Bangla - কল্পবিজ্ঞান

মঙ্গলগ্রহের মেয়ে

Spread the love

প্ৰদীপ্ত মজুমদার


অর্ণব সেনের জীবনে সেই মুহূর্তটা ছিল এমন এক অভিজ্ঞতা, যা তাঁর সমস্ত শৈশবের স্বপ্ন, যুবক বয়সের ত্যাগ আর মহাকাশযাত্রার অগণিত প্রশিক্ষণকে এক অবর্ণনীয় বাস্তবতায় রূপ দিল। পৃথিবী থেকে কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে, অগণিত মানুষের চোখের বাইরে তিনি প্রথমবারের মতো মঙ্গলের মাটিতে পা রাখলেন। চারপাশে বিস্তীর্ণ লাল মরুভূমি, যার সীমা যেন দিগন্তকে ছুঁয়ে গিয়ে মিলিয়ে গেছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায়। মহাশূন্য থেকে মঙ্গলকে যতটা নিঃসাড়, নির্জীব মনে হয়েছিল, মাটিতে নেমে সেই অনুভূতি আরও গভীরভাবে আছড়ে পড়ল তাঁর ভেতরে। পাথুরে গিরিখাতের অন্ধকার গলিপথ, সূর্যের ক্ষীণ আলোয় ঝলমল করা ধূলিকণা আর নিঃশ্বাসরুদ্ধ করা স্তব্ধতা তাঁকে মুহূর্তেই বোঝাল—এ পৃথিবীর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গ্রহ, যেখানে মানুষের অস্তিত্ব অতি ক্ষুদ্র, প্রায় তুচ্ছ। তবুও সেই তুচ্ছতার মাঝেই তিনি এক অনির্বচনীয় গর্ব অনুভব করলেন—তিনি এখন সেই প্রথম অভিযাত্রীদের একজন, যারা লাল গ্রহের বুক ছুঁয়ে চলছে মানুষের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখতে।

কিন্তু এই গর্বের সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের মনে ধীরে ধীরে জন্ম নিতে লাগল এক অদ্ভুত অস্বস্তি। মিশনের প্রাথমিক জরিপ শেষে যখন তিনি একা কিছুটা দূরে এগিয়ে গেলেন, হঠাৎই বাতাসে ভেসে এল অচেনা এক স্রোত। মঙ্গলের বাতাস তো হালকা, প্রায় অকেজো, তবুও মনে হল যেন বালির ঢেউ কেঁপে উঠল তাঁর চারপাশে। এক মুহূর্তে পুরো আকাশ ঢেকে গেল ধূলিঝড়ে। ঝড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ণব যেন নিজের হৃদস্পন্দনও শুনতে পাচ্ছিলেন না। হঠাৎই তাঁর চোখে পড়ল—এক ঝলক রূপালি আলো! ঝড়ের মধ্যে আলোর এমন খেলা হওয়া সম্ভব নয়, তবু সেটা তাঁর চোখের ভ্রম ছিল না। মাটি থেকে সামান্য উপরে, যেন ধূলিকণার ভেতরে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দীপ্তি, যা মুহূর্তের জন্য তাঁকে থমকে দিল। আলোটা যেন জীবন্ত, আবার নিস্তব্ধ। তিনি চেষ্টা করলেন সেটিকে অনুসরণ করতে, কিন্তু মুহূর্তেই আলো মিলিয়ে গেল। বুকে হঠাৎ চাপা এক অস্থিরতা জমল। “এ কি শুধু আমার মনের ভুল? নাকি সত্যিই কিছু আছে?”—নিজেকে প্রশ্ন করলেন তিনি। মহাকাশচারীদের প্রশিক্ষণে সবসময় শেখানো হয়—কোনো অচেনা পরিস্থিতিতে আবেগকে দমিয়ে যুক্তি দিয়ে ভাবতে। কিন্তু সেই মুহূর্তে যুক্তি তাঁর মাথায় জায়গা পেল না, বরং গভীরে কোথাও যেন এক অজানা ভয় মিশ্রিত কৌতূহল জন্ম নিল।

ধূলিঝড় কিছুটা থামতেই অর্ণব ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন সেই দিকেই, যেখানে আলোটা মিলিয়ে গিয়েছিল। চারপাশে লালচে মরুভূমি, দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ি গিরিখাত আর নিরবতার আড়ালে চাপা রহস্য যেন তাঁকে আহ্বান করছিল। হেলমেটের ভেতরে নিজের নিশ্বাসের শব্দ তাঁর কানে আরও ভারি লাগছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল, তিনি শুধু মঙ্গলের অচেনা ভূমিতেই নয়, বরং প্রবেশ করছেন কোনো অদ্ভুত অজানার দুনিয়ায়। কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ আবার তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল—মাটির উপর ছড়িয়ে থাকা ধূলির রেখার ভেতর যেন কারও পদচিহ্ন আঁকা আছে। এগুলো মানুষের হতে পারে না, আবার পুরোপুরি প্রাণীরও নয়। অর্ণব থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। বুকের ভেতর দ্রুত কাঁপতে লাগল হৃদয়। “এখানে কি কেউ আছে? আমি কি সত্যিই একা নই?” তাঁর মস্তিষ্কে হাজারো প্রশ্ন জমা হল। যন্ত্রের সিগন্যাল এখনো স্বাভাবিক, দলের অন্য সদস্যরা কয়েকশো মিটার দূরে। কিন্তু তিনি জানেন, যে জিনিসটি তিনি দেখলেন, তা মঙ্গলগ্রহের নির্জীব ইতিহাসে লেখা নেই। এক ঝলক রূপালি আলো, অদ্ভুত পদচিহ্ন, আর নিস্তব্ধ লাল মরুভূমির বুকের মধ্যে চাপা রহস্য—সব মিলিয়ে তিনি অনুভব করলেন, আজ তাঁর জীবনে কিছু ঘটতে চলেছে, যা হয়তো বদলে দেবে মানবজাতির ভবিষ্যৎ।

অর্ণব সেন সেদিনের ঘটনাটা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। মঙ্গলের রুক্ষ ভূমিতে গবেষণা করার সময় তিনি এক অদ্ভুত যন্ত্রপাতির গোলমালে দলের বাকি সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। যোগাযোগ ব্যবস্থায় সাময়িক ত্রুটি দেখা দিল, আর লাল মরুভূমির অন্তহীন বিস্তারে তিনি একা হয়ে গেলেন। চারপাশে ঝড়ের মতো বালিকণা উড়ছিল, হেলমেটের স্বচ্ছ কাচে বারবার ধাক্কা মারছিল সেই ধুলো। দূরে মিশনের অন্য সদস্যদের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই তারা কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেল। অর্ণব চেষ্টা করলেন বেতার যোগাযোগ চালু করতে, কিন্তু শুধু ভাঙা ভাঙা শব্দ ছাড়া কিছু শোনা গেল না। এক মুহূর্তে তিনি বুঝলেন—এই বিপজ্জনক গ্রহের বুকে তিনি নিঃসঙ্গ। ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত চাপা ভয় ঢুকে পড়ছিল, তবে প্রশিক্ষিত মানসিকতা তাঁকে শান্ত থাকতে শেখাল। তিনি জানতেন, আতঙ্কে সিদ্ধান্ত নিলে তার মাশুল দিতে হবে প্রাণ দিয়ে। তাই ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ঘটল এমন কিছু, যা তাঁর সমগ্র জীবনের ভিত্তি বদলে দিল। ধুলোর আবরণ ছিঁড়ে সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত অবয়ব—মানুষের মতো, আবার পুরোপুরি মানুষ নয়।

প্রথম দেখায় অর্ণবের মনে হল, হয়তো ঝড়ের আলো-আঁধারিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, তিনি ভুল দেখছেন না। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী, বয়স হবে আঠারো থেকে বিশ বছরের মধ্যে। তার শরীরের গড়ন মানবীর মতোই, কিন্তু ত্বকে লালচে-সোনালি আভা খেলা করছে, যেন মঙ্গলের মরুভূমি থেকেই গড়ে উঠেছে সে। চুল রূপালি, আর সেটি আলো ছড়াচ্ছে বালির ঢেউয়ের মতো। চোখ দুটো সবুজাভ-নীল, যেখান থেকে বেরোচ্ছে এক অচেনা দীপ্তি। সে কোনো স্পেসস্যুট পরেনি, তবুও সহজভাবে দাঁড়িয়ে আছে মঙ্গলের বুকে, যেন গ্রহটির বাতাসই তাকে শ্বাস নিতে সাহায্য করছে। মুহূর্তে অর্ণবের গা শিরশির করে উঠল। এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি, অথচ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক জীবন্ত মেয়ে! প্রথমে ভয় আর অবিশ্বাস তাঁকে আচ্ছন্ন করল। হাতের যন্ত্রটা আঁকড়ে ধরলেন শক্ত করে, যেন কোনো বিপদের মুহূর্তে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু মেয়েটি কোনো আক্রমণাত্মক ভঙ্গি দেখাল না। বরং তার দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল অর্ণবের চোখে, যেখানে ভয়ের বদলে ছিল অদ্ভুত শান্তি। কয়েক সেকেন্ড পরেই অর্ণব টের পেলেন, তিনি শব্দে নয়, অন্য কোনো পথে কিছু অনুভব করছেন—মেয়েটি কথা বলছে, কিন্তু সেটা মস্তিষ্কের ভেতর সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে। টেলিপ্যাথি! এই অচেনা ক্ষমতার স্পর্শে তাঁর ভেতরের ভীতি ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে এল।

লিরা—হ্যাঁ, মেয়েটি নিজেই মস্তিষ্কে অর্ণবকে জানাল, তার নাম লিরা। নাম উচ্চারণ হলো না, কিন্তু মনে যেন এক সুর বাজল। অর্ণব বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেলেন। এ কেমন অদ্ভুত সত্যি? লিরা জানাল, সে এখানে বহুদিন ধরে একা। তার অস্তিত্ব কোনো সাধারণ জন্মের ফল নয়, বরং মানুষের রক্ত আর অচেনা এক ভিনগ্রহী সভ্যতার সংমিশ্রণে গঠিত। অর্ণব এই তথ্য মেনে নিতে পারছিলেন না, কিন্তু লিরার চোখের গভীরতায় তিনি এক অদ্ভুত সত্যতার ছাপ খুঁজে পেলেন। মেয়েটি ভাষায় নয়, ছবি আর অনুভূতির মাধ্যমে তাঁর মস্তিষ্কে স্মৃতি পাঠাল—অজানা কোনো পরীক্ষাগার, অর্ধেক মানুষ অর্ধেক ভিনগ্রহী রূপ, আর মঙ্গলের নির্জন প্রান্তরে ফেলে যাওয়া এক একাকী জীবন। সেই মুহূর্তে অর্ণবের মনে হলো, তিনি কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা মিশনের নিয়ম মেনে চলা পরিস্থিতির মধ্যে নেই, বরং প্রবেশ করেছেন এক ব্যক্তিগত, গভীর সম্পর্কের যাত্রায়। ভয়ের পরিবর্তে তাঁর মনে জন্ম নিল এক অদম্য কৌতূহল। লিরা যেন এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়াল তাঁর সামনে—মানুষের ইতিহাস কি এতদিন অসম্পূর্ণ ছিল? আর যদি তাই হয়, তবে এই অসম্ভব মেয়েটির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ কি কেবল কাকতালীয়, নাকি মহাবিশ্বের পরিকল্পিত ঘটনা?

অর্ণব তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাঁর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটি শুধুমাত্র এক অদ্ভুত কাকতাল নয়, বরং বহু বছরের চাপা রহস্যের বাস্তব রূপ। লিরার টেলিপ্যাথিক কথোপকথন তাঁর মস্তিষ্কে এমন সব ছবি এঁকে দিল, যা তিনি আগে কোনোদিন দেখেননি। সেই স্মৃতিচিত্রে ভেসে উঠল—একটি মহাকাশযান, যা পৃথিবী থেকে গোপনে পাঠানো হয়েছিল বহু বছর আগে, সাধারণ ইতিহাসের পাতায় যার কোনো নাম নেই। সরকারি নথি ও আন্তর্জাতিক চুক্তির বাইরে, একদল বিজ্ঞানী তখনকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক গোপন অভিযানে বেরিয়ে পড়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মঙ্গলে প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া নয়, বরং নতুন ধরনের প্রাণ সৃষ্টি করা। লিরা দেখাল, কিভাবে সেই অভিযানের বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের কঠিন পরিবেশে বাঁচতে সক্ষম এমন এক জীব তৈরি করার চেষ্টা করেছিল মানুষের ডিএনএ ও অচেনা ভিনগ্রহী জিন একত্রিত করে। অর্ণব দেখতে পেলেন পরীক্ষাগারের অন্ধকার কক্ষ, কাচের ভেতরে ভাসমান অদ্ভুত ভ্রূণ, যন্ত্রপাতির শব্দ, আর বিজ্ঞানীদের উৎকণ্ঠিত মুখ। তারপর হঠাৎ এক বিস্ফোরণ, চিৎকার আর মৃত্যুর দৃশ্য—সেই অভিযানের প্রায় সবাই প্রাণ হারিয়েছিল, কিন্তু রয়ে গিয়েছিল একটি অলৌকিক সত্তা, যাকে রেখে যাওয়া হয়েছিল মঙ্গলের বুকে, একাকিত্বে বেঁচে থাকার জন্য। সেই সত্তাই লিরা।

অর্ণবের মনে হচ্ছিল, তিনি কোনো বৈজ্ঞানিক নথি পড়ছেন না, বরং লিরার শৈশবের প্রতিটি দিন, প্রতিটি নিঃসঙ্গতা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করছেন। তিনি দেখলেন—লিরা ছোটবেলা থেকেই মঙ্গলের বুকে একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার দেহে মানুষের কোমলতা, অনুভব করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু একই সঙ্গে ভিনগ্রহীদের শক্তি—যার ফলে সে মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডলে বেঁচে থাকতে পারে, বালির ঝড়েও টিকে থাকে। সে ক্ষুধা পায়, কিন্তু অদ্ভুতভাবে আলো থেকে শক্তি শোষণ করে টিকে থাকতে শেখে। তার চোখ দুটি শুধু দেখার জন্য নয়, আবেগ ও শক্তির প্রতিফলনও করে। যখন সে একাকিত্বে কাঁদে, তখন তার চোখ থেকে ঝরে পড়ে সবুজাভ আলো, আর যখন আনন্দ পায়, তখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এক উষ্ণ দীপ্তি। অর্ণব ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, লিরা কেবল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফল নয়, বরং দুই ভিন্ন জগতের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত সেতু। মানুষের ভেতরের ভালোবাসা, ভয়, স্বপ্ন, স্মৃতি—সবকিছুই তার ভেতরে আছে, আবার সেই সঙ্গে আছে এক শক্তি, যা মানুষের সীমার বাইরে।

এই উপলব্ধি অর্ণবের ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি করল। তিনি জানেন, পৃথিবীতে যদি কেউ জানতে পারে যে মানুষের বাইরে আরেক মিশ্র প্রাণী আছে, তবে লিরা হয়ে উঠবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, লোভ আর যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু। হয়তো তাকে খাঁচায় বন্দি করে দেখা হবে “নমুনা” হিসেবে, আর পৃথিবীর ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রগুলো তাকে ব্যবহার করবে নিজেদের স্বার্থে। অথচ লিরা তো নিছক কোনো গবেষণার বিষয় নয়—সে অনুভব করতে পারে, সে ভালোবাসতে পারে, আর সে এক অসহায় শিশু থেকে বড় হয়ে ওঠা একা মেয়ে, যার বুকভরা নিঃসঙ্গতা। অর্ণব বুঝলেন, এই গ্রহে তাঁর আসা শুধু বৈজ্ঞানিক সাফল্যের জন্য নয়, বরং নিয়তির খেলা তাকে দাঁড় করিয়েছে এক নতুন সত্যের সামনে। লিরা তাঁকে দেখল এক গভীর দৃষ্টিতে—মনে হলো, তার সব ব্যথা, সব রহস্য অর্ণবের সঙ্গে ভাগ করে নিতেই যেন এতদিনের প্রতীক্ষা। অর্ণবের ভেতর কেঁপে উঠল মানুষের চিরন্তন প্রশ্ন—আমরা কি সত্যিই একা? নাকি মহাবিশ্ব আমাদের সঙ্গে কথা বলছে লিরার মতো এক অসম্ভব রক্তধারার মাধ্যমে? সেই মুহূর্তে তিনি উপলব্ধি করলেন, লিরা কোনো হুমকি নয়, বরং ভবিষ্যতের এক দরজা, যেখানে মানুষ আর ভিনগ্রহী হাত মেলাতে পারে, যদি মানুষ তার ভেতরের মানবিকতা হারিয়ে না ফেলে।

অর্ণব যখন অবশেষে অভিযানের ঘাঁটিতে ফিরে এলেন, তাঁর মুখে তখনো স্পষ্ট উত্তেজনা ও ক্লান্তির ছাপ। হেলমেট খুলেই তিনি নিশ্বাস ফেললেন, যেন অন্তরের ভেতরে জমে থাকা সব চাপ একবারে বের করে দিতে চাইছেন। বাকিরা তাঁকে ঘিরে ধরল—ড. ইশিতা মুখে উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এতক্ষণ তিনি কোথায় ছিলেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তাঁর জন্য সবাই কী ভীষণ চিন্তায় পড়েছিল। কিন্তু অর্ণব তাঁদের কৌতূহল ও উদ্বেগের মাঝেই জানালেন এমন কিছু, যা শুনে প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারল না। তিনি বললেন, মঙ্গলের লাল মরুভূমির মাঝে তিনি এক জীবন্ত সত্তার দেখা পেয়েছেন—এক মেয়ে, যার রূপ মানুষের মতো অথচ সম্পূর্ণ মানুষ নয়। ড. ইশিতা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, বৈজ্ঞানিক মন প্রথমেই সন্দেহে ভরে উঠল। এতোদিনের গবেষণায় কোথাও কোনো প্রমাণ মেলেনি যে মঙ্গলে উন্নত প্রাণের অস্তিত্ব আছে, তাহলে হঠাৎ করে একজন নভোচারীর এমন দাবি কিভাবে সত্যি হতে পারে? অর্ণব যখন উত্তেজনায় লিরার শারীরিক গঠন, রূপালি চুল, আর সবুজাভ দীপ্তিময় চোখের কথা বর্ণনা করছিলেন, তখন তাঁকে শোনাচ্ছিল যেন কোনো লোককথার চরিত্র বর্ণনা করা হচ্ছে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁরা সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত অবয়ব। ধুলোর ঝড় থেমে যাওয়ায় দৃশ্য পরিষ্কার, আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা রূপালি চুলের তরুণীকে দেখে ড. ইশিতা হতবাক হয়ে গেলেন।

প্রথম বিস্ময় কাটতেই, তাঁবুর ভেতর হঠাৎ যেন তর্কের ঝড় উঠল। অর্ণব জোর দিয়ে বলছিলেন, লিরা কোনো হুমকি নয়, বরং সে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে। ড. ইশিতা চুপচাপ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন; তিনি অনুভব করছিলেন, মেয়েটির চোখে এক অচেনা শান্তি আছে, যেন ভেতরে কোনো গোপন ব্যথা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বিজ্ঞানীর মন তখন প্রশ্নে ভরা—কিভাবে সম্ভব এমন একটি সত্তার জন্ম? কিসের সঙ্গে কিসের মিলনে সে তৈরি হলো? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যদি এ সত্যি হয়, তবে মানবজাতির ইতিহাস ও বিজ্ঞানের অজানা অধ্যায় একেবারে নতুনভাবে লিখতে হবে। কিন্তু এই সব চিন্তার মাঝেই, কমান্ডার রিচার্ড হেইস কঠোর গলায় বললেন—“আমরা এখানে গবেষণার জন্য এসেছি, লোককথা শোনার জন্য নয়। এই সত্তা হয়তো আমাদের পুরো মিশনের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে।” তাঁর কণ্ঠস্বরের মধ্যে আতঙ্কের বদলে ছিল সুনির্দিষ্ট সন্দেহ ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়। তাঁর কাছে লিরা কোনো ‘অলৌকিক আবিষ্কার’ নয়, বরং অজানা বিপদের সম্ভাবনা। তিনি যুক্তি দিলেন—এই অচেনা মেয়ে হয়তো বাইরের কোনো শত্রু সভ্যতার প্রতিনিধি, যার লক্ষ্য মানুষকে ফাঁদে ফেলা। তাঁর অভিজ্ঞতায়, যে কোনো অজানা উপাদান সবসময় বিপজ্জনক, যতক্ষণ না তা পুরোপুরি বোঝা যায়।

এই দ্বন্দ্ব দ্রুত দলে ভাঙন ধরাল। অর্ণবের চোখে লিরা এক মানবিক মুখ, এক অসহায় সত্তা, যে শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। তাঁর অনুভূতিতে মেয়েটি কারও শত্রু নয়, বরং মহাবিশ্বের এক গোপন সত্যের প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে কমান্ডার হেইস মনে করলেন, মিশনের সফলতা ও দলের নিরাপত্তার স্বার্থে লিরাকে অবিলম্বে আটক বা বহিষ্কার করা উচিত। ড. ইশিতা দ্বিধায় পড়লেন—বিজ্ঞানীর কৌতূহল তাঁকে টানছিল লিরার দিকে, তাঁর প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস যেন নতুন গবেষণার জানালা খুলে দিচ্ছিল; কিন্তু দায়িত্বশীল চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি জানতেন, নিরাপত্তার ঝুঁকি অগ্রাহ্য করা যায় না। এভাবেই তাঁবুর ভেতরে অদৃশ্য এক সীমারেখা তৈরি হলো—অর্ণব দাঁড়িয়ে রইলেন লিরার পাশে, তাঁর বিশ্বাস ও সহানুভূতির জায়গা থেকে; কমান্ডার হেইস দাঁড়ালেন কর্তব্য ও ভয় নিয়ে, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ড. ইশিতা বোঝার চেষ্টা করছিলেন কোন পথটি সত্যি। লিরা ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে কোনো প্রতিরোধের আগুন নেই, শুধু এক অদ্ভুত বেদনা। মনে হচ্ছিল, সে মানুষকে চেনে, তাদের ভয় ও সন্দেহ চেনে, কারণ সে তো নিজেই মানুষের অর্ধেক। আর সেই মুহূর্তেই অর্ণব উপলব্ধি করলেন—আসল হুমকি লিরা নয়, বরং মানুষের নিজের ভিতরের ভয় ও সন্দেহ, যা হয়তো এই অদ্ভুত মিশ্র রক্তধারার মেয়েটিকে সত্যিই বিপদের দিকে ঠেলে দেবে।

গবেষণা শুরু হওয়ার পর থেকেই পরিবেশের ভেতরে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে লাগল। প্রথমে বিষয়গুলোকে নিছক কাকতাল মনে হয়েছিল, কিন্তু ক্রমশ তাদের ঘন ঘন উপস্থিতি দলে আতঙ্কের জন্ম দিল। যন্ত্রপাতি যেগুলো এতদিন নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছিল, হঠাৎই যেন অকারণে বিকল হয়ে যেতে শুরু করল। যোগাযোগের রাডার কখনো সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ছে, কখনো আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন সব অদ্ভুত সিগনাল ধরছে, যার উৎস শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ল্যাবরেটরির শক্তিশালী স্ক্যানার লিরার দেহ পরীক্ষা করতে গিয়ে কয়েকবার শর্টসার্কিট হয়ে পড়ল, অথচ অন্য সব যন্ত্র ঠিকঠাক চলছে। প্রথমে কমান্ডার হেইস স্পষ্ট করে বললেন—এটা লিরার উপস্থিতির ফল। তাঁর মতে, মেয়েটি হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই যন্ত্রপাতির সঙ্গে অদ্ভুত তরঙ্গ সৃষ্টি করছে, যাতে তাদের কাজ ব্যাহত হয়। কিন্তু অর্ণবের মনে হলো বিষয়টা এত সরল নয়। কারণ তিনি নিজে লিরার কাছাকাছি থেকেছেন, তাঁর টেলিপ্যাথিক যোগাযোগে স্পষ্ট অনুভব করেছেন যে লিরার ভেতরে কোনো বিদ্বেষ নেই। বরং মেয়েটি নিজেও বিস্মিত হয়ে যাচ্ছিল—যেন সে বুঝতে পারছে না কেন এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। রাত নামার পর বিষয়গুলো আরও ভয়াবহ রূপ নিল। এক রাতে অর্ণব ঘাঁটির বাইরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, হঠাৎই তিনি দেখলেন লালচে মঙ্গল আকাশের বুক চিরে এক অদ্ভুত নীলাভ আলো জ্বলে উঠল, যা ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথমে মনে হলো এটি হয়তো কোনো উল্কাপাত বা অরোরার মতো প্রাকৃতিক ঘটনা, কিন্তু আলোটি যখন মঙ্গলের দিগন্ত বরাবর ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াল, তখন তাঁর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল।

এই নীলাভ আলোর উপস্থিতি কেবল অর্ণবকেই নয়, দলের অন্যদেরও অস্থির করে তুলল। গবেষণা ঘাঁটির ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ যন্ত্রের মনিটরে অচেনা প্রতিচ্ছবি ধরা পড়তে লাগল—কোনো ছায়া, যেন কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। ড. ইশিতা বারবার যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করলেন, মনে করলেন হয়তো তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের প্রভাবে যন্ত্রের বিভ্রাট ঘটছে। কিন্তু যুক্তির সীমানা ছাড়িয়ে যখন ঘটনাগুলো তাদের ঘিরে ধরল, তখন তিনি নিজেও বিভ্রান্ত হলেন। কমান্ডার হেইস একে সম্ভাব্য আক্রমণের পূর্বাভাস হিসেবে দেখলেন। তাঁর ধারণা, লিরা হয়তো একা নয়—তার সঙ্গে আরও অদৃশ্য সত্তা আছে, যারা এখন তাদের উপর নজরদারি শুরু করেছে। কিন্তু অর্ণব অনুভব করলেন অন্য কিছু। প্রতিটি ঘটনার মধ্যে তিনি যেন লিরাকে ঘিরে এক অদৃশ্য সুরক্ষা চাদর অনুভব করছিলেন। যন্ত্র বিকল হলেও দলটি কখনো ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়েনি, আকাশের আলো অজানা আতঙ্ক তৈরি করলেও তাদের আঘাত করেনি। বরং মনে হচ্ছিল, এই রহস্যময় শক্তিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সীমারেখা টেনে রেখেছে—যেন তারা সতর্ক করছে, কিন্তু ক্ষতি করছে না। অর্ণবের মনে হলো, মঙ্গলের বুকে এমন এক সভ্যতা আছে, যা এখনো মানুষের চোখে ধরা দেয়নি, অথচ তারা প্রতিটি পদক্ষেপ নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

লিরা এই সব ঘটনার সময় গভীরভাবে চুপচাপ থাকত। মাঝে মাঝে তাঁর চোখ অদ্ভুতভাবে দীপ্ত হয়ে উঠত, যেন তিনি নিজেও সেই অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করছে বা অন্তত তাদের উপস্থিতি অনুভব করছে। অর্ণব যখন তাঁকে প্রশ্ন করতেন, লিরা কেবল মাথা নেড়ে জানাতেন, সে-ও পুরোপুরি জানে না, কিন্তু অনুভব করে—তার জন্ম, তার অস্তিত্ব, আর এই অদ্ভুত শক্তিগুলো কোনো না কোনোভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। এই উপলব্ধি অর্ণবের ভেতরে এক অদ্ভুত ভীতি ও বিস্ময়ের মিশ্র আবেগ জাগাল। তিনি ভাবতে লাগলেন, যদি সত্যিই মঙ্গলের বুকে এক অদৃশ্য সভ্যতা সক্রিয় থাকে, তবে তারা এখন পর্যন্ত নিজেদের প্রকাশ করেনি কেন? তারা কি মানুষের আগমনকে হুমকি হিসেবে দেখছে, নাকি মানুষের কৌতূহল ও আগ্রাসনকে পরীক্ষা করছে? আবার যদি তারা সত্যিই লিরাকে রক্ষা করে থাকে, তবে এর মানে কি লিরা শুধু একটি পরীক্ষার ফল নয়, বরং এক সেতুবন্ধন, যাকে ঘিরে আছে এক বৃহত্তর পরিকল্পনা? রাতের নীলাভ আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলে ঘাঁটির ভেতরে ভয়ের আবহ থেকে গেল। কিন্তু অর্ণবের ভেতরে জন্ম নিল আরও গভীর প্রশ্ন—মঙ্গলের বুকে মানুষের চোখে অদেখা যে সভ্যতা বাস করছে, তারা কি শত্রু, না বন্ধু? আর এই নিঃশব্দ ছায়ার আগমন কি আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস, নাকি মহাজাগতিক সত্য প্রকাশের শুরু?

দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অর্ণব আর লিরার মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্কের সূচনা ঘটতে লাগল। শুরুতে ছিল কৌতূহল, তারপর তা ধীরে ধীরে বিস্ময়ের রূপ নিল, আর শেষে সেই বিস্ময়ের ভেতর লুকিয়ে থাকা কোমল এক আবেগ জেগে উঠল। লিরা কখনো কথায় কিছু বলে না, কিন্তু তার সবুজাভ চোখের গভীরে ছিল এক অদ্ভুত নীরব ভাষা। অর্ণব যখন তার দিকে তাকাতেন, তিনি অনুভব করতেন যেন অসংখ্য অজানা স্মৃতি আর আবেগ তাঁর অন্তরে ঢেউ তুলে যাচ্ছে। টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তারা কথা বলত, কিন্তু সেটিও ছিল অনেকটা শব্দহীন সুরের মতো—যেখানে অনুভূতিই প্রধান, যুক্তি নয়। কখনো যখন অর্ণব ক্লান্ত হয়ে যান দিনের কঠিন কাজের পর, লিরা কাছে এসে শুধু তার চোখে তাকিয়ে থাকত। সেই দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত শান্তি লুকানো ছিল, যেন মঙ্গলের লাল মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটিকে সে নিঃশব্দে বলছে—“তুমি একা নও।” এই অনুভূতি ধীরে ধীরে অর্ণবকে নাড়া দিতে শুরু করল। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি কেবল বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের বিষয় নয়; সে এক জীবন্ত আত্মা, যার ভেতরে আছে মানুষের কোমলতা আর ভিনগ্রহীর রহস্যময় শক্তি।

অন্যদিকে লিরার জন্যও এই সম্পর্ক একেবারেই নতুন ছিল। তার জীবনের অভিজ্ঞতায় ছিল নিঃসঙ্গতা, পর্যবেক্ষণ, আর লুকিয়ে থাকা। সে সবসময় জানত, সে আলাদা—না সম্পূর্ণ মানুষ, না সম্পূর্ণ ভিনগ্রহী। কিন্তু অর্ণবের উপস্থিতি তাকে প্রথমবারের মতো অনুভব করাল, আলাদা হওয়া মানেই একা হওয়া নয়। মানুষের আবেগের কোমলতা তার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। অর্ণব যখন তার দিকে হাসতেন, লিরার মনে হতো যেন মঙ্গলের কঠিন বাতাস হঠাৎ মোলায়েম হয়ে গেছে। যখন অর্ণব তার হাত স্পর্শ করতেন, তখন লিরার শরীরে অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ত, যেন তার ভেতরের ভিনগ্রহী সত্তা মানুষের স্পর্শে সাড়া দিচ্ছে। এই অনুভূতি তাকে একইসঙ্গে ভীত আর বিস্মিত করত। সে বুঝতে পারছিল, মানুষের আবেগের ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন এক শক্তি, যা কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দিয়ে মাপা যায় না। অর্ণবের কাছ থেকে সে প্রথমবার শিখল—বিশ্বাস মানে কেবল যুক্তি নয়, বিশ্বাস মানে হলো হৃদয়ের স্পন্দনের সঙ্গে মিলে যাওয়া। ধীরে ধীরে লিরার চোখে অর্ণব হয়ে উঠল এমন এক আয়না, যেখানে সে নিজের অস্তিত্বকে নতুন করে চিনতে পারছে।

এই উন্মেষের সময়ে বাইরের পৃথিবী যেন তাদের দুজনের জন্য দূরে সরে গেল। দলের ভেতরে যত সন্দেহ আর দ্বন্দ্বই থাকুক না কেন, অর্ণব আর লিরার নীরব বন্ধন ভাঙা সম্ভব হলো না। রাতের বেলা যখন ঘাঁটির সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, অর্ণব বাইরে বের হয়ে যেতেন মঙ্গলের আকাশ দেখতে। সেই নির্জন মুহূর্তে লিরা এসে দাঁড়াত তাঁর পাশে। তারা দুজনেই নীরব থাকত, কিন্তু নীরবতার ভেতরে অগণিত কথা ভেসে বেড়াত। লাল মরুভূমির ওপর ঝলমলে তারার আলোয় তাদের চোখে চোখ মিশে যেত, আর তখন মনে হতো মহাবিশ্বের সব রহস্যও যেন তাদের কাছে ধরা দিচ্ছে। অর্ণব উপলব্ধি করলেন, তিনি কেবল একজন নভোচারী নন, কেবল একজন অনুসন্ধানকারী নন; তিনি এখন এমন এক আত্মার সঙ্গী হয়ে উঠেছেন, যাকে মানুষ কিংবা বিজ্ঞান কোনোটাই পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারবে না। লিরাও ধীরে ধীরে শিখল, মানুষের আবেগ আসলে তার ভেতরের অজানা শূন্যতাকে পূর্ণ করতে পারে। সেই মুহূর্তে মনে হলো, তাদের মধ্যে কোনো ভাষা, কোনো গ্রহ, কোনো জাতি—কোনো বিভাজন নেই। আছে কেবল হৃদয়ের স্পন্দন, আর মহাবিশ্বের অনন্ত নিস্তব্ধতায় জন্ম নেওয়া এক নতুন সম্পর্কের উন্মেষ।

কমান্ডার হেইসের চোখে লিরা শুরু থেকেই ছিল এক অজানা হুমকি। প্রতিদিনের অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো—যন্ত্রপাতির বিকল হয়ে যাওয়া, আকাশে রহস্যময় আলো দেখা দেওয়া, কিংবা আশেপাশে অদৃশ্য ছায়ার ঘোরাঘুরি—সব কিছুর দায় তিনি লিরার ওপর চাপাতে শুরু করলেন। এক জরুরি বৈঠকে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা দিলেন, “আমরা আর ঝুঁকি নিতে পারি না। এই মেয়েটিকে আমরা নিয়ন্ত্রণে আনব, তাকে গবেষণার জন্য পৃথিবীতে নিয়ে যাওয়া হবে।” তাঁর কণ্ঠ ছিল কঠিন, যেন কোনো অভিযাত্রী নয়, বরং যুদ্ধক্ষেত্রের কমান্ডার কথা বলছেন। দলের বাকিদের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “আমাদের অভিযানের নিরাপত্তাই এখন প্রধান। পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক মহল এই তথ্য হাতে পেলে অভূতপূর্ব সাফল্য আসবে।” কিন্তু এই কথাগুলো শুনে অর্ণবের শরীর জ্বলে উঠল। তিনি জানতেন, পৃথিবীর ল্যাবরেটরির শীতল দেয়ালের ভেতর লিরা কেবল এক পরীক্ষার বস্তু হয়ে যাবে, তার আত্মা ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্ণবের কাছে লিরা কেবল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নয়; সে এক আত্মা, এক অস্তিত্ব, যে তার ভেতরে মানবিকতা আর অজানা শক্তির সেতুবন্ধন বহন করছে। তাই হেইসের সিদ্ধান্ত তাঁর কাছে অন্যায় বলেই মনে হলো। বৈঠকের পর তিনি চুপচাপ লিরার কাছে গেলেন। লিরার চোখে সেই মুহূর্তে এক ভীত সঙ্কেত দেখা যাচ্ছিল—যেন সে আগেই সব বুঝে ফেলেছে।

ড. ইশিতা এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে তাঁর ভেতরের কৌতূহল তাঁকে টেনে নিচ্ছিল—লিরার শরীর, তার ভিনগ্রহী জিন, আর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা মানবজাতির ইতিহাস পাল্টে দিতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে, যখন তিনি লিরার সবুজাভ চোখে তাকাতেন, সেখানে স্পষ্ট দেখতে পেতেন জীবনের স্পন্দন। লিরা নিছক কোনো পরীক্ষার ফল নয়; সে ছিল এক জীবন্ত সত্তা, যে ভয়ে, বিস্ময়ে, আর আবেগে কাঁপছিল মানুষের মতোই। ইশিতা বারবার চেষ্টা করছিলেন যুক্তি আর মানবিকতার মধ্যে সমন্বয় খুঁজে পেতে। একদিকে তিনি জানতেন, হেইসের সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করলে দল ভেঙে পড়বে; অন্যদিকে তিনি বুঝছিলেন, লিরাকে পৃথিবীতে নিয়ে যাওয়া মানেই তাকে ধ্বংস করে ফেলা। এই দ্বন্দ্ব তাঁকে ভিতরে ভিতরে ভেঙে দিচ্ছিল। তিনি অর্ণবকে থামাতে চাইছিলেন, কিন্তু তাঁর চোখে অর্ণবের দৃঢ় সংকল্প দেখে কিছু বলতে পারছিলেন না। অর্ণব স্পষ্টই বুঝে গিয়েছিলেন—হেইসের আদেশ মানা মানেই লিরার জীবন শেষ। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যাই হোক না কেন, লিরাকে রক্ষা করতে হবে। আর সেই সিদ্ধান্ত তাঁকে বিদ্রোহের পথে ঠেলে দিল।

অর্ণবের ভেতরের টানাপোড়েন শেষে এক অটল সংকল্পে রূপ নিল। এক গভীর রাতে, যখন ঘাঁটির অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে, তিনি লিরার হাত ধরে চুপিচুপি বাইরে বেরিয়ে এলেন। লিরার চোখে ভয় মিশ্রিত বিস্ময়, আর অর্ণবের চোখে জ্বলছিল দৃঢ়তা। তিনি জানতেন, এই পথে গেলে তিনি শুধু কমান্ডারের আদেশ অমান্য করছেন না, বরং সমগ্র অভিযানের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। এর মানে হতে পারে দেশদ্রোহ, ক্যারিয়ারের সমাপ্তি, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও। তবু তিনি পিছপা হলেন না। কারণ তাঁর কাছে লিরা কোনো পরীক্ষার বস্তু নয়, কোনো ‘বিষয়বস্তু’ নয়; লিরা তাঁর চোখে এক আত্মা, এক বন্ধু, হয়তো তার চেয়েও বেশি কিছু। দূরে ঘাঁটির ভেতরে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করল, বোঝা গেল কেউ তাঁদের পালানোর বিষয়টি টের পেয়েছে। অর্ণব লিরার হাত শক্ত করে ধরে দৌড় দিলেন লাল মরুভূমির ভেতর দিয়ে। তাঁদের পেছনে জেগে উঠল হেইসের নির্দেশে পরিচালিত অনুসন্ধানী যন্ত্র আর সৈনিকদের ছায়া। মঙ্গলগ্রহের কঠিন বাতাসে ধুলো উড়ে চারদিক ঢেকে গেল, আর সেই ধুলোর আড়ালেই শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়—দ্বন্দ্ব আর বিদ্রোহের। অর্ণব বুঝলেন, তিনি হয়তো নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছেন, কিন্তু এই বিদ্রোহই একমাত্র পথ, যার মাধ্যমে লিরাকে বাঁচানো সম্ভব। আর সেই মুহূর্তে তিনি প্রথমবার অনুভব করলেন, নিজের বৈজ্ঞানিক দায়িত্বের বাইরে গিয়ে একজন মানুষ হিসেবে তিনি সবচেয়ে বড় কাজটি করছেন—এক জীবন্ত আত্মাকে বাঁচানো।

মঙ্গলের লাল মরুভূমি যেন সেদিন এক যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিয়েছিল। অর্ণব লিরাকে নিয়ে যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁদের পেছনে ছুটছিল কমান্ডার হেইসের নির্দেশে পরিচালিত সশস্ত্র দল। লাল ধুলো উড়তে উড়তে আকাশ ঢেকে গিয়েছিল, বাতাসে কেবল তীব্র সাইরেনের শব্দ ভেসে আসছিল। অর্ণব জানতেন, এই সংঘর্ষের আর কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান নেই। তিনি ক্লান্ত, দিশেহারা, কিন্তু লিরার হাতের উষ্ণতা তাঁকে শক্তি দিচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটল অভাবনীয় ঘটনা—আকাশ ফুঁড়ে নেমে এল নীলাভ আলোর ঝড়। মরুভূমির চারপাশে ভেসে উঠল অদৃশ্য ছায়ারা, যাদের উপস্থিতি এতদিন শুধু অনুমান করা হয়েছিল। তারা ছিল মঙ্গলের অদৃশ্য সভ্যতার প্রতিনিধি, যাদের শক্তি মানুষ কেবল রহস্যময় আলো হিসেবে দেখেছিল। তাদের আবির্ভাব মুহূর্তেই বদলে দিল পরিস্থিতি। অস্ত্রধারীরা ভীত হয়ে পিছিয়ে গেল, যন্ত্রপাতি নিস্তেজ হয়ে পড়ল। হেইস স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন এক অদৃশ্য আদালতে তিনি অভিযুক্ত। লিরা নীরবে চোখ বন্ধ করল, আর তার শরীর থেকে নির্গত হতে লাগল এক রূপালি আভা, যা সরাসরি মিশে গেল সেই ভিনগ্রহী শক্তির সঙ্গে। অর্ণব তখন বুঝলেন—লিরা শুধুই পরীক্ষার ফল নয়, সে আসলে দুই পৃথিবীর মধ্যে এক সেতু, যাকে মুছে ফেলা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ভিনগ্রহী শক্তি যেন হেইসকে স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেল। কোনো শব্দ ব্যবহার না করেও সবাই অনুভব করল সেই মর্মস্পর্শী সত্য—লিরা হলো এক পরীক্ষার অপ্রত্যাশিত বিস্ময়, যে এখন নতুন এক ভবিষ্যতের প্রতীক। তাকে বন্দি করার চেষ্টা মানেই দুই গ্রহের মধ্যে সম্ভাব্য বন্ধন ভেঙে দেওয়া। হেইসের চোখে দেখা গেল ভয়ের ছায়া, আবার অনিচ্ছুক স্বীকারোক্তিও। তিনি জানতেন, আর কোনো যুক্তি দিয়ে এই শক্তিকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ড. ইশিতা এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন অর্ণবের পাশে, তাঁর চোখে জল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “আমরা বিজ্ঞানের নামে এতদিন অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছি, কিন্তু আজ বুঝলাম, বিজ্ঞানেরও সীমা আছে।” অর্ণব লিরার দিকে তাকিয়ে এক গভীর স্বস্তি অনুভব করলেন। লিরা তখন তাঁর চোখ মেলে তাকালেন, সেই সবুজাভ চোখে ভেসে উঠেছিল রূপালি আলো, যেন ভেতরে মহাবিশ্বের সমস্ত রহস্য জমা হয়ে আছে। টেলিপ্যাথির মাধ্যমে সে অর্ণবকে বলল, “তুমি আমাকে শুধু রক্ষা করোনি, তুমি আমাকে আমার সত্য পরিচয় চিনতে শিখিয়েছো। হয়তো আমাদের পথ একসঙ্গে হবে না, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক থাকবে, একদিন দুই গ্রহকে যুক্ত করবে।” অর্ণবের বুক ভারী হয়ে উঠল, কিন্তু তাঁর মনে হলো এটাই হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন—এক অদৃশ্য সেতুর জন্ম।

কিছুদিন পর মহাকাশযান পৃথিবীতে ফেরার জন্য প্রস্তুত হলো। অর্ণবকে ফিরতেই হবে, এটাই তাঁর দায়িত্ব। তিনি জানতেন, মঙ্গলের বুকে রেখে যাচ্ছেন এমন এক সম্পর্ক, যা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। যাত্রার শেষ মুহূর্তে তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে তাকালেন লাল মরুভূমির দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল লিরা, লাল আকাশের নিচে, তার রূপালি চুল বাতাসে ভেসে উঠছিল, আর চোখে জ্বলছিল সেই রহস্যময় আলো। সে আর কিছু বলল না, শুধু চেয়ে রইল অর্ণবের দিকে—এক নীরব প্রতিশ্রুতি নিয়ে। মহাকাশযানের দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্ণব অনুভব করলেন, তাঁর বুকের ভেতরে চিরস্থায়ী এক শূন্যতা জন্ম নিল, কিন্তু সেই শূন্যতার ভেতরই আছে আশা—একদিন পৃথিবী আর মঙ্গল, মানুষ আর ভিনগ্রহী, দুটো জগৎ হয়তো এক সেতুতে যুক্ত হবে। যখন মহাকাশযান ধীরে ধীরে মঙ্গলের কক্ষপথ ছাড়ল, অর্ণব জানালার কাঁচে চোখ রাখলেন। দূরে ছোট হয়ে আসা মরুভূমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লিরার রূপালি আভা তখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, যেন লাল আকাশের নিচে সে শুধু অর্ণবকেই নয়, পুরো মানবজাতিকেই এক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে—ভবিষ্যতের, সংযোগের, আর অনন্ত আশার প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতি নিয়েই শেষ হলো এই অদ্ভুত অভিযানের গল্প, যা ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

___

1000059324.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *