Bangla - সামাজিক গল্প

মায়ার দোকান

Spread the love

গৌরি রায়


ছায়াপুর—পাহাড়ঘেরা সবুজ এক গ্রাম, যেখানে রেলগাড়ি আসে না, রাতের অন্ধকারে কুয়াশা গা ছমছম করে ছড়িয়ে পড়ে আর মানুষ অচেনাকে ভয় পেয়ে গল্প বানিয়ে নেয়। সেই গ্রামের এক প্রান্তে, পুরনো তালগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরের মতো কাঠের দোকান, নাম নেই, বোর্ড নেই, অথচ সবাই জানে—ওটাই “মায়ার দোকান”। গ্রামের লোকেরা তাকে “ডাইনীর দোকান” বলে ডাকে, মুখের হাসির আড়ালে জড়ায় শঙ্কা, ভয় আর অদ্ভুত সব গুজব। কেউ বলে, সেখানে গেলে মানুষ বদলে যায়, কারও রোগ সারে, কারও গোপন চিঠি এসে পৌঁছে যায় যেভাবে জানে না কেউ। এই দোকানের মালকিন—মায়া—এক রহস্যময়, একলা থাকা, অর্ধেক সাদা শাড়িতে ঢাকা, গভীর চোখের এক মহিলা। অনেকে বলে, তার বয়স পঞ্চাশের বেশি, অনেকে বলে সে জাদু জানে। শিশুরা তার দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মা-বাবার হাত ধরে রাখে শক্ত করে, আর মায়া শুধু জানালার পাশে বসে ছোট্ট কাঠের মেঝেতে, একটা ধুপকাঠি জ্বালিয়ে চুপচাপ বসে থাকে, যেন কারও অপেক্ষায়। সে কারও সঙ্গে কথা বেশি বলে না, জিজ্ঞেস করলে এক শব্দে উত্তর দেয়, আর দোকানের ভেতর যা আছে—তা যেন কোনো সাধারণ দোকানের জিনিস নয়—কখনও পুরনো সাদা ওষুধের শিশি, কখনও ছেঁড়া বই, কখনও পুরোনো একজোড়া চশমা, আবার কারও জন্য অদ্ভুতভাবে একটা চিঠি, যা সে বলে, “তোমার দরকার হবে।”

এইসব কুসংস্কারময় পরিবেশেই ছায়াপুর স্কুলে নতুন শিক্ষক হয়ে যোগ দেন গোবিন্দ মাস্টার, শহরের মানুষ, যুক্তিবাদী মন, কুসংস্কারে একটুও বিশ্বাস নেই। প্রথম দিনই স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি খেয়াল করেন লোকজন একটা দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেও চোখ রাখে না, এমনকি রিকশাওয়ালা দোকানের পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নেয় রিকশা। কৌতূহলে তিনি দোকানটা দেখতে যান। তিনি তখনও জানতেন না, এই জায়গাটা নিয়ে পুরো গ্রামের মুখে মুখে রটেছে কত কিছু। দোকানটা বাইরে থেকে ধুলোমাখা, কিন্তু ভেতরে পা রাখতেই আশ্চর্যভাবে ধূপের গন্ধে একধরনের প্রশান্তি আসে মনে। ভেতরে মায়া বসে, চোখ নিচু করে ধুপকাঠির ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। গোবিন্দ মাস্টার সালাম জানিয়ে বলেন, “আপনার দোকানটা কেমন অদ্ভুত, কিন্তু খুব শান্ত,” মায়া মুখ তুলে তাকিয়ে শুধু বলেন, “যে যা খোঁজে, সেটাই পায়।” সেই প্রথম দিনের পর থেকেই গোবিন্দ মাস্টারের মনে এক অদ্ভুত প্রশ্ন ঘোরে—এই মহিলা কে? কেন গ্রামের লোকেরা তাকে ভয় পায়, অথচ তার দোকানে এত কিছু পাওয়া যায়, যা মনে হয় কাউকে না কাউকে চিনে শুনে দেওয়া হয়েছে? এদিকে গ্রামের লোকেরা খবর পেয়ে যায়, মাস্টারমশাই নাকি ডাইনীর দোকানে গেছেন। রঘু দা, যিনি বছরের পর বছর ধরে গ্রামের মুদি দোকান চালান, কাঁচা গলিতে দাঁড়িয়ে বলেন, “বাবু, ভালো মানুষ আপনি, কিন্তু ওই দোকানে গেলে মন ঘুরে যায়, সাবধানে থাকবেন।” গোবিন্দ হেসে এড়িয়ে যান, কিন্তু ভেতরে কেমন যেন এক অনভিজ্ঞ কৌতূহল কাজ করতে থাকে।

অন্যদিকে সোমু, কুন্তলার ছোট ছেলে, সে-ই একমাত্র শিশু যে ভয় না পেয়ে প্রায়ই মায়ার দোকানে যায়। কুন্তলা, একজন বিধবা মা, তার জীবন চলে সেলাই আর বাড়ি বাড়ি রান্না করে। সোমুর হাঁপানির সমস্যা আছে, হঠাৎ একদিন সে মায়ার দোকানে গিয়ে ফিরে আসে হাতে এক পুরনো চকলেটের কৌটো আর একজোড়া ছোট্ট ইনহেলার। কুন্তলা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে—“ওই দোকানের জিনিস বাড়িতে এনেছিস? ভেতরটা নষ্ট হয়ে যাবে তোকে নিয়ে!” সে ইনহেলার ফেলে দিতে যায়, কিন্তু রাতের বেলা যখন সোমুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয় আর ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, তখন কুন্তলা বাধ্য হয়ে সেই ইনহেলার ব্যবহার করে। আশ্চর্যভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেটা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে রাতে কুন্তলা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে মায়ার দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকে, বাইরে হালকা বৃষ্টি, আর দোকানের জানালা দিয়ে দেখা যায়—মায়া বসে আছেন ধূপের ধোঁয়ার ভেতরে, যেন তিনিও কারও ঘুম পাহারা দিচ্ছেন। গোবিন্দ মাস্টার বইয়ের পাতার বাইরে বাস্তবের এক নতুন অধ্যায় খুঁজে পান, আর গ্রাম জুড়ে আবার গুজব ছড়ায়—মায়া কি সত্যিই ডাইনী? নাকি এমন কেউ, যে গ্রামের মানুষদের অজান্তেই তাদের ভালোটা বোঝে? প্রশ্নের ভেতরেই ছায়াপুরের অন্ধকারে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করে, এক অচেনা, অস্বস্তিকর আলো যা হয়তো পরিবর্তনের পূর্বাভাস।

***

পরদিন দুপুরে, ছায়াপুর গ্রামের স্কুল ছুটি হওয়ার পর গোবিন্দ মাস্টার একা হাঁটছিলেন মায়ার দোকানের দিকে। তার মনে একটা অদ্ভুত টান কাজ করছিল—যেন মায়ার দোকানটা শুধু একটা দোকান নয়, একটা ধাঁধা, একটা দরজা, যার ওপারে লুকিয়ে আছে কিছু অজানা গল্প। তিনি গিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়াতেই মায়া মাথা তুলে তাকালেন না, বরং ধুপকাঠির গন্ধে ঘোরে থাকা ধোঁয়ার মধ্যে চোখ রাখলেন। গোবিন্দ মাস্টার ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকে এক কোনায় রাখা কাঠের টুলে বসলেন, সামনে তাকিয়ে দেখলেন—দোকানের তাকভর্তি পুরনো জিনিস: কারো পুরনো ছাতা, পুরনো রেডিও, ছেঁড়া ছাতাপড়া বই, গহনার খালি বাক্স, এমনকি কিছু চিঠির বান্ডিল, হলদে হয়ে যাওয়া কাগজে হাতে লেখা, অদ্ভুতভাবে সাজিয়ে রাখা। গোবিন্দ মাস্টার বললেন, “এত কিছু কীভাবে জোগাড় করেন?” মায়া মুখ তুলে না তাকিয়ে বললেন, “যারা ফেলে রেখে যায়, আমি রেখে দিই—সময় এলে ওগুলো নিজের মানুষ খুঁজে নেয়।” কথাটা শুনে গোবিন্দ থমকে গেলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে দোকানে ঢুকলেন একজন বৃদ্ধ মানুষ, গায়ে ময়লা ধুতি, হাতে একটা পুরনো কাপড়ের থলে, চোখে ঘোলাটে চশমা। তিনি ঢুকেই ধপ করে বসে বললেন, “তুই চিনবি না আমায়, আমি তোর দোকানে বহুদিন আগে এসেছিলাম, আমার একটা চিঠি ছিল হারিয়ে গিয়েছিল। তুই বলেছিলি, একদিন পাবো।” গোবিন্দ মাস্টার বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইলেন। মায়া উঠে গিয়ে দোকানের পেছনের এক ছোট্ট বালুচিক্কি খুলে ভিতর থেকে একটি চিঠি বের করে এনে বৃদ্ধের হাতে দিলেন। চিঠিটা একেবারে মলিন, কিন্তু বাঁধা ছিল একটা লাল সুতো দিয়ে। বৃদ্ধ কাঁপা হাতে সেটা খুলে পড়তে শুরু করলেন, আর চোখ থেকে ঝরতে লাগল অশ্রু। তিনি বললেন, “এটা আমার ছেলের চিঠি, বিদেশ থেকে পাঠিয়েছিল… আমি তখন বুঝিনি সে আর ফিরবে না। চিঠিটা আমার হাতেই আসার কথা ছিল, কিন্তু হারিয়ে গিয়েছিল…।” গোবিন্দ মাস্টার স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এই মহিলার কাছে কীভাবে সেই হারানো চিঠি এল, সেটা প্রশ্ন করার সাহস তার হল না, কারণ মায়ার চোখে ছিল সেই অপার ধৈর্যের ছায়া, যা ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে।

চিঠির ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল গ্রামের অলিতে-গলিতে। কেউ বিশ্বাস করল, কেউ বলল মায়া আগে থেকেই এসব জিনিস রেখে দিয়ে লোকের দুর্বল মুহূর্তে নাটক করে। কিন্তু কুন্তলা চুপচাপ মায়ার দোকানের পেছনের দরজায় গিয়ে তাকে বলল, “তুমি ওরকম চিঠি কিভাবে রাখো?” মায়া বলল, “যে কষ্ট বোঝে, সে অপেক্ষা করতে পারে। কাগজ ফেলে গেলে কাগজ হয়ে যায়, আমি কষ্টটা রেখে দিই।” সোমু এবার প্রায় রোজ মায়ার কাছে গিয়ে বসে, গল্প করে, একদিন বলে, “মায়া মা, তুমি জাদু জানো?” মায়া হেসে বলে, “তুই জানিস না, আমি কিন্তু ডাইনী।” সোমু ভাবে সে মজা করছে। কিন্তু সেই রাতে, এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। গ্রামের সবচেয়ে কৃপণ লোক, গোপাল হালদার, হঠাৎ তার দাদার মৃত্যুর ২০ বছর পরে একটা পেনড্রাইভ মায়ার দোকানে খুঁজে পায়, যেখানে সেই দাদার গলায় বাঁধা গান রেকর্ড করা ছিল। গোবিন্দ মাস্টার এবার আর চুপ থাকতে পারেন না। তিনি একটি ছুটির দিনে মায়ার সঙ্গে বসে বলেন, “আপনি আসলে কী করেন?” মায়া বলেন, “আমি কিছুই করি না। মানুষ ফেলে যায় তার নিজের ব্যথা, আর কেউ একজন খোঁজে—আমি মাঝখানে বসে থাকি, ধরে রাখি।” কথাগুলো যেন সহজ, কিন্তু গভীর। গোবিন্দ বুঝতে পারেন, এই দোকানটা কোনো অলৌকিক জায়গা নয়, কিন্তু এর ভিতরে এমন কিছু আছে যা আধুনিক যুক্তির বাইরে—এটা এমন এক জায়গা, যেখানে মানুষের ভুলে যাওয়া জিনিস ফেরে ঠিক সময়ে, যেমন কোনও অব্যক্ত ক্ষমা, কোনও পুরনো স্মৃতি, বা কোনও অপূর্ণ কথা।

মায়ার দোকান এখন আর শুধুই ভয়ের জায়গা নয়। কিছু মানুষ কৌতূহল নিয়ে ঢোকে, কিছু লোক লুকিয়ে এসে দেখে, আবার কেউ কেউ চুপচাপ এসে পুরনো জিনিস রেখে দিয়ে যায় আশায়—হয়তো কোনোদিন কেউ সেটা খুঁজে নেবে। কিন্তু রঘু দা বিষয়টাকে সহজভাবে নেয় না। সে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে বলে, “জাদু দিয়ে মানুষকে কাঁদানো আর মানবতা এক জিনিস নয়!” সে একদিন চিৎকার করে বলে, “যদি এতই ভালো কাজ করো, তবে কেন মুখ চেয়ে থাকে, লোকের কষ্ট নিয়ে বসে থাকে?” মায়া তখন শুধু উত্তর দেয়, “তুমি কষ্ট বোঝো না, তাই তোমার কথায় রাগ নেই।” গোবিন্দ মাস্টার এসব শুনে চিন্তা করেন—এই গ্রামে সত্যিই অন্ধকার আছে, কিন্তু আলো আসছে ধীরে ধীরে, মায়ার মতো মানুষের হাত ধরে। তিনি স্থির করেন, এই দোকানের সত্যি ঘটনাগুলো একদিন তিনি লিখবেন, যেন মানুষ জানে, মানবতা কেমন করে প্রতিদিন একটা ছোট দোকানে ধূপের গন্ধে অপেক্ষা করে।

***

গ্রামে শীত পড়তে শুরু করেছে। ভোরবেলা কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছায়াপুর যেন আরও নির্জন, আরও গুমোট হয়ে ওঠে। এই সময়টাতেই রঘু দার স্ত্রী বিনীতা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড জ্বর, হঠাৎ শ্বাসকষ্ট আর গায়ে অজানা ব্যথা। রঘু দা, গ্রামের একগুঁয়ে মুদি দোকানদার, ডাক্তার ডাকে না, ঝাড়ফুঁক শুরু করে, বৈদ্য রামাইকে বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু তিনদিন কেটে গেলেও বিনীতার অবস্থার উন্নতি হয় না। গোটা গ্রামে কানাঘুষো শুরু হয়—“বোধহয় ডাইনীর চোখ লেগেছে!” রঘু দা নিজেই লোকজনের সামনে ঘোষণা করে বসে, “এইসব রোগ, এইসব বাতাস—সব ওই মায়ার দোকানের ধোঁয়া থেকে আসে! যেদিন থেকে মাস্টারমশাই সেখানে গেছেন, গ্রামে অশুভ কিছু ঢুকেছে।” কেউ কেউ মাথা নাড়ায়, কেউ কেউ চুপ করে থাকে, কিন্তু পরদিন সকালে রঘু দা নিজেই দেখা যায়, গা ঢাকা দিয়ে দোকানের উল্টো গলি ধরে মায়ার দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখে কালো চশমা, মুখে কাপড় জড়ানো—কেউ চিনতে পারল না ঠিকই, কিন্তু গোবিন্দ মাস্টার স্কুল থেকে ফেরার পথে বিষয়টা খেয়াল করলেন।

মায়ার দোকানে ঢুকে রঘু দা প্রথমে কথা বলেননি। তিনি একটা খালি টুলে বসে শুধু মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মায়া তখন ধুপকাঠি গুঁজে দিচ্ছিলেন ছোট্ট একটা মাটির পাত্রে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তিনি বললেন, “স্ত্রী কেমন?” রঘু দা আঁৎকে উঠেছিলেন। মায়া বলেছিলেন, “আজ তোমার কথা শোনে না শরীরটা, কালও হয়তো না, কিন্তু একটা তেল আছে, গায়ে মালিশ করালে, ভোরবেলায় যদি ঘুমাতে পারে, তাহলে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।” মায়া একটা ছোট শিশিতে হলদেটে রঙের তেল দিয়ে একটা কাগজে মোড়ানো বার করে দিলেন, কোনো দাম চাইলেন না, শুধু বললেন, “তোমার ভয়টাই বড় রুগ্ন।” রঘু দা সেটা নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফেরেন, বিনীতার পায়ে, বুকে, কপালে সেই তেল ঘষেন, আর মনে মনে বলেন, “যদি ভালো হয়, তবে বুঝবো ও ডাইনী নয়।” সকালবেলা বিনীতা যখন কিছু খেতে চায়, উঠে বসে বলেন, “আজ হালকা লাগছে”—রঘু দার মুখে তখনও কোনও হাসি নেই, কিন্তু তার চোখের গভীরে একটা কাপা-কাপা নিরবতা ছিল। অথচ সে মুখে কিছু স্বীকার করে না। দোকানে গিয়ে চুপচাপ জিনিস নেয়, কিন্তু কারও সামনে কিছু বলে না। বরং গ্রামে বলে বেড়ায়, “ওভাবে একটা দিন ভালো লাগতেই পারে, সব মায়ার কৃতিত্ব নয়!”

কিন্তু গোবিন্দ মাস্টার, কুন্তলা এবং সোমু জানে, কী ঘটেছে। তারা বুঝতে পারে, মায়ার আসল শক্তি শুধু ওষুধ বা পুরনো জিনিস নয়—তার শক্তি হল মানুষকে বোঝার, তাকে ধৈর্য দিয়ে সময় দেওয়ার ক্ষমতা। সেই দিন থেকেই মায়ার দোকানে কদাচিৎ দেখা যায় কিছু নতুন মুখ—যেমন এক বৃদ্ধা যিনি মায়ার কাছ থেকে একটি পুরনো আয়না চান, যেটা তার মৃত মেয়ের ঘরে ছিল; বা এক কিশোরী, যার মা মারা যাওয়ার আগে একটি কবিতার খাতা রেখে গিয়েছিলেন, যা সে খুঁজে পায় ঠিক এই দোকানে। মায়া কোনোদিন কাউকে বলে না, জিনিসগুলো কিভাবে এল, কে দিয়ে গেল, কবে রেখে গেল। সে শুধু বলে, “সব কিছু ফিরে আসে, যদি তার প্রয়োজন শেষ না হয়।” কিন্তু রঘু দা অস্বস্তি বোধ করে, কারণ তার ভেতরের রক্ষণশীলতা, তার গড়ে তোলা ভয়ের সাম্রাজ্য—সব এখন ধীরে ধীরে ধসে যাচ্ছে। তার নিজের স্ত্রী এখন মাঝে মাঝে বলে ওঠেন, “ও মহিলা খারাপ নয় রে রঘু, একটা ধন্যবাদের কথা অন্তত বলা যেত।” কিন্তু রঘু দা তখন মুখ ঘুরিয়ে বলেন, “ডাইনীর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া যায় নাকি?” আর মায়া প্রতিদিনের মতো ধুপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকে, যেন ওই গন্ধেই তার উত্তর, আর দোকানের কোনায় রাখা সব পুরনো জিনিস যেন অপেক্ষায় থাকে—কখন তাদের খোঁজে আবার কেউ আসবে, একজন, যাকে সমাজ ‘ভয়’ বলে চালালেও, সে আসলে শুধু ‘মানবতা’র মুখ।

***

সন্ধ্যার ছায়া নেমে এলে ছায়াপুর গ্রাম যেন আরেক রূপ নেয়। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, চায়ের কেটলি স্তব্ধ হয়, খুঁটিতে ঝোলানো কেরোসিন ল্যাম্পগুলো দপদপ করে জ্বলে ওঠে। ঠিক এমন এক সন্ধ্যাবেলায় কুন্তলা মাটির উঠোনে বসে নিজের সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। সোমু পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎই তার বাড়ির পাশ দিয়ে তাড়াহুড়া করে হেঁটে যেতে দেখলেন রামাই বৈদ্যকে—মাথা নিচু, হাতে একটা থলে। কিছু একটা অস্বাভাবিক ছিল তার ভঙ্গিতে। কুন্তলা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চুপ করে যান, কারণ যেদিকে রামাই যাচ্ছেন, সেটা মায়ার দোকানের পথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে ফিরে এলো স্মৃতির মতো চাপা একটি ধূপের গন্ধ—চেনা, কিন্তু ব্যাখ্যাতীত। এদিকে, গোবিন্দ মাস্টার যিনি বিকেলবেলা অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন লাইব্রেরিতে, ফিরতি পথে হঠাৎ দেখেন—রামাই বৈদ্য মায়ার দোকান থেকে বেরোচ্ছে, এবং বেরিয়ে এসে মাথা নিচু করে দ্রুত গলির ভিতর মিলিয়ে গেল। পরদিন সকালে আবার শোনা গেল, রামাই বৈদ্যের একমাত্র মেয়ে—বৃষ্টি—যে কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছিল, হঠাৎ অনেকটাই সুস্থ। রামাই লোকজনকে বলেন, “মা কালীর কৃপা, রাত্তিরে প্রার্থনা করেছিলাম, শুনেছেন।” কিন্তু কিছু মানুষ জানে—সে রাতে তিনি কোথায় গিয়েছিলেন।

গোবিন্দ মাস্টার মায়ার দোকানে এসে বসে থাকেন অনেকটা সময় ধরে। দোকানে ঢোকার সময় যেন একটা অন্য জগতের দরজা খোলে। ছোট ছোট তাকের গায়ে ধুলো জমে থাকলেও প্রতিটি জিনিস এমনভাবে রাখা যেন কারো অপেক্ষায়, কোন এক কথার অসমাপ্ত বাক্যর মত। তিনি একদিন বলেন, “আপনি তো ডাক্তার নন, কিন্তু আপনি যেভাবে মানুষের শরীর আর মনের ভাষা বোঝেন, সেটা শিক্ষায় শেখা যায় না।” মায়া ধীর স্বরে বলেন, “আমি শুনি। মানুষ যা মুখে বলে না, শরীর তা বলে। কষ্টের গন্ধ থাকে, ভয় শরীরে বাসা বাঁধে, আমি শুধু সেগুলো আলাদা করতে শিখেছি। এটা চিকিৎসা নয়, এটা সহানুভূতির ভাষা।” সেই দিন থেকেই গোবিন্দ বুঝতে পারেন, এই দোকান শুধু দোকান নয়—এটা একটা নিরাময়ের আশ্রয়, যেখানে মানুষ নিজেকে আবার চিনে নিতে পারে। গ্রামের অনেকেই এখনো দ্বিধায়, অনেকেই চুপ করে আছেন, কিন্তু কিছু মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে—“মায়া ডাইনী নয়, হয়তো উনি বোঝেন—আমাদের মতো মানুষদের ভুলে যাওয়া কষ্টগুলো।” এদিকে সোমু প্রায় রোজ মায়ার দোকানে গিয়ে বসে, চুপচাপ তার ধূপের ধোঁয়ার ভেতর ছবি বানায় মনে মনে—মায়াকে ঘিরে একটা কুয়াশাচাপা আলোয় মোড়া রাজ্য, যেখানে মানুষ শুধু তাদের হারানো জিনিসগুলো ফিরে পায় না, ফিরে পায় নিজের ভেতরের সাহসটুকুও।

কুন্তলা একদিন মায়ার দোকানে গিয়ে তাকে বলেন, “তুমি যে এত কিছু জানো, এত মানুষের দুঃখ বুঝো—তোমার নিজের দুঃখগুলো কোথায় রাখো?” মায়া তখন অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “আমার ছেলেটা যখন মারা গেল, শহরের হাসপাতালের দোরগোড়ায়, তখন আমি শুধু ভাবছিলাম—যদি একটুখানি ইনহেলার সময়মতো পেতো… সেই দিন আমি ঠিক করেছিলাম, আমার কাছে যা থাকবে, তা আমি রেখে দেবো, হয়তো কাউকে বাঁচাতে পারবে। আমি তো ডাক্তার হতে পারিনি, কিন্তু একটা দোকান বানাতে পেরেছি, যেখানে সময়মতো মানুষ যা খোঁজে তা পায়।” কুন্তলার চোখে জল চলে আসে। সে জানে, তার ছেলেকে একবার শ্বাস ফেরাতে যে ইনহেলারটা দরকার ছিল, সেটা কোনো বড় হাসপাতাল নয়—এই ছোট্ট দোকানটাই জুগিয়েছিল। আর এখন যখন লোকেরা রঘু দার স্ত্রীর সুস্থতার গল্প শোনে, কেউ বলে “ভাগ্য”, কেউ বলে “ঝাড়ফুঁক”, কেউ কিছু বলে না—কিন্তু রাতের অন্ধকারে, ধূপের আলোর নিচে, একটা দোকান জেগে থাকে, যেখানে কিছু মানুষের কষ্ট জমে ওঠে বোতলে, চিঠিতে, তেলে, কবিতায়। আর সেইসব বস্তু নিয়ে মায়া বসে থাকেন, যেমন একজন দুঃখ বুঝতে পারা মানুষ, যিনি নিজের কথা বলেন না, শুধু শোনেন।

