Bangla - ছোটদের গল্প

মায়া আর জোনাকি রাত

Spread the love

সন্ধ্যা নামতেই সেই ছোট্ট গ্রামের চিত্র যেন এক জাদুকরী রূপকথার মতো ভেসে ওঠে। চারদিক অন্ধকারে ডুবে যেতে না যেতেই গাছপালা, ধানখেত আর কুয়াশায় ঢাকা সরু পথগুলো ভরে ওঠে অসংখ্য জোনাকির ঝিলমিল আলোয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন আকাশের তারারা নেমে এসেছে মাটির বুকে, মিশে গেছে মানুষের জীবনে। গ্রামের বাচ্চারা প্রতিদিনের মতো আজও মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, তাদের হাসির শব্দ মিশে যাচ্ছে আলোছায়ার খেলায়। বৃদ্ধরা পানের পাত্র হাতে বসে নিজেদের পুরনো গল্প শোনাচ্ছে, অথচ এই আলোকিত রাত যেন সবার চোখে কেবল বিনোদনের মতো। কিন্তু মায়া নামের সেই তরুণী এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে এক ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে। তার কাছে জোনাকির এই আলো নিছক প্রকৃতির খেলা নয়, বরং যেন কোনো লুকানো রহস্যের অঙ্গীকার। প্রতিটি আলো তার মনে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন জাগায়—কে যেন ফিসফিস করে তাকে কিছু বলতে চাইছে, অথচ শব্দে নয়, কেবল চোখের দৃষ্টিতে। গ্রামের অন্যরা যেভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, মায়া তেমন নয়। তার বুকের ভেতর প্রতিদিনের মতো আজও হালকা কাঁপন তোলে এই জোনাকির আলো, যেন কোনো ডাক তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অজানার পথে।

মায়ার জীবন ছিল সাধারণ, অথচ তার কল্পনার জগৎ ছিল গভীর। ছোটবেলা থেকেই সে প্রকৃতির প্রতিটি খুঁটিনাটি লক্ষ্য করত—কখনো গাছের পাতায় ফোঁটা ফোঁটা শিশির জমে থাকার শব্দ শুনত, কখনো নদীর ঢেউয়ের ভেতর অদ্ভুত ছন্দ খুঁজে বের করত। কিন্তু জোনাকির আলো তার কাছে অন্যরকম ছিল। যতবার সে এদের দেখত, মনে হতো যেন প্রতিটি জোনাকি তার সঙ্গে চোখাচোখি করছে, তাদের ক্ষুদ্র দেহের ভেতর লুকিয়ে আছে কোনো অজানা কাহিনি। সে বুঝতে চাইত—কেন প্রতিদিন সন্ধ্যার পর এরা ভেসে আসে, আবার ভোর হতেই হারিয়ে যায়? তার অন্তরের গভীরে যেন কেউ ফিসফিস করে বলত, এই জোনাকির আলো কেবল আলো নয়, এগুলো আসলে কোনো অদৃশ্য আত্মার নিশ্বাস, যাদের কথা মানুষ বোঝে না। মায়া মাঝেমধ্যে খেয়াল করত, যখন সে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে কোনো একটি জোনাকির চোখে, তখন তার মনের ভেতর ভেসে ওঠে অচেনা মুখ, অজানা গল্পের টুকরো, যেন সময় আর স্থান ভেদ করে কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে। সে ভীতও হতো, আবার আকৃষ্টও হতো। রাত যত গভীর হতো, মায়া ততই অনুভব করত—এই আলোকিত গ্রাম তার জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, যদিও সে এখনো জানে না কেন।

গ্রামের মানুষরা মায়ার এই অদ্ভুত অনুভূতির কথা জানলেও কেউ তাকে গুরুত্ব দিত না। তারা হাসাহাসি করে বলত, “মায়া অনেক কল্পনা করে,” কিংবা “জোনাকির আলো দেখে স্বপ্ন দেখে।” কিন্তু মায়া জানত, এটা কেবল স্বপ্ন নয়। প্রতিদিন রাতে সে আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকত, দৃষ্টি স্থির রাখত সেই আলোদের ভিড়ে, যেন কোনো দিন উত্তর পাওয়া যাবে। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক টান বাড়ছিল—যেন এই আলো তাকে ডেকে নিয়ে যাবে এমন এক জগতে, যেখানে লুকিয়ে আছে গ্রামের অতীত, মানুষের অজানা স্মৃতি, হয়তো মৃত্যুরও রহস্য। আজকের রাতেও সে দেখল, জোনাকিরা ধীরে ধীরে গাছের ডাল ঘিরে একটি বৃত্ত তৈরি করছে, যেন নাচতে নাচতে কোনো পুরোনো কাহিনি সাজিয়ে তুলছে। মায়ার শ্বাস দ্রুত হয়ে উঠল, চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। তার মনে হলো—যদি সে আরেকটু মনোযোগ দেয়, তবে হয়তো সে শুনতে পাবে সেই গল্প, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেউ শুনতে পায়নি। রাতের আকাশে অগণিত তারা জ্বলছিল, অথচ মায়ার চোখ আটকে ছিল মাটির জোনাকির আলোয়—কারণ সে জানত, এই আলো শুধু আলো নয়, বরং অদৃশ্য কোনো সত্যির অঙ্গীকার, যা একদিন তার জীবন পাল্টে দেবে।

সেদিন রাতে আকাশে চাঁদ ছিল আধো অন্ধকারে ঢাকা, যেন কুয়াশা আর নীরবতা মিলে নদীর ধারটাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছিল। মায়া একা বসেছিল সেই নদীর ঘাটে, যেখানে মাঝেমধ্যে জেলেরা নৌকা বেঁধে রাখে। চারপাশে মানুষের কোনো চিহ্ন ছিল না, শুধু জলের মৃদু ঢেউ আর ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম ডাক। সে বসেছিল নিজের ভেতরের অশান্তি শান্ত করার জন্য—কারণ জোনাকিদের আলো যেন গত কয়েকদিন ধরে তার মনকে আরও বেশি আলোড়িত করছিল। কিন্তু হঠাৎই তার বুক কেঁপে উঠল, যখন একটি জোনাকি তার একেবারে কান ঘেঁষে এসে ভেসে উঠল, আর তারপর শোনা গেল ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট একটি ফিসফিসানি—“আমরা মৃত মানুষের আত্মা, আমাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি।” প্রথমে মায়ার মনে হলো, হয়তো সে কল্পনা করছে। সে হকচকিয়ে উঠল, চোখ মেলে চারপাশ তাকাল, কিন্তু কেউ নেই। শুধু সেই ক্ষুদ্র জোনাকির আলো নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠছিল, আর মনে হচ্ছিল যেন সেটাই কথা বলছে। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল, গলা শুকিয়ে গেল, কিন্তু তার অন্তরের কোথাও একটা বিশ্বাস জন্ম নিতে শুরু করল—এই আলো নিছক আলো নয়, এর ভেতরে আছে বহু অজানা কাহিনি, যা সে এতদিন ধরে অনুভব করছিল। ভয় আর কৌতূহলের মিশেলে তার চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু সে দৃষ্টি সরাল না।

মায়া ধীরে ধীরে স্থির হয়ে আবার সেই ক্ষুদ্র আলোকে লক্ষ্য করতে লাগল। এবার তার মনে হলো, আলোটা আর নিছক কোনো পোকা নয়, বরং এক অদৃশ্য সত্তার বাহন। জোনাকির ক্ষুদ্র চোখে সে যেন দেখতে পাচ্ছিল মানবীয় আবেগের ছায়া—দুঃখ, অপূর্ণতা, আর এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। জোনাকির মৃদু কণ্ঠ আবার শোনা গেল, “আমাদের জীবন শেষ হলেও আমাদের কিছু স্বপ্ন, কিছু প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ থেকে গেছে। তাই আমরা এভাবেই ঘুরে বেড়াই, আলো হয়ে রাতকে ভরে দিই। তুমি আমাদের দেখতে পাও, কারণ তুমি আমাদের কথা শোনার জন্য নির্বাচিত।” মায়ার বুক ধকধক করতে লাগল, কিন্তু ভয়ের পাশাপাশি এক অদ্ভুত শান্তিও নেমে এল তার ভেতরে। তার মনে হলো, সে যেন এক নতুন জগতে প্রবেশ করছে—এক জগৎ যেখানে জীবিত আর মৃতের মাঝের সীমারেখা ভেঙে গেছে। চারপাশের অন্ধকার নদী যেন আরও গভীর হয়ে উঠল, অথচ সেই গভীরতার ভেতরেই মায়া খুঁজে পেল অদ্ভুত আলো। সে বুঝতে পারল, তার জীবন আর আগের মতো সাধারণ থাকবে না। এই রাত তাকে এমন এক সত্যি দেখিয়েছে, যা গ্রামের অন্য কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।

এরপর থেকে রাত আর মায়ার কাছে নিছক নিস্তব্ধতা ছিল না, বরং এক রহস্যময় দরজা, যেটা খুললেই অপেক্ষা করছে অসংখ্য অদেখা গল্প। নদীর ধারে বসে সে বারবার ভাবছিল—কেন তাকে এই সত্য জানানো হলো? কেন অন্য কারও নয়, বরং কেবল তাকেই? তার মনে হলো, হয়তো তার ভেতরের কৌতূহল আর সংবেদনশীলতা তাকে আলাদা করেছে। জোনাকিরা তাকে বেছে নিয়েছে কারণ সে শোনার ক্ষমতা রাখে, বিশ্বাস করার সাহস রাখে। সে বুঝল, রাত মানে শুধু অন্ধকার নয়, বরং এক গোপন জগৎ, যেখানে অপূর্ণ আত্মারা নিজেদের কাহিনি বলতে চায়। ভয় ধীরে ধীরে কেটে গিয়ে জায়গা নিল এক গভীর টান—একটা দায়িত্ব যেন তার কাঁধে এসে পড়েছে। মায়া অনুভব করল, এই আলোগুলো নিছক নাচানাচি নয়, বরং তারা নীরবে আর্তি জানাচ্ছে, তাদের অসমাপ্ত গল্পগুলো শেষ করার জন্য। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো, তার জীবন আর শুধুই তার নিজের নয়, বরং এই হাজারো জোনাকির সঙ্গে বাঁধা। রাত যেন হয়ে উঠল তার কাছে অন্য এক মহাবিশ্ব, যেখানে সে একা নয়, বরং অসংখ্য আত্মার সহযাত্রী।

রাত যত গভীর হতে লাগল, মায়ার চারপাশে জোনাকিদের আলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন তারা সবাই একসঙ্গে তাকে ঘিরে ধরেছে। নদীর ধারের শীতল বাতাসে মায়া কেঁপে উঠলেও তার চোখ আটকে রইল সেই ক্ষুদ্র আলোগুলোর দিকে। একসময় তার মনে হলো, প্রতিটি জোনাকি যেন ফিসফিস করছে, নিজেদের দুঃখভরা গল্প শোনাতে চাইছে। হঠাৎ করেই তার ভেতরে এক তীব্র কম্পন জাগল, যেন কারও কান্না সে শুনতে পাচ্ছে। প্রথমে এল এক বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর—যিনি মৃত্যুর আগে তার ছেলেকে শেষ বিদায় জানাতে পারেননি। সেই ব্যথা এত গভীর ছিল যে, বৃদ্ধ আত্মা আলো হয়ে প্রতিদিন এই গ্রামে ভেসে বেড়াচ্ছে। মায়া অনুভব করল বৃদ্ধের অশ্রু, তার বুক ভেঙে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস, আর অসমাপ্ত কথাগুলো যেন বাতাসে ঝুলে আছে। কিছুক্ষণ পর আরেকটি আলো এসে তার চোখের সামনে ঘুরতে লাগল। এবার সে শুনল এক তরুণীর কথা, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজের হাতে বাড়ি বানানোর, কিন্তু সময় তাকে সেই স্বপ্ন পূর্ণ করার সুযোগ দেয়নি। তার আত্মা এখন আলো হয়ে প্রতিরাতে সেই স্বপ্নের রূপ আঁকতে চায়। মায়া দেখল—এই আলোগুলো শুধু জ্বলে না, বরং প্রতিটি শিখা ভেতরে ভেতরে বহন করছে মানুষের অশ্রু, স্বপ্ন আর বেদনার ছাপ।

মায়ার মনে হলো, তার চারপাশ যেন হাজারো অদৃশ্য আত্মার সভায় রূপ নিয়েছে। কেউ কাঁদছে, কেউ ফিসফিস করছে, কেউ আবার নির্বাক দাঁড়িয়ে শুধু তাকিয়ে আছে, যেন কিছু বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের মধ্যে একজন বলল, সে মৃত্যুর আগে প্রিয়জনের কাছে ক্ষমা চাইতে পারেনি। সেই অক্ষমতা তার বুকের ভেতর এত ভার হয়ে আছে যে, সে মুক্তি পাচ্ছে না। অন্য এক আত্মা বলল, তার ছোট্ট সন্তান ঘুমিয়ে ছিল যখন সে এই পৃথিবী ছেড়ে গেল—সেই শেষ বিদায় জানাতে না পারার দুঃখই তাকে আটকে রেখেছে। মায়া শুনতে শুনতে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠছিল, কিন্তু সে দৃষ্টি সরাতে পারছিল না। তার মনে হলো, প্রতিটি আলো আসলে মানুষের অসম্পূর্ণতার প্রতীক। জীবনের যে মুহূর্তগুলো মানুষ শেষ করতে পারেনি, সেগুলোই রূপ নিচ্ছে এই আলোকিত কণিকায়। নদীর ধারে বসে মায়া অনুভব করছিল, এই গ্রাম নিছক একটি গ্রাম নয়, বরং এক অদৃশ্য কবরস্থান, যেখানে আত্মারা মুক্তির অপেক্ষায় ঘুরে বেড়ায়। প্রতিটি আলো একেকটি ভগ্ন হৃদয়ের কান্না, একেকটি হারানো স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।

ধীরে ধীরে মায়ার বুক ভারী হয়ে উঠল। তার চোখ ভিজে উঠল, কারণ সে যেন নিজের ভেতরেও এই বেদনার ছায়া খুঁজে পাচ্ছিল। সে ভাবছিল—মানুষ যখন জীবিত থাকে তখন কত সহজে ভালোবাসাকে অবহেলা করে, কত সহজে কথা না বলেই রাগ করে দূরে সরে যায়, কত স্বপ্ন অসম্পূর্ণ রেখেই সময় ফুরিয়ে যায়। মৃত্যুর পর সেই আক্ষেপই রূপ নেয় আলো হয়ে। মায়ার কাছে রাত আর নিছক এক রূপকথা রইল না, বরং এক তীব্র বাস্তবতা হয়ে উঠল, যা তাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে বারবার। সে বুঝতে পারল, এই আলোদের কাহিনি শুধু শোনার জন্য নয়, বরং এগুলো তার কাছে এক আহ্বান—এই অসমাপ্ত কাহিনিগুলো পূর্ণ করার চেষ্টা করা, আত্মাদের মুক্তির পথ খুঁজে বের করা। মায়ার মনে হলো, তার নিজের জীবনও এখন আর কেবল তার জন্য নয়, বরং এই আলোদের জন্য। প্রতিটি রাত তার কাছে নতুন দায়িত্ব নিয়ে আসবে, নতুন বেদনার স্রোত বয়ে আনবে। আর এই বেদনা তাকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যাবে সেই অজানা জগতের দিকে, যেখানে মানুষ ও আত্মার মাঝের সীমারেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

রাতের অন্ধকারে নদীর ধারে বসে মায়া যখন আত্মাদের আক্ষেপ ও কান্না শুনল, তখন তার বুকের ভেতর যেন এক অদৃশ্য আগুন জ্বলে উঠল। সে জানল, ভয় পাওয়া বা কেবল তাদের গল্প শোনা কোনো সমাধান নয়। এই ভগ্ন আত্মারা মুক্তি পাবে কেবল তখনই, যখন তাদের অসমাপ্ত ইচ্ছাগুলো পূর্ণ হবে। কিন্তু কাজটি সহজ নয়—কারণ জীবিতদের দুনিয়ায় মৃতদের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তবুও মায়ার মনে হলো, এ কাজের জন্য তাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। রাত যত গভীর হলো, জোনাকিদের আলো তাকে ঘিরে ধরল, যেন তারা নীরবে প্রতিজ্ঞা করাচ্ছে। মায়া মুঠি শক্ত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে প্রতিজ্ঞা করল—সে আর শুধু দর্শক হয়ে থাকবে না, সে হবে এই আত্মাদের কণ্ঠস্বর, তাদের অসমাপ্ত স্বপ্নের পূর্ণতার সেতু। চারপাশের বাতাসে যেন ভেসে এল এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন আত্মারা তার প্রতিজ্ঞা শুনে স্বস্তি পেল। সে জানত, সামনের পথ অজানা, বিপদে ভরা, তবুও তার হৃদয়ে কোনো দ্বিধা রইল না।

পরদিন সকালে মায়া নতুন দৃষ্টিতে গ্রামকে দেখতে শুরু করল। প্রতিটি মুখ, প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি আঙিনা—সব যেন এখন তার কাছে গল্পে ভরা। রাতের পর রাত সে নদীর ধারে কিংবা বটগাছের নিচে বসে আত্মাদের কথা শোনে। কেউ জানায়, তার মাটির ব্যাংকে লুকানো টাকা পরিবারকে পৌঁছে দিতে, কেউ বলে, তার অসমাপ্ত চিঠি প্রিয়জনের হাতে তুলে দিতে, কেউ আবার শুধু চায় মৃত্যুর আগে না বলা কোনো কথাটা পৌঁছে দিতে। মায়া প্রতিটি গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনে, মনে রাখে, আর দিনের বেলায় নিঃশব্দে সেই কাজগুলো পূরণের চেষ্টা করে। প্রথমদিকে গ্রামবাসীরা তার অদ্ভুত আচরণ দেখে অবাক হয়। কেউ ভাবে, মায়া কল্পনাবিলাসী, কেউ আবার ভাবে সে পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু মায়া এসব কথায় কান দেয় না। সে জানে, যদি সত্যিই কারও শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারে, তবে সেই আত্মা মুক্তি পাবে। আর এটাই এখন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। প্রতিটি কাজ শেষ করার পর মায়া রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে—একটি জোনাকি আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে হারিয়ে যায়, যেন কৃতজ্ঞ আত্মা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। এই দৃশ্য তার সাহস আরও দৃঢ় করে তোলে।

ধীরে ধীরে মায়ার জীবন এক অদ্ভুত ছন্দে বাঁধা পড়ে গেল। দিনে সে গ্রামের পথে হেঁটে বেড়ায়, মানুষের সঙ্গে মিশে আত্মাদের কাজ গোপনে সম্পূর্ণ করে। রাতে সে নদীর ধারে বসে নতুন আত্মার গল্প শোনে। প্রতিটি রাত নতুন রহস্য উন্মোচন করে, প্রতিটি দিন তাকে আরও সাহসী করে তোলে। কখনো তাকে যেতে হয় অপরিচিত বাড়িতে, কখনো চিঠি পৌঁছে দিতে হয় অচেনা হাতে, আবার কখনো মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে এমন কথা বলতে হয়, যা তার নিজের নয়—বরং কোনো অদৃশ্য আত্মার। সবকিছুই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু তার ভেতরের শক্তি তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, এ কাজ শুধু আত্মাদের জন্য নয়, বরং জীবিত মানুষদেরও শান্তি দেয়। অসমাপ্ত কাহিনিগুলো যখন পূর্ণ হয়, তখন কেবল মৃতরাই নয়, বেঁচে থাকা মানুষও মুক্তি পায় আক্ষেপের শৃঙ্খল থেকে। মায়ার চোখে গ্রামটা এখন আর সাধারণ নয়—এটি হয়ে উঠেছে আলো আর অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক সেতু, যেখানে সে-ই একমাত্র পথপ্রদর্শক। আর তার প্রতিজ্ঞা প্রতিটি দিনকে নতুন এক পরীক্ষায় রূপান্তরিত করলেও, তার আত্মা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দৃঢ় হয়ে উঠল।

সেদিন রাতে নদীর ধারে বসে মায়া হঠাৎ অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতলতা, যেন বাতাসের সঙ্গে কেউ নিঃশব্দে কান্না মিশিয়ে দিয়েছে। চারপাশে হাজারো জোনাকির ভিড়ের মাঝ থেকে একটি আলো ধীরে ধীরে ভেসে এসে তার সামনে থেমে গেল। সেই আলো যেন কাঁপছিল, যেন ভেতরে ভেতরে দীর্ঘদিনের জমে থাকা আক্ষেপের ভার বইছে। মায়া চোখ বন্ধ করতেই তার কানে ভেসে এল এক বৃদ্ধার মমতামাখা কণ্ঠস্বর—“আমি চলে আসার আগে আমার ছেলেকে আশীর্বাদ জানাতে পারিনি। সে মনে করছে, আমি তাকে রাগ করে ছেড়ে গেছি। কিন্তু আমি চাই সে জানুক, আমি তাকে সবসময় আশীর্বাদ করেছি।” মায়ার বুক হু-হু করে উঠল। সে স্পষ্ট অনুভব করল, এই কণ্ঠে কতটা ভালোবাসা, কতটা না-পারা কথা জমে আছে। বৃদ্ধার আত্মা কাঁদছিল, আর সেই কান্না যেন মায়ার চোখ দিয়েই বেরিয়ে আসছিল। সে প্রতিজ্ঞা করল, যতই কঠিন হোক, এই শেষ আশীর্বাদ ছেলেকে পৌঁছে দেবে। রাতটা তার কাছে হয়ে উঠল দায়িত্ব আর ভালোবাসার এক নতুন দীক্ষা।

পরদিন সকালে মায়া ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়ল। তার হাতে এক টুকরো কাগজ, যেখানে সে লিখে রেখেছিল বৃদ্ধার বলা কথা—একটি চিঠির মতো বার্তা। সে গ্রামের পথ পেরিয়ে বৃদ্ধার ছেলের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকতেই দেখল, এক যুবক নিঃশব্দে বসে আছে, চোখে ক্লান্তি আর শূন্যতা। তার চারপাশে কাজের যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে আছে, অথচ তার চোখে জীবনের আগ্রহ নেই। মায়া ভদ্রভাবে এগিয়ে গিয়ে চিঠিটা তার হাতে দিল, বলল—“এটা তোমার মায়ের পক্ষ থেকে।” প্রথমে যুবক অবাক হয়ে তাকাল, তারপর দ্বিধাভরে কাগজ খুলল। মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখ ভিজে উঠল। শব্দগুলো পড়তে পড়তে তার দেহ কেঁপে উঠছিল, আর ঠোঁট থেকে বের হচ্ছিল হাহাকার মেশানো শব্দ—“মা… তুমি আমাকে সত্যিই আশীর্বাদ করেছিলে!” সেই মুহূর্তে ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। যুবক কাগজটা বুকে জড়িয়ে ধরল, আর তার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। মায়া নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, তার চোখেও জল এসে গেল। সে অনুভব করল, এই কাগজ কেবল অক্ষরের সমষ্টি নয়, বরং এক মায়ের উপস্থিতি, এক অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া। সেই যুবকের হৃদয়ে যে শূন্যতা এতদিন জমে ছিল, তা ভরে উঠল শান্তির স্পর্শে।

সেদিন রাত নামতেই মায়া নদীর ধারে ফিরে এলো। আকাশে পূর্ণিমার আলো ঝিকমিক করছিল, আর জোনাকিদের ভিড়ও আগের মতো জমে উঠছিল। কিন্তু মায়ার দৃষ্টি খুঁজছিল সেই একটিমাত্র আলোকে, যে বৃদ্ধার আত্মা তার কাছে এসেছিল। কিছুক্ষণ পরই সে দেখল, দূরে একটি ক্ষুদ্র আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। অন্য সব জোনাকিরা যেমন জ্বলছে, সেটি তেমন নয়—বরং ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। মায়ার বুক কেঁপে উঠল, চোখে জল এসে গেল, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তিও ছড়িয়ে পড়ল। সে জানল, বৃদ্ধা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। তার ছেলের কাছে আশীর্বাদ পৌঁছেছে, আর সেই ভালোবাসার বন্ধন তাকে আর অন্ধকারে বেঁধে রাখেনি। নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন ঝলমল করছিল, আর মায়া মনে মনে ফিসফিস করে বলল—“তুমি শান্তিতে থাকো, তোমার আলো আমার হৃদয়ে জ্বলতে থাকবে।” সেই মুহূর্তে তার প্রতিজ্ঞার সত্যতা আরও দৃঢ় হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, আত্মাদের সাহায্য করা নিছক দায়িত্ব নয়, বরং এক পরম আশীর্বাদ, যা তাকে জীবনের নতুন অর্থ দিচ্ছে।

দিন যত এগোতে লাগল, মায়ার কর্মকাণ্ড গ্রামবাসীদের নজর কাড়তে শুরু করল। তারা লক্ষ্য করল, মায়া প্রতিদিন ভোরে বা দুপুরে অচেনা দরজায় কড়া নাড়ছে, কারও হাতে চিঠি দিচ্ছে, কারও সঙ্গে নিঃশব্দে কথা বলে আবার চুপচাপ ফিরে আসছে। কেউ কেউ দেখেছে, সে গভীর রাতে নদীর ধারে বসে থাকে, যেন কারও সঙ্গে কথা বলছে। এসব দেখে গ্রামবাসীর মনে ভয় আর সন্দেহ জন্ম নিতে শুরু করল। কারও কারও মনে হলো, মায়া হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছে; কারও কাছে মনে হলো, এ কাজগুলো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, নিশ্চয়ই কোনো অশুভ শক্তির ছোঁয়া আছে। ধীরে ধীরে কানাঘুষো বাড়তে লাগল। কেউ বলল, “ও শয়তানের সঙ্গে যোগ করেছে, তাই এমন আচরণ করছে।” আবার কেউ বলল, “এভাবে রাত কাটানো মানেই অশুভ আত্মাদের খোরাক হওয়া।” মায়া যখন বাজারে যেত, লোকজন ফিসফিস করত, কেউবা তাকে এড়িয়ে যেত। একসময় তার বন্ধুরাও দূরে সরে গেল। গ্রামের পরিবেশ তার জন্য ভারী হয়ে উঠল, যেন প্রতিটি চোখ তার দিকে শঙ্কা আর ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তবুও মায়া জানত, সে যে কাজ করছে তা সঠিক, যদিও সবাই তাকে ভুল বুঝছে।

এই পরিস্থিতি মায়ার ভেতরে ভয় আর দ্বন্দ্ব তৈরি করল। সে নিজেকে প্রশ্ন করত—“আমি কি সত্যিই ভুল করছি? এই আত্মাদের সাহায্য করার জন্য যদি আমার নিজের মানুষরা আমাকে দোষী করে তোলে, তবে কি এই পথে থাকা উচিত?” রাতের পর রাত সে আকাশের নিচে বসে কাঁদত, জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজত। তার ভেতরে ভয় ছিল—যদি একদিন গ্রামের সবাই মিলে তাকে তাড়িয়ে দেয়? যদি তার নিজের পরিবারও তাকে অস্বীকার করে? কিন্তু এর মাঝেই যখন অসংখ্য জোনাকির চোখ তার দিকে জ্বলে উঠত, তখন সে যেন ভরসা পেত। সেই আলো যেন বলত, “তুমি একা নও, আমরা আছি।” এই অদৃশ্য সমর্থনই তাকে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি দিত। মায়া বুঝতে পারছিল, মানুষের অন্ধ বিশ্বাস আর ভয়ের সঙ্গে লড়াই করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। তবুও সে জানত, যদি সে থেমে যায়, তবে আত্মাদের বেদনা চিরদিন অমীমাংসিত থেকে যাবে। প্রতিটি আত্মার চোখে যে আক্ষেপ সে দেখেছে, তা তার ভেতরে শেকড় গেড়ে বসেছে। সে যতই ভয় পাক, সেই চোখগুলোর কথা ভাবলেই তার বুক দৃঢ় হয়ে উঠত।

এভাবে দিন আর রাতের ভেতরে মায়া এক অদ্ভুত যুদ্ধের মধ্যে পড়ে গেল। একদিকে ছিল মানুষের সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অবজ্ঞা, অন্যদিকে ছিল জোনাকিদের নির্ভরতা, তাদের অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের ডাকে সাড়া দেওয়ার দায়িত্ব। কখনো সে মনে করত, হয়তো সত্যিই সে অদ্ভুত এক পথে পা বাড়িয়েছে, যেখানে ফেরার পথ নেই। আবার পরক্ষণেই সে অনুভব করত, এই পথই তার নিয়তি। ভয় তাকে ঘিরে ধরলেও দৃঢ়তা বারবার সেই ভয় ভেঙে ফেলত। গ্রামবাসীদের কটু কথা শুনেও যখন সে নদীর ধারে বসত, জোনাকির আলো তার চোখে ভেসে উঠত মুক্তির প্রতিশ্রুতি হয়ে। তখন তার মনে হতো, এই কাজ কেবল আত্মাদের মুক্তির জন্য নয়, বরং মানুষের অজ্ঞানতার শিকল ভাঙার জন্যও জরুরি। নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বকে জোনাকিদের আলো দিয়েই সামলে নিত সে। আর এভাবেই সন্দেহ, ভয় আর দৃঢ়তার লড়াইয়ের মাঝেই মায়া ধীরে ধীরে আরও শক্ত হয়ে উঠতে লাগল—যেন আলো আর অন্ধকারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক যোদ্ধা, যে একা হলেও সত্যের পথে এগিয়ে চলেছে।

মায়া এতদিন ধরে আত্মাদের গল্প শুনে, তাদের অসমাপ্ত ইচ্ছা পূরণ করে আসছিল নিঃশব্দ যোদ্ধার মতো। কিন্তু একসময় তার ভেতরের গভীরে অচেনা এক ব্যথা নড়ে উঠতে শুরু করল। প্রতিটি আত্মার দুঃখ শুনতে শুনতে সে বুঝতে পারছিল—শুধু তাদের নয়, তার নিজের জীবনেও অসম্পূর্ণতা জমে আছে। শৈশবে মায়া তার মাকে হারিয়েছিল হঠাৎ অসুখে। সেই দিনগুলো এখনো তার স্মৃতিতে স্পষ্ট—রোগশয্যায় শুয়ে থাকা মায়ের কাতর চোখ, আর হঠাৎই ডাক্তাররা ঘোষণা করলেন, সব শেষ। মায়া কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে ছুটে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু গ্রামবাসীরা তাকে বাইরে আটকে রেখেছিল, কারণ তারা বিশ্বাস করত শিশুদের মৃত্যু দৃশ্য দেখা অশুভ। সেই রাতে তার মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলার সুযোগ সে আর পায়নি। সেই অপূর্ণতার বেদনা বহুদিন তার বুকের গভীরে চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু এখন, যখন সে প্রতিরাত আত্মাদের কান্না শুনছে, তখন নিজের না-পারা বিদায়ের শূন্যতা তাকে আরও তীব্রভাবে আঘাত করতে লাগল। মনে হচ্ছিল, অন্যদের মুক্তি দিলেও সে নিজে অন্ধকারে আটকে আছে, কারণ তার সবচেয়ে আপনজনকে বিদায় না জানাতে পারার কষ্ট এখনো তাকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে।

সেই রাতে চাঁদ ছিল ফিকে, আর আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল হালকা কুয়াশা। মায়া নদীর ধারে বসে নিজের ভেতরের অশান্তি সামলাতে পারছিল না। হঠাৎই সে দেখল, অসংখ্য জোনাকির ভিড়ের মাঝে একটি আলোকবিন্দু ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। অন্য আলোদের মতো সেটি নিছক ঝলমল করছিল না, বরং তাতে ছিল এক অদ্ভুত মমতার ছায়া। মায়ার বুক কেঁপে উঠল, চোখ বড় হয়ে গেল, আর সে নিঃশ্বাস আটকে রাখল। আলোটি তার সামনে এসে থেমে গেল, আর মুহূর্তেই সে শুনতে পেল পরিচিত এক কণ্ঠস্বর—তার মা’য়ের। “মায়া, আমি সবসময় তোমার সঙ্গে ছিলাম।” কণ্ঠস্বরটিতে মমতা, শান্তি আর আশীর্বাদের স্নিগ্ধতা মিশে ছিল। মায়ার চোখ ভিজে উঠল অঝোরে। বহুদিনের চাপা কান্না হুহু করে বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে। সে হাত বাড়িয়ে দিতে চাইল, যেন আলোকবিন্দুটাকে ছুঁয়ে মায়ের হাতের উষ্ণতা পেতে পারে। আলোর ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠ আবার শোনা গেল—“তুমি যে কাজ করছ, তা খুবই পবিত্র। তুমি অন্যদের আলো দিচ্ছ, আর আমি সবসময় তোমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে থাকব।” এই কথাগুলো শুনে মায়ার ভেতরের শূন্যতা যেন ধীরে ধীরে পূর্ণ হতে লাগল।

সেই মুহূর্তে মায়া অনুভব করল, সে যেন জন্মের পর প্রথমবারের মতো নিজের সত্যের মুখোমুখি হয়েছে। এতদিন ধরে সে অন্যদের ব্যথা বহন করেছে, তাদের অসমাপ্ত ইচ্ছার ভার কাঁধে নিয়েছে, কিন্তু নিজের ভেতরের অশ্রু গোপন রেখেছিল। মায়ের আশীর্বাদ শোনার পর তার বুকের ভার যেন গলে গেল। সে বুঝতে পারল, নিজের বেদনা স্বীকার না করলে অন্যের ব্যথা বোঝা সম্পূর্ণ হয় না। চোখের জল শুকিয়ে এলে তার মুখে এক নতুন প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যেভাবে সে নিজের অসমাপ্ত ব্যথার মুখোমুখি হয়েছে, ঠিক সেভাবেই অন্যদের সাহায্য করবে, কিন্তু আর নিজের অনুভূতি থেকে পালাবে না। সেই রাত তাকে ভেঙে দিয়েছিল, আবার গড়ে তুলেছিল এক নতুন শক্তি দিয়ে। এখন থেকে তার যাত্রা আর শুধু আত্মাদের মুক্তির জন্য নয়, বরং নিজের ভেতরের সত্যকেও আলিঙ্গন করার পথে। জোনাকিদের আলোতে ভরা সেই অন্ধকার রাত তাই হয়ে উঠল মায়ার জীবনের এক নতুন সূচনা, যেখানে ভেতরের শূন্যতা ভরে গেল ভালোবাসা আর আলোতে।

মায়ার জীবনের পথ এখন সম্পূর্ণ অন্য রূপ নিয়েছে। এতদিন সে ভেবেছিল জোনাকিরা কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক, রাতের অন্ধকারে আলোকবিন্দু হয়ে ওঠা ক্ষুদ্র প্রাণী। কিন্তু এখন তার উপলব্ধি গভীরতর—প্রতিটি আলো একেকটি অসমাপ্ত কাহিনি, একেকটি না-পারা বিদায়, একেকটি ব্যথার স্মৃতি। মায়া বুঝে যায়, এই আলো নিছক ঝলমল নয়, বরং আত্মাদের চিরন্তন তৃষ্ণার প্রকাশ। আর তাদের শান্তিতে রূপান্তরিত করা এখন তার জীবনের দায়িত্ব। এই উপলব্ধি তার ভেতর নতুন শক্তি এনে দিল। একদিকে আছে মানুষের অবিশ্বাস, গঞ্জনা, কখনো কখনো তাচ্ছিল্য, কিন্তু অন্যদিকে আছে অগণিত আত্মার আর্তি, যারা তার দিকে ভরসা নিয়ে তাকিয়ে আছে। মায়া সিদ্ধান্ত নিল নিজের জীবনকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করবে এই কাজের জন্য। সে বুঝল—এটি কোনো অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ। প্রতিটি আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আসলে সে পৃথিবীকে হালকা করে দিচ্ছে, অন্ধকারকে দূরে সরাচ্ছে। আর সেই শক্তি তাকে ভেতর থেকে নতুন আলোয় ভরিয়ে তুলল।

দিন কেটে যেতে লাগল, আর গ্রামবাসীরা ধীরে ধীরে তার কাজে পরিবর্তন দেখতে পেল। যাদের কাছে সে কোনো মৃত আত্মার শেষ কথা পৌঁছে দিল, তারা প্রথমে অবাক হলেও পরে অনুভব করল সত্যিকারের শান্তি। এক তরুণী, যে বাবাকে হারিয়েছিল হঠাৎ দুর্ঘটনায়, মায়ার দেওয়া বাবার শেষ শুভেচ্ছা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। সেই কান্নার পর তার মুখে যে প্রশান্তি ফুটে উঠল, তা দেখে গ্রামের মানুষ ভাবতে বাধ্য হলো—হয়তো মায়া সত্যিই কিছু করছে। একইভাবে এক বৃদ্ধ কৃষক, যিনি স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন বহু বছর আগে, মায়ার মাধ্যমে স্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনার বার্তা শুনে অঝোরে কাঁদলেন, আর এরপর যেন তার বহুদিনের হাহাকার মুছে গেল। এসব ঘটনাই ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের মন পাল্টে দিল। যারা আগে বলত মায়া পাগল কিংবা অশুভ শক্তির সঙ্গে যুক্ত, তারা এখন তার পাশে দাঁড়াতে শুরু করল। গ্রামের আড্ডায়, মেলায়, এমনকি মন্দিরের পূজোতেও মায়ার কথা আলোচনায় আসতে লাগল। সবাই বলতে শুরু করল—“ও যে কাজ করছে, তা আমাদের সবার জন্য আশীর্বাদ।” মায়ার নিঃসঙ্গতা ভাঙল, আর তার ভেতরের আলো এবার বাইরের জগতেও ছড়িয়ে পড়ল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরো গ্রামই বদলে গেল। রাত নামলে গ্রামবাসীরা আর ভয়ে ঘরবন্দি থাকত না। তারা আকাশের দিকে তাকাত, আর অসংখ্য জোনাকি দেখে ভাবত—এরা কেবল আলো নয়, এরা মুক্তির পথে যাত্রা করা আত্মা। মায়ার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকেই ছোটখাটো সাহায্য করতে শুরু করল—কেউ চিঠি লিখতে সাহায্য করত, কেউ দূরের গ্রামে বার্তা পৌঁছে দিতে যেত। ধীরে ধীরে মায়ার ব্যক্তিগত সংগ্রাম হয়ে উঠল সমষ্টিগত উৎসব। প্রতিটি আত্মা যখন মুক্তি পেত, আরেকটি জোনাকির আলো মিলিয়ে যেত, তখন গ্রামের মানুষরা যেন একসঙ্গে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলত। এভাবে গ্রামের রাতগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তবে আর নিছক ঝলমল আলোয় নয়—এইবার তা মুক্তির সুরে ভরা। প্রতিটি জোনাকি যেন অন্ধকারে আলোর দিশা দেখানোর পাশাপাশি জীবিতদেরও শিক্ষা দিল—অসমাপ্ত ব্যথা জমিয়ে রাখা নয়, তা পূর্ণতা দেওয়াই শান্তির আসল পথ। মায়া নিজেকে খুঁজে পেল এই আলোয় মিশে গিয়ে, যেখানে সে কেবল একজন গ্রাম্য মেয়ে নয়, বরং আশ্রয়দাত্রী, মুক্তিদাত্রী। তার জীবন হয়ে উঠল জোনাকিদের আলো, আর সেই আলো ছড়িয়ে পড়ল আকাশ থেকে মাটির প্রতিটি কোণে, মানুষের হৃদয় থেকে আত্মাদের চিরশান্তিতে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *