Bangla - রহস্য গল্প

মরণফাঁদ

Spread the love

দিব্যজ্যোতি হালদার


অধ্যায় ১:

বছর সাতেক পর দীপঙ্কর চৌধুরী পা রাখল মুর্শিদাবাদের পুরনো রাজবাড়ির উঠোনে। হাওয়ায় একরকম বাষ্পঘন গন্ধ—পুরনো কাঠ, চুনকাম ধরা দেয়াল, আর দাদুর ব্যবহৃত তেল-সুগন্ধির মিশেল। ইংল্যান্ডে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার পর এমন প্রাসাদোপম, অলস অথচ রহস্যময় পরিবেশে ফিরে আসাটা একধরনের সাংস্কৃতিক ধাক্কা। অথচ মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা—এই বাড়িতেই তার শৈশব কেটেছে, তার ঠাকুমার সঙ্গে কান্না-মাখা গল্পের সন্ধ্যা, পেছনের বাগানে আমগাছের ডালে দোল খাওয়া, আর গজদরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ের মুখোশ পরা কল্পনা। সেই গজদরজা—মুখ্য আকর্ষণ, আর একসাথে সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস এই বাড়ির—আজও একইরকম দাঁড়িয়ে, জং ধরা লোহার দাঁতের মতো নখর ছড়ানো দরজা, যার পেছন থেকে মাঝরাতে কান্নার আওয়াজ শুনেছে বহু মানুষ। দীপঙ্কর যখন গাড়ি থেকে নামল, তখনই নিরুপা দিদিমণি—বাড়ির পুরনো কাজের মহিলা—এক কাপ কড়াকড়া লাল চা হাতে এগিয়ে এসে বলল, “ছেলেটা ফিরল অবশেষে… রাজবাড়ির ছেলে ফিরে এলো, তবে কি আবার চলবে খেলা?” এই কথার গভীরে কিছু ছিল, যেন সে জানে কিছু এমন, যা বাকিরা শুধু আঁচ করতে পারে।

বাড়ির ভেতর এখন একধরনের চক্রাকারে জমা হওয়া বিদ্যুৎ। সকলেই এসেছে রায়বাহাদুর অমলেন্দু চৌধুরীর ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে—মেয়েরা শাড়ি পরে, গলায় সোনার হার ঝুলিয়ে ঘোরাফেরা করছে, পুরুষেরা বিভিন্ন কোণে দাঁড়িয়ে মদ্যপানে মগ্ন, কেউ কেউ ফোন ঘেঁটে, কেউ আবার পুরনো পারিবারিক রেষারেষি নিয়েই মুখ বেঁকিয়ে কথা বলছে। অরিত্র চৌধুরী, দীপঙ্করের কাকা, একসময় বাবার ব্যবসা দেখতেন—আজকাল কলকাতার রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন, বেশ দাপট নিয়ে ঘুরছেন; পাশে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী মায়া—যার চোখে কেমন এক নিঃসঙ্গ ছায়া। কৃত্তিকা পিসি, যিনি সংস্কৃতির চর্চায় বিশ্বাসী, আধা-পাগল আর্টিস্টদের মতো পোশাকে এসে জানিয়েছেন, “বাড়ির হাওয়ায় আজকাল অশুভ কিছু আছে।” এইসব চরিত্রের মাঝে দীপঙ্কর নিজেকে অচেনা মনে করল—কিন্তু আরও অচেনা ছিল দাদু রায়বাহাদুরের হুইলচেয়ারে বসা মুখ, মুখে নিঃসাড় নিরবতা, চোখে তীক্ষ্ণ অভিমানের রেখা। বয়স তাঁর শরীরকে হারিয়ে দিলেও দৃষ্টির ধার কাটেনি। দীপঙ্কর বুঝতে পারে, এই বাড়ির ছায়া নেমে এসেছে দাদুর চোখেও।

সন্ধ্যেবেলা যখন আলো কমে এল, আর প্রাসাদের করিডোরে ঘন ছায়া পড়ল, তখন ডিনার টেবিলে সবাই বসে। হাসি, ঠাট্টা, কথাবার্তার মাঝে একটা অলক্ষ্যে চাপা টান। আর তখনই ঘটে সেই ঘটনাটা—মায়া এক চিৎকারে উঠে পড়ে বলল, “অরিত্র! দরজা খুলছে না!” সবাই দৌড়ে গেল অরিত্রর ঘরের সামনে। ভেতর থেকে বন্ধ দরজা, জানালা লোহার গ্রিল দেওয়া, ঘরের মধ্যে কারও সাড়া নেই। কেউ কেউ ডাকতে লাগল, কেউ আবার দরজা ধাক্কাতে লাগল। অবশেষে দরজা ভাঙা হলো। ঘরে ঢুকে দেখা গেল—অরিত্র মৃত, বিছানার উপর নিথর পড়ে আছেন, গলায় ফাঁসের দাগ, কিন্তু ঘরের কোথাও আত্মহত্যার সরঞ্জাম নেই। তার মুখ বিকৃত, চোখ ফোলা, এক হাতে মুঠোবদ্ধ কাগজ—তাতে লেখা কিছু অক্ষর, যেগুলো ঘোলাটে। অথচ দরজা ছিল ভিতর থেকে ছিটকিনি মারা। সবার চোখ গেল গজদরজার দিকে—দরজাটা ঠিক সেই অবস্থায়, একটু খোলা, যেন কেউ চুপি চুপি গিয়েছিল ওখান দিয়ে, অথবা… এসেছিল। অথচ বাইরের সিসিটিভি, পাহারাদার—কেউ কাউকে আসতে যেতে দেখেনি। বাড়িতে থমথমে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কেউ কিছু বলে না—শুধু নিরুপা গজদরজার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “ফিরে এসেছে… পান্না ফিরেছে…”

রাত্রে, সবাই যার যার ঘরে চলে গেলেও দীপঙ্করের ঘুম আসে না। সে জানালা দিয়ে দেখে, নিরুপা গজদরজার সামনে বসে আছে—মাথা নীচু, চোখ বন্ধ, ঠোঁটে প্রার্থনা। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দেড়টা ছুঁই ছুঁই করছে। একঝলক বাতাস দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে আসে। বাতি দপ করে নিভে যায়। হঠাৎ যেন গজদরজার পেছন থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস শোনা যায়। দীপঙ্কর মনে মনে ভাবে—এটা কি কাকতালীয়? না কি এই রাজবাড়ির দেওয়ালের ভেতরে সত্যিই এমন কিছু আছে, যা বছরের পর বছর অপেক্ষা করে, কেবল ফিরে আসার জন্য? তার চোখে ভেসে ওঠে ছোটবেলার এক ছবি—একবার নিরুপা বলেছিল, “এই বাড়িতে এক গৃহপরিচারিকা ছিল, যাকে কেউ খুঁজে পায়নি… খুঁজবে না, কারণ সে এখানেই আছে।” সেই রাতে দীপঙ্কর সিদ্ধান্ত নেয়—সে নিজেই খুঁজবে সত্যি, যেটা কেউ খুঁজে বের করেনি।

অধ্যায় ২:

ভোরবেলা যখন রোদ হালকা হাওয়ার সঙ্গে জানালায় ধাক্কা দিচ্ছিল, তখন চৌধুরী পরিবারের পুরনো ভৃত্যরা ঘর ঝাঁট দিতে গিয়েই পেছনের করিডোরে মানুষের ফিসফিস শুনে থমকে যায়। রাতের ঘটনার পর সবার মধ্যে একটা অদ্ভুত স্নায়ুচাপ, একটা অব্যক্ত ভয় ছড়িয়ে পড়েছে। রায়বাহাদুর অমলেন্দু আজ আর কাউকে ডাকেননি, বরং তাঁর নিজের ঘরের দরজাটাও ভিতর থেকে বন্ধ। মায়া নিজ ঘরে দরজা আটকে দীর্ঘক্ষণ কাঁদছিলেন—যে কান্না কেউ শুনতে পায়নি, শুধু চুপ করে গজদরজার নিচ দিয়ে হাওয়া বয়ে গিয়েছিল সেই শব্দ নিয়ে। পুলিশ ডাকা হয়েছে—আর এসেছেন সুব্রত দত্ত, কলকাতা পুলিশের একজন অভিজ্ঞ অথচ বিতর্কিত তদন্তকারী অফিসার, যাঁকে বহু বছর আগে রায়বাহাদুর নিজে ব্যক্তিগত ভাবে অপমান করেছিলেন এক জমি মামলা নিয়ে। সেই সুব্রত দত্ত আজ আবার ফিরেছেন এই প্রাসাদে, কিন্তু এবার তদন্তকারী হয়ে। তিনি প্রথমেই অরিত্রর ঘর পরীক্ষা করলেন, দরজার ছিটকিনি, জানালার গ্রিল, চাদরের অবস্থান—সব কিছু। তার চোখ পড়ল কাগজের টুকরোটার ওপর—অরিত্রর মুঠোয় আঁচড়ে ধরা ছিল যেন শেষ মুহূর্তে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কাগজে ছিল আধভাঙা লেখা, গায়ে দাগ—“তুমি তো জানো… পান্না…”। এই নামটি সকলের মনে যেন বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিল, অথচ কেউ সরাসরি উচ্চারণ করল না। শুধু নিরুপা, যিনি বারবার দরজার কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন কারও ফেরার অপেক্ষায়।

দীপঙ্কর সেইসময় নিজের ঘরে বসে গজদরজার একটা পুরনো ম্যাপ খুঁজছিল। বাড়ির পুরনো নীলনকশার কপি সে পেয়েছে লাইব্রেরির ভিতর থেকে—এক জীর্ণ কাঠের আলমারিতে রাখা। ম্যাপটি অনুযায়ী, বাড়ির পেছনের দিকের গজদরজার নীচে রয়েছে একটি ইটের ঘর—“দরজাঘর”—যেখানে বহু বছর আগে বন্দিদের রাখা হতো বলে জানা যায়। সেই ঘর বহু বছর বন্ধ, অথচ রাতে সেখান থেকেই নিঃশ্বাস, চাপা কানের শব্দ, ছায়া দেখা গেছে। দীপঙ্কর লণ্ঠন হাতে নিয়ে একাই সেই ঘরে ঢোকার চেষ্টা করল। দরজায় তালা, কিন্তু তালা জং ধরা আর প্রাচীন। খানিক জোরেই খুলে গেল। ঘরের ভিতর চুন-সুরকি ভরা দেয়াল, কালি লাগা আয়না, আর এক কোণে পড়ে থাকা একটি ভাঙা কাঠের পিড়ি। মেঝের উপর ধুলো ঢাকা, কিন্তু মাঝখানে যেন হালকা হালকা পায়ের ছাপ! কে এসেছে এখানে? কীভাবে? দরজা তো বন্ধই ছিল! হঠাৎ সে মেঝেতে একটি জং ধরা সিন্দুক দেখে থেমে যায়। সিন্দুক খুলে সে পায় একটি ছেঁড়া পুরনো কাপড়, কিছু হলদে কাগজ—আর একটি কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো পুঁতি জড়ানো চুলের কাঁটা। সেই কাঁটার পিছনে লেখা: “পান্না, ১৯৪৩”। দীপঙ্করের মনে পড়ে, ছেলেবেলায় সে শুনেছিল, এই বাড়িতে এক গৃহপরিচারিকা ছিল যার নাম ছিল পান্না—কথা ছিল, সে একদিন হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, কেউ খুঁজে পায়নি, আর বাড়ির লোক মুখ বন্ধ করে দেয়।

সেই দুপুরেই সুব্রত দত্ত সকলকে ড্রয়িংরুমে ডেকে জেরা শুরু করেন। প্রশ্ন উঠে আসে অরিত্রর মৃত্যু নিয়ে—কে কোথায় ছিলেন, কে কী শুনেছেন, আর বিশেষ করে—কে জানেন পান্না সম্পর্কে? রায়বাহাদুর কিছু বলেন না, শুধু চোখ বন্ধ করে থাকেন। কৃত্তিকা বলেন, “পান্নার নাম বাড়িতে এখন উচ্চারণ হয় না। একসময় উনি রান্নাঘরে কাজ করতেন। মা বলতেন, বাড়ির সর্বনাশের শুরু ওর হাত ধরেই হয়েছিল।” মায়া বলেন, “আমরা তো ছোট ছিলাম… শুনেছিলাম, পান্না কিছু চুরি করেছিল… অথবা…” তার গলা কাঁপে। কেউ কেউ বলেন, পান্না নাকি অমলেন্দু বাবুর সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রাখতেন। তখনকার সমাজে এমন ঘটনায় কী হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। সুব্রত দত্ত তখন একটি ফোটো বের করেন—একটি সাদা-কালো ধূসর ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে এক তরুণী—মাথায় ওড়না, চোখে বিষণ্ণতা, মুখে গর্ব। “এই কি পান্না?” কেউ জোর দিয়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে না, কিন্তু নিরুপা তার মুখ ঢেকে বলে, “ওর চোখ ভুলে যাওয়ার নয়।” তারপর হঠাৎ মাথা তুলে বলে—“সে আবার আসবে, মশাই… আমি বলেছিলাম, গজদরজা একবার গিলে ফেললে সে আর কাউকে ছাড়ে না।”

রাত বাড়ে। দীপঙ্করের ঘুম আসে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে চুপ করে গজদরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। হালকা বাতাস দরজার ফাঁক দিয়ে হুহু করে ঢুকছে, আর একটা অদ্ভুত শব্দ—কান্নার মতো নয়, যেন দীর্ঘশ্বাস। দীপঙ্করের মনে হয়, কোনো অদৃশ্য চক্র যেন এই বাড়ির চারপাশে ঘুরছে—যেখানে পুরনো অপরাধ চুপ করে বসে আছে সময়ের ফাঁকে, শুধু জেগে উঠতে চায়। হঠাৎ করিডোর থেকে এক ছায়া সরে গেল—দীপঙ্কর দৌড়ে গিয়ে দেখে নিরুপা সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে উঠছেন। সে পেছনে পেছনে ছাদে যায়—আর সেখানে গিয়ে দেখে, নিরুপা বসে গজদরজার ঠিক উপরের দালানে, চোখ বন্ধ করে কিছু বলছেন। কান পাতলে শোনা যায়: “আমি তো কিছু করিনি, আমি তো শুধু চেয়ে দেখেছিলাম… আমি ভয় পেয়েছিলাম… ওরা পুঁতে ফেলেছিল…” দীপঙ্করের গা শিউরে ওঠে। সে বুঝতে পারে, এই রহস্যের সূত্র শুধু আধুনিক বিজ্ঞানে বা পুলিশের তদন্তে নেই—এর গোড়ায় রয়েছে একটা চাপা পারিবারিক পাপ, একটা মুখ না খোলা অভিশাপ, আর একটা নাম—পান্না—যে হয়তো আর শুধু নাম নয়, বরং হয়ে উঠেছে প্রতিশোধের প্রতীক।

অধ্যায় ৩:

বাড়ির লাইব্রেরি ঘরটা বরাবরই ছিল চুপচাপ, ধুলো জমা, আর একরকম দূরের—যেন কেউ ইচ্ছা করেই তাকে ভুলে থাকার জায়গা বানিয়ে রেখেছে। বইয়ের তাকগুলোতে যত না বই আছে, তার চেয়েও বেশি রয়েছে সময়ের ছাপ, পুরনো আলমারির গায়ে কাঁচ ভাঙা কাঠের গন্ধ, আর মাঝে মাঝে শোনা যায় সাড়াশব্দ—যেটা হয়তো ইঁদুরের, আবার নাও হতে পারে। দীপঙ্কর এবার নিজের অনুসন্ধান আরও গভীরভাবে শুরু করে। তার বিশ্বাস, পান্না শুধু এক কাজের মেয়ে ছিলেন না—সে ছিল এই বাড়ির ইতিহাসের এক মৃতপ্রায় পাতার নাম, যাকে কেউ কখনো পড়তে চায়নি। লাইব্রেরির দক্ষিণ দেওয়ালে সে চোখ রাখে—সেখানে একটা বড় ফটোফ্রেম ঝোলানো, চৌধুরী পরিবারের পূর্বপুরুষদের ছবি। হঠাৎ দীপঙ্করের চোখ পড়ে, ফ্রেমটার পিছনটা যেন একটু আলগা। সে সেটি সরিয়ে দেয়াল স্পর্শ করে, এবং বুঝতে পারে—পেছনে কিছু একটা আছে। কাঠের ফ্রেম সরিয়ে সে আবিষ্কার করে এক গোপন তাক, যার ভিতরে একটি মোটা খাম আর ধুলোপড়া নীল কভার দেওয়া একটি ডায়েরি। খামে লেখা: “ব্যক্তিগত – রায়বাহাদুর অমলেন্দু চৌধুরী, ১৯৪৩”।

ডায়েরির প্রথম পাতায় রায়বাহাদুর নিজ হাতে লেখা: “এই কথাগুলো কেউ জানবে না… যদি জানে, তবে এই রাজবাড়ির রক্তে আগুন লাগবে।” দীপঙ্কর ডায়েরির পাতা উল্টায়, আর তার চোখের সামনে এক অজানা ইতিহাস খুলে যেতে থাকে। পান্না—এই নামটি শুধুই এক গৃহপরিচারিকার নয়, বরং সে ছিল একজন তরুণী যাকে রায়বাহাদুর নিজে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই প্রেম ছিল অসম, নিষিদ্ধ, সমাজ-নিষেধে বাঁধা। সে সম্পর্কের কথা যখন অমলেন্দুর স্ত্রী জানতে পারেন, তখন চরম অপমান আর প্রতিশোধের বশে পান্নাকে চুরি আর পরকীয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। ডায়েরিতে লেখা আছে—”তাকে সেদিন সবাই মিলে ধরে, পিছনের দরজাঘরে নিয়ে যাই। কেউ প্রশ্ন করেনি, কেউ প্রতিবাদ করেনি। দেওয়ালের পাশে খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল আগেই… ওখানেই তাকে ফেলে দেওয়া হয়। আমি চুপ ছিলাম। আমি চেয়েছিলাম ও বাঁচুক, কিন্তু পারিনি…”। দীপঙ্করের মনে একসঙ্গে দুঃখ, ক্ষোভ, আর ভয় জমে ওঠে। সে বুঝে যায়, এই গজদরজার ছায়া শুধু ধাতব নয়—এটা একটি সময়ের চিহ্ন, এক পাপের রূপ, যা আজও বেঁচে আছে।

সেই রাতে দীপঙ্কর জানে তার ঘুম আসবে না। সে ডায়েরির শেষের দিকের পাতায় পায় আরেকটি মানচিত্র—প্রাসাদের নিচে এক সুড়ঙ্গ পথের ইঙ্গিত। এটি শুরু হয়েছে লাইব্রেরির একটি কাঠের তাকের নিচ থেকে, আর শেষ হয়েছে দরজাঘরের পাশের দেওয়ালে। এই মানচিত্র অনুসরণ করেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে একবার দেখে আসবে পুরনো কুঠুরি, যেটি আজ অবধি বন্ধ ছিল। রাত দেড়টায়, হাতে টর্চ আর ডায়েরি নিয়ে সে যায় লাইব্রেরিতে, আর বইয়ের তাকের নিচে এক কাঠের পাটাতনে চাপ দিলে সেটি সরে যায়। ভিতরে অন্ধকার, ভেজা মাটির গন্ধ, আর স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। হাঁটু গেড়ে রডের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলে পাওয়া যায় একটা সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ, যার দেয়ালে এখনও কিছু জায়গায় হাতের ছাপ—বুঝতে পারা যায়, কেউ এই পথ ব্যবহার করেছে, হয়তো এখনো করছে। দীপঙ্কর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। চারদিকে নিঃস্তব্ধতা, শুধু নিজের নিঃশ্বাসের আওয়াজ। হঠাৎ টর্চের আলোয় সে দেখে দেয়ালের পাশে একটা ছোট দরজা, তার গায়ে দাগ: “অভিশপ্ত”। দরজার হাতলে হাত রাখতেই ঠান্ডা ধাতব অনুভূতি—যেন কেউ স্পর্শ করছে তাকে।

দরজা ঠেলে সে ঢোকে এক পুরনো কুঠুরিতে, যেটা বন্ধ ছিল অন্তত চল্লিশ বছর। মেঝেতে এক কোণে পড়ে থাকা লোহার খাট, ঘরের একদিকের দেওয়ালে বড় বড় আঁচড়ের দাগ—যেন কেউ ভিতর থেকে বেরোতে চেয়েছিল। এক কোণে একটি কাঠের বাক্সে কিছু জিনিস পাওয়া যায়—একটা পুরনো শাড়ি, একটি ঠুনকো কাচের চুড়ি, আর একটি কাপড়ের পুতুল। এর মাঝে একটি চিঠি—রক্তমাখা, ছেঁড়া: “আমি কাউকে কিছু করিনি… আমি শুধু ভালোবেসেছিলাম। তারা আমাকে দেয়ালে বেঁধে ফেলেছে… আমি মরব না… আমি ফিরে আসব।” দীপঙ্করের গা ঠান্ডা হয়ে আসে। এই চিঠি যদি পান্নার হয়, তবে আজকের সব মৃত্যুর পিছনে কি সেই “ফিরে আসা”-র বাস্তব প্রতিফলন? সে জানে না। কিন্তু সে নিশ্চিত, এই সুড়ঙ্গ আজও ব্যবহার হচ্ছে। যে কেউ এই পথ দিয়ে ঘরে ঢুকতে পারে—দরজা বাইরে থেকে বন্ধ দেখালেও ভিতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে অবলীলায়। এখন প্রশ্ন—কেউ কি এখনও এই পথ ব্যবহার করছে প্রতিশোধের জন্য? যদি করে, তবে সে কে? সেই রাতেই দীপঙ্কর জানে, আগামী রাত তার জন্য অপেক্ষা করছে—নতুন আরেক মৃত্যু, কিংবা সত্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

অধ্যায় ৪:

পরদিন সকালের আলো এখনও প্রাসাদের ভারি দেয়াল ছুঁতে পারেনি, অথচ দীপঙ্করের চোখে ঘুম নেই। সারারাত সে কাটিয়েছে গোপন কুঠুরির ভিতর ঘুরে বেড়িয়ে, পান্নার চিঠি, কুড়ানো চুড়ি আর সেই সুড়ঙ্গপথের মানচিত্র হাতে নিয়ে বসে থেকে। তার মনে হচ্ছে, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বুকের মধ্যে কেমন যেন চাপা শ্বাস চলছে—যেন কেউ ভেতরে আটকে আছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে, হাঁটছে, শুনছে… আবার থেমে যাচ্ছে। সকালবেলা, সকলে যখন ঘুম থেকে ধীরে ধীরে উঠে এসেছে, তখন আচমকাই এক চিৎকার গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে তোলে। এই চিৎকার আর কারও নয়—মায়ার। সে দৌড়ে এসেছে করিডোর দিয়ে, মুখে আতঙ্ক, কণ্ঠে কাঁপন: “কৃত্তিকার ঘর… বন্ধ… কেউ উত্তর দিচ্ছে না!” এবার আর কেউ দেরি করে না। সকলেই ছুটে আসে কৃত্তিকা চৌধুরীর ঘরের সামনে। দরজা ভিতর থেকে ছিটকিনি মারা, জানালা বন্ধ, লাইট অফ। কেউ কেউ ধাক্কা দিতে শুরু করে, কেউ আবার ছিটকিনি ভাঙার জন্য লোহা খোঁজে। অবশেষে দরজা ভেঙে যখন ঘরে ঢোকা যায়, তখন দৃশ্যটা এমন যে কেউ এক মুহূর্তে পাথর হয়ে যাবে—কৃত্তিকা মৃত, খাটের একদম কিনারায়, শরীরের ভঙ্গি এমনভাবে বাঁকানো যেন তাকে কেউ ঘাড় মুচড়ে দিয়েছে।

কৃত্তিকার শরীরের পাশে ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, মুখে ফেনা, চোখ অর্ধমোচড়ানো। ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা কাঁচের জলের গ্লাস, মেঝেতে ছিটানো ওষুধের বোতল। টেবিলের ওপর খোলা রয়েছে এক অদ্ভুত চিত্রকলা—একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমণী, তার চোখে রক্ত, পেছনে আঁকা কালো ছায়া। কেউ কেউ তখনই জোরে বলে ওঠে—“ও তো এসব অলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাস করত!”—কেউ বলে—“শেষ কিছুদিন কৃত্তিকা কিছু অদ্ভুত কথা বলছিল…” কিন্তু সবার চোখ একসাথে পড়ল দরজার উপর—যেটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, অথচ কোনো লক টুটে নাই, জানালাও আস্ত, এবং কারও প্রবেশের চিহ্ন নেই। পুলিশ এসে আবার তদন্ত শুরু করে। সুব্রত দত্ত এবার স্পষ্ট করে বলে—“এখানে কিছু চলছে। একটা মারণ পরিকল্পনা, যেটা শুধু একজন করছে না—হয়তো বাড়ির কেউ, নয়তো অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো ছায়া…” দীপঙ্করের বুকের ভিতর চিনচিন করে ওঠে। সে জানে, এই হত্যার পেছনে মানুষ আছে—কিন্তু হয়তো সেই মানুষ তার মুখোশে হাঁটে, বাড়ির লোকদের মতই হাসে, এবং সেই গজদরজা দিয়েই আসে—যেটা সবাই চোখে দেখে কিন্তু কেউ জানে না ঠিক কতটা গভীর।

কৃত্তিকার মৃত্যুর পর, বাড়ির পরিবেশ এমন হয়ে ওঠে যেন প্রাচীন কোনো অভিশাপ পুনরায় জেগে উঠেছে। রায়বাহাদুর অমলেন্দু নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেন। মায়া সারা দিন কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় পড়ে থাকেন, চোখে যন্ত্রণার রঙ লেগে থাকে। নিরুপা আবার গজদরজার পাশে বসে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন—“দুইজন গেল… এখনও যারা আছে, তাদের হিসেব রাখে সে… যে মুখ ঢেকে বসে ছিল দেওয়ালে…”। সেই সন্ধ্যেবেলা, দীপঙ্কর আবার গোপনে লাইব্রেরির নিচের সুড়ঙ্গে নেমে আসে। এবার তার লক্ষ্য সেই দরজাঘর, যেটি মানচিত্রে দেখানো ছিল সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে। সেখানে পৌঁছে সে আবিষ্কার করে নতুন কিছু চিহ্ন—তাজা মাটির ছাপ, একটি লাল কাপড়ের ফালি, এবং এক ছোট রূপোর নূপুর। এর মানে কেউ এই পথ এখনো ব্যবহার করছে। সে ঠিক করে, সে এবার নিজেই গজদরজার সামনে পাহারা দেবে। রাত বাড়ে, বাতি নিভে আসে, আর সে এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখে—একটি ছায়া গজদরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল… চুপচাপ, যেন বাতাস। দীপঙ্কর সোজা দৌড়ে যায় করিডোরে, কিন্তু ছায়াটি অদৃশ্য। পরের মুহূর্তেই সে পায় একটুখানি ভিজে কাপড়ের ছোঁয়া—সেই কাপড়, যেটা সেদিন কৃত্তিকার বিছানায় ছেঁড়া অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।

পরদিন সকালে সুব্রত দত্ত গোটা বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একত্র করে। এবার প্রশ্ন ওঠে, মায়া কি জানতেন কিছু? তার ঘরে কেন পাওয়া গেছে ঘুমের ওষুধের বোতল, যার গায়ের নাম অভিষেক সেনের প্রেসক্রিপশনে লেখা? ডাঃ সেন, যিনি ছিলেন এই পরিবারের পুরনো চিকিৎসক, জানান তিনি অনেক আগে থেকেই কৃত্তিকার মানসিক ভারসাম্যহীনতার চিকিৎসা করছিলেন—কিন্তু তার মুখে এমন কিছু লুকোনো আছে, যা বলা হয়নি। দীপঙ্করের প্রশ্ন—তাহলে ঘর ভিতর থেকে বন্ধ থাকল কীভাবে? সুব্রত দত্ত তখন একথা বলেন যা শোনার পর সবাই চুপ—”এই বাড়ির ভিতরে এমন কিছু পথ আছে, যা দেওয়ালে লেখা নেই—শুধু সময় জানে। যার হাতে মানচিত্র, তার হাতেই মৃত্যু।” কথাটা শোনার পর দীপঙ্কর বুঝে যায়—ডায়েরি এবং মানচিত্র সে একা জানে না। কেউ একজন আরো জানে… এবং সেই কেউ তাকে টার্গেট করেই এগোচ্ছে।

অধ্যায় ৫:

বাড়ির চারদিকে আতঙ্কের গন্ধ ঘনীভূত হতে হতে এখন তা যেন দেওয়ালেও চেঁপে বসেছে। মেঝের ফাঁক, বারান্দার খোলা দরজা, এমনকি গজদরজার প্রতি ইঞ্চি যেন একটা অদৃশ্য ভয় চুঁইয়ে দিচ্ছে। তিনটি মৃত্যু—তিনটি রহস্যময় মৃত্যু, যার কোনওটাই আজও সমাধান হয়নি। দীপঙ্কর জানে, আর দেরি করা মানেই হয়তো পরবর্তী নাম তারই হবে। সে এবার স্থির সিদ্ধান্ত নেয় রায়বাহাদুর অমলেন্দুর মুখোমুখি হওয়ার, কারণ সেই একমাত্র ব্যক্তি যিনি অতীত জানেন, এবং সম্ভবত সত্য গোপন করছেন। দুপুরে সে ঠাকুরদার ঘরে যায়। ভিতরে ঢুকে দেখে অমলেন্দু জানালার দিকে পিঠ করে বসে আছেন, যেন জানালা দিয়ে পুরনো দিনগুলোর সাথে কথা বলছেন। দীপঙ্কর বলল, “আমি সব জেনে গেছি দাদু—ডায়েরি, পান্নার কথা, কুঠুরি, সুড়ঙ্গ—সব।” অমলেন্দু মুখ ঘুরিয়ে চুপচাপ তাকালেন। তারপর বেশ কিছু সময় চুপ থেকে বললেন, “ভেবেছিলাম সব চাপা দিয়ে দেব… মাটি হয়ে যাবে… কিন্তু কিছু পাপ গোরস্থানে থেকেও উঠে দাঁড়ায়। আমরা সেই পাপ করেছিলাম।” তাঁর কণ্ঠে ছিল শোক আর অপমানের মিশ্র স্বর।

“পান্না খুব সাধারণ মেয়ে ছিল। সে এ বাড়িতে কাজ করত। আমার স্ত্রী তখন গর্ভবতী, অনেকটা সময় আমি একা থাকতাম, আর… আমি দুর্বল হয়েছিলাম,” অমলেন্দু বলেন। “সে আমাকে ভালোবেসেছিল, কিন্তু আমি তাকে শুধু সময় দিয়েছিলাম, আশ্বাস দিয়েছিলাম… ও একদিন আমার সন্তান নিয়ে এসেছিল, বলেছিল সে গর্ভবতী। আমি ভয় পেয়ে যাই। আমার পরিবার জানলে আমাকে রক্ষা করবে না। স্ত্রী জেনে গেলে চরম কেলেঙ্কারি… আমি কাউকে কিছু না বলে নিরুপা আর আমার ভাইদের নিয়ে… তাকে পিছনের দরজাঘরে নিয়ে যাই। গজদরজার পেছনের ঘরে তখন মাটি খোঁড়া হচ্ছিল। আমরা বলেছিলাম, ও চুরি করেছে। তারপর… তারপর শুধু কাদা… আর নীরবতা।” দীপঙ্করের গলা শুকিয়ে আসে। অমলেন্দু কাঁপা হাতে একটা ফোটো বের করে দেন—একটি পুরনো শিশুর ছবি, পেছনে লেখা: “সুব্রত, ১৯৪৪”। দীপঙ্কর বিস্ময়ে বলে ওঠে—“সুব্রত দত্ত? সেই পুলিশ অফিসার?” অমলেন্দু মাথা নেড়ে বলেন, “হ্যাঁ… পান্না মারা যাওয়ার একদিন পরেই শিশুটিকে দূরের আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল… আমি তখন জানতাম না ও সত্যি বেঁচে আছে কিনা।”

দীপঙ্কর বুঝতে পারে সবকিছু—সুব্রত দত্ত, যার চোখে প্রথম দিন থেকেই ঘৃণা ছিল, শুধু তদন্তের জন্য নয়—বরং এক পুরনো প্রতিশোধের আগুন নিয়ে সে এসেছে। প্রতিটি খুন, প্রতিটি দরজা—সব ছিল পরিকল্পিত। এবং সে এতটাই নিখুঁত ছিল কারণ তার হাতেই ছিল সেই সুড়ঙ্গপথ, সেই মানচিত্র, যা একমাত্র পান্নার উত্তরাধিকার পেতে পারে। সেই রাতে, দীপঙ্কর স্থির করে, সে এবার সুব্রতের মুখোমুখি হবে। কিন্তু তার আগে সে নিরুপার কাছে যায়—কারণ তার বিশ্বাস, সেই একমাত্র জীবিত মানুষ যিনি সেই দিন উপস্থিত ছিলেন, এবং হয়তো আরও কিছু জানেন। নিরুপার ঘরে গিয়ে সে চুপচাপ বসে। নিরুপা জানে, এই মুহূর্তটাই হবে তার স্বীকারোক্তির। “আমি তখন দেখেছিলাম, বাবু… আমি চুপ করেছিলাম, কারণ আমাকেও ভয় দেখানো হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম, সুব্রত ফিরে আসবে… সে মায়ের মৃত্যুর বদলা নেবেই…” নিরুপা তার খাটের নিচ থেকে বের করে এক কাঠের বাক্স—যার মধ্যে পান্নার একটি বেনারসি শাড়ি, কপালে টিপ লাগানো ছবি, আর একটি লাল সুতোয় বাঁধা রুপোর চেন।

সেই রাতে, রাজবাড়ির আকাশ যেন আরও ভারী হয়ে আসে। গজদরজার নিচ দিয়ে হাওয়া নয়, যেন শ্বাস টেনে নিচ্ছে কেউ। দীপঙ্কর ছাদে উঠে গিয়ে দাঁড়ায়, নিচের পেছনের বাগান দেখা যায় সেখান থেকে। গজদরজা খোলা, তবে তালাবদ্ধ। সে জানে তালা শুধু দৃষ্টির জন্য, পথটা তো ভিতর থেকে খুলেই নেওয়া যায়। সে মনে মনে বলে—“পান্নার প্রতিশোধ শেষ হয়নি। এখন সে এসেছে তার ছেলের হাত ধরে, পাপের ঘরকে পুড়িয়ে দিতে।” গজদরজার ছায়া যেন দীর্ঘ হতে হতে সিঁড়ির নিচে নেমে আসে। দীপঙ্কর এবার নিশ্চিত, সে এবার আর শুধু তদন্ত করছে না—সে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। এখন যদি সে থামে, তবে হয়তো সেই গজদরজার তালা একদিন তার ঘরের দিকেও তাক করে খুলে যাবে…

অধ্যায় ৬:

যখন ভোরের আলো গজদরজার জং ধরা দাঁতের গায়ে পড়ে, তখন তা ঠিক সোনালি হয় না—বরং ছায়া ছায়া লাগে, যেন আলোটাকেও সন্দেহে ভিজিয়ে রাখে। আগের রাতের অভিজ্ঞতা দীপঙ্করের চোখে একরকম স্থির হয়ে আছে। পান্না, সুব্রত, অমলেন্দু—সবকিছু মিলে যেন সময়ের এক ঘূর্ণিপাকে সে আটকে পড়েছে, যেখান থেকে বেরনো মানে শুধু নিজেকে নয়, পরিবারের শতাব্দীপ্রাচীন অভিশাপকেও মুক্ত করা। তবে সে জানে—সব সত্য এখনো সামনে আসেনি। বিশেষ করে এক ব্যক্তি যিনি বারবার ছায়ার মতো চলাফেরা করছেন কিন্তু সেভাবে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েননি—ডাঃ অভিষেক সেন, পরিবারের চিকিৎসক, যিনি একাধারে বন্ধু, বিশ্বাসভাজন, আবার নিঃশব্দে উপস্থিত একজন অজানা কুশীলব। কৃত্তিকার মৃত্যুর সময় ওষুধের বোতলে তাঁর নাম, মায়ার ঘরে ঘুমের ওষুধে তাঁর সিল—সব কিছুই সন্দেহ বাড়াচ্ছে।

সেই সকালে দীপঙ্কর সিদ্ধান্ত নেয় একবার একান্তে ডাঃ সেনের সঙ্গে কথা বলবে। সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, অভিষেকবাবু সকাল সকাল কাছের বাগানের দিকে হেঁটে যান। দীপঙ্কর ছুটে গিয়ে তাঁকে পায় এক বিরাট শালগাছের নিচে, হাতে পাইপ, চোখে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকা একজন চিন্তিত মানুষের মুখ। প্রথমে ডাকতেই ডাঃ সেন তাকালেন, মুখে একরকম থমকে যাওয়া হাসি—“তুমি দীপঙ্কর, না? তোমাকে তো অনেক ছোটবেলা দেখেছি… চশমা পড়তে না আগে?” দীপঙ্কর বসে পড়ে, সরাসরি প্রশ্ন করে—“কৃত্তিকার ওষুধে আপনার নাম… মায়ার ঘুমের ওষুধও আপনার প্রেসক্রিপশনে… আপনি কি জানেন, কী হচ্ছে এই বাড়িতে?” অভিষেকবাবু প্রথমে কিছু বলেন না। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “আমি চিকিৎসক, সত্য… কিন্তু চিকিৎসা কেবল শরীরের হয় না, মানসিক অবস্থাও দেখতে হয়। এই বাড়ির মানুষগুলো শুধু রোগগ্রস্ত নয়, তারা অভিশপ্ত… আর সেই অভিশাপ আমি স্পর্শ করেছি, নিজের অজান্তে।”

“পান্নাকে আমি চিনতাম,” তিনি বলেন। “তাকে যখন মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পুঁতে ফেলা হয়, তখন আমি এক জুনিয়র ডাক্তার। আমার জ্বর, সংক্রমণ আর উদ্বেগের জন্য তাকে দেখে কিছু মেডিসিন দিয়েছিলাম—কিন্তু তার শরীরের অবস্থায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সে গর্ভবতী। আমি সে কথা বলেছিলাম রায়বাহাদুরকে, কিন্তু তার মুখের চেহারা দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। তারপর একদিন পান্না উধাও হয়ে গেল… আমি তখন বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু মুখ খোলার সাহস ছিল না। সময় পেরিয়ে গেল, আমি বাড়ির চিকিৎসক হয়ে গেলাম, কিন্তু প্রতিটা দিন মনে হয়েছে—ওর আত্মা আমাকে লক্ষ করছে। কৃত্তিকা… ওর মানসিক সমস্যা ছিল, ও বারবার বলত, তার ঘরে কেউ আসে, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকে, কিন্তু যেন ছায়া ভিতরে হেঁটে বেড়ায়… আমি ভেবেছিলাম ও হ্যালুসিনেট করছে। আমি ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলাম… কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে।” দীপঙ্করের গা কাঁপে। সে বুঝতে পারে, ডাক্তার সেন অপরাধী নন, কিন্তু তিনিও নীরব দর্শকের মতো ভুলের শরিক।

এরপর দীপঙ্কর ফিরে আসে বাড়িতে এবং লুকিয়ে ডাঃ সেনের ঘরে ঢুকে পড়ে। খোঁজাখুঁজির সময় তার চোখে পড়ে একটি পুরনো ডায়েরি—অভিষেকবাবুর ব্যক্তিগত নোট। সেখানে লেখা: “১৯৮২—একটি বাচ্চা ছেলে, নাম বলা হয়নি, বয়স ৮, গভীর দুঃস্বপ্ন, ঘুমে কাঁদে, বারবার বলে—‘মা আমাকে গর্তে ফেলে দিয়েছে’, ‘তারা মা’কে পুতে দিয়েছে।’ এই বাচ্চাকে আমি এক আশ্রমে রেফার করি… ঠিকানা: শান্তিনিকেতন শিশু আশ্রম।” দীপঙ্করের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। এ তো সেই সুব্রতর অতীত! মানে, অভিষেক সেন সেই সময় থেকেই সব জানতেন! তাহলে কি তিনি সুপরিকল্পিতভাবে চুপ থেকেছেন? না কি… তিনিও ভীত ছিলেন? পরের পৃষ্ঠায় লেখা: “১৯৯৯—বাড়িতে পুনরায় কাজ শুরু করলাম। সুব্রত দত্ত নামে এক পুলিশ অফিসার আসবে শুনেছি—চোখ যেন চেনা, কথার মধ্যে বিষ। আমি যদি ভুল না করে থাকি, তাহলে সে-ই সেই শিশু।” দীপঙ্কর জানে, সত্য আর ঢাকনা দিয়ে ঢাকা যাবে না।

রাত বাড়ে। দীপঙ্কর গোপনে পুলিশের রেকর্ড ঘেঁটে জানতে পারে, সুব্রত দত্তের জন্ম, আশ্রমের তথ্য, এবং রেকর্ডে সংযুক্ত মা’র নাম—পান্না চৌধুরী। সব এখন স্পষ্ট। আর তখনই বাড়িতে একটি নতুন ঘটনা ঘটে—এইবার টার্গেট হয় মায়া। রাত তিনটের সময় মায়ার ঘরের দরজা বন্ধ অবস্থায় ভেতর থেকে চিৎকার শোনা যায়। দরজা ভাঙা হলে দেখা যায়—মায়া অচেতন, কিন্তু বেঁচে। বিছানায় একটি লাল সুতোয় বাঁধা রুপোর চেন রাখা, আর দেওয়ালে লেখা—“বাকি আছে”। সবাই স্তব্ধ। দীপঙ্কর জানে, সুব্রত এখন খেলা শুরু করেছে। এখন আর শুধু প্রতিশোধ নয়—এটা এখন মনস্তাত্ত্বিক খেলা, বাড়ির ইতিহাসের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির নীরব যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধে কেউই নিরাপদ নয়, এমনকি সে নিজেও নয়।

অধ্যায় ৭:

চৌধুরী বাড়িতে এখন রাত যেন দীর্ঘতর, নিঃশব্দ আর ভারী। প্রতিটি দরজার কড়িতে হাওয়া বাজে, যেন কারও পায়ের শব্দের ছায়া। দীপঙ্কর, যার চোখে ছিল শুধু যুক্তি, এখন প্রতিটি প্রহর গুনছে এক অদৃশ্য ভয়কে আশ্রয় করে। সেই রাতে মায়ার ঘরের ঘটনার পর দীপঙ্কর বুঝে যায়, সময় এসেছে ছায়ার চোখে চোখ রাখার। সে ফিরে যায় লাইব্রেরিতে—যেখানে শুরু হয়েছিল সব। খোলা ডায়েরি, গোপন তাক, সুড়ঙ্গের মানচিত্র—সব তার নিজের মতো সাজিয়ে সে বসে থাকে। হাতে একটি ক্যামেরা, ছোট রেকর্ডার এবং পকেটে একটি ছোট ছুরি। সেই সুড়ঙ্গ পথে ঢোকার আগে সে মনে মনে বলে—“এবার মুখোমুখি দেখা হবে।” গভীর রাতে সে আবার নেমে আসে সেই পাথরের গোপন পথে, যেখানে দেওয়াল ভিজে, বাতাসে এক মৃতার দীর্ঘশ্বাস, আর জমাট অন্ধকার। তার হাঁটার শব্দ যেন প্রতি ধাপে কারও ঘুম ভাঙাচ্ছে।

দীপঙ্কর গজদরজার নিচ দিয়ে যখন দরজাঘরের দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ তার কানে আসে ফিসফিস শব্দ। শব্দটা পরিচিত—একজন পুরুষের, চাপা কণ্ঠ, যেন কারও সাথে কথা বলছে… কিন্তু সেখানে কেউ নেই। সে থেমে যায়। ছায়ায় চোখ রাখতে সে টর্চ বের করে, কিন্তু আলোটা নিভে যায়। এখন সে শুধু শুনতে পায় শব্দ—“সবাই পাবে তাদের হিসেব… একে একে… যারা চুপ ছিল, যারা চাপা দিয়েছিল…” দীপঙ্কর দৌড়ে এগিয়ে যায় সেই পুরনো কুঠুরির দিকে। কুঠুরিতে ঢুকেই সে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ব্যক্তি—ছায়ার মতো, কিন্তু স্পষ্টভাবে মানুষ। হাতের তালুতে রুপোর চেন, চোখে খয়েরি দাগ, গায়ে পুরনো কোট, আর মুখে এমন একটা অভিব্যক্তি, যা রাগ আর যন্ত্রণা—দুটোর অদ্ভুত মিশ্রণ। সে মুখ ঘুরিয়ে চেয়ে বলে, “তুমি এসে গেছো অবশেষে?” দীপঙ্কর তখন জিজ্ঞাসা করে—“তুমি সুব্রত দত্ত? নাকি… পান্নার ছেলে?” ছায়ামূর্তিটি হাসে—একটা গলা চিরে বেরোনো শব্দে—“আমি দুটোই। আমি বিচারক… আমি সাক্ষী… আমি সেই সন্তান, যাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।”

সুব্রত তার জীবনের কাহিনি বলতে শুরু করে—যেমনটা কেউ শোনেনি আগে। “আমাকে যখন আশ্রমে ফেলে দেওয়া হয়, তখন আমার মা শুধু তার গলায় লাল সুতো বেঁধে বলেছিলেন—‘বুঝবি একদিন সব, ফিরে আসবি…’ আমি বড় হয়েছি অন্ধকারে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ভুলিনি। আমি পুলিশ হয়েছি, কারণ আমি চাইনি প্রতিশোধ শুধু খুন হয়ে থাকুক। আমি চাইতাম তারা ভয় পাক, তাড়না পাক, যেমন আমার মা পেয়েছিল। আমি চাইতাম তারা জানুক—মৃতদেরও প্রতিশোধ থাকে। অরিত্র ছিল সেই বাড়ির প্রথম উত্তরাধিকারী—যার ঠাকুরদা আমার মা’কে কবর দিয়েছিল। কৃত্তিকা… সে ছিল সেই পাপের স্থায়ী রক্ষক—বাড়ির ইতিহাস জানত, কিন্তু চুপ ছিল। মায়া? সে ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, কারণ তার মা-ই ছিল পান্নার বিরুদ্ধে মূল ষড়যন্ত্রকারিণী। আমি কাউকে গুলি করিনি। আমি শুধু সত্যটাকে সামনে এনেছি… আর তারা নিজেরাই ভেঙে পড়েছে।” দীপঙ্কর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে বুঝতে পারে, সুব্রতের প্রতিশোধ যুক্তিতে নয়, আবেগে নির্মিত। কিন্তু সে প্রশ্ন করে—“তুমি কি নিজেকে ঈশ্বর ভাবছো?” সুব্রতের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে—“না। আমি একজন সন্তান, যার মায়ের জন্য কেউ কাঁদেনি… আমি শুধু চেয়েছি তারা যেন অন্তত একবার থামে… আর শোনে সেই কান্নার ধ্বনি।”

সেই মুহূর্তে পেছন থেকে কাউকে আসতে দেখে তারা। নিরুপা। হাতে একটি ছোট পুঁটির মালা, চোখে জল, কাঁপা গলায় বলেন, “তুই যা করেছিস… আমার পাপও তার ভাগীদার। আমি চুপ ছিলাম… আমি সব দেখেও মুখ বন্ধ করেছিলাম। আজ আমি তোর সামনে দাঁড়িয়ে, তোকে ক্ষমা চাইছি না, শুধু বলছি… আর কষ্ট দিস না…” সুব্রত ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ে। দীপঙ্করও বোঝে, একটা অধ্যায় শেষ হতে চলেছে, কিন্তু তার ভিতর যেন কিছু ভেঙে পড়ছে। ছায়ার মতো মানুষ, যাকে সে খুনি ভেবেছিল, সে এখন সামনে দাঁড়িয়ে, ভাঙা শিশু হয়ে। সে একটা ছোট বাক্স দেয় দীপঙ্করের হাতে—ভেতরে পান্নার সেই পুঁতির কাঁটা, শিশুর ছবি, আর একটি লাল সুতোয় বাঁধা তালা। সে বলে, “এই তালা খুলবে না আর… এই দরজা আর খোলা যাবে না।” এরপর সে উঠে যায়—চুপচাপ, সেই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে, যেভাবে এসেছিল। আর গজদরজার নিচ দিয়ে একটা বাতাস বয়ে যায়—নিরব, যেন অভিশাপের শেষ দীর্ঘশ্বাস।

অধ্যায় ৮:

গভীর রাতের সেই মুহূর্তে, যখন সুব্রত সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, দীপঙ্কর অনেকক্ষণ বসে থাকল দরজাঘরের ঠান্ডা পাথরের মেঝেতে। বাতাস নিঃশব্দে চলেছে, কিন্তু তার গায়ে কেমন এক ভার। গজদরজার ওপারে যেন এখন আর কোনো অভিশাপ নেই, আছে শুধু ইতিহাস, অনুশোচনা আর মানুষের অপরাধবোধ। কিন্তু সত্যি কি সব শেষ? দীপঙ্করের মনে কাঁটার মত প্রশ্ন বিঁধতে থাকে—সুব্রত নিজেই কি সবকিছু ঘটিয়েছে? না কি এই বাড়ির বুকের ভিতর এমন কিছু এখনও বেঁচে আছে যা তার অজান্তেই নিঃশব্দে চলেছে? তার মনে পড়ে যায়, পান্নার শেষ চিঠির কথা—“আমি মরব না… আমি ফিরে আসব।” যদি সুব্রত-ই পান্নার প্রতিশোধের মুখপাত্র, তবে তার কাজ শেষ… কিন্তু যদি নয়? যদি সে মাত্র একটি পাতা হয়ে থাকে সেই ভয়াবহ ইতিহাসের?

সকালবেলা বাড়ি জুড়ে নীরবতা। রায়বাহাদুর অমলেন্দু আর কখনো দরজা খোলেননি। নিরুপা চুপচাপ বসে থাকেন গজদরজার দিকে তাকিয়ে, যেন অপেক্ষা করছেন কারও ফিরে আসার। মায়া একরকম ঘোরের মধ্যে, এবং বাড়ির অন্য সদস্যরা একে একে বাড়ি ছাড়তে শুরু করেছে—যেন এই প্রাসাদ এখন শুধুই একটা কঙ্কাল, যা কেবল অতীতের বোঝা বইছে। দীপঙ্কর সেই দিন বিকেলে আবার একবার গজদরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজাটা তালাবদ্ধ, কিন্তু সে জানে ভেতরে সেই পুরনো সুড়ঙ্গ আর তার প্রতিটি মোড় এখনও নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। সে আবার সুড়ঙ্গে নামে—তবে এবার আর তদন্ত নয়, এবার সে খুঁজতে চায় শেষ সত্যটা। কুঠুরির ভিতর কিছু জায়গা খুঁড়ে সে এক জায়গায় কাদার নিচে পায় একটি ধাতব কৌটো—যেটার ভেতর পান্নার হাতে লেখা একটি দীর্ঘ চিঠি। এই চিঠি কোনও অভিশাপ নয়—বরং নিজের সন্তানের উদ্দেশে লেখা এক করুণ আর্তি।

চিঠিতে লেখা: “যদি কখনো এই লেখা তুই পড়িস, জানবি—আমি তোকে ভালোবেসেই জন্ম দিয়েছিলাম। আমি জানতাম, আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। কিন্তু তুই যদি বাঁচিস, তোকে কেউ যেন ভালোবাসে—এই আশা ছিল। যদি কখনো এ বাড়িতে ফিরিস, ওদের মারিস না। ওদের ভেতরে যা আছে, তা তাদের শাস্তি দেবে, সময় দেবে। শুধু নিজেকে অন্ধকারে নিস না।” দীপঙ্কর চিঠিটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে—সুব্রত যতই প্রতিশোধ নিয়ে থাকুক, পান্না নিজের সন্তানের জন্য এমনই ভবিষ্যৎ চেয়েছিলেন, যেখানে সে আলোতে ফিরতে পারে। সে চিঠি নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, এই সত্য এখন প্রকাশ পাবে। সকলকে একত্র করে সে পড়ে শোনায় সেই চিঠি। নিরুপা কাঁদতে শুরু করেন, মায়া চুপ করে বসে থাকেন—কিন্তু কারও মুখে আর কোনও অজুহাত নেই। দীপঙ্কর সবার সামনে জানিয়ে দেয়—“পান্নার প্রতিশোধ আমরা কেউ থামাতে পারতাম না। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছা ছিল ক্ষমা। আমরা যদি আজও ঘৃণাই বাঁচিয়ে রাখি, তাহলে তার আত্মা চিরদিন গজদরজার ভেতরে ঘুরে ফিরবে।”

শেষরাতের দিকে, দীপঙ্কর ছাদে দাঁড়িয়ে গজদরজার ওপারে তাকিয়ে থাকে। চাঁদের আলোতে দরজার গায়ে ছায়া পড়ে, আর হাওয়ার দোলায় তালা খানিকটা নড়ে ওঠে—যেন কেউ বলছে, “এবার মুক্তি।” সে বুঝে যায়, অভিশাপ হয়তো শেষ হয়নি, কিন্তু সেই ভয় এখন ক্ষমায় রূপ নিচ্ছে। সে ঠিক করে, এই ইতিহাস সে লিপিবদ্ধ করবে—চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস, পান্নার কাহিনি, সুব্রতের যুদ্ধ। সে লেখার কাজ শুরু করে। পরদিন সকালে, যখন সে গজদরজার পাশ দিয়ে হাঁটছে, দেখতে পায় তালাটা খুলে পড়ে আছে মাটিতে, দরজা হালকা খোলা। কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। শুধু বাতাস, আর একরাশ নিঃস্তব্ধতা। সেইদিন প্রথমবারের মতো, বাড়ির উপরকার আকাশটা স্বচ্ছ লাগে। গজদরজা এবার সত্যিই বন্ধ হয়েছে—না তালা দিয়ে, বরং ক্ষমা আর সত্য দিয়ে।

অধ্যায় ৯:

চৌধুরী পরিবারের উপরকার অন্ধকার যেন কিছুটা সরেছে, কিন্তু দীপঙ্করের মনে একটা অস্বস্তি ঠিকই রয়ে গেছে। সুব্রত দত্ত চলে গেছে, গজদরজার তালা খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই দরজার ওপাশে ঠিক কী ছিল—তা আজও একধরনের রহস্য। আরও বড় প্রশ্ন: সত্যি কি সব শেষ হয়েছে? না কি এর পরেও আছে একটা শেষ খেলা, যেখানে পুরনো ছায়ারা আবার ফিরে আসবে? দীপঙ্কর কিছুতেই নিজেকে নিরপদ মনে করতে পারছিল না। সে লক্ষ্য করছিল, রায়বাহাদুর অমলেন্দু ক্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠছেন। রাতে ঘুম ভেঙে উঠে চিৎকার করছেন, অদৃশ্য কারও সাথে কথা বলছেন, আর বারবার বলছেন—“আমি করিনি… আমি চেয়েছিলাম ও বাঁচুক… পান্না… আমায় ছেড়ে দিও না!” এই ভাঙা মানুষটার কণ্ঠে আতঙ্ক, অনুশোচনা, আর অদ্ভুত রকম এক ভয়। দীপঙ্করের মনে হয়, সত্যিই যদি কিছু অতিপ্রাকৃত কিছু থেকে যায়, তবে তার মূল শিকড় এই মানুষটার মধ্যেই।

তিনদিন পর অমলেন্দু একেবারে ঘরছাড়া হয়ে যান। দুপুরবেলা দেখা যায় তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণের পুরনো দালানে ঢুকে গেছেন—যেটা বহু বছর ধরে তালাবদ্ধ। কাজের লোকেরা ভয়ে সেখানে যায় না। দীপঙ্কর পেছন পেছন গিয়ে দেখতে পায়, তিনি একটি পুরনো কাঠের সিন্দুক খুলে বসে আছেন, সামনে পান্নার পুরনো ছবি। তিনি ফিসফিস করে বলছেন, “তুই তো বলেছিলি, ফিরবি… ফিরেছিস, না? এই নে… আমি সব ফিরিয়ে দিচ্ছি… আমার জীবনও।” দীপঙ্কর এগিয়ে গিয়ে হাত রাখে তার কাঁধে। কিন্তু অমলেন্দুর চোখ যেন ফাঁকা—সেখানে কোনও হুঁশ নেই, আছে কেবল ভয়। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন মেঝেতে। চিকিৎসক এসে জানান—স্নায়বিক ভেঙে পড়া, ভয় ও অপরাধবোধের ফল। দীপঙ্কর বুঝে যায়—পান্নার প্রতিশোধ সম্পূর্ণ হয়নি, যতক্ষণ না তার মৃত্যু স্বীকার করে নেওয়া হয়।

ঠিক তখনই ঘটে আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা। বাড়ির পুরনো একটি দেয়াল ভেঙে মেরামতের কাজ চলছিল। সেখানে ইট সরাতে গিয়েই মিস্ত্রিরা খুঁজে পায় একটি হাড়গোড়ের গাদাগাদি। ফরেনসিক রিপোর্টে জানা যায়, মৃতদেহ কমপক্ষে ৬০-৭০ বছরের পুরনো, এবং একটি নারী ও একটি শিশুর কঙ্কাল সেখানে পাশাপাশি শোয়ে ছিল। খবরটা ছড়িয়ে পড়লে বাড়ির সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। তাহলে কি শুধু পান্না নয়, আরও একটি শিশু—হয়তো তার সন্তান—তাকেও মেরে ফেলা হয়েছিল? দীপঙ্কর এবার ঠিক করে, সে আর শুধু পর্যবেক্ষক থাকবে না। সে সমস্ত নথি, চিঠিপত্র, ডায়েরি, এমনকি গজদরজার গোপন মানচিত্র পুলিশের হাতে তুলে দেয়, এবং বলে—“এই বাড়িকে খুঁজে দেখুন, এখানে শুধু ইতিহাস নয়, অপরাধ পোঁতা আছে।” তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে সেই রাতে। দীপঙ্করের ঘরের জানালায় এসে পড়ে একটি খাম, কেউ চুপচাপ রেখে গেছে। খুলে দেখে ভিতরে শুধু একটি ছোট কাগজে লেখা: “শেষ হয়নি। আমি এখনো আছি। – পি”

কে ‘পি’? পান্না? না কি… কেউ নিজেকে তার নামে চালিয়ে যাচ্ছে? দীপঙ্কর জানে, এটা শুধু ভয় দেখানো নয়—এটা একটা বার্তা। এবং সেই মুহূর্তে, তার মনে হয়, সে নিজের জীবন নিয়েও আর নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে না। যিনি এই কাগজ রেখেছেন, তিনি এখনো বাড়ির ভিতরে আছেন। সুব্রত কি সত্যিই চলে গেছে? নাকি সে-ই ‘পি’? বা অন্য কেউ? সেই রাত দীপঙ্করের জীবনে আরেকটা মোড় এনে দেয়। সে বুঝে যায়, শেষ খেলা শুরু হয়ে গেছে। এখন যা ঘটবে, তা হবে চূড়ান্ত, নির্মম এবং বিভীষিকাময়। এবং গজদরজার ওপাশে যা রয়েছে, তা এবার আবার তার দিকে তাকিয়ে আছে—চোখ রক্তবর্ণ, শ্বাস ভারী, আর কণ্ঠে একটি মৃদু প্রতিধ্বনি—“তুমি সত্যিই জানো তো, কে খুনি?”

অধ্যায় ১০:

চৌধুরী পরিবারের রাজপ্রাসাদ এখন আর একটিও বাতি জ্বলে না সন্ধ্যার পরে। দরজাগুলো সজাগ, দেওয়ালগুলো নিঃশব্দে শ্বাস নেয়, আর বাতাসে কোথাও একটা পূর্বাভাস—যেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সময় থেমে যাবে। দীপঙ্কর জানে, আজ রাতেই কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সেই শেষ চিঠি—“আমি এখনো আছি – পি”—এটা শুধু ভয় দেখানো নয়, এটা যুদ্ধের ঘোষণাপত্র। গজদরজার মানচিত্র, পান্নার চিঠি, শিশুর কঙ্কাল, অমলেন্দুর ভাঙা মন—সবকিছু মিলে একটা ভয়ঙ্কর গল্পের শেষ পৃষ্ঠা উল্টানোর সময় এসে গেছে। রাতে বাড়ির ছাদে উঠে সে দেখে, দক্ষিণের করিডোরে আলো জ্বলছে—যেখানে বহুদিন কেউ যায় না। তার হাতে টর্চ, কোমরে রেকর্ডার, আর মনে প্রস্তুতি—আজ সে মুখোমুখি হবে, শেষ সত্যের, যেটা রক্তের ভিতরে লেখা ছিল বরাবর।

যখন দীপঙ্কর করিডোর ধরে এগিয়ে চলেছে, সে শুনতে পায় ঘরের ভিতর ফিসফিস—একটা পুরনো কণ্ঠ, যেটা খুব চেনা—নিরুপা। সে চুপচাপ ঢোকে সেই ঘরে—দেখে নিরুপা এক অদ্ভুত অগ্নিপূজার সামনে বসে, কাঁপা হাতে ধূপ জ্বালাচ্ছেন। তাঁর চোখে কান্না, মুখে মন্ত্র: “ওরা ফিরেছে… ওরা থেমে যাবে না… রক্তে লেখা হয়েছিল যা, তা আগুনেই মুছতে হয়।” দীপঙ্কর বলে ওঠে, “আপনি জানেন কে ‘পি’? আপনি জানেন কে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে এই অভিশাপ?” নিরুপা চুপ করে থাকেন। তারপর খুব ধীরে বলেন, “তুই ভুল জানিস, পি মানে শুধু পান্না নয়… পি মানে ‘প্রিয়ময়ী’। আমার দিদি। ও-ই ছিল প্রথম, যার সঙ্গে অমলেন্দুর প্রেম হয়েছিল, কিন্তু সে ছিল এই পরিবারের বাইরের। তাকে যখন বাড়ির সম্মান রক্ষার নামে খুন করা হয়… তখন আমি চুপ করে থেকেছিলাম। আমি দ্বিতীয়বার চুপ থেকেছিলাম, যখন পান্নাকে তোলা হল… আমি থামাইনি। কারণ আমি ভয় পেতাম। এখন আমি তাদেরই দেখছি ছায়ার মধ্যে। ওরা ফিরেছে।”

এই প্রথম, দীপঙ্করের সামনে খুলে যায় সবচেয়ে অন্ধকার চ্যাপ্টার—প্রিয়ময়ী, পান্না, এবং হয়তো আরও অনেক নারী, যাদের চৌধুরী পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। দীপঙ্করের মনে পড়ে যায়—রায়বাহাদুরের ঘরে একটি লুকনো ডায়েরি ছিল, যেখানে বহুদিন আগে লেখা ছিল, “সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে যদি কয়েকটি জীবন যায়, তবে সেটাই সময়ের দাবি।” সে বুঝতে পারে, সুব্রত দত্ত শুধু প্রতিশোধ নেয়নি—সে ছিল প্রতীক, কিন্তু চক্র এখনো চলছে। সে প্রশ্ন করে নিরুপাকে, “তাহলে শেষ কে আছে এখনও এই বাড়িতে, যার শরীরে সেই পাপের রক্ত বয়ে চলেছে?” নিরুপা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে—“তুই।” দীপঙ্কর স্তব্ধ। “তুই চৌধুরী, তোর রক্তেই সেই নাম লেখা—তুই বাঁচলে পাপ বাঁচে, তুই নিজে শেষ কর।” দীপঙ্কর তখন জানে, এই অভিশাপ থামানো যাবে না সত্য সামনে না আনা পর্যন্ত। সে পুলিশে ফোন করে, সমস্ত প্রমাণ, নোট, ভিডিও, এবং মানচিত্র হস্তান্তর করে দেয়। বাড়িটি সিল করা হয়, তদন্ত শুরু হয় উচ্চ পর্যায়ে।

তিন মাস পর, এক সকালে “The Telegraph”-এ একটা খবর ছাপা হয়—“Chowdhury Mansion Sealed: Century-Old Secrets Unearthed”। খবরে বলা হয়, ওই বাড়ির নিচে একটি প্রাচীন কূপ পাওয়া গেছে, যার ভেতরে ৬টি নারীর কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। নাম নেই, পরিচয় নেই, কেবল একটি পোড়া টিপের চিহ্ন—পান্না, প্রিয়ময়ী, আর হয়তো আরও নামহীন আত্মারা, যারা আজও জেগে আছে। বাড়িটি সরকার অধিগ্রহণ করে জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। দীপঙ্কর, যে একসময় যুক্তিতে চলত, এখন জানে—কিছু অন্ধকার যুক্তির বাইরে। সে এখন ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে থাকে, কলমে লিখে চলে “মরণফাঁদ: চৌধুরী পরিবারের অন্ধকার ইতিহাস”। বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা:
“এই বই শুধু খুনের নয়, ক্ষমার। যারা ভুল করেছে, তাদের কথা বলাই যথেষ্ট নয়—তাদের মুখোমুখি হওয়াও প্রয়োজন।”
নিচে স্বাক্ষর—দীপঙ্কর চৌধুরী।

-সমাপ্ত-

1000039327.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *