Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

মাদলের শব্দে নিঃসঙ্গতা

Spread the love

অন্বেষা পাল


পর্ব ১: শহর থেকে আগমন

শহর যতটা দ্রুত হাঁটে, শান্তিনিকেতন ততটাই ধীরে হাঁটে—আর সেই ধীর গতির মধ্যেই যেন তার প্রকৃত ছন্দ। ঈশিতা চক্রবর্তী, কলকাতার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী, প্রথম যখন শান্তিনিকেতনে পা রাখল, তার মনে হয়েছিল যেন কেউ টিভির রিমোটে ‘স্লো মোশন’ বাটন চাপিয়ে দিয়েছে। কলকাতা থেকে আসা লোকাল ট্রেনটা বোলপুর স্টেশনে থেমে যাওয়ার পর যে নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে ধরল, তা কিছুটা আরামদায়ক, কিছুটা অস্বস্তিকর। সে যেন নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও বেশি করে শুনতে পাচ্ছিল। ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে সে স্টেশনের বাইরে বেরোল। শান্তিনিকেতনের বাতাসে একটা হালকা শুকনো পাতার গন্ধ ছিল—সেই গন্ধ শহরে নেই, পারফিউমেও নেই। অথচ কেমন একটা চেনা, পুরোনো শাড়ির ভিতর থেকে বেরোনো পাতার মতো নরম।

এই ট্রিপটা নিছক ভ্রমণ নয়। ঈশিতা তার থিসিস প্রজেক্টের জন্য এসেছেন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক রীতিনীতির সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে। প্রজেক্ট সাবজেক্টের নাম: “Ritual and Rhythm: Trance, Trauma and Tribal Healing.” তার গাইড প্রফেসর সেন বলেছিলেন, “তুমি যদি সত্যিই কিছু আলাদা করতে চাও, শুধু পর্যবেক্ষক হয়ে থাকলে চলবে না। ওদের ভিতরে ঢুকতে হবে, ওদের বিশ্বাস বুঝতে হবে। তবে খেয়াল রেখো, তুমি গবেষক, শখের ট্রাভেল ব্লগার নও।”

ঈশিতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, “আমি জানি, স্যার।” কিন্তু তার ভিতরটা বলছিল, “আমি ঠিক জানি না।”

ওলটপালট একটা অটোতে চাপল সে, আশ্রম এলাকার পাশেরই একটি হোমস্টেতে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। হোমস্টের মালকিন—সঙ্গীতা মাইতি, একা থাকেন, স্বামী নেই, ছেলে চাকরি করে বাইরে। ঘরটা সাজানো—ছোট ছোট কাঁসার প্রদীপ, এক কোণে রবীন্দ্রনাথের ছবি, একটা কাঠের বুকশেলফ, আর একটা ছোপছোপ হলুদ আলো দেওয়া ঝাড়বাতি। সঙ্গীতা বললেন, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন মা, যা লাগবে বলবেন। ল্যাপটপ চার্জ করতে সমস্যা হলে আমায় বলবেন। লোডশেডিং মাঝে মাঝে হয়।”

ঈশিতা ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ঢুকল। সে জানালার পাশে বসে বসল। জানালার ওপারে গাছ, ছায়া, আর মাঝে মাঝে কিছু অচেনা পাখির ডাক। তার মাথার ভিতর এখনো ঘুরছে শহরের শব্দ—গাড়ির হর্ন, মেট্রোর ফুসফুসের মতো শব্দ, লোকের ব্যস্ত হাঁটা। এখানকার এই ধীরতা যেন ছুরি দিয়ে কেটে নেওয়া যায়। এমন নিরবতা শহরে পাওয়া যায় না।

সন্ধেবেলা কিছুটা হেঁটে বেরোলো সে। আশ্রমের ভেতর ঢুকল না—পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ কোথাও থেকে ভেসে এল একটা মাদলের শব্দ। ধীরে, ভারী। সে থেমে গেল। মাদলটা যেন তার বুকের ভিতরে বাজছে। কোথায় বাজছে ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু শব্দটা বাতাসকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সে গাছের দিকে তাকাল, সন্ধ্যার কুয়াশা নামছে। পাখিরা ফিরছে। কিন্তু সেই মাদল যেন অন্য কিছু বলে।

সে আরেকটু এগিয়ে গেল। একটি কাঁচা পথ বেঁকে গিয়েছে বাঁদিকে—সেই দিক থেকে শব্দটা আসছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঈশিতা পা বাড়াল। কুয়াশার ভেতর দিয়ে সে একটু এগোল, তারপর হঠাৎ থমকে গেল। একটা ছোট্ট clearing-এর মতো জায়গা। তার মধ্যে কিছু বাচ্চা নাচছে, কেউ তালি দিচ্ছে, আর এক যুবক রিদমিক তালে মাদল বাজাচ্ছে। একটাও মোবাইল ফোন নেই, না কোনো ক্যামেরা, না দর্শক। কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না। এ যেন rehearsed কিছু নয়—এটা যেন নিখাদ আনন্দ, নিঃশর্ত ছন্দ।

ঈশিতা দাঁড়িয়ে দেখছিল, তার চোখের পাতা ধীরে ধীরে ভারী হয়ে এল। মাদলের তালে সে কেমন হিপনোটাইজড হয়ে যাচ্ছিল। কেউ হঠাৎ হাত ছুঁয়ে বলল, “আপনি কে?” সে চমকে উঠল। এক কিশোরী, বড় বড় চোখ, গলায় লাল পুঁতির মালা, তাকে দেখে প্রশ্ন করল।

“আমি… আমি ঈশিতা। আমি গবেষণার জন্য এসেছি। তোমার নাম কী?”

মেয়েটি কিছু বলল না। কেবল মুচকি হাসল, তারপর বলল, “পূর্ণিমা।” তারপর আবার ছুটে গেল দলে। ঈশিতা দেখল, মেয়েটির শরীর যেন ঝড়ের মতো নড়ে—কিন্তু একটুও কৃত্রিমতা নেই। তার নাচে ক্লাসিক্যাল কোনও স্টেপ নেই, কিন্তু আছে এক আদিম, পবিত্র শক্তি। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ধীরে ধীরে ফিরে এল হোমস্টেতে।

সেদিন রাতে ঘুম এল না। শহরে সে বহুদিন ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমোতে পারে না। কিন্তু আজকের মাদলের শব্দ তার শরীর থেকে সরে না। যেন বুকের মধ্যে একটা ঢেউ চলছে। সে জানে না—এই ঢেউ ভয়, না ভালোবাসা, না আবেগ।

তার মনে পড়ে গেল পূর্ণিমার মুখটা। সেই চোখ দুটো। সে জানে, কাল আবার যাবে। হয়তো কথা বলবে। হয়তো কিছু প্রশ্ন করবে। কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা তাকে কিছু একটা শিখিয়ে দিয়েছে—যে না দেখে শুধু পর্যবেক্ষণ করা যায় না। বোঝার আগে অনুভব করতে হয়।

পর্ব ২: পূর্ণিমার চোখে রাত

ঈশিতা ঘুম ভেঙে প্রথমেই জানালার বাইরে তাকাল। রোদের সোনালি রেখা খাটের পায়ের কাছে এসে থেমেছে। গাছে পাখিরা ইতিমধ্যে উড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু তার মাথার ভিতরে এখনো বেজে চলেছে সেই রাতের মাদল। একটা ঘোর, একটা ছায়াময় স্বপ্ন তাকে যেন জড়িয়ে আছে। সে জানে, আজকেও তাকে যেতে হবে সেই গ্রামে, যেখান থেকে সে ফিরেছিল—মন আর শরীর দুটোই ভার নিয়ে। সঙ্গীতা মাইতির দেওয়া লুচি আর আলুর তরকারি খেয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। হাতে ছোট খাতা, কলম, রেকর্ডার। আজ সে কথাবার্তা রেকর্ড করবে, তথ্য নেবে, ‘ethnographic field note’ লিখবে—তাই ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু তার মন জানে, আজ কিছুই ঠিকঠাক হবে না।

পথ চিনে রাখা সহজ ছিল না, কিন্তু ঈশিতার পা আপনাআপনি বেঁকে গেল সেই কাঁচা রাস্তার দিকে, যেখান থেকে মাদলের শব্দ এসেছিল। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল, যেন সেই কিশোরী—পূর্ণিমা, তার জন্যই অপেক্ষা করছে। কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবু এই বিশ্বাসটা তার ভিতরে গেঁথে গিয়েছে। গাছের ছায়া পড়ে আছে পথে, শালপাতা পড়ে আছে মাটিতে, বাতাসে শুকনো মাটি আর ধূপের গন্ধ। হঠাৎ সে দূর থেকে দেখতে পেল পূর্ণিমাকে—একটা বড় বেতের ঝুড়ি হাতে সে মাঠের দিকে যাচ্ছে।

“পূর্ণিমা!” ঈশিতা ডাকল।

পূর্ণিমা থেমে তাকাল। চোখে একটু বিস্ময়, তারপর চিনতে পেরে হাসল। সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। ঈশিতা এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি কি কাল এখানে ছিলে? মাদল বাজছিল, সবাই নাচছিল—সেটা কি কোনো অনুষ্ঠান ছিল?”

পূর্ণিমা মাথা নাড়ল। “না, ওটা নাচ শেখা। প্রতি সন্ধ্যেতে সবাই একসাথে নাচি। বড়দিন আসছে তো, তখন নাচ দেখাতে হবে।”

“তুমি খুব ভালো নাচো,” ঈশিতা বলল। “তোমার নাচ দেখে আমি…”

পূর্ণিমা আবার মুচকি হাসল, “নাচলে মন ভালো থাকে।”

এই সহজ বাক্যটা যেন ঈশিতার ভিতর ঝাঁকুনি দিল। শহরে ‘মন ভালো রাখার’ মানে ছিল মেডিটেশন অ্যাপ, থেরাপি সেশন, অ্যাসাইনমেন্টে পেছনে পড়ে থাকা সময় পুষিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখানে ‘নাচলে মন ভালো থাকে’—এমন সরল ভাষায় কেউ বলে কীভাবে? ঈশিতা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী। আমি গবেষণা করছি, মানুষ কিভাবে দুঃখ ভুলে যায়, বা মন ভালো রাখে। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কখনো মন খারাপ করে, বা খুব কষ্ট পায়, তখন কী করে?”

পূর্ণিমা কাঁধ ঝাঁকাল, “তখন কেউ গান গায়, কেউ নদীর ধারে যায়। আমি নাচি। দিদা বলে, দুঃখ মাটির মতো। মাটি জলে গেলে কাদায় বদলায়। কাদা পায়ে মাখলে ঠান্ডা লাগে, তারপর শুকিয়ে গেলে মুছে যায়।”

এই কথা শুনে ঈশিতা তার খাতায় কিছু লিখে রাখতে চাইল, কিন্তু কলমটা খুলতেই ইচ্ছে হল না। যেন এই কথাগুলো লিখে রাখার জন্য নয়, রাখার জন্য মনে রাখতে হয়।

গ্রামের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে পূর্ণিমা বলল, “চলো, তোমাকে দিদার সঙ্গে পরিচয় করাই।” ঈশিতা অবাক হয়ে গেল—এত সহজে, এত খোলামেলা আমন্ত্রণ? শহরে তো কেউ কাউকে নিজের বাড়িতে ডাকে না, অন্তত চেনা না হলে তো নয়ই। কিন্তু পূর্ণিমার চোখে ছিল না কোনো দ্বিধা, না সংশয়। ছিল শুধু একরকম শান্ত আস্থা।

ছোট্ট কুঁড়েঘর। দরজায় বোনা পর্দা। ভিতরে একজন বৃদ্ধা বসে আছেন, সাদামাটা শাড়ি, রূপালি চুলে বিনুনি, হাতে রুক্ষতা। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি, যেন অনেক কিছু জানেন, তবু বলেন না। পূর্ণিমা বলল, “দিদা, এ আমার নতুন বন্ধু। শহর থেকে এসেছে।”

ঈশিতা প্রণাম করল। বৃদ্ধা মাথা ছুঁয়ে দিলেন। “তুমি কি লেখাপড়া করো?”

“হ্যাঁ, দিদা,” ঈশিতা মাথা হেঁট করে বলল, “রিসার্চ করছি।”

“রিসার্চ মানে?”

“যে কাজগুলো তোমরা করো, তা আমি দেখে শিখছি, আর লিখছি।”

বৃদ্ধা হাসলেন, “তবে চোখ বড় করে দেখতে শিখো। কানে যা শুনবে, তা সব ঠিক নয়। কিন্তু হৃদয় যা শোনে, সেটাই ঠিক।”

ঈশিতা যেন গা শিউরে উঠল। এই কথাগুলো কোথাও শিখেছিল না। কিন্তু মনে হচ্ছিল, অনেক আগেই শুনেছে। হয়তো তার শৈশবের কোনো গল্পে, হয়তো কোনো দাদিমার মুখে।

পূর্ণিমা তখনই বলল, “আজ সন্ধ্যেয় আবার নাচ হবে। তুমি আসবে?”

“আমি আসব,” ঈশিতা বলল, “তবে এবার শুধু দেখব না, বুঝতেও চেষ্টা করব।”

সেদিন দুপুরটা সে কাটাল গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে, শিশুরা প্রথমে তাকে দেখে লুকিয়েছিল, পরে খেলতে ডাকল। একজন বয়স্ক লোক তার বাঁশি বাজাল, আর বলল, “শহরের লোক গান শোনে কানে, আমরা শুনি পেট দিয়ে।” ব্যাখ্যা করতে বললে তিনি বললেন, “যা গান করে, তা পেটের ভিতর দিয়ে আসে। হৃদয়ের কাছে পৌঁছাতে গেলে শরীরের ভিতর দিয়েই যেতে হয়।”

বিকেলের আলো নরম হয়ে আসছে। মাঠে আবার লোক জড়ো হচ্ছে। পূর্ণিমা আজ লাল-হলুদ শাড়ি পরে এসেছে, কপালে সাদা আঁচড়, হাতে কাঞ্চনের বালা। মাদল বাজছে, তাল আসছে। কিন্তু আজ ঈশিতার অনুভব আলাদা। সে কেবল পর্যবেক্ষক নয়, যেন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীও।

পূর্ণিমা নাচতে শুরু করল। তার চোখে আজ অদ্ভুত এক দৃঢ়তা। যেন সে নিজের শরীরকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে, আবার তুলে নিচ্ছে আকাশ থেকে আলো। ঈশিতার মনে হল, এই মেয়েটা কেবল একজন নৃত্যশিল্পী নয়—সে যেন একটা মিথ, একটা জীবন্ত কবিতা।

হঠাৎ, তালের মধ্যে ঈশিতা নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। তার পা একটানা মাটি স্পর্শ করে বাজছে। কেউ তাকে ডাকেনি, কেউ তাকে শেখায়নি, তবু সে শরীর নড়াচড়া করতে লাগল মাদলের তালে। পূর্ণিমার চোখে পড়ল সেটা। সে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে হেসে হাত নড়াল—একটা অভিবাদন, একটা সম্মতি। যেন বলছে, “ভয় নেই, এসো, তুমি আজ আমাদের একজন।”

রাত নেমে আসে ধীরে, কিন্তু মাদলের শব্দ থেমে থাকে না।

পর্ব ৩: মাটি দিয়ে দুঃখ ধুয়ে ফেলা

ঈশিতা যেন ঘুম থেকে নয়, কোনো দীর্ঘ মাদলের স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল। ঘরের ছাদের কাঠের কড়িকাঠে এক জোড়া চড়ুই পাখি ঠোঁট ঘষে ডাকছে, আর বাইরের থেকে হালকা ধোঁয়া-মেশানো শুকনো পাতার গন্ধ ভেসে আসছে। হোমস্টের দরজার নিচ দিয়ে কাগজ গড়াগড়ি খাচ্ছে, কিন্তু ঈশিতার হাতে আজ কলম নেই, তার মনেও প্রশ্ন নেই। আছে শুধু একটা অনুভব, যে আজ সে কিছু শেখার নয়, বরং শোনার। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছে পূর্ণিমার পায়ের তালে কেমন জমির ধুলো উঠছে, আর সেই ধুলোর ভিতরই মিশে যাচ্ছে তার নিজস্ব নিঃসঙ্গতা, শূন্যতা।

সে উঠে পড়ল, স্নান করল স্রেফ জল দিয়ে—যেন শরীর থেকে মুছে ফেলতে চাইছে শহরের ব্যস্ততা, রুটিন, কৃত্রিমতা। এরপর একটা মাটি রঙের কুর্তি পরে সে খাতা, কলম আর রেকর্ডার ব্যাগে ভরে হাঁটা ধরল। আজ আর অটো নেয়নি। কাঁচা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে বুঝতে পারছিল—এই রাস্তাটা আর আগের মতো অচেনা নয়। প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা গাছ তাকে ডাকছে নাম ধরে। যেন তারা বলছে, “তুই আবার এলি? চল, আজ অন্য গল্প বলি।”

পূর্ণিমার ঘরের পাশে আজ অনেক জটলা। কিছু মহিলারা পুঁই শাক কাটছে, কেউ ছোট ছোট মাছ কুটছে, কেউ রোদে শুকোতে দেওয়া ধান উল্টে দিচ্ছে। পূর্ণিমা দূরে নদীর দিকে হাঁটছে, কাঁধে বালতির দড়ি। ঈশিতা ছুটে গেল তার পেছনে।

“পূর্ণিমা, আমি তোমার সঙ্গে আসতে পারি?”

পূর্ণিমা পেছনে তাকিয়ে হালকা হাসল, “চলো। কিন্তু পা পিছলে যাবে, সাবধানে। আজ জল কম।”

দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে চলল। পথে মাঝে মাঝে ঘাসে ভরা জমি, ছোট ছোট কাঁকর, বুনো ফুল। নদীর পাড়ে এসে পূর্ণিমা জুতো খুলে ফেলল। ঈশিতা কিছুটা ইতস্তত করল, তারপর তাকিয়েই বুঝে গেল, এ মুহূর্তে জুতো পায়ে রাখাটা যেন অশ্রদ্ধা। পা ডুবিয়ে দিল নদীর ধারে নরম কাদায়। ঠান্ডা জলের ছোঁয়ায় ঈশিতার শরীর কেঁপে উঠল, কিন্তু সেই কম্পন ভয় নয়—বরং এক ধরণের অচেনা আনন্দ।

পূর্ণিমা মাটি কুড়োতে শুরু করল। কাদার দলা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে একটা নির্দিষ্ট ধরনে ছাঁচ দিল। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, “তুমি এটা দিয়ে কী করছো?”

পূর্ণিমা বলল, “এই মাটি দিয়ে আমরা ‘মারাং বুরু’-র মূর্তি বানাই। পূজার সময় লাগে। কিন্তু মাঝে মাঝে, মন খারাপ হলে, শুধু মাটি ছুঁলেই ভালো লাগে। দিদা বলে, ‘যা দুঃখ, সব মাটি খেয়ে নেয়।’”

ঈশিতা হাঁটু গেড়ে বসে নিজেও হাত ভিজিয়ে ফেলল। আঙুলের ফাঁকে নরম কাদা, ভেজা ঘ্রাণ, আর কোথাও এক অদ্ভুত আত্মীয়তার স্পর্শ। সে অনুভব করল, তার শরীরের ভিতরের কোনো জমে থাকা ক্লান্তি, কোনো না বলা কষ্ট এই মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। যেন কাদা টেনে নিচ্ছে তার ভিতরের থমকে থাকা সময়গুলোকে।

পূর্ণিমা হঠাৎ বলল, “তোমার মা-বাবা কোথায়?”

প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু তার অভিঘাত গভীর। ঈশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আছে, কিন্তু তারা দু’জনই আলাদা থাকে এখন। আমি একাই বড় হয়েছি বলতে পারো। বাবা অনেক ব্যস্ত, মা–তিনি নিজের মতো আছেন। আমার সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ করেন না।”

পূর্ণিমা মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের তো বাবা অনেকেই থাকে না। কেউ মারা গেছে, কেউ শহরে গেছে আর ফেরেনি। তাই আমরা শিখে গেছি, দিদা-ভাই-বোনই আমাদের পরিবার।”

ঈশিতা চুপ করে রইল। এই কথার মধ্যে কোনো অভিযোগ নেই, নেই কোনো আক্ষেপ। যেন এটাই স্বাভাবিক। অথচ শহরে এইটুকু শুনলেই সবাই ভেঙে পড়ে, কাউন্সেলিং দরকার হয়, থেরাপি দরকার হয়। এখানে যেন দুঃখও একরকম বাঁচিয়ে রাখে।

পূর্ণিমা বলল, “তুমি আমার সঙ্গে আজ সন্ধেবেলা গান করতে পারো। আমাদের একটা নতুন তাল শিখিয়েছে। তুমি তালি দাও, আমি গাই আর নাচি।”

“আমি গান পারি না,” ঈশিতা হেসে বলল।

“তুমি মন দিয়ে থাকলেই হবে,” পূর্ণিমা বলল। “মাদল শুধু হাতে বাজে না, চোখ দিয়েও বাজানো যায়।”

ফেরার পথে তারা দু’জনে অনেকটা কথা বলল না, কিন্তু শব্দহীনতার মধ্যে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। ঈশিতা বুঝতে পারছিল, তার এই গবেষণা শুধু তথ্য সংগ্রহ নয়—এটা আসলে আত্ম-আবিষ্কারের একটা যাত্রা। তার থিসিসের পৃষ্ঠা হয়তো এই অভিজ্ঞতাকে ধরতে পারবে না। কিন্তু তার মনে, তার শরীরে যা জমা হচ্ছে, তা কোনো গ্রন্থপঞ্জির থেকে অনেক বেশি সত্য।

সন্ধ্যে নামল। পূর্ণিমার গ্রামে বাঁশের আলো জ্বালানো হল। মেয়েরা শাড়ি পরে নাচের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ ঈশিতা তাদের মধ্যে একজন। যদিও সে নাচবে না, গাইবে না, কিন্তু সে জানে, সে আর বহিরাগত নয়।

মাদল বেজে উঠল। পূর্ণিমা পা ফেলে, কোমর দুলিয়ে, মাথা ঘুরিয়ে সেই ছন্দে ঢুকে গেল, যেটা শহরের কোনো গানের সিডিতে নেই। ঈশিতা পাশেই বসে তালি দিল। সেই তালি নিখুঁত ছিল না, কিন্তু ছিল ভালোবাসা, সম্মতি। তার চোখের কোণে জল এসে গেল—কোনো কারণ ছাড়াই। হয়তো মাটির গন্ধে, হয়তো পূর্ণিমার নিঃশব্দ সাহচর্যে।

এইখানে এসে ঈশিতা প্রথমবার অনুভব করল—সে একা নয়।

পর্ব ৪: বাইরের লোক, ভিতরের গল্প

ঈশিতা এবার বুঝে গিয়েছে, এই গ্রামে তার ‘গেস্ট’ পরিচয়টা আর টিকে নেই। এখন সে পাড়ার ছেলেমেয়েদের কাছে সেই আপা, যে মাঝে মাঝে নাচের তাল ভুলে যায় কিন্তু হেসে ঠিক হয়ে যায়, যে গ্রামের পুকুরপাড়ে বসে কাঁচা তেঁতুল খায় আর মুখ কুঁচকে বলে, “খুব টক!” এখন সে পূর্ণিমার সঙ্গে এক বালতির জল টেনে আনে, ভাঙা ইটের ওপর বসে পা ভেজায়, আর হাত কাদায় মাখিয়ে শোনে দিদিমাদের মুখে হারিয়ে যাওয়া গল্প। তবু তার ভিতরে কোথাও একটা সঙ্কোচ কাজ করে—এই যে সে শহরের একজন, সে যে এখানে এসেছেও একপ্রকার ‘তথ্য’ নিতে, সেই দায় সে ভুলে থাকতে পারে না।

তবে গ্রামের মানুষজন কখনো তাকে ‘অন্য’ মনে করেনি। প্রথম দিন যারা তাকিয়ে ছিল দ্বিধায়, এখন তারাই হেসে ডাকে, “দিদি, চা খাবে?” বা “আজ তোরা গান শিখলি?” সে বুঝতে পারে—এখানে আপন হতে গেলে বেশি কিছু করতে হয় না। শুধু চুপ করে থাকতে হয়, এবং বুঝতে হয় যে প্রতিটি হাঁটা, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি ছুঁয়ে যাওয়া একটা ভাষা। সেই ভাষা বুঝতে পারলে, বাইরে আর ভিতরের ফারাকটা নিজেই ভেঙে পড়ে।

সন্ধ্যেবেলা পূর্ণিমা তাকে নিয়ে গেল গ্রামসংলগ্ন একটি ছোট কুঁড়েঘরে—যেখানে দু’জন বৃদ্ধা নিয়ম করে সন্ধেবেলা গল্প বলেন। শুধু বাচ্চারাই নয়, বড়রাও শুনতে আসে। ঘরের মধ্যে মাদুর পাতা, দেওয়ালে রঙচটা আলপনা, এক কোণে ধূপকাঠি জ্বলছে। গল্প বলা শুরু করলেন বৃদ্ধা রানুদি। তাঁর কণ্ঠে শ্লথতা আছে, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন মাটির মতো গাঢ়।

“অনেক কাল আগে,” রানুদি বললেন, “এই গ্রামে একটা মেয়ে থাকত, নাম তার ছিল সরিণী। সে কারও সঙ্গে কথা বলত না, সারাদিন শুধু পুকুরপাড়ে বসে থাকত। লোকে বলত—ওর শরীরে বনদেবীর আত্মা ঢুকেছে। কেউ কেউ ভয় পেত। কিন্তু সেই মেয়েটা নাচত। একলা একলা, গভীর রাতে। যখন সবাই ঘুমোত, তখন সে পায়ে পায়ে নেমে যেত মাঠে, মাদলের তালে না, নিজের মনের তালে। কেউ তা দেখেনি, কিন্তু সকালে মাঠে পাওয়া যেত দু’জোড়া পায়ের ছাপ—একটা ছোট, একটা বড়।”

শিশুরা গা ছমছম করে বসে আছে। ঈশিতা তাকিয়ে আছে রানুদি’র দিকে—তার কথায় কোনো অতিনাটকীয়তা নেই, কেবল এক নিঃশব্দ বিশ্বাস। রানুদি আবার বললেন, “একদিন সরিণী হারিয়ে গেল। কেউ খুঁজে পেল না। কিন্তু আজও কেউ কেউ বলে, পূর্ণিমার রাতে, যখন তাল বেজে ওঠে, তখন মাঠে সেই ছায়া দেখা যায়—যেন কেউ আরেকজনের সঙ্গে নাচছে। যাকে চোখে দেখা যায় না, শুধু মনে টের পাওয়া যায়।”

এই শেষ লাইনটা কাঁটার মতো গেঁথে গেল ঈশিতার মনে। “যাকে চোখে দেখা যায় না, শুধু মনে টের পাওয়া যায়”—এ তো শুধু লোকগাথা নয়, এ যেন ঈশিতার নিজের জীবনের কথা। এমন অনেক অনুভব আছে, যেগুলোর কোনো ছবি নেই, নেই কোনো শব্দ, তবু তারা থেকে যায়, নিঃশব্দ আত্মীয়তার মতো।

গল্প শেষ হলে সবাই একে একে বেরিয়ে গেল। পূর্ণিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, “তুমি সরিণীর গল্পটা বিশ্বাস করো?”

ঈশিতা বলল, “আমি ঠিক জানি না। কিন্তু ওই গল্পের মধ্যে একটা অনুভব আছে—সেটা মিথ্যে মনে হয়নি।”

পূর্ণিমা হেসে বলল, “দিদা বলে, গল্প মানে শুধু কথা না, ওটা একরকম মন্ত্র। যদি মন খারাপ থাকে, গল্প শুনলে মনের ঘর পরিষ্কার হয়। তুমি তো গবেষণা করছো, এসব লিখে রাখবে তো?”

ঈশিতা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “হ্যাঁ, লিখব। কিন্তু হয়তো লেখার থেকেও বেশি মনে রাখব। যেমন তোমার এই কথা, দিদার মুখ, রানুদির গল্প—এসব হয়তো কখনো হারাবে না।”

রাতে ফেরার সময় পূর্ণিমার মা, গঙ্গোত্রি বৌদি, ঈশিতাকে ডাকলেন। “দেখো মা, আমাদের কিছুই নেই, কিন্তু তুমি যেভাবে আসছো, তাতে খুব ভালো লাগছে। আজ তোমার জন্য একটু চালকুমড়ো আর শালপাতায় মুড়ে ভাজা মাছ রেখেছি। খেয়ে নিও। শরীর ভালো রাখতে হবে তো!”

এই স্নেহ, এই অজুহাত-ছাড়া যত্ন ঈশিতা অনেকদিন পায়নি। কলকাতায় তার ফ্ল্যাটে বাড়ির কেয়ারটেকার ছাড়া কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে না, “তুমি ভালো আছো?” কিন্তু এখানে, যাদের সঙ্গে তার পরিচয় মাত্র কয়েক দিনের, তাদের চোখে সে এক আত্মার আত্মীয়।

রাত গভীর হলে ঈশিতা হোমস্টের বারান্দায় বসে খাতাটা খুলল। কিন্তু আজ সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কলম কাগজে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাক্য তৈরি হচ্ছে না। তার পরিবর্তে সে লিখল:

“আমি তথ্য খুঁজতে এসেছিলাম, পেয়েছি সম্পর্ক। আমি ভাষা বিশ্লেষণ করতে এসেছিলাম, শিখছি নীরবতা পড়তে। মাদল কেবল তালের জন্য বাজে না—ওটা একটা ডাক। ডাক বাইরে থেকে নয়, ভিতর থেকে আসে। যেমন পূর্ণিমা আসে আমার দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, গল্প আসে ঘ্রাণ হয়ে, আলো আসে মাটির আঙুল ছুঁয়ে। আমি এখন বাইরের লোক নই—আমি এক অদৃশ্য গল্পের ভিতরের কেউ।”

সে লিখে চলল। রাত বাড়ল। শালপাতার নিচে বাতাসে হালকা শিরশির শব্দ। তার মনে হল, আজ রাতে সরিণীর ছায়া হয়তো কারও সঙ্গে নাচছে—হয়তো পূর্ণিমার সঙ্গে, হয়তো তার নিজের সঙ্গেই।

পর্ব ৫: ঘ্রাণ, গান ও গলার ফাঁদ

সকালে হালকা শিরশিরে ঠান্ডা ছিল বাতাসে। ঈশিতা যখন উঠল, তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা এমন গভীর যে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ যেন খুব জোরে কানে লাগছিল। সে ধীরে ধীরে বারান্দায় এল, গাছের পাতা দিয়ে রোদের হালকা রঙ ছড়িয়ে পড়েছে মাটির ওপর। শিউলি ফুল পড়ে আছে জমে, হালকা সাদা-কমলা চুয়ান। হঠাৎ করেই তার মনে হল—এই রকম শিউলি সে প্রথম দেখেছিল তার ঠাকুমার কাছে, সেই ছোটবেলায়, যখন তারা পুজোর আগে চাটাইয়ের ওপর ফুল শুকিয়ে রাখত ধূপ বানানোর জন্য। সেই ঘ্রাণটা আজকে আবার ফিরে এল, যেন শিউলির ভিতর দিয়ে সময় পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।

সে জানে, আজ তাকে বিশেষ একটা প্রস্তুতি নিতে হবে। আজ পূর্ণিমার মা গঙ্গোত্রি বৌদি তাকে নিয়ে যাবে গ্রামসংলগ্ন জঙ্গলের ধার ঘেঁষে বসবাসকারী বাউলদের ডেরায়। সেখানেই নাকি প্রতি শুক্রবারে ‘গানের জলসা’ বসে। কেউ কেউ বলে, সেই গানের মধ্যেই থাকে কিছু গোপন কথা, কিছু মন্ত্র, কিছু নিষিদ্ধ উচ্চারণ—যা কেবল অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না।

গঙ্গোত্রি বৌদি তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, “আজ একটু আগে রওনা দিতে হবে। মাঠ পেরিয়ে ঢোকার পরে ফোন ধরবে না, ভয় পেও না।” ঈশিতা মাথা নেড়ে হাসল। শহরের মেয়েরা যখন ভয় পায়, তখন সেটা বুঝতে দেওয়া শিখে গিয়েছে। কিন্তু গ্রামের এই নারীরা ভয় পেলেও মুখে বলে না—তারা ভয়কে হাতে মুঠো করে ধরে রাখে। হাঁটতে হাঁটতে ঈশিতা ভাবছিল, গঙ্গোত্রি বৌদির কণ্ঠে সেই তীব্রতা আছে, যেটা একদিকে কোমল, আবার অন্যদিকে তীক্ষ্ণ—যেন নকুলদানা ভাঙলে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে লঙ্কার স্বাদ।

জঙ্গলের পথটা ছিল ধুলোমাখা, লতাপাতায় ঢাকা, মাঝে মাঝে পায়ের নিচে খসখসে শব্দ। পথের পাশে কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গাছ, ঝোপঝাড় আর মাঝেমধ্যে দূরে দেখা যায় গরু চরাতে আসা কেউ একজন। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন তারা পৌঁছল সেই খোলা জমিতে, যেখানে পাতার ছায়া রোদকে ছেঁকে ফেলে এক রকম ছায়ার পাটিগণিত তৈরি করেছে, তখন হঠাৎ করেই ঈশিতার মনে হল—সে যেন ঢুকে পড়েছে কোনো গোপন আখড়ায়। সামনে বসে আছেন চার-পাঁচজন বাউল, কেউ দোতারা হাতে, কেউ মৃদঙ্গ ঘষছেন কাপড়ে, কেউ চোখ বন্ধ করে গান গুনগুন করছেন।

সবার চোখের দৃষ্টি যেন এক সুরের ভেতরে ডুবে আছে। কেউ কাউকে দেখছে না, কিন্তু যেন সকলেই জানে কে কোথায়। গঙ্গোত্রি বৌদি ধীরে ধীরে গিয়ে এক প্রান্তে বসলেন, ঈশিতাও তার পাশে বসে পড়ল। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না, কারো মধ্যে আগ্রহ নেই কে শহর থেকে এসেছে, কে গবেষণা করছে। এখানকার নিয়ম—তুমি এসেছ মানেই তুমি প্রস্তুত।

এক বৃদ্ধা বাউল চোখ খুলে তাকালেন ঈশিতার দিকে, তারপর খুব নরম গলায় বললেন, “তোমার গলার আওয়াজ শুনব?”

ঈশিতা থমকে গেল। সে তো গাইতে জানে না, অন্তত এমন গানের ভাষায় নয়। গলা শুকিয়ে এল যেন। গঙ্গোত্রি বৌদি পাশে ফিসফিস করে বললেন, “ভয় পেও না, গান মানে ঠিক সুরে গলা নয়, গান মানে নিজের ভিতরের ঢেউকে বাইরে আনা। তুমি চাইলে শুধু উচ্চারণ করো, এমনকি একটা শব্দ, তবু সেটাও গান হয়ে যাবে।”

বৃদ্ধা তখন বললেন, “যদি না পারো, চোখ বন্ধ করে বসে থেকো। আর ঘ্রাণ নিতে শেখো।”

এই শব্দটায় ঈশিতা চমকে উঠল। “ঘ্রাণ নিতে শেখো”—এর মানে কী? গান শোনার বদলে ঘ্রাণ নেওয়া? কিন্তু সে বুঝে গেল, এ কোনো মেটাফর নয়, এটা সত্যিই একটা শরীরী অভিজ্ঞতা। একটু পরেই শুরু হল গান। কেউ দোতারার দুই তারে ছুঁয়ে এক দীর্ঘ স্পন্দন তুলল, আর একজন গলা ভাঙা সুরে গাইতে শুরু করল—

“মনে যে বাগান ছিল,
সে বাগান পুড়ে গেছে ধোঁয়ায়।
ঘ্রাণে খুঁজি আমি আমারে,
আলোর আগে গন্ধই চেনায়।”

এই গান ঈশিতা আগে কোনোদিন শোনেনি। কিন্তু তার বুকের ভিতর যেন কেউ ধীরে ধীরে দরজা খুলছে। শব্দ নয়, গলা নয়, গানের মধ্যে থেকে ভেসে আসছে মাটির গন্ধ, লতার চিরচেনা গন্ধ, এমনকি একটা অদ্ভুত ঘামে ভেজা কাঠের ঘ্রাণ—যা হয়তো কারও শৈশব, কারও ফেলে আসা ঘর।

গান শেষ হলে সবাই চুপচাপ বসে রইল। কেউ হাততালি দেয়নি, কেউ বাহবা দেয়নি। যেন এ গান কোনো পারফর্ম্যান্স নয়, কোনো দাবি নয়, বরং নিজেকে নিজে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। ঈশিতা ধীরে ধীরে চোখ খুলল। তার মনে হল, তার কণ্ঠে যেন আটকে থাকা একটা গিঁট খুলে গেছে। সে কিছু না গেয়ে, কিছু না বলেই অনুভব করল—এই অনুভবই গবেষণার সবচেয়ে গভীর স্তর, যেটা কোনো চ্যাপ্টারে লেখা যায় না।

ফেরার পথে গঙ্গোত্রি বৌদি বললেন, “তুমি এবার বুঝেছো, গান শুধু গলা দিয়ে হয় না। এইখানে গলা মানে একরকম ফাঁদ, যেটায় অনুভব আটকে পড়ে। আর ঘ্রাণ? সেটা মুক্তি দেয়। তাই গান যত শুনবে, তত শরীর দিয়ে শুনো, চোখ, নাক, চুল—সব দিয়ে।”

ঈশিতা হেসে বলল, “আমার মনে হয়, আমি এবার গান লিখতে পারব, গাইতে না পারলেও।”

“তুমি পারবে,” বৌদি বললেন। “তুমি আর বাইরের কেউ নও। এখন তুমি সেই ঘরের মানুষ, যাদের ঘর আসলে কোনো এক জায়গা নয়—তারা থাকে যেখানেই ঘ্রাণ থাকে, মাটি থাকে, আর থাকে শোনার মানুষ।”

ঈশিতা হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারছিল, তার কণ্ঠে এখন আর ভয় নেই, তার গলায় হয়তো গান নেই, কিন্তু তার ভিতরে জমে উঠেছে একটা ভাষাহীন ভাষা। সেটা মাদলের মতো, গন্ধের মতো, সেই চোখের মতো যাদের দেখে বোঝা যায়—তারা অনেক কিছু জানে, অথচ বলে না। আজ তার গলায় কোনো শব্দ নেই, কিন্তু মনে একপ্রকার প্রতিধ্বনি চলছে—নিস্তব্ধতার প্রতিধ্বনি।

 

পর্ব ৬: প্রেমে পড়া যায় মাদলের তালে?

যেদিন বৃষ্টি পড়ল, সেদিন মাদলের শব্দটাও কেমন ভিজে গেল। ঈশিতা জানালার পাশে বসে দেখছিল, কুয়াশার মতো ঝরছিল হালকা ফোঁটা, মাটির উপর পড়ে গন্ধ তুলছিল কাদার, আর বাতাসে হালকা একটা উদাসী সুর ছিল, যেটা ঠিক গান নয়, আবার নীরবতাও নয়। সেই সময়টাতেই সে প্রথম অনুভব করল—এই জায়গাটার প্রতি, এই মানুষগুলোর প্রতি, এমনকি মাটির গন্ধের প্রতিও তার একটা অদ্ভুত টান জন্মেছে। টানটা স্নেহ নয়, দায়িত্ব নয়, বরং তার চেয়েও সূক্ষ্ম কিছু—হয়তো প্রেম।

প্রেম? ঈশিতা চমকে উঠেছিল নিজের ভাবনায়। সে কি প্রেমে পড়েছে? কার প্রেমে? পূর্ণিমার? না, শুধু তার নয়। সে প্রেমে পড়েছে একটা ছন্দের, একটা জ্যামিতির, একটা অস্পষ্ট নিকটতার—যেটা মানুষের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেলেও আসলে অনেক বেশি বিস্তৃত। ঠিক তখনই তার মনে পড়ল পূর্ণিমার কথা—সেদিন জঙ্গলের সেই আখড়ায় ফিরে আসার পথে পূর্ণিমা বলেছিল, “তুমি জানো, প্রেমে পড়লে শরীর আগে টের পায়, মন পরে শেখে।”

ঈশিতা হেসে বলেছিল, “তুমি এসব কথা শিখলে কোথা থেকে?”

পূর্ণিমা বলেছিল, “শিখিনি। শুনেছি। আর বোধহয় বুঝেছি। কিছু কথা বোঝার জন্য ভাষা লাগে না।”

সেই মুহূর্তটার কথা আজ বৃষ্টির দিনে যেন আবার ফিরে এলো। বাইরে বৃষ্টির শব্দে যখন তাল আসছিল না, ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল। ঈশিতা দরজা খুলে দেখে পূর্ণিমা দাঁড়িয়ে। ভিজে কাপড়, হাতে একটা পুটলি আর মুখে চেনা হাসি।

“চা আছে?” পূর্ণিমা জিজ্ঞেস করল।

“তুমি চা খাও?” ঈশিতা অবাক।

“আজ খেতে ইচ্ছে করছে,” সে বলল।

দু’জনে বারান্দায় বসল। বৃষ্টি তখনো পড়ছে, কিন্তু ঝিরঝিরে। গাছের পাতাগুলো জল মেখে চকচক করছে, আর আকাশটা কেমন ধূসর অথচ সুন্দর। পূর্ণিমা পুটলি খুলে দেখাল—ভেজা শালপাতায় মোড়া কিছু শুকনো ফুল, কয়েকটা কাঁথা সেলাই করা টুকরো আর একটুকরো লাল সুতো।

“এগুলো?” ঈশিতা প্রশ্ন করল।

“তোমার জন্য। আমরা যা ভালোবাসি, তাকে এমন জিনিস দিয়ে চিনি। এই ফুলটা দিদার কাছ থেকে পেয়েছিলাম, সেলাইটা আমার ছোট বোনের করা, আর এই সুতো—এটা আমি বেঁধে রাখি হাতে যখন মনে হয় আমি একা। এখন তোমার জন্য দিলাম।”

ঈশিতার গলা আটকে গেল। এত সরল উপহার, এত শব্দহীন স্নেহ—সে কোনোদিন পায়নি। সে শুধু বলল, “আমি এই জিনিসগুলো রাখব, কিন্তু আমি যে কৃতজ্ঞ, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না।”

পূর্ণিমা বলল, “তুমি বোঝাতে পারো না ঠিক আছে, কিন্তু যদি কখনো মনে হয়, আমার মতো কেউ তোমার জীবনকে ছুঁয়ে গেছে, তাহলে একদিন গল্প লিখে বোলো।”

এই কথাটা যেন ঈশিতার বুকের ভিতর গেঁথে গেল।

তারা কিছুক্ষণ চুপ করে বসল। হঠাৎ পূর্ণিমা বলল, “তুমি জানো, আমি তোমার দিকে তাকিয়ে মাদল শুনি।”

“মানে?” ঈশিতা জিজ্ঞেস করল।

“মানে, তোমার পাশে বসলে আমার শরীর আপনাআপনি তাল খুঁজে পায়। মনে হয় মাদল কোথাও বাজছে না, তবু আমি শুনতে পাচ্ছি। তুমি এসেছ বলেই হয়তো।”

এই প্রথমবার ঈশিতা চোখ নামিয়ে ফেলল। এতদিন ধরে সে চেষ্টা করেছে, দূরে থেকে বোঝার। এবার সে ভিতর থেকে জড়িয়ে পড়ছে—এই অনুভবই যেন একপ্রকার প্রেম। এমন প্রেম যার মধ্যে নেই চেনা আকর্ষণ, নেই স্পর্শের ভাষা, আছে শুধু ছায়ার মতো উপস্থিতি, যেটা আশ্রয় দেয় আবার উড়ে যায়।

ঈশিতা বলল, “তুমি জানো, আমার শহরে কেউ এভাবে কথা বলে না। প্রেম মানে সেখানে চ্যাট, ফোনকল, ভুল বোঝাবুঝি, আর শেষে ক্লান্তি।”

পূর্ণিমা মাথা নাড়ল, “তবে থেকে যাও এখানে। আমরা ক্লান্ত হই না। কারণ আমরা প্রেমকে বোঝাতে যাই না, আমরা শুধু মাটি ছুঁয়ে থাকি। ভালোবাসা যদি যায়, সে মাটি হয়ে ফেরে। আবার জন্মায়।”

ঈশিতা জানে, তার থাকা সম্ভব নয়। সে ফিরবে। আবার শহরের সেই ঘর, ইমেল, থিসিস, ডেডলাইন তাকে টেনে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন যে সে এখানে, এখন যে তার পায়ের নিচে এই ভেজা মাটি, পাশে এই মেয়েটি, আর দূরে কুয়াশায় মিশে থাকা তালহীন মাদলের ঘ্রাণ—এইসব মিলেই এক অস্থায়ী অথচ শাশ্বত ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে।

পূর্ণিমা তখন বলল, “তুমি কি কাগজে লিখে নিয়ে যাবে আমার কথা?”

“না,” ঈশিতা বলল। “তোমার কথা আমি লিখে রাখব হাওয়ায়। আর যদি কখনো খুব মন খারাপ হয়, আমি জানব, একটা মাদল বাজছে কোথাও—যেখানে তুমি নাচছ, আর আমি চোখ বন্ধ করে শুনছি সেই শব্দ, যেটা আসলে প্রেম।”

বৃষ্টি থেমে গেছে। তারা দু’জন সেই মুহূর্তটাকে টেনে ধরে রেখেছে। সেই নিরবতা, সেই দৃষ্টি, সেই অপ্রকাশ্য অনুভব—সেই তো আসল প্রেম। শব্দের ওপারে, তাল ছাড়িয়ে, কোথাও গভীরে।

পর্ব ৭: ফিরে যাবার আগে যা থেকে যায়

শান্তিনিকেতনের আকাশের রঙ ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। ভাদ্র শেষ, আশ্বিনের আলো এসে পড়েছে পাতায় পাতায়। গাছগুলো হঠাৎ যেন কেমন বেশি কথা বলে উঠেছে—প্রতিটি পাতা যেন বাতাসের সঙ্গে ফিসফিস করে বলে চলেছে তার পুরোনো দিনের গল্প। ঈশিতা হাঁটছিল গোরু চলে যাওয়া মেঠো পথে, মাথায় খোলা আকাশ, আর মনের ভিতর এক বিশাল প্রশ্ন: “ফেরার সময় কি কিছু রেখে যাওয়া উচিত?” সে জানে, তার ফেরা অবধারিত। প্রজেক্ট শেষ হয়েছে, প্রফেসর সেন ইমেইলে লিখেছেন: “তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে এসো, এনালাইসিসে অনেক কাজ বাকি।” আর যাওয়া মানেই—এই মাটি, এই মানুষ, এই তাল থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু সত্যিই কি ফেরা মানে বিচ্ছেদ?

পূর্ণিমা তাকে সেদিনই জানিয়েছে, “কাল আমাদের পরব। তুমিও এসো। এবারের পরবটা আমার জন্য আলাদা।” ঈশিতা কিছু জিজ্ঞেস করেনি, শুধু মাথা নেড়েছে। এই একটা মাসে সে বুঝে গিয়েছে, কিছু অনুভব ব্যাখ্যার জন্য নয়, শুধু থেকে যাওয়ার জন্য। তার সেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠছিল। অথচ ভিতরে কোথাও একটা টানও আছে ফিরবার—নির্বাক, অমোচনীয়।

সন্ধ্যার সময় সে গিয়েছিল গঙ্গোত্রি বৌদির সঙ্গে বসে থাকতে। আকাশে তখন ভাসছিল অদ্ভুত এক কমলা-হলুদের আলোর রেখা। বৌদি দুধ গরম করছিল, আর বলছিল, “তুই যাবি জানতাম। শহরের মানুষ বেশি দিন আটকে থাকে না। কিন্তু তুই যা শিখেছিস, তা ভুলে যাস না।” ঈশিতা জিজ্ঞেস করেছিল, “আমি কী শিখেছি, বৌদি?” বৌদি বলেছিল, “তুই নিজেকে শিখেছিস। তোর ভিতর যে অন্ধকার ছিল, যেটা তুই বোঝাতেও পারতিস না, সেটাকে তুই ছুঁয়ে ফেলেছিস। আমরা যারা মাটি চষে চলি, তারা জানি—যতবার মাটি খুঁড়ি, ততবার ভিতর থেকে কিছু বেরোয়। সেই মাটি দিয়ে যদি বাড়ি না-ও বানাই, তবু সে মাটি থেকে যায় শরীরে।”

সেই কথাগুলো মাথায় নিয়ে ঈশিতা সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। পূর্ণিমা তাকে উপহার দিয়েছিল লাল সুতো, একটা শুকনো ফুল, একটা ছোট্ট কাপড়ে মোড়া দানা বাঁধা চিঠি। সেই চিঠিটা এখনো সে খোলেনি। আজ পরবের দিন। আজই খুলবে।

পরবের সকালে গ্রামে যেন একটা অন্যরকম উত্তেজনা। বাঁশ বেঁধে তোড়ন তৈরি হচ্ছে, তালপাতায় রং করা আলপনা বসছে, শিশুদের মুখে সিঁদুর আর খড়ির টান। পূর্ণিমা সেই উৎসবের মাঝখানে, মাথায় ফুলের মালা, কপালে আঁকা আঁকা দাগ, ঠোঁটে নিঃশব্দ আত্মবিশ্বাস। সে ঈশিতাকে দেখে কিছু বলল না, শুধু একটা হাসি দিয়ে তাকাল, যেন বলছে, “আজ কিছু বলার নয়। শুধু অনুভব কর।”

ঈশিতা বসেছিল মহিলাদের পাশে, পাটকাঠি বিছানো চত্বরের এক কোণে। সন্ধে নামছিল, আলো কমে আসছিল, এবং ঠিক তখনই শুরু হল মাদল। এই মাদলের তালে ছিল না আগের মতো কেবল ছন্দ—এবার তাতে ছিল এক ধরণের অন্তিমতা, যেন এই শব্দ দিয়ে কারও জীবনের গল্প শেষ হবে, আবার নতুনভাবে শুরুও হবে।

পূর্ণিমা নাচতে শুরু করল। শরীরে আগুনের রেখা, চোখে জল আর আলো মিশিয়ে তৈরি এক ভাষা। সে পা ফেলছিল ধীরে ধীরে, কিন্তু প্রত্যেকটি পদক্ষেপ যেন জমির উপর লেখা কারও নাম। তার হাত নড়ছিল এমনভাবে, যেন আকাশের দিকে কেউ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে—“তুমি কি দেখছো?” ঈশিতার বুক কেঁপে উঠছিল। সে জানে না, তার চোখে জল কেন আসছে। এই কি প্রেমের পরিণতি? এই কি বিদায়ের মুহূর্ত?

নাচ শেষে পূর্ণিমা একা দাঁড়িয়ে থাকল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কিন্তু মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি। তখনই সে ঈশিতার দিকে এগিয়ে এল। কেউ কিছু বলল না। সে হাতে তুলে দিল সেই কাপড়ে মোড়া ছোট্ট জিনিসটা—যেটা ঈশিতা এখনো খোলেনি। “এটা এখন খুলে দেখো,” সে বলল।

ঈশিতা কাপড় খুলল। ভেতরে ছিল একটা মাদলের ছোট্ট কাঠের অংশ—হয়তো পুরনো, হয়তো ভাঙা কোনো মাদলের শরীর থেকে কাটা। আর তার সঙ্গে কাগজে লেখা কয়েকটি শব্দ—

“প্রেমে পড়া যায় মাদলের তালে।
কিন্তু থেমে যাওয়া যায় না।
তুমি থেমো না।”

এই তিনটা লাইন যেন ঈশিতার জীবনের সবচেয়ে গভীর চিঠি হয়ে উঠল। সে পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে বলল না কিছু, শুধু একটানা তাকিয়ে রইল। আর ভাবল, ‘ফিরে যাবার আগে যা থেকে যায়’—সেটাই আসলে থেকে যাওয়ার সবচেয়ে সত্যিকারের রূপ।

পর্ব ৮: রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা মাদল

বোলপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ঈশিতা ভেবেছিল, কোনো কোনো স্টেশন কেবল যাত্রার জায়গা নয়—ওরা সীমানা। এখানে এসে একটা জীবন থেমে থাকে, আরেকটা শুরু হয়। ট্রেন এখনো আসেনি, ঘড়িতে সকাল ৬টা ৫০। কুয়াশা জমে আছে লাল সিমেন্টের বেঞ্চে, পাখিরা ইতস্তত ডানায় ঝাঁকুনি দিচ্ছে, আর মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা—যেটা ঈশিতা আগে কোনোদিন শুনতে পায়নি।

তার হাতে এখনো সেই ছোট কাপড় মোড়ানো মাদলের কাঠের টুকরো। সে জানে না, এটাকে কীভাবে বর্ণনা করবে। এটা কি প্রেমের চিহ্ন? না বন্ধুত্বের টোকেন? না নিজেকে খুঁজে পাওয়ার প্রতীক? সে শুধু জানে—এটা হাত থেকে ফেলতে পারছে না। পকেটেও রাখতে ইচ্ছে করছে না। শুধু চেপে ধরেছে, মুঠোয়।

পূর্ণিমা আসবে কি না, সেটা সে জানত না। আগেই বলে দিয়েছিল, “আমি প্ল্যাটফর্মে আসব না। আমাদের নিয়ম, কেউ গেলে আমরা চোখে চোখ রাখি না।” তখন ঈশিতা হাসতে হাসতে বলেছিল, “তবে কি এটাও একধরনের পালিয়ে যাওয়া?” পূর্ণিমা মাথা নাড়িয়ে বলেছিল, “না, এটা একধরনের থেকে যাওয়া। না দেখলে চোখে জল আসে না।”

তবু তার মনে হয়েছিল, সে আসবে। কিংবা হয়তো দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকবে, একটা গাছের আড়ালে, কিংবা স্টেশনের বাইরে কোনও পানের দোকানের ছায়ায়। হয়তো এক ঝলক দেখা দেবে, অথবা কিছুই না, শুধু মাদলের একটা ছায়া হয়ে থেকে যাবে।

প্ল্যাটফর্মে লোক বাড়ছিল। কেউ কেউ পাটনায় যাবে, কেউ হাওড়ার লোকাল ধরবে, কেউ আবার ট্রেন মিস করে অটো ধরার ফন্দি আঁটে। ঈশিতা চুপচাপ বসে, ব্যাগপত্র পাশে রেখেই ভাবছিল—এই যে এতগুলো স্মৃতি, এতগুলো অদেখা স্পর্শ, এত শব্দহীন গান—এসব কি ট্রেনে ওঠার সময় সঙ্গে নেওয়া যায়? নাকি সব ফেলে রেখে যেতেই হয়? তার মনে হল, এই অভিজ্ঞতা যেন জলরঙে আঁকা ছবি—ছুঁলেই ছড়িয়ে যাবে, কিন্তু শুকিয়ে গেলে আর মুছে ফেলা যাবে না।

ট্রেনের ঘোষণা এল—“হাওড়া প্যাসেঞ্জার দুই নম্বর লাইনে আসছে।” সে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ কাঁধে তুলল। ঠিক তখনই পাশের থেকে কে যেন হালকা গলায় বলল, “তোমার পায়ের নীচে যা আছে, সেটা ফেলো না।” ঈশিতা চমকে উঠে নিচে তাকাল—একটা শুকনো শালপাতা উড়ে এসে পড়ে ছিল তার পায়ের কাছে, সেই পাতার কোণে একটুকরো আলপনা আঁকা, যা সে চিনতে পারল—পূর্ণিমার আঁকা।

সে চারপাশে তাকাল। পূর্ণিমা নেই। কিন্তু তার গলার সেই স্বর? না, সে হয়তো কল্পনা করছে। হয়তো নয়। কে জানে। ঈশিতা ঝুঁকে পাতাটা কুড়িয়ে নিল, তারপর একটা অদ্ভুত বাচ্চামির মতো সেটাকে তার বইয়ের ভিতর রেখে দিল, যেন স্কুলে থাকা অবস্থার মতো—যখন শুকনো পাতা জমিয়ে রাখা হতো কোনো বিশেষ দিনের স্মৃতি হিসেবে।

ট্রেন ঢুকল। ধীরে ধীরে, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, যেন কোনো বৃদ্ধ লোক হাঁটছে লাঠি নিয়ে। মানুষ উঠে পড়ল। সিট খালি নয়, তবু সে একটা জানালার পাশে বসে পড়ল। জানালার বাইরে তখনও কুয়াশা, ভোরের আলো, আর ছায়া।

ট্রেন ছাড়ল। ধীরে ধীরে ছুটতে শুরু করল চেনা পথে। আর ঠিক তখনই, জানালার পাশে একটা ছায়া দেখা গেল মাঠের ধারে—একটা লাল শাড়ি, কপালে সাদা আঁচড়, এবং হাতে একটা ছোট্ট মাদল। পূর্ণিমা?

সে দৌড়চ্ছে না, হাঁটছে না—শুধু দাঁড়িয়ে আছে। মাদল হাতে ঝুলছে, আর চোখে একধরনের প্রশ্রয়। দু’জনের চোখ মেলেনি, তবু দেখা হয়ে গেছে।

ঈশিতা জানে, সে পুরোপুরি কখনো এই জায়গা থেকে যাবে না। তার শরীর শহরে ফিরলেও, আত্মা থাকবে এই মাটিতে, এই মাদলের শব্দে। আর তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে বাজবে সেই অদৃশ্য তান, যেটা কেবল প্রেম নয়, এক গভীর আত্মিক যোগ। মাদল কখনও থামে না—সে শুধু গতি বদলায়।

পিছনে পড়ে থাকে বোলপুর, গাছের ছায়া, পূর্ণিমার হাসি, রানুদির গল্প, গঙ্গোত্রির দুধে ফোঁড়ন, আর সেই মাটির কাদা যেটা দুঃখকে শুষে নেয়। ঈশিতা মাথা ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়—কুয়াশার মধ্যেই সে যেন শুনতে পায় সেই শব্দ—টুপটাপ, থুপথাপ, থুমকথুম… মাদল বেজে চলে, নীরব স্টেশনের মতো, অপেক্ষার মতো।

এবার সে জানে—প্রেমে পড়া যায় মাদলের তালে। কিন্তু তেমন ভালোবাসা কখনও বিদায় নেয় না।

পর্ব ৯: কান্না নয়, তালের পরিণতি

হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মটা বোলপুরের মতো নয়—এখানে কুয়াশা নেই, নেই শান্তি। এখানে ঘোষণা গর্জে ওঠে, চা-ওয়ালার হাঁক থেমে থেমে ধাক্কা মারে কানে, আর মানুষের ভিড় যেন দম আটকে দেয়। ঈশিতা নেমে দাঁড়াল, ভিড়ের মাঝে যেন একটুকরো নিঃশব্দ ঘিরে ধরল তাকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মনে হচ্ছিল, পায়ের নিচে এই প্ল্যাটফর্ম যেন কাঁপছে, আবার ছিঁড়েও যাচ্ছে—যেন তার ভেতরের কোনো দড়ি অল্প অল্প করে খুলছে।

রেল স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ধরে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এল সে। ছ’তলার এক কামরার ঘর। জানালা থেকে দেখা যায় অন্য ফ্ল্যাটের বারান্দা, যেখানে শাড়ি শুকায়, কিছু বাচ্চা চিৎকার করে খেলে, আর দূরে মেট্রো লাইন চলে যায়। এখানে শালপাতার গন্ধ নেই, কাদামাটির ছোঁয়া নেই, আর নেই মাদলের সেই তীক্ষ্ণ, অথচ কোমল ডাক। ঈশিতা ব্যাগ নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়াল, তারপর ধীরে ধীরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বাতাসে হালকা একরকম কৃত্রিমতা—যেটা শহরের বাতাসের চেনা চরিত্র।

সে তার ল্যাপটপ খুলল, “Thesis: Ethnographic Study on Tribal Rhythm Therapy” নামের সেই ফাইলটা খুলে বসলো। কীবোর্ডে আঙুল নামতেই হাত থেমে গেল। এত কথা মাথার মধ্যে, অথচ শব্দ তৈরি হচ্ছে না। সে জানে, প্রজেক্টের জন্য রিপোর্ট দরকার। একাডেমিক ভাষা, টেমপ্লেট, চার্ট, রেফারেন্স। কিন্তু এই যে সে যে সত্যিকারের অনুধাবনগুলো নিয়ে ফিরেছে—সেগুলো কোথায় রাখবে?

সে কাগজে লিখল—

“এখানে আমি মাদলের শব্দ পাই না। কিন্তু প্রতিদিন মনে হয়, আমার বুকের ভিতর কোথাও তাল বাজছে। আমি এখন আর শহরের সেই ঈশিতা নই—যে সবকিছু বিশ্লেষণ করে, ব্যাখ্যা খোঁজে। আমি এখন সেই মেয়ে, যে জানে—কান্না নয়, সত্যিকারের তাল মানে নিজের শরীরের মধ্যে ছন্দ খুঁজে পাওয়া। যাকে কেবল শ্রুতির জন্য নয়, অনুভবের জন্য রাখা হয়। যারা কাদায় পা রাখে, তারাই জানে—পৃথিবীর সবচেয়ে মৃদু শব্দই সবচেয়ে গভীর ছোঁয়া দেয়। আমার থিসিস শুধু গবেষণাপত্র নয়, এটা একটা অন্তরের বিবৃতি।”

সে বুঝল, কান্না নয়—এই অনুভবের শেষ ফলাফল হল একপ্রকার স্বীকারোক্তি। যে ভালোবাসা গলায় আটকে থাকেনি, অথচ সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। সেই অনুভবই তাল। সেই তালেরই পরিণতি।

রাতে সে ঘুমোল না। তার মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াল পূর্ণিমার হাসি, রানুদির সেই গল্প—সরিণী আর অদৃশ্য ছায়ার—আর সেই নির্দিষ্ট সন্ধেটা, যখন তারা মাদলের তালে একসাথে শ্বাস নিয়েছিল। এতদিন ধরে যে ক্লিনিক্যাল বিশ্লেষণের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল, আজ তা অকেজো মনে হল। মাদলের ভাষা কোনো মেডিক্যাল জার্নালে ধরা যায় না।

সকালে উঠে সে প্রথম যে কাজটা করল—তা হলো সেই লাল সুতোর টুকরোটা বার করে চুলে বেঁধে ফেলা। তারপর ফোন তুলল, প্রফেসর সেনকে কল করল। “স্যার, আমি রিপোর্ট দেব, কিন্তু সেটা হয়তো একটু আলাদা হবে। এটা কেবল থিসিস নয়, এটা একটা যাত্রা।”

প্রফেসর থেমে গম্ভীর গলায় বললেন, “আমি সেটাই আশা করছিলাম, ঈশিতা। গবেষণা যদি নিজেকে না বদলায়, তা হলে সেটা তথ্য জোগাড় মাত্র। বদলে যাও—তারপর লিখে দাও।”

ফোন রেখে ঈশিতা জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। শহরের কোলাহল তখনও আছে, কিন্তু তার ভিতরে কোথাও একটা আশ্চর্য নিঃশব্দতা। সে চোখ বন্ধ করল।

মনে হচ্ছিল, দূরে কোথাও বাজছে এক মাদল। স্পষ্ট নয়, কিন্তু তাল ঠিক। সেই তালেই প্রেম ছিল, সেই তালেই বিদায়, আর সেই তালেই ফিরে আসা।

পর্ব ১০ : তবু বাজে মাদল—যেখানে আমি নই, তবু আছি

একটা গল্প শেষ হলে সেখানে কিছু শব্দ রয়ে যায়, যেগুলো বলা হয়নি। একটা তাল থেমে গেলে ওর কম্পনটা অনেকক্ষণ শরীরে বাজতে থাকে। ঈশিতা আজ বুঝতে পারছে—গল্প আর তাল, দুটোই থেমে যায় না; তারা শুধু অন্যরকম হয়ে ওঠে। সে শান্তিনিকেতন থেকে চলে এসেছে, নিজের শহরে, নিজের ঘরে, কিন্তু তার ভিতরে এখনো মাদল বাজছে। সেই বাজনা এখন আর শ্রুতিযোগ্য নয়—তা অনুভবের, ত্বকের ঠিক নীচে, শিরায় রক্তের সঙ্গে বয়ে চলা এক প্রকার নীরব সঙ্গীত।

তার থিসিস জমা হয়ে গেছে। তাতে সে লিখেছে “Rituals are not merely therapeutic techniques, they are lived philosophies; rhythm is not an instrument of distraction, it is a way of remembering one’s own breath.” তার গাইড বলেছেন, এটা থিসিসের মতো নয়, এটা জার্নালের জন্য লেখা যায়। ঈশিতা হেসে বলেছে, “এই লেখাটা আমি নাচতে নাচতে লিখেছি, স্যার।”

শহরের ক্লাসে ফিরেও তার চোখে বারবার ভেসে ওঠে পূর্ণিমার মুখ, মাটির গন্ধ, রানুদি’র গল্প, আর সেই শেষ সন্ধ্যেটা, যেখানে তাকে কেউ বিদায় জানানোর বদলে বলেছিল, “থেমো না।” কখনো তার মনে হয়, সে একটা পুরোপুরি অন্য সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল কিছুদিনের জন্য—যেখানে কেউ কারও প্রেমে পড়ে না ঠিক, কিন্তু মাটি ছুঁয়ে থেকে যায়। কখনো আবার মনে হয়, এইসবকিছুই ছিল তার নিজের ভিতরের অজানা সত্তার সঙ্গে দেখা হওয়া।

একদিন কলেজ শেষে সে হেঁটে ফিরছিল। রাস্তায় একটা বাউল গান গাইছিল ফুটপাতে দাঁড়িয়ে—ভাঙা কণ্ঠ, পুরনো দোতারা, কিন্তু তার গলায় ছিল একরকম সত্য যা শহরের পারফর্মারদের নেই। সে থেমে শুনল। গানটা ছিল—

“আমি ছিলুম ধূলোর ঘরে
তুমি এসে পায়ের ছোঁয়ায়
আমায় করলে নদী।”

ঈশিতার চোখে জল চলে এল। সে জানত না, এই শহরের মাঝেও সে এমনভাবে কেঁপে উঠতে পারে। তার মনে হল, সে আর একা নয়। কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও এখনো মাদল বাজাচ্ছে, কোনো পরবের জন্য, অথবা কারও জন্য যাকে সে চেনে না—তবু অনুভব করতে পারে।

সে নিজের ব্যাগ থেকে এক টুকরো শালপাতা বার করল—পূর্ণিমার আঁকা পাতাটা। এখনো তা শুকিয়ে আছে, মুছে যায়নি। সে জানত, সেটা কেবল একখানা পাতা নয়—ওটা একটা পাসপোর্ট, এক সীমানার থেকে আরেকটায় পার হওয়ার ছাপ। সে সেটা রেখে দিল তার ঘরের টেবিলের কাচের নিচে, যেন প্রতিদিন দেখলে মনে পড়ে যায়—সে কোথা থেকে ফিরেছে।

তাকে এখন অনেকে বলে, “তুমি একটু পাল্টে গেছ, ঈশু। আগের মতো মুডি বা অস্থির না, চোখে অন্যরকম কিছু ঝিলিক।” সে উত্তর দেয় না। উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। কারণ কেউ জানে না, সে যখন অফিস থেকে ফিরছে, ল্যাপটপ খুলছে, ফোনে ক্লাস নিচ্ছে—তখনও তার ভিতরে বাজছে এক তাল, এক অনাহুত মাদল।

একদিন সে পকেটে রাখা সেই ছোট কাঠের মাদলের টুকরোটা নিয়ে পূর্ণিমার দেওয়া চিঠির নিচে রেখে লিখল—

“আমি আছি।
যেখানে তুমি নেই, সেখানে আমি নেই।
যেখানে তুমি আছো, সেখানে আমি বাজি।
একটা মাদল হয়ে।
যেটা তুমি ছুঁলো না কখনো,
তবু যেটা তোমার পায়ের ছায়া মেপে তাল রাখে।
আমি তাল নই, আমি তালের ভিতরের হাওয়া।
যেখানে শব্দ নেই, তবু অনুভব আছে।
তোমার মতো।”

সেদিন বিকেলে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। ছাদের উপর ছিটে পড়ল ফোঁটা ফোঁটা জলের। ঈশিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করল। মনে হল, দূরে কোথাও পূর্ণিমা একটা নতুন তাল শিখছে—তার পায়ের নিচে জমে উঠছে কাদা, আর সেই কাদার ঘ্রাণে সে নিজে আবার গড়ে উঠছে। ঈশিতা জানত, তাদের মধ্যে কোনও চিঠি চালাচালি হবে না, কোনো ছবি তোলা হবে না, এমনকি ফোন নম্বরও নেই। তবু একটা সম্পর্ক থেকে গেছে—যেটা ছুঁয়ে যাওয়া যায় না, কিন্তু ভুলে যাওয়া যায় না।

কিছু প্রেম থাকে মাদলের মতো।
তাকে বোঝাতে হয় না।
তাকে থামাতে যায় না।
সে শুধু বাজে।
যেখানে আমি নেই, তবু আছি।
তবু বাজে মাদল।

 

শেষ

1000024915.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *