অধ্যায় ১: অশরীরীর আগমন
ধনপুর নামের ছোট্ট গ্রামটি যেন প্রকৃতির এক নিভৃত কোলে বসে আছে। শরৎকালের শুরুতে গ্রামজুড়ে এখন পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে, মেঘের আড়াল থেকে নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছে, কাশফুলে ঢাকা মাঠে বাতাসের খেলায় দুলছে সাদা ফেনার মতো শিরীষের তুলো। গ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি বছর দুর্গাপুজোর প্রতিমা গড়ার দায়িত্ব থাকে মৃৎশিল্পী নিবারণ পাল ও তাঁর পরিবারের হাতে। নিবারণের হাতে তৈরি মূর্তির খ্যাতি আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে বহু বছর ধরেই। গাঁয়ের মানুষ বিশ্বাস করে, নিবারণের আঙুলের ছোঁয়ায় যেন দেবীর জীবন্ত ছায়া ফুটে ওঠে। দিনভর কাদা মাটি আর রঙের ঘ্রাণে ভরা কর্মশালায় চারদিক গমগম করে, কিন্তু রাত নামলেই সে ঘর একেবারে অন্যরকম হয়ে ওঠে। দিনের উষ্ণতা মিলিয়ে গিয়ে রাতের শীতল বাতাসে যেন মাটির গন্ধ আরও গাঢ় হয়, আর মূর্তির অর্ধেক তৈরি মুখাবয়বগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, তারা নীরবে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। সেই অচেনা অনুভূতির মধ্যেই বাস করত নিবারণের একমাত্র কন্যা সুমনা। বয়সে সদ্য কৈশোর পেরোনো সুমনার মনে অদ্ভুত এক কৌতূহল—মাটি, রঙ আর দেবীর প্রতিমার চোখে যেন সে মানুষের বাইরের এক অদ্ভুত জগতের ছোঁয়া খুঁজে বেড়ায়। সারা দিন কর্মশালার ভেতর বাবাকে মূর্তি গড়তে দেখে দেখে সে বড় হয়েছে, তবু প্রতিবারের মতো এবারের পুজোর প্রস্তুতিতেও তার চোখে এক অজানা শিহরণ কাজ করছিল।
সেই দিন গভীর রাত। ধনপুরের আকাশে চাঁদ ছিল প্রায় নিখুঁত পূর্ণিমার মতো, তার আলো মাটির ওপর সাদা কাপড়ের মতো বিছিয়ে দিয়েছিল। দূরের পুকুরপাড় থেকে ভেসে আসছিল ঝিঁঝিঁর ডাক আর শেয়ালের হাঁক, যা রাতের নিস্তব্ধতাকে আরও গাঢ় করে তুলছিল। সুমনা বিছানায় শুয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম তার চোখে আসছিল না। কেমন অদ্ভুত এক টান তাকে কর্মশালার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, যেন কেউ নিঃশব্দে তাকে ডাকছে। অবশেষে মনের অদৃশ্য নির্দেশ মেনে সে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। ঘরের মেঝে ঠান্ডা, কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল তার পায়ের পাতায়। বাতাসে এক অচেনা শীতলতা, যেন শরতের রাত হঠাৎ শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। কর্মশালার দরজায় পৌঁছেই সুমনা থমকে দাঁড়াল। মৃদু আলোয় ভেতরের মূর্তিগুলো যেন নিঃশ্বাস ফেলছে। সবচেয়ে বড় দুর্গামূর্তিটি প্রায় সম্পূর্ণ, শুধু চোখের কাজ বাকি। নিবারণ বলতেন, চোখের আঁচড়েই প্রাণ সঞ্চার হয় প্রতিমায়—চোখ না থাকলে দেবী কেবল মাটির শরীর। কিন্তু সেই অসমাপ্ত মূর্তির দিকে তাকিয়ে সুমনার মনে হল, দেবী যেন ইতিমধ্যেই জেগে উঠেছেন। এক ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে প্রতিমার গায়ের সোনালি প্রলেপে লেগে রহস্যময় আভা ছড়াচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে সুমনা দেখল—দেবীর চোখের কোণে ঝিলমিল করে উঠল এক ফোঁটা জল। প্রথমে সে ভেবেছিল, হয়তো রাতের শিশিরের ফোঁটা। কিন্তু পরের মুহূর্তেই সেই ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল গালের নিচে, আরেকটি ফোঁটা তার পিছু নিল। শিশিরের মতো নয়, ওটা ছিল প্রকৃত অশ্রু, যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক অচেনা বেদনার ভার। সুমনার শরীর হঠাৎ শিহরে উঠল। মনে হল, কেউ যেন তার কানে ফিসফিস করে বলছে—“আমি আছি।”
সুমনা আতঙ্কে চারপাশে তাকাল। কর্মশালার কোণে ছায়ারা নড়ছে, বাতাসে মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে হালকা ধূপের সুগন্ধ, অথচ কোথাও কোনো মানুষ নেই। দেবীর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের রেখা মাটির মেঝেতে এক অদ্ভুত আকার এঁকে গেল, যা সুমনার কাছে অচেনা হলেও যেন কোনো লুকানো বার্তা বহন করছে। বাতাসের তাপমাত্রা হঠাৎ নেমে এল এতটাই যে তার নিঃশ্বাস ধোঁয়ার মতো বেরোতে লাগল। এক অদৃশ্য চাপা কান্নার শব্দ যেন মূর্তির ভেতর থেকে ভেসে আসছে। ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্রণে সুমনার হৃদস্পন্দন এত দ্রুত হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, সে যদি একটু দেরি করে তবে শব্দটা বাইরে বেরিয়ে যাবে। ঠিক তখনই কর্মশালার বাইরের গাছপালা থেকে হালকা হাওয়া এসে দেবীর কানের দুলটাকে কাঁপিয়ে দিল, আর প্রতিমার চোখের কোণে লেগে থাকা শেষ ফোঁটা জল মাটিতে পড়ে টুপ করে শব্দ করল। সেই শব্দে সুমনার হঠাৎ মনে হল, কোনো এক অশরীরী উপস্থিতি তাকে সতর্ক করে যাচ্ছে—হয়তো কোনো হারিয়ে যাওয়া আত্মা, হয়তো কোনো অসমাপ্ত ইতিহাস। সে এক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু দৃষ্টি সরাতে পারল না। যেন সেই চোখ তাকে বন্দি করে ফেলেছে। অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে সে দৌড়ে ঘরে ফিরে গেল, কিন্তু বুকের ভেতর কেঁপে ওঠা সেই রাতের শীতলতা আর দেবীর চোখের অশ্রু তার চেতনায় গভীর দাগ কেটে রইল। পরদিন ভোরে কর্মশালার দরজায় বাবার হাতের ছোঁয়ায় মাটির গন্ধ আবারও সাধারণ হয়ে উঠলেও সুমনার মনে তখনও ভেসে বেড়াচ্ছিল সেই একরাশ অশরীরী প্রশ্ন—কেন দেবীর চোখে জল? কে কাঁদছে এই ধনপুরের নিস্তব্ধ রাতে? সেই প্রশ্নের উত্তর তখনও কেউ জানত না, কিন্তু সুমনার মনে জন্ম নিয়েছিল এক অমোঘ অনুভূতি, যে এই পুজো অন্যসব বছরের মতো হবে না, এবং তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে এমন এক রহস্য, যার শুরু হয়েছিল দেবীর চোখ থেকে ঝরা সেই প্রথম অশ্রুর মধ্য দিয়ে।
অধ্যায় ২: হারিয়ে যাওয়া কিশোরীর গল্প
ধনপুর গ্রামের মানুষজন পুজোর মরশুমে যেমন আনন্দে মেতে ওঠে, তেমনি অচেনা এক শিহরণও বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে। গ্রামের প্রবীণরা আজও সেই রাতের কথা ভুলতে পারেন না, যেদিন ধনপুরের আকাশে আতঙ্কের কালো ছায়া নেমে এসেছিল। বছর দশেক আগের কথা—শরতের ঠিক এই সময়, যখন মাটির গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ, কাশফুলে সাজে ধনপুরের মাঠ, আর দুর্গাপুজোর প্রস্তুতিতে গ্রামের প্রতিটি ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। সেই উৎসবের প্রহরেই হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল বারো বছরের কিশোরী ঝিলিক। ঝিলিক ছিল গ্রামের সবার প্রিয় মুখ, চঞ্চল আর হাসিখুশি স্বভাবের জন্য যার পরিচিতি ছিল দূরদূরান্তে। ছোট্ট শরীরের ভেতর লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস—সে গান গাইতে ভালোবাসত, নদীর ঘাটে বসে গল্প করতে, আর প্রতিমা গড়ার কর্মশালায় ঘুরে বেড়াতে। গ্রামের বয়স্করা বলেন, ঝিলিকের চোখে ছিল এক ধরনের স্বপ্নিল দীপ্তি, যা দেখে মনে হত, সে যেন এই মাটির গ্রামে জন্মালেও তার আত্মা কোনো অদ্ভুত রহস্যের সঙ্গে বাঁধা। কিন্তু সেই উজ্জ্বল চোখের মালিকের নিখোঁজ হওয়ার রাতটি যেন গ্রামবাসীর মনে এক স্থায়ী অন্ধকার গেঁথে দিয়েছিল।
সেই রাতের স্মৃতি আজও অনেকের গায়ে কাঁটা দেয়। দুর্গাপুজোর আগের সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল ঝিলিককে, হাতে রঙিন লণ্ঠন, চুলে সাদা শিউলির গুচ্ছ। সেদিন আকাশে হালকা মেঘ ভেসে ছিল, নদীর ঘূর্ণিতে সাঁতার কাটছিল জোনাকির মতো আলো। গ্রামের কয়েকজন মৎস্যজীবী দাবি করেছিলেন, তারা শেষবার ঝিলিককে দেখেছিলেন নদীর ঘাটের শেষ বাঁকের কাছে, যেখানে ঘন কাশফুলের ফাঁক দিয়ে বাতাসে অদ্ভুত গুঞ্জন ভেসে আসে। কিন্তু রাত গভীর হওয়ার পর যখন মা-বাবা তাকে ঘরে ফেরেনি দেখে খোঁজ শুরু করেন, তখন গ্রামজুড়ে নেমে আসে অস্থিরতা। নিবারণ পাল, যিনি সেই সময় প্রতিমা গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তিনিও কাজ ফেলে মশাল হাতে খোঁজে বের হন। খাল-বিল, নদীর ঘাট, পুকুরপাড়—ধনপুরের প্রতিটি কোণে মানুষজন ছুটে বেড়ালেন, কিন্তু কোথাও ঝিলিকের ছায়া পর্যন্ত মিলল না। কেউ বলল, হয়তো নদীর ঘূর্ণিতে পড়ে গিয়েছিল সে, কারণ নদীর স্রোত সেদিন ছিল অস্বাভাবিকভাবে তীব্র। আবার কেউ বলল, বাইরের কোনো অচেনা লোক তাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কোনো লাশ পাওয়া গেল না, কোনো চিহ্নও নয়—মাটিতে এমনকি কোনো পদচিহ্ন পর্যন্ত নেই। এই নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে ঘিরে গ্রামে শুরু হল নানা কল্পনা, নানা গুজব। কেউ বলল, রাতের আঁধারে ঝিলিককে দেখা গেছে দেবীর কর্মশালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে, আবার কেউ বলল, তাকে নাকি শেষবার দেখা গিয়েছিল নিবারণের মাটির ঘরের পাশের পুরনো বটগাছের তলায়, যেখানে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত ছায়া নড়াচড়া করে। ধনপুরের রূপকথার মতো শান্ত গ্রামে হঠাৎ যেন ভয়ঙ্কর এক অজানা উপস্থিতি নেমে এল।
এরপর থেকে নিবারণ পালের কর্মশালা হয়ে উঠল গুজবের কেন্দ্র। ঝিলিকের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই প্রতিমা গড়ার সময়ে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করল—রাতের বেলায় মূর্তির চোখে জল দেখা যাওয়া, ভোরবেলা কারও পায়ের শব্দ শোনা, বা মাটির গন্ধের সঙ্গে হঠাৎ কেমন এক শীতলতা মিশে যাওয়া। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, প্রতিটি দুর্গাপুজোর আগে যেন বাতাসে এক অদৃশ্য আতঙ্ক ছড়িয়ে থাকে। শিশুদের মায়েরা রাত নামার পর তাদের বাইরে যেতে দেন না, আর নদীর ঘাটে যেতে গ্রামের মৎস্যজীবীরাও ভয় পান। ঝিলিকের গল্প ধীরে ধীরে কেবল একটি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নয়, বরং এক অমোঘ রহস্যের প্রতীক হয়ে উঠল। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে ঝিলিকের আত্মা কর্মশালার মূর্তির ভেতর আশ্রয় নিয়েছে, হয়তো সে নিজের অমোঘ কষ্টের কথা জানাতে চায়। কেউ কেউ আবার বলেন, ঝিলিকের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে পালের বাড়ির দুর্গামূর্তির চোখের কান্নার গভীর যোগ আছে—প্রতি বছর প্রতিমা গড়ার সময় সেই চোখ যেন এক অদৃশ্য দুঃখের কথা বলে ওঠে। দশ বছর কেটে গেলেও গ্রামের বৃদ্ধরা যখনই এই স্মৃতি মনে করেন, তাদের গলায় এক অচেনা শিহরণ ধরা পড়ে। তারা এখনো নিঃশব্দে বলেন, “ওই রাতের পর ধনপুর আর আগের মতো নেই। মাটির মূর্তিতে আজও ঝিলিকের কান্না লুকিয়ে আছে।” এভাবেই এক কিশোরীর হারিয়ে যাওয়া ধনপুরের মানুষকে শুধু ভয় নয়, এক অনন্ত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে—কোথায় হারিয়ে গেল ঝিলিক? নাকি সে সত্যিই কোথাও হারায়নি, বরং অন্য এক অদৃশ্য জগতে থেকে আজও ধনপুরের প্রতিমাকে ঘিরে নীরব উপস্থিতি রেখে যাচ্ছে?
অধ্যায় ৩: রাত্রির কান্না
ধনপুরের রাত যেন সেদিন আরও গভীর ও ভারী হয়ে উঠেছিল। পুজোর আগের দিনগুলোয় সাধারণত গ্রামের আকাশে উৎসবের আলোছায়া খেলা করে, ঢাকের শব্দ দূরের মাঠ থেকে ভেসে আসে, আর প্রতিটি ঘরের আঙিনা জুড়ে হাসি আর গানের মেলা বসে। কিন্তু সেই রাতের বাতাসে যেন উৎসবের উত্তাপকে ঢেকে দিয়েছিল এক অচেনা শীতলতা। প্রথম রাতের সেই অশরীরী অভিজ্ঞতার পর সুমনা যতই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করুক, তার মনে ভয় এবং কৌতূহলের মিশ্র অনুভূতি তীব্র হয়ে উঠছিল। বাবাকে কিছু বলতে পারছিল না, কারণ নিবারণ পাল ছিলেন বাস্তববাদী মানুষ; তিনি কখনও অলৌকিকতাকে পাত্তা দেননি। কিন্তু সুমনার ভেতরের অস্থিরতা তাকে শান্তি দিচ্ছিল না। সেদিন রাতেও ঘুম তার চোখে এল না। জানলার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরের মেঝেতে সাদা রেখা এঁকে যাচ্ছিল, আর দূরের বাঁশবাগান থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল শেয়ালের দীর্ঘ হাহাকার। সেই শব্দ যেন তাকে অদৃশ্য কারও আহ্বান মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অজানা এক টান আবারও তাকে কর্মশালার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। বুক ধড়ফড় করতে করতে সে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে বাইরে বেরোল। চারদিকের নীরবতা এতটাই ঘন হয়ে ছিল যে তার নিজের পায়ের শব্দও কানে অস্বাভাবিকভাবে জোরে লাগছিল।
কর্মশালার কাছে আসতেই সুমনার মনে হল, বাতাসে যেন এক অচেনা গন্ধ মিশে আছে—মাটির গন্ধের সঙ্গে এক ধরনের শীতল ধূপের সুবাস, যা একইসঙ্গে মিষ্টি এবং ভয়ঙ্কর। দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরের অন্ধকার ঘরের মধ্যে চোখ রাখতেই সে থমকে দাঁড়াল। মূর্তিরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তাদের উপস্থিতি যেন জীবন্ত। সবচেয়ে বড় দুর্গামূর্তিটি এখনও অসম্পূর্ণ, চোখের শেষ আঁচড় দেওয়ার আগেই যেন সে জেগে উঠেছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই সুমনার কানে এল এক মৃদু টপটপ শব্দ। প্রথমে মনে হল, হয়তো কোনো ফুটো ছাদ থেকে পানি পড়ছে। কিন্তু শীতল রাতের আকাশ একেবারে পরিষ্কার, কোথাও কোনো ফোঁটা নেই। শব্দটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল—টপ… টপ… টপ… যেন কোনো গভীর বেদনার অশ্রু মাটির ওপর পড়ে সুর তুলছে। বুকের ভেতর হঠাৎ শীতল স্রোত বয়ে গেল সুমনার। সে নিঃশব্দে ভেতরে পা রাখল, চাঁদের আলোয় ভেজা মাটির মেঝে কেমন অদ্ভুত ভাবে ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। চোখ তুলে তাকাতেই সে দেখল—দেবীর চোখের কোণ থেকে টলটলে জল গড়িয়ে পড়ছে। প্রথম রাতের মতো এ দৃশ্য কোনো কাকতাল নয়, স্পষ্টতই বাস্তব। জলের ফোঁটাগুলো অদ্ভুত স্বচ্ছ, যেন কাঁচের মতো ঠান্ডা। সুমনা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াল, আঙুলের ডগায় স্পর্শ করতেই শরীরে শীতল স্রোত ছড়িয়ে পড়ল। সেই জল মাটির আর্দ্রতার মতো নয়, বরং কোনো অদৃশ্য দুঃখের নিঃশব্দ প্রমাণ যেন। দেবীর চোখের ভেতরকার বিষণ্ণতা এতটাই গভীর যে মনে হচ্ছিল, প্রতিমা নয়, কোনো মানুষের আত্মা কাঁদছে। সুমনার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু চোখ সরাতে পারল না।
পরের দিন সকালে সুমনা বাবাকে সব খুলে বলল। নিবারণ প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “মাটির মূর্তিতে এমনটা হতেই পারে। রাতে আর্দ্রতা বাড়লে চোখের কোণে জমা শিশির বা মাটি থেকে বেরোনো জলকণাই হয়তো ফোঁটা ফোঁটা পড়ে।” তাঁর কণ্ঠে ছিল নিশ্চিন্ত আত্মবিশ্বাস, যেন কোনো অলৌকিকতার অবকাশ নেই। কিন্তু মূর্তির দিকে তাকাতেই নিবারণের চোখেও যেন এক মুহূর্তের জন্য থমক লাগল। প্রতিমার চক্ষুতে এক অদ্ভুত বিষাদের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে, যা কেবল কাদামাটির খেলা বলে মনে হয় না। মাটির গায়ের সূক্ষ্ম রেখাগুলো যেন এক গভীর কান্নার ছাপ বয়ে এনেছে। গ্রামের কয়েকজন মদনবাবু, হরিপদ দাদারা যখন কর্মশালায় এলেন, তাঁরাও মূর্তির চোখের অদ্ভুত বিষণ্ণতা দেখে চুপ হয়ে গেলেন। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলতে লাগলেন ঝিলিকের গল্প, সেই হারিয়ে যাওয়া কিশোরীর রাতের রহস্যময় নিখোঁজ হওয়ার কথা। নিবারণ মুখে না বললেও অনুভব করলেন বাতাসে এক অদৃশ্য ভার। তিনি কাজের ফাঁকে মূর্তির চোখে বারবার হাত বুলিয়ে দেখলেন, কোনো ফাটল বা জল জমার জায়গা আছে কিনা, কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলেন না। সুমনা নীরবে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল—তার চোখে এখন স্পষ্ট বিশ্বাস, দেবীর চোখ থেকে ঝরছে শুধু জল নয়, কোনো হারিয়ে যাওয়া আত্মার দীর্ঘশ্বাস। সেই রাতের কান্না যেন শুধু ধনপুরের নয়, সময়ের গহ্বর পেরিয়ে আসা কোনো অমোঘ যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি, যা সবার অজান্তেই প্রতিমার প্রাণে বেঁচে আছে।
অধ্যায় ৪: গ্রামের আতঙ্ক
ধনপুরের গ্রামে পুজোর আগের দিনগুলো সাধারণত আনন্দ, কর্মব্যস্ততা আর কোলাহলে ভরে থাকে। কিন্তু সুমনার সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার পর থেকেই যেন গ্রামের বাতাসে অচেনা এক ভারী নীরবতা নেমে এসেছে। প্রথমে ঘটনাটা সীমাবদ্ধ ছিল শুধু সুমনা আর নিবারণের কর্মশালার মধ্যে, কিন্তু শীঘ্রই পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল রহস্যময় কানাঘুষো। প্রতিমা গড়ার কাজ দেখতে আসা গ্রামের মানুষরা একে একে অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে শুরু করল। মৃৎশিল্পীর ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে স্পষ্ট টপটপ শব্দ শোনা যাচ্ছিল, যেন অদৃশ্য কোনো উৎস থেকে জল পড়ছে। গ্রামের প্রবীণ মদনবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো ছাদ থেকে রাতের শিশির টপকাচ্ছে। কিন্তু দুপুরের শুকনো গরমেও যখন সেই শব্দ কানে এল, তাঁর মুখের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুধু শব্দই নয়, কেউ কেউ বললেন যে তাঁরা মূর্তির ঠোঁটকে অল্প নড়তে দেখেছেন, যেন কোনো নিঃশব্দ ভাষা উচ্চারণের চেষ্টা করছে। এইসব খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামের প্রতিটি পাড়ায়। পুজো কমিটির সদস্যরা যারা নিয়মিত মূর্তি গড়ার অগ্রগতি দেখতে আসতেন, তাঁদের মুখেও দেখা গেল অস্বস্তির ছাপ। সকালের জমায়েতে হরিপদ দাদা ফিসফিস করে বললেন, “এ কি সত্যিই দেবীর কৃপা? না কি কোনো অশুভ আত্মার ছায়া?” কথাগুলো বাতাসে ঝুলে রইল, আর মানুষের মনে গা ছমছমে একটা অনুভূতি পাক খেতে লাগল।
রাত যত গড়াতে লাগল, ভয়ও তত গভীর হতে থাকল। গ্রামের বহু মানুষই জানালেন, তাঁদের ঘুম ভেঙে গেছে অদ্ভুত এক কান্নার শব্দে। কারও মতে সেই কান্না স্পষ্ট মানুষের, আবার কারও মতে তা যেন মাটির ভেতর থেকে উঠে আসা অস্পষ্ট গুঞ্জন। নদীর ঘাটে বসা মৎস্যজীবীরা শপথ করে বললেন, রাতের আঁধারে তারা দেখেছেন কর্মশালার দিকে ভেসে যাচ্ছে ফ্যাকাসে নীলচে আলো, যেন কেউ ধূপ জ্বালিয়ে রেখে গেছে। কয়েকজন সাহসী যুবক একসঙ্গে কর্মশালার চারপাশে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু রাত যত গভীর হল, তাঁদের সাহস তত কমে আসতে লাগল। বাতাসে মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে গেল এক অজানা শীতলতা, কানে আসতে লাগল সেই টপটপ শব্দ, কখনও আবার এক নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস। পাহারা দিতে গিয়ে কেশব ও গোপাল নামের দুই যুবক স্পষ্ট দেখলেন, মূর্তির চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। ভয়ে তাঁদের হাত থেকে লণ্ঠন পড়ে গেল। তারা দৌড়ে বাইরে বেরোতেই পেছন থেকে যেন মৃদু হাহাকারের মতো শব্দ ভেসে এল। পরদিন ভোরে এই খবর পুরো গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। শিশুরা ভয়ে রাতে ঘর থেকে বেরোতে সাহস পেল না, বয়স্করা অকারণে পুকুরের ধারে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। পুজোর আনন্দমুখর গ্রাম যেন হঠাৎ অদৃশ্য কোনো শক্তির ছায়ায় ঢেকে গেল।
পুজো কমিটির বৈঠক ডাকা হল তড়িঘড়ি করে। বড়বাবু অমলেন্দু মুখোপাধ্যায় গম্ভীর মুখে বললেন, “এভাবে চলতে থাকলে গ্রামবাসীর মনোবল ভেঙে পড়বে। পুজো বন্ধ করা যায় না, কিন্তু আমাদের জানতে হবে—এ কি শুভ সংকেত, নাকি অশুভ আত্মার বার্তা।” মদনবাবু কাঁপা গলায় বললেন, “আমি আমার জীবনে অনেক পুজো দেখেছি, কিন্তু এমন ঘটনা কখনও দেখিনি। দেবী কি আমাদের কিছু জানাতে চাইছেন?” কেউ প্রস্তাব দিলেন, কর্মশালায় প্রতিদিন গঙ্গাজল ছিটিয়ে পূজা দিতে হবে। কেউ বললেন, কোনো তান্ত্রিক এনে মন্ত্রপাঠ করাতে হবে। আবার অনেকে মনে করলেন, হয়তো এটি কোনো হারিয়ে যাওয়া আত্মার অশান্তি, ঝিলিকের নিখোঁজ হওয়ার রহস্যের সঙ্গে যার গভীর যোগ থাকতে পারে। সুমনা নীরবে সব শুনে গেল। তার মনে হচ্ছিল, মূর্তির চোখে যে কান্না সে দুই রাত ধরে দেখেছে, তা হয়তো শুধু মাটির আর্দ্রতা নয়, বরং কোনো অব্যক্ত যন্ত্রণার নিঃশব্দ প্রতিবাদ। নিবারণও এবার আর স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না। তাঁর শিল্পীর চোখে মূর্তির ঠোঁটের সেই অদ্ভুত নড়াচড়া, চোখের গভীর বিষণ্ণতা নিছক কল্পনা মনে হচ্ছিল না। গ্রামের মানুষরা যখন রাতে বাড়ির দরজা শক্ত করে বন্ধ করতে শুরু করল, তখন ধনপুরের আকাশে যেন এক অদৃশ্য ভার নেমে এল। উৎসবের আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়ে সেই ভারী বাতাসে লুকিয়ে রইল এক প্রশ্ন—এই কান্না কি দেবীর আশীর্বাদ, না কি ঝিলিকের হারিয়ে যাওয়া আত্মার নীরব আহ্বান?
অধ্যায় ৫: সুমনার স্বপ্ন
ধনপুরের অদ্ভুত ঘটনাগুলোর পর সুমনার মন যেন ক্রমশ এক অদৃশ্য ঘূর্ণিতে টেনে নেওয়া হচ্ছিল। প্রতিমার চোখের কান্না, গ্রামের মানুষদের আতঙ্ক, আর বাবার মুখের গম্ভীর নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে তার চারপাশের পৃথিবী যেন বদলে যাচ্ছিল। দিনভর পুজোর প্রস্তুতির মধ্যে থাকলেও সুমনার মন বারবার ফিরে যাচ্ছিল কর্মশালার সেই অন্ধকার রাতগুলোর দিকে। বাবার ব্যস্ততায় ভরা হাতের মাটি মাখা ছোঁয়া, গামলার রঙিন জল, ধূপের গন্ধে ভরা আঙিনা—সব যেন এক অচেনা সুরে বেজে উঠছিল। কিন্তু তার মনের গভীরে জমে থাকা ভয় আর কৌতূহল রাতে ঘুমের মধ্যে অন্য রূপ নিল। সেই রাতে শরতের আকাশ ছিল পরিষ্কার, কিন্তু হালকা কুয়াশার পর্দা গ্রামকে ঢেকে রেখেছিল। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল দূরের কুকুরের হাহাকার ভেসে আসছিল। সুমনা ঘুমের কোলে তলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ অনুভব করল, যেন তার শরীরের ওপর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে এল, অথচ মনে হল সে এক অচেনা অন্ধকারের দিকে হাঁটছে। স্বপ্নের ভেতর সে নিজেকে দেখতে পেল মাটির গন্ধে ভরা এক বিস্তীর্ণ মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে ফিকে চাঁদ, বাতাসে নদীর কাদামাটির সোঁদা গন্ধ আর ধূপের ধোঁয়ার হালকা পরত। কুয়াশা ঘেরা মাঠের ওপারে একটি ক্ষীণ আলো তাকে আহ্বান করছে।
সুমনা সেই আলোর দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল—এক কিশোরী সাদা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির গায়ের পোশাক যেন নদীর জলে ভিজে গিয়ে ঝলমল করছে, বাতাসে তার চুল উড়ে উঠছে। সুমনার মনে হল, সে যেন ঝিলিকের গল্পের সেই হারিয়ে যাওয়া কিশোরীকে দেখছে, যদিও মুখটা প্রথমে অস্পষ্ট ছিল। মেয়েটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো। তার পায়ের ছাপ মাটিতে পড়ছে না, অথচ চারদিকের বাতাস কেঁপে উঠছে তার প্রতিটি নড়াচড়ায়। কাছে আসতেই সুমনা দেখতে পেল, কিশোরীর চোখে অদ্ভুত এক গভীরতা, যেখানে একইসঙ্গে বেদনা আর অনন্ত মমতা লুকিয়ে আছে। মেয়েটি মৃদু কণ্ঠে বলল, “আমাকে মুক্ত করো।” সেই কণ্ঠ যেন বাতাসে ভেসে সুমনার বুকের গভীরে গিয়ে আঘাত করল। শব্দের মধ্যে ছিল এক অচেনা কান্নার সুর, আবার যেন এক ধরনের মৃদু অনুনয়। চারিদিকে হঠাৎ ধূপের ধোঁয়া ঘনীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ধোঁয়ার ভেতর সুমনা দেখতে পেল মাটির প্রতিমা, যার চোখ থেকে টলটল করে ঝরছে জল। কিশোরীটি আবার বলল, “আমাকে মুক্ত করো।” সুমনার মনে হল, সে হাত বাড়িয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যতই কাছে যেতে চায়, মেয়েটি ততই দূরে সরে যাচ্ছে। বাতাসের শীতলতা তার শরীরকে জমিয়ে দিচ্ছিল, অথচ মন তাকে এক অজানা আকর্ষণে টেনে নিচ্ছিল সেই কণ্ঠের দিকে। হঠাৎ মাটির নিচ থেকে যেন নদীর গর্জনের মতো শব্দ উঠল, কিশোরীর মুখে ছড়িয়ে পড়ল ম্লান হাসি, আর সেই হাসির ভেতর দিয়ে সুমনা অনুভব করল এক গোপন দুঃখের ভার।
হঠাৎ করেই সুমনা চমকে জেগে উঠল। বুক ধড়ফড় করছে, ঘরের অন্ধকারে মোমবাতির আলো কেঁপে উঠছে। স্বপ্নের সেই কিশোরীর কণ্ঠ যেন এখনো কানে বাজছে—“আমাকে মুক্ত করো।” ঘরে চারদিকে মাটির গন্ধ যেন অস্বাভাবিকভাবে স্পষ্ট, যেন কর্মশালার ধূপের ধোঁয়া এই ঘরেও এসে লেগে আছে। সুমনা তাড়াতাড়ি জানলার দিকে তাকাল, বাইরে তখনও রাতের নিস্তব্ধতা। সে বুঝতে পারল, এ শুধু স্বপ্ন নয়, এর ভেতর লুকিয়ে আছে কোনো অমোঘ ইঙ্গিত। কিশোরীর মুখের দিকে ভাবতেই তার মনে ঝিলিকের নামটা ঝিলিকের মতো উঁকি দিয়ে উঠল। গ্রামের মানুষ যে নিখোঁজ মেয়েটির গল্প বারবার ফিসফিস করে বলত, সেই ঝিলিকের ছবির সঙ্গে স্বপ্নের কিশোরীর মুখের আশ্চর্য মিল খুঁজে পেল সে। ঠোঁটের বাঁক, চোখের গভীরতা, আর সেই দুঃখভরা হাসি—সবকিছু যেন একই। সুমনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হল, ঝিলিকের অশান্ত আত্মাই স্বপ্নের আড়ালে এসে তাকে ডেকেছে। হয়তো সেই মূর্তির কান্নার পেছনে ঝিলিকের অসমাপ্ত জীবনের গল্প লুকিয়ে আছে। সুমনা জানল, এই রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত তার নিজেরও মুক্তি নেই। সে ধীরে ধীরে জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের প্রথম আলোকে দেখতে দেখতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যে কোনো মূল্যে সে ঝিলিকের অশান্ত আত্মাকে মুক্ত করার পথ খুঁজে বের করবে।
অধ্যায় ৬: গোপন কক্ষের সন্ধান
প্রথমেই সুমনা এবং অনিরুদ্ধের চোখে পড়ে কর্মশালার পুরনো অংশের অদ্ভুত নীরবতা। পুজোর মরসুমে যেখানে প্রতিটি কোণে হাতুড়ির শব্দ, কাদা মাটির গন্ধ, আর শিল্পীদের ফিসফিসানি ভেসে আসার কথা, সেখানে সেই নির্জন অংশে যেন সময় থেমে গেছে বহু বছর ধরে। রাতের অন্ধকারে শুধুই কাকের ডাক আর মাটির গন্ধে ভরা হাওয়া। মাটির মূর্তিগুলোর সারি পার হয়ে তারা দু’জন যখন পুরনো ঘরের দিকে এগোলো, বাতাস যেন হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠল। কাঠের মেঝেতে পা রাখতেই শোনা গেল হালকা কড়মড় শব্দ, আর তাতে সুমনার বুকের ধুকপুকানি যেন আরও জোরে বাজতে লাগল। ছোটবেলায় নিবারণ পাল তাকে এই দিকটায় আসতে বারণ করতেন। বলতেন, “ওই দিকের ঘরগুলোর মাটির গন্ধে রোগ বাসা বাঁধে।” কিন্তু আজকের রাতে সেই বারণ যেন এক অদৃশ্য টানে মুছে গেছে। সুমনার মনে হচ্ছিল, স্বপ্নে দেখা সাদা পোশাকের কিশোরীর ডাক যেন তাকে টেনে নিয়ে আসছে এই গোপন কক্ষের দিকে।
অবশেষে তারা একটি তালাবদ্ধ ছোট্ট কামরার সামনে এসে দাঁড়ালো। কাঠের দরজাটা জীর্ণ, তবু তালাটা অদ্ভুতভাবে নতুন, যেন বহুদিন পরও কেউ তা সচেতনভাবে বন্ধ করে রেখেছে। অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি নিশ্চিত? হয়তো তোমার বাবা কিছু রেখে দিয়েছেন এখানে।” সুমনা মৃদু কাঁপা গলায় উত্তর দিল, “কিন্তু এই তালা আমি কখনও দেখিনি।” দু’জন মিলে তালাটা পরীক্ষা করতে লাগল। ধুলো জমা ফাঁক দিয়ে ভিতরের অন্ধকারটা যেন চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধ একটি ছোট্ট লোহার রড খুঁজে এনে ধীরে ধীরে তালা খোলার চেষ্টা করতেই পুরনো দরজাটা কাঁপতে কাঁপতে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকতেই এক ঝটকা ঠান্ডা বাতাস তাদের মুখে এসে লাগল। যেন অনেক দিন ধরে আটকে থাকা শ্বাস এক মুহূর্তে বেরিয়ে এল বাইরের জগতে। মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে ছিল ধূপের পুরনো গন্ধ আর এক অদ্ভুত স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, যা একই সঙ্গে ভৌতিক ও বিষণ্ণ। ঘরের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পুরনো রঙের ড্রাম, ভাঙা পুতুলের মাথা, ছেঁড়া কাপড়, আর কিছু অচেনা সরঞ্জাম। দেওয়ালের ধুলো জমা তাকের ওপর কিছু কাগজপত্রও ছড়ানো, যেগুলোতে জীর্ণ হাতের লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আবিষ্কার ছিল ঘরের মাঝখানে পড়ে থাকা একটি লালচে ফিতা। ম্লান আলোয় সেই ফিতেটি অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, যেন নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দিতে চাইছে। সুমনা নিচু হয়ে ফিতেটা হাতে নিতেই তার বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। স্পর্শ করা মাত্রই ফিতেটি থেকে এক ধরনের ঠান্ডা শিরশির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। ঠিক তখনই গ্রামের প্রবীণ এক বৃদ্ধা—যিনি তাদের পিছু পিছু এসেছিলেন কৌতূহলে—চোখ কুঁচকে ফিসফিস করে বললেন, “এই ফিতেটা তো ঝিলিকের। দশ বছর আগে যখন মেয়েটা হারিয়ে গিয়েছিল, তখন ওর মাথার বেনীতে বাঁধা ছিল এই লাল ফিতা।” কথাগুলো শুনেই সুমনার মনে ঝড় বয়ে গেল। অনিরুদ্ধও নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল সেই ফিতের দিকে। ঝিলিকের হারিয়ে যাওয়ার রহস্য, মূর্তির চোখের কান্না, আর সাদা পোশাকের কিশোরীর ডাক—সবকিছুর মধ্যে যেন এক অদ্ভুত যোগসূত্র স্পষ্ট হতে শুরু করল। ঘরটার দেওয়াল যেন নিঃশব্দে শত অজানা কাহিনি শুনিয়ে দিচ্ছিল, যা বছর দশেক ধরে কেউ শোনেনি। সুমনার মনে হল, এই গোপন কক্ষই হয়তো সেই অশরীরী কান্নার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সময় থেমে আছে ঝিলিকের শেষ দিনের মতোই।
অধ্যায় ৭: অদ্ভুত আলোকছটা
পুজোর অষ্টমীর রাতে ধনপুর গ্রামে বাতাসে যেন এক অদ্ভুত সঙ্কেত ভেসে উঠল। সকাল থেকে গর্জন করছে ঢাক, কাশফুলের সুগন্ধে ঘেরা গ্রামসাজ, আর পুজো কমিটির সদস্যরা ব্যস্ত প্রতিমার সাজে। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই হঠাৎ করেই সব কিছু থেমে গেল—বিদ্যুৎচালিত বাতি নিভে গেল, দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল, আর পুরো গ্রাম একটি অন্ধকারে ডুবে গেল। অন্ধকারের মধ্যে প্রথমে মানুষের মনে ভয় নেমে এল। নিবারণ পাল, যিনি সব সময় বাস্তববাদী, প্রথমে বললেন, “হয়তো কোনো লাইন বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ভয় পাবার কিছু নেই।” কিন্তু কর্মশালার ভেতরে এসে দেখলেন, বিদ্যুতের অন্ধকারকে উপেক্ষা করে মূর্তির কপালে হঠাৎ নীলাভ আলো জ্বলছে। সেই আলো এতটা নিখুঁত এবং শক্তিশালী, যেন কোনো অদৃশ্য উৎসের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে। বাতাসে এক অদ্ভুত শীতলতা ভেসে উঠল, আর মাটির গন্ধে মিশে গেল ধূপের আর্দ্র ঘ্রাণ। সুমনার হৃদয় মুহূর্তে দগ্ধ হয়ে গেল—স্বপ্নের সেই কিশোরীর উপস্থিতি যেন বাস্তবে এসে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে।
নীলাভ আলোয় সুমনা স্পষ্ট দেখতে পেল এক কিশোরীর অবয়ব। মেয়েটির চুল কালো, গায়ে সাদা পোশাক, যা বাতাসে হালকা ঢেউ খাচ্ছে। চোখে অশ্রু জমে আছে, আর ঠোঁটে একটি ক্ষীণ হাসি—যা দেখতে ছোট্ট, মৃদু, কিন্তু অদ্ভুতভাবে বেদনার্ত। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে যেন সুমনাকে ডাকছে। চারপাশে অন্ধকার, কিন্তু সেই নীলাভ আলো তার চারপাশকে আলোকিত করছে, যেন অদৃশ্য কিছুর উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সুমনা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, কিন্তু পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় বাতাস আরও ভারী হয়ে এসেছে। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির স্পর্শ নিয়ে আসে। মূর্তির চোখ থেকে আগের মতোই ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে, আর কপালের আলো যেন সেই জলকে আরও জীবন্ত করে তুলছে। অনিরুদ্ধও পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে, তার মুখে ভীতির ছাপ স্পষ্ট। তারা দু’জনই বুঝতে পারল, মূর্তির মধ্যে যে অশান্ত শক্তি রয়েছে, সেটি এখন শুধুমাত্র নিঃশব্দ নয়—এটি নিজেকে প্রকাশ করছে আলোর মাধ্যমে।
হঠাৎ কিশোরীর চোখের দিকে তাকাতে থাকল সুমনা। চোখের ভেতরে যেন গল্প লুকিয়ে আছে, গল্প যা দশ বছর ধরে কেউ শুনতে পায়নি। অশ্রুর সঙ্গে মিলিয়ে ভেতরের ক্ষীণ হাসি যেন বলে, “আমাকে বুঝো, আমাকে মুক্ত করো।” সুমনার মনে হল, সে শুধু দেখছে না, অনুভবও করছে—মেয়েটির বেদনা, নিঃশ্বাস, এবং সেই অমোঘ আকাঙ্ক্ষা যেন সরাসরি তার হৃদয়ে প্রবেশ করছে। অনিরুদ্ধ ছায়ার ভেতর একাগ্র হয়ে দেখছে, আর দু’জনে মিলিয়ে অনুভব করছে যে, বিদ্যুতের অন্ধকার ও নীলাভ আলো এক ধরনের সংকেত। এটি কোনো সাধারণ অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া ঝিলিকের আত্মার দীর্ঘশ্বাসের প্রকাশ। ধনপুরের পুরনো কর্মশালার মধ্যে সেই একাকী আলো, কিশোরীর ক্ষীণ হাসি, জল গড়িয়ে পড়া চোখ—সব মিলিয়ে একটি অনন্য দৃশ্য তৈরি করছে। সুমনার মনে হল, এ শুধু আলোর খেলা নয়, এটি একটি ডাক—একটি আহ্বান যা তাকে নির্ধারিত পথের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। সে বুঝতে পারল, ঝিলিককে মুক্ত করার জন্য যে পথ বাকি আছে, সেই পথের প্রথম সংকেত এই অদ্ভুত নীলাভ আলোকছটা।
অধ্যায় ৮: সত্যের মুখোমুখি
ধনপুরের সেই অষ্টমীর রাতের নীলাভ আলো এবং কিশোরীর ক্ষীণ হাসি দেখার পর, সুমনা এবং অনিরুদ্ধ জানতেন—এখন আর সময় নেই গোপন রহস্যের ভেতর চাপা রাখতে। ঘরের মধ্যে নীরবতা শুধু বাতাসের কাঁপন নয়, বরং এক অদৃশ্য ভীতি ও সত্যের গন্ধ বহন করছিল। রাতে, যখন গ্রাম অর্ধনিঃশব্দ, সুমনা বাবার মুখোমুখি বসে তাকে সমস্ত ঘটনা জানাতে বলল। নিবারণ পাল প্রথমে কিছু বলতে পারলেন না। দশ বছরের পুরনো গোপন এক স্রোত হঠাৎ তার মনের মধ্যে ভেসে উঠল। চোখে জল, হাতে কাদা, এবং ধুলো মেখে থাকা ধূসর মেঝের দিকে তাকিয়ে তিনি ভেঙে পড়লেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাসের পর নিবারণ স্বীকার করলেন—ঝিলিক তাঁর শিষ্য। সে ছোটবেলা থেকে মৃৎশিল্পের প্রতি অদ্ভুত আগ্রহ দেখাত, প্রতিমা গড়ার প্রতিটি খুঁটিনাটি শেখত, আর নিজের হাতে সৃজনশীলতার ছোঁয়া রেখে মানুষের হৃদয় ছুঁত। কিন্তু সেই রাত, দশ বছর আগে, যখন মূর্তি বানানোর কাজে ঝিলিক তার পাশে ছিল, ঘরের দেওয়াল হঠাৎ ধসে পড়ে। ঝিলিকের ছোট্ট শরীরটি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়, আর নিবারণ চিৎকারে নিজেকে হারাতে লাগেন।
নিবারণের কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “আমি… আমি ভয়ে আর আতঙ্কে ছেলেটির মৃতদেহ বাইরে আনতে পারিনি। পুজো বন্ধ হয়ে যাবে, গ্রামের মানুষদের মনে ভয় জাগবে—আমি… আমি গোপনে তাকে মাটির মূর্তির কাদামাটির মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছিলাম।” কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে সুমনার চোখে অশ্রু। দশ বছর ধরে লুকানো সত্য, যে ঝিলিকের মৃত্যু শুধু দুর্ঘটনা নয়, বরং নিবারণের ভয় এবং অপরাধবোধের কারণে রহস্যের আড়ালে চাপা পড়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখল। নিবারণ আরও বললেন, “আমি জানতাম, তার আত্মা মুক্তি পায়নি। আমি যা করেছি, তা শুধু আত্মার নিঃশ্বাস আটকে রাখল—তার কান্না, তার আশা—সব কিছু মাটির মধ্যে আটকে গেছে।” কণ্ঠে লজ্জা, চোখে অপরাধবোধ, আর হাতে কাদা—সব মিলিয়ে সুমনা উপলব্ধি করল, এই গ্রামের আতঙ্কের মূল কারণ এক ব্যক্তির ভীতির সঙ্গে বেঁধে থাকা সত্য। মূর্তির চোখের জল, নীলাভ আলো, আর স্বপ্নের কিশোরী—সবই ঝিলিকের আটকানো আত্মার আভাস।
সুমনা তখনই বুঝতে পারল, এই সত্য জানার পরই ঝিলিককে মুক্ত করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সে অনিরুদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা কেবল সত্য জানলেই শেষ নয়, এখন কাজের পালা শুরু।” নিবারণ চুপ করে থাকলেন, চোখের সামনে অতীতের ভুলগুলো আবার খেলতে লাগল। তিনি জানতেন, দশ বছর ধরে যে অপরাধ, যে গোপন কক্ষ, যে লালচে ফিতা—সবই এখন সামনে। গ্রামের আতঙ্ক, কর্মশালার অদ্ভুত কান্না, মূর্তির চোখের জল—এগুলো সবই বাস্তব। আর সুমনা বুঝল, ঝিলিকের আত্মাকে মুক্ত করতে হলে কেবল সাহস নয়, বরং তার হৃদয়ের সত্যিকারের ভালোবাসা, সঙ্গীতা এবং নৈতিকতার সঙ্গে মুখোমুখি হতে হবে। নিবারণ চুপচাপ বসে রইলেন, যেন নিজেই স্বীকার করেছেন অতীতের দায়। সেই রাতটি ধনপুরের জন্য শুধুই একটি অন্ধকার নয়, বরং একটি নতুন যাত্রার সূচনা—যেখানে সত্য, অপরাধ, বেদনা এবং মুক্তির অমোঘ সুত্র একত্রিত হয়ে ঝিলিকের আত্মাকে স্বস্তি দেবে।
অধ্যায় ৯: মুক্তির আচার
নবমীর রাত ধনপুরে আসে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও ভারী নিঃশ্বাসের সঙ্গে। গ্রামবাসী জানত যে, আজকের রাতটি শুধু পুজোর নয়—ঝিলিকের আত্মার মুক্তির রাত। সকাল থেকে সব আয়োজন শুরু হয়েছিল। পুজো কমিটির লোকেরা মূর্তির চারপাশে গঙ্গাজল, ফুল, ধূপ এবং প্রদীপ সাজাচ্ছিল। তবে আজকের আচারটি সাধারণ নয়, বরং গ্রামের পুরোহিতের নির্দেশে সম্পূর্ণ বিশেষ। তিনি বলেছিলেন, “আজকে শুধু দেবীর নয়, আত্মারও আরাধনা করতে হবে। মন্ত্রোচ্চারণ ও গঙ্গাজলের ছিটানোই মুক্তির চাবিকাঠি।” সন্ধ্যা নামতেই কর্মশালার চারপাশে মানুষ জড়ো হতে শুরু করল। মাটি ভিজে গেছে গঙ্গাজল ও ধূপের সুবাসে। প্রতিটি প্রতিমার চোখে ছড়ানো জল, যা এতদিন কান্নার মতো ভেসে এসেছিল, আজ যেন পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুন আলো পেতে শুরু করল। নীলাভ আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, বাতাসে অদ্ভুত এক শান্তি নেমে এসেছে। অনিরুদ্ধ ও সুমনা দু’জনে এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কিভাবে গ্রামের সব মানুষ আত্মবিশ্বাস ও বিশ্বাস নিয়ে আচারটি পালন করছে, আর মূর্তির চোখে যেন ধীরে ধীরে বেদনার আবরণ হালকা হতে শুরু করেছে।
পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করতেই চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেল। শব্দগুলো এক অদ্ভুত কম্পন তৈরি করল, যা কেবল কানেই নয়, আত্মার গভীরে অনুভূত হচ্ছিল। ধূপের ধোঁয়া ঘিরে ফেলে কর্মশালাকে, আর গঙ্গাজলের প্রতিটি ফোঁটা যেন মাটির গায়ে আছড়ে পড়ে নতুন জীবনের সুর তোলা শুরু করল। সুমনা দেখছিল, মূর্তির চোখ থেকে ধীরে ধীরে কান্নার ফোঁটা কমতে লাগল। আগের রাতের টপটপ শব্দ, নীলাভ আলোর ঝিলমিল, সব মিলিয়ে যেন একটি নিঃশব্দ কবিতা গঠিত হচ্ছে। কিন্তু সেই শান্তি সম্পূর্ণ নয়—যেন সেদিনের বেদনা ও আতঙ্ক এখনও অর্ধেক শিথিল। সুমনা হঠাৎ অনুভব করল, যেন চারপাশে অদৃশ্য শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মূর্তির চোখে ভেসে আসা আলো এবং নীরবতার মধ্যে সে খুঁজে পাচ্ছিল ঝিলিকের আত্মার মৃদু স্পর্শ, যা দশ বছর ধরে তার অন্তরে জমে ছিল। প্রতিটি মন্ত্রের সুরে সে বুঝতে পারল, আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ শুধু শব্দের মাধ্যমে নয়, হৃদয়ের সংবেদনেও সম্ভব।
শেষ মুহূর্তে, যখন আচার প্রায় সমাপ্তি লাভ করছিল, সুমনার গালে হঠাৎ একটি অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভূতি বয়ে গেল। মনে হলো, এক অদৃশ্য হাত তার গালে স্পর্শ করল—হালকা, কোমল, কিন্তু তীব্রভাবে উপস্থিত। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসের নীরবতায়, মূর্তির চোখের শান্তির মাঝে এই স্পর্শ যেন নিশ্চিত করল—ঝিলিকের আত্মা সত্যিই মুক্তি পেয়েছে। চোখে অশ্রু, ঠোঁটে মৃদু হাসি—সবকিছু মিলিয়ে সেই অদৃশ্য স্পর্শ ছিল এক আত্মার বিদায়, যা জীবন্ত থেকে মৃত্তিকায় মিলিয়ে যাওয়ার মধ্যে অনন্ত শান্তি নিয়ে এসেছিল। সুমনা উপলব্ধি করল, যে দীর্ঘ দশ বছর ধরে ধনপুরের মানুষদের ভেতর জমে থাকা আতঙ্ক, মূর্তির কান্না, নীলাভ আলো—সবই আজ শেষ হয়ে গেল। মূর্তির চোখে আর জল নেই, আর চারপাশের বাতাসে ভেসে আসে শুধু মুক্তির নীরবতা। সুমনা জানল, এই আচার এক নতুন শুরু, যেখানে অতীতের দুঃখ, আত্মার নিঃশ্বাস, আর মানুষের বিশ্বাস মিলিত হয়ে প্রকৃত শান্তির রূপ নিয়েছে।
অধ্যায় ১০: নীরব শান্তি
পুজোর দশমীর সকাল ধনপুর গ্রামে এসে ভোরের নীরবতাকে ভেঙে দিল। সকাল থেকেই গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজ দেখা যাচ্ছিল—শুভ্র আকাশের নিচে মানুষজনের মুখে উদ্দীপনা, হাতে রঙিন ফুল আর ঘরে ঘরে মাটির মূর্তির সাজ। কিন্তু সবার মনে ছিল এক অদ্ভুত ভার—গতদিনের নবমীর আচার, ঝিলিকের আত্মার মুক্তি, আর সেই অদৃশ্য হাতের স্পর্শের স্মৃতি। সকাল থেকে সকলে প্রস্তুতি নিল বিসর্জনের জন্য। নদীর তীরে সাজানো হল এক দীর্ঘ ধূপের সারি, যেখানে মূর্তির কপাল থেকে চোখ পর্যন্ত পরিচ্ছন্নভাবে জল ছিটানো হলো। ধনপুরের মানুষজন একত্রে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু হল। বাতাসে রঙিন ধোঁয়া, গঙ্গাজল আর ফুলের সুবাস মিশে একটি অলৌকিক অনুভূতি সৃষ্টি করল। প্রতিটি চোখে এক অদৃশ্য আনন্দ, প্রতিটি হৃদয়ে এক নীরব কৃতজ্ঞতা।
বিসর্জনের সময়, হঠাৎ করেই আকাশে ছড়িয়ে পড়ল রঙিন আলো। সূর্য হালকা মেঘে ঢাকা থাকলেও সেই আলো যেন অন্য জগৎ থেকে এসেছে। নীল, গোলাপী, স্বর্ণালী রঙের আলো একত্রে মিশে গ্রামজুড়ে ঝিলমিল করতে লাগল। মানুষের চোখ বড় হয়ে গেল, এবং শ্বাসকোশ আটকে গেল। সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন প্রকৃতি নিজেই সেই দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা বেদনার মুক্তি ঘোষণা করছে। সেই আলোতে সুমনা স্পষ্ট দেখতে পেল—স্বপ্নে দেখা সেই সাদা পোশাকের কিশোরী, যার চোখে অশ্রু আর ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি। কিশোরীর মুখ থেকে যেন ধীরে ধীরে শান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। ঝিলিকের আত্মা অবশেষে মুক্ত। গ্রামের মানুষজন একে অন্যকে দেখল, চোখে আনন্দের জল, মুখে হাহাকারমুক্ত হাসি। পুজোর আনন্দ পুনরায় ফিরে এল, আর ধনপুরের বাতাসে মিষ্টি ধূপ, ফুল আর আনন্দের ছোঁয়া মিলিত হলো।
নিবারণ পাল, যিনি আজীবন অনুতপ্ত, ধীরে ধীরে দাঁড়াল। দশ বছর ধরে তার ভেতর জমে থাকা অপরাধবোধ, ভয় এবং দুঃখ—সবই মিলেমিশে আজ হালকা হয়ে গেল। সে জানল, ঝিলিকের আত্মা শান্তি পেয়েছে। কিন্তু সেই শান্তির মাঝেও তার মনে ছিল গভীর অনুতপ্ততা, সেই ভুলের স্মৃতি যা আর মুছে যাবে না। অন্যদিকে, সুমনার মনে ঝিলিকের ক্ষীণ হাসি চিরকাল থিতিয়ে থাকল। সে বুঝল, হারিয়ে যাওয়া কিশোরীর গল্প শেষ হলেও তার স্মৃতি আর বেদনা কখনও ভোলা যাবে না। গ্রামের মানুষজন আবার নতুন করে পুজোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করল, কিন্তু এবার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি পূজা, প্রতিটি ধূপের সুবাসের মধ্যে লুকিয়ে ছিল অতীতের গল্পের স্বাদ। ধনপুর আজ শুধু আনন্দের নয়, বরং স্মৃতির, শান্তির এবং নিঃশব্দ মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠল।
শেষ