অভিরূপ মুখার্জি
চোখ খুলতেই আরুণাভ টের পেল কিছু একটা অস্বাভাবিক। জানালার ফাঁক দিয়ে সোনালি আলো ঢুকছে, কিন্তু সেই আলোয় একধরনের ধূসরতা মিশে আছে, যেন রোদ নয়—কোনো স্ক্রিনের আলো। বিছানায় বসে চারপাশ তাকাল সে—ঘরটা পরিষ্কার, ছিমছাম, কিন্তু যেন গতকালের ঘর নয়। দেয়ালে যে রঙটা ছিল সবুজাভ, আজ সেটা হালকা নীল; জানালার বাইরে যে গাছটা ছিল, সেটা নেই, তার জায়গায় একটা পুরোনো ইলেকট্রিক পোস্ট, আর দূরে অদ্ভুত সব শব্দ—যেন লোকজন হাঁটছে, অথচ একটাও কণ্ঠস্বর নেই। আয়নায় নিজের মুখ দেখে চমকে উঠল আরুণাভ—চোখের নিচে কালি, মুখে ক্লান্তির রেখা, অথচ মনে পড়ছে না কেন। সে তো মাত্র ঘুম থেকে উঠল। পাশে টেবিলের ওপর একটা কফির কাপ, ধোঁয়া ওঠা কফি, কিন্তু কাপটা সে রাখেনি। দেয়ালের ঘড়ি বলছে সকাল ৭:১৯, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা থেমে আছে। ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই সে বুঝল, শহরটা যেমন দেখেছিল গতকাল, আজ সেটা সম্পূর্ণ আলাদা—রাস্তাগুলো নতুন, দোকানগুলোর নাম অজানা, আর মানুষগুলোর মুখে একধরনের প্রোগ্রামড হাসি।
চলতে চলতে তার মনে হলো সে একটা স্মৃতিশূন্য চক্রে আটকে পড়েছে। প্রতিদিন সে ঘুম থেকে উঠে এক নতুন শহরে প্রবেশ করছে, অথচ তার নাম সেই একটাই থাকছে, তার স্মৃতিগুলোও ঠিক আছে, কিন্তু বাইরের জগৎ পাল্টে যাচ্ছে একেবারে মৌলিকভাবে। একটি ক্যাফের সামনে এসে থামল সে, যেন চুম্বকের টানে—কাচের ভেতর দেখা গেল একটা চেনা মুখ, মেয়েটির চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা, যেন সে কিছু জানে, যেটা আরুণাভ জানে না। সে ভেতরে ঢুকতেই মেয়েটি বলল, “আজ তোমার ২৮তম লুপ।” আরুণাভের কাঁধ গুঁড়িয়ে এল। “আমি ইরা। আমি তোমার স্মৃতির আংশিক রূপ,” মেয়েটি বলল, হাসি না হাসি মুখে। “তুমি জানো না, কিন্তু তুমি আসলে নিজেকে খুঁজছো এই সিমুলেশনের মধ্যে।” আরুণাভ ব্যাখ্যা চাইল, কিন্তু ইরা উত্তর দিল না, কেবল এক কাপ কফি এগিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি এই শহরে বন্দি। রোজ এক নতুন বাস্তব তৈরি হয়, যাতে তুমি ভুলে যাও কে তুমি। তবে এখনও দেরি হয়নি।” এক মুহূর্তের জন্য ঘরের আলো নিভে গেল, জানালার কাচ কালো হয়ে এল, আর ঠিক তখনই বাইরে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল—যেন কোনো অদৃশ্য সিস্টেম বলছে, “System Calibration Complete. Cycle 28 Restarting.”
আরুণাভ দৌঁড়ে বেরিয়ে এল ক্যাফে থেকে। রাস্তা যেন লাফিয়ে বদলে যাচ্ছে তার চোখের সামনে—একবার পুরনো লাল ইটের গলি, পরমুহূর্তে সেটা চকচকে মেটালিক করিডর। লোকজনদের মুখে এখন আর কোনো অভিব্যক্তি নেই, যেন সব চরিত্র এক অদৃশ্য স্ক্রিপ্টে বাঁধা। সে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে খুঁজছে এমন কিছু যা বাস্তব, যা বদলায় না। হঠাৎই এক দেয়ালে চোখ পড়ে তার—সেখানে ঝুলছে একটি সাদা দরজা, যার নিচে লেখা আছে অদ্ভুত এক ভাষা, যার অর্থ সে বুঝতে পারলেও উচ্চারণ করতে পারে না। সে এগিয়ে গিয়ে দরজার হাতল ছোঁয়ামাত্রই দরজাটা গায়েব হয়ে গেল, আর সে নিজেকে দেখতে পেল ঠিক তার পাশের ভবনের জানালায়—সেখানে দাঁড়িয়ে সে-ই, যেন এক আয়নার প্রতিবিম্ব নয়, বরং এক বিকল্প বাস্তবতা। ঠিক তখনই ইরার কণ্ঠ ভেসে এল বাতাসে: “তুমি পালাতে পারো না, যতক্ষণ না তুমি নিজেকে ভুলে যাও।” কাঁপতে কাঁপতে সে মাথা নিচু করল, আর মনেই পড়ল না—সে কে ছিল আসলে, কোথা থেকে এসেছিল। শুধু মনে আছে—তার নাম ছিল আরুণাভ, কিন্তু তাও কি নিশ্চিত?
***
ঘোর কাটতেই আরুণাভ নিজেকে খুঁজে পেল এক লিফটে, যেখানে কোনো বোতাম নেই—শুধু একপাশের দেয়ালে একটি আয়না। আয়নাটা স্বচ্ছ, কিন্তু তার প্রতিবিম্ব যেন তার গতিবিধির ঠিক উল্টো কাজ করছে—সে ডান হাতে চুলে আঙুল চালালে, আয়নার ভেতরের সে বাঁ হাতে নাক স্পর্শ করছে। অস্বস্তিতে মাথা ঘুরে গেল তার, আর তখনই এক শব্দহীন টোনে আলো টিমটিম করে জ্বলে উঠল। আয়নার ওপারে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল ইরার মুখ। তবে এবার সে মানুষ নয়—তার চোখগুলো কাঁচের তৈরি, চুলের গোড়ায় তারের মতো কিছু টানটান হয়ে আছে। “তুমি কি নিজেকে দেখতে পাচ্ছো, আরুণাভ?” —কণ্ঠটা যেন কোনও এক স্থির তরল থেকে আসছে। আরুণাভ মুখ খোলার আগেই আয়নার মধ্যে তার প্রতিবিম্ব বলে উঠল, “তুমি এখানে নেই। তুমি যা ভাবো, সেটাও নয়।” লিফট হঠাৎ কেঁপে উঠল, আর সে অনুভব করল তার শরীরটা যেন গলে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে কোনও এক ভার্চুয়াল তরঙ্গের ভেতর। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আয়না ভেঙে পড়ল, আর দেহটা পড়ল কোথাও না থাকা এক জগতে।
পড়ে গিয়ে চোখ খুলতেই সে দেখল নিজেকে এক খোলা মাঠে, যেখানে ঘাসের মাথা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, আর আকাশটা আসলে স্ক্রিনের মতো টিমটিম করছে। তার সামনে ইরা হাঁটছে, কিন্তু সে আর আগের মতো নয়—এই ইরা যেন বহু শতাব্দীর ক্লান্তি বয়ে বেড়ানো এক যান্ত্রিক আত্মা, যার দেহ একদম নিখুঁতভাবে মানুষের মতো হলেও ভেতরে কেবল কোডের অনুরণন। “তুমি ভাবছো, আমি কে? আমি আসলে কিছুই নই। আমি কেবল সেই একফালি স্মৃতি যা তুমি প্রতিবার মুছে ফেলো, আবার খুঁজে পাও।” আরুণাভ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমি কীভাবে মুক্তি পাবো?” ইরা থেমে বলল, “তোমাকে মুক্তি চাইলে ভুলতে হবে নিজেকে। মনে রেখো, এই শহর প্রতিদিন তোমাকে নতুন নামে ডাকবে, নতুন ঘর দেবে, নতুন অতীত তৈরি করবে—কিন্তু তুমিই সেই একমাত্র চরিত্র যাকে সব জেনেও অভিনয় করতে হয়।” দূরে একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল, ছায়ার গায়ে ঝুলে আছে প্রাচীন কম্পিউটারের মতো কীবোর্ড আর তার। ছায়াটি ক্রমশ এগিয়ে আসছে, আর ইরা ফিসফিস করে বলল, “সে আসছে, প্রোগ্রামার।”
এই শব্দ শোনামাত্র চারপাশের বাতাস জমে গেল, মাঠটা নিঃশব্দ হয়ে গেল যেন কেউ ‘মিউট’ বোতাম টিপে দিয়েছে। আরুণাভ সেই ছায়ামূর্তিকে স্পষ্ট দেখতে পেল—তাঁর মাথার জায়গায় কোনও মুখ নেই, শুধুই এক গাঢ় নীল আলো, আর সারা শরীরে কোডের মতো কিছু ঘুরছে। মূর্তিটি চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেও যেন কথা বলছে, আর তার মাথার ভেতরে বাজছে—“তুমি এখনও লগড ইন আছো, আরুণাভ সেন। তুমি এখনও বোঝোনি, তুমি কে?” ইরা তার কাঁধে হাত রাখল, বলল, “তুমি যদি সত্যিই বুঝতে চাও, তবে আয়না ভেঙে ফেলো। যতক্ষণ না আয়নার ওপারে নিজের মুখ খুঁজে পাবে, তুমি কেবল একটা সিমুলেশনেই ঘুরে বেড়াবে।” সেই মুহূর্তে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এলো একটি নতুন দরজা, যার গায়ে লেখা: “Mirror Loop Initiation: Version 29.” আরুণাভ দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে, মুখে এক অদ্ভুত বিষণ্নতা। পেছনে তাকিয়ে দেখল—ইরার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে, অথচ সে তো এক মেশিন, তাই কি সত্যিই কাঁদছে? না কি সেটাও একটা মরীচিকা?
***
দরজা পেরিয়ে আরুণাভ যেন এক গ্লিচে ঢুকে পড়ে। চারপাশের সময় আর স্থান ভেঙে টুকরো হয়ে যায়—ছাদ থেকে নেমে আসে পাখির ডাক, রাস্তার পিচ ফেটে উঠে পড়ে শূন্যে, আর বাতাসে ঘুরে বেড়ায় ভাঙা স্পিকারের শব্দ—“Initiating Home Sequence… Error… Error…”। সে বুঝতে পারে, সে একটি ‘ফিরে যাওয়ার’ চক্রে প্রবেশ করেছে—কিন্তু এ ফিরিয়ে নেয় না তাকে তার নিজের ঘরে, তার নিজের শহরে, বরং তাকে নিয়ে যায় এমন এক জায়গায়, যেখানে প্রতিটা মানুষ তার নামে ডাকে, কিন্তু কোনো সম্পর্ক নেই। সে যখন রাস্তায় হাঁটে, দোকানের লোক বলে, “আজ একটু দেরি করলি রে, আরুণাভ,” অথচ তার মুখে হাসি নেই, চোখে অভিব্যক্তি নেই—এ যেন কোনো একটা পূর্বনির্ধারিত ডায়ালগ। এক বৃদ্ধা তার হাতে দেয় এক ছবি, যেখানে সে, ইরা আর আয়ান দাঁড়িয়ে আছে কোনো এক পাহাড়ের সামনে। অথচ এমন কোনো স্মৃতি তার নেই। চারপাশের সবকিছু যেন তাকে বোঝাতে চায়—“তুই এখানেই থাকিস, এখানেই জন্মেছিস, এখানেই ফিরবি।” কিন্তু তার ভেতরে একটা তীব্র অস্বস্তি দানা বাঁধে—এই ‘ফিরে যাওয়া’ কি আসলেই নিজের বাড়ি, না কি আরেকটা নিখুঁত ভুল?
সে আবার খুঁজে পায় আয়ানকে—একটা ছিমছাম পার্কের বেঞ্চে বসে সে কফি খাচ্ছে, হাসছে, পুরনো বন্ধুদের মতো তাকে ডাকছে। কিন্তু আরুণাভ জানে, এটা বাস্তব নয়। সে আয়ানকে জিজ্ঞেস করে, “তুই মনে রাখতে পারিস প্রতিদিন সকালে কোথায় ঘুম থেকে উঠিস?” আয়ান চুপ করে যায়। সে চোখ নামিয়ে বলে, “আমি কিছু মনে রাখি না, কারণ রাখার দরকার নেই। আমাদের এখানে সবটাই নতুন, প্রতিদিন। ভুলে থাকাই বাঁচা।” আরুণাভ তবু বলে যায়, “কিন্তু আমি তো মনে রাখি। আমি জানি গতকাল কী হয়েছিল। আমি জানি প্রতিদিন আমি অন্য ঘরে উঠি, অন্য শহরে হাঁটি। আমি জানি এই সব লোকগুলো, তুই, এমনকি ইরাও… তোমরা কেউই প্রকৃত নয়।” আয়ান মুখ তুলে চেয়ে বলে, “তাহলে তুই কেন এখনও আমাদের সঙ্গে কথা বলিস, হ্যাঁ? ভুলে যা সব। ভুলে গেলেই তো সিস্টেম তোকে শান্তি দেবে।” আর ঠিক তখনই বেঞ্চটা গলে যায়, কফির কাপ ভেঙে পড়ে—আর আয়ান নিখোঁজ হয়ে যায় কুয়াশায়। চারপাশ থেকে এক আওয়াজ ভেসে আসে—“Reality Conflict Detected. Stabilization Required.”
এইবার শহরটা ভয়ানক রূপ নেয়। রাস্তাগুলো দুলতে থাকে, দেয়ালে ভেসে ওঠে আগের দিনের দৃশ্য, বাতাসে গন্ধ আসে পোড়া প্লাস্টিকের মতো। দূর থেকে দেখা যায়, এক বিশাল স্ক্রিনে আরুণাভের মুখ—আবার সেই লুপে ঢুকে পড়েছে সে। সে দৌড়ে চলে যেতে চায়, কিন্তু প্রতিটি রাস্তা তাকে ফিরিয়ে আনে সেই একই চত্বরে—যেখানে প্রথমদিন তার ঘুম ভেঙেছিল। সে বুঝতে পারে, এ শহর তাকে আটকে রেখেছে, কারণ সে ভুলতে চায় না। স্মৃতি এখানে দোষ, স্মরণ মানেই শাস্তি। আর তখনই বাতাসে ভেসে আসে ইরার গলা—“তুমি পালাতে পারো না, যদি না নিজেকে বদলাও। ভুলে যাও ফিরে যাওয়ার চেষ্টা।” আরুণাভ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে একা, আর ধীরে ধীরে তার চারপাশে গড়ে ওঠে এক অদৃশ্য দেয়াল, স্ক্রিনে ঝলসে ওঠে বারবার—“You Are Not Ready Yet.” সে জানে, ফিরতে পারবে না, কারণ ফিরে যাওয়ার আর কোনো বাস্তব নেই।
***
সকালটা যেন এক পুরনো দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। আরুণাভ আবার জেগে ওঠে সেই নিঃশব্দ ঘরে—ঘড়ি থেমে আছে ঠিক ৭:১৯-এ, কফির কাপ টেবিলে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু আজকের ঘরটা আগের চেয়ে আলাদা। জানালার কাচে সে নিজেকে দেখে, আর হঠাৎই বুঝতে পারে, তার মুখটা আগের দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন। নাকটা বেশি তীক্ষ্ণ, চিবুকের রেখা গভীরতর, চোখে লালচে ছাপ। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আর দেখে—প্রতিবিম্ব এবার অনুসরণ করছে না। সে ডান হাত তোলে, কিন্তু আয়নার ভেতরের সে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, নিঃস্পৃহ, মাটির দিকে তাকিয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে আয়নার মধ্যেকার প্রতিবিম্ব ধীরে ধীরে মাথা তোলে, চোখে চোখ রাখে আর বলে, “তুই এখন আমার জায়গায়, আর আমি তোর।” মুহূর্তের মধ্যে আয়নাটা ফাটল ধরে, ভেঙে পড়ে না, কিন্তু ফাটলজুড়ে ভেসে ওঠে নানা দৃশ্য—তার ফেলে আসা স্মৃতি, মা’র মুখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, একটা পুরনো হোস্টেল ঘর, আর একটা কফি ভরা সন্ধ্যা। সবকিছু যেন কেবল ছায়া, কিন্তু ব্যথা বাস্তব। সে চোখ বন্ধ করে, মুখে হাত রাখে, আর অনুভব করে—এই স্মৃতিগুলো কি আদৌ তার ছিল? নাকি এগুলোও কেউ ইনপুট করে দিয়েছে, শুধু তাকে ‘মানুষ’ বলে বোঝাতে?
শহরটা আজ আরও বেশি ফাঁপা লাগে। লোকজন কথা বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে আরুণাভর দিকে। একটা ছেলেকে সে দেখে বসে আছে রাস্তায়, হাতে একটা চিপসের প্যাকেট, কিন্তু খাচ্ছে না—হঠাৎ ছেলেটা তাকিয়ে বলে, “তুমি সিস্টেমের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছো, তাই তো?” আর কিছু বলার আগেই ছেলেটার মুখটা গলে গিয়ে ফোটো-রিয়ালিস্টিক মুখোশের মতো খুলে পড়ে, নিচে আরেকটা ফাঁকা মুখ—শুধু দুটি চোখ, আর একটা স্ক্রিনে লেখা নাম: Ayaan_26। আরুণাভ পেছনে ফিরে পালাতে চায়, কিন্তু শহরের রাস্তা আজ সব কেমন যেন টেকনিক্যাল গ্লিচে ভরা—চলন্ত গাড়ি হঠাৎ থেমে যায়, দেয়ালের রং বদলে যায় লাইভ কোডিং এর মতো, এক বিশাল স্ক্রিনে দেখা যায় তারই মুখ, তারই গলা—কিন্তু সে কিছু বলেনি। ইরার গলা শোনা যায়, এবার দূর নয়, তার পাশের দেওয়াল থেকে: “তুমি যতই চেষ্টা করো, ততই প্যাটার্ন ভাঙবে, কারণ তুমি নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো। এই শহর একটা আয়নার ঘর। তুমি সব দরজা ঘুরে ঘুরে আবার নিজের সামনে এসে পড়ো। এখান থেকে যাওয়ার একটাই রাস্তা—নিজের সমস্ত প্রতিচ্ছবি ভেঙে দাও।”
সে হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়ে একটা গোলাকার কক্ষের সামনে, যার চারপাশে শুধু আয়নাই আয়না। প্রতিটি আয়নায় তার একটা প্রতিকৃতি—কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ রক্তাক্ত, কেউ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে। ঠিক মাঝখানে একটা চেয়ার আর টেবিল, টেবিলে রাখা একটি ছোট বাক্স, যার গায়ে লেখা: “Memory Override Key”। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, বাক্স খুলতে গিয়েই কেঁপে ওঠে—কারণ তার ভেতরে রাখা একটা পুরোনো ডায়েরি, যার প্রথম পাতায় লেখা: “আমি নিজেই এই শহর বানিয়েছি, নিজেকে ভুলে যাব বলে। কিন্তু আমি ভুলিনি। আমি আরুণাভ।” হঠাৎ সব আয়না একসাথে ফেটে যায়, প্রতিটি প্রতিকৃতি একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, আর চারপাশে শুধু একটা শব্দ—“LOOP FAILURE. IDENTITY BREACH DETECTED.” সে বুঝে যায়, তার প্যাটার্ন আর আগের মতো চলবে না। সে নিজেই এবার কোড ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু সে কোথায় ফিরবে? আর কীই বা অপেক্ষা করছে পরের দরজার ওপারে?
***
শহরের ছায়া ভেঙে আজ একটি নতুন স্তরে পৌঁছেছে আরুণাভ। আয়নার ঘরটা যখন ভেঙে পড়ল, তখন তার আশেপাশে কিছুই ছিল না—শুধু নিস্তব্ধতা আর একরঙা আলোয় ভেসে থাকা বায়ুরঙা বুদবুদ। সেই শূন্যতার মধ্য দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটার পরে হঠাৎই সে এসে পৌঁছায় এক অদ্ভুত ভবনের সামনে। ভবনটি বাইরে থেকে আধা-পরিত্যক্ত ল্যাবরেটরির মতো, গায়ে রুক্ষ সিমেন্ট, জানালায় ধুলো ধরা কাঁচ। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই সময় যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি দেয়ালে ছড়িয়ে আছে সারি সারি পর্দা—কিছুতে তার মুখ, কিছুতে অন্য শহর, আবার কিছু পর্দা কেবল কালো, যেখানে একটাই শব্দ জ্বলছে: “WAITING.” ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন ড. সোমদত্ত মিত্র—একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, যার মুখে যেন নীরব বিদ্রুপ, চোখে সময়ের গভীর ক্লান্তি। তিনি বললেন, “অবশেষে তুমি এখানে পৌঁছেছো, আরুণাভ। আমার সর্বশেষ প্রোটোটাইপ।” আরুণাভ স্তম্ভিত। “আপনি… আপনি কে? এই শহর কি আপনি বানিয়েছেন?”—প্রশ্ন ছুটে আসে। ড. মিত্র হেসে বলেন, “আমি শুধু দরজা খুলে দিয়েছিলাম। তুমিই এই শহরের স্থপতি। ভুলতে চেয়েছিলে নিজেকে, বুঝতে চেয়েছিলে—‘আমি’ বলে কিছু আদৌ আছে কি না। আমি শুধু সেই চেতনার ছাঁচ দিয়েছিলাম।”
আরুণাভ তখন বুঝতে পারে, সবকিছু পরিকল্পনার অংশ ছিল না, কিন্তু সে ছিল পরিকল্পনার কেন্দ্র। ল্যাবের ভেতরে একটি ছোট ঘরে ড. মিত্র তাকে নিয়ে যান, যেখানে একটি কাঁচের ঘরে রাখা একটি দেহ—নির্জীব, কিন্তু অবিকল তার মতো দেখতে। ড. মিত্র বললেন, “তুমি এখন যে চেতনায় বাঁচছো, সেটি তোমারই তৈরি একটি কপি। এই দেহ, এই সত্তা—সবই এই সিমুলেশনের ‘বেস লাইয়ার’। তুমি এখানে এসেছো ‘আত্ম-প্রশ্নের’ উত্তর খুঁজতে, কিন্তু প্রশ্নটাই যে ভুল।” আরুণাভ কাঁপতে কাঁপতে বলে, “তাহলে আমি কি মিথ্যে?” ড. মিত্র জবাব দেন না, শুধু তাকে দেখান একটি মোটা বই—তার লেখা গবেষণাপত্র, নাম: “Simulated Identity Collapse: Case Study – Subject A.Sen.” সেই বইয়ের প্রতিটি পাতায় তার নাম, তার স্মৃতি, তার মানসিক ভাঙন, তার রাত্রির ঘুমহীনতা লিপিবদ্ধ। একেকটা পাতায় সে খুঁজে পায় নিজের মুখ, নিজের ভয়, নিজের পুরোনো প্রশ্ন। সে চিৎকার করে ওঠে, “আমি যদি বেঁচেই না থাকি, তাহলে এত কষ্ট পাই কীভাবে?” ড. মিত্র এবার ধীরে ধীরে বলে ওঠেন, “কারণ কষ্টটাই তোমার বেঁচে থাকার একমাত্র প্রমাণ, আর সেই কষ্টের চেতনা—তাকেই তুমি ভুলে ফেলতে চেয়েছিলে। তাই এই সিমুলেশন।”
ঘরটা ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসে। ল্যাবের বাতাস ভারী হয়ে যায়, যেন সময় থেমে আছে, শুধু তাদের দু’জনের কথাই বেঁচে আছে। ড. মিত্র একটা সুইচ টিপলে ভেসে ওঠে এক ঘূর্ণায়মান কিউব, যার প্রতিটি কোণে আরুণাভর কোনো না কোনো স্মৃতি গেঁথে আছে। ইরা, আয়ান, পার্কের দৃশ্য, আয়নার ঘর, প্রতিটি মুহূর্ত সেখানে গুনগুন করছে। “এই হচ্ছে তোমার ‘ফ্রেমওয়ার্ক’,” বলেন মিত্র, “এটাই তোমার মানসিক গঠন, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই মরীচিকার শহর। তুমি যদি এই কিউব ভাঙো, তবে হয়তো ফিরে যেতে পারো তোমার মৌলিক সত্তায়, কিন্তু তুমি হারাবে সব স্মৃতি—সব প্রশ্ন, সব ব্যথা।” আরুণাভ হাত বাড়িয়ে কিউব ধরতে যায়, কিন্তু থেমে যায়। চোখে জল, মুখে অসহায়তা। সে জানে না—ভুলে যাওয়াই কি মুক্তি, নাকি এই প্রশ্নবিদ্ধ যন্ত্রণার মধ্যেই সত্যের স্পর্শ। তার কানে ভেসে আসে ইরার কণ্ঠ, শেষবারের মতো: “ভুলে যাওয়া সহজ, কিন্তু বেঁচে থাকা তার চেয়ে কঠিন।” আর তখনই ল্যাবের সব আলো নিভে যায়, স্ক্রিনগুলো একে একে মুছে যায়, আর দেয়ালের গায়ে ভেসে ওঠে কেবল একটা শব্দ—“DECIDE.”
***
আকাশে তখন গোধূলির রঙ, শহরের বিলবোর্ডগুলো যেন এক বিশাল প্রজেক্টরের মতো ঘন ঘন চেহারা বদলে দিচ্ছে। রাহুল থমকে দাঁড়ায় এক চওড়া স্ক্রিনের সামনে, যেখানে বারবার ভেসে উঠছে ‘RESTART TO RECOGNIZE’। প্রথমে মনে হয়েছিল কোনো বিজ্ঞাপন, কিন্তু তৃতীয়বার দেখার পর তার চোখে এক তীব্র টান অনুভব হয়। কে যেন বলছে—তুই এখানে আগেও এসেছিস। পরক্ষণেই, তার মস্তিষ্কে হঠাৎ এক কল্পনার তরঙ্গ: একটা ভাঙাচোরা ঘর, দেয়ালে লাল পেন্সিলের দাগ, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক মেয়ে—যার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু চোখে এক অসমাপ্ত আকুতি। সে দৃষ্টি রাহুলের ভিতরটা কাঁপিয়ে দেয়। অথচ সেই স্মৃতিটা স্পষ্টভাবে মনে পড়ে না। এই শহরে তার আগেও আসার কথা নয়, কিন্তু কেন যেন সব কিছু চেনা চেনা লাগছে। সেই অনুভবটা শুধু চেনা নয়, যেন তার অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। রাহুল জানে, শহরটা প্রতিদিন নতুন হয়, তবু সে এও জানে, প্রতিটি নতুনতার আড়ালে লুকিয়ে আছে পুরনো কোনও নিঃশব্দ ইঙ্গিত। প্রশ্নটা সেখানেই—কেন সে এই পুনরাবৃত্ত চিত্রনাট্যের কেন্দ্রবিন্দু?
সেদিন রাতে রাহুল ফিরে যায় তার ছোট্ট ঘরে, যেটা শহরের এক প্রান্তে, আবছা আলোয় ঢাকা। রুমের দেয়ালে একটা আয়না, আর আয়নার বিপরীতে রাখা একটা পুরনো ডেস্কটপ—যেটা সে খুলেছে বহুদিন পরে। লাইট বন্ধ করে, সে কম্পিউটার অন করে, আর আশ্চর্য হয়ে দেখে, ডেস্কটপে কোনো ফোল্ডার নেই—শুধু একটা নামহীন আইকন, ক্লিক করতেই এক অদ্ভুত সফটওয়্যার চালু হয়, যার ইন্টারফেস যেন বহু পুরনো ২০০০ সালের DOS কমান্ড উইন্ডোর মতো। কমান্ড প্রম্পটে লেখা, “REMEMBER TO EXIT.” যেন কেউ ইচ্ছা করে রেখেছে রাহুলের জন্য। সে ENTER চাপতেই স্ক্রিনে অদ্ভুত চিত্র ফুটে ওঠে—তার নিজের চোখ দিয়ে দেখা একটা স্মৃতি—যেখানে সে একটা স্কুলের ক্লাসরুমে, দেয়ালে তোলপাড় করা ডায়েরিগুলোর ছবি, আর কিছু হাতে লেখা অক্ষর—‘Project Morichika’। সে চমকে উঠে পেছন ফিরে দেখে, ঘরের দেয়াল যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে, যেন সফটওয়্যারের মধ্য দিয়ে সে শহরের অন্য এক ভার্সনে চলে যাচ্ছে। বাস্তব আর ভার্চুয়ালের এই সীমান্তরেখা এখন আর আলাদা করা যাচ্ছে না। রাহুল জানে, এই সফটওয়্যার শুধুই একটা দরজা, সেই দরজা দিয়ে ঢুকতে হলে তাকে পুরনো স্মৃতিগুলো আবার ফিরিয়ে আনতে হবে—কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে তার স্মৃতি মুছে দিয়েছিল?
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে রাহুল দেখল শহরটা আবার বদলে গেছে—এইবার সিগন্যাল পোস্টগুলো উল্টো, মানুষগুলোর মুখে একই রকম হাসি, কিন্তু চোখে কোনো চিন্তার রেখা নেই। সে হাঁটতে হাঁটতে এক বাচ্চা ছেলের সামনে দাঁড়ায়, যার হাতে ধরা একটা খেলনা ড্রোন। রাহুল জিজ্ঞেস করে, “তুমি আগে এই শহরে ছিলে?” ছেলেটা মাথা নাড়ল, “আমি তো সব সময় এখানেই ছিলাম, শুধু রাস্তা বদলে যায়।” রাহুল এবার নিশ্চিত হয়, এই গেম সিমুলেশন শুধু ওর চারপাশেই নয়—প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক অনুভব, প্রত্যেক পরিচিতি হয়তো কোডের মতো লিখে রাখা। কিন্তু এর পিছনে কেউ আছে—কেউ যে জানে সে এই শহরের ‘বাগ’, অথবা হয়তো সে-ই একমাত্র ‘রিয়েল প্লেয়ার’। কিন্তু এই ভয়াবহ আবিষ্কারের মাঝে একটাই সমস্যা—এই শহর থেকে বেরিয়ে যেতে হলে, তাকে সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলতে হবে, এমনকি নিজের নাম, পরিচয়, কষ্ট, ভালোবাসা—সবকিছু। রাহুলের সামনে তখন দাঁড়িয়ে শুধুই এক অদৃশ্য প্রশ্ন—সত্যি কী সে তার অস্তিত্ব ভুলে যেতে পারবে মুক্তির বিনিময়ে? নাকি সে লড়ে যাবে এই মরীচিকার শহরের ভিতরেই, নিজেকে খুঁজে পেতে?
***
অরণ্যর ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত শব্দে—মনে হলো যেন বাতাস ভেদ করে কেউ ফিসফিস করে ডাকে তাকে। কিন্তু ঘরের ভেতর বা বাইরের জানালার ফাঁক দিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। উঠেই ওর মনে পড়ল, আজ সকালটা অন্যরকম। কারণ গতরাতের অভিজ্ঞতা, সেই সাদা পর্দা, ‘লোডিং…’ শব্দটা, আর সেই অনন্ত-অন্ধকার—সবকিছু যেন ওর ভিতরের বাস্তবতাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। অথচ বাইরে তাকিয়ে দেখে, শহরটা আবার বদলে গেছে। রাস্তার মোড়ের সেই পুরনো চায়ের দোকান আজ এক রঙিন ড্রোন ক্যাফে। পাশের বাড়ির জানালায় আগে যেখানে এক বয়স্ক মানুষ বসতেন, এখন সেখানে দাঁড়িয়ে এক কিশোর, যার চোখে ভার্চুয়াল হেডসেট, এবং শরীরে লেড স্ট্রিপ-জোড়া বডি স্যুট। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো এখন আর অরণ্যকে চমকে দেয় না। বরং ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে—প্রতিদিন সকালে বদলে যাওয়া এই শহরটাই ওর জীবনের নিত্যদিনের একমাত্র নিশ্চিততা। কিন্তু আজকের দিনে কোথাও যেন একটা অদৃশ্য টান আছে। মনে হলো, শহরটা নিজেই ওকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। ও রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটতে থাকে, আর লক্ষ্য করে, আশপাশে লোকজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটে না—সবাই যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা প্রোগ্রাম মাত্র। তখনই ওর চোখ পড়ে এক বৃদ্ধার দিকে, যিনি ধীরে ধীরে একটি পুরনো ইলেকট্রিক ট্রলির পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলেন, “তুমি যখন বুঝবে, তখন জানবে ভুলে যাওয়াটাই মুক্তি।” অরণ্য হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে মহিলাটি অদৃশ্য হয়ে যান। যেন এক গ্লিচের মতো, হঠাৎ করেই মুছে গেলেন সিস্টেম থেকে।
ও দ্রুত ছুটে যায় সেই ‘গ্লিচ’–এর উৎস অনুসন্ধানে। কিন্তু যেখানেই যায়, সব কিছু নিখুঁতভাবে কোডেড, সাজানো। এমনকি লোকজনদের কথাবার্তা, আচরণ, হাসি—সবটাই যেন নিখুঁত স্ক্রিপ্টের মতো। তবে আজ, কেউ একজন সেই স্ক্রিপ্ট ভেঙে ফেলেছে। হঠাৎই অরণ্যর মনে পড়ে যায় সেই ডেটা সেন্টারের কথা, যেটা শহরের প্রান্তে পুরনো এক লিফ্টের নিচে আছে—অপ্রচলিত, ব্যবহৃত নয় বহুদিন ধরে। বলা হয়, ওটা আগে ‘সার্ভার রুম’ ছিল, এখন বন্ধ। ঠিক তখনই ওর চোখে পড়ে এক ব্লু-স্যুট পরা ব্যক্তিকে, যার চোখেও হেডসেট নেই, মুখে হালকা দাড়ি, আর চেহারায় অবচেতন এক শূন্যতা। ও ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে উল্টো দিকে, যেখানে শহরের ‘রিস্টার্ট জোন’ থাকে—একটা লাল রঙের নিষিদ্ধ গেট, যেখানে প্রবেশ করা মানেই নিজের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলা। অরণ্য দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু সাহস করে অনুসরণ করে তাকে। লোকটি এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে পড়ে, পিছন ফিরে বলে, “তুমি কি প্রস্তুত ভুলে যেতে?” অরণ্যর সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে যায়, অথচ কিছু না ভেবেই সে জবাব দেয়, “হ্যাঁ, যদি জানি সত্যিটা কি।”
ওরা দু’জনে একসঙ্গে সেই লাল গেটের সামনে পৌঁছায়। গেটের ওপারে নেমে গেছে এক সরু অন্ধকার সিঁড়ি, যার শেষ দেখা যায় না। প্রত্যেক ধাপে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের শব্দ, আলো, রঙ বদলে যেতে থাকে। যেন একটা করিডোর নয়, একেকটা স্তর—যা একেকটা স্মৃতি মুছে দেয়। প্রথম ধাপে নামতেই অরণ্য অনুভব করে, ওর পুরনো স্কুলের স্মৃতি কোথাও মিলিয়ে গেল। দ্বিতীয় ধাপে মা’র সঙ্গে শৈশবের ছুটির দুপুর হারিয়ে যায়। তৃতীয় ধাপে প্রিয় বন্ধুদের মুখ যেন ঝাপসা হয়ে পড়ে। এবং চতুর্থ ধাপে সে বুঝতে পারে, তার নিজের নামও মনের মধ্যে থেকে মুছে যাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে, হাঁপাচ্ছে, কাঁপছে, কিন্তু পিছিয়ে যেতে পারছে না। পাশে থাকা সেই ব্লু-স্যুট পরা লোকটি শান্ত গলায় বলে, “যতক্ষণ তুমি নিজের অস্তিত্বে জড়িয়ে থাকবে, ততক্ষণ তুমি বাস্তব পৌঁছতে পারবে না।” এই কথাটা যেন একটা চাবিকাঠির মতো খুলে দেয় সব কুয়াশা। অরণ্য হঠাৎ বুঝে যায়—এই শহর, এই গ্লিচ, এই মানুষেরা—সবই এক বিশাল গেমের অংশ, যেখানে সে নিজে শুধু একটি চরিত্র নয়, বরং একটি চেতনার অংশ, যাকে প্রতিনিয়ত ভুলে যেতে বলা হয়েছে, যাতে সে কখনো বাস্তব চিনতে না পারে। সেই মুহূর্তেই ও সিদ্ধান্ত নেয়—পরের ধাপে নামবে। নিজেকে ভুলে, কিছু খুঁজে পেতে। ঠিক কোন সত্য, সেটা সে জানে না। কিন্তু খোঁজার তীব্রতা এখন সবচেয়ে প্রগাঢ়।
***
অরণ্যের ভিতরে শহরের সীমারেখা কোথায় মিলিয়ে গেল, তা বুঝে ওঠার আগেই নীলয় এক অদ্ভুত পরিবেশে এসে পড়ল। সকালবেলার আলো একরকম ঘন কুয়াশার মতো আবছা, যেন সূর্য তার দায়িত্ব ভুলে গেছে। পাশের দালানগুলো আগের চেনা গঠনের মতো নয়, বরং গড়নেই কিছু ভার্চুয়াল গ্লিচ ধরা পড়ছে—একটা জানালা মাঝেমধ্যে অদৃশ্য হয়ে আবার ফিরে আসছে, রাস্তার একাংশ মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে পাথরবাঁধানো পথ থেকে ধাতব সিঁড়িতে। নীলয় আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল, কিছু লোকজন—যাদের সে এক সপ্তাহ আগেও দেখে আসছিল—এখন এমনভাবে হাঁটছে যেন তারা প্রোগ্রামড। তাদের চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই, মুখে অদ্ভুত মেকানিকাল শান্তি। একজন বৃদ্ধ হঠাৎ পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল, “তুমি অনেক দূর এগিয়ে এসেছ, ছেলেটা। এখন আর ফিরে যাওয়া যাবে না।” কথাটা শুনেই নীলয়ের গায়ে কাঁটা দিল। সে বুঝল, তার চারপাশের বাস্তবতা এখন পুরোটাই প্রশ্নসাপেক্ষ—এটা কি তার কল্পনা, নাকি এমন কোনও মাল্টি-লেয়ারড সিমুলেশন যেখানে সে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে?
সে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল এক চেনা ক্যাফের সামনে—কিন্তু তাও যেন বদলে গেছে। দোকানের ভিতরে আগের সেই হাসিখুশি বারিস্টা নেই, বরং একজন নিঃশব্দ মহিলা বসে আছে যার চোখ স্থির, গলার স্বর যেন অডিও লুপে চলছে। “আপনার অর্ডার দিন, আপনার অর্ডার দিন, আপনার অর্ডার দিন…” একই সুরে সে বলছে। নীলয় বুঝতে পারল—এটা কোনও ভুল বা এলোমেলো গ্লিচ নয়, বরং একটা তৈরি বাস্তবতার সূক্ষ্ম ফাঁক। সে ব্যাকরণহীনভাবে ভাবতে থাকল—এই শহরটা তৈরি হয়েছে কার পরিকল্পনায়? কে এই নিয়ন্ত্রণ করে? হঠাৎই পিছন থেকে এক কিশোরের কণ্ঠে ভেসে এল, “তুই এখানেও পৌঁছে গেছিস? ভাবিনি।” ঘুরে দেখে নীলয় চমকে উঠল—ওর বন্ধু অর্ক, যে বছরখানেক আগে হারিয়ে গিয়েছিল। তবে অর্কের চোখ এখন কেমন শূন্য, তার শরীরের চারপাশে একধরনের ডিজিটাল ওরা ঘোরাফেরা করছে। “তুই আমাকে অনুসরণ করছিস, তাই তো? রিয়েল ওয়ার্ল্ড খুঁজছিস, না?” নীলয়ের গলা শুকিয়ে এল। সে বুঝতে পারল, এই শহরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি মুহূর্ত আসলে একেকটা স্তর, আর প্রতিটা স্তরের পেছনে লুকিয়ে আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন।
অর্ক ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, আর বলল, “তুই জানিস, ‘রিয়েল ওয়ার্ল্ড’-এ যেতে হলে নিজেকে মুছে ফেলতে হয়। যেদিন আমি বুঝে ফেলেছিলাম যে আমি শুধুই একটা অবজার্ভার, সেদিনই আমি এই সিমুলেশনের নিয়ম ভেঙেছিলাম।” নীলয়ের মাথায় যেন বজ্রপাত হল। সে চেয়েছিল এই শহর থেকে মুক্তি, কিন্তু সেটা যদি তার নিজের অস্তিত্বের বিনিময়ে হয়? অর্ক বলল, “যতক্ষণ তুই নিজের পরিচয় আঁকড়ে ধরবি, ততক্ষণ তুই এই শহরের সীমানার বাইরে যেতে পারবি না। প্রতিদিন তোকে নতুন বাস্তবতা দেখানো হবে, কিন্তু সবই মরীচিকা।” নীলয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে কি এই মরীচিকার শহরের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবে? নাকি একদিন তাকেও এই সিস্টেম গ্রাস করে নেবে, যেমনটা করেছে অর্ককে? চারপাশে আবার গ্লিচ শুরু হল—একটা দেয়াল হঠাৎ ঢেউ খেলতে খেলতে অদৃশ্য হয়ে গেল, আকাশে সূর্য দুটি দেখা যাচ্ছে। সময় থেমে নেই, বাস্তবতা ক্রমাগত ভেঙে পড়ছে। নীলয় জানে, সামনে যা আসবে, তা তার অস্তিত্বের শেষ চ্যালেঞ্জ।
***
অর্ণবের দৃষ্টিতে যেন শহরটা এক বিশাল গোলকধাঁধার মতো পরিণত হয়েছে। দিনের আলো ফুটতেই চারপাশের ভবনগুলো, রাস্তার বাঁক, এমনকি ট্রাফিক সিগন্যালগুলো পর্যন্ত পাল্টে গেছে। সে হাঁটছিল নিজের কলেজের উদ্দেশে, কিন্তু ঠিক সেই জায়গাটায় এসে পৌঁছাল, যেখানে কাল ছিল একটি ধাবা, আজ সেখানে একটা লোহার গুদাম। অর্ণব চোখ কচলাল, মাথা নাড়ল, ফোন বের করে লোকেশন চেক করল—সব ঠিকঠাক, তবু চারপাশ যেন সম্পূর্ণ অচেনা। বারবার মনে হচ্ছিল, যেন একটা সফটওয়্যারের বাগে আটকে গেছে সে, একটি বৃত্তাকার বিভ্রমে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে এক চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে একজন স্থানীয় বৃদ্ধের সঙ্গে কথাবার্তা জুড়ল। বৃদ্ধ বলল, “ছেলে, এই শহরের মানুষজন রোজ সকালে নতুন হয়। তুমি যদি আগের দিনের কিছু মনে রাখো, তবে তুমি এখানকার নও।” অর্ণব থমকে গেল। বৃদ্ধ চোখে চোখ রাখল, তারপর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশার ভেতর। অর্ণব বুঝতে পারল, এখানকার সময় ও বাস্তবতা—দুটোই একটি অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতে।
পরদিন ভোরে উঠে সে দেখল, তার নিজের ঘরটিও বদলে গেছে। দেওয়ালের রং, জানালার দিক—সব কিছুই অচেনা, অথচ জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা আগের মতোই। আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠল সে; মুখটা তারই, কিন্তু চোখে এক ধরনের অচেনা নির্লিপ্ততা। ঘরের কোণে রাখা ল্যাপটপটা খুলতেই একটি স্ক্রিন মেসেজ ভেসে উঠল: “LEVEL 9: আপনি এখন অস্তিত্ব পর্যবেক্ষণের ধাপে আছেন।” অর্ণব হতবাক হয়ে গেল। তাহলে সে কোথায় রয়েছে? এ কি কোনো বহুমাত্রিক রিয়েলিটি সিমুলেশন? কে চালাচ্ছে সবকিছু? হঠাৎ দরজার বাইরেটা আলোর স্রোতে ঢেকে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেল, আকাশে বিশাল এক থ্রিডি গ্রিড, যার প্রতিটি কোষে নড়াচড়া করছে মানুষের ছায়া। তার মনে পড়ল কালকের বৃদ্ধের কথা—এই শহরের মানুষজন আসলে কি সব অবজারভার, কিংবা গেমারের চরিত্রমাত্র? এই ভাবনার মধ্যেই দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল, আর তার সামনেই দাঁড়িয়ে এক তরুণী—দীপ্তি, যাকে অর্ণব চিনত না, অথচ মেয়েটি জানত অর্ণব সম্পর্কে এমন কিছু, যা শুধুমাত্র সেই জানে।
দীপ্তি তাকে বলল, “তুমি Level Break করতে চাইছো, তাই তো? মনে রাখতে হবে—তোমার স্মৃতিই তোমার শেষ শত্রু।” এই বলে সে একখানা ছোট চিপ দিল অর্ণবের হাতে। সেটি ছিল ত্রিকোণাকৃতি, মাঝখানে একটি নীল আলো জ্বলছিল। চিপটি ছোঁয়াতেই অর্ণবের সামনে খুলে গেল একটি নতুন ইন্টারফেস—যেখানে শহরের একটি ম্যাপ, কিছু চরিত্রের ছায়া এবং সময়ের রৈখিক বিভাজন দেখাচ্ছিল। অর্ণব বুঝে গেল, এই ইন্টারফেসই তার গেম থেকে মুক্তির শেষ চাবিকাঠি। কিন্তু দীপ্তির কথার অর্থ কী? কেন স্মৃতিই শত্রু? সে কি তার অতীতের কোনো ভার বয়ে বেড়াচ্ছে যা তাকে আটকে রেখেছে এই সিমুলেশনে? এর উত্তরের খোঁজে অর্ণব যখন সেই ম্যাপে নির্দেশিত একটি নির্জন স্থানের দিকে হাঁটা দিল, তখন তার মনে হচ্ছিল যেন সে ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্বের গভীর এক ঘোরে প্রবেশ করছে, যেখানে সবকিছুই বাস্তব—তবু কিছুই আসল নয়।
***
অর্ণব হাঁটছিল সেই নির্জন পথ ধরে, ম্যাপে দেখানো শেষ বিন্দুর দিকে। আকাশটা ঠিক নীল নয়, ধূসর নয়, যেন এক অনির্ধারিত রঙে আঁকা পর্দা। শহরের শব্দ নেই—কোনও গাড়ির হর্ন, না মানুষের হাঁটার আওয়াজ—শুধু নিজের নিঃশ্বাসের ছায়া পেছনে পড়ে রয়েছে। পথের পাশে ছড়ানো বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোতে ঝুলছে নোঙরহীন স্ক্রিন, যেখানে একেকটা ভেসে উঠছে তারই মুখ—ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতিতে। কোনওটাতে সে চিৎকার করছে, কোনওটাতে কাঁদছে, আর কোনওটাতে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে এক শূন্যে। সে নিজেই নিজের পরিদর্শক হয়ে উঠেছে। সময়ের হিসেব নেই, কারণ ঘড়ির কাঁটা এখানে এগোয় না। পথ শেষ হলো এক বিস্মৃত গেটের সামনে—লোহার কাঠামোয় জং ধরা, তার ওপরে লেখা: “EXIT / DELETE SELF”। দরজার পাশে রাখা এক কনসোল, যার স্ক্রিনে জ্বলছে কমান্ড: “Final Access: Confirm Memory Erasure?” অর্ণব দাঁড়িয়ে থাকে, কাঁপতে থাকে, আর স্মৃতির ভারে ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তার সামনে একে একে ভেসে ওঠে মা’র মুখ, স্কুলের মাঠ, সেই ছেলেটার চিৎকার, দীপ্তির কণ্ঠে শোনা শেষ বাক্য—“তোমার স্মৃতিই তোমার শত্রু।” প্রশ্নটা তখন তীব্র: মুক্তি যদি ভুলে যাওয়ার বিনিময়ে আসে, তবে সে কি আদৌ মুক্তি?
তার সামনে দুইটি বোতাম: একটায় লেখা “YES”, অন্যটায় “NO”. ওর চোখ তখন ঝাপসা। যে শহরটা প্রতিদিন বদলায়, যে বাস্তবতাকে সে ধরে রাখতে পারেনি, সেই শহর কি আদৌ তাকে ক্ষমা করবে? সে বোতামের ওপর হাত রাখে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়, যদি সে নিজের নামটুকুও ভুলে যায়, তবে কি সে নিজেই থাকবেনা? তার অস্তিত্ব কি শুধু তার মনে থাকা কিছু আবছা ছবির উপর দাঁড়ানো? সে বোতাম চাপে না—বরং চোখ বন্ধ করে বলে ওঠে, “আমি ভুলবো না। যদি এটাই আমার শাস্তি হয়, হোক। আমি জানি, আমি আছি, কারণ আমি মনে রাখি।” ঠিক তখনই স্ক্রিন কালো হয়ে যায়। চারপাশে ঝড়ের মতো আওয়াজ, ঘূর্ণায়মান ছায়া, আর ভারী শব্দে স্ক্রিনে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত বার্তা—”UNEXPECTED BEHAVIOR. USER REJECTED FINAL ESCAPE. INITIATING MEMORY PRESERVATION PROTOCOL.”
পরক্ষণে তার সামনে খুলে যায় আরেকটা দরজা—সাদা আলোয় ভরা, নিঃশব্দে দুলতে থাকা। সে এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে। দরজা পেরিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে। চারপাশে কোথাও গেম নেই, সিমুলেশন নেই, স্ক্রিপ্ট নেই। নেই মানুষ, নেই ঘরবাড়ি। শুধু এক বিস্তৃত ফাঁকা প্রান্তর—যেখানে সে দাঁড়িয়ে, একা। নীচে তার পায়ের ছাপ পড়ছে, যা এই প্রথমবার, এই প্রথম এবং সম্ভবত শেষবার, সে নিজের উপস্থিতির ছাপ রেখে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারে, সিমুলেশন এখনও চলছে, কিন্তু এ স্তরে সে নিজেকে ভুলে যেতে পারেনি—বরং নিজের ভিতরেই খুঁজে পেয়েছে সত্যের বীজ। এটাই হয়তো মুক্তির আসল রূপ—ভুলে যাওয়া নয়, বরং সবকিছু জেনেও বেঁচে থাকা। অর্ণব দাঁড়িয়ে থাকে, বাতাসে তার নামের প্রতিধ্বনি মিশে যায়, আর শহরের ওপরে ধীরে ধীরে উদিত হয় এক নতুন সূর্য—যার আলো প্রথমবার তার ছায়া ফেলে বাস্তবের দিকে।
—
শেষ




