Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

মনের টানাপোড়েন

Spread the love

অর্পণা দাস


নিরবতার অন্তরালে

মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতায় জানালার ধারে বসে থাকা মেয়েটির নাম রায়া। বাইরের অন্ধকার যেন ঠিক ওর মনটা মতোই গাঢ়, ভারী। ঘরের ভেতরে ঝুলে থাকা ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে – সময়ও হয়তো ওর কষ্টের সামনে থেমে পড়েছে।

রায়ার বয়স মাত্র পঁচিশ, কিন্তু চোখে-মুখে যেন ত্রিশ বছরের ক্লান্তি। গত পাঁচ বছর ধরে সে একটি দাম্পত্য যন্ত্রণার মধ্যে আবদ্ধ। তার স্বামী অভিষেক, বাইরে থেকে পরিপাটি, একজন শিক্ষিত মানুষ – কিন্তু ঘরের দরজার ওপারে সে এক ভয়ানক দৈত্য।

প্রতিদিনের মানসিক নির্যাতন, ছোট ছোট কথা দিয়ে অপমান, সন্দেহ, একঘেয়েমি – এসবই হয়ে উঠেছিল রায়ার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অভিষেক কখনো গায়ে হাত তোলেনি, তাই সমাজ বলবে “ভালো ছেলে”, কিন্তু মনকে যেভাবে সে থেতলে দিয়েছিল – তার হিসেব কোনো শরীরী আঘাতে মাপা যায় না।

“তুই তো কিছুই পারিস না। তোর মতো মেয়েকে তো কেউ বিয়েই করত না। আমি না থাকলে তুই ভিখারিনী হতিস,” এই কথাগুলো রায়ার প্রতিদিনের ভাতের চেয়ে বেশি পরিচিত ছিল।

রায়ার পরিবার – মা, বাবা কেউই এসব বিশ্বাস করত না। “মেয়েরা একটু সহ্য করতে শেখে না, আজকালকার মেয়েরা তো সংসার করতে জানেই না,” – এই একটাই বুলি শুনতে শুনতে রায়া আজ আর কাঁদে না, শুধু একরাশ ঘৃণা জমে থাকে বুকের মধ্যে।

কিন্তু আজ রাতে সে অন্যরকম ভাবছে।

জানালার ওপাশে তাকিয়ে সে একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে – সে ভেঙে পড়বে না, সে পালাবে না, সে মুখোমুখি দাঁড়াবে এই ছায়ার মতো নির্যাতনকে।

শিকলের শব্দ

রায়া সেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই জানালার পর্দা সরিয়ে সূর্যের দিকে তাকাল। অদ্ভুত এক আলো যেন ভেসে এলো চোখে—যেন অনেক বছর পর সূর্যটা ওর জন্য উঠেছে। অথচ মনটা ধু ধু করছে। যেন ভেতরে কোথাও একটা নদী শুকিয়ে গেছে।

অভিষেক তখনও ঘুমোচ্ছে। তার নিঃশ্বাসের ধাক্কায় পাশের পর্দাটা হালকা কাঁপছে। সেই নিঃশ্বাসের আওয়াজটাই রায়ার কানে আজ শিকলের মতো শোনায়।

শিকল, যা বেঁধে রেখেছে তাকে এতগুলো বছর।

সে ধীরে ধীরে শাড়ি পরে, চুল বেঁধে, একটা ছোট ব্যাগে কিছু কাগজ, পুরনো ডায়েরি আর নিজের কলেজ আইডি কার্ডটা রেখে নেয়। দরজার কড়া টিপে দেখে—চাবি লাগানো নেই। গা ঘেঁষে বেরিয়ে পড়ে সে। খুবই সাধারণ একটা সকালের মতোই।

রাস্তায় বেরিয়ে হেঁটে যায় রায়া। কারওর দিকে চোখ তোলে না। যেন শহরের ভিড়ে নিজেকে ঢেকে ফেলতে চায়। হঠাৎ রাস্তার এক কোণে পরিচিত মুখ দেখে সে থমকে যায়—মল্লিকা, ওর কলেজের বান্ধবী। এখন একটি NGO-তে কাজ করে, যা নির্যাতিত নারীদের জন্য আইনি সহায়তা ও সাইকোলজিক্যাল কেয়ার দেয়।

“রায়া! তুই এখানে?”—চমকে ওঠে মল্লিকা।

রায়া জবাব দেয় না। শুধু চোখের দিকে তাকায়। সেই চোখে মল্লিকা যেন কিছুর আহ্বান দেখে।

“চল, আমার সঙ্গে,” বলে হাত ধরে মল্লিকা।

NGO-র ঘরটা শান্ত, আলো ভর্তি। দেওয়ালে লেখা আছে:

“নিজেকে ভালোবাসা প্রথম বিপ্লব।”

রায়া চুপচাপ বসে থাকে। একজন পরামর্শদাতা এসে ওর পাশে বসে, ধীরে ধীরে কথা বলে, প্রশ্ন করে। প্রথমে কিছু বলে না রায়া, মুখ নিচু করে থাকে। কিন্তু একসময়, অদ্ভুতভাবে, হঠাৎ সে ডায়েরি খুলে দেয়। সেখানে লেখা ছিল অভিষেকের প্রতিটি অপমান, প্রত্যেকটি কষ্ট—তারিখ সহ।

“আপনি তো কখনো বলেননি কাউকে। কিভাবে এই ডিটেলস লিখে রাখতেন?” — জিজ্ঞেস করেন পরামর্শদাতা।

রায়া প্রথমবার হেসে ওঠে। “কারো কাছে আমার কষ্টের গায়ে প্রমাণ চাই, তাই সময় ধরে ধরে লিখে গেছি। আমার নিঃশ্বাসের খরচা হিসেবের মতো।”

তারপর মল্লিকা তাকে দেখে। “তুই চাস কি? তালাক? কেস? না শুধুই মুক্তি?”

রায়া বলে, “আমি এখনো জানি না। শুধু এটুকু জানি—আর ফিরব না।”

এই ‘না ফেরা’ই তার প্রথম বিপ্লব।

সম্পর্কের বিষ

“তুমি কি কখনো ওর পরিবার সম্পর্কে কিছু জানো?” মল্লিকা প্রশ্নটা করে যখন রায়া চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল।

সে মাথা নাড়ে। “না। খুব বেশি কিছু নয়। অভিষেক কখনো কিছু বলেনি। শুধু এটুকু জানি, তার বাবা খুব কঠোর মানুষ ছিলেন। আর মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না।”

মল্লিকা মাথা ঝাঁকে। “অনেকসময় নির্যাতক নিজেও নির্যাতনের ফসল হয় রায়া। কিন্তু সেটা কোনোদিনই অপরাধের বৈধতা দেয় না।”

সেদিন রাতে NGO-র আশ্রয় কেন্দ্রে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে রায়ার মনে পড়ে অভিষেকের বলা একটুখানি কথা—“আমার বাবা আমার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। আমি কোনোদিন নিজের মতো কিছু করতে পারিনি।”

রায়া তখন বুঝতে পারে, তার স্বামী নিজেই একটি বিষাক্ত পরিবেশে বড় হয়েছে। সেই বিষের ছায়া নিয়েই সে তৈরি করেছে নতুন সম্পর্ক, যেখানে ভালোবাসা নেই—আছে নিয়ন্ত্রণ, সন্দেহ, অপমান।

তবু, এটা কি ক্ষমা করার মতো?

না। কারণ অভিষেক সেই বৃত্ত ভাঙার চেষ্টাও করেনি। বরং সে সেই বিষ আরেকটি জীবনে ছড়িয়ে দিয়েছে—রায়ার জীবনে।

সকালে রায়া আবার পরামর্শদাতার সঙ্গে বসে। এবার তার কণ্ঠে একধরনের দৃঢ়তা।

“আমি ওর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চাই,” বলে সে।

পরামর্শদাতা জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি মানসিক নির্যাতনের প্রমাণ দিতে পারবে?”

রায়া ব্যাগ থেকে বের করে ডায়েরিটা। “এটা কি যথেষ্ট নয়?”

তিনি পাতা উল্টে দেখেন—প্রতিটি অপমানের তারিখ, সময়, প্রসঙ্গ। কোথাও রায়া নিজেকে শূন্য বলেছে, কোথাও লিখেছে, ‘আজ আমি আর কাঁদিনি।’ কোথাও লিখেছে, ‘অভিষেক আজ হাসেনি, তবে অপমান করতে হাসি লেগেছিল।’ প্রতিটি বাক্যে বিষ ছড়িয়ে আছে, আবার এক আশ্চর্য নীরব শক্তিও।

পরামর্শদাতা বলেন, “তোমার সাহসকে আমি কুর্নিশ করি। এই ডায়েরি শুধু প্রমাণ নয়, এটা তোমার আত্মার স্বাক্ষর।”

সন্ধ্যার আগে রায়া আবার NGO-র লাইব্রেরিতে যায়। সেখানে একটা বইয়ের প্রথম লাইন চোখে পড়ে তার—

“যে সম্পর্ক দম বন্ধ করে দেয়, তা ভালোবাসা নয়—তা এক প্রলেপ মাত্র, বিষের উপর মধুর মলম।”

সে বইটা নিয়ে বসে পড়ে। যেন প্রথমবার কোনো বই তাকে তার নিজের ভাষায় কথা বলছে।

রায়া ধীরে ধীরে বোঝে—ভালোবাসা মানে চোখে জল এনে দেওয়া নয়, ভালোবাসা মানে আত্মসম্মানকে মুছে ফেলা নয়। ভালোবাসা মানে স্বাধীনতার সঙ্গে বেড়ে ওঠা।

মায়ের মুখ

রাতে শুয়ে থাকা অবস্থায় রায়ার ঘুম আসে না। NGO-র নির্জন শয্যাঘরে অন্য নারীদের নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ, কারও কর্কশ কাশির আওয়াজ, কোথাও যেন চাপা কান্নার মতো কিছু—সব মিলিয়ে এই ঘরটা ঘুমের চেয়ে স্মৃতির জায়গা বেশি।

হঠাৎ একটা দৃশ্য তার চোখে ভেসে ওঠে—সে তখন খুব ছোট, হয়তো আট বা নয় বছর বয়স। মা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, আর বাবা গলা চড়িয়ে বলছে, “তোকে না বলেছি আমার সঙ্গে তর্ক করিস না! তোকে যখন বলেছি, তখন করবি—এইটাই শেষ কথা।”

রায়া কোণের ঘর থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল মা খুব ছোট হয়ে গেছে, বাবার চিৎকারে যেন তাকে কেউ থেঁতলে দিচ্ছে। মা তখন মুখ ঢেকে বসে কাঁদছিল, আর বারবার বলছিল, “আমি কিছু ভুল করিনি, কিছু বলিনি, আমি শুধু মতামত দিয়েছিলাম…”

সেদিন থেকেই রায়ার ভেতরে জন্ম নিয়েছিল এক ভয়—ভালোবাসার সঙ্গে চিৎকার থাকতে পারে, অপমান থাকতে পারে, সম্পর্ক মানেই শ্রদ্ধাহীন সহনশীলতা।

বড় হওয়ার পর রায়া দেখেছিল, তার মা ধীরে ধীরে এক ক্লান্ত, চুপচাপ, আত্মসমর্পিত মানুষ হয়ে উঠছেন। আর রায়া নিজে নিজের মতো প্রতিজ্ঞা করেছিল—সে এমন হবে না।

কিন্তু কী অদ্ভুত!

সে নিজেই হয়ে উঠেছিল নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি।

তফাৎ শুধু এটাই—রায়া এখন বলার চেষ্টা করছে, পালানোর চেষ্টা করছে।

পরদিন সকালে মল্লিকা চা হাতে তার পাশে বসে। রায়া চোখ মুছছিল।

“আজ খুব মনে পড়ছে মায়ের মুখটা,” বলে সে।

“তুই কি কখনও মায়ের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলেছিস?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করে।

“না। কারণ মা এখনো বলে—‘ঘর করলে ঘরের মতো চলতে হয়’। মা মনে করেন স্ত্রীর কাজ সব সহ্য করা। আমি জানি না, আমি কি শুধু সেই ধারণার বিরুদ্ধে লড়ছি, না নিজেকেই ভাঙছি বারবার।”

মল্লিকা তার হাত ধরে বলে, “তুই যা করছিস, তা কোনো একজন নারীর জন্য নয়—তোর ভেতরের মেয়েটার জন্য, যার ছোটবেলায় বাবা চিৎকার করেছিল, আর মা মুখ ঢেকে কাঁদছিল। তুই তো ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছিস।”

রায়া একটু হেসে বলে, “আজ মনে হচ্ছে, মায়ের মুখটা আমি ভুলে যাচ্ছিলাম না বলে নিজের মুখটাও চিনতে পারিনি।”

পালাবার দরজা

আকাশটা মেঘলা ছিল, যেন দিনটার বুকেও চাপা কষ্ট জমে আছে। রায়া NGO-র কনফারেন্স রুমে বসে অপেক্ষা করছিল একজন আইনি পরামর্শদাতার—অ্যাডভোকেট সীমা সেনের জন্য। তার আঙুলগুলো টেবিলের ওপর ধীরে ধীরে কাঁপছিল, বুকের ভেতরে শব্দহীন ঝড়।

সীমা আসেন—একজন আত্মবিশ্বাসী, চৌকস, নির্ভীক নারী। তার চোখে মুখে ক্লান্তি নেই, বরং একরকম অদম্যতা, যা দেখে রায়ার প্রথমেই মনে হয়, “এ মানুষটা বুঝবে আমার কথা।”

সীমা চুপচাপ বসে, কিছু নোট নিয়ে, রায়ার কথা শোনেন। রায়া ডায়েরিটা এগিয়ে দেয়, কথা বলতে গিয়ে দু-তিনবার গলা কেঁপে ওঠে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে—তবু থামে না।

সব শুনে সীমা বলেন, “রায়া, মানসিক নির্যাতন এখন IPC 498A-র আওতায় বিচারযোগ্য। তোমার ডায়েরি, তারিখ অনুযায়ী নথি, এবং আমাদের সাক্ষ্য এই কেসে খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। তুমি কি এ কেস লড়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছো?”

রায়া ধীরে মাথা নাড়ে। “আমি কিছু চাই না, শুধু যেন আর কোনো রায়া এই একই অন্ধকারে না পড়ে।”

সীমা একটু থেমে বলেন, “তাহলে এবার পালাবার দরজা নয় রায়া—এটা ঢোকার দরজা। নিজেকে ফিরে পাওয়ার, অন্যদের বাঁচানোর।”

সে রাতে NGO-র ঘরে ফেরার সময় রায়া একটা ছোট চিঠি লেখে নিজের জন্য।

“প্রিয় আমি,

তুই ভুল করিসনি। তুই ভালোবাসতে চেয়েছিলি, বুঝতে চেয়েছিলি, সহ্য করেছিলি। কিন্তু এখন তুই বাঁচতে চাস—এই চাওয়াটাই সবচেয়ে সৎ, সবচেয়ে শক্তিশালী। এই পথ কঠিন হবে, কিন্তু আমি তোর পাশে থাকব। — আমি”

চিঠিটা ওর বালিশের নিচে রাখে। এখন ওর শুয়ে পড়ার আগে প্রার্থনার দরকার নেই—ওর দরকার নিজের হাত শক্ত করে ধরা।

সকালে মল্লিকা রায়াকে একটি নতুন ফোন ও সিম দেয়, যাতে অভিষেক তাকে আর খুঁজে না পায়।

সেই মুহূর্তে রায়ার মনে হয়, একটা শিকল কেটে গেছে। একটা নতুন দরজা খুলছে। সে এখনো জানে না দরজার ওপাশে ঠিক কী আছে, কিন্তু জানে—ভিতরে একটা আলো জ্বলছে। এটাই তার প্রথম মুক্তির স্বাদ।

ফিরে দেখা

দুপুরের রোদটা খুব উজ্জ্বল, তবু যেন গায়ে লাগে না। রায়া বসে আছে NGO-র ছাদে। পাশে এক কাপ কফি, আর হাতে মল্লিকার দেওয়া একটা খাতা—সাদা, ফাঁকা পৃষ্ঠা। মল্লিকা বলেছে, “লিখে ফেল যতটুকু মনে পড়ে। তুই আগে যেটা ছিলি, সেটাকেই কাগজে ফিরিয়ে আন।”

প্রথম পৃষ্ঠায় রায়া শুধু একটা লাইন লেখে—

“আমি কে ছিলাম, সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আবার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি।”

সে ভাবে—সত্যিই তো, কে ছিল সে?

একটা সময় সে কবিতা লিখত। কলেজের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল, এমনকি একটি ছোট পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়েছিল—মা সেই পত্রিকাটা লেমিনেট করে রেখেছিল।

আরও মনে পড়ে—সে নাচত। টেলিভিশনে বাংলা গানের তালে সে কী ভঙ্গিমায় হাত-পা ছুঁড়ে দিত! মা বলত, “তুই তো একেবারে ঝড়!” তখন সে হেসে বলত, “আমি ঝড় না মা, আমি আলো।”

অথচ বিয়ের পর অভিষেক একদিন বলে, “এইসব ছেলেমানুষি বাদ দে রায়া, এখন সংসার সামলাস।” সেদিন থেকে কলম নামিয়ে দিয়েছিল সে। মঞ্চের আলো ভুলে গিয়েছিল।

আজ এতদিন পরে সেই ঝড়টা আবার বুকের ভেতরে উঠছে। রায়া ভাবছে, এতগুলো বছর—সে কাদের জন্য হারিয়ে গেল? কিসের ভয়ে থেমে গেল? সন্ধ্যাবেলা NGO-র ঘরে মল্লিকা এসে তাকে একটা ফাইল দেয়।

“এই নামগুলো আমাদের সাপোর্ট গ্রুপের। এরা সবাই আগে নির্যাতনের শিকার ছিল, এখন নিজের মতো জীবন গড়ে নিয়েছে।” রায়া এক এক করে নামগুলো দেখে—প্রত্যেক নামের পাশে ছবি, ছোট বায়ো। কেউ রাঁধুনি হয়েছে, কেউ কনসালটেন্ট, কেউ টিউশনি দেয়, কেউ ছবি আঁকে।

হঠাৎ সে দেখে “সুতপা সেন—আন্তর্জাতিক NGO-তে কর্মরত, একসময় গৃহবন্দী ছিলেন তিন বছর”—সঙ্গে রয়েছে একটি রঙিন ছবি, যেখানে সুতপা একদল শিশুর সঙ্গে হাসছেন।

রায়ার মুখে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে। মল্লিকা বলে, “চোখে বিশ্বাস ফিরে আসছে বুঝি?”

সে মাথা নাড়ে। “একটু একটু করে।”

রাতে ঘুমোনোর আগে সে পুরনো সেই কবিতার খাতা খুলে আবার লেখে—

“তুই যা হারিয়েছিস

তা পেছনে ফেলে যাস না

তুই যা ফিরে পাস

তা বুকের মাঝে রাখিস

একদিন সেই আলোতেই

তোর ছায়া ছুটে আসবে—

তোকেই খুঁজে নিতে।”

সংগ্রামের প্রতিশ্রুতি

সকালটা কেমন অস্বস্তিকর ঠেকছিল। আকাশ মেঘলা, রাস্তায় ভেজা বাতাস, আর NGO-র ভেতরেও যেন একটা অজানা টেনশন। রায়া আজ প্রথমবার কোর্টে যাবে। সীমা আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, “প্রথম নোটিসটা পাঠানো মানেই যুদ্ধের শুরুর ঢাক।”

NGO থেকে যখন গাড়িতে উঠছিল রায়া, তখন তার হাতটা হালকা কাঁপছিল। মল্লিকা বলল, “চাইলে এখনো পিছিয়ে আসতে পারিস।”

রায়া তাকায়। “আমি তো এতদিন পিছিয়ে ছিলাম, এবার একটু সামনে যাই।”

আলিপুর কোর্ট চত্বরে পৌঁছে, প্রথমে অস্বস্তি হয়। অজস্র মানুষ, চিৎকার, ফাইলের ঠাসাঠাসি, স্যুটেড-আপাত-শান্ত মুখগুলো। এসবের মধ্যে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগে। সীমা এসে পাশে দাঁড়ান, তার চোখে দৃঢ়তা।

“তুমি একা নও,” বলেন তিনি।

তারা ভিতরে ঢোকেন, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা হয়—ডায়েরি, চিকিৎসার কাগজ, মানসিক অবসাদের রেফারেন্স, এবং অভিষেকের বিরুদ্ধে মানসিক অত্যাচারের বিবরণ।

সীমা বলেন, “আজ শুধু নোটিস পাঠানো হবে। এর পরের ধাপ, যদি অভিষেক মীমাংসা না চায়, তবে মামলা দায়ের।”

রায়ার মুখে তখন একটি নির্জন কঠিনতা। যেন কাঁদা আর গ্লানির ভিতর থেকে সে নিজের এক নতুন রূপে জন্ম নিচ্ছে।

বিকেলবেলা NGO-তে ফিরে, এক ঘরে চুপচাপ বসে থাকে রায়া। মল্লিকা এসে পাশে বসে।

“কেমন লাগছে?”

“যুদ্ধ শুরুর আগের মতো,” বলে রায়া। “কিন্তু যুদ্ধটা আমার শুধু অভিষেকের বিরুদ্ধে নয়, আমার ভেতরের ভয়, অপরাধবোধ আর দুর্বলতার বিরুদ্ধেও।”

“তুই জানিস?”—মল্লিকা বলে—“আজ তোকে দেখে আমার নিজের পুরনো সময়টা মনে পড়ল। তোর চেয়ে অনেক বেশি ভাঙা ছিলাম আমি। কিন্তু এখন দেখ, তোর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এই শক্তিটুকুই তুইও অন্য কাউকে একদিন দিতে পারবি।”

রায়া কিছু বলে না। শুধু একটা জিনিস ভাবে—যদি যুদ্ধই তার নিয়তি হয়, তবে সে এবার অন্তত মাথা উঁচু করে লড়বে।

রাতে রায়া ডায়েরির শেষ পাতায় লেখে—

“আজ আমি প্রথমবার নিজের হয়ে কথা বলেছি। আমার ভিতরের সেই কাঁপা মেয়েটা আজ কলম ধরেছে। যুদ্ধ শুরু, শেষ কবে হবে জানি না—কিন্তু আমি আর থামব না।”

শেষ চিঠি

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, NGO-র রিসেপশনে এসে ডাক পড়ে—“রায়া দত্ত? আপনার নামে একটি কুরিয়ার এসেছে।”

একটা সাদা খামে মোড়া প্যাকেট হাতে নিয়ে রায়া চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওপরের হস্তাক্ষরটি খুব পরিচিত—অভিষেকের। তার বুকের ভিতর যেন হঠাৎ হিমেল বাতাস বয়ে যায়।

ঘরে ফিরে ধীরে ধীরে খামটা খুলে সে। ভিতরে একটি হাতে লেখা চিঠি আর একটি ফটো—ওদের বিয়ের দিনের ছবি। রায়া থমকে যায়। সেই রঙিন হাসির ফ্রেমের পেছনে এতটা বিষ ছিল, সে বুঝতে পারেনি তখন।

চিঠির প্রথম লাইন—

“রায়া,

আমি জানতাম তুমি একদিন এমন করবেই। তুমি কখনোই সংসার করতে শেখনি। সবসময় নিজের মতো চলতে চেয়েছো। এখন যখন আমি সব হারাতে বসেছি, তুমি বীরের মতো কোর্টে গিয়ে দাঁড়াচ্ছো—এটা কি আদৌ ভালোবাসা?”

রায়ার বুক ধক করে ওঠে। চিঠির প্রতিটি লাইনেই অভিষেক তার অভিযোগকে “অতি প্রতিক্রিয়া” বলে ঠাহর করেছে। তাকে মানসিকভাবে “অস্থির, ডিপ্রেসড, অলস” বলে উল্লেখ করেছে।

শেষে লেখা—

“এই চিঠিটাই আমার শেষ চেষ্টা। যদি এখনও ফিরে আসতে চাও, সব মিটমাট হয়ে যাবে। আর না হলে, লড়াইটা শুরু হোক। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো—যুদ্ধ করলে কেউও পুরোভাবে জেতে না।”

রায়া চুপচাপ চিঠিটা পড়ছিল। চোখের কোনে জল আসছে না, বরং মনের ভেতর জ্বলছে কিছু—লজ্জা, রাগ, তাচ্ছিল্য—সব মিলিয়ে এক ধরণের জেদ।

মল্লিকা এসে দাঁড়ায় দরজায়। “চিঠি?”

রায়া মাথা নাড়ে। “হ্যাঁ, অভিষেকের লেখা। শেষবারের মতো তার নিয়ন্ত্রণ প্রয়াস।”

“কি বলেছে?”

“যদি ফিরে যাই, তবে ক্ষমা করে দেবে। আর না গেলে, যুদ্ধ।”

“তাহলে?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করে।

রায়া ফটোটা ছিঁড়ে ফেলে। চিঠিটা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলে,

“আমি ফিরে যাব না। আমি এবার সত্যিই নিজেকে ফিরিয়ে আনব।”

রাতে সে ডায়েরিতে লেখে—

“যারা শুধু ভালোবাসা চায়, তারা কখনো ভালোবাসতে পারে না। অভিষেক শুধু আমাকে পেতে চেয়েছিল, ভালোবাসেনি কখনো। আমি এবার নিজেকে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করছি। আমি হার মানব না।”

আত্মার আয়না

শনিবার বিকেল। NGO-র কমন হলরুমে গোল হয়ে বসেছে একদল নারী—বয়স, ভাষা, পোশাক, ব্যথার ধরন আলাদা, কিন্তু সবার চোখে একটাই ছাপ—কোনো এক সময় ভেঙে পড়া এবং তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর প্রত্যয়।

আজকের সাপোর্ট গ্রুপ সেশনের মূল বিষয়—“আমি কেন চুপ ছিলাম?”

রায়া একটু দূরে বসে, মল্লিকার পাশে। চারপাশে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল, এতগুলো মুখে যেন তারই প্রতিচ্ছবি।

প্রথমে কথা বলেন জেসমিন—a single mother, তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সন্তান না হওয়ায়।

“তখন মনে হতো, আমি নারী হিসেবে ব্যর্থ। এখন বুঝি, আমি কখনো ব্যর্থ ছিলাম না—ওরাই ছিল অমানবিক।”

তারপর উঠে দাঁড়ায় অনিতা—যার স্বামী দিনের পর দিন মানসিক নিপীড়ন চালিয়ে গেছে, কেবল তার চাকরি আছে বলে।

“আমার টাকাটা ওর আত্মবিশ্বাস ছিল। আর আমার চুপ থাকাটাই ওর সাহস।”

সবাই যখন নিজের গল্প বলছিল, রায়া শোনে, গায়ে কাঁটা দেয়। কেউ ধর্ষণের শিকার, কেউ নিজের বাবা বা ভাইয়ের নির্যাতনের। তবু আশ্চর্য, এই নারীরাই আজ অন্যদের হাত ধরতে পারে।

শেষে মডারেটর বলেন, “রায়া, তুমি কি কিছু বলতে চাও?”

সবার চোখ তার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলে

“আমি চুপ ছিলাম, কারণ ভয় পেতাম। কারণ ভালোবাসা মানেই মাথা নত করা বলে শিখেছিলাম। কিন্তু আজ বুঝি—ভালোবাসা মানে কখনোই নিজের অস্তিত্ব বিলীন করা নয়। আমি আজ প্রথমবার ভাবছি, আমি কিছু হারাইনি, আমি নিজেকে ফিরে পাওয়ার পথে।”

ঘরের এক প্রান্ত থেকে করতালি উঠে আসে। কেউ চোখ মুছে, কেউ মৃদু হাসে।

সেশনের শেষে মল্লিকা বলে, “তুই জানিস, এতদিন পর তোকে বলতে শুনে আমার মনে হলো—তুই জন্ম নিচ্ছিস আবার।”

রায়া চুপ করে আকাশের দিকে তাকায়। বাইরে সূর্যটা হেলে পড়েছে, কিন্তু আলোটা এখনও উজ্জ্বল।

সে ভাবে—“আমি একা নই। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরও অনেক ভাঙা মেয়ে, যারা আজ দেয়াল নয়—আলো।”

রাতে ডায়েরিতে লেখে—

“আজ অন্যদের মুখে নিজের যন্ত্রণা শুনে মনে হলো—আমরা সবাই একটাই আয়নায় তাকিয়ে আছি। সেই আয়না কেবল ব্যথা দেখায় না, শক্তিও দেখায়। আমি আর নিজেকে ছোট ভাবব না। আমি বাঁচতে চাই। জিততে চাই।

একটা নতুন সকাল

প্রথম আলোটা মৃদু হলেও স্পষ্ট ছিল। রায়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অনুভব করছিল একটা নতুন দিনের গন্ধ।

আজ তার কোর্টে প্রথম শুনানি। এই একদিনের জন্য সে দীর্ঘ মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে—নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত করে, ডায়েরির পাতায় নিজের যন্ত্রণা লেখা থেকে শুরু করে সীমার দিকনির্দেশনা।

NGO-র কর্মীরা তাকে উৎসাহ দিয়ে যায়। মল্লিকা হাত ধরে বলে, “আজ তোর দিনের শুরু। এই লড়াই শুধু তোর জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য।”

কোর্টে ঢোকার মুহূর্তটা সহজ ছিল না। মানুষের চোখ, বিচারকের দৃঢ় দৃষ্টি, আইনজীবীদের ভাষা—সব মিলিয়ে এক অজানা চাপ। কিন্তু রায়ার মনে ছিল এক গভীর শান্তি, এক অনবদ্য আত্মবিশ্বাস।

সে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য শুরু করল। তার কণ্ঠ ছিল স্থির, চোখে জ্বাল ছিল।

“আমি এই লড়াইটা শুরু করলাম শুধু আমার জন্য নয়, আমার মতো সমস্ত নারীর জন্য, যারা আর কেউ শুনতে চায় না। আমি এখানে নিজেকে মুক্ত করার জন্য এসেছি।”

তার কথা শুনে বিচারক ও উপস্থিত সবাই স্তব্ধ।

শুনানি শেষে বাইরে এসে মল্লিকা বলে,

“আজকে তুই শুধু আইনজীবীকে নয়, নিজের ভয়কে ও হারিয়েছিস।”

রায়া হেসে ওঠে, “আমার এই যাত্রা শেষ নয়। শুরু মাত্র।”

সন্ধ্যার পর NGO-র ছাদে দাঁড়িয়ে রায়া সূর্য অস্ত যাওয়া দেখছে। বাতাসে একটা স্বতন্ত্র সুর—সেই গান যা তার হারানো স্বপ্নগুলোকে জাগিয়ে তুলছে।

সে বুঝতে পারছে, তার জীবন আর আগের মতো হবে না। হয়তো রোজ নতুন যুদ্ধ থাকবে, নতুন কাঁটা আসবে, কিন্তু এবার সে প্রস্তুত।

ডায়েরির শেষ পাতায় লেখে—

“আজ থেকে আমা

র জীবন আমার। আমি আমার গল্পের নায়িকা, আমার যাত্রার নেতা। একা নই আমি, আমার সঙ্গে অনেক হাত আছে যেগুলো ধরা অপেক্ষায়। নতুন সকাল এসেছে—আমার নতুন জীবন শুরু হলো।”

Lipighor_1749411594627.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *