শ্রেয়সী ঘোষাল
১
তপনজ্যোতি মুখার্জি ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আগরতলা রেলস্টেশনের ঠিক বাইরে। ভোরবেলা ট্রেন এসে পৌঁছেছে, কিন্তু ত্রিপুরার পাহাড়ি বাতাসে যেন এক অজানা কিছুর গন্ধ ছিল—অদ্ভুত, রহস্যময়, আর আকর্ষণীয়। সামনে এসে দাঁড়ালেন মৃণালিনী ধর, তার একহাতে একটি নোটবুক, আর অন্যহাতে একটি পুরনো মানচিত্র। এই মানচিত্রেই চিহ্নিত করা ছিল মানিকছড়ি—একটা প্রায় হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ি গ্রামের নাম, যেটা আজকের কোনও আধুনিক ম্যাপে খুঁজে পাওয়া যায় না। তপনজ্যোতি, একজন ডকুমেন্টারি নির্মাতা, পুরনো লোককথা নিয়ে কাজ করেন। কিছুদিন আগে একটি ট্রাইবাল মিউজিয়ামে পুরনো বই ঘাঁটতে গিয়ে এই ‘সময়-বিচ্ছিন্ন’ গ্রামের খোঁজ পান। তখনই ঠিক করেন, তিনি সেখানে যাবেন—যা খুঁজে পাওয়ার নয়, তাকেই খুঁজে আনবেন। তার সঙ্গী হিসেবে এই অভিযানে আছেন আরও তিনজন—মৃণালিনী, যিনি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ; বিবেক দত্ত, অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ও ট্র্যাকার; এবং অন্বেষা রায়, তরুণী ব্লগার ও ফটোগ্রাফার। এই অভিযানের উদ্দেশ্য শুধুই ভিডিও করা নয়, বরং এমন কিছু রেকর্ড করা, যা মানুষের বিশ্বাসের সীমানা ছুঁয়ে যেতে পারে।
গাড়ি রিজার্ভ করে তারা এগোতে লাগল আগরতলার শহর ছেড়ে ধীরে ধীরে দুর্গম অঞ্চলের দিকে। প্রথমদিকে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও, দুই ঘণ্টা পর পথ যেন ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল। রাস্তাগুলো সরু হতে থাকল, মোবাইল নেটওয়ার্ক একদম নেই, এবং জিপিএস কাজ করা বন্ধ করল। মৃণালিনী মানচিত্র দেখে বুঝিয়ে দিল—তারা এখন সরকারি ম্যাপের বাইরের অঞ্চলে প্রবেশ করছে, যেখানে সবকিছুই শুধু স্থানীয় মানুষের মুখে শোনা কথার ওপর নির্ভরশীল। রাস্তার দুই পাশে ঘন বন আর মাঝে মাঝে পাহাড়ি ঝর্ণা দেখা যায়। অন্বেষা বারবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছবি তুলছিল, কিন্তু কিছু একটা যেন তার মনকে অস্থির করে তুলছিল—যেন চারপাশে কোথাও কেউ চোখ রেখে আছে। দুপুর গড়িয়ে গেলেও তারা কোনো জনপদে পৌঁছায়নি। বিবেক গাড়ি থামিয়ে বলল, “আমরা হয়তো ভুল পথে যাচ্ছি।” ঠিক তখনই, দূরে এক পাহাড়ি ছায়ার নিচে দেখা গেল একটি পাথরের তোরণ, যার ওপরে ক্ষয়ে যাওয়া ছিন্ন হরফে লেখা: “মানিকছড়ি গ্রাম”। আশ্চর্যের বিষয়, এই তোরণ কোনো রাস্তার সঙ্গে যুক্ত নয়—সেটা যেন জঙ্গল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে। সবার চোখ একসাথে সেই দিকেই গেল। মৃণালিনী ফিসফিস করে বলল, “এই চিহ্ন তো আমার দাদুর গল্পে শুনেছি… একবার ঢুকলে কেউ আর ফিরে আসে না…।”
তবুও চারজন মিলে হাঁটা শুরু করল সেই পাথরের তোরণের ভেতর দিয়ে। ভিতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে আশেপাশের শব্দ থেমে গেল। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে এলেও পাখির শব্দ নেই, বাতাস নেই, এমনকি সূর্যটাও যেন এক জায়গায় থেমে আছে। তপনজ্যোতি ঘড়ি দেখল—সময় থেমে আছে ৩:১৮-এ। কেউ কথা বলছিল না, শুধু হাঁটার আওয়াজ আর ভেতরের চাপা অস্বস্তি। কিছুদূর হাঁটার পর একটা চড়াই এল, যার ওপারে দেখা গেল একটি অদ্ভুত শান্ত পাহাড়ি গ্রাম—ঘরবাড়িগুলো কাঠ আর মাটির, কিন্তু অদ্ভুতভাবে ধুলোমুক্ত, ঝকঝকে। গ্রামের মাঝখানে একটা বিশাল বটগাছ, যার গায়ে জড়ানো রয়েছে লাল কাপড়, মালা, আর পুরনো তাম্রপত্র। এমনকি পথঘাটও যেন অনেক দিনের পুরনো, অথচ কোনও জীর্ণতা নেই। গ্রামে মানুষের দেখা নেই, অথচ ঘর থেকে ভাতের গন্ধ আসছে, দরজা খোলা, যেন কেউ আড়াল থেকে দেখছে। হঠাৎ তপনজ্যোতির ক্যামেরা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। অন্বেষার মোবাইলের স্ক্রিন সাদা হয়ে যায়। তারা জানে, এবার তারা এমন এক স্থানে ঢুকেছে, যেখানে সময় আর নিয়মের কোন মানে নেই—এটা শুধু একটা গ্রাম নয়, এটা একটা ছায়া, এক রহস্যময় কুয়াশার মতো জায়গা, যার নাম মানিকছড়ি।
২
তারা গ্রামের প্রথম পথঘাটে পা রাখতেই অনুভব করল, যেন এক অদৃশ্য চাদরে মোড়া সময়ের গায়ে পা দিচ্ছে তারা। বাতাস ছিল শান্ত, কিন্তু সেই শান্তিতে যেন ছিল এক অবর্ণনীয় ভার—যেমনটা হয় কোনও শ্মশানের নিরবতায়। বটগাছটার পাশে দাঁড়িয়ে তপনজ্যোতি ক্যামেরা বের করে শট নিতে চাইল, কিন্তু তার ডিএসএলআর-এর পাওয়ার অন হচ্ছিল না। নতুন চার্জ দেওয়া ব্যাটারি হঠাৎই ডেড দেখাচ্ছিল। অন্বেষা বলল, “আমার ফোনেও কোনো ছবি সেভ হচ্ছে না। স্ক্রিন সাদা হয়ে যাচ্ছে… এটাও কি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফেয়ারেন্স?” মৃণালিনী একপ্রকার হতভম্ব হয়ে চারদিক দেখছিল। রাস্তার পাশে রাখা একটি কাঠের টুলে সে হঠাৎ চোখে পড়ে কিছু লেখা—অসম্পূর্ণ, তবুও স্পষ্ট: ‘বাইরের কেউ যেন ঢুকতে না পারে।’ সেই লেখাটা আধা মোছা, কিন্তু এত স্পষ্টভাবে আঁচড় কাটা যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল একসময়। একটু এগোতেই দেখা গেল একটা পুরনো দরজা, টিনের ছাউনি দেওয়া একচালা ঘর, দরজাটা অল্প খোলা। দরজার আড়াল থেকে তখনই কাঁপা গলায় কেউ বলে উঠল—“তোমরা বাইরের লোক, না?” চারজন একসঙ্গে থমকে দাঁড়াল। দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটি বয়স্ক মানুষ—লম্বা ধুতি পরা, কাঁধে সাদা গামছা, চোখে মোটা কাঁচের চশমা। সেই প্রথম দেখা গেল মানিকছড়ির প্রথম জীবন্ত মানুষ—বেণীমাধব চৌধুরী।
বেণীমাধব তাদের ভিতরে ডেকে নিলেন। ঘরের ভিতরটা বেশ পরিপাটি, কিন্তু খুব পুরনো—যেন ১৯৪০-এর দশকের ঘর, কোন পরিবর্তন হয়নি। তেল-দেওয়া কাঠের মেঝে, দেয়ালে সাদা-কালো ছবি, পুরনো হারমোনিয়াম, আর জানালার পাশে রাখা ধুলো ধরা রেডিও। “তোমাদের ঘড়ি চলছে?” তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন। তপনজ্যোতি বলল, “না… আমার ঘড়ি ৩:১৮-এ থেমে আছে।” বেণীমাধব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক তাই তো হয়… এটাই হয় এখানে। মানিকছড়িতে সময় চলে না—এখানে স্মৃতিরা ঘোরে। যারা বাইরে থেকে আসে, তারা বুঝতে পারে না প্রথমে, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা হারিয়ে যায়… কে কোথায় গেছে, কে ফিরে এসেছে—তা জানে না কেউ। এখানে ঢুকলে সময়ের হিসেব বদলে যায়।” চারজন একে অপরের দিকে তাকায়, যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। মৃণালিনী ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কত বছর ধরে আছেন এখানে?” বেণীমাধব শান্তভাবে উত্তর দিলেন, “আমিও জানি না। কবে এসেছি, মনে নেই। কেবল এটুকু মনে আছে, আমি এখানে এসেছিলাম আমার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে। এখন শুধু আমি আছি… বাকিরা সময়ের স্রোতে কোথায় গিয়েছেন, জানি না।” কথাগুলো যেন ঠান্ডা বাতাসে মিশে যাচ্ছিল। অন্বেষা ততক্ষণে বাইরের বারান্দা থেকে দেখতে পেল, এক দূরের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ের অবয়ব—ধনিষ্ঠা। সে হেসে তাকাচ্ছে, কিন্তু তার চোখে যেন এক চিরন্তন অভিমান জমে রয়েছে।
তারা রাতে বেণীমাধবের ঘরেই থাকার ব্যবস্থা করে। চারপাশে গভীর অন্ধকার, কোনও আলো নেই, কেবল বটগাছের নিচে কয়েকটা দীপ জ্বলছে। সেই আলোতে কিছুক্ষণের জন্য তারা দেখতে পায়, গ্রামের ঘরগুলোতে যেন ছায়ার মতো কিছু মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে—কিন্তু কেউ মুখ ফেরায় না, কেউ কথা বলে না, কেউ যেন কোথাও যাচ্ছে না। অন্বেষা আবার সেই মেয়েটিকে দেখে, যাকে সে আগেও দেখেছিল—এইবার আরও কাছ থেকে। মেয়েটির চোখে যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা, আর ঠোঁটে একটি ছেঁড়া হাসি। তপনজ্যোতি জানে, কিছু একটা ঠিক নয়। এই গ্রাম যেন কোনও বাস্তব স্থানে নেই, বরং সময়ের কোনো প্রাচীন স্তরে আটকে গেছে। মৃণালিনী রাত্রে নোট লিখতে গিয়ে আবিষ্কার করে, তার পেনের কালি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। সে রাত্রে স্বপ্ন দেখে—এক বৃদ্ধ তার দিকে তাকিয়ে বলছে, “সময়কে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি আমরা… তাকে আর জাগিও না।” সেই রাতে কেউ ভালো ঘুমাতে পারে না। আর পরের সকালে যখন তারা উঠল, তখন বটগাছের নিচে ধূপের ধোঁয়া উড়ছে—কিন্তু আগুন জ্বালানোর কোনও চিহ্ন নেই। তারা বুঝতে পারে, মানিকছড়ি তাদের এক অনন্ত মায়ার ভেতরে টেনে নিচ্ছে, ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে।
৩
সকালবেলা বেণীমাধব চৌধুরীর ঘরের বাইরে সূর্য থেমে থাকার মতোই দেখাচ্ছিল। আলো আছে, কিন্তু তার তীব্রতা বাড়ে না, ছায়াও ছোটে না। চারদিকে ধোঁয়াটে নরম রোদ—যেন কেউ স্বপ্নে রং মিশিয়ে দিচ্ছে সময়ের গায়ে। মৃণালিনী ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে বটগাছের দিকে তাকিয়ে রইল। পাতাগুলো একটুও নড়ছে না, বাতাস নেই, কিন্তু তবু গাছটি যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ভিতরে, বেণীমাধব বসে ছিলেন হারমোনিয়ামের পাশে, চোখ বুজে। তপনজ্যোতি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি বলছিলেন, আপনি এখানে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন… তারা কোথায় এখন?” বেণীমাধব চোখ খুলে তাকালেন, তার দৃষ্টিতে ছিল শুষ্ক নিঃসঙ্গতা। তিনি বললেন, “ওরা এখন সময়ের ওপারে। মানিকছড়িতে সময় যখন থেমে গেল, তখন কিছু মানুষ স্থির থেকে গেল, কেউ ধ্বংস হয়ে গেল, আর কেউ হয়তো এখন ছায়া হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমার মেয়ে ধনিষ্ঠা… তোমরা হয়তো তাকে দেখেছ গতকাল সন্ধ্যায়। ও এখন তোমাদের সঙ্গে কথা বলবে, হাঁটবে, কিন্তু সময়ের নদী তাকে আর ছোঁবে না।” অন্বেষা ঠিক তখনই ঘরে ঢোকে এবং থমকে দাঁড়ায়। “আমি ওকে দেখেছি… বারান্দা থেকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু আমি বুঝিনি…” বেণীমাধব চুপচাপ বললেন, “বোঝা যাবে না। এখানে সবকিছু ধোঁয়ার মতো। স্মৃতি যেমন ধরা যায় না, মানিকছড়িও ধরা পড়ে না। এখানে যার যা অপূর্ণ, তা চিরকাল ঘুরে বেড়ায়—একটা গল্প হয়ে। আমি শুধু অপেক্ষা করছি, কবে আমার গল্পটা শেষ হবে।”
বিবেক বাইরে বেরিয়ে এল, তার হাতে ছিল একটা কম্পাস, যা সে পাহাড়ি ট্রেকিংয়ে সবসময় সঙ্গে রাখে। কিন্তু এখানে কম্পাস ঘূর্ণায়মান অবস্থায় থেকে যাচ্ছে, উত্তর-দক্ষিণ কোন দিকে, বোঝাই যাচ্ছে না। সে গাছের গায়ে একটা ছোট খোদাই লক্ষ্য করে—‘১৮৫৬’ সাল খোদাই করা, তার নিচে লেখা, “নাম ভুলে যেও না, তবেই মুক্তি।” সে মাটিতে বসে পড়ে, এবং ধীরে ধীরে তার ভয় জমতে শুরু করে—এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে তারা, যা শুধু জ্যামিতিক নয়, সময়গতভাবেও ঘোর লাগা অবস্থায় আটকে রয়েছে। মৃণালিনী তখন একটি পুরনো বইয়ের পাতা পড়ে বের করল—তার দাদুর লেখা নোট, যেখানে মানিকছড়ির উল্লেখ ছিল। বইয়ে লেখা ছিল, “মানিকছড়ি ছিল এক পাণ্ডব-যুগীয় স্থান, যেখানে মানুষ নয়, স্মৃতি বাস করে। যারা প্রবেশ করে, তারা তাদের অতীতের ছায়ার মুখোমুখি হয়।” মৃণালিনী ভয় পেল না, বরং তার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। সে বটগাছের পেছনের দিকে ঘুরে গিয়ে দেখতে পেল, এক ছোট্ট মন্দির—ধ্বংসপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনও রক্ষিত। ভেতরে ছিল এক কালো শিবলিঙ্গ, আর পাশে এক কাঁসার থালা, যাতে শুকিয়ে যাওয়া কিছু লাল পাতা আর পাথরের মূর্তি রাখা।
ঠিক তখনই ধনিষ্ঠা এল। সে মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “আপনি দাদুর বই পড়ছেন?” মৃণালিনী অবাক হয়ে তাকাল, “তুমি আমার কথা জানো?” ধনিষ্ঠা মাথা নাড়ল, “এই গ্রামে যারা আসে, তারা সবাই কোথাও না কোথাও নিজেদের হারানো অংশকে খুঁজতে আসে। কেউ ভুলে যেতে, কেউ মনে রাখতে।” মেয়েটির কথায় অদ্ভুত ভার ছিল—যেন সে এক পুরোনো সুর গাইছে। অন্বেষা জানালার ফাঁক দিয়ে ওদের দেখছিল, কিন্তু তার মাথায় তখন ঘুরছিল আগের রাতে দেখা স্বপ্নটা—একটা গলির মোড়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, আর পেছনে হাঁটছে ধনিষ্ঠার মতোই দেখতে অনেকগুলো মেয়ে, প্রত্যেকের মুখে সেই একই ছেঁড়া হাসি। তপনজ্যোতি তখন বসে ক্যামেরা ঠিক করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু স্ক্রিন শুধু কালো দেখাচ্ছিল। সে জানত, তার ডকুমেন্টারি এবার হয়তো এমন কিছু নিয়ে হবে, যা শুধু দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। মানিকছড়ি আর তার মানুষগুলো তাকে প্রতিনিয়ত টানছে এক অদৃশ্য বাস্তবতার দিকে—যেখানে সময় স্থির, স্মৃতি জীবন্ত, আর মানুষরা গল্পের ছায়া মাত্র।
৪
ধনিষ্ঠার চোখে কিছু একটা ছিল—কেমন যেন কুয়াশায় ঢাকা আলো। সে কথা বলছিল, হাঁটছিল, হাসছিল ঠিকই, কিন্তু তার শরীরের গতিবিধি ছিল অস্বাভাবিক ধীর আর ছন্দহীন। অন্বেষা প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিল, ভেবেছিল কোনও স্থানীয় কিশোরী হবে। কিন্তু পরদিন সকালে ওকে যতই কাছ থেকে দেখছে, ততই একটা অসঙ্গতি মনে হচ্ছিল—মেয়েটির মুখ যেন পুরনো ছবি থেকে উঠে আসা, গলায় ছোট্ট লাল পুঁতির মালা, আর তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাপড়ের নকশা সবই ছিল অনেক পুরনো দিনের। অন্বেষা সাহস করে বলল, “তুমি কি এখানে একাই থাকো?” ধনিষ্ঠা হেসে বলল, “আমি একা নই। এখানে সবাই আছে, শুধু তোমরা দেখতে পাও না।” তার হাসিটা থেমে যাওয়ার পর হঠাৎ আশেপাশের বাতাস ভারী হয়ে এল, আর একটা ঠাণ্ডা শিরশিরে অনুভূতি অন্বেষার গা ঘিরে ধরল। মৃণালিনী ততক্ষণে বটগাছের পেছনের মন্দিরটা ঘুরে এসে ধনিষ্ঠার কথার গভীরতা বুঝতে চেষ্টা করছিল। সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি জানো, মানিকছড়ির সময় থেমে গেছে?” ধনিষ্ঠা একটু চুপ করে থেকে বলল, “এখানে সময় কেউ ধরে রাখে না, সময় এখানে মানুষকে ধরে রাখে। তুমি যদি ভুলে যাও, তাহলে তুমি এখানকারই হয়ে যাবে।”
তপনজ্যোতি আর বিবেক তখন গ্রামের দক্ষিণ দিকে রওনা দিয়েছে, একটা পাহাড়ি টিলার দিকে, যেটা বেণীমাধব ‘ছায়াপাহাড়’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তারা দেখতে চায়, এই গ্রামের গণ্ডি কোথায় গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু পাহাড়ে ওঠার সময় তারা খেয়াল করে, যে তারা যত ওপরে উঠছে, তাদের পায়ের নিচের জমি ততটাই একই জায়গায় ঘুরে ফিরে আসছে—যেন তারা হাঁটছে, কিন্তু এগোচ্ছে না। হঠাৎ বিবেক থেমে বলল, “দেখেছো? আমরা ঠিক এই গাছটার পাশ দিয়েই ৫ মিনিট আগে হেঁটেছিলাম।” তপনজ্যোতি চমকে ওঠে, সে তার পকেট থেকে একটা চক বের করে গাছটার গায়ে X চিহ্ন দিয়ে দেয়। এরপর আবার তারা হাঁটা শুরু করে। দশ মিনিট পর, তারা আবার সেই গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে, আর চক দিয়ে দেওয়া সেই X এখনও ঠিক জায়গায়। তারা বুঝতে পারে, এই গ্রাম শুধু সময় নয়, স্থানকেও বন্ধ করে রেখেছে। তাদের আলোচনার সময়েই হঠাৎ ছায়ার মতো কিছু নড়েচড়ে উঠল পাহাড়ের ওপরে—আলো-ছায়ার খেলায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়, কিন্তু বিবেক নিশ্চিত, সে কিছু একটা দেখেছে। সে তাড়াতাড়ি ক্যামেরা তুলতেই ব্যাটারি ডেড। তপনজ্যোতি তাকিয়ে বলে, “আমরা এখানে যতই আধুনিক হই, এই জায়গা আমাদের বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে।”
এদিকে, অন্বেষা আর মৃণালিনী গ্রামের মধ্যে একটা পরিত্যক্ত স্কুলঘর দেখতে পায়। ভেতরে টেবিল-চেয়ার, ব্ল্যাকবোর্ড, এমনকি পুরনো খাতা পড়ে আছে, যেখানে লেখা—‘১৯৫৭ সালের ফাইনাল পরীক্ষা’। ধুলো নেই, জঞ্জাল নেই—সবকিছু যেন সেই দিনের মতোই পড়ে আছে, কেবল ছাত্ররা নেই। মৃণালিনী চোখের চশমা খুলে বলল, “এই গ্রামের সবকিছু থেমে গেছে, কিন্তু নষ্ট হয়নি। যেন কেউ এখানে প্রতিদিন সব ঝাড়ুদিয়ে রাখছে, স্মৃতি পরিষ্কার করে রাখছে।” ঠিক তখনই, অন্বেষা জানালার বাইরে দেখতে পায় ধনিষ্ঠা দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখে চোখ রাখে অন্বেষার সঙ্গে—তিন সেকেন্ডের জন্য। সেই চোখে যেন স্রেফ জল নয়, এক ইতিহাসের ভার ছিল। অন্বেষা চমকে উঠে দরজার দিকে দৌড়োয়, কিন্তু বাইরে গিয়ে দেখে কেউ নেই। চারদিকে ছায়া, ঝরা পাতার আওয়াজ, আর একটা পুরনো সুর ভেসে আসে বাতাসে—যেমনটা পুরোনো দিনের রেকর্ড প্লেয়ারে শোনা যেত। হঠাৎ অন্বেষার মনে পড়ে যায় তার কাকিমার কথা—ত্রিপুরায় এসেই আচমকা আত্মহত্যা করেছিলেন, কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই। তখন মনে হয়, ধনিষ্ঠার মুখ যেন কোথায় যেন দেখেছে সে… অনেক ছোটবেলায়… হয়তো সেই পুরনো অ্যালবামে… হয়তো পরিবারের গল্পে… অথবা কোনও ভুলে যাওয়া স্বপ্নে। সেই মুহূর্তে সে অনুভব করে—এই গ্রাম শুধু ভুলে যাওয়া নয়, বরং মনে রাখা ভয়গুলোর ঠিকানা।
৫
তাদের বুঝতে বাকি রইল না—মানিকছড়ি কোনো সাধারণ জায়গা নয়। এখানকার প্রতিটি মাটি, গাছ, বাতাস এমনকি ছায়াও যেন সময়ের বাইরের কোনও স্তরে আটকে আছে, যেখানে অতীত হারায় না, বরং ঘুরেফিরে ফিরে আসে। সেই দিন সকালে, মৃণালিনী একটি পুরনো পথ ধরে একা হাঁটতে শুরু করেছিল। পথটা গ্রামের বাইরে চলে গিয়েছিল দক্ষিণ দিকে, যেখানে একসময় একটি পুরনো পাথরের মন্দির ছিল বলে বেণীমাধব জানিয়েছিলেন। সেই জায়গাটাই যেন তাকে ডাকছিল। সে হাঁটতে হাঁটতে দেখে, পথের দু’পাশে বাঁশঝাড়ে পাতাগুলো একটুও নড়ছে না—নিস্তব্ধতা এতটাই ঘনীভূত, যেন শব্দ পর্যন্ত এখানে ঢুকতে ভয় পায়। কিছু দূর যাওয়ার পর, মাটিতে অদ্ভুত চিহ্ন চোখে পড়ে—প্রাচীন কোনো লিপিতে খোদাই করা, বৃত্তাকারে ঘূর্ণায়মান ডিজাইন, যার মাঝখানে একটি শব্দ: “অকালমৃত্যু।” মৃণালিনী নিচু হয়ে সেই খোদাইটা ছুঁয়ে দেখে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেন শরীর ঝিম ধরে আসে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে, আর দেখে—তার সামনে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। জায়গাটা জংধরা, কিন্তু নিখুঁতভাবে অক্ষত। ভিতরে একটি পাথরের বেদি, তার ওপরে রাখা এক শিবলিঙ্গ। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সেই পাথরের উপর জল ঝরছে—যদিও আশেপাশে কোনো জলের উৎস নেই। শিবলিঙ্গের গায়ে খোদাই: “যারা ভুলে যায়, তারা বেঁচে থাকে।” তার ঠোঁট শুকিয়ে আসে। এই মন্দির যেন শুধু পূজার স্থান নয়, সময়কে বন্দি করে রাখার এক ঘূর্ণিত পাথর।
ঠিক তখনই, গ্রামে ফিরে, অন্বেষা আর ধনিষ্ঠার মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্বেষা ক্রমশ বুঝতে পারছিল, ধনিষ্ঠা কেবল অতীতের কোনো এক কিশোরী নয়—সে যেন অন্বেষার নিজেরই ছায়া। তার কথাবার্তা, চোখের ভাষা, এমনকি হাঁটার ছন্দে একটা পরিচিত দোলা ছিল। এক দুপুরে তারা একসঙ্গে বসেছিল পুকুরঘাটে। ধনিষ্ঠা বলেছিল, “তুমি কি কখনও তোমার অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে ভেবেছো, তুমি নিজেকে চেনো তো?” অন্বেষা জবাব দিতে পারেনি। সে শুধু বলেছিল, “তুমি এখনো এই গ্রামে আছ কেন?” ধনিষ্ঠা তাকিয়ে ছিল পুকুরের স্থির জলের দিকে। “কারণ আমি মরে গিয়েও ভুলিনি। যারা সব ভুলে যায়, তারা বাইরে চলে যায়। আমি পারিনি। আর তাই… আছি।” সেই মুহূর্তে, পুকুরের জলে অন্বেষা নিজের প্রতিবিম্বে ধনিষ্ঠার মুখ দেখেছিল। ভয়ে পিছিয়ে এসেছিল। ঠিক তখনই তার ফোনটা অটোমেটিকভাবে চালু হয়ে গিয়েছিল। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল আগের রাতে ক্যামেরায় তোলা কোনও অজানা ভিডিও—কেউ একজন জানালার বাইরে থেকে তাকিয়ে আছে তাদের ঘরের ভেতর। ভিডিওর শেষে দেখা যায়, সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে… সময়ের গভীর এক ফাটলে।
এদিকে তপনজ্যোতি আর বিবেক আবার ‘ছায়াপাহাড়’-এর পথে বেরিয়েছিল। তারা এবার সঙ্গে এনেছিল দড়ি, পাথরচিহ্ন, এমনকি পথচিহ্ন রাখার জন্য লাল ফিতা। কিন্তু যতদূর তারা এগোয়, সময় যেন ক্রমাগত ভেঙে পড়ছিল তাদের শরীরের উপর। হাঁটার পর ক্লান্তি হচ্ছে, ক্ষুধা লাগছে, অথচ ঘড়ি দেখাচ্ছে এখনও ৩:১৮। হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে তারা দেখতে পেল, একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, ধুতি পরে, গায়ে গামছা, পিঠ ঘোরানো। তপনজ্যোতি হাঁক দিল, “কাকু! শোনেন!” কিন্তু লোকটি মুখ ফিরিয়ে তাকায় না। তারা এগিয়ে গেলে সে হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যায় বাতাসের মধ্যে। শুধু পড়ে থাকে এক জোড়া পুরনো চটি। তপনজ্যোতি কাঁপা গলায় বলে, “এই পাহাড়ে কেবল ভূগোল নয়, সময়ও গলে যাচ্ছে… এখানে কিছুই ধরা যায় না।” তারা সিদ্ধান্ত নেয় ফিরে যাবে, বেণীমাধবের কাছে, এবং জানবে—কিভাবে বের হওয়া সম্ভব এই সময়-চক্র থেকে। কিন্তু ফেরার সময়ও তারা খেয়াল করে, সেই গাছ, সেই বাঁক, সেই মোড়—সবকিছু আবার ঘুরে ফিরে আসছে, যেন তারা এক লুপে আটকে আছে। তাদের মধ্যে তখন আর কোনও সন্দেহ থাকে না—মানিকছড়ি কেবল হারানো গ্রাম নয়, এটা এক জীবন্ত ফাঁদ… সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়াগ্রস্ত আয়না, যেটা শুধু তাকাতে জানে, ফেরত দিতে জানে না।
৬
সন্ধ্যা নামার কথা, কিন্তু আলো একটুও বদলায় না। চারদিকের সেই রোদ্দুরে ছাওয়া কুয়াশা এখন ঘন হয়ে উঠেছে। বাতাসে অদ্ভুত একটা ধাতব গন্ধ—যেন পাথরের গায়ে লেগে থাকা পুরনো রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে, তবুও তার ঘ্রাণ থেকে গিয়েছে কোথাও। তপনজ্যোতি, বিবেক, মৃণালিনী ও অন্বেষা— চারজনের মুখে নীরবতা, কিন্তু দৃষ্টিতে অস্ফুট শঙ্কা। বেণীমাধব চৌধুরীর ঘরের সামনের উঠোনে সবাই জড়ো হয়েছিল সন্ধ্যায়, যেখানে একটা ছোট আগুন জ্বলছিল কাঁসার পাত্রে। আগুনে না কাঠ, না কয়লা—জ্বলছিল কিছু শুকনো লাল পাতা আর একটা কালো কড়ি। আগুনের আলোতে বেণীমাধব বললেন, “আজ রাতে যদি কেউ ছায়াপাহাড়ে হাঁটতে দেখো, তাকিও না… আর ডাকলেও সাড়া দিও না।” কেউ প্রশ্ন করল না কেন, শুধু অনুভব করল—আজ রাতে গ্রামটা একটু বেশি নিঃশব্দ, একটু বেশি ভারী।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের ঘরগুলো যেন একে একে অদৃশ্য হতে লাগল। জানালাগুলোর ভেতর আলো নেই, কুকুর নেই, মানুষের আওয়াজ নেই। শুধু মাঝে মাঝে বটগাছের দিক থেকে বাতাসে ছায়ার মতো কিছু নড়ছে বলে মনে হচ্ছিল। তপনজ্যোতি ঘরে ঢুকে ক্যামেরা অন করতেই সেটা হঠাৎ ফ্ল্যাশ দিয়ে ওঠে—কিন্তু স্ক্রিনে কোনও কিছু নেই। সে ক্যামেরা নামিয়ে জানালার বাইরে তাকায়—একটি ছায়ামূর্তি, অনেকটা মানুষের মতো, হাঁটছে ধীরে ধীরে গ্রামের শেষ প্রান্তে, সেই ছায়াপাহাড়ের দিকে। তার হাতে একটা বাতি, তার মাথায় একটা টুপি। তপনজ্যোতি ফিসফিস করে বলে, “আমরা তো ওই লোকটাকেই সকালে দেখেছিলাম… কিন্তু সে তো…” অন্বেষা পেছন থেকে বলে ওঠে, “সে তো বাতাসে মিশে গিয়েছিল। এখন আবার হাঁটছে?” তাদের ঘুম আসে না। ঘড়ি দেখায় এখনও ৩:১৮। তিনজন একসাথে বেরিয়ে পড়ে বটগাছ পেরিয়ে ছায়াপাহাড়ের দিকে—অন্ধকারে। মৃণালিনী বলে, “আমরা যদি মুখোমুখি হই সেই ছায়াগুলোর, তাহলে?” বিবেক বলে, “তখন আমরা নিজেদের মুখোমুখি হব।” চারদিকে পাখির ডাক নেই, কেবল শুঁ শুঁ বাতাস, আর শুকনো পাতার ওপর পদচিহ্নের মতো কিছু শব্দ।
ছায়াপাহাড়ের ঢালে উঠে তারা দেখে, পথ যেন নিজেই তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে নতুন মাটি জমছে পায়ের নিচে—যেন এই পথ তারা তৈরি করছে নিজেদের উপস্থিতিতে। ঠিক তখনই এক ঝটকায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। এমন অন্ধকার, যা চোখ খুলে থেকেও দৃষ্টিশূন্য করে দেয়। কেউ কিছু দেখতে পায় না, কারো নাম ধরে ডাকতে গেলে গলা আটকে আসে। ঠিক সেই মুহূর্তে, হঠাৎ করে কোথাও থেকে ছায়ার মতো একটা বিশাল অবয়ব দেখা যায়—মানুষ নয়, পশু নয়, যেন মেঘ আর ছায়ার ভেতর মিলিয়ে যাওয়া এক বিশাল উপস্থিতি। তার দেহ জুড়ে গহ্বরের মতো ফাঁকা চোখ, বাতাসে ভেসে বেড়ানো হাত, আর কণ্ঠে এক রুদ্ধশ্বাস শব্দ—“তোমরা কি ভুলে গেছো?” সেই কণ্ঠ শুনেই মৃণালিনী হঠাৎ নিচে পড়ে যায়, তার চারপাশে ভেসে ওঠে তার শৈশবের একটি স্মৃতি—তার দাদুর মৃত্যুদিনে সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, ভয় পেয়ে পালিয়েছিল। এখন সেই ভয় যেন আবার ফিরে এসেছে, মূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। অন্বেষার চোখে ভেসে ওঠে সেই সাদা জামা পরা এক মহিলা—তার কাকিমা, যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। মুখ ঢাকা, চোখের জলে ভিজে। আর তখন সে বুঝতে পারে—মানিকছড়ির ছায়াগুলো আসলে অন্য কিছু নয়, তারা নিজস্ব অপরাধবোধ, দুঃখ আর না-বলা স্মৃতির ছায়া।
তাদের কেউই জানত না তারা ঠিক কতক্ষণ এই ছায়াগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি, একটা হালকা আলো, আর সময় যেন আবার একটু করে চলতে শুরু করে। পাতার নিচে জমে থাকা শিশির গড়িয়ে পড়ে, পাখির ডাক শোনা যায় দূরে। তবে সূর্য ওঠে না। তারা জানত, মানিকছড়ির ছায়াপাহাড় শুধু ভয় দেখায় না, বরং নিজের ভিতর দিয়ে নিয়ে যায় সেই সব ছায়াকে, যেগুলো মানুষ ভুলে যেতে চায়, কিন্তু পারে না। তারা ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে নেমে আসে, কিন্তু প্রত্যেকে বোঝে—এই রাত বদলে দিয়েছে তাদের ভিতরকার কিছু। তারা এখন শুধু পর্যটক নয়, স্মৃতি-বাহক। মানিকছড়ির ছায়া তাদের ছুঁয়ে গেছে।
৭
সকালে যখন তারা ছায়াপাহাড় থেকে ফিরে আসে, তখন গ্রামের বাতাসে অদ্ভুত পরিবর্তন ধরা পড়ে। আগের দিনের সেই ভারী নিঃশব্দতা কিছুটা হালকা হলেও, তাতে যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রার সজাগতা—যেন গ্রামের প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি পথ এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাড়ি ফিরে মৃণালিনী দেখতে পায় তার ব্যাগের ভেতর রাখা পুরনো খাতাটির কালি হঠাৎই গাঢ় হয়ে উঠেছে। সেই খাতাটি, যার কিছু পাতায় সে দাদুর গবেষণার নোটস লিখে এনেছিল মানিকছড়ির সময় নিয়ে। একটা পাতায় নতুন করে লেখা দেখতে পায় সে—যা সে লেখেনি। সেখানে লাল কালিতে লেখা, “যদি নিজের ভয়কে চিনতে পারো, তবে এখান থেকে মুক্তি সম্ভব।” সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে খাতার পাতাগুলো উল্টায় এবং আবিষ্কার করে কিছু অদ্ভুত প্রতীক, যেগুলোর সঙ্গে মিল রয়েছে বটগাছের পেছনে থাকা সেই ক্ষয়িষ্ণু মন্দিরের মূর্তি আর খোদাইয়ের।
এদিকে অন্বেষা একা বসেছিল ঘরের জানালার পাশে, হাতে ধরা তার সেই পুরনো মোবাইল ফোন। স্ক্রিনে সে আগের রাতের ভিডিও বারবার চালিয়ে যাচ্ছিল। ছায়ামূর্তির মুখটা অস্পষ্ট হলেও তার ভিতর যেন সে কিছু খুঁজে ফিরছিল—একটা আত্মীয়তা, এক নিঃশব্দ কান্না, যেটা শুধু খুব কাছের মানুষদের চোখে বোঝা যায়। তারপর হঠাৎই তার মনে পড়ে, শৈশবে একবার তার কাকিমা তাকে বলেছিলেন, “মানুষ যত কিছু ভুলে যায়, তার সবচেয়ে বড় ভয়টা থাকে—যা সে ভুলতে চায় না, কিন্তু মুখেও আনতে পারে না।” অন্বেষা যেন সেই ভয়কে স্পর্শ করছিল এবার, খুব গভীরে, যেখানে তার নিজের পরিচয়ও আর স্পষ্ট থাকে না। সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে বটগাছের কাছে যাবে, যেখানে গ্রামটা নিঃশব্দে সব স্মৃতিকে পুঁতে রেখেছে।
তপনজ্যোতি ও বিবেক তখন গ্রামের কেন্দ্রের দিকটায় ঘুরছিল। সেখানে একটা পরিত্যক্ত বাড়ির দরজা খোলা পড়ে ছিল, এবং ভিতরে ঢুকে তারা দেখতে পেল এক বিশাল ছবি—সেই ছবিতে পাঁচজন মানুষ, যার মধ্যে একজন অবিকল তপনজ্যোতির মতো। তার চোখ কেঁপে ওঠে। সে ছবিটার নিচে একটা তারিখ দেখতে পায়: ১৯৭২। বাড়ির দেয়ালে অনেকগুলো ছেঁড়া কাগজ, যার কিছু কিছুতে নাম লেখা: “আলোক বিশ্বাস, তনয়া কর, উজ্জ্বল পাল…” এবং তাদের পাশে ছোট করে লেখা: ‘ফিরে আসেনি’। সেই বাড়ি যেন মানিকছড়ির স্মৃতির ঘর, যেখানে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের নাম চিরকাল পড়ে থাকে, কেবল আর কেউ উচ্চারণ করে না। বিবেক টর্চ জ্বালিয়ে দেখে, ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা একটা কাচের বয়ামের মধ্যে শুকনো গোলাপের মালা। বয়ামের গায়ে লেখা: “ভুলে যাবেন না।” তারা বুঝতে পারে, এই গ্রাম আসলে এক স্মৃতি-ফাঁদ—যারা ভিতরে ঢোকে, তারা নিজের ভুলে যাওয়া দুঃখ বা অপরাধের সঙ্গে মুখোমুখি হয়, আর যারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা এখানেই আটকে যায় চিরকাল।
তাদের চারজনের মধ্যে গভীর এক দোলাচল শুরু হয়। মৃণালিনী, যিনি প্রথমে এই জায়গাকে শুধুই প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শন ভেবেছিলেন, এখন বুঝতে পারছেন—এখানে বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক বড় কিছু আছে। অন্বেষা, যে এসেছিল শুধু একটা ব্লগ আর কিছু ছবির জন্য, এখন অনুভব করছে নিজের পরিবারের ইতিহাসের অন্ধকার ছায়াকে। বিবেক, যিনি এতদিন আত্মবিশ্বাসে পর্বত জয় করেছেন, এখন মানিকছড়ির প্যাঁচে পড়ে বুঝতে পারছেন, কিছু কিছু পাহাড় শুধুই পাথরে তৈরি নয়—তারা তৈরি হয় অপরাধবোধে, ভুলে যাওয়া সিদ্ধান্তে, এবং নীরব কান্নায়। আর তপনজ্যোতি—যিনি ডকুমেন্টারি নির্মাতা, তিনি এবার ঠিক করে ফেলেন, এই বার্তাটি তাকে নিয়ে যেতেই হবে বাইরের জগতে। কিন্তু কীভাবে? কারণ তারা চারজনেই বুঝতে পারছে, মানিকছড়ি ছাড়তে গেলে তাদের প্রত্যেককে তাদের নিজের স্মৃতির সবচেয়ে গভীর ভয়টার মুখোমুখি হতে হবে।
বেণীমাধব তখন ঘরের বাইরে বসে, চোখ বন্ধ করে কীসব গুণগুণ করছিলেন। তার পাশে ধনিষ্ঠা এসে দাঁড়ায়, আর খুব নিচু গলায় বলে, “ওরা কি এবার যেতে পারবে, ঠাকুরদা?” বেণীমাধব চোখ মেলে বলেন, “যদি ওরা নিজেদের সত্যিটা মেনে নিতে পারে… তবে সময় ওদের ছেড়ে দেবে।” ধনিষ্ঠা তাকায় দূরের ছায়াপাহাড়ের দিকে, আর তার চোখে অদ্ভুত একটা আলো জ্বলে ওঠে—একসঙ্গে আনন্দ, দুঃখ আর মুক্তির সম্ভাবনা। হয়তো এবার সত্যিই কেউ কেউ ফিরবে… মানিকছড়িকে পেছনে ফেলে।
৮
সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্ত। বটগাছের ছায়া আরও দীর্ঘ হয়ে মাটি ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের রাস্তা জুড়ে। চারপাশে নিস্তব্ধতার গায়ে যেন অদৃশ্য কাঁটার চাদর। বেণীমাধব চৌধুরী আজ আর আগুনের পাত্রটা বের করেননি। তিনি চুপচাপ বসে ছিলেন উঠোনের ঠিক মাঝখানে, চোখ বুজে। যেন তিনি কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ততক্ষণে অন্বেষা, তপনজ্যোতি, মৃণালিনী ও বিবেক—চারজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের এখান থেকে ফিরতেই হবে। কিন্তু সেই ফেরা সহজ নয়। কারণ মানিকছড়ি কাউকে ছেড়ে দেয় না, যতক্ষণ না সে নিজেকে ছেড়ে দিতে শেখে।
বেণীমাধব বললেন, “মানিকছড়ি থেকে বেরোনোর একটা মাত্র উপায় আছে। নিজের ভিতরের সবচেয়ে অস্বস্তিকর স্মৃতির সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলো—যেটা এতদিন তুমি চেপে রেখেছিলে, ভুলে যাওয়ার ভান করেছিলে। এখানে সেই সব কিছু ফিরে আসে। যে ভয়কে মুখোমুখি হতে পারো, সে ভয় আর তোমাকে বেঁধে রাখতে পারে না।” কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসে গা ছমছমে একটা পরিবর্তন এলো। মাটির নিচে যেন কাঁপুনি, আকাশের এক কোণে কালো মেঘ, আর গাছের পাতা একসাথে কেঁপে উঠল। মনে হলো—গ্রাম বুঝতে পেরেছে, কেউ পালাতে চাইছে। আর গ্রাম সেই চেষ্টাকে সহ্য করে না।
তাদের মধ্যে প্রথম এগিয়ে এল অন্বেষা। সে বটগাছের কাছে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করল। বাতাসে জোয়ার এল, আর সামনে ধীরে ধীরে তৈরি হতে লাগল এক অবয়ব। তার কাকিমা—হাতের শাড়ির আঁচল ঝুলে পড়ে আছে, চোখে জল, ঠোঁটে নিঃশব্দ অনুযোগ। কাকিমা বললেন না কিছুই, কেবল একবার চোখে চোখ রাখলেন। অন্বেষা ফিসফিস করে বলল, “আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। তোমার ডাকে সাড়া দিইনি। আমি ভয় পেয়েছিলাম… নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম… কিন্তু আমি ভুলিনি তোমায়।” কাকিমার অবয়ব হেসে ফেলল—একটা ছোট্ট, শান্ত হাসি। তারপর বাতাসে মিলিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে অন্বেষা বুঝল, তার ভিতরের গোপন কান্না সে প্রকাশ করতে পেরেছে। গ্রাম যেন তাকে একটু হালকা করে দিয়েছে।
তপনজ্যোতির পালা এল। সে দাঁড়িয়ে ছিল বটগাছের গুঁড়ির পাশে। হঠাৎ তার সামনে আবির্ভূত হল এক দৃশ্য—তার বাবা, যিনি সবসময় চাইতেন ছেলেটা সরকারি চাকরি করুক। কিন্তু তপনজ্যোতি নিজের মতো জীবন বেছে নিয়েছিল, আর বহুদিন যোগাযোগ ছিল না। এখন বাবার মুখে কোনো অভিমান নেই—শুধু একটা প্রশ্ন: “তুই কি নিজের মতো সুখী হয়েছিস?” তপনজ্যোতি চোখে জল নিয়ে বলল, “সুখী হতে গিয়ে তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, বাবা। কিন্তু আমি ভুল করিনি—এখন বুঝি। আমি তোকে মিস করি।” সেই কথায় বাবার অবয়ব ম্লান হয়ে গেল, আর বটগাছের ছায়া যেন তার শরীর থেকে পিছিয়ে এল—একটু মুক্তি দিয়ে।
মৃণালিনীর সামনে তার দাদুর অবয়ব এল—দাদু যিনি একসময় মানিকছড়ি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন। সেই সময় পরিবার বলেছিল, দাদু ‘পাগল’ হয়ে গিয়েছেন, মানিকছড়ির মতো গল্পে সময় নষ্ট করছিলেন। মৃণালিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “আমি এখন বুঝি, দাদু। এটা গল্প নয়, এটা ইতিহাস। তুমি যা বলেছিলে—সব সত্যি। আমি তোমার অসমাপ্ত কাজ শেষ করব। আমি তোমায় সম্মান করি, ভালোবাসি।” দাদুর মুখে এক গর্বময় প্রশান্তির ছাপ। তারপর ধীরে ধীরে তিনি মিলিয়ে গেলেন পাতার ফাঁকে।
সবশেষে দাঁড়াল বিবেক। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে তার এক ট্রেকিং টিমে এক বন্ধু প্রাণ হারিয়েছিল। সেই ঘটনা কখনো সে মুখে আনেনি। এখন সে চোখ বন্ধ করতেই সেই বন্ধুটির রক্তমাখা মুখ দেখা গেল। বিবেক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। বলল, “আমি দোষী, আমি সাহসী নয়। আমি দুঃখ পাই, ভয় পাই… আমি ভুল করেছিলাম। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম, তাই তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম।” বন্ধুর অবয়ব ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, একটা হাত রাখল তার কাঁধে—তারপর হারিয়ে গেল বাতাসে।
চারজনই বোঝে, তাদের ভিতরের শিকল ভেঙেছে। ঠিক তখনই ঘড়ির কাঁটা নড়ল—৩:১৯। পাখির ডাক শোনা গেল। গ্রামের মাঝখানে আলো বাড়তে লাগল। বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ধনিষ্ঠা এবার হাসল—খুব মৃদু আর শান্ত এক হাসি। বলল, “তোমরা প্রস্তুত। এবার ফিরে যেতে পারো।” বেণীমাধব দাঁড়িয়ে বললেন, “এই গ্রাম কাউকে ধরে রাখে না, কেউ নিজেকে ধরে রাখে। যেই সে নিজেকে মুক্ত করে, গ্রামের মায়া কেটে যায়।”
সেই মুহূর্তে প্রথমবারের মতো সময় সচল হলো মানিকছড়িতে। বাতাস বয়ে গেল, ছায়া সরে গেল, সূর্যের আলো প্রকৃত ছায়া ফেলল মাটির উপর। ঘড়িতে ৪:১০ বাজে। সেই মুহূর্তে তারা বুঝল—গ্রাম তাদের ছেড়ে দিয়েছে।
৯
তারা চারজন যখন গ্রামের শেষপ্রান্তের সেই সরু পথ ধরে নিচে নামছে, তখন পেছনে তাকিয়ে দেখে—পুরো মানিকছড়ি যেন সোনালি আলোয় মোড়া। গাছের পাতায় আলোর ঝিকিমিকি, বাতাসে বাজনার মতো শ্বাস, আর আকাশ যেন এক নিঃশব্দ আশীর্বাদে ঝুঁকে আছে তাদের দিকে। কিন্তু হঠাৎই, একসঙ্গে সবার মনে হয়—পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তারা একসঙ্গে ঘুরে তাকায়। ধনিষ্ঠা, সেই ছায়ামেয়ে, দাঁড়িয়ে আছে বটগাছের নিচে। এবার সে কাঁদছে না, হাসছেও না—শুধু তাকিয়ে আছে। হাতে তার সেই ছোট্ট লাল পুঁতির মালা। হাওয়ায় তার চুল উড়ছে, আর তার মুখ যেন সময়ের বাইরে থেকে দৃষ্টিপাত করছে। তপনজ্যোতি এক পা এগিয়ে এসে হাত তুলতেই, ধনিষ্ঠা নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। তার ঠোঁট থেকে উচ্চারিত হয় একটি মাত্র শব্দ—“যেও।”
নেমে আসার পর, তারা দেখে বাইরে একেবারে আলাদা এক জগৎ। মোবাইলে নেটওয়ার্ক, ঘড়িতে সঠিক সময়, পাখির ডাক, আর পাহাড়ের গায়ে ঠিক সেই সব শব্দ যেগুলো তারা এতদিন ভুলে গিয়েছিল—জীবনের চেনা ছন্দ। কিন্তু সমস্যা হয় যখন তারা লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে যায়। কাছের একটি চা দোকানে গিয়ে জানতে পারে—তারা নাকি নিখোঁজ ছিল পুরো নয় দিন ধরে। অথচ তাদের নিজেরা মনে হয় মাত্র তিন রাত পার করেছে। খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল তাদের ছবি, স্থানীয় পুলিশ কাঁধে তুলে নিয়েছিল ব্যাপারটা, আর পরিবার—তারা ধরে নিয়েছিল খারাপ কিছু ঘটে গেছে।
তারা যখন ফিরে যায় নিজেদের শহরে, তখন প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে বোঝে—তারা আর আগের মতো নেই। অন্বেষা তার পুরনো ব্লগ আর ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দেয়। সে এখন গ্রামীণ আত্মহত্যা-প্রবণ নারীদের নিয়ে কাজ করে, চুপচাপ, নিঃশব্দে। মাঝে মাঝে সে একটি পুঁতির মালা পরে ঘাড়ে—লাল রঙের। মৃণালিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে তার গবেষণায় যোগ দেয়। কিন্তু এবার সে শুধু প্রত্নতত্ত্ব নয়, লোককথা আর লোকবিশ্বাস নিয়েও লেখে। তার থিসিসের নাম রাখে: “Time as Memory: The Living Silence of Manikchhari.” তপনজ্যোতি তার ডকুমেন্টারি তৈরি করে ঠিকই, কিন্তু কোথাও জমা দেয় না। শুধু ইউএসবিতে রেখে দেয় এবং ভিডিওর শেষে লিখে—”এই ছবি কোনো ছবি নয়, এই আমি।” আর বিবেক? সে এখন স্কুলে পাহাড়চূড়ার গল্প বলে বাচ্চাদের, কিন্তু সব গল্পের শেষে একবার থেমে বলে, “ভয় যদি সত্যি হয়… তবে মুক্তিও হয়।”
তবে এখানেই গল্প শেষ নয়। এক বছর পর, অন্বেষা হঠাৎ একদিন একটি ডাক পায়—ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে। একটি স্থানীয় স্কুলের শিশুদের মুখে, ধনিষ্ঠা নামের এক বাচ্চা মেয়ের কথা শোনা যাচ্ছে, যে রাতে হঠাৎ এসে পাশে বসে থাকে, গান গায়, আর বলে—“তোমরা একদিন চলে যাবে, কিন্তু আমি এখানেই থাকব।” সেই খবর পেয়ে মৃণালিনী আর তপনজ্যোতি ফের যোগাযোগ করে। তারা বুঝে যায়, মানিকছড়ি এখনও কাউকে ডাকে। হয়তো তাদেরই… আবার।
তারা সিদ্ধান্ত নেয়—একবার আবার ফিরবে। না ফিরে যাওয়ার জন্য নয়, বরং জানতে—মানিকছড়ি কি শুধু একবারই নিজের দরজা খোলে? নাকি সে এক জীবন্ত সত্তা, যে তার ছায়ায় রেখে যায় মানুষদের ভিতরের গভীরতর সত্য?
শেষ দৃশ্যে, দূরে পাহাড়ের কোণে দাঁড়িয়ে থাকে এক ছায়ামূর্তি। লাল পুঁতির মালা তার হাতে। চারপাশে বাতাসে ভাসে সেই পুরনো সুর—
“যারা ভুলে যায়, তারা চলে যায়।
যারা মনে রাখে… তারা মানিকছড়ি হয়ে যায়।”
১০
এক বছর পর, আবার মানিকছড়ির পথে পা রেখেছিল চারজন—অন্বেষা, মৃণালিনী, তপনজ্যোতি ও বিবেক। না, তারা কারও খোঁজে আসেনি এবার। ধনিষ্ঠা কি আছে, মানিকছড়ি কি আবার ডাকছে—এসব প্রশ্নও তাদের পিছু নেয়নি। তারা এসেছিল এক নিঃশব্দ বন্ধনের কাছে ফিরতে, যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল তাদের স্মৃতি, তাদের দুঃখ, অপরাধবোধ, এবং স্বপ্ন। গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছেই তারা থমকে গেল। কারণ এবার গ্রাম ছিল না। পাথুরে পথটা শেষ হয়েছে এক ফাঁকা তৃণভূমিতে। বটগাছ, পুকুরঘাট, বেণীমাধবের উঠোন—সব কিছু যেন হাওয়া হয়ে গেছে। শুধু হাওয়ার মধ্যে এক অদৃশ্য ঘ্রাণ—পুরনো পুঁতির মালা, আর ধুলোমাখা সময়ের।
তাদের কেউ কিছু বলেনি। সবাই নিঃশব্দে হাঁটছিল সেই জায়গায় যেখানে একদিন ছায়াপাহাড় শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন সেখানে কিছুই নেই—না ছায়া, না পাহাড়। তবু পায়ের নিচে মাটি নরম, আর মাঝে মাঝে যেন সেই পুরনো শব্দটা ফিরে আসে বাতাসে—“ভুলে যেও না…” হঠাৎ, অন্বেষা তার ব্যাগ থেকে একটি পুরনো পৃষ্ঠা বের করল—যেখানে লেখা ছিল ধনিষ্ঠার হাতের লেখা:
“এই গ্রাম হারিয়ে যাবে একদিন। কিন্তু যারা সত্যকে মুখোমুখি হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়ে যাবে আমাদের ছায়া। তুমিই তো আমি, নয় কি?”
তাদের চারজনের চোখে জল আসেনি, তবু হৃদয়ের গভীরে কিছু একটায় ধাক্কা লাগল। মৃণালিনী ধীরে ধীরে বলে উঠল, “আমরা ফিরে এসেছি, কিন্তু যা ছিল তা আর নেই। হয়তো এটা ইচ্ছাকৃত। হয়তো মানিকছড়ি আমাদের মুক্ত করে দিয়েছে।” তপনজ্যোতি পাথরের ওপর বসে পড়ে বলল, “অথবা হয়তো আমরা নিজেই মানিকছড়ি হয়ে গেছি।” তখন হঠাৎ আকাশে ভেসে উঠল একটা অদ্ভুত মেঘ। সেই মেঘে তারা দেখতে পেল চারটি ছায়া—একটা ছোট মেয়ে, এক বৃদ্ধ, এক ব্যথিত যুবক, আর এক অপরাধী চোখ। তারপর ধীরে ধীরে মেঘ মিলিয়ে গেল।
অন্বেষা বলল, “আমরা মানিকছড়ির গল্প লিখব না। কারণ এটা লেখা যায় না। এটা শুধু অনুভব করা যায়… বাঁচা যায়… আর একদিন একদম চুপচাপ নিজের ভিতরে রেখে দিতে হয়, যেন সে আবার কাউকে ডাকে।”
বিবেক মৃদু হেসে বলল, “আমরা কেউই ফিরিনি… আমরা এখনো সেই গ্রামে আছি, শুধু শরীরটাই বেরিয়েছে।”
তারা ফিরে গেল শহরে। ফিরে গিয়েও কেউ আর আগের মতো হল না। অন্বেষা আর কারও ছবি তোলে না—সে এখন অন্ধ শিশুদের মুখে ছায়ার গল্প বলে। মৃণালিনী একটি বই লিখে, যার নাম হয়: “ছায়া যার ভিতরে রয়ে যায়”—কিন্তু প্রকাশ করে না। তপনজ্যোতি তার ডকুমেন্টারির ক্যামেরা বিক্রি করে দেয়, এবং শুধু খাতায় লেখে—“সত্য গল্পের চেয়েও বেশি ভয়ের।”
আর বিবেক, সে এক পাহাড়ি গ্রামে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। অন্বেষা একদিন খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যায় সেই তৃণভূমিতে। আর সেখানে পাথরে খোদাই করা লেখা দেখতে পায়:
“ভয়কে যে ভালোবাসে, তার ছায়া রয়ে যায়।
ভুলে গেছো? না, এখনো মনে রেখেছো। তাই তুমি এখানেই আছো।”
সেই জায়গায় আজও সন্ধ্যা হলে হাওয়ায় ভেসে আসে পায়ের শব্দ, ছায়ার নিঃশ্বাস, আর সেই পুরনো সুর:
“তুমি যদি নিজেকে চিনে ফেলো, সময় তোমাকে ছেড়ে দেবে। যদি না পারো… তুমি সময় হয়েই রয়ে যাবে।”
সমাপ্ত




