Bangla - রহস্য গল্প

মা দুর্গার সোনার টিপ

Spread the love

সায়ন ঘোষ


এক

শ্যামতলা সর্বজনীন দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সন্ধ্যা, কলকাতার উত্তর শহরের এক পুরনো পাড়ার ভেতরে ছায়া-আলোয় জ্বলজ্বল করে ওঠা ঐতিহ্য আর বিশ্বাসের মেলবন্ধন। সন্ধ্যা ছ’টার পর থেকেই প্যান্ডেলে মানুষের ঢল নেমেছে—মেয়েরা নতুন শাড়িতে, ছেলেরা পাঞ্জাবি-পাজামায়, কারও হাতে ধূপকাঠি, কারও হাতে প্রসাদ আর সবার চোখে অদ্ভুত এক উজ্জ্বল আলো, যেন বছরের এই ক’টা দিনের মধ্যেই আটকে আছে জীবনের আসল আনন্দ আর আশা। ঢাকের বাজনা, কাঁসর-ঘণ্টা আর শঙ্খের ধ্বনি মিলে বাতাস ভারী হয়ে আছে, আর তার মধ্যেই বসানো হয়েছে মায়ের প্রতিমা—ছয় হাত উঁচু, সাদা সাঁকোয় দাঁড়িয়ে থাকা, সোনার গয়নায় সজ্জিত মুখ, যাকে ঘিরে রয়েছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, আর পেছনে মহিষাসুরকে বধরত রূপে দশভুজা মা দুর্গা। মণ্ডপের ছাদে ঝুলছে কাগজের চূড়া, কাপড়ের ঝাড়, আর রঙিন আলোয় স্নাত চেহারা যেন জ্যান্ত মনে হয় প্রতিটি ভক্তের চোখে। রূপসা সেনগুপ্তও সেই ভিড়ের মধ্যে, তার চোখে আছে ভক্তি আর জিজ্ঞাসার মিশেল—কারণ এই পুজো শুধুই উৎসব নয়, তার শিকড়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পরিচয়, ছোটবেলার স্মৃতি, আর বাবার কথা, যিনি একসময় এই কমিটির অন্যতম প্রাণ ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পরও এই পুজোয় আসা রূপসার কাছে একরকম মানসিক বন্ধন—প্রতিবার সে প্রতিমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, “মা, আমায় শক্তি দাও।” আজকের সন্ধ্যায়ও ঠিক তেমনই সে ভিড় ঠেলে দাঁড়াল প্রতিমার সামনে, কপালে একটু প্রসাদ ছুঁইয়ে নিঃশ্বাস নিল ধূপ-ধুনোর গন্ধ মেশানো বাতাসে, আর ভাবল—এবারের পুজোয় যেন সব ভালো হয়, কারণ গত বছর করোনা আর অর্থনৈতিক টানাটানিতে পুজো ঠিকমতো আনন্দ দিতে পারেনি।

কিন্তু সেই মুহূর্তেই হঠাৎ এক অস্বাভাবিক কোলাহল ভিড়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল—কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, “দ্যাখো! মায়ের কপাল খালি! সোনার টিপ কোথায় গেল?” চারপাশে চোখ বড় বড় করে তাকালো সবাই, ঢাকে এক মুহূর্তের জন্য তাল কেটে গেল, বাতাসে ধূপের ধোঁয়ার ভেতরেও টের পাওয়া গেল ভয়ের গন্ধ। মণ্ডপের ভেতরের স্বেচ্ছাসেবকেরা ছুটোছুটি শুরু করল, সভাপতি বিশ্বনাথ দত্ত তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলেন, সেবাইত রঘুবাবু কপালে হাত দিয়ে বললেন, “ওগো মা!” রূপসা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না, তারপর তাকিয়ে দেখল—হ্যাঁ, সত্যিই মায়ের কপাল ফাঁকা, সোনার টিপ, যা প্রায় একশো বছরের পুরনো আর এই পুজোর গর্ব, উধাও! এমন ঘটনা কোনোদিন শোনা যায়নি, প্যান্ডেলের ভেতর-ই ঘটেছে, অথচ এত মানুষের ভিড়, আলো, সিসিটিভি ক্যামেরা, স্বেচ্ছাসেবকের নজর—সবকিছু থাকার পরেও! ভিড়ের মধ্যে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়তে লাগল: কেউ বলল অভিশাপ, কেউ বলল চুরি, কেউ আবার মুখ টিপে বলল, “ভেতরের কেউ না হলে এটা সম্ভবই নয়।” রূপসার মাথায় যেন ঝড় বয়ে গেল, কানে ঢুকল না কারও কথা, চোখ আটকে রইল মায়ের মুখে—যেখানে টিপের জায়গায় এখন কেবল ফাঁকা সাদা মাটি, আর সেই ফাঁকা দেখে অজানা এক কষ্ট বুকের ভেতর জমে উঠল। এ পুজো কমিটির সঙ্গে তার ছোটবেলা থেকে কত স্মৃতি—প্রতিমা গড়ার দিনগুলো, বোধনের সন্ধ্যা, অঞ্জলির ভিড়, আর বাবার গলা, “দ্যাখ, রূপসা, ঐ টিপটা আমাদের পরিবারের দেওয়া”—সেই টিপ এখন নেই! রূপসা দেখল অঙ্কন ঘোষাল, তার কলেজের বন্ধু আর ফটোগ্রাফার, প্যান্ডেলের এক কোণ থেকে ক্যামেরা হাতে তাকিয়ে আছে; চোখাচোখি হতেই ও এগিয়ে এল, চাপা গলায় বলল, “তুই দেখলি? এমন কীভাবে হতে পারে?” রূপসা মাথা নাড়ল, জবাব দিতে পারল না, কারণ ভেতরে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে—যদি এটা শুধু চুরি হয়, তাহলে চোর এত বড় ঝুঁকি নেবে কেন? আর যদি এটা কোনও বার্তা দেওয়ার জন্য হয়, তাহলে কে সেই বার্তাবাহক?

মিনিট দশেকের মধ্যে পুলিশ এল, কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারি সবাই মিলে ঘিরে ধরল মণ্ডপ, ভেতরের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল। ভিড় ছাঁটাই করে বের করে দিল দর্শনার্থীদের, শুধু কমিটির লোক, স্বেচ্ছাসেবক আর সাংবাদিকদের রাখা হল ভেতরে। রূপসা নিজের পেশাদার পরিচয় দেখিয়ে থেকে গেল, কারণ তার ভেতরের সাংবাদিক মন বলছে—এ গল্প শুধু এক টুকরো সোনার চুরির নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক বড় কিছু। সিসিটিভি ফুটেজ আনানো হল, দেখা গেল ঠিক ষষ্ঠীর সন্ধ্যা ছ’টা ত্রিশের পর থেকে ভিডিও বন্ধ! এমন কাকতালীয়ভাবে কারেন্ট যায়নি, প্যান্ডেলের বাইরে আলো জ্বলছে—তাহলে? সভাপতি মুখ কালো করে বললেন, “সব ঠিক করেছিলাম, কীভাবে এমন হল!” রঘুবাবু, যিনি কমিটির সবচেয়ে পুরনো সেবাইত, নিঃশব্দে বসে রইলেন, মুখে একরকম অভিশপ্ত বিষাদের ছাপ। রূপসা এগিয়ে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “রঘুবাবু, এমন আগে কখনও হয়েছে?” বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “না, মা-র টিপ তো অভিশাপের থেকেও বড় আশীর্বাদ… একবার কেউ টিপ বিক্রি করতে গিয়েছিল, তারপর কী হল জানিস?” রূপসা শুনতে চাইল, কিন্তু ঠিক তখনই অঙ্কন ওকে ইশারা করল—তার তোলা ছবিতে কিছু ধরা পড়েছে। রূপসা ওর ক্যামেরার ডিসপ্লেতে তাকিয়ে দেখল, ভিড়ের মধ্যে এক অচেনা ছেলেকে—চোখ নীচু, মুখে অদ্ভুত কঠোরতা, আর ষষ্ঠীর আরতির ঠিক আগের মুহূর্তে সে মণ্ডপের পেছনের গলি দিয়ে ঢুকছিল। কে এই ছেলে? রূপসার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ শুরু হল। প্যান্ডেলে ঢাক আবার বেজে উঠল, ঢোল-ঢাকের গর্জনে চাপা পড়ে গেল মানুষের ফিসফাস, কিন্তু রূপসা বুঝল—এবার শুধু সাংবাদিক নয়, তাকে হতে হবে সত্য খোঁজার পথের এক অনুসন্ধানী। কারণ মা দুর্গার কপালে যে টিপ ছিল, সেটি শুধু সোনার গয়না নয়, বরং এই পুজোর ইতিহাস আর আত্মার প্রতীক—আর সেই প্রতীকের হারানো মানে হয়তো অনেক গভীর এক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত। প্যান্ডেলের রঙিন আলো আর ধূপের ধোঁয়ার ভেতর, অদৃশ্য কারও পায়ের ছাপ রেখে গেছে এক অদৃশ্য রহস্য, আর রূপসা জানে—এখন তাকে সেই ছাপের পথেই হাঁটতে হবে।

দুই

সন্ধ্যার হুল্লোড় আর কোলাহল থেমে গেলেও রূপসার ভেতরের উত্তেজনা থামল না, বরং আরও গভীরভাবে গেঁথে গেল হৃদয়ের মধ্যে। মণ্ডপের ভেতর তখন শোনা যাচ্ছে ঢাকিদের ক্লান্ত ঢোলের শেষ শব্দ, ফিসফিস করে কমিটির লোকজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, কেউ বা ফোনে পুলিশের সাথে কথা বলছে, আবার কেউবা হাপুস নয়নে কাঁদছে—মায়ের গহনা চুরি হয়ে যাওয়া এই পুজো কমিটির জন্য শুধু লজ্জার নয়, একপ্রকার কলঙ্কও বটে। রূপসা ভেতর থেকে এই পুজোর সঙ্গে বড় হয়েছে—ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে মণ্ডপে এসে দাঁড়ানো, প্রতিমা গড়ার দিনগুলোতে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে দেখা, মায়ের চোখে টিপ লাগানোর সময় বাবার গলা শুনে শিহরণ অনুভব করা—সবই আজ মনে পড়ছে। সেই টিপ হারানোর শোক যেন তার নিজের হৃদয় ছিঁড়ে দিচ্ছে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, মা যেন রাগে-ক্ষোভে চুপ করে গেছেন; ধূপের ধোঁয়ার মধ্যে সোনালি আলোর ঝলকানি আর নেই, ফাঁকা কপাল যেন অবিশ্বাস আর অভিমান নিয়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। রূপসা জানে, পেশায় সে একজন সাংবাদিক, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে শুধুমাত্র কাগজে খবর লেখার চেয়ে বড় দায়িত্ব আছে তার উপর। পুলিশের জেরায় কারও কাছ থেকে সঠিক উত্তর আসছে না; কমিটির সভাপতি বিশ্বনাথ দত্ত বারবার বলছেন, “এ তো অসম্ভব, আমাদের মধ্যে কেউ এমন করবে না!” অথচ সিসিটিভির ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—ক্যামেরা ঠিক ওই সময়েই বন্ধ হয়ে গেছে। রূপসা ভাবে, এত বড় চুরি বাইরে থেকে আসা কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়, প্যান্ডেলের ভেতরের কোনো লোক না জড়ালে এটা হতে পারে না। সেবাইত রঘুবাবুর কথাগুলো মাথায় ঘুরতে থাকে: “মা-র টিপ অভিশপ্ত… একবার কেউ বিক্রি করতে চেয়েছিল…” কে সেই ‘কেউ’? কেন সেই ঘটনার কথা এত বছর বাদেও মানুষ ভয় পায়?

রূপসা জানে, শুধু সাংবাদিকের চোখে দেখলে হবে না, তাকে দেখতে হবে একজন মেয়ের চোখে, যে এই পুজোকে ভালোবাসে; দেখতে হবে সেই রূপসা হয়ে, যে ছোটবেলায় মায়ের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, “মা, আমি কখনও মিথ্যা বা অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না।” অঙ্কন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ওর তোলা ছবিতে দেখা সেই অচেনা ছেলের ছবি বারবার দেখছে রূপসা—কে এই ছেলে, যে প্যান্ডেলের ভিড়ের মধ্যে অচেনা মুখ নিয়ে ঢুকেছে? অঙ্কন গম্ভীর গলায় বলে, “রূপসা, তুই দেখেছিস? ছেলেটার চোখে কেমন একটা রাগ আছে, আর মাথা নিচু করে হাঁটছে, যেন কিছু লুকোচ্ছে।” রূপসা মাথা নাড়ে, “আমি খুঁজে বের করব ওকে।” এটাই তার নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিজ্ঞা—সত্যি খুঁজে বের করব, কারণ মা দুর্গার কপালে টিপ চুরি করা শুধু এক টুকরো সোনার চুরি নয়, এ একধরনের অসম্মান, যেটা সহ্য করা যায় না। প্যান্ডেলের ভেতরের বাতাসে ধূপের গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে অবিশ্বাস আর ভয়ের গন্ধ, আর তার মধ্যেই রূপসা সিদ্ধান্ত নেয়—পুলিশের ওপর ভরসা না করে নিজেই অনুসন্ধান করবে। অঙ্কন রাজি হয়, “তুই যেদিকেই যাবি, আমি তোকে সঙ্গ দেব।” রূপসা জানে, অঙ্কন শুধু ফটোগ্রাফার নয়, বরং এক বিশ্বস্ত সঙ্গী, যার তোলা প্রতিটি ছবি অনেক সময় কথা বলে যা চোখে দেখা যায় না। ওরা ঠিক করে, কাল সকালেই কমিটির পুরনো নথি, মণ্ডপের চারপাশের রাস্তা, স্বেচ্ছাসেবক আর কর্মীদের খোঁজ শুরু করবে। প্যান্ডেলের পেছনের সরু গলিটা, যেখান দিয়ে সেই ছেলেটি ঢুকেছিল, ওদের প্রথম লক্ষ্য।

রাত বাড়ে, মণ্ডপ প্রায় ফাঁকা হয়, ঢাকিদের ঢোল থামে, বাতাস ঠান্ডা হতে থাকে, কিন্তু রূপসার ভেতরের আগুন নিভে না। প্যান্ডেলের মায়ের প্রতিমার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, মায়ের চোখ যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে—“তুই ছাড়িস না, রূপসা।” ছোটবেলায় বাবার মুখ মনে পড়ে যায়, যিনি একবার বলেছিলেন, “যখন সবাই চুপ থাকে, তখন সত্যকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিজের হাতে নিতে হয়।” রূপসা সেই কথাই মনে মনে বলল, “আমি খুঁজবই।” অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে হাসল একবার—তাদের বন্ধুত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বোঝাপড়া আর আস্থার বন্ধন ওকে সাহস দেয়। দুই বন্ধু মণ্ডপ ছাড়ে রাত প্রায় বারোটার সময়, কিন্তু যাবার সময় রূপসা একবার ফিরে তাকায়—মায়ের কপালে ফাঁকা জায়গাটা অন্ধকারের মধ্যে আরও স্পষ্ট, আর সেটাই তাকে মনে করিয়ে দেয়, এই লড়াই এখন তার নিজেরও। মণ্ডপের চারপাশে আলো টিমটিম করে জ্বলছে, কিন্তু সেই আলোয় সত্যের রাস্তাটা এখনো অন্ধকারে ঢাকা। ভিড় নেই, কেবল দূর থেকে ঢোলের আওয়াজ ভেসে আসে, আর বাতাসে লেগে থাকে ধূপের গন্ধ। রূপসা ভাবে—যদি এ শুধু সোনার চুরি হত, তাহলে হয়তো পুলিশই সমাধান করে ফেলত, কিন্তু এখানে তো অন্য কিছু আছে; হয়তো লুকিয়ে আছে পুরনো শত্রুতা, প্রতিশোধ, কিংবা এক অজানা ইতিহাস, যা আজও প্রকাশ পায়নি। প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে রূপসা হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে আবার বলে, “মা, আমায় শক্তি দাও, আমি এই সত্যি বের করব।” আর সেই অদৃশ্য অন্ধকারের মাঝেই, তাদের দুজনের ছায়া পড়ে লম্বা হয়ে যায় মণ্ডপের মাটিতে, যেন অদূরেই লুকিয়ে আছে সেই রহস্য, যা উন্মোচনের অপেক্ষায়।

তিন

রূপসা আর অঙ্কনের রাতের সেই প্রতিজ্ঞার পরের সকালটা যেন এক অদ্ভুত অস্থিরতায় ভরা ছিল। শ্যামতলা সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মণ্ডপের চারপাশে সকাল থেকেই কৌতূহলী মানুষের ভিড় লেগেই আছে—কে চুরি করল, কীভাবে করল, কারা দোষী—এই সব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। প্যান্ডেলের ভেতর ঢোকার মুখে বড় বড় খবরের কাগজের সাংবাদিকেরা ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কেউ কমিটির সভাপতিকে ঘিরে ধরছে, কেউবা স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে কিছু জানার চেষ্টা করছে। রূপসা পেশাদার সাংবাদিকের মতো নয়, বরং অনেকটা ভেতরের একজনের মতো প্যান্ডেলের মধ্যে ঢুকল, চোখের দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই ছেলেটাকে—যে ছবি দেখা গিয়েছিল অঙ্কনের ক্যামেরায়। কিন্তু ছেলেটির আর দেখা নেই, নামও কেউ বলতে পারল না; অনেকে বলল নতুন স্বেচ্ছাসেবক, কেউ বলল রাতে একবার দেখেছে, কিন্তু পরে আর খুঁজে পায়নি। রূপসা ভাবল, এমন বড় চুরি পরিকল্পনা ছাড়া হয় না—তাহলে পরিকল্পনা করেছে কে? প্যান্ডেলের পেছনের গলিটা যেটা অন্ধকার, সেখানেই চাবির ছোঁয়ায় খোলা থাকে একটা ছোট লোহার দরজা—সেটাই হয়তো চোরের রাস্তা। কিন্তু এই রাস্তাটা জানত খুব অল্প মানুষই, যাদের মধ্যে কমিটি আর পুরনো কর্মীরাই প্রধান। রূপসা টের পেল, সোনার টিপ চুরির পেছনে শুধু লোভ নয়, বরং হয়তো আছে কোনো পুরনো আক্ষেপ, অভিমান বা প্রতিশোধের গল্প, যা প্রকাশ পায়নি এতদিন।

অঙ্কন রূপসার পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বলল, “তোর মনে আছে, রঘুবাবু কাল কী বলেছিল? টিপ নাকি অভিশপ্ত!” রূপসা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আমি কাল থেকেই ভাবছি, সেই গল্পটা পুরোটা শোনার দরকার।” ওরা রঘুবাবুর কাছে গেল, যিনি সকালে ধূপকাঠি জ্বালাচ্ছিলেন, মায়ের চরণে ফুল রাখছিলেন—বয়সের ভারে একটু কুঁজো হয়ে গেছেন, কিন্তু চোখের ভেতর এখনো জ্বলছে এক অদ্ভুত স্মৃতির আগুন। রূপসা খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “রঘুবাবু, কাল যে কথাটা বলছিলেন, সেটা পুরো বলবেন?” রঘুবাবু ধোঁয়ায় ভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, “বছর পঞ্চাশেক আগের কথা, মা-র টিপ ছিল না তখন সোনার, ছিল কপালের এক লাল পাথর। কমিটির এক নতুন কোষাধ্যক্ষ, নাম ছিল বালারাম মিত্র—তিনি বললেন, মা-কে রাজরানীর মতো সাজাতে হবে, আর সেই জন্যে দিলেন এই সোনার টিপ। কিন্তু শোনা যায়, বালারামবাবু পরে সেই টিপ বিক্রি করার চক্রান্ত করেছিলেন, কারণ কমিটির টাকা কমে যাচ্ছিল, আর তাঁর নিজেরও নাকি কিছু দেনা ছিল। তখন এই মণ্ডপের প্রতিমা গড়তেন এক শিল্পী, নাম ছিল বিমল পাল। খুব গরিব, কিন্তু ভক্তি দিয়ে প্রতিমা গড়তেন। খবর পেয়ে বিমলবাবু এত লজ্জা পেলেন, এত দুঃখ পেলেন যে, মা দুর্গার অলংকার বিক্রি হবে—সেই লজ্জায় আর অভিমানে এক রাতেই আত্মহত্যা করে বসলেন।” রূপসার গলা শুকিয়ে গেল, “তারপর?” রঘুবাবু বললেন, “তারপর থেকেই টিপ নিয়ে গুজব—যদি কেউ টিপ সরানোর কথা ভাবে, কোনো না কোনো অঘটন ঘটে। কেউ বলে অভিশাপ, কেউ বলে মায়ের অভিমান। কিন্তু ওটা শুধু গয়না নয় মা, ওটাই এই পুজোর আত্মা।” রূপসা শুনে শিউরে উঠল, কারণ এই ইতিহাস শুধু লোভ আর মৃত্যুর নয়, বরং এক শিল্পীর আত্মা আর মায়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার গল্পও বটে। রূপসা বুঝতে পারল, সোনার টিপ চুরি কেবল এখনকার ঘটনা নয়, বরং এর শিকড় গিয়ে মিশেছে সেই দিনের সাথে, যেদিন এক মানুষ নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে মা দুর্গা কেবল সোনায় নয়, বিশ্বাসে সজ্জিত।

রূপসা আর অঙ্কন একসাথে মণ্ডপের পেছনের গলির দিকে গেল, সেই লোহার দরজাটা দেখতে, যেখানে হয়তো সেই ছেলেটি ঢুকেছিল। দরজাটা ছোট, বাইরে থেকে সহজে দেখা যায় না, আর তালা খুলতে এক বিশেষ চাবি লাগে—যা আছে কেবলমাত্র কমিটির কয়েকজনের কাছে। রূপসা ভাবল, তাহলে সেই ছেলেটির কাছে এই চাবি এল কীভাবে? কমিটির মধ্যে থেকেই কেউ হয়তো তাকে সাহায্য করেছে। অঙ্কন তখন বলল, “আমরা ছেলেটাকে খুঁজে বের করতেই হবে, না হলে কিচ্ছু হবে না।” রূপসা মাথা নাড়ল, “আমরা শুরু করি আজই।” ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের পাশে দাঁড়াল রিয়া চ্যাটার্জি, এক নতুন স্বেচ্ছাসেবক মেয়ে, হাসি মুখে বলল, “তোমরা তো সাংবাদিক? আমি কালও দেখেছিলাম, ও ছেলে প্যান্ডেলের পেছনে গিয়েছিল। নাম শুনেছি দীপক।” এই প্রথম কোনো সূত্র পেল ওরা—নাম দীপক। রূপসা ভেতরে ভেতরে ভাবল, দীপক কে? আর কেনই বা এমন কাজ করতে যাবে? মণ্ডপের বাতাসে ঢাকের তাল আবার শুরু হয়, অঞ্জলির জন্য ভিড় বাড়তে থাকে, আর সেই ভিড়ের মধ্যে রূপসা দেখে মায়ের মুখ—যেখানে সোনার টিপের ফাঁকা জায়গাটা যেন চুপ করে তাকিয়ে আছে তার চোখে চোখ রেখে, মনে করিয়ে দিচ্ছে, “সত্যের পথ সহজ নয়, তবু তুই থামিস না।” রূপসা গভীর শ্বাস নিল, মনে মনে বলল, “মা, এবার আমি থামব না—তোমার টিপ ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত।”

চার

পুজোর ভিড় আর কোলাহলের মধ্যে থেকেও রূপসা আর অঙ্কনের মন যেন সম্পূর্ণ অন্য জগতে ছিল; তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছেলেটির ছবি—যার নাম তারা জানতে পেরেছে দীপক। অঙ্কনের তোলা ছবির দিকে তারা বারবার তাকাচ্ছে, যেন প্রতিটি রঙ, প্রতিটি ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো গোপন সংকেত। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায়—দীপক প্যান্ডেলের পেছন দিক দিয়ে ঢুকছে, তার মুখে অদ্ভুত এক ধরনের কঠিনতা, চোখে নীচু হয়ে থাকা ভঙ্গিতে চাপা রাগ, আর চলার মধ্যে এমন কিছু অভিব্যক্তি, যা স্পষ্টভাবে বলে দেয় সে কিছু একটা লুকোচ্ছে। রূপসা বুঝতে পারে, এই ছেলেটা হয়তো চোর, আবার হয়তো চোর নয়—বরং এমন একজন, যার মনে পুঞ্জীভূত হয়েছে অনেক দিনের অভিমান আর ক্ষোভ, যা তাকে এই চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। মণ্ডপের পেছনের সেই গলি, যেটি অন্ধকার আর প্রায় অদৃশ্য, সেটিই যেন সব রহস্যের সূত্র। রূপসা আর অঙ্কন সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়, দরজার তালা দেখে, তালার দাগে হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কখন খুলেছে, কতবার খুলেছে। অঙ্কন ফিসফিস করে বলে, “তুই দেখেছিস? তালার রঙে নতুন আঁচড়ের দাগ আছে, মানে খুব সম্প্রতি কেউ এটা খুলেছে।” রূপসা ভাবতে থাকে—তাহলে দীপকের কাছে কীভাবে এ চাবি এল? কমিটির কারো সাহায্য ছাড়া তো অসম্ভব। সেই কারা? সভাপতি বিশ্বনাথ দত্ত? নাকি অন্য কেউ? মনের মধ্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে, আর সেই অদৃশ্য ছেলেটির ছায়া যেন চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।

প্যান্ডেলের ভেতরে ফিরে আসতেই রূপসা চোখে পড়ে রঘুবাবুর দিকে, যিনি এক কোণে বসে চুপচাপ মন্ত্র জপ করছেন, আর চোখে দূর অতীতের কোনো দৃশ্য। রূপসা এগিয়ে গিয়ে ধীরে জিজ্ঞাসা করল, “রঘুবাবু, দীপক বলে কোনো নতুন স্বেচ্ছাসেবক কি আপনি চেনেন?” রঘুবাবু একটু চমকে তাকালেন, তারপর আস্তে বললেন, “হ্যাঁ মা, ছেলেটি এসেছিল—খুব চুপচাপ, কাজ করে, কথা কম বলে। কিন্তু চোখে মনে হয়েছিল অন্য কিছু আছে, যেন পুরনো কিছু বোঝায় ভার। তুমি কেন জিজ্ঞাসা করছ?” রূপসা বলল, “কারণ ছবিতে দেখা গেছে, ওই গলির দিকে যাচ্ছিল।” রঘুবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তোমরা সাবধানে থেকো মা, এই পুজোর ইতিহাসে অনেক অদ্ভুত জিনিস লুকিয়ে আছে।” রূপসা অনুভব করল, রঘুবাবুর চোখের গভীরে ভয়ের পাশাপাশি লুকিয়ে আছে দুঃখ আর অনুশোচনা—যা হয়তো সেই বালারাম মিত্রের ঘটনার সাথে জড়িয়ে। অঙ্কন তখন পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “চল রূপসা, রেকর্ডিং করি।” রূপসা ক্যামেরা চালু করল, রঘুবাবুর সাক্ষাৎকার নিতে চাইল, কিন্তু উনি অস্বীকার করলেন, “না মা, সব কথা ক্যামেরায় বলতে নেই, অনেক সত্যি আছে যা প্রকাশ করা বিপজ্জনক।” সেই কথার মধ্যে এক অদ্ভুত শীতলতা রূপসার মন কাঁপিয়ে দিল—যেন অজানা কোনো বিপদ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তবু সাংবাদিক হিসেবে রূপসা জানে, এই অস্বীকৃতিই প্রমাণ করে কিছু একটা সত্যিই লুকিয়ে আছে।

দিন গড়াতে গড়াতে সন্ধ্যা নামল, প্যান্ডেলে আবার ভিড় বাড়তে লাগল, ঢাকের গর্জন, কাঁসর, শঙ্খে বাতাস ভারী হয়ে গেল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রূপসা দেখল, টিপের ফাঁকা জায়গাটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আর সেই শূন্যতা যেন চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করছে—“তুই কি পারবি?” রূপসা মনে মনে বলল, “পারবই।” অঙ্কনের তোলা ছবিগুলো আবারও একবার খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল, আর তখনই দেখতে পেল নতুন কিছু—ছেলেটির জামার হাতায় লাল রঙের এক অদ্ভুত চিহ্ন, যেটা সাধারণ দাগ নয়, বরং এক ধরনের নকশা, যা পুরনো দিনের কোনো পরিবারের চিহ্ন হতে পারে। অঙ্কন চমকে বলল, “এটা কি মিত্র পরিবারের প্রতীক?” রূপসা ভাবল, যদি সত্যিই ছেলেটি মিত্র পরিবারের কেউ হয়, তবে কি সে সেই বালারাম মিত্রের আত্মীয়? আর যদি হয়, তবে কি সে এই চুরি করেছে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য? না কি প্রমাণ করার জন্য যে তার পূর্বপুরুষ অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন? মণ্ডপের ভেতরের আলো, ধূপের ধোঁয়া, মানুষের গলার শব্দ আর ঢাকের তালে তালে যেন সব মিলিয়ে এক জটিল ছায়ার খেলা খেলতে লাগল। আর সেই ছায়ার মধ্যেই রূপসা স্পষ্ট বুঝতে পারল—এ কেবল এক রাতের চুরি নয়, এ এক অভিশপ্ত ইতিহাসের মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রতিশোধ, অভিমান আর সত্যের খোঁজ। অদৃশ্য সেই দীপক হয়তো তাদের খুব কাছেই আছে, হয়তো তার হৃদয়েও লড়াই চলছে—সে কি চোর, না সত্য প্রকাশের যোদ্ধা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে, আর রূপসা জানে, সেই উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার লড়াই থামবে না।

পাঁচ

সপ্তমীর ভোরের আলো শহরের চিরচেনা কোলাহলের আগেই শ্যামতলা সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মণ্ডপে ছায়া ফেলল, আর সেই ছায়ার নিচেই রূপসা আর অঙ্কন দাঁড়িয়ে, চোখে লেগে আছে নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি আর উত্তেজনা। রাতের অন্ধকারে অঙ্কনের লেন্সে ধরা পড়া দীপকের সেই ছবি–অচেনা ছেলের মাথা নিচু, চোখের কোণে অভিমান, আর জামার হাতায় লাল নকশা–এখনও রূপসার চোখের সামনে ভাসছে। মায়ের প্রতিমার ফাঁকা কপাল যেন এক অদৃশ্য শূন্যতার বার্তা দিচ্ছে, আর সেই বার্তাই যেন রূপসাকে বলছে: “তুই খুঁজে বের কর সত্যিটা, ভয় পাস না।” রূপসা জানে, সত্য খুঁজতে গেলে শুধু চোখের দেখা বা কাগজের তথ্য নয়, প্রয়োজন হৃদয়ের কান দিয়ে শোনা, ছায়ার মধ্যে ছুটে বেড়ানো অস্পষ্ট আওয়াজকে বোঝা। মণ্ডপের পেছনের সেই সরু গলি, যেখানে প্রায় কেউ যায় না, রূপসা আর অঙ্কন আবারও সেখানে ঢুকল। দেয়ালে পুরনো পোস্টার, ভাঙা ইটের গায়ে শ্যাওলার ছাপ, আর বাতাসে একটা বদ্ধ গন্ধ—সব মিলিয়ে সেই জায়গা যেন নিজের ভেতরেই লুকিয়ে রাখে কোনো দুঃখ আর অভিমান। গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছে রূপসা থমকে দাঁড়াল, ভাবল, এই দরজার চাবি কেবল গোনা কয়েকজনের কাছে—তাহলে দীপকের কাছে এল কীভাবে? আর চুরি যদি কেবল লোভের কারণে হত, তবে এত সাহসিকতা, এত হিসাবি পরিকল্পনা কেন?

প্যান্ডেলে ফিরে এসে ওরা খুঁজল রঘুবাবুকে, সেই মানুষটি যিনি এই পুজোর জীবন্ত ইতিহাস, যার কণ্ঠে শোনা যায় অতীতের গল্প আর অজানা ভয়ের সুর। রূপসা এবার আর সরাসরি প্রশ্ন না করে, আলগোছে বলল, “রঘুবাবু, আপনার কাছে কি আছে বালারাম মিত্রের সেই দিনের কথা?” রঘুবাবুর চোখের পাতা কেঁপে উঠল, মুখের বলিরেখা যেন আরও গাঢ় হলো, আর দীর্ঘ নীরবতার পর ফিসফিস করে বললেন, “শোন মা… বালারামবাবু যা করেছিল, সেটা কেউ জানে না পুরোটা… আসলে তিনি চুরি করতে চাননি, শুনেছি কমিটির কারও হাত থেকে টিপ বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই প্রতিমা শিল্পী বিমল পাল ভুল বুঝে জীবন শেষ করল… আর সেই থেকে শোনা যায়, মা রাগ করেছেন, টিপ সরানো মানেই অঘটন।” এই গল্প রূপসার হৃদয়ে অদ্ভুত এক ঝড় তোলে; এতদিন যেটাকে নিছক চুরি ভাবা হচ্ছিল, সেটার পেছনে আছে অসমাপ্ত আত্মত্যাগের কাহিনি আর অপমানের ছায়া। সেই ছায়া যেন এখন ফিরে এসেছে, দীপকের হাত ধরে। অঙ্কন ধীরে ধীরে বলল, “রূপসা, যদি দীপক সত্যিই মিত্র পরিবারের কেউ হয়, তাহলে হয়তো সে চুরি করতে আসেনি, সত্যি প্রমাণ করতে এসেছে।” রূপসা চুপ করে মাথা নাড়ল; তার চোখে তখন অদ্ভুত এক মিশ্র ভাব–সাংবাদিকের কৌতূহল, আর এক মেয়ের হৃদয়ের টান, যে পুজোর মধ্যে শৈশব আর বাবাকে খুঁজে পায়। রূপসা অনুভব করল, দীপক হয়তো চোর নয়, বরং ইতিহাসের অন্যায় বোঝা বয়ে চলা এক তরুণ।

ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ রূপসা দেখল, প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেই নতুন স্বেচ্ছাসেবক রিয়া। রূপসা কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বলেছিলে দীপককে চেনো?” রিয়ার চোখে এক মুহূর্তের দ্বিধা, তারপর আস্তে বলল, “হ্যাঁ, ও আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়, আমরা এক পাড়ায় বড় হয়েছি। ওর দাদুর কথা ও ছোটবেলা থেকে শুনেছে, খুব কষ্ট পেত, বলত একদিন সত্যি সবাইকে দেখাবে।” রূপসা গভীর শ্বাস নিল; পুজোর আলোর নিচে রিয়ার মুখে সেই ব্যথা স্পষ্ট দেখা গেল, যা শুধু রক্তের সম্পর্কে নয়, শৈশবের শিকড়ে গাঁথা থাকে। অঙ্কন তখন পাশে বলল, “আমাদের ওকে খুঁজতে হবে, না হলে এই সত্য অন্ধকারেই থেকে যাবে।” রূপসা মনে মনে ভাবল, এই চেষ্টার মধ্যে শুধু একটি সংবাদ তৈরি নয়, বরং বহু বছর আগের এক শিল্পীর আত্মত্যাগ, এক পরিবারের অসম্মান, আর মায়ের প্রতিমার কপালের ফাঁকা হয়ে যাওয়া মানে বোঝার লড়াই। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রূপসা দেখল, সেই ফাঁকা টিপের জায়গা যেন জ্বলছে, যেন বারবার বলছে, “তুই থামিস না, সত্যি বলার জন্য যত দূর লাগে যা।” আর সেই ছায়ায় দাঁড়িয়েই রূপসা প্রতিজ্ঞা করল—সে ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা দীপককে খুঁজে বের করবে, আর সত্যকে আলোয় নিয়ে আসবেই।

ছয়

সপ্তমীর দিনের ম্লান রোদ আর প্যান্ডেলের চারপাশের নোনা ধূপের গন্ধে ভিজে থাকা বাতাসের মধ্যে রূপসা আর অঙ্কন হাঁটছিল যেন কোনো অদৃশ্য সুতোর টানে টানা হয়ে, সেই সুতোর এক প্রান্তে লুকিয়ে আছে দীপক নামের এক ছেলেটি, আর অন্য প্রান্তে জড়িয়ে আছে অজানা এক অভিমানী ইতিহাস। মণ্ডপের গলির পেছনে সেই পুরনো পরিত্যক্ত ঘরটাকে খুঁজে বের করা যেন সহজ নয়, অথচ অদ্ভুতভাবে সেই ঘরটিই আজ তাদের কাছে সবচেয়ে আপন মনে হচ্ছিল। ভাঙা দেয়ালে অজানা চিহ্ন, ধুলোয় ঢাকা ভাঙা টেবিল আর বাতাসে জমে থাকা কালের গন্ধ—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, ইতিহাসের ছায়ারা এখানে এখনও বসে আছে, নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে কেউ তাদের গল্প শোনার জন্য। রূপসা ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে তাকাল, আর তার চোখে পড়ল সেই চুপচাপ বসে থাকা ছেলেটি, দীপক। মাথা নিচু, কপালে ঘাম, আর মুখে একরাশ অপরাধবোধ আর ক্লান্তি; যেন কতগুলো না বলা কথা তার কাঁধের ওপর পাথরের মতো চাপ ফেলেছে। অঙ্কন একটু পেছন থেকে দাঁড়িয়ে রইল, আর রূপসা গভীর শ্বাস নিয়ে ডাকল, “দীপক?” সেই ডাকের মধ্যে ছিল না কোনো সাংবাদিকের শাসানি, বরং এক বোনের মতো স্নেহমিশ্রিত দৃঢ়তা। দীপক ধীরে মাথা তুলল, চোখে লুকনো কান্নার ছাপ স্পষ্ট।

রূপসা এগিয়ে গিয়ে আস্তে জিজ্ঞেস করল, “তুমি সত্যিই চুরি করেছ?” দীপক এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ… আমি নিয়েছি, কিন্তু আমি চুরি করতে আসিনি।” সেই কণ্ঠস্বর যেন অন্ধকার ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আরও ভেঙে গেল। অঙ্কন ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল, “তবে কেন?” দীপক চোখের কোণে লুকনো অশ্রু মুছে নিয়ে বলল, “আমি বালারাম মিত্রের নাতি। ছোটবেলা থেকে শুধু শুনেছি, দাদু চোর ছিল। কিন্তু আমার বাবার ডায়েরিতে পড়েছি, দাদু আসলে চুরি করতে চায়নি, বরং মায়ের টিপ বিক্রি না হয়, সেইজন্য লুকিয়ে রাখতে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ভুল বোঝাবুঝিতে এক শিল্পী আত্মহত্যা করেন, আর দাদুর কাঁধে চোরের কলঙ্ক লাগে। সেই দুঃখ আমাদের পরিবারের রক্তে মিশে আছে। আমি চাইতাম সত্যিটা প্রমাণ করতে, তাই টিপ সরিয়েছিলাম, যাতে লোকে খুঁজতে গিয়ে ডায়েরির কথাটা জানে… আমি চাইনি মায়ের কপাল খালি হোক, কিন্তু আমার উপায়ও ছিল না।” দীপকের গলায় সেই কষ্ট শোনা গেল, যা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে চলেছে; সেই অভিমান, যে অভিমানে লুকিয়ে থাকে ভালোবাসা আর হারানোর ভয়। রূপসা দীপকের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল, ছেলেটি শুধু চোর নয়, বরং অতীতের বোঝা বয়ে চলা এক আহত মানুষ, যে সত্য বলার ভুল পথে পা বাড়িয়েছিল।

রূপসা আস্তে বলল, “টিপ কোথায়?” দীপক কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমার কাছে… লুকিয়ে রেখেছি। আমি চাই মা-র কপালে আবার ওটা পরানো হোক, আর আমি সত্যিটা সবার সামনে বলব।” অঙ্কন বলল, “তোমাকে এই সত্যি বলতেই হবে, আর টিপ ফিরিয়ে দাও।” দীপক মাথা নত করে সম্মতি জানাল, চোখে জল ভিজে উঠল। তিনজন মিলে প্যান্ডেলের দিকে হাঁটতে লাগল, বাতাসে ঢাকের তালে তালে যেন তাদের পায়ের ছন্দ মিশে গেল। প্যান্ডেলের কাছে গিয়ে দীপক থেমে বলল, “রূপসাদি, আমি চাই তুমি নিজে টিপটা মায়ের কপালে পরাও—কারণ তুমি প্রথম বিশ্বাস করেছিলে আমি শুধু চোর নই।” সেই কথায় রূপসার চোখে এক মুহূর্তের জন্য জল চলে এল, বাবার সেই পুরনো কথা মনে পড়ল, “সত্যিই যদি বিশ্বাস করিস, তবে ভয় পাবি না।” মায়ের প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে টিপটা হাতে নিয়ে রূপসা বলল, “মা, তোমার টিপ ফিরিয়ে দিচ্ছি, আর তোমার কৃপায় সত্যিটাও সামনে আসবে।” টিপ পরানোর সাথে সাথেই মনে হল প্রতিমার চোখ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ঢাকের তালে বাতাস কেঁপে উঠল, আর সেই মুহূর্তে রূপসা বুঝল—মায়ের টিপ কেবল সোনার নয়, বরং ইতিহাস, বিশ্বাস আর প্রজন্মের লড়াইয়ের প্রতীক। আর সেই প্রতীকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মুক্তি, ক্ষমা আর সত্যের শক্তি, যা আজ অবশেষে ফিরে এল তার rightful জায়গায়।

সাত

অষ্টমীর সকাল। কলকাতার আকাশে মেঘের ছায়া, বাতাসে ধূপ আর অঞ্জলির গন্ধ। প্যান্ডেলের ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে রূপসা, অঙ্কন আর দীপক—তাদের চারপাশে ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খ আর মানুষের উল্লাস, কিন্তু তাদের মন তখন অন্য এক শূন্যতায় ভাসছে। টিপ ফিরিয়ে দেওয়ার পরও রূপসার বুকের ভেতর চাপা অস্থিরতা, যেন শুধু মায়ের কপালে সোনার টিপ পরিয়ে দিলেই গল্প শেষ হয় না। দীপকের মুখে সেই গভীর দ্বিধা—সে কি মুখ খুলবে? বলবে সেই ডায়েরির কথা, যা তার বাবার পুরনো ট্রাঙ্কে লুকিয়ে ছিল? সে কি পারবে বলার সাহস করতে, যে তার দাদু চোর ছিলেন না, বরং অন্যায় থামাতে গিয়ে চোরের অপবাদ কাঁধে নিয়েছিলেন? অঙ্কন ধীরে ধীরে দীপকের কাঁধে হাত রাখল, যেন এক নিঃশব্দ ভাষায় বলল, “তুই একা নয়।” রূপসার চোখে সেই বিশ্বাস, যা শুধু সাংবাদিকের নয়, বরং মানুষের প্রতি এক অদৃশ্য দায়িত্বের প্রকাশ—সত্য যত তেতোই হোক, তবু বলতে হবে। মায়ের প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে দীপক কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল, যেন ভেতরে ভেতরে লড়াই করল ভয়, লজ্জা আর বংশগত অপবাদের বিরুদ্ধে, তারপর চোখ খুলে সরাসরি জনতার দিকে তাকাল।

তার কণ্ঠস্বর প্রথমে কাঁপছিল, তারপর দৃঢ় হয়ে উঠল, “আমি দীপক মিত্র, বালারাম মিত্রের নাতি। আমার পরিবারের নামে বহু বছর ধরে যে দাগ লেগে আছে, তার সত্যিটা আজ বলতে চাই। ছোটবেলা থেকে শুনেছি আমার দাদু মায়ের টিপ চুরি করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমার বাবার ডায়েরিতে পড়েছি আসল সত্য—দাদু চুরি করতে চাননি, বরং অন্য একজন কমিটির লোক টিপ বিক্রি করতে চাইছিল, আর দাদু সেটা আটকাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভুল বোঝাবুঝিতে প্রতিমা শিল্পী বিমল পাল আত্মহত্যা করেন… আর আমার দাদুর কাঁধে কলঙ্ক চিরকাল থেকে যায়।” চারপাশের ভিড় নিস্তব্ধ, শুধু ঢাকের তালে কাঁপতে থাকা বাতাস। দীপক চোখ নামিয়ে বলল, “আমি জানি, আমার পথ ভুল ছিল—টিপ সরিয়ে আমি চুরি করেছি, মায়ের কপাল খালি করেছি, কিন্তু আমি চেয়েছিলাম মানুষ সত্যিটা জানুক।” অঙ্কন পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “এ শুধু এক পরিবারের অপমান নয়, এ ইতিহাসের ভুল বোঝাবুঝি, যা প্রজন্মকে দগ্ধ করেছে।” রূপসার চোখে জল ভিজে এল, মনে হল মায়ের প্রতিমার চোখে যেন এক মুহূর্তের জন্য মমতা ফুটে উঠল—যেন মা নিজেই ছেলের সাহসকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন।

প্যান্ডেলের ভিড়ের মধ্য থেকে আস্তে আস্তে ভাঙা ভাঙা গলায় কেউ বলল, “বালারামবাবু কি সত্যিই চোর ছিলেন না?” কেউ বলল, “সত্যিই কি এই ছেলেটা সেই কলঙ্ক মোছার জন্যই এমন করল?” মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সেই ডায়েরির কথা, যার কথা দীপক বলল; অনেকে অবিশ্বাস করল, অনেকে চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। মণ্ডপের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল—একদিকে অপবাদ, অন্যদিকে ক্ষমা আর বোঝার চেষ্টা। দীপকের কণ্ঠ তখন আরও নরম হয়ে এল, “আমি চাই, আমার দাদুর নামে যে ভুল ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেটার সত্যিটা অন্তত সবাই জানুক। আর আমি দোষী, আমি চুরি করেছি, তার শাস্তি পেতে রাজি।” এই কথায় রূপসা দীপকের দিকে তাকাল, দেখল সেই ছেলেটি, যে ইতিহাসের বোঝা বয়ে আনতে গিয়ে নিজেই নিজের কাঁধে পাপের দাগ বসিয়েছে—তবু তার চোখে ভয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস। ঢাকের আওয়াজের ফাঁকে রূপসা মনে মনে বলল, “মা, এই ছেলেটাকে তুমি ক্ষমা করো, ও শুধু চোর নয়, ও তো তোমারই সন্তান, যে ভুল করে আবার সত্যের পথেই ফিরে এসেছে।” আর সেই মুহূর্তে মনে হল, মায়ের প্রতিমার কপালের সেই সোনার টিপ আগের মতোই জ্বলছে, যেন ইতিহাসের অন্ধকার কেটে গিয়ে সত্যের আলোয় নতুন করে ঝলমল করছে।

আট

অষ্টমীর সন্ধ্যা। ঢাকের একটানা গর্জন, বাতাসে ধূপের ধোঁয়া আর শঙ্খের সুরে ভরে উঠেছে শ্যামতলা সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মণ্ডপ, কিন্তু সেই উৎসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে দীপক, রূপসা আর অঙ্কনের বুকের ভেতর যেন ঢেউয়ের মতো বয়ে চলেছে অজানা আশঙ্কা আর অপেক্ষা। দীপকের বলা সত্যের পরে কমিটির সদস্যরা একে একে জড়ো হলেন—সভাপতি বিশ্বনাথ দত্ত, রঘুবাবু, রিয়া আর আরও কিছু প্রবীণ মুখ, যাদের চোখে কৌতূহল, অবিশ্বাস আর চাপা ক্ষোভ মিলেমিশে এক জটিল ছায়া তৈরি করেছে। বিশ্বনাথ দত্ত চশমা ঠিক করে দীপকের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন ছেলেটির চোখের গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যটুকু পড়ে ফেলতে চান। কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি যা করেছ, সেটা অপরাধ; মায়ের কপাল খালি করা বড় অন্যায়। কিন্তু তোমার কথায় আমি মিথ্যা পাইনি।” দীপকের কণ্ঠে কাঁপুনি নিয়ে স্বীকার, “আমি দোষী… কিন্তু আমি সত্যটাকে আলোয় আনতে চেয়েছিলাম, সেই ডায়েরির কথা বলেছি, যাতে বোঝা যায় আমার দাদু চোর ছিলেন না।” এই স্বীকারোক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনুতাপ আর সৎ সাহস শুনে রঘুবাবুর চোখে একফোঁটা জল জমল, হয়তো পুরনো স্মৃতির ভারে, হয়তো এক দীর্ঘ দিনের বোঝা কিছুটা হালকা হবার আশায়।

রূপসা সেই মুহূর্তে অনুভব করল, কেবল এক ছেলের মুখের কথা নয়, বরং প্রজন্মের অভিমান, অন্যায়ের কষ্ট আর ভুল বোঝাবুঝির পর্দা সরিয়ে দেওয়ার লড়াইয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। অঙ্কন পাশ থেকে আস্তে বলল, “তুই দেখেছিস রূপসা, সমাজ যেমন কঠোর, তেমনি এই সত্য শুনে অনেকে চোখ নামিয়ে ফেলেছে—হয়তো মনে মনে মানতেও শুরু করেছে।” মানুষের কানে কানে ফিসফাস, অনেকে বলছে, “তাহলে কি সত্যিই বালারামবাবু চোর ছিলেন না?” কেউ আবার সন্দেহ করছে, “ডায়েরি কোথায়?” কিন্তু সেই সন্দেহের ভেতরেও এক অদ্ভুত নীরব শ্রদ্ধা যেন জন্ম নিচ্ছে দীপকের সাহসের জন্য। সভার শেষে বিশ্বনাথ দত্ত দীপকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার শাস্তি হবে, কিন্তু মায়ের কৃপায় তোমার বলা সত্যের আলো আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তুমি যদি সেই ডায়েরি আমাদের দেখাতে পার, আমরা সেই ইতিহাস নতুন করে লিখব।” দীপক মাথা নত করে বলল, “আমি আনব, আমি চেয়েছি সত্য প্রকাশ পাক।” সেই কথায় মণ্ডপের ভিড়ের মধ্যে এক অদৃশ্য ঢেউ উঠল—যেখানে অভিমান, রাগ, লজ্জা আর আশা মিলেমিশে এক নতুন সুর বুনে দিল।

রূপসা সেই মুহূর্তে মায়ের প্রতিমার চোখের দিকে তাকাল, দেখল সোনার টিপের ঝলক ঠিক আগের মতোই জ্বলছে, আর সেই আলোয় প্রতিফলিত হচ্ছে দীপকের চোখের জল, রূপসার ভিজে ওঠা দৃষ্টি আর অঙ্কনের মৃদু হাসি। রূপসা মনে মনে বলল, “মা, এই টিপ শুধু গয়না নয়, এ বিশ্বাস, ক্ষমা আর সত্যের প্রতীক। তুমি আমাদের ক্ষমা করো।” ঢাকের তালে তালে বাতাস কেঁপে উঠল, যেন প্রতিমার নিঃশব্দ আশীর্বাদ নেমে এল। সেই রাতে রূপসা আর অঙ্কন প্যান্ডেলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখল দীপক একা একা বসে আছে, চোখে স্বস্তির ছায়া আর মনে ক্লান্তি। রূপসা ধীরে কাছে গিয়ে বলল, “ভয় পাস না, তোর লড়াই সার্থক হয়েছে।” দীপক তাকিয়ে ম্লান হাসি দিল, “আমি শুধু চেয়েছিলাম, দাদুর নামে যে অভিশাপ লেগে ছিল, সেটা ভাঙতে।” রূপসা বলল, “ভুল পথে গিয়েছিলিস, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যিটা বলেই তুই প্রমাণ করেছিস, মানুষ চোর হয়ে জন্মায় না, পরিস্থিতি মানুষকে বাধ্য করে।” আর সেই মুহূর্তে মনে হল, মায়ের মূর্তির পেছন থেকে ভেসে আসা ধূপের ধোঁয়া আর ঢাকের তালে তালে এক নতুন সকাল আসছে—যেখানে ইতিহাসের ভুল শুধরে গিয়ে শুরু হতে পারে এক নতুন অধ্যায়, যেখানে অভিশাপের জায়গায় লেখা থাকবে ক্ষমা আর প্রতিধ্বনি হবে সত্যের।

নয়

নবমীর সকাল। আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে ফোটে স্বর্ণাভ আলো, প্যান্ডেলে ঢাকের বাজনা, মানুষের ভিড় আর ধূপের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে চারদিক, কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যেই রূপসা আর অঙ্কনের চোখের দৃষ্টি স্থির দীপকের হাতে ধরা এক পুরনো, বাদামী চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরির দিকে। দীপকের কণ্ঠস্বর কাঁপছে, তবু চোখে আজ ভয় নয়, বরং একরাশ সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা। ডায়েরির হলুদ পাতায় লাল কালিতে লেখা বালারাম মিত্রের হাতের অক্ষর—যা শুধু কালি আর কাগজের চিহ্ন নয়, বরং এক পরিবারের গোপন ব্যথা, এক শিল্পীর আত্মহত্যার অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা অসমাপ্ত স্বপ্ন আর অন্যায় বোঝার অক্ষরে লেখা দলিল। দীপক চুপচাপ ডায়েরিটা সভার টেবিলের ওপর রাখল; চারপাশের মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। রূপসার চোখে সেই মুহূর্তে স্পষ্ট হল–এ শুধু এক যুবকের সাহস নয়, বরং প্রজন্মের কান্না আর অভিশাপ ভাঙার শেষ চেষ্টা। বিশ্বনাথ দত্ত ডায়েরির পাতা উল্টালেন, আর তাতে লেখা বাক্যগুলো পড়ে শোনালেন–“আমি চুরি করতে আসিনি… কমিটির ভিতর কেউ মায়ের টিপ বিক্রি করতে চেয়েছিল… আমি শুধু লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই ভুল বোঝাবুঝিতে শিল্পী বিমল পাল নিজের জীবন নিল…” এই শব্দগুলো বাতাসে ভাসতেই মনে হল ঢাকের তালে কেঁপে উঠল মণ্ডপ, আর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল বিস্ময়ের এক নীরব প্রতিধ্বনি।

অঙ্কন কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “রূপসা, দেখেছিস? একশো বছরের অভিশাপের পেছনে লুকিয়ে ছিল সত্য আর অন্যায়ের সঙ্গে লড়াই।” রূপসা ধীরে মাথা নাড়ল, চোখে জল জমে উঠল; মনে হল, বাবার সেই পুরনো গল্পগুলো আর মায়ের প্রতিমার চোখে দেখা অনাবিল স্নেহ একে একে সত্য হয়ে ফুটে উঠছে। মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে শুনছে, কেউ চোখ মুছছে, কেউ চুপচাপ মাথা নিচু করছে; তাদের চোখের ভাষায় লেখা–“আমরা একশো বছর ধরে যা বিশ্বাস করেছি, সেটা হয়তো ভুল ছিল।” রঘুবাবুর কণ্ঠ কাঁপছে, “আমরা বালারামবাবুকে ভুল বুঝেছিলাম… আর সেই ভুল বোঝাবুঝি অনেক প্রাণকে দগ্ধ করেছে।” দীপক তখন নিঃশব্দে বলল, “আমি চেয়েছিলাম এই সত্য সামনে আনতে, কিন্তু আমি ভুল করেছিলাম চুরি করে… তবু আমি চাই, দাদুর নামে যে কলঙ্ক লেগে আছে, সেটা মুছুক।” তার সেই স্বীকারোক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনুতাপ আর ভালোবাসা প্যান্ডেলের বাতাসে মিশে গেল, ঢাকের আওয়াজের মতোই গভীর আর প্রাচীন।

বিশ্বনাথ দত্ত ডায়েরি বন্ধ করে দীপকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি দোষ স্বীকার করেছ, শাস্তি পাবে… কিন্তু তুমি যে সত্য দেখালে, তা অস্বীকার করা যায় না। আমরা মণ্ডপে ঘোষণা করব, ডায়েরির কথা মানুষ জানবে, আর ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে।” দীপকের চোখ ভিজে গেল, কিন্তু সেই ভেজা চোখেই ফুটে উঠল একরাশ মুক্তির আলো। রূপসা তখন মায়ের প্রতিমার দিকে তাকাল, দেখল কপালের সোনার টিপ আগের মতোই জ্বলছে, আর সেই ঝলকে যেন লেখা আছে–ক্ষমা আর আশীর্বাদ। রূপসা মনে মনে বলল, “মা, এই ডায়েরির অক্ষরে শুধু দুঃখ নয়, আছে প্রেম, প্রতিজ্ঞা আর সত্যের গরিমা।” ঢাকের তালে তালে সেই কথাগুলো বাতাসে মিশে গেল, আর মনে হল, বালারাম মিত্রের দীর্ঘশ্বাস, বিমল পালের নিঃশব্দ কান্না আর দীপকের অভিমান–সব মিলিয়ে আজ মুছে যাচ্ছে এক ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়, আর শুরু হচ্ছে আলোয় লেখা এক নতুন গল্প, যেখানে অভিশাপ নয়, শুধু সত্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

দশ

দশমীর সকালে শহরের আকাশ নরম রোদে ভিজে আছে, প্যান্ডেলের চারপাশে সিঁদুর খেলার লাল আভা, ঢাকের তালে তালে মিশে যাচ্ছে মানুষের হাসি, চোখের জল আর বিদায়ের ব্যথা। এই বিদায়ের মধ্যেই রূপসা, অঙ্কন আর দীপক দাঁড়িয়ে আছে প্রতিমার সামনে—যেন প্রতিমার চোখে চোখ রেখে তাদের যন্ত্রণার ইতিহাস বলছে, আর প্রতিমা নিজের মতো করে আশীর্বাদ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। কাল রাতের কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে—ডায়েরির সত্য মেনে নতুন ইতিহাস লেখা হবে; বালারাম মিত্রের নামে যে কলঙ্ক লেগেছিল, তার পাশে সত্যের নতুন ব্যাখ্যা থাকবে। দীপক স্বেচ্ছায় নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে, কমিটি শাস্তি হিসেবে ওকে প্যান্ডেলের জন্য এক বছর স্বেচ্ছাসেবার দায়িত্ব দিয়েছে, আর শর্ত দিয়েছে, পুজোর ইতিহাস ও স্মৃতি নিয়ে একটি প্রকাশনা তৈরি করতে হবে, যাতে আগামী প্রজন্ম জানে কোথায় ভুল হয়েছিল আর সত্য কীভাবে আলোয় আসে। দীপক সেই শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছে—তার চোখে এখন কোনো ভয় নেই, আছে শুধু শান্তি, আর দাদুর জন্য গোপন গর্ব। রূপসা অনুভব করল, এই ছেলেটি তার ভুল শোধরাতে চেয়েছে, আর সেই চেষ্টার মধ্যে শুধু অপরাধ নয়, বরং ভালোবাসা আর উত্তরাধিকার রক্ষার এক অসমাপ্ত লড়াই লুকিয়ে আছে।

অঙ্কন পাশে এসে বলল, “রূপসা, এই ক’দিনে আমরা শুধু এক চোরকে খুঁজিনি, বরং এক ইতিহাস, এক পরিবারের কান্না আর অভিমান খুঁজে পেয়েছি।” রূপসা ধীরে মাথা নাড়ল, চোখ ভিজে উঠল—মনে পড়ল বাবার সেই পুরনো গল্প, শৈশবে প্যান্ডেলের রঙ আর ঢাকের তালে নাচা দিনগুলো, আর মনে হল, এবার সেই স্মৃতির সঙ্গে জুড়ে গেল নতুন কিছু; সত্যের কাছে ফিরে আসা এক ছেলের গল্প, আর ইতিহাসের অন্ধকার সরিয়ে নতুন আলো দেখার গল্প। প্রতিমার চোখের দিকে তাকিয়ে রূপসা যেন শুনতে পেল নিঃশব্দ আশীর্বাদ—“ভয় পাস না, সত্য বলার পথেই আশীর্বাদ থাকে।” ঢাকের তালে তালে ধূপের ধোঁয়া আকাশের দিকে উঠল, আর সেই ধোঁয়ার আড়ালে হারিয়ে গেল একশো বছরের ব্যথা, লজ্জা আর অন্যায় বোঝা। দীপক আস্তে বলল, “রূপসাদি, অঙ্কনদা, তোরা না থাকলে আমি কখনো সাহস পেতাম না… দাদুর নামে সত্য বলার লড়াই একা লড়তে গিয়ে হয়তো হেরে যেতাম।” রূপসা দীপকের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই একা ছিলিস না, আর ইতিহাসও শুধু ভুলের নয়, সংশোধনের সুযোগও দেয়—এটাই শিখেছি।”

বিজয়ার দিনে প্রতিমা বিসর্জনের সময় ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রূপসা আর অঙ্কন দেখল—প্যান্ডেলের গেটে দীপক দাঁড়িয়ে, চোখ ভিজে উঠেছে, কিন্তু মুখে একরাশ আশ্বস্ত হাসি। ঢাকের তালে তালে প্রতিমা জলে ভাসল, আর সেই ভেসে যাওয়ার মধ্যে রূপসা মনে মনে বলল, “মা, তোমার টিপ শুধু সোনার নয়, ইতিহাসের ভার, সত্যের প্রতীক, আর বিশ্বাসের আলো। তুমি আবার ফিরবে, আর এই আলো নিয়েই ফিরবে।” ঢাকের গর্জন, শঙ্খের ধ্বনি আর মানুষের চোখের জল মিশে গিয়ে গড়ে তুলল এক অদ্ভুত সুন্দর সুর—যেখানে শেষ নেই, বরং নতুন শুরুর ইঙ্গিত আছে। প্যান্ডেলের ধুলো, ধূপের গন্ধ আর ভোরের রোদ মিশে গিয়ে যেন বলল, অভিশাপ নয়, সত্য আর ক্ষমাই শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। আর সেই অনুভূতিতে শেষ হল এক গল্প—যেখানে চুরি আর কলঙ্কের মধ্যেও লুকিয়ে ছিল ভালোবাসা, লড়াই আর আশীর্বাদের আলোয় লেখা এক নতুন সকাল।

সমাপ্ত

1000038523.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *