Bangla - তন্ত্র

মশানতান্ত্রিক

Spread the love

সমীক দাশগুপ্ত


বারাণসীর গলির গাঢ় ধুলো, ভাঙাচোরা ঘাট আর প্রাচীন মন্দিরের শিলালিপির মাঝখানে হাঁটতে হাঁটতে অরুণাভ ক্যামেরা হাতে পৌঁছে গিয়েছিল মণিকর্ণিকা ঘাটের একটু দূরের একটি পুরনো শ্মশানে। খুব বেশি কেউ আসে না এখানে। জায়গাটির একধরনের পবিত্র ভয়াবহতা আছে—যেন কেউ নিঃশব্দে দেখছে সব, পুড়তে থাকা কাঠের ফাঁক দিয়ে, আগুনের গন্ধে মিশে থাকা পুরোনো আত্মার নিঃশ্বাসে। অরুণাভ এমনটাই খুঁজছিল। তার ফটোগ্রাফির বিষয়বস্তু বরাবরই ছিল ‘আত্মা আর দেহের অন্তরালের গল্প’। সে বলে, “জীবন নয়, মৃত্যু সত্যি, তাই আমি তাকেই দেখি।” এমন একটা কথা শুনে কেউ হেসে উড়িয়ে দিলেও, অরুণাভ নিজের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়ায় এক নিঃসঙ্গ দর্শন — যে মৃত্যু দেখেছে, সে আর পৃথিবীর আলোতে চোখ রাখে না। শ্মশানে ঢুকে সে এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়ল। বেলা তখন গড়িয়ে পড়েছে বিকেলের দিকে, সূর্য টালমাটাল আলোর রেখা ফেলে দিচ্ছে মৃতদেহের মুখে। কাঠের স্তূপের উপর রাখা একটা শবদেহের ছবি তুলতেই অদ্ভুত লাগল। যেন চোখের কোণ দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল। অরুণাভ প্রথমে পাত্তা দেয়নি, কিন্তু দ্বিতীয় ছবিতে পরিষ্কার দেখতে পেল — মৃতদেহের বুকের ওপর একরাশ কালো ছায়া জমাট বেঁধে আছে। তৃতীয় ছবিতে সেই ছায়ার ভেতরে যেন হাতের মতো কিছু একটা ছড়িয়ে আছে। “ছবি তো বিকৃত হতে পারে,” সে নিজেকেই বলল, কিন্তু তার শরীরে এক গা-চাঁটানো ঠান্ডা ঢুকে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। মনে হচ্ছিল, বাতাসটা অনেক ভারি, শব্দবর্জিত, আর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।

রাতের দিকে ঘরে ফিরে অরুণাভ ক্যামেরার সব ছবি ট্রান্সফার করছিল ল্যাপটপে। কিন্তু তৃতীয় ছবির সময় সিস্টেম হ্যাং করে গেল। পর্দার মাঝে এক ঝলক কালো একটা মুখ দেখা দিল — কুয়াশার মতো, অস্পষ্ট — আর তারপর সব নিস্তব্ধ। সে বুঝে উঠতে পারল না বিষয়টা কল্পনা, সফটওয়্যারের সমস্যা না অন্য কিছু। তখনই ফোনটা বেজে উঠল, অপরিচিত নম্বর থেকে। ধরতেই ভাঙা ভাঙা কণ্ঠ — “তুমি ছবি তুলেছো, তুমি দেখা পেয়ে গেছো, এখন তোকে সে খুঁজবে।” ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এল। “কে আপনি?” — জিজ্ঞেস করতেই ফোন কেটে গেল। বাইরে তখন তীব্র বাতাস, বারান্দার ঘুণধরা দরজাটা আপনাতেই খটখট করে উঠছে। অরুণাভ দাঁড়িয়ে পড়ল জানালার কাছে। কাঁচের ওপারে শ্মশানের দিকেই তার বাড়ির সামনের রাস্তা যায় — সেখানে আজ আলো কম, আর অদ্ভুতভাবে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোর ছায়া যেন একই দিকে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যামেরার ব্যাগ খুলতেই সে আবার দেখতে পেল সেই ছবি — এবারও মনে হল, ছায়াটির চোখ আছে। অথবা, হয়তো সে কল্পনা করছে। কিন্তু সমস্যা শুরু হল রাতে। ঘুমের মধ্যে সে দেখল, যে মৃতদেহটি সে ছবিতে তুলেছিল, সে তার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ নেই, কেবল শরীর — কিন্তু তার বুকে সেই ছায়াটি গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে। একটা ফিসফিসে গলা বলে উঠল, “আমার পথ আটকে দিয়েছো, এবার তোমাকেই দরজা হতে হবে…”

পরদিন সকালে, শরীর ভারী, চোখ লাল। মনে হচ্ছিল শরীরের ভেতরে কেমন যেন শূন্যতা ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল, সে যখন আয়নায় তাকাল — তখন নিজের ঘাড়ের কাছে দেখতে পেল হালকা পোড়া দাগের মতো ছাপ। তার চুলের ভেতরে যেন কেউ আগুনের আঁচ রেখে গেছে। ভয় আর কৌতূহলের মধ্যে, সে চলে গেল সেই শ্মশানে আবার — দুপুরে, রোদ মাথার ওপরে তীব্র, তবু শ্মশানটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা। এবার সে দেখতে পেল, আগের মৃতদেহটি নেই, কিন্তু তার নিচে পচে যাওয়া কাঠের স্তূপে এক অর্ধদগ্ধ প্রতীক আঁকা — একটি বৃত্তের মাঝে চোখ, আর চারদিকে আগুনের রেখা। পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধা — চোখে ছানি পড়া, হাতে কাঠির মতো আঙুল। তিনি হঠাৎ বললেন, “রুদ্রশর্মা তোকে খুঁজছে।” অরুণাভ চমকে তাকাল, “কে?” বৃদ্ধা বললেন, “তোর ছবি তোলার লোভ তাকে জাগিয়ে তুলেছে। সে যার শরীর পাবে, সে তার ফেরার পথ হবে।” অরুণাভ থ হয়ে গেল। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “এই শ্মশানে শুধু শরীর পোড়ে না, আত্মাও আটকে থাকে… আর কিছু আত্মা নিজের জন্য ফেরার দরজা খোঁজে — তুই সেই দরজা হয়েছিস।” শ্মশানের গা ছমছমে বাতাসে যেন হঠাৎ একটা ঢেউ এলো। গাছের পাতাগুলো একসঙ্গে কেঁপে উঠল, দূরে কোনো চিতার আগুনে একটা ফোঁস করে শব্দ হল। আর অরুণাভ জানত, তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে — নিঃশব্দে, নিঃশ্বাসহীন, কিন্তু ঘাড়ে জমাট শ্বাস ফেলে বলছে, “এইবার…”

অরুণাভ পরের দিন সকালেই আবার ফিরে গেল সেই বৃদ্ধার কাছে, যাকে সে আগের দিন শ্মশানে দেখেছিল। আশ্চর্যজনকভাবে তাকে সেখানে আর খুঁজে পেল না, অথচ পচা কাঠের স্তূপের নিচে একটা পুরনো লাল কাপড় মোড়ানো কিছু দেখতে পেল। তুলে দেখল — সাদা হাড়ের মতো দেখতে একটা কাঠের পুতুল, যার চোখের জায়গায় সুতোর গিঁট আর মুখ আঁকা নেই। কিন্তু পুতুলটা হাতে নেওয়ার পরেই তার দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেল। কানে এল অসংখ্য কণ্ঠস্বর — একসঙ্গে ফিসফিস করছে, যেন অনেকগুলো মানুষ মৃত আগুনের ফাঁক দিয়ে ডাকছে — “রুদ্র… রুদ্রশর্মা… রুদ্র… ফিরে আয়…” সেই সময়ই শ্মশানপাড়ার এক বৃদ্ধ চা-ওয়ালা কাছে এসে দাঁড়াল। মুখে বিস্ময়ের ছাপ, বলল, “এই পুতুলটা কোথা থেকে পেয়েছো বাবু? এসব আগুনে ফেলা উচিত ছিল… ওটা ভবানীচরণ রুদ্রশর্মার চিহ্ন!” অরুণাভ তাকিয়ে রইল বিস্ময়ে, “কে এই রুদ্রশর্মা?” চা-ওয়ালা নিচু গলায় বলল, “ওই শ্মশানের আগের তান্ত্রিক। অনেক আগে, শ্মশান-সাধনায় সিদ্ধি লাভের সময় নিজের আত্মা ভেঙে সাতভাগ করে মাটির নিচে সাতটা মৃতদেহে আটকে রেখে গিয়েছিল… আর বলেছিল, ‘যেদিন কেউ আমার সব আত্মাদর্শীকে একত্র করবে, সেদিন আমি আবার আগুন পেরিয়ে ফিরব।’”

কিন্তু শহরে কেউ এখনো জানে না কোথায় আছে সেই সাতটি দেহ। অনেকেই বলেছে, রুদ্রশর্মার মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয় — সে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিল আগুন, মাটি আর ছায়ায়। অরুণাভ হঠাৎ মনে করল — তার ছবিতে যেসব মৃতদেহ ছিল, সব ক somehow অদ্ভুতভাবে শরীরের গঠন, মুখের রেখা, এবং ছায়ার উপস্থিতি ছিল একইরকম। সে বাড়ি ফিরে দ্রুত ছবিগুলো খুলে দেখতে লাগল। প্রতিটিতে, যদিও জায়গা আলাদা, সময় আলাদা — কিন্তু মৃতদেহের গড়ন, গায়ের দাগ, এমনকি আগুনের ধোঁয়ার ভিতর লুকিয়ে থাকা ছায়া এক। যেন এক দেহ বারবার ফিরে আসছে ভিন্ন রূপে। সে তখন বুঝল, সে এই সাতটি ‘আত্মা-দেহ’ ধরেই ফেলেছে — আর তার ক্যামেরা হয়ে উঠেছে এক ‘চক্রের দরজা’। ভয়াবহ সত্যিটা তখনই বোঝা গেল, যখন সে আবার সেই তৃতীয় ছবিটা খুলল — ছবির মধ্যে হঠাৎই তার নিজের মুখ দেখা যাচ্ছে, যেখানে মৃতদেহ থাকার কথা ছিল। যেন কোনও অলৌকিক শক্তি তার মধ্যেই আত্মস্থ হয়ে গেছে। আর তখনই ফোন বেজে উঠল — আগের রাতের সেই নম্বর থেকে। diesmal, কণ্ঠস্বর আরও গাঢ়, আরও কাছে — “তুই আমাদের খুঁজে বের করেছিস, এবার তুইই আমাদের শেষ বাহক… রুদ্র আসছে… দরজা খুলে দে…”

সেই রাতে ঘুম এল না। হঠাৎ ৩টা ৪৫ মিনিটে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। বাইরে কেউ ছিল না, কেবল দরজার নিচ দিয়ে ছায়া গড়িয়ে পড়ছিল ঘরে। ঘরের বাতি নিভে গেল, আর অরুণাভ দেখতে পেল, দরজার ঠিক ওপরে টাঙানো পুরনো আয়নাটায় তার নিজের প্রতিবিম্ব আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি — মাথায় পাগড়ি, চোখ নেই, কেবল গাঢ় ফাঁপা গহ্বর, আর লম্বা হাত। সে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, আর আয়নার প্রতিবিম্ব ফিসফিসিয়ে বলে উঠল — “ভবানীচরণ এখনও বাঁচে… শ্মশান তার ঘর… আর তুই তার পথ… সে ফিরে আসছে আগুনের ভেতর দিয়ে… আগুনের ছাইতে লেখা তার নাম…” পরদিন সকালে ঘরের দেয়ালে অরুণাভ এক অদ্ভুত প্রতীক দেখতে পেল — আগুনের আকৃতির ভিতর ‘রু’ অক্ষরটি খোদাই করা। সে জানত না কীভাবে, কে করেছে, কিন্তু অনুভব করল, রুদ্রশর্মা তার ছায়ার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। তার ঘুম, তার শরীর, এমনকি তার ক্যামেরা — সবকিছু যেন রুদ্রশর্মার পরবর্তী জন্মের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। কে তাকে রুখবে? বৃদ্ধা কোথায়? সাতটি আত্মা কি জাগ্রত? এই শ্মশান কি কেবল এক জায়গা, না কি এক চক্র, যার শুরু আছে, শেষ নেই?

রাতটা অরুণাভের জন্য শুধুই নিদ্রাহীন নয় — বরং চেতন আর অবচেতনের মাঝখানে দোল খাওয়া এক অসহ্য অভিজ্ঞতা। ঘরের বাতিগুলো বারবার ফ্লিক করে নিভে যাচ্ছিল। ক্যামেরার ব্যাটারি, যা সম্পূর্ণ চার্জ ছিল, হঠাৎ করেই নিঃশেষ। কানের ভেতর যেন কেউ নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলছে, “চোখ বন্ধ কর… তাকিয়ে দেখিস না…” কিন্তু ঠিক তখনই শুরু হল সবচেয়ে অস্বাভাবিক ব্যাপারটা — ডান হাত নিজে থেকেই মুভ করতে শুরু করল। প্রথমে আঙুলগুলো শিরশির করে উঠল, তারপর কবজিতে টান, তারপর পুরো বাহু। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে দেখল — তার হাত নিজের দখলে নেই। আয়নায় প্রতিফলিত হাতটিতে আঁকা আছে সেই আগুনঘেরা প্রতীক, যা সে আগের দিন শ্মশানে মৃত কাঠের গায়ে দেখেছিল। ভয় আর বিস্ময়ের মাঝে সে কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে এল — কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘরের ঠিক পাশের জানালাটা হঠাৎ খুলে গেল। বাইরে ছিল ঘন অন্ধকার — তবু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক মৃতদেহকে দেখতে পেল সে। সাদা কাফনে মোড়া, পা নেই, চোখ নেই — কেবল বুকের ওপরে লালচে দাগ, আর তার মাঝখানে সেই চিহ্ন। মৃতদেহের ঠোঁট নড়ছিল না, কিন্তু একটা কণ্ঠস্বর অরুণাভের কানে বাজল — “আমি সেই একজন… যাকে সে ব্যবহার করেছিল… আমি তার সাতজনের মধ্যে একজন… আর তুই আমাদের মুক্তির জন্য বাধা, আবার উপায়ও।”

কণ্ঠস্বরটা কোনও এক মস্তিষ্কের কল্পনা নয় — সেটা ছিল প্রাণবন্ত, অনুভূতিসম্পন্ন। আর অরুণাভ বোঝে, মৃতদেহটির আত্মা সরাসরি তার মাথায় কথা বলছে। সে তাকিয়ে দেখল, পেছনের দেয়ালে প্যাঁচানো ক্যালেন্ডারের উপর আগুনের মতো ছোপ ছোপ লাল দাগ ছড়িয়ে পড়ছে, যেন কেউ অদৃশ্য রক্ত দিয়ে লিখে চলেছে কিছু — “আমি মণিদীপ… দ্বিতীয় বাহক… সে আমায় ছিন্ন করেছিল, আগুন দিয়েছিল, আমি এখনও পোড়ি।” হঠাৎ ক্যামেরার স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল, আর সেখানে সেই মৃতদেহের মুখ পুরোপুরি স্পষ্ট — চোখ নেই, কিন্তু চোখের গর্তে যেন ধোঁয়ার মতো কিছু ঘুরছে। তখনই সেই মৃত আত্মা বলে উঠল, “আমাদের কেউ জানতে পারবে না, আমরা কোথায় গিয়েছিলাম… আমরা দেহ নই, আমরা তার তৈরি ছায়া… কিন্তু তোদের মাঝে ফেরার জন্য সে তোদের শরীর চাই… সাতজন মৃত, একজন জীবিত — সেই চক্র সম্পূর্ণ হলে, সে ফেরে…” অরুণাভ চিৎকার করে ক্যামেরা ছুঁড়ে ফেলল, কিন্তু স্ক্রিন তখনও জ্বলছে। আর তখনই — ঘরের মধ্যে এক তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, যেন পোড়া চুল, ঘামের ভেজা কাফন আর অদ্ভুত আতর মিশে এক ভয়ংকর ঘ্রাণ তৈরি করেছে।

তীব্র আতঙ্ক আর ব্যাখ্যাতীত অভিজ্ঞতার ভারে ভোর হওয়ার আগেই সে পৌঁছাল চিন্ময়ী দেবীর কুঁড়েঘরে — যা শ্মশান লাগোয়া এক শ্মশানপাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা কাঠের ঘর। এই বৃদ্ধা যেন কেবল এক মানুষ নন, বরং মৃত ও জীবিতের মাঝখানে এক সেতু। তাকে দেখেই অরুণাভ কেঁপে উঠে বলল, “আমি এক মৃতদেহের আত্মা শুনেছি… সে বলেছে সে দ্বিতীয় বাহক… রুদ্র ফিরে আসছে… আপনি তো বলেছিলেন…” বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করলেন, কপালে ভাঁজ — “তুই যা দেখছিস, তা বাস্তব… রুদ্র আত্মাকে ছিন্ন করেছিল সাত ভাগে, সাতটি মৃত শরীরে তাকে লুকিয়ে রেখেছিল — কিন্তু তার আত্মার সপ্তম অংশ ছিল ‘চেতনার চাবি’, সেটা ছিল খোলা… সেটাই সে তোকে দিয়েছিল… ছবির সময়… ক্যামেরার লেন্স হয়ে উঠেছে আত্মার দরজা।” অরুণাভ স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। বৃদ্ধা বললেন, “সাতটি আত্মা জেগে উঠেছে, তুই তারই ডাক শুনছিস… কিন্তু ওরা মুক্তি চায়, আবার ভয়ও পায়। কারণ, রুদ্র ফিরলে ওদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।”

“তাহলে কি করব আমি?” — অরুণাভ জানতে চাইল। বৃদ্ধা বললেন, “তুই যদি ওদের শরীরগুলো খুঁজে পাস, আগুনে ফিরিয়ে দিতে পারিস… তবে চক্র ভেঙে যাবে। কিন্তু যদি রুদ্র তোকে সম্পূর্ণ দখল করে নেয়, তবে আর কেউ তাকে থামাতে পারবে না।” অরুণাভ বুঝল, সে এক দুঃস্বপ্নে ঢুকে পড়েছে, যেখান থেকে পালানোর উপায় নেই। তাকে খুঁজে বের করতে হবে সেই সাতটি দেহ — মৃত অথচ জীবিত, ছায়া অথচ স্পষ্ট। আর ক্যামেরা নয় — এবার তাকে নিজের শরীর দিয়েই পথ খুঁজে নিতে হবে, আগুনের চক্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। জানালার বাইরে তখন ভোরের আলো ফোটে, কিন্তু সেই আলোর মধ্যেও এক পুড়ে যাওয়া মুখ তাকে চেয়ে আছে — নীরব, ধোঁয়ায় মোড়া, আর ফিসফিসে গলায় বলছে, “তুই তোর দেহ নিয়ে চল… আমার ফেরার আয়োজন কর…”

চিন্ময়ী দেবীর দেওয়া নির্দেশ মতো অরুণাভ ফিরল সেই পুরনো শ্মশানে, যেখানে সে প্রথম ছবি তুলেছিল। এইবার সে নিয়ে এসেছিল একটা ছোট নোটবুক আর মোবাইলের GPS লোকেশন ট্র্যাকার — কারণ বৃদ্ধা বলেছিলেন, “সাতটি দেহ সাতদিকে ছড়িয়ে — কিন্তু এক অদৃশ্য রেখায় বাঁধা। তুই তাদের অবস্থান ছবি দিয়ে বুঝবি, পথ তৈরি হবে চক্রাকারে।” অরুণাভ প্রথমেই গিয়েছিল গঙ্গার বাঁকের দিকে, যেখানে পুরনো একটি পোড়া পলাশ গাছ আছে — সেই গাছের নিচে সে আগেও একটি কাফনচাপা দেহের ছবি তুলেছিল। এবার গিয়েই দেখে — গাছের গোড়ায় লালচে রঙের কিছু লেখা, যা আগুনে দগ্ধ হয়ে আধা-পোড়া। লেখা মাত্র একটা শব্দ — “অসীম।” আর পাশে এক ছেঁড়া কাফন — আর কিছু নেই। ক্যামেরায় ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই স্ক্রিনে এক ঝলক ধোঁয়া উঠল, আর সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে যেন ভেসে এল একটি ঘন কণ্ঠস্বর — “আমি প্রথম বাহক… আমার চোখ দিয়ে সে দেখত, আজও দেখি… যদি আগুনে ফেরাও, আমি মুক্ত হবো… কিন্তু তোর রক্ত লাগবে…” অরুণাভ কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে এল। ক্যামেরার মেমোরি কার্ডে ‘অসীম’ নামে একটা নতুন ফোল্ডার তৈরি হয়েছে — সে কিছুই করেনি।

পরদিন সকালে সে খুঁজে পেল দ্বিতীয় জায়গাটা — পুরনো ধ্বংস হওয়া একটি শিবমন্দির, যার বেদীর নিচে চাপা আছে এক পুরনো চিতাভস্ম। সেই চিতার কাছে দাঁড়াতেই শুরু হল দ্বিতীয় আত্মার ফিসফিস — “আমার নাম মণিদীপ… আমি দ্বিতীয় বাহক… সে আমার হৃদয়ে ছিল, আমি তাকে ভালোবাসতাম… সে আমার মাঝেই আগুন দিয়েছিল… আজও পোড়া গন্ধ বয়ে বেড়াই…” এবার শুধু কণ্ঠ নয়, অরুণাভ চোখে দেখল — চিতার পাশে ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা এক অর্ধদগ্ধ মুখ, যার চোখ নেই, কিন্তু মুখ বাঁকা হাসিতে ভরা। কণ্ঠ বলল, “আমাকে মুক্ত কর… নয়তো আমি তোর মধ্যেই আশ্রয় নেবো।” অরুণাভ কাঁপতে কাঁপতে একটা কাঠি জ্বালিয়ে চিতার সেই স্থানটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় — আর কণ্ঠ নিঃশেষ হয়ে যায় বাতাসে। কিন্তু ঠিক তখনই তার ডান কাঁধ জ্বলে ওঠে — সেখানে আগুনঘেরা এক চিহ্ন ফুটে উঠেছে। বুঝতে পারল, প্রতিটি আত্মা তাকে ‘স্বীকার’ করছে — সে একদম মাঝখানে, এক জীবিত চক্রবিন্দু — যে সাতটি দেহকে জাগাবে আবার পুড়িয়ে মুক্তিও দিতে পারবে। এরপর একে একে সে খুঁজে পেল —
৩) একটি প্রাচীন কুয়োর ধারে এক পুরনো কাঠের কফিন, যেখানে ছিল ‘নৃসিংহ’ — এক ভ্রান্ত শিষ্য, যাকে রুদ্রশর্মা বলি দিয়েছিল।
৪) একটি ফেলে যাওয়া স্কুলঘরের ভেতর কাঠের বেঞ্চের নিচে এক জরাজীর্ণ দেহ — যার নাম ছিল ‘গগন’, সে রুদ্রশর্মার রক্ষক ছিল।
৫) গঙ্গার মাঝের এক ছোট চর দ্বীপে পাওয়া গেল ‘রুদ্রপ্রতাপ’ — যাকে তন্ত্রের প্রয়োগে একবারেই ছিন্ন করে আগুনে ফেলা হয়েছিল।
৬) এক পোড়া বিহারে পাওয়া গেল ‘সুচরিতা’ — রুদ্রশর্মার একমাত্র নারী বাহক, যার দেহেই সে তার কামনা-তন্ত্র চালিয়েছিল।
৭) আর শেষে, অরুণাভ ফিরে গেল সেই পুরনো শ্মশানে — সেখানেই ছিল সপ্তম বাহক — নাম নেই, মুখ নেই — কেবল এক ছায়া, যে কিছু বলে না, শুধু চেয়ে থাকে। আর তার চোখেই অরুণাভ দেখল নিজের মুখ।

এই সাতটি আত্মা একে একে তাকে বলে গেল, “তুই যদি আগুনে ফেরাস, আমরা মুক্ত হবো… কিন্তু রুদ্র তোর মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে… একবার সব আগুন জ্বলে উঠলে, সে তোকে পূর্ণভাবে পাবে।” অরুণাভ বুঝতে পারল, সে শত্রু নয়, মিত্র নয় — সে নিজেই ভবানীচরণ রুদ্রশর্মার আত্মার শেষ আধার। তার দেহ, তার রক্ত, তার চোখ… সব হয়ে উঠেছে এক তান্ত্রিক ছায়ার পুনর্জন্মের আয়োজন। প্রশ্ন একটাই — সে কি পারবে এই সাত দেহকে আগুনে ফিরিয়ে চক্র ভাঙতে? নাকি অজান্তেই, সে হয়ে উঠবে সেই চূড়ান্ত দরজা, যার ভিতর দিয়ে ফিরবে এক আগুনময় তান্ত্রিক — ভবানীচরণ রুদ্রশর্মা?

অরুণাভের শরীর ক্রমশ বদলে যাচ্ছে — সে বুঝতে পারছিল। হাতের শিরা ফুলে উঠছে, ঘাড়ের নিচে যেন চিরুনি আঁচড়ে কেউ আঁকছে তান্ত্রিক প্রতীক, আর ঘুমের মধ্যে সে বারবার বলে উঠছে এক অবিকৃত ভাষায় — “জ্যোতিশ্ক, মহাত্বম, ছিন্নবিন্দু, অগ্নিসন্ধি…” — যেগুলো সে জীবনে কখনও শোনেনি। চিন্ময়ী দেবী তার শরীর ছুঁয়ে শুধু বললেন, “তোর ভেতরে যা চলছে, সেটা রক্ত নয়… ওটা আগুন… তোর ভেতরে রুদ্রের সপ্তম ভাগ জেগে উঠেছে।” অরুণাভ কেঁপে উঠে জানতে চাইল, “আমি কি এখন থেকেই ওর হয়ে যাচ্ছি?” বৃদ্ধা মাথা নেড়ে বললেন, “না… এখনো নয়। কিন্তু চক্র সম্পূর্ণ হলে তুই যদি নিজেকে আগুনে না দেয়, তবে রুদ্র তোর দেহই বেছে নেবে নিজের পুনর্জন্মের জন্য।” অরুণাভ স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মানে সাতটি আত্মাকে আগুনে ফিরিয়ে দিতে হলে, তাকে নিজেকেও সেই আগুনের ছোঁয়া দিতে হবে। তার দেহের একাংশ — রক্ত, চুল, হাড় — কিছু একটা আত্মাহুতির মতো ছেঁড়া লাগবে। সে যদি না দেয়, তাহলে ওই আত্মারা কখনও মুক্তি পাবে না। কিন্তু যদি দেয়, তাহলে হয়তো তার ভেতরের রুদ্র অংশ জেগে উঠবে চিরতরে।

সে সেই রাতে সিদ্ধান্ত নিল — সাতটি আত্মাধারী স্থানেই নিজে যাবে, আগুনের চিহ্ন কেটে দেবে, আর শেষ শ্মশানে গিয়ে দেবে নিজের শরীরের এক টুকরো অংশ — আঙুলের ডগা। সাত নম্বর বাহক — মুখহীন ছায়াটি তাকে নির্দেশ দিয়েছিল, “আমরা তোকে পেতে চাই না… আমরা চাই না রুদ্র ফিরে আসুক… কিন্তু আমাদের মুক্তির জন্য তুই একমাত্র দরজা… দরজা যদি খুলতে না চাস, তবে আমরা ফিরে যাব না, আর সে… তোকে নিয়েই ফিরবে।” সে প্রথমে গিয়েছিল পলাশ গাছের কাছে, কাফনের ছিঁড়ে রাখা জায়গাটিতে আগুন জ্বালাল। কাঁপতে কাঁপতে সে ছুঁড়ে ফেলল তার মাথার এক আঁচড় চুল। আগুন এক মুহূর্তে তীব্র হয়ে উঠল, আর সেখান থেকে এক অদৃশ্য আত্মা নিঃশব্দে ভেসে গেল — বাতাস ভারি হয়ে উঠে আবার হালকা হয়ে পড়ল। ঠিক একইভাবে পরপর চারটি আত্মা সে নিজ হাতে ‘অগ্নিদান’ করল। কিন্তু পঞ্চম আত্মার সময়… কিছু বদলে গেল।

গঙ্গার মাঝের ছোট চর দ্বীপে পৌঁছানো মাত্র অরুণাভের চোখ ঘোলাটে হয়ে গেল। সে আর নিজেকে চিনতে পারছিল না। বাতাসে হঠাৎ কিছুর চাপ, শরীর ভারী, হঠাৎ করেই তার হাত দিয়ে সেই আগুনের চিহ্ন আঁকা শুরু করল সে — মাটিতে, ঘাম ঝরতে লাগল, চোখ লাল। সে কিছু একটা বলছিল — “রক্তে জন্ম, ছায়ায় বাস, মৃতের মুখে আমি হাস…” — এ যে ভবানীচরণ রুদ্রশর্মার স্বগতমন্ত্র! ঠিক সেই সময় চর দ্বীপের পাশ থেকে উঠে এল এক বিকৃত ছায়ামূর্তি — এই দেহটি আত্মাহীন, কিন্তু সক্রিয়। আর তার ভেতরে রুদ্র নিজেই ঢুকে পড়েছিল। ছায়াটা হেঁটে এল অরুণাভের কাছে, বলল, “তুই আমার দ্বার, তুই আগুনে নামলে আমি জাগবো, তাই আমি তোকে এখনই পোড়াবো।” হঠাৎই সে ছায়া ছুটে এল অরুণাভের দিকে, সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে ছুরি বের করে নিজের বাম কাঁধ কেটে ফেলল — রক্ত ঝরল মাটিতে, আর সেই রক্ত দিয়ে সে আঁকল আগুনচক্র। ছায়া থমকে গেল, আগুন এক ঝলকে জ্বলে উঠল, আর সেই আত্মা নিঃশেষ হয়ে গেল ধোঁয়ার মধ্যে। রুদ্রকে ঠেকানো গেল — কিন্তু শুধু একবারের জন্য।

অরুণাভ জানত, আগামী দুটি আত্মা মুক্ত হবে না সহজে। প্রতিটি আত্মা তাকে ভয় দেখাবে, লোভ দেখাবে — কেউ বলবে, “আমাকে মুক্তি দাও, আমি তোমায় অমর করব।” কেউ বলবে, “আমায় পোড়ালে তুমি নিজেই ধ্বংস হবে।” কিন্তু তার মন স্থির ছিল — এই চক্র, এই তন্ত্র, এই ছায়াচক্র ভাঙতেই হবে। তবুও তার মাথায় এখনো একটাই প্রশ্ন ঘুরছে — “আমি যা করছি, সেটা কি সত্যিই মুক্তি দিচ্ছে ওদের? নাকি এইসব আগুনের ছায়ার মধ্যে দিয়ে আমি ধীরে ধীরে হয়ে উঠছি রুদ্রশর্মা নিজেই?”

অরুণাভ বুঝে গিয়েছিল, রুদ্রশর্মাকে হারাতে হলে তার অতীতের পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করতেই হবে। সে যাকে বোঝে না, তার বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না। চিন্ময়ী দেবী বলেছিলেন, “ভবানীচরণ নিজেকে ভেঙেছিল সাতবার — কিন্তু তার মন ছিল অটুট, সেই মন কোথাও বন্দি আছে — কোনও তন্ত্রে, কোনও বাক্যে।” সেই সূত্র ধরেই অরুণাভ যোগাযোগ করেছিল কাশীর এক পুরনো সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা আত্রেয়ী ঘোষ-এর সঙ্গে, যিনি মৃত-চক্র ও আগুনতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু অরুণাভ যখন তাকে তার ছবিগুলো দেখায়, এবং নিজের শরীরের পোড়াদাগগুলো, তখন তার চোখে আতঙ্কের পাশাপাশি আগ্রহও দেখা যায়। তিনি বললেন, “এই চিহ্ন আমি আগে দেখেছি… এটা মূলত ‘ত্রিনয়ন-সংচল’ — তন্ত্রবিশ্বে একমাত্র ব্যবহার হয় আত্মাসঞ্চার চক্রে… ভবানীচরণ যদি সত্যিই এই প্রতীক নিজের আত্মার খণ্ডে ব্যবহার করতেন, তবে তিনি আত্মা ফেরানোর কোনও পদ্ধতি লিখে গেছেন… কোথাও।”

আত্রেয়ী গবেষণাগারে নিয়ে যান অরুণাভকে। পুরনো, কাঠের আলমারিতে রাখা বহু শতাব্দীর পুরনো পুঁথি ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি হঠাৎ একখানা খয়েরি, পোড়া প্রান্তের পাণ্ডুলিপি বের করে আনলেন — যার নাম “মশানদণ্ড”। সেটির ভিতর লেখা ছিল, “সপ্তমীর চতুর্থ রাতেই আত্মাচক্রের বন্ধ দরজা খুলবে, এবং বাহক যদি চক্র পূর্ণ করে, তবে আত্মা পাবে অবতার রূপ।” পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে রুদ্রশর্মার নিজের হাতে লেখা এক ধরণের আত্মবৃত্তান্ত — যেখানে সে লিখেছে, “আমি মরব, কিন্তু আমি ফিরব। আমি ছিন্ন হব, কিন্তু আমি গড়ব। আমি ফিরে আসব তোর রক্ত দিয়ে। তুমি আমার দেহ নয়, তুমি আমার সাক্ষর।” পুঁথির এক জায়গায় লেখা ছিল এক অদ্ভুত শর্ত — “আত্মাহুতি মানেই মৃত্যু নয় — আত্মাহুতি মানে যা সবচেয়ে প্রিয়, তার বিসর্জন।” এই বাক্য পড়ে চুপ করে যায় অরুণাভ। তার মানে নিজেকে নয় — তাকে বিসর্জন দিতে হবে সেই স্মৃতিকে, সেই মানুষটিকে, যে তার আত্মার কেন্দ্রে বাস করে। কিন্তু কে সেই মানুষ? কে তার প্রাণ? কিছুতেই সে উত্তর পায় না।

রাতে হোস্টেলে ফিরে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীরের পোড়াদাগ এখন পরিষ্কার প্রতীকে রূপ নিচ্ছে — যেন তার শরীরই হয়ে উঠছে এক মণ্ডল। সে জানে, সময় কম — সপ্তমী আসছে। আর সপ্তমীর রাতে রুদ্র পূর্ণ আত্মাসহ অবতার রূপ নিতে চাইবে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল — আত্রেয়ী ফোনের ওপার থেকে বললেন, “আমি ভুলে গিয়েছিলাম… পুঁথির শেষে একটা পাতায় লেখা আছে — ‘জীবিত বাহকের ছায়া তাকে পূর্ণ করে, যদি তার হৃদয় শূন্য হয় তবে সে রক্ষা পায়, আর যদি হৃদয় পূর্ণ হয়, তবে আত্মা অধিকার করে।’ বুঝতে পারছো, অরুণাভ? ও তোমার হৃদয়ের ভালোবাসা, তোমার স্মৃতি দখল করতে চাইছে — তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো, তাকে সে দখল করবে।”

অরুণাভ স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখে ভেসে ওঠে কলকাতার কলেজের সেই পুরনো মুখ — নৈবা — যে একদিন তাকে বলেছিল, “তুই মরলে আমি তোকে কবর দেব ছবি দিয়ে।” সেই সম্পর্ক, সেই ভালোবাসা… হয়তো ভুলে গিয়েছিল এতদিন। কিন্তু রুদ্র জানত। তার চক্র জানত। তার প্রতিটি দেহ জানত, কে অরুণাভকে পূর্ণ করে। আর সে বুঝে যায়, পরবর্তী ধাপে তাকে শুধু আগুনে দেহ নয় — আগুনে বিসর্জন দিতে হবে তার ‘ভালোবাসার নাম’। এখন প্রশ্ন একটাই — সে কি প্রস্তুত সেই আত্মাহুতির জন্য?

সপ্তমীর আগের দিন সূর্য ডোবার সময়, বারাণসীর মণিকর্ণিকা ঘাট ছিল অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। বাতাসে ভেসে আসছিল পোড়া কাফনের ঘ্রাণ, আগুনের মৃদু ফোঁসফোঁস শব্দ আর ধোঁয়ার ভেতর ছায়া ছায়া চলাচল। অরুণাভ, একা, চুপচাপ পৌঁছে গিয়েছিল সেই নির্জন কোণায়, যেখানে প্রথম ছবিটি তুলেছিল। তার হাতে ছিল “মশানদণ্ড” পুঁথির শেষ পৃষ্ঠা — আর হৃদয়ে অনিঃশেষ টানাপোড়েন। ভালোবাসা কি আত্মাহুতি হতে পারে? যদি হয়, তবে সে কি প্রস্তুত হারাতে, যাকে একদিন নিজেকে দিয়েছিল? চিন্ময়ী দেবী বলেছিলেন, “ভালোবাসা মানেই আত্মার গভীর গ্রন্থি — রুদ্র সেই গ্রন্থিকে দখল করতে চাইছে, কারণ ওই জায়গায় ছায়া সহজে ঢুকে পড়ে।” তার কপালে তখন তিলক নয়, আগুনের দাগ; হাতে ছিল কাঠের কাঠি, আর শরীর যেন আগুনে পুড়ছে প্রতিনিয়ত, ভেতর থেকে।

ঠিক তখনই — গঙ্গার দিক থেকে ঘন ধোঁয়া উঠতে উঠতে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল তার দিকে। এটা আর আগের মতো আত্মাধারী কোন মৃতদেহ নয় — এটা যেন আলো-আঁধারির মিশ্রণে গঠিত কিছু, যার মুখ দেখা যায় না, কিন্তু যেটার কণ্ঠস্বর প্রচণ্ড পরিচিত। অরুণাভের গা ছমছম করে উঠল যখন কণ্ঠ বলল — “তুই আমাকে মনে রেখেছিস, তাই আমি এসেছি… আমি নৈবা… কিন্তু এখন আমি শুধু তোর স্মৃতি নই, আমি তোর ভয়।” মুহূর্তে তার শরীর শক্ত হয়ে এল। সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেই মুখ — চোখে কালো রিং, ঠোঁটে চেনা হাসি, আর চুলে গঙ্গার ধুলো লেগে থাকা সেই চেহারা — নৈবা, যে পাঁচ বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল তার জীবন থেকে। কিন্তু এ কি স্বপ্ন? না কি রুদ্র এই রূপ নিয়ে এসেছে তাকে ভুলাতে?

“তুই যদি আমায় বিসর্জন দিস, আমি হারিয়ে যাবো চিরতরে,” — বলল ছায়া-নৈবা।
“আর যদি না দিই?” — অরুণাভের গলা কাঁপছিল।
“তাহলে রুদ্র তোকে আমার মাধ্যমে অধিকার করবে। আমি তোকে নিজের হৃদয়ের দরজা করে দেবো… রুদ্র শ্বাস নেবে আমার স্মৃতির ভেতর দিয়ে।”

অরুণাভ তখন বুঝল — এটি তার শেষ পরীক্ষা। আগুনের সামনে সে দাঁড়িয়ে, এক হাতে কাঠির আগুন জ্বলছে, আর অন্য হাতে আঁকড়ে ধরা স্মৃতি — একমুঠো পুরনো চিঠি, নৈবার লেখা কবিতা, আর ক্যামেরায় তোলা শেষ ছবি। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে — ভালোবাসা বাঁচাবে, নাকি মুক্তি আনবে। ঠিক সেই মুহূর্তে, ছায়া-নৈবা এগিয়ে এসে তার কপালে হাত রাখে — আর মুহূর্তে অরুণাভ দেখে ফেলল, রুদ্রশর্মা তার মধ্যেই বসে আছে, নৈবার রূপকে ব্যবহার করে চক্র পূর্ণ করতে চাইছে।

অরুণাভ ধীরে ধীরে কাঠির আগুন এনে ছুঁয়ে দিল সেই চিঠির কোণ। এক ঝলকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ল পুরোনো কাগজে। ছায়া-নৈবার চোখে তখন শুধু বিস্ময়, আর একটুকরো কৃতজ্ঞতা। “তুই আমায় মুক্ত করলি…” — বলল সে নিঃশব্দে। অগ্নিসাক্ষী সেই আত্মা ধীরে ধীরে গলে গিয়ে মিলিয়ে গেল বাতাসে — ধোঁয়ার মতো, স্মৃতির মতো, ভালোবাসার মতো।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, অরুণাভের বুকের মধ্যে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি — যেন কিছু ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। সে বুঝতে পারল, এই প্রথম সে রুদ্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে এক টুকরো নিজেকে ছিঁড়ে এনেছে। আত্মাহুতি সম্পূর্ণ — কিন্তু আগুন নিভে যায়নি। আগুন যেন আরও বড় হয়েছে, যেন অপেক্ষা করছে শেষ পর্বের জন্য।

সপ্তমীর রাত। চারদিক নিস্তব্ধ, অথচ আকাশ জুড়ে বাজছে অস্পষ্ট ধ্বনি — যেন বহু আত্মা একসঙ্গে উচ্চারণ করছে এক শ্মশানমন্ত্র। বারাণসীর গঙ্গার ধারে, ঘাটের ঠিক পাশেই সেই পুরনো পোড়া চিতার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অরুণাভ। আগুন জ্বলেনি, অথচ আশপাশের বাতাস গরম — যেন আগুন নিজেই অপেক্ষা করছে ডাকের। আজই সেই রাত, যেদিন চক্র সম্পূর্ণ হলে রুদ্র ভবানীচরণ তার অষ্টম জন্ম নেবে — অরুণাভর শরীরের ভেতর দিয়ে। আর তাই অরুণাভ প্রস্তুত, নিজের রক্ত, নিজের শরীর, এমনকি নিজের চেতনার টুকরো আত্মাহুতি দিতে। কিন্তু সে জানে না, রুদ্র শুধু বাইরে থেকে আসবে না — সে ভিতর থেকেই জন্ম নেবে।

হঠাৎই শ্মশানের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। তার পায়ের নিচে কেঁপে উঠল মাটি — এবং একটা একদম নতুন কণ্ঠস্বর শোনা গেল। এটা আগের মত আত্মাদের ফিসফিসান নয় — এটা তীব্র, গম্ভীর, ত্রাসজাগানিয়া। “তুই আগুনে আত্মা ফেরাতে চাস? আমি তোর শরীরেই আগুন রাখব… আমি তোর হাড়ে লুকিয়ে, তোর রক্তে গড়া… আমি, ভবানীচরণ রুদ্রশর্মা, এই দেহেই ফিরে আসব।” সে বুঝল — আর সময় নেই। হঠাৎ চারপাশের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো সেই সাতটি আত্মা — আগুনে পোড়া চোখ, মুখে শোক, হাতে আগুনচক্র আঁকা। তারা একসঙ্গে বলল, “আমরা তাকে বেঁধে রেখেছিলাম, এখন তুই চাবি। যদি তুই পুড়িস, তবে সে জাগবে। যদি তুই নিজেকে মুক্ত করিস, তবে আমরা আবার তাকে ছায়ায় রূপান্তর করব।”

রুদ্র এবার ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল — অরুণাভর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল আগুনময় মন্ত্র:
“বিন্দু ছিন্ন, চক্র পূর্ণ, দেহ আগুনে, আত্মা জন্মে!”
অরুণাভ কাঁপতে কাঁপতে নিজের বুকে আঁকল সেই প্রতীক — আগুনের আঁচে। আগুন হঠাৎ নিজেই জ্বলে উঠল তার চারপাশে। আর সেই আগুনের মাঝেই জন্ম নিল এক ছায়া — মানুষের মতো, কিন্তু মুখহীন, চোখহীন, কেবল শরীর জুড়ে পাণ্ডুলিপির লিপি। সেই রুদ্র — পূর্ণ অবতাররূপে। কিন্তু ঠিক তখনই, আত্মারা ঘিরে ফেলল রুদ্রকে, একে একে তাদের নিজ নিজ স্মৃতি তুলে ধরল আগুনে —
অসীমের চোখ, মণিদীপের হৃদয়, নৃসিংহের কণ্ঠ, গগনের হাড়, রুদ্রপ্রতাপের পাঁজর, সুচরিতার চুল, আর সেই মুখহীন আত্মার মুখ — যেটা ছিল অরুণাভরই ছায়া।

এক মুহূর্তে রুদ্র চিৎকার করে উঠল — “তোমরা আমায় দিয়েছিলে শরীর, আজ আমায় নিয়ে নিচ্ছো?”
আত্মারা বলল, “তুই আমাদের দেহ নিয়েছিলি, আমরা তোকে ফিরিয়ে দিচ্ছি ছায়ায়…”

হঠাৎই চারদিকের আগুন একত্র হয়ে এক বিষণ্ণ অগ্নিমণ্ডলে রুদ্রকে আবদ্ধ করল। আর অরুণাভ চিৎকার করে নিজের ডান হাত সেই আগুনে ঢুকিয়ে দিল — রক্ত ঝরল, কিন্তু সেই রক্তেই লেখা হল শেষ প্রতীক: “অগ্নিবন্ধ”।
রুদ্র থেমে গেল। ছায়া গলে গিয়ে ফিরে গেল বাতাসে। অরুণাভ পড়ে রইল মাটিতে — অচেতন, অর্ধপোড়া হাতে।

শেষবারের মতো সে শুনল আত্মারা বলছে, “তুই আমাদের মুক্ত করেছিস। তোর ছায়া এখনও রক্ষিত। কিন্তু মনে রেখ — আগুন কখনও নিভে যায় না… সে শুধু অপেক্ষা করে।”

হাসপাতালের সাদা আলোতে চোখ মেলল অরুণাভ। কাঁধে জ্বলছে এক পুরনো ক্ষত, ডান হাতটা ব্যান্ডেজে মোড়া, তবু তার মনের ভেতরে যেন কেউ চুপিচুপি বলছে— “শেষ হয়নি, অরুণাভ, তুমি তো শুধু দরজা খুলেছো…”। চিন্ময়ী দেবী তাকে দেখতে এসেছিলেন আগের দিন। তিনি শুধু বলেছিলেন, “আগুন বন্ধ হয়েছে, কিন্তু ছাইয়ের নিচে অদৃশ্য স্ফুলিঙ্গ থেকে গেছে… এখন তুই সাবধানে থাকিস। আত্মা তো মুক্ত হল, কিন্তু ভবানীচরণের ‘লিখিত ছায়া’ এখনও পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।” ঠিক তখনই এক নার্স এসে জানায়, কারা যেন বাইরে থেকে তার নামে একটা খাম রেখে গেছে। অরুণাভ যখন খুলল খামটা, তার ভেতর বেরিয়ে এল এক ছেঁড়া কাগজ — আর তার ওপর অগ্নিলিপিতে লেখা ছিল:
“অগ্নিবিন্দু। শ্মশান নয়, এবার শহরের ছায়া।”
কাঁপতে কাঁপতে সে পেছনের দিকে তাকায় — কেউ নেই। শুধু জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ধোঁয়ার মতো ফিকে হয়ে যাওয়া এক ছায়া। মুখ নেই। চোখ নেই। কিন্তু বুকের মাঝখানে আঁকা সেই আগুনঘেরা চক্র — রুদ্রের স্বাক্ষর।

অরুণাভ বুঝে গেল, তার লড়াই এখানেই শেষ হয়নি — বরং শুরু হয়েছে আরেকটি স্তরে। কাশীর শ্মশান ছেড়ে এবার ছায়া ঢুকেছে শহরের অলিগলিতে, মানুষের স্মৃতি, ভালোবাসা, চিত্রকল্প, শিল্প আর লেখার মধ্য দিয়ে। সে তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করল আত্রেয়ী ঘোষের সঙ্গে। তার গবেষণাগারে গিয়ে তারা একসঙ্গে বিশ্লেষণ করতে থাকে “মশানদণ্ড” পাণ্ডুলিপির সেই অংশ, যা এখনো তারা বুঝে ওঠেনি। তখনই তারা খুঁজে পায় — এক পাতার নিচে আঁচড় দিয়ে লুকানো ছিল আরও একটি বাক্য:
“যদি আত্মা ছিন্ন হয়, তবে তার শব্দ খুঁজবে নতুন দেহ — কলমে, কাগজে, মঞ্চে, ক্যানভাসে।”
অর্থাৎ, রুদ্র নিজে শরীর পায়নি ঠিকই, কিন্তু তার আত্মার বাক্য, তার লেখা — যা সে শ্মশানের ছায়ার মাঝে লিখেছিল — সেই লেখাগুলো মানুষ যদি পড়ে, বিশ্বাস করে, বা উচ্চারণ করে… তবে সে আবার জন্ম নেবে। এইবার আগুন নয়, শব্দই হবে রুদ্রের বাহন।

তাদের আশঙ্কা সত্যি হতে সময় লাগে না। শহরের এক পুরনো নাট্যগোষ্ঠী হঠাৎ নতুন একটি নাটকের রিহার্সাল শুরু করেছে, যার নাম “তান্ত্রিকের আত্মা”। স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী, নাটকে একজন আগুনময় তান্ত্রিক ছায়া ফিরে আসে মৃতদের শরীর থেকে। নাট্যসংঘের পরিচালক, অভিনেতা আর সেট ডিজাইনার — সকলেই অসুস্থ হতে শুরু করে। কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠে বলে, “আমি তার বাহক… আমার চুল, আমার হাড়… ছুঁইয়ে দাও আগুন…”
একজন অভিনেতা তো মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছয় — এবং তার মরদেহের বুকে পাওয়া যায় সেই অগ্নিচক্র চিহ্ন, যেটা অরুণাভ নিজের শরীরে বহন করেছিল একসময়।

অরুণাভ এখন বুঝতে পারল — শুধু আত্মা নয়, ভবানীচরণ নিজের পুনর্জন্ম নিশ্চিত করে গিয়েছিল শব্দ ও লেখার মাধ্যমে। এখন প্রতিটি উচ্চারিত সংলাপ, প্রতিটি ছবির পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে এক আত্মাঘাতী ছায়া।
সে আত্রেয়ীকে বলল, “আমায় আবার ফিরতে হবে… এবার এই লেখা পোড়াতে হবে… আগুনে নয়, বিশ্বাস ভেঙে। যতক্ষণ লোকে ওকে বিশ্বাস করবে, ততক্ষণ সে ফিরে আসবে।”

১০

শহরের এক প্রাচীন লাইব্রেরির ভেতর, যেখানে মাটি আর ধূলোর গন্ধ মেশে পুরনো কাগজের সুবাসে, অরুণাভ পা রাখল। আত্রেয়ী ঘোষ তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, যিনি এই লাইব্রেরির একজন বিশেষ গবেষক ছিলেন। “এই লাইব্রেরির এক ঘরে,” বললেন তিনি, “লুকানো আছে সেই পাণ্ডুলিপি যা ভবানীচরণ রুদ্রশর্মা লিখেছিল, কিন্তু যা কেউ পড়েনি — কারণ সেটি ছিল একটি ‘অনুচ্চারিত মন্ত্র’। এটি উচ্চারণ করলেই চক্র পূর্ণ হয় অথবা শেষ হয়।” অরুণাভ মনে করল, এখানে আর কোন ভুল করার সুযোগ নেই।

ঘরটির দরজা খুলতেই ভেতর ছড়িয়ে গেল অদ্ভুত এক শীতল বাতাস। দেয়ালে লেপানো হাজারো প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, সেগুলোর মাঝে এক চামড়ার বাইন্ডিং করা বই, যার নাম ‘মশানদণ্ড’ — একই নামে যেটি আগে তিনি দেখেছিলেন, কিন্তু এইটি ছিল সম্পূর্ণ। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো এতটাই প্রাচীন যে স্পর্শ করলেই হাত জ্বলে ওঠার মতো অনুভূতি দিচ্ছিল। আত্রেয়ী একটু কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “এই মন্ত্র পড়ার সময় তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে। এই মন্ত্রের শক্তি ব্যাপক — তুই যদি ভুল করিস, রুদ্র চিরকালের মতো ফিরে আসতে পারে।”

অরুণাভ ধীরে ধীরে পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো ঘাটতে লাগল। সেখানে লেখা ছিল এক গা ছমছমে ধ্বনি, এক মন্ত্র যা ছিল ছিন্ন আত্মাদের পুনর্জন্ম এবং নির্বাসন উভয়েই দায়ী। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল — এই মন্ত্রটি সম্পূর্ণরূপে উচ্চারিত হলে, রুদ্রের আত্মা মুক্তি পাবে, কিন্তু সেই সাথে তার শক্তি চিরতরে ভেঙে পড়বে। এক ধরণের আত্মার মুক্তি ও আত্মাহুতির মেলবন্ধন। তার মনের মধ্যে বেজে উঠল চিন্ময়ী দেবীর সেই কথা — “আত্মাহুতি মানে মৃত্যু নয়, স্মৃতি, প্রেম আর আত্মার বিসর্জন।”

ঠিক তখনই লাইব্রেরির দরজা যেন নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। চারপাশ থেকে অদ্ভুত ছায়া উঠল, আর অরুণাভ অনুভব করল যেন রুদ্র তার ভেতর থেকে চিৎকার করছে, “উচ্চারণ কর, অরুণাভ, চক্র পূর্ণ কর, তোর হাতেই আমার জীবন!” সে জানত ভুল করলে নিজেই মৃত্যুর ফাঁদে পড়বে, সুতরাং গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে মন্ত্রটি উচ্চারণ শুরু করল। ধীরে ধীরে তার কণ্ঠস্বর বাড়তে লাগল, গা ছমছমে শব্দগুলো লাইব্রেরির দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল —
“বিন্দু ছিন্ন, আগুনে পুড়ে, আত্মা মুক্তি পাবে, চক্র ভাঙবে…”

মন্ত্র শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারপাশের ছায়াগুলো মুছে যেতে লাগল, বাতাস শীতল হয়ে গেল, আর অরুণাভ অনুভব করল যেন ভেতর থেকে এক ভারমুক্তি এসে পড়েছে। আত্রেয়ী তার পাশে এসে বললেন, “তুই করেছিস — চক্র ভাঙল, আত্মারা মুক্ত হলো। রুদ্র আর নেই।”
কিন্তু অরুণাভ জানত, আগুন নিভে গেলেও ধোঁয়া থেকে যায় — আর সেই ধোঁয়া মাঝে মাঝে ফিরে আসে… কিন্তু এবার সে প্রস্তুত।

1000040974.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *