Bangla - ভূতের গল্প

মহালয়ার সুর

Spread the love

পল্লব সেনগুপ্ত


প্রতি বছর শরৎকালের সেই বিশেষ সকালটি যেন গ্রামটির বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। রাতভর কুয়াশা আর শিশিরে ভিজে থাকা বাতাস যখন আস্তে আস্তে আলোয় গা ভিজিয়ে নেয়, তখনই শুরু হয় সেই সুর—চণ্ডীপাঠের গম্ভীর ও সুরেলা ধ্বনি। গ্রামটি খুব সাধারণ, মাটির ঘর, কাঁচা রাস্তা, পুকুর আর ধানখেত দিয়ে ঘেরা, অথচ প্রতি মহালয়ার ভোরে এই গ্রাম হয়ে ওঠে রহস্যময়। সূর্যের প্রথম কিরণ ওঠার আগেই দূর থেকে ভেসে আসে ধ্বনি, যেন দেবীর আহ্বান চলছে। যারা গ্রামে থাকে তারা সবাই জানে, এই সুর অন্য কোনো মাইক থেকে নয়, কিংবা মন্দির থেকেও নয়। এটা ভেসে আসে সেই পুরোনো, ভগ্নপ্রায় বাড়ি থেকে, যার অন্দরমহল বহু বছর ধরে তালাবদ্ধ, যার জানালার কাঁচ ভেঙে গেছে, যার বারান্দায় শুধু বুনো ঘাস আর লতাপাতা ছড়িয়ে আছে। বাড়িটি একসময় ধনীদের ছিল, শোনা যায়, সেই পরিবারের লোকেরা এক ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের পর গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকে ওখানে কেউ থাকে না, শুধু শূন্য ঘর, ভাঙা দরজা আর অদ্ভুত নীরবতা। কিন্তু মহালয়ার দিন ভোরবেলায় সেই নীরবতা ভেঙে সুর উঠতে শুরু করে, যা এতটাই স্পষ্ট যে গ্রামের বৃদ্ধ থেকে শিশু পর্যন্ত সবাই শোনে। কারও সাহস হয় না বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর, শুধু দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে, কৌতূহলে আর ভক্তিভরে শোনে। একেকজন মনে করে এটা দেবীর অলৌকিক আবির্ভাব, কেউ ভাবে এটা কোনো অদৃশ্য সাধুর সাধনা, আবার কেউ ভাবে এটা শয়তানি খেলা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যে বাড়ি বহু বছর ধরে বন্ধ, সেখানে কার কণ্ঠে প্রতিধ্বনি ওঠে?

গ্রামের মানুষের মধ্যে এই রহস্য নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত। গ্রামের মোড়ের চায়ের দোকানে বসে মানুষজন নানা কাহিনি বলে, কেউ বলে সেই বাড়ির পূর্বপুরুষরা ছিলেন তন্ত্রসাধক, তারা নাকি মহালয়ার রাতে বিশেষ পূজা করতেন। কেউ বলে অগ্নিকাণ্ডের রাতে পরিবারটি প্রাণ হারালেও তাদের আত্মারা শান্তি পায়নি, তাই প্রতি বছর এই দিনে তারা ফিরে আসে আর চণ্ডীপাঠ শুরু করে। আবার অন্য কেউ বলে, এটা আসলে কোনো অভিশাপ, আর গ্রামের মানুষ এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে না যতদিন না বাড়ির ভেতরে কেউ গিয়ে রহস্য উদঘাটন করে। কিন্তু এতসব কথা বললেও কাজের কাজ কেউ করে না। ভোরবেলায় যারা নদীতে স্নান করতে যায় বা শিউলি ফুল কুড়োতে বেরোয়, তারাও দূর থেকে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করে। তারা গলা শুকনো হয়ে যাওয়া ভয় নিয়ে শুধু সুরটা শোনে, অথচ মনে মনে প্রণাম করে নেয় দেবীর প্রতি। শিশুরা প্রথমে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে—“ওই বাড়ির ভেতরে আসলেই কেউ আছে?” কিন্তু বড়রা তাদের চুপ করিয়ে দেয়, কারণ এমন প্রশ্ন করলে নাকি অমঙ্গল ডেকে আনে। গ্রামের বৃদ্ধ দাদু-ঠাকুমারাও বলেন, এই সুর আসলে অশরীরী শক্তির, মানুষের পক্ষে ওটা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তাই বছর ঘুরে বছর চলে যায়, কিন্তু সেই বাড়ির রহস্য অমীমাংসিতই থেকে যায়।

কিন্তু এই বছরের মহালয়া যেন অন্য রকম। আগের বছরের তুলনায় সুরটা যেন আরও গাঢ়, আরও তীব্র, যেন কারও বুকফাটা আহ্বান। ভোরের নরম কুয়াশার ভেতরে শিউলির গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকা সেই সুর গ্রামটিকে আরও ভৌতিক করে তোলে। কিছু মানুষ প্রথমবার সাহস সঞ্চয় করে বলে ওঠে, “এবার আমাদের গিয়ে দেখা উচিত, নাহলে এই রহস্য চিরকাল চলতেই থাকবে।” তবুও কেউ এগোয় না, শুধু এক অদৃশ্য ভয়ে সবাই পিছু হটে। গৃহিণীরা ঘরের জানালা বন্ধ করে দেয়, পুরুষরা কেবল ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করে, আর শিশুরা গা শিরশিরে ভয় নিয়ে মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরে। সেই পরিত্যক্ত বাড়ির চারপাশে যেন বাতাসও ভারী হয়ে ওঠে, পাখির ডাক কমে যায়, কুকুরেরা ভয়ে ঘেউ ঘেউ করতে করতে দূরে সরে যায়। চণ্ডীপাঠের প্রতিটি শব্দ যেন ঘরের ভেতর থেকে নয়, বরং শূন্য আকাশ থেকে ভেসে আসছে, তবুও মানুষ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে—একজন নারীস্বরে উচ্চারিত মন্ত্র, যার ধ্বনি শক্তি গ্রামটিকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আর গ্রামবাসীরা ভাবছে, এ সুরে কি সত্যিই দেবীর আবাহন হচ্ছে, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও গভীর এক গোপন রহস্য? বছর বছর যেমনটা ঘটে, এবারও কেউ বাড়ির ভেতরে পা রাখতে সাহস পায় না, কিন্তু মনে মনে সবাই ঠিক করে নেয়—কেউ না কেউ একদিন এই রহস্য ভেদ করবেই, আর সেই দিন হয়তো গ্রামটির ইতিহাস পাল্টে যাবে চিরকালের মতো।

সেই বছর মহালয়ার কয়েকদিন পরের এক বিকেলে গ্রামের কয়েকজন কিশোর মিলে ঠিক করল, তারা আর ভয়ে ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে সুর শুনবে না। তারা জানত, বড়রা কখনোই সেখানে ঢুকতে দেবে না, কিন্তু কৌতূহলের তাড়না তাদের চুপ থাকতে দিল না। আকাশে তখনো বিকেলের ম্লান আলো, পশ্চিমে সূর্য লালচে হয়ে ডুবে যাচ্ছে, আর মাঠের পাখিরা ঘরে ফেরার ডাক দিচ্ছে। ছেলেগুলো—অভিজিৎ, সমীর, তনয় আর ছোট্ট রাজীব—সাহস সঞ্চয় করে লুকিয়ে সেই ভগ্নপ্রায় বাড়ির দিকে এগোল। মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাদের বুক ধুকপুক করতে লাগল, কিন্তু কেউই ভীরু হতে চাইল না। চারপাশে শাল-সেগুন গাছের ফাঁক দিয়ে বাতাসে শুকনো পাতার মচমচে শব্দ, আর সেই শব্দ যেন আরও ভয়ের রেশ তৈরি করছিল। তারা যত কাছে পৌঁছাল, ভাঙা বাড়ির ছায়া ততই দীর্ঘ হতে লাগল, যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে তাদের আটকে ফেলবে। অবশেষে তারা কেঁপে ওঠা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল, দরজাটা আধভাঙা, মরচেধরা কপাটে শুধু লতাপাতা জড়িয়ে আছে। ভিতরে প্রবেশ করার আগে তারা একে অপরের মুখের দিকে তাকাল—কে আগে ঢুকবে? অভিজিৎ সাহস দেখিয়ে এক ধাক্কায় দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল, আর বাকিরা পেছন পেছন অনুসরণ করল।

ভেতরে ঢুকতেই তাদের মনে হল, যেন বহুদিনের এক চাপা গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে—ধুলো, পুরোনো কাঠ, জীর্ণ কাপড় আর পোড়া ধূপকাঠির গন্ধ। অন্দরমহল অন্ধকার, ভাঙা জানালা দিয়ে কিছু আলো আসছিল, আর সেই আলোয় দেখা গেল ঘরের এক কোণে ভাঙাচোরা প্রতিমা পড়ে আছে। প্রতিমাটির মাথা নেই, হাত দুটোও ভেঙে গেছে, শুধু শরীরের একাংশ ধুলোর নিচে ঢাকা। প্রতিমার সামনে ছড়িয়ে আছে ছেঁড়া ধূপকাঠি, ভাঙা থালা, শুকনো ফুল আর কেঁচো-ধরা মাটির প্রদীপ। মনে হচ্ছিল, বহু বছর আগে কেউ এখানে পূজার আয়োজন করেছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই সব থেমে গেছে। ছেলেগুলো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তাদের বুকের ভেতর ভয় জমে উঠল, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার মতো সাহসও হলো না। ঘরের ভেতর যেন এক অদ্ভুত ঠান্ডা, বাইরের উষ্ণ বাতাসের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। তারা ধীরে ধীরে প্রতিমার কাছে এগোল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে ভেতরে প্রতিধ্বনিত হলো চণ্ডীপাঠের সুর—স্পষ্ট, গম্ভীর, যেন কেউ তাদের সামনে বসে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। ছেলেগুলো ভয়ে কাঁপতে লাগল, তবুও কানে বাজতে থাকা সেই ধ্বনির টান তাদের আটকাতে পারল না। তারা চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল, কোথাও তো কোনো মানুষ নেই, অথচ সুরটা আসছে প্রতিমার দিক থেকেই। প্রতিটি মন্ত্রের সঙ্গে ঘরের ভেতর যেন কেঁপে উঠছিল, ধুলো নড়ে যাচ্ছিল, আর মোমবাতির মতো আলো জ্বলজ্বল করে আবার নিভে যাচ্ছিল।

কিশোরদের মনে তখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—ভয়ের সঙ্গে কৌতূহলের লড়াই। রাজীব প্রায় কান্নার মতো গলায় বলল, “চলো, বাইরে যাই… এটা ঠিক কিছু নয়।” কিন্তু অভিজিৎ সাহস করে বলল, “না, এটাই তো দেখতে এসেছি, সত্যিই এখানে কী হচ্ছে।” তারা আরও কিছুক্ষণ ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিমার ভাঙা মুখমণ্ডলের জায়গা থেকে যেন এক ফিসফিসে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, আর চণ্ডীপাঠের প্রতিটি উচ্চারণে সেই আলো কেঁপে উঠছিল। তনয় চোখ কুঁচকে ফিসফিস করে বলল, “হয়তো কেউ আমাদের সঙ্গে খেলা করছে… কোথাও লুকিয়ে বসে আছে।” কিন্তু তারা চারপাশে খুঁজে দেখল, ভাঙা ঘরে মানুষের কোনো চিহ্ন নেই। কেবল ছেঁড়া আসন, ভাঙা কাঠের বাক্স আর পরিত্যক্ত পূজার সামগ্রী পড়ে আছে। এদিকে সুর আরও তীব্র হয়ে উঠছিল, যেন অদৃশ্য কেউ তাদের অচেনা কোনো শক্তির সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। অবশেষে তারা আতঙ্কে একে অপরের হাত ধরে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। ভাঙা দরজা পেরিয়ে যখন খোলা আকাশে দাঁড়াল, তখনও কানে বাজছিল সেই প্রতিধ্বনি, যেন ঘরটার ভেতর এখনো কারও উপস্থিতি আছে। তারা হাঁপাতে হাঁপাতে গ্রামমুখো ফিরল, কিন্তু ভেতরের সেই দৃশ্য তাদের মনে দাগ কেটে রইল। প্রতিমার ভাঙা দেহ, ছেঁড়া ধূপকাঠি, আর অদৃশ্য চণ্ডীপাঠ—সব মিলিয়ে যেন নতুন এক রহস্য উন্মোচিত হলো, যা শুধু ভয় নয়, বরং এক অনিবার্য আকর্ষণও সৃষ্টি করল। তারা বুঝতে পারল, এই বাড়ির ইতিহাসে এমন কিছু গোপন আছে, যা গ্রামের কেউ জানে না, আর সেটাই হয়তো তাদের সামনে একদিন খুলে যাবে ভয়ঙ্কর সত্য হিসেবে।

কিশোরদের ভয়ের অভিজ্ঞতার কথা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তেই এক অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি হলো। কেউ বিশ্বাস করল, আবার কেউ বলল—“ছেলেরা বাজে কথা বলছে।” কিন্তু ভেতরে গিয়ে ভাঙা প্রতিমা আর অদৃশ্য চণ্ডীপাঠের সুর শুনে আসার যে বর্ণনা তারা দিল, তা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে গ্রামবাসীরা আর একেবারে উড়িয়ে দিতে পারল না। এই সময় গ্রামের প্রবীণ মানুষরা, যাঁরা বহু বছর ধরে এই গ্রামে আছেন এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাহিনি শুনে এসেছেন, তাঁরা মুখ খুললেন। সন্ধ্যার পর, যখন পুকুরপাড়ের বটগাছের নিচে গ্রামবাসীদের আড্ডা বসে, তখনই বৃদ্ধ মহাদেব মশাই প্রথম গল্পটা বলা শুরু করলেন। তাঁর কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ছিল গাঢ় স্মৃতি। তিনি জানালেন, বহু বছর আগে এই বাড়িতে বাস করতেন রাজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় নামের এক খ্যাতনামা পুরোহিত। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ তাঁকে ডাকত পূজা, যজ্ঞ বা মন্ত্রোচ্চারণের জন্য। তিনি ছিলেন দেবীর এমন ভক্ত যে সারা বছর ধরে সাধনা চালাতেন, আর মহালয়ার দিনে তাঁর আঙিনায় বিশাল আয়োজন হতো। শোনা যায়, মহালয়ার ভোরে তাঁর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শুনতে মানুষ ভিড় জমাতো, আর বলা হতো, তাঁর কণ্ঠে দেবী নিজে নেমে আসেন।

কিন্তু সেই খ্যাতির মাঝেই ঘটল ভয়ংকর দুর্ঘটনা। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, সেই বছরের মহালয়ার দিন ভোরে পূজা চলছিল যথারীতি, সবাই মগ্ন ছিল মন্ত্রোচ্চারণে, আর রাজেন্দ্রনাথ মশাই তখনো পাঠ করছিলেন। হঠাৎ বাড়িতে আগুন লেগে গেল—কেউ জানে না কীভাবে। কেউ বলে প্রদীপ উল্টে গিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, কেউ বলে বাইরের শত্রুরা ঈর্ষায় ইন্ধন জোগায়। আগুন মুহূর্তের মধ্যে ভেতরে ছড়িয়ে যায়, আর ভিড় করা মানুষজন ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সবাই প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ায়, কিন্তু পুরোহিত তখনো থামেননি। তাঁর গলা ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছিল, তিনি মন্ত্র থামাননি, যেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দেবীকে আহ্বান জানাতে চাইছিলেন। প্রবীণরা বলেন, সেই আগুনেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর কণ্ঠ যেন থেমে যায়নি। অনেকেই শপথ করে বলেছিল, তারা আগুনের ভেতর থেকেও চণ্ডীপাঠ শুনেছিল, আর আগুন নিভে যাওয়ার পরও সেই প্রতিধ্বনি চারদিকে বাজছিল। তারপর থেকে এই বাড়ি আর কেউ বাসযোগ্য মনে করেনি, ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। রাজেন্দ্রনাথ মশাইয়ের আত্মা যে শান্তি পায়নি, সেই বিশ্বাসে গ্রামবাসীরা ভয়ে আর ভক্তিতে বাড়ির কাছে ঘেঁষেনি। মহালয়ার দিন আসলেই সেই সুর আবার ভেসে ওঠে, যেন তিনি মৃত্যুর পরও নিজের সাধনা থামাননি।

বৃদ্ধ মহাদেব মশাইয়ের কাহিনি শোনার পর গ্রামের মানুষদের চোখে-মুখে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি ফুটে উঠল—ভয়, শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ের। কেউ বলল, “তাহলে এত বছর ধরে আমরা যে সুর শুনছি, সেটা তাঁর আত্মার প্রতিধ্বনি!” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল, “হয়তো দেবী তাঁকে মুক্তি দেননি, তাই তিনি আজও বাঁধা পড়ে আছেন।” প্রবীণারা জানালেন, তাঁদের ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে শুনেছেন, এই পুরোহিত ছিলেন তন্ত্রসাধনায়ও সিদ্ধহস্ত। তাই তাঁর আত্মা সাধারণভাবে বিলীন হয়নি, বরং আটকে গেছে এই জগতে। চণ্ডীপাঠের সুর তাঁর দেহহীন আত্মা থেকে উঠে আসছে, আর সেই কারণেই প্রতি মহালয়ার ভোরে গ্রামময় ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়। গল্প শোনার পর কিশোররা বুঝল, তাদের দেখা আর শোনা জিনিসগুলো অকারণ ছিল না। প্রতিমার ভাঙা দেহ, ধূপকাঠির ছাই, ধুলোমাখা অন্দরমহল—সব যেন মিলে যাচ্ছে এই কাহিনির সঙ্গে। তবে তাদের মনে এক নতুন প্রশ্ন জেগে উঠল—যদি সত্যিই পুরোহিতের আত্মা বন্দি হয়ে থাকে, তবে কি কেউ আছে যে তাঁকে মুক্তি দিতে পারবে? নাকি গ্রামটির ভাগ্যে চিরকাল বয়ে চলবে এই রহস্যময় প্রতিধ্বনি, ভোরের সেই ডাক, যা ভয় আর ভক্তি মিশিয়ে মানুষকে চিরকাল অস্থির করে রাখবে? প্রবীণদের এই কাহিনি গল্পটিকে শুধু ভয়ের আবহ থেকে টেনে এনে এক গাঢ় ইতিহাসে দাঁড় করাল, আর গ্রামের মানুষ বুঝল, তারা আসলে এক মৃত পুরোহিতের অসমাপ্ত সাধনার সাক্ষী হয়ে আছে।

অরিন্দম গ্রামের অন্যান্য কিশোরদের চেয়ে ভিন্ন ছিল—সে ভয়ে সহজে হার মানতো না। অন্য ছেলেরা ভাঙা বাড়ির কাছাকাছি গেলে চোখ বুজে পালাত, কিন্তু অরিন্দম মনে করত, “ভয় শুধু মানুষের মনেই। বাস্তবতা আর মন ভেদ করা প্রয়োজন।” সে বিশ্বাস করত যে, আত্মারা শুধুই গল্পের চরিত্র, বাস্তবে কিছু নেই। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল, এবার মহালয়ার আগের রাতেই সে নিজে সেই বাড়ির ভেতরে যাবে এবং সঠিকভাবে দেখবে কি ঘটছে। বিকেলের পর থেকে সে সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তুতি নিল। পেছনে তার বাবা-মা থাকলেও কিছুটা আশঙ্কা প্রকাশ করল, কিন্তু অরিন্দমের দৃঢ় মনোবল দেখে তাঁরা বাধ্য হয়ে চুপ থাকলেন। সে তার ব্যাগে ফ্ল্যাশলাইট, কয়েকটা শুকনো খাবার, পানি আর একটি ছোট নোটবুক রাখল, যাতে অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে পারে। বিকেলের ম্লান আলোয় সে বাড়ির দিকে এগোল। রাস্তার ধুলো কুঁচকে উঠছিল, শাল ও সেগুন গাছের পাতার শব্দ যেন ফিসফিসে কিছু বলছিল। তার প্রতিটি ধাপই যেন অদৃশ্য সুরের দিকে এগোচ্ছে। অরিন্দম জানত, ভেতরে যে রহস্য লুকিয়ে আছে তা হয়তো তার কল্পনার চেয়েও ভয়ংকর, কিন্তু মনোবল বলছিল—“সত্যি জানো, না হলে কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”

বিকেল শেষে অন্ধকার নেমে এলো, এবং গ্রামের ঘরগুলো আলোর রেখার মধ্যে ক্ষীণ হয়ে গেল। অরিন্দম ধীরে ধীরে বাড়ির ধূলোমাখা দরজার কাছে পৌঁছালো। ছেঁড়া কপাট উল্টো দিয়ে সে দরজা খুলল, ভেতরের অন্ধকারে পা রাখল। প্রথমে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাল, হালকা আলো ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। ভাঙা প্রতিমা, ছেঁড়া ধূপকাঠি, মাটির প্রদীপ আর ধুলো—সবই আগের মতোই। কিন্তু যেটা অরিন্দমকে চমকে দিল, তা হলো ভেতরে এখনও অদ্ভুত শীতলতা এবং কিছুটা অদৃশ্য নড়াচড়া। সে প্রথমে থমকে গেল, মনে হল যেন কেউ চোখ রাখছে। তারপর সাহস জুগিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিমার দিকে এগোতে লাগল। সে তার ফ্ল্যাশলাইট দিয়ে প্রতিমার ভাঙা মুখমণ্ডল, হাত ভাঙা অবস্থায় পরীক্ষা করতে লাগল। প্রতিটি ধাপে সে খুঁজে দেখল, ছেঁড়া ধূপকাঠি ও শুকনো ফুল কেবল মানব সৃষ্ট নয়, এখানে যেন সময়ও থেমে আছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কানে ভেসে এলো সেই চণ্ডীপাঠের সুর—অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার, যেন ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে উঠছে। অরিন্দম প্রথমে ভয়ে কেঁপে উঠল, কিন্তু নিজের মনকে কাঁধে চাপিয়ে বলল, “সাধারণ বায়ু প্রবাহ, প্রতিস্বর… সব কিছুই বাস্তবতার মধ্যে।” সে নিজেকে বোঝাল, আত্মা কোনো ভৌত অস্তিত্ব নয়, সবই কল্পনার খেলা।

রাতের গভীরতায় অরিন্দম ধীরে ধীরে প্রতিমার সামনে বসল। সে তার নোটবুক খুলল এবং প্রতিটি অনুভূতি লিপিবদ্ধ করতে লাগল। ফ্ল্যাশলাইটের হালকা আলো ঘরের অন্ধকারে নীরব ছায়া তৈরি করল। প্রতিটি মন্ত্রোচ্চারণে সে অনুভব করল, মানুষের ভয়ের শক্তি কতটা গভীর। তবে সে মনস্থির করল, ভয়ে নয়, বরং বিশ্লেষণ ও কৌতূহলের কারণে এখানে এসেছে। সে ঘরের প্রতিটি কোণ পর্যবেক্ষণ করল—দেয়ালের ফাটল, ধুলোমাখা আসবাবপত্র, ভাঙা জানালা, আর ছেঁড়া প্রতিমা। আরেকটু শান্ত মনে সে ভাবল, হয়তো পুরোহিতের আত্মা বন্ধ নয়, বরং মানুষ তাদের ভয়ের মধ্যেই বন্দি থাকে। রাতের সেই নীরবতা, ধুলো, ভাঙা প্রতিমা আর ধূপকাঠির ছাই—সবই অরিন্দমকে দেখালো, ভয়ের মধ্যে সত্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সে ঠিক করল, মহালয়ার ভোরে সে পুরোপুরি এই ঘরের রহস্য উন্মোচন করবে। আর সেই রাতে অরিন্দম শুয়ে থাকল, ঘরের ধুলো ও ছায়ার মাঝে, নিজের কল্পনা আর বাস্তবতার মধ্যে সীমা টেনে ধরে, এক অদ্ভুত প্রশান্তি ও সংকল্পের সঙ্গে।

রাত গভীর হলে ঘরের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে গেল। অরিন্দম প্রতিমার ভাঙা মুখমণ্ডল আর ছেঁড়া ধূপকাঠির সামনে বসে থাকল, ফ্ল্যাশলাইটের হালকা আলো ঘরের প্রতিটি কোণকে অল্প অল্প জ্বালাপোড়ার মতো স্পর্শ করছিল। সে ভাবছিল, সবই কল্পনা, বাস্তবতায় কোনো আত্মা নেই। কিন্তু হঠাৎ করেই বাতাস থেমে গেল। এমন শূন্য নীরবতা আগে কখনো অনুভব করেনি। ফ্যানও ঘুমন্ত, জানালা বন্ধ—কিন্তু যেন ঘরটির প্রতিটি কণা স্থির হয়ে আছে। অরিন্দম ফ্ল্যাশলাইট হাতে চাপিয়ে ধীরে ধীরে চারপাশ পরীক্ষা করল, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না। ঠিক সেই মুহূর্তে, ছোট্ট মাটির প্রদীপ নিভে গেল, তারপর অল্পশব্দে আবার জ্বলে উঠল। অদ্ভুতভাবে প্রদীপের আলো কেঁপে উঠছিল, আর তার ছায়া যেন অদৃশ্য কোনো হাতের সঙ্গে নাচছে। অরিন্দম প্রথমে কাঁপল, মনে হলো, এখানে কেবল তারই উপস্থিতি নয়—কিছু অদৃশ্যও আছে। তবুও সে স্থির থেকে বলল, “ভয় পেলে কিছুই হবে না। সবই আমাদের মনেই।” সে নিজের সাহসকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকল, প্রত্যেক শব্দ, প্রতিটি ছায়ার নড়াচড়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

হঠাৎ দূরে কোথাও অদৃশ্য ঠোঁট নড়ার মতো শব্দ হল—একটি মৃদু ফিসফিসনির মতো। মনে হলো, কেউ ঘরের কোনোকোনায় মন্ত্রোচ্চারণ করছে। অরিন্দম প্রথমে চমকে উঠল, তার বুক দম বন্ধ করে দিল। কিন্তু সে পিছু হটল না, বরং মনকে জোর দিয়ে বলল, “এটা কেবল প্রতিধ্বনি। বাস্তবতায় কিছু নেই।” সে তার ফ্ল্যাশলাইটের আলো ধীরে ধীরে ঘরের চারপাশে ঘোরাল। আলো পড়ল প্রতিমার ভাঙা দেহে, ধুলোমাখা আসবাবে, এবং ছেঁড়া ধূপকাঠিতে। প্রতিটি জিনিস যেন তার চোখের সামনে নতুনভাবে প্রাণ পেল। অদৃশ্য ঠোঁটের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে মনে হলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে চণ্ডীপাঠের মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে এলো, যেন কারও কণ্ঠ নেই, কিন্তু শব্দটি প্রতিটি কোণে পৌঁছে যাচ্ছে। অরিন্দম বুঝল, এটি কোনো মানব কণ্ঠ নয়; এটি সেই শক্তি, যা বহু বছর ধরে এই বাড়িতে আটকে আছে। সে ভয় পেলেও স্থির থেকে ভাবল, এই মুহূর্তটাই তার সাহসের পরীক্ষা। তার মন বলল, “যদি সত্যিই কিছু থাকে, তবে ভয় না পেয়ে তা দেখার চেষ্টা কর।”

রাত এগোতে থাকল, এবং অরিন্দম অনুভব করল অদৃশ্য উপস্থিতি তার চারপাশে ঘুরছে। কখনও বাতাসের হালকা দুল, কখনও ধুলোর নীরব নড়াচড়া, কখনও আবার প্রদীপের নিভে-জ্বলে ওঠা—সব মিলিয়ে একটি দৃঢ় অনুভূতি তৈরি করল যে, এখানে সত্যিই কেউ আছে। কিন্তু সে বিশ্বাস করল, বাস্তব এবং কল্পনার সীমা আলাদা। অরিন্দম আস্তে আস্তে সেই ভাঙা প্রতিমার দিকে এগোল, ফ্ল্যাশলাইট তার কাঁপতে থাকা হাতে ধরে রেখেছিল। প্রতিমার ভাঙা মুখমণ্ডল, ভাঙা হাত, ছেঁড়া ধূপকাঠি সবই যেন তার কাছে গল্প বলা শুরু করল—এক দীর্ঘ সাধনার গল্প, এক অসমাপ্ত মন্ত্রোচ্চারণের কাহিনি। হঠাৎ তার কানে এলো একটি মৃদু গম্ভীর ফিসফিস, যেন বলা হচ্ছে, “ভয় করো না, সাহসী হও।” অরিন্দম বুঝল, যে অদৃশ্য শক্তি এখানে বন্দি, তা ভয় দেখাতে নয়, বরং তার কৌতূহল ও সাহসকে পরীক্ষা করছে। রাতে সেই দীর্ঘ সময় ধরে বসে থেকে অরিন্দম অনুভব করল, ভয়ের সঙ্গে কৌতূহল মিলিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি হয়, যা তার মনে চিরকাল দাগ কেটে রাখবে। অদৃশ্য উপস্থিতি, প্রদীপের নড়াচড়া, ধূপকাঠির ছাই—সব মিলিয়ে সে বুঝল, ভয় এবং সাহস একসাথে থাকার মধ্যেই সত্যের সন্ধান লুকিয়ে আছে।

ভোরবেলার কুয়াশা এখনও গ্রামের উপর নেমে আছে, আর পুকুরপাড়ে ছড়ানো শীতল বাতাস ছেঁড়া শালপাতার সঙ্গে নরম আলো খেলাচ্ছে। অরিন্দম ভাঙা বাড়ির ভেতরে বসে আছে, তার মন কৌতূহল আর উদ্দীপনায় পূর্ণ। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো চণ্ডীপাঠের প্রথম উচ্চারণ—গম্ভীর, স্পষ্ট, ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অরিন্দম চোখ বড় করে তাকাল, মনে হলো সে এবার সত্যিকারভাবে সেই শক্তির মুখোমুখি হবে যা বহু বছর ধরে গ্রামে রহস্যের আবরণ তৈরি করে এসেছে। ধীরে ধীরে, প্রদীপের নড়াচড়া আর ধূলোমাখা বাতাসের মধ্যে এক পরিস্কার রূপ ধারণ করল—সাদা পোশাকে এক বয়স্ক পুরোহিত, যার চোখে করুণ দৃষ্টি, হাতে জপমালা ধরে এক অদ্ভুত মনোযোগে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। প্রতিটি শব্দে ঘরের নীরবতা কেঁপে উঠছে, আর প্রতিমার ভাঙা মুখমণ্ডল যেন তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। অরিন্দম প্রথমে ভয় পেল, মনে হলো, তার চোখের সামনে একটি জীবন্ত ইতিহাস চলমান, যা কল্পনার চেয়েও গভীর।

পুরোহিত ধীরে ধীরে অরিন্দমের দিকে তাকাল, কিন্তু তার চোখে কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই। বরং করুণার মিশ্র এক অদ্ভুত শান্তি। তিনি যেন বছরের পর বছর ধরে আটকে থাকা মন্ত্রজপের শক্তিকে বহন করছেন। অরিন্দম বুঝল, এই উপস্থিতি কোনো দৈত্য বা ভূত নয়; এটি হলো সেই পুরোহিতের আত্মা, যিনি মহালয়ার দিনে মৃত্যু বরন করেছেন, আর তাঁর সাধনা থেমে গেছে অসমাপ্ত। প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ, প্রতিটি জপমালার স্পর্শ—সবই তার চারপাশের বায়ুকে পূর্ণ করছে, এবং অরিন্দম অনুভব করল, ভয়ের সঙ্গে এক অদ্ভুত প্রশান্তি মিলেছে। সে হালকা ফ্ল্যাশলাইটের আলো হাতে ধরে স্থির থেকে দেখছে, যেন দেখছে এক অনন্তকাল ধরে আটকে থাকা সাধনার দৃশ্য। ঘরের প্রতিটি ছায়া যেন এই আবির্ভূতের প্রতি সাড়া দিচ্ছে, ধুলো নড়ছে, প্রদীপের জ্বলে ওঠা নিভে যাওয়া ঘটছে সমন্বয়ে, আর সবকিছু মিলিয়ে এক অলৌকিক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। অরিন্দম বুঝতে পারল, সাহসের সঙ্গে উপস্থিতি গ্রহণ করলেই এই রহস্যের সত্য স্পষ্ট হয়।

পুরোহিতের চোখের করুণ দৃষ্টি অরিন্দমের দিকে থাকলেও তার মনের মধ্যে কোনো ভয় নেই। অরিন্দম অনুভব করল, এই আবির্ভাব তার কৌতূহল ও সততার প্রতিদান। তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মন্ত্রজপে লিপ্ত, কিন্তু ধীরে ধীরে অরিন্দমের উপস্থিতিকে স্বীকার করছেন, যেন জানাচ্ছেন, বহু বছর ধরে আটকে থাকা আত্মা কোনো ক্ষতি করতে চায় না, বরং জানাতে চায় সত্যের গল্প। অরিন্দম হালকা কণ্ঠে বলল, “আমি ভয়ে এসেছি না, জানতে এসেছি।” পুরোহিতের উপস্থিতি আরও স্পষ্ট হলো—তার সাদা পোশাকের ছায়া, করুণ চোখ, জপমালার স্পর্শ—সবকিছু যেন এক গভীর নিঃশব্দের আলোয় ভেসে উঠল। ঘরের প্রতিটি ধুলো কণা, প্রতিমার ভাঙা অংশ, প্রদীপের আলো—সবই একত্র হয়ে এই ভোরকে অদ্ভুতভাবে পবিত্র করে তুলল। অরিন্দম বুঝল, পুরোহিতের আত্মা আটকে নেই শুধুই ভয়ের কারণে; এটি আটকে আছে যে সাধনার অসমাপ্ততার মধ্যে। সেই ভোরবেলায়, অরিন্দমের চোখের সামনে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠল—অদৃশ্য শক্তি আর সাহসের মিলনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো, যা তাকে ভয়ের চেয়ে সত্যের আরও কাছাকাছি নিয়ে এল।

ভোরের হালকা কুয়াশার মধ্যে অরিন্দম এখনও বসে আছে ভাঙা প্রতিমার সামনে। পুরোহিতের আবির্ভাব তাকে নতুন এক বোধে আনে—ভয় আর কৌতূহলের মধ্যে মিশে এক গভীর শান্তি। ধীরে ধীরে তিনি অরিন্দমের দিকে তাকালেন, করুণ দৃষ্টি, ভাঙা হাতের জপমালা আর গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণে বললেন, “আমার মৃত্যু হয়েছিল মহালয়ার দিনে, পূজা অসমাপ্ত রেখে। সেই কারণে আমি আজও এখানে আটকে আছি। প্রতিবার মহালয়ার ভোরে আমার মন্ত্র বাধ্য হয়ে উচ্চারিত হয়।” অরিন্দম অবাক, তবুও স্থির থেকে শুনছে। সে বুঝতে পারল, যে সুর, যে ধোঁয়া, যে অদৃশ্য উপস্থিতি—সবই কোনো কল্পনার সৃষ্টি নয়; এটি বাস্তব। পুরোহিতের আত্মা যে আটকে আছে, তার কারণ একটাই—অসমাপ্ত সাধনা। অরিন্দম মনে করল, মানুষের জীবনে অসমাপ্ত কাজ যেমন মানসিকভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করে, তেমনি মহালয়ারের এই বিশেষ দিনে প্রার্থনা থেমে যাওয়ায় আত্মাও বেঁচে থাকতে চায়, শান্তি পায় না।

পুরোহিতের কথায় ঘরটি যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে বাতাস নড়ে গেল, ধুলো কণার নীরব নড়াচড়া বেড়ে গেল। অরিন্দম লক্ষ্য করল, জপমালা ধীরে ধীরে তাঁর হাত থেকে ঝরে পড়ছে না; মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে যেন একটি সেতু তৈরি হচ্ছে জীবিত ও অদৃশ্য জগতের মধ্যে। তিনি বললেন, “প্রতিটি মহালয়ার ভোরে আমি আমার সাধনা পুনরায় শুরু করি, কিন্তু শেষ করতে পারি না। আমি চাই কেউ আসে, দেখুক সত্যি কি ঘটেছে, আমার কষ্ট অনুভব করুক। কেউ যদি আমাকে পূজা সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করে, তবে হয়তো আমি মুক্তি পাব।” অরিন্দম অনুভব করল, ভয়ের পিছনে রয়েছে শুধু অসমাপ্ত দায়িত্বের বোঝা। এবং এই উপলব্ধি তার মনে এক অদ্ভুত দায়িত্ববোধ জাগায়। সে ভেবেছিল শুধু রহস্যের মুখোমুখি হবে, কিন্তু এখন বুঝতে পারল, সে এমন এক কাজের সাক্ষী হয়েছে যা মৃত্যুর পরেও চলতে থাকে—অসমাপ্ত পূজার বন্ধন।

রাতের শেষ দিক থেকে ভোরের আলো আসে, আর অরিন্দম বসে থাকে প্রতিমার ভাঙা অংশের পাশে। তিনি বুঝতে পারল, পুরোহিতের আত্মা তার কণ্ঠে নেই, ভঙ্গিতে নেই, বরং যে মানসিক বাঁধন তাকে আটকে রেখেছে, সেই অসমাপ্ত কাজের কারণেই তার উপস্থিতি এখনও গ্রামে স্পষ্ট। অরিন্দম স্থির থেকে ভাবল, সত্যিই মুক্তি কেবল ভয়ে নয়, বরং দায়িত্ব ও পূজার পূর্ণতা দিয়ে আসে। পুরোহিতের চোখে করুণা ও শান্তি মিশ্রিত এক দৃষ্টিতে সে দেখল, ভয়ের চেয়ে বোধ আরও শক্তিশালী, আরও গভীর। অবশেষে অরিন্দম সিদ্ধান্ত নিল, মহালয়ারের সকালে সে গ্রামে ফিরে গিয়ে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মিলিত হবে, পূজার বিস্তারিত জানাবে এবং দেখাবে, কিভাবে একজন সত্যিকারের ভক্তের অসমাপ্ত সাধনা জীবনের ধারায় প্রভাব ফেলতে পারে। সেই ভোরে, অরিন্দম বুঝল, সাহস এবং দায়িত্ব মিলিয়ে কখনো অসমাপ্ত কাজও সমাধান করা যায়।

মহালয়ারের আগের রাতটি গ্রামের জন্য বিশেষ হয়ে উঠল। অরিন্দম জানাল যে সে এবার পুরোহিতের অসমাপ্ত পূজা সম্পূর্ণ করবে, আর গ্রামের সবাইকে সে সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাল। প্রথমে গ্রামের কিছু মানুষ কৌতূহলী হলেও দ্বিধাগ্রস্ত ছিল—ভয় তো বহু বছর ধরে তাদের মনে ঢুকে আছে। কিন্তু অরিন্দমের দৃঢ় মনোবল, তার সাহসী চোখ এবং গত রাতের অভিজ্ঞতা তাদের ভাবনার সীমা ভেঙে দিল। সে ধীরে ধীরে প্রতিটি বাড়িতে ঘুরে তাদের বোঝাল, যে ভয়ের কোনো ভিত্তি নেই, বরং যদি সবাই একসাথে পূজা করে, তাহলে পুরোহিতের আত্মা মুক্তি পাবে এবং গ্রামের উপর থেকে এই দীর্ঘদিনের রহস্যময় প্রতিধ্বনি সরবে। গ্রামের বয়স্করা, যারা বহু বছর ধরে চুপচাপ শুধু ভয়ের কাছে মাথা নত করেছিল, এবার এক অদ্ভুত উদ্দীপনায় প্রতিক্রিয়া দেখালেন। তারা অরিন্দমের সঙ্গে মিলিত হয়ে সকল আনুষ্ঠানিকতা এবং পূজার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করল।

পরের সকাল, মহালয়ারের ভোরে, গ্রামের মানুষ একত্রিত হলো ভাঙা বাড়ির আঙিনায়। অরিন্দম নেতৃত্বে স্থিরভাবে দাঁড়ালো, ফ্ল্যাশলাইট বা কোনো অতিরিক্ত আলো ছাড়াই। প্রতিটি মানুষ ভীত সত্ত্বেও উপস্থিত—শিশু থেকে বৃদ্ধ, সকলেই। অরিন্দম ধীরে ধীরে জানাল, কিভাবে ধূপকাঠি, মাটির প্রদীপ, ফুল এবং মন্ত্রপাঠ ব্যবহৃত হবে। তিনি জানালেন, পূর্বপুরুষের নিয়ম অনুযায়ী পূজা সম্পূর্ণ করা হবে। ধীরে ধীরে চণ্ডীপাঠ শুরু হলো, এবং অরিন্দম দেখল, পুরোহিতের অদৃশ্য উপস্থিতি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করল—সাদা পোশাক, করুণ দৃষ্টি, জপমালার স্পর্শ, সবকিছু যেন শান্ত ও স্থির। মানুষের একতা, তাদের বিশ্বাস, এবং অরিন্দমের সাহস মিলিয়ে সেই শক্তিকে শক্তিশালী করল। প্রতিটি মন্ত্রোচ্চারণে বাতাসে এক অদ্ভুত কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো, কিন্তু এবার তা ভয়ের নয়, বরং মুক্তির বার্তা বহন করল।

শেষ পর্যায়ে, যখন পূজার সমস্ত আচার সম্পূর্ণ হলো, অরিন্দম দেখল, পুরোহিতের আত্মা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল। করুণ দৃষ্টি এখন প্রশান্তিতে পরিণত হলো, জপমালা হাত থেকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল, এবং চণ্ডীপাঠের সুর অবিরামভাবে বাতাসে ভেসে থাকা বন্ধ হলো। গ্রামবাসীরাও অনুভব করল, দীর্ঘদিনের রহস্যময় ভয়ের পরিবর্তে এক অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। অরিন্দম স্থির থেকে হাসল, বোঝাল যে সাহস, একতা এবং দায়িত্ববোধের মাধ্যমে অসমাপ্ত কাজও সমাধান করা যায়। পুরোহিতের আত্মা অবশেষে মুক্ত হলো, আর ভাঙা বাড়ির অন্ধকার এখন শান্তিতে ভরে গেল। সেই ভোরের আলো, গ্রামের মানুষদের মনে সাহস এবং শান্তি নিয়ে এল, আর অরিন্দম বুঝল, কখনো কখনো একটি দৃঢ় মনোবল, কৌতূহল এবং মানবিক দায়িত্ব মানুষের এবং ইতিহাসের উপর এমন প্রভাব ফেলতে পারে, যা বহু বছর ধরে আটকানো সত্যকেই মুক্তি দিতে সক্ষম।

মহালয়ার ভোরের কুয়াশা গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, আর সেই সঙ্গে অদ্ভুত উত্তেজনা ও আস্থা সকলের মনে জাগ্রত হয়। বহু বছর পর গ্রামবাসী ভাঙা বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন, যেখানে বহু প্রজন্ম ধরে অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি তাদের মনে ভয়ের ছাপ রেখেছিল। অরিন্দম নেতৃত্বে সকলেই উপস্থিত হলো, তার চোখে দৃঢ়তা, মুখে সাহস, আর হৃদয়ে দৃষ্টান্তমূলক দায়িত্ববোধ। প্রতিটি মানুষ ছোট থেকে বড়, বৃদ্ধ থেকে শিশু—সকলেই একত্রিত হলো। ঘরের ভাঙা দেয়াল, ধুলোমাখা ফ্লোর এবং ছেঁড়া ধূপকাঠির মধ্যে এখন এক নতুন প্রাণের অনুভূতি ছড়াল। অরিন্দম তাদের বোঝাল, ভয়ের কোনো ভিত্তি নেই; তাদের উপস্থিতি, একতা এবং বিশ্বাসই পুরোহিতের আত্মাকে মুক্ত করতে পারে। প্রতিটি মানুষ ধীরে ধীরে তার নিজের জায়গায় দাঁড়াল, এবং ভাঙা প্রতিমার কাছে নতুন করে পাথরের তৈরি প্রতীক স্থাপন করা হলো, যেন এটি পুরনো ইতিহাসের সম্মান জানানো হয়। বাতাসে হালকা কুয়াশার সঙ্গে চণ্ডীপাঠের প্রথম উচ্চারণ ভেসে এলো, ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

যেমন চণ্ডীপাঠ ধ্বনিত হতে থাকল, গ্রামের মানুষদের মনে অদ্ভুত অনুভূতি জাগল। প্রতিটি মন্ত্রের শব্দ যেন ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে প্রতিস্বরিত হচ্ছে, এবং হঠাৎ মনে হলো, অদৃশ্য কারও কণ্ঠ তাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অরিন্দম লক্ষ্য করল, যে পুরোহিতের অদৃশ্য উপস্থিতি এখন স্পষ্ট; তিনি শান্ত ও স্থির, কিন্তু তার শক্তি সবার চারপাশে প্রবাহিত হচ্ছে। কেউ কেউ হালকা দমবন্ধের অনুভূতি পেলেও ভয়ের বদলে তারা এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করল। চণ্ডীপাঠের প্রতিটি শব্দ, মন্ত্রের উচ্চারণ, ফ্ল্যাশলাইট বা প্রদীপের নরম আলো—সবই মিলিয়ে এক মহিমান্বিত পরিবেশ তৈরি করল। অরিন্দম ধীরে ধীরে প্রতিটি ধাপ পর্যবেক্ষণ করল, দেখল যে গ্রামের মানুষদের একতার শক্তিই মূল—প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ পুরোহিতের আত্মার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, আর তা তার বাঁধন ভাঙছে। প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বুঝল, বহু বছর ধরে আতঙ্কিত গ্রামের মানুষদের এই সমবেত আস্থা এক নতুন শক্তি তৈরি করছে, যা শুধু অদৃশ্য শক্তিকে নয়, বরং তাদের নিজেদের সাহস ও ঐক্যকেও মুক্তি দিচ্ছে।

মহালয়ারের সকাল ক্রমশ উঠতে থাকল, আর পূজার শেষ মুহূর্তে, অরিন্দম অনুভব করল, সমস্ত আতঙ্ক, রহস্য এবং অসমাপ্ত সাধনা মিলিয়ে এক বিশাল প্রশান্তির অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে। ধীরে ধীরে, অদৃশ্য পুরোহিতের আত্মা স্থির হয়ে গেল, তার করুণ দৃষ্টি এখন প্রশান্তির আলোয় ভরে উঠল। গ্রামের মানুষ অনুভব করল, বহু বছরের ভয়ের পরিবর্তে তারা এক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াল—যেখানে সাহস, কৌতূহল এবং একতার মাধ্যমে অসমাপ্ত সাধনা সম্পূর্ণ হলো। চণ্ডীপাঠের প্রতিধ্বনি এখন ভয়ে নয়, বরং মুক্তি, একতা এবং প্রার্থনার শক্তি হিসেবে বাতাসে ভেসে থাকল। অরিন্দম স্থির দাঁড়িয়ে দেখল, এক দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকা ইতিহাসের চূড়ান্ত সমাধি ঘটল—অদৃশ্য শক্তি প্রশান্ত হলো, গ্রামের মানুষদের মনে শান্তি এলো, আর ভাঙা বাড়ির অন্ধকার এখন আলোয় ভরে উঠল। সেই ভোরে সবাই বুঝল, সাহস, ঐক্য এবং দায়িত্ববোধের মাধ্যমে অসমাপ্ত কাজকে পূর্ণ করা সম্ভব, এবং এটি শুধু মানুষের মধ্যে নয়, ইতিহাসের মধ্যেও মুক্তির বার্তা বয়ে আনে।

১০

মহালয়ারের পূজা শেষে, যখন প্রতিটি মন্ত্র উচ্চারিত হয়ে শেষ পর্যায়ে পৌঁছালো, গ্রামের মানুষজন এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করল। ভাঙা বাড়ির ভেতর এবং আঙিনার চারপাশে এখন কোনো অদ্ভুত ফিসফিস বা অদৃশ্য কণ্ঠের প্রতিধ্বনি নেই। বাতাস নীরব, শুধু পাখির ডাকে ভোরের সূচনা বোঝা যাচ্ছে। অরিন্দম স্থির দাঁড়িয়ে প্রতিটি মানুষের মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করল—ভয় আর কৌতূহল মিশে এক অদ্ভুত শান্তি। তিনি বুঝতে পারলেন যে, বহু বছরের রহস্য, দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাসীর মনে ভয়ের বীজ বোনা ইতিহাস, অবশেষে সমাধান পেয়েছে। পুরোহিতের আত্মা মুক্ত, আর তার করুণ দৃষ্টি আর অদৃশ্য উপস্থিতি এখন শান্তি ও প্রশান্তি হয়ে বাতাসে ভেসে আছে। গ্রামের মানুষজন অবাক, যেন তারা দীর্ঘদিনের অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়ে এসেছে।

পুরোহিতের মুক্তির পর ভাঙা বাড়ি আর কোনো ভয়ের জায়গা নয়। বরং সেটি হয়ে উঠল গ্রামের মিলনকেন্দ্র—যেখানে সবাই একত্রিত হয়ে একে অপরের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। অরিন্দম দেখল, গ্রামের বয়স্করা শিশুরা হাতে হাত মিলিয়ে হাঁটছে, কথাবার্তা চলছে, আর একে অপরকে গল্প শোনাচ্ছে—যেমন দীর্ঘদিন ধরে কেউ বলতে সাহস পায়নি। ছেঁড়া ধূপকাঠি আর প্রতিমা এখন পুনর্গঠিত হয়ে নতুন আকার পেয়েছে, আর প্রতিটি ফুল, প্রদীপ এবং সাজ-সজ্জা যেন ভাঙা ইতিহাসকে পূর্ণ করে দিয়েছে। অরিন্দম অনুভব করল, সাহস, কৌতূহল, এবং দায়িত্ববোধের মিলন এক শক্তিশালী পরিবর্তনের সূচনা করেছে। গ্রামবাসীরা বুঝল, ভয়ের পরিবর্তে যখন একতা ও বিশ্বাস থাকে, তখন অসমাপ্ত কাজও সমাধান করা সম্ভব। ঘরের প্রতিটি কোণ, প্রতিমার ভাঙা অংশ, আর বাতাসে ভেসে থাকা মৃদু আলো—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্তি সৃষ্টি করছে, যা শুধু মানুষ নয়, ইতিহাসকেও ছোঁয়।

নীলাভ ভোরের আলোয়, অরিন্দম ধীরে ধীরে গ্রামবাসীর দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল, ভাঙা বাড়ি আর ভয়ের প্রতীক নয়; এটি এখন শিক্ষা, সাহস এবং একতার প্রতীক। গ্রামের মানুষজন নতুন এক আশায় ভরে গেছে—যেখানে তারা অতীতের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতের পথে এগোতে পারবে। প্রতিটি মুখে হাসি, প্রতিটি চোখে প্রশান্তি, আর প্রতিটি হৃদয়ে এক অদৃশ্য শক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা। অরিন্দমের মনে একটি গভীর উপলব্ধি জেগে উঠল—কেউ সাহসী মন নিয়ে এগিয়ে এলে, ইতিহাসের আটকে থাকা অধ্যায়ও পূর্ণ হয়ে যেতে পারে। সেই নীরব ভোরে, ভাঙা বাড়ি আর শুধু পুরোহিতের সাধনার সাক্ষী নয়; এটি হয়ে উঠল গ্রামের মানুষের সাহস, বিশ্বাস এবং ঐক্যের এক নতুন প্রতীক।

-শেষ-

1000066392.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *