সমাজে তো শাপের মতো হবে। আমাদের নিয়ম ভাঙলে দেবতার অভিশাপ পড়বে।” গ্রামের তান্ত্রিক গোপালও বলে, “দেবীর রোষ পড়বে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় তুই নেবি?” বাবার চোখে আতঙ্কের ছায়া নামে, সে চুপ করে বসে থাকে। মুক্তা জানে, তার বাবা সমাজের ভয়ে কুঁকড়ে যায়, দারিদ্র্য আর লোকের কথায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তার নিজের ভেতর অদ্ভুত এক জেদ গড়ে উঠতে থাকে, এক লুকানো আগুন যা সে বোঝাতে পারে না কাউকে। অন্ধকার রাতে তার বুকের ভেতর সেই আগুন জ্বলতেই থাকে।
তবে এই আঁধারে আলোর রেখা খুঁজতে থাকে মুক্তা। তার একমাত্র আশ্রয় সেই ছেঁড়া খাতা, যেটা কুঞ্জ তাকে দিয়েছিল। দিনের কাজ সেরে সে যখন একা থাকে, তখন খাতার পাতায় আঙুল বুলিয়ে অক্ষরের ছবি মনে করার চেষ্টা করে। মাঠের ঘাসে বসে কুঞ্জ তাকে নতুন শব্দ শেখায়। “দেখ মুক্তা, এইটায় লেখা ক, এইটা গ, এইটা ম। তুই চাইলেই শিখতে পারবি।” কুঞ্জের মুখে সাহস পায় সে। নদীর পাড়ে বসে তারা দুজন অক্ষরের নকশা আঁকে মাটিতে কাঠকাঠি দিয়ে। মুক্তা ভাবে, যদি সত্যিই একদিন সে পড়তে পারে! স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কখনো কখনো, ক্লাসের আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে। মধুসূদন মাস্টারমশাই একদিন বেরিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “কী রে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পড়তে চাস?” মুক্তা লজ্জায় চুপ থাকে, মাথা নিচু করে ফেলে। মাস্টারমশাই বুঝতে পারেন, এই মেয়ের চোখে স্বপ্ন আছে, সাহস আছে। তিনি বলেন, “যদি একদিন পড়তে চাস, তুই আয়, আমি পড়াব। কেউ আটকাতে পারবে না।” সেই কথাগুলো মুক্তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনি তোলে। সে রাতভর ভাবে, কীভাবে সেই পথ খুঁজে পাবে? কুপির আলোয় বইয়ের পাতায় আঙুল বুলিয়ে, মাটিতে অক্ষর আঁকতে আঁকতে তার মনে হয়, অক্ষরই একদিন সমাজের এই দেওয়াল ভেঙে ফেলবে। চারদিকের বাঁকা চোখ, পঞ্চায়েতের শাসন, কুসংস্কারের অভিশাপ—সব পেরিয়ে একদিন সে স্কুলের আঙিনায় দাঁড়াবে। অন্ধকার রাতে, শীতলডাঙ্গার নিস্তব্ধতার মাঝে মুক্তা শপথ নেয় নিজের মনের মধ্যে—সে একদিন পড়বেই, শিখবেই, সমাজের চোখকে বুড়ো আঙুল দেখাবেই।
অধ্যায় ৩: প্রথম বই
শীতলডাঙ্গার আকাশে গ্রীষ্মের শেষ বিকেল যেন এক স্বপ্নময় ছবি এঁকে রেখেছিল সেদিন। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে ধানক্ষেতের শেষ সীমানা পর্যন্ত। গ্রামের মেঠো রাস্তায় ধুলো উড়ছে, গরু-বাছুরেরা মাঠ থেকে ফিরছে ঘরে। এই দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে ক্লান্ত পায়ে ফিরছিল সরলা মণ্ডল। মাথায় শাকপাতার পোটলা, হাতে একটি পুরনো কাগজে মোড়া পুঁটলি। সেই পুঁটলিটা বারবার আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে রাখছে সে, যেন লুকিয়ে রাখছে কোনও অমূল্য রত্ন। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, তবু মনের ভেতরে এক অজানা তৃপ্তি, কারণ সে জানে এই পুঁটলির ভেতর লুকিয়ে আছে তার মেয়ের ছোট্ট স্বপ্নের প্রথম সিঁড়ি। হাট থেকে ফেরা পথে কতো মানুষের কটুকথা কানে এসেছে তার—“সরলা, তুই কি তোর মেয়েকে সাহেবি পড়া শেখাবি?” “শুনেছি নাকি, তোর মেয়ের জন্য বই কিনেছিস? হা হা! সমাজে মাথা তুলতে পারবি না।” তবু সরলা কিছু শোনেনি, শুধু মনের ভেতর নিজের মেয়ের মুখটা ভেসে উঠেছে বারবার, সেই মুখের স্বপ্নমাখা চোখদুটো যেটা প্রতিদিন স্কুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে, মুক্তার জন্য এই ছোট্ট বইটি যেন অক্ষরের আলোর প্রথম প্রদীপ। ঘরে ফিরেই পুঁটলিটা নিজের আঁচলে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল সে। তখন ঘর অন্ধকার, শুধু কুপির ম্লান আলোয় ঘরের কোণায় মাটির দেওয়ালে ছায়া নাচছে। মুক্তা তখন উঠোনে বসে ছিল, হাতে কাঠকয়লা, মাটিতে আঁকিবুঁকি কেটে অক্ষরের ছবি আঁকছে। মা ডাকল, “মুক্তা, একবার এখানে আয় তো মা।” মুক্তা ছুটে এসে মায়ের হাতে সেই পুঁটলিটা দেখল। “এটা কী মা?” সরলা কাঁপা হাতে পুঁটলি খুলল। ভেতর থেকে বেরোল এক ছেঁড়া, প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া পুরনো বাংলা পprimer। পাতাগুলো প্রায় হলুদ, কিছু পাতা ছিঁড়ে গেছে, কিছু পাতা জলে ভিজে গেছে, কিন্তু মুক্তার চোখে সেটাই যেন স্বর্ণের মতো ঝলমল করে উঠল। সে দুহাতে বইটা নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরল, যেন সারাজীবনের সব খুশি এক নিমেষে তার হাতে ধরা দিল।
রাতের খাওয়া সেরে, যখন চিত্তরঞ্জন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন কুপির আলোয় মুক্তা বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকে। প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষর—অ, আ, ই, ঈ। নিচে ছোট ছোট ছবি—আম, আকাশ, ইঁদুর, ঈশ্বর। সে আঙুল দিয়ে অক্ষরগুলোর গায়ে ছুঁয়ে দেখে, মনে হয় যেন অক্ষরগুলো কথা বলছে তার সাথে। মায়ের মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। “দেখলি মা, পড়তে শেখা এমন কঠিন নয়। মন দিয়ে পড়লে তুই পারবি।” মুক্তা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে, সেই মুখে সে সাহস খুঁজে পায়, ভরসা পায়। প্রতিদিন সকালে হাঁস-মুরগির খোঁয়াড় সামলে, কুয়ো থেকে জল তুলে, গরুর জন্য খড় কেটে, সে কিছু সময় বের করে বইয়ের পাতা খুলে বসে। সে জানে না সঠিকভাবে কীভাবে পড়তে হয়, কীভাবে অক্ষরের উচ্চারণ করতে হয়, তবু সে নিজের মতো করে চেষ্টা করে যায়। কুঞ্জ যেটুকু শিখিয়ে দেয়, সে তাই মনে রাখে, আর প্রতিটি অক্ষরকে আঁকতে আঁকতে নিজের মনে শব্দ তৈরি করার চেষ্টা করে। বিকেলে নদীর ধারে বসে সে বইটা নিয়ে যায়, কুঞ্জ তার পাশে বসে অক্ষরগুলো বলে দেয়, মুক্তা সেটাকে কণ্ঠস্থ করার চেষ্টা করে। কুঞ্জের সাথে বসে বসে মাটিতে কাঠি দিয়ে অ, আ আঁকে। দুজনে মিলে নদীর জলে বইয়ের প্রতিচ্ছবি দেখে হেসে ওঠে। গ্রামের শিশুরা দূর থেকে দেখে বলে, “দেখো দেখো, মণ্ডলের মেয়ে নাকি বই পড়ছে!” তাদের হাসির শব্দ বাতাসে ভেসে আসে, কিন্তু মুক্তা আর গায়ে মাখে না। তার চোখ এখন অক্ষরের জগতে ডুবে আছে, তার মন পড়াশোনার নতুন আনন্দে ভরে গেছে। মায়ের দেওয়া সেই বই যেন তার জীবনের প্রথম সঙ্গী হয়ে গেছে, যে সঙ্গী তার সব অজানা পথের দিশারী।
কিন্তু সমাজ কি ছেড়ে দেয় এত সহজে? গজারু কাকা, কুশল মোড়ল আর গ্রামের কিছু লোক একসাথে বসে নতুন করে কথা ছড়াতে শুরু করল—“দেখেছিস, মেয়েটা বই হাতে ঘুরছে, পাপ হবে পাপ! দেবতার অভিশাপ পড়বে!” তান্ত্রিক গোপাল আবার পঞ্চায়েতে গিয়ে বলল, “দেবী অসন্তুষ্ট হবেন, এই মেয়েকে থামা উচিত। নাহলে গ্রামে দুর্যোগ নামবে।” চিত্তরঞ্জনের কানে এসব কথা ঢোকে। সে রাতে বিড়ি টানতে টানতে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুক্তা বুঝতে পারে, বাবার বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে চলেছে। বাবা সমাজের ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে, কিন্তু মেয়ের স্বপ্নও সে ভাঙতে চাইছে না। মায়ের চোখে তখন উদ্বেগ আর ভালোবাসা একসাথে মিশে গেছে। কিন্তু মুক্তা থামে না। কুপির আলো নিভে আসছে, তবু সে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে, অক্ষরের আঁচড়ে আঁচড়ে সে খুঁজে বেড়ায় নিজের নতুন জীবন। তার মন জুড়ে তখন শুধু একটাই কথা—এই অক্ষর একদিন তার হাত ধরে সমাজের দেওয়াল ভেঙে দেবে। সেই রাতে শীতলডাঙ্গার আকাশে তারা আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে যেন। মুক্তা জানে না, সামনে কী ঝড় আসছে, কত কষ্ট আসছে, তবু তার বুকের ভেতর সেই অজানা সাহস ক্রমেই বাড়ছে। সমাজের চোখ, কুসংস্কারের শেকল, পঞ্চায়েতের শাসন—সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে তার প্রথম বইয়ের পাতা যেন তার অন্তরাত্মার মন্ত্র হয়ে বাজতে থাকে।
অধ্যায় ৪: অক্ষরের পথে প্রথম পা
শীতলডাঙ্গার সেই ভোরটা অন্য ভোরের চেয়ে আলাদা ছিল। আকাশে লালচে রঙের ছাপ, শাল-পলাশের গন্ধে ভরা হাওয়া আর পাখিদের কুজন যেন এক নতুন আশার বার্তা বয়ে আনছিল। গ্রামের মাটির পথ ধরে হাটের দিকে যাওয়ার ছুতোয় মায়ের হাত ধরে মুক্তা স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। মুক্তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়ছিল, কারণ সে জানত আজকের দিনটা তার জীবনের বড় দিনের শুরু হতে পারে। স্কুলের ফটকের বাইরে এসে তারা দাঁড়ালে মধুসূদন মাস্টারমশাই বারান্দায় বসে তাকে দেখে হাত ইশারা করলেন। “তুই এসেছিস? ভিতরে আয়,” তাঁর কণ্ঠে আশ্বস্তির ছোঁয়া। মা ভয়ে ভয়ে বলল, “ও মাস্টারমশাই, সমাজ কী বলবে, ভয় করে।” মাস্টারমশাই নরম গলায় বললেন, “সরলা, বিদ্যার থেকে বড় কিছু নেই। তোর মেয়েটার চোখের দিকে দেখ, কত স্বপ্ন লুকিয়ে আছে। অক্ষর শেখা পাপ নয়।” মায়ের কাঁপা হাতটা ছাড়িয়ে মুক্তা স্কুলের বারান্দায় পা রাখল, যেন সেই মাটির বারান্দা ছিল তার স্বপ্নের রাজপথ। মাস্টারমশাই তার হাতে পুরনো এক খাতা আর এক টুকরো পেন্সিল দিলেন। “লিখতে চেষ্টা কর। ভয় নেই,” বললেন তিনি। মুক্তা প্রথমবার নিজের নামের অক্ষরগুলো লিখতে চেষ্টা করল। “মু…ক্তা”। হাত কাঁপছে, অক্ষরের আকার বেঁকেছে, কিন্তু তার চোখের উজ্জ্বলতা বলছে, সে জিতে গেছে আজ। সেই মুহূর্তে বাতাস যেন থেমে গিয়েছিল, স্কুলের পাশের শিমুলগাছের পাখিরা যেন তার জন্যই গান গাইছিল। মাস্টারমশাই খুশি হয়ে বললেন, “দেখিস, তুই পারবি। তোর মন বড়। তুই একদিন সমাজের চোখ উপেক্ষা করে জিতবি।”
কিন্তু সেই আনন্দের সাথে সাথে সমাজের ছায়া ঘনিয়ে এলো। বিকেল গড়াতেই খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে—মণ্ডলের মেয়ে নাকি স্কুলে পা রেখেছে! পঞ্চায়েত বসার নির্দেশ এলো। গ্রামের মোড়ল, কুশল বাবু, তান্ত্রিক গোপাল আর বাকি প্রবীণরা একজায়গায় জড়ো হলো। চিত্তরঞ্জনকে ডেকে পাঠানো হলো। মোড়লের চোখ রাঙিয়ে বলল, “চিত্তরঞ্জন, তুই আমাদের সমাজের নিয়ম ভাঙছিস? মেয়েমানুষ বই পড়লে কাল আবার দেবতার রোষ পড়বে, গ্রামে দুর্যোগ নামবে!” গোপাল তান্ত্রিক ভয় দেখিয়ে বলল, “অমঙ্গল হবে! মাঠের ফসল নষ্ট হবে, নদী ভেঙে যাবে!” চিত্তরঞ্জনের মাথা নিচু হয়ে গেল। সে বোঝে না কী করবে। মুক্তা দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, বুকের ভেতর আগুনের মতো জ্বলছে অভিমান আর বেদনা। সে ভাবে, কেন বিদ্যা চাওয়া পাপ হবে? কেন সমাজ তার স্বপ্ন ভাঙতে চাইছে? সেই রাতে চিত্তরঞ্জন ঘরে ফিরে চুপ করে বসে থাকে, মুখে কোনো কথা নেই, চোখে হেরে যাওয়ার ছাপ। কিন্তু মা সরলা সাহস দিয়ে বলে, “যা হবার হবে। মেয়ের স্বপ্ন ভাঙতে দেব না।” সেই রাতে মুক্তা নিজের খাতার পৃষ্ঠায় বারবার নিজের নাম লিখে চলল, আঙুল কেটে রক্ত বেরোলেও থামল না। সে শপথ করল, পঞ্চায়েতের শাসন, সমাজের বাঁকা চোখ, কোনো কিছুই তাকে অক্ষরের পথ থেকে সরাতে পারবে না।
পরের দিন ভোরে মুক্তা স্কুলে গেল আবার, মধুসূদন মাস্টারমশাইয়ের কাছে। এবার সে আরও সাহস নিয়ে পেনসিল ধরে লিখতে শিখল, অক্ষরের আকার বোঝার চেষ্টা করল, একে একে লিখল অ, আ, ক, খ। মাস্টারমশাই তার হাত ধরে অক্ষরের বাঁকগুলো বুঝিয়ে দিলেন। স্কুলের বারান্দা, খাতা, পেন্সিল—সব যেন তার নতুন জীবনের বন্ধু হয়ে উঠল। কিন্তু গ্রামের মানুষের বাঁকা কথা থামল না। পঞ্চায়েত আবার শাসাল, “মেয়েটাকে স্কুলে যেতে দিলে গ্রামে অভিশাপ নেমে আসবে।” চিত্তরঞ্জন আর চুপ রইল না, একদিন পঞ্চায়েতের চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার মেয়ের স্বপ্ন ভাঙতে দেব না। আমি গরিব হতে পারি, কিন্তু মেয়ের মন বড়। সে পড়বেই।” গ্রামে হইচই পড়ে গেল, চিত্তরঞ্জন সাহস দেখিয়েছে! কিন্তু মুক্তা জানে, লড়াই কেবল শুরু হয়েছে। রাতে আকাশের তারা দেখল সে, আর মনের ভেতর অদ্ভুত এক শান্তি নামল—অক্ষরের পথে তার প্রথম পা রাখা হয়ে গেছে। এখন সেই পথ যত কঠিন হোক না কেন, সে আর থামবে না।
অধ্যায় ৫: ঝড়ের রাতে শপথ
শীতলডাঙ্গার আকাশে সেদিন বিকেলের পর থেকে অদ্ভুত এক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছিল। শাল, মহুয়া, পলাশের গাছগুলো কেমন অস্বাভাবিকভাবে দুলতে লাগল, আর আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। চারদিকে বাতাসের গর্জন, বাঁশঝাড়ের পাতায় শোঁ শোঁ শব্দ যেন কোনো অজানা অশনি সংকেত বয়ে আনছিল। সেই সময় পঞ্চায়েতের বৈঠক বসেছে গ্রামের মাঠের ধারে, বড় বটগাছের তলায়। কুশল মোড়ল, তান্ত্রিক গোপাল আর কয়েকজন প্রবীণ বসে আছে গম্ভীর মুখে। গজারু কাকা গলা চড়িয়ে বলল, “এই চিত্তরঞ্জন কী করছে শুনছ? মেয়েমানুষকে বই শেখাচ্ছে! আমরা এই সমাজে কী করে মুখ দেখাব?” কুশল মোড়ল চোখ কুঁচকে বলল, “এই অন্যায় বন্ধ করতে হবে। মেয়েটাকে শাস্তি দিতে হবে, যাতে আর কোনো মেয়ে সাহস না পায় বই পড়তে।” চারদিক থেকে ফিসফিসানির ঝড় বয়ে যায়। সেই সময় বজ্রপাতের শব্দে আকাশ কেঁপে ওঠে। চিত্তরঞ্জন ভয়ে কুঁকড়ে যায়, কিন্তু সরলা মণ্ডল মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে বলে, “আমি মেয়েকে পড়াবই। যে যা খুশি বলুক। ঈশ্বর সব দেখছেন।” সেই রাতে ঝড় নেমে এল শীতলডাঙ্গায়। চারদিক অন্ধকার, কেবল বিদ্যুতের চমক আর ঝড়ের গর্জন। মাটির ঘরের চালা কাঁপছে, ঘরের কোণে কুপির আলো প্রায় নিভে যাচ্ছে, আর মুক্তা সেই আলোয় নিজের ছেঁড়া খাতার পৃষ্ঠায় বারবার নিজের নাম লিখতে থাকে। অ, আ, ক, খ, মু, ক্তা… অক্ষরগুলো তার চোখে আর অক্ষর নয়, যেন মুক্তির মন্ত্র। বাইরে সমাজ ঝড় তুলুক, ভেতরে তার মনের দীপ্তি নিভতে দেয় না সে।
ঝড়ের রাতে পঞ্চায়েতের লোকেরা চিত্তরঞ্জনের ঘরে এসে দাঁড়ায়। “চিত্তরঞ্জন! সমাজের নিয়ম ভাঙলে ফল ভালো হবে না,” কুশল মোড়লের গলা বজ্রধ্বনির মতো শোনা যায়। চিত্তরঞ্জন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ঝড়ের মধ্যে গর্জে ওঠে তার কণ্ঠ, যা কেউ আগে শোনেনি, “যা হবার হবে! আমার মেয়ের স্বপ্ন ভাঙতে দেব না! আমার মেয়ে পড়বে!” সেই কথা শুনে চারপাশ নীরব হয়ে যায় এক মুহূর্তের জন্য, কেবল ঝড়ের আওয়াজ ছাপিয়ে যায় সেই নীরবতাকে। গোপাল তান্ত্রিক হুমকি দেয়, “দেবতার রোষ পড়বে!” কিন্তু চিত্তরঞ্জন এবার থামে না। সেই রাতে মুক্তা জানালার ফাঁক দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় ভিজে গাছগুলোকে দেখে শপথ নেয়—যত ঝড় আসুক, সে থামবে না। সমাজের চোখ, পঞ্চায়েতের শাসন, কুসংস্কারের শেকল—সব পেরিয়ে সে অক্ষরের দীপ্তি নিজের জীবনে আনবেই। ঝড়ের রাতে অন্ধকার ঘরের মাটিতে বসে মুক্তা খাতার পৃষ্ঠায় অক্ষর আঁকতে আঁকতে মনে মনে উচ্চারণ করে—“আমি শিখবই, আমি থামব না।”
পরদিন সকালে ঝড় থেমে যায়। আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে, যেন নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সূর্য ওঠে। শীতলডাঙ্গার মাটিতে ঝড়ের ছাপ, ভাঙা ডালপালা, ভিজে মাটি, কিন্তু মুক্তার চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। সে স্কুলের দিকে পা বাড়ায়, মধুসূদন মাস্টারমশাইয়ের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। মাস্টারমশাই হেসে বলেন, “তুই আজও এলি?” মুক্তা মাথা নেড়ে বলে, “আমি শিখব, মাস্টারমশাই। যত ঝড় আসুক, আমি শিখব।” সেই মুহূর্তে আকাশের মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো পড়ে তার মুখে। মাস্টারমশাই বুঝে যান, এই মেয়েকে আর কেউ থামাতে পারবে না। সমাজের চোখ, কুসংস্কার, পঞ্চায়েত—সবই এবার হার মানবে মুক্তার জেদের কাছে। অক্ষরের পথে তার প্রথম শপথ আজ আরও দৃঢ় হলো। সেই ঝড়ের রাত তার জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দিল, এক নতুন গল্পের শুরু হয়ে গেল।
অধ্যায় ৬: অক্ষরের আলোর পথে
শীতলডাঙ্গার ভোরের আকাশ যেন নতুন আলোয় ভরে উঠল সেদিন। ঝড়ের রাতের পরে মাটি ভিজে, গাছের ডালপালা ছড়িয়ে আছে মাঠে, কিন্তু সেই সব কষ্টের ছাপের মধ্য দিয়েও নতুন দিনের সূর্য রোদ্দুর ছড়িয়ে দিল। মুক্তা সেই রোদে ভিজতে ভিজতে স্কুলের দিকে হাঁটছিল, বুকের ভেতর এক অজানা সাহস নিয়ে। পা ফেলে এগোনোর সময় মায়ের মুখের কথা মনে পড়ল, “মুক্তা, মন শক্ত কর। তোর স্বপ্নকে কোনো ঝড় ভাঙতে পারবে না।” স্কুলের বারান্দায় পৌঁছে সে মধুসূদন মাস্টারমশাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মাস্টারমশাই মুক্তার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন, “তুই এলি? খুব ভালো করেছিস মা। এস, আজ নতুন অক্ষর শিখবি।” সেই দিনের সকাল যেন মুক্তার জীবনের নতুন শুরু। খাতার পাতায় পেন্সিলের আঁচড়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল নতুন অক্ষর—ট, ঠ, ড, ঢ। হাত কাঁপছে, চোখে জেদ, মনে অদম্য ইচ্ছা। মাস্টারমশাই ধৈর্য ধরে তার ভুলগুলো শুধরে দেন, মুক্তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে যখন সে নিজে নিজের লেখা পড়তে পারে। “দেখিস, তুই পারবি,” মাস্টারমশাই বলেন। বারান্দার ওপর দিয়ে হালকা হাওয়া বয়ে যায়, যেন প্রকৃতিও আশীর্বাদ করছে তাকে। প্রতিদিন সকালে কাজ সেরে মুক্তা স্কুলে যায়, বিকেলে ফিরে গরুর খোঁয়াড় সামলায়, তারপর রাতে কুপির আলোয় বই নিয়ে বসে থাকে। কাগজের পাতায় অক্ষরের আঁকিবুঁকি আর মনের ভেতর স্বপ্নের ছবি মিশে যায় এক হয়ে।
কিন্তু সমাজের কটুকথা থামেনি। গ্রামের মাঠে, হাটে, চায়ের দোকানে, বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কান ভরে যায় বাঁকা কথায়। “মণ্ডলের মেয়ে সাহেবি হচ্ছে!” “কাল দেখবি, বাড়ির অভিশাপ নামবে!” চিত্তরঞ্জনের কানে এসব কথা পৌঁছায়, তার বুকের ভেতর দ্বন্দ্বের ঝড় ওঠে। সে জানে সমাজের ভয় কত বড়, তবু মেয়ের চোখের স্বপ্ন সে ভাঙতে পারে না। রাতের অন্ধকারে, কুপির মৃদু আলোয় সে একা বসে থাকে, বাইরে শিয়ালের ডাক শোনা যায়, আর মনে হয় এই সমাজ নামের জঙ্গল তার চারপাশে ঘুরছে। তবু সরলার মুখের দৃঢ়তা আর মুক্তার কপালের জেদ চিত্তরঞ্জনকে নীরবে সাহস জোগায়। মুক্তা বুঝতে পারে বাবার ভেতরের লড়াই। কিন্তু সে আর পিছু হটতে চায় না। প্রতিদিন অক্ষরের পাশে দাঁড়িয়ে তার সাহস যেন আরও বড় হয়। কুয়োর জলে মুখ ধুতে গিয়ে নিজের ছায়া দেখে সে ভাবে, একদিন এই মুখই সমাজকে দেখাবে যে মেয়েমানুষ বিদ্যা শিখলে অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ বয়ে আনে। সেই ভোরের প্রথম আলোয় যখন সে স্কুলের দিকে হাঁটে, মাটির রাস্তার ধুলো পায়ে লেগে যায়, কিন্তু মন তার আকাশের মতো বিশাল হয়ে যায়।
মাসের পর মাস কেটে যায়, মুক্তা ক্রমে অক্ষর চেনে, শব্দ বানায়, নিজের নাম লিখে দেয়ার আনন্দে বুক ভরে যায়। মধুসূদন মাস্টারমশাই মাঝে মাঝে তাকে গল্প শোনান—বেগম রোকেয়ার কথা, যিনি সমাজের চোখ উপেক্ষা করে মেয়েদের জন্য স্কুল খুলেছিলেন; সেই সব গল্প মুক্তার মনকে আরও জাগিয়ে তোলে। স্কুলের বারান্দায় বসে মুক্তা দূরে দিগন্তের দিকে চেয়ে ভাবে, একদিন সে আরও বড় হবে, অন্য মেয়েদেরও শেখাবে। কিন্তু এই স্বপ্নের মাঝে সমাজের কাঁটা যেন বারবার পায়ে বিঁধে যায়। পঞ্চায়েত নতুন করে চিত্তরঞ্জনকে তলব করে, হুমকি দেয়—“মেয়েকে থামাও, নাহলে শাস্তি হবে।” চিত্তরঞ্জন চুপ করে থাকে, শুধু রাতের অন্ধকারে আকাশের তারা দেখে মনে মনে প্রার্থনা করে, “হে ঈশ্বর, আমার মেয়েকে রক্ষা করো।” আর মুক্তা সেই রাতে, কুপির আলোয়, বইয়ের পাতা খুলে বসে, অ, আ, ক, খ থেকে শুরু করে নিজের লেখা শব্দগুলো পড়তে থাকে, মনে মনে উচ্চারণ করে, “আমি থামব না, আমি শিখবই।” শীতলডাঙ্গার আকাশে তারা আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যেন সেই ছোট মেয়ের স্বপ্নকে আশীর্বাদ জানাতে।
অধ্যায় ৭: সমাজের দেওয়ালে ফাটল
শীতলডাঙ্গার সকালে সেদিন অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছিল। পাখিরা যেমন কিচিরমিচির করছে, শাল আর মহুয়ার পাতায় মৃদু হাওয়া বইছে, তেমনি গ্রামের মানুষের চোখে রয়েছে অশান্তির ছাপ। কারণ আগের রাতে পঞ্চায়েত আবার এক কঠোর হুকুম জারি করেছে—“মণ্ডলের মেয়ে আর এক পা স্কুলে দিলে পরিবার সমাজচ্যুত হবে।” চিত্তরঞ্জনের বুকের ভেতর কাঁপন ধরে গেছে সেই কথা শোনার পর থেকে, সে জানে সমাজচ্যুতি মানেই শেষ, জমিজমা হারানো, হাটে-বাজারে মুখ দেখানোর জায়গা না থাকা। কিন্তু ঘরের কোণে বসে সে মুক্তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে—সেই মুখে অদ্ভুত এক দীপ্তি, সেই চোখে ভেসে আছে অক্ষরের আলো। মেয়ের সেই চোখের ভাষা বুঝতে পারে চিত্তরঞ্জন, আর তার নিজের অন্তরদ্বন্দ্ব যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বাইরে সমাজের কটুক্তি, কুশল মোড়লের চোখরাঙানি, গজারু কাকার বাঁকা হাসি, আর ভেতরে বাবার মন—যেখানে মেয়ের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চলছে। সেই সকালে মুক্তা যখন কাঁধে খাতা নিয়ে স্কুলের দিকে পা বাড়ায়, তখন চারপাশের মানুষ ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে চায় তার সাহসটাকে। “দেখেছিস, মেয়েটা থামল না!” “দেবতার রোষ আসবেই।” কিন্তু মুক্তার পা আর থামে না। তার প্রতিটি পা যেন সমাজের দেওয়ালে ছোট ছোট ফাটল ধরায়। স্কুলের বারান্দায় পৌঁছে সে বুকের ভেতর গুমগুম করা ধুকপুকানি নিয়ে খাতার পাতা খুলে বসে। মধুসূদন মাস্টারমশাই তার চোখের দিকে চেয়ে শুধু বলেন, “আজ আরও বড় অক্ষর লিখবি। ভয় পাস না মা, তুই পারবি।” আর সেই কথা মুক্তার মনে বৃষ্টি ফোটায় খরার মাঠে।
বিকেলের দিকে পঞ্চায়েতের বৈঠক বসে আবার বটগাছের তলায়। কুশল মোড়ল বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করে, “চিত্তরঞ্জনের মেয়েকে যদি কাল স্কুলে দেখা যায়, তাদের পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হবে।” গজারু কাকা হাততালি দেয়, তান্ত্রিক গোপাল উল্টো মন্ত্র পড়ে ভয় দেখায়। চিত্তরঞ্জনের ঘরে সেই সংবাদ পৌঁছালে সে নিস্তব্ধ হয়ে যায়, কপালে হাত রাখে। সরলা তার কাঁপা হাত ধরে বলে, “চিত্ত, ভয় পাস না। সমাজ আমাদের নেবে বা নেবে না, কিন্তু মেয়ের স্বপ্ন ভাঙলে ঈশ্বরও ক্ষমা করবে না।” চিত্তরঞ্জনের চোখে জল আসে, সে জানে এই লড়াই শুধু মেয়ের নয়, তার নিজেরও। সেই রাতে মুক্তা কুপির আলোয় অ, আ, ক, খ-এর পরে নতুন নতুন শব্দ লিখে যায়—“আলোর পথ, স্বপ্ন, সাহস।” তার ছোট হাতের লেখা বেঁকেচুরে গেলেও সেই লেখার মধ্যে রয়েছে এক অদম্য শক্তি। বাইরে সমাজের ঘোর অন্ধকার, ঘরের মাটিতে শিয়ালের ডাক শোনা যায়, কিন্তু মুক্তার মনের ভেতর জ্বলছে অক্ষরের আলো। সেই রাত যেন তার জীবনের আরেকটা শপথের রাত হয়ে ওঠে।
পরদিন সকালে গ্রামে আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। মধুসূদন মাস্টারমশাই নিজের হাত ধরে মুক্তাকে স্কুলে নিয়ে যান। পঞ্চায়েতের লোকজন হাটের ধারে দাঁড়িয়ে হুমকি দেয়, কিন্তু গ্রামের কয়েকজন সাহসী মানুষ—পুরনো চাষি ধনঞ্জয় কাকা, বিধবা রমা বৌদি, পানের দোকানের হরিধন—চুপিচুপি পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা ফিসফিসিয়ে বলে, “মেয়েটা যেন পড়ে, আমরা আছি।” সমাজের দেওয়ালে যে ফাটল ধরেছিল, সেই ফাটল আজ আরও বড় হয়। মুক্তা বারান্দায় বসে নতুন অক্ষর শেখে, শব্দ গঠন করে, নিজের নামের পাশে মায়ের নাম লিখে দেয়, আর সেই মুহূর্তে আকাশের মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদের কিরণ তার খাতার পাতায় পড়ে। মাস্টারমশাই বলেন, “মুক্তা, তুই দেখিয়ে দিচ্ছিস, মেয়েমানুষের বিদ্যা পাপ নয়, আশীর্বাদ।” গ্রামের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে নতুন কথা—“মুক্তা শিখছে, আমাদের মেয়ে শিখছে, সমাজ বদলাবে।” সমাজের দেওয়ালে ছোট্ট একটা ফাটল আজ নতুন দিনের আশার ছবি আঁকতে শুরু করে।
অধ্যায় ৮: বিদ্যার দীপ জ্বলে ওঠে
শীতলডাঙ্গার আকাশে সেদিন সকালটা যেন আলাদা হয়ে উঠেছিল। ভোরের আলো ফুটতেই চারপাশে নতুন কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। গ্রামের মাটির পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুক্তার পায়ের ছাপ পড়ে থাকল ভেজা মাটিতে। তার হাতে মায়ের দেওয়া ছোট্ট খাতা আর পেনসিল, চোখে জেদ আর মুখে শান্তি। পঞ্চায়েতের হুমকি, কুশল মোড়লের চোখরাঙানি, গজারু কাকার বাঁকা হাসি—সব পেরিয়ে সে আজ স্কুলের বারান্দায় দাঁড়াল আরও একবার। মধুসূদন মাস্টারমশাই তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, “আজ তোকে নতুন গল্প পড়াব। আজ তুই নিজে লিখে পড়বি।” মুক্তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে যায়, কিন্তু পা আর পিছু হটে না। খাতার পৃষ্ঠায় সে প্রথমবার নিজের পুরো নাম লিখল স্পষ্ট অক্ষরে—“মুক্তা মণ্ডল।” সেই নামের অক্ষরগুলো দেখে মাস্টারমশাই আনন্দে চোখে জল টেনে রাখলেন। তিনি বললেন, “তুই জিতে গেছিস মা, এই সমাজের দেওয়ালে তুই প্রথম দাগ কেটেছিস।” সেই সময় হালকা হাওয়া বইল বারান্দা দিয়ে, শালগাছের পাতা ঝরে পড়ল মুক্তার খাতার উপর, আর সে মনে মনে ভাবল, এই পাতা যেন বিদ্যার আশীর্বাদের প্রতীক। ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামের কিছু শিশু দৌড়ে এসে বলল, “মুক্তাদি, তুই আমাগোও শেখাবি?” মুক্তার চোখ চকচক করে উঠল, তার মনে হল অক্ষরের দীপ এবার আরও দূরে ছড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু সমাজ এত সহজে হার মানে না। বিকেলেই পঞ্চায়েতের বৈঠক বসল বটগাছের তলায়। কুশল মোড়ল গলা চড়িয়ে বলল, “এখনই থামা দরকার। না হলে এই মেয়েকে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। মেয়েমানুষ বিদ্যা শিখছে! এ যে অভিশাপ নামিয়ে আনবে!” গজারু কাকা আর তান্ত্রিক গোপালও তালে তালে কথা বলল, “দেবতা রুষ্ট হবেন। কালই পুজো দিতে হবে, নয়তো ফসল নষ্ট হবে।” চিত্তরঞ্জনের বুকে যেন পাথর চেপে বসে। কিন্তু এবার সে আর একা নয়। গ্রামের চাষি ধনঞ্জয় কাকা, পানের দোকানি হরিধন, বিধবা রমা বৌদি আর কয়েকজন সাহসী মানুষ একসাথে পঞ্চায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। তারা বলে, “মেয়েটা তো শুধু নিজের নয়, আমাদের আশাও জাগিয়ে তুলছে। ওকে থামাতে দেব না।” সেই মুহূর্তে বাতাসে যেন বিদ্রোহের গন্ধ ছড়িয়ে যায়। সরলা মণ্ডল মেয়ের হাত ধরে থাকে শক্ত করে, আর মনে মনে প্রার্থনা করে, “হে ঈশ্বর, এ লড়াইয়ে আমাদের জিতিয়ে দাও।” সেই রাতটা ঘরে ঘরে আলো জ্বেলে রাখে অনেকে, যেন সমাজের অন্ধকারে বিদ্যার দীপ জ্বলে ওঠে।
রাতের নীরবতায় মুক্তা কুপির আলোয় বসে নতুন অক্ষর শেখে, “ভালোবাসা, আশার আলো, সাহস, শক্তি।” তার ছোট্ট আঙুলে পেন্সিলের দাগ, চোখে ঘুম নেই, কপালে ঘাম। কিন্তু সেই ঘাম তার পরিশ্রমের প্রমাণ, আর চোখের জ্যোতি তার স্বপ্নের দীপ্তি। চিত্তরঞ্জন দূর থেকে মেয়েকে দেখে আর ভেতরে ভেতরে গর্বে ভরে যায়। তার মন জুড়ে আজ একটাই কথা—এই মেয়েটাই একদিন সমাজের শিকল ভাঙবে। ভোর হবার আগে মুক্তা জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। দূরের তারা মিটিমিটি জ্বলছে, যেন সেই ছোট মেয়ের স্বপ্নকে আশীর্বাদ করছে। মুক্তা মনে মনে বলে, “আমার বিদ্যার দীপ একদিন পুরো শীতলডাঙ্গায় আলো ছড়াবে।” সেই ভোরের প্রথম আলোয় পাখিরা গান গায় আর হাওয়া বয়ে যায়, নতুন দিনের আশ্বাস নিয়ে।
অধ্যায় ৯: সাহসের কুয়াশায় সকাল
শীতলডাঙ্গার আকাশে সেদিন কুয়াশার চাদর পাতা ছিল। ভোরের আলোয় মাঠের ঘাসে শিশিরের বিন্দুগুলো মুক্তার চোখের মতোই জ্বলজ্বল করছিল, যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল স্বপ্নের দীপ্তি। সেই সকালে পঞ্চায়েতের চূড়ান্ত হুমকির খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গেল—“মণ্ডল পরিবারকে সমাজচ্যুত ঘোষণা করা হবে যদি মেয়ে স্কুলে যেতে থাকে।” কুশল মোড়ল, গজারু কাকা আর গোপাল তান্ত্রিক মিলে বৈঠকে সমাজের নিয়মের কথা বলে চিত্তরঞ্জনকে চেপে ধরল। চিত্তরঞ্জন সেই কথা শুনে চুপ করে বসে থাকে, বুকের ভেতর বেদনার ঢেউ ওঠে। কিন্তু তার চোখে তখন মেয়ের মুখ ভাসে, সেই ছোট মুখে জেদ, সেই চোখে অক্ষরের আলো। চিত্তরঞ্জন জানে, সমাজের শাসন অটল, কিন্তু মেয়ের স্বপ্নের চেয়ে বড় নয়। সেই সকালে মুক্তা খাতা আর পেনসিল হাতে নিয়ে যখন স্কুলের পথে পা বাড়ায়, তখন কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্যের আলো তার মুখে পড়ে। চারপাশের বাঁকা চোখ, ফিসফাসানি, শিস, হুমকির শব্দ তাকে আর থামাতে পারে না। স্কুলের বারান্দায় গিয়ে সে বসে পড়ে, মাস্টারমশাই তার কাঁধে হাত রেখে বলেন, “তুই সাহসী মেয়ে, মুক্তা। এই কুয়াশার সকাল একদিন বিদ্যার আলোয় ভরে উঠবে।”
গ্রামে কিন্তু উত্তেজনার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চায়েতের চূড়ান্ত হুকুমে কিছু মানুষ ভয়ে সরে যায়, কিন্তু কিছু মানুষের মধ্যে সাহসের সুর বেজে ওঠে। পানের দোকানের হরিধন, বিধবা রমা বৌদি, চাষি ধনঞ্জয় কাকা, এমনকি দুই-একজন যুবকও মুখ খুলতে শুরু করে। তারা বলে, “এভাবে তো চলতে পারে না! একটা মেয়ের স্বপ্ন সমাজের নিয়মে মরে যাবে?” চিত্তরঞ্জনের বাড়ির সামনে রাতের বেলা জড়ো হয় পঞ্চায়েতের লোকজন, মশাল হাতে হুমকি দেয়, “কাল থেকে মেয়েকে স্কুলে যেতে দেখলে সর্বনাশ হবে।” চিত্তরঞ্জনের বুক ফেটে যায়, কিন্তু সরলার দৃঢ় কণ্ঠ শোনা যায়, “আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু মেয়ের স্বপ্নের দাম জানি।” সেই রাতটা ঘরের মধ্যে কেঁপে থাকা আলোয় কেট যায়, বাইরে শিয়ালের ডাক, বাতাসে কাঁপা বাঁশঝাড়, আর ভেতরে মেয়ের খাতার পাতায় লেখা অক্ষরের নীরব শপথ। মুক্তা জানে, আর পিছু হটার জায়গা নেই। এই লড়াই তার নিজের নয়, সমাজ বদলের লড়াই। সেই রাতে সে বারবার লিখতে থাকে—“ভালোবাসা, সাহস, স্বপ্ন, শিক্ষা”—এই শব্দগুলো তার অক্ষরের যুদ্ধের অস্ত্র হয়ে ওঠে।
ভোরের আলো ফুটতেই মুক্তা আর চিত্তরঞ্জন দুজনেই একসাথে স্কুলের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে পঞ্চায়েতের শাসনের ছায়া, সামনে বিদ্যার আলোয় ভরা নতুন দিনের আশ্বাস। পথে কিছু মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ কেউ সসম্মানে মাথা নোয়ায়, কেউ বা ভয়ে মুখ লুকায়। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের বারান্দায় পৌঁছে মুক্তা যখন খাতার পাতা খুলে অ, আ, ক, খ লিখতে শুরু করে, তখন মনে হয় কুয়াশার পর্দা সরিয়ে এক নতুন সকাল জন্ম নিচ্ছে শীতলডাঙ্গায়। মাস্টারমশাই চিত্তরঞ্জনের দিকে চেয়ে বলেন, “আজ থেকে তোর মেয়ের অক্ষরের আলোয় এই সমাজের অন্ধকার কেটে যাবে। তুই আর একা নোস চিত্তরঞ্জন, আমরা আছি।” দূরের আকাশে সূর্য আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, শালমহুয়ার পাতায় রোদ্দুর খেলে যায়, আর মুক্তার অক্ষরের পথে সাহসের কুয়াশা ছিঁড়ে নতুন গল্পের শুরু হয়।
অধ্যায় ১০: অক্ষরের আলোয় সমাজ বদল
শীতলডাঙ্গার সেই সকালে সূর্যের আলো যেন অন্যরকম দীপ্তি নিয়ে উঠল। ভিজে মাটির গন্ধে মিশে ছিল নতুন আশার ঘ্রাণ। খোলা আকাশের নীচে মুক্তা তার ছোট্ট খাতা আর পেনসিল হাতে স্কুলের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল, আর সেই পথে শাল, মহুয়া আর বটগাছের ছায়া যেন তার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। মায়ের চোখে সেদিন প্রথমবার কোনো ভয়ের রেখা ছিল না, ছিল গর্বের দীপ্তি। চিত্তরঞ্জন কাঁধে হাত রেখে বলল, “যা মা, আজ তুই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবি।” গ্রামের পথে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ আজ আর বাঁকা কথা বলেনি; বরং নীরবে মেনে নিয়েছে এক ছোট মেয়ের সাহসিকতা। মাস্টারমশাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুক্তাকে দেখে হেসে বললেন, “আজ তুই নিজের লেখা দিয়ে এক নতুন ইতিহাস লিখবি।” খাতার পাতায় অক্ষর গেঁথে মুক্তা লিখল—“আমরা পারি।” সেই শব্দগুলো যেন শুধু কাগজে লেখা নয়, সমাজের দেওয়ালে আঁকা এক নতুন গল্পের শুরু। দূর আকাশে উড়ে যাওয়া পাখিদের ডানায় যেন সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আর শীতলডাঙ্গার বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল অক্ষরের আলো।
কিন্তু সমাজের শেকল ভাঙা সহজ নয়। পঞ্চায়েতের বৈঠক বসল আবার, কিন্তু এবার সেই বৈঠকে আগের মতো গর্জন শোনা গেল না। কুশল মোড়লের চোখের ভাষা নরম হয়ে এল, গজারু কাকার মুখে পড়ল চুপচাপির ছাপ, আর তান্ত্রিক গোপাল আর কোনো মন্ত্র পড়ল না, বরং চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল, এক মেয়ের অক্ষরের আলো সমাজের অন্ধকারকে কেটে ফেলেছে। গ্রামের অনেকেই আজ মুক্তার পাশে এসে দাঁড়াল—যুবক-যুবতী থেকে বৃদ্ধ-প্রবীণ পর্যন্ত। কেউ বলল, “আমার মেয়েও পড়বে,” কেউ বলল, “আমরা বই কিনে দেব।” সেই দিনের বিকেলে গ্রামের ছোট্ট মাঠে মধুসূদন মাস্টারমশাই ছোট্ট পাঠশালার কথা ঘোষণা করলেন, যেখানে মেয়েরাও শিখবে, লিখবে, বড় হবে। পঞ্চায়েতও আর বাধা দিল না। চিত্তরঞ্জনের বুকের ভেতর জমে থাকা বেদনা জল হয়ে গড়িয়ে পড়ল চোখ বেয়ে, কিন্তু সেই জল ছিল আনন্দের, গর্বের, স্বপ্নের সজল ভাষা।
সন্ধের সময় শীতলডাঙ্গার আকাশে তারা ফুটল অন্য দিনের মতো, কিন্তু মাটিতে ছিল অন্যরকম শান্তি। মুক্তা সেই রাতে খাতার পাতায় লিখল—“স্বপ্ন, সাহস, শিক্ষা, সমাজ।” তার ছোট হাতের লেখা কাগজের পাতায় দীপ্তি ছড়াল, কুপির আলোয় সেই অক্ষরগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চিত্তরঞ্জন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “আমার মেয়ের অক্ষর সমাজ বদলাবে।” মাস্টারমশাই নিজের বারান্দায় বসে চুপিচুপি বললেন, “আজ শীতলডাঙ্গার সত্যি নতুন ভোর।” গ্রামের গাছপালা, মাটির ঘর, কাঁচা রাস্তা—সবই আজ সেই অক্ষরের আলোয় স্নান করল। মুক্তার লেখা দিয়ে শুরু হলো শীতলডাঙ্গার নতুন গল্প—যেখানে বিদ্যা অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ; যেখানে মেয়ের স্বপ্ন সমাজের গর্ব। আর সেই গল্প চলতে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, অক্ষরের দীপ্তি হয়ে।
সমাপ্ত




