সুপ্রিয় নাথ
এক
ট্রেনটা যেন ধীরে ধীরে ছুটে আসছিল অন্য এক জগতে, যেখানে শহরের ধোঁয়া, কোলাহল, অফিসপাড়ার তাড়াহুড়ো মিলিয়ে যাচ্ছিল সবুজে মোড়া বিস্তৃত মাঠের আড়ালে। জানালার বাইরে অরিত্রর চোখ থেমে থাকছিল বারবার গরুর গাড়ি, ধানক্ষেত আর পাকা রাস্তার ধুলোয়। বহু বছর পর সে আবার গ্রামে এসেছে, অথচ তার নিজের গ্রামের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। মামাতো বোনের বিয়ের জন্যই এই সফর। শহরের অ্যাপার্টমেন্ট, গাড়ির হর্ন আর কংক্রিটের জগতের বাইরে এসে যেন এক নতুন নিঃশ্বাস নিতে পারছিল সে। তার মনে হচ্ছিল, এখানে বাতাসও অন্য রকম—আরও নরম, আরও পরিষ্কার। ট্রেনের জানালা দিয়ে দিগন্ত পর্যন্ত ছুটে চলা সবুজকে দেখে তার মনে হচ্ছিল, এ জীবনেরই এক টুকরো, যা থেকে সে দীর্ঘদিন দূরে ছিল। ভেতরে বগির ভিড়, সিটে বসা যাত্রীরা নানা গল্পে মশগুল, কিন্তু অরিত্রর কানে পৌঁছচ্ছিল শুধু চাকার ছন্দ আর গ্রামের ডাকঘরের টঙে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের হাসি। যেন এক ধরণের নির্দোষ, অকৃত্রিম আবহ যা তাকে এক অদ্ভুত টানে জড়িয়ে নিচ্ছিল।
স্টেশনে নামতেই তার চোখ আটকে গেল ছোট্ট প্ল্যাটফর্মে। লাল রঙের ছাদওয়ালা স্টেশনঘর, দেওয়ালে ঝুলছে পুরনো ঘড়ি, আর চা-ওয়ালার হাঁক। শহরের চেনা ভিড় এখানে নেই, বরং আছে ধীরলয়ের ব্যস্ততা। বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে এসেছে তাকে নিতে। চারপাশে এমন পরিবেশ যে, মনে হচ্ছিল যেন সিনেমার সেটে পা রেখেছে। ধুলো-মাখা রাস্তায় বোলানো টেম্পো গাড়ি, রাস্তার ধারে গাছের ছায়া, আর মাঠে খেলা করছে কিছু বাচ্চা। গাড়ি চলতে শুরু করল, আর অরিত্র ধীরে ধীরে দেখতে লাগল গ্রামের ছবির মতো দৃশ্যপট। বাগানবাড়ি পৌঁছাতে যেতে কিছুটা সময় লাগল, আর সেই পথেই সে প্রথম দেখল পাকা রাস্তার পাশে ঝুলে থাকা কাশফুল, খালের ওপর বাঁশের সাঁকো, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো এক মন্দির। শহরের ভিড়ের মধ্যে এত বছর বাস করার পর হঠাৎ এত নিস্তব্ধ, অথচ প্রাণবন্ত দৃশ্য দেখে তার মনে হচ্ছিল, এই যাত্রাই যেন এক রকম মুক্তি।
বাগানবাড়িতে পৌঁছে প্রথমেই চোখে পড়ল বিশাল লাল রঙের দালান, যার সামনে একখানা প্রশস্ত উঠোন। বাড়িটার চারপাশে যেন গাছের এক অরণ্য—আম, জাম, কদম, আর বড় এক বকুলগাছ উঠোনের কোণে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। দালানের বারান্দায় রঙিন আলো-ফানুস ঝোলানো, উঠোনে বাঁশের মাচা বেঁধে সাজানো হয়েছে বিয়ের জন্য। আত্মীয়স্বজনের ভিড় ইতিমধ্যেই জমে উঠেছে। কেউ রান্নাঘরের দিকে দৌড়চ্ছে, কেউ আবার হাসি-গল্পে মেতে আছে। অরিত্রর চোখে যেন সবকিছু অপরিচিত, আবার একই সঙ্গে আপনও লাগছিল। শহরের বন্ধ ঘর থেকে হঠাৎ করে এই মুক্ত প্রকৃতির ভেতর এসে দাঁড়ানোয় তার মনে হচ্ছিল, ভিড়ের মধ্যে সে একাকী হলেও এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় আবদ্ধ। মামাতো বোন দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, আত্মীয়রা হাসিমুখে খোঁজখবর নিতে লাগল, কিন্তু সে যেন নিঃশব্দে চারপাশের দৃশ্য গিলছিল চোখ ভরে। উঠোনের এক কোণে সাজিয়ে রাখা পানের বাটা, অন্য কোণে পুকুরঘাটে ভিড় জমে থাকা মেয়েরা—সবকিছুতেই ছিল এক ধরনের প্রাণ, যা শহরে থেকে সে হারিয়ে ফেলেছিল।
রাত নামতেই বাড়ির চারপাশে আলো জ্বলে উঠল। নীল, লাল, সবুজের রঙিন বাতি দালানটাকে যেন অন্য এক জগতে রূপান্তরিত করল। উঠোনে তখন বসে গান হচ্ছে, ঢোলক বাজছে, হাসি-ঠাট্টায় মুখরিত পরিবেশ। অরিত্র একপাশে দাঁড়িয়ে সেসব উপভোগ করছিল, কিন্তু তার ভেতরে চলছিল এক ধরণের দ্বন্দ্ব। ভিড়ের মধ্যেও সে খানিকটা অচেনা, যেন নিজের জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। তবু সেই অচেনা অনুভূতির মাঝেই মিশে ছিল এক রকম শান্তি। বাড়ির চারদিকে গ্রামীণ সৌন্দর্য, পুকুরের জলে প্রতিফলিত আলো, আর বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ তাকে টেনে নিচ্ছিল আরও গভীরে। সে অনুভব করছিল, এই আগমন শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য নয়, বরং নিজের অজান্তে এক নতুন কাহিনির দরজা খুলে দিয়েছে, যেখানে অচেনা মানুষ, অচেনা পরিবেশই তাকে হয়তো অন্য এক পরিচয়ের দিকে নিয়ে যাবে। তার বুকের ভেতর হালকা এক উত্তেজনা জমতে শুরু করল—যেন আগামী দিনে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, যা আজকের এই প্রথম রাতের নীরব মুগ্ধতাকে বদলে দেবে চিরকালের জন্য।
দুই
সকালের আলো তখন মফস্বলের বাগানবাড়ির উঠোনে নেমে এসেছে স্নিগ্ধ রূপে। রাতের কোলাহল, গান-বাজনা, আত্মীয়দের দৌড়ঝাঁপ সব মিলিয়ে যে ব্যস্ততার আবেশ তৈরি হয়েছিল, তা সকালের মৃদু রোদ আর শিউলি ফুলের গন্ধে যেন প্রশমিত হয়েছে। অরিত্র তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। শহরের ছন্দে অভ্যস্ত তার কাছে এখানে ভোরবেলা এতটা শান্ত লাগছিল যে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। চারপাশে ভোরের আর্দ্রতা, পাখির ডাক, দূরে শোনা যাচ্ছিল মন্দির থেকে ভেসে আসা ঘণ্টার ধ্বনি। ঘরের ভিড় আর বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল পুকুরঘাটে। পুকুরের জলে সূর্যের প্রথম কিরণ প্রতিফলিত হচ্ছিল, চারপাশে গাছের ছায়া পড়েছিল, আর সেই শান্ত নীরবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে অরিত্রর মনে হচ্ছিল যেন সময় এক মুহূর্তের জন্য থেমে আছে। সেই মুহূর্তেই তার চোখে পড়ল—এক তরুণী, হাতে কলসি, পুকুরের ধারে জলের কাছে নেমেছে। সাদা শাড়ি, হালকা নকশা, চুল বাঁধা, মুখে কোনো সাজগোজ নেই, তবু তার ভেতর থেকে এমন একটা আলো বেরিয়ে আসছিল যা অরিত্রকে নিঃশব্দে থামিয়ে দিল।
মেয়েটি জলের ধারে নেমে কলসি ডুবিয়ে জল তুলছিল একেবারে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে। অরিত্রর চোখে পড়ল তার প্রতিটি ভঙ্গিমা কতটা সহজ আর স্বাভাবিক। শহরে সে যত মেয়েকে দেখেছে, তাদের সাজসজ্জা, গাড়ি, বাজারঘাটের ভিড়—সব মিলিয়ে যেন একরকম কৃত্রিমতার আবরণে ঢাকা। অথচ এই মেয়েটি যেন প্রকৃতির অংশ, যেন পুকুরঘাট, কচুরিপানা আর সকালের আলো তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি। হঠাৎ মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল, আর চোখাচোখি হলো দুজনের। সেই দৃষ্টিতে কোনো বাড়াবাড়ি বা দ্বিধা ছিল না, বরং ছিল একেবারে নিরাভরণ এক চাহনি। অরিত্রর বুকের ভেতর হঠাৎ করে কিছু কেঁপে উঠল। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু গলা শুকিয়ে এলো, ঠোঁটের কোণে কোনো শব্দ এল না। মেয়েটি চোখ নামিয়ে নিল, আবার জলের দিকে মন দিল। মুহূর্তের জন্য অরিত্র অনুভব করল, যেন একটা স্বচ্ছ কাচের দেয়াল তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে—দেখা হচ্ছে, কিন্তু বলা যাচ্ছে না।
মেয়েটি ধীরে ধীরে কলসি ভরে মাথায় তুলে নিল। তখন তার ভঙ্গিমায় এমন এক সরল গরিমা ফুটে উঠল যা শহরের কোনো রঙিন আসরে পাওয়া যায় না। অরিত্র নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল, তার মনে হচ্ছিল, এই অচেনা মেয়েটি যেন শতাব্দীর পুরনো কোনো লোককথা থেকে উঠে এসেছে। মেয়েটির প্রতিটি পদক্ষেপ পুকুরঘাটের সিঁড়ি ভরে দিচ্ছিল এক অদ্ভুত সুরে। বিদায় নেওয়ার আগে সে আবার একবার চোখ তুলে তাকাল অরিত্রর দিকে—সেই চাহনিতে কোনো প্রশ্ন ছিল না, কোনো আমন্ত্রণও নয়, কেবল নিস্পাপ এক জিজ্ঞাসা, যেন বলতে চাইছে, “তুমি কে?” অরিত্রর ভেতরে তখনও এক অদ্ভুত আলোড়ন। সে এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু ভেতরের সংকোচ তাকে আটকে দিল। মেয়েটি ধীরে ধীরে পুকুরঘাট ছেড়ে চলে গেল, কলসি মাথায়, ভোরের আলো তার চারপাশে আভা ছড়িয়ে দিল। অরিত্র অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়, যেন তার নিঃশ্বাস আটকে গেছে।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পরও অরিত্রর চোখ পুকুরের জলের দিকে স্থির রইল। জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল বকুলগাছের ছায়া আর সকালের সূর্যালোক, কিন্তু অরিত্রর মনে হচ্ছিল সে যেন আরেক জগৎ দেখছে। তার বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত নাড়া কাজ করছিল। এত বছর ধরে শহরের যান্ত্রিক জীবনে সে যত মুখ দেখেছে, কোনো মুখ তাকে এইভাবে থমকে দেয়নি। এই মেয়েটির নিছক উপস্থিতিই তার ভেতরে কিছু জাগিয়ে তুলেছে। সেই সময়ে বাড়ি থেকে ডাক এল—কারো কণ্ঠ ভেসে এলো তাকে সকালের নাশতার জন্য ডাকছে। অরিত্র চমকে উঠল, যেন স্বপ্ন ভেঙে গেল। সে ধীরে ধীরে ফিরে গেল উঠোনের দিকে, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, পুকুরঘাটে যে অচেনা মেয়েটির সঙ্গে আজ চোখাচোখি হলো, সেই চাহনি তাকে ছেড়ে যাবে না কোনোদিন। ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে তাকে খুঁজবে, প্রতিটি হাসির আড়ালে, প্রতিটি গানের সুরের ভেতর, প্রতিটি বাতাসের ঝাপটায়। সেই প্রথম দেখা, কোনো কথা না বলা—তবু যেন হাজারো অপ্রকাশিত কথার জন্ম দিয়ে গেল অরিত্রর হৃদয়ে।
তিন
বিয়ের বাড়ির কোলাহল তখন তুঙ্গে। উঠোনে বাঁশের মাচা বেঁধে তার ওপর রঙিন আলো-ফানুস ঝুলছে, রান্নাঘরে বড় বড় হাঁড়িতে পোলাও, মাংস, লুচি, সন্দেশের গন্ধ ভেসে আসছে, আর আঙিনায় ছোটদের দৌড়ঝাঁপে ধুলো উড়ছে। সবাই ব্যস্ত—কেউ ফুল সাজাচ্ছে, কেউ অতিথিদের খাওয়াচ্ছে, কেউ আবার খেলার ছলে হৈচৈ করছে। এই ভিড়ের মাঝেই অরিত্র যেন নিজের জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না। সে মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে জানে, কিন্তু এত বড় পরিবারের আনাগোনা, আত্মীয়স্বজনের অবিরাম প্রশ্নোত্তরে তার গা ক্লান্ত হয়ে উঠছিল। তাই এক ফাঁকে সরে গিয়ে উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বকুলগাছের তলায় এসে বসেছিল। দুপুরের আলো তখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছায়া-আলো তৈরি করেছে, চারপাশে হালকা বাতাস বইছে। গাছটার নিচে বসে অরিত্রর মনে হচ্ছিল, যেন গ্রামীণ আকাশের বুকের ভেতর সে লুকিয়ে গেছে। তার চোখ হঠাৎ বন্ধ হয়ে আসছিল, কানে ভেসে আসছিল দূরের ঢাকের শব্দ আর আত্মীয়দের হাসি। কিন্তু এই অচেনা পরিবেশে হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যাচ্ছিল সকালের সেই পুকুরঘাট—আর সেই মেয়েটির চাহনি, যে তার ভেতর অদ্ভুত আলোড়ন তুলেছিল।
এই ভাবনার ভেতরেই হঠাৎ সে টের পেল, পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। মাথা তুলে দেখল, সকালবেলার সেই মেয়েটিই। এবার আর কলসি নেই, সাদামাটা নীল শাড়ি, চুল খোঁপা করে বাঁধা, মুখে যেন এক নির্লিপ্ত প্রশান্তি। অরিত্রর বুক ধক করে উঠল। এত লোকের মধ্যে আবার এই মেয়েটির সঙ্গে দেখা—এ যেন কাকতালীয় নয়, বরং ভাগ্যের খেলা। মেয়েটি প্রথমে একবার তাকাল, তারপর খুব সহজ ভঙ্গিতে বকুলগাছের ছায়ায় মাটিতে বসল। দুজনের মাঝখানে এক অদ্ভুত নীরবতা তৈরি হলো, যেন কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার সময় চাইছে। অরিত্র দ্বিধা ভাঙল আগে—নরম স্বরে বলল, “আপনি কি এখানকার?” মেয়েটি চোখ নিচু করে হাসল, তারপর উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এই বাড়িরই আত্মীয়া। আপনিই তো শহর থেকে এসেছেন?” এই সরল কথোপকথন যেন অনেকটা পথ খুলে দিল। অরিত্র একটু সাহসী হলো, তার নিজের নাম বলল, পেশার কথাও শোনাল। মেয়েটি জানাল, তার নাম মেঘলা, কলেজের পড়াশোনা সবে শেষ করেছে, তবে গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।
প্রথমে কথাবার্তা এগোচ্ছিল ধীরে ধীরে—শহরের জীবন কেমন, গ্রামে কীভাবে দিন কাটে, পড়াশোনার ভবিষ্যৎ—এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল। কিন্তু যত তারা কথা বলছিল, ততই দ্বিধার প্রাচীর গলে যাচ্ছিল। অরিত্র অবাক হয়ে দেখল, মেঘলার কথা বলার ভঙ্গি যেমন সরল, তেমনই গভীর। শহরের মেয়েরা হয়তো অনেক বেশি আধুনিক সাজে, বড় বড় স্বপ্ন নিয়ে চলে, কিন্তু মেঘলার চোখে ছিল এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস, যেন সে তার মাটি, তার গ্রাম আর প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অটুটভাবে। মেঘলা তাকে বলল, ছোটবেলা থেকেই সে এই পুকুরঘাট, এই বকুলগাছ, এই বাড়ির আঙিনা—সবকিছুর সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। গরমের দুপুরে এই গাছের নিচেই কত গল্প হয়েছে, কত গান গাওয়া হয়েছে। অরিত্র তার কথা শুনে মুগ্ধ হচ্ছিল। সে হঠাৎ অনুভব করল, এই মেয়েটির সরলতায় এক অদৃশ্য শক্তি আছে—যা মানুষের ভেতরে ঢুকে পড়ে। কথার ফাঁকে মেঘলা মাঝে মাঝে হেসে উঠছিল, আর সেই হাসি যেন অরিত্রর বুকের গভীরে আলোর ঝলক এনে দিচ্ছিল।
কথোপকথন চলতে চলতে সময় কেটে যাচ্ছিল অজান্তেই। উঠোনে তখনও হৈচৈ চলছে, কিন্তু বকুলগাছের ছায়ায় যেন আলাদা এক জগৎ গড়ে উঠেছিল। মেঘলার চোখে কৌতূহল—শহরের জীবন কেমন, অরিত্রর কাজের অভিজ্ঞতা কী, ভবিষ্যৎ নিয়ে তার পরিকল্পনা কী—এসব নিয়ে সে প্রশ্ন করছিল বারবার। আর অরিত্র অবাক হচ্ছিল, এমন সহজ অথচ খোলামেলা কথোপকথন সে বহুদিন পায়নি। তাদের দুজনের মধ্যে যেন হঠাৎ এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে গেল—যেখানে অপরিচয় ধীরে ধীরে ঘুচে গিয়ে জায়গা করে নিচ্ছিল এক নতুন বোঝাপড়া। বাতাসে বকুলফুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছিল, চারপাশের ভিড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুজন মানুষ এক অদ্ভুত নির্জনতায় নিজেদের আলাপ খুঁজে পাচ্ছিল। অরিত্র বুঝতে পারল, এই প্রথমবার সে মফস্বলের মাটির গন্ধে ভিজে যাওয়ার পাশাপাশি, এক অচেনা মেয়ের সরলতা আর সৌন্দর্যের ভেতরে নতুন এক আকর্ষণের জন্ম নিচ্ছে। মেঘলা তার গল্প শেষ করে হালকা হাসল, আর সেই মুহূর্তে অরিত্র মনে মনে ঠিক করে নিল—এই বকুলগাছের ছায়া তার কাছে শুধু একটা স্মৃতির স্থান হবে না, বরং এক নতুন যাত্রার সূচনা।
চার
বিয়ের ঘর যেন উৎসবের উচ্ছ্বাসে ভেসে চলেছে। আঙিনা থেকে শুরু করে বারান্দা, ঘরের প্রতিটি কোণ ভরে গেছে হাসি-ঠাট্টা, গানের সুর আর চঞ্চল কথাবার্তায়। ঢাক-ঢোলের তালে তাল মেলাচ্ছে মেয়েদের কণ্ঠে গাওয়া বউভাতের গান, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটরা হৈ-হুল্লোড়ে মাতিয়ে রেখেছে পরিবেশ। মেঝেতে কলাপাতা সাজানো হচ্ছে, একপাশে রান্নার গন্ধে ভরে উঠেছে বাতাস—গরম ভাত, মাংস, মাছভাজা আর মিষ্টির গন্ধে সবাই যেন ক্ষুধার্ত অপেক্ষায়। আত্মীয়স্বজনরা দূরদূরান্ত থেকে এসেছে, তাদের গল্প আর হাসির রোল আকাশে বাজতে থাকা আতশবাজির মতো ফেটে পড়ছে। এমন কোলাহলপূর্ণ, আনন্দময় পরিবেশে দাঁড়িয়েও দুজন চোখ খুঁজে ফিরছে একে অপরকে। প্রথমবার যেভাবে দেখা হয়েছিল, সেই মুগ্ধতা এখনও রয়ে গেছে—কোলাহলের মাঝেও তাদের জন্য যেন সময় থমকে গেছে। ভিড়ের ভেতরও তারা এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা অনুভব করছে, যেন চারপাশের শব্দ এক মুহূর্তের জন্য ম্লান হয়ে শুধু তাদের দুজনকে ঘিরে রেখেছে এক নিভৃত জগত।
সন্ধ্যার আলো যখন ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে, ঠিক তখনই সামনের উঠোনে আলো ঝলমল করে উঠল। শোভাযাত্রার মতো সাজানো রঙিন আলোকসজ্জা, ফুলের মালা আর সুগন্ধি ধূপে ভরে উঠল পরিবেশ। সবাই ব্যস্ত, কেউ সেজেগুজে ছবি তুলছে, কেউ আবার খাবারের আয়োজন সামলাতে দৌড়ঝাঁপ করছে। বড়রা প্যান্ডেলের ভেতরে বসে গল্পে মগ্ন, ছোটরা খেলার ছলে একে অপরকে ধাক্কাধাক্কি করছে, আর মাঝবয়সীরা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে মাতামাতি করছে। এই অগোছালো অথচ প্রাণবন্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে হঠাৎই তাদের দুজনের চোখের দৃষ্টি এক বিন্দুতে এসে মিশল। চারপাশের হৈচৈ আর হাসির কোলাহলের মাঝেও সেই মুহূর্তে তারা যেন নিঃশব্দে কথা বলে ফেলল। চোখে চোখ পড়তেই এক ধরনের অস্বস্তি আর মিষ্টি উত্তেজনা শরীরে বয়ে গেল—যেন ভিড়ের ভেতরেও তারা আলাদা করে একে অপরের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। আশেপাশে কে কী করছে, কে কী বলছে, সেদিকে তাদের কোনও মনোযোগ নেই; বরং অচেনা ভিড়ের মাঝেও পরিচিত সঙ্গের ছোঁয়া যেন এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিল দুজনের মনে।
আনন্দ-আয়োজন যত বাড়ছে, ততই তাদের নিঃশব্দ টানও যেন গভীর হয়ে উঠছে। ভোজের টেবিলের সামনে যখন সারি করে লোক বসছে, তখনও তারা ইচ্ছে করেই এমন জায়গা বেছে নিচ্ছে যেখানে একে অপরকে দেখা যায়। কেউ হাসছে, কেউ মজা করছে, কেউ আবার ছবি তোলার জন্য ভিড় করছে, অথচ তাদের চোখের ভাষায় লুকিয়ে আছে এক ধরনের ব্যক্তিগত সংলাপ। বিয়ের গান যখন আবার নতুন সুরে বাজতে শুরু করল, তখন দুজনের মনে হলো, এই সুর শুধু তাদের জন্যই। আশেপাশে থাকা মানুষজনকে নিয়ে যেন একটা অদৃশ্য আবরণ তৈরি হয়েছে, ভিড়ের ভেতরেও একফোঁটা নিঃসঙ্গতা তাদের ঘিরে ফেলেছে। কোলাহল, হাসি, চিৎকার, গানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই নিস্তব্ধতা কেবল তারাই অনুভব করছে। এই নিস্তব্ধতার ভেতরেই তারা একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে, একে অপরকে বুঝেছে—যেন এই আয়োজনের আসল আনন্দ লুকিয়ে আছে শুধু তাদের দৃষ্টির মিলনে।
শেষরাতের দিকে আয়োজন যখন ধীরে ধীরে স্তিমিত হলো, অতিথিরা খাওয়া-দাওয়া সেরে বিদায় নিতে শুরু করল, তখনও তাদের মনে হচ্ছিল—দিনভর চলা এই গান, হাসি, আলোর ঝলক আর কোলাহল সবই যেন এক উপলক্ষ মাত্র; আসল মুহূর্ত ছিল তাদের নিঃশব্দ মিলন। তারা কেউ কারও সঙ্গে একটিও সরাসরি কথা বলেনি, তবু মনে হয়েছে, অনেক কথা বলা হয়ে গেছে। আয়োজিত বিয়ের ঘরের এই কোলাহল তাদের কাছে এক অজানা সেতু হয়ে উঠল, যা ভিড়ের ভেতর থেকেও দুজনকে একে অপরের দিকে টেনে নিয়ে এল। রাত যত গাঢ় হলো, বাতাসে লেগে থাকা ফুলের গন্ধ আর দূর থেকে ভেসে আসা বউভাতের শেষ গানের সুর তাদের মনে আরও গভীরভাবে ছাপ ফেলল। তারা জানল, এই ভিড়ের মাঝেই জন্ম নিয়েছে এক অদ্ভুত নির্জনতার বন্ধন, যা একে অপরের কাছে পৌঁছে যাওয়ার নতুন পথ তৈরি করেছে।
পাঁচ
অরিত্র সেদিন রাতে ঘুমোতে পারছিল না। বাড়ির ভেতর আলো-আঁধারি, জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে মেঝের ওপর পড়েছিল। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁতেই তার মনে হলো, বাড়ির পেছনে নদীর ধারে একটু হাঁটতে বের হওয়া যায়। হঠাৎ করেই মেঘলাকে বাইরে আসতে দেখা গেল। মেয়েটির পরনে ছিল হালকা রঙের সালোয়ার-কামিজ, হাতে একটা পাতলা শাল জড়ানো। নদীর ধারে এই সময়ে হালকা শীতল হাওয়া বয়ে যায়, তাই শালটাকে জড়িয়ে নিয়ে সে হাসিমুখে দাঁড়াল। অরিত্র খানিকটা অবাক হলেও কোনো কথা না বলে তাকে ইঙ্গিত করল পাশে হাঁটার জন্য। দু’জনে ধীরে ধীরে পা বাড়াল। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে কেবল শোনা যাচ্ছিল নদীর জলের মৃদু কলকল শব্দ আর মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁর ডাক। রাতের এই নির্জনতায় তাদের দুজনের ছায়া মাটিতে লম্বা হয়ে পড়েছিল, যেন পৃথিবীকে সাক্ষী করে তারা দুজনে নিজেদের কথা ভাগাভাগি করতে চলেছে।
মেঘলা প্রথমে কিছুটা নীরব ছিল। নদীর পাড়ে এসে সে একটা শুকনো পাথরের উপর বসে বলল, “এই নদীটা আমার ছোটবেলা থেকে কতকিছু দেখেছে জানো? আমি যখন একেবারে ছোট, তখন এখানেই সাঁতার শিখেছি। আমার বাবা আমাকে এই নদীর ধারে বসিয়ে গল্প করত, বলত নদী নাকি মানুষকে নিজের মনের কথা শোনায়। আমি তখন এসব কিছু বুঝতাম না, কিন্তু বড় হতে হতে বুঝেছি, নদী যেন এক অদ্ভুত সঙ্গী। আমার দুঃখ, আনন্দ, স্বপ্ন—সবকিছু এই নদীর জলের মধ্যে প্রতিফলিত হয়।” অরিত্র গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সে লক্ষ্য করল, মেঘলার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি জ্বলজ্বল করছে, যেন তার প্রতিটি কথা ভেতর থেকে উঠে আসছে। সে আবার বলল, “তুমি হয়তো জানো না, আমি শহরে পড়তে চাই। আমি শুধু এখানেই থেকে যেতে চাই না। গ্রামের প্রতি টান আছে, কিন্তু স্বপ্ন আরও বড়। আমি চাই, পড়াশোনা করে এমন জায়গায় পৌঁছাই যেখানে আমায় দেখে গ্রামের মেয়েরা সাহস পায়।” অরিত্র মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তুমি কি মনে করো, তোমার স্বপ্ন একদিন সত্যি হবে?” মেঘলা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল—”হ্যাঁ, হবে। আমি জানি অনেক কষ্ট আছে, অনেক বাধা আছে, কিন্তু আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।”
ধীরে ধীরে তাদের আলাপ গভীরে পৌঁছাল। অরিত্র বুঝতে পারছিল, এই মেয়েটি শুধু স্বপ্ন দেখছে না, সে জানে কীভাবে সেই স্বপ্নের দিকে এগোতে হবে। তার কথায় কোনো শূন্যতা নেই, বরং একধরনের দৃঢ়তা আছে যা সহজে দেখা যায় না। মেঘলা নিজের স্কুলের কথা বলল, শিক্ষকদের কঠোরতা, বন্ধুদের দুষ্টুমি, আর গ্রামের মেলার সময় তার নাচের স্মৃতি। মাঝে মাঝে সে হেসে উঠছিল, আবার কিছু সময় তার কণ্ঠে গাম্ভীর্য ফুটে উঠছিল। নদীর ওপারে অন্ধকারে মাঝে মাঝে জোনাকি জ্বলছিল, আর সেই আলোতে মেঘলার মুখে এক অদ্ভুত আভা পড়ছিল। অরিত্রর মনে হলো, এই মুহূর্তে সে যেন তার সামনে বসে থাকা কোনো সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে নয়, বরং স্বপ্নে ভর করে এগিয়ে চলা এক অদম্য প্রাণশক্তি। সে কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “তুমি জানো, আমি শহর থেকে এসেছি। শহরে সবকিছু আছে—আলো, বই, সুযোগ… কিন্তু সেখানকার মানুষদের চোখে আমি প্রায়ই সেই দীপ্তি দেখি না, যেটা আজ তোমার চোখে দেখছি। তুমি যে এতটা বিশ্বাস নিয়ে কথা বলছ, সেটা সত্যিই অনন্য।” মেঘলা হেসে বলল, “হয়তো কারণ আমরা যারা ছোট জায়গা থেকে বড় স্বপ্ন দেখি, আমাদের ভেতরে একধরনের আগুন জ্বলতে থাকে। সেটা হয়তো তোমরা শহরের মানুষ এত সহজে বুঝতে পারো না।”
রাত আরও গভীর হতে লাগল, নদীর জলে চাঁদের প্রতিফলন ঝিলমিল করছিল। দুজনের কথোপকথন যেন থামছিল না—তারা বই, গান, কবিতা, এমনকি ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়েও আলোচনা করল। মেঘলা বলল, তার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ, কারণ তিনি প্রকৃতিকে যেমন দেখেছেন, তা অন্য কেউ দেখাতে পারেনি। অরিত্র অবাক হলো, এত কম বয়সে এমন গভীর সাহিত্যচেতনা কোথা থেকে পেল মেয়েটি! সে নিজের ছাত্রজীবনের গল্প বলল, প্রথম শহরে এসে কেমন কষ্ট হয়েছিল, কেমন করে একা লড়াই করে টিকে থাকতে হয়েছে। মেঘলা মন দিয়ে শুনল, যেন তার প্রতিটি অভিজ্ঞতা নিজের মধ্যে ধারণ করছে। এই রাত, এই নদীর ধারে হাঁটা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছিল, যা দুজনের মধ্যে এক অচেনা কিন্তু আন্তরিক সেতুবন্ধন তৈরি করে দিল। মেঘলার চোখে যে অদম্য দীপ্তি অরিত্র দেখেছিল, সেটাই তাকে এক অদ্ভুত টানে কাছে টেনে আনছিল। সে অনুভব করল, হয়তো এই গ্রামের নির্জনতা আর নদীর স্রোতই তাকে এমন একটি মানুষের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে, যে তাকে নিজের ভেতরের শক্তি, নিজের অজানা স্বপ্নের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছে। এভাবে রাত বাড়ল, হাওয়া ঠান্ডা হতে লাগল, আর দুজন নিঃশব্দে বুঝতে পারল—এই নদীর ধারের হাঁটা তাদের দুজনের জীবনের স্মৃতিতে চিরদিন অমলিন হয়ে থাকবে।
ছয়
শুভায়ন আর সুধীপ্তার আলাপচারিতা এতদিন পর্যন্ত একেবারেই সাধারণ সৌজন্যের সীমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে দুজনের চোখে চোখে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হতে শুরু করল, যা তারা কেউই এড়াতে পারছিল না। ক্লাসের ভিড়ের মধ্যেও, কোলাহলের ভেতরেও, তাদের মধ্যে যেন এক নিরব টান খেলা করে যাচ্ছিল। কথোপকথন শেষ হওয়ার পরও দুজনের মনের ভেতর এক অনুরণন থেকে যেত—শব্দগুলো, দৃষ্টিগুলো, আর সেই সামান্যতম হাসিটুকু যেন দীর্ঘক্ষণ তাদের মনোযোগে আঁকড়ে থাকত। শুভায়ন বুঝতে পারছিল, এই অনুভূতিটা নিছক কৌতূহল নয়; যেন কোথাও একটা লুকোনো আকর্ষণ ক্রমে ভেতরে ভেতরে বাড়ছে। সুধীপ্তাও অবাক হচ্ছিল নিজের ভেতরের পরিবর্তনে। আগে যাকে কেবল সহপাঠী হিসেবেই দেখত, হঠাৎই সে যেন নতুন আলোয় ধরা দিতে শুরু করেছে। সে খেয়াল করল, শুভায়নের চোখে এমন এক ধরণের আন্তরিকতা আছে যা তাকে নিরাপদ মনে করায়, আর সেই নিরাপত্তা থেকেই অজানা এক টান তার ভেতরে গড়ে উঠছে।
তাদের প্রতিদিনকার আচরণেও এর ছাপ পড়তে লাগল। উদাহরণস্বরূপ, লাইব্রেরির করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যদি শুভায়নের সঙ্গে সুধীপ্তার দেখা হয়ে যেত, দুজনেই সামান্যক্ষণ থেমে থাকত, চোখে চোখ রেখে হালকা হাসি বিনিময় করত। কোনো প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করার অজুহাতে তারা একসঙ্গে বসত, কিন্তু আসল আলোচনার বাইরে গিয়ে দুজনেই অন্য বিষয়ে গল্পে ডুবে যেত। ক্লাসে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় শুভায়নের দিকেই সুধীপ্তার চোখ চলে যেত, আর শুভায়নও প্রায়শই অনুভব করত সুধীপ্তার সেই দৃষ্টি তাকে ঘিরে রেখেছে। তাদের সহপাঠীরা হয়তো এই অদ্ভুত পরিবর্তনটা টের পাচ্ছিল, কিন্তু দুজনেই যেন একপ্রকার ভেতরের গোপন চুক্তি করে নিয়েছিল—এই অনুভূতির প্রকাশ বাইরের কারো সামনে করা যাবে না। ফলে চোখের ইশারা, সামান্য অঙ্গভঙ্গি, কিংবা হালকা মুচকি হাসি—এসবই হয়ে উঠল তাদের গোপন ভাষা।
কিন্তু এই অজানা টান শুধু সুখের ছিল না; এর সঙ্গে ছিল এক ধরনের অস্থিরতাও। সুধীপ্তা মাঝেমধ্যেই নিজের মনে প্রশ্ন তুলত—সে কি সত্যিই শুভায়নের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে? এটা কি শুধুই সাময়িক এক কিশোরী-আবেগ, নাকি এর ভেতরে সত্যিই কোনো গভীরতা আছে? তার মনের ভেতর দ্বন্দ্ব চলত—যদি কারও সামনে এ অনুভূতি প্রকাশ পেয়ে যায়? যদি শুভায়ন অন্যভাবে নেয়? ঠিক একই দ্বিধার মধ্যে শুভায়নও পড়েছিল। সে অনেক সময় নিজের ভেতরে যুক্তি খুঁজত—“হয়তো এটা নিছকই কাকতালীয়, হয়তো আমি বাড়তি কিছু ভেবে নিচ্ছি।” কিন্তু যতই সে যুক্তি দাঁড় করাক না কেন, তার ভেতরের আকর্ষণ ক্রমেই তাকে গ্রাস করে ফেলছিল। একদিন দুপুরবেলা ক্লাস শেষ হওয়ার পর শুভায়ন স্কুলের মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে সুধীপ্তাকে দেখছিল, আর সুধীপ্তা হঠাৎ করেই ফিরে তাকিয়ে একবার দৃষ্টি দিলো। সেই এক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়েই দুজনেই বুঝে গেল—এটা নিছক কাকতালীয় নয়, বরং এক অজানা টান, যেটা ক্রমশ তাদের ভেতরের জগৎকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই অজানা টানই তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাচ্ছিল। বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও, ভেতরে ভেতরে তাদের দুজনের পৃথিবী বদলাতে শুরু করেছে। সুধীপ্তা আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে শুভায়নের কথায়, শুভায়নও খেয়াল করছিল সুধীপ্তার উপস্থিতি তার দিনটাকে অদ্ভুতভাবে হালকা করে তোলে। এই টান, এই নিরব সংযোগ হয়তো এখনো ভাষায় প্রকাশ পায়নি, কিন্তু তাদের অন্তর্গত অনুভূতির গভীরে সে অনেকখানি শিকড় গেড়ে ফেলেছে। তারা দুজনেই এখন বুঝতে পারছে, একে অপরকে এড়িয়ে চলা আর সম্ভব নয়। অচেনা হলেও এই টান তাদের কাছে পরিচিতির থেকেও বেশি আপন মনে হচ্ছে, আর সেই অদৃশ্য সুতোর বাঁধনই এখন থেকে তাদের সম্পর্ককে নতুন এক পথে নিয়ে যাবে।
সাত
বিয়ের বাড়ির চারপাশে তখনো উৎসবের রঙ লেগে আছে। অতিথিদের ভিড়, খাওয়া-দাওয়ার ঘ্রাণ, আলো-ঝলমলে সাজসজ্জা আর হাসি-ঠাট্টার ভিড়ের মাঝেও যেন অচেনা এক স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। মেঘলা আর অর্কর উপস্থিতি সবার চোখ এড়ায়নি। শুরুতে দু’জনের একসঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল একেবারেই স্বাভাবিক, তারা দূরসম্পর্কের পরিচিত বলে মাঝে মাঝে কথা বলছিল, তবে ধীরে ধীরে তাদের সময় কাটানো যেন বাড়তে লাগল। দুপুরের খাওয়ার পর একসঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়া, সন্ধ্যার গানের আসরে পাশাপাশি চুপচাপ হাসি-ঠাট্টা, কিংবা হঠাৎই সিঁড়িঘাটে দেখা হয়ে দীর্ঘ আলাপ—সবই বাড়ির অন্যদের চোখে ধরা পড়তে লাগল। অনেকে মজার ছলে টিপ্পনী কাটতে শুরু করল, বিশেষ করে রঞ্জনা মাসিমা, যিনি সবকিছুর মধ্যে নতুন গল্প খুঁজে নিতে ভালোবাসেন। তিনি একদিন হাসতে হাসতে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বললেন—“এই যে বউমা, তোমার হাসিটা আজকাল একটু অন্যরকম লাগছে। নাকি কারও প্রভাবে বদলে গেছে?” চারপাশে হেসে ওঠে সবাই, আর মেঘলা হালকা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়। অর্কও একটু মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে যায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দু’জনেই বুঝতে পারে যে লোকজনের খেয়াল এখন তাদের দিকে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এই নজরদারি আর ঠাট্টা-তামাশা মেঘলার মনে এক অদ্ভুত দ্বিধা তৈরি করল—সে যেন নিজের অনুভূতিকে গোপন করতে চাইল, অথচ তা ক্রমেই উন্মুক্ত হতে লাগল অন্যদের সামনে।
দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পরিবেশেও সূক্ষ্ম পরিবর্তন টের পাওয়া গেল। বিয়ের উৎসবের হাসি-আনন্দে কারওরই খুব একটা আপত্তি ছিল না, কিন্তু পরিবারের অভিজ্ঞ মানুষদের চোখে লুকিয়ে থাকা ইঙ্গিত অনেক কিছু বলে দেয়। মেঘলা বুঝতে পারছিল যে তার প্রতি অর্কর বিশেষ মনোযোগ আর তাদের একসঙ্গে থাকার বাড়তি সময় অন্যদের কৌতূহল জাগাচ্ছে। এর ফলে তার ভেতরে লজ্জা আর সংকোচের সঙ্গে সঙ্গে একরকম অস্বস্তি জমতে শুরু করল। সে চেষ্টা করছিল অর্কের সঙ্গে আগের মতো খোলামেলা না থাকতে, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে সবসময় নতুন করে ধরা দিচ্ছিল। এক সন্ধ্যায়, যখন সবাই আঙিনায় বসে আলো-ঝলমলে পর্দা আর লাইটিংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল, অর্ক মেঘলাকে হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করল—“তুমি কি আমার সঙ্গে হাঁটতে বেরোবে? একটু ভিড় থেকে দূরে।” মেঘলার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল দ্বিধা, তার মনে হচ্ছিল যদি কেউ আবার দেখে ফেলে? কিন্তু অর্কের চোখের আন্তরিকতা আর কণ্ঠের স্বাভাবিক স্নেহে সে না করতে পারল না। দু’জনে বাড়ির ভেতর থেকে একটু দূরে নিঃশব্দ পুকুরঘাটের দিকে হেঁটে গেল। কিন্তু সেই মুহূর্তে কারও চোখ এড়ায়নি তাদের একসঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া। রঞ্জনা মাসিমা আর কয়েকজন যুবতী হেসে ইঙ্গিত করে একে অপরকে বলল, “দেখো দেখো, আবার একসঙ্গে!” যদিও কারও মন্তব্য তারা তখন শুনতে পায়নি, পরে সেই টিপ্পনী কানে আসতেই মেঘলা ভেতরে ভেতরে দোটানায় ভুগতে লাগল। অর্ক বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিলেও মেঘলার ভেতরের সংকোচ দিন দিন গভীর হতে থাকল।
তবুও, যতই সংকোচ আর অস্বস্তি হোক, মেঘলার অন্তরে অর্কের প্রতি যে সহজ টান তৈরি হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে, যখন দু’জন নীরবে জলের ঢেউয়ের শব্দ শুনছিল, তখন মেঘলার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছিল। অর্ক খুব সাধারণ কিছু কথাই বলছিল—বাড়ির আয়োজন, শহরের কোলাহল, কিংবা আসন্ন ভবিষ্যতের ব্যস্ততা নিয়ে। কিন্তু সেই সাধারণ আলাপচারিতায়ই মেঘলা অনুভব করছিল এক অদ্ভুত সংযোগ। তার ভেতরে একটা লুকোনো কণ্ঠ বারবার বলছিল—‘এই মানুষটার কাছে থাকলে যেন সবকিছু সহজ মনে হয়।’ অথচ সেই মধুর মুহূর্তগুলিই হয়ে উঠছিল তার জন্য সবচেয়ে বড় বাধার কারণ। কারণ সে জানত, পরিবারের কাছে এভাবে খোলামেলা ঘোরাঘুরি হয়তো ভালোভাবে গ্রহণ করা হবে না। একসময় তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তার মনে হচ্ছিল, যদি কখনও পরিবার জেনে যায়, তবে কীভাবে তা সামলাবে? সেই ভাবনা তার প্রতিটি মিষ্টি মুহূর্তকেও অস্বস্তিতে ভরিয়ে তুলছিল। অর্ক অবশ্য সবকিছু সহজভাবে নিতে চাইছিল। সে হালকা হেসে বলল, “মানুষ তো বলবেই, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।” কিন্তু মেঘলা চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিল—“কিন্তু আমি তো তাদের পরিবারের একজন, আমার ওপর তো দায়িত্বও আছে।” সেই দ্বিধা আর সংকোচ মেঘলার ভেতরে ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছিল।
বিয়ের বাড়ির দিনগুলো যত এগোতে লাগল, ততই মেঘলা বুঝতে পারছিল যে চারপাশের নজর তাদের আর অবহেলা করছে না। সকালের আলাপন থেকে রাতের নাচগানের আসর—যেখানেই তারা পাশাপাশি দাঁড়াত, সেখানেই একটা চাপা ফিসফিসানি তৈরি হত। যদিও সেটা সবার কাছে মজা আর আনন্দের খোরাক, কিন্তু মেঘলার ভেতরে যেন অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি করছিল। সে চেষ্টা করছিল দূরে থাকতে, কিন্তু অর্কর স্বাভাবিক সহজতায় সবকিছু আবার আগের জায়গায় চলে আসত। মেঘলা উপলব্ধি করছিল, এই সম্পর্কটা ধীরে ধীরে এক বাঁধার আভাস নিয়ে আসছে—যা হয়তো পরিবার কিংবা সমাজের চোখে প্রশ্ন তুলতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে, তার হৃদয়ও অস্বীকার করতে পারছিল না যে অর্কর উপস্থিতি তার জীবনের শূন্যতা পূর্ণ করছে। সেই দ্বন্দ্বের ভেতরেই মেঘলা টের পেল, এই সম্পর্ক শুধু কিছু মুহূর্তের কাছাকাছি আসা নয়, বরং এমন এক যাত্রার সূচনা যা তাকে নিজের ভেতরের লজ্জা, সংকোচ আর সামাজিক বাধার মুখোমুখি দাঁড় করাবে। আর এই অচেনা স্রোতই তাকে ভয় আর আশার মাঝখানে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।
আট
বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে এসে পৌঁছেছিল। বাড়ির উঠোনে লণ্ঠন আর রঙিন বাতির আলো তখনও ঝলমল করছে, অথচ সেই আলোর আড়ালে ক্লান্তি নেমে এসেছে সবার শরীরে। আত্মীয়স্বজনেরা কেউ বিদায় নিচ্ছে, কেউবা গল্পে মশগুল, আর দূরে রান্নাঘর থেকে ধূপকাঠির সঙ্গে মিশে আসছে পায়েসের মিষ্টি গন্ধ। এতসব হৈচৈয়ের মধ্যেও যেন একটা অদৃশ্য নীরবতা ভেসে উঠেছিল। সেই নীরবতার টানেই অরিত্র বাইরে বেরিয়ে এল, আর মেঘলা নিঃশব্দে তার পিছু নিল। দু’জন হেঁটে গিয়ে পৌঁছল সেই পুরোনো বকুলগাছের তলায়—যে গাছ একসময় তাদের কিশোরবেলার গোপন আড্ডার সাক্ষী ছিল। চাঁদের আলোয় গাছের পাতাগুলো যেন রূপোলি আভা ছড়াচ্ছিল, আর বাতাসে ভেসে আসছিল ফুলের হালকা গন্ধ। মুহূর্তটা ছিল শান্ত, অথচ গভীর—যেন চারপাশের সবকিছু থেমে গিয়ে শুধু তাদের দু’জনকে এই শেষ রাতের কথোপকথনের জন্য জায়গা করে দিচ্ছে।
অরিত্র মাটির দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল, “সবকিছুই কত তাড়াতাড়ি বদলে গেল, তাই না?” মেঘলা হালকা হাসল, যদিও সেই হাসির আড়ালে ছিল একটা অদৃশ্য কষ্ট। “হ্যাঁ, বদলে গেছে,” সে বলল, “কিন্তু কিছু জিনিস বদলায় না, অরিত্র। যেমন এই গাছটা—এখনও একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেমন ছিল আমাদের শৈশবে।” কথাগুলো বলার পর মেঘলার কণ্ঠে একটু কাঁপুনি ধরা দিল। অরিত্র তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ রইল, যেন প্রতিটি শব্দ মনের ভেতর গভীরভাবে গেঁথে নিচ্ছে। তারপর মেঘলা হঠাৎই ধীরে ধীরে প্রশ্ন করল, “তুমি আবার আসবে তো?” প্রশ্নটা এতটাই সরল, অথচ এত গভীর, যে অরিত্র এক মুহূর্তের জন্য উত্তর খুঁজে পেল না। সে শুধু চেয়ে রইল মেঘলার চোখের দিকে, যেখানে লুকিয়ে ছিল হাজারো অজানা কথা, হাজারো অপ্রকাশিত অনুভূতি।
চাঁদের আলোতে তাদের দু’জনের ছায়া গাছের নিচে লম্বা হয়ে পড়েছিল। দূরে বউভাতের গান এখনো ভেসে আসছিল, কিন্তু এখানে যেন আরেকটা জগত গড়ে উঠেছিল—যেখানে ছিল শুধু অরিত্র আর মেঘলা। অরিত্র ধীরে ধীরে বলল, “আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে, কিন্তু আমার মন চাইছে বারবার ফিরে আসতে, তোমাদের কাছে, এই গ্রামে, এই গাছটার তলায়।” মেঘলার চোখে জল চিকচিক করছিল, কিন্তু সে জোর করে হাসল। “আমি জানি, তুমি আসবে,” সে বলল, “কারণ এই জায়গা তোমাকে ডাকবে বারবার। যত দূরেই যাও না কেন, মনে রেখো, এখানে কেউ তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।” তার কণ্ঠে একটা নিশ্চয়তা ছিল, আবার ছিল ভয়—যেন সময় সবকিছু মুছে দেওয়ার আগেই এই মুহূর্তটাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। দু’জনের মধ্যে আর কোনো বাড়তি কথা হল না। শুধু নীরবতার মধ্যেই তারা ভাগ করে নিল অনেক না-বলা অনুভূতি।
রাতটা ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছিল, বাতাসে শিশির জমছিল। বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছিল। অরিত্র মনে মনে বুঝতে পারছিল, এই রাতের আড্ডা হয়তো তাদের সম্পর্কের শেষ নিঃশ্বাস, হয়তো আবার এক নতুন শুরু। সে এগিয়ে এসে মেঘলার হাত ছুঁয়ে দিল—খুব অল্পক্ষণের জন্য, তবু সেই স্পর্শ যেন এক অমোঘ প্রতিশ্রুতি বয়ে আনল। মেঘলার ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু সে কিছু বলল না। শুধু আকাশের দিকে তাকাল, যেখানে পূর্ণচাঁদ তখন নিঃশব্দে হাসছিল। সেই নীরবতা, সেই গোপন স্পর্শ, আর সেই প্রশ্ন—“তুমি আবার আসবে তো?”—চিরদিনের মতো তাদের দু’জনের মনে দাগ কেটে রইল। রাত ফুরিয়ে এল, কিন্তু সেই শেষ রাতের আড্ডা থেকে যাওয়া স্মৃতি যেন আরও দীর্ঘজীবী হয়ে উঠল, এক অদৃশ্য বাঁধনের মতো, যা সময় বা দূরত্ব কোনোদিন ভাঙতে পারবে না।
নয়
অরিত্রর শহরে ফেরার দিন যেন হঠাৎ করেই এসে পড়ল। গত কয়েকদিনে গ্রামে তার উপস্থিতি, মেঘলার সাথে তার হঠাৎ দেখা হওয়া, একসাথে কাটানো নীরব অথচ অর্থপূর্ণ সময়গুলো—সবই যেন স্বপ্নের মতো লেগেছিল। কিন্তু আজ ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবতার ভার নামল। সকালবেলার ট্রেন ধরতে হবে, তাই রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রাখা ছিল, শুধু কিছু শেষ মুহূর্তের জিনিসপত্র গোছাতে বাকি। বাড়ির উঠোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা অরিত্রর চোখে সেই চেনা টানটান ব্যস্ততা আর অদৃশ্য শূন্যতার মিশ্রণ। গৃহস্থরা সকালের কাজকর্মে ব্যস্ত হলেও তার ভেতর চলছিল এক অদৃশ্য দ্বন্দ্ব—ফিরে যাওয়া জরুরি, অথচ এ মাটির টান আর মেঘলার চাহনির কাছে সব সিদ্ধান্তই ভঙ্গুর। ঘরে শেষবারের মতো তাকিয়ে নিল সে, যেন এই মাটির গন্ধ, এই বাতাসের স্পর্শ, আর এই ক’দিনের প্রতিটি মুহূর্ত চিরদিনের মতো মুঠোর মধ্যে ধরে রাখতে চায়। ট্রেনের সময় এগিয়ে আসছিল, অথচ তার মন যেন প্রতিটি মুহূর্তকে আরও কিছুটা দীর্ঘ করতে চাইছিল।
বেরোনোর মুহূর্তটা যেন আসতে চাইছিল না। ব্যাগ হাতে বারান্দা থেকে নামতেই মেঘলার ছোট্ট সাড়া কানে এল। সে গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিল, নিঃশব্দে। অরিত্র এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল—এই দৃষ্টি, এই নিস্তব্ধতা, কত কথাই না লুকিয়ে রেখেছে। তাদের মধ্যে কখনও সরাসরি কোনো প্রতিশ্রুতি বা ভবিষ্যতের কথা হয়নি, তবু যেন এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েছিল তারা। মেঘলার চোখে হালকা আর্দ্রতা ঝিলমিল করছিল সকালের আলোয়। কোনো কথা না বলেও দুজনের ভেতর দিয়ে অনেক কিছু বয়ে যাচ্ছিল—বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, আবার সেই অমোঘ টান যা তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে কিছু অনুভূতি ভাষায় বাঁধা যায় না। হাঁটতে হাঁটতে দুজন পৌঁছল গ্রামের পুকুরঘাটে, যেখানে একদিন তারা প্রথম দীর্ঘক্ষণ বসেছিল। যেন সেই জায়গাটিই আজকের বিদায়ের সাক্ষী হতে এসেছে।
পুকুরঘাটে পৌঁছেই তারা দুজন নীরবে বসে পড়ল। সকালের বাতাসে ভেসে আসছিল শিউলি ফুলের গন্ধ, পাড়ার ছেলেমেয়েদের কোলাহল, আর কোথাও দূরে ট্রেনের বাঁশির ক্ষীণ আওয়াজ। অরিত্রর বুকটা কেঁপে উঠল—সময় হয়ে আসছে। অথচ মুহূর্তগুলো থামিয়ে রাখার সাধ্য কারও নেই। মেঘলা ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে জলের ঢেউ স্পর্শ করল, যেন নিজের অস্থিরতা শান্ত করতে চাইছে। অরিত্রর মনে হল, সে যদি এই মুহূর্তটাকেই চিরস্থায়ী করতে পারত, তবে হয়তো কোনো বিদায় থাকত না। তার ঠোঁটে কোনো শব্দ এল না, তবু মনের গভীরে অসংখ্য অপ্রকাশিত বাক্য উথলে উঠছিল—“ফিরে এসে আবার দেখা হবে কি?”, “এই টান কি সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে?”, “নাকি এ-ই শেষ?”। মেঘলার দৃষ্টিও যেন সেই প্রশ্নগুলোই ফিরিয়ে দিচ্ছিল। দুজনেই জানত, কিছু প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে, কিন্তু সেই অপেক্ষা কতটা সহ্য করা যায়, কে জানে।
অবশেষে অরিত্র উঠে দাঁড়াল। ট্রেনের বাঁশি এবার আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্ত থেমে মেঘলার দিকে তাকাল সে। সেই দৃষ্টিতে ছিল গভীর কৃতজ্ঞতা, না বলা ভালোবাসা, আর এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। মেঘলা কোনো কথা বলল না, শুধু চোখের জল লুকোনোর চেষ্টা করল। বিদায়ের এই সকালে শব্দগুলো অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছিল—সবই তো চোখে লেখা হয়ে গেছে। অরিত্র ধীরে ধীরে পায়ে চলতে শুরু করল, মেঘলা দাঁড়িয়ে রইল পুকুরঘাটে। সূর্যের আলো ধীরে ধীরে চারপাশ আলোকিত করছিল, অথচ তাদের হৃদয়ের ভেতর ছায়া নেমে আসছিল। পেছনে ফিরে শেষবারের মতো তাকাল অরিত্র—মেঘলা তখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, নদীর ঢেউ আর সকালের বাতাসে ভিজে থাকা তার স্নিগ্ধ অবয়ব যেন এক অমোঘ প্রতিজ্ঞার মতো স্থির হয়ে রইল। সেই দৃশ্যই অরিত্রর চোখে চিরদিনের মতো গেঁথে রইল—এক বিদায়ের সকাল, যেখানে না বলা অনেক কিছুই চিরকালের মতো থেকে গেল।
দশ
অরিত্র শহরে ফিরে আসার পরও যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারল না। অফিসের কোলাহল, ব্যস্ত রাস্তাঘাট, আর শহরের চেনা মুখগুলো হঠাৎই তার কাছে অচেনা ঠেকতে লাগল। ঘড়ির কাঁটা যত দ্রুত এগোচ্ছে, ততই মনে হচ্ছিল কিছু একটা পিছনে ফেলে এসেছে, যা তাকে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে জানলার বাইরে তাকিয়ে সে যেন বারবার খুঁজে ফেরে সেই গ্রামের আকাশ, যেখানে অগণিত তারা একসাথে জ্বলজ্বল করত। শহরের আকাশে তেমন তারা দেখা যায় না, অথচ তার চোখের সামনে প্রতিটি রাতেই ভেসে ওঠে সেই বকুলগাছের ছায়া, পুকুরঘাটের ঢেউ, আর মেঘলার স্নিগ্ধ হাসি। ফোনের তালিকায় মেঘলার নাম খুঁজে পেত না সে, কারণ কোনো নম্বর আদানপ্রদানই হয়নি, অথচ মনে হচ্ছিল প্রতিদিন এক অদৃশ্য আলাপ চলছে তাদের মধ্যে—চোখের ভাষায়, নীরবতার ভেতরে। কাজের টেবিলে বসে থাকলেও মন চলে যেত সেই বাগানবাড়ির উঠোনে, যেখানে সে প্রথম মুগ্ধ হয়েছিল গ্রামীণ সরলতায়। অরিত্র বুঝতে পারছিল, শহরের চকচকে জীবন যতই চারপাশে ঘিরে থাকুক, ভেতরে ভেতরে সে আজও সেই মাটির গন্ধে ডুবে আছে।
এদিকে মেঘলাও প্রতিদিনের মতো গ্রামে নিজের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলেও মনে একটা অদ্ভুত শুন্যতা অনুভব করছিল। বিয়ের বাড়ির কোলাহল শেষ হয়ে গিয়েছে, আত্মীয়স্বজনরা ফিরে গিয়েছে, আবার আগের মতো শান্ত হয়ে গেছে গ্রাম। কিন্তু তার মনে সেই শান্তি আর নেই। প্রতিদিন বিকেলে সে বকুলগাছের নিচে এসে বসত, যেখানে শেষবারের মতো তারা কথা বলেছিল। গাছের ডাল থেকে ঝরে পড়া ফুলগুলো যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিত অরিত্রর কথা। নদীর ধারে হাঁটতে গিয়েও সে শুনতে পেত সেই স্নিগ্ধ আলাপের প্রতিধ্বনি, যেখানে সে নিজের স্বপ্ন শেয়ার করেছিল অরিত্রর সঙ্গে। এখন আর কাউকে কিছু বলতে হয় না, কিন্তু তার মন বারবার প্রশ্ন করে—সে কি আবার ফিরবে? মেঘলা জানত না সেই প্রশ্নের উত্তর, তবু প্রতিদিন বকুলগাছের ছায়ায় বসে সে অপেক্ষা করত, যেন কোনো অলৌকিকভাবে আবার হেঁটে আসবে অরিত্র, তার পাশেই বসবে, আর হয়তো বলবে—“আমি ফিরে এসেছি।”
সময়ের সাথে সাথে ঋতু বদলাল। শহরে অরিত্র ব্যস্ততার জগতে আটকে গেলেও মাঝে মাঝে ছুটির দিনে নিজের ডায়েরি খুলে বসত। সেখানে সে লিখত—“আজও বকুলফুলের গন্ধ পেলাম, অথচ জানি, সেটা কেবলই স্মৃতির গন্ধ।” সে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিলেও কোথাও না কোথাও মেঘলার মুখ মনে পড়ে যেত। তার ভেতর যেন এক দ্বন্দ্ব চলছিল—সে কি শুধু এক অস্থায়ী মোহ, নাকি সত্যিই জীবনের এক গভীর অধ্যায়? অন্যদিকে মেঘলা গ্রামের মাটিতে মিশে গিয়েও প্রতিদিনের জীবনে অরিত্রকে খুঁজে পেত। কাজের ফাঁকে তার মনে হতো, কোনো একদিন আবার হঠাৎ ট্রেন থেকে নেমে আসবে সেই শহুরে ছেলে, যে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল তার সরলতার দিকে। দু’জনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই, তবু মনে হচ্ছিল অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা রয়েছে তারা। স্মৃতির বাগানবাড়ি হয়ে উঠেছিল তাদের মিলনের একমাত্র স্থান, যেখানে বাস্তবের অভাব পূরণ হচ্ছিল স্মৃতির রঙে।
গল্পটা এখানেই এসে থেমে যায়—না বলা হাজারো প্রশ্নের ভিড়ে। অরিত্র কি আবার ফিরবে? মেঘলা কি সেই বকুলগাছের নিচে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠবে? নাকি সময়ের স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ভিন্ন ভিন্ন পথে? উত্তর নেই। হয়তো জীবন এমনই—সব গল্পের শেষ থাকে না, কিছু গল্প শেষ হয় প্রশ্নে, উত্তর নয়। অরিত্রর শহুরে জীবনের ভিড় আর মেঘলার গ্রামীণ নীরবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে সেই বাগানবাড়ি, যেখানে একদিন দু’জন অচেনা মানুষ খুঁজে পেয়েছিল একে অপরকে। সেই বাড়ি, সেই পুকুরঘাট, সেই বকুলগাছ যেন চিরকাল সাক্ষী হয়ে রইল এক অসমাপ্ত কাহিনির, যা শুধু স্মৃতির ভেতরে বেঁচে থাকবে। পাঠকও বুঝতে পারে, প্রেমের সব গল্পের সমাপ্তি হয় না মিলনে—কিছু গল্পের সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে তার অসম্পূর্ণতায়, যেমন মফস্বলের বাগানবাড়ি চিরকাল থেকে যাবে অরিত্র আর মেঘলার না বলা কথার প্রতিধ্বনিতে।
-শেষ-
				
	

	