***

সন্ধ্যার আকাশ ঘনকালো, ছায়াপুরে কুয়াশা একটু তাড়াতাড়িই নামছে আজ। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে থাকা বাতাস যেন গায়ে ছুঁয়ে দিয়ে যায় পুরনো ভয়ের ছায়া। এমনই এক রাতে মায়ার দোকানে হঠাৎ ঢুকে পড়ে এক দল মানুষ, তাদের মধ্যে একজন গর্ভবতী মহিলা, যার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, পেটের ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে। আশপাশে কেউ ডাক্তার খুঁজে পায় না, কেউ ওঝার কাছে ছুটে যায় না—কারণ সময় নেই। একমাত্র সিদ্ধান্ত নেয় রবি, গ্রামের এক তরুণ কৃষক, যে মায়ার দোকানের গুজবে কান না দিয়ে বলে, “ওই মহিলার প্রাণ আগে, ভয় পরে।” দোকানের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই মায়া চোখ তুলে তাকিয়ে বলেন, “চোখে ভয় নিয়ে এসেছো, কিন্তু মন বলছে—তুমি সাহসী।” রবির কাঁধে রাখা মহিলাকে মায়া ভেতরে নিয়ে যান, কুন্তলা দৌড়ে গরম জল নিয়ে আসে, সোমু দড়ি খুলে দেয়, আর গোবিন্দ মাস্টার খবর পেয়ে ছুটে আসেন। বাইরে তখন গ্রামবাসীরা থমকে, কারো চোখে আতঙ্ক, কারো মুখে কানাঘুষো, কেউ কেউ ভাবছে—এবার হয়তো প্রমাণ হবে, মায়া ডাইনী না দেবী।

ভেতরে সেই রাতে যা ঘটেছিল, তা কারো পুরোপুরি জানা নেই। কেউ বলেন, মায়া মেয়েটিকে গরম জলে ভিজিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ বলেন, তার পায়ের রগে একধরনের তেল ঘষা হয়েছিল, কেউ বলেন, সে শুধু মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়েছিল। কিন্তু ফলাফলটা ছিল স্পষ্ট—রাত পেরিয়ে সকালে মেয়েটি সুস্থভাবে কথা বলতে শুরু করে। তার মুখে একটিই কথা ছিল—“যখন ব্যথায় আর পারছিলাম না, তখন ওর স্পর্শে মনে হয়েছিল আমি মায়ের কোলে আছি।” সকালবেলা গোবিন্দ মাস্টার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলেছিলেন, “আপনারা ভয় পান, কারণ আপনি জানেন না, বোঝেন না, শুধু শোনেন—গুজব, ভ্রান্তি, আর বিভ্রান্তি। কিন্তু আজ, একটা জীবন বাঁচানোর জন্য এই দোকান ছাড়া আর কোথাও কেউ ছিল না।” সেদিন প্রথম কেউ প্রকাশ্যে মায়ার পক্ষে কথা বললেন, আর গোবিন্দের কথা গায়ে না মেখে ফেলতে পারল না গ্রাম। কিছু মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল, কিছু মুখ অশ্রু সামলাতে পারল না। রঘু দা দূর থেকে দেখলেন, কিছু একটা বদলে যাচ্ছে—যে ভয়ের প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে ফাটল ধরছে।

সেই রাতের পর মায়ার দোকানে নতুন আলো বসানো হয়—না, বিদ্যুৎ নয়, রবির উপহার দেওয়া একটি সোলার ল্যাম্প, যাতে করে দোকানটা রাতে আর অন্ধকারে না ডোবে। কেউ কেউ বলে, এখন আর ওটা “ডাইনীর দোকান” নয়, “মানবতার আলো”। কিন্তু মায়া তাতে গা ভাসান না, যেমন চুপচাপ ছিলেন, তেমনই থাকেন। তিনি জানেন, এই স্বীকৃতির পেছনে এখনো অনেক প্রশ্ন, অনেক সন্দেহ জমে আছে। তবু, প্রতিদিন কেউ না কেউ আসছে—কেউ একটুকরো পুরনো ছবি খুঁজে নিচ্ছে, কেউ বাতিল হয়ে যাওয়া রেডিওটা মেরামতের জন্য দিয়ে যাচ্ছে, কেউ কারো জন্য রেখে গেছে ছোট্ট একটা গামছা, যেন কোনোদিন দরকার হতে পারে। সোমু নতুন নাম দিয়েছে দোকানটার—“আলোর ঘর।” আর কুন্তলা প্রতি সন্ধ্যায় এক কাপ দুধ নিয়ে আসে মায়ার জন্য, কোনো কথা না বলে, শুধু রেখে যায়। গোবিন্দ মাস্টার এখন মাঝে মাঝে সেখানে বসে বই পড়ে, আর লেখে—একটা উপন্যাসের খসড়া, নাম রেখেছেন মায়ার দোকান। আর গ্রামের লোকেরা, যারা আগে মুখ ফিরিয়ে নিত, তারা এখন একে একে এসে দাঁড়ায় দোকানের সামনে, কিছু চায় না, কিছু কেনে না—শুধু দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, যেন বুঝে নিতে চায়, অন্ধকারের পরে সত্যিই কোনো আলো আছে কিনা।

***

গ্রামে যখন আলোর সঞ্চার শুরু হয়েছে, ঠিক তখনই তার উল্টো দিকে নেমে আসে ভয় আর হিংসার ছায়া—কারণ যখন সমাজ বদলায়, তখন কিছু মানুষ সেই পরিবর্তনের সামনে নিজেকে অসহায় মনে করে, ভয় পায় তার অস্তিত্ব হারানোর। রামাই বৈদ্য সেই মানুষগুলোর একজন। যিনি এতদিন ধরে নিজেকে গ্রাম্য চিকিৎসা, ঝাড়ফুঁক আর গুজবের অদৃশ্য প্রভু ভেবেছেন, তিনিই এখন সবচেয়ে বেশি কাঁপছেন মায়ার দোকানের জনপ্রিয়তা দেখে। মানুষ এখন আর তার কাছে আসছে না আগের মতো, মন্দিরের পাশে রাখা ধানের গাছের মালা বা গাঁদার পাতায় বাঁধা কালো সুতোতে কারও আর বিশ্বাস নেই। এই অসহায়তাই রামাইকে করে তোলে হিংস্র, এবং সে সিদ্ধান্ত নেয়—মায়াকে সরিয়ে দিতে হবে, নইলে নিজের অস্তিত্ব আর থাকবে না। সে একদিন কৌশলে গ্রামে গুজব ছড়ায়, “শুনেছেন? মায়ার একটা ছেলে ছিল। সে শহরে গিয়ে জাদু শিখেছিল। পরে খবর এল, সে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে, আর তার আত্মা এখনও মায়ের দোকানের ভিতর ঘোরে।” কিছু মানুষ আবারও কান দেয়, কারণ ভয় সহজে পিছু ছাড়ে না। এমনকি রঘু দাও মুখ টিপে বলেন, “খোঁজ নিচ্ছিলাম আমিও… সত্যি নাকি!”

এই কথা কানে যেতেই গোবিন্দ মাস্টার আর চুপ থাকেন না। তিনি খোঁজ নেন মায়ার অতীতের, শহরের হাসপাতালের পুরনো রেকর্ড থেকে বের করেন সত্যি—মায়ার একমাত্র ছেলে, অয়ন, মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিল। এক দুর্ঘটনায় মারা যায়, এবং মৃত্যুর আগে সে একটি চিঠি লিখেছিল—“মা, মানুষের পাশে দাঁড়াতে শিখেছি, তোমার কাছ থেকেও শিখব।” সেই চিঠি মায়া তার দোকানের ভেতর, এক পুরনো বইয়ের পাতার ভাঁজে রেখে দিয়েছিলেন, কখনো কাউকে দেখাননি। গোবিন্দ চিঠিটি পড়ে চোখে জল নিয়ে দোকানে এসে বলেন, “আপনার দোকান শুধু দোকান নয়, এটা তো আপনার ছেলের শেষ ইচ্ছার চিহ্ন।” মায়া শান্ত গলায় বলেন, “মানুষ যখন হারায়, তখন সে একটা আলো খোঁজে। আমি আমার আলো হারিয়েছি, তাই অন্যদের আলোর পথটা ধরে বসে আছি।” কথাটা কানে যেতেই কুন্তলা, রবি, এমনকি রঘু দার স্ত্রী বিনীতা এসে দাঁড়ান মায়ার পাশে। সোমু সেই রাতে দোকানের দরজায় রং করে লেখে—“ডাইনীর দোকান নয়, মা-র দোকান।”

কিন্তু রামাই এই সম্মিলিত ভালোবাসায় চুপ করে থাকতে পারে না। সে ঠিক করে, কিছু ছেলেপুলে নিয়ে রাতে দোকানে আগুন লাগিয়ে দেবে, যাতে ‘ভয়ের উৎস’ চিরতরে মুছে যায়। গোবিন্দ মাস্টার আগেই আঁচ পান, কুন্তলা তাকে জানান কিছু কানাঘুষো, আর রাত নামতেই তারা দোকানের পাশে পাহারা দেন। হঠাৎই রাত বারোটার সময় কয়েকজন ছায়া দোকানের দিকে এগোয়, হাতে কেরোসিন আর মশাল। কিন্তু তখনই মায়া দরজা খুলে বেরিয়ে দাঁড়ান, তার চোখে কোনো ভয় নেই, শুধু ধুপের ধোঁয়ার মতো নীরবতা। তিনি বলেন, “আগুনে ভয় কাটে। লাগাও, যদি মনে হয় এতে আমার অপমান হবে, তবে লাগাও। কিন্তু জানবে, আমি পুড়ে গেলেও ভালোবাসা পুড়বে না।” ছেলেগুলো থমকে যায়। কুন্তলা, গোবিন্দ, রবি সবাই তখন এসে দাঁড়ায় তার পাশে। কেউ কিছু বলে না, শুধু একসঙ্গে দাঁড়ায়। সেই রাতে আগুন লাগেনি, কিন্তু গ্রামের বুকে এক কঠিন পর্দা পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়—ভয়ের, কুসংস্কারের, আর অপমানের। মায়া আবারও ধুপ জ্বালিয়ে বসেন, আর পরদিন সকালে দোকানের বারান্দায় রাখা থাকে ছোট্ট একখানা চিঠি—কোনো নাম লেখা নেই, শুধু লেখা—“ভয়কে জয় করেছো, এখন ভালোবাসাও তোমার।”

***

রাতের সেই ভাঙনের পর ছায়াপুর যেন একটা নতুন সকাল দেখতে পেল। আগুন না লাগলেও, আগুনের আশঙ্কা যেটুকু শিকড় ছড়িয়েছিল, তার ধোঁয়া এখনও কিছু মানুষকে কুয়াশার মতো ঘিরে রেখেছে। রামাই বৈদ্য গ্রাম ছাড়েনি, কিন্তু তার হাসি আর ঝাড়ফুঁক দুটোই নিস্তেজ। গ্রামের মোড়ে এখন কেউ মায়াকে “ডাইনী” বলে ডাকতে সাহস করে না, কিন্তু মুখে নাম নেয় না বলেও, ভিতরে ভিতরে সেই ভয়টুকু কিছু মানুষের হৃদয়ে গেঁথে রয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় এক সকালে গোবিন্দ মাস্টার স্কুল যাওয়ার পথে আবিষ্কার করলেন—মায়ার দোকানের দরজা বন্ধ, অথচ দরজার নিচে একে একে রাখা রয়েছে সাদা খামে মোড়া চিঠির বান্ডিল। প্রতিটা খামের উপর কারও না কারও নাম। তিনি অবাক হয়ে একটা তুলে দেখলেন—তাতে লেখা ‘রঘু ঘোষাল’। অন্যটা কুন্তলার জন্য, একটা সোমুর নামে, একটা এমনকি তার নিজেরও। হঠাৎ দোকানের জানালা খুলে গেল ধীরে, আর ভিতর থেকে দেখা গেল মায়া এক কোণায় বসে আছেন, ধুপকাঠির ধোঁয়া ধীরে ধীরে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।

সেই চিঠিগুলোর ভাষা ছিল অবর্ণনীয়। রঘুর চিঠিতে ছিল একটি ছোট্ট পেনড্রাইভ, যেখানে তার স্ত্রীর ছোটবেলার কিছু গান রেকর্ড করা, যা সে ভুলে গিয়েছিল—অথচ তার স্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর আগে সেগুলো একবার শুনে যাওয়া। কুন্তলার খামে ছিল তার মায়ের লেখা একটি পুরনো চিঠি, যা সে ভাবত হারিয়ে গেছে বহু বছর আগে। সেখানে লেখা ছিল—“জীবনে একদিন এমন একটা মুহূর্ত আসবে, যখন তুমি ভাঙবে, তখন মনে করিস, আমি পাশে আছি।” সোমুর চিঠির মধ্যে ছিল তার আঁকা একটি ছোট্ট ছবি—এক রাজকন্যার, হাতে ধুপকাঠি, পেছনে আলো, আর ছবির নিচে লেখা—“আমার মা-র দোকান।” আর গোবিন্দ মাস্টারের চিঠিতে মায়া লিখেছিলেন—“তুমি লিখতে চেয়েছিলে, আমি শুধু তোমাকে শব্দ দিলাম। এই গল্পটা শেষ হলে, মনে রেখো—এটা শুধু আমার নয়, এটা আমাদের সকলের গল্প।” গোবিন্দ সেই চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে যান। সেই মুহূর্তে তিনি বুঝে যান—মায়া সবসময় জানতেন কে কী খুঁজছে, কে কোথায় ভাঙছে, কে কোথায় দিশাহীন। তার দোকান ছিল সেই শ্বাসের মতো, যা বোঝা যায় না, কিন্তু না থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত।

চিঠির ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে ছায়াপুরে। প্রথমবার গ্রামের লোকেরা নিজেরাই কথা তোলে—“ও তো শুধু দোকান চালায় না, ও তো স্মৃতি ধরে রাখে।” কেউ বলে, “মায়া কি তবে আমাদের সবার গল্প জানতেন?” কেউ চোখ মুছে ফেলে বলে, “ও তো আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যেকার নীরবতা।” কিন্তু সেই দিন বিকেলবেলা আবার দেখা যায় মায়ার দোকান খোলা, জানালায় ধূপের গন্ধ, তাকের উপর আগের মতোই রাখা পুরনো কাঁচের বোতল, ছেঁড়া বই, ওষুধের শিশি আর চিঠির বান্ডিল। তবে একটা পরিবর্তন হয়েছিল—দোকানের সামনে ছোট একটা কাঠের বোর্ড ঝুলছে, লেখা—“মানুষের মনে যেটুকু মায়া বাঁচে, সেটুকুই আমার দোকান।” আর নিচে ছোট্ট করে লেখা—“ভয় নয়, ভালোবাসা থাকুক।” সেই দিন থেকে গ্রামের মানুষ শুধুই ‘মায়ার দোকান’ বলত না, বলত, “ওই তো আমাদের একটা জায়গা—যেখানে কষ্ট রেখে আসা যায়, আর ফিরে পাওয়া যায় নিজের আলো।”

***

সন্ধ্যাবেলার রোদ ছায়াপুরে যেন একটু বেশি সোনালি হয়ে নামে আজকাল। তালগাছের ছায়া লম্বা হয়, বাতাসে ধুপের গন্ধ ছাড়া আর কিছুই থাকে না। মায়ার দোকান এখন আর একা পড়ে থাকে না—সকালে শিশুদের হাসির আওয়াজে ভরে ওঠে, দুপুরে কেউ বই খুঁজতে আসে, বিকেলে কেউ চুপ করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। কিন্তু মায়া একটু একটু করে যেন কম কথা বলছেন। গোবিন্দ মাস্টার লক্ষ্য করেছেন, মায়ার চোখের তলায় গাঢ় ছায়া, শরীরটা যেন কেমন দুর্বল। কুন্তলা একদিন বলেই ফেলেন, “তোমার শরীরটা ঠিক আছে তো?” মায়া শুধু বলেন, “আমার ভিতরটা আর পুরনো জিনিস রাখে না কুন্তলা, ওগুলো এখন নিজের ঠিকানা খুঁজে নিচ্ছে।” সেই কথাগুলো যেন ধূপের গন্ধের মতো মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে—অস্পষ্ট, অথচ চেনা। সোমু একদিন দেখে, মায়া তার ছেলের সেই পুরনো ছবিটা ধরে বসে আছেন, আর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দ জল। দোকানের ভিতরে যেন বাতাসও তখন ধীর হয়ে যায়, বোঝে—শেষ অধ্যায়ের প্রস্তুতি চলছে। গোবিন্দ মাস্টার একদিন বলেন, “আপনার এই দোকান একদিন বন্ধ হয়ে গেলে?” মায়া হাসেন, “দোকান বন্ধ হয়, আলো নয়। আমি থাকি না থাকি, আলোটুকু রেখে যাব।”

তবে এর মধ্যেই একটি চূড়ান্ত বিস্ময় গ্রামবাসীদের সামনে আসে। এক বিকেলে, গ্রামে এক অচেনা মানুষ আসে—কালো ব্যাগ কাঁধে, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখে মোটা চশমা। সে কারো সঙ্গে বেশি কথা বলে না, শুধু মায়ার দোকানে গিয়ে চুপ করে দাঁড়ায় অনেকক্ষণ। পরে জানা যায়, সে একজন লেখক, শহরের এক পত্রিকায় “ভুলে যাওয়া ভারত” নামে একটি সিরিজ লেখেন, যেখানে তুলে ধরেন অজানা মানুষদের গল্প—যাঁরা আলো হয়ে থাকেন অন্যের জীবনে। তিনি মায়ার কথা জানতে পেরে এসেছেন, কেবল দেখার জন্য। তিনি কিছু লেখেন না, কিছু জিজ্ঞেসও করেন না—শুধু একটি ছোট্ট ছবি তোলেন দোকানের। তারপর মাসখানেক পর সেই লেখকের লেখা ছাপা হয়, নাম—“The Woman Who Held Time”। সেই গল্পে তিনি লেখেন, “এই দেশে কতশত বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সমাজকর্মী আছেন—তবে আমি একবার একটি ছোট গ্রামে এক মহিলাকে দেখেছিলাম, যিনি একটি দোকানে পুরনো জিনিস রাখতেন, অথচ আসলে তিনি সময়কে ধরে রাখতেন—ভয়, কষ্ট, অনুশোচনা, স্মৃতি আর ভালোবাসার সময়কে। তিনি মানুষকে ফিরিয়ে দিতেন তাঁদের হারানো আত্মবিশ্বাস, আত্মপরিচয়। সেই মহিলা ছিলেন—মায়া।” সেই লেখার পর ছায়াপুর শুধু আর এক গ্রাম নয়, হয়ে ওঠে এক প্রতীকের জায়গা—যেখানে কুসংস্কারের ভিত ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল মানবতা।

সেই বছরের শেষ বিকেলে, আশ্বিন মাসের এক নীরব সকালে, মায়ার দোকান বন্ধ থাকে প্রথমবারের মতো। দরজায় ঝোলানো থাকে একটি ছোট্ট বোর্ড—“আজ দোকান খোলা নেই, আজ আমি নিজের মতো সময় চাই।” কেউ জোর করে না, কেউ প্রশ্নও করে না। বিকেলে গোবিন্দ মাস্টার, কুন্তলা, রবি, আর ছোট সোমু গিয়ে দাঁড়ায় দোকানের সামনে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, মায়া ধুপকাঠি হাতে বসে আছেন, সামনে রাখা অয়নের চিঠি, পাশে তার শেষ কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। সন্ধ্যার আলো এসে পড়ে তার চুলে—যা এক সময় কুন্দ ফুলের মতো ছিল, এখন ছাইরঙা। সোমু চুপ করে জানালার ধারে রেখে যায় তার আঁকা একটা ছবি—মায়ার দোকান, তার সামনে লেখা, “যতদিন মানুষ কষ্ট নিয়ে বাঁচে, ততদিন মায়া থাকবে।” পরদিন ভোরে গ্রামের মানুষ যখন জড়ো হয়, দেখে মায়ার দোকান খোলা, ধুপ জ্বলছে, কিন্তু ভিতরে কেউ নেই। টেবিলের উপর শুধু একটি চিঠি, লেখা—“আমি চললাম। আমার জায়গা ফাঁকা নয়, কারণ তোমাদের মধ্যে কেউ একজন ঠিক বসে যাবে সেখানে। আমি শুধু মানুষকে ভালোবাসতাম, ভয় পেতাম না। সেই ভালোবাসার নামই ছিল আমার দোকান।”

***

মায়া চলে যাওয়ার পর ছায়াপুর গ্রাম প্রথমবার বুঝল—একটা মানুষ কীভাবে একা এক গ্রামকে পাল্টে দিতে পারে, অথচ তার বিদায় হয় নিঃশব্দ, ধূপের ধোঁয়ার মতো হালকা। তার কোনো দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় না, কোনো শোকসভা হয় না, কোনো পুরোহিত আসেন না। কিন্তু মানুষ একে একে আসতে থাকে দোকানের সামনে, কেউ একটা পুরনো চিঠি রেখে যায়, কেউ একটা গাঁদার মালা, কেউ তার নিজের হাতে বানানো একটা পুতুল। দোকানের ভেতরটা একদিন সাফ করে কুন্তলা আর গোবিন্দ মাস্টার সাজিয়ে তোলেন, ঠিক যেমনটা মায়া রেখে গিয়েছিলেন—টাকগুলো একই রকম, ধূপের পাত্র সেই পুরনো জায়গায়, আর মাঝখানে মায়ার জন্য রাখা একটা খালি চেয়ারে একটা ছায়া যেন বসে থাকে সবসময়। সোমু জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকে—আজ সে মায়ার দোকানে নতুন এক বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে, লেখা—“এখানে কেবল পুরনো জিনিসই নয়, পুরনো মানুষদের গল্পও রাখা হয়।” রবি মাঝে মাঝে দোকান দেখে, গ্রামের যুবকদের বলে, “ভবিষ্যতে এই জায়গা শুধু কুসংস্কারের কথা নয়, আলো আর সাহসের জায়গা হবে।”

গোবিন্দ মাস্টার অবসর নেওয়ার পর লেখেন মায়ার দোকান নামক একটি বই। বইটি প্রথমে শুধু ছায়াপুরের মানুষ পড়েন, পরে তা পৌঁছে যায় শহরের পাঠাগারে, কলেজের ক্লাসরুমে, এমনকি এক আন্তর্জাতিক বইমেলাতেও জায়গা পায়। বইটিতে শুধুই কাহিনি নয়, থাকে চিঠির অনুলিপি, থাকে পুরনো ঘটনার নথি, থাকে মানুষদের অনুভব। শহরের এক নামকরা মনস্তত্ত্ববিদ লেখেন—“এই দোকান ছিল একরকম থেরাপি, যেখানে মানুষ নিজের ব্যথা, ভুল, অসম্পূর্ণতা, ভয় আর আশা জমা দিয়ে নিরাময় খুঁজত। এমন একজন মহিলা, যিনি কোনো চিকিৎসা জানতেন না, তবু কষ্ট বোঝার ভাষা জানতেন—তিনি আমাদের আধুনিক মানবিকতার মুখ।” কুন্তলা আর রবি মিলে ঠিক করেন, দোকানটাকে চালিয়ে রাখবেন ঠিক আগের মতোই—কেউ আসবে, কেউ রেখে যাবে কিছু, কেউ খুঁজে পাবে পুরনো হারিয়ে যাওয়া নিজেকে। দোকানের নাম ‘মায়ার দোকান’ই থাকে, কিন্তু তার নিচে এক নতুন লাইন লেখা হয়—“ভয় নয়, ভালোবাসাই শেষ সত্যি।”

সোমু বড় হয়ে শহরে পড়ে, কিন্তু প্রতি বছর আশ্বিন মাসে সে ফিরে আসে ছায়াপুরে। দোকানে গিয়ে সে বসে জানালার ধারে, মায়ের মতো ধুপকাঠি জ্বালে, আর একটা ছবি আঁকে। সেই ছবিতে থাকে এক মহিলা, যার চোখে গভীর ক্লান্তি, কিন্তু মুখে একরকম শান্তি। সে জানে—মায়া কোনোদিন হারিয়ে যাননি, তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন প্রতিটি ভালোবাসার কাজে, প্রতিটি নির্ভীক উচ্চারণে, প্রতিটি চিঠির পাতায়, যেগুলো কোনো এক খোলা জানালার ধারে পড়ে থাকে মানুষের অপেক্ষায়। এক সন্ধ্যায়, হঠাৎ ঝড়ের রাতে, দোকানের জানালা খুলে যায় একা একা। কুন্তলা ছুটে এসে দেখে—ধুপকাঠি জ্বলছে, অথচ দোকানে কেউ নেই। সে মুচকি হেসে বলে, “ফিরেছেন বুঝি? ঠিক জানতাম…” বাতাসে ধূপের গন্ধ মিলিয়ে যায় দূরের দিকে, আর জানালার কাঁচে পড়ে থাকা একটা হলুদ কাগজে লেখা থাকে—“যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে আমি থাকি।”

____

 

1000032577.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *