Bangla - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

মাকড়সার কুঠি

Spread the love

ঋতম ঘোষাল


বীরভূমের মাঠ পেরিয়ে ধুলো ধরা লাল মাটির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আদিত্য রায় এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করল, যেন সূর্যের আলো সত্ত্বেও তার চারপাশে সময় থমকে আছে। রোদ মাখানো দুপুর, তবু ওই গাঁয়ের কাঁচা রাস্তা যেন নিস্তব্ধতার এক দীর্ঘ করিডোর—যার শেষে দাঁড়িয়ে আছে পোড়ো জমিদারবাড়িটি, স্থানীয়দের ভাষায় “মাকড়সার কুঠি”। সে একা নয় এখানে, তার সাথে ছিল ব্যাগ ভর্তি রেকর্ডিং যন্ত্র, ক্যামেরা, আর কিছু পুরনো নথি, যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল কুঠির ইতিহাস, জমিদার অচ্যুত লাহার নাম, আর এক অর্ধ-পরিচিত নারীর অস্পষ্ট ছায়া। লোকেরা বলে বাড়ির ভেতরে নাকি এত ঘন মাকড়সার জাল যে মানুষ ঢুকলে আর বেরোতে পারে না—ভবনের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটাও যেন তার দীর্ঘ শিকড় দিয়ে বাড়িটিকে আঁকড়ে ধরেছে, যেন কিছু ছাড়তে চায় না। আদিত্য এই কথাগুলো বিশ্বাস করে না ঠিক, কিন্তু ইতিহাস ও লোকবিশ্বাসের সন্ধানে তার মনে বরাবরই টান কাজ করে। সে চায় অতীতের পর্দা সরিয়ে তার অন্তর্নিহিত সত্যকে বের করতে। যদিও আজ সকাল থেকেই তার মাথার ভেতরে এক অজানা শ্বাস ফেলার শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছিল, যা সে কোনোভাবেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিল না।

যখন বাড়ির মূল ফটকে পৌঁছোল, সে লক্ষ্য করল পুরনো লোহার গেটটা হেলানো, একপাশে প্রায় ভেঙে পড়েছে। গেটের ওপারে ঘাসে ঢাকা উঠোন, আর তার শেষে বিশাল কুঠি—কালো ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে। দোতলা বিশিষ্ট সেই অট্টালিকার জানালাগুলো যেন অন্ধ চোখের মতো, তাকিয়ে আছে—কিন্তু দেখে না। আদিত্য কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই থমকে দাঁড়াল। তার পায়ের নিচে কিছু একটার ‘চিঁড়িক’ শব্দ হল। নিচে তাকিয়ে সে দেখল, একটা শুকনো মাকড়সা, মৃত, ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। সে কাঁধ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে প্রথম ছবি তুলল—ফ্রেমে ধরা পড়ল বিশাল কুঠির ফ্যাকাশে দেওয়াল, জানালার গায়ে আটকে থাকা শত শত মাকড়সার জাল। হঠাৎ করেই বাতাস থেমে যায় যেন, পাতা নড়ে না, পাখি ডাকে না, এমনকি গাছও নিশ্বাস নেয় না। ভেতরে ঢুকতে গিয়েই সে বুঝতে পারল, সময় এখানে গলে গেছে। সিঁড়ির নিচে পড়ে থাকা ভাঙা চেয়ার, ছাদের কাছ থেকে ঝুলে থাকা একটা হারিয়ে যাওয়া ঘড়ি, আর হলঘরের মাঝখানে পড়া এক বিবর্ণ চৌকাঠ—সব কিছুই যেন অন্য এক সময়ের সাক্ষী। মেঝেতে হাঁটতে হাঁটতে তার জুতো থেকে ধুলো উড়ে উঠছে, আর সেই ধুলোয় যেন অদৃশ্য পায়ের ছাপ গেঁথে যাচ্ছে পিছন থেকে—কে জানে, তার আগেও কেউ ছিল কিনা এই পথ ধরে।

বাড়ির পশ্চিমদিকের ঘরে ঢুকে সে প্রথম সেই চিত্রকর্মটি দেখে—একটি নারীর মুখ আঁকা, চোখে বিষণ্ণতা, ঠোঁটে অস্পষ্ট এক হাসি, যেন কেউ অপেক্ষা করছে বহুদিন ধরে। তার গায়ের পোশাক ছিল অতীত যুগের, সম্ভবত ব্রিটিশ পোশাক—কিন্তু মুখখানা যেন বঙ্গদেশীয় নারীসুলভ গড়নের। ছবির নিচে লেখা আছে শুধু একটি নাম—”রজনী?” প্রশ্নবোধক চিহ্নসহ। আদিত্য ব্যাগ থেকে খাতা বের করে তা টুকে রাখল। হঠাৎ তার পেছন থেকে একটা হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইল, যেন জানালার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। সে ঘুরে তাকাল, কিন্তু কাউকে দেখল না। ঠিক সেই মুহূর্তে দূরে কোথাও একটা মাটির হাঁড়ি পড়ার মতো শব্দ হল, আর সাথে সাথে কুঠির ভেতরে বাতাস যেন জমে গেল। তার কানে এল অতি মৃদু এক নারীকণ্ঠ—”তুমি ফিরেছ…”। আদিত্য কাঁধে রাখা ব্যাগ শক্ত করে ধরল, আর ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগল, যা উঠে গেছে দোতলায়। প্রতিটি সিঁড়িতে চাপলেই একটা কেঁচকেঁচে আওয়াজ, আর দেয়ালে ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল যেন তার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। দোতলার করিডোরে পৌঁছে সে যেন অনুভব করল, কেউ তার ঠিক ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে—কিন্তু যখন ঘুরে তাকাল, তখন কেবল শুন্যতা। সে জানে, তার সামনে আরও কিছু আছে, যা কেবল ইতিহাস নয়—হয়তো চুক্তি, হয়তো অপেক্ষা, কিংবা হয়তো এমন এক জাল—যার ভেতরে একবার ঢুকলে আর ফিরে যাওয়া যায় না।

কুঠির দোতলায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যর মনে হল যেন পায়ের নিচের কাঠের সিঁড়িগুলো কাঁপছে, বা ধীরে ধীরে দুলছে—ঠিক যেমন হয় পুরনো জাহাজে উঠে দাঁড়ালে, যা বহুদিন ধরে সাগরে ভেসে আছে। উপরের করিডোর একেবারে অন্ধকার নয়, কিন্তু আলো এতই ম্লান যে ছায়া আর বাস্তবের পার্থক্য মুছে যায়। একপাশে খোলা বারান্দা, যেখান থেকে দূরের তালগাছগুলোকে দেখা যায়, তারা যেন হাওয়া ছাড়াই নড়ে উঠছে, নিজস্ব ইচ্ছায়। করিডোরের এক প্রান্তে ছিল একটা আধা খোলা দরজা—যার গায়ে রং উঠে গেছে, আর চারপাশে মাকড়সার ঘন জাল বুনেছে এক অলক্ষ্য শিল্পী। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা গন্ধ এসে পৌঁছাচ্ছিল আদিত্যর নাকে—একধরনের পুরনো কাগজ, ধুলো, আর হালকা পচা গোলাপের মতো গন্ধ—যেটা কেবল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ঘরেই পাওয়া যায়। সাহস করে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে, আর দেখল ঘরটা অনেক বড়, প্রায় হলঘরের সমান। মেঝেতে রয়েছে একটি পালঙ্ক, ধুলোমাখা ও ছেঁড়া পর্দা, পাশেই একটা আয়না—যার উপর এত বেশি জাল পড়েছে যে নিজের প্রতিবিম্ব স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু ঠিক সেই আয়নার এক কোণায় সে চোখে পড়ল কিছু… যেন এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে।

আদিত্য এগিয়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজের প্রতিবিম্বের পাশাপাশি সে দেখতে পেল এক মুহূর্তের জন্য আরেকটি মুখ—অত্যন্ত বিবর্ণ, যেন পানির তলায় দেখা যায় এমনভাবে। সে চোখে-মুখে হাত বুলিয়ে আবার আয়নার দিকে তাকাল, কিন্তু এইবার সেখানে শুধু তার নিজের অবয়ব। আয়নার পেছনে সে হাত দিয়ে স্পর্শ করল, যেন খুঁজে বের করতে পারে কোনো গোপন দরজা বা খাঁজ। হঠাৎই ঘরের জানালার পর্দা নিজে থেকেই নড়ে উঠল, যদিও বাইরে বাতাস নেই। জানালার গা ঘেঁষে সে লক্ষ্য করল—একটা বিশাল জাল ঝুলে আছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে একটি গোল, নিটোল গর্ত, যেন কোনো কিছু বা কাউকে সে আহ্বান জানাচ্ছে ভেতরে ঢোকার জন্য। সেই গর্ত থেকে যেন এক ধরনের ডাক ভেসে আসছে—মৃদু, গভীর, ঘুমপাড়ানি সুরের মতো। আদিত্য সেই জালকে গভীরভাবে দেখতে দেখতে হঠাৎই যেন স্মৃতির ভেতর ঢুকে পড়ে—সে দেখতে পায় এক ব্রিটিশ নারী, হাতে মোমবাতি, হেঁটে যাচ্ছে এই করিডোর ধরে, তার মুখের অর্ধেক আলোয় ভরা, অর্ধেক ছায়ায় ঢাকা। সে বলে উঠছে, “অচ্যুত… আমি তোমার কথা রাখলাম, আর তুমি?” সেই নারী চলে যেতে যেতে হাওয়ার মত মিলিয়ে যায়, আর আদিত্য ভেঙে পড়ে মেঝেতে, যেন তার শরীর হালকা হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে সে নিজেকে খুঁজে পায় কুঠির সিঁড়ির গোড়ায়, অজান্তেই নিচে নেমে এসেছে সে, কিংবা নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাত-পা কাঁপছে, মাথায় একধরনের ভার। সে বুঝতে পারে সময় কেটে গেছে—বাইরে সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে। সে বেরিয়ে আসে কুঠির গেট অবধি, সেখানে তাকে অপেক্ষায় পায় এক বৃদ্ধ—হরিপদ বাউরী। বৃদ্ধ কিছু না বলে তার দিকে একটা পিতলের লকেট এগিয়ে দেয়, যার মধ্যে একটি ক্ষয়ে যাওয়া ছবি। ছবি দেখে আদিত্য স্তম্ভিত হয়ে পড়ে—ওই তো সেই মুখ! যার ছবিটি কুঠির ঘরে টাঙানো ছিল, যার প্রতিবিম্ব সে আয়নায় দেখেছিল। হরিপদ বলল, “তুমি শুধু ইতিহাস জানো না বাবু, তুমি ইতিহাসের মধ্যেই ঢুকে পড়েছো… ওই দোতলার ঘরে কেউ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওর নাম রজনী… আর সেই নামের ভেতরই আছে শীতল আগুন।” আদিত্য কিছু বলতে যায়, কিন্তু গলা শুকিয়ে আসে। তার মনে হচ্ছিল—সে যেটাকে গবেষণা ভাবছিল, সেটা আসলে এক পুরনো বন্ধন, যা তাকে নিজেই টানছে অজানা এক জালের গভীরে।

রাতের অন্ধকারে কুঠির কাছের গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে আসে। দূরের শ্মশানের মরা চুল্লি থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে, যেন রাতের আত্মারাও নিঃশ্বাস ছাড়ছে ধীরে ধীরে। আদিত্য ফিরে গেছে স্থানীয় ডাকবাংলোয়, কিন্তু তার মন পড়ে আছে সেই কুঠির ভেতরে, সেই আয়নার কাছে, সেই মুখের ছায়ার দিকে। হাত-পায়ে অদ্ভুত শীতলতা, আর বুকের ভেতর অকারণ চাপা ব্যথা। সে তার ডায়েরিতে লিখছিল—”একটা চোখ, যার পলক পড়ে না। একটা গন্ধ, যা স্মৃতির মতো পুরনো। একটা নাম—রজনী—যা শুধুই নাম নয়, একটা প্রতীক্ষা।” রাত বাড়তেই সে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়, কিন্তু ঘুম আসে না। কেবল জানালার বাইরে তালগাছের পাতা ছিঁড়ে যাওয়ার শব্দ, আর মাঝে মাঝে কান পাতলে মনে হয়—কেউ যেন নাম ধরে ডাকে, খেয়াল করলেই বোঝা যায়, নামটা কেবল মুখে নয়, মনের ভেতরও উচ্চারিত হয়। হঠাৎ একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে, আর তখনই শুরু হয় সেই অদ্ভুত স্বপ্ন—যা মনে হয় স্বপ্ন নয়, বরং অদেখা অতীতের কোনও অধ্যায়।

স্বপ্নে সে দেখে, এক দীর্ঘ করিডোর—সাদা মার্বেলের মেঝে, ছাদে ঝোলানো কাঁচের ঝাড়বাতি আর দেয়ালে দেয়ালে সাজানো তৈলচিত্র। সেই করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে সে একা, পায়ে পায়ে এগোতে থাকে যেন অজানা টানে। দূরে একটি দরজা হঠাৎ নিজে থেকে খুলে যায়, ভিতরে আলো নেই, তবু চোখ সয়ে যায় অন্ধকারে। ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে একজন নারী—তার গায়ে একশো বছরের পুরনো সাদা গাউন, চুল খুলে পড়েছে কাঁধ ছুঁয়ে, চোখ দুটো ধোঁয়ায় ঢাকা, কিন্তু তীব্র ভাবে অনুভবযোগ্য। সে বলে, “তুমি দেরি করেছ, আমি অপেক্ষা করিনি?” আদিত্য কিছু বলতে চায়, কিন্তু মুখে শব্দ বেরোয় না। সে শুধু বুঝতে পারে, তার পা বেঁধে ফেলেছে মাকড়সার এক সূক্ষ্ম জাল, যেটা দৃশ্যমান নয়, কিন্তু অনুভবে ভারী। নারীটি ধীরে এগিয়ে আসে, তার হাতে আছে এক পুরনো চিঠি, যার একপাশে রক্তমাখা দাগ। সে চিঠি আদিত্যর হাতে দিয়ে বলে, “তোমার পূর্বপুরুষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ভালোবাসা দিয়েছিলেন, আর ফিরেও গিয়েছিলেন। আমি আজও তার অপেক্ষায়, আর তোমার রক্তে আছে তার ছায়া।” আদিত্য সেই মুহূর্তে বুঝে যায়—এই স্বপ্ন নয়, এ এক আত্মার সংলাপ, এ সেই প্রেতিনীর অপেক্ষার প্রতিচ্ছবি।

ঘুম ভাঙে ঝড়ের শব্দে। জানালার কাচ কাঁপছে, বাতাসে যেন কারও কণ্ঠস্বর মিশে আছে—এক ধরনের বিলাপ, না কি অনুরোধ? আদিত্য বিছানায় উঠে দেখে তার হাত কেটে গেছে—পাতলা রেখার মতো দাগ, যেন কেউ সূক্ষ্ম সুতোয় তার ত্বক আঁচড়ে দিয়েছে। তার পাশেই রাখা ক্যামেরার ডিসপ্লেতে একটি ছবি ভেসে উঠেছে—যা সে তোলে নি। সেই ছবিতে তার পেছনে আয়নার কোণায় স্পষ্ট দাঁড়িয়ে আছে সেই নারী, চোখের গভীর ছায়ায় আটকে থাকা আত্মা। সে ছবি দেখে আদিত্যর রক্ত হিম হয়ে আসে, কারণ ছবিতে তার নিজের মুখে যেন কিছু বদলে গেছে—চোখ দুটো আরও শূন্য, আর ঠোঁটের কোণে এক অনিচ্ছাকৃত হাসি, যেটা তার নয়। সেই মুহূর্তে সে অনুভব করে, প্রেতিনী শুধু স্বপ্নে নয়, বাস্তবেও তার পেছনে ছায়ার মতো চলতে শুরু করেছে। আর তার প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও কাছে… সেই কুঠির ভিতর, সেই জালের কেন্দ্রবিন্দুতে।

ভোরবেলা, যখন সূর্য ঠিকঠাক উঠেও ওঠে না, শুধু ধোঁয়ায় ভরা আলোর মতো পূর্ব আকাশে ঝাপসা হয়, তখন আদিত্য পৌঁছোল হরিপদ বাউরীর কুঁড়েঘরে। ঘরটা একদম নিঃস্তব্ধ, ঠিক যেমন তার ভেতরের গল্পগুলো—শব্দে নয়, নীরবতায় বলা। হরিপদ তাকে বসতে বলল, একটা কাঠের পিঁড়িতে, আর নিজে চুপচাপ মাটির কাপ গরম দুধ হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল কিছুক্ষণ, যেন সে যে গল্প বলবে, তা কেবল মুখের নয়—মনের ভেতর থেকে বের করতে হচ্ছে। অবশেষে সে বলল, “তুই ভাবিস তোরা ইতিহাস খোঁজিস, কিন্তু কিছু ইতিহাস তোদের খোঁজে বেড়ায়। সেই জমিদার অচ্যুত লাহার কথা শুনেছিস তো?” আদিত্য মাথা নাড়ল। হরিপদ একটু হেসে বলল, “ওই কুঠির শেষ পুরুষ ছিল অচ্যুত, ইংরেজ আমলে বড় হয়ে উঠেছিল। শিক্ষা, সংগীত, শিকার—সবেতেই মুগ্ধ করত, কিন্তু ওর সর্বনাশ শুরু হয় যখন ইংরেজ সাহেবের মেয়ের প্রেমে পড়ে।” তার নাম ছিল অলিভিয়া মার্শাল—এক ব্রিটিশ গবর্নরের অনাথ ভাতিজি, যিনি ক’মাসের জন্য বীরভূমে পাঠানো হয়েছিলেন ‘স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে’। সেই সময়ের সাহেব-সুবোদের মাঝে অলিভিয়ার মতো রক্তমাংসের নারী ছিলেন বিরল, আর তার বাংলা শেখার উৎসাহে জমিদার বাড়িতে তার যাতায়াত বাড়ে। সেখান থেকেই অচ্যুত আর অলিভিয়ার মধ্যে প্রেম, গোপনে। তারা প্রেমে পড়ে না, যেন আগুনে পড়ে—কোনও ভাষার বাধা, জাতপাত, বা নিয়ম তাদের থামাতে পারে না।

কিন্তু সেই প্রেম ছিল প্রতিকূলতার ভিতর দাঁড়িয়ে এক অস্থায়ী প্রাসাদ। গ্রামের ব্রাহ্মণরা, জমিদার বংশের আত্মীয়েরা, এমনকি কলকাতা থেকেও চাপ আসতে থাকে—এক ব্রিটিশ নারীকে বিয়ে করলে বংশ ‘অশুদ্ধ’ হবে। অচ্যুত বহু চেষ্টা করেও প্রতিরোধ করতে পারেনি সেই প্রবল সামাজিক ধাক্কা। শেষমেশ, একদিন অলিভিয়াকে চিঠি লিখে সে জানায়, “আমি তোমার যোগ্য নই, এ সমাজ আমাকে তোমার পাশে দাঁড়াতে দেবে না।” সেই চিঠির রক্তমাখা ছায়া আদিত্য আগেই স্বপ্নে দেখেছিল। হরিপদ বলল, “জানিস, সেই রাতে ওই মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছিল কুঠির ভেতরের দোতলার ঘরে। ভোরবেলা, তার নিথর দেহ পাওয়া যায়, তার গলায় এক পাতলা মাকড়সার জাল, যেন জাল নয়—ওর নিজের দেহে গড়া প্রতিশ্রুতির মৃত্যু। কেউ দেখে নাই, কেমনে মারা গেল, কিন্তু লোকমুখে বলে, মাকড়সারা নাকি ওকে বাঁচানোর জন্য জাল বুনতে শুরু করে, আর ওর আত্মা বন্দি হয়ে যায় সেই জালের মধ্যেই।” তারপর থেকেই ওই কুঠির ভেতরে অদ্ভুত জাল তৈরি হতে থাকে—যেটা সাধারণ মাকড়সার নয়, যেন কারও স্মৃতি দিয়ে বোনা। যারা ঢুকেছে, তারা কেউ আর ফিরে আসেনি।

আদিত্য স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। তার মন ফিরে যাচ্ছিল সেই ছবির ফ্রেমে, সেই আয়নার ছায়ায়, আর সেই নারীর চোখে—যা সে দেখেছিল কুঠির ঘরে। হরিপদ তখন বলে, “তুই যেই আয়নায় তাকিয়েছিলি, ওটা ছিল অলিভিয়ার প্রিয় আয়না। মৃত্যুর আগে সে তার চেহারা দেখে একটুও কাঁদেনি, শুধু বলেছিল, ‘সে ফিরবে, আর আমি অপেক্ষা করব’। কে জানে, হয়তো তুই সেই উত্তরসূরি, অচ্যুতের রক্তধারায় তোর মধ্যেও কিছু আছে, যেটা ও চিনে নিয়েছে। তাই তো তুই ঢুকেই পড়ে গেলি তার চোখের ভেতর।” হরিপদের চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল, যেন দীর্ঘকাল ধরে জমে থাকা অপরাধবোধ। আদিত্য সেই মুহূর্তে নিজেকে কেবল ইতিহাসের একজন পাঠক নয়, বরং এক অদৃশ্য নাটকের অংশ মনে করল, যার কাহিনি আজও লিখে যাচ্ছে কোনো অদেখা হাত। প্রেতিনী অলিভিয়া—বা রজনী—শুধু প্রতিশোধ নয়, প্রতীক্ষার প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই কুঠির প্রতিটি জালে। আর সে, আদিত্য, হয়তো সেই প্রতিশ্রুত পুরুষ, যার জন্য সেই আত্মা এখনও পথ চেয়ে বসে আছে।

দুপুরের রোদে যখন বীরভূমের কুঠিবাড়ির চারপাশ জ্বলন্ত নীরবতায় ঢেকে থাকে, ঠিক তখনই আদিত্যর ফোনে একটা পরিচিত নাম ভেসে উঠল—ইলা বসু। দুই বছর আগেও তারা একসাথে লোককথার গবেষণায় বেরিয়েছিল সুন্দরবনে, এরপর হঠাৎ করে যোগাযোগ হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইলার কণ্ঠে আজও সেই তীক্ষ্ণ আত্মবিশ্বাস, “আদিত্য, তুই ‘মাকড়সার কুঠি’ নিয়ে ঘাঁটছিস তো? আমি আসছি।” সে আসছে মানেই আদিত্য জানে, তথ্য আর যুক্তির বিস্ফোরণ আসবে সাথে। ইলা একটি ভৌতিক ব্লগ চালায়, যেখানে বাংলার নানা ভূতের গল্প, লোককথা, গ্রামীন কুসংস্কারের সঙ্গে সে যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা মিশিয়ে তুলে ধরে। আদিত্য যতটা ইতিহাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে, ইলা ততটা বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে দেখে—তাদের দুজনের গবেষণার পদ্ধতি একেবারে বিপরীত, কিন্তু লক্ষ্য এক। বিকেলে স্টেশন থেকে তাকে নিয়ে আসার সময়, আদিত্য লক্ষ্য করল ইলা এখনও আগের মতোই স্পষ্টভাষী, কিন্তু চোখে ক্লান্তি। “ঘুম হয়নি?”—জিজ্ঞেস করায় ইলা বলল, “গত রাতেও এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম, এক নারী আয়নার ভেতর আটকে আছে, আর বলছে ‘তুমি দেরি করেছ’। তুই ঠিক কী জিনিসে জড়িয়েছিস বল তো?”

কুঠিতে পৌঁছে তারা সরাসরি দোতলার সেই ঘরে ঢোকে, যেখানে আগেরদিন আদিত্য আয়নায় সেই প্রতিচ্ছবি দেখেছিল। ঘরের অবস্থান, রংচটা দেয়াল, বালিশের নিচে জমে থাকা মাকড়সার ডিম—সব কিছু দেখে ইলা একবার চোখ বন্ধ করে বলল, “এটা কেবল জাগতিক দূষণ নয়, এটা মনস্তাত্ত্বিক স্যাঁতস্যাঁতে ভাব—যেটা প্রেতদের লুকোবার প্রিয় জায়গা।” সে তার EMF ডিটেক্টর বের করল, যেটা ভূতের উপস্থিতি পরিমাপ করার আধুনিক যন্ত্র বলে অনেকে বিশ্বাস করে। যন্ত্রের সূচক খানিক নড়ে উঠল, হালকা কম্পনে। কিন্তু তার থেকেও ভয়ঙ্কর ছিল ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা সেই আয়নাটি—যার উপরের পাড়ে আজ যেন আরও বেশি জাল জমে গেছে, আর তাতে আটকে আছে কালচে ধুলোর মধ্যে এক মানবমুখ—যা কখনও ঝাপসা, কখনও স্পষ্ট। ইলা আয়নার সামনে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। “আদিত্য, এই আয়নাটা শুধু প্রতিফলন নয়, এটা এক ধরনের ‘মানসিক দরজা’। যারা দেখার ক্ষমতা রাখে, তারা এর মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। আর যারা ভিতরে আটকে পড়ে, তারা প্রতীক্ষা করে কারও চেহারায় নিজের অতীত ফিরে পেতে।” কথাটা বলার সময় তার গলা কেঁপে উঠল, কারণ ঠিক তখনই আয়নার কোণে একটি চোখ নড়ল—সাদা, বিষণ্ণ, অথচ জেগে থাকা।

দুজন মিলে ঘরের এক কোণে ধুলো সরিয়ে খুঁজে পেল একটি গোপন কুঠুরি, যার ভেতরে এক পাথরের ছোট পিঁড়ি আর একটি পিতলের বক্স। বক্স খুলতেই বেরিয়ে এল কিছু পুরনো চিঠি—অচ্যুত লাহার হাতের লেখা, আর অলিভিয়ার অনুরোধে লেখা কয়েকটি উত্তরহীন চিঠি। ইলা পড়ে শোনাল, “আমি যদি রক্ত দিয়ে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চাই, তুমি কি তা মেনে নেবে?”—এই লাইনগুলো যেন কেবল প্রেমিক-প্রেমিকার নয়, বরং আত্মা ও শরীরের মাঝখানে আটকে থাকা দুই অস্তিত্বের চিরন্তন কথোপকথন। সেই সময়েই আচমকা ঘরের দরজা নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল, আর চারদিকে জাল ঘনীভূত হতে লাগল—কেউ যেন ধীরে ধীরে গুটি বুনছে তাদের চারপাশে। বাতাস ভারী হয়ে এলো, জানালার কাচ থেকে জল ঝরার মতো শব্দ, অথচ বাইরে রোদ। আদিত্য আর ইলা তখন টের পেল—ওরা কেবল ইতিহাস পড়ছে না, বরং ইতিহাস ওদের পড়ছে। এই কুঠির মধ্যেই রয়েছে এক স্মৃতির জাল, যেখানে সময় জমে আছে, আর প্রতিটি চিঠি, প্রতিটি জাল, প্রতিটি আয়না—সেটা কেবল ভয় বা ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি নয়, বরং কোনো অসমাপ্ত চুক্তির জীবন্ত প্রমাণ।

রাতটা আর অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব হলো না। আদিত্য আর ইলা সিদ্ধান্ত নিল—এই পুরনো কুঠির মধ্যেই আজ রাত কাটাবে। প্রথমে ভেবেছিল নীচতলার হলঘরে থাকবে, যেখানে আলো কিছুটা ঢোকে। কিন্তু হঠাৎই বাইরের আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে উঠল, বাতাসে ভেসে এল পুরনো গোলাপের গন্ধ—যেটা আদিত্য আগেও অনুভব করেছিল, রজনীর উপস্থিতির ঠিক আগে। তারা একসাথে মেঝেতে বিছানা পেতে বসে, ক্যাম্পিং লাইট জ্বালিয়ে একে অন্যের চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কোনো কথা হচ্ছিল না, কারণ শব্দ যেন অকার্যকর হয়ে উঠেছিল সেই ঘরে। রাত যত গভীর হতে লাগল, কুঠির ভেতরের বাতাস তত ভারী হয়ে উঠল, যেন কারো শ্বাস তাদের ঘাড়ে পড়ছে। জানালার কাচে একটানা চুয়চুয় শব্দ—তবে সেটা বৃষ্টির নয়, যেন কেউ নখ দিয়ে কাচ আঁচড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। ইলা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই হলঘরের প্রাচীন দেয়াল ঘেঁষে থাকা পালঙ্কের পর্দা নিজে থেকেই সরে গেল, আর ভিতরে একটা ছায়া বসে থাকা অবস্থায় ধীরে ধীরে মাথা তুলে চেয়ে থাকল তাদের দিকে।

চোখ দুটো যেন পাথরের—স্থির, অথচ তীব্রভাবে জীবন্ত। মুখটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু চুল, গলার লকেট, পোশাক—সব কিছু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল সে সেই নারী, যার নাম এখন ইলা আর আদিত্য একইভাবে উচ্চারণ করে—রজনী, না কি অলিভিয়া? সে উঠে দাঁড়াল না, কিন্তু তার ছায়া মেঝেতে লম্বা হতে হতে বাড়তে থাকল, তাদের পায়ের কাছে এসে থেমে গেল। চারপাশে বাতাস স্থির, ঘড়ির কাঁটা বন্ধ, শুধু তাদের বুকের ধুকপুক শব্দ যেন পাথরের গায়ে পড়ে প্রতিধ্বনি তুলছে। আচমকা ইলা উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে গেল—হলঘরের এক কোণায় রাখা আয়নাটায় তার নিজের প্রতিচ্ছবি কেঁপে উঠল, আর আয়নার পেছনের ফ্রেমে ফুটে উঠল অতীত—একটি পুরনো বলঘর, তার মাঝে অচ্যুত লাহা দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে অলিভিয়া, হাতে রক্তমাখা চিঠি। ইলা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফিসফিস করে বলল, “এই আয়নাটা টাইমলুপ তৈরি করছে, আদিত্য… এই কুঠি ওদের সময়কে আটকে রেখেছে, আর আমাদের দেহ ব্যবহার করছে সেই পুনরাবৃত্তির অভিনয়ে।” আদিত্য তার কথার মানে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারল না, কারণ ঠিক তখনই মেঝেতে শুয়ে থাকা তাদের টর্চ নিজে থেকে নিভে গেল, আর জাল—হ্যাঁ, সেই অদৃশ্য জাল—তাদের শরীর ঘিরে আসতে শুরু করল।

তাদের শরীর হালকা হয়ে এলো, চোখ ভারী, কিন্তু চেতনা টনটন করছে। হঠাৎ ইলা কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেল, আর আদিত্য একা পড়ে রইল হলঘরের মাঝে। ঠিক সেই সময়, ধীরে ধীরে রজনী এগিয়ে এল তার দিকে—পায়ের শব্দ হয় না, কিন্তু তার উপস্থিতি শীতল বাষ্পের মতো শরীর ঢেকে নেয়। সে খুব কাছে এসে বলল, “তুমি তো কথা দিয়েছিলে… এখন পালাবে?” আদিত্য তাকিয়ে দেখল তার চোখের মধ্যে অচ্যুত লাহার চেহারা ভেসে উঠছে। “আমি সেই পুরুষ নই”—বলতে গিয়েও শব্দ আটকে গেল গলায়। রজনীর চোখে অশ্রু নেই, কিন্তু সে কাঁদছে—এক শুষ্ক কান্না, যা মাটি চুঁইয়ে সময়কে ভিজিয়ে দেয়। “তুমি আমার ছিলে… এখনো আছো… আমি প্রতিটি জন্মে তোমার জন্য জাল বুনি, আর তুমি ফিরে এসেই ছিঁড়ে ফেলো তা… কেন, আদিত্য?” তার গলা ধ্বনিত হচ্ছিল এক পুরনো যন্ত্রের মতো, যেটা বহুদিন পর চালু হয়েছে। ঠিক তখনই দূরে কোথাও ইলার কণ্ঠ ভেসে এল, কাঁপতে কাঁপতে—“আদিত্য… আয়না ভেঙে ফেলো…”। কিন্তু আয়নার ফ্রেমে তখন রজনীর মুখ স্পষ্ট—আবেগহীন, কিন্তু প্রার্থনাময়। আদিত্য সেই মুহূর্তে বুঝে গেল—এই জাল শুধুই প্রতিহিংসার নয়, এটা প্রতীক্ষার… প্রেমের এক উল্টো দিক, যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, যদি না কেউ ক্ষমা করে।

ভোর ফোটার অনেক আগেই ঘরের চারপাশ থেকে বাতাস নিঃশেষিত হয়ে গেল, যেন কুঠি নিজেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আদিত্যর সামনে রজনীর ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, এবং সে বুঝল—এটা কেবল কোনও আত্মার প্রজেকশন নয়, এ এক জীবন্ত আত্মশক্তি, যা কোনো যন্ত্র দিয়ে ধরা যায় না, আর যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় না। রজনীর চোখদুটি ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে ছিল, যেমনটা আদিত্য তার প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় বহু পুরনো মূর্তির চোখে দেখে—নড়েনা, কিন্তু দেখে। রজনী এবার এগিয়ে এসে বলল, “তুমি জানো না আদিত্য, কিন্তু তুমিই সেই আত্মা, যাকে আমি প্রতিটি জন্মে খুঁজেছি। অচ্যুত লাহা শুধু একজন মানুষ নয়, তার রক্তে ছিল এক শপথ—যা সে ভেঙেছিল। কিন্তু সেই শপথ যখন কারও রক্তে লিখে যায়, তখন তা বারবার জন্ম নেয়, বারবার ফিরে আসে—তুমিই সেই চুক্তির পরবর্তী পুনর্জন্ম।” আদিত্য প্রথমে বুঝতে পারেনি, কিন্তু রজনী তাকে আয়নার কাছে নিয়ে গিয়ে চিত্রের মতো এক স্মৃতি খুলে ধরল—এক জমিদার-পোশাকে আদিত্যর চেহারা, হাতে একটি ত্রিফল লকেট, যা সে নিজের রক্ত দিয়ে অলিভিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে কুঠির দেয়াল কেঁপে উঠল, যেন স্মৃতিও লজ্জা পায় পুনরাবৃত্তিতে।

এই চিত্রমানসিক অভিজ্ঞতার শেষে রজনী বলল, “আমি তোমায় মুক্তি দেব না, যতক্ষণ না তুমি আমাকে সেই চুক্তির শেষ শব্দ বলো—ক্ষমা।” আদিত্য বুঝে উঠতে পারে না, সে কি শুধু একজন গবেষক? নাকি তার অস্তিত্বই নির্মিত হয়েছে অতীতের সেই ভুল সংশোধনের জন্য? তার মাথায় তখন ইলার কথা ফিরে আসে—যে এখনো কোথাও কুঠির ভেতরে আটকে আছে, সেই অদৃশ্য জালের ভেতরে। সে জানে, রজনীর মুক্তি মানেই কুঠির জালের ছিন্নভিন্ন হওয়া, আর তাতে ইলাও মুক্ত হবে। কিন্তু সে এ-ও জানে, এই মুক্তির জন্য তাকে নিজের ভিতর থেকে কিছু বের করতে হবে, কোনও তথ্য নয়, কোনও যুক্তিও নয়—একটা অনুভব, যা সে আজ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। সে চোখ বন্ধ করে বলে উঠল, “আমি জানি না আমি অচ্যুত ছিলাম কিনা, কিন্তু আমি যদি তার ভুলের উত্তরাধিকারী হই, তবে আমি ক্ষমা চাই। সেই সমস্ত অঙ্গীকার ভাঙার জন্য, যেগুলো মৃত্যুর চেয়েও গভীর ছিল।” তখনই রজনী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার কপালে স্পর্শ করল—সেই স্পর্শ ছিল ঠান্ডা, অথচ তাতে আগুনের মতো কিছু ছিল, যা শরীর পুড়িয়ে দেয় না, বরং আত্মাকে জাগিয়ে তোলে।

হঠাৎ ঘরের চারপাশের সব আয়না ভেঙে পড়ল—কাচের শব্দে যেন সময় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। মেঝে কেঁপে উঠল, আর জানালার বাইরে হাওয়ায় উড়ে যেতে লাগল সেই শতাব্দীপ্রাচীন জাল—যা এতদিন ধরে কুঠিকে আটকে রেখেছিল। সেই জালের টুকরোগুলো বাতাসে মিশে একধরনের ধ্বনি তৈরি করছিল—না শব্দ, না সুর, কিছু মধ্যবর্তী। তারপর সেই মুহূর্তে মেঝের এক কোণ থেকে ইলা উঠে এল—চোখে ধাঁধা, কিন্তু চেতনা ফিরে এসেছে। সে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে বলল, “আদিত্য… আমি শুনতে পেয়েছি সব… তুমি ওকে মুক্ত করেছো।” কিন্তু তখন রজনী আর নেই—আয়নার ফ্রেমে শুধুই ফাঁকা রূপালী ছায়া, আর দেওয়ালে পড়ে আছে সেই ত্রিফল লকেট—যা আগে কখনও পাওয়া যায়নি। আদিত্য বুঝে গেল, চুক্তি শেষ হয়েছে, তবে ইতিহাস নয়। সে জানে, এই কুঠি এখন নীরব, কিন্তু যারা প্রতিশ্রুতি দেয়, তাদের গল্প কখনও একজায়গায় থেমে যায় না… বরং ছড়িয়ে পড়ে, নতুন জালের মতো অন্য সময়, অন্য রক্তে।

সকালের রোদ এসে যখন প্রথম দোতলার ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকল, তখন মাকড়সার কুঠি যেন একশো বছরের ঘুম ভেঙে উঠে হাঁপাচ্ছে। কুঠির ভিতরের ছায়াগুলো আজ যেন হালকা, দেওয়ালের ফাটলে জেগে উঠেছে লতাগুল্মের নতুন চারা, আর বাতাসে মিশে নেই সেই পুরনো পচা গোলাপের গন্ধ। আদিত্য আর ইলা ধীরে ধীরে নীচতলার চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল, কাঁধে লেগে থাকা ধুলো ঝাড়ল, কিন্তু মন থেকে কিছু মুছে গেল না। তারা ফিরে তাকাল বাড়িটার দিকে, যা এখনও দাঁড়িয়ে আছে—কিন্তু সেটার চোখমুখে কোনও অভিশাপ নেই, বরং একরকম ক্লান্তি, যেন ইতিহাস নিজেই বিশ্রাম নিতে চায়। আদিত্য নিচু গলায় বলল, “ও চলে গেছে… কিন্তু আমরা ওর জালেই আটকে ছিলাম, এটা বোঝা গেল।” ইলা মাথা নেড়ে বলল, “আর আমরা নিজেদের ভেবেছিলাম গবেষক… কিন্তু কত সহজে আমরা গল্পের চরিত্র হয়ে গেলাম, তাই না?” তার চোখে কোনও ভীতি নেই, বরং একরকম প্রশান্তি—যা আসে ভয় কাটিয়ে ওঠার পর, বা কোনও আত্মাকে নিঃশব্দে বিদায় জানালে।

কিন্তু সেই প্রশান্তি বেশিক্ষণ থাকল না। গ্রামের দিক থেকে ভেসে এল কয়েকজন মানুষের হট্টগোল, কেউ চিৎকার করে বলছে—“ওই কুঠির মাথায় ধোঁয়া উঠছে!” তারা দুজন কুঠির দিকে আবার তাকিয়ে দেখল, সত্যি—দোতলার এক কোণ থেকে হালকা ধোঁয়া বেরোচ্ছে, কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা নেই, কেবল ধোঁয়া, যেন ঘরের ভিতর কোনও পুরনো চিঠি পুড়ছে ধীরে ধীরে। আদিত্য একবার কুঠির ভিতরে ফিরে যেতে চাইল, কিন্তু ইলা হাত ধরে থামিয়ে দিল, বলল, “তাকে মুক্তি দিয়েছিস… এখন বাড়িটাকে দে। কিছু জিনিস একবার ভেঙে পড়া দরকার।” সেই মুহূর্তে কুঠির ভিতর থেকে হালকা শব্দ—চাবির ঘূর্ণনের মতো—এবং তারপর যেন চারদিক থেকে একসাথে কাচ ভাঙার আওয়াজ উঠল। তাদের চোখের সামনে কুঠির এক কোণা হঠাৎ ফাটল ধরতে শুরু করল, আর তারপর সেই ফাটল এগিয়ে যেতে লাগল উপরের দেওয়াল, জানালা, ছাদের দিকে—ধীরে ধীরে, কিন্তু অব্যর্থভাবে। গম্বুজটা প্রথমে হেলে পড়ে, তারপর জানালার কাঁচ উড়ে গেল বাতাসে—সেই সব আয়না যেগুলো এতদিন ধরে স্মৃতি ধরে রেখেছিল, আজ তাদের আর প্রয়োজন নেই। যেন রজনীর আত্মা নিজের শেষ ঠিকানা নিজেই শেষ করে দিচ্ছে।

তারা অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল—যতক্ষণ না কুঠি হালকা ধূলোর স্তূপে পরিণত হয়। ধোঁয়ার ভিতর থেকে ভেসে আসে একটা শেষমুহূর্তের কণ্ঠস্বর—অথচ সেটা রজনীর নয়, বরং এক মৃদু হাসি, যেন কেউ মুক্তির আনন্দে অশ্রু ঝরাচ্ছে। ইলা ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তুই কি জানিস আদিত্য… এই কাহিনি হয়তো এখানেই শেষ নয়। হয়তো এটার অন্য প্রান্তে কেউ নতুন করে জাল বুনছে। শুধু এ জন্মে নয়, প্রতিটি ভুল, প্রতিটি অঙ্গীকার আমাদের ফিরিয়ে আনে সেইসব জায়গায়, যেখানে কেউ অপেক্ষা করে… ক্ষমার জন্য।” আদিত্য মাথা নেড়ে বলল, “এইবার আমরা কেবল গবেষণা করব না, লিখবও না কিছুদিন… শুধু হাঁটব… দূরে কোথাও, যেখানে কোনও আয়না নেই।” পেছনে পড়ে থাকল ভাঙা ইট, ছাই, আর ত্রিফল লকেটটি—যা তারা একজায়গায় মাটির তলায় পুঁতে রাখল। কুঠির জাল ছিঁড়েছে, কিন্তু যে স্মৃতি একবার শরীর ছুঁয়ে যায়, সে চাইলেই ফিরে যায় না। হয়তো সেই স্মৃতি নিয়ে তাদের পথচলা শুরু হবে নতুনভাবে—আর এই গল্প, একদিন অন্য কারও মনে আবার ফিরে আসবে… অন্য রক্তে, অন্য জালে।

কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো বইয়ের দোকানের ভেতর, ধুলোভরা চৌকাঠ আর বাঁধানো পাণ্ডুলিপির পাশে, পড়েছিল একটি আয়না—মাঝারি আকার, কাঠের খোদাই করা ফ্রেম, আর ফ্রেমের একপাশে জরাজীর্ণভাবে লেখা: “জমিদার অচ্যুত লাহার বৈঠকখানা, বীরভূম—১৮৯২।” যিনি আয়নাটি কিনলেন, তার নাম সুদীপ দে—এক পুরাতত্ত্ব অনুরাগী, যিনি হাল আমলে “ইতিহাসের ছায়া” নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল চালান। আদিত্য আর ইলার লেখা ‘মাকড়সার কুঠি’ নামক এক অপ্রকাশিত ব্লগ পেয়ে তিনি এতটাই আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে, ঘটনাক্রমে এই আয়নাটি সংগ্রহ করে ফেলেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর এক অখ্যাত পুরাতন সামগ্রীর দোকান থেকে। দোকানের বৃদ্ধ মালিক তাকে সাবধান করে বলেছিলেন, “এটা শুধু আয়না নয়, স্মৃতি ধরে রাখে। ওতে দেখা যায় শুধু মুখ না… আরও অনেক কিছু।” সুদীপ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল কথাটা। কিন্তু আয়নাটি ঘরে আনার পর থেকেই তার ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যারে অদ্ভুত সমস্যা দেখা দিতে থাকে—ক্যামেরার ফ্রেমে সে দেখতে পায় কিছু ধোঁয়াটে প্রতিচ্ছবি, যার মধ্যে এক নারী বসে আছে, সাদা পোশাকে, হাতে এক ধাতব লকেট ঘুরিয়ে চলেছে। প্রথমে ভেবেছিল গ্লিচ, তারপর ভয়ও পেয়েছিল, কিন্তু শেষে—কৌতূহলই জিতে গেল।

রাতের একটা সময়, ক্যামেরার সামনে বসে সে নিজের স্ক্রিপ্ট রেকর্ড করছিল: “আজ আমরা কথা বলব ‘মাকড়সার কুঠি’ নামক এক রহস্যময় বীরভূমি জমিদারবাড়ি নিয়ে, যেখানে নাকি এক প্রেতিন নারী অপেক্ষা করতেন…”—ঠিক তখনই ব্যাকগ্রাউন্ডে আয়নার পাশে একটি ছায়া সরল, আর তার সঙ্গে বাতাস ভারী হয়ে উঠল, জানালার কাঁচে কুয়াশা জমে স্পষ্ট লেখা হয়ে গেল একটি নাম: রজনী। সুদীপ আতঙ্কে ঘুরে তাকায়, কিছু নেই, কিন্তু ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে গেছে পরিষ্কার। ঘামতে ঘামতে সে আয়নার সামনে যায়, হাত রাখে তার ফ্রেমে, আর সেই মুহূর্তে যেন তার চেতনা খানিক দুলে ওঠে। সে দেখতে পায় ধূসর এক ঘর, কাঁপতে থাকা ঝাড়বাতি, মেঝেতে ছড়িয়ে আছে চিঠি—আর ঠিক সামনে বসে আছে সেই নারী, যাকে সে আগেও দেখেছে ভিডিও ফুটেজে, কিন্তু এবার যেন সে কথা বলছে। “তুমি ফিরে এসেছ… আবার… আবার…”—তার কণ্ঠে বিস্ময়, প্রেম আর যন্ত্রণা একসাথে মিশে। সুদীপ চিৎকার করে উঠতে চায়, কিন্তু মুখ খুলতে পারে না। সে অনুভব করে, আয়নার ভিতরের ছায়া এক মুহূর্তে তার দৃষ্টিকে গ্রাস করে নিচ্ছে, যেন নিজের ভিতরের কোনও অতীত তার শরীর দখল করে নিচ্ছে।

এক মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজেকে খুঁজে পায় অন্য এক ঘরে—যেখানে আলো নেই, সময় নেই, কেবল ধূসর দেওয়ালে ছায়া ভেসে বেড়ায়। আয়নার ওপারে রজনী দাঁড়িয়ে, তার চোখে প্রতিক্ষার সাগর, আর ঠোঁটে একটুও কথা নেই, কিন্তু তার চারপাশে গড়ে উঠছে নতুন জাল—বাঁধার, নয়… ডাকার জন্য। সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে—কুঠি ধ্বংস হয়েছে, লকেট পুঁতে রাখা হয়েছে… কিন্তু আত্মা যদি সত্যিই সময়কে অতিক্রম করতে পারে, তবে স্মৃতি নতুন শরীরে জন্ম নেয়, নতুন যন্ত্রে, নতুন আয়নায়। সুদীপের মুখ তখন নিঃশব্দ, কিন্তু তার চোখে কেবল এক জিজ্ঞাসা—সে কি আদিত্য নয়, তবে কি পরবর্তী উত্তরসূরি? আর আয়নার এই পাড়ে যাত্রা শুরু হয়েছে নতুনভাবে… যেখানে গল্প থামে না, শুধু রূপ বদলায়।

১০

কলকাতার বুকে বৃষ্টির এক উদাস দুপুরে সুদীপ আবার বসে ছিল তার ডেস্কে, সামনে সেই আয়না, পাশে তার ল্যাপটপ, যেখানে খোলা একটি আধা-সম্পাদিত ভিডিও—”The Web Never Dies”। ক্যামেরার সামনেই সে অন্যমনস্কভাবে বলছিল, “আমরা ভাবি ভূত মানে অতীতের কিছু ছায়া, কিন্তু যদি ভূত কোনও এক অনুভব হয়? যদি একটা ভুল প্রতিবার নতুন নতুন রক্তে জন্ম নেয়?” তখনই আয়নার ফ্রেম থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ হল, ঠিক যেন কাঠের মাঝে কিছুর ফাটল ধরছে। সে ঘুরে তাকাল। আয়নার কাচ তখন ধীরে ধীরে কুয়াশা দিয়ে ঢেকে যাচ্ছিল, আর তার ভিতরে আবার সেই পরিচিত মুখ—সাদা পোশাক, উদাস চোখ, আর ঠোঁটে আধখানা নাম—“অচ্যু…”। সুদীপ এবার আর ভয় পেল না, বরং দাঁড়িয়ে গিয়ে চোখ রাখল আয়নার মাঝখানে। তার হৃদয় ধুকপুক করছিল ঠিকই, কিন্তু মন ঠান্ডা—সে বুঝেছে, এটি এক খেলা নয়, এ এক উত্তরাধিকার… এক স্মৃতির কারুকাজ, যা শুধু একজনে শুরু করে না, সবাই মিলে বয়ে নিয়ে চলে। তখনই ফোনে মেসেজ এল—এক লিঙ্ক, প্রেরক: A. Roy। মেসেজে লেখা: “আমাদের গল্পটা তুমি দেখেছ, এবার শুনে যাও শেষ গানটা… তোমার পালা শুরু হয়েছে।”

সুদীপ লিঙ্ক খুলে দেখে, এক অদ্ভুত অডিও ক্লিপ—মৃদু সুর, যেন কেউ ঝড়ের ভেতরে গাইছে। ভেসে আসছে নারীকণ্ঠ, যার প্রতিটি শব্দ যেন এক টান, এক মায়া, এক ঘোর: “আমি ছিলাম, আমি থাকব… যারাই আমাকে প্রতিজ্ঞা দিয়েছে, তারা আমায় মনে রাখুক না রাখুক, আমি মনে রাখি…”। এই অডিও বাজতেই আয়নার কাচে নতুন এক জাল ফুটে উঠতে শুরু করল—জ্যামিতিক, সূক্ষ্ম, অথচ শক্ত। সুদীপ বুঝে গেল, রজনী, অলিভিয়া, এমনকি আদিত্য—তারা কেউ ব্যক্তিমাত্র ছিল না, তারা ছিল জালের নকশা, যার ভিতর দিয়ে সময় বারবার নিজেকে বুনেছে। সেই মুহূর্তে তার ক্যামেরার স্ক্রিনে ফুটে উঠল নতুন শব্দ—“Web 2.0: Succession Begins”। সে হেসে ফেলল—একটা নীরব হাসি, যেটা ভয় পেরিয়ে যাবার পর আসে।

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল না, জানালার কাচ কাঁপল না, কেবল আয়নার প্রতিফলনে সুদীপ দেখতে পেল—তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ, অনেক দূরে, ধূসর, অন্ধকার, কিন্তু স্পষ্ট। সেই ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, কণ্ঠে বলল, “তুমি লিখবে না? কাহিনিটা তো এখনও শেষ হয়নি।” তখন সুদীপ জানে—সে এখন আর শুধু ইতিহাসের পাঠক নয়, বরং এক চরিত্র, এক উত্তরাধিকারী। সে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসল, ল্যাপটপ খুলল, আর লিখতে শুরু করল: “মাকড়সার কুঠি – দ্বিতীয় অধ্যায়: আয়নার ওপারে যারা…”। এবং তখনই, আয়নার ভিতর একটি নতুন চোখ খুলে গেল—এবার সেই চোখে না ছিল অচ্যুত, না রজনী, বরং একজন নতুন লেখক, নতুন দর্শক… যার নাম, ভবিষ্যতে কেউ না কেউ খুঁজে নেবে, আর বলে উঠবে—“এও কি সত্যি?”

শেষ

1000041420.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *