সৌরভ নাগ
১
ভারতের প্রত্যন্ত এক ছোট্ট গ্রাম, চারদিকে বিস্তৃত ধানক্ষেত, দূরে দূরে তালগাছ আর মাঝখানে মাটির ঘরগুলির সারি। দিনের বেলা গ্রামটি শান্ত, মানুষজন তাদের ফসল ও গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থাকে, আর সন্ধ্যা নামলেই যেন গ্রামটা ঢেকে যায় অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায়। আকাশভরা তারার নীচে সারা গ্রাম যখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনা। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত, চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে, কেবল কিছু ঘরে কুপির আলো দপদপ করছে। সেই সময় হঠাৎ মেঘলা, গ্রামেরই এক কিশোরী, উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে আকাশ দেখার অভ্যেস করেছে ছোটবেলা থেকে, তার মনে হয় রাতের আকাশে লুকিয়ে আছে হাজারো গল্প, হাজারো রহস্য। কিন্তু সেদিনের দৃশ্য তার আগে কখনো দেখা হয়নি—দিগন্তের ওপরে যেন এক অচেনা আগুনের রেখা, আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেটি বিস্ফোরণের মতো ঝলসে উঠল, ছড়িয়ে পড়ল এক নীলচে সবুজ আলো। মেঘলা স্তব্ধ হয়ে গেল, তার চোখে ভেসে উঠল বিস্ময়, শরীরে কেঁপে উঠল অদ্ভুত এক অনুভূতি, যেন সেই আলো তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, তার রক্তে মিশে যাচ্ছে।
গ্রামবাসীরা তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হুলস্থুল শুরু করে দিল। কারও মুখে শোনা গেল, “ডাকিনী নেমেছে!” আবার কেউ চেঁচিয়ে উঠল, “এই তো সেই অশুভ শক্তি, যাকে দাদুরা ভয় করত!” গ্রামের প্রবীণ মহিলারা কাঁথা দিয়ে মাথা ঢেকে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগল, পুরুষেরা লাঠি হাতে চিৎকার করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ভয় আর গুজব মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এই গ্রামে যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস আছে—আকাশে অদ্ভুত আলো মানেই কোনো অশুভ আত্মার আবির্ভাব, যা মর্ত্যে নেমে আসবে মানুষের ক্ষতি করতে। অথচ মেঘলা সেই আলো দেখে ভয় পেল না, বরং তার ভেতরে এক অদ্ভুত টান অনুভব করল। তার মনে হচ্ছিল, ওই আলো তাকে ডাকছে, তার কাছে কিছু বলতে চাইছে। গ্রামের লোকজন যখন আতঙ্কে ছুটোছুটি করছে, তখন মেঘলা দাঁড়িয়ে রইল একেবারে নিশ্চুপ, দু’চোখ মেলে দেখল আলোর ভেতরকার রহস্য। এমনকি যখন আলো ক্রমশ নিভে গিয়ে আবার অন্ধকার ফিরে এল, তখনও তার মনে হল—এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, এর পেছনে আছে এমন কিছু, যা মানুষের কল্পনারও বাইরে।
সেদিন রাতে মেঘলার ঘুম আসেনি। সে বিছানায় শুয়ে বারবার চোখ বন্ধ করছিল, আবার হঠাৎ উঠে গিয়ে জানলার বাইরে তাকাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, আকাশের ওই নীলচে সবুজ ঝলকানি যেন তাকে লক্ষ্য করেই এসেছিল। মেঘলার কানে যেন ভেসে আসছিল অদৃশ্য এক সুর, এমন এক ধ্বনি যা অন্য কেউ শোনেনি। এই অনুভূতিই তাকে বিভ্রান্ত করছিল—সে কি সত্যিই ডাকিনীর প্রভাবাধীন হয়ে পড়ছে, নাকি এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য লুকিয়ে আছে? সে জানত, গ্রামের মানুষ তার এই কৌতূহল মেনে নেবে না। ওরা তাকে হয়ত অভিশপ্ত বলবে, দূরে সরিয়ে দেবে। কিন্তু তার অন্তরে যে প্রশ্ন জাগল, তা দমন করা আর সম্ভব হল না। “কেন আমি এই আলো দেখলাম? কেন আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল? এই রহস্যের উত্তর কোথায়?”—এইসব ভাবতে ভাবতেই রাত কেটে গেল। ভোরের আলো ফুটতেই মেঘলা বুঝল, তার জীবন আর আগের মতো সহজ-সরল থাকবে না। এই আকাশের অদ্ভুত আলো তার জন্য খুলে দিয়েছে এক নতুন পথ—রহস্য, ভয়, আর অজানার সন্ধানের পথ। সেই রাতেই অজান্তে তার নিয়তি জড়িয়ে গেল মহাজাগতিক এক গোপন শক্তির সঙ্গে, যার প্রভাব সে খুব শিগগিরই অনুভব করতে চলেছে।
২
পরদিন সকালে গ্রামে আলোড়ন ছিল তুঙ্গে। রাতের সেই রহস্যময় আলোর কথা সবাই বলাবলি করছিল, কেউ বলছে অশুভ শক্তির আবির্ভাব, কেউ আবার এটাকে দেবীর অলৌকিক রূপ ধরে নিয়ে পূজা-অর্চনা শুরু করেছে। কিন্তু মেঘলা সবার থেকে আলাদা হয়ে নিঃশব্দে বসেছিল তাদের উঠোনের কোণে, মন ভরে আকাশের দিকে তাকিয়ে। তার ভিতরে অজানা এক টান, এক অস্থিরতা। ঠিক তখনই দাদু হরিদাস লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসে তার পাশে বসলেন। দাদুর চোখে ছিল বয়সের ছাপ, কিন্তু দৃষ্টি ছিল গভীর আর রহস্যময়। তিনি মেঘলার মাথায় হাত রেখে ধীর স্বরে বললেন, “ভয় পেয়ো না, ওই আলো তোমার শত্রু নয়। বরং সেটা তোমাকে চিনছে।” মেঘলা বিস্মিত হয়ে তাকাল, “আমাকে চিনছে মানে? দাদু, আপনি কী বলতে চাইছেন?” দাদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালেন চারদিকে, যেন তিনি বহু বছর ধরে লুকিয়ে রাখা এক ভারী বোঝা নামাতে যাচ্ছেন। “শোন মেঘলা,” তিনি ফিসফিস করে বললেন, “আমাদের রক্তে আছে আকাশের ছাপ। তুই শুধু এই মাটির মেয়ে নোস, তোর ভেতরে বইছে এক মহাজাগতিক উত্তরাধিকার।”
দাদু তখন ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন বহু পুরনো এক কাহিনি। অনেক বছর আগে, হয়ত শত শত বছর, এক ঝড়ো রাতে আকাশ থেকে নেমে এসেছিল এক আলোকযান। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে পালিয়ে যায়, কিন্তু তখনকার বংশের এক কিশোর সাহস করে গিয়ে তার মুখোমুখি হয়। সেই যান থেকে বেরিয়ে আসে এক অচেনা মানুষ—চোখে ধাতব ঝিলিক, দেহে অদ্ভুত শক্তির আভা। সে আহত হয়েছিল, আর আশ্রয় নিয়েছিল এই গ্রামে। গ্রামের সেই কিশোরই তাকে লুকিয়ে রাখে, সুস্থ করে তোলে, আর সেই অচেনা মানুষ ধীরে ধীরে তার জীবনের সঙ্গে মিশে যায়। শোনা যায়, তাদের মিলনে জন্ম নেয় এক রক্তধারা, যার ভেতরে লুকিয়ে থাকে মহাজাগতিক শক্তি। দাদু বললেন, “ওই অচেনা মানুষ ছিল ভিনগ্রহের বাসিন্দা, আর আমরা তার উত্তরসূরি। আমাদের বংশের প্রত্যেক প্রজন্মে কেউ না কেউ সেই শক্তির ছাপ নিয়ে জন্মায়। আমি জানতাম, একদিন হয়ত তোর ভিতর সেই শক্তি জেগে উঠবে।” মেঘলা শুনে হেসে উঠল, “দাদু, এসব তো রূপকথার মতো শোনাচ্ছে! মানুষ আবার আকাশ থেকে আসে নাকি?” কিন্তু তার হাসির মধ্যেও চোখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত কৌতূহল।
দাদু হরিদাস মৃদু হেসে বললেন, “রূপকথা বলে তুই উড়িয়ে দিচ্ছিস, কিন্তু সত্যি কখনো কখনো কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর হয়। তুই কি মনে করিস গত রাতের আলোটা শুধু কাকতালীয়? কেন তুই একা ওর টান অনুভব করলি? গ্রামের আর কারও ভেতর তো এমন কিছু ঘটল না!” মেঘলার মনে প্রশ্নের ঝড় উঠল। সত্যিই তো, কেন তার শরীর কেঁপে উঠেছিল? কেন সে একা সেই আলোকে ভয় না পেয়ে আকর্ষণ অনুভব করেছিল? দাদুর কণ্ঠ আরও নিচু হলো, তিনি বললেন, “তুই বুঝতে পারছিস না মেঘলা, ওই আলো তোর সঙ্গে কথা বলছে। তোর ভেতরের রক্ত তার সাড়া দিয়েছে। তোর শরীরেই সুপ্ত আছে সেই শক্তি, যা একদিন তোর ভাগ্য পাল্টে দেবে।” মেঘলার হাসি থেমে গেল, বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা জন্ম নিল। সে বুঝতে পারছিল, দাদু হয়ত একেবারে মিথ্যা বলছেন না। অদ্ভুত এক স্রোত যেন বইছে তার শিরায়। রাতের সেই আলো আর দাদুর কাহিনি মিলিয়ে তার মনে গড়ে উঠতে লাগল এক নতুন জগৎ—যেখানে সে আর স্রেফ গ্রামের সাধারণ মেয়ে নয়, বরং এক মহাজাগতিক উত্তরাধিকারের ধারক। তবু ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল—সে কি বিশ্বাস করবে, নাকি সবটা কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেবে? এই দ্বিধার মধ্যেই মেঘলার হৃদয়ে অঙ্কুরিত হলো অদম্য কৌতূহল—সে জানবে, খুঁজে বার করবে সত্যিটা, যেভাবেই হোক।
৩
মেঘলার জন্য দিনগুলো ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত নতুন অভিজ্ঞতায় ভরে উঠছিল। রাতের সেই আলো ও দাদুর গল্পের পর থেকে তার ভেতরে যেন কিছু বদলে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রথমে সে বুঝতে পারেনি সেটা আসলে কী। এক বিকেলে যখন সূর্য ঢলে পড়েছে আর আকাশ লালচে আলোয় রঙিন হয়ে উঠেছে, মেঘলা কলস ভরে পানি আনতে গিয়েছিল গ্রামের পুকুরে। হঠাৎ পুকুরের জলে তার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে সে চমকে উঠল—তার চোখে অস্বাভাবিক এক ঝিলিক। স্বাভাবিক কালো চোখের ভেতর যেন নীলচে আলোর কণা ভাসছে, আর অন্ধকার হলে তা আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ভয় পেয়ে সে চোখ মুছে নিল, ভাবল হয়তো জলের প্রতিফলনের কারণে হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে আলো ফুটে উঠল তার চোখে, এমনভাবে যেন কোনো গোপন শক্তি ভিতরে জেগে উঠছে। সে তাড়াতাড়ি কলস হাতে বাড়ি ফিরে এল, কিন্তু মনের ভেতর থেকে গেল আতঙ্ক আর বিস্ময়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। রাতে যখন মেঘলা হাত ধোয়ার সময় নিজের তালুতে তাকাল, তখন দেখতে পেল অদ্ভুত সব নকশা ফুটে উঠেছে—বৃত্ত, রেখা আর অচেনা অক্ষরের মতো কিছু চিহ্ন। এগুলো প্রথমে হালকা আভায় ফুটে উঠেছিল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন হাতের ভেতর থেকেই আলো বের হচ্ছে।
এই দৃশ্য একসময় গ্রামের লোকদের চোখে পড়ে গেল। আশেপাশের মহিলারা প্রথমে ভেবেছিল সে হয়তো তেল মেখেছে বা কোনো অদ্ভুত খেলাচ্ছলে করেছে, কিন্তু যখন তারা নিজের চোখে তার তালুর আলো দেখতে পেল, তখন ভয়ে আঁতকে উঠল। “ডাকিনী! এ তো ডাকিনীর ছাপ!”—চেঁচিয়ে উঠল এক বৃদ্ধা, আর মুহূর্তের মধ্যে সেই কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে। গ্রামের মানুষ যাদের ভেতর ভয় আর কুসংস্কারের দানা বহু যুগ ধরে জমে আছে, তারা একসাথে জড়ো হয়ে মেঘলার বাড়ির সামনে ভিড় করতে লাগল। কেউ কেউ তার দিকে কাঁটা-চামচ, লাঠি কিংবা পাথর ছুঁড়ে দিল। মেঘলা হতভম্ব হয়ে গেল, সে তো বুঝতেই পারছে না কী হচ্ছে, কেন তার শরীর এমন আচরণ করছে। সে কেঁদে ফেলল, বলল, “আমি তো কিছু করিনি, আমি তো তোমাদের মতোই মানুষ!” কিন্তু কে শোনে কার কথা? যারা তাকে গতকাল পর্যন্ত ভালোবাসত, খাওয়াত, কাছে টানত, আজ তারাই তাকে ভয় পাচ্ছে, তাকে অভিশপ্ত ভাবছে। দাদু হরিদাস দাঁড়িয়ে ছিলেন একপাশে, তাঁর চোখ লাল হয়ে উঠেছিল ক্রোধে, তিনি চিৎকার করে বললেন, “ও ডাকিনী নয়, ও আমাদের রক্তের উত্তরাধিকার! তোমরা বুঝতে পারছ না।” কিন্তু গ্রামবাসীরা কারও কথা শুনতে রাজি নয়, তাদের চোখে মেঘলা এখন এক অশুভ ছায়া, যাকে দূরে সরিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এই পরিত্যক্ত হওয়ার যন্ত্রণা মেঘলার মনে গভীর দাগ কাটল। সে জানত, গ্রামের লোকেরা তাকে আর আগের মতো মেনে নেবে না, তাকে আলাদা করে রাখবে। সে বুঝতে পারল, এখন থেকে তাকে একা পথ চলতে হবে—কোনো সমর্থন ছাড়াই, শুধু নিজের কৌতূহল আর ভেতরের সেই অজানা শক্তিকে নিয়েই। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই সে এক অন্যরকম সংকল্প নিল। অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে সে মনে মনে বলল, “আমি ভয় পাব না। হয়তো সত্যিই আমার ভেতরে আছে সেই শক্তি, হয়তো দাদুর কথা মিথ্যে নয়। যদি তাই হয়, তবে আমি এই রহস্যের শেষ পর্যন্ত পৌঁছব। গ্রামের মানুষ আমাকে ডাকিনী বলুক, আমি জানি আমি তাদের শত্রু নই। আমি প্রমাণ করব, এই আলো কোনো অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ।” আর সেই রাত থেকেই মেঘলার শরীরে পরিবর্তন আরও তীব্র হতে লাগল—তার চোখ যখন অন্ধকারে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তখন সে অনেক দূর অব্দি দেখতে পায়; তার তালুর নকশাগুলো অচেনা শব্দে রূপান্তরিত হয়, যেন আকাশ থেকে আসা কোনো ভাষা তাকে ডাকছে। গ্রামবাসী ভয় পেয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিলেও, মেঘলা অনুভব করল—এই শক্তিই তার ভাগ্য, এই শক্তিই একদিন তাকে নিয়ে যাবে অজানার পথে।
৪
গ্রামে অশান্তির আবহ চলছিল টানা কয়েকদিন ধরে। রাতের আকাশে দেখা সেই অদ্ভুত আলোর ঘটনা এবং মেঘলার শরীরে ক্রমশ প্রকাশ পাওয়া রহস্যময় পরিবর্তনের কারণে গ্রামের মানুষ আতঙ্কিত, বিভ্রান্ত। কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনেকে তাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছে, আবার কেউ কেউ লুকিয়ে তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলছে। কিন্তু গ্রামের বাইরে, শহরে এই আলো নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যরকম আলোচনা। সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো—“অজানা আলোকবিন্দু: মহাকাশ থেকে সংকেত?”। এই আলোচনার মধ্যেই অরিন্দম নামের এক তরুণ জ্যোতির্বিদ খবর পেয়ে গ্রামে চলে আসে। অরিন্দম শহরের নামকরা মানমন্দিরে গবেষক হিসেবে কাজ করত, তার বিশেষত্ব ছিল উল্কাপাত এবং মহাজাগতিক আলো নিয়ে গবেষণা। গম্ভীর চেহারা, কাঁধে একটি ব্যাগ ভর্তি যন্ত্রপাতি, হাতে নোটবুক, চোখে জ্বলজ্বলে কৌতূহল—এই ভঙ্গিতেই সে গ্রামে প্রবেশ করল। গ্রামবাসীরা প্রথমে তাকে দেখে অবাক হলেও পরে স্বস্তি পেল, কারণ তারা ভেবেছিল শহর থেকে কেউ যদি আসে তবে হয়তো সব রহস্যের সমাধান করতে পারবে। অরিন্দম স্থানীয়দের থেকে শুনতে পেল মেঘলার অদ্ভুত কাহিনি। কিন্তু তার বৈজ্ঞানিক মন বিশ্বাস করল না এত সহজে, সে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানুষের শরীর থেকে আলো বেরোবে—এ আবার কেমন অযৌক্তিক কথা! নিশ্চয়ই কোনো ভ্রম বা মানসিক কল্পনা।”
অরিন্দম যখন প্রথমবার মেঘলার সঙ্গে দেখা করল, তখন গ্রামের একদল মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছিল। মেঘলা তখন উঠোনে বসে মাটিতে কাঠি দিয়ে অচেনা সব চিহ্ন আঁকছিল—যা সে নিজেও বোঝে না, কিন্তু তার হাত যেন নিজের ইচ্ছায় আঁকছে। অরিন্দম কাছে গিয়ে দাঁড়াল এবং নরম গলায় বলল, “তুমি মেঘলা? আমি শহর থেকে এসেছি, তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।” মেঘলা মাথা তুলল। তার চোখে সেই অদ্ভুত ঝিলিক। আলোটা খুব হালকা, কিন্তু তবুও স্পষ্ট। অরিন্দমের বুক হঠাৎ ধক করে উঠল। সে তো এ ধরনের কিছু প্রত্যাশা করেনি। চোখ বড় করে সে তাকিয়ে রইল, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। তার যুক্তিবাদী মস্তিষ্ক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। “এটা… এটা কি আলোর প্রতিফলন?”—মনে মনে ভাবল সে। কিন্তু চোখ যতই ঘষুক বা ঘনিষ্ঠভাবে দেখুক, বোঝা গেল—এটা কোনো সাধারণ প্রতিফলন নয়, বরং তার চোখ থেকেই ঝিলিক বেরোচ্ছে। মেঘলা ধীর কণ্ঠে বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে না। কেউ করে না। সবাই আমাকে ডাকিনী বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি জানি, আমার ভেতরে কিছু একটা ঘটছে।” অরিন্দম নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তাকে সবসময় প্রমাণ, যুক্তি আর তথ্যের ওপর ভরসা করতে হয়। কিন্তু চোখের সামনে দেখা দৃশ্যকে সে উপেক্ষা করতে পারছিল না।
সেদিন সন্ধ্যায় অরিন্দম মেঘলার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলল। মেঘলা তাকে সব খুলে বলল—রাতের আলো, শরীরে অদ্ভুত পরিবর্তন, হাতের তালুতে নকশা ফুটে ওঠা, গ্রামের মানুষের ভয় আর ঘৃণা। অরিন্দম প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনল, মাঝে মাঝে নোটবুকে লিখে নিল। তার ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল—একদিকে তার বিজ্ঞান বলছে, “এটা অসম্ভব”, আর অন্যদিকে তার চোখে দেখা প্রমাণ বলছে, “এটা সত্যিই ঘটছে।” সে সিদ্ধান্ত নিল, মেঘলার শরীরে যে পরিবর্তন হচ্ছে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কেবল গবেষণার তাগিদেই নয়, আরও গভীর কিছু তাকে মেঘলার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। হয়তো সেটা ছিল কৌতূহল, হয়তো সহানুভূতি, আবার হয়তো এক অদ্ভুত আকর্ষণ। রাত নামার আগে অরিন্দম মেঘলাকে বলল, “আমি তোমার পাশে আছি। তোমার মধ্যে যা ঘটছে, সেটা কোনো অভিশাপ নয়—এটার একটা ব্যাখ্যা আছে, হয়তো আমাদের বিজ্ঞান এখনো পুরোটা বুঝে ওঠেনি। আমি সেটা খুঁজে বের করব।” মেঘলা প্রথমবার কারও চোখে বিশ্বাসের ছায়া দেখল, আর তার বুক ভরে উঠল অদ্ভুত এক স্বস্তিতে। সে বুঝতে পারল, গ্রাম যতই তাকে প্রত্যাখ্যান করুক, অন্তত একজন আছে যে তাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করছে। আর সেই মানুষটাই হয়তো হয়ে উঠবে তার সবচেয়ে বড় সহযাত্রী—অজানার পথে যাত্রার শুরুতে।
৫
সেই রাতটা ছিল অদ্ভুতভাবে অশান্ত। আকাশে মেঘ জমে ছিল, চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল জঙ্গলের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছিল। মেঘলা তখন একা বনের ভেতর হাঁটছিল, মাথার মধ্যে অগণিত প্রশ্ন ঘুরছিল—দাদুর গল্প, শরীরের পরিবর্তন, আর অরিন্দমের চোখে দেখা বিশ্বাস। গ্রামের মানুষ তাকে এড়িয়ে চলে, কিন্তু তার ভেতরে জেগে উঠেছিল এক অদম্য কৌতূহল—এই সবকিছুর উৎস কোথায়? বনের গভীরে ঢুকতে ঢুকতে হঠাৎ তার বুক কেঁপে উঠল। বাতাস যেন হঠাৎ স্থির হয়ে গেল, গাছের পাতা নড়াচড়া থেমে গেল, চারপাশের শব্দ নিঃশেষ হয়ে এক ভৌতিক নীরবতা নেমে এলো। মেঘলা অনুভব করল, কেউ তাকে লক্ষ্য করছে, অদৃশ্য দৃষ্টি যেন তাকে ভেদ করে যাচ্ছে। সে থেমে দাঁড়াল, কিন্তু চারদিকে কাউকে দেখা গেল না। তখনই এক অদ্ভুত আলো ঝলসে উঠল সামনের গাছের আড়াল থেকে, আর ধীরে ধীরে এক মানুষের ছায়া বেরিয়ে এলো। মেঘলার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। অচেনা সেই মানুষ লম্বা, দেহ সুগঠিত, মুখে অদ্ভুত গাম্ভীর্য, আর তার চোখে এক অস্বাভাবিক ধাতব ঝিলিক। মেঘলা মুহূর্তের জন্য ভয়ে জমে গেল, কিন্তু সেই চোখের দৃষ্টি এতটাই ভিন্নধর্মী ছিল যে তার শরীর শিহরিত হয়ে উঠল।
অচেনা মানুষটি ধীরে ধীরে মেঘলার দিকে এগিয়ে এল। তার গলার স্বর ছিল গভীর, যেন দূর থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, “তুই-ই সে… আমি তোকে চিনেছি।” মেঘলা বিস্ময়ে বলল, “চিনেছ? তুমি কে?” লোকটির ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে ছিল না কোনো উষ্ণতা, বরং এক অদ্ভুত রহস্যময়তা। সে বলল, “আমাদের ভাষায় তোকে বলা হয় ‘ধারক’—যে মহাজাগতিক শক্তিকে বহন করে। শত শত বছর ধরে আমরা খুঁজছি আমাদের হারানো শক্তির উত্তরাধিকারীকে। আর আজ, অবশেষে, আমি তোকে সামনে পেলাম।” মেঘলার মাথা ঘুরে গেল। দাদুর বলা গল্প হঠাৎ বাস্তব হয়ে ধরা দিল। সে তো সত্যিই কোনো সাধারণ মানুষ নয়, তার রক্তে বইছে সেই ভিনগ্রহের উত্তরাধিকার! কিন্তু অচেনা মানুষটির চোখে এমন এক দৃষ্টি ছিল, যা তাকে একইসাথে কৌতূহলী এবং ভীত করে তুলল। মেঘলা কাঁপা গলায় বলল, “তুমি আসলে কে?” লোকটি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমার নাম অর্ক। আমি এসেছি দূর মহাকাশ থেকে। আমার জাতি যুদ্ধের আগুনে জ্বলছে, আর সেই যুদ্ধ থামাতে পারবে কেবল তোর ভেতরের শক্তি। তোর রক্তে যে শক্তি বইছে, সেটাই আমাদের প্রয়োজন।”
অর্কের কথা শুনে মেঘলার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল। সে একদিকে বিস্মিত, অন্যদিকে আতঙ্কিত। তার চোখে ধাতব ঝিলিক তাকে স্মরণ করিয়ে দিল সেই রাতের আলোকে, যা তার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। অর্ক ধীরে ধীরে তার হাত বাড়াল মেঘলার দিকে, যেন সে তাকে নিজের দলে টানতে চায়। কিন্তু মেঘলা পিছিয়ে গেল। সে বুঝল, অর্ক যদিও তাকে চিনেছে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য হয়তো শুদ্ধ নয়। তার কণ্ঠে ছিল এমন এক কঠোরতা, যা বোঝাচ্ছিল সে কেবল শক্তি চাইছে, মেঘলার নিজের অস্তিত্ব নয়। মেঘলা সাহস সঞ্চয় করে বলল, “আমি তোমাকে চিনি না। আমার ভেতরে যদি সত্যিই কোনো শক্তি থাকে, সেটা আমি নিজেই বুঝব। তোমার জন্য নয়।” অর্কের চোখে তখন ঝিলিক আরও তীব্র হয়ে উঠল। সে বলল, “তুই আমাকে অস্বীকার করতে পারবি না। এই শক্তি আমাদের দু’জনের মধ্যে সেতুবন্ধন। তুই যেভাবেই পালাতে চাস না কেন, একদিন এই সত্য মেনে নিতেই হবে।” কথাগুলো বলে সে ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, রেখে গেল এক রহস্যময় চাপা ভয় আর অচেনা আকর্ষণ। মেঘলা একা দাঁড়িয়ে রইল বনের গভীরে, বুক ধকধক করছে, চোখে ভেসে উঠছে অর্কের ধাতব দৃষ্টি। সেই রাতের সাক্ষাৎ বদলে দিল তার ভেতরের সবকিছু—এখন সে জানে, তার ভেতরের শক্তিকে শুধু গ্রাম বা পৃথিবী নয়, মহাকাশেরও কেউ খুঁজছে। আর এই শক্তির জন্য তাকে লড়াই করতেই হবে, হয়তো নিজের অস্তিত্বের সাথেই।
৬
মেঘলা যখন অর্কের মুখোমুখি দাঁড়াল, তখন তার চোখে ছিল কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা অনিশ্চয়তা। অর্ক ধীরে ধীরে তার অতীত উন্মোচন করতে শুরু করল। সে বলল, মেঘলার পূর্বপুরুষ আসলে তার নিজের গ্রহ থেকে এসেছিল, মানুষী রূপে পৃথিবীতে বসতি গড়েছিল, আর সেই সময় থেকে মেঘলার পরিবারে কসমিক এনার্জি রয়ে গেছে। মেঘলা প্রথমে অবিশ্বাসে কণ্ঠরোধ করতে চাইল, কিন্তু অর্কের চোখের ধাতব ঝিলিক এবং দৃঢ় উপস্থিতি তাকে থামাল। সে জানালো, যে শক্তি তার রক্তের মধ্যে রয়েছে, তা একধরনের মহাজাগতিক শক্তি—যা ঠিকমতো ব্যবহার করলে, ভিনগ্রহের সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধও থামানো সম্ভব। অর্কের কথায় মনে হলো যেন সময় থমকে গেছে। মেঘলা ভাবতে লাগল, এই শক্তি কি সত্যিই তার নিজের? আর যদি হয়, তবে কি তার হাতে এত বিশাল ক্ষমতা থাকা উচিত? সে অনুভব করল শরীরের মধ্যে অদ্ভুত এক উত্তেজনা, যা আগে কখনো অনুভব করেনি। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন তার ভিতরের শক্তিকে জাগ্রত করতে চায়, কিন্তু একই সঙ্গে সে ভয় পেয়েছে—কারণ এ শক্তি যে শুধু শান্তির জন্য নয়, বরং ধ্বংসের জন্যও ব্যবহার করা যায়, তা অর্ক স্পষ্টই জানিয়েছে।
অর্কের কথায় ক্রমশ মেঘলার ভেতরের দ্বন্দ্ব বেড়ে গেল। সে জানালো, যে কারণে সে পৃথিবীতে এসেছে, তা সম্পূর্ণ শান্তির উদ্দেশ্যে নয়। মেঘলা শুনতে পেল, অর্ক আসলে সেই শক্তি দখল করতে চায়। তার ভাষায় ছিল নিখুঁত শান্ত, কিন্তু কণ্ঠে লুকানো আত্মকেন্দ্রিক লোভ। মেঘলা অল্প সময়ের জন্য হতবাক হয়ে দাঁড়াল। সে বুঝতে পারল, অর্ক যে বন্ধুর মতো দেখাচ্ছে, সেই বন্ধুত্ব আসলে ছিল এক প্রকার মায়া। অর্কের চোখে শুধুই লক্ষ্য—কসমিক এনার্জি। মেঘলা চেয়েছিল তার ভেতরের শক্তি নিয়ে কোন ধরণের দায়িত্ব পালন করতে, কিন্তু অর্কের উপস্থিতি তাকে এই স্বপ্ন থেকে ফিরিয়ে এনেছে। সে ভাবল, এই শক্তি যদি ভুল হাতে চলে যায়, তবে পুরো পৃথিবীই বিপদে পড়তে পারে। অর্ক তার কৌশলে মেঘলার বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করল, কথায় কথায় মনে হচ্ছিল যেন সে সত্যিই তার সহায়ক, কিন্তু মেঘলার অন্তরে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা জন্ম নিল। সে ভাবল, এই যুদ্ধে শুধু শক্তির দ্বন্দ্ব নয়, বরং বিশ্বাস এবং বিশ্বাসঘাতকতার দ্বন্দ্বও লড়তে হবে।
মেঘলা যখন নিজের মধ্যে শক্তি অনুভব করতে লাগল, তখন তার চেতনায় নতুন এক সংকল্প জন্ম নিল। সে বুঝল, কেবল নিজের জন্য নয়, পৃথিবীর জন্যও তাকে এ শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। অর্কের পরিকল্পনা যতই চতুর্থ দিক দিয়ে আসুক না কেন, মেঘলা জানল, তার কসমিক এনার্জি যদি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তা শুধু যুদ্ধ থামাতে নয়, নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলতে সক্ষম। সে অর্কের চোখে তাকাল, যেখানে ধাতব ঝিলিকের সঙ্গে লুকানো লোভ স্পষ্ট, আর নিজেকে প্রস্তুত করল—সত্যি শক্তি এবং নৈতিকতার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য। সে জানল, এই যাত্রায় তার হাতে একমাত্র অস্ত্র হলো সাহস এবং অন্তরের সততা। তার হৃদয়ে জন্ম নিল অদ্ভুত এক শক্তি, যা একদিকে ভয়কে দূরে ঠেলতে সক্ষম, অন্যদিকে পৃথিবীর জন্য আশার আলো জাগাতে পারবে। অর্কের উপস্থিতি এবং তার পরিকল্পনা মেঘলাকে চ্যালেঞ্জ করল, কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল—নিজের শক্তি চিহ্নিত করতে, প্রতিপক্ষকে বুঝতে এবং সেই শক্তিকে সঠিক পথে ব্যবহার করতে। শেষমেশ, মেঘলা উপলব্ধি করল, অর্কের সত্য উদঘাটন করার সঙ্গে সঙ্গে, তার নিজের প্রকৃত দায়িত্বও স্পষ্ট হয়ে গেছে—যে শক্তি তার রক্তে আছে, তা কেবল যুদ্ধ নয়, শান্তির পথ দেখাতে সক্ষম।
৭
গ্রামের বাতাসে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ঘোরে বেড়াতে শুরু করল। মেঘলা যখন গ্রামে ঢুকল, তখন প্রথমেই অনুভব করল মানুষের চোখে লুকানো ভয়। ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা—সকলের মুখে একই প্রশ্ন, একই অবিশ্বাস। কেউ তাকে দেবীর মতো দেখল, কেউ আবার ভয়ের স্রোতে অমানুষিক রূপে বর্ণনা করতে লাগল। গ্রামের পথগুলো অল্প সময়ের মধ্যে কৌতূহল আর আতঙ্কের মিলিত ঢেউয়ে পূর্ণ হয়ে গেল। লোকেরা হঠাৎ করে ভিড় জমাতে লাগল, কেউ কেউ দূর থেকে ছায়ার মতো তাকিয়ে দেখল, কেউ আবার মেঘলার দিকে পাথর ছুড়ে উত্থান করল। মেঘলা প্রথমে শান্ত থাকার চেষ্টা করল, কিন্তু তার হৃদয়ে ধীরে ধীরে সন্দেহ এবং আতঙ্কের প্রতিফলন শুরু হলো। সে বুঝতে পারল, মানুষের ভয় কোনো যৌক্তিক সীমার মধ্যে নেই; বরং তারা তাদের নিজের অজানা ভবিষ্যৎ এবং অদ্ভুত ঘটনার জন্য অস্থির। মেঘলা নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করল—সে ক্ষমতাশালী নয়, বরং সহায়ক হতে চায়। কিন্তু গ্রামের মানুষের চোখে তার শক্তি বিপজ্জনক ও অপ্রাকৃতিক মনে হচ্ছিল। সে দেখতে পেল, মানুষের ভয় কখনোই সরাসরি আক্রমণের চেয়ে ভয়ংকর হতে পারে, কারণ এটি তাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি ও ক্রিয়াকে দমন করে।
মেঘলার আশেপাশে ভয় আরও ঘনীভূত হতে থাকল। কেউ তার দিকে দৌড়ে এল, কেউ পাথর ছুড়ে তাকে দূরে রাখতে চাইল। সে প্রথমে প্রতিক্রিয়া না দেখালেও, ভিতরে ধীরে ধীরে আতঙ্ক জমতে লাগল। গ্রামের লোকেরা যখন তার চারপাশে ভিড় জমায়, তখন মেঘলা অনুভব করল, তারা শুধু তার শক্তি নয়, তার অস্তিত্বকেই গ্রহণ করতে পারছে না। প্রতিটি দৃষ্টিতে লুকানো সন্দেহ, প্রতিটি কণ্ঠে আংশিক আক্রমণ—সব মিলিয়ে তার মনে এমন এক চাপ সৃষ্টি করল যা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে চূর্ণ করতে পারে। সে ভাবল, মানুষদের ভয় হলো প্রকৃত শত্রু। তারা যেন নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাদের নিজস্ব অজ্ঞাত ভয় দ্বারা দমন হচ্ছে। মেঘলা বুঝল, মানুষের আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করা বা দমন করা তার হাতে নেই, বরং এটি তাদের নিজস্ব বোধের ফল। সে শিখল, শক্তি ব্যবহার করলেই মানুষকে বোঝানো সম্ভব নয়; কখনো কখনো শান্তি এবং বিশ্বাস স্থাপন করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই উপলব্ধি তাকে দমিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু একদিকে তার ভেতরে ধীরে ধীরে এক নতুন দৃঢ়তা জন্ম নিল—যা তাকে মানুষদের ভয় ও সন্দেহের ভেতর দিয়ে পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করবে।
গ্রামের মানুষের প্রতিক্রিয়ার মাঝে মেঘলা ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করল। সে বুঝল, এই যাত্রায় তার শত্রু শুধু বাহ্যিক নয়, মানুষের অভ্যন্তরীণ ভয় ও সন্দেহই সবচেয়ে ভয়ানক। তিনি নিজেকে স্থির করল, একান্ত একাগ্রতা এবং সহানুভূতির মাধ্যমে মানুষের আতঙ্কের অন্তরাল বোঝার জন্য। মেঘলা নিজের কসমিক এনার্জি ব্যবহার না করেই, শান্তি ও স্থিরতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করল। সে দেখল, মানুষ যতই ভয় পেয়েছে, তার ভেতরের মানবিক স্পর্শ এবং দয়া এখনও জাগ্রত। সে প্রতিটি ছোট্ট শিশুর চোখে, বৃদ্ধের কণ্ঠে এবং গ্রামের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সেই ভয় এবং সন্দেহ লক্ষ্য করল। মেঘলা উপলব্ধি করল, ভয় মানুষের মনকে বিভক্ত করে, কিন্তু সাহস এবং দয়া তাকে পুনরায় একত্রিত করতে পারে। এই উপলব্ধি তাকে আরও শক্তিশালী করল—যাতে সে বুঝতে পারল, মানুষের ভয় কোনো যাদু বা শক্তি দ্বারা সরানো যায় না, বরং ধৈর্য, সহানুভূতি এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের ভয়মুক্ত করা সম্ভব। গ্রামবাসীর আতঙ্ক এবং সন্দেহের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে, মেঘলা অনুভব করল, প্রকৃত শক্তি হলো ভয়ের মধ্যেও শান্তি স্থাপন করার ক্ষমতা।
৮
গ্রামের শান্তি হঠাৎ ভেঙে যায়, যখন অর্ক হঠাৎ মেঘলার দিকে ঝাপিয়ে পড়ল। তার চোখে ধাতব ঝিলিক, হাতের নড়াচড়ায় লুকানো ঘাতক পরিকল্পনা—সবই দেখিয়ে দিল যে সে কেবল তার কসমিক শক্তি দখল করতে চায়। মেঘলা প্রথমে হতবাক হয়ে দাঁড়াল, এমনকি হৃদয়টা কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়। সে বুঝতে পারল যে, যেটা এতদিন শুধুই তাত্ত্বিক ধারণা ছিল, এখন বাস্তবের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ভেতরের শক্তি অনুভব করতে শুরু করল—প্রতিটি কোষ যেন জেগে উঠল। অর্কের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায়, মেঘলার শরীর থেকে হঠাৎ একটি উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি বের হতে লাগল, যা প্রথমে ক্ষুদ্র কিন্তু ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠল। সে অনুভব করল, তার ভেতরের কসমিক এনার্জি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা নয়, বরং আক্রমণ এবং শক্তির বিকিরণেরও ক্ষমতা রাখে। আকাশে অদ্ভুত এক আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়ল, যা গ্রামের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি পথ এবং প্রতিটি মানুষের চোখে পৌঁছালো। গ্রামের মানুষজন প্রথমে ভয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল, তবে দ্রুত তারা বুঝল যে এই শক্তি ভয়ঙ্কর হলেও ধ্বংসাত্মক নয়; বরং এটি এক ধরনের মহাজাগতিক শক্তির প্রকাশ, যা সাধারণ মানুষ কখনো স্বাভাবিক চোখে দেখতে পায় না।
মেঘলার শরীরে শক্তির জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে তার মনোবলও বাড়তে থাকল। সে অনুভব করল, এ শক্তি কেবল বাহ্যিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার জন্য নয়, বরং নিজের ভেতরের ভয় এবং সংশয়কে সরিয়ে দিতে সক্ষম। তার হাতের নড়াচড়ায়, প্রতিটি দিক থেকে শক্তির তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল, যা আকাশকে আলোকিত করে তুলল। মেঘলা ভেসে উঠল, যেন পৃথিবী আর তার সীমারেখা নেই; সে অনুভব করল নিজের সঙ্গে সমগ্র গ্রহের সংযোগ। এই অবস্থায় তার চিন্তা আর সন্দেহকে ছাপিয়ে গেল, এবং সে শক্তির পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করল। গ্রামের মানুষজন চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে দেখল, কেমন করে একটি মানবশরীর থেকে এমন আলো, এমন শক্তি ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি আলোফালি যেন গ্রামের প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছ এবং প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করল। তারা প্রথমে আতঙ্কিত হলেও, ধীরে ধীরে সেই আলোর তীব্রতায় ভয় সরিয়ে, বিস্ময় এবং শ্রদ্ধার অনুভূতি জাগ্রত হল। মেঘলার শক্তি শুধু আক্রমণ বা প্রতিরক্ষা নয়, বরং এটি এক প্রকার জাগরণ—মানব, প্রকৃতি এবং মহাজাগতিক শক্তির এক অব্যক্ত মিলন।
আকাশে ছড়ানো শক্তির তরঙ্গ আরও তীব্র হতে লাগল। মেঘলা পুরো গ্রামকে আলোকিত করে তুলল, যেন রাত নিজেই ভোরে রূপান্তরিত হয়েছে। তার ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, শক্তির শক্তিধারী ঢেউ গ্রামকে ঘিরে ধরল, প্রতিটি মানুষের মনে এক অদ্ভুত শান্তি এবং শক্তির অনুভূতি জাগিয়ে দিল। অর্ক তার চোখে অবিশ্বাস এবং ক্রোধ দেখল, কারণ সে বুঝতে পারল যে, মেঘলার শক্তি তাকে দখল করা যাবে না। মেঘলা নিজের ভেতরের শক্তিকে পুরোপুরি গ্রহণ করল এবং এক সুষম ও সমন্বিত শক্তির প্রকাশ ঘটাল। গ্রামবাসীরা সেই আলোয় স্থির হয়ে দাঁড়াল, মেঘলার উপস্থিতি যেন তাদের আতঙ্ককে একধরনের বিস্ময় ও স্বীকৃতিতে পরিণত করল। আকাশ, বাতাস, গ্রাম—সবকিছু মিলিত হয়ে এক মহাজাগতিক দৃশ্যের জন্ম দিল, যা শুধুমাত্র শক্তির জাগরণ নয়, বরং নতুন অধ্যায়ের সূচনা। মেঘলা বুঝতে পারল, এই শক্তি কেবল আক্রমণ বা প্রতিরক্ষার নয়; এটি মানুষের ভয় দূর করার, শান্তি প্রতিষ্ঠার এবং বিশ্বকে নতুন আলোতে আলোকিত করার ক্ষমতা রাখে। শক্তির জাগরণের এই মুহূর্তে, মেঘলা শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্ব নয়, বরং গ্রাম ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে ধারণ করল, এবং এক নতুন দিকনির্দেশনা স্থাপন করল—যেখানে শক্তি, সাহস এবং নৈতিকতার মিলনে এক অনন্য বিশ্বকে গড়ে তোলা সম্ভব।
৯
গ্রামের আকাশ হঠাৎ অন্ধকারে ঢাকা পড়ল, যখন অর্ক তার পূর্ণ শক্তি উন্মোচন করল। তার চোখের ধাতব ঝিলিক, হাতের নড়াচড়া এবং মহাজাগতিক প্রযুক্তি একত্রিত হয়ে মেঘলার কসমিক এনার্জি দখল করার চেষ্টা শুরু করল। মেঘলা প্রথমে আতঙ্কিত হলেও, তার অন্তরের দৃঢ়তা তাকে স্থির রাখল। সে জানত, এই লড়াই কেবল তার নয়, বরং পুরো গ্রাম, মানুষ এবং পৃথিবীর জন্য। অর্কের শক্তি প্রচণ্ড এবং অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও, মেঘলার ভেতরে জন্ম নেওয়া সাহস এবং শক্তির সমন্বয় তাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা দিল। প্রতিটি আঘাত, প্রতিটি শক্তির বিকিরণ গ্রামে ভয়ঙ্কর কম্পন সৃষ্টি করল। মেঘলার চোখে ধরা পড়ল অর্কের লোভ এবং আগ্রাসন, যা প্রতিটি মুহূর্তে তার শক্তি বৃদ্ধি করছিল। কিন্তু মেঘলার হৃদয়ে জন্ম নিল নতুন এক সংকল্প—সে জানল, কেবল শক্তির দ্বন্দ্ব নয়, ধৈর্য, নৈতিকতা এবং সাহসের মিলনই এই লড়াইকে নির্ধারণ করবে।
অর্কের আক্রমণের সময়, অরিন্দম দ্রুত এগিয়ে এল। সে তার বৈজ্ঞানিক যন্ত্র প্রস্তুত করল, যা মেঘলার শক্তিকে সুষমভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরক্ষা করার সুযোগ দেয়। অরিন্দমের হাতের প্রতিটি নড়াচড়া এবং যন্ত্রের তীব্র আলোর বিকিরণ মেঘলার সঙ্গে মিলে এক অদ্ভুত সমন্বয় গড়ে তুলল। ভিনগ্রহী প্রযুক্তি এবং মানুষের জ্ঞান ও সাহসের এই দ্বন্দ্ব গ্রামে এক অনন্য উত্তেজনা সৃষ্টি করল। অর্কের প্রযুক্তি শক্তিশালী হলেও, মানুষের সংহতি, সাহস এবং যান্ত্রিক জ্ঞান তাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হল। মেঘলা প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে স্থির রাখল, আর অরিন্দমের যন্ত্রের সাহায্যে তার কসমিক শক্তি সঠিকভাবে পরিচালিত হল। গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত চোখে এই দৃশ্য দেখছিল, তবে ধীরে ধীরে তারা উপলব্ধি করল যে, মানব সাহস এবং নৈতিকতার শক্তি যেকোনো প্রযুক্তি বা শক্তির চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হতে পারে। প্রতিটি সংঘর্ষ, প্রতিটি বিকিরণ মেঘলা এবং অর্কের মধ্যে এক চূড়ান্ত শক্তির টানাপোড়েন তৈরি করল, যা শুধু বাহ্যিক লড়াই নয়, অন্তর আত্মার লড়াইও।
যুদ্ধ ক্রমশ রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠল। অর্ক তার শক্তি বাড়ালেও, মেঘলা এবং অরিন্দমের সমন্বিত প্রচেষ্টা তাকে প্রতিহত করতে লাগল। মেঘলার চোখে ধরা পড়ল অর্কের ক্রোধ এবং হিংসা, আর প্রতিটি আক্রমণ তাকে আরও দৃঢ় করে তুলল। অরিন্দমের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের সাহায্যে মেঘলা তার শক্তি সুষমভাবে ছড়াল, যা গ্রাম এবং আকাশকে আলোকিত করল। ভিনগ্রহী প্রযুক্তি বনাম মানুষের সাহস—এই সংঘর্ষে প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল চূড়ান্ত। শেষ পর্যন্ত, মেঘলার ধৈর্য, সাহস এবং কসমিক শক্তির সংমিশ্রণ অর্ককে পিছিয়ে দিতে সক্ষম হল। গ্রামবাসীরা অবাক চোখে দেখল কিভাবে শক্তি এবং সাহস একসাথে মিলে একটি অসাধারণ বিজয় নিয়ে আসে। চূড়ান্ত লড়াই শেষ হওয়ার পর, মেঘলা শুধু নিজের শক্তি নিয়ন্ত্রণেই নয়, মানুষের সাহস এবং নৈতিকতার শক্তিও উপলব্ধি করল। এই লড়াই ছিল শুধুমাত্র কসমিক শক্তির নয়, বরং মানব মনোবল এবং সংহতির এক চূড়ান্ত পরীক্ষা, যা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হলো সাহস এবং সত্যের হাতে।
১০
মেঘলা যুদ্ধের ধূলিকণা থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, যখন অর্ক পরাজিত হয়। তার চোখে ছিল বিজয়ের আনন্দ এবং অভিভূত বিস্ময়, কিন্তু তার হৃদয়ে জন্ম নিল এক নতুন উপলব্ধি—শক্তি কেবল তার ভেতরের কসমিক এনার্জি নয়, বরং মানুষের মধ্যে নিহিত সাহস, মানবিকতা এবং নৈতিকতার সঙ্গে মিশে প্রকৃত মহাজাগতিক শক্তি তৈরি হয়। সে দেখল, গ্রামের মানুষের চোখে, শিশুদের কণ্ঠে, বৃদ্ধদের দৃষ্টিতে—প্রতিটি মানুষের মনোবল এবং বিশ্বাস তার শক্তিকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। অর্কের প্রযুক্তি এবং আক্রমণ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, মানুষের একত্রিত সাহস তাকে পরাজিত করেছে। মেঘলা উপলব্ধি করল, যে শক্তি শুধু ধ্বংস বা প্রতিরক্ষা নয়, বরং আশা, দৃঢ়তা এবং মানবতার সংমিশ্রণে জন্ম নেয়। গ্রামে প্রতিটি মানুষ তার দিকে তাকাল, আর তার চোখে ভয় নয়, শ্রদ্ধা এবং আশ্চর্যের মিলন। তারা দেখল, যে নারী একসময় “ডাকিনী” বলে ভয় সৃষ্টি করেছিল, এখন তার কসমিক শক্তি মানুষের সাহস এবং বিশ্বাসের সঙ্গে মিশে “মহাকাশের কন্যা” হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
মেঘলা ধীরে ধীরে গ্রামকে ঘুরে দেখল। প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঘর—সবকিছু যেন তার শক্তির প্রতিফলন হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, যে শক্তি কেবল বাহ্যিক নয়, বরং মানুষের মনোবল, ধৈর্য এবং নৈতিকতার সঙ্গে সমন্বয় স্থাপন করলে তা সত্যিকারের মহাজাগতিক আকার নেয়। অর্কের পতনের পর, গ্রামের মানুষজন তার চারপাশে ভিড় জমাল, কিন্তু এবার তারা ভয়ী নয়। বরং তাদের চোখে ছিল কৌতূহল, স্বীকৃতি এবং একধরনের স্নেহমিশ্রিত শ্রদ্ধা। মেঘলা অনুভব করল, শক্তি এবং সাহস একসাথে মিললে মানুষের ভয় এবং সন্দেহ দূর হয়, এবং বিশ্বাস জন্মায়—যা সবচেয়ে বড় শক্তি। সে নিজেকে উপলব্ধি করল, যে মহাজাগতিক শক্তি শুধু তার রক্তে নয়, বরং প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে, তাদের সাহস, মানবিকতা এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাসে লুকিয়ে আছে। এই উপলব্ধি তাকে আরও দৃঢ় করল, কারণ এখন সে জানে, তার ভেতরের শক্তি এবং মানুষের সাহস একসাথে মিললে কোনো শত্রুকে দমন করা সম্ভব।
শেষ পর্যন্ত, মেঘলা গ্রামের মানুষের সঙ্গে একত্রে দাঁড়াল। তারা তাকে আর ভয়ঙ্কর ডাকিনী হিসেবে দেখল না; বরং “মহাকাশের কন্যা” হিসেবে গ্রহণ করল, যার শক্তি তাদের জীবনে আশার আলো এবং সাহসের প্রতীক। গ্রামবাসীর বিশ্বাস এবং মমত্বের মিলনে মেঘলার শক্তি চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ পেল। সে উপলব্ধি করল, শক্তি কেবল ধ্বংস বা আক্রমণের জন্য নয়, বরং মানুষের মধ্যে আশা, সাহস এবং মানবিকতার প্রতিফলন হিসেবে থাকলেও তা মহাজাগতিক মাত্রা পায়। অর্কের পরাজয় এবং গ্রামের মানুষের সমর্থন মেঘলাকে শিখিয়েছে যে, প্রকৃত শক্তি হলো মানবিকতা, একতার শক্তি এবং নিজের ভেতরের নৈতিকতার সঙ্গে সংযোগ। গ্রাম এক নতুন আলোতে আলোকিত হল, আর মেঘলার উপস্থিতি শুধু শক্তির প্রতীক নয়, বরং মানুষের সাহস এবং মহাজাগতিক দায়িত্বের মিলনের এক জীবন্ত প্রমাণ হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে, সে বুঝল—মহাজাগতিক শক্তি কেবল তার রক্তে নেই; এটি প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে নিহিত, এবং সেই শক্তিকে জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা তাকে প্রকৃত মহাজাগতিক ডাকিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল।




